কালচক্র| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | রাজশ্রী দত্ত| Bengali Detective Story
0 (0)

সূর্য পশ্চিমে অবস্থানের মায়া কাটিয়ে কিছুক্ষণ আগেই অস্তমিত হয়েছে। তবে এখনও পশ্চিমের আকাশ মেটে সিঁদুরের মতো রং মেখে বিকাল ও সন্ধ্যার সন্ধিক্ষণের মুহূর্তকে জানান দিচ্ছে। আর পূর্বের আকাশ একবারে কালো যবনিকায় ঢেকে গিয়েছে। একদল লোক ঢাক-ঢোল, কাঁসর–ঘণ্টা বাজিয়ে শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনি দিতে দিতে পুকুরঘাট থেকে উঠে, গ্রামের মেঠো সরু পথ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। তিন-চার জন মিলে কাঁধে করে চড়ক গাছটিকে নিয়ে হেঁটে আসছে আর বাকি সবাই সোল্লাসে চিৎকার করে বলছে, “বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগি, মহাদেব।” বাচ্চারা আনন্দে হৈ হৈ করছে। আসতে আসতে ভিড়টা ক্রমশ বাড়তে লাগল। একটা বড়ো মাঠের মাঝখানে, যেখানে একটা উঁচু টিলা বা মাটির ঢিবি মতো আছে, সেই স্থানটাকে সবাই ঘিরে দাঁড়াল। আর ওই তিন-চার জন লোক যাদের কাঁধে মহাদেবের প্রতীক স্বরূপ চড়ক গাছটি ছিল, সেই চড়ক গাছটিকে, পার্বতীর প্রতীক স্বরূপ সেই মাটির টিলার উপর প্রতিস্থাপন করল। সবাই একসাথে বলতে লাগল, “জয় শিব-দুর্গার জয়…” সামনেই মন্দির প্রাঙ্গণে পূজা হচ্ছে। চড়ক সন্ন্যাসীরা উঁচু গাছের মাথায় উঠে সেখানে থেকে নীচে ছুরি-কাঠারী, বঁটির উপর ঝাঁপ দিচ্ছে, কেউবা মাটিতে কাচ বিছিয়ে তার মধ্যে দিয়ে হাঁটছে, আবার কেউবা নিজের শরীরকে বঁড়শিতে বিদ্ধ করে গাছের উপর থেকে ঝুলে শূন্যে ঘুরপাক দিচ্ছে। নানাভাবে সন্ন্যাসীরা স্বেচ্ছায় শিব আরাধনার কঠোর থেকে কঠোরতম বিধি পালন করছে। এইসব কিছুই প্রতি বছরের নিত্য আয়োজন। কিন্তু এই নিত্য আয়োজনেও মহা শোরগোলের মাঝে শোনা গেল, এক করুণ কান্না, খুব ক্ষীণ হলেও আওয়াজটা যে ভিড়ের মধ্যে একবারেই শোনা যাচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। যত আওয়াজটা কাছে আসছে, মেলায় উপস্থিত সব মানুষ পথের দু’ধারে সরে যাচ্ছে। সবাই যতটা সম্ভব নিজেদের বাচ্চাদের চোখ-কান হাত দিয়ে চাপা দিয়ে দিচ্ছে। দু’ধারে অজ্ঞ গ্রামবাসীরা ভয়ে জয়জয়কার ধ্বনি দিচ্ছে, আর মাঝ পথ দিয়ে দুজন ষণ্ডা গোছের বলবান পালোয়ান হিড়হিড় করে একটি মহিলাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমের স্বর্ণ পুকুরের দিকে। মহিলাটি একবারে এলোকেশী, রক্তবর্ণা চোখ, তার হাতের শিরাগুলো যেন কঙ্কালসার দেহ থেকে উপরে বেড়িয়ে আসছে, আর সে দাঁত দিয়ে আস্ত একটা পিতলের কলসি অনায়াসে ধরে আছে। পুকুরের সামনে এনে তাকে সেই কলসি সাথে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হল স্বর্ণ পুকুরের জলে। আসতে আসতে জলের তলায় ডুবে যেতে থাকল মহিলাটি, সবাই আনন্দে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে চিৎকার করছে, একটা কচি হাত ওই ডুবন্ত মহিলার হাতটা ধরার জন্য ছুটে এল। কিন্তু তখনই পিছন থেকে কে যেন ডেকে উঠল… “শবরী শবরী… এদিকে একবার শোন, তাড়াতাড়ি আয়।”

শবরী ধড়ফরিয়ে উঠে বসল, সারা শরীর তার ঘামে ভিজে গেছে। সেই এক স্বপ্ন প্রায় রাতেই দেখে শবরী। শবরীর গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে টেবিল থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে ঢকঢক করে পান করল। তারপর কাপড়ের খুটটা দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতচকিত হয়ে গেল। শবরী মনে মনে বলল, ‘সব্বনেশ এত ঘুমিয়ে পড়েছি আজ, সক্কাল নইটা বাইজা গ্যালো, ঠাম্মু এক্ষণই আমার উপর রাগ দেখাইবে।” সে তরতরিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। ঘর থেকে ছুটে বেড়িয়ে উঠোনের সামনে গিয়ে উঠোনটা ঝাঁট দিতে শুরু করে দিল। পিছন থেকে বাড়ির পরিচারক সহদেবদা বলল, “বলি তোর একটা কাণ্ডজ্ঞান নেই এত বেলা পর্যন্ত ভোঁসভোঁস করে ঘুমাত্যাছিস! এখনি বড়বাবু, বউদি, মীনাক্ষীদি চইল্যা আসবা। বিয়া বাড়ি বইল্যা কথা।” শবরী কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আপন মনে ঝাঁট দিতে থাকল। এরপর বাড়ির সামনের বড়ো গেট বা ফটক আঁটকে ডানদিকে কলঘরে চলে গেল। সামনের ফটকের বাঁ-পাশের ধুলো পড়া শ্বেত মার্বেলের স্তম্ভের উপর লেখা আছে ঘোষাল মহল।

মুর্শিদাবাদ জেলার আজমগঞ্জে ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে একটি গ্রাম হল বড়নগর। এই গ্রামের শেষ সীমান্তে এই ঘোষাল জমিদার বাড়ি। যদিও নামেই জমিদার, জমিদারির কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। একসময় এখানে বিঘের পর বিঘে জমিতে ছিল এই ঘোষালদের জমিদারি। নানা সবজি ফসল চাষ তো ছিলই, সাথে ঘোষালদের পূর্বপুরুষদের দুধের ব্যাবসার ছিল রমরমা বাজার। এখান থেকে দুধ যেত কলকাতায়। শোনা যায়, আজমগঞ্জে ‘গঙ্গেশ্বর জোড়া বাংলা শিবমন্দির’ নির্মাতা রানী ভবানী যখন আজমগঞ্জে এসে থাকতেন তখন এই ঘোষাল বাড়ি থেকে দুধ যেত রানীর মহলে। রানী ভবানী ছিলেন খুব দানশীলা রমণী। বহু মানুষকে তিনি অনেক কিছু দান ধ্যান করেছেন। এই ঘোষাল জমিদারদের প্রতিও তিনি সদয় ছিলেন। রানী খুশি হয়ে নাকি এই বাড়ির পিছনে, মানে পূর্বের দিকের জমি ও বড়ো পুকুর দানপত্র করে দিয়েছিলেন ঘোষাল পরিবারকে। আর কিছু স্বর্ণমুদ্রাও দিয়েছিলেন। সেই স্বর্ণমুদ্রায় খোদিত বাণীই নাকি সকল সময়ে অভাব ঘুচায়। তবে সে সব ইতিহাসের বাক্সে বন্ধ। সেই নিয়ে নাড়াচাড়া করার মতো লোক এখন প্রত্যন্ত গ্রামে নেই। প্রায় সব জমিই কালের স্রোতে ক্ষয় পেয়ে পেয়ে আজ প্রায় বিলুপ্ত। এখন শুধু দু’কাটা জমির ওপর ঘোষাল পরিবারের অর্ধভগ্ন বাড়িটি ইতিহাসের করুণ সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। আর পূর্বের জমিতে এখন জলা- জঙ্গল। পশু-পাখি, সাপখোপের আস্তানা সেটা। এই বাড়ির সদস্য বলতে বৃদ্ধা কৌশল্যা দেবী, শবরী ও সহদেবদা। তবে বাড়ির বড়ো ছেলে অনিমেষবাবু সপরিবারে কলকাতায় থাকেন। আজ এখানে আসবেন। কারণ তাঁর বৃদ্ধা মার শেষ ইচ্ছা হল, তাঁর একমাত্র নাতনির বিয়েটা যেন এই পৈতৃক ভিটে থেকে হয়, তাহলে মরার আগে আবার একবার সবাইকে একসাথে দেখতে পাবেন।

