চন্দন সেন মৃত্যু রহস্য | ভয়ের দেশ | দেবজ্যোতি মিত্র| Bengali Horror Story
আনুমানিক সময়:157 মিনিট, 58 সেকেন্ড

চন্দন সেন মৃত্যু রহস্য | ভয়ের দেশ | দেবজ্যোতি মিত্র| Bengali Horror Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

“গুড মর্নিং কোলকাতা! ফাঁকা রাস্তায়, হালকা কুয়াশায় ও ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমি সায়নী, আপনাদের সকলকে স্বাগত জানাই আপনাদের প্রিয় শো যার নাম ‘আমার শহরে’!

যারা এই মূহুর্তে বাইরে বেরিয়েছেন বা বেরিয়েছ জগিং এর উদ্দেশ্যে, তাদের জন্য বলি, আজকের সকালটা একটু ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে বিক্ষিপ্ত ভাবে ভিজে থাকলেও দিনটা কিন্তু বেশ ভালোই যাবে। আজ শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্ৰি সেন্টিগ্ৰেড এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৫ডিগ্ৰি সেন্টিগ্ৰেড।

আর, যারা প্রেমে ব্রেক-আপ করেছ, বা গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করে মন ভাল রাখার এই অনুষ্ঠান শুনছ বা যারা অলরেডি প্রেম করছ, দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়া করছ এবং এত সকালে গার্লফ্রেন্ডের প্রথম ম্যাসেজ দেখার উদ্দেশ্যে ফোনটা অন করে হেডফোন কানে গুঁজে এই অনুষ্ঠান শুনছ তাদের জন্য রইল আজকের প্রথম গান।”

এই বলে সায়নী ‘কোলকাতা … কোলকাতা … আমার শহর কলকাতা’ গানটা প্লে করল।

এই সাড়ে চার মিনিট গানের পর ওকে আবার ‘অন এয়ারে’ ফিরতে হবে।

সায়নী হেডফোনটা নামিয়ে রেখে, কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ফোনে ইন্টারনেট অন করে খবর পড়ছিল। এখন বিশেষ কোন খবর বলতে মার-পিট, গোষ্ঠীদ্বন্দ আর খুন-জখম ছাড়া আর কিছুই নেই।

হঠাৎই এই খুন-জখমের খবরের ভিড়ে একটা খবর বিশেষ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সায়নীর। ভুরু কুঁচকে সেই হেডলাইনটা দেখে সে।

গত রাতে ‘সহেলী আপার্টমেন্ট’ এ খুন হয়েছেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ‘চন্দন সেন’! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল তার উইকিপিডিয়ার পেজে গতরাতেই তার মৃত্যুর তারিখ ও সময় আপডেট হয়ে যায়।

ওর আর পুরো খবরটা পড়া হয়ে ওঠে না, কারণ আর দেড় মিনিট পর ওকে অন এয়ারে ফিরতে হবে।

ওর সারা মুখে চিন্তার একটা রেখা ফুটে ওঠে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করে। মুখটা বিকৃত করে ওর ফোন থেকে একটা নম্বরে কল করে। কিন্তু রিং বাজতে বাজতে একটা সময় ফোনটা কেটে যায়। কেউ কলটা রিসিভ করে না।

ওর পেটের ভেতরটা ভয়ের তাড়নায় কেমন যেন করে ওঠে। ওর মনে হলো হৃৎপিণ্ডটা যেন মধ্যচ্ছদার খাঁচা ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

এমন সময় ওর চমকটা ভাঙ্গে, রেড অ্যালার্ম এর শব্দটা কানে আসতেই। আর মাত্র দশ সেকেন্ড।

সায়নী কোনরকমে দু’হাত দিয়ে মুখটা মুছে নেয়। মুখের ভাবমূর্তিকে পরিবর্তন করে একবার হেসে নিয়ে আবার মাইকের সামনে বসে পড়ে।

গান শেষ হবার পরেই ও পুরোনো ভঙ্গিতেই বলে ওঠে, “আপনারা শুনছেন, আপনাদের প্রিয় অনুষ্ঠান ‘আমার শহরে’ …!”

সকাল সাড়ে সাতটায় কোনোরকমে অনুষ্ঠানটা শেষ করে ও স্টুডিও থেকে বেরিয়ে পড়ে। এখন আর বৃষ্টি পড়ছে না। হালকা হাওয়াতে গাছের পাতায় লেগে থাকা সকালের সেই ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির কয়েকটা ফোঁটা জল মাঝে মাঝে রাস্তায় পড়ছে। সায়নী গাড়ির জানালাটা দিয়ে সেই দৃশ্যগুলোই দেখতে থাকে। কিন্তু ওর চোখেমুখে এখনও যেন চিন্তার চিত্ররূপ ফুটে ওঠে। কপালের ভাঁজটা যেন আস্তে আস্তে আরও পুরু হয়ে ওঠে।

ও কি কিছু চিন্তা করছে?

একাত্তরের তিন, বক্সী লেনের তিন নম্বর গলিটা দিয়ে এসে ‘সহেলী আপার্টমেন্ট’-এর সামনে এসে থামলো গাড়িটা।

সায়নী, একমনে এখনো কিছু একটা চিন্তা করতে থাকে। ড্রাইভার রতন একবার ডেকে বলে, “ম্যাডাম, ‘সহেলী আপার্টমেন্টে’ এসে পড়েছি!”

কথাটা যেন কান অবধি পৌঁছয় না সায়নীর। সে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলে ওঠে, “চন্দন…মৃত…না, সেটা হয় কি করে? তাহলে আজ ভোরে ওটা কে ছিল…না! এ কিছুতেই হতে পারে না।”

আবারও রতন সায়নীকে বলে তারা ‘সহেলী আপার্টমেন্টে’ পৌঁছে গেছে, কিন্তু যথারীতি সায়নী কোনো উত্তর দেয়না। ও ওর কাজ অর্থাৎ সেই একটানা বিড়বিড় শব্দটা করতেই থাকে।

অবশেষে কোনো উপায় না পেয়ে, একটু গলাটা খাঁকিয়ে রতন সায়নীকে বলে তারা পৌঁছনোর কথা।

এতক্ষণে চমক ভাঙ্গে সায়নীর। সে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা দেয় আপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে।

রতন স্পষ্ট লক্ষ্য করে সায়নীর হাতটা রীতিমতো কাঁপছে।

সহেলী আপার্টমেন্টের সামনে এসে সায়নী দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে চন্দন সেনের রুম কোনটা?

দারোয়ান তাকে চন্দন সেনের রুমটা বলে দেয়। সায়নীও লিফ্টে ওঠার জন্য ওদিকে এগোচ্ছিল, ঠিক এমন সময় দারোয়ানটা আবার তাকে ডেকে বলে, ”এক্সকিউজ মি ম্যাডাম, প্লিজ এখানে একটু সাইন করে দিয়ে যান!”

সায়নী ফিরে এসে ঐ রেজিস্টার খাতাটায় সই করে আবার লিফ্টের উদ্দেশ্য যেতে থাকে।

দারোয়ানটা রেজিস্টার খাতাটায় সায়নী গুপ্তা নামটা দেখে একটু অবাক হয়ে যায়।

আটতলায় এসে একটা আওয়াজ করে লিফ্টের দরজাটা খুলে যেতেই সায়নী বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল চন্দন সেনের রুমের সামনে প্রচুর লোকের আনাগোনা, পুলিশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা সকলকে মানা করছে ঐ ক্রাইম সিনের মধ্যে যেন কেউ না যায়, মৃতদেহ যেন কেউ স্পর্শ না করে।

সায়নীর আর ইচ্ছা করল না ওখানে গিয়ে মৃতদেহটা দেখার। তবুও ওর মস্তিষ্কটা, শরীরকে ওদিকে যাবার জন্য নির্দেশ দিল। একটা ভাবলেশহীন, ফ্যাকাশে মুখ ও চেতনাহীন দেহ নিয়ে সায়নী এগিয়ে যেতে লাগল ঐ রুমের দিকে। দরজার কাছে এসে সে দেখল একটু ভেতরে ‘ক্রাইম সিন, ডু নট এন্টার’ দিয়ে ঘেরা স্থানের মধ্যে চন্দন সেনের প্রাণহীন অনড় দেহটা পড়ে রয়েছে।

দেহটা দেখা মাত্রই আঁতকে উঠে দরজার কাছ থেকেই দৌড়ে পালিয়ে গেল সায়নী। চন্দন সেনের গলার কাছটায় অনেকবার ছুরি চালানো হয়েছে। রক্তে ভেসে গেছে ক্রাইম সিনটা।

সায়নী কোনরকমে লিফ্টের কাছে এসে লাল বোতামটা চিপতেই লিফ্টের দরজাটা খুলে যায়।

সায়নীর কোনো একটা ভয়ে আতঙ্কে গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট অনুভব হয় ওর। গোলাপি ব্যাগটার সাইডের চেনটা থেকে ইনহেলারটা বার করে টানতে থাকে। কয়েক সেকেণ্ড পর একটু আরাম বোধ হয় ওর। কিন্তু পরমূহুর্তেই ওপাশে তাকিয়ে শিউরে ওঠে ওর সারা শরীর। একটা হীমশীতল স্রোত শিঁড়দারা বেয়ে নীচে নামতে থাকে। ওর হাত থেকে নীচে পড়ে যায় ইনহেলারটা। ওপাশে রক্ত মাখা হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে চন্দন সেন। তার গলা থেকে রক্ত যেন ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে। চন্দন সেন মুচকি হেসে সায়নীর উদ্দেশ্য বলে, “কি রে, আমাকে না দেখেই চলে যাবি? আমি তোর কি ক্ষতি করেছিলাম, কেন মেরে ফেললি আমায়?”

কথাগুলো লিফ্টের দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ভেসে আসছিল সায়নীর কানে।

হঠাৎই ওর চোখের মধ্যে একটা অন্ধকার জগত, মহাকালের শক্তির ন্যয় ভর করে বসল। ও দু’হাতে দু’কান ধরে গোঙাতে গোঙাতে বলে উঠল, “আমি ……..আ….মি…..মা……রি…..নি তোকে, আ…..মি”

কথাটা শেষ করার আগেই লিফ্টের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল সায়নী।

গ্ৰাউন্ড ফ্লোরে এসে লিফ্টের দরজা খোলার সাথে কাউকে বেরতে না দেখে সন্দেহ হয় দারোয়ানটির। সে ছুটে এসে দেখে লিফ্টের মধ্যে সায়নী অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে।

লিফ্টের দরজাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, দারোয়ান এসে পা দিয়ে দরজা আটকে দিয়ে কোনরকমে সায়নীকে ভেতর থেকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে এসে একটা চেয়ারে এনে বসাল।

তারপর দারোয়ানটা, একটা জলের বোতল থেকে জল নিয়ে ছেটাতে থাকে সায়নীর উদ্দেশ্য।

মিনিট খানেকের মধ্যেই সম্বিত ফিরে পেল সায়নী। চোখের পাতাটা হালকাভাবে খুলতে খুলতে সে শুনতে পেল কেউ তার উদ্দেশ্যে বলছে, “ম্যাডাম, আপনার শরীর এখন ঠিক আছে তো?”

