Getting your Trinity Audio player ready...
|
“স্যার আসব?” দরজার মুখ থেকে প্রশ্ন করল অভিমন্যু। স্বয়ং ডিআইজি তাকে তলব করেছেন। তাই হন্তদন্ত হয়ে সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছে সে।
ভিতর থেকে গম্ভীর কণ্ঠে আওয়াজ এল, “এসো।”
ঘরে ঢুকতেই অভিমন্যু দেখে যে আরেকজন রয়েছে। তাকে সে খুব ভালো মতোই চেনে। ডিপার্টমেন্টের অন্যতম দুঁদে গোয়েন্দা পৃথা বন্দ্যোপাধ্যায় । ডিআইজি মৃন্ময় চৌধুরী ইশারায় দরজা বন্ধ করে বসতে বললেন দুজনকে। তারা আসন গ্রহণ করতেই মৃন্ময়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “দেখো আশা করি শহরে যে খুনগুলো হচ্ছে তোমরা তার খবরটা জানো। এই নিয়ে তিনজন হল, পুরো সেম স্টাইল অফ মার্ডার। উপর থেকে ক্রমাগত চাপ আসছে। আমি চাই পৃথা, তুমি এই কেসের দায়িত্ব নাও আর এতে তোমায় অ্যাসিস্ট করবে অভিমন্যু। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই কেসটা তোমরা সল্ভ করে খুনী কে ধরো।”
প্রায় এক মিনিট কেউ কথা বলল না। নিরবতা ভঙ্গ করল পৃথা।
“ওকে স্যার। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই কেসের সমাধান করার চেষ্টা করব।”
“বেস্ট অফ লাক বোথ অফ ইউ।”
এরপর পৃথা ও অভিমন্যু ডিআইজিকে বিদায় জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। লম্বা করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় পৃথা বলল, “অভিমন্যু, তোমার যা কাজ আছে তাড়াতাড়ি সেরে নিয়ে আধঘন্টার মধ্যে আমার কেবিনে দেখা করবে।”
“ঠিক আছে।”
অভিমন্যু নিজের চেয়ারে ফিরে এসে যা টুকটাক কাজ বাকি ছিল সেগুলো সেরে ফেলতে লাগল। সে কেসটা নিয়ে ভাবছিল। গত চার সপ্তাহ ধরেই কাগজে বেরোচ্ছে খবরটা। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে তিনটে খুন হয়েছে। প্রত্যেকটার প্যাটার্ন একই রকম। ছুরি মেরেছে তিনজনকেই। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই অন স্পট মৃত্যু। কেসটা প্রথম দুটো খুন অবধি লোকাল পুলিশের অধীনে ছিল কিন্তু এখন এটা সি আই ডির অধীনে এসেছে আর সেই সূত্রেই বড় সাহেব পৃথাদি ও তাকে কেসটার দায়িত্ব দিয়েছেন।
‘ভালো!’ অভিমন্যু মনে মনে ভাবল। এই ধরনের বেপরোয়া খুনীদের সঙ্গে লড়াই করে আনন্দ আছে। এর আগেও একটা ড্রাগ পাচারকারী দলকে ধরিয়ে দিয়ে ডিপার্টমেন্টের মধ্যে বেশ খ্যাতি অর্জন করে সে।
ইতিমধ্যে নিজের কাজ শেষ করে সে পৃথাদির কেবিনের দিকে পা বাড়াল। রুমে ঢুকে সে দেখল পৃথা চিন্তিত মুখে বসে আছে। তাকে দেখে চেয়ার এগিয়ে দিল। অভিমন্যু নিজের আসন গ্রহণ করল।
পৃথা বলল, “কেসটাকে একদম গোড়া থেকে ভাবতে হবে বুঝলে অভিমন্যু। তিনটে খুনের মধ্যে কানেকশনটা কী?”
অভিমন্যু বলল, “পৃথাদি, আমি কেসটা যতটা স্টাডি করেছি তাতে এইটুকু জেনেছি যে এই তিনজন সমরেশ সান্যাল, বিক্রম দাশ আর মনোজ সরকার এদের তিনজনেরই বয়স পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে। কিন্তু এছাড়া আর কী কোনও লিংক আছে?”
“তিনজন আলাদা আলাদা জায়গায় কাজ করত। সমরেশ কাজ করত একটা প্রাইভেট ফার্মে, সল্টলেকে। আর ওকে খুন ও করা হয়েছে ওর অফিস থেকে মাত্র পাঁচশ মিটার দূরত্বে। বিক্রম কাজ করত অ্যাক্রপলিস মলে। তাকেও খুন করা হয়েছে কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে। আর মনোজ ছিল ক্যাব ড্রাইভার। তার মৃতদেহ পাওয়া যায় তার ক্যাবেই।”
অভিমন্যু বলল, “হ্যাঁ হয় ওকে খুন করে লাশটাকে ক্যাবে রেখে দেওয়া হয় অথবা তাকে ক্যাবের মধ্যেই খুন করে আততায়ী পালায়।”
“খুনের সময় আন্দাজ সাড়ে এগারোটা।”
“একবার ওর ক্যাবের অ্যাকাউন্টটা চেক করতে হবে যে ওই সময় কোন যাত্রী ক্যাব বুক করেছিল কিনা।”
“এতে কোনও লাভ হবে বলে তো মনে হয় না। আততায়ী এত বোকা নয় যে নিজের নামে ক্যাব বুক করে ড্রাইভারকে মারবে। কাজেই ওই দিকে কোনও সুবিধে হবে না। তার থেকে চলো এই তিনজনের বাড়ি থেকে একবার ঘুরে আসি।”
“হ্যাঁ তাই চলুন। কোনও না কোনও যোগসূত্র তো নিশ্চয়ই আছে তিনজনের মধ্যে নয়তো কোনও পাগলের কাজ বলে ধরে নিতে হয়।”
“কিন্তু সেই পাগলকে ধরাও আমাদের কর্তব্য।”
“ঠিক আছে আসুন আমি গাড়ি বার করছি।”
“হ্যাঁ চলো।”
এই বলে দুজনে বেরিয়ে অভিমন্যুর গাড়িতে গিয়ে বসল। সাদা রঙের সুইফ্ট। চালকের আসনে বসে সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে অভিমন্যু জিজ্ঞেস করল, “পৃথাদি, প্রথমে কার বাড়ি যাব?”
