বিগত চার পাঁচদিন ধরে যেভাবে অনর্গল বারিপাত ঘটছে তাতে আর যাই হোক, কলকাতাবাসীর ক্ষতি হচ্ছে না। আনাচে কানাচে, দেওয়ালে যথেষ্ট পীড়াপীড়ি সহ্য করে বট, আশুতের অসংখ্য শাখা প্রশাখা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কিছু জায়গায় এই সমস্ত বৃক্ষাদি বাড়ির কংক্রিট ফাটিয়ে দিচ্ছে। মাটির তলা দিয়ে যে অজগর সদৃশ পাইপ লাইন গেছে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। বর্ষায় আর যাই হোক, বৈদ্যুতিক যোগাযোগ ছিন্ন আর পানীয় জলের সংকট বা দূষিত হওয়া নতুন ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে।
৯নং শঙ্কর বসু রোডে একটিমাত্র কৃষ্ণচূড়া গাছ। বাকি কয়েকটা রক্তিমা শিমূল, আশুত, অশোক গাছ আছে। গাছের বর্ণনা এই জন্যই দিচ্ছি, যে, অন্যত্র ব্যতীত আমাদের এই শঙ্কর বসু রোডে কম করে একটা আমাজন জঙ্গল সৃষ্টি হয়েছে। এখানে আশেপাশে তেমন বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে না। সেটাই বাঁচোয়া। আর সবদিকে যেভাবে ব্যাঙের ছাতার মত রঙ বেরঙের পায়রার খোপ বা বাড়ি গজিয়ে উঠছে, তাতে কয়েক বছরের মধ্যে বেজিং আর কলকাতার মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকবে না!
সকাল সকাল চা সহযোগে খবরের কাগজ নিয়ে বসেছি। কাগজওয়া লা আজকাল কেমন রূঢ় হয়ে গিয়েছে! রাস্তা দিয়ে এমনভাবে কাগজটা ছুঁড়ে দেয় যেন লর্ডস থেকে বল ছুঁড়ছে, এসে পড়বে ইডেন গার্ডেন্স-এ! শ্রীজাত থাকলে অবশ্য কথা ছিল না। ও যেনতেন প্রকারে লুফে নিত। আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটত না। আজ সকালে বাবু কোথায় গিয়েছেন। সাড়ে আটটা বেজে গেছে এখনও পাত্তা নেই। আমিও ব্রেকফার্স্ট করেই বসে আছি। সাড়ে দশটা থেকে পড়ানো শুরু করব। তো, এই সময়টুকু কাগজে মনোনিবেশ করলাম।
ইদানীং কাগজের প্রধান প্রধান অংশ জুড়ে রয়েছে ‘বিষমদ কেলেঙ্কারি’। এই যেমন আজকে লেখা বেরিয়েছে— “মধ্যপ্রদেশে বিষমদ সেবন করে দিনমজুরদের কাহিল অবস্থা। দেখা গেছে, অধিকাংশেরই শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রায় নেই। যারা বেঁচে আছেন, তারাও দিন আর রাতের সহিত খেলা করছেন।” এর আগেও একবার সংযোজিত হয়েছিল এমন খবর। এরপর হয়তো শুনব, কলকাতায় হানা পড়েছে। সেক্ষেত্রে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছাড়াও বাতের ব্যথা, হাড়ে হাড়ে জল জমা, মেরুদন্ড ক্ষয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপমা শুনতে পাব। আরেকটি খবর আমার চোখে পড়ল। সেটা পড়তে যাব অমনি পিঠে টোকা পড়ল।
“নগেনদা, দুটো চা আর একটা ডাবল অমলেট।”
দেখলাম, শ্রীজাত মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরেছে। গা হাত, ঘেমে নেয়ে একেকার। বর্ষা হলেও স্যাঁতসেঁতে গরম আবহাওয়া যায়নি। খুব অল্পেতেই শরীর ঘামতে শুরু করে আর দুর্গন্ধ যে কিরকম হয়, তা আর বলতে!
“গভীর মনোযোগী হয়েছিস দেখছি! দেখো, আমাদের এখানের খবরের কাগজের থেকে চা দোকানের গুরুত্ব অনেক বেশী। তুমি বলবে কেন! দেখো, আগের দিন বিকেল, দুপুর বা সন্ধ্যের সময় তুমি যাও। দেখবে, ভোট ঠিকমত হচ্ছে না, অমুক রাজনৈতিক দল ভোটের প্রচারে অভিনবত্ব এনেছে বা কোনও শ্রমিক আবার বিষমদে একমাত্র জীবনটিকে উৎসর্গ করেছেন! তাহলে, তুমি তো একসাথে এত কিছু পেয়ে যাচ্ছ। তারপরেও কাগজ!”
“না, সে নয় বুঝলাম। কিন্তু বিষমদ এল কোথা থেকে ! সেটা তো চা দোকান বলবে না। তাই না?”
—সেটা হয়তো বলবে না সুজিত, কিন্তু ত্রিমুখী রাস্তার ন্যায় চতুর্দিক দিয়ে একাধিক যানের মত মতামত তো হাজির হবেই। সেটাই ধরে নাও। আর আমি যতদূর শুনলাম, বিষমদের সুরাহা এখনও হয়নি। সুতরাং যত মত; তত পথ!
আমি ওকে কাগজটা এগিয়ে দিলাম। ও পড়তে লাগল খবরটা। দরজায় পায়ের শব্দে দেখি নগেন দা জলখাবার নিয়ে আসল। সেটা টেবিলে রেখে, একটা পেয়ালা আমায় এবং পরবর্তী পেয়ালা আর ওমলেট ওকে চালান করল। খবরের কাগজকে বুড়ো আঙুল দেখালেও আমার চেয়ে বেশি কাগজ ঐ দেখে। ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’, ‘দ্য হিন্দু’, ‘ইকনমিক টাইমস’ ইত্যাদি পত্রিকা এ অঞ্চলের হদিস পেত না, যদি না শ্রীজাত এগুলো পড়ত। সেক্ষেত্রে কার্তিকদা মানে আমাদের সবার প্রিয় পেপারকাকুকে ঝক্কি পোহাতে হয়। উনি বলেন, “না বাবারা, এটা আমি দিতে পারব না।” তবুও আমরা ওঁর থেকেই আদায় করি আর শ্রীজাত বলে, “বেশ তো, চা আর ওমলেটটা তাহলে নগেনদা-কে বলে রান্নাঘরেই চালান করি!” তারপর সব ঠিক হয়ে যায়।
“আচ্ছা, বাঁদিকের একেবারে নীচে লেজুড় হিসাবে এই খবরটা!” ওমলেট খেতে খেতে শ্রীজাত বলল। দেখলাম, ভুরুতে বেশ ঢেউয়ের রেখা প্রসারিত হয়েছে। চোখে চশমাটা নাসিকার মধ্য গগনে এসে পড়েছে।
“বিশেষ গুরুতর নাকি শ্রীজাত?”
“গুরুতর নয় সখা তবে বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচায়ক। অর্চি বন্দ্যোপাধ্যায়কে মনে আছে?”
“তোমাদের কলেজের প্রফেসর! তাই তো? সেই এশিয়াটিক সোসাইটি, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের সেমিনার। ঠিক বললাম তো? মনে থাকবে না আবার!”
“সুজিত সুজিত, ও সুজিত! তুমি এমনটা মনে রেখেছ কারণ হল সেমিনারের অতীব সুখাদ্যের পরিবেশন। রাবড়ি, দইবড়া, বিরিয়ানি, পোলাও, মন্ডা মিঠাই——কি তাই তো?”
আমি বললাম, “এসব বাজে কথা। তুমি খবরটা বল।”
ও বলল, “বেশ। শোন তাহলে। অর্চি বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন ইতিহাসের অধ্যাপিকা এবং একাধারে এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। ওঁর ‘মাগাধা এডমিনিস্ট্রেশনের’ ওপর একটা কাজ আছে। দুর্দান্ত সব তথ্যবহুল ক্ষেত্র। মানে তুমি পড়লে জানতে পারবে ইতিহাস আর অলৌকিকের মধ্যে কেমন সংঘর্ষ! কেউ কাউকে এতটুকু জমি ছেড়ে দিতে প্রস্তুত নয়। অথচ এর দ্বারা তৎকালীন কূটনীতিকরা কত অসাধ্য সাধন করেছেন। অর্চি ম্যাম এখন কলেজ থেকে বিদায় নিয়েছেন। অনলাইনেও বোধহ য় ক্লাস করান না। তাছাড়া আমি যতটা জানি, কলেজেও ওঁর সাথে অন্যান্যদের তেমন সখ্যতা নেই। সবাই ভাবছে, উনি এখন মরুভূমিতে স্বর্গোদ্যান খোঁজার বৃথা চেষ্টা করছেন! এই দেখ, আসছে সোমবার এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রথম সেমিনার। বক্তা- অর্চি বন্দ্যোপাধ্যায়।”
আমি দেখলাম, শুধুমাত্র দু’চারটে কথা বলা আছে। আসলে অতিমারির প্রভাবে সেভাবে কিছুই স্বাভাবিক হয়নি। সোমবারে সেমিনার আছে। এশিয়াটিক সোসাইটি এই প্রথম খুলছে। এতটুকুই। নিচে বক্তাদের নয় বরং কেবলমাত্র একজন বক্তার নামই দেওয়া আছে। অর্চি বন্দ্যোপাধ্যায়।
(২)
মধ্যাহ্নের চড়া তেজ এসে পড়েছে। ল্যাপটপে অনলাইন ক্লাস নেওয়ার সময় বুঝিনি এক পশলা বৃষ্টি শেষ হয়ে আকাশ ইস্পাতের ন্যায় চকচক করছে। কৃষ্ণচূড়ার লাল পুষ্পসজ্জা আকাশ বিদীর্ণ করে দিচ্ছে। আমাদের এই বাড়িটা বেশ মনোরম পরিবেশে আচ্ছন্ন। আগের বছর গ্রামের বাড়ি গেছিলাম বটে কিন্তু সেভাবে থাকতে পারিনি। চাষের খুঁটিনাটি বাবা দেখেন। আমি নিমিত্ত মাত্র। আবার ফিরে আসলাম। শ্রীজাতদের কলেজ এখন বন্ধ। সেভাবে পড়াশুনা গতি পায়নি। বেকার জীবনটা আবার কেমন উত্তেজিত হয়ে মনের ফাঁকে ফাঁকে আশ্রয় খুঁজছে। কলেজে পড়ার সূত্রেই আমাদের আলাপ। এ বাড়ির কর্তা মদন পুরকায়স্থ গত হয়েছেন অনেক আগেই। সুতরাং আমরাও থেকে গেলাম। উনি ঘর দুটো না দিয়ে গেলে যে কি বিপদে পড়াতাম তা বলবার নয়।
বিকেল পর্যন্ত শ্রীজাতর কপালে ভাঁজ দেখেছি। ইতিপূর্বে খবরের কাগজ নিয়ে ওকে এত ভাবতে দেখিনি। একবার বলল, “আচ্ছা, অর্চি ম্যামের বিষয়টা আন্দাজ করতে পার! ফোন করব একবার! না, এখন উচিত হবে না। সেমিনারের আগে এঁরা খুবই ব্যস্ত থাকেন।”
আমি বললাম, “তোমাদের রাজশেখর বাসুর সাথে কথা বলতে পার তো!”
