গুপ্তধন | বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | অনির্বান| Bengali Detective Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

কথাটা শুনেই হঠাৎ চমকে উঠেছিলাম। উঠে সোজা দৌড়ে বড়মা দের বাড়ি।

ঘড়িতে তখন সকাল ৮টা হবে, আমি প্রতিদিনের মতো বেরোনোর আগে নিজের সাইকেলটাকে মুছে প্রস্তুত হচ্ছিলাম।

আমার ভাইপো আমার পিছনে ঘুর ঘুর করছিল, হাতের কাছে স্ক্রু ড্রাইভার, রেঞ্জ এগিয়ে দিচ্ছিলো । অনেকটাই বড়ো হয়েছে সে, স্কুলে ভর্তি হয়েছে। সংকেত আমার জ্যাঠা বাবুর মেজো ছেলে বিধুদার ছেলে, তার দুষ্টুমি আর ভালো ভাবে বলতে না পারা জড়িয়ে যাওয়া কথায় সারা বাড়ি মেতে থাকে।

রাজুদা বিনীতাকে পড়াচ্ছিল। মাইকেল মধুসূদন এর লেখা “বিভীষণের প্রতি ইন্দ্রজিৎ”

-বিনীতা সংকেতের দিদি, ক্লাস এইটে পড়ে।

আমাদের সময় এই কবিতাটা আমরা ক্লাস টেনে পড়েছিলাম। ঠিকঠাক মনে নেই তবে যত দূর মনে পড়ে কবিতাটার নাম এটা না অন্য কি একটা নাম আছে তার থেকে কিছুটা অংশ তুলে নিয়ে এই সিলেবাসে দিয়েছে।

রাজুদা আমার মামার ছেলে, বাংলা বিষয় এ M.A পাস দিয়ে সরকারি চাকরি পাওয়ার আশায় নানা রকম পরীক্ষা দিচ্ছে। রাজুদা আমাদের বাড়িতে থাকে তা প্রায় এক বছরের বেশি হল। পড়াশোনা আর টিউশনের সুবিধার জন্য এখানে থাকে। কবিতাটা একটু একটু করে পড়ে তার মানে বিনীতাকে বুঝিয়ে বলছিল। আমি একটু একটু শুনছিলাম, সেই কবে পড়েছি আর মনে নেই তবে এটকু স্বীকার করছি সেই সময় এই কবিতাটা পড়তে রীতিমতো বেগ পেতাম।

দাদা বোঝাচ্ছিল আর আমি শুনছিলাম – ইন্দ্রজিৎ তার কাকা বিভীষণ এর বিশ্বাস ঘাতকতার জন্যে খুব রেগে গিয়ে তাকে নানা ভাবে বোঝাচ্ছিল। উদাহরণ স্বরূপ তাকে বলেছিল – “স্থপিলা বিধুরে বিধি স্থানুর ললাটে পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি ধুলায়”

‘বিধু’ অর্থাৎ চাঁদ কে ভগবান তার কপালে স্থান দিলে সে কি কখনও সেখানে না থেকে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে চাইবে? দাদা বোঝাচ্ছিল – শিব ঠাকুরের মাথায় চাঁদ শোভা পায় তাই তার আর এক নাম বিধুভূষণ.।

কথাটা শুনে বিনীতা হেসে বলল -আমি কি আমার বাবা কে এবার থেকে শিব ঠাকুর বলে ডাকবো?

আর এই কথাটাই আমার কানে আসতেই সব ফেলে দৌড়ে এসেছি বড়মা দের বাড়িতে।

বড়মা দের বাড়িতে গিয়েই বড়মাকে বললাম এখনই বড়োবাবার বাক্সটা খোলো, দরকার আছে।

আমার এই আকস্মিক আবদারে খানিকটা অবাক হওয়ার পর বড়মা জিজ্ঞেস করল -হঠাৎ বাক্স খুলে কি করবি?

আমি বললাম, আরে বাবা খোলোই না, তারপর তো দেখতে পাবে কী হবে।

বড়ো মা একগাল ভাত মুখে দিয়ে বলল, দাঁড়া খেয়ে নিয়ে খুলছি।

বড়মা দের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে না, একটুখানি মাত্র দূরত্ব, জোরে ডাকলে সে বাড়ি থেকে শোনা যায়। আমার দাদু পূর্ণশশীবাবু তেমন কিছু করত না, তবে এই মফস্বল এর মতো জায়গায় অনেকটা জায়গা জমি কিনে সেখানে ঘর বানিয়ে রেখেছে। জমিদার বাড়ির মতো না হলেও মোটামুটি ভালোই একটা বাড়ি। কিন্তু পরিবার বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমরা সবাই সেই জায়গাতে আলাদা আলাদা ঘর তৈরী করে থাকি। আমাদের আরও একটা ঘর আছে গ্রামে, হলিদিয়াতে। দাদু বেঁচে থাকতে পরিবারের সবাই সেখানে একসাথে থাকতাম। এখন সেটা এমনি পড়ে থাকে তালা বন্ধ হয়ে। শুধু চাষের সময় মাঝে মাঝে গিয়ে থাকা হয়, যদিও একটা ধানের করু আছে তবুও বেশি ধান হওয়ার জন্য চাষের সমস্ত ধান ওই ঘরের মধ্যে রাখা হয়।

চাষবাসের জন্য যত জায়গা জমি, ঘর সব দাদুর আমলেই। তারপর বাবা কাকারা আর কিছু করে যেতে পারেনি। সবার মধ্যে বড়োবাবা একমাত্র চাকরি করত। তিনিও একদিন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় মারা যান। হ্যাঁ তা প্রায় বছর চারেক হবে। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরের বছরগুলো তিনি শুধু বই পড়তেন আর একটা ফোন ছিল তাতে সারাদিন গান চালিয়ে শুনতেন। ওঁর একটা বাক্স ছিল যেটার চাবি উনি কাউকে দিতেন না। আজ আমি বড়মাকে সেই বাক্সটাই খোলার কথা বললাম।

মারা যাওয়ার পর শ্রাদ্ধের আগের দিন বাক্সটা খোলা হয়েছিল, আশা ছিল অনেক কিছু পাওয়া যাবে কিন্তু সবার আশাহত করে তার মধ্যে থেকে বেরোলো শুধু তিনহাজার সাতান্ন টাকা, একটা কালো পেপার এ মোড়া ছেঁড়া রামায়ণ আর একটা বড়মার নামে নমিনি করা এক লাখের জীবন বীমা। পরের দিন বীমা এজেন্টকে ডেকে সেটা দেখাতে গিয়ে তার মধ্যে থেকে একটা কাগজ বেরিয়ে ছিল, তাতে একটা কবিতা লেখা ছিল। যতদূর জানি বড়োবাবা কোনো কবিতা টবিতা জাতীয় কিছু লিখত না তবুও তাতে যেটা লেখা ছিল সেটা এইরকম —–

আছে আছে সব আছে

খুঁজে পেতে তোরা খা।

টুনটুনি আজও আছে

সেথা বসে দেয় তা। ।

এটা নয় শুধু ছড়া

মেকি নয় আগাগোড়া।

নাড়ানাড়ি করে দেখ

এখানেতে আছে এক

বহু দিন পুরানো

লুকানো শিব পুত্র

আজীবন সামলেছি

আমি শুধু মিছিমিছি

তব লয়ে রেখে গেনু অত্র।

লেখাটা দেখে বীমার লোকটা বলেছিল, দেখ, কাকাবাবু তোমাদের জন্যে কোনো মূর্তি তুর্তি রেখে গেছে কিনা। ওঁর কথা মতো আমরা সেদিন সারা বাড়ি খুঁজে বেড়িয়ে ছিলাম কোনো কার্তিক বা গণেশ ঠাকুরের মূর্তির। কিন্তু সারাবাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজার পর দেয়ালে টাঙানো একটা গণেশ ঠাকুরের ক্যালেন্ডার ছাড়া আর কিছু পাইনি সে দিন। আর সেটাতে আশ্চর্যকর তেমন কিছু পাওয়াও যায়নি সেদিন। তবুও বড়মার কথা মতো সেই ক্যালেন্ডারটা খুলে এনে যত্ন করে বাক্স এর মধ্যে রেখে দেওয়া হয়েছিল সেদিন।

আজ এতদিন পর আমার কথায় আবার সেই কবিতা লেখা কাগজটা বড়মা বের করল। এতক্ষনে হঠাৎ আমাকে দৌড়াতে দেখে আমার পিছনে পিছনে আমার বাড়ির সবাই এসে জড়ো হয়েছে এখানে.। জ্যাঠা বাবুর তিন ছেলেও এসে হাজির হয়েছে, কৌতূহলে আমাকে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় আমি কবিতাটা আরও একবার ভালো করে পড়ে নিয়ে বললাম – বড়বাবা শিব ঠাকুরের ছেলে মানে কোনো কার্তিক কিংবা গণেশ এর কথা এখানে বলে যায়নি, শিব মানে মেজদা (বিধু ভূষণ)র ছেলে সংকেত এর কথা বলেছে বলে আমার মনে হচ্ছে। আমরা সেদিন শুধু শুধু কার্তিক গণেশ খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম।

-শিব ঠাকুরের ছেলে মানেটা তো বুঝ লাম কিন্তু তা ছাড়া তো আর কিছু বোঝা গেল না।

এতক্ষনে রাজুদা আমার হাতথেকে কাগজ টা নিয়ে কয়েক বার পড়ার পর বলল -তুই ঠিকই ধরেছিস ওটা কার্তিক-গণেশ না ওটা সংকেতের কথাই বলেছে। আমার মনে হয় তোর বড়োবাবা কোনো গুপ্তধনের গুপ্ত সংকেত এর কথা বলছে রে এখানে এই দেখ..

