অভিশপ্ত মূর্তি | বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | রোহন চট্টরাজ| Bengali Detective Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

অফিসের হেড যখন বললেন এবারে পুজোর আকর্ষণ হিসেবে আমাকে কলকাতার কোনো অতীব পুরানো বাড়ির ইতিহাস নিয়ে লিখতে হবে, তখন প্রথমটায় আমি খুব বেশি আত্মবিশ্বাস অনুভব করলেও অফিস থেকে বেরিয়েই কেমন যেন দমে গেলাম! কোথায় বাড়ির হদিস পাওয়া যায় সে নিয়ে ভাবতে ভাবতে যখন কলেজ স্ট্রিট পেরিয়ে যাচ্ছি তখন হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে আমার নাম ধরে ডাকল। মুখ ফিরিয়ে দেখি, আর কেউ নয়, আমাদের গোয়েন্দাবাবু শ্রীমান শঙ্কর চৌধুরী। কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনের ব্যাগ, হলুদ জামা আর জিন্সের প্যান্ট, গালে দুদিনের না কামানো দাড়ি। হাতে বেশ কিছু বই দেখে বুঝলাম এঁর মাসিক বইপত্র খরিদ্দারি পর্ব চলছে।

আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “এত অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তায় হাঁটছিস, কী ব্যাপার? বস কি কোনো কঠিন টাস্ক ধরিয়ে দিল নাকি?”

শঙ্করের অগণিত গুণাবলীর মধ্যে এটা আমাকে খুব বেশি করে অবাক করে। ছেলেটা তার আশ্চর্য ক্ষমতাবলে লোকের মনের কথা পড়ে ফেলে। ওকে জিজ্ঞেস করলে বলে, “পাওয়ার অব অবজারভেশন।”

আমি ওকে বললাম, “আপনার অনুমান একেবারেই নিখুঁত। শ্রীমান পল্লব অধিকারীর ইচ্ছা এবার আমি কলকাতার কোনও পুরনো বাড়ির ইতিহাসের উপর লিখি। এই এত বড় কলকাতা শহরে পুরনো বাড়ির ইতিহাস জানা কি চাট্টিখানি কথা!”

“তা মন্দ কি! আর তাছাড়া তুই যদি বলিস আমি তোকে এরকমই এক বাড়ির হদিসও দিতে পারি।”

কান অনেক সময় মানুষকে প্রবঞ্চনা দেয়! তাই শঙ্করের কথা আমি প্রথমবার শুনেও যেন শুনতে পেলাম না। তাই আর একবার জিজ্ঞাসা করলাম।

শঙ্কর আবার তার কথাটা বলে আমাকে বলল, “যে বাড়ির কথা তোকে বলছি সেটা আমারই এক পুরোনো মক্কেলের বাড়ি। গোয়েন্দা হিসেবে আমার প্রতিষ্ঠা লাভের প্রথম মাসেই কেসটা পাই। ওদের বাড়ির এক হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়কে খুঁজে দিতে আমি সাহায্য করি। অবিশ্যি তখন পুলিশও হাত লাগিয়েছিল। এই কারণে ওই বাড়ির লোকেরা আমাকে একটু সমীহ করেই চলে। আমি একবার ওদের বলে তোর একটা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। যতদূর আমার মনে আছে, ওদের বাড়িটা প্রায় দুশো বছরের বেশি পুরনো। রায়বাহাদুর হরিনারায়ন চক্রবর্তীর বংশধর এরা।”

“বলিস কি!”

“হ্যাঁ, তাই বলছি তুই যদি চাস তো একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

একেই বলে মেঘ না চাইতেই জল। আমি তৎক্ষণাৎ সুবোধ বালকের ন্যায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করলাম।

শঙ্কর বলল যে কাল সকালবেলা বংশীর দোকান থেকে আমরা তাদের বাড়ি যাব।

বংশীর দোকান আমাদের পাড়ার মোড়েই। সেখান থেকেই সকাল দশটা নাগাদ আমরা রওঁ দিলাম চক্রবর্তী বাড়ির উদ্দেশ্যে। যেখানে আমরা চলেছি সেটা নিউ আলিপুরের হুমায়ূন কবির সরণিতে। সেখান থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরেই ডান দিকে দেখতে পেলাম এক সুপ্রাচীন বাড়ি। বাইরে থেকেই বলে দেওয়া যায় যে, এ বাড়ি একশো বছরের বেশি পুরনো। ঘরটার সামনে এসেই দেখি গেটে কিছু পুলিশের জটলা আর একটা জিপ দাঁড় করানো রয়েছে। গতিক ভালো না বুঝে শঙ্কর তড়িঘড়ি ভেতরে ঢুকলো আর তার পেছন পেছন আমিও। ঘরটার ভেতর ঢুকে বুঝলাম, বাইরে থেকে যা বোঝাচ্ছিল ঘরটা তার চেয়েও বেশি অভিজাত। ভেতরে ঢুকতেই একটা বিরাট হলঘর। সেখানে বেশ কিছু সোফা পাতা রয়েছে। হলঘরের বাঁদিক বরাবর সারি দেওয়া তিনখানি ঘর। আমরা হলঘরে আসতেই দ্বিতীয় ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এই এলাকার ইন্সপেক্টর মিঃ সত্যেন্দ্র মজুমদার। এঁর সাথে কর্মসূত্রে আমার পূর্ব পরিচয় আছে। মজুমদার বাবুর পেছন পেছন বেরোলেন এক বছর সত্তরের ভদ্রলোক। তার চোখে মুখে একটা আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। হঠাৎ ভদ্রলোকের চোখ আমাদের দিকে পড়তেই শঙ্করকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “এ কী! শঙ্করবাবু আপনি?”

