Getting your Trinity Audio player ready...
|
– “কিরে, কী খবর? কেমন আছিস?” সেদিন বিকেলে সুজয় এসে হাজির।
বললাম, “ধুর! কেমন আর থাকবো।”
– “কেন, তোর ইন্টারভিউটা কী হলো?”
– “বাতিল, রিজেক্টেড। ছাড়, এই জন্মে আর আমার চাকরি হবে না।”
সুজয় খানিকটা চুপ থেকে বললো, “হুম।” এর বেশি আর ও কী-ই বা বলবে।
সুজয় আমার ছোটবেলার বন্ধু, আমাকে ভালো করেই চেনে। সারাজীবন ছবি আঁকার পেছনে দৌড়ে বেড়ালাম। সুজয় ছাড়াও অনেকেই বুঝিয়েছিলো যে এসব করে আজকাল কিছু হয় না ভাই, অন্য কিছু কর। আমি শুনিনি। আসলে ছবি আঁকতে খুব ভালো লাগতো, একটা নেশার মতো দাঁড়িয়ে গেছিলো। ছবি আঁকাতেই মনের বহিঃপ্রকাশ হয়, বাস্তবের সাথে কল্পনার রঙ মিশে তৈরি হয় চিত্রকলা। তাই ভেবেছিলাম যে এটা দিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু ভাবনা আর বাস্তবের ব্যবধান অনেকটাই।
সুজয় চালাক-চতুর ছেলে, বাবার ব্যবসা সামলে নিয়েছে। স্বচ্ছল অবস্থা, বিয়ে করে বউ বাচ্চা নিয়ে থাকে।
আর আমি, ঘরে টিউশনি পড়াই, সেটাও ছবি আঁকারই। সপ্তাহে তিন দিন শিখিয়ে মাথাপিছু মাসে একশ টাকা। দশ বারোজন মত শেখে। নিজের খরচ বাদ দিয়ে মাসের শেষে যেটুকু অর্থ বাঁচে তা দিয়ে বিয়ে করার দুঃসাহসটা করে উঠতে পারিনি।
অনেক জায়গায় চাকরির খোঁজ করেছি। কিন্তু সবেতেই ব্যর্থ। সব জায়গাতেই বলে আজকাল ডিজিটাল পেন্টিং-এর যুগ, আপনার মতো হাতে ছবি আর কয়জন আঁকে। ডিজিটাল পেন্টিং-এর মতো আধুনিক জিনিস আমার জানা নেই, কাগজ-পেন্সিল-তুলি এসব নিয়েই আঁকতে আমি অভ্যস্ত। তাই, সব অফিস থেকেই প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে, স্কুলে ছবি আঁকার শিক্ষকের কোনো পোস্টও খালি নেই।
সুজয় পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে জ্বালালো, বললো, “মনে হচ্ছে তোর গ্রহ দশা ঠিক নেই।”
– “মানে!”
– “মানে আবার কি, গ্রহের দোষ কাটাতে হবে। চল, কাল তোকে আমার চেনা এক জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে যাবো।”
– “না, আমি যাব না।”
– “আরে চলই না, সে কি তোকে খেয়ে ফেলবে? একবার জেনে তো আসি, কী হচ্ছে তোর সাথে এসব।”
সুজয় নাছোড়বান্দা। যাওয়ার সময় বলে গেলো, “কাল বিকালে রেডি থাকবি, আমি এসে তোকে নিয়ে যাবো।”
পরদিন বিকেল পাঁচটার দিকে সুজয়ের সাথে গেলাম তার চেনা সেই জ্যোতিষীর বাড়ি। সিনেমা সিরিয়ালে দেখে জ্যোতিষী সম্পর্কে যে ধারণা আমার হয়েছিলো, এনাকে দেখে সেটা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হলো। যজ্ঞের আগুন, কঙ্কালের খুলি, কপালে মোটা সিঁদুরের টিপ, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা – এসব কিছুই নেই। একদম আমার সুজয়ের মতো একটি সাদামাটা পোশাকে মধ্যবয়সী এক যুবক।
সুজয়কে দেখে হাসলো, “কী খবর সুজয়দা!”