রাজুদা কবিতাটা পড়ে পড়ে তার মানে বলছিলো আর আমরা সবাই তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে শুনছিলাম

রাজুদা বলল –

আছে আছে সব আছে

খুঁজে পেতে তোরা খা।

টুনটুনি আজও আছে

সেথা বসে দেয় তা। ।

পাখিরা তার ডিমে তা দেয় যখন তখন ওই ডিমগুলোই তার কাছে সবথেকে মূল্যবান জিনিস, সে তার জীবন দিয়ে ও সেগুলোকে রক্ষা করে। আমার মনে হয় উনি টুনটুনির তা দেওয়ার মাধ্যমে কোনো মূল্যবান জিনিস এর কথা বলতে চেয়েছেন। একটা গল্প ছিল না? সেখানে টুনটুনি বলেছিল রাজার ঘরে যে ধন আছে আমার ঘরেও সেই ধন আছে?

আর

লুকানো শিব পুত্র

আজীবন সামলেছি

আমি শুধু মিছিমিছি

তব লয়ে রেখে গেনু অত্র।

বলতে বুঝিয়েছে কোনো গুপ্ত সংকেত তিনি আজীবন ধরে যত্ন করে সামলে রেখে এখানে কোথাও রেখে গেছেন। বলেই রাজুদা বড়মাকে জিজ্ঞেস করল –

বড়ো পিসিমা এই লেখাটা তোমরা প্রথম কোথায় পেলে??

শুনে বড়মা বলল, বাক্স এর মধ্যেই সে দিনই দেখার পর বাড়িতে সবাই মিলে কার্তিক গণেশ খোঁজার পর কিছু না পেয়ে ওটাকে আবার বক্সের মধ্যেই রেখে দিয়েছিলাম। পরে দু এক বার খুলেছিলাম যদিও তবে ওটাতে আর হাত দেয়নি যেমন আছে অমনই পড়ে ছিল ওটা।

রাজুদা বলল আচ্ছা পিসিমা বাক্সটা কি আমি একবার দেখতে পারি?

বড়মা বলল, হ্যাঁ কেন দেখতে পাবে না? এই তো দেখ না।

রাজুদা বক্সের জিনিসপত্র নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগল |

আমরা কয় ভাই নিজে দের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হচ্ছিলাম।

এটাও কি সম্ভব, এই একবিংশ শতাব্দীতেও গুপ্তধন? আগেকার রাজাদের মতো আবার সেটা খুঁজে পাওয়ার জন্য গুপ্ত সংকেত? আমরা নিজেদেরকে চিমটি কেটেও যেন বিশ্বাস করাতে পারছি না।

রাজুদা বক্সের মধ্যে থাকা বড়োবাবার মৃত্যুর পরের ছবি, আলতা মাখা পায়ের ছাপ, গণেশ ঠাকুরের ক্যালেন্ডারটা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিলো.।

জ্যাঠা বাবুর ছোট ছেলে সিধুদা বলল, একটা জীবন বীমার কাগজ ছিল তবে সেটা তো ওরা নিয়ে নিয়েছে ওতে কি কিছু থাকতে পারে? যদি ওটাতে কোনো কিছু লেখা থাকে…

রাজুদা বলল, বীমা কোম্পানির কাগজে গুপ্তধনের সংকেত লিখে রাখার মতো ভুল পিসিমশাই করবে না কারণ উনি জানেন ওটা কোম্পানি থেকে নিয়ে নেয়.। কবিতাটা বক্সেই ছিল তারমানে সংকেত এই বক্সের মধ্যেই আছে কিন্তু কোথায়? বলে সব জিনিসপত্র গুলো নাড়ানাড়ি করতে লাগল আবার।

আমি বড়মাকে জিজ্ঞেস করলাম বক্সের মধ্যে একটা রামায়ণ ছিল না.?

বড়মা বলল – হাঁ একটা ছেঁড়া রামায়ণ ছিল, সেটা তোর বড়বাবা একটা কালো কাগজ দিয়ে মলাট করে রেখেছিলো, কিন্তু, সেটা তো আমি তোর ছোট বৌদিকে বলেছিলাম ঠাকুর ঘরে রাখতে। ছোট বৌদি ওটা বাক্স থেকে নিয়ে গিয়ে ঠাকুর ঘরে রেখে দিয়েছে মনে হয় জিজ্ঞেস কর।

আমি ঠাকুর ঘরে গিয়ে ঠাকুরের পায়ের কাছে থেকে লাল কাপড় দিয়ে মোড়া রামায়ণটাকে টেনে বার করে দেখতে দেখতে ছোট বৌদিকে জিজ্ঞেস করলাম লাল কাপড়টা কোথা থেকে এল?

বৌদি বলল উনি নাকি লাল কাপড়টা নিজেই বেঁধে রেখেছেন যাতে নষ্ট না হয় সেই জন্য।

এদিক সেদিক উল্টিয়ে কিছু না পেয়ে আমি সেটাকে ঠাকুর ঘর থেকে নিয়ে বারান্দায় বসে থাকা রাজুদার হাতে দিতে গিয়ে বইটা পড়ে গিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে গেল। ফলে কালো কভারটা থেকে গেল রাজুদার হাতে। ছড়িয়ে যাওয়া পাতাগুলোকে নিচু হয়ে একজায়গায় করতে করতে দেখলাম রাজুদা কালো মলাটটা কে আলোর দিকে ধরে মাথা ঝুকিয়ে কিছু একটা দেখছে।

দাঁড়িয়ে উঠে দেখলাম কালো মলাটটা কে আলোতে ধরলে তার উপর চক চক করে কিছু লেখা দেখা যাচ্ছে। আসলে কালো কাগজের উপর পেন্সিল দিয়ে লেখা তাই অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছিলো না কিন্তু আলোতে ধরার সাথে সাথে সেই লেখা চক চক করে ফুটে উঠেছে।

রাজুদা লেখাটাকে আলোতে ধরে পড়তে লাগল। বড়ো বাবার হাতে লেখা একটা চিঠি মতো, তাতে লেখা, “আমি নিজেই জানি না আদৌ কোনো মূল্যবান জিনিস বা গুপ্তধন বাবা রেখে গেছে কিনা। চাকরির সুবাদে আমাকে বাইরে থাকতে হত বাড়িতে আসার খুব একটা সুযোগ হয়ে উঠতো না তাই বাবা সবসময় আমাকে চিঠি লিখতো, উত্তরে আমিও লিখতাম। বাবার মারা যাওয়ার দু দিন পর এই রকমই একটা চিঠি আমার অফিসের ঠিকানায় গিয়ে পৌঁছায়। আমি তখন গ্রামের বাড়িতে ছিলাম বাবার শেষকৃত্য করার জন্যে। সব কাজ সেরে অফিস গিয়ে হাজির হলাম যে দিন আমার পিয়ন আমার হাতে চিঠি খানা দেয়। সেখানে অনেক হাবিজাবি লেখার শেষে একটা কবিতা লেখা ছিল কিন্তু এত দিনেও আমি সেটার মানে উদ্ধার করতে পারি নি। মূল্যবান জিনিস পাওয়ার আশা যেমন ছেড়ে দিয়েছি তেমন ভয়ও আছে ,তাই সেটাকে আরও বেশি করে সংরক্ষিত করে গেলাম। বাবার লেখা ছড়াটা একটা সুন্দর স্থানে সংরক্ষিত আছে। আমার যদি মৃত্যু ও হয় তবুও সেটা সেখানে কয়েকশ বছর সংরক্ষিত থাকবে। তবে সেই ছড়ার কাছে পৌঁছাতে গেলে তোমাদেরকে আমার এই ধাঁধাটার সমাধান করতে হবে –

দিন শেষে হরি হরি

মুখ বুজে বই পড়ি

মধু এসে রেগে বলে যা তা।

চাবি হল ছিন্ন ভিন্ন

হয়ে গেছি আমি বন্য

খুলে দেখ নীল রঙের খাতা।

আমরা সবাই নিজেরা নিজেদের দিকে তাকালাম।

রাজুদা বলল পিসে মশাই কোথাও নীল রঙের একটা খাতা লুকিয়ে রেখে গেছে কী? সেটাই আগে খুঁজে বের করো তা হলেই মিলবে দাদুর লেখা ছড়াটা।

সিধু দা ভ্রু কুঁচকে বলল -নীল রঙের কোনো খাতা বাবার ছিল ? মনে তো হয় না।

মেজদা বলল -যদি থেকে ও থাকে এত দিনে সে কী আর আছে?

কবে ফেলে দিয়েছে হয়তো।

রাজুদা বলল, ফেলে রাখার মতো জায়গায় খাতা রাখবে না পিসেমশাই। দেখলে না লেখা আছে কোনো এক সুরক্ষিত জায়গায় রাখা আছে খাতাটা? আমার যতদূর মনে হয় খাতাটা এমন একটা জায়গায় আছে যেটা সকলের সামনে অথচ খুব সুরক্ষিত জায়গা। কারণ উনি যেমন চাইতেন ওটা সুরক্ষিত থাকুক তেমনই এটাও চাইতেন আমরা খাতাটা যেন পাই।

সেদিন সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো নীল রঙের খাতা আমরা কেউই খুঁজে বের করতে পারলাম না। বড়োবাবার ঘরে শরৎ, রবীন্দ্র, বঙ্কিম, ব্যোমকেশ সমগ্র সবই আছে, আছে হোমিওপ্যাথির তিনটি বই আরও কত রকমের উপন্যাস ও ছোট গল্পের বই, কিন্তু সেগুলোর মধ্যে থেকে কোনো নীল রঙের খাতা পাওয়া গেলগেল না।

রাজুদা জিজ্ঞেস করল,- পিসিমশাই কী রাতেও বই পড়তেন?

