জমিদার বাড়ির সুন্দরী ভূত | ভয়ের দেশ |রাকিবুল হাসান| Bengali Horror Story
0 (0)

ভূতের ভয় কার না হয়? সত্যিই কি ভূত আছে নাকি আদৌ নয় ভূত! ভূত! ভূত; ভূতের ভয় কার না হয়? ছোট বেলায় দাদু-দিদা, নানা-নানীর কাছে প্রায়শই আমাদের ভূতের গল্প শোনা হতো। কতো সময় নিজের আত্মীয়ের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো গল্প করতো। এমনকি আমরা ছোট বেলায় যদি বাড়ির বাইরে খেলতে যেতে চাইতাম পরিবার পরিজনেরা বলতো ওপাশে যাস নে খোকা ভূত আছে; কেবলই তো সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেছে। ভূতে ঘার মটকিয়ে খাবে! তখন বুঝবে মজা। কি সাংঘাতিক ভয়টাই না করতাম? এখনো যে ভূতের ভয় করি না সেটাও কিন্তু নয়। ভূতের ভয় করার জন্য একটা কারণও আছে। সেই গল্পই শোনাবো তোমাদের আজকে। তবে আমার একটা কথা বিশ্বাস করতে হবে যে ভূত এখনো আছে। ভূতে যদি বিশ্বাস না করো তবে গল্পটা মিছেমিছি পড়িও না। কারণ গল্পটাই ভূতের, যদি ভূতেই বিশ্বাস না করো তাহলে কিসের গল্প কিসের কি? অযথা কথা না বাড়িয়ে চলো তাহলে তোমাদের গল্পটা শোনাই-প্রাচীন আমলের জমিদার বংশের শেষ বংশধরের একটা পুরানো বাড়ি। বাড়িটা বেশ বড়সড়। জমিদার বংশ স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে আগে এই আলিশান বাড়ি রেখে সপরিবারে বিদেশে পারি দেয়। বাড়ি দেখাশোনা করার জন্য বাড়ির কাজের মানুষ মকবুল আর জলিল সহ আর দশ জন লোক রেখে গেলেও যুদ্ধের পরে তাদের আর কারো কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায় নি। যুদ্ধের পর থেকে আলিশান বাড়িটা পরিত্যক্ত দেখা শোনার করার কোন লোকজন নাই। দুই-তিন বছরের মধ্যে বাড়ির চারপাশ গাছগাছড়া ঝোপঝাড়ে ঢেকে যায়। মানুষ একা যেতে ভয় পায়। ধীরেধীরে ওই বাড়িতে মানুষের আনাগোনা বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ গ্রামের এক মেয়ে কুলসুম হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। কুলসুমের বিয়ে ঠিক হয়েছে; দিন পাঁচেক পরেই তার বিয়ে। কিন্তু বিয়ের তিন দিন আগেই মেয়েটা গ্রাম থেকে উধাও। গ্রামের কিছু কিছু মানুষজন বলাবলি করতেছিল কারো সাথে তার ভাবভালোবাসা ছিল যার কারণে বিয়ের আগেই পালিয়ে গেছে। কিন্তু গ্রামের সবাই ভালো করেই জানে কুলসুম মোটেই সেই রকম মেয়ে নয়। কুলসুম নামাজ কালাম; ইবাদত-বন্দেগিতে পাক্কা। এলাকার ছেলেপেলেরাও কেউ বলতে পারবে না তার চেহারা কেমন? কঠিন পর্দাশীল। আলখাল্লা বোরকা হাত মোজা; পা মোজাও পড়তো, শুধু চোখটাই দেখা যেত। এরকম মানুষ ভাবভালোবাসা করে পালিয়ে যাবে এমনটা তার কাছে আশা করা যায় না।

বলা বাহুল্য তার চোখের কি যে অপরূপ হরিণ-রাঙা চাউনি। যে কেউ এক বার তার চোখ দেখলেই প্রেমে পরে যাবে। ঘটনা যাই হোক কুলসুম কে খুঁজে বের করা উচিৎ। সারা গ্রাম তন্নতন্ন করে খুঁজেও কুলসুমকে পাওয়া গেল না। সব আত্মীয়ের বাড়ি খোঁজ খবর নেয়ার পরে জানা যায় কুলসুম কোথাও নাই। এলাকা থেকে বাইরে যাইতেও তাকে কেউ দেখে নি। ফজরের পর থেকে কুলসুম নিখোঁজ সারাদিন গড়িয়ে রাত নেমে এসেছে। এখন রাত ফুরাবারও কমতি নাই। রাত এখন দুইটা পনের। বর্তমান শুধু জমিদার বংশের সেই পুরানো বাড়িটাতেই কুলসুমের খোঁজ করা হয় নি। জমিদারের পুরানো বাড়িতে কুলসুমকে খুঁজবে সেই কথাও কেউ ভাবেও নি। গত তিন বছরে জমিদার বাড়িতে কারো পা পড়েছে কি না সেটাও কেউ বলতেও পারবে না। কুলসুমের ছোট বোন হালিমা ক্লাস আটে পড়াশোনা করে। এতো রাত অব্ধি বড় বোনের শোকে সেও ঘুমায় নি। অনেক কান্নাকাটিও করেছে। অনেক আহাজারিও করেছে, বোন তুই ফিরা আয়। আমি আর তোর সাথে মারামারি করমু না। তোর সব কথা শুনমু। তুই যা কইবি তাই শুনমু। তুই ফিরা আয়। তুই না আসলে আমি কার সাথে গল্প করমু? রাইতে কার সাথে গলাগলি কইরা ঘুমামু। বাড়ির অন্যকারোও ঘুম নাই। এইরকম মুহূর্তে কারই বা ঘুম আসে? হঠাৎ হালিমা তার বাবাকে বলে আইচ্ছা আব্বা সব জায়গায় তো খুঁজলা; খোঁজখবর নিলা, একবার ওই জমিদারের পুরান বাড়িতে আমার বোনরে খুঁইজা দেখো। আমার মনডা কেমন জানি করতাছে? বুবুর রাগ উঠলে আমারে কইতো তোরে থুইয়া আমি জমিদারের ওই পুরান বাড়িতে যামু গা। আর আসমু না। তুই আমার কথা শুনোস না। ঠিক মতো পড়াশোনা করস না। খালি কাইক্যাচাল করোস। আমার আর ভাল্লাগে না। আমি জানি কবে তরে থুইয়া হাচা হাচাই চইলা যাই? বুবুরে বিয়া দিতে চাইছো তাই বুঝি গোস্সা (রাগ) কইরা আছে। ওরে বিয়া দিমু না। ওর গোস্সা ভাইঙ্গা বাড়িতে ফিরা আনো। এখন রাত্র সারে তিনটা বাজে। অতঃপর হালিমার কথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সবাই মিলে ভোর হতে হতেই সেই জমিদারের পুরানো বাড়িতে যাবে কুলসুমের খোঁজ করতে। ভোর হতে হতেই সবাই বেড়িয়ে পড়লো জমিদারের