Getting your Trinity Audio player ready...
|
হঠাৎই পায়ের আওয়াজ শুনে সতর্ক হয়ে যায় সব্যসাচী। ও জানত, আজ রাতে কিছু একটা হবেই। জীবনের প্রথম তদন্ত হলে কী হবে, সে তো গোয়েন্দা গল্প পড়ে পড়ে শেখা শখের শিল্পী। হ্যাঁ, গোয়েন্দাগিরিটাকে আসলে শিল্প মনে করে সব্যসাচী। কোন সময় গোয়েন্দাদের কী করা উচিত, তার জানা। ছোটোবেলা থেকে আশপাশে ঘটে চলা ঘটনাগুলো গোগ্রাসে গিলে গিলে সব্যসাচীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টি তার মতোই চৌকস হয়ে গেছে।
সে জানে আজ আততায়ী আসবেই। সে সরাতে চায় তার পথের কাঁটাকে। সব্যসাচী নিঃশব্দে বিছানায় উঠে বসে। পবিত্র অঘোরে ঘুমোচ্ছে পাশে। পা টিপে টিপে অন্ধকারে মিশে খোলা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সে দেখতে পায়, একটা আবছায়া মূর্তি উঠোন পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকছে।
পুরোনো আমলের জমিদার বাড়ি। সামনের ডানদিকে দূর্গাদালান আর বাঁদিকে বিশাল উঠোন। বাড়িটা দোতলা। প্রতি তলায় পাশাপাশি চারটে করে ঘর। সব্যসাচী রয়েছে ওপরের তলায়।
ওপরের বারান্দা দিয়ে ঝুঁকে সে দেখল অবয়বটা সব্যসাচীর ঘরেরই নীচের ঘরে ঢুকল। অভিরামবাবুর ঘর। আর সময় নষ্ট করলে হবে না। ক্ষিপ্রতা অথচ সন্তর্পণে সব্যসাচী সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। সিঁড়ির শেষে আসতেই একটা ভারী বস্তুর পতনের শব্দ। দৌড়ে সেদিকে যেতেই সব্যসাচীর মাথায় এক আঘাত।
২
“সব্য, এ সব্য… ঠিক আছিস ভাই।” জ্ঞান ফেরার পর পবিত্রর আওয়াজে ঘোর কাটে সব্যসাচীর।
উঠে বসে সে। মাথাটা ফুলে গেছে বেশ। ঘাড়েও ভালোই যন্ত্রণা হচ্ছে। সবার দিকে ফিরে চায় সে। এই বাড়ির দুজন নেই এখানে।
“অভিরামবাবু আর নরহরিকাকা কোথায়?” সন্দেহের বশবর্তী হয়ে প্রশ্ন করে সব্যসাচী।
“নরহরিকাকা, অভিরামবাবুর ঘরে। তিনি তো ঘন ঘন মূর্ছা যা্চ্ছেন। আমরা তাই নরহরি কাকাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি ওঁর ঘরে। এখানকার স্থানীয় ডাক্তার ডক্টর মিত্র এসেছেন, দেখছেন ওঁকে।”
“মূর্ছা যাচ্ছেন, কেন? চল তো দেখি।” দু-হাত দিয়ে ঘাড়টা মালিশ করতে করতে বাকিদের সঙ্গে এগোলো সব্যসাচী।
৩
সব্যসাচী চ্যাটার্জি। বছর উনত্রিশের সো-কলড বেকার। সি.আই.ডি ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সবেমাত্র ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে। সিলেক্টেড লিস্ট বের হতে এখনও কতদিন বাকি? ওর জানা নেই। এইরকম বোরিং আর চিন্তাগ্রস্ত সময়ে যখন বাড়িতে সবসময় ঝামেলা, তখন হাজির হয় সব্যসাচীর কলেজের বন্ধু পবিত্র বোস।
“ভাই, চিনতে পারছিস তো?” ম্লান হেসে বলে পবিত্র।
ভালোই চিনেছে সে। কলেজের টপার পবিত্র। ওর মুখে গল্প শুনেছিল, পবিত্র্রর বয়স যখন পাঁচ, তখন ওর বাবা ওদের ফেলে কোথায় চলে যায়। মা, লোকের বাড়ি কাজ করে করে অনেক কষ্টে ওকে বড় করে তুলেছে। সেই পবিত্র প্রায় নয় বছর পর হাজির সব্যসাচীর বাড়ি।
“হ্যাঁ রে, তোকে চিনতে পারব না? কেমন আছিস বল?” একগাল হেসে বলল সব্যসাচী।
“এই চলে যাচ্ছে রে। তা তোর কি এখনও গোয়েন্দাগিরিতে ইনটারেস্ট আছে নাকি?”
“কেনো বল তো? ওই চলছে একটু-আধটু পড়াশোনা।”
“এটা দেখ।” বলে একটা খবরের কাগজের কাটিং এগিয়ে দেয় ওর দিকে।
কাটিংটা হাতে নেয় সব্যসাচী। একটা অদ্ভুত খবর, অনেকটা স্মরণসভা ধাঁচের, তাই সেটা ওই পেজেই স্থান পেয়েছে। খবরটা খানিকটা এরকম।
“গত ৫ই জুন তারিখে শ্যামপুকুরের বিখ্যাত ব্যবসায়ী গোবিন্দরাম বোস হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় আগামী ২০শে জুন একটি স্মরণসভা আয়োজন করা হয়েছে। সকলের উপস্থিতি কাম্য। এছাড়াও সবাইকে জ্ঞাত করা হচ্ছে, মৃত ব্যবসায়ীর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার নিকট আত্মীয়দের আসতে অনুরোধ করা হল। ওই সভাতেই উত্তরাধিকারী সম্পর্কিত ওঁর উইলটি সকলকে জানানো হবে।”
অবাক হয়ে সব্যসাচী বলল, “তা এই খবরের সঙ্গে আমার গোয়েন্দাগিরি বা তোর সম্পর্কটা কী? এনি হাউ… ইনি তোর রিলেটিভ নাকি?”
