গ্রামের নাম পুতুলগাঁ। হিমালয়ের পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ের কোলে পাইন রডোডেনড্রন বার্চ দেবদারু এবং হাজারো নাম-না-জানা পাহাড়ি গাছে ঘেরা মনোরম প্রকৃতির মাঝে একটি ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমে বিস্তৃত চা-বাগানের পরই রয়েছে এক বিশাল গভীর খাদ, আর সেই খাদের অতলে বয়ে চলেছে লিবং নদী। গ্রামের পশ্চিমে রয়েছে এক স্বচ্ছ পাহাড়ি ঝর্ণা, স্থানীয় ভাষায় নাম ‘দেবীঝোরা’। এই দেবীঝোরাই হল পুতুলগাঁয়ের পশ্চিম সীমা। পূর্বদিকে গ্রামটি যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, ঠিক সেখান থেকেই আরম্ভ হয়েছে পূর্ব হিমালয়ের গভীর জঙ্গল। আর, উত্তরে গ্রামের সীমা পেরিয়ে শুরু হয়েছে পাহাড়ের খাড়াই। সেখানে রয়েছে শতাব্দী-প্রাচীন ত্রিকাল ভৈরবের মন্দির।
গ্রামের দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে পরিষ্কার জলের এক হ্রদ, যাকে এখানকার মানুষ বলে ‘উল্কা লেক’। কথিত আছে, কয়েকশো বছর আগে এক আকস্মিক উল্কাপাতের ফলে সেই হ্রদ তৈরি হয়। গ্রামের পানীয় জলের প্রধান উৎস এই হ্রদ।
উত্তরের খাড়াই পাহাড়ের চূড়া নাকি আজ পর্যন্ত গ্রামের কেউই দেখেনি! পাহাড়টির চূড়া সারাবছর ঘন কুয়াশার আড়ালে ঢাকা থাকে। শীতকালে যখন তুষারপাত হয়, তখন ত্রিকাল ভৈরবের মন্দিরের মাথা পর্যন্ত বরফে ঢাকা পড়ে যায়।
বৃষ্টিপাত এই গ্রামের বছরভরের ঘটনা। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই সূর্যের আলোর সাথে সাথে বৃষ্টিও দেখা যায় প্রায় প্রত্যেকদিনই।
এই এখনই যেমন বৃষ্টি হচ্ছে, মুষলধারে না হলেও বেশ জোরেই। অথচ একটু আগেও রোদ-ঝলমলে ছিল বাইরেটা!
অর্ক তার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় এসে বসল বৃষ্টি দেখতে। এই গেস্ট হাউজটি থেকে পুতুলগাঁ ও তার চারিপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুব ভালভাবে উপভোগ করা যায়। সকালে মর্নিং ওয়াক ও ব্রেকফাস্ট সেরে সে তার ক্যামেরাটা নিয়ে বাইরে বের হবে বলে ভেবেছিল। এখন অবিশ্যি বারান্দায় বসেই বৃষ্টি দেখা ছাড়া আর কিছু করার উপায় নেই। গতকাল বিকেলে এখানে পৌঁছনোর পর থেকে এরইমধ্যে এই নিয়ে সে তৃতীয়বার বৃষ্টি পড়তে দেখছে! বৃষ্টিতেই দু’চারটে ভাল স্ন্যাপ তুলে নিল।
অর্ক পেশায় একজন স্কুলশিক্ষক। কলকাতার এক হাইস্কুলে ভূগোলের শিক্ষক সে। এছাড়াও, সে একজন শখের ফোটোগ্রাফার, এবং সেই সঙ্গে একজন এক্সপ্লোরার বা অভিযাত্রী! স্কুলের ছুটি-ছাটার সুযোগে সে প্রায়শই বেরিয়ে পড়ে এদিক-ওদিক, সঙ্গে নেয় তার প্রিয় ক্যামেরা। আর, পড়াশুনার দৌলতে বহু জানা-অজানা বিখ্যাত-অখ্যাত জায়গা সম্পর্কে সে অবগত। সেইসব জায়গাগুলির বৈশিষ্ট্যের বিচিত্রতা তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। যে-সমস্ত জায়গা এখনও সাধারণের জ্ঞানের বাইরে ও লোকচক্ষুর আড়ালে, সেসব জায়গায় গিয়ে ঘুরে-ফিরে সেগুলোর যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ক্যামেরা-বন্দী করে সে নিয়ে আসে। তারপর এক বন্ধুর পত্রিকা “অভিযান”-এর মাধ্যমে ঐ জায়গাগুলির সাথে মানুষের পরিচয় করিয়ে দেয়।
এমন করেই একদিন অর্ক পুতুলগাঁ ও উল্কা লেকের কথা জানতে পারে। যথারীতি জায়গাটি দেখবার উৎসাহ জাগে তার মনে। স্কুলের হাফ্-ইয়ারলি পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর ছুটি পড়লে সে ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে আসে এখানে।
এই গ্রামটি তথাকথিত পর্যটনকেন্দ্র নয়, ফলে এখানে থাকার মত কোনও হোটেল বা লজ নেই। একটি সরকারী গেস্ট হাউজ আছে বনদপ্তরের আওতায়, সেখানেই উঠেছে সে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘোরাঘুরি ও “অভিযান” পত্রিকায় লেখালিখি করার সুবাদে নানা স্তরে তার পরিচিতি তৈরি হয়েছে। তেমনই একজনের কল্যাণে পুতুলগাঁয়ে তার থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে।
গেস্ট হাউজের কেয়ারটেকার ছেলেটি বেশ আন্তরিক ও যত্নশীল। অর্কের খাতির-যত্নের ত্রুটি রাখেনি সে এ-যাবৎ। ছেলেটির নাম গৌতম বর্মণ, বাড়ি কোচবিহারের মাথাভাঙ্গায়। সে স্থানীয় নয়, কর্মসূত্রে এখানে রয়েছে। তবে সে এখানকার অনেক কথাই খুব ভাল জানে, কথায় কথায় বুঝতে পারল অর্ক।
গৌতমের সাথে গল্পে-গল্পে অর্ক এই গ্রাম সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জেনে নিয়েছে ইতিমধ্যেই। সেসবের মধ্যে রয়েছে যেমন গ্রামটির ভূগোল, উল্কা লেকের ইতিহাস, দেবীঝোরা, ত্রিকাল ভৈরবের মন্দির, তেমনই রয়েছে গ্রামের মানুষদের কথা, তাদের জীবিকা, খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ, এখানকার উৎসব-পরব, ইত্যাদি। তবে তার কাছে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক লেগেছে এই গ্রামটির নামকরণের কাহিনী – “বিন্দুগুড়ি” থেকে “পুতুলগাঁ” হয়ে ওঠার গল্প। অবশ্য বিন্দুগুড়ি বলে একটি জায়গা রয়েছে দেবীঝোরার ঐপারে; সেখানেই এ-গ্রামে আসা-যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ড আছে, আছে বাজার, কাপড় ও ফলের দোকান, হাসপাতাল, স্কুল, পুলিশ ও বনদপ্তরের আউটপোস্ট। প্রায় বছর চল্লিশেক আগে মূল বিন্দুগুড়ি থেকে এই গ্রাম্য এলাকাটি “পুতুলগাঁ” নামে আলাদা পরিচিতি পায়।
আরেকটি কাহিনীও তার কাছে অত্যন্ত আশ্চর্যজনক মনে হয়েছে। সেটার সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই গ্রামের এমন নামকরণের কারণ।
এই গ্রামের নাম “পুতুলগাঁ” হয়েছে পুতুলবাবার নামে!