মধু দা বলল – না না চাকরি শেষ হওয়ার পর বাবার চোখের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। আর উনি আবার চশমা নেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাই শেষের কয়েকটা বছর উনি দিনের বেলা বই পড়তেন। রাতে বই পড়তে কোনো দিন দেখিনি। আমি কাজ থেকে যখনই ফিরতাম দেখতাম ফোনে হয় গান শুনছে না হয় কোনো ভিডিও দেখছে। আমি তো মাঝে মাঝে বকাবকিও করতাম। এইদিকে ফোন চোখের সামনে ধরে ভিডিও দেখবে আবার কিছুক্ষন পর বলবে চোখ ব্যথা করছে।

যাইহোক অনেক খোঁজাখুঁজির পর ও কিছু না পেয়ে আমরা নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরলাম।

এর ঠিক দু দিন পর রাতে খাওয়ার পর শুয়ে শুয়ে মোবাইল ঘাঁটছিলাম। রাজুদা আমার ঘরে এসে এমনি জিজ্ঞেস করল – কি রে কী করছিস মোবাইল নিয়ে।

আমি দাদার সাথে মজা করেই বললাম – কিছু না দাদা এই একটু মুখ পুস্তিকায় চোখ বোলাচ্ছিলাম।

রাজুদা বলল – সেটা আবার কী পুস্তিকা রে?

আমি দাঁত বের করে এক গাল হেসে বললাম – কিছু না দাদা ফেসবুক। ঘুমের আগে একটু ফেসবুকে এদিক সেদিক দেখছি।

কথাটা শুনে দাদা খানিকটা হেসে বড়ো পাকা হয়েছিস, বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

রাত তখন কটা হবে জানি না, হঠাৎ রাজুদার ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল। চোখ কচলে উঠে দেখি উনি আমার খাটে এসে বসে আছে।

আমি ঘুমের মধ্যে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে ডাকছ কেন.?

রাজুদা বলল – তোর বড়বাবার ফোন ছিল তো একটা?

আমি বললাম হ্যাঁ ছিল তো

দাদা বলল- সেটা এখন কোথায়?

সেটা খারাপ হয়ে গেছে অনেক দিন হল মেজদার টিভির কাছে টেবিলে পড়ে আছে ,কেন?

রাজুদা কী জানি একটু ভেবে নিয়ে বলল – তোর বড়ো বাবার ফোন নম্বরটা তোর মনে আছে?

আমি বললাম – মনে নেই তবে আমার ফোনে সেভ করা থাকলেও থাকতে পারে। এই নাও ফোন খুঁজে দেখো পাও না কী, আমি ঘুমালাম।

সবে মাত্র আবার ঘুমটা এসেছে এমন সময় এক জোর ধাক্কায় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম।

রাজুদা প্রায় চিৎকার করার মতো করে লাফিয়ে বলল – পেয়েছি!

আমি তো অবাক হয়ে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছি। এত রাতে আবার কী পেল রে বাবা!

রাজুদা বলে চলল – আমরা একটা আস্ত গাধা বুঝলি তো, আস্ত গাধা!

তোর বড়ো বাবার ধাঁধার উত্তর পেয়ে গেছি। আমরা সবাই নীল খাতা খুজছিলাম তো? আসলে নীল রঙের কোন খাতাই নেই।

আমি বললাম তাহলে.?

রাজুদা বলল -ধাঁধাটা তোর মনে আছে?

আমি বললাম হ্যাঁ কেন থাকবে না? ওই তো –

দিন শেষে হরি হরি

মুখ বুজে বই পড়ি

মধু এসে রেগে বলে যা তা।

চাবি হল ছিন্ন ভিন্ন

হয়ে গেছি আমি বন্য

খুলে দেখ নীল রঙের খাতা।

রাজুদা একটু হেসে নিয়ে বলল – ধাঁধার উত্তর তো তুই আমাকে খুঁজে দিলি রে।

তোর বড়ো বাবার মুখ বুজে বই পড়া মানে কী জানিস? তুই যেমন খাওয়ার পর তোর মুখপুস্তিকা খুলে বসে থাকিস তেমনই উনি সন্ধের পর ওঁর মুখপুস্তিকা খুলে বসতেন আর গান শুনতেন হয়তো।

-ফেসবুকের  এর লোগো দেখেছিস? কোন রঙের বল তো?

আমি হেসে বললাম – তুমি না?ফেসবুকের লোগো কেন দেখব না নীল রঙের একটা ছোট হাতের f। রাজুদা বলল – পিসে মশাই নীল রঙের খাতা মানে কোনো নীল খাতা না রে, ওটা উনি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এর কথা বলেছেন।

এই দেখ তোর বড়ো বাবার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট।

বলে আমারটা আমার হাতে দিয়ে দিলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম সেখানে আমার অ্যাকাউন্ট এর জায়গায় বড়ো বাবার অ্যাকাউন্টটাই খোলা আছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম – রাজুদা, তুমি পাসওয়ার্ড ছাড়াই অ্যাকাউন্ট খুললে কী করে?

রাজুদা বলল কেন রে পিসিমশাই চাবি তো রেখে গিয়েছিল। প্রথমে ভাবছিলাম কাগজপত্র ছিঁড়ে ছিন্ন ভিন্ন করা যায় কিন্তু চাবি কী করে ছিন্ন ভিন্ন হয়? তার পর তোর কাছে মুখপুস্তিকা শোনার পর যখন মনে হল উনি ফেসবুকের কথা বলছেন, তখন মনে হল এই চাবি বলতে উনি পাসওয়ার্ড এর কথা বলছেন।

আর পাসওয়ার্ডটা হল ছিন্ন ভিন্ন অর্থাৎ 69v9

তোর মোবাইল থেকে ওঁর ফোন নাম্বার নিয়ে এই পাসওয়ার্ড দিতেই তো অ্যাকাউন্টটা খুলে গেল। দেখ এবার ওখানেও একটা ছড়া লেখা আছে যেটা তোর দাদু তোর বড়ো বাবাকে দিয়েছিল।

আমি দেখলাম বড়ো বাবার অ্যাকাউন্ট এর প্রোফাইল পিকচারটাই একটা ছড়া আর সেটা এই রকম –

রঙের খেলায় মাতলো ভুবন

রং ও লাগল তোমার মনে

প্রদীপ হাতে একলা বসে

তোমার আশায় ঘরের কোণে

রাজুদা বলল – দেখলি তো বলেছিলাম না? জিনিসটা সবার সামনেই আছে কিন্তু কী ভীষণ সুরক্ষিত।

– কিন্তু তোরা জানতিস না এই অ্যাকাউন্ট এর কথা?

আমি বললাম হ্যাঁ জানতাম কিন্তু ভয়ে কোনো দিন বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠাইনি। কিন্তু তখন বড়োবাবার একটা ফটো ছিল। এই ছড়াটা কবে লাগিয়েছে আমি দেখিনি।

কিন্তু রাজুদা এই ছড়াটার মানে কী?

রাজুদা হেসে বলল তোর বড়োবাবার মতো একটা জিনিয়াস লোক এই ছড়ার মানে বুঝতে পারল না আর আমি কী করে বুঝব বল?

ভাবো ভাবো বুদ্ধি খাটাতে খাটাতে ঘুমাও, বলে রাজুদা ঘর থেকে চলে গেলগেল।

আমি খাটে বসে বসে বললাম ঘুম হবে না ছাই। একটার পর একটা জটিল ধাঁধা, দূর ব্যাং ভাল্লাগে না। এই কবিতার মানেটা আবার কী কে জানে?

দ্বিতীয় ভাগ

প্রায় ঘন্টা দুই মতো সাইকেল চালিয়ে অবশেষে গ্রামের বাড়িতে এসে হাজির হলাম।

আবার প্রায় একবছর পর এলাম। আগের বছর শেষ এসেছিলাম ধান ঝাড়াই করে ঘরে তোলার সময়। আর এখন এলাম সেই ধান বিক্রি করার জন্যে, জ্যৈষ্ঠ মাস পড়ে গেছে আর কিছুদিন পর অম্বুবাচী, সেদিনই নতুন বীজতলা ফেলতে হয়। বহু দিন থেকে এই রীতি চলে আসছে। আবার চাষের সময় হয়ে এসেছে তাই গোলা ঘর সব ফাঁকা করে রাখতে হবে আবার পরের বছরের নতুন ধান উঠবে বলে। তাছাড়া এই জ্যৈষ্ঠ মাসের দিকে পুরানো ধানের দামটা একটু বেশি থাকে তাই এই সময়ই আমাদের ধানগুলো বিক্রি করা হয়। কাল ধান কেনার লোক আসবে। আমার কাজ হল ধান মাপার সময় পাশে দাঁড়িয়ে দেখা ঠিকঠাক হিসাব মিলিয়ে টাকা বুঝে নেওয়া। আর লোক ধরে চাষের আগে জমিগুলো একটু ঠিক ঠাক করে নেওয়া। প্রায় তিন চার দিন এখানে থাকতে হবে বলে মনে হয়। আমি একা আসতে চাইছিলাম না তাই মা রাজুদাকে আমার সঙ্গে পাঠিয়েছে। আগে এখানে বেশ ভালোই লাগতো কিন্তু এখন অসহ্য লাগে। যাইহোক দুজন মিলে এই কটা দিন কোনোমতে কাটিয়ে দেবো এখানে।

দুজন মিলে এখানে আসতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। পাশের বাড়ির কাকিমাকে আমাদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে একটা হ্যারিকেন আর রামুদা কে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খুললাম। লোকজন না থাকার ফলে ঘরের অবস্থা আর বর্ণনা করার মতো ছিল না। যাই হোক রামুদা আমার দাদুর থাকার ঘরটা একটু ঝেড়ে মুছে থাকার মতো করে দিল। এই একটা ঘরেই আসবাবপত্র আছে বাকি ঘরগুলো পুরো ফাঁকা। সেখানে শুধু ধানের ধানপতির বাস। আসবাবপত্র বলতে দাদুর থাকার খাট, একটা কাঠের দেরাজ, ঘরের এক কোণে জানলা। সামনে একটা টেবিল তাতে কিছু বইপত্র রাখা, আর একটা কাঠের চেয়ার।

এখানে কেউ না থাকার জন্য ঘরের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে অফিস থেকে তাই এখন হ্যারিকেনই ভরসা। মোবাইলটাকে কাকিমাদের ঘরে চার্জে বসিয়ে দিয়ে এসে দেখি, রাজুদা আমাদের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে খাটের পা এর দিকে দেয়ালে টাঙানো দাদুর নিজের হাতের তৈরী কাঠের ঘড়িটাকে চাবি দিয়ে দম দিয়ে চালিয়ে কাঁটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সময় ঠিক করছে। আর রামুদা পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি গিয়ে রাজুদাকে বললাম – কেন ঘড়িটাকে চালাতে গেলে? ওর ঘন্টার আওয়াজে আমার রাতে ঘুম ভেঙে যায়।

পেন্ডুলামটা দুলিয়ে দিয়ে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে ঘন্টা বাজাতে বাজাতে রাজুদা বলল -এত দিনের পুরানো ঘড়ি এখনও ঠিক আছে দেখ.। এই ঘড়িগুলো দারুন জানিস তো। তবে এটার একটাই সমস্যা, কাঁটা ঘুরিয়ে সময় তো ঠিক করে দিলাম, যদিও এই যে চাবিটা ভিতরে আছে, এটাতে হাত দিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে বাজিয়ে ঠিক করতে হয়।

-এই ঘড়িটা কত দিনের পুরানো?

