Getting your Trinity Audio player ready...
|
গত দুই রাত্রি ঘুম হয়নি অমরেশ বাবুর, কিংবা বলা ভালো তিনি ইচ্ছা করেই জেগে ছিলেন। তবে আজ হয়ত তাকে ঘুমতেই হবে। অবশ্য তাঁর যে আজ ঘুমের প্রয়োজন শুধুমাত্র গত তিনদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য, তেমনটা কিন্তু নয়। আজ যে এক মাস পূর্ণ হতে চলেছে। অর্থাৎ, আজই হয়ত অমরেশ বাবুর স্বপ্নে আবারও আসবেন তাঁর আরাধ্য দেবতা স্বয়ং। ঠিক এক মাস আগে সেই দেবতাই যে বর প্রদান করেছিলেন তাঁকে, সেটি পেয়ে এই একমাস কেমন ভাবে দিন কাটিয়েছেন তিনি, সেইটা জানতেই আজ দেবতা আসবেন। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আজ অমরেশ বাবুর ঘুমনোর খুব দরকার।
অমরেশ মজুমদারকে একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালিই বলা যেতে পারে। গ্রামের এক হাই স্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষক তিনি। আরও বিশেষভাবে বললে, তিনি ফিজিক্স পড়ান উঁচু ক্লাসে এবং নিচু ক্লাসে ভৌত বিজ্ঞান। মা মারা গেছেন বেশ কিছু বছর হল। তাই বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে একার সংসার অমরেশ বাবুর। বয়স ৩৮ হলেও বিয়ে করেননি আর ভবিষ্যতেও করবেন না, এমনটা অনেক আগে থেকেই স্থির করে রেখেছেন। বিজ্ঞানের শিক্ষক হলে কি হবে, ঈশ্বরের প্রতি তাঁর প্রবল বিশ্বাস। অন্ধবিশ্বাসী তিনি নন, তবে তাঁর ধারণা ঈশ্বর হয়ত সেই মহাজাগতিক শক্তি যা এই সমগ্র বিশ্বকে চালনা করছে। সেই অসীম শক্তি হয়তো এখনও বিজ্ঞানের নাগালের বাইরে। তবে একদিন তার ব্যাখ্যাও হয়তো বিজ্ঞানীরা ঠিক খুঁজে ফেলবে। এমনিতে শান্ত, ধীর-স্থির প্রকৃতির মানুষ তিনি। কোনো রকম ঝামেলা, বিবাদ পছন্দ করেননা। ছাত্র, পড়াশোনা আর পূজা-পাঠ নিয়েই নিজের মতন করে থাকেন তিনি। কেবল কোনো ছাত্র তাঁর ক্লাসে পড়া না করে আসলে আর দুষ্টুমি করলে, তিনি খুব রেগে যান। রাজনীতি, খেলাধুলো, বিনোদন – এসব কিছুর ওপর দিয়ে ওই না তাকিয়ে হেঁটে চলে যান আর কি। তাঁর শুধু ভালো লাগে দেশ-বিদেশের নতুন আবিষ্কারের কথা জানতে আর অবশ্যই বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন বই পড়তে।
পড়ার টেবিলে বসে থাকতে থাকতে কখন যে চোখটা লেগে এসেছিল, তা বুঝতেই পারেননি অমরেশ বাবু। হঠাৎই যেন চারিপাশটা রঙিন আলোয় ভরে গিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন সেই দেবতা, যার পূজা পাঠে কখনও ত্রুটি রাখেন না তিনি। যেমনটা কথা দিয়েছিলেন, ঠিক সেই কথাই রাখলেন তাঁর দেবতা। ঠিক একমাস পর আজ আবার তিনি স্বপ্ন মাঝে এলেন – অমরেশ বাবুকে দেখতে, তাঁর খোঁজ নিতে। অমরেশ বাবু সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সেরে বলে উঠলেন “আপনি এসেছেন প্রভু। আমি জানতাম আপনি ঠিকই আসবেন। শেষ দুই রাত্রি না ঘুমিয়ে শুধু আপনার আগমনের অপেক্ষায় জেগে বসে আছি। আমি আর এ যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিনা প্রভু, আমায় মুক্তি দিন। আমি এই বর থেকে মুক্ত হতে চাই। আপনি দয়া করে ফিরিয়ে নিন আপনার বর।” দেবতা যেন একটু মনে মনে হাসলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন “কেন রে? তুই তো নিজেই আমার থেকে এই বর চেয়েছিলি। তবে আজ তা ফিরিয়ে নিতে কেন বলছিস? কি হয়েছে আমায় পরিষ্কার করে সব বল। একমাস আগের তোর সেই সুন্দর হাসিখুশি চেহারাটাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। চোখে মুখে কিরকম যেন একটা আতঙ্কের ছাপ। কিসের ভয়ে তুই এতটা গুটিয়ে আছিস? আগে সব কথা শুনি, বল আমায় কি হয়েছে।”