সুজয় আমার পরিচয় করিয়ে দিলো। বললো, “এই আমার বন্ধু, খুব সমস্যায় আছে। দেখ না, কিছু করতে পারিস কিনা।”
আমার মুখ থেকে সবটাই শুনলো। কয়েকবার “হুম” “হুম” করে মাথা ঝাঁকালো। তারপর আমার হাতদু’টো টেনে নিয়ে দেখা শুরু করলো।
অনেকক্ষণ ধরে আমার হাতদুটো উল্টেপাল্টে দেখলো, বললো, “না, সেরকম কোনো সমস্যা নেই, তবে…
– “তবে কী?”
– “না, আপনার ভালো সময় আসতে চলেছে, সামনে প্রাপ্তিযোগও দেখতে পাচ্ছি। আপনাকে একটা তামার আংটি দেবো সেটা বাম হাতের অনামিকাতে পড়বেন।”
– “আপনি কি কিছু লুকিয়ে যাচ্ছেন?” আমাকে বলতেই হলো।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে উনি বললেন, “হ্যাঁ, একটা ব্যাপার হলো, ইয়ে মানে, বহুযুগ আগে পুরানে ‘কালমুণ্ডি’ নামে এক শয়তানের কথা উল্লেখ ছিলো। বীভৎস, ভয়ানক ও পাশবিক, হিংস্র। সেই পৌরাণিক যুগের হলেও সে এখনো মাঝে মাঝে ফিরে আসে সবকিছু ধ্বংস করে ফেলার উদ্দেশ্যে। পৃথিবীর সব জায়গাতেই সে ঘুরে বেড়াতে পারে বিভিন্ন রূপে। উপযুক্ত স্থান-কাল-পাত্র পেলে সে ক্ষতি করবেই। আপনার … মানে আপনি তার সম্মুখীন হতে পারেন,” জ্যোতিষী একটু থামলেন।
এ কি আপদ রে বাবা। আমার এই মনুষ্য জীবনই কি কম কষ্টের ছিল? তার ওপর এক শয়তানের পাল্লায়। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো, গাঁজাখুরি গল্প দিচ্ছেন না তো। দেখতে আলাদা হলেও স্বভাবে হয়তো সবাই এক। ওই মানুষকে খুব ভয় দেখিয়ে টাকা হাতানোর চেষ্টা।
আমি বসে বসে এসব ভাবছি। আমরা তিনজনেই চুপ। খানিকক্ষণ পর জ্যোতিষী উঠে ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন ফ্রেম বাঁধানো একটা ফটো নিয়ে। দেখালেন আমাদের। চাপা গলায় বললেন, “কালমুণ্ডি।”
সুজয় আঁতকে উঠলো। ছবিটা দেখে আমিও খানিকটা ভয় পেয়ে গেছিলাম। মুখটা কঙ্কালের, অনেকটা পশুর মতো, মাথায় শিং বেরিয়েছে একজোড়া, চোখ দু’টো কোটরে জ্বলছে আর বড় ধারালো দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না ছবিটার দিকে।
– “এই তামার আংটিটা পরে থাকবেন,” বলে জ্যোতিষীর ড্রয়ার থেকে একটা আংটি বার করে আমার হাতে দিলেন।
ফিরে এলাম নিজের বাড়ি। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে আজগুবি লাগছিলো। কিন্তু যখন কোনো উপায়ও নেই তখন ভাবলাম পরেই দেখা যাক কী হয়।
* * *
দু’মাস কাটলো। ভালো বলতে ক্লাসে আরো কিছু স্টুডেন্ট বেড়েছে। অভিভাবকদের সাথে কথা বলে আমার ফিসটা দু’শ টাকা করে নিলাম। তারা খুব একটা আপত্তি করেননি। তাতেও ওই মাসে পাঁচ হাজার।
অভ্যাস না থাকলে আংটি পরাটা খুবই অস্বস্তিকর। সবসময় মনে হয় আঙ্গুলে কি একটা আটকে আছে আর জায়গাটাতে একটা দাগ হয়ে গেছে। ধুসস্ আর পারছিলাম না, খুলেই ফেললাম একদিন।
আরও এক মাস কাটলো। কই! কেউ তো এলো না! কি একটা শয়তানের নাম বলছিলো। বেকার বুজরুকি। এই অবস্থাতেই আমায় থাকতে হবে এটা মানিয়ে নিচ্ছিলাম। আস্তে আস্তে জ্যোতিষী, তামার আংটি, কালমুণ্ডি না কি একটা – সব ভুলে গেলাম।
একদিন সকালে সুজয় এসে হাজির। “কি রে, কেমন চলছে সব?”