শবরী দক্ষিণের ঘরগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে ঝুল বারান্দার সামনে রাখা বাহারি গাছগুলোতে জল দিচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে গাড়ির আওয়াজ, এবং সাথে সাথে বাইরের গেট খোলার আওয়াজ পেয়ে ওপর থেকে সে দেখে অনিমেষবাবু সপরিবারে চলে এসেছেন। শবরীও আনন্দে ছুটে নীচে নেমে এল। সেই কোন ছোটবেলায় মীনাক্ষীকে সে দেখেছে। বলা যায়, চোদ্দ বছরের বনবাস কাটিয়ে সে আবার নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে। যদিও অনিমেষ তাঁর মাকে দেখতে ও জমিজমার তদারকি করতে বছরে একবার আসতেন, তবে এই তিন বছরে তাঁরও পদধূলি এই গ্রামে পড়েনি। মীনাক্ষীর কিছু বন্ধু-বান্ধবী আর মামাবাড়ির লোকেরাও এসেছেন। সহদেবদা পথ দেখিয়ে সবাইকে ভিতরে নিয়ে গেল। অনিমেষবাবু শবরীকে দেখে বললেন, “শবরী তোর ছোট্ট বোনটি দেখ কত বড়ো হয়ে গেছে। বিয়ের সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব কিন্তু তোর বুঝলি?” শবরীর চোখে মুখে একটা আনন্দের চমক ফুটে উঠেছে। মীনাক্ষীকে সে জড়িয়ে ধরে আদর করল। তারপর শবরীর চোখ গিয়ে পড়ল গেট দিয়ে সদ্য ঢোকা আরেকটি গাড়ির দিকে। গাড়িটি দেখে অনিমেষবাবু এগিয়ে গিয়ে বললেন, “আরে বরকর্তা ও বরযাত্রীও তো দেখছি এসে পড়েছে আমদের সাথে সাথে, কই সবাই উলু ধ্বনি দাও।”

গাড়ি থেকে নামল বরকর্তা বরের মামা এবং বর অর্থাৎ সুমিত হালদার। পেশায় লাল বাজারের হেড কন্সটেবল। সুমিতের মা–বাবা আগেই গত হয়েছেন। দেখতে সুপুরুষ বলা যায়। নিজের বলতে আছেন শুধু বিপিন মামা। তাই বরপক্ষ ও কনেপক্ষ মিলে ঠিক করেছেন বিয়েটা একই জায়গা থেকে হবে। সুমিতের মামা ছাড়া সাথে আরেকজনও এসেছে, সে হল সুমিতের প্রিয় বন্ধু, কলকাতার গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান অভিমন্যু সমাদ্দার। অভিমন্যুর সুঠাম দেহ, উচ্চতা ৬ ফুটের, গায়ের রং কৃষ্ণকালো, চোখের তারা দুটো বেশ উজ্জ্বল, তার মুখমণ্ডলে অদ্ভুত একটা বুদ্ধিদীপ্ত গাম্ভীর্য আছে।

সেদিন সারাদিন হৈ-হল্লোড় করতে করতে কেটে গেল। দক্ষিণের বড়ো ঘরটায় সুমিত আর অভিমন্যুর শোবার ব্যবস্থা করা হল। সুমিত পুরানো দিনের সেগুন কাঠের তৈরি শক্তপোক্ত খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে সিগারেট টানতে টানতে বলল, “বুঝলে ভায়া অভি শ্বশুর বাড়ির জামাই আদরটা আজ ভালোই হল। পেট একেবারে ভরপুর। এখনও বিয়ে হতে এক সপ্তাহ দেরী তাতেই এত আপ্যায়ন। না জানি বিয়ের পর কতো হবে! আমরা পুলিশ মানুষ নাওয়া-খাওয়ার সময় থাকে না। আজ চোর ধরো, কাল মন্ত্রীর মিছিল সামলাও, পরশু খুনীকে খোঁজো এই তো জীবন। তার উপর আবার সৎ পথে থাকলেও ঘুষখোর অপবাদ। তাই মাঝে মাঝে এমন আপ্যায়ন হলে মন্দ হয় না। আরে ভায়া তুমি তো দেখছি এখানে এসেও কাজ জুড়ে বসেছ। তোমাকে এক সপ্তাহের ছুটিতে নিয়ে আসা যে কী ঝকমারি কাজ, সে আমি জানি। প্রথমে তো আসতেই চাইছিলে না। কাজ আছে কাজ আছে বলে এড়িয়ে যাচ্ছিলে। তারপর কী হল নিজেই আসার সম্মতি দিলে। এখন এসো শুয়ে পড়ো। কাল তোমাকে গ্রামে ঘুরতে নিয়ে যাব।”

“তুমি না মীনাক্ষী আমাদের ঘুরতে নিয়ে যাবে। তুমিও তো সুমিতদা আমার মতোই নতুন এসেছো। এই দাঁড়াও আসছি একটা মেল করে আসছি। কয়েকমাস ধরে একটা কেস নিয়ে ঝুলে আছি, কিছুতেই সমাধান হচ্ছে না। জানো তো তুমি? ওই ব্যাপারে আমাদের এক জুনিয়ারকে একটা মেল করছি। কটা লোকেশন ট্যাগ করতে বলতে হবে। তোমার বিয়ে মিটলেই জোর কদমে কাজে মন দিতে হবে। এই কদিন ও-ই ব্যাপারটা নেড়েচেড়ে দেখবে আর কি।” তারপর সুমিত আর অভিমন্যু গল্প করতে করতে একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

গ্রামে সকালটা একটু অন্যরকমই হয়। পাখির ডাকেই ঘুম ভেঙে যায়। সুমিত উঠে দেখে সামনের বারান্দায় অভিমন্যু পায়চারি করছে। সে ফোনটা নিয়ে অভিমন্যুর কাছে এসে বলল, “কি ভাই রাতে ঘুম হয়নি নাকি! নতুন জায়গা একটু অস্বস্তি তো হয়…”

অভিমন্যু কী যেন একটা ভেবে তারপর বলল, “নাহ সেরকম কিছু না। তবে দেখো বাড়িটা কেমন অদ্ভুত রকম নয়! বাড়ির তিনদিকটি বেশ খোলামেলা, অথচ পূর্বদিকে একটাও জানলা নেই। পুরোটাই পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। একটু পরেই মীনাক্ষী এল চা নিয়ে। ওকে জিজ্ঞাসা করতে বলল, “বাবার কাছে শুনেছি পূর্বদিকে নাকি কি সব প্রেতদের বাস। এই বাড়ির ছোট বউ পিছনের পুকুরে ডুবে মারা গেছে। তারপর থেকে এই বাড়িতে একের পর এক অঘটন ঘটে। এমন কি এ গ্রামেও ঘটে। আজকের দিনেও এসব কুসংস্কার গ্রামের লোকেরা বিশ্বাস করে, ভাবলেও অবাক লাগে।”

সুমিত হো হো করে হেসে বলল, “মীনাক্ষী আমায়ও বলেছে ওর ঠাকুমারও নাকি এসব কুসংস্কারের বাতিক আছে। আর ওর ঠাকুমার কড়া আদেশ এই বাড়ির পূর্বদিকে কেউ যাবে না। তাই দেখো সব পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। অর্থ থাকলেই মানুষের হাত চুলকায় কি কি অজুহাতে খরচ করা যায়। মীনাক্ষীর ঠাকুমারও সে অবস্থা। বাদ দাও ভায়া এসব গ্রাম্য জটিলতা। চলো একটু ফ্রেশ এয়ার নিয়ে আসি আর গ্রামে ঘুরে ঘুরে মীনাক্ষীর সাথে একটু প্রেমও করি।”

অভিমন্যু নিজের দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “তা ওই পূর্বের জঙ্গলে যাওয়ার রাস্তাটা কোন দিকে?”

