নীলদর্পণ রহস্য | বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | শ্রয়ণ ভট্টাচার্য্য | Bengali Detective Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

বনবিবির সেবক

‘ন্যাশনাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হবার পরই চারদিকে শোরগোল পড়ে যায়। সালটা ১৮৭২। একে একে সব লেখক বুদ্ধিজীবী পাশে এসে দাঁড়ান দীনবন্ধুর। কলকাতার বাবু সমাজেও ব্যাপক সারা ফেলে নীলদর্পণ। কিন্তু সমস্যার শুরু তারপর থেকে। নাটকটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে বসেন একজন পাদ্রী। নাম জেমন্স লং। যার নামে এখন জেমন্স লং সরণী। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে এমন কঠিন প্রতিবাদে বেজায় চটে গেলেন সরকার পক্ষ। শুরু হল মামলা। কিন্তু দীনবন্ধুর হাতে এত টাকা নেই যে মামলা লড়বেন। তখন তার মামলার টাকা দিলেন আর এক বিখ্যাত মানুষ। কালীপ্রসন্ন সিংহ। নগদ পাঁচ হাজার টাকায় মামলা লড়া শুরু হল। তবে সরকারের সাথে কি পেড়ে ওঠা যায়। নীলদর্পণের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা এল। সমস্ত থিয়েটার থেকে তুলে নেওয়া হল শেষপর্যন্ত’- ট্রেনটা তখন বারুইপুর ছাড়িয়ে গেছে। আবিরের কাছে গল্প শুনছিল ওরা।

নতুন কেসের জন্য লক্ষ্মীকান্তপুরে উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে ‘তরুণ বিগ্রেড’। ক্যাপ্টেন আবিরের সাথে রয়েছে বন্ধু নীলিমা ও রঙ্গন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তিনজনেই। আবির ইতিহাস, রঙ্গন ও নীলিমা ভূগোল বিভাগের। তবে তাদের বন্ধুত্বের শুরু সেই স্কুল জীবন থেকে। বছর এক আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরি যায়। সবাইকে চমকে দিয়ে সাতদিনের মাথায় সেই নথিপত্র উদ্ধার করে তারা। তারপর থেকে গোয়েন্দাগিরির শুরু। ঘটা করে একটা নামও দেওয়া হয় গ্রুপের – ‘তরুণ বিগ্রেড’।

লক্ষ্মীকান্তপুরে নীলিমার মামাবাড়ি। প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো। তিনদিন আগেই বড়মামার ফোন আসে নীলিমার কাছে। তবে পত্রপাঠ বন্ধুদের দিয়ে চলে আসতে বলেন তার বড়মামা জগদীশবাবু। বড়মামা তাদের তিনজনকেই এমন হঠাৎ করে কেন ডাকল সেটা বোঝার চেষ্টা করল নীলিমা। কিছু একটা সমস্যা তো নিশ্চয়ই দেখা গিয়েছে ভলে মনে হল তার।

আবিরের কথা শেষ হতেই নীলিমা বলে বসল- ‘এই তাহলে নীলদর্পণ কাহিনী। বড়মামা আমায় যখন জিজ্ঞেস করল যে নীলদর্পণ মামলার সম্পর্কে আমি কিছু জানি কি না, আমি তো আকাশ থেকে পড়ি। সটান না বলে দিই। তখনই বড়মামা বলে তোদের নিয়ে আসতে।’

– ‘সত্যি কথা বল তো নিলি,তোর বড়মামার কি কোন মাথার ব্যামো আছে? আসলে এইসব জমিদার বাড়ির লোকজন একটু অমন ধাঁচের হয় কিনা। আর তোকেও তো এতবছর ধরে দেখছি,’ রঙ্গন টিপ্পনী কেটে বসে।

– ‘কানের গোড়ায় দেব। তুই শালা পাগল। দশদিনে একবার স্নান করিস। দাড়ি দেখলে মনে হয় হিমালয় থেকে আসছিস,’ নীলিমা ঝাঁঝিয়ে উঠল। রঙ্গনের সঙ্গে নীলিমার একটু বেশী ভাল সম্পর্ক কিনা তাই এমন চলতেই থাকে। রেগে মেগে ব্যাগ থেকে চিপস্ বার করে খেতে শুরু করল নীলিমা। রঙ্গন হাত পাতাতেই আবার চিল্লাতে যাবে কী আবির বলে উঠল- ‘রঙ্গন তোর জ্ঞাতি আসছে। যা, গিয়ে কোলাকুলিটা সেরে নে।’

রঙ্গন খানিকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল- ‘কে জ্ঞাতি? কোথায়?’

– ‘পেছনে তাকালেই দেখবে পাবি।’

রঙ্গনের সাথে নীলিমাও পেছন ফিরে দেখল। একমুখ কাঁচামাখা দাড়ি, পরণে লাল ধুতি-পাঞ্জাবি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ও কাঁধে ঝোলা নিয়ে এগিয়ে আসছে একজন বৃদ্ধ। কামরার মাঝ বরাবর এসে হাঁক পাড়লেন। হজমী গুঁড়ো বিক্রি করার উদ্দেশ্যে হাঁকডাক।

– ‘তুই ও নিলির কথায় তাল দিলি আবির। দাড়ির মহিমা তোরা কি বুঝবি। উৎপল দত্তের ভাষায় বললে দাড়ি থাকলেই ইস্টুপিট থেকে বিদ্যাপীঠ হওয়া যায়।’ রাগে লাল হওয়া নীলিমাও না হেসে থাকতে পারল না রঙ্গনের কথায়।

খানিকবাদে বৃদ্ধ লোকটি আবিরদের খোপে এসে হাজির। বার কয়েক হেঁকে তার হজমীর গুণাগুণ বললেও এক প্যাকেটও বিক্রি হল না। অবশেষে আবিরদের উল্টো দিকে সিট খালি হলে সেখানে থিতু হলেন।

সিটের ওপর পা তুলে বসে, আবিরদের দিকে চেয়ে বললেন- ‘কলেজে পড়ো তোমরা? তা কোথায় যাচ্ছো?’

– ‘কলেজ না ইউনিভার্সিটি। নিজের বাড়ি যাচ্ছি।’ গম্ভীর গলায় উত্তর দিল নীলিমা।

– ‘বাহ। কোথায় বাড়ি ?’

– ‘লক্ষ্মীকান্তপুর’ – এবার রঙ্গন মুখ খুলল, ‘আমার নাম রঙ্গন। আমরা সবাই ওর,মানে নীলিমার মামাবাড়ি যাচ্ছি।’

– ‘তাহলে বাকিটা পথ তোমাদের সাথেই গল্প করতে করতেই চলে যাব। আমিও ওইদিকেই যাচ্ছি’

– ‘আপনার বাড়ি ওখানে?’-রঙ্গন প্রশ্ন করল।

– ‘না। আমার বাড়ি ক্যানিং। ওখানে পিরানীর থানে আমার পথ্যখানা। সেখানে দক্ষিণরায়ের দয়ায় করে খাই।’

– ‘দক্ষিণরায়! মানে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। কিন্তু পিরানী কে?’

– ‘যাকে তুই বনবিবি বলে জানিস। মুসলমানরা পিরানী বলে,’ মুখ থেকে বইটা সরিয়ে বলে উঠল আবির।

– ‘একদম ঠিক। সেই যে বিয়ের পর বনে ছেড়ে দিল তাকে তারপর থেকে তিনি আমাদের মা।’ -বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি কপালে হাত দিয়ে প্রণাম ঠুকলেন।

– ‘এ আবির, বিয়ের পর ছেড়ে দিল মানে কী? জানিস কিছু?’ নীলিমা ঠ্যালা দিল আবিরকে।

ভদ্রলোকটি মুচকি হেসে উঠলেন। তারপর বললেন – ‘কি হে জানো নাকি সেই গল্প?’

– ‘ইব্রাহিম ফকির নামের একজন তার প্রথম স্ত্রীর কোন সন্তান না হওয়ায় আবার বিয়ে করে বসেন। প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল ফুলবিবি,আর পরের জন হলেন গোলামবিবি। কিন্তু ফুলবিবি একটা শর্ত রাখল যে,নতুন স্ত্রীর সন্তান হবার পর তাকে বনে রে খে যেতে হবে। হলও ঠিক তাই। এক ছেলে ও মেয়েকে রেখে ইব্রাহিম মক্কায় রওনা দিল। এই মেয়েই পরে বনবিবি হয়ে ওঠে। লোকে বলে দক্ষিণরায়ের সাথে নাকি যুদ্ধ করে বনের লোকদের বাঁচিয়ে ছিলেন তিনি। তবে রঙ্গন দক্ষিণরায় আসলে একজন জল জ্যান্ত মানুষ ছিলেন। বাঘের সাথে তুলনাটা নিতান্তই পেশিশক্তির কারসাজি’ – গড়গড় করে বলে আবার বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজল আবির।

– ‘বনবিবির কথা জানো দেখে ভালো লাগল। আবার দেখা হওয়ার ইচ্ছে রইল তোমাদের সাথে,’ ভদ্রলোক সিট থেকে উঠে পড়লেন। কাঁধে ঝোলাটা চাপিয়ে আবার হাঁক ছেড়ে এগিয়ে গেলেন।

– ‘পাগল নাকি ভাই। এই বলল আমাদের সাথে যাবে আবার উঠে গেল,’ নীলিমা মুখটা ব্যাজার করে বলল।

– ‘হয়তো হজমী বেচতে গেল। ওসব ছাড়, ভাই আবির পেটটা বড় খাঁ খাঁ করছে, কিছু না দিলেই যে নয়।’ – পেটটায় হাত বুলিয়ে নিল রঙ্গন।

