“ঘড়ির কাঁটার সাথে ‘চরিত্র’ এর আচরণে যখন পরিবর্তন নজরে আসে, তখন মনে তো প্রশ্ন চিহ্ন জাগবেই। এখন শুধু দেখার অপেক্ষায় শুভেন্দুবাবু … জালে রুই মাছ নাকি কই মাছ… ফেঁসেছে…”
“কে? কে ওখানে! এত এত রাত্রিতে কে ওখানে?”
লীলাবতী বার বার ডাকা সত্ত্বেও কিন্তু কোনও সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না, শুধু একটা বিড়ালের গলার আওয়াজ ছাড়া।
বাইরের পরিষ্কার আকাশটা ধীরে ধীরে ঘন কালো মেঘ ডেকে নিয়ে আসছে, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আলো বাড়ির ভেতরটা সাদা করে দিচ্ছে। আর এদিকে অমরেশবাবু হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে পুরনো কয়েকটি গল্পের বই আলমারি থেকে নিয়ে এসে কী যেন বইগুলোর মধ্যে খুঁজে চলেছেন। সামনের চেয়ারে বসে থাকা তার প্রিয় বন্ধু শুভেন্দু ঘোষ চারপাশটা দেখতে দেখতে অমরেশকে হঠাৎ বলে ওঠেন,
“বুঝলে অমরেশ, আজ বোধহয় খুব জোরালো বৃষ্টি হবে!”
গল্প পড়ায় মগ্ন অমরেশ চারপাশে না দেখেই অন্যমনস্ক হয়ে ধীর গলায় বলেন,
“হ্যাঁ, তা হবে হয়তো।”
শুভেন্দুবাবু একটু অস্বস্তি বোধ করে বলে উঠলেন,
“এই, তুমি ওই বইগুলোতে কী খুঁজছো বলো তো? তখন থেকে দেখছি পাতার পর পাতা উল্টে চলেছ, কি ব্যাপার অ্যাঁ!”
“না, তেমন কিছু না, আমার নতুন গল্পের স্রোত খুঁজিতেছি আমারই লেখা পুরাতন গল্পের থেকে।”
হ্যাঁ। অমরেশবাবু একটু সাহিত্য প্রেমিক, কাজের ফাঁকে সময় পেলে কিছু না কিছু লিখতে বসে যান। বিশেষ করে তার কর্মের ঘটনাগুলোকেই নিজের গল্পের রূপ দেয়। তবে গল্প বলতে গোয়েন্দা গল্প – একটু বেশিই পছন্দ করেন, কারণ সেই সব নিয়েই তো কারবার।
“আর গল্পের স্রোত খুঁজতে হবে না, কারেন্ট এই গেল বলে – ”
শুভেন্দুবাবু তার কথা শেষ করতে না করতেই অমনি দরজায় হঠাৎ টক্ … টক্ … টক্ … টক্ .. টক্… জোরে জোরে কে যেন শব্দ করতে লাগল।
“এই সময় কে আবার এল! এই শুভেন্দু একটু গিয়ে দেখ তো কে দরজার কড়া নাড়াচ্ছে।”
শুভেন্দু চেয়ার থেকে উঠে দরজা খুলতেই দেখেন পোষ্ট মাস্টারের ছেলে কানাই এসেছে কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে।
“সত্যদা আছে … সত্যদা … একটু ডেকে দাও না, সত্যদার নামে একটা চিঠি আছে।”
অমরেশকে কমবেশি সকলেই সত্যদা বলেই চেনে। অমরেশ শুনতে পেয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ান, কানাইকে দেখে বললেন,
“এই রকম মেঘের অবস্থাতে এসেছিস কেন রে, কালকে দিলেই পারতিস।”
“না! বাবা জোর করল, বাবার শরীরটা একটু অসুস্থ তাই আমাকে পাঠিয়েছে, বলেছে নাকি খুব জরুরি চিঠি আজকেই পৌঁছে দিতে হবে।”
“ও তাই নাকি কই দে দেখি।”
কানাই কাঁধের ঝোলা থেকে চিঠিটা আর মোটা একটা ডাইরি বের করে অমরেশকে দিয়ে একটা সাইন করিয়ে নিয়ে,
“এই নাও চিঠিটা, এবার আমি চললাম গো পরে কথা হবে, মেঘের মতিগতি ভাল না। কখন বৃষ্টি নামিয়ে দেবে বলা যায় না।”
“ঠিক আছে, সাবধানে যাস।”
এই বলে অমরেশ দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিয়ে ডান দিকে টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসে চিঠিটা মনোযোগ সহকারে পড়তে লাগলেন। কয়েক মিনিট পর শুভেন্দু কৌতুহলী হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“কি ব্যাপার অমরেশ! কিসের চিঠি? এত মন দিয়ে পড়ছ যে।”
অমরেশ কোনও রকম নড়াচড়া না করেই একটু গম্ভীর স্বরে বললেন,
“যারে খুঁজিয়াছি বই এর মাঝে
সে যে হাজির হয়েছে মোর দ্বারে।”
“স্পষ্ট করে বলবে ব্যাপারটা কি?”
“হ্যাঁ … হ্যাঁ… বলছি তার আগে শোনো, ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও, সকাল সকাল রওয়ানা দিতে হবে।”
শুভেন্দু একটু রেগে গিয়ে অমরেশের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন,
“ও .. এই ব্যাপার। আবার খুন! ইন্সপেক্টর রজনীকান্ত বাবু কালকে সকালেই হাজির হতে বলেছে কাশীপুর থানায়।”
অমরেশ চেয়ার থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভাবে বললেন,
“হ্যাঁ, ভুতের মাঝে আসল খুনিকে খুঁজে বের করতে হবে যে।”
“হ্যাঁ, তুমি তো তোমার নতুন গল্প পেয়ে গিয়েছ। চলো রাতটা অন্তত শান্তিতে ঘুমাই, কে জানে এবার কদিন রাতের ঘুম হারায়।”
এদিকে গিরীশবাবুকে কাশীপুরের রাজবাড়ির বংশগত দিক থেকে শেষ রাজাই বলা চলে, কারণ গিরীশবাবুর কোনও নিজের সন্তান ছিল না। সেই গিরীশবাবু গত তিন দিন আগে এক দুর্ঘটনাবশত মারা যান বাড়িতেই। আজ নিয়ে চার দিন হয়ে গেল। বাড়ির সকলের বক্তব্য যে এই রাজবাড়িতে ভূত আছে, সেই কারণেই রাজা মশাই রাত্রি বেলায় প্রচুর ভয় খেয়ে স্ট্রোক (হার্ট বন্ধ) হয়ে মারা যান। কেউই আর পরিষ্কার করে সেই রাতের ঘটনাটি বলতে পারছে না পুলিশের কাছে। গিরীশবাবুর বিশ্বস্ত চাকর কেষ্টটাও ঠিক বলতে পারছে না। রাজবাড়ির চাকর কেষ্ট’র এর কাছ থেকে দু’একটা গুপ্ত খবর বাইরে আসে। রাজবাড়ির পাশেই এক মুচির বাড়ি, সেই বাড়ির উপর তলা তিনি ভাড়া দেন। কিন্তু এখন কেউ নেই, তাই রুমগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। আর এই মুচির সাথেই কেষ্টর একটু বেশিই মেলভাব। সন্ধে হলেই সে মুচির বাড়ি চলে আসে, সেখানে দু’জনে মিলে মদ্যপান করে। রাজার মৃত্যুর তিন দিন পর আজ চার দিনের দিনে কেষ্ট মুচির বাড়ি আসে এই মেঘলা আবহাওয়ায়।
“কই হে গোবর্ধন কি খবর?”
“আরে কেষ্টদা যে, এসো এসো, ওই চলে যাচ্ছে, তা তোমার তো দিন চারেক দেখাই পাওয়া যায়নি যে, বলো আজ কী খাবে?”
