Getting your Trinity Audio player ready...
|
সুন্দরবনে আসার পর থেকে দেওয়াল ঘড়ির ছোট কাঁটাটা বার তিনেক তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে ফেললেও বুদ্ধির কাঁটায় যেন আমার পরিবহন ধর্মঘট। সি.আই.ডি জয়েনের পর শেষ সাত বছরে সতেরোটা সাংঘাতিক কেসের শেষ সংলাপ লিখেছে আমারই শানানো মগজাস্ত্র। ক্রিমিনাল আর কারাগারকে এক সুতোয় আনতে চিরঞ্জিৎ সাহার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু সুন্দরবনের এই হরিণ কেসটা কুরুক্ষেত্রের অভিমন্যুর মতোই কেমন যেন চক্রব্যুহে বন্দি করে ফেলছে আমাকে। শারীরিক সক্ষমতা কিংবা বুদ্ধির বিস্তার – দুই ক্ষেত্রেই ক্রিমিনালের যাবতীয় জারিজুরিকে যাচ্ছেতাই ভাবে জবাই করার জবরদস্ত রেকর্ড আমার দখলে থাকলেও পশুর সাথে সম্মুখ সমর এই প্রথমবার। কেসটা হাতে নেওয়ার তেমন ইচ্ছে আমার না থাকলেও যে দেশে প্রশাসনিক অঙ্গুলিহেলনে স্বয়ং রাম থেকে আল্লাহ অবধি উঠবোস করতে বাধ্য হন, সে দেশে সামান্য সরকারি কর্মচারি তো কোন ছাড়!
সুতরাং, সব দ্বিধাদ্বন্দ্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে গত পরশু সন্ধ্যায় এসে হাজির হলাম সুন্দরবনের জঙ্গল ঘেরা ঝাঁ চকচকে সরকারি আবাসনে। ঢোকার পর হাত-পা ছড়িয়ে দিন দেড়েকের বিশ্রাম, তারপর মুখোমুখি হতে হল এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকের। স্থানীয় বিধায়ক সনাতন মান্ডির কথায় – “দ্যাহেন স্যার, মানুষ মারবে মশা আর বাঘ মারবে হরিণ। এইডা খুব সাধারণ বিষয়। উদ্বেগের কোনো জায়গাই নাই। আমি পরিবেশ ফরিবেশ বুঝি না। হরিণের মরণ নিয়া আমার কোনো চিন্তাও নাই, ভাবনাও নাই। আমার সমস্যা হইল গিয়া মানুষের আতঙ্কের লাইগ্যা। আগে বাঘগুলা উদের কুর এলাকায় থাইকত, উখানেই হরিণ, ভেড়া -যা পাইরত, মাইরা খাইত। হ্, দু-একখান বাঘ মাঝেমইধ্যে বেরিয়া আইত ঠিক হই; তবে হ্যাডা কদাচিৎ। কিন্তু অহন তো দেখি রুজই আইতাসে। আমাগো পুলাপান তো কুর এলাকায় যাওনের সাহস কোনোকালেই পাইত না বাঘের লাইগ্যা। কুর এলাকার থেইক্যা বহুদূরে, নিজেদের বসতির পিঠাপিঠি জঙ্গলগুলাতেই উরা যাইত মোম, মধু সব আইনতে আর ওগুলা আইন্যাই বেচত বাজারে। বিলে মাছও ধইরতো অনেকে। কিন্তু অহন তো বাঘের ভয়ে সব বাড়িত বসা। বসতি, কুর বইল্যা আলাদা কিস্যু নাই – জলে-জঙ্গলে সুন্দরবন, গুটাটাই বাঘের। তা অহন আমাগো পেট চলবে ক্যামনে? মানুষ তো আমার ওপর ক্রমশ খেইপ্পা যাইতাসে। আমি জানি, আপনে মানুষের কারবারি করেন। পশু ধরা আপনের কাম না। কিন্তু দুমাস পরে বিধানসভা ভোট। বিরোধীগুলা তো সবকিছুরে আমার ষড়যন্ত্র বইল্যাই প্রচার করতাসে আর বন দপ্তরের কথা তো বাদই দেন। উরা তো ঘোমটা পইরা খ্যামটা নাচনেই ব্যস্ত চিরকাল। আপনেই অহন আমার একমাত্র ভরসা স্যার।”
“এমন মন্তব্য আপনি করতে পারেন না সনাতনবাবু। ইতিমধ্যেই আমরা বাঘকে পাকড়াও করতে লোকালয় সন্নিহিত জঙ্গলগুলোতে তিনশোর ওপর খাঁচা পেতেছি। শুধু মুরগি কিংবা ছাগল নয়, বিপুল ব্যয়ে হরিণকেও ব্যবহার করা হচ্ছে টোপ হিসেবে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র আন্তরিকতা ও অপরিসীম সাহসিকতায় ভর করে একের পর এক দুর্গম জঙ্গলে সোলার লাইট বসিয়েছে আমাদের একনিষ্ঠ কর্মীরা। কিন্তু প্রকৃতির উর্ধ্বে আমরা কেউই নই। এই ভরা বর্ষায় কড়া রোদের অভাবে রাতে জ্বলছে না লাইটগুলো। তার দায় কি আমাদের? ওয়াচ টাওয়ারগুলোতে সারারাত বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের লোকেরা। কিন্তু প্রবল অন্ধকারে চোখে পড়ে না কিছুই-” সনাতনবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে শুরু করেন বন দফতরের অফিসার রুদ্র রায়।
“বাঘ আমাগো দফতরের কর্মীগুলার থেকেও বেশি বুদ্ধি ধরতাসে, কি কন রুদ্রমশায়! ওগুলারেই এবার কাজে লাগায়ে দিই তাইলে।”
“দেখুন, আজ না হোক কাল। বাঘ তো ধরা পড়বেই কিন্তু ওদের জঙ্গলে আটকে রাখার দায়িত্বটা ঠিক কার, শুনি?”
“ক্যানে? বাঘ জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে আইবে ক্যানে? ও কি আপনের বৌরে পোয়াতি কইরা রাইখ্যা গেছে যে বাচ্চার দায়িত্ব নিতে আইব?”
“বাঘ আমার বৌকে কিছু না করলেও আপনার ছেলেরা যে সুন্দরবনের হরিণ মেরে সোনাগাছির বহু মেয়েকে প্রেগন্যান্ট করে এসেছে, সে গল্প তো আপনার অজানা নয়।”
“মুখ সামলে অফিসার!”
“গতবার বিশু আর মুনাইকে যখন আমরা হাতেনাতে ধরেছিলাম, তখন জামিন কিন্তু আপনিই করিয়েছিলেন স্যার।”
“ওগো অপরাধ হালকা ছিল, তাই কোর্ট ওগো জামিন দিছিল। আমি না। আর আমি তো আপনাগো আটকায়া রাখি নাই। প্রমাণসমেত বিশু, মুনাইরে অ্যারেস্ট করেন। সমস্যা কী!”
