তন্ময়| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | ফরহিন ইসরাত মেহেরীন| Bengali Detective Story
0 (0)

“এই প্রাপ্তি! তোর ভাইকে একটা ফোন দে তো।”

মা, কতবার দিলাম কিন্তু তোমার ছেলে তো ফোন ধরছে না!

এই নিয়ে মা আর আমি বিকাল থেকে কয়েক হাজার বার ফোন দিলাম। রিং যাচ্ছে, ফোন উঠাচ্ছে না।

‘ কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ কত বার যে এই কথা শুনলাম।

সকালে এই যে ছেলেটা গেল আর খবর নাই, এই সুরূজ!

জি, খালাআম্মা?

আমার ভাই তন্ময়, আমার মায়ের চোখের মণি। ডানপিটে, যখন যা করতে ইচ্ছা হয় তাই করে। সকালে হাঁটতে বের হয়েছিল, আর এখন রাত ৮টা। মা কিছুক্ষণ পর পর আমাকে একবার বলেন ফোন দিতে, অন্যদিকে আমাদের বাড়ির দারোয়ানকে এদিক ওদিক খুঁজতে পাঠান।

সবখানেই গিয়া খবর লইছি খালা সকালে যে পার্কে হাঁটতে যায় হের পর বাবু মিঞার চায়ের দোকানে বসে পরে আবার বিকালে ৫ নাম্বার মাঠে ক্রিকেট খেলে

তোকে না বললাম তরূর বন্ধুদের বাসায় যেতে

এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই ভাইয়ার বন্ধুরা সব হাজির।

আন্টি! ও আন্টি!

প্রাপ্তি! যা‌ দরজাটা খুলে দে তো মা মনে হয় আমার তরূ এসেছে।”

কিরে প্রাপ্তি, তন্ময় নাকি এখনো বাসায় ফিরেনি?

দরজা খুলতেই আদনান ভাইয়ের প্রশ্ন। আমাদের পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় পার্থ আর সিয়াম ভাইয়া।

আন্টি, শুনলাম তন্ময় বাসায় ফিরেনি এখনো!

হ্যা, বাবা সকালে হাঁটতে যাচ্ছে বলে বের হয় বলে দুপুরে খাবার বাইরে খাবে, সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে আসবে তোমাদের সাথে দেখা হয়েছিল কি তন্ময়ের?

না, আমি আর আদনান ছিলাম খুলনা আজ বিকালে এসেছি আমার চা খাচ্ছি বাবুর দোকানে, দেখি আপনাদের দারোয়ান তন্ময়কে খোঁজাখুঁজি করছে আপনি কি সব আত্মীয়স্বজনদের কাছে খোঁজ করেছেন?

এমন সময় আমার ছোট মামা আর মামী চলে আসে। তাদের দেখে মা ছুটে যায়।

ভাইজান! আমার তন্ময়কে তো খুঁজে পাচ্ছি না

এত দেরি হয়ে গেল, ছেলেটা বাসায় ফিরে না! তোকে না ফোন করে বললাম সিকদার সাহেবের সাথে কথা বলতে

হ্যাঁ শোন, তোর মা আর আমি তোর ফুপ্পির বাসায় বাসার চাবি তোর মা মিলনের মায়ের কাছে রেখে এসেছে

ভাবী, তোমার সাথে শুভকে নিয়ে আসা উচিত ছিল

মায়ের প্রশ্ন শুনে মামী ফিরে তাকান।

না, থাক ওর আবার পরীক্ষা, পাশের বাড়ির ছেলেদের সাথে একসাথে পড়বে

মামা এবার ভাইয়ের নাম্বার এ ফোন করে,

কিরে! ফোন তো এখন বন্ধ বলছে

মা এবার ভয় পেয়ে যান। কি করবেন বুঝতে পারছে না।

আমরা সিকদার সাহেবের জন্য অপেক্ষা করলে দেরি হয়ে যাবে তুমি আপাকে নিয়ে এখনই থানায় যাও