– ‘একটু চিপস খা এখন। বাড়ি গেলেই লুচি,’ নীলিমা চিপসের প্যাকেটটা বাড়াতেই এক খাবলা চিপস তুলে নিল রঙ্গন। যেন কত কাল কিছু খায়নি।

প্রথম সূত্র

– ‘তোমাদের পথে কোন অসুবিধা হয়নি তো? নীলিমা ওদের ঘরটা দেখিয়ে দিয়েছিস তো?’ বাড়ির বৈঠকখানায় তখন প্রায় সকলেই উপস্থিত। বড়মামা প্রথমেই তাদের শরীরের বিষয় জানতে চায়। নীলিমা একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাতে বোঝা গেল বাড়িতে লোকসংখ্যা জনা ছয়। বড়মামা জগদীশ চন্দ্র, তার স্ত্রী প্রতিমা ও ছেলে অর্জুন এবং ছোটমামা সতীশ চন্দ্র ও স্ত্রী আকাঙ্ক্ষা। এঁদের সন্তান নেই।

রঙ্গনের মুখে এতক্ষণে বেশ চওড়া হাসি দেখা গেছে। কারণ গরম গরম লুচির থালাটা এইমাত্র তার হাতে এসে পৌঁছল। খাওয়া দাওয়ার মাঝে নীলিমাই কথাটা পাড়ল – ‘বড়মামা হঠাৎ এমন করে আমাদের ডাকলে কেন?’

– ‘প্রয়োজন খুব তাই। তোমাদের সংস্কৃত কলেজের ঘটনাটা প্রতিমা আমায় বলেছিল। তখন বিশেষ পাত্তা না দিলেও এখন দিচ্ছি। একটু দাঁড়াও….’- কথার মাঝপথেই উঠে চলে গেলেন জগদীশবাবু। অবশ্য ফিরেও এলেন তাড়াতাড়ি। হাতে একটুকরো কাগজ নিয়ে এলেন। নীলিমার দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন – ‘এটা এসেছে চারদিন হল। চিঠির শেষে তোমার নামের উল্লেখ রয়েছে। পাঠিয়েছে তোমার দাদু।’

– ‘দাদু পাঠিয়েছে?’ আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা হল নীলিমার।

– ‘আমারও একই অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু ভালো করে চিঠিটার তারিখটা দেখে বুঝলাম সেটা দুমাস পুরনো। আর যেখান থেকে এটা পোস্ট করা হয়েছে সেখানে তোমার দাদু ছিলেন বেশ শেষদিকে। আমার কাছে তাদের নম্বর থাকায় ফোনও করি। তখনই জানতে পারি এটা রাখা ছিল ঘরের ড্রেসিং টেবিলের পেছনে। বলতে পারো লু কানো অবস্থায়। তারা ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে পেয়ে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে,’ জগদীশবাবু বললেন।

– ‘উনি কোথায় ছিলেন?’- আবির প্রশ্ন করল।

– ‘বাবা ছিলেন ঘুরে বেড়ানোর পোকা, যাকে বলে একেবারে wounderlast। কোথায় কখন যাচ্ছেন বিশেষ কাউকেই বলতে না। তবে শেষ ছিলেন কোচবিহারে। চিঠিটাও এসেছে ওখানকারই এক হোটেল থেকে। বাবা ওই হোটেলেই মারা যান। নীলিমা সবই জানে ঘটনাটা।’

– ‘আমাদের ডাকার কি কোন বিশেষ কারণ আছে?’ – আবার প্রশ্ন আবিরের।

– ‘আছে। নীলিমার হাতে যে চিঠিটা দিলাম সেটা প্রকৃতপক্ষে ধাঁধার মতো। শেষে নীলিমার নাম দেখে অনুমান করলাম বাবা হয়ত নিলিকেই চিঠিটা লিখেছিলেন। আমি এর কিছুই মানে বুঝে উঠতে পারি নি। বাড়ির সকলেও ট্রাই করেছে। শেষে ভাবলাম যার জন্য লেখা সেই দেখুক। তোমরাই দেখ।’

– ‘আপনার বাবা কি জানতেন আমাদের গোয়েন্দা সংগঠ নের কথা?’ রঙ্গন এতক্ষণ শুনছিল। এবার সে বলে উঠল।

– ‘অবশ্যই জানতেন। সংস্কৃত কলেজের ঘটনাটাও জানতেন।’

– ‘ব্যস এ তো পরিস্কার। আপনার বাবা চিঠিটা নীলিমাকেই লিখেছিলেন এবং চেয়েছিলেন নীলিমাই লেখার পাঠোদ্ধার করুক।’

– ‘কিন্তু ড্রেসিং টেবিলে লুকিয়ে রাখবে কেন দাদু?’ আবিরের দিকে তাকাল নীলিমা।

হালকা হেসে উঠল আবির। তারপর বলল- ‘পোস্ট করার সময়ই হয়তো পাননি। একটা জিনিস পরিস্কার যে উনি চাননি চিঠিটা সবাই পাক। হয়তো এমন কিছু কথা বা জিনিস যেটা নীলিমাকে বলাটাই সবচেয়ে নিরাপদ বলে করেছেন তিনি। আপাতত চিঠিটাই একমাত্র ক্লু।’

– ‘চল তোদের ঘর দেখিয়ে দি, পরে বসা যাবে এটা নিয়ে’- নীলিমা খাবারের থালাটা নামিয়ে উঠে পড়ল। সঙ্গে আবিরও উঠেছে,তবে রঙ্গন শেষ রসগোল্লাটায় কামড় দিচ্ছে তখনও। ঘর থেকে বেরতে যাবে কি আবির একটু থমকে দাঁড়াল। পেছনে ফিরে জগদীশবাবুকে প্রশ্ন করল- ‘আপনার বাবা মারা যাবার খবর পাওয়ার পর আপনারা এখান থেকে গেছিলেন তো?’

– ‘হ্যাঁ। আমি একটু কাজে আটকে গেছিলাম। ছোট গিয়েছিল।’ -জগদীশবাবু বলে উঠলেন।

– ‘আমিই গিয়েছিলাম। কেন বলো তো?’ – সতীশবাবু খানিক থতমত খেয়ে বললেন।

– ‘ওঁর সাথে নিশ্চয়ই কিছু ব্যাগ পত্তর ছিল। সেগুলো কোথায়?’ আবির সতীশবাবুর দিকে এগিয়ে এল।

– ‘ওগুলো তো বিশেষ ধরা ছোঁয়া হয়নি। মরা মানুষের জিনিস তো। তবে ফেলেও দেওয়া হয়নি। স্টোররুমে রাখা হয়েছিল মনে হয়’

– ‘নিলি একবার নিয়ে চল ওখানে।’ – কথা শেষ করেই বেরিয়ে গেল আবির। নীলিমার এইটুকুও আর ইচ্ছে নেই। একে ট্রেনের ধকল তার ওপর জমিয়ে খাওয়াদাওয়া, কিন্তু করণীয় কিছুই নেই। পা বাড়াতেই হল রঙ্গনকে নিয়ে।

ডাঁই করে রাখা জিনিসপত্রের ভেতর থেকে ঠিক ব্যাগটাকে বার করেছে নীলিমা। ব্যাগটা বেশ চমৎকার ডিজাইনের। নীলিমা জানাল এই ব্যাগটি খাঁটি কাশ্মীরী ইয়াকের লোম দিয়ে তৈরী। তার দাদুর এক আর্মি বন্ধু এটা গিফট করে ওঁকে।

আবির একাই ব্যাগটা তল্লাশি করতে লেগেছে। ভেতর থেকে এক এক করে জিনিস বার করছে আর মাটিতে ফেলছে। বেশ কতক্ষণ এমন চলার পর আবির নীলিমাকে জিজ্ঞেস করল- ‘তোর দাদু কি ট্রেকিং করত?’

– ‘পাগল হলি নাকি। জোয়ান বুড়ো হলেও বয়সের খেয়াল তো ছিল তার’- মুখ ভেঙচে উত্তর দিল নীলিমা।

– ‘চোখটা খুলে দেখ – দড়ি, জুতো, মাউন্টেন ল্যাডার,এইসব কিছুই ট্রেকিং এ লাগে। কেস!!! কিছু একটা কেস!!!’

-’তুই হঠাৎ ওঁর ব্যাগ ঘাটছিস কেন বল তো?’ – রঙ্গন ঘরে ঢোকেনি। দরজার সামনে দাড়িয়েই বলল।

– ‘কেস রিডিং ম্যান। এখানে চরিত্র মাত্র দুই। নীলিমা ও তার দাদু। নিলির বিষয়ে জানার কিছু নেই তবে এঁর সম্বন্ধে জানা উচিত। উদাহরণ তোর সামনেই রয়েছে। ট্রেকিং করতেন যে উনি এটা নিলিরা জানতই না। তবে বয়সের ব্যাপারটা সত্যিই ভাবাচ্ছে।’ – আবির আবার ব্যাগের ভেতর থেকে জিনিস বার করতে শুরু করল।

খানিকবাদে হঠাৎ-ই আবির চমকে ওঠার মতন শব্দ করল- ‘নিলি এইদিকে আয় তো’

রঙ্গন, নীলিমা দুজনে গল্প করছিল। আবিরের আওয়াজে দৌড়ে এল। তারা আসতেই আবির নীলিমাকে বলল- ‘তোর দাদু মারা যাওয়ার আগে শেষ কবে এখানে এসে ছিল?’

