গল্প হলেও সত্যি | ভয়ের দেশ |নেহা চন্দ্র| Bengali Horror Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

বাপস! এ যে ঘড়িতে দেখি ৯টা ৩০। এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম! ঘুম থেকে উঠতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল। কাল এতটা পথ ট্রেনে এসে বেশ ক্লান্ত লাগছে। ভাগ্যিস বাড়ির চাবিটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলাম নইলে কি কাণ্ডটাই না হত। কতবার বেল বাজালাম কারুর টু শব্দটি নেই, কিন্তু এমনি সময় ভাই গোটা বাড়ি মাতিয়ে রাখে, পাড়া থেকে তার জন্যে অভিযোগ পর্যন্ত আসতে বাকি নেই। মানছি প্রায় মধ্যরাতে বাড়ির দরজা ধাক্কা দিয়েছি, তবুও…। চাবিটা ছিল বলে কাল খুব জোর বেঁচে গেছি, নইলে সারা রাত বাড়ির বাইরে বসে মশা তাড়াতে হত, এর ফলস্বরূপ আমার ডেঙ্গু হওয়া অবধারিত ছিল। আজকাল যা অবস্থা ডেঙ্গু যেন ঘরে ঘরে লেগেই রয়েছে। মা বাবাকে সাবধান করে দিতে হবে দেখছি, এইভাবে ঘুমোলে তো বাড়িতে ডাকাত পড়লেও সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমাবে আর সেই ফাঁকে চোর ডাকাত বাড়ি ফাঁকা করে দেবে। অবাক হয়ে যাচ্ছি শুধু এই ভেবে যে ছোটবেলায় রাতে জল খেতে উঠলেও বাবা ঠিক টের পেয়ে যেত আর কাল এতবার বেল বাজানো সত্ত্বেও বাবা উঠলো না, অদ্ভুত ব্যাপার!

তাছাড়া… সত্যিই বাবার বয়েস হয়েছে, আজ বাদে কাল অধ্যাপক পদ থেকে অবসর নেবে, আজকাল বোধ করি ছাত্র ছাত্রী পড়িয়ে বাবা বেশ ক্লান্ত থাকে তাই আগেকার মত সহজেই ঘুমটা আর ভেঙে যায়না।

ভাই এখনও আমার পাশে ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। ঘুমোলে সবার মুখে কেমন যেন একটা সরলতা ছড়ানো থাকে। ওকে দেখে এখন মনে হচ্ছে কি সরল সাদাসিধে কিন্তু একটু পরে যখন ঘুম থেকে উঠে গোটা ঘরময় দাপিয়ে বেড়াবে তখন বোঝা যাবে এটি ভগবানের কি অসাধারণ সৃষ্টি।

রাতের বেলায় চুপটি করে এসে শুয়ে পড়েছি ভাই টেরই পায়নি, যখন চোখ খুলে আমকে দেখবে তখন একেবারে ভূত দেখার মত চমকে উঠবে। মা বাবার গলা পাচ্ছি বাইরে থেকে। মা তো সেই কোন সাত সকালে উঠে পড়ে তারপর চা টা করে বাবাকে ডাকে। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে জানালায় এসে দাঁড়িয়েছি, দূর থেকে হঠাৎ একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল। অনেকক্ষণ ধরে ডেকে ডেকে বেচারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তখনই পাশের চা দোকান থেকে একটা উড়ন্ত মাটির ভাঁড় কুকুরটার গায়ে এসে সপাটে লাগলো। দ্বিগুণ স্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে কুকুরটা পাশের গলিতে অদৃশ্য হয়ে গেল। কুকুরটার জন্য বেশ কষ্ট হচ্ছে, বেচারা বিনা কারণে মার খেয়ে গেল। কেন যে ও আমার জানালার কাছে এসে অমন চেঁচাতে লাগলো তা ভগবানই জানেন। এই জীবজন্তু দের ভাষা যদি আমরা বুঝতে পারতাম কি ভালোটাই না হত, ওদের উপর আমরা কত উৎপীড়ন করি যখন ইচ্ছে মারি যখন ইচ্ছে খেতে দি কিন্তু ওরা কি বলতে চায় সেটা বুঝতে পারিনা। এইযে কুকুরটা এতক্ষণ ধরে চেঁচালো, কেউ ওর কথার পাত্তাই দিল না, যদি দিত তাহলে হয়ত জানা যেত কুকুরটা কোনো বিষয়ে সতর্ক করছিল মানুষগুলোকে।