সেই পুরানো বাড়ির উদ্দেশে। কুলসুমের বাবা (হাসমত), চাচা (কাশেম), সমবয়সী চাচাতো ভাই (শরীফ) সহ এলাকার আরো সাত-আট জন মানুষ। বড় বাড়ি বেশি মানুষজন হলে খোঁজাখুঁজির জন্য সুবিধা। কুলসুমের বাবা আরো অনেক জনকেই ডেকেছিল কতজনে ভূতের ভয়ে আসে নি। শরীফ প্রথমে সাথে আসতে দ্বিমত করলেও শরীফের বাবার আদেশ মানতেই তাকে সবার সাথে আসতে হলো। ঝোপঝাড়ের আধ-কিলো রাস্তা পেরিয়ে জমিদার বাড়ি। মাঝ পথে যেতেই কুলসুমের একপায়ের স্যান্ডেল দেখে কুলসুমের বাবা চিৎকার করে বলে ওঠে কাশেম রে দেখ আমার মা কুলমের স্যান্ডেল। তাড়াতাড়ি কর সবাই পায়ের গতি বাড়ায়া দে। জমিদারের বাড়ির সম্মুখ গেট এর সামনে কুলসুমের আরেকটা স্যান্ডেল দেখতে পাওয়া যায়। শরীফ বাড়ির ভিতরে যেতে চাইছিল না। বার বার বলতেছিল এই ভূতের বাড়িতে ঢুকতে তার ভীষণ ভয় করছে। কিন্তু সবার বলাবলিতে শরীফও কুলসুমকে খুঁজতে নেমে পড়লো। আলিশান তিন তালা বাড়ি। পুরো বাড়িটাতে ছাপ্পান্নটা রুম সাথে বেলকুনি। তিন তালার মাঝের রুমটা বেশ বড়; সেই ঘরে নাচ গানের আসর জমাতো। তার পাশেই একটা ছোট রুম সেই ঘরে দেশি-বিদেশ নামি-দামি মদের বোতল আলমারি ভরতি সাজিয়ে রাখা হতো। আসর ঘরে গান বাজনা করতো। গ্রামের সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে গানের তালে তালে নাচাতো আর জমিদারের ছেলেপেলেরা মদ্য পান করতো। কতশত সুন্দরী মেয়ে জমিদার ছেলেপেলের রাতের উপভোগ্য বস্তু হতো তার বিনিময়ে রাত্রি গড়ালে মোটা অঙ্কের টাকাও দিতো। কারো কোনো প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না। তবে যে কেউ প্রতিবাদও করে নি তেমনটাও না। গ্রামবাসী আন্দোলনেও নেমেছিল দুইবার। যে দুই-তিন জন নেতৃত্ব করেছিল লোক-সম্মুখে তাদের বুক গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয়েছে। তারপর আর কেউ সাহস করে নি জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে। এতো সুন্দর আলিশান বাড়িতে এখন ইঁদুর, বাদুর, চামচিকা আর মাকড়শার আধিপত্য। বাড়ির ভিতরটা মাকড়শার জালে ঘেরা। প্রতি পা বাড়াতেই মাকড়শার জাল ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাইতে হয়। মাঝে মাঝে বাড়ির ছাদে বানরের লাফালাফি করতেও দেখা যায়। প্রথম তলার দরজা খোলার সাথে সাথেই বিশ্রী উটকো গন্ধ ভেসে আসলো। ভীতর থেকে এক দল চামচিকা বেড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে ছুটে গেল। চারদিক মাকড়শার জাল। প্রথম তলায় আঠারোটা রুম সাথে বেলকুনি আর বাথরুম। প্রতি ঘরে দুই জন; দুই জন করে কুলসুমকে খুঁজতে শুরু করলো। এক এক করে সব রুম খোঁজা শেষ করলেও কুলসুমের কোন খোঁজ খবর পাওয়া গেল না। সবাই মিলে একজোট হয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠলো। দ্বিতীয় তলায়ও আঠারোটা রুম একই রকম ডিজাইন কিন্তু তৃতীয় তালায় ডিজাইনের দিক থেকে কিছু বিশেষত্ব আছে। যেমন তৃতীয় তলায় মাঝ বরাবর নাচ; গান-বাজনার আসর। পাশেই মদ-পানীয়ের রুম সাথে একটা গোপন রুম। সেই ঘরে কি এমন করা হতো সেটা আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারে নি। দ্বিতীয় তলায় কুলসুমকে তন্নতন্ন করে খোঁজা হচ্ছে এ রুম থেকে ও রুম, বাথরুম, কইছেন, বেলকুনি। কোথাও কুলসুমের খোঁজখবর নেই। খাট-তোশক, আলমারি, বই- পুস্তক সবকিছু ধুলাবালির স্তরে ঢেকে গেছে। খাটের পাশে ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটাও ধুলাতে ঢেকে গেছে। তার উপর আবার মাকড়শার জালেও ছেয়ে গেছে। মাঝে মাঝে চামচিকার উটকো গন্ধ নাকে ভেসে আসতেছে। তার উপর ইঁদুর-চিকার বিষ্ঠার ভয়নায় বিশ্রী গন্ধ। সবকিছু উপেক্ষা করে দ্বিতীয় তলায়ও খোঁজাখুঁজির করে কুলসুমকে পাওয়া গেল না। সবাই মিলে এবার তৃতীয় তালার দিকে সিঁড়ির দিকে রওনা দিল। শরীফকে ভীষণ ভীতু সন্ত্রস্ত লাগছিল আর প্রচুর পরিমাণ ঘামতেছিল। সবাই ধীরেধীরে তৃতীয় তালার সিঁড়িতে একটা একটা করে পা বাড়াইতেছিল। তখন হঠাৎ করেই একটা কাঁচের গ্লাস বা প্লেট ভাঙ্গার শব্দ। সবাই সিঁড়িতে থমকে দাঁড়ালো। চমকে উঠলো। ভয়ও পেল। শরীফ কিছুটা উচ্চস্বরে বলে উঠলো আমি আর ভীতরে যাবো না। নিশ্চয়ই ভীতরে ভূত আছে। শরীফের সাথে আরো দুই একজন বলে উঠলো আমাদের আর ভীতরে যাওয়া ঠিক হবে না। আমরা এখান থেকেই ফিরে যাই। রাত গভীর হলে এই বাড়ি থেকে কেমন ভয়ানক আওয়াজ আসে। রাতেরা যখন গভীরে নেমে যায় তখন চারদিক কেমন নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে যায়। রাতেরও কিন্তু নিজস্ব এক ধরনের আওয়াজ আছে সাথে ভয়ানক কালো অন্ধকার। চারদিক নীরব-নিস্তব্ধ আর রাত গভীরে কোন কিছু আওয়াজ করলে সেটা জোড়ালো আর বিস্তৃত হয়। প্রায় দিন মাঝরাতে জমিদার বাড়ির তৃতীয় তলা আর মাঝেমাঝে ছাদের উপর থেকে