Getting your Trinity Audio player ready...
|
প্রায় ৪ ঘণ্টা হলো আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম নদী আমাজন নদী এর উপর ভাসছি। সময়টা দিনের বেলা হলে এতটা ভয় পেতাম না যতটা ভয় হচ্ছে রাতের বেলায়। এটা আমিও জানি যে এই অববাহিকা অঞ্চলের বাইরে হয়তো এখনো সূর্য ঠিকমতো ডোবেনি, কারণ আমরা এখন যে জায়গায় এসে পড়েছি তার প্রায় চারদিকেই বড় বড় গাছের সারি এবং সেই কারণেই সূর্যের আলো এই গাছের পাতা ভেদ করে আসতে পারছেনা। তবে যাই হোক, অনেকক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে আমি আর সাইমন ঠিক করলাম যে আজকে এই জায়গা তেই লঞ্চে রাত কাটাবো। অবশ্য আমি আর সাইমন বাদে এখনো পাঁচজন লঞ্চের উপর উপস্থিত। তাদের মধ্যে দুজন হল আদিবাসী যারা আমাদের মতই পর্যবেক্ষণ দলকে সাহায্য করে। অবশ্যই এদের ঠিক করেছে সাইমন নিজেই। আসলে বিশেষ কিছু ভৌগোলিক কাজ ছাড়া আমার তেমন কিছু কাজ নেই। আসলে আমি হলাম একজন ভূগোলবিদ, প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে এই অ্যামাজন জঙ্গল এবং তার অববাহিকা অঞ্চলের উপর রিসার্চ করছি। আমার বন্ধু হচ্ছে সাইমন পাণ্ডে। সাইমন ভূগোলবিদ হলেও তার খুবই ভ্রমণের নেশা। সাইমনের সাথে আমার দেখা হয় একটা সেমিনারে ৫ বছর আগে। সেখান থেকে আলাপ এবং পরিচয়। এর আগে আমরা বহু জায়গায় গেছি একসাথে তবে এটি সব থেকে বড় ট্রিপ আজ পর্যন্ত। এছাড়া এটা আমার জীবনের সবথেকে বড় একটা অবিস্মরণীয় ট্রিপ। এর আগে আমি এসেছি আমাজন জঙ্গলে, কিন্তু তখন নিছকই ঘুরতে। যেহেতু আমি ভূগোলবিদ তাই মাঝে মাঝে আমাকে ব্রাজিল আসতে হয় বিভিন্ন সেমিনার অথবা মিটিংয়ে। তবে এবারের আশাটা একটু অন্যরকম। এর আগেই বলেছি প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে আমি এই নিয়ে রিসার্চ করছি। আমাজন জঙ্গলে মাঝে যে আগুন লেগেছিল, তা আমাকে খুবই মর্মাহত করেছিল। তবে যে বিষয় নিয়ে আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি তা একটু গোপনীয় এবং তা আমি সাইমন কেও জানায়নি। আমি সাইমনকে জানায়নি কারণ তথ্য জানার পর সে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। এমনিতে সাইমন খুব বিশ্বস্ত বন্ধু। তবে যে জিনিসের খোঁজে আমি অ্যামাজনের এতটা গভীরে এসেছি তা জানলে যে কোনো বিশ্বস্ত লোক ই বিশ্বাসঘাতকতা করতে বাধ্য হবে। সাইমনকে আমি এই গভীর অরণ্যে এনেছিলাম ভ্রমণ এবং কিছু ভৌগোলিক গবেষণা এর অজুহাত দেখিয়ে। এখনও পর্যন্ত সে এই কথাই জানে।
ইতিমধ্যে সাইমন কোথা থেকে কাঠ, ডাল-পালা জোগাড় করে আনল। আমি তো অবাক। এই গভীর অরণ্যে জলে পিরানহা, ডাঙায় অ্যালিগেটর এর মতো ভয়ানক সব জীবজন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরমধ্যে সে কাঠ পেল কোথা থেকে? তাছাড়া এই কাঠ কি আদেও জ্বলবে? অঞ্চলটা পুরোটাই জলাভূমি। তাই এখানকার কাঠ ভিজেই হওয়ার কথা। নিজের কৌতূহল কে দমন করে আমি সাইমন কে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা। সাইমন মুচকি হেসে উত্তর দিলো- “হু হু, তুমি ও হতে পারো ভূগোলবিদ কিন্তু মনে হয় বুদ্ধিতে আমিই শ্রেষ্ঠ, হে হে। আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলাম যে এমন কিছু ঘটতে পারে। যতই ক্যান এ করে খাবার নিয়ে আসি, আগুনটা বড় ইম্পরট্যান্ট। তাই আগে থেকেই নিয়ে এসেছিলাম বাড়ি থেকে। ওই যে দেখছো বড়ো ব্যাগটা, ওতে করেই কাঠ গুলো নিয়ে এসেছিলাম। আর যাতে ভিজে না যায়, তাই দু’টো প্লাস্টিক এর বস্তা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিলাম। ভেজার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম – “সে না হয় মানলাম তুমি বুদ্ধি তে শ্রেষ্ঠ, তবে তুমি ও কি ভূগোলবিদ নও?”