মা, আমিও তোমার সাথে যাব

তুই সাথে গিয়ে কী করবি? আমি আর তোর মা যাচ্ছি তো তুই তোর মামীর সাথে বাসায় থাক

না, ভাইজান ওকে সাথে নিয়ে যাব, ভাবী আমাদের বেশি সময় লাগবে না

হ্যাঁ, আমি আছি তোমরা যাও খবর পেলে আমাকে ফোন দিও

এই, চল আমরা গাড়ি নিয়ে আসি

ভাইয়ার বন্ধুদের পেছনে মামাও বের হয়ে গেলেন।

থানার ঘড়িতে তখন রাত ১০.৪৭। দূরের মহাসড়ক থেকে গাড়ির শব্দ ভেসে আসছে। পুলিশ স্টেশনে তেমন কেউ নেই। মামার ফোন বেজে উঠল। মামা বেরিয়ে গেলেন কথা বলতে।

কে ভাইজান?

তোর ভাবী কতদূর আমরা পৌঁছেছি জানার জন্য ফোন দিল

একজন মধ্যবয়সী পুলিশ বসে আছে। কাঁধে দুটো উল্টো তীর। মনে হয় হেড কনস্টেবল বা নায়ক।

মা আর মামা সামনে যেতেই বসার ইঙ্গিত করেন।

আমার ছেলেটা এখনও ফিরে-”

মায়ের কথার মাঝেই তিনি মাকে থামিয়ে দেন।

মামুন!”

সামনের টেবিলে মাথা নিচু করে একজন বসে কিছু একটা পড়ছেন, ডাক পেয়ে মাথা উঠিয়ে উওর দিলেন।

স্যার?

আমার টেবিলে একটা চা দিয়ে যা তো

উনি ফিরে আমাদের দিকে তাকাতেই মামা হাত নেড়ে বুঝিয়ে দেন লাগবে না।

হ্যা, তো কি সমস্যা আপনাদের?

মামা একটু বিরক্ত হয়ে বলেন,

বললাম তো, আমাদের ছেলেটা এখনও বাসায় ফিরেনি, ফোন ও বন্ধ

ছেলেটা তো ছোট খোকা না যে, রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে আর ফিরতে পারছে না

পাশে রাখা বুটভাজা মুখে দিয়ে বললেন,

কাউকে হয়ত পছন্দ করে, আপনারা‌ মেনে নেন নাই তাই, নিয়ে পালিয়ে গেছে এখানে পুলিশ কি করবে ফ্যামিলি ম্যাটার

এটা কী বলছেন আপনি!?”

মাকে হঠাৎ এভাবে উত্তেজিত হতে দেখে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে যাই।

কথা কাটাকাটি হতে থাকে। একজন নিজের ইচ্ছায় চলে গেলে পুলিশের কিছু করার নেই, এ কথা উনি যতই বলছেন। মা এসব শুনতে রাজি না। মামা চুপ করে বসে আছেন। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না।

আমাদের কথা শুনে একজন ভেতরের ঘর থেকে বের হয়ে আসে।

কী সমস্যা, জামাল?

হেড কনস্টেবল জামাল উদ্দিন বসা থেকে লাফিয়ে ওঠেন,

স্যার, এদের ছেলে সকালে বের হয়ে আর বাসায় ফেরেনি তাই, বলছিলাম এখন একটা সাধারণ ডাইরি করেন

পরের কথা গুলো একটু গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন,

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে স্যার, রক্ত গরম প্রেমের কারণে হতে পারে, আবার পরিবার নিজেরাই কিছু করতে পারে

গলা নামিয়ে বললেন কিন্তু সব শুনতে পাচ্ছিলাম। পাশে থাকা এএসআই একমনে ফোন দেখছেন। এদিকে কোন খেয়াল নেই।

আমাদের দিকে ফিরে কনস্টেবল জোর গলায় বললেন,

বলছিলাম কী সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখুন আমরা তো আপনাদের জন্যই

হঠাৎ জোরে বলায় এএসআই মাথা তুলে একবার আমাদের দেখলেন। আবার ফোনে মনোযোগ দিয়ে বললেন,

