Getting your Trinity Audio player ready...
|
“অতীন্দ্রিয় জগতকে বিশ্বাস করেন?” বিস্ফারিত ভঙ্গিমায় বললো লোকটা। আমি ভদ্রলোকটার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললাম, “তাঁর মানে আপনি বলতে চাইছেন ভূত আছে?”
লোকটা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বললো “হ্যাঁ!”
ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার গায়ে একটা নোংরা শার্ট থেকে ভোঁস ভোঁস করে ঘামের গন্ধ ছড়াচ্ছে। মাথার চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। লোকটাকে দেখে আমার সন্দেহ হল। এখানে আসার সময় একটা মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র দেখে এসেছি। লোকটা বোধহয় সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে। আজ দুদিন যাবত লোকটার বিরক্তি সহ্য করছি।
আমি যখনই এখানে আসি লোকটা কিভাবে যেন আমার গন্ধ শুঁকে হাজির হয়ে যায়। লোকটার চোখে মুখে উদাসীনতার ভাব। কথা বলার ভঙ্গিটাও কেমন অদ্ভুত। কথা বলার ফাঁকে খুকখুক করে কাশছে। তিনি উদাস স্বরে বললেন, “দুনিয়াটা হচ্ছে রহস্যে ঘেরা, এখানে রহস্যরা খেলা করে। কিন্তু সবাই সে রহস্যের খোঁজ পায়না।”
লোকটার ভাব ভঙ্গিটা খুবই বিরক্তিকর। নিশ্চয়ই নেশা ভাঙ করেছে। এই সময়টাতে পার্কে তেমন কেউ থাকেনা, তাই প্রায় প্রতিদিনই এ সময়টায় এখানে এসে বসে থাকি। চারপাশটা একটু ছায়াঘন। সুনসান নীরব একটা পরিবেশ। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকলে সৃজনশীলতা বাড়ে। আর আমার যে পরিমাণে মানসিক বিপর্যয় ঘটেছে, তাতে এই মুহূর্তে সৃজনশীলতার খুবই দরকার। এতদিন খেটেখুটে যেটুকু ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিলাম পর পর দুই চালানের বড় রকমের লোকসানে ব্যবসা লাটে ওঠার জোগাড়। আর এ কারণেই প্রতি বিকেলে এখানে এসে বসি।
লোকটা বললো, “বুঝলেন ভাই, আমাকে আপনার মত সবাই অবিশ্বাস করে। আফসোস আসল ব্যাপারটা কেউ বুঝতে পারেনা। আর এজন্যই তারা আমার দিকে সবসময়ই এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকায়। ঠিক আপনি যেভাবে তাকিয়ে আছেন।”
আমার একটা ব্যাপার খটকা লাগলো। তাই কথাটা মনে হতেই জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা ভাই, আপনি কি লেখক শ্রেণীর কেউ?”
লোকটা একটা অদ্ভুত হাসি ঝুলিয়ে বললেন, “হঠাৎ একথা কেন মনে হল?”
আমি হাত পা ছড়িয়ে হাই তুলে বললাম, “না লেখকরা গাঁজাখুরি কথাবার্তা বলে কিনা, তাই আরকি।”
আমার কথায় লোকটা তেমন বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। মুচকি হেসে বললেন, “না ভাই আমি তেমন কেউ নই।”
আমার প্রচুর সিগারেটের নেশা পেয়েছে। একটা সিগারেট ধরালাম। খেয়াল করলাম লোকটা মুখে একটা মুচকি হাসি ঝুলিয়ে আমাকে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। আমার মেজাজটা বিষিয়ে গেল। লোকটার ভিতরে দেখছি হায়া জ্ঞানটুকুও লোপ পেয়েছে।
নিজেকে সংযত করে লোকটার দিকে তাকিয়ে একটু কৃত্রিম হেসে বললাম, “সিগারেট খাবেন?”
লোকটা লোকটা বোধহয় প্রস্তুত হয়েই ছিলেন, তাই বিলম্বহীন হয়ে বললেন “হুম, চলবে।”
একটা সিগারেট লোকটার দিকে এগিয়ে দিয়ে আমি সিগারেটে টান দিলাম।
কিছুক্ষণ ভদ্র পাগলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি এসব গাজাখুরী গপ্পো কোথায় পেয়েছেন?”