– ‘শেষ তো প্রায় ছমাস হবে। এমনটা তো নতুন নয়। কিন্তু কেন বলত?’ -নীলিমা বলল।

– ‘তোর দাদু শেষ কলকাতায় এসেছে আট ই অক্টোবর। মারা যাওয়ার কদিন আগে হল?’

– ‘নয় দিন’

– ‘দেখ, এই হল হাওড়া স্টেশন থেকে এম জি রোডের প্রি পেইড ট্যাক্সি র বিল। যেটা এই ফাউন্টেন পেনে সুন্দর করে জড়িয়ে, প্লাস্টিক দিয়ে প্যাক করা ছিল,’ প্যাকেটটা সমেত জিনিসটা এগিয়ে দিল আবির।

ভালো করে বিলটা দেখল নীলিমা। তারপর হাঁ করে আবিরের দিকে চেয়ে বলল- ‘কিছু একটা রহস্য আছে। মারা যাওয়ার শেষ দুসপ্তাহ দাদু কারোর সাথে যোগাযোগ রাখেনি। কিন্তু কলকাতায় এসেছিলেন। চিঠিটার মানে বার কর তুই প্লিজ।’

নীলিমাকে উদ্বিগ্ন হতে দেখেই রঙ্গন তাকে সান্ত্বনা দিল- ‘আমরা আছি তো। তরুণ বিগ্রেড এসে গেছে,এবার সব রহস্যের জট খুলবে।’

-’আরো কত জট পাকতে পারে সেটাও ভাবা দরকার। নে, নে ঘর দেখাবি চল। স্নান করতে হবে। যা ধুলো এই ঘরে’ – আবির তাড়া লাগাল।

নীল রং ভীষণ প্রিয়

‘গান ধরেছে বন্ধুবর, ভীষণ প্রিয় নীল রং

রাগ করেছে লালের দল, কেস খেয়েছে বেচারা লং।

পেঁচার টানে লক্ষ্মী আসে, কাব্য কলমে লুকিয়ে শেষে

যীশুর কোলে শিশু হাসে, জেনে নাও ঘুরে এসে।’

– দুপুরে খাসীর মাংস দিয়ে এমন খাওয়া হয়েছে যে তিনজনেই লম্বা ঘুম দিয়েছিল। সন্ধেবেলা নীলিমা চা নিয়ে আবিরদের ডেকে তোলে। চা পর্বের শুরুতেই চিঠিটা নিয়ে কথা উঠল। নীলিমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে ফাটা বাঁশের মতো আওয়াজ করে পড়তে শুরু করল রঙ্গন।

– ‘আবির রে, গোয়েন্দা গল্পের বইগুলো আনলে ভালো হত। দাদু সারাজীবন ভ্রমণকাহিনী ছাড়া কিছু পড়েননি। কিন্তু শেষ অবধি এ কি ধাঁধার চক্করে ফেলল।’ – রঙ্গনের চিঠিটা শেষ হতেই নীলিমা বলে উঠল। তাকে এমন মহাবিপদে ফেললেন দাদু! এটা ভেবেই সে মূর্ছা যায় যেন।

– ‘আমি একটু ছোটবাইরে যাব ভাই আবির। তুই তো এগুলো ভালো বুঝিস। তুই দেখ কেমন’- ফাঁক তালে রঙ্গন কেটে পড়ল ঘর থেকে। তবে আবিরের অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হয়নি। নীলিমা আড়চোখে একবার তাকে মেপে নিয়ে বলল- ‘কিছু এল মাথায়?’

– ‘আপাতত না। তবে তোর দাদু পাগলের প্রলাপ বকেনি। ঘটনাক্রম অন্তত সেটা বলছে না। লাইনগুলো ভাব,’ আবির জানলার ধারে এগিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরাল।

– ‘নীল রং লেখা লাইনটা তো ফসিলের গান। কী ভাবব এতে? আবিরের কাছে এগিয়ে এল নীলিমা। তার হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে লম্বা সুখটান দিল।

– ‘ফসিল বলতে কী কী মাথায় আসছে তোর?’ আবির জিজ্ঞেস করল নীলিমাকে।

– ‘রুপম…জীবাশ্ম ….। তবে দাদু এই গানও যে শুনতেন সেটা জানতাম না।’

– ‘এতে দুটো প্রশ্ন থেকে যায়। এক, রুপমের কি সত্যি নীল রঙ পছন্দ। দুই, এতে লালের দল রাগ কেন করবে আর লং নামের কেউ কেসই বা কেন খাবে? আর জীবাশ্ম মানে মৃতদেহ …মানে কি খুন?’

– ‘লালের দল রাগ করবে কেন? আর লক্ষ্মী, কবিতা,কলম এইগুলো সাথের খুনের কী সম্পর্ক?’

– ‘ভুল দিকে যাচ্ছি মনে হচ্ছে। ভাব,ভাব। নীল রং কার সবচেয়ে প্রিয়।’

– ‘আমি জানি। তবে বললে রেগে যাবি তোরা’ – কখন রঙ্গন এসে গেছে ওরা খেয়াল করেনি কেউ। ঘরে এসে হাসতে হাসতে বলতেই নীলিমা ধমক দিল- ‘সাট আপ রঙ্গন। তোর সবসময় ইয়ার্কি।

– ‘বেশ, চুপ করছি। তবে তুই… লং মানে কী জেমস লং। সকালেই নামটা বললি তুই আবির,’ মুখ ফুলিয়ে বলল রঙ্গন।

– ‘সাবাস। সাবাস ভাই। নীলিমা তোর মনে পড়ছে সকালেই তুই বললি তোর বড়মামা নীলদর্পণ মামলার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। খুলছে! খুলছে!’ – আবির এক প্রকার লাফিয়ে উঠে রঙ্গনকে জড়িয়ে ধরল।

– ‘বেটার বুদ্ধি আছে। তবে দাড়িতেই যা ঢেকে থাকে।’ নীলিমার কথায় হেসে ফেলল রঙ্গন। রাগ ভুলে নীলিমার থেকে সিগারেটের শেষ কাউন্টারটা নিয়ে অন্তঃস্থ করল পরম সুখে।

রাত আটটার মধ্যেই খাওয়ার পাট শেষ করতে হয়েছে। এইখানে এখনও এমন রেওয়াজ আছে দেখে বেশ বিরক্তই হয়েছে আবির। নীলিমা জানে সে এগারোটার আগে খায় না তাও এই আয়োজন।

যাইহোক, করণীয় কিছু নেই দেখে সকাল সকালই ডান হাতের কাজ সেড়ে নিল। রঙ্গনকে দেখে ওদের দুজনেরই মাথা আগুন। ব্যাটাছেলে শুরু করলে আর থামে না। ঘরে বসেই খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হল। ওদের খাওয়া এসে প্লেটগুলো নিয়ে নীলিমা একতলায় নামতে যাবে এমন সময় ব্যাপক চিৎকার শোনা গেল। কেউ অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে ক্রমাগত।

ব্যাপারটা শোনার জন্য তিনজনেই নীচে চলে এসেছে। তাতেই দেখা গেল,বসার ঘরে দাঁ ড়িয়ে হুংকার ছাড়ছেন সতীশবাবু। তার অঙ্গভঙ্গি এবং অঙ্গবাস পরিস্কার তার সুরাপানের চিহ্নকে বহন করছে। খানিক শোনার পর আরো বোঝা গেল যে এই হুংকার জগদীশবাবু উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে।

অনুমান সত্যি হতে সময় লাগল না। জগদীশবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাকে দেখেই সতীশবাবু আরো চিৎকার করে বলে উঠলেন- ‘কিরে বাপের সুপুত্তর। আর কদিন বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরবি। তবে ঘোর..ঘোর তুই…তবে আমার পাওনাটা এবার বুঝিয়ে দে!’

– ‘রোজরাতে এই পাওনা পাওনা করে মাতলামো না করলে কি নয় তোর। ঘরে যা, সকালে আসিস।’ দাঁত কিড়মিড় করে বললেন জগদীশবাবু।

– ‘তোর পয়সায় মদ খাই? কেন সকালে..আজই…এখনই। পুরো সম্পত্তিটা নিজের নামে করবি বল’

– ‘বেঁচে থাকতে তো বাবাকে কম জ্বালাসনি। তিনি মারা যাওয়ার পর আমাকে…’

– ‘সাধু..এখন সাধু সাজছে জগদীশ চন্দ্র। বাজারে কত ঝুলে আছে জানে সবাই। বাবাও জানত সবই।’

– ‘ঘরে যা,রাসকেল। রাতদুপুরে মাতলামো করা হচ্ছে। কাল আসিস তোর ভাগ তুই পাবি। এখন বিদায় হ।’

সতীশবাবু তখনও যেতে চাইছিলেন না। তবে স্ত্রী আকাঙ্ক্ষাই জোর করে ঘরে নিয়ে গেল। এদিকে তিনমূর্তিকে এইসময় দেখে জগদীশবাবুর মোটেই যে পছন্দ হয়নি সেটা হাবভাবেই বোঝা গেল। নীলিমাকে ওপরে যেতে বলে নিজেও ঘরের দিকে পা বাড়ালেন জগদীশবাবু।

লাল সাহেবের কুঠি

সাত সকালে এমন তাড়াহুড়ো করে বের করল আবির যে মেক-আপটাও করতে দিল না নীলিমাকে। এই ট্রেনের মধ্যেই সেটুকু সম্ভব সেড়ে নিচ্ছে সে। রঙ্গন, নীলিমা কেউই জানে না তারা যাচ্ছে কোথায়। শিয়ালদার ট্রেনে উঠেছে আধঘণ্টা হয়ে গেল। তবুও আবির চুপ। রঙ্গন তখন থেকে খুঁচিয়ে যাচ্ছে আবিরকে – ‘বল না ভাই, এই সাত সকালে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস? সাতরাত ঘুম হয়নি। তুই নিজেও তো ঘুমাসনি। কোথায় একটু জমিয়ে খেতাম এখন। তা না যতসব বাজে কাজে জড়িয়ে এখন যেতে হচ্ছে।’

– ‘কথা বললে কি তোর বুদ্ধি বেড়িয়ে যাবে? যদি সেটা না হয় বল কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?’-বেশ বিরক্ত হয়েছে নীলিমা।

– ‘নীলচাষের কথা মনে আছে?’ এতক্ষণে আবিরের মুখ খুলল।

– ‘আজ্ঞে। জানি।’ -রঙ্গন উত্তর দিল।

– ‘কালকের নীলদর্পণ মামলার কথাটাও মনে আসে নিশ্চয়ই?’