“অ্যারেস্ট তো করবই। তবে শুধু বিশু-মুনাইকে নয় ; দরকার পড়লে ওদের বাপকেও।”
“ওরে কে আছিস? অফিসাররে দুইখান প্যানডি খাওয়া। অম্বল উর মাথায় উঠে গেছে। বিচি হিট হয়া লাফালাফি করতাসে। বরফ দে।
দ্যাহেন, বিশু-মুনাই আমার হয়ে ভোটের সময় কাজ করে ঠিক হই, হ্যারা একসময় হরিণ মারত হ্যাডাও আমি অস্বীকার করি না কিন্তু সত্যি হইল এইটাই যে, উরা এখন আসন্ন ভোট নিয়াই ব্যস্ত, উসব করার সময় উগো নাই। আপনে তো জঙ্গলের কারবারি করেন, মানুষের খোঁজ না রাখতে রাখতে মগজখানও দেখতাসি দিন দিন কেমন পশু পশু হইতাসে। চোখ কানের ঘাগরা খুইল্যা একটু মুঝরা দ্যাহেন। বিশু-মুনাই অহন চাকরি করে পঞ্চায়েতে, উরাও আপনের মত সরকারি ঘরের মাইনা পায়। আর আমি আগেও বহু মিটিংয়ে আপনারে স্পষ্ট ভাষায় কইসি যে, আমি মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধি। হরিণ কিংবা বাঘের নয়। বাঘ, হরিণ আমারে ভোট দিয়া জিতায় নাই। বরং, এই বাঘের লাইগ্যাই এবার ভোটে বিচ্ছিরি রকম চাপে আসি। বাঘ, হরিণ যেদিন আমারে ভোট দিবে, সেদিন না হয় উদের মঙ্গলের কথা ভাইব্যা ইস্পেশাল সংরক্ষণ দিয়া দিমু। পেটের দায়ে মানুষ হরিণ মাইরা বেচবই, ওগো আমি বাধা দিব না। আপনের ক্ষমতা থাকলে আপনে অ্যারেস্ট করেন; আপনারেও বাধা দিব না, কইতাসি ত।”
“বনে হরিণ না পেলেই যে বাঘ খাবারের খোঁজে লোকালয়ে আসে, সে কথা আপনি আমার থেকেও অনেক ভালো জানেন সনাতনবাবু।”
“জঙ্গলে হরিণ আছে, জঙ্গলে বাঘও আছে। আবার আপনারাও জঙ্গলের কারবারি। মানুষ যাতে হরিণ না মারে আর মানুষরে যাতে বাঘ না মারে — তা দেখার দায়িত্ব আপনের। নাহলে আপনেরে নিয়ে রসিকতা তো এবার হায়ার অথরিটির সাথে করতে হইব, রুদ্রবাবু। রুদ্রের বিচি শুকায়ে দেখি লিচি।”
“আচ্ছা, অনিমেষবাবু আপনি তো আমার থেকে অনেক বেশি অভিজ্ঞ এ বিষয়ে। আপনিই বলুন যে, হরিণশূন্য বনে বাঘকে কি কখনো আটকে রাখা সম্ভব?” -ইতস্তত প্রশ্ন রুদ্র রায়ের।
– “দেখুন, রুদ্রবাবু আপনাকে তো আমি আগেই বলেছি যে খাদ্যের জন্য বাঘ কেবল হরিণ নয়, অনেক বন্য পশুর ওপরই নির্ভরশীল। তবে হ্যাঁ, হরিণটা ওদের খুব প্রিয়। ওই আমার যেমন কচি পাঠা আরকি! কিন্তু দরকারে আমি যেমন পনির দিয়েও পেটটা ভরিয়ে নিই, ওরাও তেমনি প্রয়োজনে ভোজটা চালিয়ে নেয় বনমুরগি কিংবা শিয়াল দিয়ে – তবে জিভে জল আনা হরিণের স্বাদ আর জম্পেশ উদরপূর্তি – দুয়ে মিলে বাঘের জন্য বেশ একটা জমকালো আয়োজন বলতে পারেন।
এবার বাঘ যে শুধু খাদ্যের সন্ধানেই কোর, বাফার পেরিয়ে লোকালয়ে আসে, তেমনটা কিন্তু একদমই নয়; অনেক সময় পথ ভুল করে কিংবা বাঘিনীর পিছনে ধাওয়া করেও তারা ঢুকে পড়ে মনুষ্য বসতিতে আর আপনার অনুমান অনুযায়ী সুধন্যখালির লোকালয়ে বিরাজমান বাঘের সংখ্যা একের চেয়ে বেশি; সুতরাং প্রণয় কিংবা বাঘিনী কেসটাকে আমি পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারছি না কিছুতেই।
কিন্তু যদি হরিণের অভাবই বাঘের জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসার একমাত্র কারণ হয় এবং হরিণ খুনের দায় যদি থাকে চোরা শিকারিদের কাঁধে; তবে সত্যিই আমি নিরূপায় কারণ, বাঘ ধরাটা আমার কাজ হলেও চোর ধরাটা আপনার।” – এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করলেন বাঘকে রেডিও কলার পরানোর বরাত নিয়ে মাসখানেক আগে সুন্দরবনে আসা ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধি অনিমেষ দত্ত।
“সেজন্যই তো আপনাকে বারবার বলছি যে সুধন্যখালিতে রেডিও কলার প্রজেক্টটা আগে আগে করানোর ব্যবস্থা করুন প্লিজ। সম্ভব হলে কাল থেকেই। তাতে অসহায় মানুষগুলোকে বাঁচানোর অন্তত একটা রাস্তা খুঁজে পাওয়া যাবে কারণ, আপনি নিজেও জানেন যে, এ ব্যাপারে আপনার মত দক্ষতা আমাদের দফতরের কর্মীদের সাধারণত থাকে না। জঙ্গলের অন্ধকারে ঠিকমত দিশাই খুঁজে পাচ্ছে না আমাদের স্টাফরা, গুলি করা তো দূরের কথা। আপনি সেখানে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। বিষয়টা আপনি হাতে নিলে হরিণ মৃত্যুর কারণ খুঁজে পাই বা না পাই, বাঘটাকে অন্তত বন্দি করতে পারব বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”
“কথার মাঝে কথা বলাটা আপনার ভীষণ বাজে স্বভাব রুদ্রবাবু। আগে আমাকে শেষ করতে দিন প্লিজ। দেখুন, হরিণ কিংবা খাদ্যের অভাব, যাই বলুন না কেন কিংবা প্রণয়ঘটিত যৌন বিষয় – এগুলিই যে একমাত্র সম্ভাব্য কারণের মধ্যে পড়ছে তা কিন্তু নয়। আশ্চর্যের বিষয় হল, মানুষের মত বাঘেদেরও মাঝেসাঝে বয়সজনিত মানসিক বিকৃতি কিংবা সমস্যা দেখা দেয় আর তখনই তারা দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে উন্মাদের মত খুন করতে শুরু করে। নাহলে একটা বাঘ কিন্তু ভরপেটে পরপর হরিণ কখনোই মারবে না এভাবে কিংবা হরিণের পিছনে ধাওয়া করার কসরৎটুকুও করবে না বলেই আমার অন্তত বিশ্বাস। আপনাদের তোলা ছবি দেখে আমার যা অনুমান তাতে, যে দুটো হরিণের ডেডবডি আপনারা পেয়েছেন; তাদের মাংস কিংবা ছাল – কোনোটাই কিন্তু খুলে নেওয়া হয়নি খুব একটা সুনিপুণভাবে। অথচ চোরা শিকারিদের মূল লক্ষ্য থাকা উচিত ওই দুটোই। যদিও চোরা চালান কিংবা সেসব বিক্রির বিষয়ে বাস্তবিক জ্ঞান আমার আপনার থেকে অনেক কম; তবুও কেউ চুরি করতে এলে মাংস কিংবা চামড়াটুকু বনে ফেলে রেখে যাওয়ার নির্বুদ্ধিতাটুকু বোধ হয় করবে না। সুতরাং, চোরা শিকারির অপশনটা আমার অন্তত বিশ্বাসযোগ্য লাগছে না। এবার দ্বিতীয় যে সম্ভাবনা থেকে যায় আপনার মতে, তা হল বনে হরিণের আকাল এবং আপনি বলছেন যে হরিণের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য হ্রাসের প্রমাণ আপনি পেয়েছেন আর ঠিক সেই কারণেই বাঘ হানা দিচ্ছে লোকালয়ে। কিন্তু রুদ্রবাবু, এক্ষেত্রেও আমার ভাবনার বিষয় এটাই যে, বাঘ যদি খাদ্যের অভাবেই জনবসতিতে আসবে, তবে সে বনে পড়ে থাকা মৃত হরিণকে ফেলে রাখবে কেন? এমনও নয় যে, আপনার সংগ্রহ করা মৃতদেহ সাতদিনের বেশি পুরনো; বরং যখন আপনি ওটা তুলে এনেছিলেন, তখন কিন্তু বেশ টাটকাই ছিল। আর সুধন্যখালির জঙ্গলের যা গভীরতা তাতে পুরো কোর এলাকা জুড়ে গোটা কুড়ি হরিণ মারা শিকারিদের পক্ষে যে এক প্রকার অসম্ভব, তা আপনি জানেন বিলক্ষণ। আর মারলেও মারার পর যে তারা হরিণ ফেলে রেখে চলে যেত না, সেটাও আপনার অজানা নয়। আমার ধারণা, এটা একাধিক নয়, একটি বাঘেরই কাজ আর মানসিক কোনো বিকৃতি থেকেই সে কোর এলাকায় নেশারির মত হরিণ মেরে বাফার টপকে এসেছে মানুষ মারতে।”
