মুম্বাই-এর বর্তমান ব্যস্ত নায়িকাদের মধ্যে অন্যতম একজন ঋতভরী সেন। সারাদিন সিনেমা, সুটিং, মেকআপ, ইন্টারভিউ রিপোর্টিং নিয়ে ব্যস্ত সিডিউলে হাঁপিয়ে উঠেছিল এই তরুণী। কিছুদিন ছুটি নিয়ে কোথায় চেঞ্জে যেতে পারলে ভালো হত এমনটাই ভাবছিল এমন সময় হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল।
– “হ্যালো! হ্যাঁ মা, বলো।”
– “কিরে রিমি কেমন আছিস রে মা আমার?”
– “আমি ঠিক আছি মা। তুমি, বাবা…. সব কেমন?”
– “আমরা ভালো আছি রে মা। আচ্ছা শোন না, একটা কথা বলার ছিল তোকে…..
– “কি কথা মা? বলো? ওদিকে সব ঠিক আছে তো?”
– “হ্যাঁ রে। এদিকে সব ঠিকই আছে। আসলে….
– “আসলে কি মা? খুলে বলো না কি হয়েছে।
– “আসলে…. আচ্ছা রিমি! তোর ভাগলপুরের বাড়ির কথা মনে আছে? তুই তখন অনেকটাই ছোটো….
-“হুম। একটু একটু মনে আছে। দাদু-ঠাম্মি খুব কান্নাকাটি করছিল যেদিন বাবা তোমাকে আর আমাকে নিয়ে চলে এল (চোখের সামনে দৃশ্যটা ভেসে উঠল রিমির)। দাদু-ঠাম্মিকে ছেড়ে আসতে আমারও ইচ্ছা করছিল না।
– “হ্যালো! কি রে শুনতে পাচ্ছিস?” ফোনে মায়ের আওয়াজে সম্বিত ফিরে এল রিমির।
– “হ্যাঁ বলো। কি হয়েছে ভাগলপুরে?”
– “সেখানকার এক দালাল …. জমি বাড়ি প্রোমোটিং করেন, উনি ফোন করেছিলেন।”
– “কেন?”
– “তোর বাবাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন? ঐ বাড়ি নিয়ে কী প্ল্যান আছে? ….. বলছেন মোটা টাকা দেবেন, যদি আমরা বাড়িটা ওঁর নামে করে দিই।”
– “ও! তা বাবা কি বলল?”
– “তোর বাবার পক্ষে এখন ভাগলপুরে যাওয়া কি সম্ভব, বল তুই? এ বয়সে কি আর….. তাই বলছিলাম কি?”
– “মা আমায় বেরোতে হবে। শুটিং এর কল আছে একটু পরে।”
– “মা বলছি কি? শোন না! একবার যেতে পারবি রে মা। জানি তোর অনেক কাজের চাপ, কিন্তু …. বাবার তো বয়স …… ”
– “(মা কে থামিয়ে) আচ্ছা দুদিন সময় দাও। এদিকে যদি ম্যানেজ করতে পারি …. ”
– “হ্যাঁ, সেটাই ভালো। তুই একটু ম্যানেজ কর।”
– “হুম। দেখছি। আচ্ছা মা আমি এখন রাখছি। পরে কথা হবে। টা টা।”
– “হুম। সাবধানে থাকিস। খাওয়া দাওয়া করিস সময় মত।”
ফোনটা কেটে দিল। হাতে ফোনটা নিয়ে কিছু একটা ভাবে, একটা নম্বরে কল করে ফোনটা আবার কানে ধরল।
ক্রিং ক্রিং …. দু’বার হবার পর।
– “(ওপাশ থেকে) গুড ইভিনিং ম্যাডাম! বলুন।”
– “হুম। মিস্টার বক্সি! আমার আট-দশ দিন ছুটি লাগবে। বিশেষ দরকার। আমি ফিরে এসে আবার …. ”
– “ম্যাডাম! এই সময়?… কিছু প্রবলেম হলে আমায় বলুন না, যদি আমি …. ”
– “না না আপনি … আমার পারিবারিক ব্যাপার। আমি সব সামলে নেবো। আপনি এদিকটা বরং একটু ব্যবস্থা করুন, কেমন। এখন রাখছি। আরও কিছু কাজ আছে ….. বলে ফোনটা কেটে দিল।”
দু’এক মিনিট স্থির থেকে আবার একটা কল করল ওর সেক্রেটারিকে।
-“ (ও পাশে) হ্যাঁ দিদি বলুন।”
-“তানিয়া, আমি কাল থেকে থাকছি না। তুমি ডাইরি দেখে ফোন করে শুটিংগুলো ক্যান্সেল করে দাও।”
-“কেন দিদি? কোনও অসুবিধা?”
– “না না তেমন কিছু না। একটু বাড়ি যাওয়ার আছে। বিশেষ প্রয়োজন। তুমি সাবধানে থেকো। আমি ফিরে তোমায় কল করে নেবো কেমন?”
এবার রিমি ফোনটা কেটে উঠে দাঁড়াল। সামনের টেবিলের উপর রাখা জলের গ্লাসটা নিয়ে দু’ঢোঁক জল খেয়ে আবার ফিরে গিয়ে সোফায় বসল। সমস্ত কাজটাই করল একটু আনমনা হয়ে প্রায়। কিছুক্ষন ম্যাগাজিন এবং আরও কিছু কাগজপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে হঠাৎ কিছু মনে পড়লে ফোনটা হাতে নিয়ে ড্রাইভারকে কল লাগাল।
– “আলামভাই! কাল শুভা পাঁচ বাজে আ যা না। কুচহি দিনকে কাপড়ে আপনে সাথ লে লেনা। হামলোক কুচহি দিন বাদ লটেঙ্গে, আপনা ঘরওয়ালিকো বাতা দিজিয়ে গা!”
– “হ্যাঁ ম্যাডাম জি। লেকিন?”…
রিমি পুরো কথাটা না শুনেই ফোনটা কেটে দিল।
(২)
ভোর বেলায় উঠে রেডি হয়ে ঠিক সময়ে গাড়িতে উঠে বসল।
– “আলামভাই: গুড মরনিং ম্যডাম জি। যানা কাহা হ্যা?”
– “রিমি: গুড মরনিং! হামলোক যায়েঙ্গে ভাগালপুর।”
– “ম্যাডাম জি, ও তো বহুত দূর হ্যায়। বাই রোড যায়েঙ্গে তো একদিন লাগ যায়েগা?”
– “হুম। মুঝে মালুম হ্যায়। আপ গাড়ি স্টার্ট কিজিয়ে।”
গাড়ি সোজা হাই-ওয়ে ধরে দৌড়াতে লাগল। সকালের মিষ্টি আলোয় শহরটা মায়াচ্ছন্ন লাগছে রিমার। জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। মনে ভেসে উঠছে ভাগলপুরের আবছা কিছু স্মৃতি। …….. দাদুর বাজার আনার কথা। ঠাম্মির আচার তৈরি আর ওকে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার কথা …. ইত্যাদি …. ইত্যাদি।
– “ম্যাডামজি! … ম্যাডামজি!”
– “(ইষৎ চমকে) বলিয়ে। ক্যা?”
– “ভাগালপুর মে কহি রহতা হ্যায় ক্যা? উধার কাঁহা যায়েঙ্গে?”