ইন্সপেক্টর এতক্ষন আমাদের লক্ষ্য করেননি বোধহয়। তাই বয়স্ক ভদ্রলোকের কথায় আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,”কি ব্যাপার, আজ আপনারা দুজন এখানে একসাথে? মিডিয়ার কাছে এর মধ্যে খবর পৌঁছেও গেল নাকি?” শেষের কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা এবং একটু খোশমেজাজেই বলা।

আমি কিছু বলার আগেই শঙ্কর বলল, “আমরা এসেছিলাম নিজেদের কিছু ব্যক্তিগত কাজে কিন্তু এখানে দেখছি সিরিয়াস ব্যাপার!”

এইসময় পাশের ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “আপনি এসে ভালই হয়েছে!”

এইসময় দেখলাম মজুমদারবাবু একটু বিরক্তির চোখে ভদ্রলোককে তাকালেন। তারপর শঙ্করকে বললেন, “আপনারা একে অপরের পূর্বপরিচিত মনে হচ্ছে?”

“হ্যাঁ, উনি আমার একজন পুরোনো মক্কেল।”

“আচ্ছা, তাহলে এই কেসটার ভার কি আপনিই নিচ্ছেন নাকি?”

শঙ্কর হালকা এসে বলল, “না না, আমি আপনাদের কাজে কোনোরূপ বাধা হতে চাই না। তাছাড়া এই খুনের সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাও নেই।”

ভদ্রলোক আর ইন্সপেক্টর সাহেব দুজনেই বেশ অবাক হলেন। “আপনি কি করে জানলেন যে এখানে খুন হয়েছে?” ইন্সপেক্টর প্রশ্ন ছুঁড়লেন।

“জানাটা অস্বাভাবিক নয়। আমরা যখন এখানে আসছিলাম তখন আমাদের পাশ দিয়ে একটা ময়নাতদন্তের জন্য ব্যবহৃত হওয়া গাড়ি বেরিয়ে গেল। এই এলাকায় এটা ছাড়া আর কোনো বাড়িতে খুন হয়নি। কাজেই..”

“আচ্ছা, তাহলে আপনাকে পুরো ব্যাপারটা বলি। এই বাড়ির চাকর রতন গতকাল রাতে খুন হয়েছে। খুনটা হয়েছে মাথায় এক পেতলের কলস দিয়ে আঘাতের ফলে। যেটা মৃতের পাশেই পড়েছিল। এই যে দুনম্বর ঘরটা দেখছেন, এটা এই বাড়ির ঠাকুরঘর। এখানেই তার লাশ পাওয়া গেছে।”

সব শুনে শঙ্কর ভদ্রলোককে বললেন, “ত্রিলোচনবাবু, রতন আপনার খুব প্রিয় চাকর ছিল সেটা আমি জানতাম। তাই তার মৃত্যুতে আপনার কষ্ট সবচেয়ে বেশি। I am sorry for your loss!”

ত্রিলোচনবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখ আর্দ্র হয়ে উঠছে। তিনি দুহাতে মুখ চেপে বললেন,

“সব ওই মূর্তিটার জন্য। ওটাই এই বাড়ির অভিশাপ!”

ইন্সপেক্টর বাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোন মূর্তি? জেরার সময় কিছু বলেননি তো এই নিয়ে?” তার গলায় রাগ স্পষ্ট।

“I am sorry মিঃ মজুমদার। আমার আগেই বলা উচিত ছিল হয়তো কিন্তু তখন আমি ভাবিনি ওটার জন্যেই এসব হচ্ছে। এখন যত ভাবছি তত মনে হচ্ছে যেন সব ওটাকে জড়িয়েই হচ্ছে। প্রথমে বিল্টুর অপহরণ( ত্রিলোচনবাবুর ভাগ্নে, যাকে খুঁজতেই শঙ্করের সাথে এদের পরিচয় হয়), তারপর রতনের মৃত্যু!”

এবার শঙ্কর মুখ খুলল,” মূর্তিটা আমি একবার দেখতে চাই ত্রিলোচনবাবু, অবশ্যই যদি আপনার আপত্তি না থাকে।”

“হ্যাঁ, আমিও একবার নিজের চোখে দেখতে চাই আপনাদের সেই অভিশপ্ত মূর্তিটিকে!” বলেই আওয়াজ করে হাসলেন মিঃ মজুমদার কিন্তু কারো সমর্থন না পাওয়ায় একটু যেন দমে গেলেন।

ত্রিলোচনবাবু আমার দিকে একবার অস্বস্তি ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,” হ্যাঁ দেখাতে পারি! কিন্তু.. ইনি?”

শঙ্কর একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ইনি আমার বন্ধু, মিঃ অর্ণব ব্যানার্জী। ইনি পেশায় রিপোর্টার। আমরা আজ এখানে এসেছিলাম কারন অর্ণব আপনাদের বাড়ির ইতিহাস নিয়ে কাগজে লিখতে চেয়েছিল, অবশ্যই আপনার পারমিশন নিয়ে।”

“ও! কিন্তু এখন তো আর সে সম্ভব হবে না আমার পক্ষে।”

এবার আমি বললাম,” হ্যাঁ, বাড়ির অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। আমি পরে কোনোদিন আসব। কিন্তু আমি আজ শঙ্করের সাথে এই কেসটা দেখতে চাই, যদি আপনার আপত্তি না থাকে।”

“না না, ঠিক আছে। আপনারা আসুন আমার সাথে।”

ভদ্রলোকের পেছনে ঠাকুরঘরে ঢুকে দেখলাম সেটা যেন এক আস্ত মন্দির! গোটা ঘরটায় সাদা রং করা। গোটা ঘরেই বিভিন্ন আকারের কলসি এবং বেশ কয়েকটা সিন্দুকের মতো রাখা আছে। ঘরটার একদিকে ঠাকুরের আসনের মত জায়গা। তার সামনেই একটা সাদা চকে আঁকা মানুষের ছাপ। বুঝলাম ওখানেই বডিটা পাওয়া গিয়েছিল। গোটা ঘরটাতেই পুজোর নানারকম সামগ্রীতে সাজানো। চন্দনের হালকা অথচ মিষ্টি গন্ধ সারা ঘরেই ছড়িয়ে আছে। ত্রিলোচনবাবু এগিয়ে গিয়ে ঠাকুরগুলোর মধ্য থেকে একটা পাথরের বিগ্রহ নিয়ে এলেন। সেটাতে গণেশের মুখ খোদাই করা আছে।