“অনিমেষবাবু, আমরা কিন্তু মাত্র দুটো হরিণের ডেডবডি হাতে পেয়েছি। বাকিগুলো অনেক খুঁজেও পাইনি এখনও। তাছাড়া আমার হিসেব অনুযায়ী, নিখোঁজ হরিণের সংখ্যাটা প্রায় পঁচিশ ছুঁইছুঁই। সেক্ষেত্রে বাকি হরিণ সব গেল কোথায়? আপনার কথানুযায়ী বাঘই যদি মানসিক বিকৃতিতে হরিণগুলোকে হত্যা করে থাকে, সেক্ষেত্রে মৃতদেহগুলো তো অন্তত জঙ্গলেই থাকার কথা। আমার ধারণা, নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো হওয়ার কারণে হরিণ মারার পরও উদ্ভুত কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শেষদুটো লাশ ফেলে পালাতে বাধ্য হয়েছে চোরা শিকারির দল। গত পরশু পাওয়া লাশ পরীক্ষা করে আপনি নিজেই বলেছেন যে, সেটা খুব বেশি হলে দিন তিনেকের পুরনো। আর আমাদের ব্যাঘ্র সন্ধান অভিযান শুরু হয়েছে আজ নিয়ে ষষ্ঠদিন। কাজেই হয়তো আমাদের কোনো কর্মীর উপস্থিতি টের পেয়ে বা পাওয়ার আশঙ্কা করেই চোর হরিণ ফেলে রেখেই পালিয়েছে বন থেকে। তারপর আর ওমুখো হয়নি আমাদের ভয়ে।”
“হাসালেন রুদ্রবাবু। প্রথমত, চোর কোর এরিয়ার ওই গভীর জঙ্গলে ঢুকে হরিণ মারতে পারল, তারপর আবার সুরক্ষিতভাবে বেরিয়েও গেল; মাঝে শুধু হরিণটাকে ভয়ে পেয়ে ফেলে গেল। একি পিসি সরকারের ম্যাজিক নাকি মশায়! আর যে এত কিছু করতে পারল সে একটা হরিণ নিয়ে বেরোতে পারবে না? বুদ্ধি তো দেখছি আপনার টাগরায় আটকে। ঝাঁকানিটা দিন নাকি বারখানেক। আর দ্বিতীয়ত, গোটা সুন্দরবন শুধু এটুকুই জানে যে, বন দপ্তর লোকালয়ে ঢোকা বাঘ ধরতে উঠে পড়ে লেগেছে। বাফার এলাকাতেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। খাঁচা বসানো হয়েছে।
হরিণ হ্রাসের বিষয়টা কিন্তু ডিপার্টমেন্টের বাইরের কেউ সেভাবে জানে না এখনও। সুতরাং, কোর এলাকায় বন দফতরের লোক যে নিয়মিতভাবে যাতায়াত করছে, সেটা চোরের পক্ষে অনুমান করা রীতিমতো অসম্ভব। যদিও আপনার কর্মীরা কোরে দায়িত্ব পালনে যে কতটা তৎপর, তা তো আমি গত একমাস ধরে দেখতেই পাচ্ছি। হা!হা! তাছাড়া পলাতক বাঘের খুন করা হরিণকে বনের অন্য বাঘ কি খেতে পারে না পরে? হাস্যকর যুক্তি মশাই আপনার! যদি আপনার হরিণ সম্পর্কিত গণনা পুরোপুরি নির্ভুল হয়ে থাকে, তবে হয়তো অন্য কোনো বাঘ বা পশুর পেটেই গেছে নিখোঁজ হরিণগুলো। কিন্তু আপনার অনুমানটাই আমার কাছে বেশ গোলমেলে রুদ্রবাবু।”
“আমাদের গাফিলতি আমি অস্বীকার করছি না অনিমেষবাবু। কোর এলাকায় নিয়মিত টহল চললে হয়তো আমাদের এই দিন দেখতেই হত না। কিন্তু সমস্যা হল, দফতরের কারোরই কোরে ঢুকে কাজ করার মতো উপযুক্ত কোনো প্রশিক্ষণ নেই। সিনিয়ররা তো ভিতরে যেতেই চায় না। কোর অনেকটা ওই টেস্ট ম্যাচে শর্টে ফিল্ডিংয়ের মত – কোনো জুনিয়র এলেই বিপদে ঠেলে দাও তাকে। ধরেই নেওয়া হয়, ডিউটিটা সেখানে নামেই হবে, কাজে নয়। ঘুরপাক সে খাবে বাফারেই। যাই হোক, বাদ দিন সেসব। আপনার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ এটাই যে, অনুগ্রহ করে সুধন্যখালিতে রেডিও কলার করার ব্যবস্থাটা দ্রুত করুন প্লিজ। তাতে অসহায় মানুষগুলোকে অন্তত বাঁচাতে পারব। হরিণটাকে নিয়ে না হয়, পরে ভাবা যাবে স্যার। ছ-ছটা দিন হয়ে গেল। ইতিমধ্যেই চারজন হসপিটালাইজড। জানি না, শেষমেষ কি আছে কপালে।”
– “দেখুন রুদ্রবাবু, এই বিষয়টাতে আমি দক্ষ ঠিকই কিন্তু জাদুকর নই। বাইরে থেকে দেখে মনে হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক যে, আমরা কত সহজে বাঘেদের ঘুমপাড়ানি গুলি করে রেডিও কলার পরিয়ে পাঠিয়ে দিই জঙ্গলে কিন্তু বাস্তবটা ঠিক ততটাই কঠিন। একটা জঙ্গলে ঢোকার আগে তার নাড়িনক্ষত্র নখদর্পণে আনতে বহু বিনিদ্র রাত ম্যাপ আর বই হাতে কাটাতে হয় আমাদের। তাছাড়া, প্রজেক্ট লিস্টে সুধন্যখালিকে শুরু থেকেই রাখা আছে সবার শেষে। ইনফ্যাক্ট, এই পাঁচ মাসের রেডিও কলার প্রজেক্ট শেষ করার পরিকল্পনা ছিল সুধন্যখালি দিয়েই কিন্তু আপনাদের অনুরোধে বিষয়টা এগিয়ে আনার কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছি আমি। সুধন্যখালি নিয়ে পড়াশোনাও শুরু করেছি গত পরশু থেকে। তবে কম সে কম এক মাস সময় তো লাগবেই। পরিস্থিতির গুরুত্ব আর নিজের রেপুটেশন দুটোকে আজীবন একই পাল্লায় মেপেছি আমি। তাই অপ্রস্তুত অবস্থায় কাজে নেমে নিজের কষ্টার্জিত সুনামকে নষ্ট করতে চাই না কিছুতেই।”
অনিমেষবাবুর দীর্ঘ বক্তব্যের পরিসমাপ্তির সাথেসাথেই রুদ্রবাবু ও সনাতনবাবুর চিন্তিত কপালের ভাঁজ আমার অগোছালো ওয়ারড্রবের কোঁচকানো জামাকাপড়কেও পাল্লা দিয়ে গোলের মালা পরাল অবলীলায়। ঘন্টা দেড়েকের মৌনতা ভেঙে প্রথমবারের জন্য মুখ খুললাম আমি — “দেখুন, আপনাদের কথা শুনে যা বুঝছি, তাতে সমস্যা এখানে মূলত দুটো। প্রথমটি হল বাঘের লোকালয়ে বেরিয়ে আসা এবং যার ফলে ইতিমধ্যেই আহত হয়েছেন অনেক দরিদ্র গ্রামবাসী আর দ্বিতীয়টি, রুদ্রবাবুর কথানুযায়ী, সুধন্যখালিতে হরিণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে দিনদিন এবং যার পিছনে চোরাশিকারিদের প্রত্যক্ষ হাত আছে বলে ওনার অনুমান আর এই হরিণই যেহেতু বাঘের প্রিয়তম খাদ্য; তাই খাদ্যের, অভাবই হয়তো বন ছেড়ে মনুষ্য বসতিতে হানা দিতে বাধ্য করছে মানুষখেকোকে। তবে আপনাদের সাথে আমি একমত যে মানুষের স্বার্থে বাঘকে খাঁচাবন্দি করাটাই এখন সর্বাগ্রে জরুরি। যদিও এ বিষয়ে আমি একেবারেই আনকোরা। কিন্তু হার আমি মানতে শিখিনি। এই হরিণ আর বাঘ কেসের সমাধান না করে আমি সুন্দরবন ছাড়ব না কিছুতেই। কথা দিলাম।”
আমি চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগেই কাজের তাড়ায় অনিমেষবাবু বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। সিঁড়ি দিয়ে অতীব আপ্যায়নে রুদ্রবাবু আমাকে নিয়ে এলেন একতলায়। নামতে নামতে আলাপচারিতার দু-একটা সাধারণ কথাবার্তার পাশাপাশি রাত্রে আন্তরিক নিমন্ত্রণ জানালেন নিজের কোয়ার্টারে । খাদ্যরসিক আমি নিমন্ত্রণটা সানন্দে লুফে নিয়েই বিধায়কের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম নিজের রয়াল এনফিল্ডে স্টার্ট দিয়ে। কলেজ ট্যুরে একবার এসেছিলাম বটে সুন্দরবন। তবে সে প্রায় দু’দশক আগের কথা। তদন্তের পাশাপাশি এই সুযোগে পুরনো প্রেমটাকেও একটু ঝালিয়ে নিতে হবে যে …