“আর খবর! মাথা ধরে আছে, একটা বোতল বের করো তো, সেই কদিন আগে যেটা রয়ে গিয়েছিল।”
গোবর্ধন বারান্দা থেকে উঠে রুমের মধ্যে রাখা একটা মদের বোতল বারান্দাতে নিয়ে এল। দু’জনেই দিব্যি মদ খেতে লাগল, এই মেঘলা আবহাওয়াতে, ক্ষণিক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর দু’জনেই যখন নেশাগ্রস্ত সেই সময় কেষ্ট মদের গ্লাসটা হাতে নিয়ে গোবর্ধনকে বলে ওঠে,
“বুঝলে গোবর্ধন – ”
তার কথা শেষ হতে না দিয়েই গোবর্ধন বলল,
“হ্যাঁ কেষ্টদা বলো শুনছি।”
“আর শুনছি! শালা অভিনয় পারে বটে।”
“কে অভিনয়, কিসের অভিনয়, কিছুই তো বুঝলাম না।”
“ওই রাজবাড়ির সব কটা। বুড়োর মৃত্যু দিন চারেক হতে না হতেই সবগুলো বুড়োর সম্পত্তির দিকে নজর লাগিয়েছে। সকাল থেকেই যত সব ঝামেলা শুরু হচ্ছে, শুনে শুনে কান ঝালাপালা ধরে যায়।”
“সে তো ঝামেলা লাগবেই, এতটা সম্পত্তি, তার আবার উত্তরাধিকার নাই। তা এখানে অভিনয় কোথায় এল।”
কেষ্ট তার হাতে গ্লাসের মদটা চোখ বন্ধ করে গিলে পরে গ্লাসটা মেঝের ওপর নামিয়ে চড়া গলায় বলে উঠল,
“আরে বাবা শোনো না, মাঝে বকছো কেন, তুমি আর কি জানবে হে। আসল অভিনয় তো তখন শুরু হয় যখন কোনও পুলিশ রাজবাড়িতে আসে। সব যেমন কতো শোকে আছে বেটারা। পুলিশ দেখেই সবার মুখ শুকিয়ে যায়, কারও আবার বুড়ো মরার দুঃখে চোখে জল আসে। আর পুলিশ বিদায় নিলেই সব নিজের কাজে লেগে যায়, তো এদেরকে অভিনেতা বলব না তো কি বলব!”
গোবর্ধন হে.. হে.. হে .. করে হাসতে হাসতে বলল,
“এ যে বড়োসড়ো অভিনেতা।”
কেষ্ট তার হাত নাড়াতে নাড়াতে বলল,
“ থামো, থামো, ধীরে বলো কেউ যদি জানতে পারে তবে আমি শেষ।”
কথাবার্তা চলতে চলতে দু’জন এই নেশার ঘোরে মুচির বারান্দাতেই ঘুমিয়ে পড়ল। গোবর্ধন যখন সকালে উঠে, দেখে কেষ্টদা নেই, সে ভোর ভোর বিদেয় নিয়েছে।
রাতের মেঘলা আকাশ কেটে সকালের স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া কাটতে না কাটতেই কাশীপুর থানার সামনে ঠিক ৯ টা নাগাদ একটা ট্যাক্সি এসে থামল। ট্যাক্সি থেকে দুই ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে কিছু সময় চারপাশটা দেখতে থাকেন। ওঁদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন কলকাতার সাহেবী বাড়ি থেকে দুই ব্যাক্তি এই গ্রাম বাংলায় বেড়াতে এসেছেন, পায়ে ব্ল্যাক সু, হাতে ঘড়ি, পরনে কালো কোট আর লম্বা ব্যক্তিটির হাতের আঙুলের ফাঁকে গোঁজা এক মস্ত বড়ো কালো রঙের জ্বলন্ত সিগারেট। ধীরে ধীরে পায়ের ঠক.. ঠক.. ঠক.. শব্দে থানার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। দূর থেকে ইন্সপেক্টর রঞ্জনবাবু ওঁদের দেখতে পেয়ে সেই দিকেই চেয়ে রইলেন। থানার ভেতর প্রবেশ করতেই,
“আসুন আসুন ডিটেকটিভ বাবু, বসুন এখানে। রাস্তায় আসতে কোনও অসুবিধা হয়নি তো?”
অমরেশ আর শুভেন্দুবাবু থানার বড়ো বাবুর টেবিলের উল্টো দিকে বসতে বসতে অমরেশ উত্তর দিলেন,
“না.. না.. অসুবিধে আবার কিসের হবে?”
তারপর অমরেশ আর রঞ্জনবাবু সেই পাঠানো চিঠিটা নিয়ে কথাবার্তা শুরু করে দিলেন। কিন্তু এদিকে শুভেন্দুবাবু তাদের কথায় বেশি কান না দিয়ে চেয়ারে বসে বসে থানার ভেতরের চারপাশটা দেখতে থাকে। ওঁদের কথাবার্তার মাঝেই তিনি হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে বসেন,
“থানাটা তো বেশ সাজানো গোছানো, তা কাজকর্ম কেমন হচ্ছে?”
“আজ্ঞে ওই হচ্ছে, আর না হলে সেখানে তো আপনারা আছেন।”
“হ্যাঁ সে আছি, এখনও মরে যাইনি।”
এরপর রঞ্জনবাবু অমরেশকে বললেন,
“সব কিছুই তো বুঝতে পেরেছেন বোধহয়। এবার তাহলে যাওয়া যাক।”
অমরেশ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“হ্যাঁ চলুন, আর দেরি না করে।”
তারপর তিনজনেই থানার থেকে বাইরে এলেন জিপ গাড়ির সামনে, রঞ্জনবাবু দাঁড়িয়ে জোরে হাঁক দিলেন,
“নিতেন … এদিকে একবার এসো।”
কনস্টেবেল নিতেন গাছের তলা থেকে দৌড়ে এলেন,
“হ্যাঁ সাহেব বলুন।”
“এঁদের একটু পৌঁছে দিয়ে এসো রাজবাড়ির পাশেই যে মুচির বাড়ি আছে সেখানে, আর হ্যাঁ রাজবাড়িটাও দেখিয়ে দিও।”
“আজ্ঞে সাহেব এই যাচ্ছি, চলুন আপনারা বসুন গাড়িতে।”
অমরেশ আর তার বন্ধু এবং সঙ্গে কনস্টেবল নিতেন বেরিয়ে পড়লেন জিপে করে রাজবাড়ির দিকে, রহস্য ভেদের খোঁজে। শুভেন্দুবাবুর মনে হালকা ভয় যেন বাসা বেঁধেছে। কারণ আগে অনেক গোয়েন্দাগিরি করেছেন, এই কিছুদিন আগেই অ্যাডভোকেট শ্রীকান্তবাবুর খুনির খোঁজ করে তাকে পুলিশে দিয়ে এলেন, সে এক বিশাল ঘটনা, কিন্তু এই প্রথম ভূত প্রেত নিয়ে রহস্য ভেদ করতে চলেছেন, জীবনের বিন্দুমাত্ৰ তো ভয় থাকবেই।
এদিকে জিপ এসে থামল রাজবাড়ির মস্ত বড়ো গেটের সামনে। শুভেন্দুবাবু জিপ থেকে সবে মাত্র পা টা বাইরে রাখতে যাচ্ছিলেন, সাথে সাথেই অমরেশ বাধা দিলেন।
“থামো, এখনই নামবে না, পরে আসব তার আগে থাকার জায়গাতে যাব। চলুন নিতেন বাবু।”
“আজ্ঞে! হ্যাঁ মশাই।”
জিপ আবার কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থামল মুচির বাড়ির সামনে।
“গোবর্ধন আছ নাকি ……”
কনস্টেবল জোরে জোরে হাঁক দিতে লাগল, দু’তিন বার হাঁক দেওয়ার পরেই বাড়ির ভেতর থেকে এটা মোটা গলার আওয়াজ বেরিয়ে আসে।
“হ্যাঁ … এই যে যাচ্ছি।”
অমনি মুচি বাইরে এসে দাঁড়াল, কনস্টেবল শুভেন্দু আর অমরেশকে দেখিয়ে বললেন,
“থানার বড়বাবু যে দু’জন ব্যক্তির জন্য তোমার বাড়ির উপর তলা ভাড়াতে নিয়েছেন, এই এঁরা হলেন সেই দু’জন। এঁদের রুমটা দেখিয়ে দাও গিয়ে।”
“ঠিক আছে দারোগা বাবু আমি সব কিছু দেখিয়ে দিচ্ছি।”
কনস্টেবল নিতেনবাবু অমরেশ এর কাছে বিদায় চেয়ে বেরিয়ে পড়লেন থানার দিকে। এদিকে গোবর্ধনের পিছু পিছু অমরেশ ও তার বন্ধু শুভেন্দু সিঁড়ির উপর দিয়ে টক্ টক্ টক্ শব্দ করতে করতে উপর তলায় পৌঁছালেন। গোবর্ধন চাবি দিয়ে দরজাটা খুললে তিনজনেই রুমের ভেতরে প্রবেশ করলেন।
“এই যে দেখছেন এই রুমটা আপনাদের জন্য, দেখুন তো কোনও অসুবিধা নেই তো?”