“ঠিক ধরেছিস। ইনি আমার ঠাকুরদাদা।”
“বলিস কি? এই বিখ্যাত ব্যবসায়ী…”
“মা এতদিন কেন জানায়নি আমি জানি না। হয়তো ওঁর আর বাবার ওপর অভিমানে।
সেদিন আমি খবরের কাগজে এই খবরটা পড়ে বললাম, ‘ইস, এই গোবিন্দরাম বোস যদি আমার আত্মীয় হত।’ মা শুনেই দৌড়ে এল। হাঁকুপাঁকু করে নামটা আরেকবার জিজ্ঞাসা করল। আমি বলতেই ওঁর চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেল। আলমারী খুলে ফাইলপত্র ঘেঁটে কয়েকটা ছবি বের করল। তারপর আমার সামনে সেগুলো ফেলে বলল, ‘ওই শ্যামপুকুরের গোবিন্দরাম বোস তোর নিজের ঠাকুরদা। এই ছবিগুলো নে, প্রমাণ কর নিজেকে। যেতে চাইলে যা, নিজের অধিকার বুঝে নিতে চাইলে নে।’
এই নে, এই যে ছবিগুলো।” বলে পবিত্র সব্যসাচীর দিকে বাড়িয়ে দেয় সেই ছবিগুলো।
তিনটে ছবি। দুটো সাদা-কালো, একটি রঙীন। প্রথম সাদা কালো ছবিটায় একজন বছর চল্লিশের ভদ্রলোক, আর বছর তিরিশের ভদ্রমহিলার সঙ্গে এক বারো-তেরো বছরের কিশোর। দ্বিতীয় ছবিতে একজন প্রৌঢ়ের সঙ্গে একজন যুবক। আর তৃতীয় রঙীন ছবিতে সেই যুবকের কোলে একটা বছর তিনেকে বাচ্চা আর তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে এক সুন্দরী যুবতী। সব্যসাচী দেখল সাদা-কালো ফ্যামিলি পিকচার আর রঙীন পারিবারিক ছবির ভদ্রলোক দুটির মুখের সাংঘাতিক মিল। শুধু রঙীন ছবির ভদ্রলোক যেন একটু বেশীই ফর্সা। আর সাদা-কালো ছবির লোকটার বাঁ গালে একটি বড় আঁচিল। এই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ভদ্রলোকই গোবিন্দরাম বোস, সব্যসাচী সবেমাত্র পবিত্রর দেওয়া খবরের কাগজেতে ওঁকে দেখেছে, তবে সত্তরোর্দ্ধ বৃদ্ধ অবস্থায়। এই যা পার্থক্য।
“তোর বাবা আর ঠাকুরদার মুখের তো অদ্ভুতরকম মিল।” অবাক হয়ে বলল সব্যসাচী।
“হুম। আমিও লক্ষ্য করেছি। কী বল তো ভাই, আমার কাছে বাবা বলতে তো এই ছবিগুলোই।” চোখটা জলে ভরে ওঠে পবিত্রর।
“তুই কী চাইছিস বল?”
“আমি চাই, তুই আমার সাথে শ্যামপুকুর চল। আমার সাথে থেকে প্রমাণ কর আমিই আসল উত্তরাধিকারী।” নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলে পবিত্র।
“আচ্ছা, একটা কথা বল। তোকে প্রমাণ করতে কেন হবে যে তুই উত্তরাধিকারি?”
– “দেখ। আমি তোর কাছে আসার আগে একজন উকিলের কাছে গেছিলাম। তিনি বললেন যেহেতু আমার বাবা-মা পালিয়ে গিয়ে মন্দির থেকে বিয়ে করেছিল, তাই বিয়ের কোনো প্রমাণ নেই। আমার সমস্ত সার্টিফিকেটে বাবার নাম সীতারাম বোস থাকলেও উনিই যে গোবিন্দরাম বোসের ছেলে তারও কোনো প্রমাণ নেই। আর বাবার কোনও ডকুমেন্টও মায়ের কাছে নেই বুঝলি। এখন এই অবস্থায় দুটো উপায়। এক, আমার বাবা নিজে এসে যদি আমার হয়ে সাক্ষ্য দেয়। যেটা ইম্পসিবল। আর দুই, আদালতে মামলা করা। কিন্তু সেক্ষেত্রেও জেতার চান্স কম। আর তাছাড়াও আমার এরকম ইচ্ছা নেই ভাই। নিজেকে কেমন লোভী লাগবে। যদি তুই অন্য কোনও ভাবে প্রমাণ করতে পারিস।”
“ঠিক আছে ভাই, আমি তোর সাথে যাব।”
নিজের টেনশান আর বাড়ির ঝামেলার কথা ভেবে রাজি হয়ে যায় সে। তারপরই সব্যসাচীর আসা এই শ্যামপুকুরে।
৪
“কী রকম দেখলেন ডাক্তারবাবু?” জিজ্ঞাসা করেন সৌগতবাবু। ইনি হলেন গোবিন্দরামের উকিল তথা কোম্পানির ম্যানেজার।
“ব্লাড প্রেসারটা একটু বেশী। কিছু জিনিস দেখে ভয় পেয়েছেন। কাল সকালে ঠিক হয়ে যাবে আশা করি। তাও একটা ই.সি.জি করে দেখে নিতে হবে। আর আজ এখন ওঁর সঙ্গে কেউ থাকবেন।”
সৌগতবাবু, নরহরি কাকাকে ডাক্তারবাবুকে এগিয়ে আসতে বলে সব্যসাচীর দিকে ফিরে বললেন, “তুমি তো নাকি গোয়েন্দা হতে চাও। আর নিজেই মাত খেলে?”