মীনাক্ষী ভেবে বলল, “ঠাকুমার ঘরে একটা দরজা আছে, সেখান দিয়ে যাওয়া যায় শুনেছিলাম। কিন্তু সে দরজার চাবি হারিয়ে গেছে অনেক বছর আগে।”

সকালের জল খাবার খেয়ে মীনাক্ষীর সাথে সুমিত, অভিমন্যু আর তার কিছু বান্ধবীরা একসাথে সহদেবদাকে নিয়ে বড়নগরের ইতিহাস বিজড়িত স্থানগুলো দেখতে বেরল। যেহেতু বড়নগর থেকে অনেকটা ভিতরে এই গ্রামের বাড়িটা, তাই তারা গাড়ি করে যাবে বলে ঠিক করল। গাড়িতে ওঠার সময় অভিমন্যুর মনে হল কেউ যেন আড়াল থেকে তাকে দেখছে, সে তখনি ঘুরে এদিক-ওদিক দেখল কিন্তু আশেপাশে কাক চিল ছাড়া কেউই ছিল না। দু’দিকে সবুজ ধান ক্ষেতে ভরা প্রকৃতির মাঝে এক অপরূপ সবুজ গালিচা কেউ যেন সযত্নে বিছিয়ে দিয়েছে। সাথে মাঠে দূরে দূরে পাকা ধানের গোলাও আছে। জোড় বাংলা মন্দিরের সামনে তাদের গাড়ি এসে থামল। সহদেবদা গ্রাম্য গাইডের মত করে বোঝাতে লাগল। অষ্টাদশ শতকে রানী ভবানীর তৈরি এই মন্দির কাশির অনুরূপ। এখানে তিনি ১০৮টি শিবমন্দির বানাতে চেয়েছিলেন, তবে একটা বাদে ১০৭টি ছিল সম্পূর্ণ হয়েছিল। যদিও কালের স্রোতে অনেক মন্দির এখন হারিয়ে গেছে, ইতিহাসের শেষ সাক্ষ্য হয়ে এই গঙ্গেশ্বর জোড় বাংলা মন্দির, অষ্টকোণাকৃতি ভবানীশ্বর মন্দির, চার-বাংলা মন্দির ইত্যাদি অবশিষ্ট আছে। সুন্দর টেরাকোটার কারুকার্যে রামায়ণ ও কৃষ্ণলীলার কাহিনী এবং সমকালীন সমাজচিত্রের অপরূপ কাজ সত্যি মন্ত্রমুগ্ধ অনুভূতি জাগায়। অভিমন্যু কিছুটা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা এর নাম বাংলা কেন?” সহদেবদা আগ্রহের সাথে বুঝিয়ে বলল, “বাংলা শব্দের অর্থ ‘অবয়ব বা স্ট্রাকচার’ আর দুই-বাংলা বলতে দু’চালাবিশিষ্ট — দুটো মন্দির একসাথে যুক্ত।” এরপর সবাই নিজের মতো এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। সহদেবদা মন্দিরের এক পাশে বসে ঝিমাচ্ছিল। অভিমন্যু মন্দিরের পাশের রাস্তাটা ধরে ভাগীরথীর তীরে এসে গ্রামের লোকের কাছ থেকে এই জায়গার সম্পর্কে কম-বেশি তথ্য সংগ্রহ করতে লাগল। হঠাৎ তার নজরে পড়ল একটা বুড়ো দূরে দাঁড়িয়ে একটা ব্যঙ্গের হাসি হাসছিল। লোকজনের আনাগোনা একটু কম হলে পরে বৃদ্ধ লোকটা সামনে এসে একটা বিকৃত হাসি হেসে বলল, “ঘোষাল বাড়ির পিছে মশাল/ জ্বলছে দাউ দাউ/ ফিরতি পথে দেখতে পাবে/ লোক কাঁদছে হাউ হাউ-” তখনই সহদেবদা কোথা থেকে এসে বৃদ্ধের কথাটা শেষ করতে দিল তো না, উল্টে তাড়িয়ে দিল। সহদেবদা কিছুটা যেন জোর করে অভিমন্যুকে ওখান থেকে নিয়ে চলে এল। বিকালে বাড়ি ফিরে এলেও অভিমন্যুর মনটা খুব খচখচ করতে লাগল। বারবার মনে হতে লাগল লোকটা যেন কি একটা বলতে চাইছিল। দু-প্যাকেট সিগারেট শেষ হয়ে গেল, কিন্তু রাতে ঘুম আর এল না। অভিমন্যু বারান্দায় এদিক ওদিক পায়েচারি করছে, হঠাৎ তার নজর গিয়ে পৌঁছল নীচের তলার শেষ ঘরটার দিকে। মীনাক্ষীর ঠাকুমার ঘর থেকে কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। ধীর পায়ে অভিমন্যু নীচে নামল। সে ঘরটার যত কাছে যাচ্ছে, তত একটা কথা কাটাকাটির শব্দ স্পষ্ট ভেসে আসছে। বাইরের জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে মনে হল ভিতরে অনিমেষবাবু রয়েছেন। তিনি কৌশল্যা দেবীকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, “তোমার জন্য আজ এই অবস্থা… আমি তো বলেছিলাম…” পিছন থেকে একটা নরম হাত অভিমন্যুর কাঁধটা স্পর্শ করল। সে ঘুরে দেখে শবরী দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে অভিমন্যু বলল, “আসলে কলঘরটা কোন দিকে বুঝতে পারছি না। যদি একটু বলে দেন…” শবরী ইশারা করে কলঘরের দিকে আঙুল দেখাল। অভিমন্যু ইতস্তত হয়ে কলঘরের দিকে চলে যায়। মনে মনে একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে অভিমন্যু। বারবার মনে হতে লাগল এই শান্ত ইট বার করা বাড়ির প্রতিটি ইটের আড়ালে কোন এক রহস্য লুকিয়ে আছে।

কলঘর থেকে বেড়িয়ে সামনের টিউবওয়েলে হাত মুখটা ধুতে যাবে, ঠিক এই সময় ওপরতলা থেকে একটা চিৎকার শুনতে পেল অভিমন্যু। সে তখনি সিঁড়ির দিকে ছুটে যায়, থামের আড়াল থেকে দেখল শবরী সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঠাকুমার ঘরের দিকে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। এদিকে ওপরে বেশ একটা শোরগোল পড়ে গেছে। অভিমন্যু ওপরে গিয়ে দেখল অনিমেষবাবুর কপাল থেকে রক্ত ঝরছে। সবাই জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন, “ঘুমের ঘোরে খাট থেকে নীচে নামতে গিয়ে পাপসে পা হড়কে পড়ে গেছি, আর টেবিলে মাথাটা ঠুকে গেছে।” মীনাক্ষী তার বাবা অনিমেষবাবুর মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিল। এরপর শেষ রাতে কিছুটা উদ্বেগ কিছুটা স্বস্তি নিয়ে সবাই শুতে গেল। সবাই কিছুটা স্বস্তি পেলেও অভিমন্যুর মনে একটা অস্বস্তির ঢেউ উথাল-পাথাল করতে লাগল। শবরীর হাব-ভাব মোটেও ভালো লাগছিল না। ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্য মনের ভিতর একটা উচাটন বাড়তেই থাকল।

পাঁচদিন বাদে বিয়ে সকাল থেকে আয়োজনের তোড়জোড় চলছে জোর কদমে। অভিমন্যুর আজ একটু দেরীতেইও ঘুম ভাঙল। সুমিত তখন রেডি হচ্ছে। অভিমন্যুকে দেখে বলল, “আরে আজ তুমি উঠতে বেশ দেরী করে দিলে ভাই। আর কাল রাতে যা হল আমার হবু শ্বশুর মশাই তো আরেকটু হলে একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতেন, আর আমার বিয়েটা দফারফা হয়ে যেত। আজ আমি একটু মীনাক্ষীর সাথে বেরোচ্ছি। আসতে আসতে ধরো রাত হয়ে যাবে। তোমার একা একা এখানে অসুবিধা লাগবে না তো?” অভিমন্যু হেসে বলল, “তা যুগল কপোত-কপোতী মিলে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? আমি তো এখন বাদ হব-ই।”