– “হুম। মেরি দাদাকা ঘর হ্যায়।”
দু’জনেই চুপ হয়ে রইলো। রিমির মনে এল … বাবার কথা … বাবার মুখেই শোনা দাদুর এই ভাগলপুরের বাড়ি কেনার গল্পটা।”
দাদু কর্নেল রজত সেন একবার কলিগদের সাথে ঘুরতে এসেছিলেন এই ভাগলপুরে। এখানকার মনোরম পরিবেশের আকর্ষণে রিটায়ারমেন্টের পর বৌ-ছেলেকে নিয়ে স্থায়ী বসবাসের জন্য চলে আসেন তিনি। এই কারণেই বাড়িটা বানিয়ে ছিলেন। রিমির বাবা এখানকার আর্মি স্কুলেই পড়া শোনা করেছিলেন।
-“ম্যাডামজি! চায়ে পিয়েঙ্গে আপ? সামনে হি দুকান।” (গাড়ি থামিয়ে আঙুল তুলল একটা চায়ের দোকানের দিকে)।
– “হুম। কিউ নেহি। জারুর পিয়ুঙ্গি। লে আইয়ে।”
ড্রাইভার চা আনতে চলে গেল। রিমির আবার মনে পড়ল … ভাগলপুরে থাকতে, ও কেমন দাদুর কোলে বসে দাদুর চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে খেত। মা বকে বলত, ‘ছোটোদের চা খাওয়া উচিত নয়।’ ….. তারপর মায়ের বকা খেয়ে ঠোঁট ফুলালে, দাদু বলত, ‘দিদিভাই! মাকে বলে দাও তো, আমি চা না, বুকুট খাচ্ছি।’ (ছোটোদের মত আদো আদো করে, হাসতে হাসতে)।
পাশ থেকে যাওয়া লরির আওয়াজে অস্বস্তি বোধ করল রিমি। হাতঘড়িতে একবার সময়টা দেখে গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের চারদিকটা একবার দেখল ড্রাইভারকে খোঁজার উদ্দেশ্যে, ‘এখানে বেশি দেরি করলে হবে না পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে।’ এমনটাই ভাবল সে।
আরও কিছুক্ষন পর আলামভাই ফ্লাক্স ও দুটো ভাঁড় হাতে:
– “ম্যাডামজি, ইয়ে লিজিয়ে আপকে চায়।”
– “দেরি হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি চলুন আলাম ভাই।”
– “ড্রাইভার অবাক হয়ে রিমির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকায়, রিমি:
“ক্যায়া হুয়া? চলিয়ে জলদি। … লেট হো রাহা হ্যায়। অর শুনিয়ে! লাঞ্চ সে পহেলে গাড়ি অর কহি রুকনা নেহি চাহিয়ে।”
রিমি নিজের ব্যাগ ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল, কিছুর খোঁজে। আলামভাই নিজের সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। চড়া রোদ থেকে বাচতে গাড়ির কাঁচগুলো তুলে দিয়ে রিমি ড্রাইভারকে এ.সি. অন করতে বলল। শুধু রোদ নয়, রাস্তায় ভিড় বাড়ছে, তাই … বিখ্যাত নায়িকা বলে কথা। … ভক্তদের নজরে এলে, তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছনোও পন্ড হতে পারে। আর সেই দলে কোন রিপোর্টার থাকলে তো আর কোনও কথাই
নেই …..।
(৩)
গাড়ি যখন ভাগলপুরের কর্নেলের বাড়ির বড়ো গেটের সামনে দাঁড়াল তখন প্রায় সন্ধে ছ’টা কি সাড়ে ছ’টা। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ড্রাইভার হর্ন দিতেই রিমির ঘুমটা ভাঙল। গ্ৰীষ্মকাল বলে পরিবেশে একটা আলোর আভা রয়েছে তখনও।
একজন বয়স্ক গোছের লোক দরজাটা খুলে দিল। গাড়ি সামনের বাগান ফেলে এসে দাঁড়াল বাড়ির সদর দরজায়। রিমিকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে বয়স্ক ভদ্রলোকটি,
– “বেটিয়া, আমহামাকে মনে পড়ে বেটিয়া? আমহার সব মনে আছে?”
– কী মনে আছে কাকা আপনার?”
– “(রিমির দিকে ভ্রু কুঁচকে) তুম হো রোহিত বাবুর একমাত্র বেটি। হামাদের রিমি বেটিয়া। (হাল্কা হেসে) মনে নেই তুমহাকে লিয়ে হাম দুকান যাতে থে, অর তুম ললিপপকে লিয়ে জিদ করতে থে?”
রিমির যদিও মনে পড়ল না তবু লোকটিকে না বুঝতে দিয়ে,
– “হ্যাঁ চাচা, ইয়াদ হ্যায়।”
– “কৈসি হো বেটিয়া। রোহিত বাবু! …আর তুমহার মা? সব ঠিক হ্যায় না? (একটু থেমে) ইহা খারা কিঁউ? চালো আন্দার চালো বেটিয়া।”
– “বাড়ির ভিতরে যেতে মনটা ভরে গেল রিমির। (বয়স্ক লোকটি রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন।) সামনে বিশাল ড্রইং রুম। পিছন দিকে দু’টো ঘর: একটা শোয়ার ঘর আরেকটা খাবার ঘর (মনে করতে লাগল)। ড্রইং রুমে রাখা সোফার পাশ থেকে দো-তলার সিড়ি উঠে গেছে বারান্দা অবধি। রিমি চারদিকে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে সিড়ি দিয়ে উঠে এল দো-তলায়। দো-তলায়ও দু’টো বড়ো বড়ো ঘর। (মনে পড়ল আবার) ডান দিকের ঘরটায় ও বাবা-মার সাথে ঘুমাত। আর বাদিকের ঘরটা ছিল ঠাম্মি-দাদুর।
সবে বাদিকের ঘরে যাবে এমন সময় ….
– “ম্যাডামজি! …ম্যাডামজি! … ”
– (পিছনে ফিরে এসে) “হ্যাঁ। আলামভাই!”
– কাঁহা রাখখে আপকা সামান?”
– “লেকে আইয়ে উপার।” ড্রাইভার রিমির কথানুযায়ী রিমির ব্যাগগুলো ডানদিকের ঘরে রেখে দিল।
– “আলামভাই! নিচে চাচা হ্যায়। উনকে সাথ আপকো রাহেনা হ্যায় কৈসে? আপ যাইয়ে ফ্রেশ হো লিজিয়ে।”
– ড্রাইভার মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
রিমি ওর ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এল, ‘চাচা! চাচা!’ বলতে বলতে। দাদুর ঘরটা চোখে পড়তেই, সামনে এগিয়ে গেল, ঘরটাতে ঢুকবার জন্য। দরজায় হাত রাখতেই পিছন থেকে,
– “বিটিয়া! (আওয়াজে চমকে উঠল রিমি) চায় এনেছি। ঘরমে রাখখে?”
– “হুম।” একটু ভেবে দাদুর ঘরে না ঢুকে নিজের ঘরে এল চাচার পিছন পিছন।
– চায়ের ট্রেটা টেবিলে রেখে, “কিতনা চামচ চিনি দিবো বিটিয়া?”
– “দো।” একটু অন্যমনস্ক ভাবে।
চায়ের কাপে চুমক দিতে দিতে দাদুর কথা মনে এল। বাবার মুখে শোনা দাদু, বছর তিনেক আগে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। কাজের চাপ থাকায় ও এখানে আসতে পারেনি। ঠাম্মি ….. মারা যাওয়ার পর মা-বাবা দাদুকে অনেকবার কলকাতায় নিয়ে যেতে চেয়ে ছিল, কিন্তু দাদু যাননি।
দাদু নাকি সব সময় বলত, ‘যত দিন বাচবো … মানে! ভাগলপুরের এই বাড়িতেই আমি মরতে চাই রে রোহিত বাবা। তোরা আমার জন্য চিন্তা করিস না। আর দয়ারাম (বয়স্ক লোকটি) আছে তো আমার সাথে, চিন্তা কি বল তবে?”
দয়ারাম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “বেটিয়া! রাতে ক্যা বানায়ে? রোটি-সাব্জি অর ভাত?”
রিমি চমকে ওঠে চাচার আওয়াজে। কাপটা প্রায় হাত থেকে পড়ে যায় যায় অবস্থা। নিজেকে সামলে, ( তখনো বুকের ভিতরটা ধুকপুক করছে) “হ্যাঁ! ক্যা? ভাত! … না রোটি!” ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা চাচা, দাদু কি কখনো বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতেন? মানে বাড়ির বাইরে রাত কাটিয়েছেন?”
– (একটু হেসে) “তুমহারা দাদি আম্মাকো লেকে একদো বার গায়াতো থা। …. লেকিন ভাবিজি যানেকে বাদ পুরা দিন ঘরমেহি রাহেতা থা। লেকিন! কিউ? এসৈ কিউ পুছ রাহি হো?”