“সুজিত, উনি সবে সুস্থ হয়ে ফিরেছেন। অতিমারির নৃশংসতা ছেড়ে ফিরে এসেছেন তাই কত না! ওঁকে ফোন আপাতত নয়। তবে একটা কাজ করতে পারি। কাল সকাল এগারোটায়। তৈরি থাকিস।”
বেশ শতবর্ষ পর বহিরামুখী হলাম বোধ হচ্ছে। গাড়ি ঘোড়ার প্যাঁ প্যাঁ শব্দ আদতে এত সুখকর হয়ে উঠবে ইতিপূর্বে ভাবিনি। যাই হোক, এগারোটার আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম পার্কস্ট্রীটের এশিয়াটিক সোসাইটিতে। উইলিয়াম জোনস সেকালে নির্মাণ করেছিলেন এই অতীব আশ্চর্যজনক প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশরা চলে গেলেও এর ঐতিহ্য এতটুকু ম্রিয়মাণ হয়নি। সাদা বীমগুলো এখনও সভ্যতার দ্বাররক্ষক হয়ে বিরাজ করছে। ভেতরটা অপরিষ্কার এটা বলতে হয়। কারণ বিগত ন’মাসের একদিনও এরা কেউই এখানে আসেননি। আমাদের দেখে প্রৌঢ় ভদ্রলোক বললেন, “এখানে সেমিনারে কেবল ম্যাডামই আসবেন। একটু আগেই উনি এসছিলেন। চলে গেলেন। আর কাউকে বোধহ য় অনুমতি দেবে না কর্তৃপক্ষ!” এরপর আর কিই বা জিজ্ঞেস করার থাকে! ঘরে বসে বসে চতুষ্কোণী পর্দায় মন সংযোগ একমাত্র পন্থা। কিন্তু শ্রীজাত দেখলাম, বাঁশির সুর অন্যদিকে প্রেরণ করছে। ও বলল, “আচ্ছা, আমায় যদি একটিবার ভেতরে যেতে দিতেন…” কথা শেষ হল না। সিকিউরিটি অনন্ত বাগচী বললেন, “একদম নয়।” শ্রীজাত বলল, “বেশ, তাহলে আমরা পেছনটা একবার দেখে আসি। ভেতরে তো যেতে পারব না। বাইরে দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে চলে যাব।” যান্ত্রিক টুঁ ট্যাঁ শব্দের সাথে দৈহিক তাপমাত্রা এবং কয়েকটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যাওয়ার আদেশ দিলেন।
আমরা বিল্ডিং-এর চারিপাশ ঘুরে দেখতে লাগলাম। কিছুটা যেতেই শ্রীজাত দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি বললাম, “কি হল! দাঁড়ালি যে!” ও,চারদিকটা দেখে নিয়েই দেওয়ালের একপাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। বলল, “সুজিত এর পাশে একটা দরজা আছে, সেটা ঠেল জোরে। আমি নজর রাখছি।” অগত্যা আমি তাই করলাম। আশ্চর্য হলাম বটে কিন্তু ওর যে একটা মতলব আছে সেটা চাক্ষুস করার জন্যই চুপ করে গেলাম। আলিবাবার অভিনব গুহাপ্রস্তর সঞ্চালনের মত মড়মড় শব্দ করে দরজা খালি খুললোই না, বরং ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেল। আমি আর ও, দুজনেই ‘থ’ হয়ে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলাম।
ভেতরে ঢুকে হাঁচি, কাশি, গলা ধরা সবটাই হল। সুপ্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে এসে আমরা উপনীত হয়েছি। শ্রীজাত বলল, “পোডিয়ামের দিকে চেয়ে দেখো সুজিত। তবে, বুঝতে না পারাটা স্বাভাবিক।” আমি দেখলাম, সেখানে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি জাতির প্রতিভূ হয়ে বসে আছেন। অদ্ভুত তৈলচিত্র। সত্যিই যেন জীবন্ত। তার সামনে একটা মাঝারি সাইজের বোর্ড। তাতে সেমিনারের টপিক লেখা আছে, “poison and damsels— Are they real!”
ল্যাপটপে সেমিনার আরম্ভ হল। অর্চি বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের পরিচয় এবং কি বলতে চলেছেন তার একটা ছোট্ট ভূমিকা দিলেন। ভদ্রমহিলা বেশ ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। সামনের অধিকাংশ চুল সাদা। চোখে মোটা গ্লাসের চশমা। একটা চুড়িদার পরে বক্তৃতা দিচ্ছেন। অবাক হলাম, কারণ পোশাক বেশ অগোছালো। চশমার ফাঁকে ফাঁকে মাঝেমধ্যে কালো বৃত্তাকার ছোপ বেরিয়ে আসছে। শ্রীজাত ঠিকই বলেছিল, সেমিনারের আগে এঁরা দিন আর রাত এক করে দেন। খাওয়া দাওয়া, ঘুম সমস্ত কিছুই ‘রিসার্চ’ নামক শব্দগুলোর ছায়ায় অন্তর্হিত হয়ে যায়। পোডিয়ামের ওপর উনি একাই দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে কয়েক গোছা কাগজ। আমি আর শ্রীজাত মন দিয়ে শুনছিলাম এক একটা কথা। কেন জানি না মনে হচ্ছিল, পরবর্তী দিনলিপি এই স্কলারের নির্ধারিত পথেই অগ্রসর হবে। এঁর হাত ধরেই তার আত্মপ্রকাশ। হয়তো বা এঁর হাতেই সর্বনাশ থেকে বাঁচার উপায়!
“আজ, আমি যা বলব তাতে হয়তো আপনারা ভাববেন আমি কেবল আপনাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মধ্যযুগে প্রত্যাগমন করতে বলছি কিন্তু তা নয়। প্রথমে তিনটে সাধারণ ঘটনা আমি উল্লেখ করি— মার্চ, এপ্রিল আর সপ্তাখানেক আগে ঘটে যাওয়া বিষমদ কেলেঙ্কারি আমার আলোচনার বিষয়। এ সম্পর্কে বিবিধ তথ্য লাভ করতে আমাদের ফিরে যেতে হয় আনুমানিক খৃষ্টপূর্বাব্দ চতুর্থ শতকে। ভারতবর্ষ তখন খন্ডিত। ভিনদেশি বা য়াবানরা তখন ভারতে আক্রমণ হানছে। অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আলেকজান্ডার আর গ্রীক সেনারা।
এদেশীয় রাজা তখন নন্দবংশের শেষ সম্রাট ধনানন্দ। অত্যন্ত অত্যাচারী এই শাসক দেশের শাসনভারের পাঠ চুকিয়ে আমোদে দিনাতিপাত করছেন। মদিরা বা সুরা এবং নারীর সংস্পর্শে থাকাটাই বেশি কামনা করেন। তখন দেশকে বাঁচানোর কথা ভাবছেন পন্ডিত চাণক্য। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং একাধারে বিচক্ষণ সুপন্ডিত। অচিরেই বুঝতে পারলেন ধনানন্দকে দিয়ে অখন্ড ভারত গঠন কার্যত প্রস্তরখন্ডে মাথা ঠোকার সামিল। তাছাড়া ধনানন্দ ছিলেন উগ্র, আচার ব্যবহারের সমস্তটাই মদের নেশায় নিমজ্জিত করেছেন। শেষমেশ বালক চন্দ্রগুপ্তকে দিয়ে তাঁকে উৎপাটিত করলেন। মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠা হল। নন্দবংশের যবনিকা পতন ঘটল।
এই তথ্য কমবেশি অনেকেই জানেন। আর এটাও জানেন যে চাণক্য পন্ডিত বালক চন্দ্রগুপ্তের খাদ্য তালিকায় সামান্য বিষ মিশিয়ে রাখতেন। যাতে ভবিষ্যতে অন্তত বিষের মত গোপন আর কাপুরুষোচিত হাতিয়ারে তার মৃত্যু না হয়। ফলে, শরীরে একধরনের ক্ষমতা আপনা হতেই সৃষ্টি হয়। অভ্যস্ত হয়ে গেলে ছোটো খাটো কোনও বিষই আপনার ক্ষতি করতে পারবে না। যাকে ইংরাজীতে ‘Mithridatize’ বলে।
চাণক্য, মৌর্য্য প্রশাসনের ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারী গুপ্তচরদের অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এদের ক্ষেত্রেও তাই। কুমারী বয়স থেকেই বিষের প্রয়োগ। তারপর এর থেকেই জন্ম নেয় বিষকন্যা। যারা বিষ দিয়ে গ্রামের পর গ্রামের উজাড় করে দিতে পারে। তবে, অনেকেই এটা মিথ বলে ধরে নিয়েছেন।”
আমি আর শ্রীজাত আলোচনা শুনলেও একটা জিনিস লক্ষ্য করছিলাম। জনসংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। বেশিরভাগ কেউই শুনছেন না। সৌজন্য ধর, দীনেশ রায় প্রমুখরা প্রশ্নের সময় কিছুই বললেন না। অচিরেই সেমিনারের দফারফা হল!