পিছনে ঘুরতেই দেখি ভাই দাঁড়িয়ে আছে আমার গা ঘেঁষে, যেন আমাকে দেখতেই পাচ্ছে না, আমি যে দাঁড়িয়ে আছি তাতে যেন ওর কোনো বিকারই নেই। কখন যে ছেলেটা আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছি টেরই পাইনি। আমার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট হাসি খেলে গেল ওর মুখে যেন নিজে নিজেই হাসছে। কি যে হচ্ছে আমি ঠিক ঠাহর করতে পারছিনা, হতভম্ব হয়ে শুধু দেখছি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বছর দশেকের একটি ছেলে। কিচ্ছু একটা বলবো বলে ভাবছি তখনই হঠাৎ মায়ের ডাক ভেসে এল, “কিরে ঘুম থেকে উঠবি না নাকি!” সঙ্গে সঙ্গে ভাই ফড়িং এর মত উড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

অদ্ভুত ব্যাপার, ভাই আমকে দেখে একটুও চমকালো না। যেন শুতে যাওয়ার আগেও আমকে দেখেছে, আমি ওর ঘরে এখন দাঁড়িয়ে আছি এটা যেন খুবই সাধারণ ব্যাপার। বাইরে ভীষণ হই হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠেই ভাইয়ের কেরামতি শুরু হয়ে গেছে। একটা ব্যাট হাতে নিয়ে বিভিন্নভাবে নাড়া চাড়া করে চলেছে আর মা সমানে বকে চলেছে। কেউ কারুর কথা কানেই তুলছে না। রোজকার জীবনযাপন শুরু হয়েছে।

চুপচাপ দরজার আড়ালে দেখছি ভাইয়ের বদমাইসি, মায়ের বকাঝকা। বাড়িতে যখন আমি থাকিনা তখন কেমন করে কাটে সবার দিন, কোনো পরিবর্তন হয় কি? এক সপ্তাহ খুব মিস করছি এইসব। নিশ্চয়ই ভাই প্রথম দিন খুব কান্নাকাটি করেছে, ও তো আমকে ছাড়া একদিনও থাকতে পারেনা। বছর দুই আগে যখন আমি একা বড়দির বাড়ি চলে গেলাম তখন কি কান্না, বাপরে! দুপুর রাতে আবার বাড়ি ফিরে আসতে হল নইলে বাবুর কান্নাই থামানো দায় হত। অথচ বাড়িতে থাকলে দুজনের মারপিট হবে না এরম দিন আজ পর্যন্ত আসেনি। জীবনে এই প্রথম বাবা মা ভাইকে ছেড়ে বন্ধুদের সাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মজা করেছি খুব তবু এই দুষ্টু ছেলেটিকে প্রচণ্ড মিস করেছি। ও আশেপাশে না থাকলে বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ও আমাকে দেখে অবাক হওয়ার বদলে এমন নির্লিপ্ত হাসি হাসলো মনে হল আমার ফিরে আসায় ওর যেন কোনো উৎসাহই নেই। কোথায় ভাবলাম ওকে চমকে দেবো, হঠাৎ আমকে দেখতে পেয়ে আমকে জড়িয়ে ধরবে – বলবে কি আনলি দিভাই আমার জন্যে… তা না, কি যে হচ্ছে! সাত দিনের অভ্যাসে ছিলাম না বলে কি আমি বাদ পড়ে গেলাম একেবারে। ধুস, কিসব ভেবে চলেছি যার না আছে মাথা না আছে মুণ্ডু। বুঝেছি, ভাই আমার উপর খুব রেগে আছে, একসাথে টানা সাত দিন আমি বাড়িতে নেই তাই কথা বলবেনা বলে পণ করেছে, কিছু একটা দিয়ে রাগ ভাঙাতে হবে বাবুমশায়ের।