“এই বিগ্রহটি অনেককাল ধরেই আমাদের ঘরে রয়েছে। আমার প্রপিতামহ রায়বাহাদুর হরিনারায়ন চক্রবর্তী এটাকে নিয়ে এসেছিলেন। এর ইতিহাস আমরা কেউই স্পষ্ট জানি না! কেবল আমার বাবার কাছে শুনেছি যে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং এটা তাকে উপহার হিসেবে দেন। কেন দিয়েছিলেন সেটাও আমাদের কাছে এক রহস্য!

শঙ্কর জিনিসটাকে একবার হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ইন্সপেক্টর মজুমদারকে দিয়ে দিল। তারপর বলল,” এই মূর্তির বর্তমান মূল্য সম্পর্কে আপনার কোনও ধারণা আছে?”

“না, আসলে এটা এতদিন ধর্মীয় কাজেই ব্যবহৃত হয়ে এসেছে বলেই বিক্রির কথা কেউ কোনোদিন ভাবিনি।”

ইন্সপেক্টর মূর্তিটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনি কি কাওকে সন্দেহ করেন যে এই মূর্তিটা চুরির কথা ভাবতে পারে?”

“একদমই না।”

শঙ্কর বলল, “মিঃ চক্রবর্তী, আপনার ছেলেরা মানে রথীন আর স্বাধীনবাবুকে কোথাও দেখতে পাচ্ছিনা!”

ত্রিলোচনবাবু একটু উদাসীন হাসি হেসে বললেন, “রথীন আগের বছর বিয়ে করে বাড়ি ছেড়েছে। তারপর থেকে আর যোগাযোগ রাখেনি। স্বাধীনই এখন আমার ব্যবসা দেখে। ও কাল সন্ধ্যাতেই একটু শিলিগুড়ি গেছে ব্যবসার কাছে। সকালেই ফোন করে ওকে আসতে বলেছি। সন্ধ্যে র মধ্যেই ফিরে আসবে বলেছে।”

“আপাতত আপনি তাহলে একা?”

“না, আমার একজন সেক্রেটারি আছে। ওর বাড়ি বাঁকুড়ায় বলে আমার সাথে এখানেই থাকে। ইন ফ্যাক্ট ওই আজ ভোরে রতনের দেহ আবিষ্কার করে।”

শঙ্কর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তখনই ইন্সপেক্টরবাবু বললেন, “ওয়েল মিঃ চৌধুরী, মিঃ চক্রবর্তী যেহেতু আপনার পুরোনো মক্কেল তাই উনি আপনাকে কেসটা দেখতে বলবেন এটা স্বাভাবিক। কিন্তু পুলিশ নিজের কাজ চালিয়ে যাবে। কোনো সাহায্য লাগলে জানাবেন। আমি এখন আসি।”

শঙ্কর ইন্সপেক্টরকে হাসি মুখে বলল, “আপনার কাছে সাহায্যের আশা তো করাই যায়।”

“আলবাত!”

ইন্সপেক্টর বেরিয়ে গেলে শঙ্কর ত্রিলোচনবাবুকে বললেন, “আপনার সেই সেক্রেটারিকে একবারও তো দেখতে পেলাম না তো!”

ত্রিলোচনবাবু বললেন,”হ্যাঁ, ও একটু বাজার গেছে।”

আমরা কথা বলতে বলতে হলঘরে আসতে দেখি পেছনের এক ঘর থেকে একটি বছর চব্বিশের মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আমরা তারদিকে তাকাতেই যেন সে বেশ ঘাবড়ে গেল। ত্রিলোচনবাবু বললেন,

“ও আমার সেক্রেটারি অনুপের বোন। এখানেই থাকে। অনুপের বাড়ি না ফেরার আর একটা কারন এটাও যে ওরা ভাইবোন অনাথ!”

মেয়েটার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সকাল থেকে খুন আর পুলিশের আনাগোনায় মেয়েটা বেশ ভয় পেয়েছে। ত্রিলোচনবাবু ওকে আমাদের জন্য চা বানাতে বলে হলঘরের সোফায় বসতে বললেন। আমরা বসা মাত্রই দেখলাম বাড়িতে এক যুবক ধীর পায়ে প্রবেশ করলেন। যুবকের বয়স প্রায় সাতাশ আঠাশ, পরনে ফুলহাতা জামা আর একটা ঢিলে জিন্স। চুল উস্কোখুস্কো। চোখে বড়ো ফ্রেমের চশমা। একটু অন্যমনস্ক ভাবেই যেন ভেতরে আসছিলেন কারন ত্রিলোচনবাবুর ডাকে তিনি আমাদের উপস্থিতি টের পেলেন। প্রথমটায় একটু চমকে গিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “স্যার, ওষুধটা পেলাম না!”

“ওহ্, এক কাজ করো, বিকেলের দিকে আর একবার ডক্টর সুনীলের কাছ থেকে ঘুরে এসো। আমি ওঁকে কল করে রাখব।” তারপর আমাদের দেখিয়ে বললেন, “এঁরা হলেন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর শঙ্কর চৌধুরী এবং তার বন্ধু রিপোর্টার।”

শঙ্কর তার দিকে একঝলক দেখে নিয়ে বললে, “আপনি এখন যথেষ্ট ক্লান্ত বুঝতে পারছি কিন্তু আমি কিছু প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে?”