উত্তরে সে বললো – “তা তুমি ঠিক ই বলেছ।” এই বলে সে আগুন ধরানোর তোড়জোড় করতে শুরু করলো।
সত্যি সাইমন একটা কাজের মতো কাজ করেছে। দু’টো আদিবাসী আর আমরা দু’জন কোনরকমে আমাদের লঞ্চের উপরে আগুন জ্বালালাম। শুধু ভয় এই টুকুই ছিল যে লঞ্চে না আবার আগুন লেগে যায়। লঞ্চ কাঠের না হলেও, লঞ্চের ডিজেল ছিল। এই কারণে আমরা খুব স্বল্প জায়গায় যে দিকটা তেলের ট্যাংক টা নেই, সেই দিকে আগুন টা জ্বালালাম। এখন আমি ভাবছি এয়ারপোর্ট চেকিং করার সময় কি সাইমন এর ব্যাগে কাঠ আছে, তা তাদের চোখে পড়েনি? (মুচকি হাসি হাসলাম মনের মধ্যে)।
রাতে এবার ঘনিয়ে আসছে। এখন ঘড়িতে বাজে ৯টা বেজে ২৫ মিনিট। তবে এই গভীর অরণ্যে দেখে মনে হচ্ছে মাঝরাত। চারিদিকে আলোর বিন্দু মাত্র নেই। আমাদের লঞ্চের একটা সুবিধা হল, আমরা যতটা পথ আসলাম তাতে ইঞ্জিনের মধ্যে এরকম মেশিনের মাধ্যমে শক্তিকে প্রিজার্ভ করা হয়। তারপর সেই শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে পরিণত করে তা ব্যবহার করা যায়। এই কারণে আমাদের লঞ্চে লাগানো দু’টো মিনি টিউবলাইট আমাদের পক্ষে যথেষ্ট আলোর যোগান দিচ্ছিল। এছাড়া আগুন তো জ্বল ছিলই। আগুন টা আমাদের তাপ ও আলো দুই ই দিচ্ছে। এদিকটা জলাভূমি হওয়ায় ঠাণ্ডা আছে। তাই আগুনটা ভালই কাজে লাগছিল। এমনিতে সবাই মত মত সোয়েটার পরে আছি, তবুও ঠাণ্ডা জল – হাওয়া যেন সেই সোয়েটার ভেদ করে দেহ কে পুরো শীতল করে তুলছিল। তবে আমার কাছে সোলার চার্জিং লাইট ও ফ্যান ছিল।
এবারে সাইমন কিন্তু চুপ মেরে গেল। কারণ সে এবার লাইট তো দূরের কথা, একটা ব্যাটারি আনতে ভুলে গেছে। আমি ভাবছিলাম তাকে একটু উসকে দেই তবে আমার মনের কথা ভেবেই মনে হয় সে চুপ মেরে গেলো। আমি আর কিছু বললাম না।
রাতে সকলে সবার ক্যান এর খাবার খেয়ে স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে পড়লাম। আমি আদিবাসীদের স্লিপিং ব্যাগ দিতে, তারা নাকচ করে দিল। তা বেশ সুস্পষ্ট ইংরেজিতে ই বলল যে তারা এমনি শুয়ে পড়তে পারবে। এছাড়া লঞ্চের মধ্যে চাদর আছে তাদের এতেই কাজ চলে যাবে। ভেবে অবাক লাগলো, এরা যাতে আদিবাসী হলেও ইংলিশ টা বেশ ভালোই জানে।
সবাই শুয়ে পড়ল। আমার তেমন ডাইরি লেখার স্বভাব নেই। তবে ইদানীং লিখতে শুরু করেছি। এর কারণ যে আমি এই অবিস্মরণীয় দিন গুলোকে আমার ডায়েরির পাতায় লিপিবদ্ধ করতে চাই।
যাইহোক রাতে তেমন কোনো উৎপাত হলো না। শুধু মাঝে মাঝে জাগুয়ারের গর্জন এবং কুমিরের হুংকার ছাড়া।
তবে পরদিন সে ঘটনাটা ঘটলো তা আমি কোনদিনও ভুলতে পারবো না।