মুচকি হেসে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় সব্যসাচী।
ভদ্রলোকের কথাগুলোই এমন কাঠ কাঠ। কিন্তু তিনি বিচক্ষণ মানুষ। তেত্রিশ জন উত্তরাধিকারী হতে আসা ভুয়ো লোককে নিজেই তাড়িয়েছেন। এখন সম্পত্তি প্রাপকের তালিকায় মাত্র তিনজন। পবিত্র বোস, অভিরাম বোস আর বনবিহারী সরকার।
পবিত্রর পরিচয় আগে বলা হয়েছে। এবার বাকিদের কথা বলা যাক।
অভিরাম বোস নিঃসন্তান অকৃতদার ষাটোর্দ্ধ মানুষ। বেঁটে-খাটো মোটা চেহারা। মাথায় টাক। বেজায় পেটুক। এত বয়সেও কী করে পঞ্চব্যাঞ্জন হজম করে, কে জানে? সবাইকে হেয় জ্ঞান করতে ভালোই লাগে তার। কারণ এই অভিরামবাবুই একমাত্র যে কিনা প্রমানিতভাবে গোবিন্দরাম বাবুর খুড়তুতো ভাই।
বনবিহারী সরকার আবার অমায়িক সদাহাস্যময় এক ব্যক্তি। সবসময় তার মুখে জর্দা পান। এখনকার দিনেও পানের বাটা নিয়ে ঘুরে বেড়ান। তিনি ‘আশ্রয়’ নামক এক সংস্থার কর্ণধার। বিভিন্ন সামাজিক কাজ করে গরীব মানুষের পাশে সবসময় থাকে এই সংস্থা।
গোবিন্দরামবাবুর উইল অনুযায়ী তার মৃত্যুর পর তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা পাবে তার সবচেয়ে কাছের আত্মীয়। আর সেই আত্মীয়ের অবর্তমানে তা চলে যাবে ‘আশ্রয়’ সংস্থায়। আর এখানেই হয়েছে সমস্যা। গোবিন্দরামবাবুর ডায়েরি এবং তার বিভিন্ন বন্ধু-বান্ধবকে লেখা চিঠি অনুযায়ী তার একমাত্র ছেলে সীতারাম তেইশ বছর বয়সে মারা যায়। তাই সেদিক থেকে দেখতে গেলে পবিত্র মিথ্যাবাদী। যদিও সীতারাম বোসের মৃত্যু সংক্রান্ত কোনো নথি পাওয়া যায়নি। আর পবিত্রর মায়ের কথা অনুযায়ী, বাড়ির কাজের লোকের মেয়ের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িত হওয়া এবং পরবর্তীকালে তার সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার জন্য গোবিন্দরাম, তার একমাত্র সন্তান হওয়া সত্ত্বেও সীতারামের এই সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়নি। তাই ক্ষোভ আর অপমানে সীতারাম বাড়ি ছেড়ে চলে আসে। হতে পারে ছেলের থেকে পাওয়া এই আঘাতের জন্যই হয়তো গোবিন্দরামবাবু তার ছেলেকে মৃত বলে উল্লেখ করেছেন। তবে সেটা পুরোটাই প্রমাণ সাপেক্ষ।
স্মরণসভার শেষে বাছাইয়ের পর যখন পবিত্রকেও উত্তরাধিকারীদের মধ্যে রাখা হল, তখন অভিরামবাবু তো রেগে আগুন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, “এই ছোড়াদুটো ফ্রড। এরকম ছবি অনেক দেখেছি। এখন কতরকমের কারসাজি করা যায় ছবি নিয়ে।”
সৌগতবাবু বললেন, “আহ। অভিরামবাবু আপনি থামুন। ডি.এন.এ টেস্ট করে দেখাই যাক না, এরা সত্যি বলছে কিনা। এদের প্রমানটাও ফেলে দেবার মতো তো নয়। ওই ছবি তো স্যারেরই, আর এরকম সেম ছবি এ বাড়িতেও আছে। সীতারামকে তো আপনিও দেখেছেন। আর এই ছবি এডিটেড বলে আমার মনে হয় না।”
নাহ। সে ডি.এন.এ. টেস্ট করা যায়নি। কারণ যে বেসরকারী সেল ব্যাঙ্কে গোবিন্দরাম বাবুর ব্লাড স্পেসিমেন প্রিজার্ভ করা ছিল তা কোনোভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। সব্যসাচীর কথায় একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে পবিত্রকে বঞ্চিত করার। পবিত্রকে তাই কিছুদিন সময় দেওয়া হয়েছে তার বক্তব্যকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য। যদিও সেটা এখন অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। পবিত্র আরও কোনো উপায়ে তার সম্পর্ক প্রমাণ না করতে পারলে সব সম্পত্তি অভিরামবাবুকে দিয়ে দেওয়া হবে। সব্যসাচী তাই প্রাথমিকভাবে মনে করেছিল এই অভিরাম বোসই অপরাধী। কিন্তু আজ আবার অভিরামবাবুর ওপর কেউ আঘাত করতে এসেছিল। তাহলে আততায়ী কি অভিরামবাবুকেও সম্পত্তি দিতে রাজি নয়? মাথাটা গুলিয়ে যায় সব্যসাচীর।
“এই জর্দার গন্ধে আমার মাথাটা এমন ধরে যায়।” সিঁড়ি দিয়ে নিজেদের শোবার ঘরের দিকে উঠতে উঠতে বলে পবিত্র। ভাবনায় ছেদ পড়ে সব্যসাচীর।
‘জর্দার গন্ধ’ মাথা বিদ্যুতের মতো খেলে যায় সব্যসাচীর। যে লোকটি তার ওপর আজ আক্রমন করেছে তার কাছ থেকেও হালকা জর্দার গন্ধ পেয়েছে সে। তাহলে কি… সে বনবিহারীবাবু?