লোকটার মুখে একটা ভয়ের হালকা রেখা উঠেই মিলিয়ে গেল। ফরমাল ভঙ্গিতেই বললেন, “হ্যাঁ, প্লিজ বলুন।” এইসময় ত্রিলোচনবাবু বললেন তিনি একবার তার ঘরে যাচ্ছেন। উনি নিজের ঘরে যাবার পর শঙ্কর তার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল,

“রতনের বডিটা আপনি কটা নাগাদ দেখতে পান?”

“ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। আমার রোজ ভরে ওঠা অভ্যেস। আমি উঠে রোজ একবার ঠাকুর ঘরে গিয়ে ঠাকুর প্রণাম করে মাঠের দিকে হাঁটতে বেরোই।”

“বেশ। আপনার বাড়ি তো বাঁকুড়ায়?”

“হ্যাঁ।”

“আপনি ত্রিলোচনবাবুর বাড়িতে কতদিন আছেন?”

“প্রায় দেড় বছর।”

“এর আগে কোথায় কাজ করতেন?”

“একটা প্রাইভেট ফার্মে । আইটি সেক্টরে।”

“কোথায় সেটা?”

“জামশেদপুরে ।”

“ওটা ছেড়ে দেবার কারন?”

“বাবা মা মারা যাবার পর বোনের দেখাশোনার অসুবিধা হচ্ছিল। ওখানে সেরকম পরিচিত কেউ থাকেনা যার কাছে ওকে রাখা যেত। তাই যখন ত্রিলোচনবাবুর কাজের অফারটা পাই তখন এখানে চলে আসি এবং আমি আর মনি মানে আমার বোন এখানেই থাকি এখন।”

“আচ্ছা। পুলিশের জেরাতে নিশ্চয় আপনি বিরক্তিতে আছেন।”

অনুপবাবু উদাসীন হাসি হেসে বললেন, “আমি একজন কর্মচারী, সন্দেহ প্রথমে আমার উপর পড়বে এটাই স্বাভাবিক নয় কি?”

শঙ্কর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে অনুপবাবুর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “এ বাড়ির ছেলেরা কখন আসছে?”

“স্যারের ছোটছেলে মানে স্বাধীনবাবুকে ফোন করে জানানো হয়েছে। কিন্তু বড়বাবুকে জানানোর কথা স্যার বলেননি।”

“বেশ।” শঙ্করের কথা শেষ হওয়া মাত্র ত্রিলোচনবাবু হলে এলেন। শঙ্কর আর আমি উঠে দাঁড়ালাম।

“এখন তাহলে আমরা আসি। কোনো কিছু জানতে পারলে আপনাকে জানাব।”

“বেশ।”

চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে শঙ্কর একটা সিগারেট মুখে নিল। তারপর একটু অন্যমনস্ক ভাবে বলল, “রতনের বয়সটা কত জানিস?”

আমি ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকালাম।

“আমি আজ তোর সাথে প্রথম ওই বাড়ি গেলাম। আমি কি করে জানব?”

শঙ্কর খানিকটা নিজের মনেই বলল, “বছর তিনেক আগেই সে এই বাড়িতে কাজে ঢুকেছে। বয়স তিরিশের আশেপাশে।”

তারপর দুজনে সামনের একটা দোকানে গেলাম। দোকানির কাছে একটা দেশলাই চেয়ে শঙ্কর লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল, “কি বিশ্রী ব্যাপার বলুন তো!”

দোকানী একটু দুঃখী মুখে বলল, “হ্যাঁ, রতন ছেলেটাকে আমি অনেকদিন চিনি। খুব ভালো ছেলে ছিল। মালিক খুব ভালোও বাসতেন তাকে। এমনটা হবে কে জানত!”

“হুম্, কে যে করতে পারে খুনটা?” শঙ্কর যেন নিজেকেই শোনাচ্ছে এমন ভাবে বলল কথাটা।

এবার দোকানি একটু আগ বাড়িয়ে বলল, “আমার তো ঘরের কাউকেই সন্দেহ হয় মশাই।”

“কেন বলুন তো? বাইরের চোরও তো হতে পারে!”

“তবে আপনাকে বলি শুনুন, রতন প্রায় দিন বিরক্ত মুখে এসে বলত আমাকে যে, ওর নাকি আর ভালো লাগছে না কাজ করতে, রোজ রোজ নাকি ওর সাথে কারোর ঝগড়া লাগছে। অথচ মালিকের বদনাম কোনোদিন করেনি ও। বুঝুন তাহলে, নিশ্চয়ই ও বাড়ির কেউ ওকে শাসাত!”

শঙ্করের মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। দোকান থেকে বেরিয়ে এসে একটা ট্যাক্সি দাড় করিয়ে বলল, “তুই বাড়ি চলে যা, আমার একটু কাজ আছে, বিকালে দেখা করব বংশীর দোকানে।”

শঙ্করের হাবভাব দেখে বুঝলাম ও কোনো একটা ক্লু পেয়েছে। আমি বেশি কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম।

বিকেলে পাঁচটা নাগাদ বংশীর দোকানে এসে দেখি শঙ্কর তখনও আসেনি। অফিসে বসকে ফোন করে বলে দিয়েছি আমাকে কিছুটা সময় দিতে। তাই কাজের চাপ আপাতত একটু কমই আছে। তাই মাথার মধ্যে সকালের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই ঘুরছি। সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছিল আমাকে শঙ্কর আর দোকানদারের কথাগুলো। কে রতনকে শাসাত আর রতনের বয়স নিয়ে শঙ্করের মাথা ব্যথা কেন? শঙ্কর না এলে কোনও উত্তরই পাওয়া যাবে না।

মিনিট পনেরো অপেক্ষা করার পর শঙ্কর দোকানে ঢুকল। বেয়ারাকে দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে শঙ্কর বলল, “কেসটা বেশ প্যাঁচালো বুঝলি। তবে খুনি কে সেটা আমি কিছুটা আন্দাজ করছি এখন!”