এবার আস্তে আস্তে চোখটা মেলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল সায়নী। সে দেখল সেই নীচের দারোয়ানটা তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করছে যে সে ঠিক আছে কিনা?

সায়নী হাত দেখিয়ে, মাথাটা দু’বার নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ! আমি ঠিক আছি। আমাকে একটু জল দিন না! আর ওখানে আমার গাড়িটা দাঁড় করানো আছে, কাইন্ডলি একটু এদিকে আসতে বলবেন প্লিজ! ঐ যে মেরুন মারুতিটা।”

দারোয়ানটা তার হাতে জলের বোতলটা ধরিয়ে দিয়ে ঐ গাড়িটার দিকে এগিয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এসে বলে, “ম্যাডাম, গাড়িতে তো কোনো ড্রাইভার নেই!”

সায়নী দুর্বলচিত্তে কোনরকমে উঠে পড়ে চেয়ার থেকে।

দারোয়ানটা, সায়নীকে বলে “ম্যাডাম আপনি যেতে পারবেন তো?”

সায়নী কোনরকমে বলল, “হ্যাঁ!”

এরপর আস্তে আস্তে রাস্তাটা পেরিয়ে এসে সায়নী দেখল, রতন ওদিকে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে।

তাকে দেখে রাগে চেঁচিয়ে উঠে সায়নী বলল, “রতন, তোমাকে হাজার বার মানা করেছি গাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না, আর তুমি কিনা গাড়ি ছেড়ে দিয়ে সিগারেট ফুঁকে বেরাচ্ছ?”

রতন বলল, “ম্যাডাম, আমি তো এখানেই ছিলাম!”

– “ওহ! তাহলে কি দারোয়ানটা মিথ্যা কথা বলল? যাই হোক, নাও এখন চল!”

এতক্ষণের ঝগড়ার কথাগুলো ওপাশ থেকে ঐ দারোয়ানটা যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল।

এলগিন রোডের ধারে গাড়িটা এসে থামলো। এখানেই একটা একতলা বাড়িতে ভাড়া থাকে সায়নী। মাসিক ভাড়া চার হাজার টাকা। এই বাড়িতে সায়নী ছাড়াও আরো তিনজন থাকে। বাড়ির দরজাটা খুলে ভেতরে এসে সায়নী দেখল সুজাতা সোফার ওপর ঘুমোচ্ছে।

ফ্রিজ খুলে একবোতল জল বের করে ঢকঢক করে গিলে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ল সায়নী। তার মনে পড়ে যায় সেইদিনের কথাগুলো।

* * *

(২)

কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে প্রথম চন্দনকে দেখেছিল সায়নী। ছেলেটা ভীষণ চুপচাপ, চুলের কোনো স্টাইল নেই, একটা গোল চশমা পরে থাকে।

তবে চন্দনের যে গুণটা সায়নীকে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করেছিল সেটা হল ও ভীষণ সুন্দর গান করে এবং গান লেখে। ওর গানের গলা আর সুরের জাদুতে যেন এক লহমায় ছুঁয়ে ফেলেছিল সায়নীর হৃদয়কে। সেদিনের অনুষ্ঠানের পর সায়নী নিজেই মেকআপ রুমে এসে চন্দনকে জিজ্ঞেস করেছিল, “এই গানটা তুমি লিখেছ?”

অনুষ্ঠান শেষের পর একটা ছোট প্যাকেটে পাঁউরুটিআর মিষ্টি খাচ্ছিল চন্দন।

কোনো মেয়ে যে এভাবে এসে প্রশ্ন করবে সেটা সে হয়ত বুঝতে পারেনি। তাই প্রথমটায় একটু হকচকিয়ে গিয়ে সে আস্তে করে বলল, “হ্যাঁ! ভালো হয়নি না?”

– “কে বলল ভালো হয়নি? দিব্যি হয়েছে! আমি তো রীতিমতো তোমার ফ্যান হয়ে গেলাম!”

এই বলে সায়নী তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “সো! আজ থেকে আমরা বন্ধু!”

কাঁপা কাঁপা হাতটা সায়নীর উদ্দেশ্য বাড়িয়ে দিয়ে সে বলল, “আ…..মি চন্দন! আর তোমার নাম টা?”

– “ঠিক জানতে পারবে” এই বলে সায়নী চলে গেল সেখান থেকে।

জীবনে প্রথমবার কেউ হয়ত তাকে বুঝতে পেরেছে, তার সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কথাগুলো মনে হতেই একটা হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠল চন্দনের মুখে।

চন্দনের এই চুপচাপ থাকা, এত সাধারণ হয়ে থাকা এই বিষয়গুলোই সায়নীকে চন্দনের কাছাকাছি আনতে সাহায্য করেছিল।

আর চন্দনেরও বেশ ভালো লাগত সায়নীর চড়চড়-ফড়ফড় করে হরদম কথা বলাটা।

কলেজে বিশেষ কেউ চন্দনের সাথে কথা বলত না, কিন্তু সায়নী ছিল তার একমাত্র বন্ধু যে কিনা ওর পাশে বসতে কোন দ্বিধাবোধ করত না।

আস্তে আস্তে ওদের তুমি-আমি সম্পর্কটা ক্রমশ তুই-তো-কারিতে নেমে আসে। এরপর কলেজে না এসে একসাথে সিনেমা দেখতে যাওয়া, ক্যান্টিনে বসে আড্ডা মারা আরও কতকিছু!

এমনকি মাঝে মাঝে সায়নী নোট নেবার বাহানায় চন্দনদের বাড়িতেও আসতে শুরু করে।

চন্দনের এই সমস্ত অনুভূতি দিব্য লাগত। নিজের অজান্তেই মনের চোরাকুঠুরীর মধ্যে আবদ্ধ সেই অনুভূতি দিয়ে সে ভালোবেসে ফেলে সায়নীকে। সেও ভাবতে শুরু করে হয়ত সায়নীও হয়ত তাকে ভালোবাসে।

নিজের অনুভূতিগুলোকে আর চেপে রাখতে পারে না চন্দন।

একদিন টিফিন ব্রেকে ক্যান্টিনে বসে চন্দন, সায়নীকে বলে, “তোকে একটা কথা বলব, রাগ করবি না তো!”

– “ধুর পাগল! রাগ করব কেন?”

ধরা ধরা গলায় আস্তে আস্তে চন্দন বলে, “আ…মি…..আ.মি তোকে, তোকে…… খু..ব..ব ভা…লো…বা..সি!”

এহেন কথাটা যে চন্দন বলবে সেটা হয়ত অনুমান করেনি সায়নী।

সে উঠে দাড়িয়ে অবাক হয়ে বলল, “এই কথাটা তোর মুখ থেকে শুনব, কোনদিন ভাবিনি। আমি তোকে আমার সবথেকে ভালো বন্ধু মনে করি, কিন্তু…”

কথাটা শেষ না করেই ছুটে সেখান থেকে চলে যায় সায়নী।

তারপর দু’দিন ধরে সায়নী আর একটাও কথা বলেনি চন্দনের সাথে, পাশেও বসেনি।

নিজের মনের মধ্যের একটা অপরাধ বোধ ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। ওর বারংবার এটা মনে হচ্ছিল যে সে নিজের দোষেই তার সবথেকে প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছে।

তৃতীয় দিন ছুটির শেষে সায়নীকে একা বাড়ি যেতে দেখে চন্দন ওর কাছে এসে বলে, “আমায় ক্ষমা করে দে! আমি আর কোনদিন তোকে ঐ কথাটা বলব না! আর যাই করিস আমাদের মধ্যের বন্ধুত্বটাকে শেষ করে দিস না!”

সায়নী রেগে গিয়ে বলে, “আমার রাস্তা ছাড়! দেরী হয়ে যাচ্ছে!”

– “না! আগে তুই বল আমাকে ক্ষমা করেছিস, তবেই আমি রাস্তা ছাড়ব!”

নাছোড়বান্দা চন্দনের এই কথা শুনে অগ্যতা সায়নী বলে, “বেশ, আমি তোকে ক্ষমা করলাম! কিন্তু কোনদিন যেন এই সমস্ত কথা তোর মুখ থেকে না শুনতে পাই!”

সেদিনের পর থেকে ওদের দু’দিনের জন্য থমকে থাকা বন্ধুত্বটা আবার দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে।

দেখতে দেখতে নানা ওঠাপড়ার মধ্যে কেটে যায় তিনটে বছর। এখন সায়নীরও বেশ লাগে চন্দনকে। ওর মনে হয় সেই ফাস্ট ইয়ারে চন্দনকে ওভাবে বলে কতটাই না ভুল করেছে, এখন তো উল্টৈ সেই চন্দনকে ভালোবেসে ফেলেছে! ও ভাবে পরীক্ষার শেষের পর ওর বাড়িতে গিয়েই বলবে যে সেদিনের কাজটা তার ঠিক হয়নি। তার জন্য সে তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। সত্যি আজ প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে সায়নী অনুভব করে যে সে চন্দনকে কতটা ভালোবাসে!

কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠে না।

তারপর এতবছর ধরে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না চন্দনের সাথে সায়নীর। হঠাৎই কয়েকদিন আগে সায়নী যখন এফ.এম স্টুডিও থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে, ঠিক এমন সময় ফোনের নোটিফিকেশনের আওয়াজটা এক নিমেষে সায়নীকে মনে পড়িয়ে দেয় দশ বছর আগের একটা পুরনো টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি।

সে ফোনের লকটা খুলে দেখে ফেসবুকে তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে চন্দন সেন!

ওদিকে থানায় এতক্ষণে বেশ একটা ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেছে। এস.আই জগদীশ সবাইকে বলে দিয়েছেন এই হাই প্রোফাইল কেসটা যাতে তাড়াতাড়ি শেষ করা যায় সেই জন্য ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে একজন স্পেশাল অফিসার আসছেন আজ। তার রুমটা রেডি করা, কেস ফাইলগুলো রেডি করে রাখা, ফুলদানি দিয়ে রুমটা সাজানো, দরজা-জানালার ঝুল পরিষ্কার করতে করতে রীতিমতো কালঘাম ছুটছে তাদের। এস.আই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর যেন কোন ত্রুটি না হয়!