-আমি জানি না অনেক দিনের পুরানো মনে হয়, সেই ছোট থেকে দেখে আসছি আরও অনেক ঘড়ি ছিল এই রকমের। দাদু ঘড়ির মিস্ত্রি ছিল তো, এই সব তো ওঁর নিজের হাতে বানানো। রাতে সবকটা ঘড়ি এমন আওয়াজ করত ঘুম ভেঙে যেত তাই বাবার বকুনি শুনে সব বিক্রি করে দিয়েছিল দাদু। এই একটা মাত্রই নিজের ঘরে রেখে দিয়েছিল। আর তখন থেকে ওটা ওখানেই রয়ে গেছে কেউ আর নিয়ে যায়নি। বলে আমি ব্যাগ থেকে চাদর বের করে বিছানা ঠিক করতে লাগলাম।

রাজুদা হ্যারিকেন নিয়ে ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখতে লাগল. দেরাজ পুরোই ফাঁকা কিছু ছেঁড়া বই খাতা ছাড়া আর কিছু নেই। টেবিলে অনেক পুরানো দিনের পাঁজি আর অনেকগু লো ডাইরী।

রাজুদা চেয়ারে বসে ডাইরীগুলো উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল।

আমি রামুদাকে বললাম ঠিক আছে এবার আমরা সব গুছিয়ে নিচ্ছি তুমি বাড়ি যাও আর হ্যাঁ খাবার তৈরী হলে ডেকে নিও।

রামুদা চলে যেতে আমি বিছানায় নিজেকে একটু এলিয়ে দিলাম।

রাজুদা বলল তোর দাদু তো খুব হিসাবি লোক ছিল রে? কোথায় কত টাকা খরচ করেছে সব পাই টু পাই লিখে রেখেছে।

আমি বললাম হ্যাঁ শেষের দিকে দাদু টাকা সুদে ধার দিত, দেখো না প্রথম পাতায় সব লেখা আছে কার কাছে কত টাকা পাবে। কিন্তু ওঁর মারা যাওয়ার পর ওই ডাইরী দেখে গিয়ে কারোর কাছে থেকে আর কোনো টাকা উদ্ধার করা যায়নি। সবাই এখন অস্বীকার করছে।

আমি বক বক করেই যাচ্ছিলাম হঠাৎ রাজুদা টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা প্লাস্টিকের পুতুল বের করে বলল -এই অনি এটা কী রে?

আমি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে সেটা হাতে নিয়ে দেখলাম পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্লাস্টিকের তৈরী একটা ছোট্ট ক্যাঙ্গারুর মূর্তি। তার বাচ্ছা থাকার থলির উপরে একটা কাগজ আঠা দিয়ে লাগানো আছে। আর তাতে একটা কবিতা লেখা –

হাসি হাসি মুখ করো?

নয় এটা খেলনা,

সব কিছু ফেলা যাবে

এটা নয় ফেলনা।

সে তুমি যেই হও

আপন কিংবা পর।

যদি এতে দাও হাত

খাবে কানে চড়।

-এটা কি আমি জানি না, কোনোদিন দেখিনি। যদিও আমি কোনোদিন ড্রয়ার খুলে দেখিনি।

-যাই হোক কবিতা দেখে মনে হচ্ছে এটা খুব দামি জিনিস ছিল তোর দাদুর কাছে, থাক ওটাতে হাত দেওয়ার দরকার নেই, সেখানে ছিল সেখানে রেখে দিই, দে ওটা – বলে রাজুদা ওটাকে আমার হাত থেকে নিয়ে আবার সেটাকে ড্রয়ারে রেখে দিল।

এমন সময় রামুদা এসে খবর দিলো কাকিমা খাবার খেতে ডাকছে।

অনেকদিন পর আবার আমাকে পেয়ে কাকিমারা কত গল্প করল। রাজুদার সাথেও আলাপ করিয়ে দিলাম সবাইকে। মুগের ডাল আর পুকুরের টাটকা কাতলা মাছের ঝোল দিয়ে খিদের মুখে একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেল।

চার্জে থেকে মোবাইল টা খুলে নিয়ে বাড়িতে না গিয়ে দুই ভাই ঘুরতে বেরোলাম। খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে যাওয়ায় হেঁটে আসাটা একটু জরুরি হয়ে পড়েছিল।

ত্রয়োদশীর চাঁদ তখন গাছের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে, গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে আসা আবছা আলো আর হালকা দক্ষিনা বাতাস গায়ে মাখতে মাখতে সুতিখালের পাশে দিয়ে অনেকটা হেঁটে মাঠে গিয়ে হাজির হলাম, মন্ডলদের মাঠে। মাঠের এক পাশে ঝুলন মণ্ডপটা আলোআঁধারিতে ছায়া ফেলে একটা দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

আমি সেটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে রাজুদাকে বললাম – ওই যে মণ্ডপটা দেখছো ওটা মন্ডলদের, আগে মন্ডলরা এখানকার জমিদার ছিল। হোলির দিন এই মণ্ডপ এ রাধা কৃষ্ণের মূর্তি দোলনায় বসিয়ে পুজো করা হয়। আর সেই উপলক্ষে এখানে বিশাল মেলা হত তিন দিন ধরে হরিনামের আসর বসতো এখানে। এখন সে জমিদারও নেই আর তার জমিদারীও নেই। তবে মেলাটা হয় এখনও তবে আগের মতো জমজমাট করে হয় না। মাত্র একদিনই হয় তাও সেটা নিয়ম রক্ষার্থে।

রাজুদা রেগে গিয়ে বলল হোলি কী রে, অ্যাঁ হোলি কী? আমরা বাঙালি, বাংলায় ওটা কে দোল বলে, ফাগুনী পূর্ণিমার দিন হয় বলে ওটাকে দোল পূর্ণিমা বলে। ওই দিনই কৃষ্ণ রাধকে রং মাখিয়ে ছিল আর তবে থেকে ওই ফাগুনী পূর্ণিমার দিনে রং খেলার প্রথা চলে আসছে। হোলি তো অবাঙালীরা বলে হোলিটা প্রধানত হিন্দি শব্দ তুই দোল বলবি বুঝলি? এটা বলে কিছুক্ষণ কী একটা ভেবে নিয়ে রাজুদা আমরা ফোনটা চাইল।

আমি বললাম – কেন কী হবে?

রাজুদা ফেইসবুক খুলতে খুলতে বলল – তোর দাদুর সেই ছড়াটা মনে আছে তোর? যেটা উনি তোর বড়োবাবাকে দিয়ে গিয়েছিলেন?

আমি বললাম- দূর সে তো অনেক দিনের কথা। কী সব ব্যাঙের মাথা ছড়া, ওই আবার মনে থাকে নাকি?

রাজুদা ফেসবুক খুলে কবিতাটা পড়ে নিয়ে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল – চল পেয়ে গেছি, বলেই দৌড় লাগল।

হঠাৎ দৌড়াতে দেখে আমি ও পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে বললাম -এই রাজুদা আসতে চলো, দাড়াও, আরে বাবা কী পেয়েছ সেটা তো বলো।

রাজুদা দৌড়াতে দৌড়াতে বলল – ছড়াটার মানে পেয়ে গেছি, তাড়াতাড়ি ঘরে চল। ওই ছড়াটা আসলে হিন্দি শব্দ।

উফঃ আমি কী গাধা এই টুকু মাথায় এল না রং খেলার দিন সবাই রং খেলবে খামোকা প্রদীপ নিয়ে ঘরের কোনে বসে থাকবে কেন?

আমি বললাম এই রাজুদা বলো না একটু বুঝিয়ে, কিছু বুঝতে পারছি না।

হাঁফাতে হাঁফাতে রাজুদা বলল ছড়াটা দেখলি তো আমি বললাম হ্যাঁ ওই তো –

রঙের খেলায় মাতলো ভুবন

রং ও লাগল তোমার মনে

প্রদীপ হাতে একলা বসে

তোমার আশায় ঘরের কোণে

– রঙের খেলা বলতে তো “হোলি” বুঝ লাম কিন্তু তারপর -?

রাজুদা বলল হুম ঠিক ধরেছিস আর প্রদীপকে হিন্দিতে কী বলে?

আমি বললাম – কী বলবে আবার? “দিয়া” বলে!

রাজুদা বলল -এই তো বুদ্ধি খুলেছে। তাহলে দুটো মিলিয়ে কী দাঁড়াল??

আমি চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বললাম – “হলিদিয়া”? এই রাজুদা আমাদের গ্রামের নাম তো “হলিদিয়া!”