সময়টা ঠিক জানিনা, তবে ঘটনাটা যে দুপুর আর বিকেল এর মাঝামাঝি সেটা পরিষ্কার হবে বোঝা যাচ্ছিল। দুপুরের পড়ন্ত রোদ সবে লঞ্চের উপর পড়েছে। এমন সময়, কি যেন একটা কানের পাশ দিয়ে শাঁই শাঁই করে চলে গেল। জিনিসটা যে কাঠ কাঠি দিয়ে তৈরি তা ভালোই বুঝতে পারলাম। আমি ও সাইমন পাশাপাশি বসে ছিলাম। আমরা প্রায় ছিটকে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুই আদিবাসী সঙ্গী ইংরেজি ভাষায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো। যার অর্থ- “শীঘ্রই পালান, নয়তো আর বেঁচে নিজের দেশে ফিরতে পারবেন না।” কথাটা শোনা মাত্রই আমি আর সাইমন সঙ্গে সঙ্গে ডেকের মধ্যে মেরে বসে থাকলাম।
ডেকের দরজার পাশে একটা জানলা তে কাঁচ লাগানো ছিল। হঠাৎ সশব্দে সে কাঁচ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। আর সঙ্গে সঙ্গে যে জিনিস টা আমার চোখে পড়লো সেটা হলো একটা তীর। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠলো। এই তীর একমাত্র এই আমাজন জঙ্গলের অধিবাসীরা ই ব্যবহার করে। যেহেতু তারা সভ্য সমাজের পরিচয় এখনও পর্যন্ত পেয়ে উঠতে পারিনি, তাই তারা যে কোনো প্রাণী কেই ভয়ংকর জন্তু হিসেবে মনে করে এবং সেই কারণে তারা তাদের নিজেদের তৈরি তীরের মাথায় অত্যন্ত বিষাক্ত বিষ মাখিয়ে রাখে। এই তীর একবার কারোর দেহে প্রবেশ করলে তার মৃত্যু অনিবার্য। এখন সমস্যা হচ্ছে ওরা কি আমাদের দিকে অনবরত তীর চালাতে থাকবে? এই ভাবে অনবরত তীর চালালে আমাদের সকলের এখনই মৃত্যু ঘটবে। তবে আমি আর সাইমন এছাড়া তৃতীয় একজন গুটিসুটি মেরে ডেকের এক কোনায় বসে আছি। বর্তমানে ফাঁড়া টা কেটে গেলেই ভালো।
প্রায় আধ ঘণ্টা পর পরিবেশ শান্ত হলো। আমরা এখন সেই আদিবাসী উপজাতি দের অঞ্চলটা আমরা পার করে এসেছি। আমি ভাবছি আজ থেকেই আমার মূল উদ্দেশ্যের কাজ শুরু করবো। তবে সাইমন এর মনে একটু হলেও উদ্বেগের সঞ্চার হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আমি এই ২ দিন ভৌগোলিক কোনো কাজে বিশেষ মাথা ঘামাইনি। তবে এবার একটা বিশেষ কথা বলা যাক, সেটা হলো আমাদের সাথে তৃতীয় ব্যক্তি টির পরিচয়। অবশ্য ঘটনা ক্রমে তাকে পঞ্চম ব্যক্তি থুড়ি প্রাণী বলা ই ভালো। সে হলো আমার অতি আদরণীয় বিড়াল “মার্কারি।” অতি ভদ্র এবং আমার প্রিয় পোষ্য। তবে তাকে আমার সাথে নিয়ে আসার একমাত্র কারণ হলো ওর ইচ্ছা। হ্যাঁ, ওর কিছু অঙ্গভঙ্গি দ্বারা ও ওর ইচ্ছা প্রকাশ করে। একদিন টেলিফোনে এ আমি আর সাইমন ট্রিপ নিয়ে একটু আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ মার্কারি দেখি ওর সামনে ডান পা উঁচু করে নাড়াতে লাগলো। এর আগে এমন ঘটনা অনেকবারই হয়েছে। তাই বুঝতে অসুবিধে হলো না যে আমাদের সাথে যেতে চাইছে। অনেক ভেবেচিন্তে ওকে আমাদের সাথে নিয়ে আসলাম। এবার কাজের কথায় আসা যাক।
