Getting your Trinity Audio player ready...
|
সকাল থেকে ঝম ঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। চারিদিকে মেঘ কালো করে আছে। “এই অলক্ষণে বৃষ্টিটাকেও আজকেই আসতে হল, কি করে যে বেরোই,” হ্যান্ড ব্যাগটা গোছাতে গোছাতে অহনা বলে চললো। আসলে আজ তার প্রথম দিন, মানে হসপিটালে আজই সে জয়েন করবে। ছোটবেলা থেকে যে স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে বড় হয়েছে, যেটা পাওয়ার জন্য সে নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে, আজ তার সেই স্বপ্ন পূরণের দিন। এক নামি সরকারি হাসপাতালে সে আজ ডাক্তার হিসেবে যোগ দেবে। কিন্তু বৃষ্টি তো থামছেই না। অগত্যা আর কি করে, ছাতা নিয়ে হেঁটেই বাসস্টপে গেল, তারপর বাসে ভিড় থাকায় অটো করেই সোজা হসপিটাল। মনে মনে এক অজানা ভয় কাজ করছে, আবার আনন্দও হচ্ছে খুব। যাইহোক, হসপিটালে এসেই যার সঙ্গে দেখা হল, অল্প পরিচয় করতে লাগলো। আর হ্যাঁ, সাথে করে মিষ্টি নিয়ে এসেছিল সে, তাই যাকে পেলো তাকে মিষ্টিমুখ করাতে লাগলো। সবমিলিয়ে শুরুটা বেশ ভালোই হল আজ। দুপুরের দিকে সুপার স্যার বললেন, “অহনা একটু মর্গে যাও, একটা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট লিখতে হবে। বুঝতেই পারছি তোমার আজ প্রথম দিন, কিন্তু কি করবো বল, ড. দাস আজ আসেননি তো তাই তোমাকেই…।” অহনা তখনই বলল, “ও ঠিক আছে স্যার, আমাকেও তো করতে হবে, তাই আজই শুরু করি।” এই বলে ও চলে গেল মর্গের দিকে। আসলে অহনা ছোটবেলা থেকেই একটু বেপরোয়া গোছের, আর পাঁচটা মেয়ের মত মিনমিনে নয়। মর্গে গিয়েই দেখলো সারি সারি মৃতদেহ। কিন্তু কোনটার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট লিখতে হবে তাকে, ডোমই বা কোথায় গেলো? একটু ডাকাডাকি করেও সাড়া পেলো না তার। সকালেই ওর সাথে পরিচয় হয়েছে, নিজে হাতে ও ডোমকে মিষ্টি খাইয়েছে। যাইহোক, ও সামনে থাকা মৃতদেহগুলো একের পর এক চেন খুলে দেখতে লাগলো কোনটা আজকের সদ্য লাশ। চার নম্বর চেনটা খুলতেই ওর গায়ে যেন একটা ঝটকা লাগলো, এ কার মৃতদেহ! না সে ভুল দেখছে না, তার ঠিক মনে আছে সকালে একেই সে মিষ্টি খাইয়েছিলো, এ তো সেই ডোম! কিন্তু কেন, কিভাবে হল এটা, তার মাথায় কিছুই ঢুকলো না। শুধু সে ভয়ে, বিস্ময়ে চেনটা বন্ধ করে দাঁড়ালো। যেই না সামনের দিকে তাকিয়েছে অমনি দেখে সেই ডোম তার দিকে আসছে, তার কেমন যেন মাথা ঘুরে গেল তাকে দেখে। সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ঘন্টা দুই পরে যখন জ্ঞান ফিরলো, সে তখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে। চোখ মেলতেই সামনে দেখতে পেলো নার্স, সুপার স্যার, আর ওই ডোম। সে তখনও অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো। ডোম বলে চললো, “ম্যাডাম, মাফ করবেন, আমার একটু আফিমের নেশা আছে। তাই গিয়েছিলাম একটু নেশা করতে, কিন্তু ফিরে এসে যখন আপনাকে দেখলাম তখন সরি বলতে যাবো, তার আগেই কেন জানিনা আপনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন।” ডাক্তারবাবু বললেন, “ও প্রথম প্রথম একটু ভয় লাগে, ধীরে ধীরে সব অভ্যাস হয়ে যাবে। তুমি বিশ্রাম নাও।” একটু বিশ্রাম