হু ঠিক আছে, তুমি লিখে নাও সকালে স্যার আসলে দেখা যাবে

এই বলে তিনি বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, হাতে চা নিয়ে এমন সময় ঢুকছিল কনস্টেবল মামুন। চা উঁচিয়ে স্যালুট করলো।

স্যার, এই যে আপনার চা

এদেরকে দে, মাথা ঠান্ডা করুক

লিখতে লিখতে একচোখা ভাবে তাকিয়ে যেন ব্যঙ্গ করে বললেন কথাটা।

সাধারণ ডাইরির কপি হাতে নিয়ে মামা দাঁড়িয়ে যান। কলমের মাথায় ক্যাপ লাগিয়ে, একবার আমাদের দিকে তাকালেন, বসে থাকা মাঝবয়সী জামাল সাহেব কিন্তু কিছু বললেন না।

আমরা বের হয়ে মহাসড়ক এর উপরে এসে দাঁড়িয়েছি। বড় ট্রাক, লরি ছাড়া আর কোন গাড়ি নেই। রাত প্রায় একটার সময় বাসায় ফিরলাম। গেটের সামনে নামতে দারোয়ান সুরূজ দৌড়ে আসে। বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে। মামা তাকে থামিয়ে দিলেন। ভাইয়ার বন্ধুরা এখনো এখানেই, মামী এসে মাকে ধরে রুমে নিয়ে যান।

আমরা তাহলে কাল সকালে আসবো

ঠিক আছে, তোরা যা

এই বলে ভাইয়ার বন্ধুরা সব চলে গেল।

মামী খাওয়ার জন্য ডাকছিলেন কিন্তু আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি ঘুমিয়ে পরলাম। এখন শুধু সকালের প্রতীক্ষা। উদ্ভট সব খেয়ালে সারারাত এপাশ ওপাশ করলাম। না, ঘুম আসছে না। নিশ্চয়ই মায়েরও একই অবস্থা। শেষ রাতে ঘুম এলো। সকালে উঠেই সোজা মায়ের ঘরে গেলাম। দেয়ালে পিঠ ঠেস দিয়ে বসে আছে মা। মামী প্রেসার মাপছেন। মামা পাশে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে মায়ের ফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি মায়ের পায়ের কাছে বসলাম। মা চোখ খুলে আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। আমি বুঝতে পারলাম কিছু একটা হয়েছে কিন্তু কোন চিন্তা মাথায় আনতে চাইছিলাম না। মামী এমন সময় উঠে রুমের দরজা লাগিয়ে দেন। মাকে জিজ্ঞেস না করে আমি মায়ের মোবাইল ফোনটা মামার কাছ থেকে নিলাম। অন করতেই স্ক্রীনে একটা খুদেবার্তা ভেসে ওঠে।

‘ Kidnapped, Yesterday 3.56 AM’।

আপা, তোমার প্রেসার অনেক! নাও, ঔষধ নিয়ে নাও

ভাইজান, আমার তন্ময়!

চিন্তা করিস না, আমি সিকদার সাহেবকে জানিয়েছি, কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে

মামা, এই সিকদার সাহেবটা কে?

আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মামা সুযোগ পেলেন না। আমার হাতে থাকা মায়ের ফোনটা বেজে হঠাৎ উঠলো। মা তড়িঘড়ি ‌করে মামীকে টপকিয়ে আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলেন।

তন্ময়! বাবা, তুই কই? এভাবে না বলে চলে গেলি! তোকে খুঁজতে খুঁজতে আমার কি অবস্থা জানিস?

মা একই সাথে কাঁদছেন আবার ধমকাচ্ছেন। কথা বলতে বলতে মা থেমে যান। মামা ফোন নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। স্পিকারে দিলেন।

এভাবে যে না বলে চলে গেলি, তোর মার কি অবস্থা জানিস?

বিপরীত পাশ থেকে ভারী কন্ঠস্বর ভেসে এলো।

তন্ময়ের অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন না?