৫
“অভিরামবাবু, কাল কী হয়েছিল, একটু বলবেন?” দুপুরে খাবার টেবিলে সবার সামনে প্রশ্ন করল সব্যসাচী। সকাল থেকে দু-তিনবার সে চেষ্টা করেছিল প্রশ্নটা করার, কিন্তু লোকটা সারাদিনই বিছানায় এমনভাবে নেতিয়ে ছিল যে সব্যসাচী হাল ছেড়েই দিয়েছিল।
“তুমি ছোঁড়া নিজেও কাল ভূতের মার খেয়েছ একমাত্র সেইজন্যই তোমায় উত্তর দিচ্ছি।” মুখের গ্রাসটা শেষ করে বললেন অভিরাম বোস।
-”ভূত?” অবাক হয়ে বলে পবিত্র।
“হ্যাঁ। বড়দা এসেছিল কাল রাতে।” ভয়ার্ত কন্ঠে বলেন অভিরামবাবু।
“বলেন কি?” হাসিমুখে বলে সব্যসাচী।
“তা না হলে কী আর এমনি এমনি ভিরমি খেলুম নাকি?
রাতে ভালো ঘুম হয় না আমার অনেকদিন। সবে একটু তন্দ্রা এসেছে। দেখি দরজাটা খুলে গেল। আমি উঠে বসতেই সে আমার কাছে এগিয়ে এল। সেই এক চোখ-মুখ। ভয়ে বিছানার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দাদা বলল, ‘অভিরাম তোর কেউ নেই, তাও তোর এই সম্পত্তির লোভ কেন? আমি চাই ওই সংস্থায় যাক আমার সব টাকা। তুই এখান থেকে না গেলে তোকে মেরে ফেলব।’ আমি তো ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। উফ কোমরে যা লেগেছে।”
“তাহলে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আমি আপনার পড়ে যাওয়ার আওয়াজটাই পেয়েছিলাম। আচ্ছা অভিরামবাবু, আপনি অন্ধকার ঘরে কী করে বুঝলেন ওই ব্যক্তি আপনার দাদা গোবিন্দরামবাবুই?”
“অন্ধকার কোথায়? আমার ঘরে টেবিল ল্যাম্প জ্বলছিল। নেভানোর আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর দাদার সেই রঙ, সেই চেহারা, সেই পোশাক। আমি চিনব না? এমনকি আঁচিলটাও…”
কথাটা শুনেই সব্যসাচী উঠে দৌড় দিল। বাকিরা তিনজন তো অবাক। হঠাৎ সব্যসাচীর এই কান্ড দেখে নরহরির হাত কেঁপে খানিকটা মাছের ঝোল পড়ে গেল মাটিতে। এখন সৌগতবাবু আর বনবিহারীবাবু ভাগ্যিস নেই। নাহলে আবার সৌগতবাবুর টিপ্পনি শুনতে হত।
মিনিট পাঁচেক পর সে ওইভাবে ছুটে ঘরে ঢুকে এসে পুনরায় খেতে বসল। তারপর পবিত্রর দিকে তাকিয়ে বলল, “কাকিমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আমি আজই কলকাতায় যাব।”
“তুই তো ফোনে…”
“ফোনে হবে না ভাই। এক্সপ্রেশান অলসো কাউন্টস।”
৬
“কাকু চলে গেলেন কেন কাকিমা?” সব্যসাচীর এই প্রশ্নে হাত কেঁপে যায় মীনাদেবীর। “বসুন কাকিমা। কয়েকটা প্রশ্ন করতেই আজ আসা। আমাকে ছেলের বন্ধু হিসাবে না ভেবে পুলিশের লোক ভাবুন। বলুন।”
অনেকক্ষণ ইতস্তত করার পর তিনি বললেন, “ও লোকের সেবা করতে চাইত। কোনো কাজের ইচ্ছা ছিল না ওর। শুধু বিপদে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়াতে এক পায়ে খাড়া। এই নিয়েই বড়বাবু মানে আমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে ওর প্রায়ই ঝামেলা হত। তারপর আমাকে বিয়ে করল বড়বাবুর অমতে। উনি রেগে-মেগে তাড়িয়ে দিলেন আমাদের। আমার তিনকূলে কেউ নেই, মা বিধবা হবার পর পাকাপাকিভাবে ওই বাড়িতেই আমায় নিয়ে থাকত। তারপর মা মারা গেলেন। আমি ওখানেই কাজকর্ম করতাম। বড়বাবু তাড়িয়ে দিতে ও আমায় নিয়ে এক-কামরার এক বাড়িতে এল। পাড়া না বস্তিই বলা চলে। আমি অনেক বোঝালাম, কত বড় বাড়ির ছেলে হয়ে এখানে থাকতে ওরই কষ্ট হবে। খুব জেদী ছিল, যা করতে চাইবে তাই করতে দিতে হবে। আমায় বলেছিল, ‘মীনা, তুই কোনোদিন আমায় মানুষের সেবা করা থেকে আটকাবি না। যেদিন বাধা দিবি, আমি চলে যাব কিন্তু।’