ওই আদিবাসী গুলো কে দেখে আমার মনে একটা ক্ষীণ আলো দেখা দিয়েছিল। কারণ আমি যে জিনিসের সন্ধান করতে যাচ্ছি, তাই আদিবাসীদের কাছে থাকা সম্ভব। ব্যাপারটা এইবারে খুলে বলা যাক। আমি কোন ভৌগলিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে নয়, আমি এসেছি রত্নভাণ্ডার খুঁজতে। প্রাচীন উপকথা তে পাওয়া যায় ব্রাজিলের এই ঘন জঙ্গলে বহু আদিবাসী গোষ্ঠী থাকলেও এদের মূল সরদার ছিল এক। ঘটনাটা ঘটে আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৬০০ বছর আগে। প্রাচীন উপকথা মতে এই বিশাল জনবহুল আদিবাসী গোষ্ঠী তে কোন কারণে বিবাদ দেখা দেয়। এবং তার ফলে গোষ্ঠী দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তবে দুই গোষ্ঠীতে কারোরই পোষাচ্ছিল না। তারা সর্বদাই চাইতো সমগ্র তাই গ্রাস করতে। এর ফলে বাধে যুদ্ধ। গোষ্ঠী দের দুই দলের প্রধান দের মধ্যে প্রথম হলো “সরমুম্বিস” এবং দ্বিতীয় হলো “কঙ্গোনিয়া।” এই দুই দলের মধ্যে তন্ত্র সাধনা এ মনোনিবেশ করতো গোষ্ঠী নেতা “সরমুম্বিস।” আর অনেকে মনে করেন এই তন্ত্র সাধনার ফলেই তার মৃত্যু ঘটে। তবে লোক মুখে রটে যায় যে “কঙ্গোনিয়া” এর হাত এ “সরমুম্বিস” এর মৃত্যু হয়েছে। তবে সব থেকে উল্লেখ যোগ্য ঘটনা হলো সরমুম্বিস এর মৃত্যু হলো কিভাবে? এখন আসল ঘটনায় আসা যাক। উপকথায় বর্ণনা আছে সরমুম্বিস এর কাছে ছিল ৭ টি রত্ন। এই রত্ন নাকি মহা মূল্যবান, যার টাকার অঙ্ক গুনে শেষ করা যাবেনা। সেই রত্ন গুলো কঙ্গোনিয়া তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় তার মৃত্যুর পর। তবে সেই রত্ন বেশি দিন ভোগ করতে পারলো না সে। সরমুম্বিস এর মৃত্যুর পর ৩ দিন এর মধ্যে হঠাৎই এক রাত এ কঙ্গোনিয়া এর এক ভয়ানক চিৎকারে সকল আদিবাসীদের ঘুম উড়ে যায়। তারা তাদের দল নেতার ঘরে এসে দেখে তার বুক চিরে ফেলা এবং সেখান থেকে রক্ত এর নদী বইছে। তবে লক্ষ করে দেখা যায় যে সেই চিরে থাকা বুক এর উপর সাতটা তীরে সাতটি রত্ন আটকানো আছে। সেখান থেকেই সকলের বিশ্বাস যে ভগবান তাদের দলপতি কে পরলোকে নিয়ে গেছেন এবং এই সাতটি রত্ন আশীর্বাদ স্বরূপ রেখে গেছে। অবশ্য তখনকার দিনে ভগবান বলতে তারা অরণ্যকে বুঝতো। বর্তমানেও তারা তাই বোঝে। এই জঙ্গল ই তাদের দেবতা। এখনো নাকি কঙ্গোনিস নামক এক আদিবাসী গোষ্ঠী আছে যাদের বলা হয় এরা কঙ্গোনিয়ার অনুগামী। সেই প্রাক্কাল থেকে এখনো পর্যন্ত এদের ধারা বয়ে আসছে। তবে এই যে নিছক গল্প তা আমি জানি। এসব হলো কুসংস্কার। আরেকজন ভূগোলবিদ হয়ে কুসংস্কারকে আমি মোটেই বিশ্বাস করিনা।
এখন ভারতীয় সময় হিসেবে রাত ১২:৩০। এইবারে আমরা ঘুমাতে যাব। আশা করছি যা হবার কালকেই হবে। কারণ আমার অনুমান অনুযায়ী আমরা কাল ই ওই অঞ্চলে পৌঁছাব। দেখা যাক কি হয়।