তিনি বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হলেন না বরং খুশি হয়েই বললেন, “আপনি যদি আস্তিক হন তালে তো অবশ্যই জ্বীন পরীতে বিশ্বাস করবেন?”
একজন আস্তিক হয়ে জ্বীন পরীতে অবিশ্বাস না করার কোনও উপায় নাই আমার কাছে। আমি ভ্রু কুচকে বললাম, “আপনি কি তালে আলিফ লায়লার গল্প শোনাতে চাচ্ছেন?” আগের কথার খেই ধরে তিনি বললেন
“জ্বীনে অবিশ্বাস কিন্তু নাস্তিকতার শামিল?”
আমি মনে মনে বলতে বাধ্য হলাম পাগল হলেও লোকটার যুক্তি দাঁড় করানোর ক্ষমতা ভাল। লক্ষ্য করলাম লোকটার চোখজুড়ে রহস্য খেলা করছে। লোকটার ভাব ভঙ্গিমায় যা বুঝলাম লোকটা আমাকে ভুতের কাহিনী শুনিয়েই ছাড়বে। তবে লোকটা যে একটু হলেও আমার আগ্রহ জাগিয়েছে তা না স্বীকার করলে মিথ্যে বলা হবে। খুব সম্ভবত এজন্যই তাকে এতক্ষণ সহ্য করে গেছি। আমার অনাগ্রহ সত্যেও লোকটা বলতে শুরু করলো, “যারা অতীন্দ্রিয় জগৎটাকে বিশ্বাস করে না তারা পৃথিবীর ১২ আনা রহস্যেরই খোঁজ পায়না। এই অতীন্দ্রিয় জগতটাকে গায়ের জোরে অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই, স্বয়ং কোরআনে জ্বীন জাতির কথা উল্লেখ আছে। আর জ্বীন পরীরা তো সেই অলীক জগতেরই বাসিন্দা। প্রথম প্রথম আমিও ভাবতাম এগুলো স্রেফ গাঁজার কোলকের কারসাজি।” কথাগুলো বলে লোকটা থামলো। তারপর সিগারেটে শেষ একটা টান দিয়ে আবার শুরু করলো, “আমাদের গ্রামে এমন একজন লোক ছিলো তার কাছে নাকি পরী বশ করা ছিলো। আমি অবশ্য এসব গাঁজাখুরি কথা বিশ্বাস করতাম না। মাঝেমধ্যে মনে হতেন ওই ভণ্ড গাঁজাখোর মাতালটাকে পুলিশে ধরিয়ে দিই। থানায় নিয়ে আচ্ছা-মতো ঢলা দিলে ওর ভণ্ডামি শেষ হবে।” আমি নির্লিপ্ত চোখে লোকটার কথাগুলো গিলছিলাম। লোকটার মাঝে কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করলাম না। লোকটা ভাঙা ভাঙা গলায় বলে চলল।
“আমি লোকটাকে অবিশ্বাস করলেও এই অতীন্দ্রিয় জগৎটা সম্পর্কে আস্তে আস্তে আমার আগ্রহ জন্মাতে লাগলো। নিয়মিত ওই লোকটার কাছে যেতে লাগলাম। শুনেছি পরীরা অনেক রূপবতী হয়। রূপের নেশায় সবাই পাগল। আমি সবার ব্যতিক্রম হতে যাব কেন। মনে মনে ফন্দি কষলাম যে করেই হোক একটা পরীকে বশ করতেই হবে। অআমার অনাগ্রহ সত্ত্বেও আমি আস্তে আস্তে ওই লোকটার সহচর হয়ে গেলাম। আমার উদ্দেশ্য একটাই লোকটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কোনও পরীকে যদি নিজের ঘাড়ে আনা যায়। লোকটা আমাকে কড়া সতর্ক করে দিলো; বললো কেউ জেনেশুনে এই বিপদের পথে পা বাড়ায় না। কিন্তু আমার যুবক বয়স, তাই জেদ অতিরিক্ত। আমি লোকটার পিছনে অনেকদিন ঘুরলাম। শেষমেশ লোকটা আমাকে একটা আয়না দিয়ে বললো, এই আয়নার ভিতরে একটা পরীকে বশ করা আছে আমি চাইলেই পরীটাকে দেখতে পারবো। আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে আয়নাটি নিয়ে এসে প্রায়ই আয়নার ভিতরে পরীটাকে দেখতাম। কিন্তু আমি আস্তে আস্তে অনুভব করলাম পরীটা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমি কোনও খারাপ কাজ করতে পারি না। কোনও খারাপ কাজ করতে গেলেই অজ্ঞান হয়ে যাই।” লোকটা একটু থামলো। আমি একগাল হো হো করে হেসে নিয়ে বললাম, “আপনি পাগল হলে কি হবে, মিথ্যা গল্প সাজাতে আপনি যথেষ্ট ওস্তাদ।”
আমি খেয়াল করলাম লোকটার ভিতরে কোনও ভাবান্তর নেই। আমার দিকে ক্ষণিক চেয়ে থেকে বললো, “বিশ্বাস করলেন না তো? দাঁড়ান আপনাকে দেখাচ্ছি” এই বলে লোকটা পকেট থেকে একটা আয়না বের করলো। পিতলের ফ্রেম বিশিষ্ট একটা ছোট্ট আয়না। আয়নাটা আমার সামনে ধরলো। আমি খেয়াল করলাম আশপাশটা যেন এক অদ্ভুত সুগন্ধিতে ছেয়ে গেছে। হঠাৎ একটা নূপুরের শব্দ শোনা গেল আর আয়নায় ভেসে উঠলো রূপবতী নারীর প্রতিবিম্ব।
আমার সারা শরীর শিউরে উঠল। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে খুব। আমি জানি সব বিভ্রম। একটা পাগল আমাকে এত অদ্ভুতভাবে সম্মোহিত করে ফেলেছে। মেনে নিতে পারছি না। আমার শরীর থেকে রীতিমত ঘাম ঝরছে। মাথায় সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে ভাবলাম সব মিথ্যে। সব কল্পনা। থরথর করে কাঁপছি আমি। শরীর থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। আমার কপালে একটা শীতল বাতাসের ঝাপটা টের পেলাম।
আমি ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। থরথর করে কাঁপছে সারা শরীর। চারদিকে একবার দেখে নিলাম। কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম আমি কোথায় আছি। আমি আমার রুমেই আছি। বিছানার উপরেই বসে আছি। চোখটা কেমন ধাঁধাঁময় লাগছে। স্বাভাবিক হতে সময় লাগল বেশ কিছুক্ষণ। বিষয়টা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম। ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত। স্বপ্নটা যেন একদমই বাস্তব। কোনওমতেই ঘোর কাটতে চাচ্ছে না। ওই বদমাইশটা প্রতিদিন পার্কে বিরক্ত করত সেটা মানা যায়, তাই বলে আমাকে স্বপ্নেও বিরক্ত করবে?
সবকিছুই গুলিয়ে যাচ্ছে। চোখটা ধাঁধাঁময় মনে হচ্ছে।
বিছানা হাতড়ে মোবাইলটা খুঁজে পেলাম। চোখ রগড়ে দেখি ভোর ৪ টা বাজে। জগ থেকে এক গ্লাস পানি খেলাম।
জানালা দিয়ে বাইরে চোখ মেললাম। জানালার শিক গলে ভোরের জ্যোৎস্না ঘরের ভিতরে আছড়ে পড়েছে। জ্যোৎস্নার সাদা আলোর সাথে কুয়াশার ধোঁয়াটে বিন্দুর আনাগোনা। কিছুক্ষণ পরে আমি বুঝতে পারলাম কোথাও বড় কোন গোলমাল হয়ে গেছে। জানালার ওপাশে কে যেন নূপুর পড়ে হাঁটছে। সেই নূপুরের রিনিঝিনি আওয়াজ কর্ণকুহরে গিয়ে বিঁধছে। স্বপ্নের মধ্যে পাওয়া প্রখর সেই সুগন্ধটা এখনও রুমের মধ্যে বিদ্যমান আছে। জানালার ওপাশে মিহিকন্ঠে কে যেন হা হা করে হেসে উঠলো!