– “না! মানে, এমনি। জানতে ইচ্ছা হল।”
– “হামি যাই?”
– “হুম, যাও।” (চাচা সবে পিছন ফিরেছে)… আচ্ছা চাচা দাদুর কাছে কে কে আসতেন, তোমার মনে আছে?”
– “বাহুত লোক আসতো। এই গাওয়ের সবাই নানা জারুরাতমে আতে থে। হামারা বাবুজি তো বাহুত আচ্ছা ইনসান থা। সাবকা মাদাৎ করতা থা ও। … পুরে গাও … ”
– “চাচা! তুমি যাও। রাতের খাবারটা রেডি করে নাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
– “হুম। ঠিক। ঠিক।” (চাচা কিসব বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল)।….
(৪)
রাত তখন পৌনে নয়টা। রাতের খাবার খেয়ে উপরে উঠে এসেছে রিমা। কিছুক্ষণ পর রামু চাচা একটা জগে করে জল রেখে চলে গেলেন। রিমি বসল খোলা ল্যাপটপের সামনে। এর মধ্যে ফোনটা বেজে উঠল।
ফোনটা তুলতেই ওপাশ থেকে রিমির মায়ের গলা পাওয়া গেল।
– “কী রে? দুপুর থেকে কতবার তোকে ফোন করছি, নট-রিচেবল বলেই যাচ্ছে। ব্যাপারটা কী বল’তো?”
– “মা! … ”
– “কী রে মা? কোথায় ছিলি সারাদিন? চিন্তা হয় না?” (ব্যস্ত হয়ে)
– “মা! আচ্ছা তুমি প্লিজ শান্ত হও। আমি সব বলছি।”
– “তোর কি কখনো মনে আসে না, অ্যাঁ! একবার মা কে ফোন করার কথা? কী রে?”
– “রাগ কোরো না মা। আচ্ছা বাবা আমার ভুল হয়ে গেছে। এই আমি কান ধরছি।” (আলতো করে নিজের কানটা ধরে রিমি) …
– “আচ্ছা হয়েছে। আর আমায় মানাতে হবে না। সারাদিন খাওয়া-দাওয়া করেছিস ঠিক মত। এখন কি করছিস রে মা?”
– “হুম। মা, আমি খাওয়া দাওয়া করেছি। জানো আমি কোথায় এখন? গেস করো দেখি।”
– “কেন রে রিমি? তুই আজ বাড়ি ফিরিসনি? সুটিং আছে বুঝি?”
– “না মা। পারলে না তো বলতে। (হাল্কা হেসে) তুমি কাল বলছিলে না? ভাগলপুরের কথা! তাই আজ সকালে ….”
– “মানে … এ! তুই ভাগলপুরে গেছিস? হঠাৎ। এইভাবে? না বলে কয়ে?”
– “আচ্ছা! শোনো না মা। কয়েকদিন ধরেই মনে করছিলাম- একটু আউটিং এ যাবার কথা। …. আসলে এত কাজের চাপ। … তাই একটু … ”
(একটু থেমে) “তাই তুমি কাল ভাগলপুরের কথাটা বলায়, আমি ভেবে দেখলাম, এখানে আসলে আমার রিফ্রেশমেন্টও হবে আর …. সত্যি তো বাবার বয়স হয়েছে। তাই আর কী!”
– “তা ভালোই করেছিস। দাঁড়া আমি বরং তোর বাবাকে ডেকে বলি।… ও গো শুনছো!”
– “মা। এখন থাক না …বাবা হয়তো?”
– “কি রে মা? কেমন আছিস?” (রিমি বাবার গলা পেলো)
– “বাপি আমি ঠিক আছি। তুমি?”
– “আমিও। ভাগলপুরে গেছিস বুঝি? তোর মায়ের কথা শুনে মনে হল!” (গলাটা কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে)।
– “হুম বাবা। আসলে মা বলছিল …”
– “হুম। তা ভালোই করেছিস। ওখানে সব ঠিক আছে তো মা? খুব মনে পড়ে বাবা মার কথা। (আবারও মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে)। আচ্ছা দয়ারাম কেমন আছে রে?”
– “হুম বাবা। চাচা ঠিক আছেন। তোমাদের কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন। …”
_ “আচ্ছা বাবা। এবার রাখি। তুমি বরং সাবধানে থেকো। আমি পরে আবার ফোন করে নেব কেমন?”
– “আচ্ছা রে মা। রাখ। … তুই ও সাবধানে থাকিস।”
ফোনটা রেখে চোখ ওঠাতেই রিমি ভয়ে আঁতকে উঠল। … দরজার পর্দায় একটা কালো ছায়া দেখে, কে? … কে ওখানে?” (খুব ভয়ে, গলাটা যেন শুকিয়ে আসছে)।
কোনও সাড়া না পেয়ে, আওয়াজটা একটু জোরে করে আবার বলে, “কে? কে ওখানে? সাড়া দিচ্ছেন না কেন?.
অনেক কষ্টে ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে লাইটের সুইচটার দিকে এগতে লাগল রিমি। অন্ধকারে টেবিলে উপর রাখা ফুলদানিটা ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ে ভেঙে যাওয়ায়, আরও ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে রিমি।
– “ক্যা হুয়া বেটিয়া? ডর গেয়ি ক্যায়া?” সাড়া দিচ্ছেন না কেন?”
ঘরটা আলোকময় হয়ে গেছে। সম্ভবত দয়ারাম ঘরে ঢোকার সময় আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওঁর পিছনে ড্রাইভার আলামও এসে উপস্থিত হয়েছে এই ঘরে। রিমি ভয়ে মাটিতে বসে আছে, ডান হাতের তর্জনী দরজার দিকে তাক করে।
– “ম্যাডামজী! ক্যায়া হুয়া? আপ ঠিক তো হ্যায় না?”
রিমি (একটু ঘাবড়ে) ডান হাতটা নামিয়ে, স্বাভাবিক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
– “হুম। কে যেন! এই দরজার সামনে … ” (এক দৃষ্টে দরজার দিকেই তাকিয়ে)
– “কাঁহা বেটিয়া? ইহা তো কেউ না আছে। অন্ধেরামে তুমহার কোনও গালাতফেমি হয়েছে।”
– “হুম। তা…ই হবে।” (প্রশ্নবোধ নিয়ে)
– “ম্যাডামজি! আপ বলে তো ম্যায় বাহার রেহতা হুঁ। ডরনেকি কোই বাত নেহি।”
– “না। না। আলামভাই। … আমি ঠিক আছি। … ঠিক হুঁ মে। আপ যাইয়ে। শো যাইয়ে।”
– “চাচা। একটু জল দিন না।”
– “এ লো বেটিয়া। (জলের গ্লাস হাতে)। রাত বাহুত হয়েছে। তুমহি শো যাও। কথা গুলো বলতে বলতে, ভাঙা ফুলদানিটা তুলে ঘরটা পরিষ্কার করে দিল।
– “হুম। আমার ঘুম পাচ্ছে। তুমি লাইটটা অফ করে দাও চাচা। কেমন। আমি একটু ঘুমাই।”
– ‘হয়তো ঘুমের চোখে ভুল দেখেছি, অন্ধকারে ঠিক মত …. কী দেখতে কী দেখে বেকার চিৎকার করলাম। … ছিঃ সবার ঘুম ভেঙে গেল আমার জন্য। এসব কথা মনে মনে ভাবতে ভাবতে রিমি ঘুমিয়ে পড়ল।
রাত তখন দু’টো। হঠাৎ টেলিফোনটা ঘরের স্তব্ধতা ভেঙে বেজে উঠল। ঘুম চোখে ধড়মড় করে উঠে ফোনটা ধরতে গিয়ে রিমির খেয়াল হল, দাদুর ঘরের এই টেলিফোনটার তো কোনও তার নেই; শুধুই পুরোনো দিনের স্মৃতি হিসাবে রেখে দেওয়া! তাহলে রিং হচ্ছে কিভাবে? অজানা একটা ভয় আবার যেন তাকে গ্ৰাস করতে আসছে। গলা শুকিয়ে এল ওর, চিৎকার করার মত জোর নেই যেন শরীরে। অথচ ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। মাথার মধ্যে মায়ের কথাগুলো বারবার ঘুরপাক খেতে লাগল। শুনেছি ! দাদুর ডেডবডিটা ওই টেলিফোনটার পাশেই পড়ে ছিল – মুখে ছিল ভয়ের ছাপ। সবার সন্দেহ ছিল ফোনে ভয়ঙ্কর কিছু শুনেই দাদুর হার্ট ফেল হয়। তবে কি দাদুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়? সবার সন্দেহটাই ঠিক?