বেলা দেড়টা নাগাদ একটা জিপ এসে থামলো থানার সামনে। জিপ থেকে বেরিয়ে এলেন ক্রাইম ব্রাঞ্চের স্পেশাল অফিসার শুভঙ্কর সান্যাল!

থানার সামনেটায় কনস্টেবল রথীন, এস.আই জগদীশ ও আরও দু’জন অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন। জগদীশের হাতে একটা ফুলের তোড়া আর কনস্টেবল রথীনের হাতে একটা গাঁদা ফুলের মালা।

শুভঙ্কর এগিয়ে আসতেই ফুলের তোড়া তার হাতে দিয়ে স্বাগতম জানালেন জগদীশ। সঙ্গে সঙ্গে কনস্টেবল রথীনও গাঁদা ফুলের মালাটা পড়িয়ে দিলেন শুভঙ্করের গলায়।

শুভঙ্কর একটু মুচকি হাসল। তারপর মালাটাও ফুলের তোড়াটা রথীনের হাতে দিয়ে বললেন, “মালাটা রেখে দাও! কিন্তু তোড়াটা যাবার সময় আমকে দিয়ে দিও!”

এস.আই জগদীশ তার উদ্দেশ্যে বলল, “এই যে স্যার! এদিকে এগিয়ে আসুন!”

তারপর আলতো করে হেসে সে বলল, “বুঝতেই তো পারছেন স্যার! ঐ কম বাজেটের মধ্যে যেটুকু পেরেছি আর কি!”

রুমে ঢুকে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন শুভঙ্কর। চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন, বাঃ! ঘরটা বেশ ভালো করে পরিষ্কার করা হয়েছে।

জগদীশ প্রশ্ন করল, “স্যার! আপনার আসতে এত দেরি হল যে!”

পকেট থেকে রুমাল বের করে হাত মুছতে মুছতে শুভঙ্কর বলল, “আসলে আজ শনিবার, তাই মেয়েটার স্কুল আজকে একটায় ছুটি হয়ে গিয়েছিল, তাই ওকে রেখে দিয়ে এলাম!”

– “হ্যাঁ! স্যার! আপনার স্ত্রীর ব্যাপারটা শুনেছিলাম। সো স্যাড!” এই বলে একটা হাই নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন জগদীশ।

শুভঙ্কর হয়ত কিছু বলতে চেষ্টা করছিল! কিন্তু সেটা না বলে সে বলল, “আচ্ছা! কেসের আপডেট কিরকম?”

– “বলছি স্যার!” এই বলে একবার চেঁচিয়ে সে বলে উঠলো, “কই রে? কে কোথায় আছিস স্যারকে একটু ঠাণ্ডা দিয়ে যা!”

কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই একটা বছর পনেরোর ছেলে কোল্ড্রিংকসের একটা বোতল নিয়ে ঢুকল। মনে হল ছেলেটা অনেকক্ষণ থেকেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে নির্দেশের অপেক্ষা করছিল।

এবার জগদীশ বলতে শুরু করল, “স্যার! ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী খুনটা হয়েছে রাত দু’টো থেকে তিনটের মধ্যে। খুনি যে কোনো এক্সপার্ট তা অনুমান করা যায় তার খুন করার পদ্ধতি দেখে। খুব নিখুঁতভাবে এগজাক্টলি গলার নলিটা কাটা হয়েছে, তারপর ভিক্টিমের মৃত্যুর পরও নিজের ক্ষোভকে জাহির করতেই আরো ছুরিকাঘাত করেছে খুনি।”

শুভঙ্কর জিজ্ঞেস করল, “কোন সাসপেক্ট?”

জগদীশ একটু ভেবে নিয়ে বলল, “কাল রাতে ওনার রুমে রাত দশটা নাগাদ একটা লোক এসেছিল। সি.সি.টি.ভি ফুটেজে তার চেহারা দেখা যায়নি। কারণ স্যুট-বুট পরা লোকটির মাথায় কালো টুপি, চোখে কালো চশমা আর মুখ মাক্সে ঢাকা ছিল।

কিন্তু রাত দু’টো থেকে লোডশেডিং হয়ে যায়। ফলে তারপরের কোনো ফুটেজ পাওয়া যায় নি। ঠিক সেই সময় সেই লোকটি চলে যান। কিছুক্ষণ পরে কিছু একটা মনে হতেই দারোয়ান দেখে যে মেইন সুইচটা কেউ বন্ধ করে দিয়েছে। এই আধঘন্টার মধ্যেই হয়ত লোকটি পালিয়ে যায়। কারণ দারোয়ান তাকে ঢুকতে দেখলেও বেরোতে দেখেনি।

শুভঙ্কর বলল, “তার মানে ঐ লোকটাই যে খুনি সেটা আন্দাজ করা গেলেও সঠিক ভাবে বোঝার কোনো উপায় নেই।

আচ্ছা! আর কোনো প্রমাণ পাওয়া গেছে? সেই ছুরি বা কোন হাতের ছাপ কিংবা জুতোর ছাপ! আর ঐ উইকিপিডিয়ার ব্যপারটা?”

জগদীশ বলল, “না! স্যার! আমাদের ফরেনসিক এক্সপার্টদের মতে খুনি হাতে গ্লাভস আর পায়ে রাবারের জুতো পরেছিল, আর ছুরিটা হয়ত খুনি নিজের সঙ্গে নিয়ে গেছে।

সেই রাতে রাত দু’টো পনেরোর সময় ওনার ফোন থেকে ওনার উইকিপিডিয়ার পেজে ডেড লেখা হয়, আর সেটা ঐ আই পি আড্রেস ট্রেস করেই জানা গেছে।”

শুভঙ্কর আস্তে করে বলল, “স্ট্রেইনজ! খুনি এত বুদ্ধিদীপ্ত দিয়ে খুন করছে, তার মানে ইট ওয়াজ এ প্ল্যান্ড মার্ডার! ঠিক আছে যতই সে বুদ্ধিজীবী হোক না কেন ধরা তাকে পড়তেই হবে। কোনো হত্যাই নিঁখুত নয়! আচ্ছা, মৃতের ফোন থেকে আর কিছু পাওয়া গেছে?”

– “আসলে স্যার! ফোনটা ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কাছে আছে ওরা ডেটা কালেক্ট করে কালকের মধ্যে জানাবে বলেছে।”

শুভঙ্কর আবার কিছু একটা ভেবে জগদীশকে বলল, “মৃতের বাড়ির লোকদের খবর দেওয়া হয়েছে? আর ওর ফ্ল্যাটে আশেপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন?”

জগদীশ একটু কেশে গলা খাঁকরিয়ে বলল, “মৃতের ফ্ল্যাটের আশেপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। সকলের মতে আজ চারবছর ধরে এই ফ্ল্যাটে আছেন চন্দন সেন, কিন্তু ওর মতো ভদ্র, নেশাহীন লোক আর দু’টো দেখা যায় না। আর ওর মা বাবা থাকেন রাজনগর কলোনীতে। কলকাতা থেকে ঐ চল্লিশ কিলোমিটারের রাস্তা। ওনাদের খবর দেওয়া হয়েছে। ওনারা এসে পড়বেন।”

শুভঙ্কর আবার জগদীশের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা! পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কখন পাওয়া যাবে?”

– “কাল বিকালের মধ্যেই স্যার!”

এরপর জগদীশ চলে যেতেই ক্লান্ত শরীরে রুমালটা চোখে ঢাকা দিয়ে গা এলিয়ে দিল শুভঙ্কর।

ঘন্টাখানেকের মধ্যেই থানায় এসে উপস্থিত হলেন চন্দন সেনের বাবা-মা। খুব কান্নাকাটি করছিলেন দু’জনেই।

ওনাদের কাছ থেকে একটা ব্যপার জানা গেল। চন্দন সেনের স্কুলে কোন বন্ধু ছিল না, কোন শত্রুও ছিল না। কিন্তু কলেজে উঠে একটা মেয়ের সঙ্গে ওর ভীষণ বন্ধুত্ব হয়।

মেয়েটির নাম ছিল দেবযানী। দেবযানী দারুণ গল্প লিখত। কারোর লেখায় এমন কিছু ক্ষমতা থাকে যা মনকে ছুঁয়ে যেতে পারে, দেবযানীর লেখায় সে রকম ক্ষমতা ছিল।

চন্দনের বাবার একটা প্রেস ছিল। দেবযানী, চন্দনকে তার একটা লেখা ছাপতে দিয়েছিল। চন্দনের গল্পটা পড়ে বেশ ভালো লেগে যায়। বইটা ছাপানোও হয়, কিন্তু লেখকের স্থানে নাম দেওয়া হয় চন্দন সেন!

কিন্তু সেদিনের পর থেকেই একটু আবনর্মাল বিহেব করতে থাকে চন্দন।

চন্দন সেনের মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে উঠলেন, “সেদিনের পর থেকেই ওর নামডাক হতে থাকে! ও নিজের লেখার জন্যই আমাদের ছেড়ে এই ফ্ল্যাটে একা থাকতে শুরু করল!

কেন কেন কেন ও এখানে থাকতে গেল? এখানে ওর কোন শত্রু ছিল না, থাকলে আমাদের বলত! ঐ হাড়-হাভাতে, হতচ্ছাড়ি মেয়েটাই খুন করে দিল গো আমার ছেলেটাকে………….”

শুভঙ্কর জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “শান্ত হন! শান্ত হন মিসেস সেন!”

আমাদের জীবনে মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার কোনো যুক্তি থাকে না। যেমন আমাদের চোখের মধ্যে দেখা যে কোনো দৃশ্য মস্তিষ্কের মধ্যে তার একটা উল্টানো দৃশ্য তৈরী হয় বা ধরুন একজন হাই তুললে পাশে থাকা অন্য আরেকজনও হাই কেন তোলে বলুন তো? পুরোনো দিনের কথাগুলো মনে করতে করতেই কখন যে টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সায়নী, সে বুঝতেও পারেনি। কখন যে বেলা পড়ে সন্ধ্যের সূত্রপাত হয়েছে কে জানে?

হঠাৎ করে তার ঘুমটা ভাঙ্গল ফোনের রিংটোনটা কানে আসতেই। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে, হালকা তন্দ্রাভাবসহ সে বলে উঠলো, “হ্যালো…….কে?….কে বলছেন?”

