১ ম পর্ব:
কি রে তোফায়েল এখন তোর ঘুমের সময় হলো? কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আজান হবে।
টাইম দেখতো কয়টা বাজে এখন অবেলায় পড়ে পড়ে ঘুম দিচ্ছিস, আজ তো বিকেলে আমার সাথে হাঁটতে বের হলি না। এবার উঠ যা ফ্রেশ হয়ে নে, মাঝেমধ্যে কি যে করিস কিছুই বুঝিনা। তোফায়েল আর হাসান ইন্টারে পড়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী দু’জন ম্যাসে থাকে। কলেজ থেকে বাড়িতে যাতায়াত আর পড়াশোনার সুবিধার্থে দুই বন্ধু খরচ ভাগাভাগি করে ম্যাসে একটি রুম নিয়ে থাকে। দুজনেই খুব ভালো বন্ধু এসএসসি এক সাথে দিয়ে ইন্টারে দু’জন এক সাথে ভর্তি হয়।
প্রতিদিন বিকেলে দু’জন বাইরে একটু হাঁটতে যায়, পার্কে বা এমনি কোথাও হাঁটতে যায় আবার কখনও টং এর দোকানে বসেও আড্ডা দেয়। তাদের আরও কয়টা বন্ধু আছে তারা নিজস্ব বাসায় এই পাশাপাশি থাকে তাই তোফায়েল আর হাসান বের হওয়ার পূর্বে অন্য বন্ধুদেরকে কল করে বের হয়। তাদের এক বন্ধুর নাম অনিক তার আবার গিটার আছে খুব ভালো বাজাতে পারে তাই কখনও পার্কের কোন কোণায় গাছের নিচে বসে হালকা হিমেল হাওয়ায় অনিক খালি গলায় গান ধরে, আর গিটার বাজায় এবং বাকি বন্ধুরা অনিকের সাথে ঠোঁট মেলায় কিন্তু আজ তোফায়েলের মাথায় ব্যথা করতেছে বলে আজ আর বিকেলে হাঁটতে যায়নি, হাসান একা একা যায়।
তোফায়েল ফ্রেস হয়ে চোখ চটকাতে চটকাতে বিছানায় বসল। হাসান জিজ্ঞেস করল তোফায়েলকে
——“কি অবস্থা এখন মাথা ব্যথা সেরেছে?”
আর বল তো দেখি আজ মাথা ব্যথার কারণটা কি মিতুর সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি?
হাসান এ কথা বলেই হেসে দিল। তোফায়েল বলল
——-“আরে ধুর এইসব কিছুনা এমনি প্রচণ্ড রোধ ছিলো তো আজ এজন্য মাথাটা ধরেছে।” আচ্ছা শোন হাসান, আজ তো রুহানের বোনের মেহেদী সন্ধ্যা এবং কনসার্টও আছে আমাদের তো যাওয়ার কথা, দাওয়াত দিয়েছে।”
হাসানকে বলল তুই চট করে তৈরি হয়ে যা আমিও হচ্ছি।
আজ রাতে হেব্বি মাস্তি হবে দোস্ত, খাওয়া-দাওয়া হবে আমাদের রাতের খাবারটা বেঁচে যাবে এই বলে তোফায়েল হাসতে শুরু করল, হাসান বলল আজ তো রাত ০৯ টায় মিস নিলুফা ম্যাডামের কাছে একাউন্টিং পড়তে যাওয়ার কথা।
মিস নিলুফা ম্যাডাম হলেন তোফায়েল আর হাসানের কলেজের একাউন্টিং সাবজেক্ট এর অধ্যাপিকা বয়স ৩৮ কিংবা ৪০ এর বেশি হবেনা, ম্যাডাম এ বয়সে দেখতে খুব চমৎকার এবং মডার্ন আসলে শুধু মডার্ণ বললে কম হবে আল্ট্রামডাৰ্ণ বলা যায়। ম্যাডাম বিবাহিতা তাই খুব ব্যস্ত থাকেন কলেজে ক্লাস পরিবার নিয়ে। ম্যাডাম সচরাচর প্রাইভেট পড়ান না কারণ সময় নেই তবুও ছাত্র-ছাত্রীদের চাপাচাপিতে কলেজ টাইম শেষে একটা শিফট পড়ান। তোফায়েল আর হাসান একাউন্টিং সাবজেক্টটা খুব ভয় পায় এবং তাদের মাথায় এ বিষয়টা খুব একটা ঢুকে না, কলেজ টাইম পরে যে শিফটে ম্যাডাম প্রাইভেট পড়ান সেখানে ৩৫ জন ছাত্র-ছাত্রী পড়ে কিন্তু তোফায়েল আর হাসান এত জনের মধ্যে পড়তে চায় না কারণ তারা দুজনেই একদম বুঝেনা একাউন্টিং সাবজেক্ট। মিস নিলুফা ম্যাডমকে অনেক জোর করে এক কথায় হাতে-পায়ে ধরে পড়ানোর জন্য স্থির করল। নিলুফা ম্যাডাম সময় দিলেন সপ্তাহে তিন দিন রাত ৯ টায় এবং বললেন কাউকে না জানাতে কারণ তিনি আর স্টুডেন্ট পড়াতে পারবেন না সময় নেই।
