Getting your Trinity Audio player ready...
|
গ্রামের নাম ইছাপুর। সবুজ ঘেরা গ্রামের উত্তর দিকে কুলু কুলু শব্দে চলেছে রূপরেখা নদী। কোথায় যে মিশে গেছে এই চঞ্চলা কেউ জানে না। গ্রীষ্মের দুপুরে নদীর ধারে বসে কাঁচা আম লবণ দিয়ে মেখে – আহা যেনো অমৃত। গুটিকতক ঘর গ্রামে, প্রায় বেশিরভাগ ঘর মাটির, কিন্তু কারুর টিনের চাল আবার কারুর খড়ের ছাউনী। গ্রামের শেষ প্রান্তে আছে একটা প্রাইমারি ও একটা হাই স্কুল আর এক প্রান্তে আছে একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। হিরন্ময় ওই গ্রামেরই বাসিন্দা, পড়াশুনা ও ব্যাবহারে খুব ভালো হওয়ার সুবাদে গ্রামের সবাই হিরন্ময় মানে হিরুকে একডাকে চেনে। হিরন্ময় গ্রামের ওই তিরুপতি মুকুন্দরাম শিক্ষা নিকেতন- এর একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়েও ভালো স্কুলে ভর্তি হলো না দুটি কারণে – প্রথমত, ভালো স্কুল বলতে প্রায় ৫ কিমি রাস্তা পেরিয়ে শহরে যেতে হবে আর অনেক খরচের ব্যাপার। গরীবের পক্ষে এত খরচ বহন করা একটু কষ্টকর, আর দ্বিতীয়ত বাবা ছোটো বেলাতে মারা যাওয়ায় মাকে একা ফেলে নিজেও যেতে চায় না ওতো দূরের স্কুলে। তাই এই স্কুলেই থেকে গেলো। আর কয়েকদিন পর দুর্গাপূজা। তারই আগমনী বার্তা জানান দিচ্ছে নদীর ধারের কাশফুল। পুজোর কটা দিন গ্রামবাসীরা খুব আনন্দ করে। তারা সবাই মিলে সারাবছর ধরে একটু একটু করে জমিয়ে একসঙ্গে একটা দুর্গাপুজো করে গ্রামে।
– মা মা, মামাবাড়ি থেকে সবাই কবে আসবে? ছয় দিন পর থেকে তো স্কুল পুজোর ছুটি পড়ে যাবে। কার সঙ্গে যে খেলবো। তাড়াতাড়ি ডাকো না মামার ছেলেদের, একটু খেলবো (জিজ্ঞেস করে হিরন্ময়)
– আসবে ঠিক সময়। পুজো এখন আসুক।
হিরন্ময় এর এক মামা, তাদের দুই ছেলে। দুজনের হিরন্ময় এর মতই একাদশ শ্রেণীতে পড়ে। ওরা তিন ভাই একসঙ্গে হয় এই পুজোর সময়ে। কি আনন্দ করে তিনজন মিলে এই পুজোতে!