ওপাশ থেকে একটা বছর চল্লিশের এক ব্যক্তির আওয়াজ ভেসে এলো, “হ্যালো, সুস্মিতা? আমি ডক্টর রায় বলছি!”

– “সরি! আমি সায়নী! রং নম্বর!” ঘুম জড়ানো গলায় বলল সায়নী।

– “ওহ! সায়নী আমি চিরজ্ঞীব রায়! শোন না তোমাকে আগের সপ্তাহে যে ওষুধটা দিয়েছিলাম, তার ডোজটা একটু বাড়াতে হবে। আমি আজ থাকছি না, তোমার আপয়ন্টমেন্টটা পরশুদিনে শিফ্ট করে দিলাম!”

– এবার গলাটা বেশ জোড় দিয়েই সে বলল, “ওহ! ডাক্তারবাবু! আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে।

ফোনটা কেটে দিয়ে সায়নী উঠে গিয়ে লাইটটা জ্বালিয়ে দেখল, সুজাতা কখন চলে গেছে কে জানে?

ডাক্তারবাবু যে ঐ ওষুধটার ডোজটা বাড়াতে বললেন, ওষুধটার নাম কি ছিল সেটা একেবারেই ভুলে গেছে সায়নী। প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে, কিছু ওষুধও নেই।

ডাক্তার রায় যে ওষুধটা তাকে আগের সপ্তাহে দিয়েছিলেন, সেই প্রেশক্রিপশনটা খুব সম্ভবত তার ব্যাগেই আছে।

সে তাড়াতাড়ি ব্যাগটা তাড়াতাড়ি কোলের ওপর তুলে সাইডের চেনটা খুলে ভেতরে হাতরাতে লাগল।

হঠাৎই একটা অজানা ব্যথায় আহত হয়ে ‘আঁও’ চেঁচিয়ে উঠে বলল, “এটা কি?”

তার ডান হাতের তর্জনীর ডগাটা কেটে রক্ত বেরোতে লাগলো।

সায়নী‌; ব্যাগের ঐ সাইডের অংশটা থেকে বের করল, একটা সাদা রুমাল দিয়ে হাতল ঢেকে রাখা একটা শুকনো রক্ত মাখা ছুরি।

* * *

(৩)

পরের দিন সকালে একটা ফোন আসতেই ঘুমটা ভেঙে গেল শুভঙ্করের। দাঁত খিমচিয়ে হাই তুলতে তুলতে ঘুম জড়ানো চোখেই ফোনটা ধরল সে।

ওপাশ থেকে ভেসে এলো কনস্টেবল রথীনের গলা।

– “স্যার! আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন! আজ সকালে চন্দন সেনের ফোনের সমস্ত ডেটা কালেক্ট করে ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে ওনার মারা যাবার কয়েকঘন্টা আগেই একটা নম্বরে অনেকবার ফোন করা হয়েছে। আমরা নম্বর ট্রেস করে জানতে পেরেছি তার নাম ‘সায়নী গুপ্তা’!”

– “আচ্ছা! চন্দন সেনের কললিস্টে কি আর কোনো নম্বর আছে যেটা দেখে সন্দেহ হয়?”

– “না স্যার! চন্দন সেন কয়েকজন পাবলিকেশন্স আর বাবা-মা ছাড়া অন্য কোনো বন্ধু-বান্ধবের নম্বর পাওয়া যায় নি। বিশেষ কারোর সাথে যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু এই নম্বরে গত একমাস ধরে অনেকবার ফোন রিসিভ এবং ডায়াল করাও হয়েছে।

ফোনটা কাটার আগে শুভঙ্কর বলল, “হুম! আমি আসছি।”

ফোনটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে জানালাটা খুলে শুভঙ্কর তাকিয়ে দেখল, একটা ছোট শালিক পাখি কার্নিশে বারবার ঠোঁট দিয়ে ঘষছে। বড় ভালো লাগছে দৃশ্যটা দেখতে। একটা মিষ্টি সুরেলা ও শান্ত প্রাতঃকালের বাতাস ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেছে। শুভঙ্করের মনের ফাঁকে উঁকি দিয়ে যায় আট বছর আগের একটা পুরনো স্মৃতি।

তখন শুভঙ্কর সবে সবে নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। তখন ওর পোস্টিং ছিল রাজনগর কলোনীতে। বাবা-মায়ের ইচ্ছেতেই বছর খানেকের মধ্যেই শুভঙ্কর বিয়ে করে সৌমিলীকে। সৌমিলী ভীষণ শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের মেয়ে। ও পারতপক্ষে খুব কম কথা বলত। শুভঙ্করকে ও বেশ ভয় করত, ওর পুলিশি মেজাজের জন্য। কিন্তু তা বলে যে সে শুভঙ্করকে ভালোবাসত না, তা কিন্তু নয়।

সৌমিলী ভীষণ যত্ন করত ওর প্রতিটা সময়। ও কি খাবে, ও কি পরবে?

একবছরের মধ্যেই সুন্দর একটা ফুটফুটে মেয়ে হয় তাদের। সৌমিলীর খুব আদরের মেয়ে মিঠি। অপারেশন থিয়েটারে বাঁচার কোন আশা ছিল না সৌমিলীর। ডাক্তার তো বলেই দিয়েছিল, হয় মা বাঁচবে না হয় বাচ্ছা।

সেই সময় বাড়ির সকলের খাওয়া দাওয়া, ঘুম উড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে সময় হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকেনি শুভঙ্কর। সবসময় পড়ে থাকত হসপিটালের ভেতর ঐ রাধা গোবিন্দের মূর্তির সামনে। টাকার কোনো ক্রটি রাখেনি ও।

অবশেষে যেদিন ডাক্তারবাবু এসে ওর কোলে ওদের ছোট্ট মিঠিকে তুলে দিয়েছিল, সেদিন একনিমেষে এতদিনের দুঃখ কষ্ট সমস্ত কিছুই ভুলে গেছিল শুভঙ্কর। সৌমিলীর খুব কষ্টের সন্তান ছোট্ট মিঠি। স্বামী, সন্তান নিয়ে দিব্য ছিল সৌমিলী।

কিন্তু সুখ যে বেশীদিন স্থায়ী হয় না। একদিন ঝড় বৃষ্টির সকালে শুভঙ্কর উঠে দেখল, সৌমিলী ড্রেসিং টেবিলে বসে একটা নতুন শাড়ি পরে সাজছিল। শুভঙ্কর পেছন থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, “কি গো, এত সকালে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ বুঝি?”

সৌমিলী উঠে শুভঙ্করের কপালে একটা ঠোক্কর মেরে বলেছিল, “আমার পাগল বরটা! তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও গিয়ে শান্তি পাব বুঝি?”

কথাটা কিন্তু মজা করেই বলেছিল শুভঙ্কর। কিন্তু সেটাই যে সত্যি হয়ে যাবে কেউ বোঝেনি। সেদিন আর সৌমিলীর ফেরা হয়নি। ঘরে ফিরে এল সৌমিলীর অগ্নিদগ্ধ মৃতদেহটা।

সেদিনের কথাটা মনে হতেই শুভঙ্করের চোখটা জলে ভরে উঠলো। ও মিঠির ঘরের কাছে এসে দেখল, মিঠি আরামে ঘুমোচ্ছে। একমাত্র মিঠিই তো হল তার কাছে সৌমিলীর শেষ স্মৃতি। ও নিজের মনেই বলে উঠল, খুব তো বলেছিলে আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না, এখন তো বেশ আছো। লাইফ ইজ আনস্টপেবল।

ঐ ঘটনার পর শুভঙ্কর ঐ ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে কলকাতায় ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসে। এখানে একটা বাড়িতে শুভঙ্কর, মিঠি আর মিঠিকে দেখাশোনা ও কাজকর্মের জন্য একটা মেয়ে থাকে। মায়ের অভাব কোনোদিন ছোট্ট মিঠিকে বুঝতে দেয়নি শুভঙ্কর। মেয়ের প্রতিটি আবদার সে যথাযোগ্যভাবে পালন করে।

শুভঙ্কর চলেই যাচ্ছিল এমন সময় ও দেখল মিঠি কুঁকড়ে শুয়ে আছে। ওপাশের জানালাটা খোলা। জানালাটা দিয়েই সকালের মিষ্টি বাতাস ঘরের ভেতরে এসে ঘুমন্ত মিঠিকে ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে শুতে বাধ্য করেছে।

না! এতো ভারি অন্যায়! মুচকি হেসে শুভঙ্কর মিঠির গায়ে চাদরটা টেনে দিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিল‌। আজ, রবিবার ঘুমোক মেয়েটা।

শুভঙ্কর থানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। গাড়িতে যেতে যেতে এফ.এম টা লাগিয়ে শুভঙ্কর ‘আমার শহর’ অনুষ্ঠানটা শুনছিল। বদ্ধ গাড়িতে ওর বরাবরই দমবন্ধ হয়ে আসে এরকম অনুভুতি হয়। তাই কাঁচটা নামিয়ে একবার বাইরে তাকিয়ে ও দেখল সূর্যটা সবে উঠতে শুরু করেছে, লাল আভাটা চারিদিকে দিগন্তব্যপী সমুদ্রের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।

হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই ও রাস্তার একপাশে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে মন দিয়ে একটা জিনিস শুনছিল। প্রায় মিনিট দু’য়েক সেটা শোনার পর, ও মনে মনে বলে উঠল, “আরে..এর নামও তো? কিন্তু এই গলাটা ভীষণ চেনা।”

মিনিট দু’য়েক ধরে যেটা শুনে ও অবাক হয়ে গাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়েছিল সেটা আর কিছুই নয়, ‘আমার শহর’ অনুষ্ঠানের হোস্ট সায়নীর, “আপনারা শুনছেন আপনাদের প্রিয় শো আমার শহর, আপনাদের সাথে আমি সায়নী…!” এই কথাগুলো।

থানায় এসে শুভঙ্কর, রথীনকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ঐ সায়নী নামের মেয়েটির কোনো ঠিকানা পাওয়া গেছে?”