“বিক্রম দাশ। অ্যাক্রপলিস থেকে ডানদিকের রাস্তাটা দিয়ে খানিকটা গিয়ে একটা অ্যাপার্টমেন্ট পড়বে। ‘নীলাম্বর অ্যাপার্টমেন্ট’। তার তিনতলায় থাকত। আগে ওখানেই চলো।”
গাড়ি ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। অভিমন্যু চালাতে চালাতে ভাবছিল কী অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এই মেয়েটার। বয়সে হয়ত তার সমান বা সামান্য বড় কিন্তু কাজে তার দ্বিগুণ।
এই সব ভাবতে ভাবতে যখন গাড়িটা অ্যাক্রপলিস পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তাটা ধরল তখন খানিকটা গিয়ে দেখা গেল যে রাস্তার একটা অংশ ঘেরা রয়েছে কলকাতা পুলিশের সিল দিয়ে। পৃথা বলল, “এটাই মনে হচ্ছে ক্রাইম স্পট। একবার থামাও তো।”
দুজনে নামল গাড়ি থেকে। ভালো করে জায়গাটা দেখল কিন্তু প্রয়োজনীয় কিছুই পাওয়া গেল না। তাই অগত্যা তারা নীলাম্বর অ্যাপার্টমেন্টের দিকে গাড়ি এগোলো।
গাড়িটা বাইরে পার্ক করে তারা গেট থেকে ভিতরে ঢুকল।
ফ্ল্যাটটা খুব আড়ম্বরের নয়। বেশ পুরনো আর তাও মাত্র পাঁচতলা। কোনও দারোয়ান নেই দেখে ওরা খুব আশ্চর্য হল না। সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠে দেখল পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাট। একটার উপর লেখা বিশ্বজিৎ দাশ। বিশ্বজিৎ দাশ বিক্রমের বাবা। ওরা বেল টিপল। কেউ খুলল না।
আরো দুই তিনবার টেপার পর এক ভদ্রলোক দরজা খুলল। চোখে মুখে বিষণ্ণতার ছাপ।
অভিমন্যু বলল, “নমস্কার। আমরা লালবাজার থেকে আসছি। আপনাদের সঙ্গে একটু কথা ছিল।”
“আসুন” একটা বিধ্বস্ত গলায় উত্তর এল।
ওরা দুজনে ভিতরে ঢুকল। ঘরে কোনও চাকচিক্য নেই। সাধারণ আর পাঁচটা মধ্যবিত্তের মতোই ছিমছাম। ওরা বসতেই ভিতর থেকে এক মহিলা বেরিয়ে এসে তাদের সামনের চেয়ার তার বসলেন, পাশে সেই ভদ্রলোকও।
অভিমন্যু কিছু বলার আগেই পৃথাই মুখ খুলল- “আপনারা কি বিক্রমের বাবা মা?”
আলতো করে ভদ্রলোক বললেন, “হ্যাঁ।”
“দেখুন এই সময় আপনাদের বিরক্ত করার জন্য খুবই দুঃখিত তবু কয়েকটা প্রশ্ন ছিল আর কী।”
এবার ভদ্রমহিলা বললেন, “বলুন যা জানতে চান। কিন্তু আমাদের ছেলেটা তো আর ফিরে আসবে না।” বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কিন্তু পর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন।
বিশ্বজিৎবাবু বললেন, “আপনাদের যা জানার জিজ্ঞেস করুন। জানলে নিশ্চই বলব।”
“বিক্রম কে কি বিগত কিছুদিন ধরে একটু অস্বাভাবিক লাগছিল কি? ভালো করে ভেবে বলুন।”
“না তো। আলাদা তো কিছু লক্ষ্য করিনি।”
“ও কি প্রত্যেকদিন এক সময় বাড়ি ফিরত?”
“হ্যাঁ সন্ধ্যে বেলার ডিউটি থাকলে ওই রকম এগারোটা দশ পনেরোর মধ্যেই বাড়ি ফিরত। কয়েকদিন ওর সন্ধে বেলাতেই ডিউটি পড়ছিল। তাই ওই সময়ই রোজ ফিরত।”
“হুঁ। এবার একটু ভেবে বলুন ওর কি কোনও শত্রু ছিল যে ওকে খুন করতে পারে?”
এবার বিক্রমের মা বললেন, “একদম না। ও র কোনও শত্রু ছিল না। আমরা অন্তত জানি না। ছেলে আমার খুব ভালো ছিল। কারোর সঙ্গে ঝগড়াও করত না।”
“কোনও প্রেম ঘটিত ব্যাপার ছিল কি ? এই বয়সে তো……..”
এবার প্রায় চেঁচিয়ে উঠল বিক্রমের মা, “নাঃ নাঃ নাঃ। সেসব কিছু হলে নিশ্চয় জানতাম।”
এবার পৃথা সমরেশ আর মনোজ এর ছবি এগিয়ে দিল দুজনের দিকে, “দেখুন তো এদের চেনেন কি না?”
বিশ্বজিৎবাবু ও তার স্ত্রীর মুখগুলো কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিন্তু মুখে বললেন, “না। এদের আগে কখনও তো দেখিনি।”
“কখনও সমরেশ বা মনোজ বলে কারোর নাম শুনেছেন বিক্রমের মুখে?”
