Getting your Trinity Audio player ready...
|
সেই তখন থেকে পিছু নিয়েছে ছায়াটার। আজকে যে ওটার আর নিস্তার নেই। কোন এক অজানা মোহ কাজ করছে সেটার উপর। স্কুলের ১০০ মিটার শর্ট রানেও এত জোরে দৌড়ায়নি অ্যাথলেট অমিত।
– এই দাড়াও বলছি (ঘুমের ঘোরে অমিত)।
– কোথায় দাঁড়াবো (বাস্তব জগৎ)।
– ওখানে স্থির হয়ে দাঁড়াও আমি আসছি
– কোথাও যেতে হবে না তোর ওঠ তো এখন। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে এলো তারপরও ছেলে এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।
ঘুম আর বাস্তবতাকে একসাথে মিশিয়ে মজাদার মসলা বানানোর কাজটি ইতিমধ্যে শেষের পথে। সেই মসলাতে চিকেন কারি রান্নাটা ভালোই জমবে।
-ধুর আপি! তুমিও না! একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দেবে না। এত সকালে কেউ ঘুম ভাঙ্গায় বলো!
– সকাল! ঘুম এর মধ্যে তুই কোন গ্রহে ছিলিস বলতো? ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন, পৃথিবীর এই প্রান্তে এখন দুপুর হতে যাচ্ছে বুঝলি? ইটস ফাইভ মিনিটস টু টুয়েলভ ডিয়ার!
– বারোটা! সিরিয়াসলি!!
– না বাবা আনসিরিয়াসলি। যা তো! এখন দ্রুত ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়ে আমাকে উদ্ধার কর।
এভাবে ওকে আগলে রেখে কোলে পিঠে করে বড় করেছে অদিতি। ওর কাছে অমিতিই যেন পুরো দুনিয়া। জন্মের কিছুদিন পর চিরতরে পরপারে চলে যাওয়ায় বাবার মুখটা মনে নেই অমিতের। সেটাই স্বাভাবিক কিনা। তবে মায়ের মুখটা খুবই মনে পড়ে অমিতের। বাবা মারা যাওয়ার পর তার মমতাময়ী মা ই তাদের দুই ভাই-বোনকে আগলে রেখেছিলেন। কয়েক বছর হলো তিনি অমিত – অদিতিকে ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন ওদের বাবার কাছে না ফেরার দেশে। আর তখন থেকেই অমিতের প্রধান অভিভাবক অদিতি। ব্রাশ করতে করতে অমিতের হঠাৎ মনে পড়ল আজ তো তার ম্যাজিক মামার আসার কথা তাদের বাসায়। সুদূর আফ্রিকা থেকে কিছুদিন আগে দেশে ফিরেছেন তিনি। মামার নামছে ম্যাজিক কিংবা তিনি হে ম্যাজিক জানেন এমন কিছু কিন্তু নয়। এখানে যে কারো মনে প্রশ্ন আসবে এই যে এই নামটা রহস্য কি তাহলে? আর সেটাই তো স্বাভাবিক। মামারা আসল নাম হাবিবুর রহমান। সবাই হাবিব বলেই ডাকে মামাকে। এখন কাজের চাপের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকাতে বছরের বেশিরভাগ সময় থাকেন তিনি। সেই অমিতের ছোটবেলায় যে এবার তিনি ওদের বাসায় এসেছিলেন তখনকার ঘটনা। অমিতের মা তখন বেঁচে আছেন। ঘটনার সময় বোধহয় তিনি রান্নাঘরেই ছিলেন।
– জানিস পুচকু আমি দিনকে রাত বানিয়ে দিতে পারি নিমিষেই।
– (অমিতার অদিতি অবাক হয়ে) সত্যি মামা!! কী যে বলো! তাই আবার হয় নাকি?
– আরে দেখবি তো আগে পারে কিনা তারপরে না বলবি।
মামা তাদের খুবই রসিক প্রিয়। সুযোগ পেলেই মজা নেন ভাগ্নেদের সাথে। সেদিনের ঘটনাটাও ব্যতিক্রম কিছু নয়।
– ম্যাজিক দেখতে হলে তো প্রথমে চোখ বন্ধ করতে হবে। নে, অমিত, এখন চোখ বন্ধ করতো। তারপর দেখ কি হয় ম্যাজিক তো শুরু হবে তখন।
এদিকে অমিতের চালাক বোন বয়সের অভিজ্ঞতার কারণে হালকা আন্দাজ করতে পেরেছিল। কৌতুহলী অমিত চোখ একদম টাইট করে বন্ধ করে অপেক্ষা করছে ম্যাজিকের জন্য। ওদিকে তার বোন অদিতি তো সবই দেখছিল। বুঝতে পারছিল কিছু একটা হবে। এজন্য চুপিচুপি হাসছিল। এই ফাঁকে নিজের মাথার পেছনে লাগানো সানগ্লাসটা খুলে মামা অমিতের চোখে লাগিয়ে দিয়ে অমিতকে চোখ খুলতে বললেন। এদিকে সানগ্লাস সম্পর্কে অজ্ঞাত অমিত তো তখন ছোট্ট নাবালক বাচ্চা। সানগ্লাস জিনিসটা কখনো চোখেও পড়ে নি ওর। হত এটাও জানত না যে দিনকে রাত বানানোর ক্ষমতা শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার ই আছে। মামা প্রথমে বুঝতে পেরেছিলেন ছোট বাচ্চা অমিতের কান্নাকাটির একটা ঘটনা ঘটলেও ঘটতে পারে। এজন্য পরে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আসল রহস্যটা তারপর বুঝতে পেরেছিল অমিত। ম্যাজিক মামা নামকরণের ইতিহাস এখান থেকেই শুরু। মামার মত অদিতিও হালকা রসিক প্রিয় স্বভাবের। আর বেচারা অমিত বরাবরের মতোই সবকিছুর ভোক্তা। আর তখন থেকেই সবকিছু সিরিয়াসলি নেয় না অমিত। যদিও সেই মজা করাটা অদিতি হালকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখত কারণ সে জানত যে তার ছোট্ট ভাইটা হালকা আবেগি। তবে ইতিবাচক বিষয় হল এটা পরিণত হওয়ার পাশাপাশি অমিত এখন আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী হতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু একটা জায়গায় তার দুর্বলতা থেকেই গেছে। সেটা হলো তার মমতাময়ী মা। মায়ের মমতাময়ী মুখটাতে মাঝেমধ্যেই সেজে হারিয়ে যায়। কল্পনায় তখন সে তার মাকে খুঁজে বেড়ায়। কখনো কখনো মিছিমিছি তার মাকে পেয়েও যায়। মূলত মায়ের বেদনা কমাতে অদিতির অমিতের সাথে হালকা রসিকতা করে থাকে। তো একদিন স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দুইটা পুরস্কার পেয়ে অনেক আনন্দের সাথে খুশিমনে বাড়িতে ফিরে তার আপুকে জানালো। মনে মনে অনেক খুশি হলো বাইরে থেকে একটা সিরিয়াস ভাব নিয়ে আছে অদিতি। পড়াশোনায় ভালো করার পাশাপাশি অদিতি বিভিন্ন রকম প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। মুখ অভিনয় একক অভিনয় কিংবা নাটক সবকিছুতেই পারদর্শী আছে ওর।
– আপু, জানো জানো আমি আজকে দুইটা পুরস্কার পেয়েছি।
– হেহ্! তাতে কি হয়েছে? কেউ বুঝি পুরষ্কার পায়না? তাছাড়া আমি তো আগেই জানতাম যে তুই দুইটা পুরষ্কার পাবি।
– অ্যা… মোটেও না। তুমি কিভাবে জানলা? বললেই হলো নাকি তুমি কি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার স্কুলে গিয়েছিলে নাকি? বাতাও বাতাও সাচ বাতাও!