পুতুলবাবা এই গ্রামেরই বাসিন্দা। তাঁর আসল নাম সাম্যময় সরকার। গ্রামের লোকেরা তাঁকে ভীষণ মান্য করে। প্রায় আশি বছর বয়সী অতিবৃদ্ধ এই মানুষটি গ্রামের পূর্বপ্রান্তে উল্কা লেকের কাছে জঙ্গলের ধারে এক ক্ষুদ্র কাঠের বাড়িতে একলা বাস করেন। জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে ভাঙা মৌচাক থেকে দলা দলা মোম নিয়ে এসে পুতুল বানান – নানা ধরণের পুতুল। তবে প্রতিটি পুতুলের আলাদা বৈশিষ্ট্য, ভিন্নগড়ন ও বর্ণ, পৃথক পৃথক মুখমণ্ডল ও দেহসৌষ্ঠব। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হল এই যে, প্রতিটি পুতুলই এই গ্রামেরই কোনও-না কোনও মানুষের অবয়বে তৈরি! সেই মানুষগুলি হয় মৃত, কিংবা গ্রাম ছেড়ে চিরতরে চলে গিয়েছে অন্য কোথাও।
গৌতমের মুখে পুতুলবাবার গল্প শুনে অর্ক তো রীতিমত রোমাঞ্চিত! ভদ্রলোক এক আজব শিল্পী। এঁর সঙ্গে দেখা করে একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে, তার সাথে একটা ডকুমেন্টারি স্যুট করতে হবে। এঁর মত বিরল প্রতিভাকে বাইরের জগতের আলোয় নিয়ে আসা দরকার। তাই সে স্থির করল, আজই সকালে একবার পুতুলবাবার খোঁজ করবে। কিন্তু রোদ-ঝলমলে সকালের বারোটা বাজিয়ে দিল এই বৃষ্টি! অর্ক আবার ছাতা, রেনকোট এসব নিয়ে ঘুরতে পছন্দ করে না। অগত্যা বৃষ্টি থামবার অপেক্ষা করতে হবে।
দুপুর দু’টোর পর বৃষ্টিটা একটু ধরে এল। অর্ক স্নান-খাওয়া সেরে বেরনোর জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল, বৃষ্টি কমার সাথে সাথে ক্যামেরাটা নিয়ে সে গেস্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে পড়ল।
গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে পূর্বদিকে উল্কা লেক অভিমুখে চলল। পুরো রাস্তাটা নুড়ি পাথর-বিছানো। রাস্তার দু’ধারে একটা-দু’টো করে ছোট ছোট ঘরবাড়ি, প্রতিটি বাড়ির সামনে এক-ফালি করে বারান্দা ও বাগান। সেখানে বাড়ির পুরুষরা কেউ ফুলগাছের দেখাশোনা করছে, কেউ ভেড়ার লোম থেকে পশম বানানোর কাজ করছে, কেউ বা সাদা ও হলুদ রেশমগুটি সেদ্ধ করে সেগুলো থেকে রেশম-সুতো তৈরি করতে ব্যস্ত। দু’-একজন কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওকে দেখে নিয়ে আবার কাজে মন দিল। বাড়ির মহিলারা এইসময় জঙ্গলে কাঠ ও মধু সংগ্রহ করতে যায়, কিংবা চা-বাগানে পাতা-তোলার কাজে যায়। অর্ক গৌতমের কাছেই জেনেছে, এই অঞ্চলটা মাতৃ-তান্ত্রিক সমাজের নিয়মাধীন। এখানে বাড়ির মহিলারা বাইরের কাজ করে, আর ঘর সামলায় পুরুষরা।
চলার পথেই অর্ক তার ক্যামেরায় অনেকগুলো ছবি তুলে ফেলল। উল্কা লেকের কাছাকাছি পৌঁছনোর পথেই সে পুরো জায়গাটাকে কাছ থেকে ভাল করে দেখল। এদিককার নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী সত্যিই অপূর্ব! এত ঘন সবুজের সমারোহ খুব কম পাহাড়ি জায়গায় দেখা যায় এখনকার আমলে। তার উপর প্রায় পাঁচ-ছ’ঘণ্টার বৃষ্টিতে গাছের পাতা, মাঠের ঘাস, ফুল ও পাতাবাহারের গাছ – সবকিছু ধুয়ে-মুছে একদম চকচকে সবুজ হয়ে গেছে। সাথে অবশ্য তাপমাত্রাও একেবারে অনেকটাই কমে গিয়ে ঠাণ্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে ধরেছে! অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে রাতেও খুব জমিয়ে ঠাণ্ডা পড়বে।
পথের দু’ধারের দৃশ্য ক্যামেরা-বন্দী করতে গিয়ে অর্ক হঠাৎ একটা জিনিস লক্ষ্য করল। একসময় দু’পাশের বাড়িঘর কমতে কমতে এদিকটায় এখন বেশ ফাঁকা। আন্দাজ তিরিশ পা দূরে সামনেই দেখা যাচ্ছে উল্কা লেকের বাঁধানো উঁচু পাড়। সবুজ ঘাসের মোলায়েম গালিচায় গোটাছয়েক মেষশাবক নিজেদের মধ্যে খেলা করে বেড়াচ্ছে, আর তাদের মা-বাবারা কাছাকাছির মধ্যেই খানিকটা তফাতে ঘাস খাচ্ছে। ঘাসের গালিচাটা শেষ হয়েছে একটি বাড়ির সামনে এক সাজানো বাগানের কাছে গিয়ে। ঐ বাগানেরই এদিকে-ওদিকে পাতা রয়েছে গোটাতিনেক লোহার বেঞ্চ, যেগুলোতে রং-বেরঙের বাহারি পোশাক পরে বেশ কিছু মানুষ বসে আছে!
অর্ক ভাল করে লক্ষ্য করল বাগানের সেই বেঞ্চগুলিতে বসে থাকা মানুষগুলোকে। সকলে বসে রয়েছে ঠিকই, কিন্তু কারও বুঝি কোনও নড়াচড়া নেই! একসঙ্গে কয়েকজন বসে থাকবে, অথচ তারা নিজেদের মধ্যে কোনও ভাব বিনিময় করবে না – এ হতে পারে না; অন্ততপক্ষে তাদের শরীরের কোনও-না কোনও অংশের চলন তো হবেই।
সন্দিগ্ধ মনেই এবার সে তার ক্যামেরার লেন্স দিয়ে সেই মানুষগুলিকে জুম করে দেখল। আর দেখামাত্র তার হাত দু’টো ভয়ে কেঁপে উঠল, বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবেগ বেড়ে গেল!
সে স্পষ্ট বুঝতে পারল, যাদেরকে এতক্ষণ সে জলজ্যান্ত মানুষ ভেবেছিল, সেগুলো আদৌ মানুষ নয়! তাদের কারও মুখ হাত পা নড়ে না, চোখের পাতা পড়ে না, মাথা ঘাড় সব স্থির। সেগুলো সব একেকটি মোমের পুতুল!
হুবহু মানুষের আদলে তৈরি মোমের পুতুল ওয়াক্স মিউজিয়াম ছাড়া খোলা আকাশের নীচে হঠাৎ চোখে পড়াটা যেকোনো লোকের পক্ষে অস্বাভাবিক ও ভয়ের কারণ মনে হতেই পারে, বিশেষত যেখানে হলিউডের বিখ্যাত থ্রিলার “হাউজ অফ ওয়াক্স”-এর উদাহরণ রয়েছে। তবে প্রথমে ভয়ে আঁতকে উঠলেও অর্ক পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। সে যে এখন পুতুলগাঁয়ের পুতুলবাবার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে!
এক-পা দু’পা করে অর্ক বাগানের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। এমনি সাধারণ মানের বাগান, তবে যত্ন-আত্তি হয় বোঝা যাচ্ছে। বাগানটার একদিকে লেকের পাড়ে একটি ছোট কাঠের তৈরি বাড়ি, আর অন্যদিকে ঘন জঙ্গল। বাগানে সারি সারি ফুটে রয়েছে বুগেনভিলিয়া, ক্যালেন্ডুলা, লিলি, ক্রিসেন্থিমাম-এর মত ফুল। এছাড়াও রয়েছে রেড রোজ বা রক্তগোলাপ, ডালিয়া, দোপাটি, স্থলপদ্ম ইত্যাদি ফুলেভরা গাছ। সাথে কিছু স্থানীয় ফুল ও ফলের গাছও রয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে।
তবে ঐসবের থেকেও বেশী আকর্ষণীয় বস্তু হল মোমের পুতুলগুলি। মসৃণ ত্বকের উজ্জ্বলতা থেকে শুরু করে চোখের চাহনি, ঠোঁটের ভাঁজ, নাকের আকৃতি, কানের খাঁজ, এছাড়াও হাত-পা প্রভৃতি ও অন্যান্য দেহাঙ্গের ত্রুটিহীন গড়ন দেখে বোঝাই মুশকিল, ওগুলো মোমের পুতুল না আসল মানুষ! কী অভাবনীয় কারুশিল্প! কী নিখুঁত হাতের কাজ! কী অসাধারণ পারদর্শিতা!– যেন একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে হয়!
অর্ক একের পর এক সেই পুতুলগুলোর ছবি তুলতে শুরু করল। পুতুলবাবার মৌচাকের মোম দিয়ে পুতুল বানানোর দক্ষতা সত্যিই অভূতপূর্ব ও অতুলনীয়!
সে গুনে দেখল, সবশুদ্ধ মোট চোদ্দটি মোমের পুতুল রাখা আছে লোহার বেঞ্চগুলোয়। সেগুলোর মধ্যে আটটি পুরুষের, পাঁচটি স্ত্রীলোকের এবং একটি একটা বাচ্চা মেয়ের। গৌতমের কথা অনুযায়ী, এই পুতুলগুলি সেইসব মানুষের, যারা বিভিন্ন সময়ে হয় মারা গিয়েছে, কিংবা এই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছে অন্য কোথাও, চিরকালের জন্য।
এমন সময় হঠাৎ লেকের দিক থেকে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে আরম্ভ করল! এমনই দাপট সে-হাওয়ার, বাগানের গাছগুলি বেশ ভালোরকম জোরে দুলতে শুরু করল তাতে। কয়েকটি গাছ থেকে কিছু তাজা রঙিন ফুলও ঝরে পড়ল। মোমের পুতুলগুলিতে প্যাঁচানো রঙিন কাপড়গুলো ঝালরের মত নড়তে নড়তে যেন সেই হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিল! পুতুলগুলিও হালকা হালকা নড়তে লাগল সেই হাওয়ার তালে তালে। উজ্জ্বল পরিষ্কার সবুজ পটভূমিতে লাল নীল হলুদ খয়েরি গেরুয়া তুঁতে ইত্যাদি নানা রঙের ছড়াছড়ি দেখে মনে হয় যেন গোটা জায়গাটা একটা ক্যানভাসে ছড়িয়ে দেওয়া রঙের মেলায় পরিণত হয়েছে!
ঠাণ্ডা হাওয়ায় অর্কর ভিতর অবধি যেন কেঁপে উঠল; শরীরে মোটা ফোমের উইন্ডচিটার থাকায় রক্ষে, নইলে এই ঠাণ্ডা বাতাসে জমে যেতে হত! ক্যামেরাটা বন্ধ করে সে ঐ হিমশীতল বাতাসের প্রকোপ থেকে বাঁচতে একটু আশ্রয়ের খোঁজে পুতুলবাবার ঘরের বারান্দা অভিমুখে পা বাড়াল।
পুতুলবাবার বাড়িটি বেশী বড় নয়, তবে বারান্দাটা বাড়ির চারদিকটা ঘিরেই, আর অনেকটাই চওড়া। ছবিতে যেমন দেখা যায়, ঠিক তেমনই একটি কাঠের বাড়ি, উপরে ঢেউখেলানো টিনের ছাউনি। বাড়ির সব জানলা-দরজা বন্ধ, তাই ভিতরটা দেখার উপায় নেই। বারান্দার ধার বরাবর ছোট ছোট টবে বিভিন্ন ধরণের চারাগাছ লাগানো রয়েছে। টিনের ছাউনির বর্গা থেকেও বেশ কিছু টব ঝুলছে, আর সেগুলোতেও নানান চারাগাছ লাগানো আছে। অন্য প্রান্তে কোণের দিকে পেল্লায় একখানা আরাম কেদারা রাখা, তাতে শৌখিন গদি পাতা।
অর্ক বারান্দায় উঠে মূল দরজার সামনেই দাঁড়াল।
বাইরেটা অন্ধকার করে এসেছে, বোধ হয় আবার বৃষ্টি নামবে! ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপট বেড়ে গিয়ে একটা ঝড়ো-ভাব দেখা দিল। দু’-চার ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ল বাইরে। সবে দুপুর তিনটে, এরইমধ্যে বাইরের ওরকম অন্ধকার ভাব দেখে মনে হয় যেন প্রকৃতির ভীষণ তাড়া পড়েছে আজকের মত রাত নামানোর পাট চুকিয়ে দেওয়ার!