নিতেই ও একেবারে ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু মন কিছুতেই মানতে চাইছে না, ও কি এতটাই ভুল দেখলো! কি হল তার! অহনা সেদিন একরাশ বিস্ময় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। রাতে শুয়ে শুয়ে সে এইসবই ভাবতে লাগলো আর ভাবতে ভাবতে ও ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন আকাশ পরিষ্কার। ওর মেজাজটাও ফুরফুরে। যাক, কাল যা হয়েছে তা ভুলে যাওয়াই ভালো, এই ভেবে সে নতুন উদ্যমে বেরিয়ে পড়ল। এদিন বাসে করেই হসপিটালে এলো। এসেই দেখে এক জায়গায় যেন লোক জড়ো হয়েছে। তখন ও একজন সিস্টারকে ডেকে বললো, “কি হয়েছে দিদি, এতো গোলমাল কিসের?” তখন সিস্টার বললো, “আপনি কিছু শোনেননি ম্যাডাম! সে বিরাট কাণ্ড ঘটে গেছে, খুন হয়েছে, খুন!” অহনা অবাক হয়ে বলল, “কে, কোথায়, কি করে?” “ড. দাস ম্যাডাম, ড. দাস। কাল তো উনি আসেন নি। তাই যে লাশটা আপনি পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে কাল অজ্ঞান হয়ে গেলেন, আজ উনি সকালে ওটা পোস্টমর্টেম করতে গিয়েছিলেন। তারপর কিছুক্ষণ পরে, আমাদের সুইপার রামলাল কি জন্য একটা মর্গের ওদিকে গিয়েছিল, গিয়ে দেখে ডাক্তারবাবু মেঝেতে পড়ে আছেন, চারিদিকে রক্ত ভেসে যাচ্ছে, গলার নলিটা বিচ্ছিরি ভাবে কাটা। আর ডোমটা পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে তো দেখেই খুন, খুন বলে চিৎকার করে ছুটে এলো। এরপর সবাই গিয়ে দেখলো এই কাণ্ড।” এতগুলো কথা বলে সিস্টার এক ঢোক জল খেল। অহনা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। এদিকে এতক্ষণে থানার বড় দারোগাবাবু চলে এসেছেন। তিনি প্রথমে রামলাল কে ডেকে বললেন, “তুমিই প্রথম লাশটাকে দেখেছিলে?” রামলাল কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “আজ্ঞে জি হুজুর।” “কি দেখেছিলে একদম সত্যি করে বল, না হলে তোমাকে লকাপে পুরবো,” ধমক দিয়ে দারোগা বাবু বললেন। তখন রামলাল একেবারে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, “হুজুর আমার উমর হয়েছে, কিন্তু হামি যা দেখেছি সেটা স্পষ্টভাবে বলছি। ঝুট বলবো না হুজুর, আমার একটু ওই আফিমের নেশা আছে। আজ সকালে ঝাড়পোঁছ শেষ করে হামি ডোম ভাইয়ের কাছে যাচ্ছিলাম একটু আফিমের জন্য। কিন্তু মর্গে গিয়ে দেখি হুজুর ডাক্তারবাবু চিৎ হয়ে পড়ে আছে, চারিদিকে রক্ত ভেসে যাচ্ছে, আর পাশে ডোম টা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এসব দেখে হুজুর হামি ভয়ে ছুট লাগাই।” দারোগা বললেন, “ঠিক আছে, তুমি যাও।” এরপর তিনি ডোমকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কিছু বলবে?” ডোম নির্বাক হয়ে শুধু মাথা নাড়তে লাগলো। তখন পুলিশ তাকে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে গেল। দ্বিতীয় দিনটাও ভালো কাটলো না অহনার। ও ভাবতে লাগলো, আমি আসার পরেই এখানে কি সব কাণ্ড ঘটে চলেছে! ওর মনে মনে এবার একটু ভয় হতে লাগলো, ওর কোনো বিপদ হবে না তো! আর ও প্রথম দিন ডোম ভাইকে দেখেছিল হাসি-খুশি, প্রাণবন্ত। ওই রকম একজন লোক খুন করতে পারে! আর ও কেনই বা ড. দাসকে খুন করলো? এই সব ভাবতে ভাবতে ও রাতে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন আবার অহনা সময়মত হসপিটালের জন্য রওনা দিলো। যেতে যেতে ভাবছে, আজকে আবার কি ঘটনা ওর জন্য অপেক্ষা করছে! হসপিটালে ঢুকে ও তার নিজস্ব চেম্বারে চলে গেল। বসেই আনমনা ভাবে facebook টাতে চোখ বোলাতে লাগলো। হঠাৎ একটা খবরে ওর চোখ আটকে গেল। “রহস্য জনক ভাবে থানার বড় দারোগা খুন, আসামী পলাতক।”