বিভিন্ন ধরনের ভয়ংকর আওয়াজ আসতো মানুষেরা আন্দাজ করতে পারতো। কোন কোনদিন উচ্চস্বরে গানবাজনা বাজতো। শরীফের সাথে এক-দুই জন তৃতীয় তলায় প্রবেশ করতে দ্বিমত পোষণ করলেও আর বাকিরা এর শেষটা দেখার জন্যই প্রস্তুত ছিল। তারা দুই-তিন জন প্রচুর ভয় পাচ্ছিল আর ক্রমে ক্রমে ঘামতেছিল। মুখের ঘাম বার বার মুছেও স্বাভাবিক থাকতে পাচ্ছিল না। কুলসুমের বাবা বলল তোরা ফিরে গেলে যা আমার মনে কইতেছে আমার মা কুলসুম ভীতরেই আছে। একটা একটা কইরা কুলসুমের স্যান্ডেল জোড়া পাইছি। আমার মনে ও এই বাড়িতেই আছে। আমি একাই ভীতরে যামু। আমি কুলসুমরে নিয়া বাড়ি ফিরা যামু। তোরা ফিরা গেলে যা। আমি আমার মা কুলসুমরে নিয়াই বাড়ি ফিরমু। কুলসুমের চাচা কাশেম দোয়া দরুদ জানতো। গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ঝাড়ফুঁক করতো। মজার ব্যাপার হলো গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে শুধু কাশেম চাচাকে গিয়ে নাম করে বলে আসলেই হতো যে অমুকের গলায় মাছের কাঁটা ফুটেছে একটু ঝাড়া দিয়ে দিয়েন। কাশেম চাচা জিজ্ঞাস করতো, ডান দিকে নাকি বাঁ দিকে? উত্তরে ডানদিক বা বাঁ দিক। খেল খতম। তিনি বাসায় থেকেই ঝাড়া দিতেন আর গলা থেকে কাটা নেমে যেত। বিড়াল কুকুর আঁচড় দিলে ঝাড়া দিতো। নুন পড়ে দিতো। কুকুর কামড়ালে তামা বা কাসার প্লেট পিঠে লাগিয়ে দিতো বিষ ফুরিয়ে গেলে পিঠ থেকে তামা বা কাসার প্লেটটি খসে পড়তো। কোন সময় কাঁটা ওয়ালা ঠোঁট বিশিষ্ট মাছের ঠোঁট দিয়ে পায়ে টোকা দিয়ে ফুটো করে বিষ রক্ত বের করে দিতো। ভূত-পেতের আঁচড় পড়লেও ঝাড়ফুঁক করতেন। কুলসুমের চাচা বলে উঠলো কিরে তোরা কি আসলেই ব্যাডা ছাওয়াল? এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? আমরা তো সব একসাথেই আছি। কিসের ভয়? সাথের একজনকে ডেকে বলে ছলিম তুই দরজাটা খোল তো। আর আমি তো টুকটাক ঝাড়ফুঁক জানি। দেখি কিসের ভূত কিসের কি? আমি তো আছি… ছলিম কাঁপাকাঁপা হাতে দরজা খুলল। চামচিকা, বাদুর রুম থেকে ফরফর করে দলে দলে আর কিছু এলোমেলো করে এদিক ওদিক করে জানালা দরজা দিয়ে বাইরে উড়ে গেল। অন্য দুই তালার থেকে তৃতীয় তালা দেখতে কিছুটা ভিন্ন রকম ছিল। জায়গায় জায়গায় পায়ের ছাপ। একটু আগাতেই দেখা যায় কাঁচের জগ ভেঙ্গে মেঝেতে পরে আছে। জগে পানিও ছিল। ভাঙ্গা জগের আশেপাশে মেজের কিছু অংশ ভেজা। পাশে চেয়ারের উপর পরিষ্কার চকচকে গ্লাস। এতো ধুলোবালির মধ্যেও চকচকে গ্লাস আবার জগে পানি বিষয়টা সত্যিই বিস্ময়কর। মেজেটাও অন্য দুই তালার থেকে বেশ পরিষ্কার। আশেপাশের জিনিসপত্রেও তেমন গভীর মলিনতার ছাপ নেই। নাচগানের আসরের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাসের কার্ড। আশেপাশে গড়িয়ে আছে মদের বোতল। তবে এগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুরনো আর নামি দামিও নয় যেগুলো জমিদারেরা পান করতো। তৃতীয় তলার রুম টা দেখে মনে হচ্ছে এই রুমে মানুষের আনাগোনা আছে। অন্যদিকে এলাকার মানুষ কোনভাবেই জানতো না এই বাড়িতে লোকজন চলাফেরা করে। কুলসুমকে খুঁজতে সবাই একসাথে নাচগানের আসর পর্যন্ত আসলো। তাদের মধ্যে একজন উচ্চস্বরে বলল কাশেম চাচা দেখো ওই দিকে একটা মরা বানর। সবাই তার দিকে গেল। বানরের মাথাটা ফাটা। আর মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছেনা এটা বানর পড়ে আছে। মুখ ভীষণ বাজে ভাবে থেঁতলানো। মাথার পাশেই ফ্লোরে রক্ত জমে আছে। রক্তের রং কালো হয়ে গেছে। একটু বড়সড় পাথর দিয়েই হয়তো বানরের মুখটা থেঁতলেয়ে দেওয়া হয়েছে। বানরের প্রসঙ্গ ছেড়ে সবাই কুলসুম কে খুঁজতে নেমে পড়লো। শরীফ, ছলিম আর তাদের সাথে থাকা মেছেরকে খুবই চিন্তিত আর ভীতু সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। তারা তিনজন খুবই ভয় পাচ্ছিল আর প্রচুর পরিমাণে ঘামতেছিল। সবাই পূর্বের মতো দুইজন দুইজন করে বিভিন্ন রুমে কুলসুমকে খুঁজতে গেল। ছলিম আর মেহের এক সাথে ছিল। শরীফ আর শরীফের বাবা এক সাথে। এভাবে দুই জন দুই জন করে জুটি বদ্ধ হয়ে বিভিন্ন রুম, বেলকুনি বাথরুম খুঁজতে আরম্ভ করলো। কিছুক্ষণ পরে খোঁজা খুঁজি শেষে সবাই নাচগানের আসরের এখানে এসে জমা হলো। সবারই এক কথা কুলসুমকে খুঁজে পাওয়া গেল না। কুলসুমের বাবার মনে খটকা লেগেই আছে। কুলসুমের বাবা বললেন, যদি কুসম না থাকে তাহলে কুলসুমের স্যান্ডেল কেন এই বাড়ির সামনে? অনেকে জবাব করলো বাড়ির সামনে শুধু স্যান্ডেল দেখেই প্রমাণ হয় না কুলসুম এখানে এই বাড়িতে আছে। স্যান্ডেল অনেক সময় কুকুর কামরে নিয়ে যায়। হয়তো স্যান্ডেল কুকুরও কামরে এনে ফেলে দিতে পারে। সেটা না হয় মানলাম কিন্তু এই পরিত্যক্ত ঘরে তাসের কার্ড, মদের বোতল, জগে পানি, পরিষ্কার গ্লাস সত্যিই কি বিস্ময়কর নয়….?