টেলিফোনের আওয়াজটা বন্ধ হয়ে যেতেই আবার এক অদ্ভুত স্তব্ধতা ছেয়ে গেল চারদিকে। সারাটা রাত আর দু’চোখের পাতা এক হল না রিমির। এক ভয় মিশ্রিত অস্বস্তিতে ছটফট করতে লাগল সে। দাদুর মৃত্যু! তাহলে? এখন ওর কি করণীয়? আর মাথা কাজ করছে না যেন রিমির।
(৫)
পরের দিন সকলে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেল। ঘড়িতে তখন আটটা বারো। সূর্যের চড়া রোদ জানলা দিয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ছে। চড়া হলেও বেশ মিষ্টি রোদের গরমটা। বিছানায় শুয়ে জানলা দিয়ে বাইরের সবুজ আলোকময় পরিবেশটা দেখতে খুব ভালো লাগছিল রিমি। বিছানা ছাড়ার মন করছিল না।
কিছুক্ষণ এই ভাবেই শুয়ে থাকার পর, দরজার বাইরে থেকে আওয়াজ পেল, “বেটিয়া। বেড টি দে যায়ে? না তুমহি টেবিলেই …”
বিছানার উপর উঠে বসে রিমি বলল, “গুড মর্নিং চাচা। আমি ফ্রেশ হয়ে টেবিলে আসছি। আপনি বরং ওখানেই চা আর ব্রেকফার্স্টটা দেবেন।”
নীরবে ঘাড় নাড়িয়ে দয়ারাম চলে গেলেন। রিমিও গেল বাথরুমের দিকে।
প্রায় আধ ঘন্টা বাদ ফ্রেশ হয়ে টেবিলে এসে বসতেই, ড্রাইভার পাশে এসে দাঁড়াল, “গুড মর্নিং ম্যাডামজি! আজ কাহি ঘুমনে কা প্ল্যান হ্যায়? গাড়ি নিকালে?”
– “হুম। গুড মর্নিং। বাজারকে তরফ জানে কা মন হো, আপ যাইয়ে গাড়ি লেকে আইয়ে, আলামভাই।”
– “ঠিক হ্যায় ম্যাডামজী। ম্যায় গাড়ি নিকালনে যা রহা হুঁ।” আলামজি যাওয়ার জন্য পিছন ফিরল।
– “আচ্ছা আলামভাই! কাল রাত টেলিফোন বাজা থা? আপকো কুছ আওয়াজ মিলা ক্যা?”
আলামভাই রিমির দিকে ফিরে বলল, “নেহি তো? কব কা বাত? ম্যায় তো শো গয়া থা ম্যাডামজী।”
রিমি একটু চুপ করে থেকে কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবল। তারপর বলল, “ও। ঠিক হ্যায়। আপ গাড়ি লেকে আইয়ে।”
প্রশ্ন করবে কী করবে না ভেবে ভ্রু কুঁচকে একবার রিমির দিকে তাকিয়ে, ড্রাইভার ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। রিমি এই ব্যাপারটা আর খেয়াল না করে, খবরের কাগজে মন দিল।
এক কাপ চা নিয়ে টেবিলে রেখে, দয়ারাম বলল, “বেটিয়া। ই লো। তুমহার চায়। বাটার টোস্ট ভি রেডি আছে। দিহে দেবো?”
একটু চুপ করে থেকে রিমি বলল, “আচ্ছা চাচা! দাদুর ঘরের টেলিফোনটা কি কাজ করে?”
– “কৌন সা?”
ব্রেডে বাটার লাগাতে লাগাতে রিমি বলে, “বাবুজির ও তার ওয়ালা পুরানা ফোন?”
দয়ারাম মৃদু হাসে, “নেহি, নেহি। উ তো রোহিতবাবু পেমেন্ট করকে বন্ধ কর দিয়া থা। পিছলে সাল যাব আয়া থা না, তব।”
– “ও। কিন্তু রিসিভারটা ওখানে রাখা কেন?”
– “ওহ তো, এ্যাসা হি রাখখা হ্যা। কিঁউ? কুছি বাত হ্যায় ক্যা?”
– “না না। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।” রিমি চায়ে চুমুক দিল।
ব্রেকফাস্ট সেরে রিমি তাড়াতাড়ি বেরুবে বলে ব্যাগটা চেক করে নিল। ফিরে এসে দাদুর ঘরটা খুলে দেখতে হবে। মনে মনে এমনটাই ভেবে নিল রিমি। মায়ের ফোনটা বাজতে দেখেই, আলামজিকে বলল ‘বাজার থেকে কী কী আনতে হবে’ সেটা চাচার কাছ থেকে জেনে নেওয়ার জন্য। মায়ের ফোনটা রিসিভ করে, কথা বলতে বলতে বাইরে এসে দাঁড়াল সে।
– “গুড মর্নিং মা।”
– “কিরে? কখন উঠলি? রাতে, অচেনা জায়গায় ঠিকঠাক ঘুম এসেছিল তো?”
একটু অন্যমনস্ক ভাবে রিমি বলল, “হ্যাঁ মা। ঠিক আছি আমি।”
– “ব্রেকফার্স্ট করলি? আজ কি ঐ প্রোমোটারের সাথে … ”
– “মা! তোমার কাছে ঐ প্রোমোটার ভদ্রলোকের নম্বর আছে না? দাও তো নম্বরটা।”
– “দাঁড়া, নম্বরটা তো তোর বাবা জানে। দাঁড়া ফোনটা ধর।”
ও পাশে মায়ের গলা শুনতে পেলো রিমি, “এই যে! বলি কোথায় তুমি? তোমার মেয়ে। ভাগলপুরের ঐ প্রোমোটারের নম্বর চাইছে।”
কয়েক সেকেন্ড পর রিমির মায়ের গলা আবার শোনা গেল, “হ্যালো রিমি! আছিস তো?”
– “হ্যাঁ মা। বলো।”
– “নে নম্বরটা লিখে নে। ৯০১৫৪৩২৬৭৮। ভদ্রলোকের নাম জিতেন্দর শেঠ।”
– “ওকে মা। এখন রাখছি।”
ফোনের ও প্রান্ত থেকে রিমির মা বললেন, “হুম। শোন না মা তুই সাবধানে থাকিস। ঐ শেঠজির সাথে তুই যেন আবার কোনও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়িস না। কেমন?”