আমার অনুমান ভুল হয়নি। সকাল সাড়ে দশটা থেকে টানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর আমরা সঠিক জায়গায় এসে পৌছালাম। জায়গাটা বড়ই নির্জন ছিল। আমি তো ভাবলাম ভুল জায়গায় এসে পড়েছি, সবেমাত্র একটু নিরাশা নিয়ে দিকের দিকে যাচ্ছি, হঠাৎ ভীষণ এক হুংকারে আমার দৃষ্টি ফিরল। দেখলাম প্রায় দেড়শ জন মানুষ হাতে বল্লম নিয়ে অববাহিকা অঞ্চলে এর ধারে দাঁড়িয়ে। মাত্র ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে এত মানুষ কিভাবে জড়ো হল আমি নিজেই বুঝতে পারলাম না। তারপর বুঝলাম ব্যাপারটা। এবং বুঝেই আমি শিউরে উঠলাম। শিউরে ওঠা আতঙ্কের নয় আনন্দের। কারণ কঙ্গোনিস দের একটা লক্ষণ হলো এরা গাছের উপর থেকে স্বীকার করে। কোন পশু অথবা জলজ প্রাণী যদি কখনো এই স্থল স্থানে ওঠে, তবে এই আদিবাসীরা উপর থেকে বল্লম মেরে তাকে হত্যা করে। এছাড়া কঙ্গোনিস দের আরেকটা লক্ষণ হলো এরা তীর ধনুক না নিয়ে বল্লম নিয়েই শিকার করে।
এবার যে জিনিসটা আমার মাথায় এলো সেটা হল আমাকে যে কোন রকম ভাবে এই অঞ্চল টায় নামতে হবে। আমি দুই আদিবাসীদের বললাম যে লঞ্চ থামাও। সাইমন হতবাক। সে ভেবেছে আমি নির্ঘাত মরতে যাচ্ছি। তবে আমি জানি যে এরা অন্যান্য আদিবাসীদের মত অচেনা মানুষ অথবা প্রাণী দেখলে শিকার করার উদ্দেশ্যে যায় না। এটাও এদের একটা বৈশিষ্ট্য বলা চলে। আমার কথামতো লঞ্চ আস্তে আস্তে অববাহিকার মাটি জমির উপর যেতে লাগলো। মাটি তো নয়, পা দিতেই প্রায় পা টাই বসে গেল। এরপর কোনরকমে শক্ত জায়গায় গিয়ে উঠলাম। আমরা পাঁচজন এরমধ্যে আদিবাসী দুইজন ছাড়া আর কেউ এদের ভাষা বোঝে না। আমি আদিবাসী একজনকে ডেকে তাদের কানে কানে বললাম যে আজকে আমরা এদের সাথেই থাকব। শুনে খানিকটা খানিকটা হতবাকই হল আদিবাসী টা। যাই হোক আমার কথামতো সে তাদের কাছে গিয়ে বলল। ওদের ভাষা বুঝলাম না তবে এটুকু বুঝলাম যে ওরা একটু বিরক্ত। এরপরই মাথায় ফন্দি টা এলো। আমি আমার লঞ্চ এগিয়ে দু’টো মাংসের ক্যান নিয়ে আদিবাসীদের বললাম যে এটা তাদের দিতে। তারা বুঝতেই পারল না যে কি হচ্ছে ব্যাপারটা। তারা আমার কথামত তাদেরকে খানিকটা বুঝিয়ে-সুজিয়ে ক্যান গুলো দিল। সেগুলো দেখে বল্লম ধারী আদিবাসীরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। এ জিনিস তারা হয়তো প্রথমবার দেখছে। তবে একটা ব্যাপার দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। একজন সভ্য মানুষ যেভাবে ক্যান খোলে, ঠিক সেইভাবেই একজন বল্লম ধারী আদিবাসী তার ক্যান টি খুলে ফেলেন। ব্যাপারটা দেখে সাইমন পর্যন্ত হতবাক হয়ে। এই একঘণ্টা সবকিছুই হতবাক করার মত কাজ চলছে।
অনেকক্ষণ ধরে এই আদিবাসীদের সাথে কথা চলছে। এদের সাথে অনেকটা আলাপ করে উঠেছি আমরা। এবং এও বুঝতে পারছি যা করার আজকের মধ্যেই করতে হবে।
এবার একটা কথা আমার মাথায় আসলো, আদেও এরা সেই রত্ন সম্বন্ধে জানে তো। আমার কেমন একটা সন্দেহ হলো। আমি আদিবাসী গুলোকে বললাম যে ওদেরকে একটা কথা জিজ্ঞেস করো। আদিবাসী দু’জন বলল – “কি?”