– কি মজা, কি মজা, মামা আসবে।
নাচতে নাচতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো হিরন্ময়।
– পাগল একটা
বলে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে হিরুর মা।
(২)
আজ ইছাপুর আনন্দে মুখরিত। কাশফুলের দোলায়, গানের সমারোহে আজ মহাষষ্ঠি। হিরন্ময় তার মামার দুই ছেলে কুন্তল ও অনুপমকে নিয়ে আনন্দে মশগুল। মামা মামী গল্প করছে অপরূপা দেবী মানে হিরন্ময় এর মায়ের সঙ্গে। অনেকদিন পর তিন ভাই একসাথে হয়ে সে কি আনন্দ তাদের। তার সঙ্গে তো খাওয়া দাওয়া আছেই।
এইভাবে একসঙ্গে ষষ্ঠি, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী বেশ ভালোভাবেই কাটলো কিন্তু ……….. দশমীর দিন সন্ধ্যাবেলা গ্রামের উত্তর দিক থেকে একটা আর্তনাদ ভেসে আসে। মাইকের বিসর্জনের গানকেও যেনো ছাপিয়ে গেলো সেই তীব্র আর্তনাদ। হয়তো অনেকেই শুনেছে, কেউ তেমন পাত্তা দেইনি। কিন্তু সেই আর্তনাদের মতো ভয়ংকর চীৎকার শুনে একটু ভয় আর একটু খটকা লাগলো হিরন্ময়, কুন্তল ও অনুপমের।
– কি ব্যাপার বল তো, এমন চীৎকার তো কোথাও শুনিনি তাও এই গ্রামে (কুন্তল বললো)
অনুপম বললো – হ্যাঁ রে হিরু, তোদের এখানে আবার ভুত তুথ
– না না, আমাদের গ্রামে ভুত। এটা হয় নাকি। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা, আর্তনাদটা কার – কোনো মানুষ, পশু নাকি তোদের কথায় ভুত। যাই হোক কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আজকের বিসর্জন অনুষ্ঠান ভালোভাবে হয়ে যাক। তারপর দেখা যাবে।
তারপর যে যার নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।
(৩)
– মা, কুন্তল আর অনুপম এখানে কতদিন থাকবে গো।
– কি জানি, ওদের কেই জিজ্ঞেস কর না। গতকাল তো বিসর্জন হয়ে গেছে। যতদিন ইচ্ছে থাকুক।
– হুমম, তাই তো বলছি। আরো কতদিন থেকে যেতে বলো নাগো মামাদের। খুব মজা হবে।
– সে ঠিক আছে, কিন্তু হিরু তোকে একটা কথা বলার ছিল।
– বলো মা
– গতকাল মানে দশমীর দিন সন্ধ্যাবেলা গ্রামের উত্তরদিকে থেকে একটা আর্তনাদের মতো চীৎকার শুনতে পেলাম
– (কথা ঘুরিয়ে) আর্তনাদ! ও কিছু না। পুজোর সময় কে ইয়ার্কি করে কি সব করছে।
– তাই হবে হয়তো। কিন্তু নদীর ধারে একটা পড়ো ছোটো বাড়ির মত আছে তো, যদিও বাড়িটা ভগ্নপ্রায়। ওখানে যদি কেউ …..
বিদ্যুৎ খেলে গেলো যেনো হিরন্ময় এর মনে।
– আরিব্বাস, এটা তো ভেবে দেখিনি। মনেও ছিল না যদিও – পোড়ো বাড়ি, ইন্টারেস্টিং (ভাবতে থাকে হিরন্ময়)
আজ একাদশীতে তিন ভাই মিলে অনেক অপেক্ষা করেও কিছু শব্দই শুনতে পেলো না তারা। তাই তারা মনে ভুল বলেই উড়িয়ে দিল ব্যাপারটা।
(৪)
আজ দ্বাদশী, তিনদিন পর পূর্ণিমা। সকাল থেকে আকাশ বেশ পরিস্কার। তিন ভাই মিলে সারা দুপুর খেলা করছে না ঘুমিয়ে। মায়ের শত বকাবকিতেও কে বা শোনে। এইভাবে হতে হতে বিকাল গড়িয়ে যায়। খেলা শেষ করে হাত পা ধুয়ে খাটের ওপর বসেছে সবাই। তখন সোয়া আটটা হবে, ঠিক এই সময় গ্রামের উত্তর দিক থেকে ভেসে আসে সেই বিকট আর্তনাদ। সেই বিভীষিকাময় চিৎকারে সবাই চমকে ওঠে, রীতিমত ভয় পেয়ে যায়। আগের দিন পুজোর গানের আয়োজনে ভালো শোনা না গেলেও আজকে সান্ধ্যকালীন নীরবতার মাঝে এই আর্তনাদ সবার শ্রুতিগোচর হওয়ারই কথা। অপরূপা দেবী তো ভয়ে কাঠ। তিন ভাই একটু ভয় পেলেও টিনেজার হওয়াতে ভয়ের থেকে অবাক হলো বেশি। তাদের মনে একটা কৌতূহল ও উৎসুক দানা বাঁধলো। মনে মনে হিরু ভাবলো যে করেই হোক, এই রহস্য ভেদ করতেই হবে।