কে! কে কথা বলছে? তন্ময় কোথায়?

তন্ময় এখন ঘুমাচ্ছে, আমার কথা না শুনলে এই ঘুমই ওর শেষ ঘুম হবে

আমার ছেলে! আমার তন্ময় কোথায়তুমি কে?

ওহ!‌ শিউলি মেডাম আমার পরিচয় জানতে চাচ্ছেন? আমার পরিচয় তো এখন আপনার হাতে

কী! কী বলতে চাও?

আমার কথা মত কাজ করলে আমি জিব্রাইল আর না শুনলে আজরাইল পুলিশের কাছে যেতে হবে না কোন রকম চালাকি করলে এর অনেক উচ্চমূল্যে শোধ করতে হবে

কত? কত চাও?

সব বলব পুলিশেকে কিছু না বললেই হবে

সবাই যেন নিজ নিজ অবস্থানে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দরজায় টোকা পড়তে সবাই নড়ে উঠলো। মা ধপ করে বসে পড়েন। মামা দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে পড়েন। মামী না ডাকলে হয়ত এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতাম।

কি বলছি, এই প্রাপ্তী! তোর মার প্রেসারের ঔষধ নিয়ে আয়, জলদি যা!

ঔষধ নিয়ে বের হয়ে দেখলাম একজন নীল পাঞ্জাবী পরা লোক, আমার দিকে পিঠ করে বসে আছেন। মামা তার সাথে হাত নেড়ে কথা বলছে আর সেই ভদ্রলোক ঘন ঘন মাথা ঝাঁকাচ্ছেন। আমি ঔষধ নিয়ে ফিরে এলাম। বিকালে বাসায় পুলিশ এলো।

প্রাপ্তি,‌ তোর ভাই কোথায় হাঁটতে বের হয়? আমাদের নিয়ে যেতে পারবি?”

মামা, আমি আর তিনজন পুলিশ ‌পার্কের কাছে চলে আসলাম। দুইজন কনস্টেবলকে দুইদিকে পাঠিয়ে, আমাদের দিকে ফিরলেন এসআই তালুকদার, বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকেন।

কতক্ষন হাঁটে পার্কে?”

প্রশ্নটা আমার জন্য ছিল।

একঘন্টা প্রায় পার্কে দুএকটা রাউন্ড দিয়ে বাবু মিঞার চায়ের দোকানে বসে

আপনারা এখন বাসায় যান আমরা দেখছি

দুই দিন ধরে খোঁজ করা হল কিন্তু আর কোন ফোন এলো না। মা’র শরীর আরো খারাপ এর দিকে যাচ্ছে, হাসপাতালে যেতে রাজী না হওয়ায় বাসায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মা উঠতে পারছে না, তাই মামা আর আমাকে থানায় যেতে হবে।

স্যার এখনও আসেননি, বসেন

আমরা বসলাম এবং প্রায় একঘন্টা পর ইন্সপেক্টর আসলেন।

অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন। কারও সাথে শত্রুতা আছে কি না? কাউকে সন্দেহ হয়? কে করতে পারে? ইত্যাদি।

ইন্সপেক্টর আবদুল বারীর একটা কথায় আমরা অবাক হলাম।

কাউকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে, এখন বাসা থেকে টাকা দরকার, তাই এই অপহরণ এমন কি হতে পারে না?”

স্যার, আপনারা আগেই কেন এসব বলছেন, ছেলেটার তিনদিন ধরে কোন খোঁজখবর নাই

এই কারণেই বলছি যে প্রথম দিনের একটা ফোন কল ছাড়া আর কোন কল আসেনি

আমরা বাসায় ফিরে এলাম। আমাদের সাথে সবসময় থাকবে এমন একজনকে সাথে দিয়েছেন সিকদার সাহেব। আমি মামা থেকে জানতে পারলাম উনি কোন একসময় সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন এখন অবসরে আছেন।

কিরে আবার কি কোন ফোন এসেছে?”