– দেখো দেখি ছেলের কাণ্ড। তোর বিশ্বাস হয় না.. যা দেখতো আমার টেবিলের উপর কয়টা রুবিক্স কিউব আছে। যে কয়টা থাকবে সে কথা মিলিয়ে নিবি আমি সেটাই জানতাম। আমিতো জানতামই যে আমার ভাইটু পুরস্কার পাবেই। হা হা। যা গিয়ে দেখ আগে।
অমিতের মনে হচ্ছিল এটা সম্ভব নয়। তবুও আপুর রুমের দিকে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলো। দরজা খুলে যা দেখতে পেল তা দেখে অমিত নিতান্তই হতভম্ব হয়ে পড়লো। টেবিলের উপরের দৃশ্য দেখে অমিত অবাকই হল। আসলেই তো ওখানে দুইটা রুবিক্স কিউব রাখা। এটা কি আসলেই সম্ভব! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না অমিত। গণিতের পাশাপাশি রুবিস্কিউবেও প্রচণ্ড অনুরাগ আছে অদিতির। গণিত অলিম্পিয়াডে দারুণ সফলতার গল্প রয়েছে তার। আর রুবিকস কিউবের কথা বলতে গেলে উল্লেখযোগ্য পরিবহন রুবিক্স কিউব তার সংগ্রহে রয়েছে। কিন্তু এখনো আসল জিনিসটাই বুঝতে পারছনা অমিত। অদিতি কিভাবে বুঝবো যে সে দুইটা পুরস্কার পেয়েছে। অদিতি তো বললও আজ নাকি ওর স্কুলে যায়নি। টেবিলের ওপর থেকে রুবিক্স কিউব দু’টো নিয়ে দ্রুত ছুটল তার আপুর কাছে।
– বলো না আপু কিভাবে বুঝলা যে, আমি দুইটা পুরস্কার পেয়েছি এটা কিভাবে সম্ভব হলো।
-ম্যাজিক ম্যাজিক। হা হা।
-আহা বলো না! তুমিও না! শুধু মামার মত রসিকতা।
-আরে তেমন কিছু না। তুই বোধ হয় খেয়ালই করিস নি দরজা দিয়ে ঢুকে ছটি সমতল জায়গা আছে টেবিলটা ছিল দুই নাম্বারে। সমতল জায়গা এর নম্বর অনুযায়ী একটা দুইটা তিনটা চারটা পাঁচটা ছয়টা করে কিউব রাখা ছিল বাকিটা তো তোর নিজেরই বুঝে যাওয়ার কথা। হা হা।
-ধুর আপু তুমিও না! খালি মজা নাও মামার মত। নতুন ম্যাজিশিয়ানের আবির্ভাব হলো আমাদের বাসায়।
-হাহা, যাইহোক। কনগ্রাচুলেশন ব্রাদার।
-ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, ট্রিট তো দেয়াই উচিত।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ। অবশ্যই অবশ্যই দে দে, ট্রিট দে।
-ধুর, তুমিও না! ফের রসিকতা… ছোটদের কে ট্রিট দিতে হয় নিতে হয় না।
– আচ্ছা, আচ্ছা। বাবা দেখা যাবে।
এভাবেই খুনসুটি চলতে থাকে। ওদের দু’জনের মধ্যে বেড়ে ওঠে সখ্যতা। মামার এয়ারপোর্ট চেকিং শেষ করে ওদের বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা লেগে গেল। মামার জন্য তার প্রিয় মুরগির মাংস রান্না করা হয়েছে আজ। রাত্রে বেলা খাওয়ার সাথে সাথে মামা-ভাগ্নে দের আড্ডা ও জমে উঠেছে ডাইনিং টেবিলে।
মামা – তোরা দুইজন যে মুরগির মাংস খেয়ে এত মজা পাচ্ছিস, আমাদের আফ্রিকাতে এ রেসিপি পুরোপুরি বোরিং, আর পুরনো জিনিস বুঝলি!
অমিত – সেকি! চিকেন রোস্ট তোমার অনেক পছন্দের। এইজন্যই তো আপু এত কষ্ট করে রান্না করলো তোমার জন্য।
মামা – আরে পছন্দের না কখন বললাম! আমার তো এখনো অনেক পছন্দের মেন্যু এটা।
অদিতি – তাহলে এসব বোরিং পুরাতন হাবিজাবি কি বলতেছো?
মামা – আরে বুঝলিনা! আমিতো আফ্রিকার মানুষের কথা বললাম।
অমিত – হুম, বুঝলাম। জঙ্গলের মানুষ তো সাপ টিকটিকি খাবে। তাইনা, আপু? হাহা।
অদিতি –অমিত একদম মনের কথা বলেছিস। হা হা।
মামা- এই কি বলছিস, হ্যাঁ? আমি কিন্তু ওসব খাইনা একদম।
অদিতি -তাহলে তুমি কি না খেয়ে থাকো নাকি? হা হা।
মামা- সবখানেই হালাল খাবারের ব্যবস্থা থাকে রে পাগলা।
অদিতি – ও হ্যাঁ তাইতো। আমিও শুনেছি এটার কথা।
অমিত- ও হ্যাঁ। তাইতো অনেক দেশেই তো বাঙালি কিংবা হচ্ছে মুসলমান থাকে।
মামা – আরে তোরা কি তোদের মামাকে অতটাই অকর্মের ভেবেছিস নাকি! তোদের মামা রান্না ও পারে বুঝলি!
অদিতি- ওয়াও মামা। জোস তো। সত্যি নাকি আবার সেই ম্যাজিক? হা হা।
মামা -আরে ধুর এটা সিরিয়াসলি বলতেছি।
অমিত – তুমি কি কি রান্না করতে পারো মামা? আমাকেও শিখায় দিবা?
মামা – চিকেন তো আমি মাঝেমধ্যে রান্না করে থাকি। আর তোরা আফ্রিকা মানে কি সব জঙ্গল বলতেছিলিস?
অদিতি -হাহা। জঙ্গলে থাকলে তো জঙ্গল বুঝবো। তা না হলে কি বলব? হাহা।
মামা -তোরা সাহারা মরুভূমির নাম শুনেছিস? তারপর নায়াগ্রা জলপ্রপাত?
অমিত – হ্যাঁ হ্যাঁ। শুনবো না কেন? অনেকবার শুনেছি নায়াগ্রা জলপ্রপাত তো অনেক সুন্দর নাকি দেখতে।
অদিতি -আফ্রিকা মহাদেশ টাতে প্রকৃতির অনন্য রূপ দেখা যায় মামা
মামা- এক্সাক্টলি!
অদিতি – মামা মামা তুমি তো অনেক জায়গায় ঘুরেছো তাইনা বলো!
মামা- বিদেশ তো ঘুরেছি ভাগ্নে। কিন্তু নিজের দেশ ই তো ঘুরতে পারলাম নারে। এই আফসোস কোথায় রাখি বল?
অমিত – কিছুদিন পর আপুর ইন্টার্নি আর আমার কলেজের ফাইনাল এক্সাম দু’টোই শেষ হবে চলনা ট্যুরে বেড়োই আমরা।
অদিতি- হ্যাঁ, মামা চলোনা, চলো চলো চলো। অনেক মজা হবে।
মামা – চল, তাহলে এবার কক্সবাজারেই যায়। নাকি?