(৩)
পরের দিন কাগজে দুটো জিনিসে আমরা চমকে গেলাম। এক, কলকাতার নামকরা রেঁস্তোরায় খুন এবং উল্টোডাঙ্গায় অর্চি বন্দ্যোপাধ্যায় গত হয়েছেন। শ্রীজাত বেশ আনমনা হয়েই বলল, “এসো সুজিত, ক্ষতি যখন হয়েই গেছে আর কী করা যাবে!”
বিধান সরণীর কাছে ম্যামের ফ্ল্যাট। অফিসার যুধিষ্ঠির হাজরা তদারকি করে বললেন, “শ্রীজাত, কাল রাতে শোয়ার আগেই হয়েছে। আর, রুমে কিছু পেলে জানিও।” পরবর্তী ক্ষেত্রে কী হবে জানি না, তবে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের কার্ড আর দেখাতে হল না। আমরা সিঁড়ি দিয়ে ভেতরে গেলাম। যুধিষ্ঠির হাজরা ওর সুপরিচিত। সেক্ষেত্রে ঝক্কি পোহাতে হল না।
দরজা খোলাই ছিল। মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি একটা ছোট্ট ডায়েরি বার করে যা দেখছি, সেসব নোট করতে লাগলাম। শ্রীজাত চারপাশ শুঁকে নিয়ে বলল, “সুজিত, দুর্গন্ধ! এটা কিসের বলতে পার! বেশ অচেনা।” প্রশ্বাস নিয়ে দেখলাম সত্যিই একটা গন্ধ বাতাসকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে। পাশের ঘরে যেতে গিয়ে হঠাৎ যেন মস্তিষ্কের ভেতরটা ঝনঝনিয়ে উঠল। শিরা উপশিরায় রক্ত চলাচল দ্রুত হয়েই কাঁপুনি সৃষ্টি হল। মনে হল সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে অনৈতিক কিছু ঘটছে। পেছনে একটা হ্যাঁচকা টানে আমি প্রায় মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়লাম। সাথে বৃষ্টিস্নাত ময়ুরের কেকাধ্বনি আর ঝুমুরের একপ্রস্থ স্বর ভেসে এল!
চোখ খুলতেই দেখলাম, এক বিশালাকার মধ্যপ্রদেশ নিয়ে যুধিষ্ঠির হাজরা দাঁড়িয়ে আছেন। শ্রীজাতর গলা পেলাম। “এই সুজিত, সুজিত, এখন কেমন!” ওর গলায় নিজের সখ্যতা ভরা ডাক শুনে কেমন শক্তি ফিরে পেলাম। ওখান থেকে ফেরার সময় কোনও কথা হল না। চলন্ত গাড়ির জানলায় মাথা দিয়ে আমি আবার ঘুমে ঢোলে পড়লাম।
দিন চারেক পর সুস্থ হলাম। শ্রীজাত কলেজে যাওয়া আরম্ভ করেছে। ওদের নতুন প্রফেসর সূচনা রায় এসছে। অল্প বয়সী মেধাবী ছাত্রী। ওঁর বাবা একসময় ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্টের হেড ছিলেন। ফোনে ওপাশে সূচনা বলছে, “হ্যাঁ, বলছি তুমি একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারবে শ্রীজাত দা! আমি আসলে হাঁদি একটা। সব তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি।” শ্রীজাতকে দেখলাম এই প্রথম কেস ছাড়া বহিরাগত কোনও বল ওকে এত টানছে। ভালো লাগছে ওকে দেখতে। সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে ভালো করে চুল আঁছড়ে চলে গেল।
বিকেলে আবার আমাদের দেখা হল। বলল, “সূচনা একেবারে আমাদের স্যারের মতন। তবে, একটা বিষয়ে কেমন একটা গন্ধ!” আমি সিগারেট ধরালাম। বললাম, “কিসের গন্ধ! রহস্য নাকি!” ও বলল, “না, তবে অর্চি ম্যামের ঐ রিসার্চ ওয়ার্ক নাকি আদতে মিথ! এটা ওর ধারণা। দেখো, ম্যাম বলতে চাইছেন খোলা আকাশের নিচে এই বিষকন্যা ঘুরে বেড়াচ্ছে। মদে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করছে। কিন্তু কারোর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। কারণ এরা বিষয়টা বুঝতেই চাইছে না। কলেজ না করে দিয়েছে এ ব্যাপারে। তারপর ম্যাম আর বেঁচে নেই।”
“আচ্ছা, সেদিন আমি অজ্ঞান হলাম কি করে?”
“সুজিত, এটা অনবদ্য একটা ব্যাপার। ঠিক যতটা ভয়ংকর, ততটাই সুন্দর। তারপর আমার দিকে মুচকি হেসে বলল, ঐ ঘরটায় poison ছিল। ডিকশনারি বলছে, এই poison-এর বাংলা করলে দুর্গন্ধকেও বোঝায়। আমি তোমায় বললাম না, সেদিন ঘরে কিসের একটা বিদঘুটে গন্ধ বের হচ্ছিল।”
এরই মাঝে একদিন যুধিষ্ঠির হাজরা ফোনে বললেন, “শ্রীজাত, ন্যাচারাল ডেথ! মানে ঐ আচমকা কিছু দেখে বিস্মিত হয়েই ওঁর মৃত্যু হয়েছে।”
যুধিষ্ঠির হাজরাকে না জানিয়ে ও একটা ডায়েরি গোছের এনেছিল। ওটা অর্চি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত ডায়েরি। পড়তে পড়তে আনমনা হয়ে বলল, “সুজিত, এটা রিসার্চ ওয়াক। আমি আর তুমি ছাড়া আর কেউ যেন এ বিষয়ে জানতে না পারে। খেয়াল রেখো।” আমি বললাম, “আমি আপাতত মনোবিদ্যা ছেড়ে বায়োলজি নিয়ে পড়েছি। সুতপার স্যারের শরীর নাকি বেশ খারাপ। ওটা তুই দেখ।”
এক্ষেত্রে বলে রাখি অর্চি ম্যামের মারা যাওয়ার দিন পার্ক স্ট্রীটের একটি নামি রেঁস্তোরায় খুন হয়েছে। যুধিষ্ঠির হাজরা কনফার্ম করলেন, “শ্রীজাত, এটাও একই। মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে এসছে। একটা ছোকরা গোছেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়, সে বলে কিছুই জানে না।”
হঠাৎ কি মনে হল, শ্রীজাত ডায়েরিটা বিছানায় ঝপ করে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “এই, সুতপার স্যারের বাড়ি কোথায়!” আমি বললাম, “দাঁড়াও, আমি বলে দিচ্ছি। আমি জানি ওকে। ওর নাম সুবিমল দাস। বেকার রোডে বাড়ি।”
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। জুতোর পচপচ শব্দে পিছনে কাদা ছিটোচ্ছে। আমরা প্রায় হনহনিয়ে হাঁটতে লাগলাম। একটা অজানা লক্ষ্যে উজ্জ্বল আলোকবিন্দু হাতড়ে বেড়াচ্ছি। জানি না কোথায় বিপদ ঘাপটি মেরে আছে। আন্দাজ পঁচিশ মিনিট পর আমরা পৌঁছালাম। দোতলা বাড়ি। গেট খুলে দিলেন এক সৌম্যকান্তি পুরুষ। সুবিমল আমাদের ঘরে বসতে বললেন।
“বলুন, মানে এত ব্যস্ততা! কোনও গুরুতর কিছু?”
আমি বলার আগেই শ্রীজাত বলল, “গুরুতর তো অবশ্যই! আসলে আমার আবার সবেতেই সন্দেহের বাতিক আছে। সে জলে কুমীর আর ডাঙায় বাঘই থাকুক না কেন, খুঁজে দেখাটাই আমার কাজ। এই হল আমার কার্ড।”
সুবিমল প্রায় কম্পিত হস্তে কার্ডটা নিয়ে বলল, “গোয়েন্দা! তারপর আমার দিকে ঘুরে বলল, সুজিত তুমি তো বলোনি আগে! তোমার সাথে, একজন গোয়েন্দা থাকেন!”
শ্রীজাত বলল, “ভয়ের কোনও কারণ নেই। খালি কয়েকটা প্রশ্ন।”
“বলুন।”
“আচ্ছা, আপনি সেদিন রেঁস্তোরায় ঠিক কখন গিয়েছিলেন?”
“হুম, আমি গিয়েছিলাম অনেক রাতে, ন’টার সময় হবে।”
“আপনি ন’টার সময় কি দেখলেন? রেঁস্তোরায় অনেক লোক ছিল নাকি খালি! ঠিক কে কোথায় ছিল, মনে করতে পারবেন?”
সুবিমল মুখের ওপর একবার হাত চালিয়ে বলল, “সব মনে নেই। তবে, পাশে দু’জন শর্ট ড্রেস পরা মেয়ে বসেছিল। ওদের সামনের দিকেও একটি মেয়ে ছিল। তাছাড়া নিচে প্রচন্ড জোরে গান চলছিল। আর কিছু জানি না।”
শ্রীজাত বলল, “আচ্ছা, এমন কিছু খেয়ে ছিলেন যা অস্বাভাবিক ঠেকছিল!”
সুবিমল এবারেও মাথা নেড়ে বলল, না। সেরকম বোধ করিনি। এরপর আমরা ঘর ছেড়ে বাইরে চলে আসি। শ্রীজাতকে দেখে মনে হল বেশ অখুশি! আশানুরূপ ফল বোধহয় হল না। এই সময় হঠাৎ পেছন থেকে কে ডাকল, ‘এই সুজিত, শোনো একবার।’ ঘুরে দেখি, সুবিমল। শ্রীজাত দাঁড়িয়ে রইল। আমি গেলাম ওর কাছে। তারপর ফিরে এসে বললাম, “এই শ্রীজাত, ও বলল সেদিন রাতে একজনের বোতল থেকে জল খেয়েছিল। একটি মেয়ে। মুখটা মনে নেই, তবে ঠোঁটের লিপস্টিক নাকি বিকট রঙের!”
শ্রীজাত চমকে উঠে বলল, “বিকট! মানে কি রকম!”