– ‘সব মনে আছে। আসল কথাটা বল তো?’ নীলিমা বলে উঠল।

– ‘বেশ। চিঠির সমাধান হয়ে গেছে। এটাই বলার ছিল।’

– ‘সত্যি! বল আমাদের।’ – নীলিমার সাথে রঙ্গনেরও চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।

– ‘প্রথম লাইনে কি ছিল – “গান ধরেছে বন্ধুবর, ভীষণ প্রিয় নীল রং”। এখানে নীল রং আসলে নীলের চাষ। বন্ধুবর হচ্ছে দীনবন্ধু মিত্র। এককথায় দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক। ‘ – সোজাসুজি উত্তর দিল আবির।

– ‘গান ধরবে কেন সে?’- নীলিমা প্রশ্ন করল।

– ‘বলছি। দীনবন্ধু মিত্রের আর এক নাম হল গন্ধর্ব নারায়ণ। গন্ধর্ব কারা? সুতরাং গান ধরেছে বন্ধুবর,’ হালকা হাসির রেখা গেল আবিরের মুখে।

– ‘লেগ ডাস্ট দে ভাই। এই জন্যই তুই আমাদের ক্যাপ্টেন!’ রঙ্গন রঙ্গ করে আবিরের পায়ে হাত দিতে গেলে গাঁট্টা খেল আবিরের কাছে।

– ‘পরেরগুলো বল। তুই চুপ করে বস রঙ্গন।’ নীলিমা টেনে বসাল রঙ্গনকে।

– ‘পরের লাইন তো রঙ্গনই কাল বলে দিল। ভাব পেরে যাবি,’ আবির বলল।

– ‘লং হল জেমস লং। “রাগ করেছে লালের দল”……ইয়েস লালমুখো … ব্রিটিশ সরকার। তার মানে দাঁড়ালো দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পণ লেখায় ব্রিটিশ সরকার রাগ করেছে। আর যেহেতু জেমস লং সেটাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে তাই সে কেস খেয়েছে মানে মামলা হয়েছে তার মানে,’ নীলিমার চোখমুখে একটা আলাদাই হাসি খেলে গেল।

– ‘একদম ঠিক। এবার আসি পরের লাইনে- “পেঁচা টানে লক্ষ্মী আসে”। এখানে এই পেঁচা যে সে পেঁচা নয়। একেবারে হুতোম পেঁচা’

– ‘কালীপ্রসন্ন সিংহ।’ – রঙ্গন বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে।

– ‘সাবাস। আর লক্ষ্মী হল টাকা। জেমস লং এর মামলার জন্যই আমাদের হুঁতোম পেঁচা নগদ পাঁচ হাজার টাকা দেয়। এইবার পরের লাইনটায় আয়, ‘কাব্য কলমে লুকিয়ে শেষে’। মামলা চলাকাকীন লং সাহেবকে বার বার প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, কে এই অনুবাদ করেছে। কিন্তু তিনি একটা কথাও বলেননি। পরে লোকের মুখে শোনা যায় অমন অসাধারণ ভাষায় অনুবাদ করেছেন আমাদের মধুসূদন দত্ত। আর লক্ষ্য করলে দেখবি মধুসূদন দত্তের ছদ্মনামের শেষ শব্দটা হল- “পেনপোয়েম”।

– ‘কাব্য কলমে মানে ওই অনুবাদ করার কথাই বলতে চেয়ে দাদু?’

– ‘তোর দাদু জিনিয়াস লোক ছিল। প্রথমে আমারও ঠিক এটাই মনে হচ্ছিল। কিন্তু তার পরের লাইন ? সেটা কিছুতেই মগজে আসছিল না। তারপর খানিক ধোঁয়ার টানে মগজ খুলল। মনে করে দেখ যখন তোর দাদুর ব্যাগ তল্লাশি করছিলাম তখন একটা ট্যাক্সির বিল আর কলমটা পেয়েছিলাম। সেখানেই তাই বলছে কাব্য মানে এই চিঠি আর কলম মানে সেই পেন এতেই লুকিয়ে আছে এবং যেখানে যীশুর কোলে শিশু হাসে সেখানেই যেতে বলেছে।’

– ‘আমার মাথাটা কেমন ঘুরছে। নিলি কিছু খাবার জোগার কর। এই সকালে এত বুদ্ধি খরচ করতে হচ্ছে’ – রঙ্গন সিটের মধ্যেই আধা শুয়ে পড়ল।

নীলিমার ওদিকে মোটেই মন নেই। সে সরাসরি জিজ্ঞেস করল আবিরকে – ‘পেনের মধ্যে কী লোকানো আছে আবির? কী পেয়েছিস?’

– ‘ওটা নিতান্তই সাধারণ ফাউন্টেন কলম। ভেতরে কালি ছাড়া আর কিছুই নেই,’ আবির জবাব দিল।

– ‘তাহলে এর মানে কী? কি ভেবে আমরা বেরিয়েছি?’

– ‘বাকিটা রাস্তা এটাই তোর কাজ। খুঁজে বের কর এর মানে। আর শিয়ালদা আসলে ডেকে দিস, আমি একটু চোখ বুঝলাম।’ আবিরের ওপর ভীষণ রাগ হল নীলিমার। ঠিক শেষ মুহূর্তে এসে সাসপেন্স ধরে রাখল। নিজের মনে খানিক গজগজ করে সামনের চাওয়ালাকে হাঁক দিল

– ‘ও দাদা, এদিকে আসুন’।

ট্যাক্সিটা তখন এম জি রোড ছাড়িয়ে গিয়েছে। ট্রেন থেকে নেমে তারা ট্যাক্সি করে নিয়েছে। সামনে রঙ্গন, পেছনের সিটে আবির ও নীলিমা। গন্তব্য আমহার্স্ট স্ট্রিট। তবে সেখানে যে কোথায় যাচ্ছে সেটা এখনো বোধগম্য হয়নি নীলিমার। রঙ্গনের সাথেও কথা বলা বেকার কারণ সে এখন ঝালমুড়ি খেতে ব্যস্ত। ট্যাক্সিতে ওঠা র পর থেকে একটাও কথা বলেনি আবিরের সাথে। মাঝে আবির একবার নীলিমার হাত ধরলেও সে চুপ থাকে। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়েই চলেছে সারাটা পথ।

ট্যাক্সিটাকে সেন্ট পলস কলেজের কাছে দাঁড় করালো আবির। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বলল- ‘নে চল ভেতরে যাওয়া যাক।’

– ‘যতক্ষণ না জানতে পারছি কোথায় যাচ্ছি আমি আর এক পাও নড়ব।’

– নীলিমা জেদ ধরল।

তার যে বেশ অভিমান হয়েছে তা বুঝে গিয়েছে আবির। নীলিমার কাছে এগিয়ে এসে বলল ,

– ‘সামনে যে চার্চটা দেখছিস,আমরা সেখানেই যাব।’

– ‘কারণ?’ নীলিমা গম্ভীর গলায় বলল।

– ‘তোর দাদুর ওই কলমটা ক্যামলিন কোম্পানির। প্রোডাক্টের নাম ট্রিনিটি। আর এই চার্চের নাম হোলি ট্রিনিটি চার্চ। সবচেয়ে মজার কথা হল জেমস লং এই চার্চের পাদ্রী ছিলেন। এইবার বোঝা গেল ম্যাডাম কেন এখানে আসলাম’

– ‘এটা আগে বললে মহাভারত অশুদ্ধ হত না। এখন চল ভেতরে যাই,’ নীলিমাই সবার আগে হাঁটা ধরল। আবির একবার নিজের মনেই বলে উঠল –‘পাগলি একটা’। তারপর পেছনে হেঁকে বলল- ‘ভেতরে কোন ফাদার থাকলে তোর দাদুর নাম বলবি। আমার সিগারেট শেষ কিনতে গেলাম। ‘

আবির যখন ফিরল তখন সব কান্ডের শেষ। রঙ্গনের হাতটা কেটেছে অনেকটা। নীলিমাও কপালে চোট। সব দেখে হতভম্ব হয়ে আবির জিজ্ঞেস করল – ‘তোদের এই অবস্থা কি করে হল?’