“না কোনও দিন নয়।” বেশ ইতস্তত করেই বললেন ভদ্রলোক। অভিমন্যুর চোখ দেখে বিক্রমের মার যেন একটু অস্বস্তি হচ্ছে।
“বেশ আমরা তাহলে এখন উঠি। পরে প্রয়োজন হলে আবার আসব। অনেক ধন্যবাদ। নমস্কার।” এই বলে উঠে পড়ল পৃথা আর অভিমন্যু।
নিচে এসে গাড়িতে উঠতে উঠতে অভিমন্যু বলল, “আমি ভাবলাম আপনি ওর ঘরটা সার্চ করার কথা বলবেন।”
পৃথা বলল,” অযথা সময় নষ্ট হত। লাভ হত না কিছু। এটা ব্যক্তিগত খুন নয়।”
“হ্যাঁ সেটা তো নিঃসন্দেহে। আর এই বিক্রম যে মনোজ আর সমরেশকে চিনত তাও বোঝা যাচ্ছে। আপনি ছবি আর নাম দুটো বলার পর ওদের মুখগুলো লক্ষ্য করেছিলেন?”
“করেছিলাম। চলো সমরেশ সান্যালের বাড়ি। সল্টলেকের স্টেডিয়াম আইল্যান্ড থেকে লেফট টার্ন নিয়ে পাঁচ মিনিট গেলেই রাস্তার বাঁদিকে পরবে। ‘প্যারাডাইস অ্যাপার্টমেন্ট’।”
গাড়ি ঘোরাল অভিমন্যু। মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে গেল সমরেশের অ্যাপার্টমেন্ট এ। কিন্তু এখানেও বিশেষ কিছু জানা গেল না। সমরেশের বাবা পলাশ সান্যাল আর মা দিপা সান্যাল এমন কোনও তথ্য দিতে পারলেন না যাতে তাদের ছেলের খুনের কিনারা করা যায়। বাকি দুজনের ছবি দেখিয়ে ও নাম বলেও কোনও ফল হয়নি। ওঁদেরও বক্তব্য তাঁরা বিক্রম বা মনোজ কাউকেই চেনেন না।
এরপর তাদের গন্তব্য মনোজ সরকারের বাড়ি।
অভিমন্যু বলল, “আচ্ছা পৃথাদি এই মনোজের বাড়িটা তো বালিগঞ্জে কিন্তু ওকে খুন করা হয় কুষ্ঠিয়ার কাছে ওই পুকুরটার সামনে। ওই স্পটে কি একবার যাব নাকি?”
পৃথা যেন কি ভাবছিল। হঠাৎ চমকে বলল, “হ্যাঁ! হ্যাঁ হ্যাঁ চলো।”
আগে ওরা খুনের জায়গায় গেল। বেশ খানিকটা জায়গা পুলিশি ব্যারিকেড দেওয়া। রাস্তাটা খুব চওড়া না হলেও দুটো গাড়ি পাশাপাশি যাওয়া যায়। কিন্তু রাস্তার সামনে পিছনে অন্তত একশো মিটারের মধ্যে কোনও বসত বাড়ি নেই। খুন করবার উপযুক্ত জায়গা।
“খুনি জানল কী করে মনোজ এই রাস্তা দিয়ে আসবে?” জিজ্ঞেস করল অভিমন্যু।
“নিশ্চয়ই ওকে ফলো করেছিল। সেটা কোনও বড় ব্যাপার নয়। চলো এবার ওর বাড়িতে।”
মনোজদের বাড়িতেও তেমন চোখে পড়ার মতো কোনও বৈশিষ্ট্য ছিল না। তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। পৃথা আর অভিমন্যু যখন মনোজের বাড়িতে ঢোকে তখন একজন লোক হঠাৎ করে ভিতর থেকে কে একজন বলে ওঠে, “লিটল মিস মাফেট, স্যাট অন হার টাফেট..” এর পরেই একটা মৃদু ধমকের আওয়াজ এল ভিতর থেকে। তারপরে একজন মহিলা বেরিয়ে এল। ওদের নমস্কার করে বসতে বলল।
“নমস্কার। আমার নাম অ নিতা সরকার। আমি মনোজের মা। কি জানতে চান বলুন?”
এবার অভিমন্যুই আগে মুখ খুলল।
“ভিতরে উনি কে?”
“উনি আমার হাসব্যান্ড বিপ্লব সরকার।” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভদ্রমহিলা।
পৃথা এবার বলল, “কবে থেকে ওঁর এই অবস্থা?”
“আমার শাশুড়ি মা মারা যাওয়ার পর থেকে।”
কেমন একটা খটকা লাগে পৃথার। তবু মুখে কিছু প্রকাশ না করে সোজা আসল প্রশ্নে চলে গেল।
“মনোজের কি কোনও শত্রু ছিল যে তাকে খুন করতে পারে?”
“না সেরকম কাউকে চিনি না।”
“আচ্ছা ও কবে থেকে এই ক্যাবের কাজটা করছে?”
“প্রায় দুবছর হয়ে গেল। হাতের কাছে আর কোনও চাকরি পায়নি। চেষ্টা করছিল আরও ভালো কিছু পাওয়ার। কিন্তু তার তো আর অবকাশই হল না।” এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অ নিতাদেবী।
এবার অভিমন্যু মোবাইলে ছবি দুটো দেখল।
“দেখুন তো এদের চেনেন?”
ভদ্রমহিলা একবার দেখে ঘাড় নাড়ালেন।
“সমরেশ সান্যাল বা বিক্রম দাশকে মনোজ চিনত?”
“না।”
“জনি জনি, ইয়েস পাপা
এটিং সুগার, নো পাপা
টেলিং লাই, নো পাপা
ওপেন ইউর মাউথ, হা হা হা।”
এতক্ষণ কেউ লক্ষ্য করেনি যে ভিতরের দরজার সামনে একটা লোক দাড়িয়ে ছিল। সেই ছড়াটা বলে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে গেল। অ নিতা দেবীর মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিন্তু পৃথা বা অভিমন্যু কেউই আর কথা বাড়াল না। তারা ভদ্রমহিলাকে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়ল।
বাইরে বেরিয়ে অভিমন্যু জিজ্ঞেস করল, “পৃথাদি এখন কোথায় যাবেন?”