আমি সুবিমলের কথাটা বললাম। ঠোঁটের লিপস্টিক হল বেগুনি রঙের এবং তার মাঝে মাঝে কালো কালো ফোঁটা।
“সত্যিই বিকট!” বলল, শ্রীজাত।
(৪)
এ ক’দিনে আমরা ডায়েরি পড়ে সম্যক ধারণা লাভ করেছি। বিষকন্যাকে নির্মাণ করতে যে কিরকম কাঠ খড় পোড়াতে হয়, তাও জানলাম। মাঝে মাঝে শিউরে উঠতে হয়, সেসব কাহিনি শুনতে গেলে। ডায়েরির এক জায়গায় বলা হচ্ছে, “কথাসরিতসাগর, বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস ইত্যাদি ঐতিহাসিক রচনায় সমসাময়িক রাজনীতি, সমাজব্যাবস্থা ছাড়াও চরবৃত্তির ক্ষেত্রে এই বিষকন্যাদের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। ‘Vishmayi kanya,’ ‘vishangani’ ইত্যাদি শব্দ চয়ন করা হয়েছে। ইংরাজী শব্দ ‘Mithridatism’ এর উল্লেখ আছে। ‘A plan to put an end of the Alexander great – poison damsels’ অর্থাৎ তখন বীর আলেকজান্ডারের রথের চাকা থামাতে বিষকন্যাদের প্রেরণ করা হয়েছিল। এছাড়াও ইংরাজী হরফে লাল পেন দিয়ে হাইলাইট করা হয়েছে- It depends on the poison but sometime the process of building up an immunity to poison is referred to as mithridatism, after legends about king Mithridates the sixth. After his father was poisoned, Mithridates vi decided to subject himself to a daily routine of all known poisons to become immune to poison. এর বাংলা করলে এটাই দাঁড়ায় যে, বিষ প্রয়োগে পিতার মৃত্যু ঘটায় তার পুত্র অর্থাৎ পরবর্তী রাজা শুরু থেকেই খাদ্যদ্রব্যের সাথে নিয়মিতভাবে বিষপান করা শুরু করলেন যাতে পরবর্তীকালে ভুলবশত ছোটোখাটো যে কোনও বিষ সেবন করে নিলেও তার কিছুই হবে না।
শ্রীজাত হেসে বলল, “গোদা বাংলায় বিষের মুন্ডচ্ছেদ!”
আমরা যত পড়ছি ততই যেন বিস্মিত হচ্ছি। একবিংশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এরা দিব্যি নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে। অবশ্য পৃথিবীতে সবকিছু সায়েন্স দিয়ে হয় না। প্রকৃতির মত ধরিত্রীও আমাদের কাছে জ্ঞানের দিক দিয়ে অধরা। সমগ্র সভ্যতাকে উজার করে দিলেও আমরা সেই সমস্ত রহস্য উদঘাটন করতে পারব না। শেষ পর্যন্ত ‘বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকুই বা চিনি!’ এ কথা বলতেই হয়।
শ্রীজাত পড়তে পড়তে মুচকি হেসে বলল, “বাবা, এদের আবার ডায়েট, রূপ, যৌবন, কেশের সৌন্দর্য ইত্যাদির বিবরণ আছে।” কথাটা বলা মাত্রই ওর মুখে কেমন একটা আঁধার নেমে এল। কপালের দাগ চওড়া। “এখানটা পড়ছি সুজিত, একটু তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন যদিও, শুনিস। দুধের সাথে একধরনের নীলাভ তরল এরা পান করে। বক্ষদেশ জাগরিত হওয়ার সাথে সাথে এদের ডায়েট চেঞ্জ হয়। নিজ শরীরকে এরা শিশির ভেজা প্রজাপতির পালকের ন্যায় মেলে ধরতে সুগন্ধি ব্যবহার করে। আমি যেদিন এই মেয়েকে প্রথম দেখি… সত্যিই অপরূপা! চোখের দৃষ্টিতে উত্তপ্ত লাভা যেন, ঠোঁটের কোণে হাসি যেন সমগ্র পৃথিবীর ধ্বংস বহন করে চলেছে। মধ্যযুগীয় রীতি দ্বারা অঙ্কিত এই মেয়ের শরীর। ঝুমুরের শব্দে কটিদেশ আচ্ছন্ন কেশরাশি যেন উল্কা পতনের সামিল। জঠরদেশের গভীর উপত্যকা আমায় আচ্ছন্ন করে। কিন্তু ও বিষকন্যা! মোহময়ী!”
“সুজিত, ধরো তুমি তোমার সামনে এই মেয়েটিকে দেখছ, কি করবে তখন?”
আমি ভেবে বললাম, “যার এক কামড়েই ভবলীলা সাঙ্গ হবে, সেক্ষেত্রে যঃ পলায়তি স্বঃ জীবতি!”
ও সিগারেট ধরিয়ে বলল, “একবার ভাব সুজিত, খেয়ে দেয়ে তুমি উঠেছ বিছানায় শোবে বলে! একটা বই নিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে ঘরের বাতি বুজিয়ে দেখছ সামনে অসামান্য সুন্দরী সেই বিষকন্যা দাঁড়িয়ে আছে। ।”
আমি বললাম, “হুম, সত্যিই অস্বাভাবিক!”
“এটাই হয়েছে ম্যামের সাথে। তোমার কতটা মনে আছে জানি না, যাওয়ার সময় দেখলাম ম্যামের গায়ে নাইট ড্রেস আর স্টাডি রুমে তখনও ল্যাম্প জ্বলছে।”
(৫)
আজ সকালে শ্রীজাত কোথায় বেরিয়েছে। আমি সুতপাকে পড়া বোঝাচ্ছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম ওর স্যারের কথা। বলল, “স্যার এখন দিব্যি আছেন।” শ্রীজাত নেই দেখে আমি ডায়েরিটা উলটে পালটে দেখছিলাম। হঠাৎ একটা ছবি আমি দেখতে পাই।
শ্রীজাত আসতে বললাম ব্যাপারটা। ও, যুধিষ্ঠির হাজরাকে ফোনে বলল, “আপনি একটু বড়বাজারে সুলেখা হার্ডওয়্যার সম্পর্কে খোঁজ নিন।” ফোন রাখতে আমি বললাম, “আচ্ছা, ছবিটায় অর্চিম্যাম দাঁড়িয়ে আছেন। সেলফি নেওয়া। দোকানটার ছবি তো এমনিও চলে আসতে পারে।” ও, কিছুই বলল না।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। সারা সকাল পড়িয়ে সময় কেটেছে। দুপুরে খেয়ে একটু দিবানিদ্রা পর্যন্ত হয়নি। শ্রীজাত কিন্তু খালি সিগারেট টেনে বিছানায় হাতের ওপর মাথা রেখে জানলায় চেয়েছিল। সামনে আমাদের প্রিয় কৃষ্ণচূড়া। আমি বললাম, “এই কৃষ্ণচূড়াকেই দেখো না। সকালে কেমন সুন্দর দেখতে লাগে। রাতে এর চরিত্র আলাদা হয়। তখনও সে অন্যদের চেয়ে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যে বিরাজমান।” দেখলাম, বলা মাত্রই শ্রীজাত হাঁ করে চেয়ে রইল আমার দিকে। বলল, “সকালে একরকম, আবার রাতেও অন্যরকম! কি করে!” আমি বললাম, “হবে না! বা রে! এটা তো কৃষ্ণচূড়া! বট, আশুতের মত সাধারণ গাছ তো নয়!” ও বলল, “সত্যিই, মেয়েটা সাধারণ নয়!” আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “শ খের গোয়েন্দাগিরি চরমে! কলেজের ক্লাস শুরু হল বলে!” ও দেখলাম, বিড়বিড় করতে করতে পায়চারি করতে লাগল।
অবশেষে যবনিকা তার নিকষ শাখা প্রশাখা নিয়ে আমাদের সামনে আবির্ভূত হল। আমরা একটা ক্যাব বুক করে ফ্লাইওভার দিয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চললাম। যাওয়ার পথে একবার শুধু বলল, “সুজিত, কার্তিক দা-কে বললে আসাম ট্রাইবুন এনে দিতে পারবে! হবে না বোধহয়!” আমি অবশ্য চুপ করে রইলাম। ও এমন সময়ে এই রকমই আচরণ করে। এটা অবশ্য পাগলামির লক্ষণ বলে আমি অন্তত মনে করি না।
উল্টোডিঙি নাম ছিল একসময়ে। কত জঙ্গল সাফ করে যে এই অংশটুকু জীবন্ত হয়ে বাসের উপযোগী হয়েছে তা ভাবনার অতীত। তবুও ঝোপ ঝাড়ে বেশ ঝিঁঝিঁপোকারা গিটার বাজাচ্ছে। রাত প্রায় দশটা। পুলিশের একজন লোক এখানে সেদিন থেকেই রয়েছেন। আমরা কথা বলে ভেতরে গেলাম। অন্ধকার সিঁড়ির কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অধিকাংশ বাসিন্দারা ভেগেছেন। যারা আছেন তারাও নীরবতা পালন করছেন। একটা টর্চ বার করে ও বলল, “অতি সন্তর্পণে সুজিত। কিছু স্পর্শ তো করবেই না, আর খাবেও না। ঠিক আছে! এখানে আমাদের আগেও কেউ এসেছে।” আমি প্রায় অবাক হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম….ও ফিসফিসিয়ে বলল, “বিশাল মধ্যপ্রদেশ ছাড়া যুধিষ্ঠির হাজরার আর কিছুই নেই! একটা লোক নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে গেছেন। যাই হোক, এসো।”
সেদিন অর্চিম্যামের ফ্ল্যাটে সন্দেহের বশেই গেছিলাম। দিন আর রাত! ভিন্ন চরিত্র কিনা! সিঁড়ির প্রতিটা ধাপ আমরা টর্চের আলোয় দেখে দেখে উঠতে লাগলাম। খাঁড়া সিঁড়ি। ধরে ওঠা মানা। ম্যামের আত্মীয় পরিজনেরা হয়তো দেখে বিদেশে ফিরে গেছেন। তাছাড়া পুলিশি কান্ডজ্ঞানহীনতা নাকি অন্যকিছু! দেখলাম, দরজা ভেজা দেওয়া। দরজায় মড়মড় শব্দ হল একবার। আমরা ভেতরে গেলাম। সেখানে অবশ্য একটা পীতবর্ণের আলো জ্বলছিল। আপাতত আমরা ছাড়া কেউ নেই। শ্রীজাত পকেট দিয়ে কয়েকটা বৃত্তাকার জিনিস বার করে ভেতরে ছুঁড়ে দিল। গোল জিনিসটা মেঝের সাথে ঠক্কর খেতে খেতে ভেতরে গড়িয়ে গেল। বুঝলাম এগুলো মার্বেল বা গুলি। নিশ্চিত হলাম, ভেতরে কেউ নেই।