কাশেম চাচা কুলসুমের বাবাকে বুঝলও দেখ ভাই আমি বলি তাসের কার্ড, মদের বোতল এগুলো হয়তো এলাকার ছেলেপেলেরা করছে। এগুলোর সাথে আমাদের কুলসুমের কোন সম্পর্ক আমরা ফিরে যাই কুলসুমকে আমরা তো সবাই অনেক খুঁজাখুঁজি করলাম; পাইলাম না। সবাই কাশেম চাচার কথায় সম্মতি দিলো। আবার অনেকে কুলসুমের বাবাকেও বলল চলেন চাচা আমরা এখন ফিরা যাই। কিন্তু কুলসুমের বাবার মন কোন ভাবেই মানে না। সবাই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কুলসুমের বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে রও না দিল। সবাই সিঁড়ি দিয়ে নিচের তালায় নেমে এল। কি যেন মনে করে কুলসুমের বাবা আবার উপরের দিকে দৌড় দিল। শরীফ, ছলিম আর মেহের আঁতকে উঠলো। তার পিছনেও কয়েকজন ছুটে গেল। কুলসুমের বাবা দৌড়ে গিয়ে সিঁড়ি বেঁয়ে ছাদের দিকে উঠলো ছাদের গেট খুলে এদিক ওদিক চোখ বুলালো; পুরা ছাদ ফাঁকা। সেখানেও কুলসুম নেই। মন ভীষণ ভার করে কুলসুমের বাবা ছাদ থেকে তৃতীয় তলায় নেমে আসলো। ছোট ভাই কাশেম কে আশা মুখে বলল ভাই আমার মন মানতেছেই না। তুই এই গোপন ঘরের তালা টা ভাঙ্গার ব্যবস্থা কর। এটাই শেষ দেখা। তৃতীয় তলায় গোপন সিঁড়ি দিয়ে একটু নেমে জমিদার বাড়ির সেই গোপন রুম। তালা টা বেশ পুরানো জং ধরেছে সেটা জমিদারেরা চলে যাওয়ার পরে খোলো হয়েছে বলে মনে হয় না। তবুও বড় ভাইয়ের কথা রাখতে তাদের সাথে করে নিয়ে আসা রড দিয়ে আঘাত করে তালাটা ভেঙ্গে ফেলল। রুমটা মাঝারি সাইজের। ঘরে যাবতীয় অস্ত্রপাতি, দা-কুঠার, বল্লম, তীর-ধনুক, বন্দুক-গুলি আর মাঝারি আকারের কয়েকটা আলমারি। আলমারির তালা ভেঙ্গে দেখা যায় যতপ্রকার জমিজমার দলিল। যেগুলো গ্রামের মানুষের কাছে জমিদারেরা বেআইনিভাবে জবর দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এগুলো দেখার সময় নেই এখন। কুলসুমকে খুঁজে পাওয়া গেলে না। সবাই নিরাশ হয়ে গোপন রুম থেকে বেড়িয়ে পড়লো। সবাই নাচগানের আসরের উপর জমা হলো বাড়ির দিকে রওনা দিবে। তখন কুলসুমের বাবা নাচগানের আসরের কার্পেটের উপর কুলসুমের একটা কানের দুল দেখতে পায়। দুলটা হাতে নিয়েই এ রুম থেকে ও রুম ছোটাছুটি শুরু করে দিল দুই টা রুম দেখার পর তৃতীয় রুমে গিয়ে কুলসুমের বাবা কাশেম; কাশেম করে চিৎকার শুরু করে। সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখে কুলসুমের নিথর দেহ সিলিং ফ্যানের সাথে সাথে ঝুলছে। শরীর সম্পূর্ণ ঢাকা। গলায় তার ওড়না পেঁচানো। কয়েকজন ধরাধরি করে স্বাভাবিকভাবেই কুলসমকে নামানো হলো। দেহ পুরা শীতল। কুলসুমের দেহের মৃত্যু অনেক আগেই হয়েছে। কুলসুমের বাবার ঘারে থেকে চাদর নিয়ে কুলসুমকে পেঁচানো হলো। চারজনকে এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো খাটিয়া আনার জন্য। বাকি কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে তৃতীয় তলা থেকে কুলসুমকে নিচে নামিয়ে আনা হলো। অবশেষে খাটিয়া আনলে কুলসুমকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। তখন দুপুর। কুলসুমের ছোট বোন ও তার মায়ের কান্নাকাটি থামানোর কোন উপায় ছিল না। কান্নাকাটি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ফিরে আবার কান্নাকাটি। আর কুলসমে বাবা হতভম্ব; বাক বন্ধ হয়ে গেছে তার মুখে কোন কথা নাই। এলাকাবাসীও কুলসুমের জন্য অনেক আফসোস করতেছিল। সবাই বলাবলি করতেছিল মেয়েটা অনেক ভালো ছিল, নামাজ বন্দেগী পড়তো, পর্দাপুশিদা করতো, কোরআন পড়তো। এ কি হয়ে গেল? তার মৃত্যুটা এভাবে কেউ মেনে নিতে পারতেছিল না আর কুলসুমের মৃত্যুটাও আট-দশ জনের মতো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না…. জীবনের শেষ গোসল। গরম পানিতে বরই পাতা ভাসছে। গোসলের জন্য সব সরঞ্জাম তৈরি। গোসল শেষে সাদা কাফন পরিয়ে শেষ বিদায়। গোসল করানোর জন্য যে দ্বীনদার মহিলা ছিলেন তিনি যেটা দেখলেন সেই বিষয়টা সম্পূর্ণ গোপন রাখলেন। তিনি এগুলো দেখার জন্য মটেও প্রস্তুত ছিলেন না। কুলসুমের সারা গায়ে কামরের দাগ। ডান হাতটা খুব ভয়ানক ভাবে ভাঙ্গা। হাড়ের জোড়া একটা থেকে অন্যটা আলাদা হয়ে গেছে। হাতে পায়ে আঙ্গুলের ছাপ; রশির ছাপ। তার বক্ষে জুরে আঁচড়ের দাগ; কামরের দাগ। দেখে মনে হইতেছে পাষাণ হায়নারা তার শরীরের সমস্ত রক্ত চুষে