কথা বলতে বলতে দৌড়ে আমরা ততক্ষনে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছি।

রাজুদা ঘরের কোনের জানলাটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ড্রয়ারটা খুলতে খুলতে বলল –

প্রদীপ হাতে একলা বসে

তোমার আশায় ঘরের কোনে

মানে হল ঘরের কোনে কোনো কিছু একটা অপেক্ষা করছে।

বলতে বলতে ক্যাঙ্গারুর মূর্তিটা বের করে হাতে রেখে কবিতাটা আরও একবার পড়ে দেখল –

হাসি হাসি মুখ করো?

নয় এটা খেলনা,

সব কিছু ফেলা যাবে

এটা নয় ফেলনা।

সে তুমি যেই হও

আপন কিংবা পর।

যদি এতে দাও হাত

খাবে কানে চড়।

তার পর সেটাকে টেবিলে রেখে দুই হাত দিয়ে মূর্তিটার দুই কানে জোরে চাপ দিতেই, তার পেটের থলির উপরে কবিতা লেখা কাগজট ফেটে গিয়ে আরও একটা গুটানো কাগজ বেড়িয়ে এল।

রাজুদা সেটা বের করে ভাঁজ খুলে হারিকেন এর কাছে নিয়ে গিয়ে পড়তে লাগল –

বয়ে যায় বেলা

থেমে নেই ক্ষণ।

বলি যা আমি

মন দিয়ে শোন্।

একে একে তিন

পরে সাথে দুই,

তিন ভাগে মাঝখানে

জিভে হাত ছুঁই।

বিরক্ত হয়ে বললাম এই রাজুদা এই সব কী হচ্ছে বলো তো? একটার পর একটা ধাঁধা…

রাজুদা বলল – হ্যাঁ তাই তো দেখছি, তবে এত আড়ম্বর এত লুকোচুরি দেখে মনে হচ্ছে তোর দাদু বেশ ভালো কিছুই রেখে গেছে তোদের জন্যে।

– এখন একটু খাতা কলমের ব্যবস্থা কর দেখি হিসেব করতে হবে বলে মনে হয় …

আমি দৌড়ে পাশের বাড়ির কাকিমাকে গিয়ে বললাম – কাকিমা একটু কাগজ কলম দাও তো। কালকে ধান কেনার লোক আসবে, কত বস্তা ধান হবে তার হিসাব রাখতে হবে।

কাকিমা কিছু না বলে একটু কাগজ কলম এনে আমাকে দিল আর জিজ্ঞেস করল বালিশ চাদর কিছু লাগবে কী না। আমি না সূচক মাথা নেড়ে বাড়ি চলে এলাম।

এসে দেখি রাজুদা চুপচাপ বসে কী যেন ভাবছে আমাকে দেখে বলল – এনেছিস? দে আমার কাছে।

কাগজ কলম রাজুদার হাতে দিয়ে আমি টেবিলটার এক কোণে পা ঝুলিয়ে বসে দেখতে লাগলাম। হ্যারিকেন টা কে একটু কাছে টেনে নিয়ে সেটার আলোটাকে একটু বাড়িয়ে দিয়ে কাগজ কলম নিয়ে লিখতে লিখতে রাজুদা বলল – একে একে তিন অর্থাৎ এক যোগ এক তিন, কিন্তু তিন কী করে হবে? এক আর এক যোগ করলে তো দুই হয়?

আমি হেসে বললাম – হয় হয় একে একে যোগ করতে গেলে যদি ভুল করে ফেলো তাহলে তিন হয়।

রাজুদা একটু রেগে গিয়ে হালকা ধমক এর সুরে বলল – দেখ একদম বাজে ইয়ার্কি করবি না বলে দিলাম।

একে একে গুন ভাগ যোগ বিয়োগ যাই করি না কেন কোনও মতেই তো তিন হয় না। আচ্ছা আমি ধরেই নিলাম একে আর একে তিন হল, পরে সাথে দুই, এই দুইটা কী যোগ করতে বলছে? মুখে হাত দিয়ে বলল রাজুদা

যদি যোগও করি তিন আর দুই এ হল গিয়ে পাঁচ, তারপর –

তিন ভাগে মাঝখানে

জিভে হাত ছুঁই

মাঝখান বলতে পাঁচের অর্ধেক করলে গিয়ে দাঁড়ায় আড়াই, খানিকটা ভেবে বলল পাঁচের অর্ধেক বলছে না তিনের অর্ধেক? তিনে র অর্ধেক করলে হয় দেড়। কিন্তু এই সংখ্যাগুলো কী? এত ভগ্নাংশ? নাকি এইগুলো কেও যোগ করতে বলছে?

রাজুদা মাথা চুলকাচ্ছে আর খাতায় যোগ বিয়োগ করছে।

আমি হাবলাকান্তের মতো একবার খাতার দিকে আর একবার রাজুদার দিকে দেখছি।

রাজুদা আবার কলমটা তুলে নিয়ে বলল – আড়াই আর দেড়কে যদি আমি যোগ করি তাহলে হয় চার। অর্থাৎ নম্বরগুলো কত হল?

আমি খুব মনোযোগ দিয়ে হিসেব গুলো দেখছিলাম তাই বিশ্ব জয় করার মতো এক গাল হেসে বললাম ওই তো নম্বর গুলো হল ১৩২৪

রাজুদা বলল হুম কিন্তু নম্বরগুলো পর পর নয় কেন? ১২৩৪ নয় কেন?

১৩২৪ এটা কী শুধুই নম্বর? নাকি কোনো বইয়ের পৃষ্ঠা নম্বর? কিন্তু এতগুলো পৃষ্ঠা যুক্ত কোনো বই তো এখানে নেই।

খাতা পেন রেখে টেবিলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলল – এই অনি এটা কত সাল রে?

আমি বললাম – কত আবার দু হাজার কুড়ি! কেন?

রাজুদা বলল -ধ্যাৎ সে তো ইংরেজিতে, বাংলায় কত সাল সেটা বল?

আমি বললাম বাংলা সাল মনে আছে নাকি এখন আর কেউ বাংলা সাল ধরে হিসাব করে.? সেতো পুরানো দিনের লোকেরা করত।

রাজুদা বলল – সেই জন্যই তো বলছি তোর দাদু কী নতুন দিনের লোক? মোবাইলে দেখ কত সাল দেখে বল আমাকে।

আমি মোবাইলে ক্যালেন্ডার খুলে দেখছি ততক্ষনে রাজুদা দাঁড়িয়ে উঠে টেবিলের কোণে রাখা পুরানো পঞ্জিকাগুলো টেনে নিয়ে ধুলো ঝেড়ে একটা একটা করে দেখতে লাগল।

আমি বললাম – ক্যালেন্ডার তো দেখাচ্ছে বাংলায় ১৪২৬ সাল।

রাজুদা বলল – ১৩২৪ তার মানে প্রায় একশো বছর আগের, কিন্তু অত দিনের পুরানো পঞ্জিকা তো থাকার কথা না! তাহলে কী আমরা ভুল রাস্তায় হাঁটছি বলে কিসব বিড়বিড় করতে লাগল।

দুজন মিলে অনেক খুঁজে ও ১৩২৪ সালের পঞ্জিকা না খুঁজে পেয়ে হতাশ হয়ে আবার বসে পড়লাম।

কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর রাজুদা জিজ্ঞেস করল – আচ্ছা তোর দাদুর কোনো সিন্দুক ছিল কিংবা কোনো বাক্স? ব্যাংকে তোর দাদুর নামে কোনো লকার আছে নাকি জানিস? হতে পারে এই নম্বরগুলো তার নম্বর লক?

আমি বললাম – সিন্দুক তো ছিল না। একটা ছোট বাক্স ছিল তালা চাবি মারা ওইতো দেখো না খাটের তলায় পড়ে আছে। কিছু নেই ওর মধ্যে এখন, খোলাই আছে তালা চাবি মারা নেই। আর দাদু মারা গেছে অনেক দিন হয়েছে, ব্যাংকে লকার থাকলে এত দিনে আমরা সবাই জানতে পারতাম।

রাজুদা বলল তাহলে এই নম্বরগুলো কী? একে দুয়ে কী হয়?

আমি হেসে বললাম একে চন্দ্র হয়, দুয়ে পক্ষ হয়।

রাজুদা কিছুক্ষন ভেবে বলল – ঠিক বলেছিস। ছড়াটা ছিল –

একে একে তিন

পরে সাথে দুই

একে ‘চন্দ্র’ হয়, দুয়ে ‘পক্ষ’ – কৃষ্ণ আর শুক্ল পক্ষ।

তিনে ‘নেত্র’ অর্থাৎ জ্ঞান চক্ষু ধরে মোট তিনটি চোখ।

তিনটি চোখ কাদের থাকে?

আমি বললাম ঠাকুরদের থাকে |

রাজুদা বলল হুম কিন্তু কোন ঠাকুরের থাকে?

প্রায় সব ঠাকুরের তো তিনটে করে চোখ আঁকা থাকে – আমি বললাম।

রাজুদা বলল তিন চক্ষু দেবতা, তার উপর পূর্ণিমা, অমাবস্যা, চাঁদ তার মানে কী শিব ঠাকুরকে বোঝাতে চাইছে হয়তো? শিব ঠাকুরের মাথায় তো চাঁদ থাকে।

চল তো তোদের ঠাকুরথানে গিয়ে একটু দেখি কিছু পাওয়া যায় কিনা?