আমি বেজার মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি দেখে বললো, “শোন একটা ভালো খবর আছে।”
– “রাখ তো, আমার আবার ভালো খবর।”
– “না রে সিরিয়াসলি বলছি। একটা ছেলেকে আঁকা শেখাতে হবে। তবে বাড়ি গিয়ে। আমাদের পাশের পাড়াতেই বাড়ি। সপ্তাহে দু’দিন, মাসে দু’হাজার। বল রাজি আছিস?”
অফারটা তো মন্দ না। সুজয় সাথে গেলাম ওই বাড়িতে।
মিসেস নন্দিনী সেন আর তার ছেলে রিজু সেন। উনার হাজবেন্ড দু’বছর আগে মারা গেছেন, তারপর থেকে ছেলেকে নিজেই মানুষ করছেন। মিসেস সেনের বয়স আন্দাজ সাতাশ-আঠাশ হবে। উনি কলেজের আর্কিওলজি বিভাগে পার্টটাইম লেকচারার হিসেবে কাজ করেন। উনার হাজবেন্ড ওই কলেজেরই হিস্ট্রি বিভাগের প্রফেসর ছিলেন। রিজু পড়ে ক্লাস ফোরে।
– “নমস্কার, আসুন আসুন, বসুন,” বেশ হাসিখুশি মেজাজের মহিলা।
সুজয় আমার পরিচয় করালো। “আপনি ছেলের জন্য ড্রয়িং টিচার খুঁজছিলেন। এ আমার বন্ধু, আঁকার হাত ফার্স্ট ক্লাস। ও বাড়িতে এসে ড্রইং শিখিয়ে যাবে।”
– “হ্যাঁ, একটু দেখুননা কোনো ভালো ড্রয়িং টিচারই পাচ্ছি না। আমার হাতেও একদম সময় নেই। আমার বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির সবাই ড্রয়িং জানে। আমার ছেলেটা ঠিক করে শিখতে পারছে না। ওকে একটু সময় দিলেই খুব ভালো করে পারবে, দেখবেন।”
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। সুজয় হঠাৎ বলে উঠলো, “ওসব নিয়ে আপনার টেনশন নেই, ও কাল থেকেই শুরু করে দেবে।” তারপর আমার দিকে ঘুরে বললো, “কি ঠিক তো?”
আমি ছোট করে শুধু “হ্যাঁ” বললাম।”
ফেরার সময় সুজয় বলছিলো, “তোর সবেতেই কিন্তু কিন্তু! এরকম অফার তোকে আর কে দেবে বলতো!” আমি আর কিছু বলিনি।
পরের দিন বিকেলে গেলাম মিসেস সেনের বাড়ি। উনি তখনও কলেজ থেকে ফেরেননি। রিজুকে নিয়ে বসলাম ছবি আঁকাতে। প্রথম দিন, তাই আমিই একটি পাখির ছবি আঁকলাম, বললাম, “এটাকে রঙ করো দেখি।”
রিজু একটু কম কথাই বলে। আজ প্রথম সাক্ষাৎ, হয়তো সেইজন্য। আমার দেওয়া কাগজটা হাতে নিয়ে রং করতে লাগলো। মিনিট পনেরো পর আমাকে দেখালো তার রং করা ছবিটা।
পুরো পাখিটাকে কালো রঙ করেছে আর চোখগুলোকে লাল। দেখে একটু অদ্ভুতই লাগলো। সামনে বিভিন্ন রঙের মোম পেন্সিল পড়ে আছে, তার মধ্যে ওই দুটো রঙ -ই বেছে নিলো! আমার এই পদ্ধতিটা পুরোনো। শুরুতে আমি এরকম ভাবেই সবাইকে আঁকা শেখাই। কিন্তু কোনোদিন কেউ এই লাল কালো রং করেনি পাখিকে।
– “তোমার স্কুলে আঁকা শেখায়?” জিজ্ঞেস করলাম ওকে।
– “হ্যাঁ,” খুবই সংক্ষিপ্ত জবাব।
আবার জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা তোমার প্রিয় রঙ কি?”