মোট তিনটি রুম। একটা বাথরুম আছে। সেখানে শ্রীজাত ভালো করে দেখে নিল। নিকাশিটা পরীক্ষা করল। বেসিনের গন্ধ নিল। ঘরের মেঝেতে একবার টর্চের আলো ফেলে দেখল, বলল, ‘পায়ের ছাপটা হারিয়ে ফেলেছি।’ তারপর এটা ওটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আমরা কিছু পেলাম না। ঘড়িতে এবার ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। এক একটা শব্দ যেন বুকের পাঁজরের কাছে দামামা বাজাচ্ছে। তারপর অন্ধকার হাতড়ে একটা শোফা গোছের পাওয়া গেল। সেখানেই দুজনে বসে রইলাম। শ্রীজাত বলল, “কিছুই নেই। বেকার দমবন্ধ করা পরিবেশ। একটা সিগারেট হলে ভালো হত।”
কতক্ষণ ওভাবে বসেছিলাম জানি না, হঠাৎ একটা শব্দে দুজনে নড়ে উঠলাম। দরজাটা মনে হল খুলেছে কেউ। আমরা শোফার পিছনে চলে আসলাম। যতটা সম্ভব গিরগিটির ন্যায় নিজেদের লোকানোর চেষ্টা করলাম। প্রচন্ড গরমে জামা ভিজে গিয়েছে। দেখলাম, ও একেবারে স্থির। ঘাস আর জমে থাকা খড়কুটোর মধ্যিখানে যেভাবে হিংস্র চিতারা বসে থাকে, ঠিক সেভাবেই। আগন্তুক সামনে এলেই তার তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। একটা দীর্ঘকায় ছায়ামূর্তি। সম্পূর্ণ কালো পোশাকে আচ্ছন্ন। ধীর গতিতে টেবিলের কাছে আসল একবার। এদিক সেদিকে কী যেন খুঁজছে। মনে হল, এই প্রাণীটাই রাতবিরেতে এখানে যাওয়া আসা করে। এরই পায়ের ছাপ আমরা পেয়েছি সিঁড়িতে। আর তখনই বিকট একটা শব্দ করে লোকটা পড়ে গেল। সারা ঘরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। লোকটা বোধয় কিছু একটার ওপর পা দিয়ে ফেলেছে। মিনিট তিনেকের মধ্যেই সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
ভোরের দিকে একটা সবজি-ফল বিক্রেতার গাড়ি করে আমরা ঘরে ফিরলাম।
(৬)
আজ সারাদিন আবার বৃষ্টি। কাল রাত প্রায় পুরো জাগা। আমি তবুও কয়েকজন নতুন স্টুডেন্টকে পড়া বুঝিয়ে দিলাম। ওদের মধ্যে এখনও পড়ুয়া ভাব আছে। দেখে ভালো লাগল। এখন অনেকেরই পড়াশোনা থেকে ইচ্ছে চলে যাচ্ছে। এদের দেখলে তবু মনে আশার সঞ্চার হয়। আয়তাকার যান্ত্রিক চৌহদ্দি পেরিয়ে ছেলে মেয়েরা আবার বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজবে সেটা ভাবাই যায় না। শ্রীজাত অবশ্য পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। বিকেলের দিকে একবার সুতপা এসছিল। বলল, “শ্রীজাত দা-কে বলে দিও, ভায়োলেট কালারের সেরকম কোনও লিপস্টিক এখানে নেই।” মনে মনে ভাবলাম, বাবা, শ্রীজাত আবার লিপস্টিকের খোঁজ খবর রাখছে আজকাল!
আন্দাজ সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় আমাদের বাড়িতে যুধিষ্ঠির হাজরা আসলেন। নগেন দা চা দিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “শ্রীজাত, ভারি বেহায়া কেস মাইরি। তোমাদের ঐ প্রফেসর অনেক কিছুই করে গেছেন! শুনলে ভারি অবাক হবে।”
“অনেক কিছু! সেটা কেমন মি. হাজরা?”
“এই দেখো,” উনি একটা ফর্ম দেখালেন। একটি ব্যাঙ্কের কাগজ!
শ্রীজাত দেখে নিয়ে বলল, “এমার্জেন্সি একাউন্ট খোলা হয়েছে! গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ?”
উনি বললেন, “বারো লাখ শ্রীজাত!”
আমরা বেশ চমকে উঠলাম। অর্চিম্যাম সঞ্চয়ের প্রায় অধিকাংশই ফিক্সড করে গেছেন। ও বলল, “কোন নামে বা ঠিকানায়! সে বিষয়ে কিছু জানেন!”
“একটা নাম,সুলোচনা! তাছাড়া, আর কিছুই নেই শ্রীজাত।”
এরপর, চারটে মুচমুচে শিঙারা, দু কাপ চা খেয়ে হাজরা বেরোতে উদ্যত হলেন। যাওয়ার সময় দরজায় মুখ ঝুলিয়ে বললেন, “আচ্ছা, ওটা একটা পঞ্জাবির দোকান। ইলেকট্রনিকস পার্টস বিক্রি করেন ভদ্রলোক।”
অফিসার চলে গেলে পর ঘরটা কেমন আবছায়া হয়ে গেল। বাতাস স্তব্ধ। পুঞ্জীভূত চিন্তা আমাদের দুজনকেই কুড়ে কুড়ে খেতে লাগল।
পরের দিন, অবরুদ্ধ মনের চাকায় গতি সঞ্চার করতে ও বাইরে বেরুল। আমি, একটা গল্পের বই নিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লাম। বাইরের আবহাওয়া বেশ মনোরম। ঝড় বাদলা আসবে বেশ জাঁকিয়ে। নিচে নগেন দা খিচুরি করছে। সুস্বাদু গন্ধে আমার পড়ার দফারফা হয়ে যাচ্ছিল।
আজ, দুপুরের দিকে সুবিমলের সাথে একবার দেখা হল। দেখলাম, একটু ন্যুব্জ হয়ে হাঁটছে। চোখ ফুলে আছে। আমি বললাম, “কি, এদিকে কোথায়! সুতপার ক্লাস নাকি!” সুবিমল বলল, “না, একটু ওষুধ দোকানে যাব।” একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি, ওমন করে হাঁটছে কেন! তারপর ভাবলাম, না থাক, ও এমনিতেই লাজুক। বয়সে আমাদের চেয়ে কয়েক বছরের ছোটো সুবিমল বেশ স্নেহপরায়ণ বলতেই হয়। শুনেছি, ওরা এদেশীয় নয়। যাই হোক, ওকে বিদায় দিয়ে আমি গেলাম দেশপ্রাণ পার্কে। সেখানে ক্যারাটে খেলা হচ্ছে। এদিক ওদিক আরও কিছুক্ষণ ঘুরে আমি ৯নং শঙ্কর বসু রোড ধরলাম। দূর দিয়ে মনে হয় আস্ত বাগান একটা। আমাদের গ্রামের বাড়িতেও আশেপাশে এত বড় বড় গাছ নেই।
শ্রীজাত এল বিকেলে। দেখলাম, বেশ বিধ্বস্ত। ফ্যানটা জোরে করে টেবিলে বসল। সশব্দে সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কেউ এসেছিল! খোঁজ টোঁজ বোধহয় নিতে আসেনি!”
আমি বললাম, “না, পরে কি হবে জানি না। তবে আজ কেউ আসেনি।”
“আসাম ট্রাইবুন হল একটি পত্রিকা। মাস ছ’য়েক আগে তাতে ‘বিষাক্ত’ ছদ্মনামে একটি লেখা বের হয়। আলোচ্য বিষয় একেবারে ভিন্ন ধরনের। ইংরাজীতে লেখা প্রবন্ধের নাম দেওয়া হয়, “রাইস অফ দ্য স্মার্ট ট্যালেন্ট।” লেখক যিনি লিখেছেন তাঁর ক্ষেত্র হল মধ্যপ্রদেশের একটি ছোটো গ্রাম। নাম প্রকাশ করা হয়নি। গ্রাম্য পরিবেশের সুবাদে কিছুদিন পর সেখানে ছত্রাকের ন্যায় একাধিক হোটেল আস্তানা গেড়েছে। তো একদিন এক ভদ্রমহিলা চাক্ষুস করেন এক মারাত্মক বিপর্যয়! একে বিপর্যয় এই জন্য বলা হচ্ছে কারণ যা ঘটছে তা পরবর্তী সময়ের জন্য উপযোগী একেবারে নয়। তাও ধরো আজ থেকে প্রায় বারো বছর আগের ঘটনা বলছি এটা। তো, হোটেল মালিকের সাথে একজন সাধুবাবার বচসা বেঁধেছে। সাধুবাবা যত বলেন আমি চুরি করিনি, তত ম্যানেজার ও বাকিরা তাকেই দোষারোপ করে। এমন হতে হতে হাতাহাতি শুরু হয়। লোক জড়ো হওয়ার প্রশ্ন নেই কারণ সেখানে তখন প্রবল শৈত্য প্রবাহ চলছে। সাধুবাবার কর্মঠ শরীর তথাপি ধাক্কাধাক্কির চোটে ছিটকে পড়লেন। আর ঠিক তখনই ঘটে বিপর্যয়! ভদ্রমহিলা লিখছেন, “ঝোপের মধ্য দিয়ে যেমন করে হিংস্র হায়না, নেকড়ে, চিতাবাঘেরা রক্তলোলুপ দৃষ্টি নিয়ে ছুটে আসে, তেমনই বছর বারোর একটি মেয়ে তীব্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে ম্যানেজারের ওপর। সে তখনই প্রচন্ড জোরে কামড় বসায়। যাই হোক, তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া গেল। সাধুবাবাকে ও তার মেয়েটিকে বিতাড়ন করা হল। এখানে যদি বিষয়টা মিটে যেত তাহলে হয়তো ভদ্রমহিলা আর লিখতেন না। দিন দুয়েক পর একটা কান্ড হল। ম্যানেজার সাহেবের মৃত্যু! পুলিশ সূত্রে খবর ম্যানেজার মানে রাম সিং ভাদোদিয়া অতিরিক্ত মদ্যপান করতেন এবং সেই হেতু একটা মেজর এট্যাক হয়েছে। ভদ্রমহিলা কিন্তু নিজে চোখে মৃতদেহ দেখেছেন কারণ উনি ঐ হোটেলেই উঠেছিলেন। পিঠের কাছে ক্ষতের দাগ ওঁর চোখ এড়ায়নি। যাই হোক, ওঁর বিশ্বাস, এটা ঐ ছোট্ট মেয়েটির কামড়ের ফলেই হয়েছে। গাঁজা উঠে মৃত্যুই হয়েছিল লোকটার।
এর কয়েকদিন পর, উনি জঙ্গলে সেই সাধু আর মেয়েটিকে খুঁজতে যান কিন্তু ততক্ষণে পাখি ফুড়ুৎ। এখান থেকেই এই ‘বিষকন্যা’ নামক অদ্ভুত বিষয়টার সূচনা।”
আমি বললাম, “ভদ্রমহিলা কে! নিশ্চয়ই অর্চি বন্দ্যোপাধ্যায়!”