আমি বললাম – “ব্যাপার টা গোপনীয়, তোমরা যেকোনো একজন এসো। ব্যাপার টা যেন আমাদের দলের লোক ও না জানে। জানলে তোমাদের কিন্তু ভালো হবে না।”
একটু উস্কানি দিয়ে বললাম আমি।
ওরা ভয়ে ভয়ে ইংরেজি তে বললো – “ঠিক আছে।”
বলে তাদের মধ্যে একজন আমার কাছে আসলো। আমি তাদের কানে জানে ব্যাপার টা বললাম। তারা বিস্মিত এবং হতবাক হয়ে বললো – “আপনি জানেন?”
আমাকে এবার ধমক দিয়ে বলতেই হলো – “যা বলেছি সেটা করে আসো। বেশি কথা বলও না।”
আদিবাসীরা তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললো – “ওই কাজটি আপনি করতে যাবেন না। আপনার থেকে ও অনেক আগে এই চেষ্টা করেছে। তবে তাদের পরিণতি কিন্তু ভালো হয়নি। তারা সকলেই………”
আমি তাদের কথার মাঝখানেই বললাম – চুপ, একদম চুপ। তোমাদের ওই সব বাজে কথা শোনার জন্য আমি নেই। এমনিতে বিকাল হয়ে যাচ্ছে, তার উপর বাজে কথা, যাও যা বলেছি গিয়ে করো।”
তারা আর কিছু বললো না চুপ চাপ চলে গেলো।
কয়েক মিনিট হলো যা ঘটে গেছে তা আমার মনে রাখার কোনো ইচ্ছা নেই। একটা কোথাকার বুড়ো, মনে হলো এই দলের বর্তমান নেতা। ওই দুই আদিবাসীদের কথা শুনে আমার কাছে আসলো এবং ওই তীর এর পুরাণ কাহিনী শোনালো। সেই কাহিনী যে আমার আগে থেকেই জানা তা আমি আর বললাম না। তবে যেটা সব থেকে উল্লেখ যোগ্য সেটা হলো এই বুড়ো নেতা একমাত্র লোক যে এই সমগ্র দল এর মধ্যে ইংরেজি জানে। সে আমার কাছে এসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা তবে পরিষ্কার ইংরেজি তে সব কথা বললো। এর পর বললো – “তোমার উদ্দেশ্য কি আমি জানি না, তবে তুমি যে পবিত্র সাত রত্ন এর কথা বলছও সেই রত্ন আমি দেখতে পারি। চলো।”
বলে সে আমাকে নিয়ে গেলো এক প্রাচীন ভাঙ্গা মন্দির এ। দেখলাম সেই মন্দির কে মন্দির না বলে একটা কুড়ে ঘর বললেই হয়। সেই ঘরে কোনো জানালা অথবা দরজা বলে কিছুই ছিল না। ভিতরে ঢুকলাম। সেই বয়স্ক মানুষ টা আসতে আসতে আমার আগে আগে ঢুকলও। ঘরের ভিতর দেখলাম কিছুই নেই, শুধু মাত্র একটি লাল রঙের বড়ো দেখে পাতায় মোড়া কিছু একটা জিনিস ছাড়া। আমি জিজ্ঞেস করলাম – “এতে কি আছে?”