আদিতি – ইয়াপ। ডান। কক্সবাজারেই যাব।
অমিত- মামা তুম তো গ্রেট হো।
মামা – বাব্বাহ! ভাগ্নেরা দেখি ভালোই হিন্দি পারে।
অমিত- হাহা। এটা তো তেমন কিছু ও না। হালকা।
মামা- ভালো ভালো। অনেক কিছু জানিস তোরা। আচ্ছা, বলতো আফ্রিকার ভাষা কি?
অদিতি- আমি বলব, আমি বলব। আফ্রিকান্স না?
মামা- বাহ। আমার ভাগ্নেরা তো অনেক ব্রিলিয়ান্ট।
এতক্ষণ খাওয়া দাওয়া থেকে গল্প আর খুনসুটিই হচ্ছিলো বেশি। ঘন্টাখানেক লেগে গিয়েছিলো ওদের ডিনার করতে। বিদেশের লোকজন অনেকক্ষণ ধরে খাওয়াদাওয়ার পর্বে অংশ নিয়ে থাকে। তবে এদের মত এতটা গল্প আর হয়না হয়তো বিদেশিদের। তবে আপাতত মূল কথা হচ্ছে ওদের খাওয়া শেষ। অদিতি আর মামা আগেই উঠে পড়েছেন। অমিত এখনো টেবিলেই বসে আছে। মানু বুয়া টেবিলটা গুছিয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ মানু খেয়াল করলো কি যেন ভাবছে অমিত। কক্সবাজারের কথা শুনে ওর হয়ত ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গিয়েছে। সেইবার মায়ের সাথে গিয়েছিল ওরা দুইজন। কত্ত মজা হয়েছিল সেবার। মায়ের বড্ড আদরের ছিল অমিত। শাসন যেমন ছিল না, তেমনিভাবে ছোট্ট অমিতের কোনো আবদার ই যে তার মা অপূর্ণ রাখতেন না। এ যেন পুরো সোনায় সোহাগা। বাবার অভাবটা বুঝতেই দেননি ওদের মা। অবশ্য মায়ের আদরের সাথে যে কোনো কিছুরই তুলনা হয়না।
অমিত বাবু। উঠে পড়ো, হাত ধুয়ে নাও। সকালে কলেজ আছে না তোমার? ঘুমাইতে যাবা না তুমি রাত্রে?
মানু বুয়ার ডাকে হকচকিয়ে উঠে অমিত। এতক্ষণ পরে ফিরে আসে বাস্তব জগতে। ওর তো কলেজে যেতে হবে কাল। নাহ! এটা অস্বীকার করা যাবেনা যে সে তার গর্ভধারিণী মা কে প্রচণ্ড মিস করতেছিল তখন। সেটাই তো স্বাভাবিক। মায়ের কারণেই তো আজ ও এই সুন্দর পৃথিবীর আলো দেখতে পারছে। কত কষ্টই না দিয়েছে তার মাকে। কত কষ্টই না দিয়েছে মা কে। টানা দশ মাস মায়ের ভালোবাসার চাদরেই গর্ভে মোড়ানো ছিলো। মানু বুয়া ওদের বাসায় সবসময় থাকে না। অদিতির পরীক্ষার সময় টুকুনই আর কি। বাকি সময়ে দুই ভাই বোনের দিনকাল ভালোই কাটে। রান্নাঘর অদিতি সামলায়। বাকি ঘর গোছানোতে অমিত যথেষ্ট সাহায্য করে থাকে। চেয়ারটা হালকা পিছিয়ে হাত ধোয়ার জন্য উঠে পড়লো অমিত। বেসিনের আয়নাতে ডোরেমনের স্টিকারগুলো অমিতেরই লাগানো। সারাদিন টিভি সেটের সামনে পড়ে থাকত অমিত। তার বোন অদিতিও তার সঙ্গ দিতে ভুলত না। অনেকটা নেশা হয়ে গিয়েছিল ওদের। ডোরেমন কার্টুন দেখতে দেখতে হিন্দি ভাষাটাও অনেকটা রপ্ত করে নিয়েছে দুই ভাই বোন। তারপর থেকে তো ওদের হিন্দি ভাষার উপর আলাদা টান কাজ করে। মাঝেমধ্যে এজন্য হিন্দি বলেও ফেলে কথা বলতে বলতে। এর ফাঁকে বাল্লেবাজ, কাপ্তান, খিলাড়ি সহ আরও কতকগুলো ক্রিকেটের শব্দ শিখে নিয়েছে অমিত। ক্রিকেট যে ওর অনেক পছন্দের খেলা। ছেলে বেলায় মায়ের চোখ কে ফাঁকি দিয়ে কতবার যে লুকিয়ে লুকিয়ে খেলতে চলে গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ক্রিকেটের সাথে যে ওর অনেক মধুর স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। গত বছরও জেলা পর্যায়ে সেরা ক্রিকেটারের ক্রেস্টটি অমিতের ঝুলিতেই এসেছিল।
অদিতির ইন্টার্র্নি আর অমিতের কলেজ ফাইনাল দু’টোই শেষ। বরাবরের মতোই অদিতির ডাকে ঘুম ভাঙ্গে অমিতের।
এখন অন্তত বোইলো না যে সকাল হয়ে গেছে। আমি ঘুমাইলাম ই তো দুপুরে। আরেকটু ঘুমাইতে দাও না আপু।
আরেহ উঠ উঠ। পারলে আবার এসে ঘুমাস। সারাদিন পাইছে শুধু ঘুম আর ঘুম।
আবার এসে মানে? এই ভর দুপুরে কোথায় যাব আমি?
আরেহ তোকে বাইরে যেতে কে বলল?
তাহলে? কোথায় যাব?
সোফার রুমে চল
ধুর আপু, তুমিও না এখন টিভি দেখার কোন মুড নেই। রাত্রে দেখবো নি।
– তোকে টিভি দেখতে কে বলল?বলতো?
তাহলে সোফায় ঘুমাবো নাকি?
আরে ধুর ট্যুরের প্লানিং হবে। আর মিস্টার, এখন তুই দুপুর কোথায় পেলি? সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। সোফার রুমে আয় তাড়াতাড়ি। মামা কোথায় যেন বেরোবেন।
ট্যুরের কথা ভেবে অমিতের আবার পুরনো কথা মনে পড়ে যায়। অনেক দুরন্ত ছিল অমিত তখন। এর মধ্যে একবার হারিয়ে উপক্রম হয়েছিল। ছোটবেলা থেকে অনেকটাই কম শাসন করা হলেও সেবার হালকা বকা শুনতে হয়েছিল মায়ের কাছ থেকে। মাঝে মাঝে যদিও একটু আধটু শাসন এর প্রয়োজন আছে। তবে অমিতের মা কখন ও মারেন নি অমিতকে। সামান্য বকাঝকার মধ্যেই মধ্যে সীমিত ছিল। ওঘর থেকে আপন ডাকে বাস্তব জগতে ফিরে আসে অমিত।
-আরেহ ওয়াও মামা। লুকিং শার্প।
– থ্যাঙ্ক ইউ! থ্যাঙ্ক ইউ!
– কোথাও বের হবা নাকি?