খেয়েছে। যৌনাঙ্গ রক্তাক্ত। রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সতীত্ব কেড়ে নিয়েছে। তিনি বুঝতে পারছেন কুলসুমের সাথে কি ঘটেছে? আর এটা দুই-তিন জনের পক্ষে এটা করা সম্ভব না। না হলেও পাঁচ থেকে ছয়জন এর সাথে জড়িত ছিল। সম্মানীর সম্মান সৃষ্টিকর্তাই রক্ষা করেন। আর একজন দ্বীনদার মহিলা কখনোই চায় না অন্য একজন নারীর সম্মানহানি হোক। তিনি বিষয়টা সম্পূর্ণ গোপন রাখলেন এবং পাপীদের সাজার জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন। সবশেষে শেষ বিকালের দিকে কুলসুমের দাফনকাজ সম্পন্ন করা হলো। শরীফ, ছলিম, মেহের, লতিফ ও গফুর পাঁচ বন্ধু। গ্রামের মানুষ সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ে। রাত কিছুটা গভীর হলেই খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়তো পাঁচ বন্ধু যাইতো জমিদার বাড়ির সেই তৃতীয় তলায় আড্ডা, তাস খেলা, জুয়া খেলা, মদ খাওয়ার জন্য। তারা পাঁচজন কখনোই একসাথে যাইতো না। পাঁচজন আলাদা আলাদা করে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন পথে যাতায়াত করতো। একই পথে তারা কখনোই চলাচল করতো না। মাঝ রাতেই তারা যে যার যার ঘরে ফিরে আসতো। যেটা গত তিন বছরেও এলাকার কারো চোখে পড়ে নি। তারা পাঁচজন এমনটাই ছিল যে এলাকার একটা মানুষও বলতে পারবে না তারা অন্যায় এতো বাজে অভ্যাস আর পাপ কাজে লিপ্ত। কারণ তারা পাঁচ জন নিতান্তই ভালো মানুষ রূপে এলাকায় বসবাস করতো। এমনকি তারা সমাজের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমুখী কাজ করতো। আমাদের বর্তমান সমাজেও এমন মানুষ দেখা যায়। যারা মুখে ভালো মানুষের মুখোস পরে চলাফেরা করে কিন্তু তাদের মুখোসের আড়ালে যতো অন্যায়-অবিচার, সমাজ বিরোধী আর পাপ কাজে লিপ্ত। তারা পাঁচজন ভীষণ ভয় সন্ত্রস্তে ছিল কেউ যদি জেনে যায় তারাই প্রতিদিন সেখানে আড্ডা দিতে আসতো যার ফলে কুলসুমের হত্যার জন্য তাদেরকেই দোষারোপ করা হয়। কারণ তারা পাঁচজন ছাড়া ওই পুরানো বাড়িটাতে কেউ আসতো না। যদিও কুলসুমের হত্যার বিষয়টা সম্পূর্ণ গোপন। কি ভাবে কি হয়েছে কেউ জানে না? তবুও চোরের মনে পুলিশের ভয় থাকাটা স্বাভাবিক। শরীফ, ছলিম আর মেহের সেইদিন কুলসুমকে খুঁজতে গেলেও সেইদিন লতিফ আর গফুর তাদের সাথে ছিল না। অবশ্য তাদের দুইজনকে যাওয়ার জন্য ডাকাও হয় নি। কুলসুমের মৃত্যুর পর থেকে তারা আর জমিদার বাড়িতে আড্ডা দিতে যেত না। কুলসুমের মৃত্যুর শোক-সীমা কমে গেলে কিছুদিন এলাকার অবস্থা স্বাভাবিক গেলেও তার কয়েকদিন পরে এলাকায় অদ্ভুত রকমের কিছু ঘটনা ঘটে। মাঝে মাঝেই রাত গভীর হলে পায়ে ঘুঙুর পরে কেউ দৌড়াদৌড়ি করে। ঝুনঝুন শব্দ করতে করতে এদিক থেকে ওদিক পুরা এলাকা ছোটাছুটি করে। কখনো বা টিনের চালে ইটপাথর দিয়ে ঢিল ছুড়ে মারে। কিন্তু কে বা কারা এইসব করে তা কেউ কখনো দেখে নি। মধ্য রাতের শেষের দিকে জমিদার বাড়ি থেকে ভয়ঙ্কর তীব্র আওয়াজ আসে এলাকায়। কেউ গানবাজনা করে ঢাকঢোল তবলা বাজায়। আবার কখনো কখনো কেউ মনে হয় ঘুঙুর পরে নাচে। পাঁচ বন্ধু রাতের আড্ডা শেষে যে যার মতো বাড়ি ফিরলেও লতিফ আর বাড়ি ফেরে না। সেই রাতে ঘুঙুর পরা মেয়েটি আসে সেই মেয়েটিকে দেখে লতিফ মন্ত্রমুগ্ধে বশীভূত হয়ে যায়। মেয়েটি অসম্ভব সুন্দর; রূপ-রূপসী। যাকে এক পলক দেখলেই যে কোন পুরুষ পাগল হয়ে যাবে। খোলা চুল; পায়ে ঘুঙুর। ঝুনঝুন শব্দ করতে করতে মেয়েটি আগে আগে জমিদার বাড়ির পথ ধরে চলছে লতিফ মেয়েটিকে অনুসরণ করে পিছু পিছু চলছে। একপর্যায় মেয়েটি আর লতিফ জমিদার বাড়ির সেই তৃতীয় তলায় এসে পৌঁছল। রাত তখন অনেক গভীর। অনেক চিৎকার চেঁচামিচি হয়। বাবা গো আমায় বাঁচাও… মাগো আমায় বাঁচাও…. যে চিৎকার পুরা এলাকাবাসী শোনে। সবাই ভয় পেয়ে যায়; সেই রাতে কেউ আর বাহির হতে সাহস পায় নি। সকাল হতে হতেই সবার কাছে খবর পৌঁছে যায় লতিফকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গভীর রাতে যে জমিদার বাড়ি থেকে চিৎকার চেঁচামিচি করতেছিল বাঁচাও বাঁচাও সেটা লতিফের গলার আওয়াজ ছিল নাতো? কাশেম চাচা আট-দশ জন মানুষ নিয়ে জমিদার বাড়িতে যায় লতিফের খোঁজ করতে। তৃতীয় তলায় নাচগানের আসরের মাঝখানে চেয়ারের সাথে হাত-পা বাঁধা আছে লতিফের উলঙ্গ নিথর দেহ। তার শরীরের মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর বড় বড় দাঁতের কামরের দাগ; এটা বড় কোন জীবজন্তুর কামরের মতোও নয় এবং তার যৌনাঙ্গ ভীষণ বিশ্রী ভাবে পাথর দিয়ে থেঁতলানো। মাথাটা খুব বাজে ভাবে দ্বিখণ্ডিত। মাথার মস্তক পর্যন্ত গলে গেছে। রড দিয়ে লতিফের মাথায় আঘাত করা হয়েছে। চেয়ারের পাশেই পরে আছে রক্তাক্ত রড। লতিফের মৃত্যুর কারণ টা কেউ ব্যাখ্যা পারতেছে না। খুবই বাজে ভাবে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।