ঠিক এক মাস আগে, এরকমই একদিন অমরেশ বাবুর আরাধ্য দেবতা এসেছিলেন তাঁর স্বপ্নে। তিনি বলেছিলেন “অমরেশ তোর সেবা, যত্ন, নিষ্ঠা, বিশ্বাস – এসব কিছুই আমাকে বড়ই সন্তুষ্ট করেছে। বল তোর কি চাই? যা বলবি, সেই বর-ই আমি তোকে প্রদান করবো।” অমরেশ বাবু স্বপ্ন মাঝেও যেন নিজের পঞ্চ-ইন্দ্রিয়কে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি জানালেন “প্রভু আপনিতো জানেনই আমি ফিজিক্সের শিক্ষক। এতকাল ধরে টাইম ট্রাভেল নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছি। আমার এটাই স্বপ্ন যে টাইম মেশিনে চড়ে আমি ভবিষ্যতে যাব এবং আগামীকাল আমি কি করতে চলেছি বা আমার জীবনে কি ঘটতে চলেছে, সেটা জানতে চাই আগে থেকেই। কিন্তু জানি যে এখনও পর্যন্ত সেরকম কোন যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি। তাই আমার এ স্বপ্ন হয়ত কোন কালেই বাস্তব হবেনা। কিন্তু আপনি কি আমায় এমন কোন বর দিতে পারেন, যাতে আমি একটি বারের জন্য হলেও, আমার ভবিষ্যৎ কে জানতে পারি।” দেবতা খানিক ভাবলেন তারপর তিনি অমরেশ বাবুর উদ্দেশ্যে বললেন “আমি যখন তোকে কথা দিয়েছি যে তুই যে বর চাইবি, আমি তাই তোকে দেব, তখন তোর এই ইচ্ছাটাও আমি নিশ্চয় পূরণ করবো। আমি এক মাস পর তোর কাছে আবার আসব। আমি জানতে আসব, এই বর-কে সঙ্গে নিয়ে তুই ঠিক কেমন ভাবে জীবন অতিবাহিত করছিস? তুই সুখী আছিস কিনা? কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা? – এইসব খোঁজ নিতে আমি ঠিক আসব। ভালো থাকিস অমরেশ, আমি আসলাম।” এই বলেই তাঁর আরাধ্য দেবতা আবার ওই রঙিন আলোর মধ্যে মিলিয়ে গেলেন।
সকালে ঘুম থেকে উঠে খাওয়া দাওয়া সেরে, প্রতিদিনের মতই স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন অমরেশ বাবু। গতকাল রাতের স্বপ্নের কথা তাঁর মনেও ছিলনা। আজ তাঁর বাড়ি থেকে বের হতে একটু দেরী হয়ে গেলো। তাই প্রতিদিন যে বাসে চড়ে উনি স্কুলে যান, আজ সেটা মিস হয়ে গেলো। অগত্যা পরের বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই তাঁর মনে হল, এইরকম ঘটনা আগেও তাঁর সাথে একবার ঘটেছে। অবশ্য এইরকম অনুভূতি আমাদের প্রত্যেকেরই মাঝে মধ্যে হয়ে থাকে। তাই এটা নিয়ে উনি আর মাথা ঘামালেন না। এরপর, অমরেশ বাবুর কাছে আজ খুচরো পয়সা না থাকায়, যেই মুহূর্তে ১০০ টাকার নোট-টা বাস-কন্ডাক্টরকে দিতে গেলেন, কেন জানিনা তাঁর আবারও সেই একই অনুভূতি জাগলো মনে। এরপর সেই দিনে ঘটে যাওয়া আরও বেশ কিছু ঘটনা যে গুলো সাধারণত অন্য দিনের থেকে আলাদা – সেগুলো যখন যখন ঘটতে থাকে, বারবার-ই অমরেশ বাবুর এটা মনে হতে থাকে যে এই ঘটনা তাঁর সাথে আগেও ঘটেছে। আচ্ছা একই দিনে কি কোনো মানুষের এতবার এরকম ফিলিং আসে? অথচ এর আগে তিনি যে কবে এই ঘটনাগুলির সাক্ষী হয়েছেন, কিছুতেই তা মনে করতে পারছিলেন না। বড় অস্বস্তি হচ্ছিল অমরেশ বাবুর। যাই