– মামিও যাব তোমার সাথে? হাহা।
– আরে তেমন কিছু না।
– মামা ছেড়ে কাশো।
– ক্লায়েন্টের মিটিং আছে এক ঘন্টা পর।
বাসার পিছনে অফিস হওয়াতে কত চিল আছে মামা দেখ অমিত।
হ্যাঁ সেটাই তো আসল মজা চঞ্চল প্ল্যানিং করি। না হলে লেট হয়ে যাবে পরে।
চলো চলো। ইউ প্লীজ প্রসিড।
তো কোনটায় যাবি? ইউএস-বাংলা নাকি রিজেন্ট?। অনলাইনে বুক করে রাখি
মামা আমি বলি আমি বলি যাওয়ার সময় বাস অথবা ট্রেনে যাই। চট্টগ্রামেও পর্যন্ত ট্রেন আছে। তারপর বাস …। কেমন হয় বলতো?
হ্যাঁ হ্যাঁ আর ফেরার সময় না হয় প্লেনে আসবো। সমস্যা নাই।
আচ্ছা তাহলে এটাই ফাইনাল। আমি তাহলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রেনের টিকেট কেটে ফেলি বাকিগুলো টিকিট এমনি পাওয়া যাবে।
আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে সব।
কিন্তু মামা…..
আবার কি হলো?
আরে যাইবা কবে? সেটাই তো বললা না।
আরে হ্যাঁ। তাইতো! ভুলেই গেছিলাম। সামনের মঙ্গলবার। ঠিক আছে না?
হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক আছে মঙ্গলবারে মঙ্গল যাত্রা।
আরে ওয়াহ বেহেনা! কে কবিতা কাহাহে।
হা হা। কার বোন দেখতে হবে না! আর মামা পারলে হোটেলের টিকিট বুক করে ফেলাইও, বেটার হবে আই গেজ।
আচ্ছা মাথায় রাখবো। থাক তাহলে তোরা। ঘুরে আসি।
হোটেলের কথা শুনে অমিতের আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায় জায়গাটা ঠিকানা
মনে না থাকলেও এতটুকু মনে আছে হোটেলের মাথায় একটা সূর্য ছিল।
তার মানে এই না যে হোটেলের উপর দিয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হতো। সেটা অন্য কিছু ও হতে পারে। তখনকার দিনগুলো আজও ঝাপসা হয়ে আছে তার স্মৃতির পাতায়। ওর ভেতরের কিছু অংশ চাইছে সেগুলো চিরতরে মুছে দিতে আবার কিছু অংশ চাচ্ছে স্মৃতিগুলোর রোমন্থন হোক বা হয়তো কিছু অংশ চাচ্ছে সেগুলো আঁকড়ে ধরে অমিত বেঁচে থাকুক জীবন সংগ্রামে।
কিরে কোথায় হারালি?
কোথায় হারাবো?
লিস্ট শুরু করছিস?
কিসের লিস্ট?
আরে বার্মিজ মার্কেটে যাবো না? এবার একটা সাঁওতাল ড্রেস তো কিনবই কিনব।
হা হা তোমাকে বাচ্চার মত লাগবে।
ধুর, কে বলেছে? লাগলে লাগুক। আমি তো আর বাচ্চা না।
হাহা দেখবনি।
ওহো হ্যাঁ, বার্মিজ আচার পিনার চকলেট এগুলোও লিখিস লিস্টে।
এত কিছু যে! মামার স্পন্সরশীপ নিবে নাকি?
হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। সন্দেহ কোথায়? মামার তো বিয়েও আছে!
তাই তো ঠিকই বলেছ। লিস্টে আরও দাও! আরও দাও! হাহা।
তুই ও দে কিছু। হাহা। ষোলো কলা পূর্ণ হবে।
আচ্ছা আচ্ছা।
মামারব বয়স কিন্তু ভালই। ২৮এর বেশি। অদিতির চেয়ে কয়েক বছরের বড়। তবে দেখে অতোটা বোঝা যায় না। নিজের শরীর নিয়ে যথেষ্ট সচেতন মামা। নিয়মিত পরিশ্রমের পাশাপাশি জিমেও যায় ব্যস্ততার মাঝে সময় করে। দেখে মনে হয় হয়ত ২২ বছর বয়স।
বয়সের কারণে ওদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছে তবে ওদের সাথে বেশি একটা সময় কাটানো হয়নি। ব্যস্ততার কারণে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াতে দিন চলে যায় মামার। এইতো প্রায় দশটা বেজে যাচ্ছে মামার আসার সময় চলে এসেছে। এসে খাওয়া-দাওয়া করে যথা নিয়মে আর্লি টু বেড এন্ড আর্লি টু রাইজ কবিতার মত নিয়ম মেনে চলেন মামা।
– আপু পরশু না মঙ্গলবার?
বাবা আজকে সূর্য কোন দিকে ওঠে ছে রে?
আহা বলোই না আপু!
আরে বাবা হ্যাঁ মঙ্গলবার। কিন্তু কি হয়েছে তোর?
আমার আবার কি হবে?
দিনক্ষণ মনে রাখার পাত্র তো তুই না।
আরে পরশুদিন যাব না আমরা?
খোকা এইবার পথে রয়েছে।
হাহা। তোমার প্যাকিং শেষ?
কি বলিস? শুরু করলাম নাতো। কেন তোর শেষ নাকি?
কি করে বুঝলা?
হাহা যেভাবে লাফাচ্ছিস! যেন এখনই তোর ট্রেন তোর
আরে ধুর হালকা এক্সাইটেড তো অবশ্যই। এজন্যই আর কি।
সেটা তো বুঝতেই পারছি কুহু।
আচ্ছা, মামা কোথায়?
ছাদে মনে হয়। ওই হয় না বিয়ে বিয়ে ভাব, বৌয়ের অভাব হাহা।
অভাব কোথায় পাচ্ছ? বিয়ে করেই তো যাবে এইবার।
হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটারই তো অপেক্ষায় আছি। অনেক মজা হবে। তাই না বল!
তা তো অবশ্যই। আচ্ছা থাকো। মামাকে হালকা জ্বালিয়ে আসি।
বাবা মা মারা যাওয়ার পর এই একমাত্র মামা ওদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, লালন পালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি মানসিকভাবেও ওদের রেখেছেন আগলে।
নয়তো এভাবে হয়তো হাসি খুশিতে মেতে থাকতো না দুই ভাই বোন। আর দশটা ছেলে মেয়েদের মতো ওদের কেউ কাটাতে হতো ইয়াতিম খানায়। আর স্কুল-কলেজের খরচের পাশাপাশি টিউশান ফিস হাতখরচ তো রয়েছেই। অদিতির কঙ্কালের খরচ থেকে শুরু করে হাজার হাজার টাকার বইয়ের খরচ দিতে তিনি দ্বিতীয় বার ভাবেননি বা পিছপা হননি। অমিতের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয় অনেকটা ভাই বোনের মত সখ্যতা এদের। ওদের একমাত্র দায়িত্বশীল অভিভাবকদের মামাই।
মামা, কি করো?
ভাবতে ছিলাম রে।
কি ভাবো? মামি কি করতেছে, এমন কিছু? হাহা।
আরে না ভাবছিলাম, অনেক দিন ট্রেনে যাতায়াত হয়না।
হাহা এত চিন্তা কিসের? পরশু যাব আমরা।
আরে ওটাই তো ভাবছিলাম। ট্রেন জার্নি অস্থির। বুঝলি?
আমি কি করে বলব, বলো। ট্রেনে তো এটা আমার প্রথম যাত্রা।
ও, তাহলে তো আরো ভালো লাগবে তোর।
হুহু। হোপিং ফর দ্যাট টু, মামা। আচ্ছা তোমার প্যাকিং শেষ?