অমরেশ ও তার বন্ধু রুমটার চারপাশটা দেখতে থাকে। ঠিক যেন অমরেশ এর নিজের বাড়ির মতনই দক্ষিণ জানালার পাশে একটি মস্ত টেবিল তার উপর নানান বই ছড়ানো রয়েছে, জানালা দিয়ে রাজবাড়িটি নজরে পড়ছে, সামনে একটা কাঠের চেয়ার, আর পূর্বদিকে একটা আলমারি, রুমের দেওয়ালে নানান মূর্তি ঝোলানো কোথাও কাঠের তৈরী হরিণের মাথা আবার কোথাও গন্ডারের মাথা। এই সব জিনিস দেখে মনে হচ্ছে যেন রুমটা গমগম করছে। সব কিছুই দেখে, পরে অমরেশ বললেন,
“হ্যাঁ সবকিছু তো বেশ ভালো সাজানো গোছানো, আর ওই মূর্তিগুলো কোথা থেকে এনেছিলেন?”
গোবর্ধন একটু মুচকি হেসে বললেন,
“হে.. হে.. হে.. মশাই ভালো লেগেছে তাই না, ওই মাথাগুলো বাঁকুড়া জেলার এক ছোট্ট গ্রাম শিমূলবেড়িয়া থেকে নিয়ে এসেছিলাম।”
অমরেশবাবু টেবিলটার দিকে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন,
“এর আগে এখানে কে থাকত?”
“আজ্ঞে মশাই, এর আগে একজন কলকাতার সাহেব থাকত, তবে তার কথা আমার মগজে ঢুকত না বুঝলেন, সব সময় হিন্দিতে বক বক করত।”
অমরেশ টেবিলের বইগুলো দেখতে থাকলেন, প্রত্যেকটি বই নেড়ে চেড়ে মুচিকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তবে সব বইগুলো বাংলা গল্পের, উপন্যাসের কেন?”
শুভেন্দুবাবু একটু চমকে গিয়ে টেবিলের কাছে পৌঁছে বইগুলি দেখেন।
“হ্যাঁ এ যে আশ্চর্যের বিষয়, বাংলার নানা বই।”
গোবর্ধন শুকনো শুকনো মুখে হালকা হেসে বলল,
“হে.. হে.. হে.. কী যে বলেন, উনি বাংলা শিখতে চেয়েছিলেন, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ওঁকে বলেছিলেন, “মুঝে বেঙ্গলি শিখনা বহত আচ্ছা লাগতা হে।”
“তা বেশ ভালো নাকি শুভেন্দু!”
“হ্যাঁ… হ্যাঁ.. নিশ্চয়, এ যুগে তো হিন্দি আর ইংরেজির পেছনেই সবাই ছোটে, তার মাঝে কেউ বাংলা শিখছে, তা শুনে ভালোই লাগল।”
গোবর্ধন এবার হালকা হেসে বলল,
“তবে আমি আসি, যদি কোনও প্রয়োজন হয় জানাবেন মশাই।”
শুভেন্দু বললেন, “হ্যাঁ ঠিক আছে আসুন, ধন্যবাদ।”
গোবর্ধন বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই অমরেশ দরজার খিলটা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিয়ে টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসে বইগুলো উল্টোতে থাকে। শুভেন্দু একটু অস্বস্তিবোধ করলেন, না বলে থাকতে পারলেন না।
“অমরেশ শুনছো, বলি আমরা এখানে গল্পের বই পড়তে আসিনি। আর আমাদের গল্পের বই পড়তেও ডাকা হয়নি!”
বইগুলো দেখতে দেখতে অমরেশ বললেন,
“আহঃ! এত তাড়া কিসের, বসো বসো। একটা সিগারেট দাও দেখি।”
শুভেন্দু তার পকেট থেকে দু’টো সিগারেট বের করে একটা অমরেশের দিকে এগিয়ে দিলেন, সাথে নিজেও একটা নিলেন। দু’জনেই সিগারেট টানতে টানতে ক্ষণিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শুভেন্দু বললেন,
“কিছু ভাবলে?”
“কী ভাবব?”
“আরে ওই রাজবাড়িতে যাওয়ার কথা।”
অমরেশ একটু হেসে বললেন,
“সাপের বিষ এই তো উঠেছে শিরে,
সবে তো শুরু ভাবার কী আছে।”
শুভেন্দুবাবু খুব বিরক্ত হয়ে বললেন,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি থাকো এই কবিতার ছন্দ নিয়ে, আর এদিকে সব শেষ।”
অমরেশ চোখ দু’টো বন্ধ করে হালকা মুডে, বলে উঠলেন,
“আহঃ, এত চিন্তা কোরো না , আজ বিকেলে ওই বাড়িতে পা দেবো। তবে তার আগে কবি, সাহিত্যিক, লেখক যেটা হওয়ার ইচ্ছে সেটা প্র্যাকটিস করো।”
শুভেন্দু অবাক হয়ে বড়ো বড়ো চোখ করে একটু রেগে গিয়ে বললেন,
“ওসব আমার দ্বারা হবে না বাপু! তুমি ওই সব নিয়ে থাকো, যেটা করতে এসেছি সেটাতে মন দাও।”
অমরেশ চোখ দু’টো খুলে, চেয়ার থেকে উঠে শুভেন্দুর কাছে গেলেন এবং তার কাঁধে বাম হাতটা রেখে জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আরে তোমাকে শুধু অভিনয় করতে বলেছি, গল্প লিখতে বলিনি।”
“তা এসবের কি দরকার আছে এই কেসের সাথে?”
আবার শুভেন্দুবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন,
“আছে আছে, প্রয়োজন আছে। কারণ আজ বিকেলে রাজবাড়িতে কোনও গোয়েন্দা নয়, দুই লেখক যাবে তাদের রাজবাড়ি নিয়ে গল্প লিখতে।”
“ও বুঝেছি! আবার ছদ্মবেশী, তা আগে তো শুধু রূপ পাল্টাতাম এবার তো দেখছি চরিত্রই পাল্টাতে হবে।”
অমরেশ হালকা হেসে বলে উঠলেন,
“চলো এবার কাজে লেগে পড়ো, যা হবে বিকেলে হবে।”
ঘড়ির কাঁটায় চারটে বেজে পনেরো মিনিট, তবু সূর্য মাথায় চেপে বসে আছে। গীষ্মকালে কোনও কোনও দিন বিকেলে মেঘ করে। কিন্তু আজকে আকাশটা পুরোপুরি পরিষ্কার, চারিদিকে রোদ ঝলমল করছে। রাজবাড়ির ভেতরে বাগানের ধারে ধারে লাগানো সব ফুল গাছের ফুলগুলো বাগানের সৌন্দর্য্যের সৌন্দর্য যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সময় রাজবাড়ির মস্ত গেটের সামনে অমরেশ আর শুভেন্দু এসে হাজির। চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা, সাদা পাঞ্জাবি, আর সাদা ধুতি পরে এগিয়ে আসছে, কাঁধে একটা করে সুতির ঝোলা নিয়ে। তাদের দেখে কেউ যাতে সন্দেহ করে তার কোনও জায়গাই রাখলেন না। বাগানের রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে চললেন রাজবাড়ির দিকে। তাদের দেখতে পেয়ে বাগানে কাজ করতে থাকা রাজবাড়ির আরেক চাকর গোপাল জোরে হাঁক দিল।
“ওহে বাপু আপনারা কারা? ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?”
ছদ্মবেশী শুভেন্দু চলতে চলতে উত্তর দিলেন,
“আমরা একটু রাজবাড়ির ভেতর যাচ্ছি, একটু দরকার আছে।”
“দাঁড়ান মশাই আমি সাথে আইতেছি।”
গোপাল বাগানের কাজ রেখে দিয়ে হাত ঝেড়ে চলতে লাগল তাদের আগে আগে।
“কার সাথে দেখা করতে আইছেন? দিদিমনির সাথে!”
“দিদিমণি! মানে ঠিক বুঝলাম না, তুমি কার কথা বলছ!”
“আরে আমাদের রাজবাড়ির দিদিমণির কথা, রাজাবাবুর মেয়ে লীলাবতীর সাথে …।”
শুভেন্দু কিছু বলার আগেই অমরেশ হাত নাড়িয়ে তাকে চুপ করিয়ে অমরেশ বললেন,
“হ্যাঁ.. হ্যাঁ ওঁর সাথেই একটু জরুরি প্রয়োজন।”
গোপাল রাজবাড়ির দরজাটা খুলে জোরে হাঁক দিল,
“দিদিমনি, আপনার সাথে কারা দেখা করতে এইছে।”
এই বলে গোপাল শুভেন্দু আর অমরেশকে বিশাল বারান্দার মাঝে সোফাতে বসতে বলল। ওঁরা সোফাতে বসে চারিদিকটা দেখতে থাকে, বেশ সুন্দর করে সাজানো গোছানো, বিশেষ করে পুরাতন যুগের নানান শিলালিপিগুলো। এই সব দেখতে দেখতে অমরেশ আর শুভেন্দুবাবুর নজর গেল উপরের সিঁড়ির দিকে। এক মহিলা প্রায় পঁচিশ বছরের একটি মেয়েকে হাতে ধরে নিচে নামিয়ে নিয়ে এসে বিশাল বারান্দার মাঝে সোফার সামনে দাঁড়াতেই অমরেশ ও তার বন্ধু সোফা থেকে উঠে ‘নমস্কার’ জানালেন। এদিকে পঁচিশ বছরের মেয়েটি ওঁদের বসতে বলে নিজেও সোফাতে বসে জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনারা কারা? কোথা থেকে এসেছেন?”