আমি বিস্ময়ে বললাম, “কে?”

শঙ্কর ভাবনায় ডুবে থেকেই বলল, “উহুঁ, এখনই বলা যাবে না। তবে কাল আশা করছি অনেকটা জট ছাড়াতে পারব।”

“কীভাবে ? কীভাবে?”

“রথীন আর স্বাধীন।”

“তুই আজ কোথায় গিয়েছিলি?”

“পুলিশের কাছে কিছু প্রাইমারি ডিটেলস আর এক্সট্রা কিছু ইনফরমেশন নিয়ে এলাম।”

“শুনতে পারি কি?”

“পুরোটা বলা যাবে না তবে এটুকু বলতে পারি খুনি ঘরের লোকই।”

“আর ওই অভিশপ্ত মূর্তি?”

“ওটাই এই কেসের মেন অ্যাট্রাকশন! ওটা আছে বলেই এত কান্ড।”

“আচ্ছা, রতনকে কে শাসাত বল তো?”

“সেটা কাল আর একবার চক্রবর্তী বাড়ি গেলেই জানা যাবে। তুই যাবি কি?”

“অবশ্যই। কেসটাতে কেমন যেন আকর্ষণ অনুভব করছি!”

“That’s the spirit! কাল তাহলে ওই দশটাতেই রওনা দেব।”

পরদিন চক্রবর্তী বাড়িতে গিয়ে দুজন নতুন ব্যক্তির সাথে পরিচয় হল। তারা হলেন শ্রী রথীন চক্রবর্তী এবং শ্রী স্বাধীন চক্রবর্তী, ত্রিলোচন চক্রবর্তীর দুই ছেলে। সকালে গিয়েই শঙ্কর তাদের জেরা করা শুরু করে দিই। পুলিশ নাকি সকালে এসেই একবার জবানবন্দি নিয়ে গেছে। তাই শঙ্করের জেরা করার প্রস্তাবে দুজনকেই বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিল।

প্রথমে শুরু হল রথীনবাবুকে দিয়ে। শঙ্করের নির্দেশ ছিল তার জেরা চলাকালীন কেউ যেন ঘরে না আসে।

শঙ্কর প্রশ্ন করল,” মিঃ চক্রবর্তী আমি প্রথমে জানতে চাই আপনার এ বাড়িতে না থাকার কারণ কী?”

“দেখুন শঙ্করবাবু, আমি বাবার বিনা অনুমতিতে এক so called নিচু জাতের মেয়েকে বিয়ে করি, যা বাবার সম্মানে লাগে। তাই তিনি আমাকে তার সম্পত্তি থেকে বাদ দিয়ে দেন কিন্তু সম্পর্ক পুরোপুরি নষ্ট করে দেননি এই যা ভাগ্য আমার। টাকাপয়সার অভাব নেই আমার, শুধু বাবা যে দুর থেকেই আমাদের সাথে আছেন এই অনেক।”

“আপনি এখন কোথায় কাজ করছেন?”

“Dutta textiles এর আমি একজন পার্টনার।”

“আচ্ছা। আপনাদের বাড়ির গণেশের মূর্তিটি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?”

“ওটা তো বাবার প্রপিতামহের আমল থেকেই আছে। সারাক্ষণ একটা লাল শালুতে মোড়া থাকে বলে আমি ভালো করে দেখিনি কখনও। আমার ঈশ্বর ভক্তি প্রায় নেই বললেই চলে। তবে শুনেছি নাকি ওর বর্তমান বাজার মূল্য অনেকটাই বেশি।”

“কীভাবে জানলেন যে দাম খুব বেশি?”

“ছোটবেলায় বাবার সেক্রেটারি অবিনাশ বাবু আমাদের বলেছিল গল্পচ্ছলে।”

“বেশ। কাল রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?”

“বাড়িতেই ছিলাম। আমার বাড়িতে কল করে জেনে নিতে পারেন।”

“আচ্ছা। আপনি এখন আসতে পারেন আর স্বাধীনবাবুকে ভেতরে পাঠিয়ে দিন।”

স্বাধীনবাবুর সাথে শঙ্করের পূর্ব পরিচিতি ছিল। আগের কেসে এঁর সাথে তার পরিচয় হয়।

“কেমন আছেন?”

“বাড়ির যা অবস্থা, ঠিক কি করে থাকি বলুন!”

“সে তো বটেই। আচ্ছা, আপনি কাল কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন?”

“আমার সন্ধ্যা ছটায় ফ্লাইট ছিল। আমি তার ঘন্টাদুয়েক আগেই বেরিয়ে যায়।”

“আচ্ছা! আপনাকে কি ত্রিলোচনবাবু নিজেই কল করে ডেকেছিলেন?”

“না, অনুপবাবু মানে বাবার সেক্রেটারীই আমায় ফোন করে আসতে বলে।”

“রতন সম্পর্কে আপনার কী মনে হত?”

“মানুষ হিসেবে খারাপ ছিল না। ওর বাবা আগে আমাদের বাড়িতে কাজ করত। কিন্তু সে অন্য জায়গায় কাজে ঢুকেছিল। তারপর তার বাবা মারা যাওয়াতে বাবা তাকে খুঁজে নিজের কাছেই রেখে দেন। মা তার ছোটবেলা তেই মারা গিয়েছিল।”

“আচ্ছা। আপনার বাড়ির গণেশ মূর্তি সম্পর্কে আপনার কী মতামত?”

“ওটা ঠাকুরঘরে থাকলেও ওটা কোনোদিন পুজো করা হয়নি। বাবা যে কেন ওরকম একটা দামী জিনিস ওভাবে অবহেলায় রেখে দিয়েছিলেন জানি না!”

“ওটার উপর যে কারোর নজর পড়তে পারে বা চুরির সম্ভাবনা থাকতে পারে এমনটা মনে হয়নি আপনাদের?”