হোক, এসব ভাবতে ভাবতেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন সেই দিন রাতে। পরের দিন স্কুলে গিয়েই সই করার সময় যখন তিনি দেখলেন আজ লাল কালির পেন-টা আনতে তিনি ভুলে গেছেন, তখন আবার তাঁর আগের দিনের মতই মনে হল যে এই ভুল তিনি আগেও করেছেন। আর ঠিক তারপর আচমকাই বিদ্যুৎ ঝলকানির মত যেন তাঁর মনে পরে গেলো গতকাল রাতে দেখা স্বপ্নের কথা। তিনি এবার একটু ভালো করে মনে করার চেষ্টা করলেন ঠিক কি কি দেখেছিলেন। খুব অদ্ভুত ভবেই তাঁর যেন সব কিছু মনে পড়তে শুরু করলো। এটা ছাড়াও অমরেশ বাবু দেখেছেন যে আজকে তিনি বেল পড়ার পরও, ক্লাস নিয়ে চলেছেন, বাড়ি ফেরার পথে বাসে তাঁর পাশে খুব মোটা এক ভদ্রলোক বসেছেন এবং রাতের বেলায় ঘরের রান্না করার মেয়েটা খুব ভালো রেঁধেছে মাংসের ঝোলটা ইত্যাদি। অদ্ভুত ভাবেই আজ তাঁর ক্লাস শেষ হওয়ার একটু আগে এমন একটা প্রবলেম করাচ্ছিলেন, যেটা বেল পড়ার পরও একটু বাকি থেকে যাই, তাই বাধ্য হয়েই তাকে এক্সট্রা আরও চার মিনিট ক্লাস নিতে হয়। রাতের সুস্বাদু মাংসের ঝোল খেয়ে, বিছানায় শরীরটা রেখে সব ঘটনা গুলো মেলাচ্ছিলেন। গতকাল রাতের স্বপ্নের সাথে আজ সারাদিনের কিছু বিশেষ ঘটনার হুবহু মিল খুঁজে পেলেন তিনি। অর্থাৎ, গতকাল যে ঘটনাগুলি তাঁর বারবার মনে হচ্ছিল যে আগেও ঘটেছে, সেগুলি আসলে তিনি, তার আগের দিন রাতের স্বপ্নে নিশ্চয় দেখেছিলেন। যদিও স্বপ্নটার কথা তাঁর আর কিছুই মনে নেই। এর মানে তাহলে এটাই দাঁড়ায় যে তিনি তাঁর আগামীকাল –কে স্বপ্নে দেখতে পাচ্ছেন আগের দিন রাতেই। অর্থাৎ, অমরেশ বাবু তাঁর ভবিষ্যৎ দেখতে সক্ষম। এইবার তাঁর হঠাৎই দুই দিন আগে দেখা স্বপ্নের কথা মনে এলো। তাঁর আরাধ্য দেবতা স্বপ্নে এসে তাঁকে বর প্রদান করেছিলেন এক মাসের জন্য। তার মানে, এই ভাবেই প্রতিদিন তাঁর জীবনে কি হতে চলেছে, সেটা তিনি জেনেই ঘুম থেকে উঠবেন। মনটা বেশ খুশি হয়ে উঠল অমরেশ বাবুর। তাঁর আরাধ্য দেবতাকে স্মরণ করে, চটজলদি গভীর নিদ্রায় মগ্ন হওয়ার প্রস্তুতি নিলেন তিনি।
এমন ভাবেই প্রথম সপ্তাহটা ভালোই কাটলো অমরেশ বাবুর। প্রতিদিনের বিশেষ কিছু ঘটনা যা অন্যান্য দিনের থেকে একটু আলাদা – সে সব তিনি আগের রাতের স্বপ্ন থেকেই জেনে যেতে থাকলেন এবং অলৌকিক ভাবেই ঠিক সেই সেই ঘটনা পরের দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাঁর জীবনে ঘটতে থাকলো। এর মধ্যে ভালো জিনিস যেমন দেখেছেন, খারাপও কিছু কিছু ব্যাপার এই প্রথম সপ্তাহের স্বপ্নেতেই ধরা পড়েছে। এই যেমন, উনি একদিন ৫০০ টাকার একটি নোট রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছেন, তাঁর এক বন্ধু এসে অনেক দিনের ধার নেওয়া টাকা ফেরত দিয়ে গেছে। আবার একদিন রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়েছেন, পড়া না করা এবং ক্লাসে বসে অন্যদের জ্বালাতন করার অপরাধে আবারও কৌশিক-কে লাঠির বাড়ি মেরে শাস্তি দিয়েছেন। এখানে বলে রাখা দরকার, কৌশিক হচ্ছে তাঁরই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, যে পড়াশোনা না করা এবং বদমায়েশি করার নিরিখে ক্লাসের মধ্যে অন্যতম।