রথীন কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, স্যার! আমরা জানতে পেরেছি যে মেয়েটার বাড়ি, শিমূলনগর, রামহরিপুর।”

“আর এখানে মেয়েটা কোনো কাজ-টাজ করে?” শুভঙ্কর, রথীনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল।

রথীন বলল, “বলতেই ভুলে গেছিলাম, ভাগ্যিস জিজ্ঞেস করলেন স্যার! মেয়েটা একটা প্রাইভেট এফ.এম কোম্পানিতে রেডিও জকির কাজ করে। বেশ ফেমাস স্যার, আরে প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে যে অনুষ্ঠানটা এফ.এম এ হয় না সেটাই তো ও করে। আমার স্ত্রী তো ওর বিশাল ফ্যান।”

রথীনের শেষের কথাগুলো কানে এলো না শুভঙ্করের। সে মনে মনে ভাবল, তার মানে তার আইডিয়াটাই ঠিক। এই মেয়েটাই তবে ‘আমার শহর’ অনুষ্ঠানের হোস্ট সায়নী গুপ্তা।

একবার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে শুভঙ্কর দেখল, সাড়ে সাতটা বাজছে। সে বলল, “বেশি সময় নেই, আমাদের তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।”

আবার একটু গলা হাঁকড়িয়ে সে বলল, “স্যার! একটু চা-বিস্কুট নিয়ে আসি?”

– “খাবার সময় নেই রথীন, তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করতে বল! ‘আমার শহর’ অনুষ্ঠান শেষ হয় সাড়ে সাতটায়। অনুষ্ঠান শেষ হলেই মেয়েটা ওখান থেকে বেরিয়ে যাবে!”

এই কথাগুলো বেশ জোরেই বলে ফেলেছিল শুভঙ্কর। কাজও হল তেমনি। রথীন ছুটে গেল গাড়ি বের করতে। তার এক নিমেষে সকালের চা- বিস্কুট খাবার রোজকার রুটিনটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

সকাল হোক বা রাত কলকাতার রাস্তায় জ্যাম লেগে থাকা খুবই সাধারণ ব্যপার। থানা থেকে স্টুডিও মাত্র মিনিট কুড়ির পথ, সেখানে ওরা যখন স্টুডিওর সামনে এসে থামলো তখন ঘড়িতে বাজছে আটটা দশ। গাড়ি থেকে নেমে শুভঙ্কর দেখল সামনে কল্পতরু আপার্টমেন্ট। পাঁচ তলায় এফ.এম স্টুডিওটা। শুভঙ্কর ছুটে কোনরকমে রাস্তা পার হল, পেছনে রথীন ও আরও দু’জন কনস্টেবল। লিফ্ট আসতে দেরী দেখে ওরা ছুটল সিঁড়ি বেয়ে।

ওপরে উঠে এসে স্টুডিওর ভেতরে ঢুকে রিসেপশনে বসে থাকা মেয়েটিকে, শুভঙ্কর হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল, “সা….সা..য়নী গু..প্তা আছেন…!”

মেয়েটা যে উওরটা দিত, সেটা আগে থেকেই হয়ত প্রত্যাশিত ছিল শুভঙ্কর ও রথীনের। কিন্তু তার বদলে মেয়েটি যা উওর দিল, তা শুনে শুভঙ্কর মাথাটা চেপে ধরে ওপাশের সোফায় বসে পড়ল!

মেয়েটি বলল, “না, স্যার! কিন্তু আপনারা কে?”

শুভঙ্কর পকেট থেকে আই কার্ডটা বার করে বলল, “শুভঙ্কর সান্যাল! ক্রাইম ব্রাঞ্চ!”

“সায়নী ম্যাডাম চলে গেছেন। ওনার আজ শেষ শো ছিল।”

তাহলে এতদূর আসা ওদের বিফলে গেল!

কিছুক্ষণ পর রথীন মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, “ওনার কোন ছবি আছে আপনাদের কাছে?”

মেয়েটি এবার একটা প্রত্যাশিত উওর দিল।

সে বলল, “হ্যাঁ স্যার! আমাদের ডেটাবেসে এমপ্লয়ীদের ছবি আছে, এক্ষুনি দিচ্ছি!”

রথীনও আবারও মেয়েটির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল, “ওনার বাড়ি কি এখানেই?”

চোখের সামনে থাকা চুলটাকে সরিয়ে সে বলল, “না, স্যার! আমাদের একটা অন্য ব্রাঞ্চ ছিল রামহরিপুরে। সেখান থেকে উনি ট্রান্সফার নিয়ে এখানে এসেছিলেন।”

– “আচ্ছা! এখানে উনি কোথায় থাকতেন, সেই ঠিকানাটা একটু পাওয়া যাবে?”

মেয়েটা ছবিটা প্রিন্ট আউট করে আর ঠিকানাটা একটা ছোট কাগজে লিখে রথীনকে দিল ঐ রিসেপশনের মেয়েটা।

শুভঙ্করের কিছু একটা মনে হতেই সে বলল, “আচ্ছা ওনার টেবিলটা কোথায়?”

মেয়েটা সায়নীর ডেক্সটা দেখিয়ে দিল। টেবিলের কাছে এসে সে দেখল গোটা টেবিলটা ফাঁকা, কিছুই নেই! এমন সময় ওর চোখে পড়ল, টেবিলের একটা কোণে ছোট মতন করে লেখা রয়েছে EGGLAPS! লেখাটা কোণের দিকে এমনভাবে লেখা যে কারোর চোখে খুব সহজে পড়বে না। শুভঙ্কর লেখাটার ওপর হাত দিয়ে দেখল হালকা কাশি উঠছে অর্থাৎ লেখাটা খুব একটা পুরনো নয়।

কখন যে রথীন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, শুভঙ্কর বুঝতেই পারেনি। সে ঝুঁকে পড়ে দেখে বলল, স্যার! এটা কি লেখা? EGGLAPS, তার মানে ডিমের কোল? এই বলে হো হো করে হেসে উঠলো। শুভঙ্কর অবশ্য কিছু বলল না। বাইরে এসে রিসেপশনে বসে থাকা মেয়েটিকে শুভঙ্কর বলল, “ওনার ডেস্কের ওপরের সি.সি.টি.ভি ফুটেজটা একটু দেখান প্লিজ!”

মেয়েটি কয়েকবার মাথা চুলকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কি খুঁজছেন বলুন তো?”

– “আমরা সাহিত্যিক চন্দন সেনের মার্ডার কেসটার তদন্ত করছি! আপনি তাড়াতাড়ি করুন প্লিজ!”

এবার মেয়েটি শুভঙ্করের কথা শুনে তৎক্ষনাৎ উঠে গিয়ে তাদের কন্ট্রোল রুমের দিকে নিয়ে গেল।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই একটা ফুটেজটা চালানো হল। দেখা গেল একটা কালো ওরনা দিয়ে ঢাকা মেয়েটি অনুষ্ঠান শেষ করেই তার সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে রওনা দিল। তার মুখটা বোঝা না গেলেও তার হাঁটাচলার ভঙ্গিটা শুভঙ্করের ভীষণ চেনা চেনা ঠেকলো।

গাড়িতে উঠে রথীন, শুভঙ্করকে প্রশ্ন করল, “স্যার! আপনি সায়নীকে এত সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেন? এমনটাও তো হতে পারে যে চন্দন সেনের একজন ফ্যান ছিল বা ওদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল?”

শুভঙ্কর বলল, “হুম! হতেও পারে আবার নাও হতে পারে!”

রিসেপশনের মেয়েটার কাছ থেকে ওরা এলগিন রোডের ধারের সেই বাড়ির ঠিকানাটা পেয়েছিল। আধঘন্টার মধ্যেই ওরা ঐ বাড়ির সামনে এসে দেখল তারা ঝুলছে। একটা বুড়ো লোক ভীষণ চিল্লাচিল্লি করছে।

– “বদমাশ মাইয়া আইসা জুটছে কপালে। ভাড়া দেওনের বেলা আর মুখ দেখাতে মন চায় না।”

শুভঙ্কর বাড়ির সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, “দাদা, সায়নী কি এখানে থাকে?”

লোকটা মেজাজে ঘুরে বলল, “কেডা আপনে? ওরে নিয়ে আপনার কি কাম? আপনারও টাকা ঝেরে দিইসে বুঝি?”

– “আজ্ঞে না, আমরা ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে এসেছি, একটা মার্ডার কেসের ব্যপারে!”

শুভঙ্করের মুখ থেকে এহেন কথাটা যে শুনবে সেটা ঐ বুড়ো লোকটা ভাবতেও পারেনি। তার মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, “মার্ডার!”

– “আচ্ছা! সায়নী কেমন মেয়ে?”

বুড়ো লোকটা কি ভাবতে ভাবতে বলল, “আঁ…হাঁ! একটা পাগল মেয়ে!”

– “মানে?”

বুড়ো লোকটা আবার বলল, “দেখুন না আমি একটা একা মেয়ে, কোথায় যাব এই ভাইবা বাড়ি ভাড়া দিয়াছিলাম, কিন্তু ওর সাথে দেখা হলেই বলত, ওর সাথে নাকি সুজাতা, সুমি আর মন্দিরা নামে আরও তিনটে মাইয়া থাকত। অথচ এই অঞ্চলে ঐ তিনজন মহিলাকে কেউ দেখেইনি। এই যে আইজকেই আমাকে যাবার সময় আমার বাড়িতে এসে বলল, বাড়ি ভাড়াটা সুজাতার কাছে রাইখা আছে। অথচ আইসা দেখি কেউ নাই, বাড়ি তালা মারা।”

– “দাঁড়ান দাঁড়ান, চলে গেল মানে কোথায়?”

লোকটা আবার মেজাজে বলল, “আইজ ওর গাড়িটা নিয়ে কোথায় চইলা গেল, বলতে পারব না!”

– “ওর গাড়ির নম্বরটা জানেন?”

– “না! কোনোদিন সেইডা দেখার প্রয়োজন মনে করি নাই!”

– “আচ্ছা! ও কোথায় যেতে পারে জানেন?”

– “আইজ্ঞে না! তবে ও এইখানে একজন ডাক্তারকে দেখাইতো। তার ঠিকানাটা কি আর লাগব আপনার?”