“শঙ্করবাবু, আপনি হয়তো জানেন যে আমাদের বাড়ির বাইরে সিসিটিভি ক্যামেরা সেট করা আছে। কেউ এলে গেলে আমরা ঠিক খবর পেয়ে যায়। তাছাড়া মূর্তিটা সম্পর্কে বাড়ির লোকছাড়া বাইরের কেউই জানত না।”

“আচ্ছা। আপনি এবার আসতে পারেন।”

চক্রবর্তী ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে দেখলাম কালকের মেয়েটাকে যে কিনা অনুপবাবুর বোন। শঙ্কর তাকে দেখে দাড়িয়ে বলল,”মিস মনি আপনার কাছে কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল, যদি আপত্তি না করেন কিছু প্রশ্ন করতে পারি?”

মেয়েটা একটু জড়সড় হয়ে বলিয়ে “হ্যাঁ, বলুন।”

“রতনকে আপনি কেমন চিনতেন?”

হঠাৎ মেয়েটা যেন খুব ভয় পেয়ে গেল। আরো বেশি আড়ষ্ট হয়ে বলল, “রতনদার সাথে আমার বেশি কথা হয়নি কোনোদিন।”

“রাতে আপনি কটায় ঘুমোতে যান?”

“সব কাজ বাগিয়ে শুতে আমার এগারোটা বেজে যায়!”

“কাল রাতে কোনো আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন কি?”

“কই না তো!”

“বেশ। আজ আসি আমরা।”

চক্রবর্তী বাড়ি থেকে বেরিয়ে শঙ্কর বলল, “ময়নাতদন্তে জানা গেছে যে খুনটা নাকি রাত দুটো নাগাদ হয়েছিল এবং মাথায় ভারী কিছু আঘাতের ফলেই তার মৃত্যু হয়।”

“তোর এখন কী মনে হচ্ছে?”

“মনে তো অনেক কিছুই হচ্ছে। তবে জট খুলতে আর বেশি দেরি নেই। আর কিছু প্রমাণ শুধু।”

“At least আমাকে খুনীর নামটা বল!”

“ধৈর্য্য ধরো বৎস। বড়জোর কাল বা পরশুর মধ্যেই যবনিকা পতন ঘটবে!”

আজ আমার অফিসে কাজ থাকায় আমাকে ওখান থেকে ট্যাক্সি ধরে অফিস চলে যেতে হল। তারপর সারাদিন কাজের চাপে শঙ্করের কেসের কথা একরকম ভুলেই গেলাম। এর মধ্যে যে শঙ্কর আমাকে বার কয়েক ফোন করেছিল সে কথা আমি একেবারেই বুঝতে পারিনি। অফিস থেকে বেরিয়ে ফোন হাতে নিয়েই দেখি শঙ্করের মিসড কল। সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করে দেখলাম ওর ফোন সুইচ অফ। হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ করে আমি চলে আসছিলাম। হঠাৎ শঙ্করের একটা মেসেজ এল।

‘বংশীর দোকান, ৪টে।’

আমি বুঝলাম সিরিয়াস কিছু ঘটেছে। তাড়াতাড়ি একটা ট্যাক্সি ধরে চলে এলাম আমাদের পাড়ায়। শঙ্কর আগে থেকে অপেক্ষা করছিল। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ব্যাপার?”

হঠাৎ শঙ্করের গম্ভীর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল।

আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, “মানুষ desperate হয়ে কীভাবে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে সেটা সে নিজেও বুঝতে পারে না।”

আমি তাকে পুরো ব্যাপারটা বলতে বললাম।

“তুই অফিস যাবার পর আমি পুলিশের কাছে ইনফরমেশন জোগাড় করতে যাই, এছাড়া আরো কিছু সোর্স থেকে ও বাড়ির লোকেদের কিছু গোপন তথ্য জানতে পারি। আসার পথে আমি বেশ অন্যমনস্ক হয়েই হেঁটে আসছিলাম। সেই সময় পেছন থেকে একটা SUV এসে আমাকে চাপা দেবার চেষ্টা করে। পাশের এক বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালার জন্য আজ আমি প্রাণে বেঁচে যাই। এসবের মাঝে আমাকে মারতে আসা লোকগুলো একটা বড় মিসটেক করে বসে।”

আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, “কী?”

শঙ্কর নিরুত্তাপ গলায় বলল, “গাড়ির নম্বর প্লেট!”

পরদিন সকালে আমরা চক্রবর্তী বাড়ি গেলাম। ইন্সপেক্টর আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন, শঙ্কর তাকে আগেই পুরোটা জানিয়ে দিয়েছিল। আমি প্রায় পুরো ব্যাপারটাই জানতাম খুনীর নাম ছাড়া। শঙ্করকে আজ বেশ ঝরঝরে দেখাচ্ছিল। বুঝলাম রাতের ঘুমটা বেশ ভালই হয়েছে তার। হলঘরের ঘড়িতে দশটা বাজে। সবাই সেই ঘরে উপস্থিত।

শঙ্কর এক গ্লাস জল খেয়ে শুরু করল, “খুনের ধরন দেখে খুনিকে পাকা হাতের মনে না হলেও তার মোটিভ ছিল কিন্তু বেশ ভালই। কী, ঠিক বলেছি তো অনুপবাবু?”

অনুপবাবুকে দেখলাম তিনি রীতিমত কাপছেন ভয়ে! সকলের দৃষ্টি একবার শঙ্করের দিকে আর একবার অনুপবাবুর দিকে।

শঙ্কর বলে চলল, “ত্রিলোচনবাবুর অনুমান ঠিকই ছিল। দুষ্কৃতী প্রধানত আপনাদের বাড়ির so called অভিশপ্ত মূর্তির পেছনেই ছিল। কিন্তু তার চালে একটু গোলমাল হয়ে যায় নিজের দোষে। বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বুঝতে পারি যে কাল রাতে বাইরের চোর আসেনি কোনও। অর্থাৎ কাজটা ভেতরের লোকই করে। এবার নিজের কিছু কানেকশানের মাধ্যমে আমি চোরের হদিস পাই। এখন কে ওই মূর্তি চুরির চেষ্টা করছিল তার নাম শুনলে এখানে উপস্থিত সকলেরই ভিরমি খাবার জোগাড় হবে!”