অমরেশ বাবুর আরাধ্য দেবতা বললেন “তুই প্রথম সপ্তাহে তোর জীবনের ভালো – মন্দ সকল ঘটনাকে স্বপ্নে দেখেছিস এবং সেগুলিকে নিজের জীবনে তাদের ছন্দ মতই ঘটতে দিয়েছিস। অর্থাৎ, তুই তোর ভবিষ্যৎকে আগে থেকে সঠিক ভাবে জেনে গেলেও তাতে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করিসনি। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই তোর জীবন এগিয়েছে এবং তুইও তাতে সুখী থেকেছিস। কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতেই, তোর মাথায় এলো অদ্ভুত এক প্ল্যান। তুই মনে ভাবলি যে তোর ভবিষ্যৎ জেনে নেওয়ার ক্ষমতাটাকে অন্য ভাবে কাজে লাগাবি। সাধারণ নিয়মে জীবন চললে, যে কাজ গুলো করা তোর পক্ষে করা কঠিন হত বা সম্ভব ছিলনা, সেগুলো-কেই তুই এখন করতে পারবি তাদের ঘটবার নিশ্চয়তার কথা জেনে গিয়ে।”
অমরেশ বাবু মনে মনে ভাবলেন, তিনি ঠিক কি এমন কাজ করেছিলেন দ্বিতীয় সপ্তাহে। বেশ কয়েকটা ঘটনার কথা তাঁর মনে এলো। তিনি সেদিন ইচ্ছাকৃত ভাবে দেরী করে স্কুলে গিয়েছিলেন কারণ তিনি জানতেন প্রথম ক্লাসটা সেদিন তাঁকেই নিতে হত। যদিও সেটা অন্য কাউর নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেদিন সেই শিক্ষক কোনো কারণে স্কুলে আসতে পারবেন না, সেটা অমরেশ বাবু তো আগে থেকেই জানতেন। তারপর অন্য একদিন ঘরের কাজের মেয়েটা দেরী করে আসবে, আগে থেকেই জেনে যাওয়ায় তাকে ফোনে ধমক দিয়ে কথা বলেছিলেন। কিংবা, সেই কৌশিক বলে যে ছেলেটা – সেদিন তার জন্মদিন ছিল। তাই মনের খুশিতে ছেলেটা সেদিনের পড়াটা করে এসেছিল। অমরেশ বাবু স্বপ্নেতেই দেখে অবাক হয়েছিলেন যে তাঁর করা প্রশ্নের উত্তর সেদিন কৌশিক ঠিক ঠিক বলে দেবে। তাই ইচ্ছা করেই তিনি কঠিন একটি প্রশ্ন করেন এবং কৌশিক-কে আবারও শাস্তি দেন। অথবা ওই দিনের বাসের ঘটনা-টাই ধরা যাক। অমরেশ বাবু জানতেন একটি বাচ্চা ছেলে বাস থেকে নামার সময় ভিড়ের মধ্যে অসতর্ক ভাবেই তাঁর পায়ে পাড়া দিয়ে চলে যাবে। তিনি তাই সেদিন তক্কে তক্কে ছিলেন। যখনই তাঁর পায়ের ওপর বাচ্চাটির জুতোটা উঠে যায়, সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটা চিমটি কেটে দেন বাচ্চাটির হাতে। সে বেচারা ভিড়ের মধ্যে বুঝতেও পারেনা যে চিমটি-টা কে কাটলো। অর্থাৎ, দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি অনেকগুলো ভুলই করেছিলেন, যে গুলো স্বাভাবিক নিয়মে তাঁর জীবন চললে হওয়ার কথা ছিলনা। অমরেশ বাবু দেবতার উদ্দেশ্যে বললেন “হে প্রভু, আমায় ক্ষমা করবেন। আপনি ঠিকই বলেছেন, আমি আমার শক্তির অপব্যবহার করেছিলাম – যেটা করা আমার উচিত ছিলনা।” দেবতা বললেন “তুই ভেবেছিলি এই ভাবেই হয়তো ধীরে ধীরে তোর ভবিষ্যৎ পালটে দিতে পারবি। তোর জীবনে যা কিছু খারাপ হতে চলেছে, তাদেরকে তুই ভালোতে পরিবর্তিত করতে পারবি। কিন্তু তৃতীয় সপ্তাহ থেকে তোর সাথে কিছু অস্বাভাবিক জিনিস ঘটতে শুরু করলো, যেগুলো তুই কল্পনাও করতে পারিসনি। তুই কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলিনা যে এসব কিছু কেন এবং কিভাবে সম্ভব হচ্ছে। সাধারণ বুদ্ধিতে বিচার করা কঠিন হয়ে আসছিল। এতটা কোইন্সিডেন্স কি হতে পারে? কি আমি ঠিক বলছি তো?।”