“আর বলো না আমার পাঞ্জাবিটা ওকে দিয়েছিলাম নিয়ে আসার জন্য। আমার কাজের মন যদি মিস করে যাই ওটা নিয়ে আসতে। ম্যাডামকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলাম। ওমা এ তো ম্যাডাম আমার থেকেও বেশি ভুলো। নিজের সব জিনিস গুছিয়ে নিয়েছে আর আমারটাই ভুলে গেছে। বিয়ের আগেই এই হাল, না জানি বিয়ের পর কি হবে আমার! এদিক দিয়ে তুমি ভালো আছ বেশ ঘুরছ ফিরছ আর গোয়েন্দাগিরি করে যাচ্ছ। বলো ভায়া, গ্রামের কোনো মেয়ে দেখে দেবো নাকি? এক যাত্রায় আর পৃথক ফল হবে না।”

অভিমন্যু মুচকি হেসে বলল, “প্রস্তাবটা মন্দ নয়। তবে কি জানো কোনো মেয়েই এই একঘেঁয়ে মানুষটার সাথে বেশিদিন থাকতে পারবে না। বেকার কোনো মেয়ের পৌষ মাসের জায়গায় সর্বনাশ ডেকে লাভ কি! তোমার মত রোমান্টিকগোছের মানুষ যদি হতে পারতাম তাহলে অন্য কথা ছিল।”

“রোমান্টিক না আরও কিছু…” মীনাক্ষী এক মুখ হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকল। “অভিদা, তোমার বন্ধুটি কিছুই বোঝে না। পাঞ্জাবি আনা তো একটা অজুহাত, আসলে তো তোমার সুমিতদার সাথে একটু আলাদা টাইম স্পেণ্ড করতে চাই সেটাও বোঝে না। নেহাত ঠাকুমার আবদার রাখতে বাপীর কথা শুনে এখানে এসে বিয়েটা করতে হচ্ছে, নাহলে এই পরিবেশে কে আসত?”

অভিমন্যু একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “যাই বলো জায়গাটা বেশ ভালো লেগেছে আমার। বেশ শান্ত, মনোরম। শুধু পূর্বের দিকের সব জানালা পাঁচিল দিয়ে আটকানো আর ঘেরা এটাই যা। আমার তো ওই জঙ্গলে যেতে ইচ্ছা করছে। আচ্ছা অনিমেষবাবু কেমন আছেন এখন?”

“বাবা ভালো আছে। তবে ঠাকুমার শরীরটা ভালো নেই। শোনো অভিদা কিছু অসুবিধা হলে শবরীদিকে বলো। ও কথা বলতে পারে না কিন্তু ইশারায় বুঝতে পারে। খুব ভালো মেয়ে। আমি ওকে বলে রেখেছি তোমার খেয়াল রাখতে।”

বিকাল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এদিকে কৌশল্যা দেবীর শ্বাস কষ্টটা বাড়ায় তাঁকে আর বাড়িতে রাখা সম্ভব ছিল না। অনিমেষবাবু ও সুমিতের মামা ও সহদেবদা মিলে গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তাঁকে নিয়ে যান। অভিমন্যু সাথে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বাড়িতে এত জন মেয়েরা একা থাকবে এই ভেবে অভিমন্যুকে বাড়িতেই থেকে যেতে বলা হয়। দোতলায় সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। শবরী আর অনিমেষবাবুর বউ রাতের রান্নার আয়োজন করছে নীচে। মীনাক্ষী আর সুমিত বৃষ্টির জন্য পথেই আটকে পড়েছে। ঘরে বসে বসে অভিমন্যুর আর সময় কাটছে না। হঠাৎ কি মনে হলো সে ঠাকুমার ঘরে গিয়ে দেখল ঠাকুমার খাটের পাশে সেই দরজাটায় তালা দেওয়া। সে তালাটা হাত দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে লক্ষ্য করল তালায় একটা নম্বর বোতাম করা আছে। কিন্তু নম্বরটা কি, যা দিয়ে এই তালা খুলবে? হঠাৎ ঝুমুরের আওয়াজ হলো। সতর্ক হয়ে অভিমন্যু বুক কেসের পিছনে লুকিয়ে পড়ল। একটা নীল কাপড় পরা মেয়ে মাথা থেকে এক গলা ঘোমটা টেনে ঘরে ঢুকল। এদিক ওদিক দেখে কোমরের খুঁট থেকে একটা চাবি বের করে ওই তালাটা খুলল, সাথে একটা নম্বর তালার মধ্যে টিপল। দূর থেকে কিছুটা হলেও আঙুলের ইঙ্গিত অনুযায়ী নম্বরটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো অভিমন্যু। তারপর প্রচণ্ড বৃষ্টিতেই ওই দরজা দিয়ে মেয়েটা বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই অভিমন্যু মেয়েটার পিছন পিছন চলতে শুরু করল। চারিদিকে গাছ, একবারে ঘন জঙ্গল। কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না।

অভিমন্যু ছোটো টর্চের আলো দিয়ে সামনের দিকে দেখার চেষ্টা করল। খুব আঁশটে পচা একটা গন্ধ বার বার তার নাকে ভেসে আসছে। সে যত সামনে এগোচ্ছে, বন তত গভীর হচ্ছে। শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। সামনে একটা পুকুর, পুকুরের জলটা অনেক নীচে আর পাড়টা বেশ উঁচু, সাধারণত এরকম হয় না। হঠাৎ করে একটা কান্নার শব্দ ভেসে এলো দূর থেকে… মেয়েটাকেও আর দেখা যাচ্ছে না। টর্চ নিয়ে এদিক সেদিক দেখল অভিমন্যু, কিছুই দেখতে পেল না সে। বারবার মনে হচ্ছে কেউ যেন তার পিছনে পিছনে আসছে। হঠাৎ করে একটা হাত তার মুখ চেপে ধরল, পিঠের কাছে খুব ভার লাগছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব যেন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।

######

চারিদিকটা বেশ অস্পষ্ট লাগছে, গায়ে হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। আস্তে আস্তে মনে হল আগের থেকে সব অস্পষ্ট সম্মুখ দৃশ্য স্পষ্ট হচ্ছে। অভিমন্যুর সামনে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছেন অনিমেষবাবু, মীনাক্ষী, সুমিত আরও বাড়ির সবাই। প্রথম প্রশ্নটা সুমিত–ই করল, “এখন কেমন লাগছে অভি। আর কিছু কষ্ট হচ্ছে না তো?” অভিমন্যু আস্তে আস্তে উঠে বালিশে হেলান দিয়ে বসে বলল, “আমি এখানে এলাম কী করে? গায়ে হাতে এত ব্যাথা লাগছে… কি হয়েছিল আমার?”

মীনাক্ষী শান্ত স্বরে বলল, “এত উদ্বিগ্ন হোয়ো না, তুমি সামনের গেটের সামনে চিৎ হয়ে পড়েছিলে, শবরী কুয়ো থেকে জল আনতে গিয়ে তোমাকে ওই অবস্থায় দেখে সবাইকে ডাকে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল তোমাকে মারল কে? তুমি কোথায় গিয়েছিলে?” এই কথার মাঝখানে সহদেবদা এক গ্লাস দুধ ও এক প্লেট ফল নিয়ে ঘরে ঢুকল। অভিমন্যুর সামনের টেবিলটায় সেগুলো রাখার সময় একদৃষ্টিতে অভিমন্যু তাকে দেখে যাচ্ছে। এদিকে মীনাক্ষী যে হাজার প্রশ্ন করছে সে দিকে অভিমন্যুর এক ফোঁটা কর্ণপাত করল না। তিন চার বার নাম ধরে ডাকার পর অভিমন্যুর সম্বিৎ ফিরল, সে কিছু একটা ভেবে চিন্তে বলল, “আসলে বাড়ি ফাঁকা দেখে একদল লোক কিছু একটা খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে গেটের বাইরে ঘোরাফেরা করছিল, আমি বুঝতে পেরে ওদের কাছে যাই, ওরা ভয় পেয়ে আমাকে মেরে চলে যায়।”