সূর্য তখন প্রায় নিভে এসেছে। শাঁখের আওয়াজ ভেসে এল দূর থেকে। বাঘের ভয়ে সন্ত্রস্ত গোটা সুধন্যখালি। আলপথ ধরে বাইক ছুটিয়ে আমি এসে হাজির হলাম নূর আলমের মাটির ঘরে। গতকাল রাতেই সে ফিরেছে হাসপাতাল থেকে। দিন সাতেক আগে ভোরবেলা খোয়ার থেকে পোষা ছাগল মদিনাকে বের করতে গিয়ে সে দেখে, ঘরময় চাপ চাপ রক্ত বিস্মিত নূর ভয়ে ভয়ে আরও পা দুয়েক এগোতেই প্রত্যক্ষ করে সামনে পড়ে মদিনার ছিন্নভিন্ন নাড়িভুঁড়ি আর তার অনতিদূরেই জ্বলন্ত দুটো চোখ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখদুটো বিদ্যুৎ বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে নূরের ওপর। তীব্র আর্তনাদ শুনে ছুটে আসা পাড়া-পড়শি আবিষ্কার করে বাঘটিকে। মশাল হাতে সমবেত জনতার গর্জন শোনামাত্রই ডোবা টপকে পালিয়ে যায় ম্যান ইটার। সুন্দরবন এলাকায় এমন মশাল সর্বদা প্রস্তুতই থাকে গ্রামবাসীদের বাড়িতে। বাঘের আক্রমণকে পাশবালিশ করেই এদের জীবন এগিয়ে চলেছে যে।
রাত্রে হাজির হলাম রুদ্রবাবুর কোয়ার্টারে । ভেটকি, ইলিশ, কাতলা সহযোগে সে এক এলাহি আয়োজন। আলাপ এগোতে বুঝলাম, নিজের মনের কথা একান্তে সবিস্তারে খোলসা করতেই রুদ্রবাবুর এই অভিজাত আমন্ত্রণ। খেতে খেতেই বলা শুরু করলেন তিনি, “দিন সাতেক আগে নূরের গোয়ালে বাঘটাকে প্রথম দেখে গ্রামবাসীরা। রোজকার মতোই নূর সেদিনও গিয়েছিল ওর ছাগলগুলোকে গোয়াল থেকে বের করতে আর সেখানেই দর্শন পায় ভয়াল রয়্যাল বেঙ্গলের। বাকি গল্পটা তো আপনি ওর মুখেই শুনেছেন। অভিযোগ আসামাত্রই আমরা সেদিন প্রায় চল্লিশটি খাঁচা বসাই গোটা গ্রাম জুড়ে। প্রাথমিকভাবে আমি নিজেও ভেবেছিলাম হয়তো একটি বাঘই কোনো বিশেষ কারণে জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে লোকালয়ে। এ আর নতুন কী! এমন ঘটনা তো আকছারই ঘটে থাকে। কিন্তু আমার ভুল ভাঙল দিন তিনেক পর। ততদিনে বাঘের থাবায় আহত হয়েছে আরো দুজন। উপায়ন্তর না দেখে আশেপাশের সমস্ত ওয়াচ টাওয়ার থেকে শুরু করলাম নজরদারি আর তখনই চোখে পড়ল বিশেষ এই গরমিল। সুধন্যখালির কোর এরিয়ায় বাঘের সংখ্যার অনুপাতে প্রতিবছর বর্ষায় তিরিশটি হরিণ ছাড়ার ব্যবস্থা করা হয় বন দফতর থেকে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে নজর রাখলে জঙ্গলে বাঘ আপনার চোখে না পড়লেও সংখ্যাধিক্যের কারণে হরিণ চোখে পড়বেই। কিন্তু ব্যতিক্রম হল এই প্রথমবার। আধঘন্টা বাইনোকুলারে চোখ রাখার পরও দেখা নেই হরিণের। অগত্যা আমি আর ড্রাইভার সুরেশ জিপ নিয়ে রওনা দিলাম জঙ্গলে। সাথে ছিলেন আরো দুজন সিনিয়র অফিসার। প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই সোজা ঢুকে পড়লাম কোর এরিয়ায়। হরিণ কিছু নজরে এল বটে, তবে তা হিসেবের তুলনায় নেহাতই নগণ্য। উপরন্তু পথে পেলাম, খুবলে নেওয়া দুটো হরিণের লাশ। কাল সকালে সেগুলো দেখাতে আপনাকে নিয়ে যাব মিউজিয়ামে। কিন্তু আমার প্রশ্ন এটাই যে, হঠাৎ এমন হরিণ হ্রাসের আসল কারণটা ঠিক কী? আর অনিমেষবাবুর মত যাই হোক না কেন, আমার অধীত বিদ্যে বলে, যে খাদ্যের টানই বাঘকে মূলত টেনে আনে লোকালয়ে। নিজের বাসস্থান ছাড়তে বাঘ কেন, কোনো প্রাণীই চায় না। আর আমার হিসেব অনুযায়ী নিখোঁজ হরিণের সংখ্যা দুয়ের থেকে অনেক গুণ বেশি। তাছাড়া, সুধন্যখালির সমস্ত বাঘ যে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে, এমনটাও তো নয়। হয়তো অন্য কোনো বাঘের তাড়া খেয়েই চোরা শিকারি বাধ্য হয়ে হরিণের লাশ ফেলে পালিয়েছে। কি বলেন চিরঞ্জিতবাবু?”
“কিন্তু আপনি চোরা শিকারির বিষয়ে এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে?”
“অভিজ্ঞতা চিরঞ্জিতবাবু অভিজ্ঞতা। কম দিন তো হল না আমার এই লাইনে। তার মধ্যে এই সুন্দরবনেই ছ-ছটা বছর। একটা ভোটে জেতা মানে কত ইনকাম আপনার কোনো আন্দাজ আছে কী?”
“কোটিখানেক তো বটেই।”
“পাঁচ বছরে কম সে কম একশো কোটি। পাঁচবছর আগে এই ভোটের মরসুমেই পীরখালির জঙ্গল থেকে ধরেছিলাম বিশু আর মুনাইকে। যদিও পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ হয়নি সেবার। ঘটেনি কোনো বাঘের আক্রমণও। রুটিন রাউন্ডে গিয়েই ধরেছিলাম ওই দুটোকে। বানচোদ দুটো বন্দুক নিয়ে ঘুরছিল বাফারে। কিন্তু আটকে রাখতে পারিনি। জামিন করিয়ে নিল এম.এল.এ সনাতন মান্ডি। আসলে, হরিণ বেচে কামানো টাকার বড়ো অংশই ওরা দিত পার্টি ফান্ডে আর সনাতনবাবু দিত ওদের নিরাপত্তা।
তবে পরিস্থিতি এবার বেশ ঘোরালো। সীমাহীন দুর্নীতির ধাক্কায় সনাতনবাবুর নৌকো রীতিমতো বেসামাল। ভোট বৈতরণী পারে যেনতেন প্রকারে মরিয়া তিনি। বিশু-মুনাই দিয়ে গদি টিকবে না এবার। তাই পাশের উত্তরপ্রদেশ কিংবা ঝাড়খণ্ড থেকে মোটা ব্যয়ে স্পেশাল ফোর্স এনে ভোট করানোর পরিকল্পনা করাটাও অসম্ভব নয়। হয়তো তারাই এখন ঘাপটি মেরে রয়েছে সুধন্যখালির জঙ্গলে। হরিণ পাচারও হয়তো তাদেরই কাজ আর সেই কারণেই সম্ভবত বিষয়টি এড়িয়ে যেতে দেখলেন সনাতনবাবুকে।”
“যে গভীর অরণ্যে আপনার মত অফিসাররা ঢুকতে সাহস পায় না, সেখানে আনকোরা ক্রিমিনালদের পক্ষে দিনের পর দিন লুকিয়ে থাকা সম্ভব?”
“সিস্টেম চিরঞ্জিতবাবু। সিস্টেম। আমাদের এই পোড়া দেশে কত ফুল যে অঙ্কুরেই ঝরে যায়, সে হিসেব চকচকে এসি ঘরে বসে পাওয়া সম্ভব নয় কখনোই। একজন উগ্রপন্থী আর দক্ষ অফিসারের মধ্যে প্রতিভার তফাৎ প্রায় নেই বললেই চলে; বরং তুল্যমূল্য বিচারে প্যাশনের দিক থেকে ভাবলে উগ্রপন্থীই হয়তো এগিয়ে বেশ কিছুটা কিন্তু উর্দির মনস্তাত্ত্বিক অ্যাডভান্টেজ গণবিচারে অফিসারকে এগিয়ে দেয় অনেক বেশি।”
“আপনি তো মশাই দেখছি সাহিত্যিক হলেও বেশ জমিয়ে লিখতেন ‘জলে জঙ্গলে জমজমাট’!”
“সেসব আর হল কই! ছাড়ুন! আপনি তো কিছুই খেলেন না তেমন! দোষটা অবশ্য আমারই। কানের কাছে এমন বকবক চললে কি আর শান্তিতে খাওয়া যায়?”
“ওভারলোডেড হয়ে গেছি বস। রাতে আমি এর অর্ধেক খাই। আর তাছাড়া আপনার মত একজন মানুষের সাথে পরিচয় হওয়াটাই পরম পাওনা। কেস সলভ হওয়ার পর না হয় জমিয়ে খানাপিনা হবে একদিন।”
“বেস্ট অফ লাক। পাশে আছি আপনার। তবে সাবধানে থাকবেন কিন্তু। সনাতনবাবু লোকটা বাইরে যতটা সরল, ভিতরে ততটাই সাংঘাতিক!”