– “কালো,” চোখগুলো কিরকম বড়ো বড়ো করে বললো।
বুঝলাম, এই কারণেই মিসেস সেন আমাকে বারবার রিকোয়েস্ট করছিলেন ওকে একটু ভালো করে আঁকা শেখানোর জন্য। এই বয়সে ছেলে মেয়েদের মন কতো রঙিন হয়, হলুদ-সবুজ-লাল-নীল কিনা কি রঙ করে ফেলে, আর কালোটাই ওর ভালো লাগে!
প্রথম দিন আর বেশি কিছু নিয়ে বসলাম না। মিসেস সেনও চলে এসেছেন। তাকে আঁকাটা দেখাতে তিনি খুব খুশী হয়ে রিজুর গাল দু’টো টেনে বললেন, “ওমা! কি সুন্দর এঁকেছে দেখো!”
আমি একটু হাসলাম। চায়ের আপ্যায়নে বিশেষ সাড়া না দিয়ে সেদিনের মতো বাড়িতে ফিরে এলাম।
এরপর শনিবার আবার বসলাম রিজুকে নিয়ে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কোন ফল খেতে সবচেয়ে ভালো লাগে?”
– “আম।”
– “আচ্ছা, আঁকো তো দেখি একটা আম।”
ততক্ষণ মোবাইলে আমি জব ভ্যাকেন্সির অ্যাডগুলো দেখছিলাম। এই দশ পনেরো মিনিটের মধ্যেই আম এঁকে রঙ করে আমাকে দেখালো। কাগজটা নিয়ে আমি বেশ কিছুক্ষণ হাঁ করে ওর দিকে চেয়ে রইলাম।
একটা আম এঁকেছে, কালো, তার আবার অর্ধেকটা খাওয়া, ওই জায়গাটায় লাল রঙ করেছে, মনে হচ্ছে রক্ত ঝরে পড়ছে।
ছবি আঁকতে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় সেটা কল্পনা শক্তি। সামনে সেই জিনিসটা না থাকলেও কল্পনা দিয়ে জিনিসটাকে হুবহু ফুটিয়ে তোলা যায়। এই ছেলে এরকম আম কল্পনা করলো কী করে! ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “এরকম আম দেখেছো কোনোদিন?”
– “হ্যাঁ।”
– “তাই! কে এনে দেয় তোমায় এরকম আম?”
– “মা।”
মিসেস সেন ফিরলে ওনাকে আঁকাটা দেখালাম, বললাম, “রিজু বললো আপনি নাকি ওকে এরকম আম এনে দেন!” শুনে মিসেস সেন অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন, “কী বলি বলুন তো!” আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছিলাম রিজুর এই বদমাইশির কারণেই কোনো টিচার ওর সাথে টিকতে পারেনি।
বাড়িতে ফিরে এলাম, রিজুকে নিয়ে অন্য ভাবে ভাবতে হবে। আমিও হাল ছাড়বার পাত্র নই। আবার পরের মঙ্গলবার যাবো। ঠিক করলাম, রিজুকে শুধু পেন্সিলে স্কেচ করাবো, রঙ-এর ব্যাপারটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে।
* * *
মঙ্গলবার। আকাশের অবস্থা সকাল থেকেই খারাপ, একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে বাজ পড়ার বিকট আওয়াজ। বিকেলে বৃষ্টিটা একটু ধরেছিল। আকাশ তবু ঘোলাটে। একটা ছাতা নিয়ে বের হলাম রিজুদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
মিসেস সেন কলেজ যাননি, বাড়িতেই ছিলেন। আমি বসলাম রিজুকে নিয়ে। রিজুকে বললাম, “একটা কুকুরের ছবি আঁকো দেখি, রঙ করতে হবেনা, শুধু পেন্সিলে আঁকলেই হবে।”
মিসেস সেন গরম চা দিয়ে গেছেন। চায়ে চুমুক দিতে দিতে রিজুর দিকে লক্ষ করছিলাম, একমনে এঁকে চলেছে, অন্য বাচ্চাদের মত একটুও অন্যমনস্ক না। এটা হয়তো একটা ভালো গুণ।
আঁকা শেষ করে আমাকে দেখালো। ছবিটা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। বয়সের তুলনায় এঁকেছে ভালোই। তবে এরকম আমি আগে দেখিনি। কোনো হিংস্র কুকুর কোনো শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে এরকম একটি ছবি।
রিজুর দিকে তাকালাম নিষ্পলক চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে, যেন কিছুই হয়নি। এটা কি স্রেফ বদমাইশি নাকি ও সারাক্ষণ মনের মধ্যে এই হিংস্র, কালো ও রক্তাক্ত জিনিসগুলোই ভাবে!