সায়নী এতক্ষণে অনেকটা দূর চলে এসেছে শহরতলি থেকে। ওর চোখেমুখে কেমন যেন একটা চিন্তার ছাপ! কপালে একটা চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে তার। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে সে সামনে তাকিয়ে দেখল একটা অল্পবয়সী ছেলে সাইকেলের বেল বাজিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে, কিন্তু ছেলেটা গাড়ির এতটাই কাছে এসে পড়েছে যে আর কোন উপায় নেই। সায়নী চিৎকার করল, “রতন ব্রেক মার…!” একটা জোরে ব্রেক কষা হল, রাস্তার ওপর চাকার একটা ঘষার শব্দ ভেসে এলো। হঠাৎই একটা আর্তনাদ। ছেলেটা ছিটকে পড়ল রাস্তার ওপরে। গাড়ির স্টিয়ারিং এ মাথাটা গুঁজে পড়ে গেল সায়নী।

কয়েকটা লোক এসে রাস্তা থেকে ছেলেটাকে টেনে তুলল। ছেলেটার সাইকেলের সামনের মাডগার্ডটা ভেঙে গেছে, কিন্তু তার বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় নি শুধু মাত্র তার পা টা আর হাতের কিছু অংশ ছিঁড়ে গেছে।

সেই লোকগুলো গাড়ির দরজাটা খুলে সায়নীকে টেনে হেঁচড়ে বার করল। সায়নী বলল, “র….ত…ন র..তন।”

লোকগুলো জিজ্ঞেস করল, “কে … কে রতন?”

সায়নী অস্পষ্টস্বরে বলল, “আ….মা..র ড্রা..ই, ড্রাই…ভার।”

ভেতরে তাকিয়ে কাউকেও দেখতে পেলনা লোকগুলো।

মুখে কিছু একটা বিড়বিড় করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল সায়নী।

ওদিকে সেই বুড়ো লোকটার কাছ থেকে সেই ডাক্তারের ঠিকানাটা নিয়ে শুভঙ্কর, রথীন ও আরও দু’জন কনস্টেবল এসে পৌঁছলো শংকর স্ট্রীটে ডঃ রায় এর চেম্বারে।

ডাঃ চিরজ্ঞীব রায় পেশায় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। কিন্তু তার কাছে সায়নী আসবে কেন?

* * *

(৪)

চেম্বারে ঢুকেই রথীন বাইরে বসে থাকা ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল, “ডাক্তারবাবু কোথায়?”

ছেলেটির বয়স খুব একটা বেশি নয়, ঐ ছাব্বিশ-সাতাশ হবে। ছেলেটি একবার রথীনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপয়েন্টমেন্ট আছে?”

রথীন স্বাভাবিক ভাবে বলল, “না! একটু ওনার সাথে দরকার আছে!”

বাইরে একটা মহিলা আর একটা বৃদ্ধ বেঞ্চে বসে আছে। বাইরে এরকম পরিস্থিতি হয়ত বুঝতে পেরে ডাঃ চিরজ্ঞীব রায় বাইরে বেরিয়ে এলেন।

শুভঙ্কর ওদিকে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। রাস্তায় কয়েকটা বাচ্চা ছেলে খেলা করছে।

হঠাৎ চিরজ্ঞীব রায় বললেন, “কি হয়েছে এখানে?”

কথাটা রথীন শুনতে পায়নি, সে এতক্ষণে ঐ ছেলেটির সাথে রীতিমতো ঝগড়া জুড়ে দিয়েছে। শুভঙ্কর এবার এদিকে তাকাতেই ডাঃ চিরজ্ঞীব রায় বললেন, “আরে শুভ! তুই এখানে?”

শুভঙ্কর এবার সিগারেটটা বাইরে ফেলে দিয়ে বলল, “সরি! ঠিক চিনতে পারলাম না!”

ডাঃ রায় বললেন, “আরে! আমি টুলু! আমরা এক স্কুলে পড়তাম, তোর দু’টো বাড়ির পরে আমাদের বাড়ি ছিল।”

এবার শুভঙ্করের মুখেও একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল, “ওহ! টুলু তুই! আরে তুই যে শালা এতবড়ো ডাক্তার হয়েছিস, জানতামই না! সেই যে ক্লাস টেনের পর কাকুর চাকরির জন্য কোথায় চলে গেলি, তারপর তো আর কোনো পাত্তাই নেই তোর, তারপর তোর কোনো ঠিকানাও ছিল না, আর এই দাঁড়িগোঁফে তো তোকে আরও চেনাই যাচ্ছে না।”

অল্পবয়সী ছেলেটি হাঁ করে ডাঃ রায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল, তার হয়ত বিশ্বাস হচ্ছিল না যে ডাক্তারবাবুর এরকম একটা নাম আছে বা তাকে কেউ শালা বলে সম্বোধন করছে। তার এই হাঁ মুখ দেখে রথীন ছেলেটার কানের কাছে এসে বলল, “মুখের সাটারটা নামাও না হলে তো মাছি ঢুকে পড়বে!”

ওদিকে ডাঃ রায় হেসে বলল, “ও! কিন্তু তোর সেই একই মুখ রয়ে গেছে। তাহলে, মনে পড়ল আমাকে‌। সেই তুই আমাকে শালা বলতিস আর আমি বলতাম, বানাবি?” কথাটা বলে ডাঃ রায় ততটা না হাসলেন তার থেকে বেশি হাসির শব্দ পাওয়া গেল শুভঙ্করের মুখ থেকে।

এবার ডাঃ রায় বললেন, “দেখছিস! বাইরেই দাঁড় করিয়ে রেখেছি, আয় আয় শুভ ভেতরে আয়।”

এই বলে ডাঃ রায় শুভঙ্করকে ভেতরে নিয়ে গেলেন আর ঐ অল্পবয়েসী ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলে গেলেন, কেউ আসলে তাকে যেন কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করতে বলে।

ডাঃ রায়ের চেম্বারটা বেশ সাজানো গোছানো। শুভঙ্কর ভেতরে এসে চেয়ারে বসল। ডাঃ রায় বললেন, “তুই তো দারুণ ঘেমে গেছিস, দাঁড়া এ.সি. টা চালিয়ে দিই!”

ডাঃ রায় হেসে বললেন, “কাকু, কাকিমা কেমন আছেন?বিয়ে করেছিস?কি করছিস এখন?”

– “বাবা-মা গত হয়েছেন দশ বছর হল, স্ত্রীও মারা গেছে কয়েক বছর আগে, একটা ছোট মেয়ে আছে, ওকে নিয়ে এখানেই একটা বাড়িতে থাকি! আমি ক্রাইম ব্রাঞ্চে আছি! শোন না! আমি একটা ভীষণ দরকারে তোর কাছে এসেছি, এই সমস্ত কথা পরে নিশ্চয়ই হবে।”

ডাঃ রায় হয়ত ভেবেছিলেন যে শুভঙ্কর হয়ত তার পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু তার না করে এইভাবে একটা কথা বলে অভদ্রতার পরিচয় দেবে তা হয়ত বুঝতে পারেননি তিনি। অগ্যতা তিনি বললেন, “হ্যাঁ! বল না!”

– “আমি একটা কেসের ইনভেস্টিগেশনে এসেছি। তোর একজন পেশেন্ট আছে, সায়নী গুপ্তা! ওর সম্বন্ধে জানতে এসেছি।”

– “সায়নী! ওহ! হ্যাঁ! হ্যা, মনে পড়েছে। জীবনে এই রকম সাইকোলজিকাল পেশেন্ট খুব কম পাওয়া যায়! এই ধরণের পেশেন্টদের ‘ক্রিটিক্যাল সাইকিক ট্রমাস্টা’ বলা হয়। এই মেয়েটির সাথে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল, একটি মেন্টাল এসাইলাম হোমে।”

এতটুকু শুনে শুভঙ্কর জিজ্ঞেস করল, “হোম! হোম কেন?”

কিছু একটা ভেবে ডাঃ রায় বললেন, “মেয়েটার মেন্টাল কন্ডিশন এতটাই খারাপ ছিল যে কোনো ডাক্তারের পক্ষে তাকে সামলানো সম্ভবপর হচ্ছিল না, তাই অবশেষে আমার ডাক পড়ে। আমি ঐ হোমের লোকগুলোর কাছ থেকে শুনেছিলাম যে কোন একটা সিরিয়াল কিলিং কান্ডের সাথে মেয়েটা যুক্ত ছিল।”

এবার শুভঙ্করের কপালে চিন্তার রেখাটা আরও পুরু হয়ে উঠল। ও বলল, “আচ্ছা! ওর ভালো নাম কি সায়নী ই?”

– “না! ওর আসল নাম হল, সুস্মিতা গুপ্তা!”

নামটা শুনে এ.সি চলা বদ্ধ ঘরে ঘামতে শুরু করে শুভঙ্কর। কোন এক অজানা অলৌকিক ক্ষমতা যেন দমকা হাওয়ার মত তার কানের কাছে এসে বলে যায়, “সে ফিরে এসেছে!”

এক নিমেষে শুভঙ্করের মনে পড়ে যায়, সেই এফ.এম স্টুডিওর মেয়েটা তাদের এমপ্লয়ীজ লিস্ট থেকে সায়নীর একটা ছবি প্রিন্ট-আউট করে দিয়েছিল রথীনকে। সে তাড়াতাড়ি চেম্বারের দরজাটা খুলে বেরিয়ে গেল। ডাঃ রায় বুঝতে পারলেন না, আসলে হলো টা কি? সে বলে উঠলো, “আরে কি হল রে শুভ?”

শুভঙ্কর বাইরে এসে রথীনকে বলল, “রথীন ঐ স্টুডিও থেকে মেয়েটা যে ছবিটা দিয়েছিল, সেটা দাও!”

রথীনের কাছ থেকে ছবিটা নিয়ে অতি বিস্ময়ের সাথে ছবিটা দেখে শুভঙ্কর আস্তে আস্তে বলল, “আবার!”

ডাঃ রায়ের চেম্বারে ফিরে এসে শুভঙ্কর চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল।

ডাঃ রায় বললেন, “কি রে তুই ঠিক আছিস তো?”