“সাড়ে পাঁচটা বাজে। একটু ভাবতে হবে কেসটা নিয়ে। তুমি আমায় বাড়িতে ড্রপ করে দাও আর দরকার হয় তুমিও বাড়ি চলে যাও। আজকের মতো আর ঘোরাঘুরি করার দরকার নেই।”
“ঠিক আছে।”
অভিমন্যু পৃথাকে তার এলগিন রোডের বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।
পৃথা ঘরে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে ভাবতে লাগল এই তিনজন ভিক্টিমের মধ্যে যোগসূত্রটা কোথায়। হঠাৎ তার বিপ্লববাবুর মুখে সেই রাইমটার কথা মনে পড়ে গেল। “জনি জনি ইয়েস পাপা” – কিন্তু কেন বলছিলেন ভদ্রলোক এই ছড়াটা। শুধুই কি পাগলের প্রলাপ না অন্য কিছু। আরেঃ শেষ লাইনটা যেন কি? “টেলিং লাই” তার মানে কি অ নিতা দেবী মিথ্যে কথা বলছেন যে উনি বা মনোজ, সমরেশ আর বিক্রমকে চেনেন না। কিন্তু কেন?
পৃথা এবার মোবাইলটা তুলে অভিমন্যুর নম্বরটা ডায়াল করল। ক্রিং। ক্রিং।
“হ্যালো?”
“হ্যালো অভিমন্যু?”
“হ্যাঁ পৃথাদি বলুন।”
“একটা কাজ করবে। এই তিনজনের ছবি আর নামগুলো একটু মিলিয়ে দেখো তো এদের কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে কিনা।”
“আপনি কি কিছু সন্দেহ করছেন?”
“হ্যাঁ এদের বাবা মার হাব ভাব দেখে সন্দেহ হচ্ছে। তুমি এটা খোঁজ নিয়ে আমায় কাল জানিও তো।”
“ঠিক আছে।”
“আচ্ছা রাখছি।” বলে ফোনটা রেখে দিয়ে পৃথা আবার ভাবনার সাগরে ডুবে গেল। একটা ক্ষীণ আলোর আভা দেখা দিচ্ছে। আলোটা আরো জোরালো হবে না নিভে যাবে সেটা কালকে অভিমন্যুর ইনফরমেশনের পরেই বোঝা যাবে। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।
(দুই)
এমনিতে খুব তাড়াতাড়ি ওঠার অভ্যেস পৃথার নেই। কিন্তু আজ সাড়ে সাতটার সময় উঠতেই হল। ফোনটা বেজেই চলেছে। ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখে অভিমন্যুর নম্বর। তাড়াতাড়ি সে ফোনটা তুলল – “হ্যালো।”
“হ্যাঁ পৃথাদি আমি অভিমন্যু বলছি।”
“হ্যাঁ বলো।”
“কাল আপনি আমায় একটা কাজ দিয়েছিলেন। আমি কাল রাতে বসে ওই তিনজনের ক্রিমিনাল রেকর্ড চেক করছিলাম আর একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য পেলাম। এখনই কী আপনার বাড়ি গেলে অসুবিধা আছে?”
“না না চলে এসো। এখানেই ব্রেকফাস্ট করে নেবে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে আমি আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছচ্ছি।” বলে ফোনটা রেখে দিল অভিমন্যু।
পৃথা তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিল আর মাকে বলে দিলো অভিমন্যুর আসার কথা। আটটার কিছু পরেই অভিমন্যু এসে হাজির হল। তার সঙ্গে তার ল্যাপটপের ব্যাগ। এরপর দুজনে গিয়ে হাজির হল পৃথার ঘরে। পৃথা বলল, “হ্যাঁ বলো কী পেয়েছ?”
“আপনি কাল বলেছিলেন এদের নাম আর ছবি চেক করতে যদি আমাদের রেকর্ডের কারোর সঙ্গে মেলে? আমি রাতে সেটাই করছিলাম। তারপর একটা কেসের রেকর্ড বের হল এই দেখুন।” বলে ল্যাপটপটা খুলে বাড়িয়ে দিল পৃথার দিকে। ল্যাপটপে কিছুক্ষন চোখ বুলিয়ে মুখটা হাঁ হয়ে গেল পৃথার।
অভিমন্যু বলল, “বারো বছর আগের কেস। আমদের দুজনের কেউই তখন ডিপার্টমেন্ট জয়েন করিনি। একটা গ্যাং রেপের কেস। আর অ্যাকিউজড হল সমরেশ সান্যাল, মনোজ সরকার, বিক্রম দাশ ও ইন্দ্রজিৎ মিত্র আর ভিক্টিমের নাম ঐন্দ্রিলা মজুমদার। রেকর্ডে এটাও পাওয়া যাচ্ছে অভিযোগ ওঠে যে ওই মেয়েটিকে এই চারজন ধর্ষণ করে। তারপর তাকে খুন করা হয়। শুধু তাই নয়, এরপর নাকি ওই মেয়েটির দেহটা পুড়িয়ে ওই চারজন পালায়।”
“হুঁ। মেয়েটি তার বন্ধু অনির্বাণের সঙ্গে বেরিয়ে ছিল। আর ফেরেনি বলে অভিযোগ করেন তার বাড়ির লোক। কিন্তু এটা কী?… দেওয়া আছে যে কেসটাকে কোনও পোক্ত প্রমাণ না পাওয়ার দরুন চারজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।”
“হ্যাঁ। এই ইন্দ্রজিৎ মিত্রের বাবা কিন্তু যথেষ্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোক, কলকাতার নামি ব্যবসায়ী। আমার তো মনে হয় এর মদতেই এই কেসটা বন্ধ হয়। তাছাড়া ঘটনাটার একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিল অনির্বাণ। কিন্তু সে কোনও সাক্ষ্য দেয়নি।”
“এখন এই ইন্দ্রজিৎ কোথায়?”