সবাইকে তখনকার মতো বানানো গল্প বলে সবার কৌতূহল কিছুটা কমানো গেল। সেদিন রাতে ঠাকুমার ঘরেই অভিমন্যুর থাকার জায়গা হল। আর রাতে দেখাশোনার ভার পড়ল শবরীর ওপর। রাতে প্রদীপের মৃদু আলোয় শবরীকে বেশ সুন্দর লাগছে। শ্যামবর্ণা, একরাশ কালো এলো চুল, পদ্মের পাপড়ির মতো ওষ্ঠ যুগল, তার উজ্জ্বল তারারন্ধ যেন আঁধার রাতের রূপকথার পরীদের মতো লাগছে। ঘুম ঘুম চোখে ওই কৃষ্ণকালো সৌন্দর্যে কোন পুরুষ না রূপের মায়ায় আহত হয়! অভিমন্যুর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কর্মমুখী মানুষকেও ক্ষণিকের জন্য হলেও কামনার মায়াজালে আচ্ছন্ন সে করে। তবু অভিমন্যু নিজের মনে উদ্বেলিত হওয়া ইচ্ছাকে সংবরণ করে। শবরীর চোখের দিকে তাকিয়ে কখন যেন সে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। অনেক রাতে ঘুম ভাঙার পর সে দেখল পাশে শবরী নেই, আর পূর্বের ওই দরজটা খোলা। গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়েই কষ্ট করে উঠে, আবার ওই দরজা দিয়ে অভিমন্যু বেড়িয়ে পড়ল। সেই একই রকম চেনা পরিবেশ। তবে কালকের প্রবল বৃষ্টির জন্য পচা পাতার গন্ধটা আরও বেশি চরা লাগছে। পায়ের উপর দিয়ে সুর সুর করে কি যেন একটা চলে গেল। আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতে, সে দেখল সেই আগের দিনের দেখা পুকুরটা। বৃষ্টিতে কাল বোঝা যাচ্ছিল না। আজ ভালো বোঝা যাচ্ছে। এত দিনের অব্যবহৃত পুকুরে একটুকুও পানা জমেনি। আর ঘাটটা বেশ পরিষ্কার, দেখে মনে হচ্ছে নিত্য দিনের ব্যবহার্য এই পুকুর। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল, পুকুরের তিনটে পার বাঁধানো থাকলেও একটা পার বাঁধানো নেই। সেদিক দিয়ে পুকুরের জল কত দূর বয়ে গেছে, তা এই অন্ধকারে আন্দাজ করা যাচ্ছে না। আরেকটু এগোতে সামনে একটা বিরাট খন্দ, অভিমন্যু লক্ষ্য করে দেখল তার চারিধারে এরকম অনেকগুলো খানাখন্দ। কোনটা আবার খুঁড়ে মাটি দিয়ে বোঁজানো হয়েছে। অভিমন্যু মনে মনে বলল, “বাড়ির পিছনে এত বড়ো জমি, অথচ পেত্নীর বাস বলে ফেলে রেখেছে। অথচ এ জমি নাকি আবার অভিশপ্ত জমি। হায় রে আজও কত কুসংস্কার মানুষকে গিলে আছে!” কিন্তু মাঝে মাঝেই পচা মরার গন্ধ ভেসে আসছে। অভিমন্যু যত এগিয়ে যেতে লাগল তার টর্চের আলোটা ততই অপ্রয়োজনীয় হতে লাগল। ক্রমশ সামনে যেতে যেতে, সে দেখল একটা ক্ষীণ আলো স্পষ্ট হয়ে এল। সামনে একটা পোড়ো আটচালা ঘরের মতো মনে হল, আর সেখানে আগুন জ্বলছে। সামনের গাছের পাতাগুলো সরিয়ে দেখতে যাবে, অমনি তার বাঁ-হাতের দিকের ঝোপটা যেন নড়ে উঠল। শুকনো পাতার উপর দিয়ে খসখস করে দৌড়ানোর শব্দ হচ্ছে। অভিমন্যু টর্চটা ঘুরিয়ে সেই আওয়াজের পিছু নেয়। একজন গোয়েন্দার সাথে সেই ধাবক আর ছুটে পারল না, হার স্বীকার করতে হল। অভিমন্যু তার হাতটা টেনে নিয়ে সামনের দিকে করতেই দেখে, এ তো শবরী। অবাক হয়ে যায় সে, যে মেয়েটার চোখে রাতে ভালবাসার মায়া ভরা রয়েছিল, তার চোখে যেন আগুন জ্বলছে। শবরীর হাতদুটো চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলল, “তুমি … তুমি এখানে কি করছ! যদি না আমার ভুল হয়ে থাকে আগের দিনও তুমি এ জঙ্গলে এসেছিলে। আর সবাই বলে এই জঙ্গলের দরজার তালার চাবি হারিয়ে গেছে। তাহলে তুমি কী করে জানলে?” শবরী ফ্যালফ্যাল করে অভিমন্যুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার ঠোঁট দুটো যেন স্বল্প কেঁপে ওঠে। অভিমন্যু বিরক্তির সুরে বলে ওঠে “ও তুমি তো কিছু বলতে পারবে না। তাহলে আমার সাথে চলো ওই দিকে, কে আছে আমিও দেখতে চাই। অভিমন্যু পাশ ফিরে যেতে উদ্যত হল, কিন্তু শবরী তার হাত দুটো চেপে ধরে ইশারায় যেতে নিষেধ করল। কিন্তু অভিমন্যু দমবার পাত্র নয়। সে যাবেই। তাদের দুজনের এই টানা হেঁচড়ার মধ্যে কোথা থেকে, কারা যেন তীর ছুঁড়তে শুরু করল। ভয়ানক সব আওয়াজ হতে শুরু করল। শবরী প্রায় জোর করেই অভিমন্যুকে ওই জঙ্গল থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এল। আর অভিমন্যুর তখন উপায় ছিল না। কারণ সে সাথে বন্দুকটা নিয়ে আসেনি। এই তীরের হাত থেকে বাঁচার একটাই উপায় ছিল — ওইখান থেকে তখনকার মতো চলে আসা। ঘরে ঢুকে শবরী জঙ্গলের দিকের দরজাটা বন্ধ করে দেয়। শবরী এক অজানা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে, সারা শরীর তার ঘামে ভিজে গেছে। এতক্ষণ অভিমন্যু লক্ষ্য করেনি, শবরীর ডানহাতে তীরের একটা ফলা কিছুটা ছুঁয়ে চলে গেছে বলে বেশ ঝরঝর করে রক্ত বেরছে। শবরী সেই রক্ত দেখে তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারাল। না, সে রাতে অভিমন্যু শবরীকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেল না। শবরীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সে বিছানার পাশের চেয়ারটায় বসে তার হাতে ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। তবে সেদিন রাতে সে আর ওই জঙ্গলে গেল না। কারণ অনেক উত্তর শবরীর কাছ থেকেই পেয়ে যাবে এই আশায় তার পাশে বসে রইল। শবরীর জ্ঞান ফিরলেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দেবে। এই ভাবতে ভাবতে সেও ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে বাইরে বেশ শোরগোল পড়ে গেছে। সুমিতদৌড়ে ঠাকুমার ঘরে এসে বলল, “এই অভি ওঠ, এদিকে এক কাণ্ড হয়েছে। আমাদের একটু সতর্ক হতে হবে। ওঠ রে…”

অভিমন্যু আলসি ভেঙে উঠে বসে বলল, “কি হয়েছে?” সুমিত উদ্বিগ্ন মুখে বলল, “আরে শবরীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কাল রাতে তো তোর দেখাশুনার দায়িত্ব নিয়েছিল, তুই কিছু জানিস!”