সকলের উৎসুক দৃষ্টির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে শঙ্কর বলল, “তিনি আর কেউ নন, ত্রিলোচনবাবুর চাকর রতন!”

নামটা শুনেই আমি বাদে সকলেরই সত্যি সত্যি ভিরমি খাবার জোগাড় হল, বিশেষ করে ত্রিলোচনবাবুর। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, “এসব তুমি কী বলছো? রতন এ কাজ কেন করতে যাবে?”

শঙ্কর একই রকম নিরুত্তাপ গলায় বলল, “সে প্রশ্নের উত্তর আমিও পেতাম না যদি না আপনাদের বাড়ির বাইরের দোকানির সাথে পরিচয় হত। লোকটিকে বাইরে থেকে চুপচাপ মনে হলেও, সে আগে থেকেই টের পেয়েছিল যে এ বাড়িতে কিছু একটা ঘটতে চলেছে!”

“কীভাবে?” প্রশ্নটা করলেন স্বাধীনবাবু।

“তার আগে ত্রিলোচনবাবু বলুন তো, আপনি রতনের সুরাপানের অভ্যাস সম্পর্কে অবগত ছিলেন কিনা?”

“কই না তো! আমি নিজে কোনোদিন ওইসব খাওয়া সমর্থন করিনি। রতন খেত জানলে আমি ওকে কাজেই রাখতাম না।”

“আপনার আড়ালেই সে রোজ খেত তাও আবার ওই দোকানির সাথে। একদিন মদ্যপ অবস্থাতেই সে দোকানিকে জানায় যে তাকে একজন ওই গণেশের মূর্তিটি চুরি করার জন্য আদেশ দিয়েছে!”

“কে সেই লোক? সে কি বাড়ির কেউ নাকি বাইরের?” স্বাধীনবাবু উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলেন।

“স্বাধীনবাবু, have patience। তার আগে আমার অনুপবাবুকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।”

অনুপবাবু চুপ করেই আছেন। তার পেছনে তার বোনও জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে।

শঙ্কর প্রশ্ন করল, “আপনার ব্লাড প্রেসার এখন নর্মাল তো?”

অনুপবাবু মাথাটা একেবারে নিচু করে বললেন, “হ্যাঁ!”

“গুড। আপনার বাড়ি বাঁকুড়ার ওন্দা গ্রামে তাই তো?”

অনুপবাবু অবাক চোখে শঙ্করের দিকে তাকালেন। তার বোনও তাই।

“এসব..আপনি?..”

“আমি কীভাবে জানলাম সেটার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল আপনার উত্তর পাওয়া।”

“হ্যাঁ।” সংক্ষেপে জানালেন অনুপবাবু।

“আপনার এক জ্ঞাতি কাকা আছেন সেখানে। শ্রী সুধাময় বরাত…তাই তো?”

“হ্যাঁ..,” কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন অনুপবাবু।

“আচ্ছা, অনুপবাবু আপনার বোন…”

“মনি আমার বোন নয় ও আমার স্ত্রী..এটাই শুনতে চান তো আপনি?” হঠাৎ খানিকটা জোর গলাতেই বললেন অনুপবাবু। আমরা সকলেই হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছি অনুপবাবুর দিকে। পেছনে অনুপবাবুর বোন… মানে স্ত্রী দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেছেন। ত্রিলোচনবাবুর দিকে চোখ পড়তেই দেখি তিনি রীতিমত shocked। তিনি বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,

“অনুপ, তুমি এই এতবড় মিথ্যা আমাকে এতদিন বলে আসছিলে। মনি, তুমিও আমাকে কিছু জানাওনি?”

অনুপবাবু দুহাতে মুখ ঢেকে বললেন, “I am really sorry sir! কিন্তু এছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় ছিল না। ওর ঘরের লোকের অমতে আমরা বিয়েটা করি, পরে ওর দাদা আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তাই ভয়ে আমরা জামশেদপুর ছেড়ে এখানে কাজ পেয়ে চলে আসি নিজেদের পরিচয় গোপন করে!”

“আমাকে তো অন্তত জানতে পারতে!” ত্রিলোচনবাবু যথেষ্ট আঘাত পেয়েছেন বোঝা গেল।

এর মাঝে শঙ্কর বলে উঠল, “ত্রিলোচনবাবু, এর চেয়েও বড়ো একটা খবর আপনার অপেক্ষা করছে।”

তারপর অনুপবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “মিঃ বরাত আপনি কি তাহলে এবার কাল রাতের ঘটনাটা সকলকে বলবেন?”

অনুপবাবু মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালেন। তখন মিসেস বরাত অনুপবাবুর কাঁধে হাতটা রাখলেন। অনুপবাবুও তার হাতটা ছুঁয়ে বলা শুরু করলেন,

“এ বাড়িতে আসার পর থেকেই স্যার মনিকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতে শুরু করেন। মনিও স্যারকে নিজের বাবার মতোই সেবা করতে থাকে। কিন্তু ওই রতনের নজর ভালো ছিল না। মনি সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকত। অনেকবার ওই রতন মনিকে খারাপ ইশারা করেছে। আমার সাথে ওর এই নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু কাল রাতে…সবাই যখন খেয়ে শুয়ে পড়েছিল, মনি সবার শেষে শুতে যাচ্ছিল। সেইসময় রতন ওকে পেছন থেকে চেপে ধরে। আমি তখন জেগে ছিলাম। হালকা একটা আওয়াজ শুনে আর মনিকে আসতে না দেখে আমি বাইরে এসে দেখি রতন মনিকে জোর করে ঠাকুর ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি রাগের চোটে ঠাকুরঘরে ঢুকেই পাশে নামানো একটা পেতলের কলসি দিয়ে রতনের মাথায় আঘাত করি। মারা মাত্রই সে পড়ে যায়। কিন্তু বিশ্বাস করুন…আমি বুঝতে পারিনি যে সে মারা যাবে!”