কোনোদিন কিছু বলিনি জানো সব্যসাচী। মানুষটা সারাদিন বাইরে থাকত, কিন্তু এক পয়সা উপার্জন করত না। আমি লোকের বাড়ি কাজ করা ধরলাম। পাড়ার অনেক মেয়ে বউরাই করত। আমি ছেলেকে পাশের বাড়ি রেখে বা কোনোদিন সাথে নিয়েই কাজে যেতাম। মনে হত, বড়বাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়াই, বলি আমাদের কথা নয় নাই ভাবো অন্তত নাতিটাকে বাঁচাও। দু-বেলা খাবার জন্য মুদি দোকানে ধার করতাম। কিন্তু মানুষটা নির্বিকার।
সব মুখ বুঝে মেনে নিচ্ছিলাম। কিন্তু সেদিন আমার খুব জ্বর। মাথা তুলতে পারছি না। ওকে ছেলের জন্য দুধ আনতে বললাম। নিজের ছেলের দুধ কেনার পয়সা সেদিন ও অন্য লোককে দিয়ে এল। রাগ ধরে রাখতে পারিনি। ওর ওই জনসেবা নিয়ে যা মুখে এল বললাম। পরদিন সকালে উঠে দেখলাম সে নেই। জ্বরের ওষুধ খেয়েছিলাম বলেই টের পাইনি। ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে চিঠি রেখে চলে গেল সে।”
“কী লেখা ছিল চিঠিতে?”
“যেদিন মাসমাইনের লোকসেবা করতে পারব সেদিন আবার আসব।”
“আচ্ছা, চলি কাকিমা। আমার আরও কয়েকটা কাজ আছে।”
৭
“তুই কোথায় রে?” চিন্তান্বিত কন্ঠে বলল পবিত্র। রাত নটা বাজতেও যখন সে দেখল তার গোয়েন্দা বন্ধুর গোয়েন্দাগিরি শেষ হয়নি তখন সে ফোন করল সব্যসাচীকে।
“আমি এখন বাড়িতে রে। কাল বিকেলে শ্যামপুকুর যাব। সকালে কিছু কাজ আছে। তুই আমার হয়ে সৌগতবাবুকে বলিস যে, উনি আর বনবিহারীবাবু যেন কাল বিকেলে উপস্থিত থাকে।”
“আচ্ছা। কিন্তু কেন?”
“তোকে যা করতে বলছি কর। টা টা।”
পবিত্র বন্ধুর এরূপ ব্যবহারে মনক্ষুন্ন হয়ে পড়ল। ও যে কী করছে বা করতে চাইছে কিছুই বুঝতে পারছে না পবিত্র।
৮
“কই হে পবিত্র? তোমার বন্ধুর অপেক্ষায় তো বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে হয়ে রাত হতে চলল।” কটাক্ষ করে বললেন উকিল সৌগত সাহা।
“নরহরি, আরও একবার চা কর।” হাঁক পাড়লেন অভিরামবাবু। দুবার পকোড়া সহযোগে চা খেয়েও তার তৃপ্তি হয়নি। সম্পত্তির মালিকানা ইনি পেলে নির্ঘাত খেয়েই শেষ করে দেবে, ভাবে পবিত্র।
অভদ্রভাবে একটা ঢেঁকুর তুলে অভিরামবাবু বললেন, “আমি তো আগেই বলেছিলাম ভায়া। এ ছোঁড়া দুটো ফ্রড। একজন আবার গোয়েন….”
কথাটা মুখেই আটকে যায় অভিরামবাবুর। সব্যসাচী ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল। সামনের ফাঁকা সোফায় ধপাস করে বসে বলল, “পবিত্র, একটু জল দে ভাই।”
পবিত্র উঠতেই দেখল নরহরিকাকা জল নিয়ে ততক্ষণে হাজির। সামান্য হেসে এক নিঃশ্বাসে পুরো গ্লাসের জলকে শেষ করে সবাইকে একবার দেখে নিয়ে সব্যসাচী বলল, “অসিতবাবু আমাকে একটা প্লেন পান সেজে দিন তো।”
“অবশ্যই সব্যসাচী। দিচ্ছি, একমিনিট।” একমনে নিজের পান সাজতে সাজতে উত্তর দিলেন বনবিহারীবাবু।
ঘরের মধ্যে যেন একটা নীরব উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। বনবিহারীবাবু বা অসিতবাবু ঘামে ভিজে একসার হয়ে গেলেন। সবার মুখের দিকে কোলাব্যাঙের মতো কুঁতকুঁতে চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন।
“আপনার নাম অসিত নস্কর। তো?”