মুখটা তুলে শুভঙ্কর বলল, “এর সাথে পরিচয় আমার অনেক দিনের! আচ্ছা ওর কি রোগ ছিল বলছিলি।”

শুভঙ্করের কথা কিছু বুঝতে পারলেন না ডাঃ রায়। যাই হোক! তিনি আবার বলতে শুরু করলেন।

– “এই মেয়েটার ‘ডিসোসিয়েটিভি পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার’ অর্থাৎ মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার আছে। ওর একটা শরীরে একসঙ্গে দু’টো পার্সোনালিটি থাকে। একটার নাম দেবযানী যে কিনা একজন খ্রিস্টান, দেবযানী গোমস ও অপরজনের নাম সায়নী।

অনেকগুলো সেশনের পর একটা জিনিস পারি যে, অনেক ছোটতে ওর বাবা-মা একটা এক্সিডেন্টে মারা যায়, তারপর মামার বাড়িতে প্রতিদিন অপমান, লাঞ্চনা, অত্যাচার সহ্য করতে করতে ওর একটা মেন্টাল ট্রমার সৃষ্টি হয়। যাদের এই মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার থাকে, তাদের একটা থেকে আরেকটা পার্সোনালিটিতে যেতে হলে একটা ট্রিগার বা সুইচের দরকার হয় আর এই মেয়েটির ট্রিগার ছিল প্রবলেম। ওর জীবনে যখনই কোন প্রব্লেম আহত তখন ওর পার্সোনালিটি চেঞ্জ হয়ে, হয়ে যেত দেবযানী। ঐ দেবযানী নামটাই ও ব্যবহার করত স্কুল জীবনে ডাক নাম হিসাবে। পরবর্তীকালে ঐ দেবযানী পার্সোনালিটি পরপর ছয়টা খুন করে সিরিয়ালী। কিন্তু এই দেবযানীর একটা রোগ আছে, সেটা হল ‘সাইনোফোবিয়া’ অর্থাৎ কুকুরের থেকে ভয়। এরপর এসাইলাম হোমে আট বছর থাকার পর অনেকটাই সুস্থ হয়ে যায় সুস্মিতা। তারপর রামহরিপুরে একটা প্রাইভেট এফ.এম এ ‘আর.জে’-র চাকরি পায়। কয়েকমাস পর ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসে কলকাতায়। এতদিনে ওর দেবযানী পার্সোনালিটি পুরোপুরি চলে গেছে, এখন থেকেই ও ব্যবহার করতে শুরু করল সায়নী নামটা। নতুন আই.ডি বানিয়েছিল ঐ নামে। এই নতুন নাম ওর পূর্বের ক্রাইমকে চাপা দিতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এই পার্সোনালিটিরও একটা রোগ আছে, ও ইন্টারনেলি বিশ্বাস করে ওর সাথে আরও তিনজন মন্দিরা, সুজাতা ও সুমি নামে তিনজন মহিলা থাকেন। ওর গাড়ির ড্রাইভার রতন নাকি গাড়ি চালায়। কিন্তু আদতে ঐ তিনটে মেয়ে বা রতন বলে কেউ নেই!”

এতটুকু বলে থামলেন ডাঃ রায়।

শুভঙ্কর বলল, “আচ্ছা! গাড়ি বলতে মনে পড়ল, ওর গাড়ির নম্বরটা জানিস?”

– “নারে! ওর গাড়ির নম্বর জানি না। তবে একটা মেরুন রঙের অল্টো গাড়ি!”

শুভঙ্কর উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছু একটা ভেবে আবার বসে পড়ল, তারপর জিজ্ঞাস্যভঙ্গিতে ডাঃ রায়কে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা! একটা কথা বলতো, যদিও এই দু’টো ওর পার্সোনালিটি, কিন্তু আদতে এরা কে?”

বাঃ রায় বললেন, “দ্যাখ! আমি যতদূর জানি এরা দু’জনেই সুস্মিতার ছোটবেলার প্রিয় বান্ধবী। আকস্মিকভাবে এই দু’জন একইদিনে মারা যায়, খুব সম্ভবত বৃষ্টিতে ভিজে ব্রঙ্কাইটিসে। ছোট থেকেই সুস্মিতা মা-বাবা ছাড়া, তারপর মামার বাড়িতে প্রতিদিন অত্যাচার এই দুই বান্ধবীর একসাথে ওকে ছেড়ে চলে যাওয়া, এইরকম কিছু ভয়, দুঃখ থেকেই ওর মেন্টাল ট্রমার সৃষ্টি হয়।”

শুভঙ্কর বলল, “তোকে অসংখ্য ধন্যবাদ! আমি এখন আসছি।”

কথাটা বলেই শুভঙ্কর ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ল। চেম্বার থেকে বাইরে এসে রথীনকে বলল, “রথীন তাড়াতাড়ি চল, একবার সহেলী আপার্টমেন্টে যেতে হবে। আর সমস্ত লোকাল থানাগুলোতে জানিয়ে দাও যে কোন মেরুন রঙের অল্টো গাড়ি দেখলে যেন খবর দেয়।”

রথীন বলল, – “আচ্ছা, ঠিক আছে স্যার!”

রাস্তায় জ্যাম কাটিয়ে এক ঘন্টার মধ্যেই ওরা এসে পৌঁছলো, সহেলী আপার্টমেন্টে। গাড়ি থেকে নেমে শুভঙ্কর ছুটল গ্ৰাউন্ড ফ্লোরে ঐ দারোয়ান ঘরটার দিকে, পেছন পেছন রথীন ও আরও দু’জন কনস্টেবল।

দারোয়ানটা বসে বসে খৈনি ডোলছিল, এমন সময় শুভঙ্কর হন্তদন্ত হয়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল “যে……যে রাতে চন্দন সেন খুন হয়, সে রাতে গার্ডের ডিউটিতে কে ছিল, কে?”

– “সে কথা আপনাকে বলতে যাবো কেন?” মেজাজে কথাটা বলল ঐ দারোয়ানটা।

এরপর শুভঙ্কর আই কার্ড বার করে বলল, “আমরা ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে আসছি!”

পেছনে দাঁড়িয়ে রথীন বলল, “সিভিল ড্রেসে কেউ পুলিশ বলেই গণ্য করে না!”

কথাটা শুনে হাত থেকে খৈনিটা ফেলে দিয়ে দারোয়ানটা সেলাম ঠুকে বলল, “সরি স্যার … সরি স্যার, ভুল হয়ে গেছে!”

– “ইটস অলরাইট!”

লোকটা কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “সেদিন রাতে আমি ছিলাম স্যার!”

– “সেদিন রাতে একজন পুরুষ এসেছিল, যা তুমি পুলিশকে বয়ানে বলেছ! তোমার তাকে দেখে কেন পুরুষ মনে হয়েছিল?”

দারোয়ান কিছু একটা ভেবে মাথা চুলকে বলল, “ওনার পোশাক দেখে তাই মনে হয়েছিল!”

এবার শুভঙ্কর বলল, “সেদিন রাতের সি.সি.টি.ভি ফুটেজটা একবার দেখাতে পারবে?”

দারোয়ানটা তাদের কন্ট্রোল রুমে নিয়ে গিয়ে সেই রাতের ফুটেজটা চালাতেই শুভঙ্কর একবার হেসে উঠলো ঠিকই কিন্তু একটা সন্দেহ মনের ভেতর রয়েই গেল। সেদিন রাতে রাত দশটায় মিঃ চন্দন সেনের বাড়িতে যে এসেছিল, তার হাঁটার ধরণ, সকালে সেই প্রাইভেট এফ.এম স্টুডিওর সি.সি.টি.ভিতে দেখা সায়নীর হাঁটার ধরণের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। তার থেকে কি এটা আন্দাজ করা খুব কঠিন যে সেদিন রাতে অন্য কেউ নয়, সায়নী, তার আসল নাম সুস্মিতা সেই এসেছিল। তবুও কেমন যেন একটা খটকা শুভঙ্করের মনে থেকেই গেল। তবে সেই খটকা দূর হতে বেশি সময় লাগল না, বিকেলের মধ্যেই চন্দন সেনের অটোপসির রিপোর্ট চলে এল যাতে স্পষ্ট লেখা আছে যে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয় ঠিকই কিন্তু মারা যাবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সে বাঁচার চেষ্টা করছে, খুনির সাথে একটা ধস্তাধস্তিও হয়, তার ফলেই খুনির একটা চুল ভিক্টিমের হাতে চলে আসে, সেই চুলের ডি.এন.এ পারফেক্ট ম্যাচ করেছে ক্রিমিনাল রেকর্ডের একটি মহিলার সাথে যার নাম, সুস্মিতা রায়। আর খুনি যে কোনো পুরুষ নন, একজন মহিলা এবং এই ব্যপারে সুদক্ষ, তা তার ছুরিকাঘাতের নির্দশন দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

ব্যস! আর কোনো সন্দেহ নেই যে এই সায়নী অর্থাৎ তার ভালো নাম সুস্মিতা সেই খুনি। শুভঙ্কর খালি আস্তে করে বলল, “আবার দেখা হবে!”

রথীন ওপাশ থেকে বলল, “কি বললেন স্যার? দেখা হবে মানে, আপনি এর আগে থেকে ওকে চেনেন নাকি?”

একটু মুচকি হেসে শুভঙ্কর বলল, “খুব ভালো করে, নিজের সবথেকে প্রিয় বন্ধুকে যেমন ভোলা যায় না, ঠিক প্রিয় শত্রুকেও ভোলা যায় না। পরে কোনোদিন না হয় বলব!”

* * *

(৫)

এর ঠিক দুইদিন পর, ন্যাশানাল হাইওয়ের ধারে একটা বেসরকারি হসপিটাল থেকে ফোন এল যে একটা মেরুন রঙের অল্টো গাড়ি তিনদিন আগে এক্সিডেন্ট করেছে, একটা মেয়ে গাড়িটা চালাচ্ছিল ও হসপিটালে ভর্তি আছে। খবরটা পাওয়া মাত্র শুভঙ্কর আরো দশজন পুলিশ ফোর্স ও চারটে কুকুর নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। অবশ্য কুকুর গুলো শুভঙ্কর নিয়েছিল কেন, তার পরে জানা গেছিল।

হসপিটালে পৌঁছনো মাত্র একটা নার্স হসপিটালে ভর্তি থাকা মেয়েটির বেডটা দেখিয়ে দিল। ওরা তাড়াতাড়ি এসে দেখল, ঔ বেডে কেউ নেই।

নার্সটা বলল, “আরে … মেয়েটা গেল কোথায়? ওকে তো দশ মিনিট আগেই দেখেছিলাম।” দু’জন পুলিশ ঐ নার্সটিকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করল, মেয়েটা দেখতে কেমন ছিল?

শুভঙ্করের খেয়াল কিন্তু অন্যদিকে ছিল। হঠাৎ কি একটা মনে হতেই বাথরুমে গিয়ে সে দেখলো বাথরুমের ছোট জানালার কাঁচটা কেউ ভেঙ্গে দিয়েছে, অর্থাৎ ঐ দিকেই মেয়েটা পালিয়েছে।

শুভঙ্কর বাইরে এসে নার্সটিকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা হসপিটালের পেছনে কি আছে?”

নার্সটা উওর দিল, “স্টাফ কোয়াটার, তারপরেই অনেকটা বিস্তৃত জঙ্গল।”

– “তার মানে মেয়েটা বেশি দূর যেতে পারে নি!”