তারপর কিছু দিন স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল। অতঃপর কিছুদিন পর রাত গভীর হলে আবার পায়ে ঘুঙুর পরে কেউ দৌড়াদৌড়ি করে। ঝুনঝুন শব্দ করে। এবার একই ভাবে গফুর নিখোঁজ। রাতের গভীরে চিৎকারের শব্দ। গফুরের সর্বশরীর উলঙ্গ শরীরেও কামরের দাগ; যৌনাঙ্গ থেঁতলানো। এক হাত আর দুই পা চেয়ারের সাথে বাঁধা। অন্য একটা হাত পুরোপুরি ভেঙ্গে চামরা কেটে আলাদা করা হয়েছে। তারপর তাকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। গলার মধ্যে ভয়ঙ্কর হাতের আঙ্গুলের ছাপ। হাতটা তার সম্মুখেই ফ্লোরে পরে আছে। প্রথমে কুলসুম তারপর লতিফ এবার গফুরের মৃত্যুতে এলাকাবাসী খুবই চিন্তিত আর ভীতু সন্ত্রস্ত। এলাকার এমন মৃত্যুকে কেউ প্রত্যাশা করে না। কিছুদিন পর একই ভাবে মাঝে কিছুদিন বিরতি দিয়ে ছলিম আর মেহেরের মৃত্যু। দুইজনের একইরকম ভাবে শরীরের কামরের দাগ; যৌনাঙ্গ বিশ্রী ভাবে পাথর দিয়ে থেঁতলানো। লতিফ আর গফুর চেয়ারে বাঁধা থাকলেও ছলিম আর মেহেরে নিথর উলঙ্গ দেহ সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলছিল। এলাকার মানুষ বিস্মিত! গ্রামের মানুষের উপর কি অত্যাচার শুরু হলো? এভাবে কার কবে মৃত্যু হবে কে জানে? সবার মনে ভয় ডুকে গেছে আমার নিজের সাথেও যদি এমনটা হয়? ভয়ে রাতে আর কেউ বাইরে বের হতো না। বাইরে বের হবার সাহসটা পর্যন্ত কেউ করতো না। আশেপাশের আট-দশ গ্রামের বড় বড় কবিরাজ ধরেও এর কোন সুষ্ঠু সমাধান কেউ করতে পারে নি। সবাই নীরব-পাথর। কথায় বলে “অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর।” শোক বলাও বুঝি এখানে কথাটা যুক্তিযুক্ত হলো না বরং সেই কথাটাই যদি অন্যভাবে বলা যায় ‘অল্প ভয়ে কাতর, অধিক ভয়ে পাথর’ বললে কথাটা আমার কাছে বেশ যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। কারণ শোকের চেয়ে মনের ভয়টাই অত্যধিক। মরার ভয়; নৃশংস মৃত্যুর ভয়। অন্যদিকে চার বন্ধুকে হারিয়ে শরীফ পাগল প্রায়। খাওয়া-দাওয়া করে না; গোসল করে না। সারাক্ষণ আবোলতাবোল বলে। আমাকে মেরে ফেলবে। একবার মাকে গিয়ে বলে মা গো আমাকে বাঁচাও। একবার বাবা গিয়ে বলে বাবা গো আমাকে বাঁচাও। ও আমাকেও মেরে ফেলবে। আমার চার বন্ধুকে মেরে ফেলছে। এবার আমাকেও মেরে ফেলবে। শরীফকে ওর বাবা-মা জিজ্ঞেস করে বাবা তোকে কে তোকে মেরে ফেলতে চায়? কে মেরে ফেলবে আমাদের বল? শরীফ শুধু বলে ও আমাকে মেরে ফেলবে। আর কোন কথা বলতে পারে না। তোমরা আমাকেও আর বাঁচাতে পারবে না। চার বন্ধুর মতো আমাকেও মেরে ফেলবে। অনেক ডাক্তার কবিরাজ দিয়ে চিকিৎসা করার পর শরীফ দীর্ঘ ছয় মাসের পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। এলাকায় দীর্ঘ এ ছয় মাস আর কোন ভূত-পেতের প্রভাব দেখা যায় নি। এলাকার মানুষ এখন নির্ভয়ে চলাফেরা করে। মানুষের বিশ্বাস আমাদের গ্রামে এখন আর ভূতের আঁচড় নেই। আর কারো জীবন নাশের আশঙ্কাও নেই। অন্যদিন খাওয়ার পরপরেই শরীফের ঘুম আসলেও আজকে তার চোখে ঘুম নাই। যার কারণে বাইরে একটু হাঁটতে বের হলো। একটু হাঁটা হাঁটি করেই আবার ঘুমাতে যাবে। সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল কিন্তু হঠাৎ ওইদিন রাতে শরীফের জীবনে নেমে আসে কালো অন্ধকার। ঘুঙুর পরা মেয়েটি সেই রাতে আবার আসে মেয়ের রূপ দেখে শরীফ মন্ত্রমুগ্ধে বশীভূত হয়ে যায়। শরীফ মেয়েটিকে অনুসরণ করতে শুরু করে। মেয়েটি আগে আগে যায় আর শরীফ তাকে অনুসরণ করে তার পিছু পিছু চলে। ঝোপঝাড়, জঙ্গল পার করে অবশেষে জমিদার বাড়িতে এসে পৌঁছায়। শরীফ মেয়েটিকে অনুসরণ করে একটা একটা করে সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় এসে পৌঁছায়। মেয়েটি ইশারায় শরীফকে চেয়ারে বসতে বললে