অভিমন্যু স্তম্ভিত হয়ে বলল, “কি বলছিস!” কালকের রাতের সব কথা মনে এল, ভেবেছিল সকালে খতিয়ে জিজ্ঞাসা করবে। তবে কাল রাতের কথা এখন সুমিতকে জানান ঠিক হবে না। একেই এখানে একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে, আর বিয়ে সামনে। তাই সব কথাটা চেপে গিয়ে বলল, “হ্যাঁ আমার ঘরেই তো ছিল। তারপর আমি ঘুমিয়ে যাই, তারপর যে শবরী কোথায় গেছে তা আমি জানি না। দেখো গ্রামে কারোর বাড়িও যেতে পারে! না পেলে পুলিশি তদন্ত করতে হবে। চলো বাইরে গিয়ে দেখি।”

এই সময়ে অনিমেষবাবু ঘরে ঢুকে বললেন, “অভি তুমি আর সুমিত মিলে দেখো তো মেয়েটা কোথায় গেল! একদিকে আমার মা খুব অসুস্থ এখন তখন অবস্থা, ডাক্তার বলেই দিয়েছে বড়ো জোর আর পনেরো দিন আয়ু মার। আবার এদিকে পরশু রাতে তোমাকেও কেউ মারধর করল, আর আজ শবরীকে পাওয়া যাচ্ছে না। সব কিছু যেন কেমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। ক’দিন পরেই বিয়ে… কি যে হবে!” অনিমেষবাবুর কপালে বেশ চিন্তার ভাঁজটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি অভিমন্যুকে বললেন, “সেদিন একটা কথা তোমাদের বলিনি। সেদিন আমি পড়ে যাইনি। বরং কেউ যেন আমাকে ঠেলে দেয়।”

“কে ঠেলে দেয়, কোনো মেয়ে না ছেলে?” অভিমন্যু শশব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

“না, ঠিক বুঝতে পারিনি কে ছিল…”

“আচ্ছা, সেদিন কি আপনি রাতে কৌশল্যা দেবীর ঘরে গিয়ে ছিলেন?”

“কই না তো! কেন?”

“না এমনি জিজ্ঞাসা করলাম। আচ্ছা আপনাকে যে সেদিন ধাক্কা দেয়, তাকে আপনি একটুও দেখতে পাননি? মানে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন কে হতে পারে?”

“না বাবা, অন্ধকারে বুঝতে পারিনি। সেদিন তোমাদের কাকিমা মীনাক্ষীর সাথে শুয়ে ছিল। আমি একাই ছিলাম ঘরে। আমি জল খেতে উঠে শুনতে পাই কে যেন আমার ঘরের বুককেসটা খুলে কি খুঁজছিল। ঘর অন্ধকার থাকলেও একটা মানুষ ছিল বেশ বুঝতে পারছিলাম। আমি শব্দ না করে লাইটটা অন করতে যাবো, অমনি কে যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। একটা ঠাণ্ডা স্পর্শ অনুভব করেছিলাম।”

সুমিত অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, “এ কথা সেদিন বলেননি কেন?”

“এতদিন এসব নিয়ে মাথায় ঘামাইনি, জানি সামনে বিয়ে। এসব নিয়ে আর সবাইকে ব্যস্ত সমস্ত করে লাভ কি! আর তাছাড়া মায়ের মুখে শুনেছি। এই বাড়িতে এইরকম ভৌতিক ব্যাপার ঘটতেই থাকে। তাই আর কি… বাইরে থাকতাম মাঝে মাঝে এখানে আসতাম। মা এসব নানা গল্প কথা বলতেন, কানে নিতাম না। ভাবতাম গ্রাম্য কুসংস্কার কিন্তু আজ এগুলো এখন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না। হয়তো সত্যিই এই বাড়ির পিছনের জঙ্গলটা ভয়ানকভাবে অভিশপ্ত। আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী মারা যাওয়ার পরই আমার বাবা আর ছোট ভাই তো ওই পিছনের জঙ্গলেই অপঘাতে মারা যান। তঁদের লাশ পচা গলা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।” তারপর কি একটা ভেবে অনিমেশবাবু বললেন, “আচ্ছা শবরীর সাথে এমন কিছু হয়নি তো! মেয়েটা তো কথাও বলতে পারে না। একবার ওই পিছনের জঙ্গলে খুঁজে দেখলে হয় না!”

সুমিত আগ্রহের সাথে বলে, “ঠিক বলেছেন আপনি, কিন্তু চাবি?”

“মায়ের কাছে চাবি ছিল, কিন্তু তিনি সেটা তো সেটা হারিয়ে ফেলেছেন। ওখানে যাওয়ার পথ মনে হয় আর নেই!” একটা গভীর বিষণ্ণতার ছাপ অনিমেষবাবুর মুখে চোখে ফুটে উঠল।

এতক্ষণ চুপ করে অভিমন্যু সব শুনছিল। এবার সে অনিমেষবাবুর হাত ধরে বলল, “চিন্তা করবেন না, আমি আর সুমিত যথাসাধ্য চেষ্টা করে শবরীকে ফিরিয়ে আনব। আজ আবার এখানে চড়ক সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে মেলা বসে তো। আপনি চিন্তা ভাবনা ছেড়ে পুজোর আয়োজন করুন। রাতের মধ্যে মহাদেবের কৃপায় সব প্রেতাত্মার বিনাশ হবে। শবরীকে ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে।”

অনিমেষবাবু সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত না হলেও এই দুজনের উপর তাঁর আস্থা ছিল। তাই তিনি কিছুটা আশ্বস্ত হন আর কথা বাড়ান না। অনিমেষবাবু যাওয়ার পর সুমিত গুরুগম্ভীর গলায় বলল, “কেসটা কি বল তো! বড্ড জটিল লাগছে। তুমি কিছু আন্দাজ করলে?”

“না এখনও কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না। তবে হ্যাঁ একটু সতর্ক থাকতে হবে। কে সত্যি কে মিথ্যা বলছে ধরা মুশকিল! শোনো আমার কাছে কিছু প্ল্যান আছে।” এরপর অনেকক্ষণ ধরে তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করল।

রাতে মেলা বসেছে ঘোষাল বাড়ির কাছাকাছি একটা মাঠে। সামনের মন্দিরে জাঁকজমক করে পুজো হচ্ছে। সন্ন্যাসীরা ভয়ানক খেলার মধ্যে দিয়ে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করার জন্য প্রয়াসরত। মীনাক্ষী একটা লাল পেরে সাদা শাড়ি পরে পূজা দিচ্ছে। পূজা শেষ হওয়ার পর সহদেবদা সকলের জন্য লস্যি তৈরি করে আনল। মেলা বেশ জমে উঠেছে। বহু গ্রামবাসী এসেছে। মীনাক্ষী সুমিতের সাথে নাগরদোলা চরার জন্য টিকিট কাউন্টারের কাছে এসে দাঁড়াল। কিন্তু মীনাক্ষীর মাথাটা হঠাৎ টলতে লাগল। সুমিত মীনাক্ষীকে মন্দিরের সিঁড়িতে বসিয়ে জল আনতে গেল। এদিকে সহদেবদা মীনাক্ষীকে এসে খবর দিল, তার বাবা অনিমেষবাবুর হঠাৎ হার্ট অ্যাটার্ক হয়েছে, তাই সে যেন এখনই বাড়ি যায়। মীনাক্ষী দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে টলতে টলতে বাড়ির পথে রওনা দিল। আর সহদেবদাকে বলল সে যেন সুমিতকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে।

#####

ঘন জঙ্গলে শুকনো পাতার উপর দিয়ে খস খস করে চলার শব্দ হচ্ছে। ছ’জনের চলার আওয়াজে জঙ্গলের নিস্তব্ধতা অনায়াসে ভঙ্গ হচ্ছে। দুজনের হাতে টর্চ, তারা বাকি চারজনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা একটা আটচালা ঘরের সামনে এসে থামল। চারজন তাদের কাঁধ থেকে কাপড়ে মোড়া একটা মানুষকে সেই ঘরের উঠানের সামনে রাখল। তারপর সেই চারজন আবার ফিরতি পথে রওনা দিল। একজন মাঝারি উচ্চতার, গৌরবর্ণ লোক সামনে একটি বেতের চেয়ারে বসে আছে। একমুখ দাড়ি, কিংবা গলায় গৌর বাস রুদ্রাক্ষের মালা সে সব কিছুই ছিল না। বরং পাজামা পাঞ্জাবী পরা একটা সাদামাটা দেখতে ভদ্রলোক। ভদ্রলোকটি বেতের চেয়ার থেকে উঠে সামনের দিকে এগিয়ে এসে খিলখিল করে হাসতে লাগল। আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, “জব্দ হয়েছে, এবার বেশ জব্দ হয়েছে। শবরী মা তুই সত্যি আমার উপযুক্ত সন্তান। আগের দিন কেন মা এমন অবাধ্য হচ্ছিলিস? দে মা দে, দলিল আর বাক্সখানা দে…” ঘোমটা টানা মেয়েটির হাত থেকে দলিলটা নিয়ে সে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর সে ওই কাপড় জড়ানো মানুষটার হাতের বুড়ো আঙ্গুলটা বের করে দলিলে টিপ ছাপ নিয়ে নিল। তারপর হো হো করে হেসে উঠল আবার। এবারে বাক্স খুলে সে একটা সোনার মুদ্রা দেখতে পেল। মুদ্রায় লেখা ছিল — “জলে স্থলে ছড়িয়ে আছি/ খুঁজে নাও আমায়/ রত্নভাণ্ডার ভরিয়ে দিলাম/ পূর্বের ঊষার আলোয়” লেখাটা পড়ে সে মুদ্রাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। রাগে লাল হয়ে সে বলে উঠল, “সেই একই জিনিস লেখা। ছোটোবেলা থেকে বাবার মুখে যা শুনে এসেছি, তাই লেখা আছে। কোথায় সেই রত্ন ভাণ্ডারের গোপন সুত্র? যত সব বুজরুকি। দীর্ঘ পনেরো বছর এই কবিতার চারটে লাইনের মানে হন্যে হয়ে খুঁজেছি। ভেবেছিলাম বাবা অর্ধেক সুত্র আমাকে বলে গিয়েছেন, কিন্তু না এটা ছাড়া তো এক লাইনও বেশি লেখা নেই। শবরী মা, ঠিক জায়গা থেকে এনেছিস তো কোথাও কিছু ছুটে যায়নি তো! মেয়েটি মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল সে ঠিকঠাকই এনেছে। পাশে যে আরেকজন সঙ্গী ছিল, সে আসলে সহদেব। সহদেব বলল, “দাদাবাবু তাহলে এবার কী করবে?”