অর্ধেক মত হয়েছে। কাল সকালের মধ্যে হয়ে যাবে।
জানো জানো, আমার প্যাকিং শেষ।
হাহা। এজন্যই বুঝি এত খুশি!
হুহু বলতে পারো। আচ্ছা নিচে এসো। নাস্তা করে যাও।
যা। তুই যেতে থাক। আমি আসতেছি।
ওকে ওকে আসো আসো।
বড় হয়ে গেলেও অমিতের বাচ্চামি এখনও যায়নি। মাঝেমধ্যে বাচ্চা সুলভ আচরণ করে বসে নিজের অজান্তেই। সেইবার কক্সবাজারে যাওয়া-আসার দু’টোই হয়েছিল প্লেনের মাধ্যমে। ওদের মায়ের কোন এক ক্লাসমেট বন্ধু রিজেন্ট এয়ারলাইন্স এর সাথে যুক্ত ছিলেন। সে ই টিকিটের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই ট্যুর এর কথা অমিতের তেমন একটা মনে না থাকলেও অদিতির পুরোটাই মনে আছে। একেবারে যাকে বলা যায় অদ্যপান্ত। তবু পুরনো স্মৃতি ঘেঁটে কষ্ট পেতে একদম প্রস্তুত অদিতি। এজন্য মাঝে মাঝে মনে পড়লেও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
অমিত – মামা হোটেলে রুম বুক করিয়াছো?
মামা- হ্যাঁ, রে দ্বিতীয় তলায়। ঠিক আছে তো?
অমিত- কোন হোটেলে মামা?
মামা -হোটেল কক্স টুডে’তে। একচুয়ালি ওখানে আমার একটা কলিগ উঠেছে। ওকে দিয়েই বুক করলাম। ও যদিও চারতলায় উঠেছে
অমিত- আপু তোমার কি মনে আছে গত বছর আমরা কোন হোটেলে উঠে ছিলাম?
অদিতি- অত খেয়াল রাখে নাকি কেউ? বাদ দে তো!
অমিত- আমার শুধু মনে আছে উপরে একটা সূর্য ছিল।
মামা-তুই মনে হয় হোটেল সান শাইন এর কথা বলছিস।
অমিত- হতে পারে। কিন্তু, তুমি কিভাবে জানলে?
মামা- আরে গুগল ম্যাপ আছে না! হোটেল কক্স টুডে এর পাশেই মনে হয় ওটা।
অদিতি- অত দেখার কি আছে? আমরা তো যাবো হোটেল কক্স টুডে’তে। সেটা নিয়ে ভাবতো।
অমিত- হ্যাঁ হ্যাঁ। তাইতো! আচ্ছা মামা দেখতো ওখান থেকে বার্মিজ মার্কেট কত দূরে?
মামা- দেখেছিলাম। বেশি দূরে হবে না রে। পালকিতে যেতে ১৫ মিনিট মতো লাগতে পারে বেশি হলে। বড়জোড় আর কি।
অদিতি- পালকি! আমরা কি বিয়ে করতে যাব নাকি মামা!
মামা- আরে নারে পাগল! পালকি চিনিস না! এটা অনেকটা ইজি বাইকের মত যদিও পেছনটা হালকা রিক্সার মত দুইটার কম্বিনেশন বলা যায়
অমিত- ওহো আমি চিনেছি আমি চিনেছি। সেদিন নেটে কোথায় জানি দেখেছিলাম।
অদিতি -কাল ট্রেন কয়টায় মামা?
মামা- বারোটায় রে। আমরা বের হব দশটার পরে। তাদের সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিস তো?
অমিত ও অদিতি- হ্যাঁ, মামা একদম সব শেষ গোছানো।
মামা- যা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়, একটা ফ্রেশ ঘুম দিয়ে নে জার্নির আগে।
মামা চলে গেল। অমিত অদিতি দু’জনে ঘড়ির দিকে তাকালো। দশটা বাজতে চলেছে। অমিত কিংবা অদিতি কারোরই এসময়ে ঘুমানোর অভ্যাস নেই। ভাবছে কি করবে।
অমিত- আপু এত তাড়াতাড়ি ঘুমানো কিভাবে সম্ভব?
অদিতি- আমিও তাই ভাবছি। আচ্ছা রুমে যা। লাগেজ চেক কর সব ঠিকঠাক আছে কিনা। লিস্ট এর সাথে মিলিয়ে নিস।
অমিত- ও আচ্ছা। তাই তো ঠিক বলেছ। ওটাই ভালো হবে আরেকটু পরে ঘুমানো যাবে। কি বলো?
অদিতি – হুম।
বেলা ১২ টায় ট্রেন ওদের। আর এখন রাত বারোটা। পুরো ১২ ঘন্টা বাকি। এদিকে অমিতের ঘুমই আসছে না। প্রথমবার বাবা মা ছাড়া এত দূরের যাত্রা। একটি রোমাঞ্চকর ও লাগছে ওর কাছে। তবে হঠাৎ একটা অস্বস্তি ও কাজ করছে মনের ভেতরে। মনে হচ্ছে সেই ছায়াটাকে আবার তাড়া করে বেড়াচ্ছে ও। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। ধুর এসময় বৃষ্টি কেন আসলো। ধুর ছায়াটা আবার কোথায় চলে গেল! আর ভালো লাগছে না ওর। ছায়াটা যে কেন ওকে এতো খাটনি করে বেড়াচ্ছে! বৃষ্টিটা ও এখনি আসতে হল! আর সময় পেল না নাকি!
অদিতি- এই, ওঠ ওঠ। সকাল হয়ে গেছে।
অমিত- ধরেছি ধরেছি।
অদিতি- কি ধরেছিস? ট্রেন তো বারোটায়। এখন তো ঘড়িতে মাত্র আটটা বাজতেছে। কি হয়েছে তোর?
অমিত- আরে ধুর ধরেই ফেলেছিলাম আপু।
অদিতি -কিসের স্বপ্ন যে দেখতেছিলি! এই তোর কপাল এত গরম কেন?
অমিত- আরে তেমন কিছু না বৃষ্টির মধ্যে পড়েছিলাম। মাঝপথে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল আরকি!