আমি বললাম, ঠাকুরথান বলে আলাদা করে আমাদের কোনো ঘর নেই, ঘরে ঢোকার মুখে বামদিকে যে ধানের গোলাটা আছে দেখলে না? ওটার তলায় ছোট মত একটা ঠাকুর থান। চলো নিয়ে যাচ্ছি –

মাটি থেকে প্রায় ফুট তিনেক মতো ইটের ভিত দিয়ে চারিদিকে ঘিরে তার উপর ছাদ মতো ফেলা, আর তার উপর বাঁশের চেটি দিয়ে আগর বুনে চার দিকে ঘিরে তাতে কাদামাটি লেপে গোলা বানানো। ছোট বেলায় দেখতাম ওটার মাথাটা খড়কুটো দিয়ে ছাওয়া হত প্রতি বছর। পরে অসুবিধা হত বলে টালির ছাউনি দিয়ে দিয়েছিল।

গোলার মধ্যে ওঠার জন্য একটা তিন ধাপ যুক্ত পোট করা আছে, আর তার থেকে কিছুটা দূরে অর্থাৎ ওই ভিতের মাঝ বরাবর ভিতটা কিছুটা ভিতরে দিকে ঘিরে একটা ছোট ঘর মতো করা আছে ওটাতেই আমাদের পুজো দেওয়া হয়।

আমরা কেউ এখন থাকি না বলে পাশের বাড়ির কাকিমা সকাল সন্ধ্যা পুজো দেয়।

হ্যারি কেন নিয়ে গিয়ে ছোট কাঠের দরজাটা খুলে রাজুদা ভিতরে দেখতে লাগল ,

একটা কাঠের সিংহাসন তার উপর শঙ্কু আকৃতির কলার মোচার মতো দেখতে দুটো কাঠের তৈরী ঠাকুর আর একটা কাঠের নৌকা।

জানো তো রাজুদা মা গল্প করে আমি তখন খুব ছোট, আমাদের ঘর হওয়ার পর যখন কাঠের মিস্ত্রি আসে জানলা দরজা বানাবে বলে তখন আমার বাবা এই ঠাকুর দুটো তৈরী করেছিল মিস্ত্রির কাছে থেকে যন্ত্রপাতি নিয়ে।

সেই ছোট থেকে দেখে আসছি ঠাকুর দুটো একই রকম আছে, প্রতি পূর্ণিমাতে পুরোহিত মশাই তেল দিয়ে ঘষে আর সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। শুনেছিলাম ঠাকুর দুটো নিম কাঠের তৈরী তাই এতদিন ঠিক আছে না হলে এত দিনে পোকা ধরে নষ্ট হয়ে যেত।

সামনে কিছুটা মাটির উপর একটা ঘট তার উপর অনেক দিনের পুরানো একটা ডাব যার শিসটা ভেঙে নিচে পড়ে আছে। এটাই মন্দিরের মূল অধিষ্ট ঠাকুর। সিঁদুর মাখানোটা লক্ষ্মী আর তার পাশেরটা নারায়ণ।

এছাড়াও বামদিকে একটা ছোট সরস্বতী মূর্তি, একটা কালী ঠাকুরের পট, একটা দূর্গা ঠাকুরের ছবি আর ডানদিকে একটা পাথরের বাটির উপর একটা ছোট শিব লিঙ্গ তার মাথার উপর কয়েকটা শুকনো বেলপাতা। এ ছাড়াও প্রদীপ, ধুপ, ধুনুচি, শঙ্খ ভোগের যাবতীয় সামগ্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা।

রাজুদার চোখে আনন্দের চিহ্ন দেখতে পেলাম, আমাকে জিজ্ঞেস করল তোর পুরো ছড়াটা মনে আছে তো?

আমি বললাম হ্যাঁ, ওই তো –

“বয়ে যায় বেলা থেমে নেই ক্ষণ

বলি যা আমি মন দিয়ে শোন্

একে একে তিন

পরে সাথে দুই

তিন ভাগে মাঝখানে

জিভে হাত ছুঁই”

রাজুদা বলল – শিবলিঙ্গটা দেখছিস?

আমি বললাম – হুম।

রাজুদা বলল – দেখ এটাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় নিচে স্তম্ভটা যেটা বাটির উপর বসানো আছে এখন জলের তলায় এটা একটা, যেটার উপর বেলপাতা পড়ে আছে, মস্তক, এটা একটা ভাগ আর মাঝে যেটা সামনের দিকে জিভের মতো বেরিয়ে আছে এটা একটা ভাগ। অর্থাৎ মোট তিনটে ভাগ আর তার পর

তিন ভাগে মাঝখানে

জিভে হাত ছুঁই

মানে আমাদের এখন কী করতে হবে? বলে আমার দিকে তাকালো রাজুদা।

আমি তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম|

রাজুদা একটা প্রণাম করে নিয়ে আসতে করে জিভের মতো বেরিয়ে আসা অংশটায় একটা আঙ্গুল স্পর্শ করল। যেমন জিনিস তেমনই রইল, কিছু না হওয়াতে আরও একবার স্পর্শ করল তবে এবার একটু জোরে কিন্তু যে কে সেই কোনো পরিবর্তন নেই।

আমি রাজুদাকে পিছনে সরে আসতে বলে একটা প্রণাম করে নিয়ে মূর্তিটাকে বাটি থেকে তুলে নিয়ে জিভটাতে জোরে চাপ দিয়ে এদিক সেদিক দেখতে লাগলাম।

রাজুদা আমার উপর রেগে গিয়ে বলল – গাধা কোথাকার রাখ ওটাকে আগে ওর জায়গায়। ওর মধ্যে কী ব্যাটারি আছে নাকি? ওটা কী রিমোট যে টিপছিস, টিপলে কী কোনো লুকানো দরজা খুলবে? কিছু হওয়ার হলে বাটির উপর ছিল তখন হাত দিলাম তখনই হত। রাখ ওটাকে আগে ওটার জায়গায়।

মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল – এটা নয় এটা নয় আমরা ভুল রাস্তায় হাঁটছি রে। চল এবার গিয়ে শুয়ে পড়ি।

আমি অসহায় এর মতো মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে মূর্তিটিকে যথা স্থানে রেখে রাজুদার পিছনে পিছনে এসে শুয়ে পড়লাম।

শুয়ে শুয়ে বললাম এই রাজুদা কী হবে এবার, গুপ্তধন কী পাওয়া যাবে না.?

রাজুদা বলল – গুপ্তধন পাওয়া কী অত সহজ? তোর দাদু মারা গেছে আর এত বছর পর আমরা এখানে। উনি কিসের কথা বলে গেছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না। আর তোরা তো সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছিস ওই বাড়িতে। আর উনি যে জিনিসটার কথা বলে গেছেন সেটা হয়তো আর নেই এই বাড়িতে, আবার এমনও হতে পারে আমাদের সামনেই আছে আমরা ধরতে পারছি না। কালকে একবার টেবিলের সব ডাইরিগুলো পড়ে দেখতে হবে দেখি কিছু পাওয়া যায় কী না। নে এখন ঘুমিয়ে পড়, হ্যারি কেনটা কী কম করে দেবো না একেবারে নিভিয়ে দেবো?

আমি বললাম – ধ্যাৎ আলো জ্বললে আমার ঘুম আসবে না তুমি একেবারে নিভিয়ে দাও।

তৃতীয় ভাগ

উফঃ একটু শান্তি মিলল, আর ভালো লাগছে না। বড্ডো কষ্ট হচ্ছে। সেই ভোর বেলায় ওঠা তার পর গোলার মধ্যে ঢুকে খোড়া দিয়ে সমস্ত ধান পাড়া, তারপর ধান কেনার লোক এলে বস্তা ধরা এতকিছু হয় নাকি আমার দ্বারা?

যদিও রাজুদা খুব সাহায্য করেছে কষ্ট ওরও কম হয়নি। আমি তো খোড়া করে কাটিয়ে দিয়েছি আর ও সেগুলো বয়ে এনে সব ঘরের দাওয়াতে ভর্তি করেছে।

তারপর ধান কেনার লোক এসে পাল্লা দিয়ে দুটো ঘরের ধান, দাওয়া র ধান সব মাপল। আর বস্তা ধরে ধরে আমার দুটো হাতে ব্যথা হয়ে গেছে। এখনও যন্ত্রনা করছে।

ধান মাপা শেষে সমস্ত বুঝে নিয়ে, তাদের ধান গাড়িতে তুলে দিতে দিতে প্রায় বেলা একটা হয়ে গেছিলো। তারপর স্নান করে কাকিমাদের বাড়িতে খেয়ে ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নিয়ে তারপর বিকালে সুবলদাকে ডেকে নিয়ে আমি আর রাজুদা গেছিলাম জমির আল ঠিক করতে।

ওই রোদের মধ্যে সুবলদা জমির আল ছিটে দিচ্ছিল। আমি আর রাজুদা সেই মাটি নিয়ে আলের উপর সাজিয়ে দিচ্ছিলাম।

তারপর সন্ধেবেলা এসে কাকিমাদের বাড়িতে বসে গল্প করতে করতে আর খেতে খেতে প্রায় রাত্রি দশটা বেজে গিয়েছিল।

খাওয়ার পর আমার আবার একটু হাঁটার অভ্যেস তাই আমি আর রাজুদা খালপাড়ের দিকে একটু হেঁটে এসে সবে বিছানায় শুয়েছি।

আসলে অনেক দিন এত কাজ একসঙ্গে করা হয়নি তো তাই বড্ডো কষ্ট হচ্ছে। খুব ঘুমও পাচ্ছে।

রাজুদা তুমি ঘুমাবে না…?

-এখন না, তুই ঘুমা, আমি এই ডাইরিগুলো একটু দেখব তারপর ঘুমাব।

তুই বিকেলে কাজ করতে করতে হঠাৎ কোথায় চলে গেলি একা একা? আমাকে নিয়ে গেলি না কেন.? -জিজ্ঞেস করল রাজুদা

আমি বললাম – কখন গেলাম? কোথাও যায়নি তো?

রাজুদা বলল – গেলি তো তখন আবার কিছুক্ষন পর চলে এলি। কোথায় গিয়েছিলিস?