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন অমরেশ বাবু। একটি একটি করে সব ঘটনা গুলো তাঁর মাথায় ছবির মত ভেসে উঠতে লাগলো। তাঁর প্রথমেই মনে পরে গেলো পকেটমারির ঘটনাটা। না, সত্যি সত্যি তাঁর পকেটমারি হয়নি কারণ তিনি জানতেন সেদিন বাজারে যাওয়ার পর তাঁর সাথে এমনটাই হতে চলেছে। তাই তাঁর ওয়ালেট-টা সেদিন তিনি নিয়েই বের হননি। প্রয়োজন মত টাকা পকেটে রেখেছিলেন। কিন্তু সেদিন তিনি খেয়ালই করেননি যে তাঁর পকেটটা ছেঁড়া ছিল। ফলে সব টাকা পয়সা গুলো রাস্তায় কোথাও পরে যায়। তারপর সেই দিন তিনি তো জানতেন সাইকেলটা নিয়ে বের হলে ওটা পাঙ্কচার হয়ে যাবে। তাই হেঁটেই গিয়েছিলেন দোকানে। কিন্তু ফিরে এসে দেখলেন, তাঁর বাবার সম্মতি নিয়ে পাশের বাড়ির ছেলেটা একটা জরুরি কাজে তাঁর সাইকেলটা নিয়ে যায় এবং ফেরত আসে পাঞ্ছার সাইকেল নিয়ে। কিংবা ওই দিনের ঘটনাটাই বা ভোলেন কি করে? তিনি জানতেন তাঁর হাত থেকে আজ টিফিন বক্সটা পরে গিয়ে তাঁর নতুন শার্টটা নষ্ট হবে। তাই সেই ভয়ে তিনি টিফিন নিয়েই গেলেন না সেদিন। বাইরে থেকে খেয়ে যখন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছিলেন, তখনই উল্টো দিক থেকে ছুটে আসা কোনো দুরন্ত বাচ্চার সাথে ধাক্কা লাগে তাঁর এবং বাচ্চাটির হাতে থাকা টিফিন বক্সটা থেকে টিফিন বেড়িয়ে তাঁর শার্টে এসে পরে। নিজের ভাগ্যকে দোষ দেবেন নাকি বাচ্চাটিকে – কিছুই তখন বুঝতে পারছিলেন না অমরেশ বাবু। তৃতীয় সপ্তাহে এরকমই একের পর এক এমন সব ঘটনা তাঁর সাথে ঘটে চলেছিল, যা স্বাভাবিক বুদ্ধিতে কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। এরপর থেকে তাঁর মনে একটু একটু করে ভয় বাসা বাঁধতে শুরু করলো। অমরেশ বাবুর মনে হতে লাগলো, হয়তো এবার থেকে তাঁর সাথে শুধু খারাপ কিছুই হতে চলেছে এবং এই খারাপ ভবিষ্যৎ এতটাই নিশ্চিত যে তিনি চাইলেও সেটাকে বদলাতে পারবেন না। এই ভেবেই এক সাংঘাতিক মানসিক চাপ অনুভব করতে শুরু করেন। সেই কারণেই, তিনি আর চাইছিলেন না স্বপ্ন দেখতে। অথচ, প্রতিদিন তিনি যেন স্বপ্ন মাঝে শুধুই তাঁর ক্ষতিই দেখতে পাচ্ছেন। ঠিক তার পরের দিন গুলিতে, সেটাকে এড়াতে চেষ্টা করলেও, কোনো এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় সেগুলো তাঁর জীবনে ঘটতেই থাকে। এরপর অমরেশ বাবুর মনে হতে লাগলো, চতুর্থ অর্থাৎ শেষ সপ্তাহে হয়তো তাঁর জন্য আরও খারাপ কিছু অপেক্ষা করে আছে। তাই তিনি আর চাইছেন না তাঁর ভবিষ্যৎ দেখতে। যা কপালে আছে হোক। কিন্তু প্রতিদিন একটা আতঙ্ক কিংবা বিপদের আশঙ্কা নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া এবং আবার সকালে উঠে সেই সমস্ত নিশ্চিত অথচ খারাপ কিছুর ভবিষ্যৎ বানীকে সঙ্গে নিয়ে নিত্য দিনের কাজে মনোনিবেশ করা – এ যেন আর সহ্য করতে পারছিলেন না অমরেশ বাবু। ক্লাসেও ঠিক মত মনোনিবেশ করতে পারছিলেন না তিনি। কৌশিকের বদমাইশিতেও কেমন যেন উদাসীন, কাউর সাথে ঠিক করে কথাও বলছিলেন না তিনি। খাওয়া দাওয়া-টাও প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন এই শেষ কদিনে। চতুর্থ সপ্তাহ কবে শেষ হবে এবং তাঁর আরাধ্য দেবতা এসে তাঁকে এই বর কিংবা বলা ভালো অভিশাপ থেকে মুক্তি দেবেন – শুধুমাত্র এই চিন্তাতেই অমরেশ বাবু মগ্ন থাকতেন। চতুর্থ সপ্তাহের প্রথম চারদিনে যখন দুবার এক্সিডেন্ট হলো, তাঁর