ক্লাসের বিনয়ীর স্টুডেন্টদের মতো ঘাড় কাত করলেন তিনি।
“কিন্তু সব্যসাচী, ইনিই তো বনবিহারী সরকার পরিচয়ে সেই গোবিন্দরাম বাবুর সময় থেকে এখানে আসেন। ‘আশ্রয়’ সংস্থার হেড হিসাবে সমস্ত অফিসিয়াল কাজও করেন। আমি নিজে গিয়ে ওদের সংস্থা দেখে এসেছি, ভেরিফাই করেছি।” চরম বিস্ময়ে বললেন সৌগতবাবু।
অভিরামবাবুর জন্য দিয়ে যাওয়া পকোড়ার থালা থেকে একটা মুখে পুড়ে সব্যসাচী বলল, “অসিতবাবু, আপনিই বলুন না।”
অসিতবাবু পড়া বলার মতো করে বলতে লাগলেন, “আমাদের বসের নাম বনবিহারী সরকার। কিন্তু তিনি কোনও এক বিশেষ কারণে এই বাড়িতে গোবিন্দরামবাবুর কাছে আসতেন না। তাই ওঁর পরিবর্তে আমিই এখানে আসতাম। আমি ওই সংস্থায় হিসাবরক্ষকের কাজ করি।”
“সেদিন আমার মাথায় একটু আস্তে মারতে পারতেন তো? অসিতবাবু।”
সব্যসাচীর কথায় চমকে ওঠে বাকিরা। সবাই অসিত নস্করের মুখের দিকে তাকায়।
“আমি আসলে সেদিন ঠিক বুঝতে পারিনি। কিছু মনে কোরো না তুমি। আমাকে স্যার বলেছিলেন সিঁড়িতে পাহারা দিতে। আমার হাতে এই পানের কৌটোটা ছিল। সামনে তুমি হঠাৎ চলে এলে, আমি ঘাবড়ে গিয়ে তোমায় আঘাত করে ফেললাম।”
সৌগতবাবু এবার বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনার বস আসল বনবিহারী সরকার কোথায়? কী চান তিনি?”
“নিজের জন্য কিছু চাই না কাকাবাবু।” দরজার সামনে উপস্থিত এক বছর পঞ্চান্নর সুদর্শন ব্যক্তি। এঁকে কিন্তু এখানকার সবাই অন্য নামে চেনে। সব্যসাচী আড়চোখে পবিত্রর দিকে তাকায়। তার দু-চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
“ভূউউউউউউত…” বলে প্রায় মূর্ছা যাচ্ছিলেন অভিরামবাবু।
“সীতারাম তুমি?” অবাক হয়ে বললেন সৌগতবাবু। সৌগতবাবুর কথা শুনে অভিরামবাবু খানিকটা নড়েচড়ে বসলেন। এনাকেও মিথ্যেবাদী প্রমাণ করবেন কিভাবে তাই হয়তো ভাবছেন তিনি।
ভদ্রলোক ম্লান হেসে বললেন, “হ্যাঁ। আমিই সীতারাম বোস ওরফে বনবিহারী সরকার। ভেবেছিলাম এই বাড়িতে কোনোদিন আর পা দেবো না। কিন্তু এই সব্যসাচী আমায় ধরে ফেলল। আসতেই হল আমাকে।”
“ব্রাভো সব্যসাচী। তুমি গোবিন্দরাম বোসের আসল উত্তরাধিকারীকে খুঁজে দিয়েছ।” পিঠে একটা ছোট্ট চাপড় মেরে বললেন সৌগতবাবু।
“ভাই চল। আমাদের আর এখানে থেকে কাজ নেই। সম্পত্তির মালিক এসে গেছে।” অভিমানী স্বরে পবিত্র সব্যসাচীকে উদ্দেশ্য করে বলল।
“আমার কথা শুনে আরেকটু বস।” সব্যসাচী অনুরোধ করে। তারপর সবার উদ্দেশ্যে বলল, “আপনাদের যার যা প্রশ্ন আছে করুন ওঁকে। উনি আমাকে কথা দিয়েছেন, আজ উনি সবার সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন।”
“তুমি এতদিন কোথায় ছিলে ছোটদাদাবাবু?” সবাইকে চমকে দিয়ে প্রশ্ন করল নরহরিকাকা। সে কখন ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে কেউই খেয়াল করেনি।
“মীনাকে বিয়ে করে এবাড়ি ছাড়ার পর কলকাতায় চলে যাই। একটা বড় রেলস্টেশনের পাশের বস্তিতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করি। তুই তো জানতিস নরহরি, আমি কেমন পাগল লোক। মীনাকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে আমার জন্য। আমার অন্য লোকের প্রতি ভালোবাসা, দরদ যেমন আমার বাবাকে কষ্ট দিত, তেমন আমার স্ত্রীও কষ্ট পেল। অভিমানে বাড়ি ছেড়ে এগোলাম অনির্দিষ্টের পথে।”
“এই ছেলেটি… পবিত্র… কি সত্যিই তোমার ছেলে?” প্রশ্ন করেন সৌগতবাবু।
“হ্যাঁ। ও আমারই ছেলে।”
রাগে অভিমানে জর্জরিত পবিত্র এবার ফুঁসে ওঠে। বলল, “আপনাকে বাবা বলে মানি না। পিতৃত্বের উপযোগী কোন কাজটা আপনি করেছেন? আমার পাঁচ বছর বয়সে আমায় ছেড়ে জনকল্যানের জন্য আপনি যেমন গেছেন, তেমনই থাকুন।”