আজ মিসেস সেনকে ডেকে জিনিসটা বললাম। উনি খুব সাধারণভাবে বললেন, “এটাই সমস্যা, জানেন, কেউ মানতেই পারছে না।”
মিসেস সেন পাশের ঘর থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ নিয়ে এসে আমায় দিলেন, বললেন, “এই দেখুন গত মাসে ওর বাবার ফটো দেখে এটা এঁকেছিল।”
বললাম, “আপনার হাজবেন্ড কীভাবে মারা গেলেন? কী হয়েছিল?”
মহিলা চুপ করে রইলেন।
– “ওহ্, আই এম সরি!”
কাগজটা খুলেই থ হয়ে গেলাম। আঁকা ছবিটা কালমুণ্ডির, হুবহু এক, যা জ্যোতিষী দেখিয়েছিলেন। রিজু এই ফটোটা দেখলো কোথায়! নিজের কল্পনায় আনলো কীভাবে! তাও নিজের বাবাকে দেখে!
হঠাৎই কারেন্ট চলে গেলো। রিজু চিৎকার করে উঠলো। কানফাটানো সে চিৎকার, সেটা মানুষের আওয়াজ না। এক ঝলক বিদ্যুতের আলোয় যা দেখলাম তাতে আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।
রিজুর চোখ দু’টো ঘোলাটে, ওই কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে। দাঁতগুলো অনেক বড়ো বড়ো আর ধারালো। শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে একটা চতুষ্পদের আকার ধারণ করেছে। প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়লো নিমেষেই। অন্ধকার হাতড়ে আমি ওই বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলাম। মিসেস সেন ডাকছিলেন, “কিছু হয়নি, আপনি দাঁড়ান।” একদম কর্ণপাত করিনি।
ছুটে ছুটে হাঁপিয়ে গেছি। একটু সম্বিত ফিরে পেলাম। সোজা গেলাম সুজয়ের বাড়ি। দরজা খুলে সুজয় অবাক, “পুরো ভিজে গেছিস্ যে! হাঁপাচ্ছিস কেন! কী হয়েছে?”
– “বলছি,” ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম।
হাফ বোতল জল শেষ করে সুজয়কে পুরো ঘটনাটা বললাম। “কী বলছিস!” সুজয় আকাশ থেকে পড়লো। বুঝলাম ও আমার থেকেও বেশি ভয় পেয়েছে।
সেই রাতেই গেলাম জ্যোতিষীর বাড়ি। উনি একটা তন্ত্রবিদ্যার বই আর কতগুলো তামার পাতের লাল সুতো বেঁধে আমাদের সাথে পৌঁছোলেন সেই বাড়িতে। মিসেস সেন দরজাতেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা ঘরে ঢুকলাম, রিজু সেই চতুষ্পদের ভঙ্গিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে আর মাঝে মাঝে পাশবিক গর্জন করছে।
মিসেস সেন কাঁদতে কাঁদতে আমাদের হাতে পায়ে ধরছিলেন, “আমার একমাত্র ছেলে, ওকে আপনারা ছেড়ে দিন। ও কোনো ক্ষতি করেনি আপনাদের।”
জ্যোতিষী মিসেস সেনকে পাশের ঘরে আটকে রাখলেন। একটা বড় মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘরের মাঝখানে রাখা হলো। এরপর আমি আর সুজয় রিজুকে ধরলাম, জ্যোতিষী পিছমোড়া করে দড়ি দিয়ে বেধে ফেললেন ওকে। সুজয়ের হাতে কামড় বসিয়েছে রিজু, রক্ত বেরোচ্ছে। একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে হাতটাকে বেঁধে নিলো সুজয়। কারেন্ট তখনো আসেনি।