“এবার কী করব! আমি এর পিছনে অনেক সময় নষ্ট করেছি। ভেবেছিলাম এই পূর্বের কোন জায়গায় রানীর পরিবারের তোফা — সেই মহামুল্য সম্পত্তি আছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের এত সম্পত্তি ছিল, যে এদিকে আর কারোর খেয়াল ছিল না। ছোটবেলা থেকেই এই পূর্বদিক আমার খুব প্রিয় কারণ এখানেই সে সম্পত্তি আছে জেনে এসেছি। কিন্তু বাবা এই দিকটা মীনাক্ষীর নামে করে দিয়েছিলেন। আমি কি করে এটা মেনে নিতে পারি বল? পারিনা। তবে আজ এ সম্পত্তি আমার। এখন মীনাক্ষীকে টাটা বলার সময় এসে গেছে। এই বলে ভদ্রলোকটি শুয়ে থাকা মানুষটির মুখের কাপড়টা সরিয়ে দেখে এ মীনাক্ষী নয়… এ তো শবরী। স্তম্ভিত হয়ে বলে “একি শবরী! মীনাক্ষী কই!” পাশে থাকা মেয়েটি ঘোমটা খুলে বলে, “এই যে আমি কাকা, মীনাক্ষী।” মীনাক্ষী ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে, “আমরা জানতাম তুমি মারা গেছো! কিন্তু তোমার এ কি রূপ!” ভদ্রলোক মীনাক্ষীকে ভেংচে বলে … “এ কি রূপ! যাক এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে না। আমার কাছে প্রতারণার কোন ক্ষমা নেই। শবরী তুই আমার সাথে প্রতারণা করলি? শবরী আর মীনাক্ষী তোরা দুজনেই এবার মরবি। সহদেব ওদের চেপে ধর। কালু, মাতু, জাহিদ… কোথায় গেলি এদিকে আয় সবাই।” কিন্তু কারোরই সাড়া পাওয়া গেল না। শুধু একটা বুটের শব্দ শোনা গেল। সামনের আলোয় ক্রমশ মুখটা পরিষ্কার হয়ে উঠল। সামনে এসে ভারি গলায় অভিমন্যু বলল, “তোমার সব জারিজুরি শেষ অবিনাশ ঘোষাল। এতদিন তুমি তাহলে এই জঙ্গলে লুকিয়ে পাপ ক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছিলে! অত্যন্ত বুদ্ধি তোমার সেটা তারিফ না করে পারলাম না। যত বেআইনি কাজ করার ভালো জায়গা এটা। তবে কেউ তোমার ডাকে এখন আর সাড়া দেবে না। সবাই এখন পুলিশি হেফাজতে। চারদিকে তাকিয়ে দেখো।”

অবিনাশ চারিদিকে তাকিয়ে দেখল — চারিদিক পুলিশে ঘেরা। সামনে তার দাদা অনিমেষবাবু দাঁড়িয়ে আছে। অনিমেষবাবুর চোখ ভর্তি জল। অনিমেষবাবু কান্না ভেজা সুরে বলে উঠলেন, “ভাই, তুই বেঁচে আছিস! এসবের কি দরকার ছিল! আমি তো এমনি-ই তোকে সব দিয়ে দিতে পারতাম। তুই ভালো করে জানতিস সেটা… এসবের মায়া আমার নেই।”

রাগে ঝাঁঝ দেখিয়ে অবিনাশ বলল, “আমিও বাপের সন্তান। তুই আমাকে কি দয়া করবি। দেখ এখন সব সম্পতি আমার… শবরীর ভাগটাও আমি আগেই নিয়ে নিয়েছিলাম আর এখন মীনাক্ষীর ভাগটাও আমার।”

অনিমেষবাবু হতভম্ভ হয়ে বললেন, “অভ কি বলছে এসব, আমি কিছু-ই বুঝতে পারছি না!”

অভিমন্যু বলল, “আপনি শান্ত হন আমি সব বুঝিয়ে বলছি। যদিও প্রথমটা কিছুটা আপনার জানা — মানে আপনাদের কাছ থেকেই শোনা আমার, আপনি বদলির কাজে বাইরে থাকতেন। অবিনাশ ডাক্তারি পড়া শেষ করে এখানে আসেন। আপনাদের বিধবা পরিচারিকা নবনীতার সাথে অবিনাশের একটা অবৈধ সম্পর্ক হয়। আর তিনি বাবার অমতেই নবনীতাকে বিয়ে করন। নবনীতার আগের পক্ষের একটি মেয়েও ছিল, যার নাম শবরী। আপনাদের বাবা এই বিয়েতে অসন্তুষ্ট ছিলেন। যাই হোক আপনার মায়ের চাপে আপনার বাবা বিয়েটা বাধ্য হয়ে মেনে নেন। একবার অবিনাশ কাজের সূত্রে কলকাতা যান। ফিরে এসে জানতে পারেন নবনীতা মারা গেছে জলে ডুবে। আর শবরী বোবা হয়ে গেছে। এইটুকু শোনা জানা কাহিনী। কিন্তু নবনীতা মারা যাননি। তাঁকে মারা হয়েছিল। আর সে কাজটা পরোক্ষভাবে আপনার বাবাই করেছিলেন। নবনীতার খিঁচুনির অসুখ ছিল। আর সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে আরও ওষুধ খাইয়ে তাঁকে অসুস্থ করা হয়। এরপর তাঁকে এই রকম এক চড়ক সংক্রান্তির দিন জলে ডুবিয়ে মারা হয়। নবনীতার মুখে করে কলসি তোলার ঘটনাটা গ্রামবাসীর কাছে ভূতে পেয়েছে বলে মনে হলেও আসলে এটার পিছনে একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। অনেক সময় আমাদের শরীরের কোন একটা ‘অরগ্যান’ হঠাৎ ‘পাওয়ারফুল’ হয়ে ওঠে, তখনই এটা হয়। আপনার বাবাও এটাকে ভূতে পেয়েছে নাম দিয়ে নবনীতাকে মেরে ফেলেন। তবে ছোট্ট শবরী মায়ের এই নৃশংস মৃত্যুর একমাত্র নিষ্পাপ সাক্ষী ছিল। এই দৃশ্য দেখার পর সে বোবা নয় বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অবিনাশ ফিরে আসতে তাকে শবরী সব বলেছিল। কিন্তু এই নির্মম খবর তাকে বিচলিত করেনি। কারণ নবনীতকে পাওয়ার শখ তার মিটেই গিয়েছিল। অবিনাশ শবরীকে বোঝান, সে যদি তার কথা মত চলে, তাহলে মাকে ফিরে পাবে। শবরী পরিণত হল তার খেলার একটা ঘুঁটিতে। অবিনাশের আদেশেই আজ পর্যন্ত শবরী বোবা হওয়ার ভান করে থাকত। উনি কোনোদিনই ওকে নিজের মেয়ে বলে মানতে পারেননি।