“সেটা জানতে পারিনি। কারণ নাম প্রকাশে তারা একেবারেই না করেছে। উনি এখন মারা গেছেন এটা জানলে হয়তো একটা সুরাহা হবে। যাই হোক, আজ এ পর্যন্ত। তবে হ্যাঁ, বড়বাজারে গেছিলাম। সুলেখা হার্ডওয়্যার! সত্যিই ওটা এক পাঞ্জাবির দোকান।”
এরপর শ্রীজাত নিজের বুকের কাছে হাত দিয়ে বলল, “সুজিত, পেট আর বুকের কাছে কেমন একটা হচ্ছে! মনে হচ্ছে এখুনি সব গুলিয়ে উঠবে,” বলতে বলতেই ও ওয়াক তুলে বমি করে ফেলল। আরও কিছুক্ষণ পর পাড়ার দেবাশীষ ডাক্তারকে দিয়ে স্বাভাবিক চিকিৎসা করানো হল। উনি বললেন, “বাইরের খাবার খেতে এইজন্যই বারণ করি। তোমরা তো এ যুগের ছেলে! শুনলে বড্ড ক্ষতি হবে কিনা! তাই আর বলে নিজের বিপদ বাড়াই না! এই বলে উনি চলে গেলেন।”
আমি বললাম, “শুনলি সেই ধম্মের বাণী! তা কি খেয়েছিলে!”
বিছানায় শুয়ে শ্রীজাত বলল, “কচুরি, ফুচকা, এগরোল ইত্যাদি। শেষে, সূচনার বোতলের সবটুকু জল খেয়ে এসছি।” মনে মনে ভাবলাম, “ও ব্যাটা, তুমি চলো পাতায় পাতায়! গোয়েন্দাগিরির সাথে প্রেম ট্রেম হচ্ছে ডালে ডালে!”
রাতে শোয়ার আগে একবার বললাম, “সুবিমলের সাথে দেখা হয়েছিল। ও বেশ খুঁড়িয়ে চলছিল। বলল, কোমরে নাকি ব্যথা। পড়ে গিয়ে এই অবস্থা।” আমার কথায় শ্রীজাত প্রায় তড়িৎ গতিতে বিছানায় উঠে বসল। বলল, “এটা আগে বলিসনি কেন! তুমি কী হে সুজিত! তোমায় আমি জিজ্ঞেস করলাম আর তুমি চেপে গেলে!”
আসলে আমি জানতাম না, সুবিমলের সাথে এই কেসের কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে বলে। কিন্তু এরপর ও আমায় যা বলল, তাতে মনে হল, এ পৃথিবীর সমস্ত কিছু বৈপরীত্যে ভরা!
“সুজিত, মার্বেল ছুঁড়েছিলাম ভেতরে কেউ আছে নাকি দেখার জন্যে কিন্তু সেটাই যে আগুনের ফুল্কির মত আঁধারে দিশা দেখাবে বুঝিনি! এর অর্থ কি জানো?”
“শ্রীজাত, আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না।”
“এর অর্থ এটাই, সুবিমল সেদিন মিথ্যে কথা বলেছে। তারপর চোখ বন্ধ করে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল, ঘুঘু দেখেছো, ফাঁদ তো দেখোনি!”
‘বিষকন্যা’ আদতে যে কে, তা আমরা এখনও জানতে পারিনি। হদিস পাওয়া যায়নি। তার কেশগুচ্ছ থেকে একটিও কেশের গন্ধ বা দেখা পর্যন্ত পাইনি!
আমি পাউরুটিতে কামড় দিয়ে জানলার বাইরে কৃষ্ণচূড়ার শোভা দেখছিলাম। হঠাৎ কী মনে হল, বললাম, “কাগজে ইত্যাদি নামক পেজ-টা অনেকদিন দেখা হচ্ছে না। দাও দিকি। যদি কিছু কাজের বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়।” কাগজটা আমায় দিচ্ছিল কিন্তু হাতের কাছে এসে আবার সেটা ফিরিয়ে নিল। বলল, “সুজিত, এই মাথার বিজ্ঞাপনটা নতুন না! দেখো একবার।”
আমি দেখলাম। মনে হল, সাধুবাবা টাবার হবে হয়তো! কিসব মুক্তির কথা বলা হয়েছে। দু থেকে তিনদিনের মধ্যে সুরাহা। বড়বাজারের সুলেখা হার্ডওয়্যার এর কাছে! এবার আমি ওর দিকে তাকালাম। দেখলাম, ওর গালে একটা ক্রুর হাসি খেলছে। বলল, “সুজিত, দুয়ে দুয়ে চার কি হচ্ছে!” আমি অবশ্য একটা আন্দাজ করছিলাম। কিন্তু এখানে কোনও ফোন নাম্বার দেওয়া নেই। খালি ঠিকানা হিসাবে ঐ দোকানের কথা বলা আছে।
“সুজিত, আসামি আমাদের সামনে দিয়ে দিব্যি চলাফেরা করছে অথচ আমরা বুঝতে পারছি না। একটা বিষয় ক্লিয়ার হয়েছে। এই বিষকন্যা আমাদের মধ্যেই আছে। কিন্তু বেশ ধরে আছে। মনে আছে, অর্চিম্যামের সেদিনে ডায়েরির হাতের লেখাটা! কেমন তাড়াহুড়োয় লেখা। সেদিন উনি প্রথম দেখেছিলেন মেয়েটাকে। হতে পারে বিষের মোহ-তে বা আশ্চর্য রূপ সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে পড়েছেন। হতে পারে এটাই একটা শক। আর একটা জিনিস!”
“কী শ্রীজাত!”
“যখন আমাদের চেনা পরিচিত কেউ ছদ্মবেশ নিয়েছে এমনটা বুঝে যাই!”
দেখলাম, ও বেশ চিন্তায় মগ্ন। সারাদিন হয়তো আর কোনও বাক্যালাপ হবে না। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করছে, “সাধুবাবাই বা কোথায়……বিষ নির্মাণের সরঞ্জাম!”
পরের দিন বেলা এগারোটা নাগাদ দেখি হাজরাবাবু ফোন করেছেন। শ্রীজাতকে বলতে শুনলাম, “আচ্ছা, গাছপালা হাতে নিয়ে ঢুকেছে, একটা ছোট ড্রাম, আচ্ছা…।” আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ও ফোন রেখে দিল।
“সুজিত, আজ বেরোতে হবে। এই কেসের হয়তো আজই ভবলীলা সাঙ্গ হবে। চলো তাড়াতাড়ি।”
আমরা ছদ্মবেশ নিলাম। কার্তিক ঠাকুরের মত দুদিকে তর্জনী নির্দেশিত সরু গোঁফ, এমব্রয়ডারির টুপি, আর কুর্তায় আমাকে একেবারে মাড়ওয়ারি বনেদি ব্যবসায়ী মনে হচ্ছিল। শ্রীজাত ছদ্মবেশ নিল প্রভুভক্ত চাকরের।
সুলেখা হার্ডওয়্যার আদতে একটা ঘুপচি। সরু গলির মত ঢুকেই একটা বসার চেয়ার। তারপর টেবিল। ভজন সংগীত চলছে। টেবিলের ওপারে পঞ্জাবি ভদ্রলোক একদৃষ্টিতে আমাদের নাম নথিভুক্ত করছেন। শ্রীজাত একবার বলল, “বাবু, কই তাকলিফ নেহি হোগা না!” ওর গলাটা কেমন হেঁড়ে মনে হচ্ছে। আমি চুপ করে বসে আছি।
এই সময় বিপরীতে একটা ফোন বেজে উঠল। সাথে সাথে পঞ্জাবি লোকটার মুখের হাল বদলে গেল। ফোন রেখে কটমট করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর, “বাত্তামিজ…” ও আরও কিছু গালি দিয়ে মুষ্ঠাঘাত করতে চাইলেন কিন্তু সেটা আর আমার মুখে এসে পৌঁছাল না। সামনে আসার আগেই শ্রীজাতর বন্দুক কথা বলল। আমি ছিটকে পড়ে গেলাম। তখনই দেখলাম, পঞ্জাবি পেছনের এক দরজা খুলে পালিয়ে গেল!
শ্রীজাত উঠেই ফোনের নাম্বারটা নোট করে নিল। দেখলাম, ততক্ষণে যুধিষ্ঠির হাজরা তার লোকবল নিয়ে হাজির হয়েছেন। বলল, “ধরতে পারলে ব্যাটাকে! দাগী আসামি একটা। গা ঢাকা দিয়ে ছিল বছরখানেক।” আমি কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললাম, “ফোনটা কে করেছে দেখো!”