অমরেশ অনুমান করলেন এই তবে লীলাবতী দেবী, তিনি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাওয়ার আগেই শুভেন্দু বললেন,
“আমরা কলকাতা থেকে এসেছি। আমি শুভেন্দু ঘোষ আর উনি বিশিষ্ট সাহিত্যিক অমরেশ রায়। আসলে আমরা লেখালিখি করি, আপনি হয়তো অমরেশবাবুর কিছু বই পড়ে থাকবেন?”
লীলাবতী হালকা একটু হেসে বললেন,
“আসলে আমি চোখে দেখতে পাই না, যে আপনাদের কাছ থেকে বই নিয়ে পড়ব। তা আপনাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”
সাথে সাথেই শুভেন্দু তার বন্ধুর দিকে সন্দেহের চোখে তাকালেন। আর অমরেশবাবু খানিকটা অবাক হয়েছিলেন। আর হবেনই না বা কেন, চিঠিতে তার কোনও উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এবার শুভেন্দুকে থামিয়ে অমরেশ বললেন,
“আসলে আমরা একটা গল্প লিখতে চাই, মানে এই রাজবাড়িকে নিয়ে গল্প।”
“হ্যাঁ তা আপনারা অবশ্যই লিখতে পারেন, এতে জিজ্ঞেস করার কী আছে।”
অমরেশ একটু গলা কেশে বললেন,
“তার জন্য আমরা কিছুদিনের জন্য এই রাজবাড়ি ভালো করে দেখতে চাই সাথে এখানকার সকলের সাথে একটু আলাপও করতে চাই।”
লীলাবতী ক্ষণিক চুপ করে থেকে বললেন,
“দেখুন এই বাড়িতে একেই অনেক অঘটন ঘটে গেছে। আমিও অন্ধ হয়ে গেছি, বাবাও গত হলেন। তাই আমি চাই না বাইরের কারও সাথে বেশি কথাবার্তা বলতে।”
এই শুনে শুভেন্দুবাবু বললেন,
“এই না, না, আমরা তো শুধু একটু রাজবাড়িটা দেখতে চাই, এতে কারও কোনও অসুবিধা হতে দেবো না আমরা।”
শুভেন্দুর কথার তালে তাল মিলিয়ে অমরেশ বললেন,
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আর তার জন্য আমরা ইন্সপেক্টর রঞ্জনবাবুর কাছ থেকে পার্মিশন নিয়েই এসেছি। অত দূর থেকে এসেছি, খালি হাতে ফিরে যাওয়াটা ঠিক হবে না তাই আর কী …।”
অমরেশ একটু গম্ভীর গলায় আবার বললেন,
“আর রাজাবাবু মারা গেছেন তার জন্যই গল্প লিখতে চাই এই রাজবাড়ি নিয়ে।”
এদিকে হঠাৎ বড়ো দরজা দিয়ে ‘জয় কালী, জয় কালী, জয় শিবশম্ভু’ ধ্বনি করতে করতে একজন লাল পোশাকধারী, গলায় নানা ধরনের মালা, হাতে তাবিজ আর এক গাল দাড়ি নিয়ে প্রবেশ করলেন বারান্দায়। ওঁর গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে লীলাবতী যেন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি বললেন,
“আসুন বাবা বিহারীলাল আসুন, বসুন ওখানে।”
কবিরাজ বিহারীলাল কিছুটা পা ভেঙ্গে যেই বসতে যায় এমনি ওঁর নজর এদের ওপর পড়ে। অবশেষে তিনি বসে পরে জিজ্ঞেস করলেন,
“লীলা! এ-এঁরা কারা?”
“এঁরা হলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক অমরেশ আর ওঁর বন্ধু শুভেন্দু ঘোষ। এই রাজবাড়ি নিয়ে গল্প লিখতে চায়।”
এই বলে অমরেশবাবুকে নোটিশটি দিতে বললেন, কবিরাজ এর হাতে।
কবিরাজ বিহারীলাল নোটিশটা দেখে তাদের অনুমতি দিয়ে দিলেন। এতক্ষন যে লীলাবতী বাধা দিচ্ছিলেন কবিরাজের কথা শুনে আর কিছুই বললেন, না। শেষমেষ অমরেশ বললেন,
“তবে আমরা একটু রাজবাড়িটা ঘুরে আসি।”
উত্তরে বিহারীলাল বললেন,
“হ্যাঁ..হ্যাঁ… নিশ্চই। আপনারা আমাদের অতিথি।”
বিহারীলাল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কেষ্টকে তাদের সাথে যেতে বললেন। তিনজনেই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকে, সামনে কেষ্ট তার পিছনে অমরেশ আর শুভেন্দুবাবু। কিছুটা উঠে তিনজনের পায়ের শব্দ পেয়ে দোতলার বাম দিকের একটি রুমের ভেতর খট্… খট্ ..খট্…খট্.. শব্দটি বন্ধ হয়ে গেল। ওই রুমের পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাওয়ার সময় অমরেশ জানালা দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখলেন কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। এবং তিনি এগিয়ে চললেন, কিন্তু কিছুটা যাওয়ার পরেই সেই রুম থেকে এক মহিলা বের হলেন। অমরেশ পিছু ফিরে দেখে কেষ্টকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কে উনি?”
কেষ্ট বললেন, “উনি পারমিতা দেবী, রাজাবাবুর একমাত্র বোন।”
“ও, ঠিক আছে, রাজাবাবুর রুম কোনটা, সেদিকে চলো।”
কেষ্ট ভয়ে ভয়ে বলল,
“না বাপু, ওই রাজাবাবুর শোবার কক্ষে যাওয়া যাবে না।”
তা শুনে শুভেন্দু একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন
“কেন .. কেন! কেন যাওয়া যাবে না?”
কেষ্ট একটু ভয়ে চুপি চুপি বলল,
“আরে ওই রুমে ভুত আছে মশাই। তাই বাইরে থেকে তালা মারা আছে।”
অমরেশ হেসে হেসে বললেন,
“ভূত! ভূত কি এই একটা রুমেই থাকে নাকি?”
“হ্যাঁ মশাই, ওই রুমটি কবিরাজ নিজে তালা লাগিয়ে দিয়ে গেছেন। সকলকেই খুলতে বারণ করা আছে, ওই যে! ওই যে! দেখতে পাচ্ছেন তিন তলার সিঁড়ির পাশে রাজাবাবুর লাইব্রেরি রুম তার পাশে যে বড়ো দরজায় তালা লাগানো আছে, সেটাই রাজাবাবুর শোবার রুম ছিল।”
শুভেন্দু চাকরকে জিজ্ঞেস করলেন, “তবে চাবিটা কার কাছে থাকে?”
“ওই দিদিমনির কাছেই থাকে।”
অমরেশ লাইব্রেরি রুমের কাছে এসে রুমে প্রবেশ করলেন, তার সাথে শুভেন্দু আর কেষ্ট ভেতরে এল। এত বই সংগ্রহ দেখে অমরেশ বললেন,
“রাজাবাবু খুবই বই পড়তেন বোধহয়!”
কেষ্ট বলল, “না, না, সেরকম তো পড়তে দেখিনি। কিন্তু হ্যাঁ বই সংগ্রহ করতে ভালোবাসতেন।”
আলমারিতে রাখা কিছু গল্পের বইয়ের দিকে অমরেশের নজর গেল, গিয়ে বইগুলো নেড়েচেড়ে যেমন ছিল তেমনই রেখে বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন,
“চলুন তিনতলাটা একটু দেখে আসি।”
কথাটি শুনে কেষ্ট বলল, “তিনতলায় কিছুই নেই, ছাদ আছে শুধু।”
“তবুও একবার ঘুরে আসি।”
তিনজনেই আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। সবাই উপরে উঠে দেখতে থাকে চারপাশটা। বাগানের বেড়ার ধারে সারি সারি নারকেল গাছ, নানা ধরণের ফুল গাছ, অমরেশের নজর পড়ে রাজবাড়ির পিছনে ভেঙে যাওয়া দরজার দিকে, ভেঙে পড়ে আছে। কিন্তু কেষ্টকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না সে বিষয়ে। বরং বললেন,
“চলো নিচে যাওয়া যাক।”
তিনজনেই নেমে আসে ধীরে ধীরে, যখন দ্বিতীয় তলায় খট্ খট্ শব্দ করা রুমের কাছে আসে তখন শুভেন্দু নানা কথার মধ্যে কেষ্টকে জড়িয়ে রাখে। আর এদিকে অমরেশবাবু জলদি কপাট খুলে ভেতরে প্রবেশ করে চারিদিকটা দেখতে থাকেন। হঠাৎ নজরে আসে শোবার খাটের নিচে একটি বড়ো সিন্দুকের মতো বাক্স।কিন্তু তিনি সেটা খুলতে গেলেন না। আবার দরজাটা লাগিয়ে কেষ্টর সাথে নিচে নেমে এলেন। এদের নামতে দেখে কবিরাজ বিহারীলাল হেসে হেসে বললেন,
“সবকিছু দেখলেন তো!”