এবারে একটা মিষ্টি গন্ধ অর্কের নাকে এল; কীসের গন্ধ বলা মুশকিল, তবে ভারী সুন্দর আর মিহি!
গন্ধটা কোনদিক থেকে আসছে ঠাহর করতে সে এদিক-ওদিক দেখে শেষে পিছনে ঘুরে দাঁড়াল, আর সঙ্গে সঙ্গেই তার বুকটা ধড়াস করে উঠল!
তার থেকে সামান্য তফাতে স্মিতহাস্য মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক বৃদ্ধ মানুষ! ফর্সা গায়ের রং, লম্বা সুঠাম চেহারা, আর বেশ শক্ত-সমর্থ প্রকৃতির – পার্বত্য জলবায়ুতে থাকবার ফল। পরনে একটি হালকা খয়েরি রঙের আলখাল্লা বা গাউন-প্রকৃতির পোশাক, মাথায় ফেজ টুপি, পায়ে গামবুট। মুখ ভর্তি ধবধবে সাদা দাড়ি-গোঁফ, মাথার চুলও যেটুকু দেখা যায় সবই সাদা। ভদ্রলোকের চশমার মধ্যে দিয়ে উজ্জ্বল দু’টি চোখের দিকে অতি সহজেই দৃষ্টি চলে যায়। এক নিমেষে মনে হয় যেন সান্টা ক্লোজ স্লেজগাড়ি চেপে হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে!
অর্ক নিজেকে সামলে নিল। নিঃসন্দেহে ইনিই পুতুলবাবা – আধো আলোছায়াতে একহাতে টিনের বাক্স আর অন্য হাতে পাঁচ হাত লম্বা লাঠি নিয়ে আগন্তুকের মত দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
বৃদ্ধ মানুষটি তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাত তুলে পরিষ্কার গলায় বললেন, ‘তুমি আমায় দেখে ভয় পেও না, এটা আমারই বাড়ি। এ-গ্রামে সকলে আমায় “পুতুলবাবা” নামে চেনে।’
অর্ক মুহূর্তের মধ্যে ধাতস্থ হয়ে বলল, ‘আমি আপনাকে দেখে ভয় পাইনি, চমকে উঠেছিলাম, এই নির্জন জায়গায় এমন পরিবেশে হঠাৎ দেখেছিলাম তো, তাই। দয়া করে কিছু মনে করবেন না প্লিজ!’
একটা সুন্দর গাল ভরানো হাসি দিয়ে বললেন পুতুলবাবা, ‘না না, আমি কিছু মনে করিনি। তুমি ভাল করেছ এখানে উঠে। আবার বৃষ্টি নামবে। আর এই ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় অবেলার বৃষ্টিতে ভিজলে শরীর খারাপ হওয়া অবশ্যম্ভাবী। এই গ্রামে কোনও ডাক্তার-বদ্যি নেই; গ্রামের লোকেরা টুকটাক জ্বর সর্দি কাশি হলে জড়িবুটি বা ভেষজ চিকিৎসা করে, আর বড়সড় অসুখ করলে বিন্দুগুড়ি কিংবা দূরের বড় শহর, যেমন শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার – এসব জায়গায় যায়।’
অর্ক একটা সম্মানসূচক ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের পরিচয় দিল, সাথে তার এই গ্রামে আসার উদ্দেশ্যও জানাল পুতুলবাবাকে। সে যে তার ছবি ও প্রবন্ধের মাধ্যমে এই অনামা জায়গাটির সঙ্গে সমগ্র জগতের পরিচয় করাতে চায়, বিশেষতঃ উল্কা লেক আর ত্রিকাল ভৈরবের মন্দির, যেগুলো সম্বন্ধে বাইরের পৃথিবীর মানুষ কিছুই জানে না, সেকথা শুনে পুতুলবাবা খুব খুশী হলেন। এই জায়গাগুলো সম্পর্কে সকলে জানতে পারলে ক্রমান্বয়ে হয়ত এখানেও পর্যটনশিল্পের প্রসার হতে পারে।
অর্কের কথায় সম্মতি জানিয়ে পুতুলবাবা তাকে বারান্দাতেই একপাশে রাখা একটি বেতের মোড়ায় বসতে বলে নিজে দরজা খুলে ঘরের ভিতরে গেলেন হাতের জিনিসপত্র রাখতে। ওঁর হাতের টিনের বাক্সে ছিল জঙ্গল থেকে সেদিনের সংগ্রহ করে আনা মোম, যার মিষ্টি গন্ধই একটু আগে অর্কর নাকে গিয়েছিল। কয়েক মুহূর্ত পরেই তিনি একটা গ্যাসবাতি জ্বেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তার থেকে খানিক তফাতে আরেকটি মোড়ায় বসলেন।
এ-কথা সে-কথার পর অবশেষে অর্ক তার মনের ইচ্ছেটা বলেই ফেলল পুতুলবাবাকে, ‘আমি শুধু এই গ্রামই নয়, আপনাকে নিয়েও একটা ডকুমেন্টারি বানাতে চাই।’
কথার রেশ ধরেই সে এরপর গলায় অনুরোধের সুর এনে বলল, ‘এখানে আসবার পর গেস্ট হাউজের কেয়ারটেকারের কাছে আপনার কথা শুনেছি। আপনার পুতুল বানানোর কারিগরির প্রত্যক্ষ নিদর্শন পেয়েছি আপনার বাগানে এসে। আপনার মত একজন শিল্পীকে যদি পৃথিবীর মঞ্চে তুলে ধরতে পারি, তা’হলে আমার এই অজানাকে জানবার আগ্রহ সার্থক হবে।’
পুতুলবাবা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর গম্ভীরস্বরে বললেন, ‘আমি যে পুতুল বানাই, তা একান্তই শখ; কোনও চাহিদা মেটাবার পন্থা হিসেবে আমি পুতুল তৈরি করি না। আমি এই পুতুলগাঁ ও এখানকার মানুষদের ভালবাসি, তাদের নিজের পরিবার বলেই মনে করি। এই পরিবারের কোনও সদস্য যখন এখান থেকে চলে যায়, তখন তার আদলে একটি পুতুল বানিয়ে রাখি সেই সদস্যের স্মৃতি ধরে রাখার জন্যে। আমি যখন আমার আশে-পাশে সেইসব পুতুলগুলিকে দেখি, মনে হয় যেন কেউ আমাকে ছেড়ে কোথাও যায়নি! শুধুমাত্র এইটুকুর জন্যই আমি পুতুল গড়ি।’
তাঁকে বোঝাবার সুরে বলল অর্ক, ‘আপনার আবেগকে সম্মান জানাই। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি, আপনার এই প্রতিভা অতি বিরল, আমাদের দেশে এমন পুতুল গড়ার কারিগরির আর কোনও নজির নেই।’ একটু থেমে সে আরও বলল, ‘আপনি নিজেও ভেবে দেখুন, আপনার কাজের খ্যাতি বাইরের জগতে ছড়িয়ে পড়লে আপনারই এই গাঁয়ের ও পরিবারের লোকেদের কত উন্নতি হবে! এই গ্রামের উন্নয়ন হবে, এখানকার মানুষদের আরও ভাল কর্মসংস্থান হবে, জীবনযাত্রার মান উন্নততর হবে।’
অর্ক তার ক্যামেরা হাতে নিয়েই বসেছে, পুতুলবাবার অনুমতি পেলে আর দেরী করবে না সে, ডকুমেন্টারি স্যুট করা আরম্ভ করে দেবে। হাতের ক্যামেরার লেন্সটা খুলে নিয়ে সে আবার বলল, ‘আরেকটি দিকও রয়েছে এই প্রসঙ্গের। আপনার খ্যাতির হাত ধরে সকলে জানতে চাইবে, কীভাবে আপনি এই বিদ্যেটা আয়ত্ত করেছেন, কবে থেকে এ-কাজটা আরম্ভ করেছেন, কোন কোন কাঁচামাল এবং কী কী পদ্ধতি ব্যবহার করে এই কারুকার্যকে এমন নিখুঁত ও অনায়াস রূপদান করে চলেছেন! এসব তো সকলের জানবার ইচ্ছে থাকবেই। আপনার শখ পূরণের এই বিদ্যে শিখে হয়ত একদিন কিছু মানুষ সংসার চালাবে! তাদের কথাও চিন্তা করুন না একবার!’
পুতুলবাবা নিশ্চুপ দেখে সে ফের বলতে লাগল, ‘আপনার শিল্পীসত্ত্বা সকলের সামনে এলে আদপে তো সেটা এই গ্রামেরই উন্নতির পথ প্রশস্ত করবে! এখানকার লোকেরা আপনাকে এযাবৎ মান্য করে এসেছে; তাদের প্রতি আপনার একটা দায়িত্বও তো রয়েছে। শুধু স্মৃতি রোমন্থন করে পুতুল বানানো ছাড়া আপনি কি আপনার পরিবারের লোকেদের আর কিছু দিয়ে যেতে চান না?’ এরপর অল্প থেমে সে আবার বলল, ‘ইতিহাস জীবনের ভিত্তি হলেও কেবলমাত্র ইতিহাস নিয়ে বাঁচা যায় না। এই ভিত্তির উপরই ভবিষ্যৎ গড়তে হয়। কে বলতে পারে, আজকে আপনার ডকুমেন্টারি স্যুট করতে রাজি হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ত কোনোদিন কিছু মানুষকে নতুনভাবে বাঁচার রাস্তা দেখাবে!’