গাড়িতে প্রায় এক ঘন্টা ধরে চেষ্টা করেও যখন আমরা নাম্বারের হদিস পেলাম না, হাজরাবাবু বললেন, “পাখি বোধহ য় পালিয়েছে! ইস, একটা ভুল দানে পাশা পালটে গেল!” হাজরাবাবু কাকে দোষারোপ করলেন বুঝলাম না। ভুলটা সবারই হয়েছে। কিন্তু আমি মারপিট কোনও দিনই করিনি। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম।
বাড়ি আসতে দেখলাম, ও নগেনদা-কে বেশ কষিয়ে রান্না করার নির্দেশ দিচ্ছে। “আর হ্যাঁ, মুরগীর মাংসে ঝাল দিও ভালো করে। কদ্দিন আরাম করে খাওয়া হয়নি।”
“তোমায় বেশ আনন্দিত মনে হচ্ছে শ্রীজাত! বড়বাজারে ঐ মুষ্ঠির আঘাত কি ভুলে গেলে! একটা ফাঁড়া গেল!”
“ফাঁড়া এখনও যায়নি সুজিত! কিন্তু দাঁড়াও দাঁড়াও! এই নগেনদা, ঘরে কেউ কি এসেছিল!”
নগেনদা নিচ দিয়ে বলল, “আমি বাজারে গেছলাম বাবা! না, কাউকে তো দেখলুম না!”
আমি একবার ঘরের ভেতরটা চোখ বোলালাম। টেবিল খালি, বইয়ের তাক, বিছানায় জলের বোতল, জানলাটা অর্ধেক খোলা, আজ চড়াই পাখিরা বিস্কুটের গুঁড়ো খেতে এসেছিল, তাছাড়া মেঝেতে কিছুই পড়ে নেই। এবার ওর দিকে চাইলাম। ওর চোখ, স্থির। আমার ঠিক পাশেই জলের বোতলটায়। ও, সেটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, “এই বোতলটা আমাদের নয়!”
মিনারেল ওয়াটার। ঠিক ভর্তি নয়। সামান্য খাওয়া! আমি দেখতে চাইলাম কিন্তু তার আগে আমার মুখের সামনে নিজের ডান হাতের চেটোটা উন্মুক্ত করল। দেখলাম, কালো কালিতে লেখা ‘সুলোচনা’। নিচে অস্পষ্ট একটা নাম্বার।
“তার মানে, বিষকন্যা! বিষকন্যা এসেছিল ঘরে! কিন্তু কখন! কিভাবে!”
“উত্তর খোঁজার আগে দেখো ডায়েরিটা কোথায়!”
আমি প্রায় এটা ওটা ছুঁড়ে, বইয়ের তাক খালি করে ফেললাম। ডায়েরি কিন্তু নেই! ড্রয়ারটা দেখেই বন্ধ করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু একটা কাগজে চোখ থেমে গেল। হাত দিতে যাব, ও বলল, “এক সেকেন্ড সুজিত! সাবধান, বিপদ কিন্তু এভাবেই আসে!”
হাতে দস্তানা পরে ঐ কাগজটা নিল। দেখলাম, আদতে একটা চিঠি! চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ও সেটা পড়তে শুরু করল——
“প্রিয় শ্রীজাত,
কালনাগিনী কি কখনো ভালোবাসতে পারে? জানি না, সেটা অন্য কোনওদিন খুঁজে দেখব। হ্যাঁ, আমি বিষকন্যা! কোথা থেকে কিভাবে— এসব থাক। শুধু বলব, তোমার কই মাছের জান! আজ পর্যন্ত কাউকে এই মরণ বাণ হজম করতে দেখিনি! সেদিন অর্ধেক খাওয়া সিঙারা তুমি খেয়ে দিব্যি গান গাইছিলে। বিকেলে ফেরার সময় আমার বোতলেই তৃষ্ণা মেটালে। তারপর জানলাম তুমি টিকটিকি! শ খের গোয়েন্দাগিরি করো। বিশ্বাস করো, না হলে সেদিন সমস্ত ঝড় ফেলে তোমার কাছে ছুটে আসতাম! দরকার হলে, তোমার ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকিয়ে সেই বিষ আমি বার করতাম।
এবার তুমি ভাবছ, আমি এসব কেন করছি! একটা প্ল্যাটফর্ম পেতে চেয়েছিলাম। ইতিহাসের পাতা থেকে উঠেছি তো, শখ ছিল সর্বশক্তিমানের তকমা হাসিল করার! কিন্তু সেসব হল কই! যারা মরেছেন তারা তো এমনিতেই মৃতপ্রায়! আর অর্চি বন্দ্যোপাধ্যায় তো আমায় সাহস জুগিয়েছেন। গোটা পৃথিবীতে কেবল উনিই ছিলেন যিনি পারতেন আমাদের অতীতকে মুছে ফেলে ঝাঁ চকচকে একটা উজ্জ্বল রূপোর বাটি উপহার দিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উনিও আর রইলেন না। অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু আর হল না। খালি হাতেই সেদিন ফিরলাম। ফিরলাম, বিষাক্ত ঐ ভবিষ্যতের কাছে। যে আমায় বিষকন্যা বানিয়েছে।
শেষে এটাই বলব, যারা মারা গেছেন তাদের আত্মার শুভ কামনা করি। পারলে, অর্চিম্যামের বিষয়টা নিয়ে ভেবো। বিজ্ঞানের পাতায় মোড়া এ সংসারে আমরাও তার গায়ে গা ঠেকিয়ে চলতে পারি। তুমি ভালো থেকো। যদি কোনও ভুল করে থাকি, মার্জনা কোরো। আর পারলে না খোঁজার চেষ্টা কোরো! আমাদের জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা। জীবনে তোমায় আমি ভুলব না। ভালো থেকো শ্রীজাত।
ইতি,
তোমার সূচনা”
চিঠিটা বন্ধ করে সেটা আবার ড্রয়ারে চালান করল শ্রীজাত। তারপর হাতের দস্তানা সশব্দে মেঝেতে ছুঁড়ে মারল। আচ্ছা, দস্তানাগুলোর দোষটা কোথায়! বুঝলাম না। খালি বুঝলাম, এবারে মাষ্টার ষ্ট্রোক এক নারী দিয়ে বেরিয়ে গেছে। মনে মনে হেসে বললাম, যে সে নারী নয়! বরং বিষকন্যা!
এরপর প্রায় সপ্তাখানেক কেটে গেছে। ‘বিষকন্যা’ নামক শব্দটি গা সওয়া হয়ে গেছিল। কয়েকদিন ওর সাথে এ বিষয়ে কথা পর্যন্ত বলা হয়নি। কলেজে যে পরিচয় নিয়ে সূচনা এসছিল সেটাও মিথ ছিল। শ্রীজাতদের স্যারের কস্মিনকালেও কোনও সন্তান ছিলই না! শ্রীজাত অবশ্য বলেছিল, “সুজিত, গান্ধার প্রদেশের রাজা চিত্রদেবের এক পত্নী ছিলেন, নাম ছিল সুলোচনা। ইনি ছিলেন বিষকন্যা। আমি এটা আগে জানলে অনেকটাই সুবিধে হত। যাক, সূচনা ডায়েরি নিয়ে গিয়ে ভালোই করেছে। যার শেষ ভালো তার সব ভালো।”
সুবিমল তার কয়েকদিন পর গ্রেফতার হয়। বিচারের রায় ঘোষণা হয়নি। তবে, সুলেখা হার্ডওয়্যার থেকে দু ড্রাম দুধ, ধুতরো বীজ, সিঙ্কোনা টক্সিফেরা নামক গাছ ইত্যাদি পাওয়া গিয়েছে। এবং পঞ্জাবি এখনও ফেরার!
সকালে আবার কাগজ খুলে বসলাম। এমনই একদিন বিষমদ কেলেঙ্কারি আর অতঃপর এশিয়াটিক সোসাইটির সেমিনারের কথা মনে পড়ে গেল। অতীতে ফিরলে খালি হতাশা! শ্রীজাত, আজও মর্নিং ওয়াকে গেছে। মিনিট দশেক পর এসে বলল, “রিট্যালিয়েশান— শব্দটার বাংলা অভিধান কি বলছে সুজিত!” বেসিনে মুখ ধুয়ে টাওয়াল হাতে নিয়ে চেয়ারে বসল।
আমি বললাম, “প্রতিহিংসা চরিতার্থ।”
“যাই হোক, ভাবছি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেব। শ খের গোয়েন্দাগিরি চলবে। যুধিষ্ঠির হাজরা জিজ্ঞাসা করছিলেন, ওটি তোমার বন্ধু নাকি চেলা!”
“তা কি বললে!”
আমি বললাম, “বন্ধু। এর চেয়ে সঠিক প্রতিশব্দ বোধয় আর হয় না। বন্ধুই তো বিপদে কাছে থাকে। চেলা প্রসঙ্গে অন্যদিন আলোচনা হবে।”
এই সময় নগেনদা চা নিয়ে আসল। বলল, “বাবারা, আজ রুটি করিনি। দোকান দিয়ে পুরি এনে দিই! লোকটা ভালো বানাচ্ছে ইদানীং।”
শালপাতায় মোড়া হলদে, মাঝে মাঝে লালচে ধরনের পুরি। সাথে মাখা মাখা আলুর দম। শ্রীজাত একটা কামড় দিয়ে বলল, “এই পাড়ায় পুরি আগে দেখিনি সুজিত!”
“হতে পারে এ পাড়া সে পাড়া ঘুরতে ঘুরতে চলে এসছে। বাদ দাও, খাবারে মনোযোগ দাও।”
সেদিন আনুপাতিক বৃষ্টির হার কম ছিল। জানলা দিয়ে কৃষ্ণচূড়ার শোভা বিশেষ একটা বোধ হচ্ছিল না। রাত আন্দাজ সাড়ে দশটার সময় ও সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল। আমি, দরজা খোলার শব্দ পেলাম। পরমুহূর্তেই ও আবার উঠে আসল। “দরজা কি খোলা ছিল?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“আজ ওগুলো খোলাই থাক। রাতের প্রহরীদের আলগা দিলেই তবে তো আসামী আসবে।”
আমি শেষেরটা শুনতে পেলাম না। সারাদিন নিজের মনে যা হাবিজাবি বলে অধিকাংশই মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। তাই পাত্তা দিলাম না।
ঘরের দরজা ভেজা দেওয়া ছিল। তখন বোধয় সাড়ে বারোটা হবে। শঙ্করবসু রোডের সারমেয়যুগল ভউ-উ-উ করে উঠল। এরপরেই শ্রীজাত-র গলা, বেশ উত্তেজনাপ্রবণ, “সুজিত, ওঠো, দরজার ওপাশে!” আমি ধড়ফড়িয়ে উঠছিলাম কিন্তু ও ইশারায় দরজার পাশেই চলে যেতে বলল। কে, কোথায় ছিল তখনও জানি না। অন্ধকারে বিশেষ বোঝা যাচ্ছে না তবে জানলার পর্দা উড়ছে। আর তাতেই বাইরের আলো এসে ঘরে পড়েছে।
দরজা একটানা ‘ম’ শব্দে খুলে গেল। দীর্ঘকায় ইঁদুরের মুখের মত একটা জিনিস মেঝেতে ঢুকল। তারপর আরেকটা। অর্থাৎ ধীর পায়ে সে ঘরে ঢুকল। আমি যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এত রাতে কি তাহলে চোর! এই জন্যই ও নিচের দরজা খুলে রেখে এসছিল! কে এই আগন্তুক!