রুদ্রবাবুর ভরপেট অতিথেয়তার পর রাতভর রিমঝিম বৃষ্টি। ঘড়ির কাঁটা নটা পেরিয়ে ঘুম ভাঙলো পরদিন সকালে। কোনক্রমে ব্রাশটা দাঁতে ঘষেই ছুটলাম বন দফতরের লোকাল অফিসে। সনাতন মান্ডি ও রুদ্রবাবু ততক্ষণে হাজির সেখানে। পথে অনিমেষবাবুর বাংলো থেকে ওনাকেও নিয়ে নিলাম আমাদের সাথে। তারপর জিপে চড়ে জঙ্গলের সবুজ বুক চিরে মিউজিয়ামের পথে ছুটলাম আমরা চার মূর্তিমান। রাস্তায় অনিমেষবাবুর কণ্ঠে ঝরে পড়ছিল একরাশ হতাশা, “এই বাঘ হরিণের চক্করে পড়ে গত এক সপ্তাহে কাজের অগ্রগতি আমাদের রীতিমতো তলানিতে। আমি নিজেও তো ঠিকঠাক সময় দিতে পারছি না সেভাবে। আমাদের ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড লাইফ ইনস্টিটিউটের পরবর্তী দু’বছরের শিডিউল ঠিক করা থাকে আগে থেকেই। সুন্দরবনের জন্য বরাদ্দ মাত্র ছয়মাস। কিন্তু এভাবে কাজে ডিলে হলে কি করে যে সব শেষ করব সময়ে, বুঝে উঠতে পারছি না কিছুতেই।”
অরণ্যের বুকে চিরে অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা এসে পৌঁছলাম মিউজিয়ামে। অনিমেষবাবু আর রুদ্রবাবুকে নিয়ে বিধায়ক সনাতন মান্ডি ভিতরে ঢুকে গেলে আমি গেটে দাঁড়ানো দারোয়ানের সাথে মজে গেলাম একান্ত আড্ডায়। তার কাছেই জানলাম, গত দুদিনে অনিমেষবাবু ও রুদ্রবাবু এখানে একসাথে এসেছেন বেশ কয়েকবার। ল্যাবে কাটিয়েছেন ঘন্টার পর ঘন্টা। আজ আমি নিজেও মিউজিয়ামের ল্যাবে ঢুকে দেখলাম, অ্যানিমাল বিহেভিয়ারের জটিল তত্ত্ব নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন ওরা দুজন। প্রাণীবিদ্যার ছাত্র হওয়ার দরুন ওদের দখল এ বিষয়ে আমার চেয়ে অনেকটাই বেশি। জ্ঞানগর্ভ আলোচনার বিন্দুবিসর্গ মাথায় না ঢুকলেও নিজের মত করে মৃত হরিণদুটোকে টিপেটুপে ডায়েরিতে নোট নিলাম আমি।
“আমার মনে হয় না কোনো চোরা শিকারি বা মানুষের প্রত্যক্ষ হাত এতে আছে। কারণ, হরিণের গায়ের ক্ষতগুলোতে পাশবিক নখের আঁচড় কিন্তু বেশ স্পষ্ট -”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই রুদ্রবাবু বলতে শুরু করলেন, “বন বিড়াল কিংবা বন্যশূকর হরিণকে খুন না করলেও মরা হরিণের মাংসে কিন্তু নখ দিতেই পারে অনায়াসে। কাজেই কোনো মানুষ মেরে ফেলে রেখে যাওয়ার পর অমন কোনো পশুই হয়তো….”
রুদ্রবাবুর কথায় এবার বেশ বিরক্ত হলাম আমি। লোকটা নির্ঘাত কোনো পশুশিকারির মেয়েকে লাইন মারতে গিয়ে দাগা খেয়েছিল কম বয়সে। নাহলে এত রাগ কিসের!
সনাতনবাবুর প্রবল জোরাজুরিতে মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম পাশের হরিণশালায়। নিরাপত্তার কঠোরতম রূপ দেখলাম সেখানে। ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তায় ঘেরা লোহার বিশালাকার খাঁচায় বন্দি কয়েকশো হরিণ। নির্দিষ্ট সময় মেনে এদের নাকি ছাড়া হয় জঙ্গলে, যাতে বাঘ খাদ্যের অভাবে লোকালয়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য না হয়। পুরো প্রকল্পটাই নাকি বাস্তবায়িত হয়েছে সনাতনবাবুর ফান্ডের টাকায়। বুঝলাম, নিজেদের উন্নয়নের ঢাক পেটাতেই আমাদের ঢোকানো হরিণের খাঁচায়। হরিণের মাথায় হাত বুলিয়ে ওদের গাজর খাওয়ালাম আমরা চারজন। সনাতনবাবু সেই সুযোগে নিজের সারেগামা গাইলেন সবিস্তারে। সত্যিই কেস সলভ হোক বা না হোক, এই সনাতন মান্ডি লোকটাকে প্রত্যক্ষ করাটাই এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা – ওমরিশ পুরী হতে হতে কখন যে রাজপাল যাদব হয়ে যাবে, আপনি ধরতে পারবেন না কিছুতেই।
সনাতনবাবুর এক দলীয় কর্মীর বাড়িতে পেটপুরে মধ্যাহ্নভোজন সেরে আমরা উঠে পড়লাম জিপে। অনিমেষবাবুকে তার আস্তানায় নামিয়ে রুদ্রবাবুকে জিপ ছেড়ে দিল বন দফতরের অফিসে। সনাতনবাবুর অনুরোধে আমি রয়ে গেলাম তার সঙ্গে। নরখাদকের হানায় আক্রান্তদের দেখতে হাসপাতালে গেলেন বিধায়ক মশায়, সাথ দিলাম আমিও। হাসপাতালে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিবারের হাতে হাসিমুখে পঞ্চাশ হাজারের চেক তুলে দিলেন তিনি। আমিও আমার নোটবুকে তুলে নিলাম বিশেষ কিছু তথ্য। সময় যত এগোচ্ছে, রুদ্রবাবু লোকটাকে আমার কালিদাসের আধুনিকতম সংস্করণের থেকে কম কিছু বলে মনে হচ্ছে না, বিশালাকার মাথা কিন্তু পুরোটাই ফাঁপা কারণ, আক্রান্তদের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম তাতে প্রতিটি বাঘের আক্রমণ ঘটেছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, অর্থাৎ দুটো ভিন্ন মানুষের আহত হওয়ার সময়কাল প্রতিক্ষেত্রেই আলাদা যা প্রকারান্তরে কেবল একটিমাত্র বাঘের উপস্থিতিকেই দৃঢ়ভাবে সুনিশ্চিত করে। ভিন্ন দুটো আক্রমণের সময়গত সাদৃশ্য নজরে এল না কোথাও। ফেরার পথে সনাতনবাবু স্মৃতি রোমন্থনের সুরেই বললেন, “পাঁচ পুরুষ ধরে আমরা এই সুন্দরবনেরই বাসিন্দা। সুন্দরবনরে আমি নিজের বউয়ের শরীরের চেয়েও অনেক বেশি ভালো চিনি, অফিসার। সে প্রায় বছর তিরিশ আগের কথা। আজকের বিধায়ক সনাতন মান্ডি সেসময় ছিল হরিণের চোরা কারবারি। পীরখালি, সন্দেশখালির জঙ্গলে হরিণ মাইরা বেচতাম রহিম চাচার কাছে। তাই ওই পেশা সম্পর্কে আমার ধারণা আছে বিলক্ষণ। পিরখালি, সন্দেশখালির জঙ্গল ছেড়ে সুধন্যখালির গভীরতম জঙ্গলে চোর ভুলেও ঢোকে না। যদিও বা পেটের দায়ে ঢুকে পড়ে এক আধবার, বাফারের বেশি তো পা-ই বাড়ায় না আর ওই রুদ্রবাবু কয় কুর এলাকায় চোরা শিকারি! সব আসলে নিজের গাফিলতি ঢাকার মতলব। টাকা মেরে প্রকল্প তো সব ফাঁকা করে দিয়েছে। বাঘ ধরার মুরোদ নাই, তাই লোকের মাথায় দুষ চাপায়। চোরদের সাথে বাটোয়ারা নিয়ে কেচাল করসে বোধ হয়। তাই অত রাগ! জোচ্চোর একটা! সুন্দরবনরে পুইরা শুষে নিল।”