লাল সুতো বাঁধা তামার পাতগুলো ওর মাথায় হাতে কোমরে আর পায়ে বেঁধে দিলেন জ্যোতিষী। রিজু পাশবিক চিৎকার করছে। ওর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ও আর মানুষ নেই, পরিণত হয়েছে এক জন্তুতে।
পাশের ঘর থেকে মিসেস সেনের চিৎকার শোনা যাচ্ছিলো। কিন্তু আমরা এক শয়তান বধের যজ্ঞে সামিল হয়েছি, ওদিকে কর্ণপাত করছিলাম না। রিজুকে মেঝেতে শুইয়ে জ্যোতিষী তন্ত্রবিদ্যার বই থেকে মন্ত্র আওড়াতে শুরু করলেন। প্রচণ্ড ছটপট করছে রিজু। আমার একটু খারাপও লাগছিলো। কিন্তু ও তো মানুষ নয়, হয়তো কোনোদিনই মানুষ ছিল না।
দেখলাম, তামার পাতগুলো লাল হয়ে উঠেছে, ধোঁয়া বেরোচ্ছে। রিজুর পরিত্রাহি চিৎকারে কানে আঙ্গুল দিয়ে বসে আছি আমি আর সুজয়। জ্যোতিষী মন্ত্র পড়ার বেগ বাড়ালেন। খানিক বাদে দেখলাম কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ায় ঘরটা ভরে গেছে। রিজু বেশ নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। হঠাৎ একরাশ কালো ধোঁয়া জানালা দিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল। মোমবাতিটা নিভে গেছে। আবার ধরানোর পর দেখলাম ঘরে রিজু নেই, তামার পাতগুলো পড়ে আছে শুধু। জ্যোতিষী অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন মেঝেতে। অনেকক্ষণ মুখে জল ছেটানোর পর চোখ মেললেন। আমরা নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এতক্ষণ কী দেখলাম!
সুজয় মিসেস সেনকে পাশের ঘর থেকে নিয়ে এলো। উনি আর কাঁদছেন না, কথাও বলছেন না। মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লেন। জ্যোতিষী অনেক সান্ত্বনা দিলেন, বললেন কালমুণ্ডির কথা। কালমুণ্ডির অভিশাপে জন্ম নিয়েছিলো রিজু, ও মানুষ ছিলো না, শয়তান ছিলো।
মিসেস সেন বুঝছিলেন কিনা জানিনা। উনার উপর বেশ মায়া হচ্ছিলো। জ্যোতিষী বললেন, “এখন আপনি বিপন্মুক্ত।”
অনেক রাত হয়ে গেছে, ইচ্ছে না থাকলেও মিসেস সেনকে একা ফেলেই বাড়ি ফিরতে হলো। সুজয় নিজের বাড়ি ও জ্যোতিষী নিজের স্থানে ফিরে গেলেন।
পরদিন মিসেস সেনের বাড়িতে গেলাম। একটা মানবিক বোধ তৈরি হয়েছিলো। ওনাকে দেখতে পাগলের মতো লাগছে, হয়তো সারারাত ঘুমাননি। আমি ডাকলাম, মিসেস সেন।
উনি কাঁদতে কাঁদতে আমায় জড়িয়ে ধরলেন। কিছুটা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। বেশ খানিকক্ষণ পর মিসেস সেন থামলেন, “ভগবান আমার স্বামীকে নিয়ে নিলো, এখন আমার একমাত্র ছেলেকেও। আমি আর বেঁচে থেকে কী করবো! সব আমার দোষ, সব।”
– “না, না এরকম বলবেন না। যা হয়েছে খারাপই হয়েছে, কিন্তু নিজেকে দোষ আর শাস্তি দেবেন না। আপনার যা প্রয়োজন আমায় বলবেন, সাধ্যমত পাশে থাকবো।” অনেক বুঝিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
* * *
দু’বছর পর। মিসেস সেনের এক মেয়ে হয়েছে। দাঁড়ান, ব্যাপারটা পরিষ্কার করি। কাউকে খারাপ ভাবার কারণ নেই। মিসেস সেন এখন আমার নন্দিনী, আর মেয়েটা আমাদেরই।