– ‘চার্চ থেকে বের হচ্ছি এমন সময় তিনটে বাইক এসে পথ আটকে দাঁড়ালো। নিলির দিকে এগিয়ে যেতে দেখে আমি বাঁধা দিই। তখনই ওদের একজন ছুরি মারে। তারপরও ধাক্কাধাক্কি চলে কিছুক্ষণ। পুলিশ ভ্যানের আওয়াজ পেয়ে পালাল।’ হাতে রুমাল চেপে কথাগুলো বলল রঙ্গন।

রাগে চোখ লাল হয়ে এল আবিরের। নীলিমার দিকে চেয়ে বলল – ‘এক মাঘে শীত যায় না। ওদের শাস্তি হবে।’

– ‘মুখে হেলমেট ছিল ওদের। তাই মুখ চেনা সম্ভব নয়। তবে একটা জিনিস লাভ হয়েছে,’ কঠিন স্বরে বলল নীলিমা।

– ‘কি লাভ হয়েছে?’ আবির জিজ্ঞেস করল।

পেছন ফিরে জামার ভেতর থেকে একটা চাবি বার করে আনল নিলি। তারপর সেটা আবিরকে দিয়ে বলল – ‘ফাদার এটা দিলেন। তিনি দাদুর স্কুলের বন্ধু। ছমাস আগে দাদু তাকে এটা দিয়ে যায়। সঙ্গে আরও বলেন কেবল আমি এলে তবেই এটা আমাকে দিতে।’

-’তোর কাছেই রাখ এটা। এখন আগে তোদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। অ্যাপ ক্যাব বুক করি দাঁড়া।’ চাবিটা নীলিমার কাছে দিয়ে আবির গাড়ি বুক করতে লাগল ফোনে।

চাবি রহস্য ও এক খুনী

টর্চের আলো লক্ষ্য করে সেইদিকে এগিয়ে যাচ্ছেন একজন মাঝবয়সী লোক। পরনে ঢিলে পাঞ্জাবি,মাথা-মুখ দিয়ে গামছা জড়ানো। আরো খানিকটা এগিয়ে যেতেই টর্চটা নিভে গেল। তারপরই সেই টর্চধারী ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন- ‘এত রাতে এখানে ডাকলে কেন? যা বলার কালই তো বলতে পারতে।’

– ‘খবর দেওয়াটা খুব জরুরী ছিল বাবু। আপনার কাজটা হয়নি। আমি ওদের ফলো করেছিলাম, ধরেও ফেলতাম কিন্তু পুলিশ চলে এসে সবকিছু চটকে দিল।’ – মাঝবয়সী ভদ্রলোক মাথা নীচু করে বললেন।

– ‘অপদার্থ। এই কারণে মাস গেলে অতটাকা দিচ্ছি তোমাদের। তিনটে বাচ্ছা ছেলেমেয়েকে ম্যানেজ করতে পার না!’

– ‘পেছন ছাড়ছি না বাবু। ঠিক লক্ষ্য রাখছি।’

– ‘আমার কিন্তু জিনিসটা চাই শিবেন। বুড়োটা মরে গেল তবু জিনিসটার হদিশ দিল না আমায়। দরকার পড়লে বুড়োটার মত ওদেরও লাশ পড়বে।’

– ‘বাবু, বলেন তো তুলে নিয়ে আসি? ঘা কতক দিলে সব উগরে দেবে।’

– ‘মাথামোটা একটা। যতটুকু বলেছি ততটাই কর। যত আপদ জুটেছে, যাও এখন। আর দয়া করে নজরে রেখ ওদের, পরে কী করতে হবে আমি জানিয়ে দেব। আর একটা কথা আমাকে ফোন করবে না কিংবা এমন ডাকবে না। দরকারে আমি যোগাযোগ করে নেব।’

মাঝবয়সী লোকটা বিদায় নিলে সেই ভদ্রলোকও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। দূর থেকে কুকুরদের ঝগড়ার মাঝে তাদের চলার শব্দও পাওয়া গেল না।

আঘাতটা রঙ্গনের বেশ জোরালোই লেগেছে। গতকাল রাত থেকেই জ্বর এসেছে। সকালে অবশ্য ডাক্তার এসে দেখে গিয়েছে। পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে সম্পূর্ণ বেড রেস্ট। জগদীশবাবু একবার সকালে এসে দেখে গেছেন রঙ্গনকে। তারপর থেকেই তিনি ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। রান্নাঘরের গুঞ্জন কানে আসতেই নীলিমা বুঝল এবার সম্পত্তি ভাগ হবেই। বাড়িতে উকিল এনেছে জগদীশ বাবু। বৈঠকখানায় সতীশবাবুর সামনেই আলোচনা চলছে জোরালো। নীলিমা টুক করে একটা এস.এম.এস করে দিল তার মায়ের ফোনে। তার মা একজন ন্যায্য অংশীদার, সুতরাং এই বিষয়টা তার জানা উচিত। ফোন থেকে বৈঠকখানার সামনে আসতেই উকিলের কথা কানে এল – “দেখুন জগদীশবাবু আপনার বাবা অলরেডি উইল করে তার সব সম্পত্তি আপনার ছোটবোনের মেয়েকে দিয়ে গেছে। অবশ্য তার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের টাকাগুলো আপনারা দুই ভাই পাবেন।’’

– ‘মামদোবাজি হচ্ছে এটা। আমরাও বাবার ছেলে। সম্পত্তি ভাগ হলে সমানভাবে হবে!’ চেয়ার থেকে উঠে চিৎকার করে উঠলেন সতীশবাবু।

– ‘রাগ করলে নিজেদের সামনে করবেন। আমি যা উইলে আছে তাই বলছি। হ্যাঁ, এখন যদি আপনারা কেস করতে চান তো করতেই পারেন। তবে আমার মনে হয় না কোনও লাভ হবে,’ উকিল বলে উঠল।

– ‘কেস? নিজের বোনের বিরুদ্ধে!’ – জগদীশবাবু বলে উঠলেন।

– ‘তুমি করতে না চাইলে আমি করব। আর যে বাপ তার ছেলেদের বঞ্চিত করে সেই বাপের মেয়ে আমাদের কেউ হয় না। বুড়োটা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে নইলে আমিই ওকে খুন করতাম!’ আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না সতীশবাবু। চেয়ারটাকে লাথি মেরে সোজা বেরিয়ে গেলেন।

এদিকে সকাল থেকে চাবিটাকে নিয়ে বসে আছে আবির। বারবার নানা দিক দিয়ে ভাবছে, কিসের চাবি হতে পারে এটা? এমন সময় নীলিমা ঘরে ঢুকল। ধপ করে বিছানায় বসে বলল – ‘একটা সিগারেট দে?’

আবির তার সদ্য জ্বালানো সিগারেটটাই এগিয়ে দিল নীলিমার দিকে। তারপর বলল- ‘চাপ খেয়েছিস মনে হচ্ছে? কি হয়েছে?’

– ‘বনেদি বাড়ির এই এক জ্বালা। সম্পত্তি আর সম্পত্তি। নীচে উকিল এসেছে, শুনলাম দাদু নাকি সব সম্পত্তি আমার নামে করে গেছে। আর তাই নিয়েই মামারা রেগে গেছে। মামলা করবে বলছে’ – পরপর কয়েকবার সুখটান দিল নীলিমা।

– ‘আবার এখানেও মামলা। আন্টিকে জানা সব।’

– ‘বলেছি,দেখা যাক কি করে। রঙ্গন ওঠেনি এখনো?’

– ‘ঘুমাক। জ্বরটা সবে কমের দিকে। এখন ওইসব ছেড়ে এদিকে আয়। দেখ তো চাবিটার কিছু গতি করতে পারিস কিনা।’

এগিয়ে এসে চাবিটা নিল নীলিমা। বেশ অন্যরকম দেখতে চাবিটা। মাথার দিকটায় আবার চাকার মতো নকশা করা, তবে জিনিসটা যে নতুন সেটা তার রূপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বার কয়েক ঘুরিয়ে দেখে সে বলল- ‘কিছু লেখাও তো নেই রে। কোনো ভল্টের চাবি নয় তো?’

– ‘বুঝতে পারছি না। মাথায় আবার চাকার মতো নকশা করা। কিন্তু গাড়ির চাবি এত বড় তো হয় না,’ আবির বলল।

– ‘কোনো সংকেত হয় তো রে?’

– ‘ইয়েস…ইয়েস… ফাটিয়ে দিয়েছিস। উফ আমি কি গাধা হয়ে যাচ্ছি দিনে দিনে? এই কথাটা এতক্ষণ মাথায় এল না আমার। তোর দাদু সব ক্লু সামনেই রেখে গেছে রে শুধু চিনতে হবে।’ একপ্রকার লাফিয়ে উঠল আবির। নীলিমার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলে উঠল।

– ‘কোন ক্লু? আমায় বল প্লিজ।’

– ‘আমরা কী করে জানলাম তোর দাদু কমাস আগে কলকাতায় এসেছিল?’

– ‘ওই ব্যাগ থেকে যে…….বুঝে গেছি…বুঝে গেছি….দাদু ইউ আর গ্রেট!’ ওপরের দিকে চেয়ে একটা ফ্লাইং কিস ছুঁড়ল নীলিমা।

– ‘রঙ্গনকে ডাকি। ও ব্যাটা না হলে কাজটা করা যাবে না’ – আবির রঙ্গনকে ডাকতে গেল।

রঙ্গন জ্বর গায়েও সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। হাওড়ায় এসে বিশেষ খোঁজাখুঁজি করতে হল না আবিরদের। রঙ্গনের এক কাকা ট্যাক্সি ইউনিয়নের মেম্বার। সে নিজে দায়িত্ব নিয়ে সব জোগাড় করে দিল।

– ‘বিলের সাথে গাড়ির নম্বরটা মিলিয়ে নে নীলিমা,’ ট্যাক্সির সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠল আবির।

– ‘একদম ঠিক আছে। এই ট্যাক্সিটাই,’ ট্যাক্সিচালকের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মাস দুয়েক আগে কোন বয়স্ক লোক তোমার গাড়িতে উঠেছিল। কোনও চাবির কথা বলেছিল?’