তার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পূর্বদিকের জঙ্গলে কোথাও বাজ পড়ল, আর তাতে যেন সারা পৃথিবী কেঁপে উঠল হঠাৎ করে! বিদ্যুতের ঝলকানিতে ক্ষণিকের জন্যে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আর ঠিক পরমুহূর্তেই বড় বড় ফোঁটায় মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হল।
পুতুলবাবা নীরবে বসে আছেন। অর্কের কথাতে তিনি কিছু একটা ভাবতে শুরু করেছেন। কিছুক্ষণ ঐভাবে থাকার পর তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আনমনে বলতে লাগলেন, ‘এই পুতুলগুলো বৃষ্টিতে ভেজে, রোদে পোড়ে, শীতে কাঁপে। যে কোনও পরিবেশ-পরিস্থিতিতে ওরা ঠায় একভাবে বসে থাকে, কোত্থাও নড়ে না। ওদের কোনও চাহিদা নেই, দাবি নেই, আকাঙ্ক্ষা নেই; নেই কোনও স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, রোগ-ব্যাধিও নেই। ওদের কোনও নাম নেই, পরিচিতি নেই। রয়েছে কেবলমাত্র একটা সীমাবদ্ধ গণ্ডি, একটা অপরিণত বাধ্যবাধকতা, স্মৃতিমেদুর কল্পনাবিলাসের দায়ভার। এক উন্মাদ মানুষের বেখেয়ালির খেসারত দিয়ে চলেছে ওরা!’
আবার খানিকক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন পুতুলবাবা। চশমার ফাঁক দিয়ে ওঁর দু’চোখের দৃষ্টি না-জানি কোন অজানায় চলে গেছে! হয়ত ভদ্রলোক জীবনের অতীত অধ্যায়গুলিতে বিচরণ করছেন আপন খেয়ালে। অবশেষে উল্কা লেকের পানে চেয়ে তাঁর দৃষ্টি স্থির হল।
অর্ক বুঝল, আর পুতুলবাবার মৌখিক সম্মতির দরকার নেই। আধো-অন্ধকারমগ্ন গ্যাসবাতির আলোতেই ক্যামেরা চালু করল সে। তার লেন্সের কেন্দ্রবিন্দুতে এখন পুতুলবাবা। তাঁর দু’চোখ ঝাপসা, মনে হয় যেন স্মৃতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা হৃদয়ের অত্যন্ত কাছের কিছু বিগত মুহূর্তের ছোঁয়া লেগেছে! গ্যাসবাতির আলোর আবছায়াতেই এই পটভূমি বেশী মোহময় মনোহর হয়ে উঠেছে। বাইরের বৃষ্টি তাতে তাল সংযোজন করে চলেছে অবিরত।
মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন পুতুলবাবা, ভাঙা ভাঙা ধরা গলায় বলতে আরম্ভ করলেন তাঁর কাহিনী, ‘প্রায় ষাট বছর আগে প্রথম এই গ্রামে এসেছিলাম। এই বিন্দুগুড়ি তখন এক চাইনিজ কলোনি ছিল। আমার বাবা-দাদাদের ছিল কাঠের ব্যবসা। এস্. এম্. সরকার অ্যান্ড সনস্ ছিল তখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও পেশাদার কাঠের ব্যবসায়ী বা টিম্বার মার্চেন্ট। আমার পিতামহ সুখময় সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই এই ব্যবসার রমরমা করে দেন। এর পরবর্তী পর্যায়ে দেশ স্বাধীন হবার পর আমার বাবা সৌন্দর্যময় সরকার এবং কাকা সুধাময় সরকার সেই ব্যবসাতে আরও জাঁকিয়ে বসেন।
এই বিন্দুগুড়ির ত্রিকাল ভৈরবের মন্দির ও উল্কা লেকের কাছাকাছি অঞ্চলে অতি উৎকৃষ্ট মানের সেগুন গাছের ঘন জঙ্গল ছিল। আমার দাদা ও ভাইরা কেউ তখন ত্রিপুরার জঙ্গলে, কেউ আসামের জঙ্গলে, কেউ-বা শালবনী ও ঝাড়গ্রামের জঙ্গলে। বাবা তাই এ-জঙ্গলের সেগুন কাঠের বরাত দিয়ে পাঠালেন আমাকে। সেই সূত্রেই আমার এখানে আসা। আর, এখানেই প্রথম দেখা হয় ওর সাথে!
ওর নাম কী ছিল, তা আমি আজও বলতে পারব না। ওর বান্ধবীরা ওকে ‘লিলি’ বলে ডাকত। এখানকার চাইনিজ কলোনির এক পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ কন্যা ছিল লিলি। ওরা উল্কার পাড়ের এই বাড়িটাতেই থাকত। ওর দাদারা সব দেবীঝোরার পাশের চা-বাগানের শ্রমিক ছিল। চাইনিজ কলোনির বাকি লোকেদের অধিকাংশই ঐ চা-বাগানে কাজ করত।
আমার ব্যবসায় মনোযোগ ছিল না। নিজের ইচ্ছেমত পাহাড়ে, জঙ্গলে, ঝর্ণার ধারে ঘুরে বেড়াতাম, ছবি আঁকতাম, কবিতা লিখতাম, গান গাইতাম গলা ছেড়ে, আবার কখনও-সখনও খেয়ালবশে উল্কার পাড়ে এসে একলা বসে থাকতাম। এরজন্য বাবা আমায় বহুবার তিরস্কার করেছেন।
আমায় একলা বসে থাকতে দেখেই কিনা জানি না, লিলিও মাঝেমধ্যে উল্কার পাড়ে চলে আসত একা-একা! প্রথমে চোখাচোখি ও দৃষ্টি-বিনিময়, তারপর আলাপ-পরিচয় মেলামেশা। আমরা একে-অপরের ভাষা বুঝতাম না, কিন্তু কথা ঠিক বুঝতাম! দেবীঝোরার জলের তোড়, ত্রিকাল ভৈরবের মন্দির, উল্কা হ্রদের পাড়, খাড়াই পাহাড়ের বরফ, খাদের নীচের খরস্রোতা লিবং নদী – সব জায়গায় আমরা দু’জন দেখা করতাম। কেমন করে দু’জনের মনের মিল হয়ে গেল জানা নেই; তবে আমরা যে এক অনাবিল ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি, সেটা দু’জনেই খুব ভাল বুঝতে পারছিলাম।’
একটু বিরতি নিয়ে পুতুলবাবা আবার মোড়ায় বসে পড়ে আরম্ভ করলেন তাঁর কাহিনীর দ্বিতীয় অধ্যায়, ‘ভারতের মাটিতে তখন কালোবাজারিদের পোয়া বারো – দারুণ সুসময়। সব নীতি বিসর্জন দিয়ে বাঙালী ব্যবসাদাররা বাজারে নামল, সম্বল কেবলমাত্র সুযোগসন্ধানী পুঁজিবাদ ও গুচ্ছের দুর্নীতি! মুনাফাসর্বস্ব ব্যবসায়িক মানসিকতা সমাজের সর্বস্তরে নিয়ে এল এক অবশ্যম্ভাবী ও অপ্রতিরোধ্য অবক্ষয়। এখানকার চা-বাগানে চা চাষের আড়ালে শুরু হল গাঁজা ও আফিমের চাষ। আশপাশের জেলাগুলি থেকে শ’য়ে শ’য়ে শ্রমিক আনা হল ঐ কাজের জন্য। তাদের বাসস্থান হল দেবীঝোরার পূর্বপারের জঙ্গলে, চাইনিজ কলোনির পাশেই।
ওদিকে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত ও ভুটান সীমানা দিয়ে চীন তার শয়তান ঔপনিবেশিকতার হাত বাড়াতে শুরু করল ভারতের বিরুদ্ধে। এই অঞ্চলসহ সমগ্র পূর্ব হিমালয়ের অধিবাসীদের মধ্যে গাঁজা ও আফিমের নেশা ধরিয়ে তাদের চিন্তাভাবনাকে পঙ্গু করে দিয়ে পুরোটা দখল করে নেওয়ার ষড়যন্ত্র ছিল চীনের! এ হচ্ছে দমনমূলক ঔপনিবেশিকতা। এসময় বহু মূর্খ ও দুর্বৃত্ত বাঙালী ব্যবসায়ী সামান্য কিছু মুনাফার লোভে চীনের ঐ ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে সামিল হয়ে গেল।
কিন্তু চীনের ঐ ষড়যন্ত্র ঘটনাচক্রে ফাঁস হয়ে গেল। বিপ্লব শুরু করল চা-বাগানের শ্রমিকরা – বাঙালী ও চীনে, দু’দলই। গাঁজা ও আফিম চাষের বাড়বাড়ন্ত অনেকখানি কমে গেল। ঐ বিপ্লবের হাত ধরেই বিন্দুগুড়িতে এক অটুট শ্রমিক সংগঠন তৈরি হল। এই সংগঠিত বিপ্লব যাতে দাবানল না ছড়ায়, সেজন্য এখানকার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকজন যুক্তি-পরামর্শ করে সমকালীন কৃষক আন্দোলনে যোগ দিয়ে ঐ বিপ্লবকে দিশাহীন করে দিল।
পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৬২ সালে ইন্দো-চীন যুদ্ধ শুরু হল। বাঙালী শ্রমিকদেরকে চীনে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলল কিছু সুযোগসন্ধানী জননেতা; তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল সদ্য মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত রাজনীতিবিদ ভাস্কর সান্যাল। যে মানুষগুলি এতদিন একসঙ্গে বসবাস করেছে, কাজকর্ম করেছে, উৎসব-আচার পালন করেছে, এমনকি বিপ্লব-আন্দোলনও করেছে, তারাই একে অন্যের রক্তের পিপাসু হয়ে উঠল!