– “ঊফ! মা, এত চিন্তা কোরো না তো। ঠিক আছে। পরে কথা বলবো।” এখন রাখছি, বলে ফোনটা কেটে দিল রিমি।
প্রায় মিনিট পাঁচেক মায়ের সাথে কথা হল। তারপর গাড়িতে উঠে বসল রিমি। ড্রাইভারও সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট দিল।
(৬)
মনে অনেকটা সাহস জুগিয়ে দাদুর ঘরের দরজাটা খুলতে, মনের মধ্যে ভীড় করে এল কুড়ি একুশ বছর আগেকার স্মৃতি। ঘরটা ঠিক একই ভাবে সাজানো, যেমনটা দেখে ছিল রিমি ওর ছোটোবেলায়। ঘরের মাঝখানটায় একটা বড়ো পালঙ্ক। রিমির চোখের সামনে ভেসে উঠল ঠাম্মি-দাদুর সাথে কাটানো সেই মিষ্টি দিনগুলোর কথা। মাঝে মাঝেই রিমি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরত এই খাটের উপর বসে থাকা ঠাম্মিকে। আদো আদো গলায় বলত, “আমি আজ তোমার কাছে ঘুমাব ঠাম্মি!” ঠাম্মিও হেসে রিমির মাথায় একটি করে স্নেহ চুম্বন দিয়ে দিত।
খাটটার ঠিক বিপরীতে বাঁ-পাশে রাখা ঠাম্মির পছন্দ করে কেনা সোফাটা। দাদু তো এই সোফায় বসেই রিমির আর ওর ঠাম্মির আদর আবদারের গল্প উপভোগ করতেন আর মিটিমিটি হাসতেন।
এক-দু’ পা এগিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকতেই, রিমির চোখে পড়ল, ডানদিকে জানলার পাশে ছোটো লম্বা টেবিলের রাখা টেলিফোনের রিসিভারটির দিকে। এই তো, এই ফোনটাই তো কাল রাতে বাজতে শুনেছিল রিমি। সামনে এগিয়ে আসতে লক্ষ্য করল, সত্যি তো এই টেলিফোনটা তো কোনও তারের সাথেই যুক্ত নেই। শুধু মাত্র রিসিভারটা সাজানো। তাহলে? ভুল শুনেছিল কি? কিন্তু স্পষ্ট আওয়াজ। কে জানে বাবা? কী হচ্ছে? আর কিছুই ভেবে উঠতে পারল না রিমি। এক অজানা ভয় জমাট বেঁধে গলার সামনেটা যেন আটকে আছে মনে হল রিমির। ভয়ে ভয়ে রিসিভারটা তুলে কানের কাছে আনল সে। নাঃ, কোনও ডায়েলটোন নেই। সত্যিই তবে ভুল শুনেছে কাল রাতে। হয়তো পাশের কোনও বাড়ি থেকে ঐ আওয়াজটা আসছিল! এমনটাই মনে করার চেষ্টা করল সে।
বাইরে কেউ ডাকছেন বলে মনে হওয়ায় রিমি বেরিয়ে এসে দাঁড়াল দোতলার বারান্দায়। দেখল, একজন মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক নীচে ডাইনিং এ দাঁড়িয়ে রিমির দিকে জোড় হাতে তাকিয়ে আছেন।
– “নমস্কার! মিস ঋতভরী সেন। আপনি তো রোহিত সেনের একমাত্র মেয়ে?” কি ঠিক বললাম তো? ”
– “নমস্কার! হ্যাঁ। কিন্তু, আপনাকে তো …?”
ভদ্রলোক আবার হাত জোড় করলেন, “আমি জিতেন্দর শেঠ। আপনার বাবার সাথে কথা হয়েছিল। দয়ারাম চাচার থেকে শুনলাম আপনি এসেছেন। তাই আর কি, ভাবলাম আলাপটা করেই আসি।
‘জিতেন্দর শেঠের চেহারায় অবাঙালীর ছাপ থাকলেও বাংলা ভাষাটা সুন্দর করেই বলেন মনে হল। তবে মতলব যে ভালো নয়, সেটা হাবে-ভাবে-চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে’ – ভাবল রিমি।
– “ওঃ। তা ভালোই করেছেন। না হলে আমিই যেতাম আপনার কাছে।” রিমি কথা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল।
সোফার সামনে অবধি এসে হাত দেখিয়ে বলল, “বসুন। চা চলবে তো?”
ভদ্রলোক বসতে বসতে বললেন, “আপনার বাবা আসবেন বলেছিলেন.. ”
– “হুম বয়স হয়েছে তো। তাই আমি একাই এলাম। তা আপনি…”
– “হ্যাঁ। আপনারা যদি … মানে, এ বাড়ি খানা তো পড়েই আছে, কাকাবাবু মারা যাবার পর থেকে। তা! সত্যিই কি বিক্রির কথা ভাবছেন? তাহলে আমি – বুঝতেই পারছেন, এটাই আমার কাজ।
রিমি দেখল এক ধূর্ত চাহনি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে চোখ দু’টোতে।
এর মধ্যে দয়ারাম চা দিয়ে গেলে, চায়ের কাপটি ভদ্রলোকটির দিকে এগিয়ে দিয়ে রিমি বলল, “এই নিন।” তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে) তা আপনি কি আগে কখনো? মানে, দাদু থাকাকালীন এসে ছিলেন?”
– “কেন বলুন তো? কাকাবাবু কি আপনায় তেমন কিছু বলেছিলেন নাকি?”
– “না না। তা না। আমি এমনি জিজ্ঞাসা করছিলাম। তা আপনি কত দাম দেবেন? মানে এখন এখানে জমি বাড়ির কি দাম চলছে? আপনার তো নিশ্চয় জানা আছে।”
– “না না, আপনারা আমায় এ বাড়ি দিলে ঠকবেন না। এ ব্যাপারে নিশ্চিন্তে থাকুন।”
– “তা তো নিশ্চয়। ঠিক আছে। আপনি সব দেখে শুনে আমায় জানান, ভালো বুঝলে না হয় – আমার উকিলকেও খবর দিতে হবে।”
– “আমার হাতে সব ব্যবস্থা আছে। ও নিয়ে আপনাকে অস্থির হতে হবে না। আমাদের কাজে উকিল, পুলিশকে বন্ধু বানিয়ে চলতে হয়।”
জিতেন্দর বাবু হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন, “আজ তাহলে উঠি, কেমন? কাল পরশু না হয় বসে, পাকাপাকি ভাবে কথা বলে নেওয়া যাবে।”
রিমিও উঠে দাঁড়াল, “হুম। নমস্কার।”
ভদ্রলোক চলে যেতেই, দয়ারাম রিমির সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভয়ে ভয়ে বললেন, “বেটিয়া! একটা বাত বলে? তুমহি বুরা না মানো তো!”
-“হুম। বলুন চাচা। কী কথা?”
– “এ জিতেন্দর না, আচ্ছা আদমী না আছে, বিটিয়া।” একটু থামলেন দয়ারাম। আবার বললেন, “বাবুজিকে বহুত পরেশন করছে লোকটা। বাবুজি কিছুতেই এ বাড়ি বিক্রি করতে রাজী হচ্ছিলেন না। তুমহি তো জানো বেটি, এ ঘর বাবুজি কা জান থা।” দয়ারাম প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে থাকে, “ লেকিন, ইয়ে জিতেন্দর! বাহুত হি পরেশন কিয়া বাবুজি কো।”
– “হুম। চাচা। আমি যেটা সন্দেহ করছিলাম, সেটাই তাহলে ঠিক!”
মনে মনে বিড়বিড় করল রিমি, “তবে কীভাবে?”
– “আচ্ছা চাচা একটা কথা বলুন তো! দাদু কি, মানে – কোনও ওষুধ খেতেন?”
– “ঔষুধ! মানে দাহবাই।”
এরপর একটু ভেবে দয়ারাম বললেন, “প্রেসার কা ট্যাবলেট খাতা থা বাবুজি। হুম। ব্যস। অর কুছ না। লেকিন! এ কিঁউ?”
– “না। এমনি। ও কিছু না।”
– “তো বেটিয়া – ই ঘর” একটু ভয়ে ভয়ে বললেন, কিন্তু পুরো কথাটা আর শেষ করলেন না।
দয়ারামের কথাটা বুঝতে রিমির কোন অসুবিধা হল না। বলল, “না না। চাচা! দাদুর স্মৃতি এই বাড়ি। এই বাড়ি বেচার কথা আমাদের মনেও আসে না। আমি তো শুধু লোকটাকে একটু বাজিয়ে দেখছিলাম।” তারপর একটু ভেবে কথাটাকে ঘোরাবার জন্য বলল, “এক কাপ চা দিতে পারবেন চাচা?”
– “হ্যা, হ্যা। কিঁউ নেহি। আভি লাতা হুঁ।”
– “তাহলে আপনি চা টা উপরের ঘরে দিন প্লীজ ।”
দয়ারাম চা করতে গেলে রিমি, আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল দাদুর ঘরে।
(৭)
কিছু একটা খুঁজতে গিয়ে দাদুর ঘরের চারপাশটা দেখতে লাগল রিমি। চোখে মুখে ব্যস্ততার ছাপ।
“কোথায় গেল?” “পাচ্ছি না কেন?” “কোথায় যাবে?” – বিড়বিড় করতে করতে বিছনার তোশক, চাদর, বালিশ সব ওলোট পালোট করতে লাগল রিমি। কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে সে আজ। একবার খাটের তলায় একবার সোফার নীচটা দেখে, কিছু না পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল সে।
“না পেলে যে দাদুর – দাদুর মৃত্যুর কারণটা আর খুঁজেই পাব না আমি।” আর কিছুই ভাবতে পারল না রিমি।
এর মধ্যে এক কাপ চা হাতে দয়ারাম ঘরের ভিতরে আসতেই রিমি জিজ্ঞাসা করল, “চাচা! দাদু ওষুধগুলো কোথায় রাখতো জানেন?”