রুদ্রবাবু লোকটাকে অকাজের লাগলেও চোর-জোচ্চোর মনে হয়নি কোনোদিন। কোয়াটারে ফিরে চারদিনের সমস্ত অভিজ্ঞতাকে অণুবীক্ষণে নিয়ে বসলাম বারান্দায়। সাথে সফট ড্রিঙ্কস আর লঙ্কা মেশানো দেশি মদের ককটেল। এই নেশাটা মস্তিষ্কের জন্য ভীষণ স্বাস্থ্যকর।
পরদিন কাকভোরে ঘুম ভাঙলো রুদ্রবাবুর ফোনে। গলায় তার বাঁধন হারা উচ্ছ্বাস। মাঝরাতে বাঘ নাকি ধরা পড়েছে এক আদিবাসীর রান্নাঘরে পাতা খাঁচায়। বাইক ছুটিয়ে তড়িঘড়ি হাজির হলাম সেখানে। চ্যালাচামুণ্ড সমেত সনাতন মান্ডি সমস্ত ঘটনার ক্রেডিট নিজের পকেটস্থ করতে ভীষণ তৎপর। স্থানীয় পশু চিকিৎসকের সহায়তায় বন্দি বাঘটির স্বাস্থ্য পরীক্ষায় গভীরভাবে মগ্ন অনিমেষবাবু। তবে সারাজীবন গরু, ছাগলের চিকিৎসা করা সুন্দরবনের ডাক্তারটি যে বাঘের চিকিৎসায় পুরোপুরি অদক্ষ, তা তার শারীরিক ভাষাতেই স্পষ্ট। ঘন্টাখানেক পরীক্ষার পর অনিমেষবাবু জানালেন, “আমার অনুমানই সঠিক। বাঘটি মানসিকভাবে রীতিমতো বিপর্যস্ত। ভিশনারি টেস্টেই সে ইঙ্গিত বেশ প্রকট। তাছাড়া, শতকরা পনেরোটি বাঘেরই এহেন সমস্যা দেখা যায় আজকাল। অসুখটা খুব একটা বিরলও না। এসব ক্ষেত্রে বাঘ সাধারণত বনে কয়েকদিন কারণে অকারণে যথেচ্ছ হত্যালীলা চালিয়ে তারপর চলে আসে লোকালয়ে। মুখে এক অদ্ভুত ধরনের রুচিহীনতা দেখা দেয়, স্বাদ পায় না কোনো জীবেই। তাই বাধ্য হয়েই থাবা বাড়ায় মানুষের দিকে। ওকে আপাতত ঘুমপাড়ানি ওষুধ কিংবা আফিং দিয়ে রাখুন রুদ্রবাবু। আমি স্বল্প পরিকাঠামোতেই ট্রিটমেন্ট চালিয়ে যাব সাধ্যমত। পুরোপুরি ঠিক হতে দিন দশেক তো লাগবেই।”
সন্ধ্যায় আজ পার্টি দিয়েছেন সনাতন মান্ডি। বাঘ ধরার কৃতিত্ব নিয়ে ভোটের পালে যতটা হাওয়া টানা যায় আর কি! মাঝরাত থেকে ভীষণ খাটাখাটনির পর নরম ধাতের রুদ্রবাবু ক্লান্তির কারণে আধঘন্টার মধ্যেই বেরিয়ে গেলেন পার্টি ছেড়ে। এমনিও আলাপচারিতায় আগেই জেনেছিলাম, মহাকালের পরম ভক্ত এই ভদ্রলোক সোমবারটা সাধারণত নিরামিষই খেয়ে থাকেন। তাছাড়া সারাদিনের ধকল তো আছেই। রুদ্রবাবুর কোয়ার্টারে পোলাও আর পনির কোপ্তা পাঠিয়ে দিলেন সনাতনবাবু।
এই পার্টিতেই অনিমেষবাবুর সাথে আমার জমিয়ে আলাপ হল প্রথমবার। প্রখর ব্যক্তিত্ব, ছাত্রজীবনে কেতাদুরস্ত মার্কশিট। আমার মত টেনেটুনে ইউপিএসসি পাশ করা লোকের থেকে যোগ্যতায় কয়েক আলোকবর্ষ এগিয়ে। ব্যাঙ্গালোর আইআইএসসি’র লাইফ সায়েন্স টপার এই অনিমেষ দত্ত। তার সাথে দোসর হিসেবে রয়েছে প্রখর সাহিত্যবোধ। কলারটিউনে ডাক দেয় উস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই। শব্দচয়ন শান্ত অথচ দৃঢ়। রুদ্রবাবু যদি জনি লিভার হন, অনিমেষ দত্ত তবে সাক্ষাৎ শাহেনশা। মৃদু হেসে আমাকে বললেন, “কেস তো আজ প্রায় সলভ হয়েই গেল তাহলে। আমি তো প্রথম থেকেই আপনাদের বলে আসছি যে, ব্যাপারটা নেহাতই বাঘের। মনুষ্য কোনো হাত এর মধ্যে নেই। তাছাড়া, সুন্দরবনের গভীরতম জঙ্গলের নাম সুধন্যখালি। আমরা ঢুকতেই রীতিমতো ভয়ে কাঁপি, আর সাধারণ মানুষ। রুদ্রবাবু মুখে যতই বলুন যে, কুড়ির ওপর হরিণ নিখোঁজ, সংখ্যাতত্ত্ব কিন্তু কেবল দুটির কথাই বলছে, তাও সেগুলো অন্য কোনো বাঘের আক্রমণের ফল হয়ে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা অনুমানের ভিত্তিতে উপসংহারে আসা ভীষণ মুশকিল, চিরঞ্জিতবাবু। আমার ধারণা, ভদ্রলোক আবেগকে যুক্তির তুলনায় এগিয়ে রাখেন অনেক বেশি। যদিও ওঁকেও পুরোপুরি দোষ দেওয়াটা অন্যায়। নিপাট ভালোমানুষ চোখের সামনে নোংরা রাজনীতি দেখছেন দিনরাত। তাই মানুষকেই নিজের সন্দেহের তালিকায় সবার শীর্ষে রাখেন হয়তো। আর সত্যি বলতে এত বছর কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বন্য জীবজন্তু মানুষের চেয়ে বিশ্বস্ত অনেক বেশি। আক্রমণটা তো বাঘটা একটা রোগের তাড়নায় করেছে, পুরোটাই ওর নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে। যাই হোক, আপনাকে তো এখন আবার দুটো হরিণমৃত্যুর রিপোর্টও জমা দিতে হবে। প্রশাসনিক চাকরির এই এক জ্বালা। সব দেখছি, সব বুঝছি — কিন্তু প্রমাণ বিনা গতি নেই।” বরাবরের অভ্যাসমতোই রেডি হয়ে পকেটে রুমাল ভরতে ভুলে গেছিলাম সে রাতে। খাওয়া শেষ হতেই আন্তরিক অনিমেষবাবু বাড়িয়ে দেন নিজেরটা। আমিও রুমালে হাত মুছে ফেরত দিতে ভুলে যাই বেমালুম।
সনাতনবাবু নিজের ব্যক্তিগত গাড়িতে আমাদের কোয়াটারে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন পার্টি শেষে। গাড়ি থেকে নামতেই আমার হঠাৎ মনে পড়ে অনিমেষবাবুর রুমালের কথা। কোনক্রমে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিই গাড়ির দিকে। অসামান্য ক্ষিপ্রতায় তালুবন্দি করে হেসে ওঠেন অনিমেষবাবু।
নিরবিচ্ছিন্নভাবে বাজতে থাকা ডোরবেলের শব্দে ঘুম ভাঙলো পরদিন। দরজা খুলতেই দর্শন পেলাম এক হাঁড়ি রাবড়ি আর ততোধিক মিষ্টি হাসি নিয়ে হাজির অফিসার রুদ্র রায়ের। বিনম্র হেসে বললাম, “আরে আবার এসবের কী দরকার ছিল?”
“না, মানে সেদিন দেখলাম, রাবড়িটা খুব তৃপ্তিভরে খেলেন আর কি! আর তাছাড়া, কেস তো প্রায় সলভড। ফিরেই যাবেন আজেকালে। তাই শেষ একটা ছোট্ট স্মৃতি ভরে দিলাম আপনার বিশাল রুকস্যাকে।”
“শেষ মানে? সুন্দরবনে আর আসতে পারি না বলছেন তাহলে?”
“পারেন। অবশ্যই পারেন। রুদ্র রায়ের হৃদয়ের দ্বার সদা উন্মুক্ত আপনার জন্য। তবে চিরঞ্জিতবাবু, আজ একটা অনুরোধ ছিল! রাখতে হবে কিন্তু।”
“বলে ফেলুন নির্দ্বিধায়।”
“আপনি আর দুটো দিন থেকে যান না প্লিজ।”
“কিন্তু কেন?”