– ‘দাদা যখন বলল আপনার আসবেন আমি তখনই সব বুঝে গিয়েছি। আপনার নাম নিশ্চয়ই নীলিমা। আপনার দাদু আমার ট্যাক্সিতে চড়েছিলেন এটা ঠিক। তবে মাঝপথে আমাকে বলছিলেন উনি একদিনের জন্য ট্যাক্সিটা ভাড়া চান। পুরোপুরি নিজের কাছে রাখবেন। তা এমন দেওয়া তো যায় না। আমি বললাম ওঁকে কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। আমাকে অনেকগুলো টাকা অফার করলে আর মানা করতে পারিনি। তবে উনি ঠিক একদিন পরই ট্যাক্সি দিয়ে দিয়েছিলেন আর আপনার নাম করে বলেছিলেন আপনি আসলে আপনাকে যেন সাহায্য করি।’ ট্যাক্সিচালকটি গড়গড় করে বলে চললেন।

– ‘নীলিমা, সূত্র মতে এখানেই কিছু পেতে পারি। ভালো করে ট্যাক্সির সামনেটা দেখ। মেরির কোলে যীশু। মনে আছে তো, যীশুর কোলে শিশু হাসে। ভালো করে খুঁজতে হবে, হাত লাগা।’ আবিরের সাথে নীলিমাও লেগে পড়ল। তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করল ট্যাক্সির মধ্যে।

প্রায় আধঘন্টা খোঁজাখুঁজির পর হঠাৎ করে নীলিমা চিৎকার করে উঠল- ‘আবির…এই আবির….শিগগির এদিকে আয়!’

আবির পেছনের ডিকিতে ছিল, নীলিমার ডাকে ট্যাক্সির পেছনের দরজায় সামনে এসে বলল- ‘কিছু পেলি নাকি?’

– ‘কেল্লাফতে’ – ট্যাক্সির পেছনের সিটের ভেতর থেকে একটা ছোট বাক্স বার করে আনল নীলিমা। আবিরের হাতে দিয়ে বলল- ‘চাবিটা দিয়ে খোল।’

সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে চাবি বার করে লকে ঢোকালো আবির। বাক্স খুলতেই সে অবাক। ভেতরে আবার একটা কাগজ। অবিকল আগেরটার মতো। নীলিমার দিকে তাকিয়ে আবির বলল – ’আপাতত চাবির রহস্য শেষ। আবার নতুন ধাঁধা। নতুন রহস্য।’

কোচবিহারের মদনমোহন

মাঝে দুদিন কেটে গেছে। নীলিমার মা এসেছিল এর মাঝে। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সতীশবাবু মামলা করার তোড়জোড় করতে নীলিমার মাও উকিলের কাছে গেছে। এদের মাঝে পড়ে জগদীশবাবু বেশ নিরুত্তাপ। যে কাজের জন্য আবিরদের ডাকা সেটার কোন খোঁজখবরই এই কদিন তিনি নেননি। তবে কাল রাতে একবার এসেছিলেন। আবির স্বভাবতই একটু চাপা। যতক্ষণ না সমাধান হচ্ছে সেই কেস নিয়ে কিছুই বলতে চায় না। জগদীশবাবুকেও ওপর ওপর বলেছে বিষয়টা।

রঙ্গন এখন অনেকটাই সুস্থ। আবিরের সাথে সেও ধাঁধার সমাধানে হাত লাগিয়েছে এবার। সকাল দশটা নাগাদ নীলিমা ব্রেকফাস্ট নিয়ে ঘরে আসল। রঙ্গন আগেই টেবিল রেডি করে রেখেছিল। নীলিমার হাত থেকে থালাদুটো নিয়ে আবিরকে বলল- ‘আবির এখন সময় আছে নিলির থেকে জেনে নে বিষয়টা।’

নীলিমা খানিকটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল- ‘কি জানবি রে আবির?’

– ‘তোর দাদু কি করতেন?’

– ‘রেলে চাকরি করতেন শুনেছিলাম। কেন বল তো?’

– ‘দরকার আছে। আচ্ছা তোর দাদু মারা গেছিলেন কুচবিহারের কোনও হোটেলে রাইট?’

– ‘হ্যাঁ’

– ‘হোটেলের ফোন নম্বর আছে তোদের কাছে?’

– ‘বড়মামার কাছে থাকতে পারে। দাদুর মৃত্যু সংবাদটা পাওয়ার পর বড়মামার কাছেই ফোন আসে।’

– ‘ওঁকে এখন বিরক্ত করে কাজ নেই। তুই বরঞ্চ তোর মামিদের থেকে হোটেলের নামটা জান। তারপর গুগুল করে দেখা যাক নম্বর নাওয়া যায় কিনা।’

– ‘বেশ। এখন খেয়ে নে। ওদিকে সুমন্ত স্যার ফোন করেছিল রঙ্গন। এই সপ্তাহের মধ্যে যেতে বলেছে। আমি যাব বলে দিয়েছি।’

রঙ্গন নাক সিঁটকে উঠল। নীলিমাও ওমনি রঙ্গনের মাথায় এক গাট্টা মেরে খাওয়া শেষ করতে বলে বেরিয়ে গেল।

দুপুরের দিকে হোটেলে ফোন করেছিল আবির। যেই সময় কিছুই মাথায় আসছিল না তখন এই ফোনটা বেশ রসদ জোগাল। সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা হল পরিচিত একজনের সন্ধান পাওয়া। হোটেলের ম্যানেজারের থেকেই জানা গেল যে একমাত্র এই ভদ্রলোকের সাথেই নীলিমার দাদু বার কয়েক দেখা করেছে হোটেলে। আবিরের অনুরোধে তিনি রেজিস্ট্রারের ছবিও মেইল করবে বলে জানালেন। সঙ্গে তিনি লোকটার ফোন নম্বরও দিলেন এন্ট্রি খাতা খুঁজে।

নম্বর পাওয়ার পরপরই কয়েকবার ফোন করে আবির। তবে সবগুলোই মিসড-কল হয়ে যায়। ঠিক সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ভদ্রলোক নিজে কল ব্যাক করেন- ‘হ্যালো, আপনি ফোন করেছিলেন কয়েকবার।’

– ‘নমস্কার মদনমোহনবাবু। আমি অম্বরীশবাবু বাড়ির লোক বলছিলাম। একটু কথা বলা যাবে আপনার সাথে,’ এপার থেকে আবির বলল।

– ‘দাদার বাড়ির লোক আপনি। নমস্কার, দাদা যে এইভাবে চলে যাবে আমরা ভাবতেও পারেনি। বলেন কী বলবেন?’

– ‘আপনি কুচবিহারে অম্বরীশবাবুর সাথে প্রায়ই দেখা করতেন কেন?’

– ‘একটা বাজে প্রশ্ন করলেন আপনি। আসলে দাদা নিজেও চাইতেন না এই বিষয়ে আমি তার বাড়ির কাউকে বলি।’

– ‘তিনি আর বেঁচে নেই মদনমোহনবাবু। এটা জানাটা খুব জরুরী। প্লিজ বলুন।’

– ‘দাদা শুধু কোচবিহার নয় অনেক জায়গাতেই যেতেন মাঝে মাঝেই। ঠিক করে বললে আমিও যেতাম।’

– ‘কেন যেতেন?’

– ‘আমাদের একটা দল ছিল। দাদা রেলে চাকরির সুবাদে অনেক জায়গায় গেছেন। আর আর্কিওলজি ছিল দাদার প্রাণ। আমাদের দল সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে অ্যান্টিক জিনিসপত্রও জোগাড় করে। সেই কারণেই দাদার সাথে দেখা করা কুচবিহারে। ওখানেও আমরা কাজ করছিলাম।’

– ‘নীলদর্পণ রহস্যটা কী মদনমোহনবাবু!’ আবিরের গলা শক্ত হয়ে এল।

– ‘নীলদর্পণ? সেটা কী জিনিস?’

– ‘মিথ্যে বলবেন না। আমার বিশ্বাস আপনি সব জানেন। তাছাড়া ইদানিং অম্বরীশবাবুর সাথে আপনার ঝামেলা বেশ বেড়ে গেছিল। এতটাই বেড়েছিল যে সেটা রুম থেকে বেরিয়ে হোটেলের ম্যানেজারের কাছে অবধিও চলে গেছিল। ঝগড়ার কারণটা কি অ্যান্টিক জিনিসপত্রগুলো স্মাগলিং করা?’ আবির চেপে ধরল তাকে।

– ‘বাজে কথা বোলো না আবিরবাবু। এই বয়সে বেশি বার ভালো নয়!’ মদনমোহনের গলায় রাগ স্পষ্ট।

– ‘ভালো খবর রাখছেন দেখছি। বেশ দুয়ে দুয়ে চার হচ্ছে এবার। বলে ফেলুন নীলদর্পণের গল্পটা কি?’

– ‘মাথায় এতো বুদ্ধি। আমার নম্বরটাও জোগার জোগাড় করে ফেললে, তাও আমি জানলাম না। বাকিটাও নিজে করে নাও। তবে একটা কথা ও জিনিসটা কিন্তু আমার চাই।’

– ‘না দিলে কি করবেন? অম্বরীশবাবুর মতো খুন নাকি আমার বন্ধুদের ওপর যেমন হামলা করেছিলেন অমন হামলা?’