মনে যেন একটা ধারণা স্থায়ী ভাবে গেঁথে গেলো যে তাঁর মৃত্যুর দিন আসন্ন। এই সপ্তাহটাই হয়তো তাঁর জীবনের শেষ সপ্তাহ হতে চলেছে। যদিও দুর্ঘটনা বলতে একবার তিনি বাথরুমে পা পিছলে পরে গিয়ে কোমরে চোট পান, আর অন্যদিন রাস্তায় এক বাইক আরোহী ধাক্কা মারায় পরে গিয়ে হাতে জোড়ে চোট পান। কিন্তু এরপর তাঁর মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় যে আরও বড়ো কোনো ক্ষতি তাঁর জীবনে আসার অপেক্ষায় লুকিয়ে আছে, যারা ধরা দেবে তাঁর বাকি শেষ তিন রাতের স্বপ্নেতে। তাঁর জীবনটা যেন এখন ওই স্বপ্নের মাঝেই আবদ্ধ। তাঁর যেন নিজের কোনো রকম কন্ট্রোল নেই তাঁর দৈনন্দিন জীবন যাপনে, ওই প্রতি রাতের স্বপ্নই সেটার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। তাই অমরেশ বাবু ঠিক করলেন এই শেষ তিন রাত তিনি আর ঘুমবেন না। শেষ তিন রাত্রির প্রথম রাত তিনি সারাক্ষণ কাটালেন বই পড়ে। পরের দিন শুক্রবার, কোনো রকমে তাঁর ক্লাস শেষ করে, বাড়ি ফেরেন তিনি। শুক্রবারের পুরো দিনটার হিসেব করতে বসে দেখলেন আজ কিছু ভালো বা মন্দ – কোনোটাই হয়নি। যদি সেরকম কিছু ঘটনা হয়েও থাকে, যা অন্যান্য দিন গুলির থেকে আলাদা, তাহলেও সেটা অমরেশ বাবুর কিছুই মনে পড়েছে না। এমনিতেই গতকাল রাতে তিনি ঘুমোতে পারেননি একটুকো, তাই এসব নিয়ে আর বেশী ভেবে মাথাকে যন্ত্রণা দিতে চাইলেন না তিনি। তবে মনে মনে একটু খুশি হলেন এবং আশ্বাস পেলেন এই ভেবে যে, আজকের দিনটাও যদি উনি একটু কষ্ট করে জেগে থাকতে পারেন তাহলে হয়ত শনিবারের দিনটাও তাঁর এরকমই কাটবে। ভালোও চাইনা, আবার খারাপও না। তাছাড়া এমনিতে যখন আগামীকাল ছুটি আছে, তাই স্কুলে যাওয়ার ব্যাপার নেই। তাই শুক্রবার রাতটাও তিনি অনেক কষ্টে জেগে কাটিয়ে দিলেন। সারা রাত চোখে মুখে জল দিয়েছেন, গরম কড়া করে কফি খেয়েছেন, আর একটু বই পড়ে ও বাকিটা সময় পায়চারি করে কাটিয়ে দিলেন। শনিবার পুরো দিনটাই তিনি ঘরের থেকে বের হলেন না। এদিকে চোখ দুটো তিনি আর যেন মেলে রাখতে পারছেন না, মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। সে হোক, শুধু মাত্র আর একটা রাতই বাকি। যদিও আজ রাতে তাঁর দেবতা আসবেন নাকি আগামীকাল, তা তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। কোনো ভাবে দিনটা কাটিয়ে রাতে তাঁর পড়ার টেবিলে বসে এই সব চিন্তা করতে করতেই কখন যে চোখ দুটো লেগে এসেছিল, বুঝতেই পারেননি অমরেশ বাবু।
অমরেশ বাবু বললেন “প্রভু আপনি অন্তর্যামী। সবই জানেন, সবই বুঝতে পারছেন। শেষ কিছুদিন থেকে আমার মধ্যে মৃত্যু ভয় বাসা বেঁধেছে। আমার কেবলই মনে হতে থাকে, যদি আমি স্বপ্ন মাঝে আমার মৃত্যুকে দেখতে পাই, তাহলে কি হবে? তাই শেষ দুই রাত্রি আমি জেগে কাটিয়েছি। বাড়ির বাইরে বের হয়নি। সারাদিন নিজেকে বন্দি রেখেছি এই ঘরে। আমার কেবলই মনে হতে থাকে হয়তো ঘুমিয়ে পড়লেই স্বয়ং যমরাজ এসে দেখা দেবে স্বপ্নে। আর ঠিক পরের দিনটাই হবে আমার জীবনের শেষ দিন।” সব কথা শুনে আবার দেবতা প্রশ্ন করলেন “এত সব ঘটনার পর তোর উপলব্ধি কি অমরেশ? আগে আমি সেটা জানতে চাই।” অমরেশ বাবু উত্তরে জানালেন “এইরকম বর আপনার থেকে চাওয়া আমার উচিত হয়নি প্রভু। ভবিষ্যৎ দেখতে চাওয়ার