পুরো খবরটা এক নিমেষে পড়ে ফেলল সে। “এ কি হল! মানে কি করে হল!” ফোনটা টেবিলে রেখেই সে বলে উঠলো। কাল থানায় ওই ডোমকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর, রাত্রি বেলা বড় দারোগা ওকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওর লকাপে ঢোকে। তখন থানায় আর দু’এক জন কনস্টেবল ছিল আর জন তিনেক সিভিক ভলেন্টিয়ার। হঠাৎ করে ভেতর থেকে চিৎকার শুনে কনস্টেবলরা লকাপের দিকে ছুটে যায়, গিয়ে দেখে দারোগবাবুর বেল্টটা ওনারই গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় আছে আর উনি মেঝেতে পড়ে আছেন। নিমেষের মধ্যে কনস্টেবলদের ধাক্কা দিয়ে ঠেলে তির বেগে ওই ডোম থানা থেকে ছুট লাগালো। সামনে থাকা সিভিকরা ওকে ধরে ফেলতেই ও যেন অমানুষিক শক্তিতে তিনজনকে রীতিমতো ছুঁড়ে ফেলে পালিয়ে যায়। তারপর আর ওই ডোমের খোঁজ পাওয়া যায় নি। এই ছিল খবর। একের পর এক খুন হয়ে চলেছে। এর পেছনে রহস্য কি? কেনই বা এসব হচ্ছে, আর ওরই বা কেন মনে হচ্ছে এবার ওর ওপর একটা যেন বড় ঝড় আসতে চলেছে, এই সব সাতপাঁচ ভাবছিল সে, এমন সময় সিস্টার এসে বলল, “ম্যাডাম পেশেন্ট আছে।” ও তখন উঠে চলে গেল। সারাদিন ওর রুগী দেখতে আজ মন বসছে না, শুধুই মনের মধ্যে কি সব উল্টোপাল্টা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। দিনের শেষে, সন্ধেবেলায় ও বাড়ি ফিরে এলো। ওর চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। মা জিগ্গেস করল, “কি রে, কিছু হয়েছে তোর? তোদের ওই ডাক্তারবাবু খুন হয়েছিল না, ওর কিছু কিনারা হল?” অহনা আনমনা মনে উত্তর দিল, “না মা, আমি কিছু জানি না, আমায় এক গ্লাস জল দাও তো।” এই বলে সে তার ঘরে চলে গেল। রাতের খাবার খেয়ে ও আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুমোতে গেল। ওর মন আজ কেমন কেমন করছে। আবার সেই ঝিমঝিম করে বর্ষা শুরু হয়েছে, সঙ্গে অল্প হাওয়াও বইছে। জানলা দিয়ে জলের ছিটা আসছে, তাই ও জানলাটা বন্ধ করতে গেল। জানলাটা সবে বন্ধ করেছে, হঠাৎ পেছন থেকে কে তার মুখ চেপে ধরলো জোর করে! অহনা প্রাণপনে চেষ্টা করল চিৎকার করার বা হাত পা ছোঁড়ার, কিন্তু পারলো না। কেউ যেন তাকে অসম্ভব জোরে চেপে ধরেছে। হঠাৎ একটা চেনা গলায় শোনা গেল, “ভয় পাবেন না ম্যাডাম, আমি আপনার কোনো ক্ষতি করবো না, শুধু আপনাকে আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনতে হবে, প্লিজ আপনাকে শুনতেই হবে।” “আরে এতো সেই ডোমের গলা না, হ্যাঁ ঠিক, ওরই গলা” অহনা মনে মনে বলে উঠলো। এবার যেন মুখের হাতটা একটু একটু করে আলগা হল। ডোম একটু সরে দাঁড়ালো। অহনা ফিরে তাকালো ওর দিকে। ভয়ে, বিস্ময়ে কিছুটা চেঁচিয়েই জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এখানে কেন, মানে তুমি