এক বছর হল আমরা বিবাহিত। সেদিনের পর থেকে মিসেস সেন, ইয়ে…মানে নন্দিনীকে একা ছাড়তে মন চায় নি। একজন স্বামী-সন্তান হারা মহিলার জন্য মনটা খারাপ হয়ে থাকতো। মনে হতো, আমিই যেন নন্দিনীর জীবনে বিপদ ডেকে এনেছি, আর এই অনুতাপ আমাকে রোজ তাড়া করে বেড়াতো। টিউশনের ফাঁকে মাঝে মাঝে নন্দিনীর কাছে যেতাম, আমার ভালো লাগতো ওর পাশে দাঁড়াতে। এক-দু’মাসের মধ্যে বুঝতে পারছিলাম নন্দিনীও আমার মধ্যে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। ওর স্বামী অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে, এটা আমায় বলেছে। খুব ভালোবাসতো। সেসব নিয়ে আমার আপত্তি ছিলো না। আমরা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছি। বাড়িতে নন্দিনীর কথা মানাতে একটু কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে ঠিকই, শেষমেশ মেনে নেয়।
সুজয় তো শুনে অবাক “সে কী রে!” হেসে হেসে বলছিলো, “যাক, এবার দেখবি টিউশনিটাই ভালো লাগবে। আগে উদ্দেশ্যহীনভাবে ছুটছিলি এবার না হয় সংসারের জন্য মন দে।”
যাই হোক, মেয়ে হয়েছে শুনে বাড়ির সকলেই উৎফুল্ল, আমি তো বটেই। মেয়ের নাম ঠিক করা হলো, ঈষা। ঈষাকে নিয়ে নন্দিনী খুব খুশি, পুরোনো দিনগুলো ভুলে গেছে ও। আবার জীবনে নতুন করে পথ চলার শক্তি ফিরে পেয়েছে। সারাক্ষণ মেয়েকে নিয়ে পড়ে থাকে। বলছিলো কলেজে পড়ানোটা ছেড়ে দেবে, হয়তো আমার উপার্জনের কথা ভেবে পিছিয়ে এসেছে।
ঈষা খুব তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে উঠছিলো, মা-বাবা ছাড়াও অনেক জটিল শব্দ আধো আধো উচ্চারণ করে। কবে যে হামাগুড়ি দেওয়া ছেড়ে উঠে দৌড়োতে শুরু করেছে, বুঝতেই পারিনি। জৈবিক নিয়ম মেনে হলেও সব বাবা-মারই এরকম মনে হয়। দেখতে দেখতে স্কুলে পড়ার বয়সও হয়ে গেলো। একটা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করলাম।
খুব আনন্দেই দিন কাটছিলো। একদিন নন্দিনী এসে আমায় বললো, “কী গো, মেয়েকে আঁকা শেখাবে না!” একটা জিনিস খেয়াল করেছিলাম নন্দিনীর ড্রইং-এর ওপর ইন্টারেস্ট আমার থেকেও বেশি। ও আঁকতে পারতো ভালো, আর্কিওলজি পড়ার সময় শিখেছিলো। শব্দজ্ঞান হওয়ার আগেই মেয়ের হাতে রঙ-তুলি তুলে দেওয়ার ইচ্ছে আমার ছিল না, তবু নন্দিনী মাঝেমাঝেই জোর করতো।
– “দ্যাখো, তোমার মেয়ে কী এঁকেছে,” সেদিন সকালে নন্দিনী একটা কাগজ এনে আমায় দিলো। দেখলাম একটা বাড়ি এঁকেছে ঈষা, তবে অপটু হাতের ছোঁয়ায় বাড়িটা অনেকটাই ভেঙে গেছে। বললাম, “বাহ সুন্দর তো।” নন্দিনী খুব খুশি, “এবার মেয়েও বাবার মতো হবে।”
দুপুরে নন্দিনী কলেজে গেছে, আমি বিছানায় শুয়েছিলাম। ঈষা এসে আমার বুকের উপর বসলো। আমার কান দু’টো ধরে টানছিলো। বললাম, “কী হলো মা?”
– “বাবা, তুমি স্বপনকাকু, রঞ্জনকাকু, রঞ্জিতদা, রিম্পাদি কে চেনো?”