স্বপ্নই আমার জীবনে কাল ডেকে এনেছে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন ছাড়াই আমি ভালো ছিলাম এক মাস আগে। আপনি আমায় দয়া করে রক্ষা করুন প্রভু। আমায় মুক্তি দিন এই যন্ত্রণা থেকে।” দেবতা হেসে বললেন “ভবিষ্যৎ জানার অধিকার এই পৃথিবীতে কোনো জীবেরই নেই। আর ভবিষ্যৎকে নিজের বশে করার মত নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার-তো স্বয়ং দেবতাদেরও অসাধ্য। মহিষাসুরকে দ্যাখ – এক অসীম শক্তির অধিকারী হয়েছিলেন তিনি ব্রহ্মার বরে। কিন্তু সেই শক্তির যখন তিনি অপব্যবহার করলেন, তাকেও বধ হতে হল। তোকে আমি ভবিষ্যৎ দেখার বর প্রদান করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু তাকে নিজের ইচ্ছে মত নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার তো দিইনি। আর তা সম্ভবও নয়। ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পর থেকে আমরা সকলেই সময়ের সাথে, তার তালে-ছন্দে এগিয়ে চলেছি। সময়ের হাতে মানুষ হোক কিংবা ঈশ্বর – সকলেই বন্দি। সময়ের আগে গিয়ে দেখতে চেয়েছিলি নিজেকে। তোদের ফিজিক্স হয়তো অঙ্কের মাধ্যমে সে পথে পারি দিতেই পারে। কিন্তু বাস্তব জগতে থেকে সময়ের আগে যাওয়ার মত বিদ্যা বা শক্তি কোনোটাই মানুষ এখনও অর্জন করতে পারেনি – পারা সম্ভবও নয়। তাই আমি তোকে ভার্চুয়াল জগত বা স্বপ্নের দুনিয়াতে সময়ের আগে যাওয়ার শক্তি প্রদান করি। কিন্তু তাকে শুধুমাত্র দেখাই যায়, তাকে বদলানো অসম্ভব। তাই তুই যখন সে চেষ্টাই করলি, তখন ভবিষ্যৎ তোকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। তোর যেটা নিয়তি, সেটা ঘটবেই। তাই অনেক রকম চেষ্টা করেও বাঁধা দিতে পারিসনি তোর নিশ্চিত ভবিষ্যৎকে। কোনো না কোনো ভাবে সেই ঘটনা গুলি ঘটেছে, যে গুলি তুই স্বপ্নে দেখেছিস। হয়তো ঘটনা গুলির স্থান, কাল আর পাত্র-এই তিনটি বিষয়ের ওপর তুই কিছুটা হস্তক্ষেপ করতে পেরেছিলি, কিন্তু তার ফলাফলটা একই ছিল। তাই ভবিষ্যৎও তোর সাথে এমন ভাবেই খেলা শুরু করলো যাতে তুই এটা বিশ্বাস করতে বাধ্য হোস যে, তুই শত চেষ্টা করেও তোর আগামী কালকে বদলাতে পারবি না শুধু মাত্র গতকালের স্বপ্নের ভিত্তিতে। আশা করি তুই বুঝতে পেরেছিস যে আমি কি বলতে চাইলাম এতক্ষণ ধরে। আর যে শিক্ষা তুই এই এক মাসে পেলি, তা নিজেও যেমন সারা জীবন মনে রাখবি, ঠিক তেমনই তোর ছাত্রদেরও শেখাবি। তোর ইচ্ছা অনুযায়ী আমি ফিরিয়ে নিলাম আমার দেওয়া বর। আজ তুই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যা। আমি তাহলে এখন বিদায় নিলাম। মঙ্গল হোক তোর।” এই বলেই অমরেশ বাবুর আরাধ্য দেবতা সেই রঙিন আলোর মধ্যেই আবার হারিয়ে গেলেন। সেই রাতে গভীর ঘুমিয়েছিলেন তিনি। যেন কত মাস কেটে গেছে, তিনি ভালো করে ঘুমোতে পারেননি। সোমবার খুশী মনেই পুরো দিনটা কাটিয়ে ফেললেন অমরেশ বাবু। মনে রাখার মত কিছু ঘটে থাকলেও, তিনি আর সেসব নিয়ে রাতে ভাবলেন না ঘুমোতে যাওয়ার আগে। মঙ্গল বার ভোরে তার ঘুমটা ভাঙ্গার পরই আবার এক আতঙ্ক ছেয়ে গেলো তাঁর সারা শরীরে। তিনি একি দেখলেন তাঁর স্বপ্নে? স্কুলের সামনে বাস থেকে নেমে রাস্তার উল্টো দিকে হাঁটা দিয়েছেন। আর আচমকাই বিশাল গতিতে ছুটে আসা একটা