দয়ারাম চায়ের কাপটা রিমির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “একটা বাক্সে। কিঁউ? ক্যা হুয়া?”
– “বাক্সে! কোন বাক্সে? দিতে পারবেন আমায় ঐ বাক্সটা?”
– “আচ্ছা। দেখতা হুঁ।” বলে খাটের সামনে রাখা টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল। ঘরটা এলোমেলো দেখে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে একবার রিমিকে পিছন ফিরে দেখে নিল দয়ারাম।
টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা ছোটো কাঠের বাক্স বার করে রিমিকে দেখাল দয়ারাম, “এই তো বেটিয়া। ইস বাক্সামে বাবুজি দাবাহি রাখতে থে।”
হাত থেকে ছোঁ মেরে বাক্সটা নিয়ে রিমি বলে উঠল, “কৈ দিন তো দেখি।”
বাক্সের মধ্যে থেকে খুঁজে খুঁজে একটা ওষুধের পাতা বার করল রিমি। মুখের সামনে সমান্তরালে ধরে ভালো করে দেখে বলল, “ হুঁ! যেটা ভেবে ছিলাম, সেটাই ঠিক হল।”
– “আচ্ছা চাচা, দেখুন তো, দাদু এই ওষুধটাই খেতেন কিনা?”
দু’পা এগিয়ে এসে ওষুধটা হাতে নিয়ে দয়ারাম একটু অবাক হয়ে ঘাড় নাড়িয়ে উত্তর দিল, “হুম। হুম বেটিয়া। এহি দাবাহি বাবুজি খেতেন।”
– “আচ্ছা। ঠিক আছে। চাচা, আপনি যান দুপুরের খাবার রেডি করুন, আমি আসছি।”
দয়ারাম বেরিয়ে গেলে রিমি ফোনটা হাতে নিয়ে একটা নম্বর ডায়াল করল।
ওপাশ থেকে, “হ্যালো। কে? রিমি?”
– “হ্যাঁ বাবা। তোমায় একটু দরকার ছিল। সময় হবে কথা বলার?”
– “হ্যাঁ। হ্যাঁ। নিশ্চয় হবে। কেন হবে না বল। এখন তো রিটায়ার জীবন। অনেক সময়, তা বল কি দরকার?”
– “আচ্ছা বাবা। দাদু তো শুধু প্রেসারের ওষুধ খেতেন, কি ঠিক বললাম তো? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ওষুধটা কে কিনে আনত? তুমি কি কিছু এ ব্যাপারে জানো?”
– “হ্যাঁ। তোমার দাদান শুধু প্রেসারের ওষুধ খেতেন। আমি প্রায় এখান থেকে অনলাইনে বুক করে দিতাম। কিন্তু! কেন রে মা? তুই হঠাৎ এ প্রশ্ন করছিস কেন?”
– “না। এমনি।” একটু যেন আনমনা হয়ে পড়ে রিমি।
– “আচ্ছা বাবা। তুমি সব সময় বুকিং করে দিতে? কোনও বারই মিস হয়নি?”
– “হ্যাঁ। আমিই তো বুক করতাম, তবে লাস্ট টাইম –”
কথা শেষ হওয়ার আগেই রিমি প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, “লাস্ট টাইম! কি বাবা লাস্ট টাইম? বলো – কী?”
– “সেইবার আমার ফোনটা খুব প্রব্লেম করছিল। তাই বাবাকে কল করে জানাই ‘এইবারের ওষুধটা আমি এখান থেকে বুক করতে পারছি না, তাই ওখান থেকে কিনে নেওয়ার জন্য।’ তোর দাদুও শুনে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘ও তুমি চিন্তা কোরো না, আমি দয়ারামকে দিয়ে কিনিয়ে নেব।’ কিন্তু! তুই কেন এ সব জানতে চাইছিস? তাহলে কি – ?”
– “হ্যাঁ বাবা। তুমি একদম ঠিক ধরেছ। দাদুর ঐ ওষুধ পাল্টানো হয়েছে। তবে বাবা, একটা খটকা এখনও আছে। জানো বাবা –”
– “কী?”
– “দাদু ওষুধের নামটা পড়ে তো বুঝে যেতেন যে, ঐটা ওঁর প্রেসারের ওষুধ নয়। তবে তো ওষুধ না খাওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু ফাইল থেকে পাঁচটা ওষুধ খাওয়া হয়েছে। এটা কী করে সম্ভব? মিলছে না উত্তরটা।”
ওষুধের প্যাকেটটা সামনে ধরে রিমি দেখতে দেখতে বলে, “আচ্ছা বাবা। তুমি চিন্তা কোরো না। আমি দেখছি। তুমি আর মা সাবধানে থেকো।”
– “হুম। তুইও সাবধানে থাকিস মা।”
ফোনটা কেটে দেওয়ার পর, রিমি আরও কয়েক মিনিট মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসে রইল। মাথায় তখনও ঘুরছে নানা প্রশ্ন। ‘বাবাকে দাদু জানিয়ে ছিল, ওষুধটা দয়ারাম চাচাকে দিয়ে আনাবেন। তাহলে কি? দয়ারাম চাচা এমনটা করতে যাবেন কেন? কোনও মোটিভ তো নেই। তাহলে?’
নীচ থেকে দয়ারাম চাচার গলা পাওয়া গেল, “বেটিয়া, খানা রেডি। আ যাও।”
বেশ কয়েক সেকেন্ড কারোর কোনও সারা পাওয়া গেল না।
কিছুক্ষণ পর, রিমি উত্তর দিল, – “হুম, আসছি চাচা।”
(৮)
খাবার টেবিলে বসে, ভাত মুখে না দিয়ে, ভাতের থালায় আঁকি-বুকি কাটতে থাকে রিমি। নানান প্রশ্ন ভীড় জমাচ্ছে রিমির মনে। এদিকে, চাচা এক এক করে ডাল, তরকারি, মাছেরবাটি এগিয়ে দিতে লাগল। তিন নম্বর বাটিটা এগিয়ে দিয়ে রিমির দিকে তাকিয়েই বলল, “ক্যা হুয়া বেটিয়া? খানা তুমহার মন পসান্দ না আছে?”
– “আছে। আচ্ছা চাচা, আমায় একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন?”
– “জরুর। ক্যা? বলো?”
– “দাদুর ওষুধ বাবা ক্যুরিয়ার করে পাঠাতেন, তাই না? আর কখনও কোনও অসুবিধা হলে? জানেন দাদু কি করতেন?”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন চাচা, “হুম। বিলকুল। রোহিতবাবু হামেসা টাইমেই সব ভেজ দেতা থা। লেকিন লাস্ট টাইম – !”
– “হ্যাঁ চাচা, বলুন কি হয়েছিল লাস্ট টাইম?”
একটু ভেবে দয়ারাম বললেন, “ঊস দিন যাব বাবুজি ঔর ও শেঠজি কথা কহছিল, রোহিতবাবুর ফোন এল।”
– “হুম। তারপর?”
– “রোহিতবাবু ঊস পার সে বলহেছিল আমহায় দিয়ে দাবাই লানে। বাবুজি ফোন কাটকে-” আবার কিছু ভাবতে লাগল দয়ারাম।
রিমি একটু উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি? কি হল তারপর চাচা? বলুন আমায় প্লিজ!”