“আসলে, এই কদিনে নিশ্চয়ই বুঝেছেন যে, গভীর জঙ্গলে গিয়ে কাজ করার মত লোক আমাদের ডিপার্টমেন্টে প্রায় নেই বললেই চলে। হয়তো আপনি হাসবেন; কিন্তু কেন জানি না অনিমেষবাবুর যুক্তি আমার মনঃপূত লাগছে না ঠিকঠাক। বাঘটা যে পাগল, এটা হয়তো সত্যি। কিন্তু ও নিজে কাল খাঁচায় একটা গোটা হরিণ খেয়েছে ঘুম ভাঙার পর, তাও সেটা আধ ঘন্টায়। এর আগে গ্রামবাসীদের গোয়াল ঘুরে সাতদিনে ছাগল, বাছুরও গিলেছে গোটা তিনেক। অনিমেষবাবু যাই বলুন না কেন, বনে শিকারি ঢুকছেই আর বাঘটাও বেরিয়েছে খাবার না পেয়েই। নাহলে এভাবে গোগ্রাসে খেত না। আর অনিমেষবাবুর অনুমান ধরেই বলছি, আমাদের পাওয়া লাশদুটো দিন দশেকের পুরনো কিন্তু প্রথম বাঘের আক্রমণ এগারো দিন আগে অর্থাৎ ওই হরিণদুটোকে এই বাঘটা মারেনি। এর লিভিং রিজিয়নের হরিণই হয়তো খপ্পরে পড়েছে শিকারিদের আর সেই কারণেই ব্যাটা খেতে না পেয়ে বেরিয়ে এসেছে বন থেকে।”
“তাহলে আমাকে এখন কি করতে হবে বলুন!”
“আপনি তো কথা দিয়েছিলেন, হরিণ আর বাঘ দুটো কেস সলভ করে তবেই সুন্দরবন ছাড়বেন। তাই আর কয়েকটা দিন থেকে যান প্লিজ। সূর্য আজ বেশ কড়া। রাতে সোলার লাইটের জোরও আশা করি ভালোই থাকবে। বাফার অবধি পৌঁছতে আমাদের সমস্যা হবে না বিশেষ। তারপর আমি-আপনি বন্দুক হাতে আজ থেকে পাহারা দেব সুধন্যখালির কোর এলাকায়। ওখানে আলো বসানো হয়ে ওঠেনি এখনও। পুরোটাই নিকশ অন্ধকার। তাই আমাদের উপস্থিতি টের পাবে না শিকারিও। বেশিদিন আপনাকে জোর করব না। আমার জন্য সাতটা দিন কষ্ট করুন একটু।”
রুদ্রবাবু, “সত্যই আমার গার্লফ্রেন্ড। সত্যই আমার চিরসঙ্গী। আমি রাজি। আজ ঠিক সন্ধে সাতটায় দফতরের অফিসে তবে দেখা হচ্ছে আপনার সাথে।”
মৃদু হেসে বেরিয়ে গেলেন রুদ্রবাবু।
পরশু থেকে জঙ্গলে কেটে গেছে তিনটে রাত। হরিণ, বাঘ, মানুষ — কাউকে দর্শনের সৌভাগ্যই এখনও অবধি হয়ে ওঠেনি আমাদের। রুকস্যাকের পাউরুটি-কলাও শেষের পথে প্রায়। মাস ছয়েকের গেরিলা ট্রেনিং আমার নেওয়া থাকলেও রুদ্রবাবু আদ্যপান্ত ভেতো বাঙালি। মনের জোরও ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে তার। অমাবস্যার নিশুত রাতে বটগাছের নিচে ঘনিয়ে আসা তন্দ্রা হঠাৎ কেঁপে উঠল আচমকা বোমের শব্দে। ধরমর করে উঠে ছুটতে শুরু করলাম আমি। পিছনে রুদ্রবাবু। কিলোমিটার খানেক ছোটার পর হাতেনাতে পাকড়াও করলাম পাঁচজনের এক চোরা শিকারির দলকে। ওস্তাদের পায়ে গুলি চালাতেই শিষ্যরা ভয়ে স্বীকার করে নিল গত একমাস ধরে সুধন্যখালি জঙ্গল জুড়ে চালানো ওদের ন্যক্কারজনক হরিণ শিকারের কথা। রুদ্রবাবুর এক ফোনেই বিশাল ফোর্স হাজির হল আমাদের লোকেশনে। পাঁচজনকেই তোলা হল পুলিশের জিপে। অমাবস্যার অন্ধকারেও রুদ্র রায়ের মুখে যেন বাঁধ না মানা চাঁদের হাসি। দফতরের কর্মীরা খুলতে শুরু করল জঙ্গলে বসানো সোলার লাইট।
পরদিন আমার কলকাতায় ফেরার পালা। নতুন কেস জাল বুনে অপেক্ষা করছে কল্যাণীতে। ব্যাগ গোছানো শেষ হয়েছে সকালের মধ্যেই। দুপুরে রুদ্রবাবু নিয়ে গেলেন হরিণের খাঁচায়। আজ প্রায় তিরিশটা হরিণ আমার সামনেই নতুন করে ছাড়া হল বাফারে। লোকটার মেজাজে পুরো ভরা কোটালের আমেজ। সকালেই ফোনে কড়া নেড়েছে অনিমেষবাবুর শুভেচ্ছাবার্তা। একশো আশি ডিগ্রি উল্টে রুদ্রবাবুর দরাজ প্রশংসাও করেছেন তিনি। ভীষণ বিনয়ে স্বীকার করেছেন চোরাশিকারি বিষয়ে নিজের ভুল ধারণার ব্যর্থতাকে। লোকটাকে যত দেখি, অবাক হই তত। বাইরে সেগুন গাছের কাঠিন্য আর হৃদয়ে পলাশ ফুলের আবদার। বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যে নামতেই কোয়াটারের গাড়ি আমাকে পৌঁছে দিলে ক্যানিং। স্টেশন থেকে লোকালে শিয়ালদা এক ঘন্টা। কিন্তু আমি ট্রেন না ধরে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম স্টেশন সংলগ্ন গ্যারেজের দিকে। চারশো টাকার বিনিময়ে একদিনের জন্য হাতে পেলাম পুরোনো মডেলের হিরো হন্ডার জং ধরা চাবি। হেডলাইটটা নিভিয়ে মোবাইলের আলতো আলো আর জোনাকির ডানায় ভর করে ঘন্টা তিনেক বাইক চালিয়ে পা রাখলাম সুধন্যখালির বাফার রিজিয়নে। ঘড়িটা কাঁটা ততক্ষণে বারোটা পেরিয়েছে। দু-একটা বাদুড়ের লাভ কিস সৌভাগ্যক্রমে ইতিমধ্যেই জুটে গেছে আমার শুকনো কপালে। তৎসত্ত্বেও কাঁপা হাতে জিপিএসটা অন করে এগিয়ে চললাম নিখুঁত গন্তব্যের সন্ধানে। জায়গাটাকে শেষ দুদিনে মেপেছি কলেজ ইউনিয়নের চাবুক ফিগারের মেয়েদের মত করেই। প্রতিটা ভাঁজ মিশে আছে আমার চোখ থুড়ি পায়ে। রিভলভার হাতে অপেক্ষা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। সঙ্গী সদ্য বিদায়ী অমাবস্যার অন্ধকার আর ঋতুমতী অর্জুন গাছ।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে পাতার মাঝে অতি চেনা ভারী বুটের শব্দ যার সাথে বারংবার পরিচয় হয়েছে শেষ কয়েকদিনে। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া চামচিকির দল, একটা হাঁফিয়ে আসা নিঃশ্বাসের শব্দ আর হরিণের আকুল আর্তনাদ। শব্দস্রোতে গা ভাসিয়ে হেঁটে এলাম বেশ কিছুটা। দূরত্ব যে কয়েক মিটারের বেশি নয়, হরিণের গোঙানির শব্দে তা বোঝা যাচ্ছিল বেশ স্পষ্ট। লক্ষ্য কাছাকাছি বুঝতেই হাত রাখলাম ট্রিগারে। ইতিমধ্যেই সন্ধ্যের পর কলকাতা থেকে রওনা হওয়া ফোর্স ঘিরে ফেলেছে গোটা জঙ্গলটাকে। ফ্ল্যাশের আলো জ্বলতেই কেঁপে উঠলেন অনিমেষবাবু। ঘামে ভিজেছে গায়ে চাপানো ডোরা কাটা জ্যাকেট। জঙ্গলে মিশে থাকা এই রঙকে দূর থেকে ঠাওর করা বেশ কঠিন। আমাকে দেখামাত্রই অপ্রস্তুত অনিমেষবাবু হাত দিতে চেষ্টা করলেন কোমড়ে গোঁজা রিভলভারে কিন্তু লিঙ্গ যে তার আটকে তখনও হরিণের যোনিতে। উরুর পর বাঁ হাত- নিশানা ভুল হল না আমার। প্রত্যাঘাতের ক্ষমতা ততক্ষণে হারিয়ে ফেলেছেন অনিমেষ দত্ত। চমকিত কণ্ঠে বললেন, “তুমি ফিরে গিয়েছিলে না?”
হাসতে হাসতে শুরু করলাম আমি, “ওটা তো ইন্টারভ্যাল ছিল জাস্ট। ইন্টারভ্যাল ঠিক সময়ে না আনলে ক্লাইম্যাক্সটা এমন জমাতাম কি করে, স্যার?”