– ‘এ আবিরবাবু, দাদাকে আমি খুন করিনি। তবে হ্যাঁ তোমার ওই বন্ধুদুটোকে আমিই একটু আদর করেছি। চাবিটা বড্ড দরকার হয়ে গিয়েছিল।’

– ‘আপনি কোনও কিছুই পাবেন না। আর একটা কথা এরপর যদি আমার বন্ধুদের গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেন….’ ফোনের লাইনটা কেটে দিলেন মদনমোহনবাবু। আবির কয়েকটা হ্যালো হ্যালো করে ফোন ছুঁড়ে ফেলল বিছানার ওপর। রাগে শরীর জ্বলছে তার। এইসব বেইমানের জন্যই দেশের সম্পদ বিদেশে চলে যাচ্ছে একে একে। এদেরকে ছাড়া যাবে না। আর কিছুতেই অম্বরীশবাবুর লুকনো সম্পদ এঁর হাতে যাওয়া চলবে না।

রঙ্গন পাশের বারান্দাতেই ছিল। তাকে ডাক দিল আবির। বলল- ‘বেশ কটা কাজ করতে হবে তোকে, পারলে আজ থেকেই শুরু কর। আমি বলে দিচ্ছি কী কাজ, মন দিয়ে শোন।’

রহস্যের কিনারা

গাড়িটা মৌলালি ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল। নীলিমার বাবা গাড়ি চালাচ্ছেন। ভোরবেলায় নীলিমাকে ঘুম থেকে তুলে বেরিয়ে পড়েছে আবির। আজও নীলিমাকে কিছু বলেনি সে। কাল রাতে নীলিমার মা বাবা ওর মামাবাড়িতে এসেছেন। আবিরের বারণ স্বত্বেও নীলিমা জোর করে বাবাকে নিয়ে বেরিয়েছে। গাড়িতে উঠে আবির কেবল একটাই কথা বলেছে- ‘সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ যাব’। তারপর থেকেই কেমন পাগলামো শুরু করেছে।

মিনিট দশেকের মধ্যে মল্লিকবাজার থেকে গাড়িটা ডানদিকে ঘুরে গেল। কিছুদুর যেতেই আবির চিৎকার করে থামাতে বলল। নীলিমাও অস্থির হয়ে পড়েছে। আবির গাড়ি থেকে নামতেই নীলিমা চেপে ধরল- ‘আমরা কোথায় যাব আবির? বল আমাকে। কেন এমন পাগলামো করছিস তুই!’ – ‘বড্ড দেরী হয়ে গেল নিলি! আমি বুঝতে অবধি পারলাম না এতদিনে যে এমন একটা সম্পদ তোর দাদু রেখে যাবে। আর একটু সময় নষ্ট করা যাবে না, নয়তো সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ আবিরের চোখমুখে অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ পালটে গেছে।

রাস্তাটা ক্রস করেই সামনে দিকে দৌড় দিল আবির। নীলিমা ও তার বাবাও আবিরের পিছু নিল। এল সি আর ডি সেমেট্রির সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। আবির আবার চিৎকার করে উঠল – ‘আমি আসছি বন্ধু। আমি তোমার কাছে আসছি।’

– ‘আবির প্লিজ বল এখানে কী আছে? আমি আর পারছি না। প্লিজ!’ – নীলিমা প্রায় হাতজোড় করে বলে উঠল।

– ‘ধাঁধাটা মনে কর নিলি, “দেয় রাজা বেদম সাজা, বাগানখানি তার বড্ড প্রিয়”। রাজা কে? রাজা হল ব্রিটিশ সরকার, যারা জেমস লংকে সাজা দিয়েছিল। বাগানখানি বড্ড প্রিয় কার জানিস? এলিজা ইম্পে। বিট্রিশ সরকারের আমালে সুপ্রিম কোর্টের প্রথম চিফ জাস্টিস। প্রিয়-র ইংরেজি রূপান্তর কর, হয় ডিয়ার এবং বাগান হচ্ছে পার্ক। এলিজা ইম্পের ডিয়ার পার্ক কোথায় ছিল?’

– ‘পার্কস্ট্রীট….পরের লাইনটা?’

– ‘বুড়ো ব্যাটা গলার কাঁটা, সাবধানে পা ফেলো’, এর দুটো মানে আছে। এখন একটাই শোন। বুড়ো ব্যাটা হচ্ছে বড়ো ছেলে। তোর দাদুর বড়ো ছেলের নাম কি? জগদীশ। আর আমরা এখন দাঁড়িয়ে লোয়ার সার্কুলার রোডে, যার এখনকার নাম আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোড।’

– ‘সাবধানে কেন পা ফেলতে বলেছে?’

– ‘নিলি,গোরোস্থানে সাবধানেই চলতে হয়,’ নীলিমার বাবা পাশ থেকে বলে উঠলেন।

– ‘বাকি পরে বলছি। এখন ভেতরে চল।’

তিনজনেই ভেতরের দিকে পা বাড়াল। ভেতরে ঢুকেই একটা রাস্তার পাশে থাকা ফলকের দিকে তাকিয়ে আবির বলল, – ‘কি নাম বলছে রাস্তার?’

– ‘মধু বিশ্রাম পথ,’ নীলিমা জবাব দিল।

– ‘নামটা মনে রাখিস। এখন এদিকে আয়’- আবির ওদের সোজা নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল একটা সমাধি সৌধের সামনে। তারপর হালকা হেসে বলল- ‘সামনে তাকা নিলি। তোর দাদু বলে গেছেন, “মেঘের কোলে খুঁজে পেলে, সার্থক মোর কাজ/বন্ধু আবার জীবন পাবে, এই অভিলাষ”। আজ সার্থক হবেই।’

– ‘মধুসূদন দত্তের সমাধি!’- অবাক করা স্বরে বলে উঠল নীলিমা।

– ‘মেঘের কোল এটা। স্বয়ং মেঘনাদ বধ কাব্যের রচয়িতার কোলেই তোর দাদু রেখে এক দুষ্প্রাপ্য সম্পদ।

– ‘জিনিসটা কি তুই জানিস আবির?- আবিরের কাঁধে হাত দিল নীলিমা।’

– ‘আন্দাজ করতে পারছি। যার জিনিস তার কাছেই রেখে গেছে তোর দাদু। এবার হাত লাগা সমাধির সামনের মাটি খুঁড়তে হবে।’

আবিরের কথা শেষ না হতেই একটা প্রচন্ড শব্দ। গুলিটা আবিরের পেটে বাঁদিকে এসে লাগল। প্রচন্ড যন্ত্রণায় মাটিয়ে লুটিয়ে সে। চোখের সামনেটা মুহূর্তের মধ্যে ঘোলাটে হয়ে গেল। ঝাপসা দেখল সামনে দাঁড়িয়ে কোর্ট প্যান্ট পড়া একজন লোক,হাতে রিভলভার। শেষটুকু জ্ঞানে শুধু শুনতে পেল নীলিমার চিৎকার- ‘আবির..র..র…র’।

রহস্য এখনও বাকি

তিনদিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল আবির। গুলিটা পেট ছুঁয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। তাই এ যাত্রায় রক্ষা পাওয়া গেল। আবিরের মা-বাবাও হাজির নীলিমার মামারবাড়িতে।

বৈঠকখানায় এনে আবিরকে বসানো হয়েছে। খানিকটা সুস্থ এখন সে। লালবাজার থেকে পুলিশ অফিসার এসেছেন। তিনি জানালেন- ‘জিনিসটা আমরা উদ্ধার করতে পারিনি আবির। নীলিমার ফোন পেয়ে আমরা রাসকেলগুলোকে ধাওয়া করে ছিলাম। বিদ্যাসাগর সেতুর কাছে আমাদের টিম ওদের ধরেও ফেলে প্রায়। তবে মদনমোহন বাক্স সমেত গঙ্গায় ছাঁপ দেয়। ওর লাশটা পেলেও বাক্সটা পাওয়া যায়নি’

– ‘ইতিহাসের কী নির্মম খেলা! যাই হোক, আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। ওদের গ্যাংটাকে পারলে ট্রেস করুন,’ আবির জবাব দিল।

– ‘কিন্তু আবির ওই বাক্সে কী এমন ছিল যে বাবা এতসব কান্ড করলেন?’- জগদীশবাবু প্রশ্ন করলেন।

– ‘নীলদর্পণ কাব্যের পাণ্ডুলিপি। আপনাদের বাবা আর্কিওলজি নিয়ে কাজ করতেন। আমার বিশ্বাস সেই কাজ করতে গিয়েই তিনি এটা খুঁজে পান। মধুসূদন দত্ত নীলদর্পণের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। জেমস লং সাহেবকে বিট্রিশ সরকার বার বার জিজ্ঞেস করলেও তিনি এঁর নাম বলেননি। সেই ইংরেজি অনুবাদের আসল পান্ডুলিপি ছিল এটা। যার ঐতিহাসিক মূল্য অনেক’

– ‘ইস, এমন একটা জিনিস হাত ছাড়া হল। আর বাবা যে এইসব কাজ করতেন আমরা কেউ জানতাম না,’ নীলিমার মা বলে উঠেন।

– ‘জানত। কেউ কেউ জানত আন্টি। আর এই কাজের জন্যই আপনার বাবাকে খুন হতে হয়,’ আবির জবাব দিল।

– ‘খুন? বাবাকে খুন করা হয়েছে?’ – সতীশবাবু আঁতকে ওঠার মতো করে জিজ্ঞেস করলেন।

– ‘হ্যাঁ খুন। দাঁড়ান ব্যাপারটা খুলেই বলছি। তার আগে কটা কথা বলি। সতীশবাবু আপনি আপনার জুয়া খেলাটা বন্ধ করুন। নইলে আরও অনেক রকমের সাজ সাজতে হবে আপনাকে রোজ রোজ।’