এবার ঐ পুলিশী কুকুরগুলো এনে বেডটা শোঁকানো হল, কুকুরগুলো বাইরে বেরিয়ে ছুটল পেছনের ঐ জঙ্গলটার দিকে। পেছনে পেছনে ছুটতে শুরু করল পুলিশ ফোর্স। প্রায় মিনিট কুড়ির মধ্যেই একটা মেয়ের কান ফাটানো আর্তনাদ ভেসে এলো জঙ্গলের মধ্যে থেকে। পুলিশ ফোর্স ছুটল সেদিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জন মহিলা কনস্টেবল একটি মেয়েকে ধরে ফেলে ও কয়েকজন কনস্টেবল চারটে কুকুরকে নিয়ে উপস্থিত হল শুভঙ্করের সামনে।

মেয়েটা উদ্বিগ্ন চোখে একবার শুভঙ্করের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো। তারপর মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

আসলে এটা একটা জাল ছিল, কারণ সুস্মিতার জীবনের প্রবলেমের সময় ওর পার্সোনালিটি সুইচ করে দেবযানীতে, আর দেবযানীর ভয় ছিল সাইনোফোবিয়ায় অর্থাৎ কুকুরের থেকে। আর এই ভয়টাই তাকে ধরিয়ে দিতে সক্ষম হল।

কয়েকদিনের মধ্যেই মামলাটা কোর্টে উঠল। কোনো উকিল এই মামলায় তার পক্ষ নিতে রাজি হয় না, ভারসাম্যহীন হলেও একজন সিরিয়াল কিলার। একমাস চলার পরেই প্রত্যাশিতভাবে মামলার রায় ঘোষণা হয়। তাতে স্পষ্ট জানানো হয় তাকে আজীবন মেন্টাল এসাইলাম হোমে থাকতে হবে, সেখানে তার চিকিৎসা চলবে।

সে ঘটনার পর প্রায় দু’মাস কেটে গেলো। একদিন বিকেলে রথীন এল শুভঙ্করের বাড়িতে কয়েকটা কেসের ফাইল নিয়ে। কথায় কথায় রথীন, শুভঙ্করকে জিজ্ঞেস করল “স্যার! আপনি সেই কেসটা আর বললেন না তো! আপনি ঐ মেয়েটিকে কিভাবে চিনলেন?”

শুভঙ্কর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, “আচ্ছা! বলছি, আগে বলতো সুস্মিতার দু’টো পার্সোনালিটি ছিল, তাদের মধ্যে কে খুনি ছিল?” – “ঐ তো, দেবযানী!”

– “একদম ঠিক! দেবযানী আদতে ছিল একজন খ্রিস্টান। এর সাথেই ঐ EGGLAPS, কথাটা জড়িয়ে আছে।”

এবার রথীন ভুরু কুঁচকে বলল, “তার মানে EGGLAPS কথাটার কোনো মানে আছে?”

– “আলবাত আছে! এটা একটা পদ্ধতি যেটা মেয়েটি একটি চক্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। একটা গল্প শোনো। মানুষ যাতে ভুল পথে না যায়, তাই ক্যাথলিক চার্চ মধ্যযুগে একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করে যার নাম সেভেন ডেডলি সিনস বা কার্ডিনাল সিনস। এর মধ্যে সাতটা এমন এমন জিনিসের বর্ণনা আছে যা মানুষকে বিভ্রান্ত করে। যেমন প্রথম হল গর্ব বা Pride, ঈর্শা বা Envy, অতিমাত্রিকতা বা Gluttony, কামুকতা বা Lust, ক্রোধ বা Anger, লোভ বা Greed এবং অলস বা Sloth.

এই সাতটি ইংরেজি শব্দের প্রথম অক্ষরকে একটু ওলটপালট করে সাজালেই তৈরি হয়, EGGLAPS।

এই প্রতিটি এনটিটির আলাদা আলাদা ডেমন ও আলাদা শাস্তি আছে। সুস্মিতা ওরফে দেবযানী ঠিক এই চক্রটাকেই অনুসরণ করেছিল।

ডাঃ রায়ের কথা অনুসারে ছোটতেই ওর মধ্যে এই মানসিক রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল।

এরপর ছোট থেকে ওর সাথে ঘটতে থাকা সমস্ত অত্যাচার সহ্য করত দেবযানী, অন্য সময় ও হয়ত সুস্মিতা বা সায়নী, কিন্তু যেকোনো প্রবলেমের সময় ওর পার্সোনালিটি সুইচ করত দেবযানীতে।

এরপর ক্লাস টেনে ওঠার পর ওকে একটা বোডিং স্কুলে পাঠানো হয়। ওখান থেকেই ওর খুনি হয়ে ওঠার গল্প। ওখানকার সিনিয়ররা ওকে প্রায়শই নানাভাবে অত্যাচার করতে থাকে। হঠাৎই একদিন রাতে আকস্মিকভাবে ঐ সিনিয়রদের দলেরই একটা ক্লাস ইলেভেনের মেয়ের মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পেছনে জঙ্গলে পাওয়া যায়, সকলের ধারণা কোনো পশু হত্যা করেছে। অর্থাৎ ক্রোধ বা Anger এর বশেই হত্যা। এরপর সুস্মিতাকে নিয়ে তার মামা আবার তাকে নিয়ে আসেন। কিন্তু আবারও অত্যাচার শুরু হয়। মামী দিনের পর দিন ওকে খেতে না দিয়ে মারধোর করতে থাকে, অবশেষে একদিন রাতে মামীর খাবারে বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলে। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেন কার্ডিয়াক এট্যাক। অর্থাৎ Gluttony বশেই হত্যা, তাকে অভুক্ত রেখে অত্যাচারের অতিমাত্রিকতা ছাড়িয়ে যাওয়া।

এরপর তার মামা আবার একটা অন্য স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেয়। ওখানে শুরু হয় নতুন বিপত্তি। স্কুলে বরাবরই পড়াশোনায় দুর্দান্ত ছিল সুস্মিতা, কিন্তু সেবার ওকে টপকে বেশি নম্বর পায় অন্য একটি মেয়ে। ওর বন্ধুরাও আর ওকে পাত্তা দেয় না, এর কয়েকদিন দিন পর স্কুলের একটা অনুষ্ঠানে বাথরুমের বেসিন এ ঐ মেয়েটির মৃতদেহ পাওয়া যায় আকস্মিকভাবে। বেসিন এর খোলা কল থেকে জল বেরোতে থাকে। অর্থাৎ Envy এর বশে মৃত্যু।

এরপর দু’বছর ঠিকঠাক কাটে। তারপর সুস্মিতা কলেজে ভর্তি হয়। কলেজের হোস্টেলে থাকার সময় থার্ড ইয়ারের একটি মেয়ে ওকে সেই একই রকম ভাবে যেভাবে ও মামারবাড়িতে অত্যাচারিত হত, সেই একই অত্যাচার করতে থাকে, কিন্তু মেয়েটি আদতে ছিল ভীষণ অলস প্রকৃতির। একদিন আকস্মিকভাবে একটা চন্দ্রবোড়া সাপ কোনোভাবে ঢুকে ঐ মেয়েটিকে কামড়ায়, কিন্তু সাপটা ঠিক কোন পথে এসেছিল তা বোঝা যায় না। অর্থাৎ Sloth এর বশে মৃত্যু।

ঐ হোস্টেলে থাকার সময় একটা মেয়ে প্রায়শই ওর সমস্ত জিনিস যেমন জামাকাপড় ওকে না বলে বার করত, ওকে না বলে খেয়ে নিত, এই লোভ দিন দিন বাড়তে থাকে, অবশেষে একদিন মেয়েটি রান্না করতে গিয়ে আকস্মিকভাবে গরম তেল ছিটিয়ে আসে ও সিলিন্ডার ব্লাস্ট করে সে মারা যায়। অর্থাৎ Greed এর বশে মৃত্যু।

এরপর ওর সাথে আলাপ হয় চন্দন সেনের। চন্দনকে ও ভালোবাসতে থাকে ঠিকই কিন্তু চন্দন প্রথমে ওকে প্রপোজ করলেও পরে একটা অন্য মেয়ের সাথে প্রেম করতে থাকে। আট বছর আগে সেই মেয়েটিকেও মেরে ফেলে, গাড়িতে হঠাৎ করে আগুন ধরে যায়। অর্থাৎ Lust এর বশে হত্যা।”

এতটা বলে একটু থেমে শুভঙ্কর বলল, “ঐ মহিলার নাম ছিল সৌমিলী, আমার স্ত্রী।”

তারপরই আমি এই কেসটার দ্বায়িত্ব নিই আর তদন্তে উঠে আসে এইসব চাঞ্চল্যকর তথ্য, যেগুলো আকস্মিক মনে হচ্ছিল তার মূলে যে ঐ সুস্মিতা তা জানা যায়।”

এবার রথীন বলল, “তাহলে স্যার, চন্দন সেনকে কেন মারল মেয়েটা?”

– “অবশেষে পড়ে রইল Proud বা অহংকার। তোমার হয়ত মনে থাকবে চন্দন সেনের মা সেদিন থানায় এসে বলেছিলেন যে দেবযানী নামে একটি মেয়ে আসে তার লেখা ছাপানোর জন্য। কিন্তু লেখা ছেপে বেরিয়ে আসার পর লেখকের স্থানে আসে চন্দন সেনের নাম। আসলে কলেজে ওর আসল নাম সুস্মিতা সবাই ভুলেই গিয়েছিল, ও সবাইকে বলত দেবযানী ওর ডাক নাম। আট বছর হোমের থাকার পর দেবযানী কিন্তু সেদিনের কথা ভোলেনি। আজ চন্দন সেনের যা নামডাক তার তার জন্যই। এতদিন পর সেই চন্দন সেনকে খুঁজে পেয়ে সেই আগুন আবার জ্বলে ওঠে সুস্মিতার চোখে অর্থাৎ Proud বা অহংকারের বশে মৃত্যু। তারপর তারই ফোন থেকেই তার উইকিপিডিয়ার পেজে মৃত্যু সময় ও তারিখ উল্লেখ করে দেওয়া।”

এতকিছু শুনে রথীন বলল, “ওরে বাপরে! এত কিছু!”

শুভঙ্কর একটু মুচকি হেসে একটা সিগারেট ধরাল। এমন সময় ওর ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা রিসিভ করে দু’বার হ্যাঁ হ্যাঁ বলে
কেটে দিয়ে বলল, “উফ! শান্তি নেই!”

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কালমুণ্ডি | ভয়ের দেশ | রাজদীপ বসু | Bengali Horror Story Previous post কালমুণ্ডি | ভয়ের দেশ | রাজদীপ বসু | Bengali Horror Story
Next post পোস্টমর্টেম | ভয়ের দেশ | সুকান্ত আচার্য্য | Bengali Horror Story