– “কারা এরা স্কুলের বন্ধু?”
– “উমহু।” ঈষা বলে চলে, “জানো বাবা, ওরা না মারা গেছে। কীভাবে জানো?”
আমি আশ্চর্য হচ্ছিলাম, বললাম, “কীভাবে?” বলার সাথে সাথেই ঈষা আমার মুখের কাছে ঝুঁকে গলায় কুটুস করে কামড়ে দিল।
– “উফফ্!! ঈষা বদমাইশি করো না।”
ধমক দিতে ঈষা আমার বুকের উপর থেকে উঠে চলে গেলো।
রঞ্জন নামটা আমার শোনা, নন্দিনীর আগের স্বামী। আমার অদ্ভুত লাগছিলো, ঈষা জানলো কীভাবে!
বিকেলে আমি বাইরে গিয়েছিলাম, মুদিখানার জিনিস কিনতে। সন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখি মা মেয়ে ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে আছে। বললাম, “একি! কারেন্ট তো আছে, মোমবাতি জ্বালিয়েছো কেন!”
– “মেয়েকে ভূতের গল্প বলছিলাম, তাই।”
– “আচ্ছা, আমিও শুনবো।”
– “যাও তো! বাচ্চা নাকি তুমি!” ঈষা খিকখিক করে হাসছিলো।
আমি আর কিছু বললাম না, খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম। ভাবছিলাম মেয়ের হাতে এবার রঙ পেন্সিল তুলে দি, ছোটো থেকে শেখানো গেলে মেয়ে অনেকদূর যাবে। আর আমার ইচ্ছেটুকু বংশধারায় বয়ে চলুক।
পরদিন ঈষাকে আমি একটা পাখি একে দিলাম রঙ করতে। নন্দিনী কলেজে গেছে। ঈষার রঙ করা ছবিটা দেখে ভিরমি খেলাম, সেই কালো পাখির লাল চোখ!
একটা হাতুড়ি নিয়ে উঠে গেলাম চিলেকোঠার ঘরে। মনের ভেতরে সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করেছে। নন্দিনীর পুরোনো জিনিসগুলো ওখানে রাখা। আমার আপত্তি ছিল না ওসবে। পুরোনো জীবনের কথা আর আলোচনা হয়নি।
ট্রাংকের মরচে ধরা তালাটা ভাঙ্গলাম। নিজেকে অপরাধী লাগছিলো ঠিকই কিন্তু কিছু করার নেই।
খুলে দেখলাম একটা আর্কিওলজির বই। বইটা হাতে নিতেই ভেতর থেকে কতোগুলো পাতা বেরিয়ে মাটিতে পড়লো। তুলে নিয়ে দেখলাম সাদা কাগজের ওপর পেপার কাটিং করে হরফে লেখা। ‘কালো চিন্তা’ ‘হিংস্রতা’ ‘খোঁজ’ ‘সুনিপুণ’ ‘চিত্রকার’ ‘মতভেদ’ ‘হত্যা’। এসব কী!! কিছুই বুঝলাম না!
একটা পোস্টকার্ড সাইজের ফটো পেলাম ট্রাংকে নন্দিনী-রিজু-রঞ্জন একসাথে। রঞ্জনের মাথার উপর কাটা চিহ্ন দিয়ে বাতিল লেখা। এরকম আরো একটি ফটো আছে। এক ভদ্রলোক, একটা ছোটো ছেলে আর একটা মেয়ে আর নন্দিনী!! ওদের মাথাতেও কাটা দিয়ে বাতিল লেখা। আমার হাত পা কাঁপছে। এরা স্বপন, রঞ্জিত, রিম্পা!! নন্দিনীর আরও পরিবার ছিলো!!
শেষে খুঁজে পেলাম সেই ভাঁজ করা কাগজটা। খুলে দেখলাম কালমুণ্ডির ছবি, যেটা রিজু এঁকেছিলো। তবে…তবে ছবিটার নিচে কাগজের আরেকটা ভাঁজ আছে। সেটা খুলতেই যা দেখলাম আমার সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিজেকে সামলে নিলাম। কাগজের ভাঁজে লেখা আছে, ‘মা’।
ইউটিউবে গল্পটি শুনুন