সব্যসাচী পবিত্রর হাতটা চেপে বলল, “উনি চলে গিয়ে সত্যিই অন্যায় করেছিলেন। কিন্তু মাস চারেক পর ওই ‘আশ্রয়’ সংস্থায় চাকরি পেয়েই ছুটে আসেন তোদের নিতে। কিন্তু…”
সব্যসাচীর মুখের কথা কেড়ে সীতারামবাবু বললেন, “কিন্তু বস্তিতে গিয়ে দেখি সেটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমার পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল। কয়েকজন লোককে জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওখানকার সবাইকে স্থানীয় একটা স্কুলে রাখা হয়েছে পুনর্বাসন হওয়া অবধি। সেই স্কুলেও গেলাম। খুঁজলাম মীনাকে, তোমাকে। তোমাদের পাইনি। ওরা বলল কাউকে না পাওয়া গেলে তারা হয়তো বেঁচে নেই। কারণ অনেক মানুষ মারা গেছেন। দগ্ধ মৃতদেহ সনাক্ত করাও যায়নি। বস্তির যাদের চিনতাম, তারা বলল মীনাকে আগুন লাগার পর ওরা কেউ দেখেনি। আমার জগৎটা তোলপাড় হয়ে গেল। ফিরে গেলাম সেখানে, যেখানে তোমাদের নিয়ে সুখে থাকব ভেবেছিলাম।”
পবিত্রর মনে পড়ে মার কাছে শোনা গল্প। সেদিন কাজের বাড়িতে কী একটা পূজো ছিল বলে রাতে বাড়ি ফিরতে পারেননি মীনাদেবী। পরদিন সকালে খবরে দেখেছিলেন তাদের বস্তির আগুনের গ্রাসে চলা যাওয়ার দৃশ্য। ভয়ে আঁকড়ে ধরেছিল পবিত্র ওর মাকে। ভাগ্যিস ওরা রাতে বাড়ি যেতে পারেনি।
কেমন ঘোরের মধ্যে বলে চলেছেন সীতারাম বোস।
“নিজেকে উজাড় করে দিলাম সংস্থার কাজে। নিজের পরিচয় লুকাতে হয়েছিল। নাম রাখলাম বনবিহারী সরকার। কারণ আমার চেহারায় বাবার ছাপ মারাত্মক। এরপর মালিক মারা গেলেন। দেখলাম উনি উইলে আমায় তার সংস্থার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। সংস্থার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তাই বিভিন্ন ধনী ব্যক্তির কাছে সংস্থার জন্য অনুদান আনতে পাঠালাম। আমাকে অবাক করে বাবা দেখলাম অনেক টাকা দান করল। হয়তো শেষ বয়সে আমার ইচ্ছার কথা ওঁর মনে পড়ত। আমি এখানে অসিতকে বনবিহারী করে পাঠাতাম। আমার ভয় ছিল যদি বাবা আমায় চিনে ফেলে কী হবে? আমি তো ওঁর মৃত ছেলে। সবাইকে তিনি তো তাইই বলতেন।”
“তুই আমায় ভয় দেখাতে গেলি কেন সীতারাম?” কথায় স্রোত অবরুদ্ধ করে প্রশ্নটা ছুঁড়লেন অভিরামবাবু।
“আমি চেয়েছিলাম বাবার সম্পত্তি ওই সংস্থাতেই যাক। তুমি থাকলে অভিকা সেটা তো হত না। তাই মুখে-হাতে একটু কালি-ঝুলি মেখে আর একটা নকল আঁচিল করে চলে আসি সেদিন রাতে।”
“মিথ্যে মিথ্যে। তুই চেয়েছিলি তোর ওই ছেলে যেন সম্পত্তিটা পায়।”
এই প্রথম সীতারামের গলা একটু চড়ে যায়। তিনি বললেন, “ভুল। আমি চাইনি বাবার এই দু-নম্বরি করে রোজকার করা সম্পত্তি আমার পবিত্র পাক। তাই বাবার প্রিজার্ভ করা ব্লাড স্যাম্পেলটা আমিই টাকা দিয়ে নষ্ট করাই। যাতে ও প্রমাণ করতে না পারে ও বাবার উত্তরাধিকারী। কিন্তু সব্যসাচী সব ধরে ফেলল।”
এবার সব্যসাচী বলা শুরু করল, “স্মরণসভার দিন অনেকে প্রথম থেকেই কাঁদছিল। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একজন লোককে দেখলাম পবিত্রর হাতে ধরা ছবি আর ওকে দেখে কাঁদা শুরু করল। তখনই প্রথম সন্দেহ হল আমার। খুব চেনা লাগল ওঁকে। কারণ মেকাপ দিয়ে সব আড়াল করা গেলেও চোখদুটো আড়াল করা যায় না।
এরপর ব্লাড স্যাম্পেল নষ্ট হওয়া। তখন অবশ্য সন্দেহ করেছিলাম অভিরামবাবুকে। কারণ পবিত্র যে গোবিন্দরাম বাবুর নাতি, তা প্রমাণ করতে পারলে তিনিই বঞ্চিত হতেন। বনবিহারী ওরফে অসিতবাবুকেও প্রথমে সন্দেহ করি। কিন্তু উনি এত নিরীহ তাই পরে ওঁকে লিস্টের বাইরে রাখি।