আমি আর সহ্য করতে না পেরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম বিন্দুগুড়ির ঐ মানুষগুলোকে বাঁচানোর কাজে। হয়ত আমার সদিচ্ছা দেখেই ওরাও আমার কথা মেনে নিল, ভুলে গেল পুরনো বিবাদ। যুদ্ধ শেষে ওদের মধ্যে আবার মিল হয়ে গেল।
কিন্তু চা-বাগানে চীনে শ্রমিকদের আর কাজ জুটলো না, পরিবর্তে নেপালি ও ভুটিয়া শ্রমিকদের নিয়োগ করা শুরু হল। সেকারণে আমার কাঠের মিলে ঐ সদ্য কাজ-হারানো চীনে শ্রমিকদেরই কাজে বহাল করলাম আমি।’
এবারে আবার একটু বিরতি।
পুতুলবাবাকে বেশ ক্লান্ত লাগছে, মনে হচ্ছে যেন তিনি ধুঁকছেন! অর্ক ক্যামেরার রেকর্ডিং থামিয়ে তাঁকে একটু জল খেয়ে নিতে বলল। ভদ্রলোক বেশ কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিলেন, তারপর তাঁর আলখাল্লার পকেট থেকে একটা ফ্লাস্ক বের করে সেটা থেকে কয়েক ঢোঁক জল খেলেন। এই অশীতিপর বৃদ্ধের মনের জোর অঢেল হলেও শারীরিকভাবে তিনি যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছেন বোঝা যাচ্ছে!
আরও কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে ধাতস্থ হয়ে নিলেন পুতুলবাবা। অর্ক তার ক্যামেরা ফের চালু করেছে। পুতুলবাবা আরও একবার উল্কা লেকের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘এরইমধ্যে আমি লিলিকে বিয়ে করব জানিয়ে বাড়িতে চিঠি পাঠালাম। বাড়ির কেউ রাজি হবে না জানতাম; তাই মনস্থির করলাম, আমরা ত্রিকাল ভৈরবের মন্দিরেই বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হব।
স্থানীয় মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন চীনেদের কাজে বহাল করেছি বলে এমনিতেই আমার উপর অসন্তুষ্ট ছিল, এবার তারা আমার ও লিলির সম্পর্ক নিয়ে জঘন্য মিথ্যে রটনা রটিয়ে দিল। আমার বাবা ও দাদারা আমায় আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দিল না, আমার চোখের সামনেই ত্রিকাল ভৈরবের মন্দির প্রাঙ্গণে লিলি ও তার পুরো পরিবারকে জীবন্ত অবস্থায় নৃশংসভাবে অগ্নিদগ্ধ করে মারল! চারজন বাঙালী শ্রমিকও সেদিন প্রতিবাদ করতে এগিয়ে ঐ অন্যায়ের ত্রাসে প্রাণত্যাগ করেছিল।’
এই পর্যন্ত বলে হঠাৎ পুতুলবাবা মাথা নিচু করে অঝোরে কেঁদে ফেললেন! এই ব্যথার ভাগীদার হওয়া অর্কের পক্ষে সম্ভব নয়। সে শুধু ভাবছে, কী বিচিত্র এই ভালবাসার কাহিনী; এই আশি বছর বয়সী মহীরুহ শিল্পীর জীবনযাত্রা কতখানি কঠিন ও বেদনাময়, তা যেন কল্পনা করাও দুরূহ! তাঁকে সান্ত্বনা জানানোর মত ভাষাও নেই অর্কের কাছে। সে-ও বাকরুদ্ধ।
পুতুলবাবার কান্না থামল। বেশ কিছুক্ষণ দু’জনেই নিশ্চুপ। বাইরে বৃষ্টি ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসছে, অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাব অনেকটা কেটে গিয়ে চারদিক আবার পরিষ্কার হচ্ছে।
ঘড়িতে বাজে পৌনে চারটে। এতক্ষণ একটানা ক্যামেরা চালানোর পর অর্ক লক্ষ্য করল, সেটার ব্যাটারি ফুরিয়ে এসেছে। রেকর্ডিং থামিয়ে ক্যামেরায় ভরা ব্যাটারির সেটটা বের করে ব্যাগের যথাস্থানে রেখে অন্য সেটটা ক্যামেরায় ভরে ফের শুটিং-এর জন্য প্রস্তুত হল সে। তারপর সে গ্যাসবাতিটা নিভিয়ে দিল; যা আলো আছে, তাতেই তার শ্যুটিংটা হয়ে যাবে।
চোখের জল মুছে নিয়ে আবার বলতে আরম্ভ করলেন পুতুলবাবা, ‘সেই ঘটনার পর আমি আর কলকাতায় ফিরে যাইনি কখনও, আমার নিজের পরিবারকে ছেড়ে স্থায়ীভাবে এখানে এই বাড়িতেই থাকতে শুরু করলাম। লিলির স্মৃতি কুঁড়ে কুঁড়ে খেত আমায়, অদ্ভুত এক পাপের বোঝা বয়ে বেড়াতাম যেন! পাগলের মত ঘুরে ঘুরে বেরিয়েছি এখানকার পাহাড় ও জঙ্গলে। শুধু যেন লিলিকেই খুঁজে বেড়াতাম ওর কাছে ক্ষমা চাইব বলে!
অবশেষে হঠাৎই একদিন লিলিকে দেখতে পেলাম – এই উল্কা লেকের পাড়েই! এক ছুটে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম; তখন আমার আর কিচ্ছু ভাববার সামর্থ্য ছিল না। বাঁধভাঙা কান্নায় দু’চোখ ভাসিয়ে আমার বাবা-দাদাদের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইলাম ওর কাছে। আমার হাতে হাত রেখে ও বোঝাল, আমায় ছেড়ে ও কোত্থাও যায়নি, আজীবন থাকবে আমার সাথেই! আমার কাছে সে কেবলমাত্র একটিই দাবি জানাল – তার পরিবারকেও সে এখানেই রাখতে চায়।
লিলির টুকরিতে সবসময় থাকত তিনটি মোমের পুতুল, খুব সম্ভবত সেগুলো ওর মায়ের তৈরি। ঐ পুতুলগুলিকে ও খুব আদর-যত্ন করত। আমার ধারণা হল যে মোমের পুতুলের প্রতি তার আকর্ষণ সবচেয়ে বেশী হবে। তাই লিলির স্মৃতিতেই শুরু করলাম নিজের হাতে মোমের পুতুল বানানো।
মিলের পুরনো ভাঙা যন্ত্রাংশ থেকে লোহা সংগ্রহ করে স্থানীয় এক কামারকে দিয়ে মানুষের মুখমণ্ডলের কয়েকটি ছাঁচ তৈরি করিয়ে নিলাম, জঙ্গলের কাঠ দিয়ে মানুষের আদলে কিছু কাঠামোও বানিয়ে নিলাম। গাছ কাটার পর ভাঙা মৌচাক থেকে মোম বের করে তা আগুনে গলিয়ে ছাঁচে ঢেলে বিভিন্ন মুখাবয়বের পুতুল তৈরি করা আরম্ভ করলাম। প্রথম প্রথম অনেক ভুল হত, কিছুতেই কাঙ্ক্ষিত আকৃতি আনতে পারতাম না, যাচ্ছেতাই জিনিস তৈরি হত; গরম তরল মোমের ছ্যাঁকায় হাত পুড়ে গেছে কতবার! রেগে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদতাম, হতাশ হয়ে বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছি, কিন্তু পারিনি; প্রতিবারই মনে হত যেন লিলি আমায় দেখছে উল্কার পাড় থেকে, হাত নেড়ে নিষেধ করছে, তাকে দেওয়া আমার প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দিচ্ছে! অবশেষে জেদ চেপে গেল মাথায় – যে করেই হোক, আমাকে নিখুঁত মোমের পুতুল বানাতেই হবে! দিন গেল, রাত গেল, মাস বছর – সব গেল, তবুও আমার পুতুল বানানো শেষ হল না। সে যেন এক অদম্য নেশা!
এই করে কেটে গেল সাড়ে তিন বছর। একদিন আমার কাঠামোয় অবয়ব এল – ত্রিকাল ভৈরবেরই অবয়ব! গ্রামের মানুষ চমকে গেল আমার এই কারিগরি দেখে। আমিও ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম, সেই সঙ্গে দুঃখিতও। যে দেবতার সামনে আমার ভালবাসার অগ্নিদাহ করা হয়েছিল আমারই আপনজনদের হাতে, সেই দেবতাই আমার হাতে ধরা দিলেন নিজের স্বরূপে! সেদিন মনে হয়েছিল যেন লিলিকে যে কথা দিয়েছি, তা অবশ্যই রাখতে পারব, স্বয়ং ত্রিকাল ভৈরবই সে-কাজে আমায় সাহায্য করবেন।
গ্রামের লোকেরা আমায় ভগবানরূপে মানতে লাগল; ওদের বোঝালাম, আমি ত্রিকাল ভৈরবের পুতুল বানিয়েছি, মূর্তি নয়! তারপর শুরু হল আরও নিখুঁত কারিগরি করা। সেই পুতুলের মুখমণ্ডলের প্রতিটি খাঁজ ও ভাঁজকে পরিষ্কার করে ফুটিয়ে তোলা – তুরপুন ও ব্লেড দিয়ে চেঁছে চেঁছে শেষে গরম কাপড় দিয়ে চেপে চেপে পালিশ করে ত্রিকাল ভৈরবের ত্রুটিহীন পুতুল তৈরি হল অবশেষে!’
পুতুলবাবা আরও একবার বিরতি নিলেন। মোড়া ছেড়ে ফের উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বাইরের উদাত্ত প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি তাঁর। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। গাছের পাতার ঝকঝকে সবুজ আরশিতে সোনালী রোদ্দুর খেলে বেড়াচ্ছে। পাখির দল কিচির-মিচির করে আকাশের গাঙে ডানা মেলে দিয়েছে আনন্দে। আর কিছুক্ষণ পরেই সূর্যাস্তের লালচে আভায় পশ্চিমদিকটা সিঁদুররাঙা হয়ে উঠবে; তখন ওদের বাড়ি ফেরার পালা। বৃষ্টিস্নাত গাছের পাতা থেকে জলের ফোঁটা মাটিতে পড়ছে – যেন নিজেকে হালকা করে আরামের সন্ধানে সে! মসৃণ ঠাণ্ডা ঝিরঝিরে বাতাস সামনের বাগান ও উল্কা লেকের পাড়ের ঘাসের গালিচায় চিরুনি চালিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আর, এসবের উপরে রঙিন অভিভাবকের মত আকাশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি অর্ধবৃত্তাকার পথে ছড়িয়ে রয়েছে রামধনু!