অদিতি- বৃষ্টি! বৃষ্টি আবার কোথা থেকে পেলি তুই? অনেকদিন ধরে তো এখানে বৃষ্টি হচ্ছে না। অমিত- আরে ওই যে আসলে ছায়া আসলো, তারপর তো শুরু হল বৃষ্টি ঝড় বৃষ্টি। তাতেই একটু ভিজে গেলাম আর কি।
অদিতি- থামতো! আর বৃষ্টিতে ভিজিস না। আমি আসতেছি মামাকে ডেকে নিয়ে।
এভাবে ঘুমের ঘরে বকতে থাকে অমিত। ছায়াটা মনে হয় ধরেই ফেলে ছিল এবার। তবে ঘুমের ঘোরে এটা বুঝতে পারেনি যে হাতটা ধরেছিলে সেটি অদিতির ছিল, ছায়াটার নয়। ফার্মাসিস্ট মামা দ্রুত চলে আসলেন। ঔষধ নিয়েই তার ব্যবসা।
অমিতের কথা শুনে অমিতের রুমে এসে দেখেন ঘুমের ঘোরে এখনো বকছে অমিত, এখনো বৃষ্টি নিয়ে আর ছায়া নিয়ে পড়ে আছে অমিত। অদিতি থার্মোমিটারটা এনে দিলে গালের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন মামা। সাথে মেডিসিন বক্স আনতে বললেন অদিতিকে। তাপমাত্রা যদিও বেশি নয় প্রায় একশর কাছাকাছি।
মামা- এই বৃষ্টিটা কেরে? তখন থেকেই দেখছি বৃষ্টি বৃষ্টি করতেছে।
অদিতি-আরে তুমি যা ভাবতেছ এমন কিছুই না। এটা মেঘের বৃষ্টি কোন মেয়ের নাম না। চিন্তার কারণ নেই
মামা- বৃষ্টি কোথায় পেল আবার?কখন হলো বৃষ্টি?অনেকদিন ধরেই তো বৃষ্টি নামে নারে।
অদিতি- সেটাইতো কথা সাহেব হচ্ছে ঘুমের মধ্যেই বৃষ্টিতে ভিজতে চাই।
মামা- সিরিয়াস কিছু না মনে হয়। জানালা খোলা রাখছো তো। বাতাসে বাতাসে মনে হয় তাপমাত্রা একটু বাড়ছে। তবু একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দিস খাওয়ার পরে।
অদিতি- আচ্ছা আচ্ছা। দেখি কপাল পট্টি দিয়ে রাখি একটু তার আগে।
মামা-আচ্ছা দেখ তাহলে।
ঘুমের ঘোর কাটতে থাকে আস্তে আস্তে অমিতের। প্যারাসিটামলে জ্বরের ইফেক্ট অনেকটা কেটে গিয়েছে। মামার কথামত ব্রেকফাস্ট এর পর টামেন টার্বো খায়য়ে দিয়েছিলো অদিতি। ফার্মাসিস্ট মামার ব্যবসাও তখন ভালোই চলছিল। মাঝে মাঝে একটু ট্যুর দিয়ে ঘুরে বেড়ানো লাগে আর কি তার।
বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ছাড়বে ওদের ট্রেন। লাগেজ ব্যাগ নিয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়েছে ওরা দশটা বাজার কিছুক্ষণ আগেই। ঢাকা শহর বলে কথা। একবার ট্রাফিক জ্যাম নামক অভিশাপে পড়লে হয়। ব্যস! ট্রেন বাস থেকে চাকরি, কারো বিয়ে কিংবা ভবিষ্যতও মিস হয়ে যেতে পারে এই ট্রাফিক জ্যামের পাল্লায় পড়ে। এরমধ্যে নাকি আবার মেট্রোরেলের কাজ শুরু হয়েছে, তখন যে কি একটা অবস্থা হয়ে পড়বে চিন্তাই করা যায় না। কল্পনা করতেও চায়না ওরা। ছোটখাটো জ্যাম ই মানুষজনের জন্য যা বিরক্তিকর! আধা ঘণ্টা রাস্তায় অনেক সময় ৩ঘণ্টা তো শেষ হয় না। সবচেয়ে বেশি মেজাজ খারাপ হয় রোজার সময়। অনেকেরই প্ল্যানিং থাকে পরিবারের সাথে ইফতার করার। কিন্তু এই অভিশাপে পড়ে বাজে বিরক্তিকর জ্যামের পাল্লায় পড়ে রাস্তায় যাত্রাবিরতি অথবা বাসের মধ্যে একমাত্র সম্বল পানি দিয়ে ইফতারী করতে হয়। সারাদিন রোজা রেখে পরিবারের সাথে ইফতারি করতে না পেরে তখন বিরক্ত বিরক্তি লাগাটাই রীতিমতো অভ্যাস হয়ে যায়। যাই হোক ওদের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে আজ। তেমন জ্যামের সম্মুখীন হয়নি। এর মধ্যে অমিত ও একদম চাঙ্গা হয়ে উঠেছে প্রায়। জ্যাম ঢাকা শহরের নিত্যসঙ্গী হলেও ঈদের দিন আর তার রূপ থাকে না। ঢাকা যেন তার প্রাণ হারিয়ে বসে ক্ষণিকের জন্য। নাড়ির টানে যে সবাই গ্রামের দিকে ছুটে যায়। ঢাকাবাসী আর তখন ঢাকার বাসিন্দা থাকেনা। এমনও হয় যেন যানবাহন ছাড়াই অদল বদল হয় ট্রাফিকের আলো লাল থেকে নীল, নীল থেকে সবুজ। ওহো! নীল আলো তো ট্রাফিকে নেই। লাল হলুদ, হলুদ সবুজ এভাবেই চলতে থাকে। ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব কমে আসে। তবুও ঢাকা শহর তো থেমে থাকার নয়। কমের ভাগ মানুষ যারা ঢাকায় থেকে যায় বিভিন্ন কারণে তারাই মাতিয়ে রাখেন এই ঢাকা শহরকে। জ্যাম কম থাকায় অনেকটা আগেই পৌঁছে গিয়েছে ওরা। সবে মাত্র ১১ টা বেজেছে অফিস টাইম এখন। প্রায় অর্ধেক ঢাকাবাসীই এখন অফিসে। আর ওরা এখন বেরিয়েছে ফ্যামিলি ট্যুরে। ভাবতেই অন্যরকম লাগে ওদের। তার উপর আবার অমিতের জন্য একদম নতুন এক্সপেরিয়েন্স হতে যাচ্ছে। এখন আরও একটা ঘন্টা। অমিতের তো আর তর সইছেনা।
অমিত- আপু ট্রেনের ভেতর না বেড আছে ঘুমানোর জন্য?
অদিতি- হ্যাঁ আছে তো। কিন্তু সেটা এসি কেবিন। রাতের বেলায় গরমকালে এসি কেবিনে ঘুমানোর মজাই আলাদা রে। পুরাই অস্থির। ঘুম যা হয় না!
অমিত- ও! আমরা তাহলে কোনটায় যাচ্ছি?
অদিতি- এই সময়ের জন্য শোভনেই ভালো।
অমিত- আমরা তাহলে শোভনেই যাচ্ছি বলো।
অদিতি- হ্যাঁ। এখন যদি টেবিলওয়ালা সিটগুলো পায় তাহলে তো একদম জমে খিল। সেই হবে হা হা।
অমিত- টিকিট চেক করলেই তো হয়। সিট নাম্বার বুঝতে পারবা, তাই না?
অদিতি- হ্যাঁ হ্যাঁ তাইতো ঠিক বলেছিস। মামা আমাদের সিটের নাম্বার কত?” কোন বগির কোনটা বলতো?
মামা- ঝ বগীর ৪১ থেকে ৪৩ দেখছিলাম সম্ভবত। শিওর না রে।
অদিতি- ও তাই যদি হয় তাহলে তো আমরা শেষের বগির দিকে। পেছন থেকে সাপের মত দেখাবে ট্রেন।
অমিত- হা হা, কেন কেন পড়োনি যে সর্পিলাকার ট্রেন? ঐতো কি যেন একটা কবিতা আছে মনে হয়!
অদিতি- থাক থাক আমরা এখন ট্যুরে যাচ্ছি পরীক্ষা দিতে না। ঠিক আছে। হাহা।
মামা- এই ধর তো নে ৫০০টাকা!
অমিত- আমাকে দাও আমাকে দাও
অদিতি- না না আমাকে দাও। ও বাদ। বাই দ্যা ওয়ে ঈদ তো অনেক আগে চলে গেছে। এটা কিসের সালামি?