অমরেশ বললেন, “হ্যাঁ দেখলাম। খুবই সুন্দর বাড়িটা।”
“বিহারীলাল হাসি মুখে বললেন,
“হ্যাঁ .. হ্যাঁ .. অবশ্যই, সে তো সুন্দর বটেই, তা আপনার গল্পের নাম কী শুনি?”
“নাম এখনো ভাবিনি! তবে গল্পটা বেশ ভেবেছি।”
“হেঁ … হেঁ …. হেঁ … তা বেশ! তা বেশ।”
“আপনার সাথে আলাপ হয়ে খুবই ভালো লাগল। তবে আজ আসি, পরে আবার দেখা হবে।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই! দেখা তো এবার হতেই থাকবে।”
অমরেশ আর শুভেন্দু রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। তখন প্রায় সন্ধে নেমে গেছে। তারা মুচির বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।
রাত্রি ঠিক কাঁটায় কাঁটায় আটটা । ঘড়ির ঘণ্টা পড়লে দু’জনেই খাবার খেয়ে রুমের মধ্যে চেয়ারে বসে পড়লেন। শুভেন্দু দু’টো সিগারেট বের করে অমরেশকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কই, খাবে নাকি একটা?”
অমরেশ কিছু না বলে তার হাত থেকে একটা সিগারেটট নিয়ে ধরালেন। আবার শুভেন্দু জিজ্ঞেস করলেন,
“কী বুঝলে?”
“কোনটা!”
“আসল খুনিটা কে হতে পারে!”
“সকলেই।”
“মানে সকলেই কী করে হতে পারে!”
“সন্দেহটা সকলকে নিয়েই, কাউকে বাদ দেওয়ার জায়গা নেই।”
বাঁ হাতে কলমটা নিয়ে টেবিলের উপর ঠকঠক শব্দ করতে করতে অমরেশ বললেন,
“রাজা গিরীশবাবুর বোন, মেয়ে, কবিরাজ, এমনকি এই ভাড়াটে রুমে এর আগে যে থাকত ওকেশুদ্ধু, আরো কে কে বের হয় তা সবুর করো, দেখতে পাবে।”
শুভেন্দু কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ওর সাথে এই খুনের কী সম্পর্ক?”
অমরেশের কাছে টেবিলে রাখা গল্পের বইগুলো হাতে নিয়ে শুভেন্দুকে দেখালেন,
“দেখছ এই বইগুলো, এগুলো রাজাবাবুর লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসা।”
“তুমি কী করে বুঝলে, যে এগুলো ওই বাড়ির লাইব্রেরি থেকেই নিয়ে আসা।”
“হ্যাঁ বুঝেছি, কারণ একই বই ওই বাড়ির লাইব্রেরির আলমারিতে রাখা আছে। আরেকটা বড়ো সন্দেহ হল, যে দিন রাজাবাবু মারা যান সেই রাতেই নাকি এই ব্যক্তিটি এই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে, পালিয়ে গেছে সেটা তার পরের দিন গোবর্ধন জানতে পারে। আরেকটা ব্যাপার কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। এই কদিনের মধ্যেই কেউ অন্ধ হয়ে গেল, সেটা কী সত্যিই ভূতে করেছে! নাকি – ”
“সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু গিরীশবাবুর বোনের সাথে তো আলাপ হল না, তা ওঁকে কী করে সন্দেহতে ফেলছ?”
এই প্রশ্নের উত্তরটা না দিয়ে বরং কথাটা উল্টে দিয়ে ঘুরিয়ে বললেন,
“কী এমন আছে ওই সিন্দুকের মধ্যে? আর কে ওই কবিরাজ বিহারীলাল? যার কথায় লীলাবতী উঠছে আর বসছে।”
শুভেন্দু মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “তোমার কথা শুনে আমারও সেই সকলকেই খুনি মনে হচ্ছে।”
“হ্যাঁ, কিন্তু এর আড়ালেই আসল খুনি লুকিয়ে আছে, কালকে একবার খোঁজ নিতে হবে কে এই কবিরাজ!”
সকাল সকাল শুভেন্দু আর অমরেশ বেরিয়ে পড়লেন রহস্যের খোঁজে, কিন্তু আজ রাজবাড়ি গেলেন না। বরং কবিরাজের আসল পরিচয় জানতে বেরিয়ে পড়লেন, কাশীপুরের গ্রামবাংলায়। কিন্তু কেউ আর ওই কবিরাজের আসল পরিচয় দিতে পারে না। সকলেই শুধু এইটুকুই জানে যে, উনি রাজাবাবু মারা যাওয়ার পর আসেন। নির্দিষ্ট কোনও রহস্যের খোঁজ না পাওয়ায়, শুভেন্দুকে বাড়ি পাঠিয়ে অমরেশ হুগলী চলে যান সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির খোঁজে। এদিকে শুভেন্দু ফিরে এল।
সন্ধে নেমে এসেছে, আকাশে চাঁদের আলো ফুটে উঠেছে চারিদিকে, অমরেশ ফিরে আসে। ক্লান্তি দূর করতে চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছে। এদিকে নিচে বারান্দায় বসে মুচি নিজের কাজে লেগে আছে। হঠাৎ জোরে হাঁক পড়ল।
“ওহে গোবর্ধন বাড়িতে আছ?”
গোবর্ধন গেটের দিকে তাকিয়ে দেখে কেষ্ট আসছে। সেও বলল, “এসো কেষ্টদা।”
“হ্যাঁ শুধু শুধু আসিনি, যেটার জন্য এসেছি সেটা তো জানোই।”
গোবর্ধন ‘হ্যাঁ’ বলে চলে এল বাড়ির ভেতরে। তার পর দু’জনেই মেতে উঠল মদ্যপানে। এদের কথাবার্তা শুনে অমরেশ এর ঘুম ভেঙ্গে যায়, দু’জনেই নিচে নেমে এসে এদের পাশে রাখা চেয়ারে বসলেন। অমরেশ আর শুভেন্দুবাবুকে দেখে কেষ্ট বলল, “আপনারা এখানে?”
অমরেশ বললেন, “হ্যাঁ বলেছিলাম না যে পাশের বাড়িতেই থাকি।”
গোবর্ধন কেষ্টকে বলল, “তুমি চেনো এঁদেরকে?”
“হ্যাঁ, তা চিনব না, রাজবাড়ি গিয়েছিলেন।” কেষ্ট গ্লাস ভর্তি মদটা নিয়ে অমরেশের দিকে এগিয়ে বলল,
“খাবেন একটু, এই নিন।”
অমরেশ বললেন, “না, না, তোমরা খাও।”
কিছুক্ষন সময় অতিবাহিত হওয়ার পর, যখন দু’জনেই নেশাগ্রস্ত তখন অমরেশ কেষ্টকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি ওই বাড়িতে কত দিন ধরে আছ?”
কেষ্ট হেসে হেসে বলল, “আমি, হেঁ .. হেঁ .. হেঁ .. দিন বলবেন না মশাই দিন বলবেন না, বছর বলুন বছর, গত পনেরো বছর ধরে আছি।”
অমরেশ তা শুনে বললেন, “তাহলে তো তুমি রাজাবাবুর অনেক বিশ্বস্ত, তাহলে তোমার কোনও ইচ্ছে রাজাবাবুও বাকি রাখেননি বোধহয়!”
কেষ্ট রেগে গিয়ে বলল, “হ্যাঁ আমি বিশ্বস্ত ঠিকই, কিন্তু ওই রাজামশাই এতই হাড় কিপটে যে আমার দরকারে কুড়ি হাজার টাকা চেয়েছিলাম। কিন্তু না বলে দিয়েছিলেন।”
“ওও এতই কিপটে! তা তুমি বিহারীলালকে কত দিন থেকে চেনো?”
“এই তো কদিন আগেই দিদিমনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন, তার আবার এসে বড়ো বড়ো হুমকি দুমকি। যেন ওর বাপের বাড়িটা।”
অমরেশ আরো দৃঢ়ভাবে বললেন, “লীলাবতী তোমাকে টাকাটা দেননি?”