“দুবাইতে। আমি এখানে আসার আগে ওকে ফোন করি। ওর বাড়ি থেকে ওর নম্বর নিয়ে ফোন করি। ও বলল ওর কলকাতায় আসার দিন কালকে। আমি ওকে বলে দিই যে এখন এখানে না আসতে। কিন্তু ওর নাকি খুব জরুরী কাজ আছে। আসতেই হবে। তাই আমি বলি যে ফ্লাইটে ওঠার আগেই যেন আমাদের ফোনে করে জানায়।”
“সেটা ভালো কাজ করেছ। কিন্তু তাহলে আততায়ী কে? একবার এই ঐন্দ্রিলা আর অনির্বাণের বাড়ি যেতে হবে। চলো এখুনি ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়ছি। অফিসে আমি স্যারকে ফোন করে বলে দিচ্ছি।”
“ওকে চলুন।”
এরপর তারা কুড়ি মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়ল। গন্তব্য পার্ক সার্কাস, ঐন্দ্রিলা মজুমদারের বাড়ি। রাস্তায় জ্যাম থাকার দরুন বেশ খানিকটা দেরী হল পৃথাদের।
সাড়ে নটার সময় তাদের গাড়ি এসে থামল ‘মীরা’ অ্যাপার্টমেন্টের সামনে। দোতলার ফ্ল্যাটে থাকত ঐন্দ্রিলা। ওরা দুজন উঠে বেল বজালো। একজন যুবক দরজা খুলে জিজ্ঞাসু চোখে চাইলো তাদের দিকে। অভিমন্যু বলল, “নমস্কার। আমরা লালবাজার গোয়েন্দা দফতর থেকে আসছি। আপনাদের সঙ্গে একটু কথা ছিল।”
ওপাশ থেকে উত্তর এল, “আসুন।”
তারা সামনের সোফায় বসতেই যুবকটি বলল, “আপনারা বসুন আমি চা আনছি।”
পৃথা সঙ্গে সঙ্গে বলল, “না না সে সব কিছু লাগবে না। আপনি বলুন ঐন্দ্রিলা আপনার কে হত?”
“আমি অনিরুদ্ধ মজুমদার। ঐন্দ্রিলা আমার দিদি।”
“বাড়িতে আর কেউ আছে কি?”
“না আমাদের মা অনেক আগেই মারা যায়। আপনারা পুলিশের লোক তাই হয়তো দিদির খবরটা জানেন। ওই ঘটনার শকটা বাবা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার কিছুদিনের মধ্যেই আত্মহত্যা করেন বাবা। যদি দিদির খুনিরা ধরা পড়ত তাহলেও হয়ত বাবা বেঁচে যেত। কিন্তু…” বলতে বলতে গলা বুঝে এল ছেলেটার।
“আপনি অনির্বাণ দত্তকে চেনেন?”
“হ্যাঁ দিদির বন্ধু। কিছুদিন পর ওদের বিয়ে ঠিক হত, সেইদিন তো দিদি অনির্বাণদার সঙ্গেই ফিরছিল। কিন্তু ওই ঘটনার পর থেকে কিন্তু অনির্বাণদাকে আর দেখিনি।”
“আপনি এখন কী করেন?”
“ব্যাংকে চাকরি করি। ওই সব অনেক দিনের ঘটনা। আমাদের মত ছাপোষা লোকেরা কখনও বিচার পায় না। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমিও ওইসব ঘটনা আস্তে আস্তে মন থেকে সরিয়ে ফেলেছি।”
“আপনি তো একা মানুষ। কোনও অসুবিধা হয় না?”
একটু হেসে ছেলেটা বলল, “না। এমনিই দিব্যি চলে যায়। কিন্তু আপনারা কেন এলেন তা তো বললেন না।”
“আপনার দিদির চার হত্যাকারীর মধ্যে তিনজন খুন হয়েছে। চারজনের মধ্যে যোগসূত্র শুধু আপনার দিদির হত্যা। কাজেই সেই সূত্রে আপনার বাড়িতে এসেছিলাম। বুঝতেই পারছেন সন্দেহের তীর কিন্তু আপনার দিকে রয়েছে। তাই আপাতত এখন শহর ছেড়ে কোথাও যাবেন না।”
এবার বেশ জোরেই হেসে উঠল ছেলেটা। “আপনাদের মনে হয় আমি খুনগুলো করছি? তা ভালো কথা। আমার তো ঠিক করে মনেও নেই কারা কাজটা করেছিল। কিন্তু আপনারা যা বলছেন তাই করব তবে ওসব খুনটুন আমি করিনি।”
“ঠিক আছে সেটা আমরা বুঝব। আপনাকে যা বললাম তা মনে রাখবেন। আজ উঠলাম। প্রয়োজন হলে আবার আসব। নমস্কার।”
বলে পৃথা আর অভিমন্যু বেরিয়ে পড়ল অনিরুদ্ধর বাড়ি থেকে।
গাড়িতে উঠে অভিমন্যু জিজ্ঞেস করল, “পৃথাদি এবার অনির্বাণ দত্তর বাড়ি যাব তো?”
“হ্যাঁ চলো।”
অনির্বাণ দত্তর বাড়িটা ল্যান্সডাউন রোডে। বাড়ির নাম ‘দত্ত ভবন’। গাড়িটা এক সাইডে পার্ক করে ওরা দুজন বাড়িতে প্রবেশ করল।
বেল বাজানোর বেশ কিছুক্ষন পর একজন মহিলা দরজা খুলল।
“হ্যাঁ বলুন?” প্রশ্ন করলেন ভদ্রমহিলা।
পৃথা বলল, “নমস্কার আমরা লালবাজার থেকে আসছি। আপনাদের সঙ্গে একটু কথা ছিল।”
“আসুন।”
মহিলা তাদের নিয়ে গিয়ে বৈঠকখানায় বসালেন। বললেন, “কোনও খোঁজ পেয়েছেন অনির্বাণের?”
“নাহ। তবে ওর অন্তর্ধান সম্বন্ধে কিছু জানার আছে আমাদের?”
“মানে? ঠিক বুঝলাম না কী বলছেন।”
“বলছি। তার আগে বলুন আপনাদের বাড়িতে কে কে রয়েছে আর আপনি অনির্বাণের কে হন?”