অবিনাশের মূল লক্ষ্য ছিল বাবার অগাধ সম্পত্তি আর পূর্বের রত্নভাণ্ডার হাসিল করা। উনি বাবাকে বলেন তার নামে সম্পত্তি লিখে দিতে আর সোনার মুদ্রাটা দিতে। এই ব্যাপার নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড বাক-বিতন্ডা হয়েছিল। রাগ মাথায় চড়ে দুজনেরই, আর সেই মুহূর্তে ছোট ছেলের হাতে প্রাণ দিতে হয় বাবাকে। ছোট্ট শবরী আড়াল থেকে এ সব দেখে আরও ভয় পেয়ে যায়। অবিনাশ তার বাবাকে ওই পুকুরেই ফেলে দিল আর গ্রামে রটিয়ে দিল যে অশুভের ছায়া পড়েছে এ গ্রামে। এরপর অবিনাশ জানতে পারেন তার বাবা আগেই ঐ পূর্বের দিকের জমি মীনাক্ষীর নামে আর বসত বাড়ি বউ কৌশল্যা দেবীর নামে করে দিয়েছেন। অবিনাশের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। উনি মায়ের সাথেও ঝামেলা শুরু করেন। একটা সময় তার মা বসত-বাড়ি শবরীর নামে করে দেন। অবিনাশের রোষ আরও বেড়ে যায়। এদিকে অবিনাশের একটা বিশাল জায়গার দরকার ছিল। কেন দরকার ছিল সে কথায় পরে আসছি। তাকে এই পূর্বের জমি পেতে হলে অন্য উপায় বেছে নিতে হবে। সেইজন্য উনি অন্য একজনকে মেরে নিজের জামা কাপড় পরিয়ে, মুখের বিকৃতি করে ওই পুকুরে ফেলে দেন। এবার গ্রামের লোকেদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়, নিশ্চয়ই কিছু অশুভ প্রভাব আছে। কৌশল্যা দেবীও গ্রামের লোকের পরামর্শে পূর্বদিকটা একদম ঘিরে দেন। তবে অবিনাশ শুধুমাত্র সম্পত্তি আর রত্নভাণ্ডার অধিকারের জন্য এত কিছু করেননি। সহদেবদার সাহায্য নিয়ে উনি একটা দল গঠন করেন। যাদের কাজ হল মানুষকে অপহরণ করে তাদের কিডনি বিক্রি করা। অনিমেষবাবু, আপনি জানেন না আপনার ভাইয়ের বিদেশে কত সম্পত্তি আছে। এখানে আসার আগে একমাস ধরে এই কিডনি বিক্রির চক্রটা ধরার জন্য আমি হন্যে হয়ে খুঁজছি। আমার সন্দেহের মোস্ট ওয়ান্টেড প্লেসগুলোর মধ্যে এই বড়নগরও ছিল। তাই সুমিত যখন বলল তার বিয়ে এখানে। তাই শাপে বর হল আমার। এই জায়গায় এসে থেকেই আমি জোড়কদমে কাজ শুরু করে দিলাম। ব্যস, তার ফল আপনাদের সামনে।”

অনিমেষবাবু বললেন,” কিন্তু এত কথা জানলে কীভাবে?”

“কিছুটা খানা তল্লাশি। আর বেশির ভাগটা এই শবরীর কৃপায়। আগের দিন রাতে শবরীকে বলা হয়েছিল, মীনাক্ষীকে আজ বেঁধে এখানে নিয়ে আসতে। মীনাক্ষীকে দিয়ে সম্পত্তি লিখিয়ে অবিনাশ আজ শবরীকে মেরে ফেলত। কিন্তু শবরী আপনাদের কোন ক্ষতি হোক সেটা কোনদিন চাইত না। অবিনাশ বলতেন, তার কথা মত কাজগুলো করলে শবরী ওর মাকে ফিরে পাবে। এই আশায় এতদিন সে অবিনাশের ইচ্ছা মত কাজ করত। কিন্তু কাল রাতে সে আড়াল থেকে শুনতে পায় সহদেবের সাথে অবিনাশের কথা, অবিনাশ যে শবরীকে ঘুঁটি বানিয়ে এই মারণ খেলা খেলছিল সেটা শবরী কাল রাতেই আড়াল থেকে শুনে ফেলেছিল। মীনাক্ষীর সম্পত্তি পেলে তারপর মীনাক্ষী আর শবরীকেও অবিনাশ মেরে ফেলবে। আমি কাল এই জঙ্গলে শবরীকে অনুসরণ করতে যাই। হয়তো এদের হাতে আমি কাল ধরাই পড়তাম। কিন্তু শবরী আমাকে বাঁচিয়ে আনে। আগের দিন এরাই আমাকে মেরেছিল। তারপর আজ ভোর রাতে শবরী আমায় সবটা জানায়। এরপর আসল খেলা শুরু করলাম আমি। ওদের প্ল্যানে ওদের কিস্তিমাত করি। আর অবিনাশ কত মানুষের জীবন নেবেন? এবার তো সংশোধনাগারে গিয়ে কবিতা দেখে হিসাব মেলান কোথায় আপনার রত্নভান্ডার লুকানো আছে।” পুলিশ সহদেব ও অবিনাশকে ধরে নিয়ে গেল।

অভিমন্যু অনিমেষবাবুর হাতে দুই মেয়ের জমির দলিল আর ওই সোনার মুদ্রা তুলে দিয়ে বলল, “কি অনিমেশবাবু, মহাদেবের কৃপায় সব প্রেতাত্মার বিনাশ হল তো? আপনার ভাই যে রত্নভাণ্ডার খুঁজে চলেছিলেন, সে ভান্ডার এই জঙ্গলে আছে।”

“এই জঙ্গলে!” সবাই একসাথে বলে উঠল।

“হ্যাঁ এই যে দেখছেন সবুজে ঘেরা বৃহৎ জমি। কত ফসল এখানে উৎপন্ন হতে পারে আপনাদের আন্দাজ আছে? আর এই নদীর পশ্চিম দিক সেই ভাগীরথীর সাথে মিশেছে। কত মৎস চাষ হতে পারে এখানে! এই কবিতার অর্থ এটাই প্রকৃতি আসল রত্নভান্ডার। কিন্তু আপনাদের পরিবার তো বুঝতেই পারল না। শুধু খুনোখুনি করেই মরল। চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন। ভোরের আলোয় সবাই দেখল সারা জঙ্গল জুড়ে নানা ফল-ফুলের সমারোহ আর পাখির মিষ্টি কুজন।

অনিমেষবাবু শবরীর কাছে এসে নিজের চোখের জল মুছে বললেন, “এই সবের খেসারত মা তোকেই দিতে হয়েছে। আর কান্না নয়। আমি সবসময় বাড়ির বাইরে নিজের কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। মা আর তোর দিকে নজরই দিইনি। এখন থেকে তুই আমার কাছে থাকবি আমার বড় মেয়ে হয়ে।”

শবরী কান্না ভেজা স্বরে বলে উঠল “বড়বাবু।”

“বড়বাবু নয় বল বাবা। বললাম না তুই আমার বড়ো মেয়ে। চলো সবাই, কাল থেকে বিয়ের তোড়জোড় করতে হবে।”

বড়নগরের আকাশ বাতাস সানাইয়ের সুরে মুখরিত হল। দেখতে দেখতে বিয়ের তিনটে দিন কেটে গেল। আজ বিদায় বেলা। মীনাক্ষীকে নিয়ে সুমিত কলকাতায় ফিরে যাবে। সাথে সুমিতের মামা আর অভিমন্যু। গাড়িতে ওঠার সময় অভিমন্যু দেখল ওপরের বারান্দার থামের আড়াল থেকে শবরীর দুটো কালো ঘন চোখ থেকে জলের রেখা গাল বেয়ে নেমে আসছে। অভিমন্যু তাকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠল। গাড়ি সবুজ ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে চলে গেল কলকাতার পথে…

সমাপ্ত

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post সম্পর্ক| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | জয় ঘরামী| Bengali Detective Story
Next post মানিব্যাগ| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | কল্পেশ মান্না| Bengali Detective Story