“মানে?”
“সনাতনবাবুর বাড়িতে প্রথম করমর্দনের সন্ধ্যায় আপনার আঙুলের সামনের দিকে নিয়মিত বাঘনখ ব্যবহারজনিত দাগের উপস্থিতি নজর এড়ায়নি আমার। প্রতিটা আঙুলের প্রায় শেষ মাথায় রিংসুলভ গোল দাগ! পেশাগত নিরাপত্তার কারণে আত্মসুরক্ষায় বাঘনখের ব্যবহার ভেবে তেমন আমল দিইনি সেদিন। মিউজিয়ামের হরিণের লাশে প্রায় সবকটি আঘাতের চিহ্নই ছিল বা হাতের অর্থাৎ পশু কিংবা মানুষ কাজটা যারই হোক না কেন, বাঁ হাত তার অনেক বেশি সাবলীল ডান হাতের তুলনায়। কিন্তু প্রতিটা আঙুলের ছাপের মাঝে জায়গার যে ব্যবধান তাতে মানুষ কিংবা শিম্পাঞ্জি জাতীয় প্রাণীর উপস্থিতির বার্তাই প্রকট হয়ে উঠছিল প্রখরভাবে, বাঘ কিংবা বিড়ালের নয়। সনাতনবাবুর আয়োজন করা সেলিব্রেশন পার্টিতে মদের গ্লাস থেকে রুমাল সবকিছুই কিন্তু আপনি বাঁ হাতেই নিচ্ছিলেন, তাই না অনিমেষবাবু? গত সপ্তাহে মিউজিয়ামের পাশের খাঁচাটায় লিঙ্গনির্বিশেষে হরিণ কিংবা হরিণী উভয়ের প্রতিই সমপরিমাণ বাৎসল্যপরায়ণ ছিলাম আমি আর রুদ্রবাবু। কিন্তু আপনার অবাধ্য আঙুল ব্যতিক্রমীভাবে বারংবার যেন খুঁজে নিচ্ছিল হরিণীর যোনি। প্যান্টের নিচে উত্থিত লিঙ্গও বেশ কয়েকবার চোখে পড়ে আমার। সুধন্যখালিকে আপনার প্রজেক্ট তালিকায় সবার শেষে রাখার কারণ কখনোই হোমওয়ার্কের অভাব নয় অনিমেষবাবু; বরং সুধন্যখালি নিয়ে আপনার পড়াশোনাটা অনেকটাই বেশি কারণ, আপনি জানতেন ওই গভীর জঙ্গলের কোর এলাকায় বন দফতরের অপ্রশিক্ষিত কর্মীরা ভুলক্রমেও রুটিন ভ্রমণে ঢুকবে না কোনও দিন আর আপনিও নির্বিঘ্নে ছমাস ধরে চালিয়ে যাবেন আপনার যৌনলীলা। কিন্তু ওই বাঘটাই এলোমেলো করে দিল সব। যদিও, তার হঠাৎ বেরিয়ে পড়ার সাথে আপনার হরিণ হত্যা বা যৌনলীলার কোনো সম্পর্কই নেই। বাঘ আপন খেয়ালেই বেরিয়ে এসেছিল লোকালয়ে। আর তাতেই রুদ্রবাবুর ভুল অনুমানজনিত জঙ্গলে টহল ভেস্তে দিল আপনার সমস্ত হিসেব। এক অবাস্তব ধারণার বশবর্তী হয়েই উনি নিরাপত্তা বাড়ালেন জঙ্গলে আর তার এই নির্বুদ্ধিতাই আবির্ভূত হল আপনার পথের কাঁটা হয়ে। জঙ্গলে আপনার যৌনলীলায় হরিণ কমছিল ঠিকই, তবে সেটা খাদ্য সংকটের পর্যায়ে যে ছমাসেও যেত না। সে অঙ্ক আপনি কষেই এসেছিলেন নিখুঁতভাবে। কিন্তু রুদ্রবাবুর অনুমানের গোলমালই গুলিয়ে দিল আপনার সব হিসেব।
আমাকে শেষ ব্রেক থ্রুটা দিল, সনাতনবাবুর পার্টিতে আপনার হাতের স্তব্ধ কম্পাস ঘড়ি। যান্ত্রিক ত্রুটিতে ঘড়িটা যে আচমকা কখন বন্ধ হয়ে গেছে তা হয়তো আপনি খেয়ালই করেননি কিন্তু সেই বন্ধ কম্পাস জানান দিচ্ছিল পীরখালির দিকনির্দেশ, অথচ আপনার প্রজেক্ট তখনও রানিং সন্দেশখালিতে। পরদিন দুপুরেই ছুটে গেলাম পীরখালির জঙ্গলে। মাটিতে পড়ে থাকা ছাইয়ে পেলাম ভুলতে বসা এক সুবাস যা বছর দুয়েক আগে নাসারন্ধ্রে ভ্রমণ করেছিল দেরাদুনে কর্মরত আমার বন্ধুর গিফট করা দামি সিগারেটের প্যাকেট থেকে। বুঝলাম, সুধন্যখালিতে বিপদ বুঝে আপনি নতুন আস্তানা গড়েছেন পীরখালিতে। আপনাকে পুরোনো যৌনভূমে ফেরাতে কলকাতা থেকে পাঁচজন অফিসারকে চোরাশিকারি সাজিয়ে হাজির করলাম সুন্দরবনের জঙ্গলে। সে খবর এখানে জানত না কেউ। সাজানো ক্রিমিনালরা গ্রেফতার হতেই নিজের পিঠ চাপড়ে জাল গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আপ্লুত রুদ্রবাবু, আর হাফ ছেড়ে বাঁচেন আপনিও। আনন্দে বিহ্বল রুদ্রবাবুকে দিয়ে সুকৌশলে আজ সকালে হরিণ ছাড়াই সুন্দরবন বাফারে। জানতাম, এ খবর আপনার কাছে পৌঁছবে ঠিকই আর আপনি আবারও হানা দেবেন নিজের চেনা জঙ্গলে। এই একমাসে গোটা দশেকের বেশি হরিণ হয়তো আপনি মারেননি। যৌন অত্যাচার চলাকালীন আপনার বাঘনখের আঘাতে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হরিণের কারণে জঙ্গলে খাদ্যের অভাবও সৃষ্টি হয়নি বিন্দুমাত্র। আর চোরা শিকারির তো কোনো গল্পই নেই। পুরোটাই রুদ্রবাবুর মোটা মাথার ভুলে ভরা অনুমান। কিন্তু সেই ভুল সূত্রেই শেষমেষ মিলে গেল অঙ্ক।
বাঘ বন ছেড়ে বেরিয়েছিল আপন খেয়ালেই, বিশেষ কোনো কারণ তার পিছনে ছিল না। আর আপনার যৌনাচারে খুব বেশি হরিণ মারা না গেলেও ভারতীয় আইনে যে তা দণ্ডনীয় অপরাধ, তা আপনি জানেন বিলক্ষণ। ব্যাস। গল্প শেষ। এবার চলুন থানায়। গোটা বন পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। পালাবার পথ নেই।”
“খানকির ছেলের মতো বছরের পর বছর শালা কাটিয়ে গেছি জঙ্গলে। গালভরা নাম – ব্যাঘ্রবিজ্ঞানী। জঙ্গলের পশুদের সাথে থাকতে থাকতে ভুলে গেছিলাম যৌনতার স্বাদ। চুদতে শুরু করলাম হরিণকেই। তোরা এসকর্ট ডেকে মানুষ চুদলে দোষ নেই চুদির ভাই আর আমি পশু চুদলেই… শালা আমাকে চুদে প্রমোশন নিবি হিজরের বাচ্চা?” – বলেই বাঁ হাতের ধারালো বাঘনখ সজোরে চালালেন নিজের গলায়। অনিমেষবাবুকে আর বাঁচানো যায়নি। কালচে রক্ত আর নতুন প্রভাতের লালচে সূর্য মিশে গেছে এক নতুন রঙে। আমার ফোন পেতেই সীমান্তে থাকা ফোর্স বাফারে এসে পোস্টমর্টেমে নিয়ে গেল অনিমেষবাবুর নিথর দেহটাকে। এলোমেলো পায়ে জঙ্গল ধরে হাঁটছি আমি একা। চোখের কোল বেয়ে অজান্তেই নেমে এল নোনাজল। বছরের পর বছর রেপুটেশনের টানে নিজের যৌনক্ষিদে লুকিয়ে ডিউটি করা সমকামী চিরঞ্জিত সাহা কোথাও যেন মুখ লুকোতে বাধ্য হল স্বাধীনচেতা পশুকামী অনিমেষ দত্তের কাছে। নিরাপত্তার সমস্ত বেড়াজালকে ফাঁকি দিয়ে অনিমেষবাবু পালিয়ে গেলেন চিরশান্তির দেশে।