“আমি ওর মা মিতালী দত্ত। অনির্বাণের বাবা এখন বাড়িতে নেই। কারখানায় আছেন। আর বাড়িতে থাকে বলতে আমার ছোট ছেলে অনীশ। এখন কলেজে। আর কেউ থাকে না।”
“আপনাদের কি পারিবারিক ব্যবসা?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“আচ্ছা এবার আসল কথায় আসি। ২৩শে আগস্ট, ২০০৯ এই দিনে অনির্বাণ তার বান্ধবী ঐন্দ্রিলার সঙ্গে নেমন্তন্ন গিয়েছিল? আশা করি মনে আছে। সেইদিন ফেরার পথে রাতে ঐন্দ্রিলার সঙ্গে একটা অমানুষিক কাণ্ড ঘটে। তারপর অনির্বাণের কি হল?”
“জানি না। এরপর থেকেই অনির্বাণ নিখোঁজ। আজ অবধি কোনও খোঁজ পাইনি ওর।” বলতে বলতে ভদ্রমহিলার গলা বুজে এল।
“অনির্বাণ ও ঐন্দ্রিলার মধ্যে ঠিক কি সম্পর্ক ছিল?”
“ওরা একে অপরকে ভালোবাসত। কয়েকমাস পর ওদের বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল।”
“আপনি কি জানেন যারা ঐন্দ্রিলাকে মেরে ছিল তাদের মধ্যে তিনজন খুন হয়েছে?”
“তাই নাকি? তাহলে ভগবান এতদিনে ওদের উচিত শাস্তি হয়েছে। কিন্তু আমি কি করব? অনির্বাণ কে কি খুঁজে আনতে পারবেন?”
“আমার মনে হয় খুব শিগগিরই অনির্বাণ ফিরবে।”
“সত্যি বলছেন?”
“হ্যাঁ তবে এখনই বেশি উৎফুল্ল হবেন না। কী অবস্থায় ফিরবে তা আমরা বলতে পারছি না। আজ উঠছি। পরে প্রয়োজন হলে আবার আসব।”
“আচ্ছা” বলে ভদ্রমহিলা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল ওদের।
গাড়িতে উঠে অভিমন্যু জিজ্ঞেস করল, “এবার কি অফিসে যাবেন?”
“হ্যাঁ চলো।” অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিল পৃথা।
“পৃথাদি একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“হুঁ।”
“এখন অবধি কাকে কাকে সন্দেহ করছেন? অনির্বাণ আর অনিরুদ্ধ ছাড়া আর কেউ হতে পারে কি?”
“না আমার সন্দেহ কাজগুলো অনির্বাণই করছে।”
“কিন্তু কথা হল ও এতদিন পর প্রতিশোধ নিচ্ছে কেন?”
“তার থেকেও বড় প্রশ্ন ও এখন কোথায়? যতদিন এই ইন্দ্রজিৎ ভারতে না ফেরে ততদিন ওকে ধরা অত্যন্ত মুস্কিল।”
বলতে বলতে তারা লালবাজার পৌঁছে যায়।
পৃথা নেমে বলে, “অভিমন্যু আমার কেবিনে এসো তো।”
“হ্যাঁ যাচ্ছি।”
দুজনে পৃথার রুমে ঢুকে নিজেদের চেয়ারে বসলো। পৃথা বলল, “এমন কি হতে পারে না যে অনির্বাণ তার বাড়ির কারোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। ওর মা কিন্তু যথেষ্ট শক্ত মানুষ।”
“হতেই পারে। আমি এক কাজ করি, ওদের বাড়িতে দুজন লোককে স্পাই করতে পাঠিয়ে দিই।”
“হ্যাঁ তাই করো আর এই অনিরুদ্ধর পিছনেও লোক লাগাও। আমার বিশ্বাস ও খুন করেনি তবু সাবধানের মার নেই।”
“ওকে হয়ে যাবে।”
“আচ্ছা কাল কখন ইন্দ্রজিৎ এর ফ্লাইট নামবে কলকাতায়?”
“রাত দশটায়।”
“এই ইন্দ্রজিতের বাড়ি কোথায়?”
“হাওড়ার সাঁতরাগাছি এলাকায়।”
“ও তার মানে তো এয়ারপোর্ট থেকে আসতে ওকে কোনা দিয়ে আসতে হবে। তারমানে বেশ খানিকটা ফাঁকা রাস্তা পড়বে যেখানে রাস্তার দুধারে শুধু গাছপালা।”
“অর্থাৎ কাল খুনি ওর উপর অ্যাটেম্পট করতে পারে?”
“এক্সাক্টলি তাই।”
“কাল তাহলে তো আমাদেরও ট্রাই নিতে হবে।”
“হ্যাঁ তা তো নিতেই হবে।”
(তিন)
পরের দিন বেশ টেনশনে কেটেছে পৃথা আর অভিমন্যুর। গোটা দিন ধরেই ওরা অপেক্ষা করছিল রাতের জন্যে। পৃথা একরকম নিশ্চিত ছিল যে অনির্বাণ সেইদিনই নিজের শেষ শিকার করবে। কিন্তু এখনও কিছু প্রশ্ন ঘুরছিল পৃথার মাথায়।
১) কেন অনির্বাণ এতদিন পরে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো?
২) কেন অনির্বাণ বারো বছর আগে গিয়ে কোর্টে সাক্ষী দেয়নি?
৩) কিন্তু ও কি শুধুই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আত্মগোপন করে আছে? নাকি অন্য কোনও কারণও আছে?
৪) এতদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ও লুকিয়ে ছিল কি করে?