আমি বললাম -ও কিছু না একটু পিসির বাড়িতে গেছিলাম।

হঠাৎ পিসির বাড়ি? – জিজ্ঞেস করল রাজুদা

আমি বললাম – হ্যাঁ অনেকদিন আসিনি এতদিন পর এলাম তাই একটু দেখা করে এলাম।

রাজুদা বলল – বাবা এমনিতে তো আসিস না পিসির বাড়িতে তো আজ হঠাৎ পিসিকে দেখতে ইচ্ছে হল? আমাকেও তো বলে যেতে পারতিস আমিও যেতাম তোর সাথে, একটু দেখা করে আসতাম।

আমি হেসে বললাম – ধ্যাৎ যা করছ করো তো। আমি ঘুমালাম, পরে একদিন নিয়ে যাব তোমাকে।

কাঁচা ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেলগেল ঘন্টার শব্দে। বিছানা থেকে না উঠেই হালকা চোখ মেলে দেখলাম রাজুদা হ্যারি কেনটাকে জোরে জ্বালিয়ে মন দিয়ে ডাইরি পড়ছে আর এই দিকে দেয়াল ঘড়িতে বারোটার ঘন্টা বেজেই চলেছে।

না তাকিয়েই বিরক্তির স্বরে বললাম – উফফ রাজুদা এই ঘড়িটা কালকেই তুমি বন্ধ করে দেবে। এতক্ষন ধরে ১২ বার ঘন্টা বাজলে কার না ঘুম ভেঙে যায় বলো? কালকে রাতেও ঘুম ভেঙে গেছিলো। উফঃ কী বিরক্তিকর দিন নেই রাত নেই শুধু ঢং ঢং ঢং ভালো লাগে না আমার আর। বলে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

হঠাৎ একটা সশব্দে পিছনে চড়ের আঘাত খেয়ে হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসে দেখি রাজুদা হাসতে হাসতে বলছে – অনি তুমি ফাটিয়ে দিয়েছ, পেয়ে গেছি, ওঠো তাড়াতাড়ি।

আমি একটু রেগে গিয়ে বললাম – আমি আর ফাটালাম কৈ? ফাটিয়েছো তো তুমি। উত্তেজনার বসে আমার পশ্চাৎচদেশে যে চপেটাঘাতটা করেছ এতচক্ষণে পাঁচটা আঙুলের দাগ বসে গেছে হয়তো। খুব জ্বালা করছে। কী পেয়েছ? ডাইরিতে কিছু লেখা ছিল?

আরে না না ডাইরিতে কিছু পাইনি -বলল রাজুদা

তাহলে শুধু শুধু চড়টা মারলে? বলে আমি আবার শুয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম।

রাজুদা একরকম হিড়হিড় করে টেনে আমাকে বিছানায় থেকে নামিয়ে বলল – আমরা কী বোকা রে, শুধু নিচের লেখা নম্বরগুলোর পিছনে দৌড়াচ্ছি। উপরে যে দুটো লাইন ছিল সে দুটো তো ভুলে মেরে দিয়েছিলাম রে। তুই বললি বলে তাই খেয়াল হল।

আমি চোখ কচলে বললাম – আমি আবার কী খেয়াল করালাম তোমার.?

রাজুদা আমাকে দেয়াল ঘড়িটার সামনে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল ছড়ার প্রথম লাইন দুটো কী ছিল?

আমি ঘুমের ঘোরে হাই তুলে জিজ্ঞেস করলাম – কী ছিল?

রাজুদা একটু রেগে গিয়েই বলল – উফঃ

“বয়ে যায় বেলা থেমে নেই ক্ষণ

বলি যা আমি মন দিয়ে শোন”

এটার মাধ্যমে উনি সময় কেই বোঝাতে চেয়েছেন, আর সময় মানে ঘড়ি। আর আমরা এই লাইন দুটোই বাদ দিয়ে সংখ্যা নিয়ে টানাটানি করছি।

আমি বললাম – বাবা ঘড়ির মধ্যে গুপ্তধন? তাহলে পরের নম্বরগুলো কী?

রাজুদা বলল – হতে পারে ঘড়ির মধ্যে গুপ্তধন আবার না ও হতে পারে।

কটা বাজে এখন.?

আমি বললাম – মোবাইলটা বিছানায়, দাঁড়াও এনে দেখে বলছি।

রাজুদা মাথায় একটা চড় মেরে বলল – সামনে এত বড়ো ঘড়ি আর উনি যাচ্ছে মোবাইল দেখে সময় জানতে, এটা দেখে বল।

আমি মাথার পিছনে হাত বোলাতে বোলাতে বললাম – ১২ টা ১০

রাজুদা বলল – হুম, এবার কখন ঘন্টা পড়বে?

আমি বললাম – সাড়ে বারোটায়

– কটা ঘন্টা পড়বে?

– একটা।

– তারপর কখন ঘন্টা বাজবে?

– ১ টা বাজলে।

– তারপর?

– দেড়টা বাজলে, সেটাও একটা ঘন্টা দেবে।

– তারপর?

– ২ টা বাজলে একসাথে দুটো ঘন্টা দেবে পর পর -বললাম আমি।

তাহলে পর পর একবার করে মোট তিন বার ঘন্টা দেওয়ার পর একসাথে দু বার ঘন্টা বাজে তাই তো.?

“একে একে তিন

পরে সাথে দুই”

এই দুটো লাইন এর মানে বুঝতে পারলি এবার?

আমি শুধু হ্যাঁ করে তাকিয়েই থাকলাম কিছু বলতে পারলাম না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম আর পরের লাইন দুটোর মানে?

রাজুদা বলল – সেদিন দেখেছিলিস? যে দিন আমি ঘড়িটা চালাই? কাঁটা ঘুরিয়ে সময় ঠিক করে দিয়ে তারপর ঘন্টার আওয়াজগলো ঘড়ির ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ঠিক করছিলাম?

ঘড়ির মধ্যে জিভের মতো আকৃতির একটা দোলক ঝোলানো আছে ওটার গায়ে টাচ করলে ঘন্টা বাজে পর পর বুজলি?

তুই কী খেয়াল করে দেখেছিস? ঘড়িটা সারা দিনে ওই একটাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মাত্র এক বার করে ঢং করে পর পর তিন বার বাজে?

সত্যিই তোর দাদু একটা জিনিয়াস লোক ছিল রে, এই সাধারণ একটা জিনিস দিয়ে একটা অসাধারণ জিনিস করে গেছে।

এবার বল এই পর পর একটা করে ঘন্টা তিন বার বাজলে, তার তিন ভাগ করলে মাঝের ঘন্টাটা কখন বাজবে?

আমি বললাম – পর পর একটা করে ঘন্টা বাজে ১২.30 তারপর ১ তারপর ১.৩০। অর্থাৎ মাঝেরটা একটার সময় বাজবে!

রাজুদা বলল – হুম ওই একটার সময়ই ওই ভিতরের দোলকটা তে হাত দিতে হবে বুজলি?

আমি বললাম – সবে তো বারোটা দশ, একটা বাজতে তো এখন অনেক দেরি ততক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি?

রাজুদা হেসে বলল- একটা বাজেনি তো কী হয়েছে, আমরা একটা বাজিয়ে নেব।

বলে হুক নামিয়ে ঘড়ির কাঁচের দরজাটা খুলে মিনিটের কাঁটাটা টেনে ১২.৩০ এ দিতে একবার ঢং করে আওয়াজ হল। তারপর আবার কাঁটা ঘুরিয়ে ১টা করতেই আবার ঢং করে একবার আওয়াজ হল।

কাঁটা ছেড়ে এবার ভিতরে দোলকটাকে স্পর্শ করতেই খচ করে একটা আওয়াজ হল।

রাজুদা বলল- মোবাইল এর ফ্ল্যাশটা একটু জ্বালা তো?

আমি দৌড়ে মোবাইল এনে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে রাজুদার হাতে দিলাম।

রাজুদা নিচু হয়ে লাইট মেরে ভিতরে দেখতে থাকল।

চ্যাপ্টা দোলকটা মাঝখান থেকে দু ভাগে ভাগ হয়ে সামান্য ফাঁক হয়েছে আর তার ভিতরে সাদা মতো একটা কাগজ দেখা যাচ্ছে।

রাজুদা বলল – একটা সর্না দে তো কাগজ টা বের করি?

আমি বললাম – সর্না কোথায় পাব?

ঠিক আছে কিছু একটা তো দে সরু মতো, কাগজটা টেনে বের করি।

আমি অনেক খুঁজে একটা ভাঙা সেফটিপিন রাজুদার হাতে ধরিয়ে দিলাম।

রাজুদা খুঁচিয়ে কাগজটা বের করে নিয়ে আর একবার হাত দিতে খুট করে আওয়াজ হয়ে দোলকটা বন্ধ হয়ে গেলগেল আর সাথে সাথে ঢং করে একটা আওয়াজ হল। মিনিটের কাঁটাটা আবার একটু ঘুরিয়ে ১.৩০ টার ঘরে দিয়ে পেন্ডুলামটা দুলিয়ে দিয়ে টেবিলের দিকে যেতে যেতে বলল কালকে দুপুরে সময়টা এডজাস্ট করে দেবো, না হলে এখন অনেকক্ষণ ধরে কাঁটা ঘোরাতে হবে।

আয় এই দিকে আয় বলে আমাকে টেবিলের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল – তোর দাদু কী লক বানিয়েছে দেখেছিস নিজের হাতে? অন্য কোনো সময় কিন্তু ওই দোলক এ হাত দিলে ওটা খুলবে না, শুধু মাত্র একটার সময়ই হাত দিলে তবে খুলবে।

হারিকেন টা কাছে টেনে নিয়ে দেখলাম ছোট একটা কাগজ চার ভাজ করে মোড়া, কাগজটার এই দিক ওই দিক দুদিকেই ছোট ছোট করে লেখা —

অশোক আমি জানতাম তুই পারবি খুঁজে পেতে। তুই হয়তো জানিস জমিদার পরিবারের একজনের সাথে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল। তোরা তখন ছোট ছিলিস মোটামুটি, তবে ভুলে যাওয়ার মতো ঘটনা এটা না। ১৯৮৭ সালে যখন আমাদের এখানে লুটপাট হয় ঘর বাড়ি সব জ্বালিয়ে দেয় তখন আগে থেকে খবর পেয়ে আমার ওই বন্ধু তার অংশের জমিদারির কিছু খাজানা আমাকে লুকিয়ে রাখতে দিয়েছিল। তোরা তো আর এখানে থাকলি না, তোর মেজ ভাই অজিত জানত এর কথা আমরা দুজন মিলে সেগুলো লুকিয়ে রেখেছিলাম। সে অজিতও তো আর নেই তাই তোকেই বলে যাচ্ছি। লুটপাট হওয়ার সময় আমার সেই বন্ধু ডাকাতদের হাতে মারা গিয়েছিল। তখন থেকে সেই সম্পত্তি আমি আগলে যাচ্ছি। ওর থেকে একটাও কিছু আমি নেয়নি। জমা রাখার সময় আমাকে দশটা মোহর দিয়েছিল সেগুলোই শুধু আমি নিয়েছিলাম। ওই বন্ধুটার কোনো উত্তরসূরিও নেই তাই ওগুলো আমার কাছেই রয়ে গেছে। নে এবার শেষ ধাঁধা এটা সমাধান করতে পারলে সেই সম্পত্তি পেয়ে যাবি….