এরপর সেদিন রাতে অভিরামবাবুকে ভয় দেখাবার ঘটনা। আততায়ী যে দুজন তা প্রথমে বুঝিনি। যখন আপনারা সবাই অভিরামবাবুকে নিয়ে ব্যস্ত। তখন উঠোনের পায়ের ছাপ দেখলাম। থ্যাঙ্কস টু দ্যা রেন। একজোড়া পায়ের ছাপ যেমন বাইরে থেকে এসেছে, তেমনই বাইরে চলে গেছে। আরেক জোড়া ছাপ যেন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আবার বাড়িতেই ফিরে এসেছে।
বাইরের এই আততায়ী ভদ্রলোক সৌগতবাবুও হতে পারতেন। কিন্তু ওঁর জুতো অন্যরকম। আর উনি ষাটোর্দ্ধ মানুষ। কিন্তু যে রাতে এসেছিল সে সৌগতবাবুর তুলনায় কম অশক্ত। কিন্তু ভেতরের আততায়ীকে ধরতে পারছিলাম না। সাহায্য করল পবিত্র। মনে পড়ল আমি জর্দা পানের গন্ধ পেয়েছিলাম। তাই আবার সন্দেহের তালিকায় বনবিহারীবাবু, উফ আই মিন অসিতবাবুকে রাখলাম।”
“লোকটা যে আমি বুঝলে কী করে? এটা তোমায় অফিসে জিজ্ঞাসা করা হয়নি।” কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করেন সীতারামবাবু।
“অসাবধানতাবশত আপনি এটা ফেলে গেছিলেন কাকু।” বলে জামার বুক পকেট থেকে একটা প্লাস্টিকের মোড়ক বের করে সব্যসাচী। বিস্মিত দৃষ্টিতে সবাই দেখে তার মধ্যে একটা ছোটো মাংসল টুকরো।
– “ও হো ওই ফলস আঁচিলটা?” হেসে বলেন সীতারামবাবু।
“হ্যাঁ। এটা পাবার পরই আমার সন্দেহ সত্যি হয় যে পবিত্রর বাবা এখানেই আছে, তিনিই স্বর্গত গোবিন্দরামবাবু সাথে তার মুখের অস্বাভাবিক মিলের সুযোগ নিয়ে অভিরামবাবুকে ভয় দেখিয়েছিলেন। কিন্তু কেন?
এই কারণ খুঁজতে গেলাম কাকিমার কাছে। তার কাছে সব কথা শুনে একটা হাইপোথিসিস মাথায় এল। নিরুদ্দেশ সীতারামবাবু পরোপকারী ছিলেন। তিনিই যদি গোবিন্দরাম বাবুর ছদ্মবেশে বাড়িতে এসে থাকেন, আর তার সাথে বনবিহারীবাবুর যোগসাজস থাকে। তবে নিঃসন্দেহে এই রহস্যের সমাধান হবে ‘আশ্রয়’ এর অফিসে গিয়ে।”
“আমি তো ভাবতেই পারিনি তুমি আমায় এভাবে ধরে ফেলবে?” স্মিত হেসে বললেন সীতারামবাবু।
“কী হল সেখানে?” কৌতুহলী পবিত্র জিজ্ঞাসা করে।
“কাকুতো হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন। যদিও অফিসের দুটো ঘর আছে। একটা সীতারামবাবুকে যারা চেনে তাদের জন্য আর একটা যারা চেনে না তাদের জন্য।”
“তাহলে ও তোমায় কী করে চিনল না হে ছোকরা?” এতক্ষণ পর অভিরামবাবু মুখ খুললেন।
“হামি তো সেখানে গরীব আদমি হয়ে গেছিলাম। কন্যাদায়গ্রস্থ এক পিতার ছদ্মবেশে। এই আঁচিলটাও কাজে লাগিয়েছি। হা হা হা। পবিত্র তোকে ছবিটা হোয়াটসঅ্যাপ করে দেবো। দেখে নিস ভাইয়ের ট্যালেন্ট। আর কারোর কোনো প্রশ্ন থাকলে করুন না হলে আমি শুতে চললুম।”
“শুতে যাবে মানে? এখনও তো উত্তরাধিকারী…” বলে ওঠেন সৌগতবাবু। কিন্তু তার কথা কেটে সীতারামবাবুর দিকে একবার তাকিয়ে পবিত্র বলল, “সৌগতবাবু, এই সম্পত্তি বাবার সংস্থা ওই ‘আশ্রয়’তেই যাবে। আপনি সেই মত পেপার তৈরী করুন।”
চোখের কোণটা ঠিক যেন চিকচিক করে উঠল সীতারাম বাবুর। তিনি উঠে এসে জড়িয়ে ধরলেন পবিত্রকে। দুজনেই একে অপরকে জড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করতে সবার অলক্ষ্যে সব্যসাচী বেরিয়ে আসে। কারণ সব্যসাচীর এসব পারিবারিক মিলন দেখার ইনটারেস্ট নেই, তার এখন খাওয়া আর ঘুম চাই।
রান্নাঘরে ঢুকে নরহরি কাকার করা চমৎকার মাংস ভাত নিজে বেড়ে খেয়ে যখন ও ওপরের ঘরে শুতে চলল তখনও বাকিদের গল্প শেষ হয়নি। পঁচিশ বছরের জমা গল্প।
বিছানায় গা এলিয়ে সব্যসাচী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাসে। সে তার প্রথম অভিযানে সফল। আজ সে গোবিন্দরাম বোসের প্রকৃত উত্তরাধিকারীকে খুঁজে দিয়েছে। সবে তো তার এই পথ চলা শুরু। এবার অপরাধীদের ধরার পালা।