‘সেই ঘটনার পর থেকে আমার নাম হয়ে গেল “পুতুলবাবা!”’ সামান্য হেসে নিয়ে বললেন তিনি, ‘দেবীঝোরার এপারের এই অংশটারও আলাদা নাম হল – পুতুলগাঁ। এসব গ্রামের লোকেদেরই কীর্তি! এরপর বছরকয়েকের প্রচেষ্টা ও সাধনায় লিলির পরিবারের মানুষগুলির অবয়বে বানিয়ে ফেললাম বেশ কিছু পুতুল।’
এরপর আবার কিছু একটা মনে করে তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘ধীরে ধীরে মনে হল, সেই রাতে লিলিদের সঙ্গেই আরও যেসব এদেশীয় শ্রমিকগুলি আমাদের জন্য প্রাণ দিয়েছিল, তাদের পুতুলও বানানো উচিৎ; সেটাই হবে তাদের আত্মত্যাগের প্রতি যথাযোগ্য সম্মানজ্ঞাপন। ক্রমে বহু স্মৃতিমন্থন করে তাদের পুতুলও বানালাম। তারপর পুতুলগুলোতে রং চাপালাম, তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ দিলাম, চুল, দাড়ি-গোঁফ, ভ্রূ, এসবও লাগালাম।
চিত্রশিল্পীরা যা একবার চোখে দেখে, তা হুবহু ক্যানভাসে তুলে ধরতে পারে ছবির মাধ্যমে। আমিও বুঝতে পারলাম, আমার মধ্যেও কতকটা সেইরকমই ব্যাপার গড়ে উঠছে! এ হয়ত আমার পরিশ্রম, অধ্যবসায়, সাধনা, মনঃসংযোগ – এসবেরই ফসল।
ওদিকে এস্. এম্. সরকার অ্যান্ড সনস্-এর কাঠের ব্যবসা এই অঞ্চল থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নিল। ততদিনে বাবাও গত হয়েছেন, আর কাকা-দাদারা মিলে অন্য ব্যবসায় টাকা ঢেলেছে। তবে আমি আর কলকাতার বাড়িতে ফিরে যাইনি; পুতুলগাঁকেই করে নিয়েছিলাম নিজের ঘর-বাড়ি-পরিবার-পরিজন।
এরপর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপকহারে বদল ঘটে গেল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশের উৎপত্তি হল, সারা দেশে ইমার্জেন্সি ঘোষণা করে রাষ্ট্রপতি-শাসন লাগু হল, বাংলায় নকশাল আন্দোলন শুরু হল, দাঙ্গা, নাশকতা, স্মাগলিং, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি ইত্যাদি নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হল।
তবে আমি মোমের পুতুল বানানোর কাজ করেই চললাম আপনমনে – লিলির পরিবারের মানুষদের পুতুল, সেই বীভৎস রাতে আমাদের রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দেওয়া সেই চারজন বাঙালী শ্রমিকের পুতুল, তারপর এই গ্রামের মৃত কিংবা অন্যত্র স্থানান্তরিত মানুষদের ঐ পুতুলগুলো। ওরা সকলেই আমার ও লিলির পরিবারের লোক। ওরা রইবে আমাদের সঙ্গেই।’
পুতুলবাবা থামলেন, শেষ করলেন তাঁর কাহিনী। বুক ভরে অনেকটা দম নিলেন – যেন বুকের উপরে চেপে বসে থাকা একটা ভারী পাথর হালকা করলেন! চোখ থেকে চশমাটা খুলে আলখাল্লার একটা খুঁট দিয়ে ভাল করে দু’চোখ মুছে নিলেন। তারপর চশমা পরে আবার ফ্লাস্ক থেকে একটু জল খেয়ে নিলেন। দৃষ্টি তাঁর তখনও বাইরের দিকেই।
অর্ক এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তি পেয়েছে যেন পুতুলবাবার কাহিনী শুনে – একজন স্বেচ্ছা-নির্বাসিত অক্লান্ত শিল্পীর ভালবাসার নির্মম পরিণতির গল্প! এঁর জীবনের নেপথ্যে যে দুঃখ-জর্জরিত ইতিকথা জড়িয়ে রয়েছে, তার তুলনায় যেকোনো কাহিনীই নির্দ্বিধায় ম্লান হয়ে যায়।
এছাড়াও, পুতুলবাবার মোমের পুতুল বানানোর কাঁচামাল ও পদ্ধতি ভীষণই সাধারণ ও প্রথাগত, যা কেবলমাত্র অধ্যবসায় দিয়েই আয়ত্ত করা যায়, অনুসরণ করে শেখা যায়, কিন্তু অনুকরণ করা যায় না! আধুনিক যুগের অত্যাধুনিক সাজসরঞ্জাম ও কলাকৌশলের দ্বারা ঐরকম নিখুঁত কারিগরি অবশ্যই সম্ভব, তবে সেক্ষেত্রে কারখানার পরিবেশের কৃত্রিমতাই সেই রূপ দিতে পারে। কিন্তু পুতুলবাবার অনন্যসাধারণ প্রতিভা ও শৈল্পিক কারিগরি দক্ষতার কাছে বুঝি কারখানার সরঞ্জাম ও কলাকৌশলও হার মেনে যাবে!
অর্কর ক্যামেরা চলছে তখনও, পুতুলবাবা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এই গ্রামের সকলেই আমার জীবনের কথা জানে। ওরা আমাকে অভিভাবক হিসেবে মান্য করে খুব। আমার এই পুতুল বানানোর কথা ওদের অনেকেই চেয়েছিল বাইরের দুনিয়াকে জানাতে; আমিই ওদের বারণ করেছি, বলেছি, এখনও সময় আসেনি পৃথিবীকে জানাবার। আমি এখনও আমার সবচেয়ে ভাল পুতুল তৈরি করে উঠতে পারিনি, এখনও আমার হাতে পূর্ণতা পায়নি আমার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি! যেদিন সেটাও বানিয়ে ফেলব, সেদিন আমি নিজেই এ-গ্রামের কাহিনী সকলকে জানিয়ে দেব, জানিয়ে দেব আমার মোমের পুতুল তৈরি করার গল্প।’
‘আপনার প্রত্যেকটা পুতুলই খুব সুন্দর ও নিখুঁত, ’ বলল অর্ক, ‘এগুলো তো সবই মনে হয় আপনার শ্রেষ্ঠ কারুশিল্প!’
‘না ভাই, ’ বললেন পুতুলবাবা, ‘আমার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি এখনও সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেনি।’ তারপর আবার এক অসম্পৃক্ত নৈঃশব্দ্যের আড়ালে চলে গেলেন তিনি!
প্রসঙ্গ বদলে অর্ক অনুরোধের কণ্ঠে তাঁকে বলল, ‘আমি কি আপনার পুতুলগুলোর ছবি নিতে পারি?’
পুতুলবাবা মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ‘এসো’ বলে ইশারায় তাকে ঘরের ভিতরে ডাকলেন।
ঘরে ঢুকে তিনি প্রথমেই জানলাগুলো খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ ঠাণ্ডা ঝিরঝিরে বাতাস ভিতরে ধেয়ে এল! একেবারেই সাধারণ ছিমছাম ঘরের অন্দরমহল। নামমাত্র আসবাবপত্র – একপাশে একটা খাটিয়া পাতা, তাতে বিছানাপত্র রয়েছে, পাশে একটি টেব্লের উপরে কিছু কাগজপত্র ও একখানা লণ্ঠন রাখা, অন্যদিকে একটা আলনায় কয়েকটি জামাকাপড় ঝোলানো। আধুনিক পৃথিবীর ছিটে-ফোঁটা চিহ্নও দেখা যায় না এ-ঘরে, এমনকি কোনও দেওয়ালে একটি ক্যালেন্ডার পর্যন্ত নেই! অর্ক বুঝল, পুতুলবাবা নিতান্তই সন্ন্যাসজীবন কাটাচ্ছেন।
তবে ঘরটির ঠিক মাঝামাঝি অংশে আরও দু’টো লোহার বেঞ্চে বেশ কয়েকটি পুতুল রাখা আছে। এইগুলোর গায়েও রঙিন পোশাক চাপানো, আর মাথার উপর একটা লম্বা তারের মাধ্যমে একটি বাল্ব ঝুলছে। অর্ক দেখল, এই পুতুলগুলো সব চাইনিজ মানুষের আদলে তৈরি। এরাই সম্ভবতঃ লিলির পরিবারের মানুষজন।
পুতুলবাবা ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা ঘর ঐ পুতুলগুলোর ঝলমলে পোশাকের ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সেই সঙ্গে আলো-আঁধারি ছেড়ে সামনের মেঝেয় প্রকট হয়ে উঠল নীলচে শরীরের জটাধারী ত্রিশূল-ত্রিনয়ন-ডমরু সম্বলিত সর্পবেষ্টিত নীলকণ্ঠী রুদ্রদেব – পুতুলগাঁয়ের ত্রিকাল ভৈরবের মোমের পুতুল। শিবের ঐ পুতুল দেখে অর্ক অভিভূত হয়ে গেল। কাঠের তৈরি ত্রিশূল, ডমরু, সাপ বাদ দিলেও শুধু পুতুলের উপরে যা কারুকার্য করা হয়েছে, তা অভাবনীয়! হতবাক হয়ে সেই পুতুলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়েই রইল সে।
চল্লিশ বছরের পুরনো অথচ অম্লান সেই ত্রিকাল ভৈরবের মোমের পুতুল থেকে অনেক কষ্টে চোখ সরিয়ে সে এবারে ঘরের বাকি জায়গাগুলোয় দৃষ্টি ফেরাল। দরজার ঠিক উল্টোদিকের দেওয়ালে একটা ফায়ার প্লেস্-সহ চিমনি যেন দেওয়ালটিতে প্রায় লুকিয়ে রয়েছে! সেটার পাশেই বিভিন্ন আকারের টিনের বাক্স, মোমদানি, একটা ছোট হাপর, কয়েকটা মুখের ছাঁচ, ইত্যাদি রয়েছে। একটা বড় চৌকো পাত্রে জল রাখা আছে। বোঝা গেল, ঐ ফায়ার-প্লেস্ই পুতুলবাবার মোম গলানোর জায়গা। গলিত মোম ছাঁচে ফেলে চেহারার প্রাথমিক আকৃতি দেওয়া হয়, তারপর চলে ঘষা-মাজা ও পালিশের কাজ, সবশেষে রং-তুলি।
ঘরের অন্যদিকের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো আছে কয়েকটি কাঠের তৈরি মানবদেহের আকৃতির কাঠামো – পুরুষ, স্ত্রীলোক ও বাচ্চা, তিন রকমই। কাঠামোগুলি অনেকটা কাপড়ের দোকানের ম্যানেকিনের মত দেখতে, যার উপরে কাপড়-জামা পরানো থাকে প্রদর্শনের জন্য! এই কাঠামোগুলোতে গলিত মোমের তাল চাপিয়ে শরীরের আকৃতি দেওয়া হয়, তারপর মুখাবয়বটি স্থায়ীভাবে গলার উপর বসিয়ে সবশেষে পালিশ করার পর কাপড়-জামা পরিয়ে দেওয়া হয়। একদম শেষ পর্যায়ে পুতুলগুলোর মাথায় ও মুখে চলে নকল চুল আর ভ্রূ লাগানোর কাজ, এবং পুরুষ হলে তাতে দাড়ি-গোঁফ লাগানোর কাজ। ভিতর ফাঁপা বলে পুতুলগুলো ওজনে হালকা হয়।
একটা একটা করে ধাপের বর্ণনা দিয়ে চলেছেন পুতুলবাবা, আর অর্ক তার ক্যামেরায় সব রেকর্ড করে নিচ্ছে। সত্যিই, অতি সাধারণ উপায়ে কী অসাধারণ শিল্পকর্মের নমুনা – এ যে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন! ছবি আঁকাও যথেষ্ট দক্ষ শিল্পকর্ম, উপযুক্ত দর্শনের দৃষ্টি ও পারদর্শিতা না থাকলে ভাল ছবিও আঁকা যায় না। এমনকি কাঠের কাঠামো ও ছাঁচে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি তৈরি করাও নিপুণ দক্ষতার কাজ। কিন্তু মোম দিয়ে পুতুল গড়ার এমন শিল্পকর্ম ব্যতিক্রমী প্রতিভা না থাকলে অসম্ভব!