মামা জিজ্ঞাস করলেন।

মতিন মিয়া, সিকদার সাহেবের পরিচিত। তিনি কলটা রেকর্ড করে ফেলেছেন।

এত সুন্দর করে বলার পরও, শিউলি ম্যাডাম আপনি পুলিশের কাছেই গেলেন যদিও পুলিশ কিছু করতে পারবে না এখন কাজের কথায় আসি, আপনার ছেলে আমাদের কাছে নিশ্চয়ই ভুলে যাননি

কি চাও তোমরা? বল, সব দিয়ে দিব! আমার ছেলেকে আমাকে ফিরিয়ে দাও

মা’র আকুতিতে ওপর পাশের জন কথা থামিয়ে আবার বলা শুরু করলো।

চাই তো শুধু টাকা

কত? কত লাগবে?”

চল্লিশ লক্ষ, সব হাজার এর নোটে হতে হবে

চল্লিশ লক্ষ টাকা?”

ম্যাডাম, আমি জানি এই বছরের প্রথমে আপনি আপনার জমি বিক্রি করেছেন আশি লক্ষ টাকায়, আমি তো শুধু অর্ধেক চাই খুব সস্তা

কিন্তু এ টাকা তো ওদের লেখাপড়ার খরচের জন্য

জীবন থাকলে জগত, জীবনের মায়া আছে? আগে জীবন বাচানোর চিন্তা করেন

আমার ছেলেকে কখন পাব?”

আমার হাতে টাকা আসবে, আপনার ছেলে আপনার কাছে পৌঁছে যাবে কোথায় কখন দিতে হবে জানিয়ে দেব একটা বিষয় লক্ষ্য রাখবেন, পুলিশ যেন সাথে না আসে

সন্ধ্যায় পুলিশ আর সিকদার সাহেব এলেন। সবাই মাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে যে, অপহরণকারীরা এভাবে ভয় দেখায়। টাকা নিয়ে যদি ওরা তন্ময়কে ফিরিয়ে না দেয়!

সব কিছু শুনে সিকদার সাহেব বলেন,

ঠিক আছে, আমি যাব আমি পুলিশের লোক না

মামা আর ইন্সপেক্টর একসাথে কিছু বলতে গেলে সিকদার সাহেব তাদের থামিয়ে দেন।

এক সপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে, ছেলেটার খোঁজ নেই আপার কথায় যুক্তি আছে, এখানে কোন প্রকার ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই

এই কাজ পুলিশের

একটু শক্ত করে কথাটা বললেন ইন্সপেক্টর।

প্রথম তিনদিন তো আপনাদের বিশ্বাসই হয়নি যে এটা অপহরণ যে দুইবার ফোন এল, ফোন কোথা থেকে কিভাবে এল এবং কখন এল কিছুই তো করলেন না

যখন নিজেরাই এত বুঝেন তো নিজেরাই করেন আমাদের তো আপনাদের দরকার নেই এই চল

ইন্সপেক্টর তার টিম নিয়ে চলে গেলেন।

হ্যাঁ ভূঁইয়া সাহেব, আপনি কিছু বলছিলেন

মামার দিকে ফিরে বললেন।

না মানে, পুলিশ থাকলে একটা সাহস থাকে আমার পরিচিত লোক আছে তো, তাই বলছিলাম

এখন পরিচিত লোক না, বিশ্বস্ত লোকের দরকার

আপা, আপনার ব্যাংকে হবে কী চল্লিশ লক্ষ?”

মা জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন, মুখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করেন,

ওরা কি করে জানল আমি জমি বিক্রি করেছি?”