তোফায়েল বলল সমস্যা নেই আমরা খাওয়া-দাওয়া করে রুহানের সাথে দেখা করে সেখান থেকে ৯ টায় মেডামের বাসায় চলে যাব। গত দুইদিনে একটি অধ্যায় শেষ হয়েছে, আজ নতুন অধ্যায় শুরু করবেন।
২য় পর্ব:
নিলুফা মেডামের প্রথম বিয়ে হয়েছিল একজন আর্মি অফিসারের সাথে, তখন নিলুফা ম্যাডাম সবে পড়াশোনা শেষ করেছেন কলেজে চাকরি পাননি, তবে একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে ছিলেন আর এই সময়ে মেডামের বাবা-মা আর্মি অফিসারের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। মেডামের স্বামী খুব ভালো একজন মানুষ ছিলেন, আর্মি অফিসাররা সচরাচর একটু রাগী গরম মেজাজের থাকেন কিন্তু নিলুফা মেডামের স্বামী তার উল্টো। যতটুকু জানতে পেরেছি নিলুফা মেডাম খুব সুখী ছিলেন সুখের সংসার ছিল, মেডামের স্বাধীনতাও ছিল।
মেজর জাফর নিলুফা মেডামের প্রথম স্বামী। প্রতিদিনের মতো সেদিনও মেজর জাফর গভীর রাতে বাসায় ফিরলেন রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়লেন। ঘন্টাখানেক পর হঠাৎ শুনতে পেলেন দরজায় কে যেন ডাকতেছে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে, ডাক শুনে মেজর জাফর বিছানা থেকে উঠে রুমের লাইট জ্বালালেন সাথে সাথে নিলুফা ম্যাডামও উঠে পড়লেন, স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন
—“এত রাতে কে ডাকে?” মেজর জাফর বললেন
—“জানিনা হয়তো কেউ কোন বিপদে পড়ে এসেছে” দরজা খুলে দেখেন ধমকা হাওয়া আর প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু দরজায় কেউ নেই। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার পর দরজা বন্ধ করে দিবেন হঠাৎ দেখলেন বাড়ির এক কোণায় পাকা করা বসার একটি জায়গা ছিল সেখানে মাথা নিচু কেউ একজন বসে আছে। মেজর জাফর আর নিলুফা মেডাম রীতিমত অবাক হলেন যে, এত রাতে এই ঝড় বৃষ্টির রাতে এখানে আবার কে বসে আছে! দারওয়ান তো গেইটের সাথে যে ছাউনি আছে সেখানে থাকে গেইটের ভিতরে তো কেউ ঢুকতে পারার কথা না। যেইমাত্র দারোয়ানকে ডাক দিতে যাবেন ঠিক তখন বৃষ্টির মধ্যে বসে থাকা সেই লোকটি উধাও, তখন আরও অবাক হলেন এদিক-ওদিক তাকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন সাথে সাথেই বাইরে বিশ্রী একটা চিৎকার শুনতে পেলেন তখন নিলুফা মেডাম পুনরায় দরজা খুলতে বাঁধা দিলেন এবং রুমে চলে গেলেন। কিছু সময় পর মেজর জাফর স্ত্রীকে ঘুমে দেখে ঘুম থেকে আর না জাগিয়ে একা দরজা খুলে বের হতেই অদৃশ্য কি যেন একটা মেজর জাফরের পা ধরে টেনে হিঁচড়ে বাড়ির পাশে বাগানের দিকে নিয়ে গেল। তখন বৃষ্টি অনেকটা থেমে গেছে।
ভোরে হাউমাউ কান্না করে দারওয়ান নিলুফা মেডামের রুমের দিকে উদ্দেশ্য করে ডাকতেছে, তখন ডাক শুনে উঠে দেখেন স্বামী মেজর জাফর পাশে নেই, লাফ দিয়ে উঠে বের হলেন গিয়ে দেখেন বাড়ির পাশে বাগানে মেজর জাফরের মৃতদেহ পড়ে আছে। বুকে নখের বিশ্রী আঁচড় কাটা, ঘাড় মচকানো অবস্থায় পড়ে আছেন মেজর জাফর।
মেজর জাফর এর এই মৃত্যুর রহস্য জানা যায়নি এটা হত্যা নাকি অন্য কিছু।
৩য় পর্ব:
নিলুফা মেডাম কলেজে পড়ানোর পাশাপাশি বাসায় কোন ছাত্রছাত্রীকে প্রাইভেট পড়ান না। তবে তোফায়েল আল হাসানের অনুরোধে তাদের দু’জনকে পড়ান। নিলুফা মেডামের প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বিয়ে হয় একজন ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে। নিলুফা মেডাম প্রথম স্বামীর সাথে যে বাসায় থাকতেন সে বাসা প্রথম স্বামী অর্থাৎ মেজর জাফর তিনি স্ত্রী নিলুফা মেডামের নামে লিখে দিয়েছিলেন, সেই বাসায় এখন তিনি থাকেন তার দ্বিতীয় স্বামীকে নিয়ে। এই বাড়িটা সবসময় একদম নীরব থাকে, বাউন্ডারি দেওয়া বড় বাড়ি মানুষ মাত্র দুইজন। নিলুফা মেডামের শ্বশুরবাড়ির লোকজন গ্রামে থাকেন। হঠাৎ তাদের এখানে দুই একদিনের জন্য বেড়াতে আসেন। আর নিলুফা মেডামের কোন সন্তান নেই এজন্য আরও বেশি ফাঁকা থাকে বাড়ি। তোফায়েল আর হাসান সন্ধ্যার পর পড়তে আসে তখন মেডাম একটু ফ্রি থাকেন, আর বাকি সময় কাটে দিনে কলেজে, বিকেলে পাখিদের খাঁচায় খাবার দেয়া এবং বাসার ছাঁদে একটু হাঁটা। বাসার পাশের ফুলের বাগান ঘুরে দেখা আর রাতে বই পড়েই সময় কাটে, মাঝে মাঝে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে থাকেন। সন্ধ্যায় তোফায়েল আর হাসানকে কিছু সময় পড়ান। তোফায়েল আর হাসান মেডামের বাসায় আসার সময় লক্ষ্য করতো যে, বাড়ির ফুলবাগানে কেউ একজন হাঁটতেছে বা বাড়ির খালি জায়গায় বাচ্চারা খেলা করতেছে দৌড়াচ্ছে, কখনও তারা অনুভব করতো যে, অদৃশ্য কিছু তাদের পিছু পিছু আসছে তারা ভয় পেয়েও নিলুফা মেডামের কাছে পড়তে যেত কারণ ফাইনাল পরীক্ষা সন্নিকটে আর অন্য কোথাও পড়লে তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়। নিলুফা মেডামের পড়া বুঝানোর দক্ষতা খুব বেশি। কিছুদিন থেকে তোফায়েল আর হাসান একটু বেশি ভয় পেতে লাগল, ভয় পেয়ে তারা চিন্তা করল সন্ধ্যার পর না পড়ে বিকেলে এসে পড়বে কিন্তু নিলুফার মেডামের বিকেলে সময় নেই আর বিকেলে পড়ার জন্য ম্যাডামকে বেশি জোর করা যাবে না কারণ এমনিতেই মেডাম বাসায় কোন ছাত্র-ছাত্রী কে পড়ান না, অনুরোধ করে রাজি করা হয়েছে। এখন বিকেলে পড়ার জন্য জোর করলে মেডাম হয়তো রাগ করে আর পড়াবেন না।
কি আর করার ভয় পেলেও সন্ধ্যার পর এসে পড়তে হবে। তারা নিলুফা ম্যাডামকেও বলেনি এই ভয়ের কথা যে, সন্ধ্যার পর আসার সময় এবং যাওয়ার সময় যা দেখে তারা ভয় পায়।
একদিন তোফায়েল আর হাসান মিলে অন্য বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে তাই সন্ধ্যার পর মেডামের বাসায় না গিয়ে অন্যদিনের চেয়ে একটু দেরিতে নিলুফা মেডামের বাসায় পড়তে যায়। মেডামের বকা শুনার ভয় আর বাড়ির অদৃশ্য সেই হাসি এবং বাচ্চাদের অদ্ভুত খেলার ভয় আরও কত কি। এরপরও যেতে হলো। অন্যদিন দরজা বন্ধ থাকে আজ দরজা খোলা প্রতিদিনের মত মেডাম সোফায় বসে আছেন একটি ম্যাগাজিন হাতে, সালাম করে তোফায়েল আর হাসান বসে বই বের করতে লাগল কিছু সময় চলে গেল মেডামের কোন কথা বা নড়াচড়া নেই। এদিকে তাদের ভয়টা আরও শক্তি পাচ্ছে, তখন হাসান মেডাম মেডাম বলে কাছে যেতেই শরীর থেকে কাটা মাথাটা টুপ করে নিচে পড়ে গেল, গদগদ করে রক্ত বের হচ্ছে। হাসান আর তোফায়েল চিৎকার করে দৌড়ে বের হতে যাবে সাথে সাথে দরজাটা নিজ থেকে বন্ধ হয়ে গেল এবং রুমের সবকটি লাইট টাশ টাশ কর নিভে গেল।