আমার চোখ একবার ত্রিলোচনবাবুর দিকে পড়তেই দেখি তিনি পাথরের মত বসে আছেন। আস্তে আস্তে তিনি বললেন, “রতন..এতটা নিচে নেমে গিয়েছিল! ও মনিকে…ছিঃ ছিঃ!” তারপর হাতজোড় করে বললেন, “অনুপ, মনি… তোমরা আমাকে ক্ষমা করো! আমার জন্যেই তোমাদের এত দুর্ভোগ হল। রতন মারা যাওয়াতে আমার আর এতটুকু আফসোস নেই।”

এইসময় মিঃ মজুমদার উঠে দাড়িয়ে বললেন, “কিন্তু পুলিশ একজন খুনের অপরাধীকে তো এত সহজে ছেড়ে দিতে পারে না!”

ত্রিলোচনবাবু বললেন, “স্যার, আপনি আপনার ডিউটি অবশ্যই করবেন। তবে আমিও আইনত উপায়ে অনুপকে ছাড়িয়ে আনব। সত্যিটা তো আপনি শুনলেন সব!”

ইন্সপেক্টর বললেন, “হ্যাঁ মিঃ চক্রবর্তী। তাই আমিও আপনাকে যথাসাধ্য চেষ্টা করব এই ব্যাপারে।”

এইসময় স্বাধীনবাবু বললেন, “কিন্তু একটা ব্যাপার এখনও পরিষ্কার হল না তো!”

শঙ্কর এতক্ষন চুপ করে সবার কথা শুনছিল একটা সিগারেট ধরিয়ে। স্বাধীনবাবুর কথায় বলল, “ঠিক ধরেছেন। রতনকে যে এই কাজে ঢুকিয়েছিল সে এই বাড়িরই একজন!”, তারপর ত্রিলোচনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ত্রিলোচনবাবু, রতনকে আপনার বাড়ির কাজে কে ঢুকিয়েছিল মনে আছে কি?”

তিনি সহসা বললেন, “হ্যাঁ, ওকে তো রথীন দেখে দিয়েছিল। রতন নাকি আগে ওর এক বন্ধুর বাড়িতে কাজ করত!”

এবার সবার চোখ রথীনবাবুর দিকে পড়তেই দেখলাম উনি একজন চোট খাওয়া নেকড়ের মত শঙ্করের দিকে তাকিয়ে আছেন।

শঙ্কর বলল,” রথীনবাবু আপনার প্ল্যানটা সফল হয়েই যেত যদি না শেষ মুহূর্তে আপনি একটা ভুল চাল চালাতেন! আমাকে গাড়ি চাপা দিয়ে মারার জন্য লোক পাঠাতে গিয়ে আপনি গাড়ির নম্বর প্লেটটা গোপন করাতেই ভুলে গিয়েছিলেন। এইরকম একটা সিলি মিসটেক আপনার ভাড়াটে গুন্ডারা করবে সেটা দেখে অবাক হই প্রথমে। সঠিক লোক ঠিক করার ক্ষেত্রে আপনার হাত খুব কাঁচা বলতে হয়।”

হঠাৎ রথীনবাবুর মুখ যেন চুপসে গেল।

শঙ্কর বলে চলল, “আপনি যে কোম্পানিতে কাজ করেন সেখানে খবর নিয়ে দেখেছি আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। বন্ধুর সাথে পার্টনারশিপ শেষ হওয়ার মুখে। তার উপর আবার আপনার জুয়ার নেশা আর বাবার সম্পত্তি থেকে বেদখল হওয়া। তাই একমাত্র উপায় ছিল আপনারই ঠিক করা চাকরকে উপরি লাভের লোভ দেখিয়ে তাকে দিয়ে এই কুকর্মটা করিয়ে নেওয়া। ঠিক বললাম তো?”

ত্রিলোচনবাবু তার বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “রথীন এসব কি শুনছি?”

এইসময় রথীনবাবু খেঁকিয়ে উঠে শঙ্করকে চিৎকার করে বলল, “how dare you! কতটুকু জানেন আপনি আমার সম্পর্কে! হ্যাঁ, আমি এই রতনকে এই কাজে পাঠিয়েছিলাম।” তারপর আবার ধপ করে সোফায় বসে গেলেন। শঙ্কর মিঃ মজুমদারকে চোখের ইশারা করতে উনি রথীনবাবুর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন।

চক্রবর্তী বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে শঙ্করকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আমার আর্টিকেলটার তাহলে কী হবে?”

“ত্রিলোচনবাবুর সাথে কথা হয়েছে। উনি এই ঝামেলাগুলো একটু মিটলে কয়েকদিনের মধ্যেই তোকে ডেকে পাঠাবেন বলেছেন।”

“যাক! নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।”

শঙ্কর তার মুখে একটা সিগারেট পুর দেখে তার কাছে দেশলাই নেই। আমরা আবার সেই দোকানির কাছে গেলাম।

শঙ্করকে দেখেই দোকানিটা বলল, “আপনার mystery solve হল?”

আমি আর শঙ্কর দুজনেই দুজনের দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকালাম।

লোকটা আবার বলল, “কী ভেবেছেন? ফেলুদা আমার favourite গোয়েন্দা মশাই!”

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post মুখোশের আড়ালে | বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | সায়নী ভট্টাচার্য | Bengali Detective Story
Next post বিষকন্যা আবার| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | দীপ্তেশ মাজী | Bengali Detective Story