বলছে যখন টাকা চায় সব খবর নিয়েই তন্ময়কে অপহরণ করেছে

মামা-মামী দুপুরে তাদের বাড়ি গেলেন। প্রথম দিন থেকেই আমাদের সাথে ছিলেন। মামা রাতে আবার আসবেন। মামী হয়ত শুভকে কাল পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাবেন। মা চেক লিখে দিলেন। মা যেতে পারছেন না, আমাকে একাও দিতে সাহস পাচ্ছেন না। তাই, সিকদার সাহেব সাথে চললেন। আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ক্যাশ কাউন্টার এ দাঁড়ালাম। উনি পান খাবেন বলে নিচে গেলেন। বাসায় ফিরার পথে সিকদার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আমার কাউকে সন্দেহ হয় কি না? বললাম সন্দেহ হয় না কাউকে।

কাউকে যখন সন্দেহ হয় না, তখন সন্দেহ সবাইকে হয়

জি বুঝলাম না।”

উওর দিলেন না, শুধু হাসলেন।

আমরা টাকা গুনে গুছাতে লাগলাম‌। এমন সময় মামা এলেন।

আর কি কোনো ফোন এসেছিল? টাকা কম পড়েনি তো?”

মা ইশারায় উওর করলেন। এই এক সপ্তাহে মা শারীরিক-মানসিকভাবে একদম ভেঙ্গে পড়েছেন।

আর কিছু দিন ধৈর্য ধর, টাকা হাতে পেলেই তন্ময়কে ফিরিয়ে দিবে

মামার কথা আদৌ কি মা শুনতে পেয়েছেন, মনে হয় না।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি সাদা পাঞ্জাবি পরা সিকদার সাহেব কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত। এ তো টাকার ব্যাগ, এর মানে আবার ফোন এসেছিল? উনার হাতের ফোনটা বেজে উঠলো।

হ্যা, আমি প্রস্তুত, বল কোথায় আসতে হবে?”

বাসস্টপে এসে বাসে উঠেন, পরেরটা পরে বলছি

আমার ভয় লাগছে, আজ তবে কি ভাই বাসায় ফিরবে?

আমি তাহলে বের হলাম

ভাই, আমার তন্ময়কে সহি সালামত আমার কাছে নিয়ে আসবেন

আপা চিন্তার কোন কারণ নেই, আজ তন্ময় ইনসা্আল্লাহ বাসায় ফিরবে আল্লাহ ভরসা

মামা পেছন পেছন বের হতে গেলে সিকদার সাহেব বাধা দেন

আপনি এখানেই থাকেন, এদের সাথেও কারো থাকা প্রয়োজন

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে লাগলাম। আবার মনে হয় কল এসেছে, কিন্তু উনি কয়েক সেকেন্ড কথা বলে কেটে দেন। মামা পিছনে হাত দিয়ে পায়চারি করছেন।

আমি গেলেই কিন্তু ভালো হত, সিকদার সাহেব আবার ওদের সাথে চালাকি করতে গিয়ে ধরা পড়েন কিনা

ভাইজান, এভাবে বল না! আল্লাহ না করুক আজ আমার তন্ময় বাসায় ফিরবে

ঘড়ির কাঁটা যেন নড়ছে না। সময় যেন থমকে আছে। মামার ফোন হঠাৎ বেজে উঠায় আমরা সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। মামা ফোন ধরে হাত নাড়িয়ে বললেন,

তোর ভাবীর কল তোরা বস

ফোন নিয়ে মামা বারান্দায় গেলেন। বিকাল এখন পাঁচটা বেজে তেইশ মিনিট। কতবার যে ঘড়ির দিকে তাকালাম হিসেব নেই।

নাহ, এভাবে বসে থাকা যায় না আমি আবার তবে থানায় যাই সেই সকাল সাতটা, সাড়ে সাতটায় বের হলেন আর কোন খবর নাই

মামা বলতে বলতে দরজার দিকে এগোতে লাগলেন। আমি আর মা পিছনে পিছনে গেলাম। দরজা খুলতেই পুলিশ এর কনস্টেবল মামুন।

আপনাদের এখন থানায় যেতে হবে

কী? আমার ছেলের কোন খবর? ওকে কি থানায় নিয়ে আসা হয়েছে?

সব কথা আমাদের স্যার বলবেন

পুলিশের গাড়িতে উঠে মামা জিজ্ঞেস করলেন,

আর আমাদের ঐ সিকদার সাহেব? উনি তো সকালে টাকা নিয়ে গেলান উনি কই?”