চুপ করে গিয়ে চেয়ারে বসে। একটু পরেই বানর রশি নিয়ে আসে। বানরের মাথা ফাটা দ্বিখণ্ডিত। মাথার মস্তক দেখা যাইতেছে। মুখ চেহারা বাজে ভাবে থেঁতলানো। দেখতেও বেশ ভয়ঙ্কর লাগতেছে। একটা চোখও সম্পূর্ণ ভাবে গলে গেছে; এক চোখ দিয়ে দেখে চলাফেরা করে। মেয়েটি শরীফের হাত পা বেঁধে দুই আঙ্গুল দিয়ে চুটকি ফুটায়। শরিফের জ্ঞান ফিরে আসে। চোখ খুলে চারপাশে চোখ বুলাতেই তার আর বুঝতে কিছু বাকি রইলো না। শরীফ চিৎকার শুরু করে। তার চিৎকার করেও কোন লাভ নেই। মেয়েটি শরীফের জবান বন্ধ করে রেখেছে। চিৎকার করলেও মুখে দিয়ে কোন আওয়াজ বের হবে না। মেয়েটি এবার মুখ খুলল বলল, শরীফ শান্ত হ তোর সাথে কথা বলি। চিৎকার চেঁচামিচি করে কোন লাভ নাই। দেখ আমি কুলসুম। আচ্ছা আমার কি দোষ ছিল? নাকি আমি তোর প্রেমের কু-প্রস্তাবে রাজি হয় নি তার কারণেই আমার সাথে এমনটা করলি? আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলি। তোদের পাঁচজনের মধ্যে তুই ছিলি প্রথম দোষী। আমাকে এলাকার অন্যকোনো ছেলেপেলে কোনদিনই দেখে নি? আমি দেখতে কেমন? তুই তোমার বন্ধুদের কাছে বর্ণনা করতি আমি দেখতে কেমন? আমি তোর প্রস্তাবে রাজি হইনি। সবাই মিলে আমাকে তুলে আনার পরামর্শ করিস। তোর কারণেই আমি লালসার শিকার; ধর্ষিত। তোদের পরিকল্পনার কদর করতে হয়। এবার হলো তো ভালো? সব কয়টাকে এক এক করে মেরে ফেলেছি। শেষ রক্ষা তো কারোই হলো না। এবার তোর পালা? কিন্তু এতো তারা কিসের আমার কষ্টের কথা গুলো তোর সাথে শেয়ার করি। না হলে আমার আত্মা মুক্তি পেলেও শান্তি পাবে না। তুই জানতি ফজরের আযানের সাথে সাথেই বাড়ির সবার আগে আমি উঠি। অযু করে নামায শেষ করি। বাড়ি থেকে টিউবওয়েল একটু দূরে ছিল। সেইদিনও অযু করেছিলাম মাত্র। অযু শেষ করে ঘরে ফিরবো তখনি তোরা আমাকে অচেতন করে তুলে এনেছিস এইতো খানে; এই জায়গাটায়। আমার জীবনের শেষ প্রান্তে। আমার জীবনের স্বপ্ন আশা সবকিছু ধ্বংস করে দিছিস সাথে আমার জীবন টাও। যখন আমার জ্ঞান ফেরে তখন আমি চেয়ারের সাথে বাঁধা। তোর কাছে মিনতি করেছি আমাকে ছেড়ে দে ভাই। আমি বাড়ি যাব। আমি অযু করেছি নামাযটাও পড়ি নাই। আমাকে ছেড়ে দে তোর দুটো পায়ে পড়ি। আমি বাড়ি যাবো নামাজ পড়বো। তোরা তখন ঘোর মদের আড্ডায় যুক্ত। আমি চিৎকার শুরু করলে আমার বুকের ওরনা সরিয়ে আমার মুখে গুজে দিস। আমার হাত পায়ের বাঁধন খুলে ঘুঙুর পড়িয়ে এই নাচগানের আসরে আমাকে জোরপূর্বক সবাই ধরে ধরে তোদের সাথে নাচিয়েছিস। দেখ ঘুঙুর টা এখনো আমার পায়ে। পর মানুষে আমার মুখটাও কেউ কোনদিন দেখে নি। আর তোরা আমার অঙ্গে অঙ্গে হাত দিয়েছিস। তোদের পায়ে পরেছিলাম। ভাই তোরা আমাকে ছেড়ে দে। আমার আল্লাহর দোহাই। তোরা আমাকে কেউ ছাড় দিস নি। একটা পর্যায়ে আমাকে এই নাচগানের আসরে শোয়াইলি। আমাকে বিবস্ত্র করলি। আমার সারা শরীরে তোদের কামরের দাগ। দাগ গুলো এখনও আমাকে ভীষণ যন্ত্রণা দেয়। আমার বক্ষে তোদের আঙ্গুলের ছাপ। নখের আঁচড়। কয়েকটা চিতা বাঘ যেমন একটা হরিণকে খাবলে খাবলে খায় তোরাও আমার সাথে সেটাই করলি। আমার যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করলি, রক্তে ভাসিয়ে দিলি আমার যৌনাঙ্গ। তোরা আমার সতীত্ব কেড়ে নিলি। তোদের বীর্যে ভাসিয়ে দিলি আমার দেহ। একই ভাবে আমাকে প্রথম দফায় সকালে একবার; দ্বিতীয় দফায় দুপুরে একবার; তৃতীয় দফায় শেষে সন্ধ্যায় একবার, পর পর তিন তিনবার তোরা পাঁচ জন মিলে আমাকে যন্ত্রণা দিলি। এইযে আমার পাশে মুখ থেঁতলানো বানরটাকে দেখতেছিস ওর কথা মনে পরে তোর? তোরা যখন আমাকে একলা হরিণের ধরে চিতা বাঘের মতো খাবলে খাবলে খাইতেছিলি তখন এই বানর টা আমাকে বাঁচাতে এসেছিল। লতিফ রড দিয়ে আঘাত করে ওর মাথা দ্বিখণ্ডিত দেয়। ফের উঠে আসে আমাকে বাঁচানোর জন্য। আমার ইজ্জত বাঁচানোর জন্য। তুই পাথর দিয়ে এই বিশ্রী ভাবে থেঁতলেয়ে দিছিস। ওর সাথের বাকি বানর গুলো ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। আমাকে যখন খাবলে খাবলে খাচ্ছিলি তখন আমার ডান হাতে জোরজবরদস্তি করে বৃথা চেষ্টা করতেছিলাম নিজেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু গফুর আমার ডান হাতটা ভেঙ্গে দেয়। তোরা আমার সবকিছু শেষ করলি। তোদের সবার উদ্দেশ্য হাসিল হলে। গফুর আমার শ্বাসরুদ্ধ করে