– ‘কী যা তা বলছ তুমি?’ – সতীশবাবু বললেন।

– ‘একদম ঠিক বলছি। ট্রেনে হজমী বিক্রির নাম করে ভন্ড সাধু সেজে কলকাতায় যান। তারপর ওখানে গিয়ে জুয়ায় টাকা লাগান। সেদিন ট্রেনে নীলিমাকে দেখে আমাদের কাছে আসেন। তারপর কথার ছলে আমাদের পরীক্ষা করেন। আপনি ভালো করে জানতে আপনার দাদা আমাদের ডেকেছে ধাঁধার সমাধানে। আপনি এও ভাবেন যে, আপনার বাবা হয়তো কোনো টাকাপয়সার সন্ধান দিয়ে গেছে ওই লেখায়। তাই যাচাই করে দেখলেন আমরা আদৌ কাজের কিনা। পরে হয়তো আমাদের ভয় দেখিয়ে সেটা আদায় করবেন।’

– ‘মিথ্যে কথা। সব মিথ্যে কথা।’

– ‘থামুন। আপনার আর এক পার্টনারের কাছেই আমরা সব জেনেছি। লক্ষ্মীকান্তপুর স্টেশন থেকেই তো আপনারা একসাথে বের হোন। রঙ্গন সব জেনে এসেছে।’ রঙ্গনের দিকে তাকাতেই রঙ্গন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

– ‘ছিঃ সতীশ। তুই আর কত নীচে নামবি। বংশমর্যাদার তো আর কিছুই রাখলি না!’ জগদীশবাবু তিরস্কার করে উঠলেন।

– ‘আপনিও কি রাখতে পেরেছেন বংশের মান?’ জগদীশবাবুর দিকে চেয়ে বলল আবির।

– ‘মানে?’

– ‘আপনার প্রোমেটারির ব্যবসা তো প্রায় লাটে উঠেছে। আপনার বাবাও সেটা জানতেন। নিলি তোর মনে আছে ধাঁধায় লেখা ছিল ‘বুড়ো ব্যাটা গলার কাঁটা’, এই হচ্ছে সেই গলার কাঁটা। আপনি আপনার বাবাকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে গেছেন পয়সায় জন্য। এমনকি তিনি যখন কুচবিহারে তখন ফোনে তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও করেন। রঙ্গন যখন আপনার হিস্ট্রি খুঁজছিল তখন যে এসটিডি বুথ থেকে আপনি ফোন করেছিলেন তার মালিক রঙ্গনকে সব বলেছে। তাই আপনি যখন ওই ধাঁধাটা পেলেন তখন সতীশবাবুর মতো আপনার মনটাও লোভে ভরে গেল। সেটার সমাধানে আমাদের ডাকলেন। অবশ্য আপনি নিজেও খানিকটা সমাধান করতে পেরেছিলেন।’

– ‘দাদা, তোরা এত নীচে নেমে গেলি রে। কী হবে এই সম্পত্তি নিয়ে যদি নিজেরাই না একসাথে থাকি। এখন বুঝছি বাবা কেন সবকিছু নিলিকে দিয়ে গেলেন,’ নীলিমার মা পাশ থেকে বলে উঠলেন। একটা অসম্ভব ঘেন্না যে তার গলা থেকে বের হল।

– ‘কিন্তু দাদুকে খুন করল কে আবির? ওঁর মতো ভালো মানুষকে কে খুন করবে?’ নীলিমা জিজ্ঞেস করল।

– ‘ওই মদনমোহনই খুন করত ওঁকে। কিন্তু তার আগেই একজন শেষ করে দেন অম্বরীশবাবুকে। মদনমোহনের আশায় জল ঢেলে দেয় সে। তারপর থেকেই সে পান্ডুলিপির সন্ধান করতে থাকে। যখন জানতে পারে আমরাও একই কাজ করছি তখন আমাদের পেছনে গুন্ডা লাগায়। তোদের ওপর সেদিনের হামলাটাও মদনমোহনই করায়। তবে এখানে আর এটা টুইস্ট আছে।’

– ‘কি টুইস্ট?’ নীলিমা চোখ পাকিয়ে ওঠে।

– ‘আমাদের পেছনে আরও একজন লোক লাগায়। তিনি হলেন জগদীশবাবু। শিবেনের সঙ্গে সেদিন রাতে তো আপনি কথা বলছিলেন। ওপরের বারান্দা দিয়ে জঙ্গলের ওখানটা দেখা যায়। প্রথমে চিনতে না পারলেও আপনার পা বেঁকে হাঁটার ধরনটা সব পরিস্কার করে দিল।’

– ‘হ্যাঁ আমি লাগিয়েছিলাম। আমার বাবার জিনিস তোমরা যদি সরিয়ে ফেলো। সেই কারণেই লোক লাগিয়েছিলাম। বেশ করেছি!’ জগদীশবাবুর চিৎকার করে ওঠে আবিরের ওপর।

– ‘নিজের বাবাকে খুন করেও কি আপনি ঠিক কাজ করেছিলেন ?’ আবিরের চোয়াল শক্ত হয়ে এল।

– ‘মামা তুমি!’ – নীলিমার আওয়াজে ঘরটা যেন কেঁপে উঠল। বাকি সবাই মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেছে।

– ‘যেদিন অম্বরীশবাবুকে মৃত পাওয়া যায় ঠিক তার আগের দিন তার সাথে দুজন দেখা করেছিল। একজন মদনমোহন আর অন্যজন আপনি জগদীশবাবু। মদনমোহনের সঙ্গে সেদিন এই পান্ডুলিপি নিয়ে অম্বরীশবাবুর তুমুল ঝগড়া হয়। হয়তো মদনমোহনকে না জানিয়েই পান্ডুলিপিটি লুকিয়ে রাখেন তিনি। দেশের সম্পদকে দেশের বাইরে পাঠাতে চাননি তিনি। এরপরের ঘটনাটা আমার ধারনা। মদনমোহনের সঙ্গে সেই ঝগড়াটা দরজার বাইরে থেকে শুনে ফেলেছিলেন। আর তারপরেই নিজের বাবার সাথে ঝগড়ায় জড়িয়ে পরেন জগদীশবাবু। তিনি তো ভেবেছিলেন না জানি কী সোনাদানা তার বাবা লুকিয়ে রেখেছে। আর তারপরেই হয়তো খুন করা হয় অম্বরীশবাবুকে। যেটা করেন আপনি জগদীশবাবু।’

– ‘প্রমাণ করতে পারবে তুমি। সব বাজে কথা। তোমার বানানো গল্প এইসব।’

– ‘হোটেলে রেজিস্ট্রারে আপনার নাম ও তারিখ রয়েছে। তাছাড়া হোটেলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে। তার চেয়েও সেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল আপনি অম্বরীশবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর উনি ঘর থেকে বের হননি। রাতে হোটেল থেকে খাবারের জন্য ডাকলেও তিনি জবাব দেননি। পরদিন সকালে দরজা ভেঙে তারা দেখে অম্বরীশবাবু মৃত। আর যেহেতু আপনি ওঁর ছেলের পরিচয়ে হোটেলে রেজিস্ট্রার করেন তাই আপনার ফোন নম্বরেই ওরা ফোন করে জানায় যে আপনার বাবা মারা গেছেন। আপনার ভেতর তখন ভয়ে সিঁটিয়ে গেছিল, তাই তো আপনি মিথ্যে অজুহাত দিয়ে সতীশবাবুকে পাঠান বডি নিয়ে আসতে।’

একটা কথারও আর জবাব দিলেন না জগদীশবাবু। সারা ঘরটা জুড়ে তখন পিন ড্রপ সাইলেন্স। খানিক পরে আবিরই মুখ খুলল আবার- ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না জগদীশবাবু। আপনি তো কোন ছাড়। আপনার জন্য অমন একটা মানুষকে চলে যেতে হল। আপনার জন্য মদনমোহন পান্ডুলিপিটাকে শেষ করে দিল। আপনাকে কি ক্ষমা করা যায়? আর বাকি প্রমাণ পুলিশই জোগাড় করে নেবে।’

লোকাল থানাকে ফোন করে জগদীশবাবুকে নিয়ে গেলেন লালবাজারের অফিসার। নীলিমা প্রচন্ড ভেঙে পড়েছে। দোতলার ঘরে গিয়ে আবির দেখে বিছানায় মুখ গুঁজে কাঁদছে সে। আবির কাছে যেতেই বলে উঠল- ‘এটাই শেষ। আর কোন গোয়েন্দাগিরির দরকার নেই। একবারও ভেবেছিস গুলিটা যদি বুকে লাগত? কী হত তখন?’

– ‘একটা সাহেব নিজের জাতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের যন্ত্রণার কথা তুলে ধরে ব্রিটিশের সামনে। আর আমরা সেই ঐতিহাসিক দলিলটাকে বাঁচাতে অবধি পারলাম না। তুই সামান্য আঘাতেই এমন করছিস?’

– ‘বকছিস কেন? কষ্ট তো আমারও হচ্ছে’

– ‘আর কষ্ট পেয়ে লাভ নেই। আমি স্নানে গেলাম।’ – বিছানা থেকে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল আবির।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post উত্তরাধিকারী কে? | বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | শতরূপা ভট্টাচার্য্য | Bengali Detective Story
Next post পাতালেশ্বরে পিনাকী | বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | শুভাশিস দাস | Bengali Detective Story