কোন উওর না দিয়ে কনস্টেবল মামুন চালককে যাওয়ার ইশারা করেন। থানায় পৌঁছে দেখি সিকদার সাহেব বসে আছেন। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন, পাঞ্জাবি ঠিক করলেন।

চলেন, তন্ময়কে নিয়ে আসি

কিছু বুঝতে না পেরে মা আর আমি একে অপরের দিকে তাকাচ্ছি। পেছন থেকে এগিয়ে আসলেন এই থানার ইন্সপেক্টর।

হাসপাতালে নিয়ে যাও উনাকে

হাসপাতালে কেন? তন্ময়ের কিছু হয়েছে? কেউ তো কিছু বল

সিকদার সাহেব মাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।

না, আপা ওর কিছু হয়নি আমাদের বলেনি হাসপাতালে যেতে

আপনি এখানে থাকেন আমরা আসছি

সিকদার সাহেবের কথা শুনে মামা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।

পুলিশের গাড়িতে আবার উঠলাম। দেখতে পেলাম মামা বের হয়েছেন থানা থেকে। কিছু সময় পর গাড়ি থামল। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। আশেপাশে অনেক অন্ধকার, রাত হয়ে গেছে। সামনে একটা পাঁচ তলা বাড়ি।

স্যার, এই দিকে

আমাদের পেছন থেকে শব্দ এলো। ফিরে তাকাতে তিনটা ছায়ামূর্তি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। দুইজন পুলিশ একজনকে সাথে নিয়ে এগিয়ে আসছে।

তন্ময়!”

মা দৌড়ে ছুটে গেলেন। আমিও পেছন পেছন গেলাম। গাড়িতে উঠানো হল। ধীরে ধীরে রাস্তায় লাইট জ্বলতে শুরু করলো। এলাকাটা অনেক পরিচিত লাগছে।

গাড়ি আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। ভাইয়ার বন্ধুরা দৌড়ে এল।

সবাই মিলে ধরাধরি করে তন্ময়কে গাড়ি থেকে নামিয়ে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল। ভাইয়ার এক বন্ধু  ডাক্তারকে কল দিল। ডাক্তার এসে তন্ময়কে ভাল করে পরীক্ষা করে বললেন,

চিন্তার কোন কারণ নেই, সুস্থ আছে হ্যাঁ, ঘুমের ঔষধের ডোজ বেশি তাই, একদুই দিন একটু ঘুম হবে

ভাইয়ার এক বন্ধু ডাক্তারকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল।

মা বসার ঘরে এসে সিকদার সাহেবের মুখোমুখি বসলেন।

আমার জানার কোন ইচ্ছা নেই কে, কেন আর কিভাবে এসব করেছে টাকা আমার ফেরত লাগবে না আমার ছেলেকে পেয়েছি যথেষ্ট

আজ যদি আপনার ছেলের কিছু হত, তাহলেও কি আপনি তাই বলতেন?”

আপনি অনেক সাহায্য করেছেন আজ আর নয় তন্ময় আরাম করুক

আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও পুরো ঘটনাটা জানতে চাচ্ছি

সিকদার সাহেব আর ইন্সপেক্টর দাঁড়িয়ে পড়েন।

থামুন

ভাইয়ার দুই বন্ধু ধরে নিয়ে আসছে ভাইয়াকে। আমরা আবার সবাই বসলাম।

মা, আর লুকিয়ে লাভ নেই আজ সিকদার সাহেব সময় মত না এলে তুমি যাদের বাচাতে চাচ্ছো তারা তোমার ছেলের হত্যাকারী হত কথায় আছে, ঘরের শত্রু বিভীষণ

আজ মাহবুবুর আলম তন্ময় অপহরণ ঘটনার ছয় মাস হতে চলল। মা আমাকে কিংবা ভাইয়াকে কোন জবানবন্দি দিতে দেননি। কেস উঠিয়ে নিয়েছেন অনেক আগে। মা’র কথা হল, কিভাবে তিনি নিজের আপন ভাই, ভাবী আর ভাইয়ের ছেলেদের জেলে পাঠাতে পারেন? হ্যা, আমার মামা, মামী আর মামাতো ভাইরা এই ঘটনায় জড়িত।