– “ফোন রাখতে হি, শেঠজি বলা, ‘চিন্তা করবেন না কার্ণেলজি, আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো। আপনার প্রেসারের ওষুধ আমি এখুনি গিয়েই পাঠিয়ে দিচ্ছি কেমন! আপনি শুধু আমার ব্যাপার দেখুন কার্ণেলজি। আজ তবে উঠি।’ মনে করে করে দয়ারাম সবটা জানালেন রিমিকে।
ছয় আর তিন মিলিয়ে নয় করতে আর কোনও সমস্যাই হল না রিমির।
একটা অসাধ্য সাধনের মৃদু হাসির পর হঠাৎ চাচার দিকে তাকিয়ে আবার কিছু মনে পরে যাওয়ায় দয়ারামকে জিজ্ঞাসা করে উঠল, “আর চাচা। শেঠজি যে ওষুধগুলো পাঠালেন, সেগুলো দাদু খাওয়ার সময় দেখেছিলেন কি?”
একটু চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাসের সাথে কথাগুলো জিজ্ঞাসা করল রিমি “আপনি কিছু কি জানেন এই ব্যাপারে? জানলে দয়া করে আমায় বলুন।”
চাচা বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর একটু হেসে বললেন, “না না বেটিয়া। শেঠজি দাবাই দিয়ে গেলে, আমহি তো দাবাই লিয়ে বাবুজিকে দিতে গিহেছিলাম। বাবুজি দাবাই বাক্সে রাখনে কে লিয়ে বলহেন। তো আমহি উহা রাখ দিয়া বেটি। লেকিন ইসব কিঁউ পুছ রাহি হো?”
কথাটা চেপে যাওয়ার জন্য স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করল রিমি, “ও কিছু না চাচা। এমনি জানতে ইচ্ছা হল তাই আর কি। তো চাচা! আমি আর এত কিছু খেতে পারছি না, পেট ভরে গেছে আমার। খুব ভালো রান্না হয়েছে।”
– “ই ক্যা! তুমহি তো কুছভি খেলে না বেটিয়া।”
– “না না, অনেকটা করে খেয়েছি।” বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল রিমি।
হাত ধুতে যাবে এমন সময় আবার পিছনে ফিরে চাচাকে জিজ্ঞাসা করল, “ আচ্ছা চাচা ঐ দিন তো আপনি রেখে দিয়েছিলেন ওষুধগুলো। কিন্তু রোজ দাদু যখন ওষুধ খেতেন তখন কি – ?”
কথা শেষ করার আগেই কোনও একটা ভাবনায় ডুবে রিমি ভাবতে লাগল, ‘খাবার আগে কেন দাদু ওষুধের নাম গুলো দেখেননি?’
দয়ারাম হাসতে হাসতে বললেন, “না না বেটিয়া। তুমহি ভুল করছো। বাবুজি কাবিহি খুদ দাবাই নিহে খেতহেন না। আমহি সব সময় টাইম দেখকে উনহাকে জল খাবারের পর ও দাবাই দিয়ে আসতাম।”
– ‘ও!’ মনে মনে ভাবতে থাকে রিমি, “তাহলে আমার সন্দেহ সম্পূর্ণ সত্যি। দাদু না জেনেই ঐ ভুল ওষুধ খান আর ঠিক তারপরই ঐ ফোনটাতে আতঙ্কিত হয়ে হার্টফেল করেন। আর ফোনটাও যে তারই কাজ – এ ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত। তবে প্রমাণগুলো কীভাবে জোগাড় করা যায়?’
এমন হাজারও প্রশ্ন ভীড় করে এল রিমির মনে।
(৯)
প্রশ্নের ভীড় মাথায় নিয়ে রিমি হাত ধুয়ে ধীরে ধীরে উঠে এল নিজের ঘরে । খাটে এসে বসে মনে মনে আবার বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘দাদুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। এটি আসলে মার্ডার। আর দাদুর খুনি এখনও অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।এটা হতে পারে না! খুনিকে ভুলের শাস্তি পেতেই হবে। কীভাবে? কীভাবে তা সম্ভব?’
খাটের উপর রাখা মোবাইল ফোনটায় হাত পড়তেই রিমির মনে পড়ল সায়নের কথা। রেডিও জকি সায়ন! ও হয়তো সাহায্য করতে পারে এমনটা ভেবে একটুও সময় নষ্ট না করে ওর নম্বরটা ডায়েল করল রিমি। অনেক বার রিং হবার পর, ও পাশ থেকে খুব সুন্দর পুরুষালি আওয়াজে কেউ একজন বলল, “হ্যালো!”
– “হ্যালো! আপনি কি সায়ন বলছেন?”
– “হুম বলছি। কিন্তু… আপনি?”
– “আমি ঋতভরী সেন। আভিনেত্রী ঋতভরী।”
– “হ্যাঁ। হ্যাঁ। বুঝতে পেরেছি। আপনাকে চিনতে পারব না এটা আবার সম্ভব না কি! কিন্তু ম্যাডাম, আমাকে আপনার? আই মিন।”
– “হ্যাঁ। আমার আপনাকে খুব দরকার। ডু মি ফেবার প্লিজ। এক্সট্রিমলি আই নিড ইওর হেল্প।”
– “হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়। আই উইল বি হ্যাপি টু হেল্প ইউ। আপনি আমায় বলুন কি করতে হবে?”
– “হুম। আসলে আমার দাদু যিনি কি না -”
রিমি সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত ভাবে বলে সায়নকে, “ও। আই সি! এখন আমি কি করলে আপনার হেল্প হয়, সেটা যদি বলেন?”
– “আপনি তো আর. জে.। আশা করি ফোন কোম্পানী গুলোর সাথে আপনার ভালো যোগাযোগ আছে?”
– “হুম। তা আছে।”
– “22 মার্চ, দাদুর মৃত্যুর দিন। ঠিক মৃত্যুর আগে কার ফোন এসে ছিল সেটা যদি, দয়া করে!”
– “হুম। বুঝেছি। আপনি বরং আমায় আপনার দাদুর নম্বরটা দিন। আমি দেখি, কতটা কি করতে পারি।”
– “না না কতটা নয়। প্লিজ। আমায় এই ফেবারটা করতেই হবে। আই ওয়ান্ট টু _ ?” ইচ্ছে করেই কথাটা অসমাপ্ত রাখে রিমি।
– “ঠিক আছে ম্যাডাম। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনি নম্বরটা দিন প্লিজ।”
– “হুম। দাদুর ফোনের নং হল: 55097801। আপনি একটু দেখুন প্লিজ!”
– “অফ কোর্স। গিভ মি টু ডেজ অনলি। আপনাকে সব ইনফরমেশন দিয়ে দেবো।”
– “আমায় আপনি নিশ্চিন্ত করলেন। থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।”
ফোনটা রাখতে, রিমি খেয়াল করল ড্রাইভার আলামজি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।
– “ও। আলামভাই! আইয়ে। মুঝে আপসে কুছ বাত করনি থি, ইস লিয়ে বুলায়ে থে।”
– “হাঁ ম্যাডামজি, বলিয়ে।” আস্তে করে ঘরে প্রবেশ করে হাত দু’টো জড়ো করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল ড্রাইভারজি।”
– “আচ্ছা আলাম ভাই মুজে অর দো তিনদিন ইহা রহেনি হ্যায়। কুচ কাম আভি ভি বাকি হ্যায়। তো আপ এক কাম কিজিয়ে, আপ লৌট জাইয়ে মুম্বাই। ইহাকা কাম খতম হোতে হি ম্যা আপকো কল কর দুঙ্গি। তাব আপ আ জাইয়েগা মুঝে লেনে। ঠিক হ্যায় না?”
– “ওকে, ম্যাডামজি। তো হাম যায়ে?”
– “হুম। আইয়ে?”