চারিদিকে ঘেরা সেথা

ধনের দেবীর বাস,

হঠাৎ করেই কোরো না প্রবেশ

তাহলেই সর্বনাশ।

প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে সেথা

মুকুন্দ মনোহরি,

আল্লাদিনির সাথে তাহার

করতে হবে আড়ি।

পায়ে ধরে বিশ্বম্বরে

করো আবাহন,

দারিদ্রতা মুছে হবে

অভীষ্ট পূরণ l

চিঠিটা পড়ে আমি বললাম এত কিছু করার পর আবার একটা ধাঁধা?

রাজুদা কয়েকবার কবিতাটা পড়ে নিয়ে বলল – গুপ্তধনের কাছে বড়ো বিপদ আছে বলছে রে, সেখানে যাওয়াটা কী ঠিক হবে.?

আমি জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যেতে হবে?

রাজুদা বলল- ধনের দেবী মানে তো লক্ষ্মী আর মুকুন্দ মনোহর তো কৃষ্ণের অর্থাৎ নারায়ণ এর আর এক নাম।

আমি যেটা ভাবছি সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে ওখানেই গুপ্তধন আছে। চল অনি! হ্যারি হ্যারি কেনটা নিয়ে আয় বলে ঘরে থেকে বেরিয়ে গেলগেল।

আমি হ্যারি কেন নিয়ে ওর পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে জিজ্ঞেস করলাম – ও রাজুদা বলো না কোথায় যেতে হবে? এত রাতে না গেলে হত না? বিপদ আছে বললে তো? আমার কিন্তু খুব ভয় করছে। কাল সকালে গেলে হত না?

রাজুদা হাসতে হাসতে বলল একবিংশ শতাব্দীতে এসে গুপ্তধনের সন্ধান করছি একটু রোমাঞ্চ না থাকলে মানায়?

গল্প করতে করতে আমরা এসে ঠাকুর ঘরের সামনে হাজির হলাম

আমি জিজ্ঞেস করলাম এখানে?

রাজুদা বলল – হুম ধন সম্পদ এর দেবী লক্ষ্মী ঠাকুর কোথায় থাকে?

আমি বললাম – কোথায় থাকে?

রাজুদা বলল – এই ধানের গোলার মধ্যে। এখানে ধান রাখা হয় তাই হিন্দু শাস্ত্রে সবাই এটাকে লক্ষ্মী জ্ঞান এ পুজো করে বুঝ লি.? কিন্তু এখানে বিপদ খুব কেন বলছে?

রাজুদা হ্যারিকেনটা আমার হাতে থেকে নিয়ে ঠাকুর থানার কাঠের দরজাটা টেনে খুলে ভিতরে দেখতে লাগল।

কিছুক্ষণ দেখার পর আমাকে জিজ্ঞেস করল আচ্ছা অনি তুই কী জানিস এই গোলাঘরের তলায় যে ছাদ মতো ফেলা ওর তলাটা ফাঁকা না নিরেট.?

আমি মাথা নেড়ে বললাম – আমি ঠিক জানি না, জন্ম থেকে একই রকমের দেখে আসছি। কিন্তু কেন হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছো?

রাজুদা বলল – এই দেখ

প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে সেথা

মুকুন্দ মনোহরি,

মুকুন্দ আর মনোহরি, নারায়ণ এর আর এক নাম। এখানে তো লক্ষ্মী নারায়ণ এর মূর্তি আছে তাই আমার মনে হয় এই ঠাকুরের পিছনে কোনো রাস্তা আছে।

এই অনি একটু আয় তো সিংহাসনটা একটু সরিয়ে দেখি।

দুজন মিলে টানাটানি করে সিংহাসনটা সরাতে তার পিছনে একটা লোহার দরজা দেখা গেল কিন্তু অনেক ধাক্কা দিয়েও দুজন সেটাকে খুলতে পারলাম না।

রাজুদা আবার কাগজটা খুলে দেখতে লাগল

প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে সেথা

মুকুন্দ মনোহরি,

আল্লাদিনির সাথে তাহার

করতে হবে আড়ি।

পায়ে ধরে বিশ্বম্বরে

করো আবাহন,

দারিদ্রতা মুছে হবে

অভীষ্ট পূরণ l

রাজুদা বিড়বিড় করে বলতে লাগল আল্লাদিনি তো লক্ষ্মী ঠাকুরের আর এক নাম তার মানে নারায়ণ কে লক্ষী ঠাকুরের থেকে আলাদা করে নিতে বলছে কী?

রাজুদা আমাকে জিজ্ঞেস করল – দুটোই তো এক রকমের দেখতে রে এর মধ্যে নারায়ণ কোনটা?

আমি বললাম – যেটাতে সিঁদুর মাখানো আছে ওটা লক্ষী ঠাকুর।

রাজুদা গিয়ে নারায়ণ এর মূর্তিটা সিংহাসন থেকে হাতে নিয়ে বাইরে এল। তারপর প্রায় লাফিয়ে উঠে মৃদু স্বরে চিল্লিয়ে বলল পেয়ে গেছি।

বিশ্বম্বর হল নারায়ণ এর আরেকটা নাম আর ওঁর পা এ ধরে আহ্বান বলতে এই দেখ, বলে- নারায়ণ এর মূর্তিটার নিচের দিকের অংশটাকে একটু ঘোরাতেই সেটা খুলে গিয়ে একটা লোহার চাবি টুং করে মেঝেতে পড়ে গেলগেল।

রাজুদা সেটাকে কুড়িয়ে নিয়ে বলল – মোবাইল এর ফ্ল্যাশ জ্বালা, দেখ লোহার দরজায় চাবির গর্ত পাবি।

আমি চাবিটা নিয়ে দরজাটা খুললাম। দেখলাম ছোটখাটো একটা ঘরের মতো। কোনোরকমে ভিতরে উঁবু হয়ে বসা যেতে পারে, কিন্তু মোবাইল এর আলোয় ভিতরে কিছু দেখ যাচ্ছে না সাদা ধোঁয়াটে দেখাচ্ছে ভেতরটা।

আমি জিজ্ঞেস করলাম ভিতরে ঢুকব নাকি রাজুদা? কিছু তো দেখা যাচ্ছে না?

রাজুদা বলল – পাগল নাকি? পড়িসনি কী লেখা আছে? হঠাৎ করে ঢুকলে সর্বনাশ, একদম মারা যাবি।

আমার মনে হয় তালাটার সাথে কোনো বিষাক্ত গ্যাস যোগ করা ছিল চাবি দিয়ে হোক বা যে করেই হোক দরজা খুললে গ্যাস টা ফেটে ভিতরে ভর্তি হয়ে যায়। আর গুপ্তধনের সংকেত না মেনে সাথে সাথে ভিতরে ঢুকলে মৃত্যু অবধারিত। কিছুক্ষন বাইরে বস একটু পরে ঢুকছি – বলল রাজুদা

কুড়ি পঁচিশ মিনিট বাইরে বসে থাকার পর রাজুদা বলল হারিকেনটা একটু ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে দেখ নিভে যায় কী না?

আমি উঠে গিয়ে তাই করলাম বললাম- না নিভে যায়নি জ্বলছে তো।

রাজুদা বলল – তাহলে চল এবার ভিতরে যাওয়া যাক |

দুজন মিলে হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখলাম সাতটা পিতলের বড়ো হাঁড়ির মতো জিনিস। তার মধ্যে ৬টাতে ভর্তি সোনার মোহর, আর একটা হাঁড়িতে নানা রকমের গয়না তে ভর্তি। এই সমস্ত দেখে আমার চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগল, যেন বিশ্বাসই করতে পারছি না।

কিছুক্ষন থাকার পর রাজুদা বলল – চল এবার বাইরে যাওয়া যাক?

বাড়িতে সবাইকে ফোন করে দে, সকালে সবাইকে আসতে বলে দে। আর থানাতেও একটা ফোন করতে হবে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম – কেন থানা কেন?

রাজুদা হেসে বেরিয়ে আসতে আসতে বলল – এখানে যা আছে সব তোদেরই, আবার এর মধ্যে কোনো কিছুই তোদের না।

বেরিয়ে এসে লোহার দরজায় চাবি দিয়ে ঘরে চলে এলাম। তারপর রাজুদার হাতে একটা খুব ছোট একটা সোনার বাক্স মতো জিনিস দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। রাজুদা এটা কী?

রাজুদা বলল – এটা আবার কোথায় পেলি?

আমি বললাম দরজা থেকে বেরিয়ে চাবি দেওয়ার আগে দরজার পাশে চকচক করছিল তাই তুলে নিয়ে এলাম।

সমাপ্ত

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post কালিম্পং এ কয়েন রহস্য | বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | সৌরভ সেন| Bengali Detective Story
Next post জলে জঙ্গলে | বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | চিরঞ্জিৎ সাহা| Bengali Detective Story