ফেললে তোরা আমার নষ্ট শরীরটা কাপরে আবৃত করলি। আমার শরীরের সব কামড় আর বক্ষের আঁচড়ের দাগ ঢেকে দিলি। অতঃপর সবাই মিলে আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে গেলি। সবাই ধরাধরি করলে ছলিম আর মেহের আমাকে সিলিং ফ্যানের সাথে আমার ওড়না দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলো। যাতে বুঝে সবাই জানে আমি আত্মহত্যা করেছি। তোর শাস্তি গুলোও তেমনি হওয়া উচিৎ। আরো ভয়ানক। আমি একা অনেক কথা বললাম এবার যতো পারিস চিৎকার কর তোর জবান খুলে দিলাম। বোন আমার তুই; আমি অনেক বড় ভুল করেছি। জানি এ ভুলের ক্ষমা হবে না। তুই আমাকে এবারের মতো ক্ষমা করে দে। তোর মনে আছে, আমিও তোদের পায়ে পড়েছিলাম। মিনতি করেছিলাম। আল্লাহর দোহাই দিয়েছিলাম। তখন একত্বরও আমার ডাক শুনিস নি। তোর মৃত্যু অনিবার্য। আজকে আমার মুক্তির দিন। আমার মৃত্যুর আজকে এক বছর পরিপূর্ণ। তোর মৃত্যুর পরেই আমার মুক্তি সাথে আমার প্রিয় সঙ্গী এই বানরের। ফজরের আযানের আগেই আমাদের বন্দি জীবন থেকে মুক্তি নিতে হবে এর জন্য তোর মৃত্যুটা খুব জরুরী। তার আগে আমার রক্তাক্ত নষ্ট শরীরটা একবার দেখা উচিৎ আমার সাথে সেইদিন তোরা কি করছিলি? নে দেখ আমার চেহারা পাল্টিয়ে নিয়েছি। বীভৎস রক্তাক্ত চেহারা দেখে শরীফ ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। চোখ বন্ধ করিস কেন? দেখ আমাকে মন ভরে দেখ হারামজাদা। চোখ খোল হারামজাদা। শরীফ চোখ খুলল। দেখ আমার যন্ত্রণা গুলো দেখ। এই একটা বছর আমাকে তুষের আগুনের মতো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। আমার অঙ্গে অঙ্গে তোদের হাতের ছাপ। শরীরের কামরের দাগ; বক্ষ জুড়ে আঁচড়ের দাগ। রক্তাক্ত যৌনাঙ্গ। ভীষণ বীভৎস চেহারা। শরীফ চিৎকার শুরু করে বন্ধ কর এইসব; বন্ধ কর। তোর দুটি পায়ে পড়ি। ততক্ষণে নিজের রূপ পাল্টিয়ে নিয়ে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। হাতে বড় বড় নখ; ধারাল বড় বড় দাঁত। শরীফের ডান হাতে কামড়ে ধরল শরীফ চিৎকার শুরু করলো। শরীফের বাম হাতে কামড়ে দিলো। এক এক করে দুই কান কামড়ে ছিঁড়ে দিলো। কান থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে মেজেতে। অতঃপর শরীফকে বিবস্র করলো। শরীফের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কামড় দিলো। কামড় দেওয়ার সাথে সাথেই ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে শরীর থেকে। বানর বড় পাথরটা তুলে আনলো। শরীফের যৌনাঙ্গ পাথর দিয়ে থেঁতলেয়ে দিল। চিৎকার চেঁচামেচি করতেছিল। তার বুক ফাটা আত্ম-চিৎকার এলাকায় অবধি পৌঁছে গেল। রড দিয়ে মাথায় আঘাত করে মাথা দ্বিখণ্ডিত করে দিল। শরীফ খুবই ছটফট করতেছিল; লাথি দিয়ে চেয়ার সহ মেজেতে ফেলে দিল। বানর পাথর দিয়ে শরীফের মুখটা থেঁতলেয়ে দিলো। তারপর চেয়ার থেকে বাঁধন খুলে সেই ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিল। শরীফের মৃত্যুর পর কুলসুম ও বানরের আত্মা পৃথিবী থেকে মুক্তি নিলো। সকাল হতে হতেই গ্রামে হইচই পড়ে গেল। ফের একজনের ভয়ঙ্কর মৃত্যু। গ্রামে আবার ভূত-পেতের আঁচড় পড়েছে। রাত হলে মানুষ আর বাড়ি থেকে বেড়ানোর সাহস পেত না। বছর-ছয় মাস পরে দিনে দিনে গ্রাম আবার স্বাভাবিক গেল।

লেখক পরিচিতি:

রাকিবুল হাসান ১৯৯৮ সালে ৩০ শে মে কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী থানার মধুর হাইল্যা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পড়াশোনায় তিনি বর্তমানে ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে বিএসসি কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করতেছেন। লেখক বেড়ে ওঠেন নিজ গ্রামেই। ধুলোমাটি প্রকৃতির সাথে তার আত্মার আত্মীয়ের মতো সম্পর্ক। নদী নালা, খাল-বিল, গ্রামীণ খেলাধুলো তার শৈশবের স্মৃতি। তাঁর পিতা মোঃ ইউনুছ আলী, পেশায় একজন শিক্ষক। মাতা মোছা: রমিচা বেগম। তাঁর প্রথম প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ ‘অম্বালিকা মনস্তাপ’।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post গাছ ভাঙা গুঁড়ি | ভয়ের দেশ |মৃত্যুঞ্জয় শীল| Bengali Horror Story
Next post পুতুলগাঁয়ের ইতিকথা | ভয়ের দেশ |অনির্বাণ সরকার| Bengali Horror Story