বয়স্ক কঙ্গোনিস আমার কথার উত্তর দিলো না। সরান খুলে ফেললো পাতা টা। আর যা দেখলাম টা দেখে আমার চোখ প্রায় ধাঁধা লেগে গেলো। দেখলাম ৭ টি পাখির পেখম লাগানো তীর এবং তাদের আগায় ফলার যায় গায় ৭ টি রত্ন। প্রায় ১০ মিনিট আমি তাকিয়ে থাকলাম। তারপর সেই বৃদ্ধ আবার সেই গুলি যেমন ছিল তেমন অবস্থা তে রেখে দিল। এই বার যে জিনিস টা আমার বেড়ে গেলো সেটা হলো লোভ, রত্নের লোভ। আমার ঐ রত্ন চাই যেকোনো ভাবে। বুড়ো আদিবাসী আর কিছু বলল না। আমাকে নিয়ে আবার নিয়ে একই গ্রামের এর মধ্য অংশে যেখানে সবাই ছিল। এর পর রাত বাড়লে ওই বুড়ো আদিবাসী এর তত্ত্বাবধানে আমাদের শোয়ার জায়গা হলো। সকলের শোয়ার জন্য আলাদা আলাদা জায়গা দেওয়া হলো। এই হলো সুযোগ। যাক সব কিছু। আজ রাতে সব হবে। আজ না হলে আর কোনো দিন হবে না।
রাত তখন কটা হবে জানি না। আমি আস্তে আস্তে উঠলাম। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। মাঝে মাঝে জাগুয়ার এর হুংকার শোনা যাচ্ছিল। একটু ভয় হলো, তারপর ভাবলাম আজ যদি ঐ গুলো হাত করতে পারি তাহলে কাল আমি কোটিপতি অথবা তার থেকেও বেশি। আস্তে আস্তে বেরুলাম। চারি দিক নিঝুম। রাস্তা টা চিনে রেখেছিলাম। গেলাম আস্তে আস্তে। মনে হলো অস্পষ্ট কি একটা আমার পিছু পিছু আসছে। পিছনে ফিরলাম, কিন্তু কেউ কেউ দেখলাম না। আবার এ-গোলাম। দেখলাম সামনে সেই কুড়ে ঘর। গেলাম তার মধ্যে। সেই লাল পাতা টা চোখে পড়লো। পাতাটা যে কি পাতা সেরা প্রথমেও বুঝতে পারিনি এখনও না। তবে টা বুঝতে পারে আমার কোনো লাভ নেই। সেটা হাতে নিলাম। দেখলাম বেশ ভারী। যাইহোক, নিলাম সেটা এবং নিয়ে দৌড় দিলাম। তবে প্রতিবার মনে হলো কিছু একটা আমার পিছন পিছন আসছে। হঠাৎ মনে হলো আমার পা অবশ হয়ে গেলো। কি হলো? এমন কেন হলো? হঠাৎ আমার চিকের সামনে এক কালো ধোঁয়া ঘুরতে লাগলো। আমার সাড়া শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে হাতে সেই তীর গুলি। হঠাৎ মনে হলো শূন্যে উড়ছি। এই বার কি হলো নিজেও বুঝলাম না হঠাৎ আমার বুকের উপর ভীষণ ব্যথা অনুভব করলাম। আর পারছি না। চেঁচিয়ে উঠলাম – আহ:………
সকালে সাইমন কান্না কাটি জুড়ে দিল। আর দুই আদিবাসী সহ সাড়া গ্রাম চুপ চাপ। বৃদ্ধ আদিবাসী বললো – “আমি জানতাম এমন কিছু হবেই। আমি বলেছিলাম, আমার কথা শোনেনি। এর আগে প্রায় 4 জন দল এসেছে এই পবিত্র তীর চুরি করতে। পারিনি। প্রত্যেকেরই একই ভাবে মৃত্যু। আর তারপর থেকেই আমি এই ইংরেজি ভাষা শিখতে চাই এবং সকলকে সাবধান করি। কিন্তু কেউ শোনে না। আর সকলের ই মৃত্যু হয় ঘরে বুক ছেরা অবস্থায়। ওই তীর গুলিতে যক্ষ প্রহরী এর মত আছে। কেউ নিতে পারবে না। সেই যক্ষ হলো আমাদের পূর্ব পুরুষ কঙ্গোনিয়া।”
আজ সকালে ভূগোলবিদ সুবল বোস এর মৃত্যু হয়েছে। যে ভাবে গত চার জন এর মৃত্যু হয় সেভাবেই।