মামা- আরে সালামি তো ঈদের সময় পাবি। এখন তোরা দুইজন আগে কিছু হালকা খাবার যা লাগবে তোদের নিয়ে আয়। বেশী সময় নাই ট্রেন চলে আসবে পরে আবার।
অদিতি-আচ্ছা আচ্ছা। আমি যাচ্ছি অমিত চলতো।
দুই ভাগ্নে ভাগ্নির সাথে মামার ভালোই সময় কেটে যায়। চাকরি আর বন্ধু-বান্ধবের চেয়ে বেশি সময় ধরে ওদের কদর ও ওদেরই বেশি। কয়েক মাস পর মামার বিয়ে জীবনে নতুন কারো পদার্পণ ঘটবে কিন্তু তার জন্য ওদের মূল্য এক চুল পরিমাণ কমবে না ওদের মামার কাছে।
এটা অমিতা আর অদিতি ও জানে। মামি যে তাদেরই পছন্দের পাত্রী। ওদের বাসার আশে পাশেই থাকেন।
অদিতির পছন্দ চকলেট আইসক্রিম আর অমিতের পছন্দ বিস্কিট আর চানাচুর। সবগুলোই আনা হয়েছে বাড়িতে সবার জন্য সবকিছু সমান ভাগে থাকবে।
আইসক্রিম চকলেট আর ফুচকা দেখলে অদিতির জিহ্বা সামলাতে পারেনা যদিও এটাই স্বাভাবিক। এখন ওর আফসোস হচ্ছে ফুচকা যে কেন নেই এখানে।
আইসক্রিমটা এখনি খেয়ে ফেলতে হবে নাহলে ঘুরে যাবে তো ভালো লাগবে না তখন আর
হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তো চকলেট কোনটা নিব। অমিত ভ্যানিলা খাই।
আমি সব ফ্লেভার খায় সমস্যা নাই।
আর মামি? হা হা
তোদের মামিও। এই মামি বলিস কেন হ্যাঁ? বিয়ে হয়েছে নাকি এখনো
হবে তো তাইনা?
তখন দেখা যাবে।
তাই মামা? লজ্জা পেলে নাকি? হাহা
আরে না ধুর। খা তাড়াতাড়ি ট্রেন আসলে ঝামেলায় পড়বে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।
হ্যাঁ হ্যাঁ আমার তো হাফ শেষও।
এই অমিত তোর জ্বরের কি অবস্থা?
ফিট হে বস। এমনই চিল মুডে থাকবে পুরো সময়। বুঝলি?
হ্যাঁ হ্যাঁ।
ট্যুরের সময় অসুস্থ থাকলে পুরো টাইমটা মাটি হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর ট্রেন এসে থামে স্টেশনে। অনেক ভিড় আশেপাশে। অনেক লোক উঠছে আবার অনেকেই আবার নামার জন্য ব্যস্ত। ট্রেন যে বেশিক্ষণ থাকবে না প্লাটফর্মে। লাগেজ নিয়ে উঠে পড়েছে ওরা। ঝ বগির গেটে অনেক ভিড় থাকার জন্য পাশের বগির গেট দিয়ে ঢুকেছে ওরা মামারা কথায়। জানালার পাশে অদিতি, মাঝখানে অমিত আর কোনায় বসেছেন মামা। প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে গেল ট্রেন।
ইশ। টেবিল ওয়ালা সিটটা পেলি নারে আপু।
আরে এটাও অনেক ভালো সিট পেয়েছি। কোন সমস্যা নেই।
আচ্ছা আমার এত ঘুম আসতেছে কেন বলতো?
রাতে ঘুম হয়নি মনে হয় তোর।
হ্যাঁ তাই তুই হালকা ঘুম দিয়ে নে রে।
আরেকটু পরে ঘুমাবো তাহলে। প্রথম জার্নির প্রথমদিকে ঘুমালে কেমন হয় বলো!
ছায়াটা হঠাৎ অমিতের পেছনে পড়ল কেন অমিতের! মনের কৌতূহল ই শেষ হয়না। সেটা কি কিছু অমিতকে বলতে চাই? কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। এটা কি কোন কিছুর ইশারা-ইঙ্গিত এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে অমিত। মসলা দিয়ে গরম গরম ঝুরি ভাজা, বাচ্চাদের মজার মজার বই, নাটরের কাঁচাগোল্লা ….একের পর এক আসতে থাকে হকারেরা। চলতে থাকে সর্পিলাকার ট্রেন, বাড়তে থাকে সময়। মাঝে অবশ্য কুমিল্লা স্টেশনে ঘুম ভেঙেছিল অমিতের। তবে তখন সময় জিজ্ঞাসা করে আর একটা হাই তুলে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল অমিত। অমিতের মতে এখনো সকাল হয়নি এই ভেবে মামা আর অদিতি তো হেসেই কূলকিনারা পাই না। ওরা বুঝতে পারে বেলা গড়িয়ে দুপুর হলেও অমিতের ডিকশনারি অনুযায়ী এখন হয়তবা গভীর রাত। নাটোরের কাঁচাগোল্লা আসলো একটু পর। হকার একজন বয়স্ক লোক দেখতে অনেকটা ওদের নানুর মত। বয়স হলে বোধহয় সবাই প্রায় এক রকমই দেখতে হয়ে যায়। তবে এখন সেটা মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হলো অমিত অদিতির দু’জনেরই মিষ্টি পছন্দ অনেক অদিতি মামাকে তাই কাঁচাগোল্লা নিতে বলল কিছু। মামারও মিষ্টি পছন্দ অনেক। অবশ্য ভালোই হলো কাঁচাগোল্লা গুলো কিনে। অনেক ভালো স্বাদের। খেয়ে তৃপ্তি পাওয়া গিয়েছিল। অর্ধেক পথ চলে এসেছিল সর্পিলাকার ট্রেনটি। কিন্তু আমিতো এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলো। ওর কাছে যে এখনো সকাল হয়নি। কিন্তু রসগোল্লা কথা শুনে হঠাৎই লাফিয়ে উঠে পড়লো বলা যায়। এরমধ্যে মামার চট্টগ্রামের বন্ধুর ফোন এসেছে। চট্টগ্রামে হোটেলের জন্য ঘোরাফেরা না করে ওনার ফ্ল্যাটে উঠতে বলেছেন। বাস স্ট্যান্ড পাশেই। ওনার ফ্লাটের চাবিটা তার পাশের ফ্ল্যাটে আছে, দারোয়ান কেও বলে রেখেছেন যাতে তাদের ব্যবস্থা করে দেন আর সাথে কাজের বুয়াকেও বলেছেন রান্নার বিষয়টা। নিশ্চিন্ত হলেন মামা। এমনিতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল চট্টগ্রাম পৌঁছাতে। তারপর ওরা ক্লান্ত অনেকটা। এজন্যই পথের মধ্যে যাত্রাবিরতি। মামার বন্ধু দুইদিন পরে চট্টগ্রামে আসার কথা ব্যবসার প্রয়োজনে ঢাকাতে রয়েছেন আপাতত। বন্ধুর বাসায় পৌঁছাতেই ৯ টা বেজে গেল প্রায়ই। ক্লান্ত থাকার কারণে আজ মামার মতোই ওরা আগে আগে ঘুমিয়ে পড়লেও ডিনার করে। দুপুরের ট্রেনে বিরিয়ানি আর এখন পোলাও। আজকে রিচ ফুড খাওয়া হলো ভালোই। সকালে উঠতে হবে ওদের বাস ধরতে হবে যে প্রথম ট্রিপেই। যাওয়ার সময় বন্ধুর সাথে দেখা করে যাবেন বলে মনস্থির করলেন মামা।