সকাল বেলা উঠেই লাফাতে লাফাতে গিয়ে টিভি চালিয়ে দিলেন নবাবপুত্তুর। ব্যস মাকে এবার পায় কে… টিভিও তারস্বরে চিৎকার করে চলেছে আর মাও ভাইকে বকে চলেছে। ভাইয়ের কিন্তু কোনো বিকার নেই, মায়ের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে টিভি দেখে চলেছে। মঞ্চে এতক্ষণ বাবা অবতীর্ণ হয়নি, এবার হল, আর সাথে ষোলো কলা পূর্ণ হল।

হঠাৎ করে মাথায় একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করছি, যেন মাথার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে একেবারে। কি যে হচ্ছে আমার সাথে বুঝতে পারছিনা। কপালের ডান দিকে হাত দিতেই একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে এল, ঘরটা এতটা নিস্তব্ধ যে শব্দটাকে অলৌকিক বলে মনে হল, নিজের গলার স্বর নিজের কাছেই অচেনা ঠেকল। গোটা শরীরে যেন একটা চিনচিনে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ, অবশ হয়ে পড়ছি প্রতিনিয়ত। বাইরে সমান তালে চিৎকার চেঁচামেচি হয়ে চলেছে, ওরা কি আমার অস্তিত্ব আদৌ টের পাচ্ছে! সারা শরীরটাকে একটা চাপা তীব্র অভিমান ছেয়ে ফেললো মুহূর্তের মধ্যে। নিজের মনকে আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করছি ওরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারেনি, কিন্তু মন যে বড় উতলা, বারবার বলে চলেছে ওরা শুনেও না শোনার ভান করছে। এটা কি সত্যি সম্ভব! আমার মাথাটা ভুলভাল ভাবনাচিন্তায় ভরে গেছে তাই যত সব বাজে কথা ভেবে চলেছি।

নিজেই নিজের চাপা গোঙানির শব্দ শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে পড়েছি, এমন সময় বসার ঘর থেকে একটা কাচের গ্লাস ভাঙার শব্দ ভেসে এল, সাথে মায়ের কান্না মেশানো তীক্ষ্ণ চিৎকার। ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগল। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম কিন্তু শরীরে একটুও জোর পাচ্ছিনা, হঠাৎ করে যেন কেউ কোনো মন্ত্রবলে আমার সব শক্তি হরণ করে নিয়েছে। বাইরে থেকে কান্নাকাটির রোল উঠেছে রীতিমত। কেন যে এমন মরাকান্না জুড়ল সবাই সেটাই বোধগম্য হচ্ছেনা। ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যাচ্ছে সারা শরীর, দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছেনা। খাটের উপর গিয়ে আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লাম, শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিলাম নিশ্চিন্তে। চোখ বুজে আসছে এক গভীর নিদ্রায়, সকালের এই নির্মল সূর্যের আলো সহ্য করতে পারছিনা আর। স্বপ্ন দেখার আশায় গভীর নিদ্রায় ডুব দিলাম। চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে পর্দায় যেন বায়োস্কোপ চলতে শুরু করে দিল। এখন একটা দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি – আমি দাঁড়িয়ে আছি হাওড়া স্টেশনের উপর, মা বাবা ভাই আমাকে বিদায় জানাতে এসেছে, রওনা হব এবার দার্জিলিংয়ের পথে। তবে এ বায়োস্কোপ শব্দহীন, শব্দ একটা পাচ্ছি বটে কিন্তু তার সাথে এই দৃশ্যের কোনো সাদৃশ্য নেই, ভাই যেন সমানে বলে চলেছে “মা দিভাই বেঁচে আছে, আজ সকালেও আমি ওর গায়ের গন্ধ পেয়ে আপন মনে বলেছি দিভাই আসছে, খবরে ভুল দেখাচ্ছে মা, ও অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়নি; মা, মা দিভাই বেঁচে আছে।”

সব গল্প সত্যি হয়না, তবে এটা বোধহয় গল্প হলেও সত্যি।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post বিভ্রান্তি | ভয়ের দেশ |শেখ রাসেল পারভেজ| Bengali Horror Story
Next post অমরেশ বাবুর ভবিষ্যৎ | ভয়ের দেশ |অঙ্কিত ভট্টাচার্য| Bengali Horror Story