নাহ্ এই উত্তরগুলো অনির্বাণকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই জানা যাবে। আপাতত প্রধান কাজ হচ্ছে ওকে ধরা। মনে মনে ভাবল পৃথা। ঠিক এই সময় অভিমন্যু তার ঘরে এল।
ঢুকে আসন গ্রহণ করে বলল, “পৃথাদি, রাতে আমরা মানে আমি আর আপনি সাতটার সময় বেরিয়ে পড়ব। বাকি ফোর্সের লোকেরা সাড়ে আটটায় বেরোবে আলাদা গাড়িতে। যেভাবেই হোক আমাদের দশটার আগেই এয়ারপোর্টে পৌঁছতে হবে।”
“হ্যাঁ এছাড়া আর গতি নেই। এখন বাজে সাড়ে ছটা। ডট আটটায় বেরোব।”
“ঠিক আছে।” বলে চলে গেল অভিমন্যু।
কাঁটায় কাঁটায় সাতটায় ওরা দুজন অভিমন্যুর কালো মারুতিটায় বেরিয়ে পড়ল। যখন ওরা এয়ারপোর্টে পৌঁছল তখন পৌনে আটটা বাজে। বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল দুজন। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সঙ্গে দুজনের উৎকণ্ঠাও বাড়তে লাগল। আটটা কুড়ি নাগাদ একটা গাড়ি বের হল এয়ারপোর্ট থেকে। সাদা রঙের অডি। অভিমন্যু বলল, “ওটাই ইন্দ্রজিৎ মিত্রের গাড়ি। ফলো করব?”
“হ্যাঁ করো কিন্তু দূরত্ব রেখে যাবে।” তাই অভিমন্যু বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখেই ইন্দ্রজিতের গাড়িটাকে অনুসরণ করছিল। সাদা রং হওয়ার ফলে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না। এই সময় এই রাস্তায় ট্রাক আর লরি ছাড়া অন্য গাড়ি খুব বেশি নেই। কিন্তু ওদের কপাল খারাপ। বৃষ্টি নেমে গেল। ফলে অভিমন্যুকে কিছুটা স্পিড কমাতে হল আর তার ফলে দুটো গাড়ির দূরত্ব আরো বেড়ে গেল। পৃথা ক্রমেই অধৈর্য হয়ে পড়ছিলো। সে বলে যাচ্ছিল – “এই বৃষ্টি আজ মনে হচ্ছে সব মাটি করে দেবে। যদি আজ কিছু হয় আর অনির্বাণ দত্তকে অ্যারেস্ট না করতে পারি তাহলে আর কোনওদিন এই কেস সলভ হবে না।”
বলতে বলতে তারা কোনা ধরে কলকাতা আসার রাস্তাটা ধরল। এরপরেই সেই ফাঁকা জায়গাটা আসবে। রাস্তা একেবারে শুনশান। এইসব রাস্তায় স্ট্রিট লাইট থাকে না। হেডলাইটের আলোয় যেটুকু যা দেখা যাচ্ছে। এরপর একটা টার্ন নিয়েই স্তম্ভিত হয়ে গেল দুজন। একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে রাস্তার উপর। গাড়িটা সাদা রঙের অডি। হেডলাইটের আলোয় দেখল একটা লোক রাস্তার উপর পড়ে আছে চিৎ হয়ে, বুক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। লোকটা যে মরে গেছে তার কোনও সন্দেহ নেই। আর খানিকটা দূরে একটা স্কুটি তীর বেগে ওদের ছড়িয়ে চলে যাচ্ছে। পৃথা বলে উঠল, “অভিমন্যু ওই স্কুটিটা। ফাস্ট ফাস্ট। আর কোনও গাড়ি নেই আশেপাশে। ওটাই হবে।”
অভিমন্যু গাড়ির গিয়ার বাড়িয়ে অ্যাক্সিলারেটরে ছাপ দিল। স্কুটিটা বেশ খানিকটা দূরে থাকলেও ক্রমশ ওটার সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে ফেললো অভিমন্যু। এই সময় পৃথা জানালা দিয়ে শরীরের অর্ধেকটা বার করে স্কুটিটার টেল লাইটের নিচে টিপ করে গুলি চালাল। একটা বেশ জোরে আওয়াজ করে টায়ারটা ফাটল আর আরোহী স্কুটি থেকে ছিটকে গিয়ে খানিকটা দূরে পড়ল। পৃথা আর অভিমন্যু দুজনেই দৌড়ে গেল লোকটার দিকে। লোকটা তখনও মাটিতে পড়ে আছে। দুজনে দুদিক থেকে ওকে ঘিরে ফেলল।
পৃথা বলল, “তোমার খেলা শেষ অনির্বাণ। বারো বছর ধরে পুষে রাখা রাগের কারণে তুমি চারজনকে হত্যা করেছ। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।”লোকটা দুহাতের উপর ভর দিয়ে বেশ কষ্টে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, “অনির্বাণ বারো বছর আগে মারা যায় অফিসার।”
“হোয়াট!!!!” মেয়েলি কণ্ঠে উত্তরটা শুনে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো পৃথা আর অভিমন্যু। অভিমন্যুর মুখটা মস্ত হাঁ হয়ে গেছে। পৃথা অনেক কষ্টে বলল, “তা তা তাহলে তুমি কে?”