এখানে কি করে!!” ডোম শান্ত গলায় বলল, “আস্তে ম্যাডাম, আস্তে। বেশি উত্তেজিত হবেন না, আমি সব বলছি।” ওদিকে অহনার চিৎকার শুনে নিচের থেকে মা চেঁচিয়ে বলল, “কি হয়েছে তোর, কার সাথে কথা বলছিস?” “কিছু না মা, এই ফোনে কথা বলছিলাম” অহনা জবাব দিল। এদিকে ডোম এবার বলে চলল — “ম্যাডাম, আমি ডোম নই।” “তবে তুমি কে?” অহনা জিজ্ঞেস করলো। ও বললো, “বলছি ম্যাডাম, আপনি শান্ত হয়ে সবটা শুনুন। আমি শুধু ডোমের শরীরটা ব্যবহার করছি মাত্র। আমার মৃত্যু হয়েছে তিন দিন আগেই।” অহনার এবার হাত, পা ঠাণ্ডা হয়ে আসলো, ও চোখের পলক না ফেলেই কথা গুলো শুনে চলল। “আমার নাম স্বরূপ বর্মন, বাড়ি হসপিটালের কাছেই। ভূগোল নিয়ে মাস্টার্স করেছিলাম, চাকরি বাকরি আর তেমন পাইনি। বাড়িতে দুই বোন আর মা আছে, বাবা অনেকদিন মারা গেছেন। সংসারে অভাব, কোনোরকমে টিউশন করে সংসার চালাতাম। তিন দিন আগে রাতের বেলা টিউশন করে বাড়ি ফিরছিলাম ওই হসপিটালের পাস দিয়ে, রাত্রি দশটা মত হবে। হঠাৎ দেখি মর্গের কাছে যেন কয়েকজন কি সব করছে। সন্দেহ হয়, কাছে গিয়ে দেখি ড. দাস আর ওই ডোম একটা লাশকে কাদের যেন বেচে দিচ্ছে, বেওয়ারিশ লাশ হবে হয়তো। আমি এর প্রতিবাদ করি। বলি, “ডাক্তারবাবু কাজটা কি ঠিক করছেন, আমি কিন্তু সকলকে বলে দেব, এখানে লোক জড়ো করবো।” তখন ড. দাস আর ওই ডোম আমাকে ভয় দেখায়, বলে মেরে গায়েব করে দেব কেউ টের পাবে না। আমি তখন ওখান থেকে পালিয়ে গিয়ে সোজা থানায় যাই। তখন বড় দারোগাবাবু থানায় নাইট ডিউটিতে ছিলেন। আমি ওনাকে গিয়ে সব খুলে বললাম। উনি সব শুনে বললেন, “তাই নাকি, চল, আমার সাথে এখুনি চল, ওখানে যাওয়া যাক।” এই বলে আমি আর উনি পুলিশের গাড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম। উনি নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম ওখানে। গিয়ে দেখি ড. দাস আর ডোম তখনও ওখানে আছেন আর লাশের দাম নিয়ে দরাদরি করছেন। সব দেখে দারোগাবাবু ছুটে গিয়ে তখনই দু’জনকে গ্রেপ্তার করলেন, যারা লাশ কিনতে এসেছিল ওরা যে যেদিকে পারলো ছুটে পালাল। দারোগাবাবু আমায় ডেকে বললেন তুমিও গাড়িতে চলে এসো, সামনেই তোমার বাড়িতে নামিয়ে দেব। আমি বললাম — “তার আর কোনো দরকার নেই আমি নিজেই চলে যাব।” উনি বললেন, “তা কি করে হয়, তুমি এত বড় কাজ করেছো, এটা আমার কর্তব্য, আর না বোলোনা, উঠে এসো গাড়িতে।” আমিও গাড়িতে উঠে বসলাম। একটু আসতেই দারোগা বাবু বললেন, “কি ড. দাস, ধরা পড়ে গেলেন যে!” তখন ডাক্তার হেসে বললো, “তা আর বলতে, একেবারে যাবজ্জীবন জেল।” এই বলে ওরা তিনজন একসাথে হাসতে লাগলো। আমি কিছুটা অবাক হলাম। হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দারোগাবাবু বললেন, “কি হে ছোকরা, নেমে এসো, তোমার ঠিকানা তো এসে গেছে।” আমি অবাক হয়ে বললাম, “আমার বাড়ি তো আর একটু দূরে।” ডাক্তারবাবু বললেন, “কে বলেছে তোর বাড়ি এসেছে? তোর ঠিকানা এসেছে, ঠিকানা, আর সেটা হল জমের ঘর।” এই বলে তিনি আমায় পেছন থেকে জাপটে ধরলেন। আমি চিৎকার করতে যাবো, কিন্তু ডোমটা আমার মুখ চেপে ধরলো। দারোগাবাবু গাড়ি থেকে একটা দড়ি বার করে ফাঁস বানালেন, তারপর ওটা জোর করে আমার গলায় পরিয়ে