রাতের খাওয়া দাওয়া করে যে যার দুগ্গা দুগ্গা বলে শুতে গেছে। তিন ভাই এক জায়গাতেই শোয়ে। কিছুতেই ঘুম আসছে না তাদের। রাত সাড়ে বারোটার দিকে হিরন্ময় বলে উঠল,
– এই কুন্তল, অনুপম ওঠ তাড়াতাড়ি। একটা কাজ করবি, যদি তোদের আপত্তি না থাকে
– কী কাজ আবার করবি এত রাতে? (একসঙ্গে বলে উঠলো)
– যাবি, ওই জায়গাতে, নদীর পাশে পোড়ো বাড়িতে। দেখতে চাই কিসের আর্তনাদ।
কুন্তল অবাক হয় বললো – তুই কি পাগল হয়ে গেলি। এই রাত্রে…, না হয় কাল সকালে
– না না কাল নয়, আজ চল। তোরা যাবি তো চল নাহলে আমি একা
– মাকে অন্তত বলে যাই (অনুপম বললো)
– পাগল নাকি। তবে ছাড়বে না। যা করার লুকিয়ে করতে হবে। আমরা নাকি টিনেজার। এই সময় রাতে অ্যাডভেঞ্চার মন্দ হবে না। ভয় লাগলেও যেতেই হবে এখুনি।
অগত্যা তিন ভাই চুপি চুপি বেরিয়ে পড়লো। তিনটে লাঠি, একটা হ্যারিকেন হাতে নিয়ে চলতে লাগলো উত্তর দিকে ওই পরিত্যাক্ত বাড়ির দিকে।
অবশেষে এসে পৌঁছালো নদী ধারের সেই বাড়িটার কাছে। নিঝুম রাতের গ্রামের রাস্তায় তিন ভাই। কাছাকাছি এসে একটু ভয় ভয় করতে লাগলো হিরন্ময়ের। তিনজন তিনটে লাঠি নিয়ে বাড়ির চারপাশে ঘুরতে লাগলো। এমন সময় হঠাৎ সেই গগনভেদী আর্তনাদ। ভয়ে আতঙ্কে তিনজনেই ও মাগো করে উঠলো। এত কাছ থেকে শুনবে বুঝতেও পারেনি তারা, সত্যি এই আর্তনাদটা এলো পোড়ো বাড়িটার ভিতর থেকে। ওরে বাবা মাগো বলে অনুপম দৌড় লাগলো, তার পেছন পেছন ছুটলো কুন্তল। আতঙ্কে হিরন্ময়ের হৃৎস্পন্দন বন্ধ হতে জায়োর জোগাড়। ছুটে পালাতেও পারছে না ভয়ে। অবশেষে সে মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে গেলো, কিন্তু অজ্ঞান হওয়ার আগে সে হ্যারিকেনের মৃদু আলোতে পোড়ো বাড়িটার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখতে পেলো দুটি হাত।
(৫)
খাটের ওপর শুয়ে আছে হিরন্ময়। পাশে বসে মাথায় হাত বোলাচ্ছে তার মা। ডাক্তারবাবু চেক আপ করছেন। অবশেষে আসতে আসতে জ্ঞান ফিরলো তার। চোখ খুলে সবাইকে দেখে উঠে বসতে গিয়েও মায়ের ধমকে আবার শুয়ে পড়লো। অরুণিমা দেবী বললেন,
– ভাগ্যিস কুন্তল আর অনুপম এসে খবর দিল। তাই আমরা সবাই ওই রাত্রে গিয়ে অচৈতন্য অবস্থায় তোকে নিয়ে এলাম ওখান থেকে। নাহলে যে কি হতো (কাঁদতে থাকে।)
– কিছু হবে না মা, এইতো আমি। কিন্তু
– কিন্তু কি?
– কিন্তু মা আমি অজ্ঞান হওয়ার আগে কয়েক মুহূর্তের জন্য বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম মানুষের মত দুটো হাত।
কথাটা শেষ হতে না হতে গ্রামের এক বাচ্চা ছেলে ছুটে ছুটে এসে বললো, – হিরু দা, হিরু দা আমি ওই পোড়ো বাড়িটার দিকে নদী ধারে মাছ ধরতে গিয়ে দেখি
– (কোনরকমে উঠে বসে হিরু বললো) কি দেখলি?