উত্তর এল, “আমি ঐন্দ্রিলা মজুমদার। আর ওই যে যার নাম নিলেন না, অনির্বাণ দত্ত! সে বারো বছর আগে মারা যায়। আমি আপনাদের সব ঘটনাই বলছি। মন দিয়ে শুনুন।” পৃথা আর অভিমন্যু এতটাই হতবাক হয়ে গেল যে তাদের মুখ দিয়ে কোনও কথা বের হল না। রিভলভারগুলো হাতেই ধরা রইল ঐন্দ্রিলার দিকে তাক করে।
ঐন্দ্রিলা বলে চলল, “২৩শে আগস্ট, ২০০৯ আমি আর অনির্বাণ এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরছিলাম আমার স্কুটিতে। সেই মুকুন্দপুর থেকে। বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। একটা বেশ ফাঁকা মতন জায়গায় আমাদের তেল শেষ হয়ে যায়। তেলের ব্যাপারটা আগে লক্ষ করিনি নইলে ভরিয়ে নিতাম। দেখি একটা গাড়ি আসছে পিছনদিক থেকে। ভাবলাম যদি আমাদের সাহায্য করে। আমাদের দেখে গাড়িটা থামলোও। ভিতর থেকে একজন নেমে এল। কিন্তু ওকে আমার একেবারেই ভালো লাগেনি। ভুরভুর করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছিল ওর গা থেকে। আমাদের সমস্যা শোনার আগেই আমার দিকে অগ্রসর হতে গেল। অনির্বাণ এটা দেখেই ছেলেটার দিকে তেড়ে গেল। কিন্তু ও বুঝতে পারেনি যে গাড়িতে আরো লোক ছিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনজন বেরিয়ে এল। চারজনের সঙ্গে কি একজন পারে? নাহ্ অনির্বাণকে ওরা মেরে মাটিতে ফেলে দিল। তাকিয়ে দেখি ওর পেটে ছুঁড়ি দিয়ে আঘাত করেছে একজন। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিল। এরপর ওরা আমায় ধরল। তারপর…” আর বলতে পারল না ঐন্দ্রিলা। ওর গলা বুঝে এল।
কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে আবার বলতে শুরু করল, “আমাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় অনির্বাণের পাশে রাস্তার ধারে ফেলে দিল। তারপর ওদের বোধয় হঠাৎ করে বোধ হয় যে ওরা যা করেছে তাতে ওদের ফাঁসি হতে পারে। নিজেদের মধ্যে কি আলোচনা করল জানি না। তারপর গাড়ি থেকে তেল এনে অনির্বাণ ও আমার গায়ে ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিল। ভেবেছিল বোধয় আমিও মরে গেছি। আগুন জ্বালিয়েই ওরা পালিয়ে যায়। আমি বহু কষ্টে নিজের গায়ের চাদরটা দিয়ে কোনমতে আগুন নেভাই। আমারও বাঁচার কথা নয় জানেন কিন্তু হয়ত ভগবান আমার সহায় ছিল। এরপর ওখান থেকে আমি ছুটতে থাকি। তারপর কোথায় গিয়ে পড়ি বা এরপর কীভাবে আমাকে উদ্ধার করা হয়েছিল এসব আমি বলব না। তারপর এই বারো বছর পর প্রতিশোধ নিলাম। অনির্বাণের মৃত্যুর আর আমার সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের”। বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ঐন্দ্রিলা।
পৃথা আর অভিমন্যু এবার অনেকটা ধাতস্ত হয়েছে। পৃথা প্রশ্ন করল, “কিন্তু এতদিন তুমি কি করছিলে? প্রতিশোধ নেওয়ার হোক আগেই নিতে পারতে”।
“আমি এত দিন ধরে নিজের হৃদয়টাকে পাথর করছিলাম। খুব অবাক হচ্ছেন না। একটা সাধারণ মেয়ে কিভাবে চার চারটে খুন করতে পারে একা হাতে। আপনিও তো একজন মেয়ে আর আপনিও অস্ত্র ধরে আছেন। কেবল আপনি নিয়মের সুতোয় বাঁধা আর আমি ব্যতিক্রম। মাঝে মাঝে আমাদের সমাজ ভুলে যায় যে লক্ষী দেবী ও সরস্বতী দেবী যেমন নারী তেমনি মা দুর্গা ও মা কালীও নারী। সেটা মনে করিয়ে দিলাম এই মহান সমাজকে”।
“কিন্তু তাও তুমি আইনের চোখে অপরাধী। তুমি পুলিশকে বললে না কন?”
“কি হত বলে? কেসটা চলতই না। আমার এই আইনের উপর কোনও বিশ্বাস নেই যা সাধারণ মানুষকে বিচার দিতে পারে না। আপনি কি ভাবছেন আমায় আপনি আইনের আওতায় ধরবেন? পারবেন না”। বলেই সটান কাউকে কিচ্ছু করার অবকাশ না দিয়ে নিজের বুকে হাতের ছুরিটা বসিয়ে দিল। তারপরই রাস্তার উপর ঢলে পড়ল ঐন্দ্রিলা। পৃথা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ঐন্দ্রিলাকে ওঠানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।
ইতিমধ্যে পুলিশের গাড়ি উল্টোদিক থেকে সাইরেন বাজিয়ে ওদের সামনে এসে হাজির হল। একজন অফিসার পৃথাকে মাটিতে বসে থাকতে দেখে নেমে বলল, “কি হল ম্যাডাম?”
পৃথা বলল, “অ্যাম্বুলেন্স ডাকো। খুনি আত্মহত্যা করেছে। পিছনেও গাড়িটার সামনে একটা মৃতদেহ আছে। ওটাকেও তুলে নিও। আমরা এখন বেরোচ্ছি। চলো অভিমন্যু”।
অভিমন্যু নিঃশব্দে পৃথাকে অনুসরণ করল। ফেরার পথে অভিমন্যু বলল, “পৃথাদি এই কেসটার শেষটা খারাপ হয়নি কি বলেন? ঐন্দ্রিলাকে ধরলে বড্ড অবিচার হত ওর আর অনির্বাণের সঙ্গে। কিন্তু অটপ্সিতে ধরা পড়ল না কেন যে লাশটা কোনও মেয়ের নয় বরং একটা ছেলের?”
“আমার মনে হয় ধরা পড়েছিল কিন্তু কেসটা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য কোনও রেকর্ড ও বোধহ য় রাখেনি। কিন্তু আমি ভাবছি একজন মেয়ে এতটা ফেরোসাস কী করে হতে পারে যে চারজনকে খুন করে সুইসাইড করার ক্ষমতা রাখে?”
“আসলে কি জানেন তো পৃথাদি মানুষের দেওয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন তাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হয়। আর যখন কোনও নারী ঘুরে দাঁড়ায় তখন সে মা কালীর রূপেই সকলের সম্মুখীন হয়। প্রত্যেক নারীর মধ্যেই একজন দুর্গা একজন কালী লুকিয়ে আছে। কেবল সঠিক সময় সেটা আত্মপ্রকাশ করে।
“হুঁ” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল পৃথা। সমাপ্ত