বরাবরের মত অমিত কে ডেকে তোলা লাগল। বাস ধরতে হবে একটু পরে। আর ছেলেটা এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। উঠে দ্রুততার সাথে রেডি হতে লাগল অমিত। টিকিট কেটে আসতে আসতে ব্রেকফাস্ট করে নিল অদিতি আর অমিত। কাহিনী হচ্ছে দামপাড়া থেকে উঠতে হবে ওদেরকে। হাতে মাত্র আধা ঘন্টা সময় আছে। সকালে বেশি সময় লাগে না। আর ওদের হাতে বেশি সময় ও নেই। যদিও সব কিছু গোছানোই আছে। তবুও সময় কম আছে অজুহাতে মামা একটু কম ই খেলেন। রওনা হল ওরা দামপাড়ায়। কিছুক্ষণের মধ্যে বাসও ছেড়ে দিল। প্রকৃতির নয়না ভিরাম সৌন্দর্য অবলোকন করতে লাগলো অদিতি। আগের সময়টুকু পুরো রাস্তা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটালেও এবার ঠিকই সজাগ আছে অমিত। এক পাশে সাগর, আরেকপাশে পাহাড়। দেখতে ভালোই লাগছে অমিতের। হোটেল কক্স টুডে তে পৌছাতে দুপুর হয়ে গেলো ওদের। স্বাভাবিকভাবেই অনেক টায়ার্ড। তবুও প্লান করলো যে বিকেলে বেরোবে। ঘুরতে এসে রুমের মধ্যে বসে থাকার কোনো মানেই হয় না। পরিকল্পনা অনুযায়ী ওদের প্রথমে গিয়ে তো ওরা মার্কেটের শুরু শেষ বা কূল- কিনারা করে উঠতে পারল না। কাছেই নাকি সী বীচ। অনেকটা পথ চলে এসেছে। এগোতে এগোতে ওরা একটা বীচে চলে এসেছে, । গুগল ম্যাপের তথ্য অনুযায়ী এটা ইনানী বীচ। দু’জনেই নাম শুনেছে এ বীচের। তবে আজ ওদের কাছে ভালোই লাগছে। দু’জনের ঘোর কাটাতে মামা বললেন “চল, শপিং করে আসি। কাছেই নাকি একটা ভালো মার্কেট আছে। কাছে ডেকে মামা বললেন,” শোন দু’টো কথা শিখায় দেই তোদের। ইবা হতো আর বরদা একটু কম লইতেননি। এগুলো এখানকার মানুষের ভাষা, ইবা হতো মানে হচ্ছে এটা কত, আর বদদা বললে ওরা ভাববে আমরা এখানকারই লোক। এজন্য একটু কম রাখতে পারে আর কি বুঝলি? ভাগ্নে ভাগিনা দু’জনে মাথা নাড়িয়া বোঝালো যে তারা বুঝতে পেরেছে। অদিতি এর মধ্যে অমিতের কাছ থেকে লিস্ট নিয়ে নিলো। অদিতির যে হালকা বড়োসড়ো লিস্ট। সাঁওতালদের ড্রেস কিনতে হবে প্রথমেই। তারপর আচারের দোকান থেকে আর কিনতেই হবে। এরপর তো আরো জিনিস লিস্টে রয়েছেই। বাজার ভর্তি জিনিস কোনটা রেখে কোনটা কিনবে। সবগুলোই দেখতে সুন্দর। ওদিকে অমিতের মন পড়ে রয়েছে বাইক রাইডে’। অনেক ইচ্ছা হচ্ছিল রাইডে ওঠার। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গেল অমিত। সামনে পড়লে একটা কসমেটিকস্ এর দোকান। তাতে সুন্দর করে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন ধরনের চশমা আর সানগ্লাস। অমিতের মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কথা সেই ম্যাজিক মামার ছোট্ট রসিকতা। ঠোঁটের কোণায় উদয় হলো মুচকি হাসি। একবার ভাবল সানগ্লাস ট্রায়াল মেরে দেখবে, পরে আবার ভাবল না থাক এখন কেনা দরকার নাই পরে কেনা যাবে, এখন কিনতে গেলে দেখা যাচ্ছে পচানি খাবে। দ্রুত পায়ে পায়ে হেঁটে জয়েন করলো মামা আর অদিতির সাথে। ওদিকে অদিতির তো কেনাকাটার ধুম পড়েছে একেবারে। কোনটা রেখে কোনটা কিনবে সেটা ঠিক করতেই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ওর। এখনো অনেকগুলো জিনিস কেনা বাকি। ওদিকে মামা বলছেন যে আজকের মধ্যে শেষ হবে তো শপিং! অমিতের তো কোন চিন্তাই নেই। হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলো। অনেক সবাই রীতিমতো টায়ার্ড। কোনমতে ডিনার করেই ঘুম সব। পরের দিন আবার হাজির হল।
অন্যদিন অদিতির ডাকে ঘুম ভাঙলেও সেদিন মামার ডাকে ওদের দু’জনের ঘুম ভেঙেছিল।
-কিরে তোরা উঠবিনা নাকি?
-এত রাতে কোথায় যাবে তুমি মামা?
-রাত কোথায় পেলি? ভোর হয়ে আসছে। আর তোরা না বললি সূর্য উদয় দেখতে যাবি। সূর্য কি তোদের সকালে ঘুম ভাঙ্গার পরে উঠবে নাকি?
-ওহো তাইতো! এই অমিত, ওঠ ওঠ। সূর্যোদয় দেখতে যেতে হবে।
নামাজ পড়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে ওরা বেরোল সূর্যোদয় দেখতে। বীচে হাঁটছিল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ অমিতের মনে হল সামনে একটা ছায়া।
– না না আমি কিছু করিনি। আমাকে ছেড়ে দাও!
– কিরে কার সাথে কথা বলছিস? দেখ দেখ সূর্য উঠতেছে। তাড়াতাড়ি দেখ।
ট্যুরটা ওদের ভালোই কেটেছিল। আপাতত ওরা ব্যস্ত মামার বিয়ে নিয়ে কয়েকদিন পরেই বিয়ে। দেখতে দেখতে মা বিয়ের দিনও চলে এল অমিত খুবই এক্সাইটেড। যেন আজ ওরই বিয়ে। সেজেগুজে বসেছে ড্রাইভারের পাশেই। আর শেরওয়ানী পড়া বরের পাশে বসেছে অদিতি। মাঝ রাস্তায় হঠাৎ ওদের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল। কাহিনী সেখানে না। কাহিনী হচ্ছে যেখানে গাড়িটা নষ্ট হয়েছিল তার কিছুদূর সামনে এক্সিডেন্ট হয়েছিল তার কিছুক্ষণ পরে। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে আবার ছায়ার দেখা পেয়েছিল অমিত। সেটাও ঠিক গাড়ি নষ্ট হওয়ার আগেই।
মাঝে অনেকদিন কেটে গিয়েছে। ও এখন সবসময় সেই ছায়ার রহস্য ই খুঁজে বেড়ায়। মানতেই চায় না যে ওটা ওর কল্পনা ছিল। সারাদিন আনমনে থাকে। কলেজ ফাইনাল শেষে ছুটিও শেষ হয়ে এলো। মামার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু অমিতের চিন্তা শেষ হয় না। অপেক্ষায় থাকে প্রতীক্ষিত প্রতীক্ষার। আবার সেটার দেখা পাবে। ক্ষণিকের জন্য হলেও যে ওর মনে হয় ও ওর মায়ের সাথে।