আবার মোবাইলটা হাতে নিয়ে, একটা নম্বর ডায়েল করল:
– “হ্যালো। তানিয়া! আচ্ছা শোনো, আমার এখানকার কাজ শেষ হতে আরও কিছুদিন টাইম লাগবে। তুমি ওদিকটা একটু ম্যানেজ করে নিও। না না। বললাম তো কয়েকদিন আরও দরকার আমার। আমি জানি তুমি সব ম্যানেজ করতে পারবে। আই হ্যাভ ফুল ট্রাস্ট অন ইউ। … আমার কাজ শেষ হলেই তোমায় কল করছি কেমন! বাই। টেক কেয়ার।” বলে ফোনটা কেটে দেয় রিমি।”
এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে, মনে মনে রিমি নিজেকে প্রস্তুত করে দাদুর মৃত্যু রহস্য ভেদ করতে।
(১০)
দিনটা ছিল বাইশে মার্চ। ঘুম ভাঙতেই চোখে পড়ল মিষ্টি সূর্যের কিরণ জানলা দিয়ে সোজা ঘরের মেঝেতে এসে পড়েছে। বড়ো আলস্য লাগছে রিমির। ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছাড়তে মন চাইছে না। জানলা দিয়ে বাইরের আকাশটা দেখতে খুব ভালো লাগছে। কাল সারা রাত বৃষ্টির পর সূর্য যেন ঝিলমলিয়ে হাসছে। নীল আকাশের বুকে একদিকে সাদা তুলোর মত মেঘ আর ঠিক তার বিপরীতে ধূসর মেঘগুলো মনটাকে রিমির উদাসীন করে তুলছে। এই ভাবে বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেল।
হঠাৎ ফোনের আওয়াজে রিমির মনটা অলীক দুনিয়া থেকে বাস্তবের মাটিতে পা দিল। নম্বরটা চোখে পড়তেই তাড়াতাড়ি খাটের উপর উঠে বসল সে। আর ফোনটা ধরতেই, ওপাশ থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ পাওয়া গেল।
– “হ্যালো! মিস. ঋতভরী সেন? আমি ভাগলপুরের সাব ইন্সপেক্টর! মিঃ সৌমেন রায় বলছি।”
– “হ্যাঁ, মিঃ রায় বলুন! আমি আপনার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম। কিছু বের করতে পারলেন?”
– “হ্যাঁ, আপনাকে একটা সুখবর দেওয়ার ছিল। মি. জিতেন্দর শেঠ এখন আমাদের কাস্টাডিতে। ঐ জিতেন্দর শেঠ নামক লোকটির উপর আমাদের আগেই নজর ছিল। আপনার কমপ্লেন সাবমিট হতেই আমরা নজর রাখতে শুরু করি। ওঁর কাজই হল, অসহায় মানুষদের ভয় দেখিয়ে বা মৃত্যুর পথে ঢেলে দিয়ে জায়গা জমি জবরদখল করা। আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের সাথে থাকার জন্য। নাহলে ঐ ধুরন্ধর লোকটিকে ধরা আমাদের পক্ষে সম্ভবই হত না।”
-“ওহ! না না, আসল কথা বলতে, রিয়েলি! আমি থ্যাঙ্কফুল আপনার কাছে (একটু উত্তেজনার সঙ্গে) আমি এক্ষুনি আসছি থানায়। জাস্ট গিভ মি সাম টাইম।”
– “আসলে – মিস. সেন, আমি একটা অন্য কেস ইনভেস্টমেন্ট করতে বাইরে এসেছি। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই থানায় ঢুকব। তারপরে আপনিও চলে আসুন।”
– “নিশ্চয়। আমি টাইমলি থানায় পৌঁছে যাব। এখন তাহলে রাখি?”
– “ওহ! সিওর। টেক কেয়ার।”
– “থ্যাঙ্ক উ। বা-বাই।”
ফোনটা কেটে, দেওয়ালে সাজানো ঠাম্মি-দাদুর ছবিটার দিকে একবার তাকাল রিমি। আনন্দাশ্রু খুব স্পষ্টভাবে রিমির চোখে মুখে ফুটে উঠেছে।
– ‘জানো দাদু। আজ আমি খুব খুশি। তোমাকে যে লোকটা সামান্য এই বাড়িটির লোভে মেরে ফেলে ছিল, আইনের সাহায্যে আজ সে যোগ্য শাস্তি পেয়েছে। দেখো তোমার নাতনি পেরেছে! পেরেছে তোমার মৃত্যুর বদলা নিতে। আজ তুমি আর ঠাম্মি থাকলে হয়তো আমায় জড়িয়ে ধরে খুব আদর করতে। ঠিক যেমন করে করতে কুড়ি বছর আগে।”
দয়ারাম চাচা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন, “বেটিয়া! আসতে পারহি?”
– “চাচা! জানেন আজ কি হয়েছে? আজ আমি খুব খুশি। খুব খুব খুব।”
দয়ারাম অবাক দৃষ্টিতে রিমির দিকে তাকায়, “কিঁউ বেটিয়া? শাদী তৈয়ার হয়েছে বুঝি?”
– “হা হা হা! তার থেকেও বেশি কিছু করতে পেরেছি আমি। ঐ মিঃ শেঠ, শয়তান দালালটা – অ্যারেস্টেড। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে? তোমার কী বলব!”
কথাটা বুঝতে দয়ারাম একটু সময় নেয়, তারপর আনন্দের সঙ্গে বলে ওঠে, “মাতলাব? বেটিয়া, ওহ যো শেঠজি আপকে পাস আতা থা! জিসকো তুম ইয়ে ঘর বেচনা চাহাতি থী?”
অনেক প্রশ্ন ভীড় করে এলেও আর কিছুই বলতে পারল না দয়ারাম। শুধু দু’চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এল কেবল।”
– “হ্যাঁ। চাচা। ঐ শেঠ। বদমাইশ একটা। দাদুর ওষুধ বদলে, ভয় দেখিয়ে ঐ লোকটা দাদুকে খুন করেছিল। শুধুমাত্র এই বাড়িটা দখল নেবে বলে। বাড়িটা ভেঙে বড়ো মাল্টিস্টোর বিল্ডিং বানিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করবে বলে, ঐ অসভ্য লোভী লোকটা আমার দাদুকে … ।”
আর কিছু বলতে পারল না রিমি। দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল।
দয়ারাম কাছে এসে রিমি মাথায় হাত দিয়ে কান্না মিশ্রিত ভারী গলায় বলল, “রো মাত, বেটিয়া। তুমহি তো বাবুজি কা বাহাদুর নাতনি আছো। আমহি তো ভেবেছিলাম, তুমহি এখহানে এসেছো এহি ঘর বেচে দিতে!”
রিমি চাচার দিকে তাকিয়ে মাথা দু’পাশে নাড়াতে নাড়াতে বলল, “না চাচা না, প্রথমে বাবা মার কথায় এই বাড়ি বিক্রি করে দেবো এমনটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে, ধীরে ধীরে জানতে পারি, দাদু কীভাবে নিজের প্রাণ দিয়েও এ বাড়ি আগলে রেখেছিলেন। আর ঠিক তখনি আমি মনে মনে স্থির করে নিই, দাদুর এই ভালোবাসার বাড়ি কোনদিনই হাত ছাড়া করব না। আর দাদুর মত্যুর জন্য, যে বা যারা দায়ী তাদের শাস্তি দেবই দেব।”
দয়ারাম দু’হাত জড়ো করে বলে, “তুম বাহুত আচ্ছি হো বেটি। হামে মাফ কার দেনা বেটিয়া, হাম তুমহে গালাত সামঝে থে।”
রিমি দয়ারামের হাত দু’টো চেপে ধরে বলে ওঠে, “এমন করে বলবেন না চাচা। এখন থেকে আপনি এ বাড়ির সব। দাদুর শেষ বিশ্বস্ত কর্মচারী, সবচেয়ে ভালো বন্ধুর প্রাপ্য এই ভালোবাসার বাড়িটি। আমরা দু’দিনের অতিথি মাত্র।”
দয়ারাম মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলতে থাকে, “না না। বেটিয়া। আমার কিছু চাই না। তুম একবার – ।”
রিমি দয়ারামের কথাটা থামিয়ে, একটু হেসে বলে, “চাচা! আমায় এককাপ চা খাওয়াতে পারবেন? আমায় একবার থানাতেও যেতে হবে। এদিকের সব কাজ আজই মিটিয়ে আমায় ফিরে যেতে হবে।”
একটা লম্বা দীর্ঘনিঃশ্বাস নিয়ে, রিমি বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। একবার পিছন ঘুরে দাদুর ছবির দিকে তাকাতেই ওর মনে হল, দাদুও আজ খুব খুশি, তার ভালোবাসার বাড়িটাকে বাচাতে দেখে!