“না .. না, দিল না, আর দিদিমনির হাতে তখন কিছুই ছিল না, এই তো কদিন হল সব কিছু এখন ওঁর হাতে। কিন্তু কিছু দিন আগে রাজাবাবু নিজেই দিদিমনিকে তাড়িয়ে দিচ্ছিলেন।”
এবার শুভেন্দু কৌতুহল হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন, কেন?”
কেষ্ট নেশার ঘোরে বলে যেতে লাগল, “আরে ওই যে কী সব ভালোবাসাবাসি তার জন্য। এক গরীব নিচু জাতের ছেলেকে দিদিমনি বিয়ে করবে বলে সন্ধেবেলায় রাজবাড়িতে নিয়ে আসে রাজামশায়ের সাথে আলাপ করাতে। কিন্তু রাজাবাবু দেখে শুনে রেগে উঠিলেন, খুব বকাঝকা করে ছেলেটিকে তাড়িয়ে দিলেন, আর যদি দিদিমনি আর ওই ছেলেটার সাথে মেশে তাহলে দিদিমনিকেও তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিলেন। আর দিদিমনি তো রাজবাবুর নিজের মেয়ে নয়, দত্তক নেওয়া।”
অমরেশ আর কিছু জিজ্ঞেস না করেই উপর তলায় চলে গেলেন। সাথে শুভেন্দুও। কেষ্ট আর গোবর্ধন ওইখানেই ঘুমিয়ে পড়ল।
শুভেন্দুবাবু রুমে প্রবেশ করতে করতেই জিজ্ঞেস করলেন, “কেস তো বেশ জন্ডিস!”
“হ্যাঁ, একদম, চলো একদিকে যেতে হবে।”
“এত রাতে কোথায় যাবে, ঘড়ির কাঁটাটা দেখেছ – বারটা বাজতে চলেছে।”
অমরেশ ছোট টর্চচটা খুঁজতে খুঁজতে বললেন, “হ্যাঁ … হ্যাঁ, জানি, এখনই সময় প্রবেশ করার।”
শুভেন্দু জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাবে?”
“রাজবাড়িতে, ওই পিছনের ভাঙ্গা গেটটা দিয়ে।”
দুজনেই বেরিয়ে পড়ল হাতে একটা ছোটো টর্চ নিয়ে। মুচির বাড়ি থেকে বেরিয়ে পিছন দিকের রাস্তাটা হয়ে হাঁটতে লাগল রাজবাড়ির দিকে। ধীরে ধীরে প্রবেশ করল, রাজবাড়ির লাইটগুলো সব নেভানো আছে। তাই শুভেন্দু ধীর গলায় বললেন, “ঘুমিয়ে গেছে সকলেই, কোনখানে যাবে বলো?”
অমরেশ ধীরে ধীরে বললেন, “লীলাবতীর শোবার রুমে, রাজাবাবুর রুমের চাবিটা আনতে।”
ধীরে ধীরে দু’জনেই অন্ধকারে বাড়িতে প্রবেশ করল একেবারে লীলাবতীর রুমে, কিন্তু দু’জনেই দেখে অবাক। লীলাবতী নিজের রুমে নেই আর সব রুমগুলোই অন্ধকার শুধু মাত্ৰ রাজাবাবুর শোবার রুমে একটি ছোট লাইট যেন জ্বলছে। সাথে সাথেই দু’জনেই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে একবারে ধীরে ধীরে। রুমের কাছে আসতেই পাশের জানালাটা ধীরে ঠেলে দেখে লীলাবতী একটা ছোট্ট ল্যাম্পের আলো নিয়ে রাজবাবুর আলমারিটা চাবি দিয়ে খুলছে।
শুভেন্দু ধীর গলায় বললেন, “এটা কি করে সম্ভব?”
অমরেশ গম্ভীর গলায় বললেন, “ঘড়ির কাঁটার সাথে ‘চরিত্র’ এর আচরণে যখন পরিবর্তন নজরে আসে, তখন মনে তো প্রশ্ন চিহ্ন জাগবেই। এখন শুধু দেখার অপেক্ষায় শুভেন্দুবাবু …. জালে রুই মাছ নাকি কই মাছ … ফেঁসেছে!”
“কে? কে ওখানে! এত রাত্রিতে কে ওখানে?”
লীলাবতী বার বার ডাকা সত্ত্বেও কিন্তু কোনও সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না, শুধু একটা বিড়ালের গলার আওয়াজ ছাড়া। এদিকে অমরেশ আর শুভেন্দু সে রকম প্রমাণ না পেয়ে ওই মুহূর্তে লীলাবতীকে হাতেনাতে ধরতে না গিয়ে সেখান থেকে দু’জনেই বেরিয়ে নিজেদের রুমে চলে এলেন। সে রাতে, মনে শুধু সন্দেহের জাল বুনে চলেছে, কারও চোখে ঘুম নেই।
পরের দিন সকালেই রাজবাড়ি থেকে ডাক পড়ল, দু’জনকেই ডেকে পাঠিয়েছে। অমরেশ আর শুভেন্দু আগের মতোই পোশাক পরে গেলেন। প্রবেশ করতে না করতেই দেখলেন বারান্দার মাঝে বসে আছে রাজ পরিবারের সকলেই, সাথে কবিরাজ। এঁদের বসতে দিয়ে লীলাবতী বললেন,
“অত রাত্রিতে আমাদের বাড়িতে কেন এসেছিলেন আপনারা? আপনাদের এত সাহস যে একটি অজানা বাড়িতে অত রাতে প্রবেশ করেছেন।”
শুভেন্দু মনে মনে ভাবছিল যে অমরেশ এবারেও মিথ্যে বলবে। কিন্তু না, পুরো কাহিনীটা পাল্টে দিল। অমরেশ জোর গলায় বললেন,
“নমস্কার লীলাবতী দেবী, আমি সত্যদা!”
লীলাবতী অমরেশের মুখে সত্যদা নামটা শুনে অবাক হয়ে ভয়ে ভয়ে বললেন,
“আপনিই কি বিশিষ্ট গোয়েন্দা সত্যদা?”
“হ্যাঁ, আমি এই সত্যদা, আর ইনি হচ্ছেন আমার আসিস্টেন্ড শুভেন্দু ঘোষ।”
লীলাবতী কী বলবেন খুজেঁ পাচ্ছেন না, সেই সময়ে কবিরাজ বললেন,
“আপনারা গোয়েন্দা তা আগে জানাননি কেন?”
অমরেশ হেসে হেসে বললেন, “আপনিও তো আমাদের অনেক কিছুই জানাননি।”
“মানে, মানে কী বলতে চাইছেন আপনি।”
“না.. না.. কিছু না, সময় সব বলবে ,এখন শুধু লীলাবতী দেবীর কাছে আমার কিছু প্রশ্ন আছে।”
লীলাবতী তা শুনে বললেন, “দেখুন সত্যদা আমি কোনও কিছুই জানি না। আমি সেই রাতের ঘটনা কিছুই জানি না।”
“না, না, আমি সেই রাতের কথা কি একবারও বলেছি! আমি তো কালকে রাতের কথা জানতে চাই। অত রাতে রাজাবাবুর রুমে কি করছিলেন আপনি? আপনি তো চোখে দেখতে পান না, তাহলে সিঁড়ি দিয়ে গেলেন কী ভাবে?”
“আমি, আমি তো বাবার রুম থেকে একটা ডাইরি আনতে গিয়েছিলাম, আর প্র্যাকটিস হয়ে গেছে অন্ধকারে চলা, কারণ সবসময় তো এখন আমার চোখে কালোই ভাসছে। তাই কোনটা রাত, কোনটা দিন তাতে কিছু এসে যায় না।”
“ডাইরি..! আপনি তো চোখে দেখতে পান না, তাহলে ডাইরি নিয়ে কী করবেন?”
“হ্যাঁ, সে তো দেখতে পাই না। কিন্তু ডাইরিটা আমার জন্য নয়, আমার এক ভাগ্নে খুঁজেছিল।”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পারমিতা দেবী রেগে উঠলেন। এমনিতেই তাদের মধ্যে রাজবাড়ির সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা চলছে, তাই রেগে গিয়ে বললেন,
“মিথ্যে কথা! একদম মিথ্যে কথা, আমার ছেলে কোনও ডাইরি খুঁজছে না। অলক্ষী আমার দাদাকে মেরে এখন পুরো সম্পত্তি গিলতে চাইছে।”
লীলাবতী রেগে বললেন, “চুপ করো, একদম বেশি কথা বলবে না। থাকতে দিয়েছি তার আবার বড়ো বড়ো কথা।”
শুভেন্দু পারমিতা দেবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “থামুন … থামুন .. আচ্ছা পারমিতা দেবী আপনার ওই রুমে সিন্দুকটি কার?”