ছায়ামূর্তি বেশ বড়সড় রকমের লম্বা। মাথায় কিছু একটা আছে। বিছানার কাছে যাওয়ার আগেই খট শব্দে লাইট জ্বলে উঠল। দেখলাম, শ্রীজাত সুইচ বোর্ডের ওখানে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। সামনে সেই প্রজ্জ্বলিত ছায়ামূর্তি!
“সুজিত, চিনতে পারছিস আসামীকে!”
লোকটার মাথায় গামছা জড়ানো, ময়লা ধুতি অনেকটাই তোলা হাঁটুর কাছে, গায়ে একটা লাল কুর্তা অনেকটা স্টেশানের কুলিদের মত। লোকটাকে পিছন দিয়ে দেখলেও বুঝতে অসুবিধে হল না। বলিষ্ঠ দেহ কাঠামো। স্থিরভাবে শ্রীজাত-র দিকে তাকিয়ে আছে।
“তোমার খেলা শেষ সাধবিলাসি হারদয়াল।”
বলার সাথে সাথে ঘরে একটা তড়িৎ খেলে গেল। লোকটা প্রায় ‘হারাম কে পিল্ল’ বলতে বলতে শ্রীজাত-র গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শ্রীজাত ভেল্কি দেখিয়ে সরে গিয়ে লোকটাকেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। জোর ধস্তাধস্তি হচ্ছে। লোকটা খালি হাতে এসছে। মনে হচ্ছে বাঘ নয়, সিংহ নয়, একটা পাগলা হাতিকে শ্রীজাত ধরে রেখেছে। কিন্তু কতক্ষণ! আমিও হাতের কাছে এমন কিছুই পেলাম না যা দিয়ে ওকে সজোরে আঘাত করা যায়। আর ঠিক তখনই লোকটার চোখগুলো দেখলাম। মুখে হিংস্রতা আর চোখে রক্তবৃষ্টি।
শ্রীজাত এরপর যেটা করল তার জন্য বোধয় লোকটাও তৈরি ছিল না। বাঁ হাতে ওর বুক ধরে ডান হাতে লোকটার মাথা নিয়ে আলমারির কাঁচের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। ঝনঝনিয়ে উঠল সমস্ত ঘর আর রাতের নিস্তব্ধতা! তবুও লোকটার মনোবল দমল না। মুখে “হুঁ, হাঁ, দেখ লেগা, ছোর মুজকো!” আওরাচ্ছে।
“সুজিত, একে এরকম ছেড়ে দিলে হবে না। গুরু শিষ্যা মিলে যে চরম দুর্ভোগ দিয়েছে তাতে এদের ঐ সাজাই হওয়া উচিত!”
শ্রীজাত-র কথা ঠিক বুঝলাম না। ও তখনও লোকটাকে জড়িয়ে ধরে আছে। এবার কি রিভলবার বের করে গুলি চালাতে বলবে নাকি শ্রীজাত! আমি কি করে গুলি চালাব!
“সুজিত, টেবিলের নিচে জলের বোতলটা আন শিগগির!”
যেমন বলা তেমনই কাজ। জলের বোতল নিয়ে যাব কি! লোকটা তখনও একই আচরণ করছে। “ছাড়, ছাড় আমাকে!”
লোকটা রীতিমত পা ছুঁড়ছে। সামনে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। আমি বোতলটা ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে। লোকটার মাথাটা আরেকবার ঢুকিয়ে দিল আলমারিতে। আবার ঝনঝনানি! সাথে কয়েক ফোঁটা রক্ত বের হল।
তারপর ছিপি খুলে সেই বোতলের মুখটাই লোকটার মুখে চেপে ধরল শ্রীজাত। এবার শ্রীজাত নিজের ডান পা দিয়ে লোকটার কোমর চেপে ধরে আছে। লোকটা যেন কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না। মুখ সরাতেও পারছে না। কয়েক ফোঁটা জল হয়তো ওর পেটে চলে গিয়েও থাকতে পারে। সাথে সাথে লোকটা কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ল। সমস্ত ছটফটানি এক নিমেষেই শান্ত হয়ে এল। শ্রীজাত হাঁফাতে হাঁফাতে বিছানায় বসে পড়ল।
আমি দেখলাম, লোকটার মুখ নীল হতে শুরু করেছে। অত বড় দেহটা মেঝেতে কয়েকবার হাত পা নাড়িয়েই শান্ত হল আবার। মুখ দিয়ে সাদা ফেনা বেরিয়ে আসল। আমি প্রায় অবাক হয়ে বোতলের দিকে চেয়ে রইলাম।
পরের দিন বেলা এগারোটা পর্যন্ত দেহ স্থানান্তর, রাতের বৃত্তান্ত, ইত্যাদি হট্টগোল চলল। হাজরাবাবু বললেন, “এখান থেকে আধ মাইল দূরে একটা অনাবৃত কাঁচের বাক্স ভর্তি খানকতেক পুরি আর শালপাতায় মোড়া আলুর তরকারি পাওয়া গিয়েছে।”
চা সহযোগে আমি আর যুধিষ্ঠির হাজরা বাকি কথা ওর মুখে শুনলাম।
“পাড়ায় এর আগে বহু নতুন লোকের আবির্ভাব হয়েছে। গাড়ি চালানো শেখা, ফ্ল্যাট দেখা ছাড়া বাইকে করে খাবার সরবরাহ— এছাড়া নতুন মুখ সম্ভব নয়। কিন্তু সেদিন দেখলাম এক ডালপুরি বিক্রেতাকে। ওর চোখ দুটো কেমন যেন ওর বশে নেই। সে দুটো খালি অন্যত্র চলে যাচ্ছে। একদিন গেল, দুদিন গেল, তিনদিনের মাথায় ও চাইল। একটা ফেক হাসি হাসল। কিন্তু আমি ততদিনে বুঝে গেছি। সুলেখা হার্ডওয়্যার এর পঞ্জাবি আর মধ্যপ্রদেশের বিষ নির্মাণকারী সাধুবাবা, সাধবিলাসি হারদায়াল! তারপর একদিন ও আমাদের পাড়ায় এল। সোজাসুজি দাঁড়ালে বিপদ! তাই বাড়ির কোণাকুনি দাঁড়াল। কি মনে হল, ওইদিন হয়তো ও একটা সুযোগ নিলেও নিতে পারে। ফাঁদ পাতলাম। বাবু সশরীরে এসে ধরা দিল। আর আপনাদের জানিয়ে রাখি ঐ মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা অন্য কারোর। যে হয়তো শেষবারের মত একটা সুযোগ খুঁজছিল! কিন্তু সাধুবাবা সেটা খেয়েই গত হলেন।”
পুলিশের গাড়ি বেরিয়ে গেলে আমি ওপরে উঠে আসলাম। দেখলাম, ও আনমনা হয়ে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। আপন মনেই বলল, “সুজিত তুমি মনে হয় জানতে না, ওতে বিষ ছিল। কিন্তু আমি জানতাম।”
আমি বললাম, “হুম, সূচনা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত মেয়ে। কাঁচা কাজ করেনি।”
ও বলল, “গুরু আর শিষ্যার মধ্যে এতটুকু পার্থক্য আর রইল না। জন্মলগ্ন থেকেই মানুষ মারার অদম্য ইচ্ছেটা কেমন বদভ্যাসে রূপান্তরিত হয়েছে।”
এরপর আমরা একদিন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে গিয়েছিলাম। সুবিমলের সাথে দেখা করতে। আমরা ভেবেছিলাম এটা হয়তো ‘camouflage’ অর্থাৎ ও অভিনয় করছে কিন্তু না! ও প্রায় হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “সুজিত, জীবনে কোনও দিন পাপ করিনি। কিন্তু সেদিন রেঁস্তোরায় মৃতদেহ দেখে আমি ভয় পাই। তোমাদের অনেক কথাই বলে দিই। নিয়মিত অর্চি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটে গিয়েছি। যদি ঐ কালনাগিনীকে মারার কোনও উপায় থাকে কিন্তু পাইনি। এখান থেকে বেরিয়ে আমি যে কি করব! কেন যে মরতে ওদের সাথে মিশলাম। টাকাই নষ্টের মূল!”
সুবিমলকে কয়েকটা শান্তির বাণী শুনিয়ে আমরা চলে আসলাম।
ও বলল, “সাধুবাবার আসল রাগ কোথায় জান সুজিত! ওর এতদিনের তপস্যা! এত নিষ্ঠার সাথে বিষকন্যাকে বানিয়েছে, এবং তার যে এত তাড়াতাড়ি রহস্য ভেদ হবে সেটা বুঝতে পারেনি। অর্চিম্যাম জানতেন, ওরা একসময় বিপদে পড়বে! তাই অতগুলো টাকা রেখে গেছেন। আর সূচনা জানে ঐ সামান্য টাকায় সাধুবাবার খিদে মিটবে না।”
“এদের পাল্লায় সুবিমলের পরিণতি দুর্বিসহ হয়েছে।”
“সুজিত, আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, আমরা এক আদিম মধ্যযুগীয় নারীর দেখা পেতে গিয়েও পেলাম না! একটা কথা আছে, কথা কও, কথা কও, কথা কও অনাদি অতীত!”
শেষেরটা আমিই বলে দিলাম, “আর অতীত যখন কথা বলে তখন সত্য মিথ্যা সবই বিষকন্যার ঝুমুঙের শব্দে অঙ্কিত হয়! কি তাই তো?”
“একদম ঠিক বলেছো সুজিত।”