সামনের তেঁতুল গাছে ঝুলিয়ে দিলেন। সব শেষ তারপর। “সেদিন আমার শেষ পরিণতিতে এমনই আকাশ অঝোর নয়নে কাঁদছিলো। পরদিন সকালে সবাই খবর পেল আমি নাকি সুইসাইড করেছি। দরিদ্রতার চাপে সুইসাইড। আমার মা, আর বোনেরা অনাথ হয়ে গেল। আমি মরেও শান্তি পেলাম না। আমার মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জেগে উঠলো। যারা আমায় এই পৃথিবীতে বাঁচতে দেয় নি, তাদের আমি ছাড়বো না। ” এই বলে সে একটু থামলো। এতক্ষণ অহনা মন্ত্রমুগ্ধের মত সবকিছু শুনছিল। এত ভয়ের মধ্যেও তার কথা গুলো শুনে দু’চোখ বেয়ে জল এলো। ও তখন ধীরে ধীরে বলল “খুনগুলো কিভাবে করলেন?” স্বরূপ আবার বলে চলল, “আমি জানতাম ড. দাস আমার ডেডবডির পোস্টমর্টেম করতে আসবেন। তাই আমি ডোমের শরীরের মধ্যে ঢুকে যাই, কারণ শরীর ছাড়া আত্মা নিজে কিছু করতে পারে না। ও এলেই আমি ওকে খতম করবো। এই পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ওইদিন আপনাকে দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। ভাবলাম আপনাকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেব, দিলে ড. দাস আসবেন। তাই আমি আপনাকে ঐভাবেই ভয় দেখাই। কিন্তু ড. দাস সেদিন আর আসেননি। আমি সেদিন থেকেই ডোমের শরীরে আছি। পরদিন যখন ডাক্তারবাবু আসেন আমার পোস্টমর্টেম করতে, তখন প্রথমে আমি কিছু করিনি। আমার পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা লিখতে দিলাম প্রথমে, কারণ ম্যাডাম আমার বাড়ির লোকেরা আমার অন্তিম সংস্কারের জন্য অপেক্ষা করছিল। আর পোস্টমর্টেম না হলে তো লাশ ছাড়বে না। তারপর আমি তার সামনে আসি। উনার দিকে ক্রূর দৃষ্টিতে তাকাই। ওনার কানের কাছে গিয়ে বলি, “লাশটা পাচার করবেন না, এই লাশটা, ভালই দাম পাবেন। তখন ও অবাক হয়ে বললো, কি আজেবাজে কথা বলছিস তুই, ডোম। কি হয়েছে তোর, আর তোর গলা এত ভারী শোনাচ্ছে কেন? আমি বললাম আমার ছুরিটা আরও ভারী, দেখবেন। বলেই হাতের ছুরিটা দিয়ে ওর গলায় কোপের ওপর কোপ বসাতে থাকি। তৎক্ষণাৎ ডাক্তারবাবু পড়ে যান। আর আমি চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকি পুলিশ আসার। ইচ্ছে করেই আমি পালিয়ে যাইনি, আমি চেয়েছিলাম পুলিশ আমাকে ধরুক। আর সেদিন আমার প্ল্যানমাফিক বড় দারোগা আমাকে লকাপে নিয়ে যায়। আমি সুযোগের অপেক্ষা করছিলাম। রাতের দিকে উনি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমার লকাপে আসেন। একাই ছিলেন। প্রথমে এসে বললেন, “তুই সত্যি ড. দাসকে মেরেছিস? কেন, কেন মারলি ওকে?” আমি শান্ত গলায় বললাম, “আমি মারিনি তো, শুধু ওর ঠিকানায় পৌঁছে দিয়েছি, ওর ঠিকানায়।” “কি বলছিস এসব, তোর গলা অন্যরকম লাগছে কেন, কে তুই?” বলেই উনি চিৎকার করে হয়তো কনস্টেবলদের ডাকতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই আমি জোরে ওর মুখ চেপে ধরলাম। কানে কানে বললাম, আমায় চিনতে পারছেন না, সেদিন আমাকে আমার ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে আসলেন যে, আমি উপকার ভুলিনা দারোগাবাবু। আজ আপনাকে আপনার ঠিকানায় পৌঁছে দেব। বলে ওনার কোমর থেকে বেল্টটা খুলে নিয়ে ওর গলায় জড়িয়ে চেপে ধরলাম। ওর চোখগুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগলো, একটুখানি নড়াচড়া করেই উনি স্থির হয়ে গেলেন।” অহনা এত ক্ষণে ওর কাছে এসে বসেছে, মনের ভয়টা অনেকখানি কেটে গেছে, তার বদলে মনে জন্ম নিয়েছে অনেকখানি ঘৃণা, এই সমাজের প্রতি, এই মানুষগুলোর প্রতি। ও বলে উঠলো, “তুমি আমার কাছে কেন এসেছ? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি।” স্বরূপ বললো, “আপনাকে আমার শেষ কাজটা করতে হবে ম্যাডাম, প্লিজ।” অহনা বললো, “কি কাজ, আর একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি তো এমনিই ওদের মেরে ফেলতে পারতে, এত কিছু করলে কেন?” স্বরূপ বলল, “তখন মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক মনে হতো না সবার, এখন দেখুন কেউই এখানে ভৌতিক কিছু ভাববে না, সবাই এগুলোকে সাধারণ খুনই ভাবছে। তাই শেষ কাজটা আপনাকে করতে হবে। এখনো একজনের শাস্তি পাওয়া বাকি। এই ডোম, যার শরীরে আমি আছি, এ তো এখনো বেঁচে। তাই যে গাছটায় আমাকে মারা হয়েছিল, ওই গাছটাতেই আমি আজ রাতে ফাঁসি লাগিয়ে মরবো, মানে ডোমটা মরবে। কাল আপনি পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ঐটাকে সুইসাইড বলেই লিখবেন। যাতে সবাই ভাবে ডোম, ডাক্তার আর দারোগাকে মেরে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে সুইসাইড করেছে।” অহনা বললো, “সে তো এমনিতেই ওটা সুইসাইডই হত, এমনিতেই আমি লিখতাম, কিন্তু তুমি আমার কাছে এলে কেন, আর আমাকেই বা কেন সব ঘটনা বললে?” স্বরূপ বললো, “কারণ আছে ম্যাডাম, আপনাকে দেখেই আমার ভালো মানুষ মনে হয়েছে। আসলে আত্মারা একটু সহজেই মানুষ চিনতে পারে। আমার ছোট বোনের ইচ্ছে ও খুব পড়াশোনা করবে, বড় হয়ে ডাক্তার হবে। পারবেন না ম্যাডাম, ওর ইচ্ছেটা পূরণ করতে, পারবেন না ওর পড়ার খরচটা দিতে, ওরা যে বড় অসহায়। “এই বলে সে হাত জোড় করে মাথা নিচু করে রইল। “আমি পারবো, পারবই, আমার এই দাদার কথা আমি রাখবো,” দৃঢ় গলায় অহনা বলল। স্বরূপ আপ্লুত হয়ে বলল, “এই দুনিয়াতে এখনো মানুষ আছে ম্যাডাম, এখনো মানুষ আছে।” এই বলে ও জানলা দিয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল। পরদিন সকালে সবাই ওই তেঁতুল গাছে ডোমকে ফাঁসিতে ঝুলে থাকতে দেখলো। দশ বছর পর … “দিদি, আজ আমার ফাইনাল ইয়ার এর রেজাল্ট বেরিয়েছে, আমি ভালো ভাবে কোয়ালিফাই করেছি দিদি, now I am an MBBS. আজ যে আমার কি আনন্দ হচ্ছে, সবই আপনার জন্য হয়েছে দিদি, আপনি আমার কাছে ভগবান, আজ দাদার জন্য মন কেমন করছে দিদি, যদি দাদা আজ দেখতো, ও কত খুশি হত” ফোনের ওপার থেকে বর্ণালী কথাগুলো বলল। বর্ণালী বর্মন। ঠিক ধরেছেন, স্বরূপ বর্মনের ছোট বোন। অহনা কথাগুলো শুনলো, ওর দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো, ও তখন বললো, “আমারও খুব আনন্দ হচ্ছে রে, আর আমি এমন কি করলাম, যা করেছিস তো তুই, তোর দাদা ঠিক ওপর থেকে দেখছে সব, I am proud of you।” এরপর অহনা আকাশের দিকে চেয়ে বলল, “এই পৃথিবীতে তোমাদের খুব দরকার স্বরূপ, জীবিত অবস্থায় না পারো, আত্মা হয়েই বার বার ফিরে এসো, যারা মুখোশের আড়ালে সমাজটাকে নষ্ট করছে, সেই নর্দমার কীটগুলোকে ধ্বংস করো।”