পারমিতা দেবী হতভম্ব হয়ে বললেন, “সিন্দুক..! কোথায় সিন্দুক? আমার কাছে কোনও সিন্দুক টিন্দুক নেই।”
“তাহলে ওই দু’তলায় কার সিন্দুক খুলছিলেন?”
“ওটা, ওটা আমার বাক্স, কোনও সিন্দুক নয় ওটা।”
অমরেশ হেসে বললেন, “যখন চোরের ঘরে বসে গোয়েন্দা! চোর খোঁজে কতো বাহানা।”
এই শুনে কবিরাজ বললেন, “দেখুন আপনি শুধু শুধুই কাউকে যা তা বলতে পারবেন না”।”
“না, না, আমি কাউকে কিচ্ছু বলছি না। আচ্ছা লীলাবতী দেবী একবার চাবিটা দিন তো।”
লীলাবতী বললেন, “কিসের চাবি?”
অমরেশ লীলাবতীর কোমরে ঝোলানো চাবির গোছাটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “রাজাবাবুর শোবার রুমের চাবি, ওই যে যেটা আপনার কোমরে ঝুলছে।”
চাবি দিতে রাজি না হলেও কোনও ভাবে চাবিটা নিয়ে ওপরতলায় একেবারে রাজামশাইয়ের রুমটি খুলে সেই আলমারির কাছে গেলেন, কিন্তু সেখানে আর কিছু নেই কিছু বই আর একটা ডাইরি ছাড়া। সাথে সাথে রুম থেকে বেরিয়ে সোজা প্রবেশ করলেন লীলাবতীর রুমে, কিছুক্ষণ খোঁজখুঁজির পর আলমারির নিচ থেকে কিছু দলিল বের করে অমরেশ বললেন, “এগুলো কিসের দলিল, আর এইভাবে নিচে রাখা আছে কেন?”
লীলাবতী এগিয়ে এসে দেখে বললেন, “এগুলো এই বাড়ির দলিল, এখানে পড়ে গেছে।”
“ও … এই নিন, তবে আজ চলি। কিন্তু হ্যাঁ, খুব শীঘ্রই আসব।”
এই বলে বেরিয়ে গেলেন অমরেশ আর শুভেন্দুবাবু।
সন্ধে বেলায় যখন অমরেশ আর শুভেন্দু রুমের ভেতর চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে, সেই সময় হঠাৎ দরজায় নাড়া দেয়। ঠক্ ঠক্ ঠক্ করতেই থাকে, শুভেন্দু চেয়ার থেকে উঠে দরজার খিলটা খোলে – দেখে কবিরাজ বিহারীলাল। ওঁকে দেখে খানিকটা চমকে গিয়ে শুভেন্দু জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি এখানে, তাও আবার এই সময়ে!”
কবিরাজ বিহারীলাল হালকা হেসে বললেন, “হেঁ .. হেঁ .. হেঁ .. ওই আর কী, বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই বলি একটু দেখা করে যাই।”
শুভেন্দু সম্পূর্ণ দরজাটা খুলে বললেন, “আসুন .. আসুন .. ভেতরে আসুন।”
বিহারীলাল ভেতরে এসে বসলেন, তাকে দেখে অমরেশ জিজ্ঞেস করলেন,
“কি ব্যাপার বিহারীলাল বাবু, আজ পথ ভুলে, নাকি এই বাড়িতেও ভূত লেগেছে!”
“না, না, তেমন কিছু না। ভাবলাম দেখি যদি আমি আপনাদের কিছু সাহায্য করতে পারি।”
অমরেশ হেসে হেসে বললেন, “আপনি সাহায্য করবেন! তাহলে তো রহস্যের সমাধান হয়েই গেল।”
“আরে কী যে বলেন মশাই, আমি ওই একটু আধটু __।”
“তা বেশ, তা বেশ, তো আপনার কী মনে হয়, খুনটা কে করেছে?”
“সেটা তো আমিও সঠিক জানি না, তবে হ্যাঁ আমার একজনকে পুরো সন্দেহ আছে, আমার মনে হয় সেই খুনটা করেছে।”
“ও … তো কার উপর এত সন্দেহ!”
বিহারীলাল হালকা ধীর গলায় বললেন, “শুনেছিলাম রাজাবাবুর সাথে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসে, এখানেই ছিলেন কয়েকদিন, আর যে রাতে রাজামশাই মারা যান সেই রাতেই নাকি উনি পালিয়েছিলেন।”
অমরেশ জিজ্ঞেস করলেন, “কোথাকার ছিলেন সেই ব্যক্তিটি?”
“ওই যে কলকাতা নাকি হুগলীর বটে ভদ্রলোক।”
পাশে বসে থাকা শুভেন্দু বিহারীলালকে জিজ্ঞেস করলেন, “ তা আপনি জানলেন কী করে?”
কবিরাজ হেসে হেসে বললেন, “হেঁ .. হেঁ .. হেঁ কী যে বলেন! ওদের বাড়িতে আলোচনা হচ্ছিল, তাই আপনাকে জানাতে চলে এলাম যাতে আপনার সুবিধা হয়। ঠিক আছে তবে আজ আসি।”
এই বলে বিহারীলাল বাবু চলে গেলেন। শুভেন্দু দরজার খিলটা আটকে দিয়ে, চেয়ারে বসে অমরেশকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার বলো দেখি, ওই বাড়ির কথা উনি নিজে এসে জানাচ্ছেন।”
অমরেশ হেসে বললেন, “রহস্যটা খুবই গোল
তুমি ধরতেই পারবে না,
কে আসল, কে নকল!”
পরের দিন সকালেই বেরিয়ে গেলেন লীলাবতীর প্রেমিকের সন্ধানে, কিন্তু সেই প্রেমিককে খুঁজে পাওয়া গেল না। কেউই নাকি দেখেনি এই কদিন ধরে, কিন্তু সে যে দেখতে কেমন সেটার কথা সকলেই প্রায় একই বলছে, আর তাকে চেনার সব চেয়ে বড়ো একটা চিহ্ন তার বাম হাতের কড়ে আঙুলের অর্ধেকটা নেই, মাঠে ঘাস কাটতে গিয়ে নাকি কেটে গিয়েছিল, তাই আর পূরণ হয়নি। অবশেষে সেই রাতে খুনির রহস্য ফাঁস করতে যাওয়ার আগে দুপুরবেলায় ইন্সপেক্টর রঞ্জন ব্যানার্জিকে খবর পাঠান যে আজ রাত ঠিক আটটার সময় তিনি যেন আরো কয়েকজন পুলিশ নিয়ে রাজবাড়িতে আসেন।
বিকেল ঘনিয়ে সন্ধে নেমে এল। রাজবাড়ির সকলেই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় আগমন হল ডিটেকটভ অমরেশ আর সাথে শুভেন্দুবাবু। সামনে কেষ্টকে দেখতে পেয়ে অমরেশবাবু বললেন, “বাড়ির সকল সদস্যকে একবার আসতে বলো গিয়ে।”
ক্ষনিকের মধ্যেই সকালেই জমা হল। শুভেন্দু আর অমরেশ পাশাপাশি বসলেন আর তাদের মুখোমুখি লীলাবতী, এবং ডানদিকে কবিরাজ বিহারীলাল, তার পাশে একটি চেয়ারে পারমিতা দেবী। লীলাবতী বললেন,
“কী এমন প্রয়োজন, হঠাৎ করে এই ভাবে ডাকলেন?”
অমরেশ বললেন, “তেমন কিছু না, কিছু প্রশ্ন আছে। দিয়ে আমরা এই কাশীপুর থেকে বাড়ি ফিরব কালকেই।”
লীলাবতী আর কিছু বললেন না। অমরেশ পারমিতা দেবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “পারমিতা দেবী আপনার স্বামীর নামটা কী যেন?”
পারমিতা দেবী উত্তর দেওয়ার জায়গায় প্রশ্ন করে বসলেন, “কেন, আমার স্বামীর সাথে এই খুনের কী সম্পর্ক?”
অমরেশ বললেন, “নামটা তবে আমিই বলি, দেবানন্দ অধিকারী ঠিক তো? উনি নাকি খুব গরিব পরিবারের ছেলে, ভালোবাসা করে বিয়ে করায় আপনার দাদা সেভাবে আপনাকে সাহায্য করেননি, তাই টাকা পয়সার সংকটের জন্য আপনি এখানে চলে আসেন, তাই তো?”
পারমিতা দেবী রেগে গিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি এখানেই থাকি, তাতে আপনার কোনও অসুবিধা?”
“না আমার ঠিক কোনও অসুবিধা নেই। এবার লীলাবতী দেবীকে কিছু প্রশ্ন করব। ঠিক ঠিক উত্তর দেবেন লীলাবতী দেবী, ভুল কিছু বললে আপনার জালে আপনিই ফেঁসে যাবেন।”
লীলাবতী নড়ে চড়ে বললেন, “কী এমন প্রশ্ন?”