– দেখলাম দুটো মানুষের হাত। আর দেখলাম কেউ একজন বাড়িটার ভিতরে আছে। মনে হচ্ছে যেনো যন্ত্রণায় কেউ কষ্ট পাচ্ছে, ভিতরে কেউ আছে মনে হয়।
সবাই অবাক হয়ে যায়। এটা শুনে কোনরকমে জোর করে কারো বারণ না শুনে হিরন্ময়, বাড়ির বাকি সবাই ও পড়ার কিছু লোকজন ছুটে চলে ওই পড়ো বাড়িটার দিকে। গিয়ে তারা দেখে এক আশ্চর্য জিনিস। একটা মানুষ শুয়ে আছে পোড়ো বাড়িটার ভিতরে, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। গ্রামের একজন বললে, – আরে এতো কুষ্ঠ রোগী। এই রুগী আমাদের গ্রামে কি করে এলো। ডাক্তারবাবুও দেখে একই কথা বললো কুষ্ঠ রোগী বলে।
লোকটা সবাইকে দেখে আসতে আসতে বলতে লাগলো, ‘আমি পাশের গ্রামের, আমার তিনকুলে কেউ নেই, কিন্তু হঠাৎ আমার এই কুষ্ঠ রোগ হওয়াতে গ্রামের মানুষ জানতে পেরে গ্রাম থেকে মেরে বের করে দেয়। কোনো উপায় না পেতে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসি ও এই পরিত্যাক্ত বাড়িটা দেখতে পেয়ে ঢুকে পড়ি। সারা গায়ে এই রোগের জন্য মাঝে মাঝে তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হয়, এই অসহ্য যন্ত্রণাতে তাই মাঝে মাঝে আর্তনাদ করে উঠি। ভাবি যে কেউ এসে উদ্ধার করবে। কিন্তু কেউ আসেনি। গতকাল রাতে কারা যেনো এসেছিলো। হ্যারিকেনের আলোটা দেখে তার বাঁচার জন্য চীৎকার করে উঠি। কিন্তু সেটা শুনে যে ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।” এইসব কথা বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে গেল লোকটা।
গ্রামের কয়েকজন অবশেষে কুষ্ঠ রোগীকে উদ্ধার করে ভর্তি করতে নিয়ে যায় গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। লোকটাকে দেখে ও তার কথা শুনে চোখ ভিজে আসে হিরন্ময় এর। অস্ফুটে দুহাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে বলে ওঠে, ‘দুগ্গা দুগ্গা।’
পরিচিতি:-
আমি প্রিয়ব্রত দাস। বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত ময়না থানার অন্তর্গত তিলখোজা গ্রামে। জন্ম এই গ্রামেই ১৯৯৩ সালের ১৬ ই জুলাই। ছোটবেলা দশম শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামের হাইস্কুল এবং পরে উত্তর চংরাচক জগদীশ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করি। হলদিয়া গভঃ কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক পাশ করে পরে ময়না রামকৃষ্ণায়ন অ্যাসোসিয়েশন কলেজ থেকে বি.এড. করি। বর্তমানে খড়গপুর আই.আই.টি. সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে এক কোম্পানির অধীনে প্রজেক্টের কাজে কর্মরত। গ্রামে থাকার সুবাদে অনেক সামনে থেকে দেখেছি খোলা আকাশ, স্পর্শ করতে পেরেছি মাটি আর ভোরের শিশির। তাই হয়তো ছোটবেলা থেকেই গল্প কবিতা লিখতে ভালোবাসি, আর ভালোবাসি ছবি আঁকতে। স্কুলের দেওয়াল পত্রিকায় লেখা প্রকাশ আমার লেখার চাহিদাকে আরো উৎসাহিত করে তোলে। কিন্তু পড়াশোনা ও বিভিন্ন কাজের ব্যস্ততার জীবনে ঠিকভাবে সময় হয়না লেখার। তবুও এর মাঝে যতটুকু সময় পাই লিখতে বসে যাই। আমি খুব ভ্রমণ পিপাসু, তাই সুযোগ পেলে বেড়াতেও বেরিয়ে পড়ি। তারপর অনেকটা পথ অতিক্রম করে সময় পেলেই বসে পড়ি সাহিত্য চর্চায়। সাহিত্যকে ভালোবাসি, সংস্কৃতিকে ভালোবাসি। তাই আমার নিজস্ব সৃষ্টি আরো উপহার দিতে চাই পাঠকদের।