বাস এসে তাঁকে ধাক্কা মেরে চলে গেলো। এরপর আর কিছু দেখতে পাননি তিনি। কারণ সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ঘুমটা ভেঙে যায়। তারপর কিছুক্ষণ বসে থেকে মনের ভয়টাকে কাটানোর চেষ্টা করলেন এবং নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন এই ভেবে যে মানুষ সাধারণত যেটা বেশী মাত্রায় ভাবে, সেটাই সে স্বপ্ন মাঝে দেখতে পায় হয়তো। তাই এতদিন ধরে এই যে তিনি নিজের মৃত্যুর আশঙ্কাতে ভুগছিলেন, তাই হয়তো এমন এক স্বপ্ন আজ ভোরে দেখলেন। একদিন আগেই তো তাঁর আরাধ্য দেবতা এসে এই সকল মায়াজাল থেকে তাঁকে মুক্ত করে দিয়ে গেছেন। তাই আজকের স্বপ্নটা নেহাতই স্বাভাবিক নিয়মে তাঁর ঘুমের মধ্যে এসেছে। এইসব ভেবে, অমরেশ বাবু অনেকটাই শান্ত করলেন নিজের মনকে। রোজকার মতই আবার তিনি বেড়িয়ে পড়লেন স্কুলের উদ্দেশ্যে। স্কুলের স্টপেজ আসার পর বাস থেকে নেমে, কেনো জানিনা তাঁর আর রাস্তা পার হওয়ার সাহস হচ্ছেনা। কেবলই মনের মাঝে ভোরের স্বপ্নটা চলে আসছে। তিনি মনকে শক্ত করে পথটা পেরোনোর জন্য হাঁটতে শুরু করলেন। এমন সময় হঠাৎই একটা জোড়ে হর্ন শুনতে পেয়ে তাকালেন তাঁর ডান দিকে। আর তৎক্ষণাৎ অমরেশ বাবু দেখলেন, দ্রুত গতিতে একটি বাস তাঁর দিকেই যেন ধেয়ে আসছে। তাঁর হৃদয় যেন মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে এলো। তাঁর জীবন আর মৃত্যুর মধ্যিখানের দূরত্ব হয়তো আর কয়েকশো মিটারের যা অতিক্রান্ত করতে হয়তো কয়েক সেকেন্ডের বেশী সময় লাগবে না। তাঁর যে ঠিক কি করা উচিত, কোন দিকে যাওয়া উচিত, কিছুই ভেবে উঠতে পারছেন না তিনি। তাঁর সমগ্র শরীর যেন অসাড় হয়ে পড়ছে। চাইলেও তিনি যেন আর নড়তে পারছেন না রাস্তা থেকে। তাঁর দিকে ছুটে আসা মৃত্যুকে তিনি আর চোখ দুখানি খুলে দেখার মত সাহস জোগাতে পারলেন না। এটাই হয়তো তাঁর নিয়তি, এটাই তাঁর নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তিনি চাইলেও সেটাকে বদলাতে পারবেন না। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ দুটি বুজে ফেললেন অমরেশ বাবু। আচমকাই বিদ্যুতের ঝলকানির মতই তাঁর ডান হাতটা ধরে কেউ একজন সজোরে টেনে আনতেই, রাস্তার ধারে ছিটকে এসে পড়লেন তিনি। তারপর আস্তে আস্তে চোখ খুলে বুঝতে পারলেন যে তিনি এখনও বেঁচে আছেন। এ দৃশ্য এখনও যেন তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না। এরপরই তাঁর মনে এলো একটাই প্রশ্ন – তাঁকে আজ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচালো কে? কে সেই ব্যক্তি, যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে হলেও আজ তাঁকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। অপর দিক থেকে সেই রক্ষাকর্তার প্রশ্ন এলো তাঁর কাছে “স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো?” চমকে উঠলেন যেন অমরেশ বাবু, কারণ গলার স্বরটা তাঁর খুবই চেনা। যতটা অবাক তিনি হয়েছেন নিজেকে এখনও জীবিত দেখে, তার চেয়েও বেশী অবাক হলেন যখন দেখলেন আজ তাঁর প্রাণ বাঁচালো তাঁরই সব থেকে অপ্রিয় ছাত্রটি – কৌশিক, যাকে আজও ক্লাসে গিয়ে হয়তো শাস্তি দেবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন অমরেশ বাবু।