এবারে ঘরের আরেক কোণে চোখ পড়ল অর্কের। সেখানে একটা কালো পর্দা ঝুলছে। বোঝা যাচ্ছে, সেই পর্দার পিছনে কিছু একটা রয়েছে। সে ক্যামেরার লেন্স সেদিকে ঘুরিয়ে পুতুলবাবাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঐ পর্দার পিছনে কী আছে?’
পুতুলবাবা আপত্তির ভঙ্গিমায় জবাব দিলেন, ‘না ভাই, ওদিকে যেও না। ঐ পর্দার আড়ালেই আমি তৈরি করছি আমার সবচেয়ে দামী পুতুল, আমার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি! সেটা এখনও নির্মীয়মাণ, তাই দেখা বারণ।’
অর্ক ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, ‘বেশ, তা’হলে বলুন, আজকের দিনে আপনি কার পুতুল তৈরি করছেন?’
পুতুলবাবা থমকে গেলেন এই প্রশ্নে; একটু ইতস্তত করে তিনি পালটা প্রশ্ন করলেন অর্ককে, ‘তুমি এখানে ক’দিনের জন্যে এসেছ?’
খানিক সঙ্কোচে পড়ে অর্ক রেকর্ডিং থামিয়ে উত্তর দিল, ‘তিনদিনের প্রোগ্রাম করে এসেছিলাম, মানে তিন রাত্রি চার দিন। হঠাৎ এ-প্রশ্ন কেন?’ তার কণ্ঠে লজ্জা ধরা দিচ্ছে, সে বোধ হয় পুতুলবাবাকে অনভিপ্রেত প্রশ্ন করে ফেলেছে!
কিন্তু তাকে হতভম্ব করে দিয়ে পুতুলবাবা কৌতুক মেশানো গলায় বললেন, ‘তোমার এ-প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এখনই সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তবে আশা রাখি, খুব শিগগিরি তুমি এ-প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।’
এক অদ্ভুত হেঁয়ালি দিয়ে নিজের কথায় যতি টানলেন পুতুলবাবা!
অর্ক বুঝে গেল, উনি নিজে থেকে যতটা বলেছেন, তার চেয়ে বেশী আর জিজ্ঞেস করা উচিৎ হবে না। তাই সে আর কথা বাড়াল না, ঘরের ভিতরে রাখা পুতুলগুলির আরও কিছু ছবি তুলে নিল তার ক্যামেরায়, বিশেষ করে ত্রিকাল ভৈরবের সেই অতুলনীয় মোমের পুতুলটির ছবি।
এদিকে প্রায় পাঁচটা বেজে গেছে, ঝপ করে অন্ধকার নামবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। বৃষ্টিভেজা শীতের কুয়াশাঘন চাদরে চোখের নিমেষে ঢেকে যাবে সমগ্র পার্বত্য উপত্যকা। এই অঞ্চলে ইলেক্ট্রিসিটি রয়েছে ঠিকই, তবে ঘন ঘন লোড-শেডিং হয়। উপরন্তু, কাছেই পূর্ব হিমালয়ের গভীর জঙ্গল, সুতরাং বন্য জীব-জন্তুর ভয়ও রয়েছে! কাজেই, অর্ক দেখল, আর দেরী না করে আজকের মত গেস্ট হাউজে ফিরে যাওয়াই শ্রেয়। কাল আরেকবার আসতে হবে পুতুলবাবার ইন্টারভিউর দ্বিতীয় ধাপ ক্যামেরা-বন্দী করতে, যেখানে তাঁকে নিজ হাতে পুতুল বানাতে দেখা যাবে। সেই সঙ্গে থাকবে তাঁর জঙ্গল-ভ্রমণ ও মধু সংগ্রহ, উল্কা লেকের একটা প্যানোরামিক ভিউ এবং পুতুলবাবার জবানিতে সেই বিশাল হ্রদ ও ত্রিকাল ভৈরবের মন্দিরের ইতিহাস, এছাড়া আরও দু’-একটি পারিপার্শ্বিক দর্শনীয় জায়গার ভিডিওগ্রাফি। এসব তার মাথায় রয়েছে, কালকের দিনটা এগুলোর পিছনেই কেটে যাবে। তার পরদিনই তার ফিরে যাবার পালা।
অর্ক আর কালবিলম্ব না করে তার ক্যামেরা ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে পুতুলবাবাকে আগামীকালের প্রোগ্রামের কিছুটা আভাস দিয়ে তাঁকে বিদায় জানিয়ে গেস্ট হাউজে ফেরার পথ ধরল। বাগান পেরনোর পর সবুজ ঘাসের মোলায়েম গালিচাটায় পা দিতেই সে দেখল, কুয়াশার একটা হালকা আস্তরণ সাদা ধোঁয়ার স্তরের আকারে তার বুকের সমানে নেমে এসেছে! সূর্যাস্তের পর শীতের দাপট আরও কিছুটা বেড়ে গিয়েছে। মেষশাবকগুলি তাদের মা-বাবাদের সাথে বিদায় নিয়েছে, পাখ-পাখালির দল সুরেলা কণ্ঠে ঘরে ফেরার গান ধরে উড়ে চলে যাচ্ছে, আশপাশের গাছগুলোতে কালচে সবুজের ছায়া লেগে গিয়েছে ইতিমধ্যেই, উত্তরের খাড়াই পাহাড়ের মাথা যথারীতি ঘন কুয়াশার আড়ালে লুক্কায়িত। মাথার উপরের সেই রামধনু কোথায় হারিয়ে গেছে, কে জানে!
এসবের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অর্ক একটিবারের জন্য উল্কা লেকের বাঁকের কাছে এসে পিছন ফিরে তাকাল। স্পষ্ট না হলেও দেখে আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না, ঝলমলে পোশাক পরানো মোমের পুতুলগুলির পিছনে লিলির কাঠের বাড়ির বারান্দায় ছায়ামূর্তির মত দাঁড়িয়ে রয়েছেন পুতুলবাবা।
* * *
পরদিন সকালে একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙল অর্কের। বাইরে থেকে যেন কীসের একটা গোলমালের আওয়াজ আসছে!
চটজলদি বিছানা ছেড়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল সে। এরপরই বারান্দা থেকে রাস্তার দৃশ্য দেখে সে ভীষণ অবাক হয়ে গেল।
গ্রামের লোকেরা সব রাস্তায় নেমে এসেছে, একটা হৈ-হৈ ব্যাপার চলছে। সবার মধ্যেই কেমন একটা অস্থির উদ্বিগ্ন ভাব। উড়ো পথে “পুতুলবাবা” কথাটা কানে এল অর্কের। ওরা সকলেই ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে উল্কা লেকের দিকে ছুটছে, আর তাদের পিছনে সাইরেন বাজিয়ে চলেছে একটা অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের জিপ!
গৌতমকে জিজ্ঞেস করে অর্ক যেটা জানতে পারল, তাতে তার বুকটা ফের কালকের মত ধড়াস করে উঠল।
পুতুলবাবা মারা গেছেন!