ভাই যেদিন হাঁটতে বের হয়, সকালে মামার সাথে দেখা হয়। মামার সাথে দেখা হলে দু’জন একসাথে নাস্তা করে। ফেরার পথে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কেউ। ভাইয়ের মতে তিনবার জায়গা বদলি করেছিল অপহরণকারীরা। কিন্তু সিকদার সাহেব বলেন, মামার ভাড়ার ঘরে এক রুম থেকে অন্য রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল শুধু। মা কিংবা আমি কখনো কন্ঠ চিনতে পারিনি কারণ ফোন করানো হয় মামীর ভাইকে দিয়ে। আমরা যখন ভাইকে খুঁজছিলাম। আমরা মামার বাড়ি ছাড়া সব জায়গায় খুঁজেছি। ভাইয়ার অপহরণের দিন মামা সিকদার সাহেবকে সাহায্য করতে বলবেন এমন বললেও কখনও তার কাছে যাননি। ভাইয়ার বন্ধুদের কাছে অপহরণের কথা শুনে তিনি আসেন। ভাইয়ার বন্ধুদের মাধ্যমে সিকদার সাহেব মামার উপর নজরদারি রাখতেন। অপহরণকারীরা সবসময় আমাদের সব খবর আর পরিকল্পনা আগে জানতে পারত। কারণ, মামা অথবা মামী সবসময় আমাদের সাথে ছিল। মামার ধরা পরার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ একটা কল। যখন ঠিক হল যে টাকা নিয়ে সিকদার সাহেব যাবেন, মামা ভয় পেয়ে যান। মামা বারবার মাকে টাকা দিয়ে দিতে উৎসাহিত করতেন। তাই, মামার যাওয়ার কথা ছিল। তিনি ভুলবশত সেই অপহরণ এ ব্যবহার করা নাম্বারে কল করে ফেলেন। মামী যেদিন ছেলের পরীক্ষা বলে বাসায় চলে যান। উনি মূলত এই ঘটনায় মাস্টার প্ল্যানার, তার বড় ছেলে হাশেমের সাথে দেখা করতে যান। একবছর ধরে কিশোর সংশোধনাগারে আছে। ক্রিকেট নিয়ে ঝগড়া হলে বিপক্ষের খেলোয়াড়কে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেয়। মামা বিভিন্ন সময় ‘তোর ভাবীর ফোন’ বললেও সে শুভর সাথে কথা বলতেন। ভাইয়ের নজরদারির জন্য সাথে ছিল শুভ। তাই, শুভ একদিনও দেখা করতে আসেনি। সিকদার সাহেব প্রথম থেকেই পুলিশকে অসহযোগিতা করতে বলেন। যেন অপহরণকারীরা ভয় পেয়ে ভাইকে কিছু করে না ফেলে। টাকা দেওয়ার দিন সিকদার সাহেব বের হওয়ার পর পুলিশকে স্ট্যান্ড-বাই এ রাখেন। উনি বাসে উঠার পর কল করে জানানো হয়, টাকা কোথায় রাখতে হবে। উনি টাকা রেখে ঐ এলাকা থেকে বের হয়ে আসেন। চায়ের দোকানে চা‌ খেতে খেতে পুলিশকে ফোন করেন। পুলিশ এর সাথে ধাওয়া পাল্টায় আহত হয় মামীর ভাই আর গুলিবিদ্ধ ছোট ছেলে শুভ। তাই, পুলিশ স্টেশনে যাবার পর ইন্সপেক্টর আমাদের হাসপাতালে যেতে বলছিলেন। একদিন সিকদার সাহেব ভাইয়াকে দেখতে এসে গল্পের ছলে সব বললেন।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post মুখোশের আড়ালে| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | সৌভিক সরকার | Bengali Detective Story
Next post সাদা কালো ডাইরী| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | গৌরব চন্দ্র| Bengali Detective Story