অমরেশ লীলাবতীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি তো প্রায় তিন বছর বয়স থেকে এই বিশাল রাজবাড়িতে রয়েছেন, রাজবাবুর কোনও সন্তান না থাকায় এক বিধবা মহিলার কাছ থেকে তিন বছরের মেয়েকে উনি দত্তক নেন, এবং সে এই বাড়িতেই বড়ো হয়ে ওঠে, আর সেই মেয়ে গত দুই বছর আগে প্রেমে পড়ে, কী যেন নাম তার?”
লীলাবতী ভয়ে ভয়ে বললেন, “আমার অতীতের সাথে এর কী সম্পর্ক।”
“আছে আছে, সম্পর্ক আছে বলেই তো জানতে চেয়েছি, কী নাম তার?”
“দীনেশ কুমার।”
“হ্যাঁ, দীনেশ কুমার, কিন্তু আপনার বাবা মানে গিরীশবাবু সেটা মেনে নিতে চাননি। কারণ তাঁর এক বোনের অবস্থা দেখে কোনও বাবাই চাইবে না, যে তার মেয়েরও একই অবস্থা হোক। তাই দীনেশ কে তাড়িয়ে দেন এবং আপনাকেও ধমকি দেয় যে ওর সাথে আর কখনো দেখলে আপনাকেও বাড়ি ছাড়া করবে। এই কথা যখন দীনেশের কানে যায়, সে ভয় খেয়ে যায়, আপনাকে এবং আপনার বাবার এই পুরো সম্পত্তি হারানোর ভয়। তাই সে আপনার বাবাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করে, যেটি প্রথমে আপনি জানতেন না। কিন্তু সাত দিন আগের রাতে একটি ঘটনা ঘটে যায়। ঠিক ঘড়ির কাঁটা যখন বারটার ঘর ছোঁবো ছোঁবো তখনও গিরীশবাবু ঘুমাননি কারণ হুগলী থেকে আসা অতিথি সুনীল সাহেব এর সাথে গল্পের তালে ঘড়ি দেখতে ভুলে যান। ঠিক বারটার ঘন্টা পড়ার পর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি মুচির বাড়ি যেখানে তিনি ভাড়াটে নিয়েছিলেন সেইখানে যেতে চান, কিন্তু গিরীশবাবু আটকে দেন এত রাতে ওঁকে যেতে দেন না। আর তিনি থাকতে রাজি হয়ে যান। কিন্তু শোবার আগে সুনীল সাহেব বাথরুমের দিকে যান। সেই সময় আপনার প্রেমিক রাজাবাবুর সাথে কেউ আছে কিনা, তা না জেনেই শুয়ে থাকা রাজামশাই এর মুখের উপর বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। হঠাৎ সুনীল সাহেব তা দেখে চেঁচিয়ে ওঠে। আর আপনি ছুটে যান রাজাবাবুর রুমের দিকে। কিন্তু আপনি দেখেন আপনার প্রেমিক দীনেশ সুনীল সাহেবকে মেরে ফেলার জন্য ছুটে নেমে আসছে। এদিকে সুনীলসাহেব জীবন রক্ষার জন্য দৌড়ে বেরিয়ে আসেন। সামনে থেকে এক ট্যাক্সি ধরে সোজা হুগলী। এদিকে আপনি উপরে উঠে দেখেন আপনার বাবা মারা গেছে। সেই সময় দীনেশ উপর তলায় ফিরে আসে, আপনি আপনার বাবাকে তো তখন হারিয়েছেন তাই আপনি আর প্রেমিককে হারাতে চাননি। সেই জন্য এই ভূত প্রেতের এক মায়া জাল সৃষ্টি করে দেন, তাই না।”
লীলাবতীর গলা শুকিয়ে যায়, তিনি ভয়ে ভয়ে বললেন, “আপনি এই সব কী করে জানলেন?”
অমরেশ বললেন, “আমি, আমি এই ঘটনা শুধু সুনীল সাহেবের কাছ থেকে শুনেছি তা নয়।” এই বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কেষ্টর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ অন্য দিকে ফিরিয়ে বললেন, “আরো অনেকের কাছ থেকে একটু একটু করে জোগাড় করেছি।”
লীলাবতী বললেন, “আপনি হয়তো এটা জোগাড় করতে ভুলেই গেছেন বা কেউ হয়তো বলেনি যে দীনেশ বেঁচে নেই সেই রাতেই মারা গেছে। আমি তাকে মেরে ফেলেছি নিজের হাতে।”
অমরেশবাবু বললেন, “হ্যাঁ, আপনি সত্যিই দীনেশকে মেরে ফেলেছেন কিন্তু জীবনে নয়!”
হঠাৎ কবিরাজ বিহারীলাল বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, “আরে মশাই কী যা তা বলে যাচ্ছেন, ভেবেছেন একবারও?”
অমরেশ বিহারীলাল এর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কেন আপনার বিশ্বাস হয়নি বুঝি বি .. হারি .. লাল কুমার?”
বিহারীলাল হতভম্ব হয়ে বললেন, “মানে, মানে, ইয়ে দেখুন প্রমাণ ছাড়া আপনি কাউকে কোনও দোষারোপ করতে পারেন না।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই, বিহারীলালবাবু আপনার হাতের ঘড়িটায় কটা বাজে?”
বিহারীলাল ঘড়ি দেখার জন্য বাম হাতটা সামনে নিয়ে এসে ঘড়ি দেখে বললেন, “এই তো আটটা বাজতে সাত মিনিট বাকি এখনও।”
অমরেশ গম্ভীর ভাবে ওঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার বাম হাতের কড়ে আঙুলটা অর্ধেক কেন? বাকিটা কি করে কাটল?”
বিহারীলাল বাবু হতভম্ব হয়ে বললেন, “ইয়ে মানে, ভুলবশত কাটা গিয়েছিল।”
“ভুলবশত নাকি ঘাস কাটতে গিয়ে!”
লীলাবতী দাঁড়িয়ে বলেন, “দেখুন দীনেশ মারা গেছে তাই আমি হাত জোড় করছি আপনারা এবার এই রকম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করা বন্ধ করুন।”
অমরেশ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে লীলাবতীর চোখ থেকে চশমাটা খুলতে খুলতে বললেন, “চশমাটা খুলে দিলাম যাতে দেখতে অসুবিধা না হয়। আর অভিনয়ের কোনও প্রয়োজন নেই।”
কথা বলতে বলতে বিহারীলালবাবুর কাছে গিয়ে ডান হাত দিয়ে দাড়িগুলো ধরে আর বাঁ হাতে তার মাথার চুলগুলো ধরে জোরে টানতেই সব খসে গেল। সকলেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, অমরেশ বললেন,
“কী দীনেশ কুমার, কি ভেবেছিলে ধরতে পারব না, তোমার আসল রূপ?”
এদিকে ঘড়ির কাঁটায় আটটার ঘন্টা বাজতে বাজতেই পুলিশ এসে হাজির, সাথে সাথে দীনেশের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। এবং ইন্সপেক্টর রঞ্জন ব্যানার্জি অমরেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে আসামিকে নিয়ে চলে গেলেন। এদিকে লীলাবতী কাঁদতে থাকে, অমরেশ তাকে শুধু একটা কথা বললেন,
“মিথ্যে দু’দিনের ভালোবাসার জন্য যে আপনাকে ছোটো থেকে মানুষ করেছে তাঁকে ভুলে যাওয়ার মতো বড়ো পাপ নেই। তাই এবার যারা আছে তাদের নিয়ে ভালো ভাবে জীবনযাপন করুন।”
এই বলে অমরেশ আর শুভেন্দু রাজবাড়ির বাইরের দিকে বেরিয়ে যেতে যেতে কেষ্টর কাছে দাঁড়িয়ে বললেন,
“এরপর কারও বাড়ি থেকে না বলে কিছু চুরি কোরো না। যদিও তোমার এই চুরিতে আমি তোমাকে দোষী বলে একটুও মনে করি না।”
এই বলে অমরেশ বেরিয়ে গেলেন সাথে সাথে শুভেন্দুবাবুও। দু’জনেই আবার নিজেদের বাড়ি কলকাতা ফিরে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লেন।
মানুষ তার নিজের বিবেককে হারিয়ে চলেছে লোভ লালসার মধ্যে দিয়ে। চাইলে সকলে মিলে এই পৃথিবীটাকে এক সুন্দর মায়াবী জগতে পরিণত করতে পারে শুধু তাদের চিন্তা ধারা পাল্টানোর মধ্যে দিয়ে। সেই দিন পৃথিবী স্বর্গের মতো সুখময় হয়ে উঠবে।