গৌতম উত্তেজনার বশে হাঁপাতে হাঁপাতে যা বলল, তার সারাংশ করলে দাঁড়ায় এই – পুতুলবাবা উল্কা লেকের পাড়ে মরে পড়ে আছেন, আর তাঁর পাশে ঘাসের উপরই বসানো রয়েছে এক বাঙালী যুবক ও এক চাইনিজ যুবতীর জোড়া মোমের পুতুল! ঐ পুতুলজোড়া যে তাঁরই বানানো, তাতে কোনও সন্দেহ নেই; অনেক পুতুলই তিনি তৈরি করেছেন তাঁর জীবনে, তবে এই জোড়া পুতুল নাকি প্রথমবার।
অর্ক নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারছে না। গতকালই যে মানুষটির ইন্টারভিউ ও ভিডিওগ্রাফি করে এল সে, আজ সকালেই তাঁরই মৃত্যুসংবাদ শুনতে হল তাকে!
প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে সে তার ক্যামেরাটা সঙ্গে করে সকলের পিছে-পিছে তৎক্ষণাৎ ছুটল উল্কা লেকের উদ্দেশ্যে। তার ক্যামেরাতেই তো রেকর্ড করা আছে পুতুলবাবার শেষ সাক্ষাৎকার!
অর্ক যখন উল্কা লেকের পাড়ে পৌঁছল, তখন সেখানে গভীর শোকের ছায়া। কান্নার শব্দে বুক ভার হয়ে যাচ্ছে, চারিদিকের পরিমণ্ডলে একটা দুঃখ-মিশ্রিত মর্মাহত স্তব্ধতা জড়িয়ে! বোঝা যাচ্ছে, এ-গ্রামে পুতুলবাবার অভিভাবক হিসেবে মান্যতা কতখানি।
সে দেখল, পুতুলবাবার মরদেহকে স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে, আর পুলিশের এক কর্তা উপস্থিত সকলের বয়ান নিচ্ছেন। সকলের আচরণে স্পষ্ট, যেন এখানকার মানুষ পিতৃহারা হয়েছে!
ওদিকে, উল্কা লেকের বাঁধানো ঢালু পাড়েই রাখা আছে সেই জোড়া মোমের পুতুল – এক সৌম্যদর্শন দীর্ঘাঙ্গ বাঙালী যুবকের কাঁধে মাথা রেখে করুণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে এক চাইনিজ রূপসী!
অর্ক নিশ্চিত, ঐ যুবকই হলেন সাম্যময় সরকার তথা পুতুলবাবা, এবং ঐ চাইনিজ রূপসীই হলেন তাঁর প্রেমিকা লিলি। এই যুগ্ম পুতুল-সমন্বয় বানানোর কাজই করছিলেন তিনি, এবং এই জোড়া পুতুল নির্মীয়মাণ অবস্থায় তাঁর ঘরের সেই কালো পর্দার আড়ালে রাখা ছিল।
গতকাল পুতুলবাবার কারুশিল্পে সে এতটাই অভিভূত হয়ে গিয়েছিল যে, সকল ধরণের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেও অন্যতম প্রধান প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার কথা খেয়ালই ছিল না তার – এত পুতুলের মধ্যে তাঁর মৃত প্রেমিকা লিলির পুতুল কোনটি! পুতুলবাবার কথায় ছিল ‘লিলির পরিবারের মানুষদের পুতুল’, তিনি দেখিয়েওছেন সেগুলোই; অর্ক দেখেওছে, কিন্তু তাঁকে জিজ্ঞেসও করেনি, লিলির পুতুল কোথায়! নিজের পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতার উপর তার যে অহমিকা-বোধ ছিল, তা মুহূর্তে চুরমার হয়ে গেল এই প্রেক্ষাপটে।
অর্ক আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে সটান গিয়ে হাজির হল সেই পুলিশকর্তার কাছে। নিজের পরিচয় দিয়ে পুতুলবাবাকে নিয়ে গতকালের ঘটনা ও অভিজ্ঞতার কথা সবিস্তারে জানাল তাঁকে; সবশেষে তার ক্যামেরায় রেকর্ড করা পুতুলবাবার সাক্ষাৎকারের কিছু অংশও দেখাল, বিশেষতঃ শেষের অংশটুকু, যেখানে পুতুলবাবার ঘরে কালো পর্দার আড়ালে তাঁর বয়ান অনুযায়ী তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি নির্মীয়মাণ ছিল।
নিঃসন্দেহে, এই জোড়া পুতুলই পুতুলবাবার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি!
গ্রামের লোকেরাও সব দেখল ও শুনল। সবাই অর্কের অভিমতে সায় দিল – এই পুতুলদু’টোর মধ্যে যুবকটি হল পুতুলবাবার যৌবনকালের পুতুল, এবং ঐ যুবতীটি হল তাঁর চাইনিজ প্রেমিকা লিলির পুতুল। শেষমেশ সেই পুলিশকর্তা তাকে তার ক্যামেরার ঐ রেকর্ডিংটা নিয়ে বিন্দুগুড়ির আউটপোস্টে আসতে অনুরোধ করলেন। স্বাভাবিক মৃত্যুতে পুলিশ-কেস্ না হলেও অর্কর ক্যামেরা-বন্দী পুতুলবাবার সাক্ষাৎকার এখন এই পুরো অঞ্চলের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য নথি! অর্কও তার পরিকল্পনার কথা সকলকে জানাল, সে এটা নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বানাতে চায়।
পুতুলগাঁয়ের লোকেরা অর্কের ঐ পরিকল্পনার কথা জেনে ভীষণ আনন্দিত – তাদের প্রিয় পুতুলবাবার অসামান্য প্রতিভার পরিচয় এবার সারা পৃথিবী পাবে! যদিও এই আনন্দের আড়ালে এক চাপা দুঃখও তাদের হাবে-ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে তাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় অভিভাবকের এমন আকস্মিক মৃত্যুতে।
অবশেষে বিন্দুগুড়ির সেই পুলিশকর্তা তাদেরকে আশ্বস্ত করে বললেন, তিনি এই জেলার জেলাশাসককে অনুরোধ করবেন যাতে পুতুলবাবার হাতে বানানো মোমের পুতুলগুলিকে জেলার যাদুঘরে কিংবা কলকাতার মাদার্স্ ওয়াক্স মিউজ়িয়ামে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে স্থাপন করা হয়। তাঁর মতেও, এমন প্রতিভা বঙ্গদেশে তো বটেই, এই ভূ-ভারতেই অতি বিরল, বিশেষত পুতুল গড়ার কাঁচামাল ও পদ্ধতিগত দিক বিচার করলে তো অবশ্যই!
আগামীকাল অর্কর ফিরে যাবার পালা। তাই সে আজ রোদ-ঝলমলে আবহাওয়ায় পুতুলগাঁ ও তার বাসিন্দারা, আশপাশের নিসর্গ প্রকৃতি, উল্কা লেক, দেবীঝোরা, ত্রিকাল ভৈরবের মন্দির – সবকিছু ক্যামেরায় তুলে নিল। স্থানীয় কয়েকজনের সাহায্যে দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়া ধ্বংস-প্রায় এস্. এম্. সরকার অ্যান্ড সনস্-এর সেই কাঠের মিলেরও ছবি তুলে নিল অর্ক। পুতুলবাবার কাঠের বাড়ি ও বাগান, যা একসময় তাঁর প্রেমিকা লিলি ও তার পরিবারের বাসস্থান ছিল, অর্কের ক্যামেরা-বন্দী হল আরেকবার। কাল এখান থেকে যাওয়ার আগে বিন্দুগুড়িতে পুলিশ আউটপোস্টে সেই পুলিশকর্তার সাথে দেখা করে তাঁকে তার ক্যামেরায় রেকর্ড করা পুতুলবাবার ইন্টারভিউ ও ভিডিওগ্রাফির একটি প্রতিলিপি দিয়ে যাবে সে।
সবশেষে বিকেলবেলায় অর্ক দেবীঝোরার পশ্চিম পাড়ের চা-বাগানের সামনে এসে দাঁড়াল। বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ঢেউখেলানো চা-বাগান, যেন মনে হয়, অনেকে মিলে একটা বিশাল গাঢ় সবুজ চাদরের প্রান্তগুলি চারপাশ থেকে টেনে ধরে রেখেছে! মাঝে মধ্যে একটা-দু’টো করে ছোট ঝাঁকড়া গাছ, অনেকটা জায়গা জুড়ে জল ছেটানোর জন্য স্প্রিংক্লার সিস্টেম, বুক চিরে বিভিন্ন দিকে বেরিয়ে যাওয়া পথের চিহ্ন – খুব চেনা-জানা চা-বাগানের ছবি অর্কের চোখে ধরা দিল।
সেই ফ্রেমেই দেখা গেল চা-বাগানের মধ্যিখানে একে-অপরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ভিন্ন দেশীয় যুবক-যুবতীর যুগ্ম-প্রণয়। যুগের পর যুগ একে-অপরকে ভালবেসে একে-অপরের জন্য ত্যাগস্বীকার করে আজও সেই একই চিরন্তন অনুভূতি নিয়ে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে – যেন কোনোদিন ছাড়াছাড়ি হয়েনি! প্রিয়তমার মৃত্যুর পর তার স্মৃতিতে প্রিয়জন ও অনুগামীদের মোমের পুতুল বানিয়ে গেছেন সারাজীবন; এরই আড়ালে সেই প্রিয়তমার দুঃখ-জর্জরিত মর্মর পুতুলকে নিজের পুতুলের কাঁধের আশ্রয়ও দিয়ে গেছেন শেষবেলায়।
অর্ক গেস্ট হাউজের পথে পা বাড়ানোর ঠিক আগের মুহূর্তে আরও একবার ফিরে তাকাল সেই চা-বাগানের দিকে, ক্যামেরার লেন্স দিয়ে আবার দেখল ঐ একই ফ্রেম, স্বাগত জানাল মোমের পুতুলের মধ্যে অমর হয়ে যাওয়া পুতুলগাঁয়ের ইতিকথাকে।
আজ আকাশে একফোঁটাও মেঘ নেই। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে; পড়ন্ত বিকেলে সেই সূর্যের রক্তিম আভা যেন পুতুলবাবার কাহিনীই সদর্পে বিশ্বচরাচরের কণায় কণায় মিশিয়ে দিয়ে যাচ্ছে – যাবার আগে।