কাল থেকেই ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। আজ শনিবার। আমি সকালেই বের হব ভেবেছিলাম, কিন্তু বৃষ্টি তাল কেটে দিল। আকাশবানী কলকাতার স্থানীয় সংবাদ শুনে যা বুঝলাম এটা প্রাক বর্ষার বৃষ্টি। মা কে বলেছিলাম আজ একটু পাশের গ্রামে যাব। ছোটবেলার শিক্ষক শান্তিবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। সারাদিন গল্পের বই আর গান শুনে ভালো লাগছিল না। সন্ধ্যা হতে বাড়িতে মন বসল না।
নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ও দুর্যোগের ভয়কে দূরে সরিয়ে বাবার থেকে পাওয়া টু-হুইলার নিয়ে একপ্রকার বাইরে যাওয়া ঠিক করে ফেললাম। আমি বরাবরই একরোখা, অনেকটা আমার আইডল প্রিয়তোষদার মত। ভয় জিনিসটা তাঁর অভিধানে নেই। সাহস তার রক্ষণ, আর অ্যাডভেঞ্চার তার বন্ধু। আমিও সেই পথেই চলি।
রাত ৮.৩০মিনিট
আকাশে ঘনঘন বাজ পড়ছে। এই সময় কেউ ঘরের বাইরে সাধারণত যেতে চায় না। কিন্ত ২৫ বছরের নির্ভীক যুবক এই সবকে পাত্তা দেয় না। বর্ষাতি গায়ে চাপিয়ে গোড়ালি সমান জল পেরিয়ে অবিরাম বৃষ্টির মধ্যে প্রিয় টু-হুইলার ‘টকেশ’ কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শান্তি বাবুর বাড়ির পথে।
শান্তিবাবুর থেকে একটা চাকরির তথ্য নিতে গিয়েছিলাম। বেশিক্ষণ তাই ওখানে বসিনি। শুধু বিজ্ঞাপন ও স্যারের থেকে সংস্থার ডিটেলস নিয়েই আপাতত বাড়ির পথে রওনা দিলাম।
বৃষ্টির প্রাবল্য বাড়তে থাকল। যতটা সম্ভব ধীরে বাইক চালাচ্ছিলাম। ট্রেনের শব্দ ভেসে আসছিল। লাইন পার হতে গিয়ে ২ মিনিট দাঁড়াতে হল।
লোকাল ট্রেন ছেড়ে চলে গেল, তার পরই সব আবার নিস্তব্ধ। আমার ‘টকেশ’ আর এগোচ্ছে না। কিছুতেই আর স্টার্ট হচ্ছে না। বৃষ্টির জল খেয়ে হয়ত পুরানো কলকব্জা তার নিজ দুর্দশা মেলে ধরতে চাইছে। বারবার স্টার্ট মেরেও আর ‘টকেশ’ কে জাগাতে পারলাম না। অগত্যা বাইক টেনে টেনে বৃষ্টির জল হাওয়া মেখে হাঁটা শুরু করলাম।
এলাকাটা আজ যেন কেমন অদ্ভুত রোমাঞ্চকর ও বিভীষিকাময় মনে হতে লাগল। সাহসী, নির্ভীক হয়েও আজ এতটা গা ছমছম লাগছে যে ভাবলে অবাক লাগে। হাঁটতে হাঁটতে আমার কেন জানিনা মনে হতে লাগল কিছু খারাপ ঘটতে চলেছে। হয়ত এটা আমার মনের ভ্রম।
বৃষ্টির বেগ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। এমন সময় দেখতে পেলাম অনাদিবাবু রাস্তার একধারে কী একটা করছেন। এত বৃষ্টির মধ্যে কী করছেন উনি? এই প্রশ্ন মনে জাগা স্বাভাবিক। ছাতাটা জীর্ণ, গায়ে কালো কোট, পায়ে বুট, ফুলপ্যান্ট শপশপ করছে। এমন সময় প্রচন্ড শব্দে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে এক প্রকান্ড বাজ পড়ল। চারিদিক নিস্তব্ধ, শুধু দূর থেকে একটা ট্রেন যেন হুইসেল ছেড়ে চলে গেল। রাত তখন ৯.৩০ হবে। হঠাৎ গোঙানীর শব্দ পেলাম সেটাও খুব অল্প। বৃষ্টির মধ্যে শব্দটা কার, ঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না। এমন ভাবতে ভাবতেই অনাদিবাবুকে আর দেখা গেল না।
আমি রাস্তার অন্যধারে একটা গাছতলায় ছিলাম।
বৃষ্টিতে ভিজে যাব বলে ফোনটা সঙ্গে আনিনি। মা চিন্তা করছে বোধহয়, দাদাও এসে পড়েছে হয়ত। বৃষ্টিটা না কমলে খুব অসুবিধা হবে, কারণ বর্ষাতিতে এই বৃষ্টি আটকাচ্ছে না। নবীনের গ্যারাজে বাইক দিয়ে এসে একপ্রকার ভালই করেছি মনে মনে বললাম। (continuity problem)
“ধুর, এমন ভেজা ঠিক না, এই তো কদিন হলো জ্বর থেকে উঠলাম।”
রাতের যে নিস্তব্ধতা সেটা আজকের বৃষ্টি ভেঙে দিয়েছে। প্রকৃতি আজ করুণ সুরে মেঘমল্লারে তান তুলেছে। জনমানুষ নেই ঘোলপাড়ার মাঠের ধারে। মনের মধ্যে উঁকি দেয় সেই একটাই কথা – অনাদিবাবু গাছতলার পাশে কি করছিলেন।
এটা ভেবে ভেবে অবশেষে বাড়ি আসি। রাত বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টির দাপট বেড়েই চলল। হাত মুখ ধুয়ে যেই না চাকরির পরীক্ষার বইটা নিয়ে পড়তে বসেছি হঠাৎ চিৎকার।
“কে আছ, বিপদ হয়েছে গ্রামে।”
বিপদ!
“কী বিপদ?”
দূর থেকে ভেসে এল, “অনাদি সমাদ্দার খুন হয়েছেন।”
খবরটা শুনে প্রথমে তো আমার মাথায় বাজ পড়ল। চারিদিকে যেন অদ্ভুত এক করুণ আর্তি, মনে বড় বেদনার সুর বেজে উঠল। কেমন একটা ঘোরে ছিলাম কিছুক্ষণ। পরক্ষনেই বাস্তবের মাটিতে ফিরে এলাম। আর ভাবলাম এই তো দেখলাম লোকটিকে রাস্তার ধারে। হঠাৎ অনাদি সমাদ্দার…
এই কথা ভাবতে ভাবতেই এসে পড়ল প্রিয়তোষদা।
বললো, “ধ্রুব আছিস।” শুনে দৌড়ে এসে বললাম, “কী ব্যাপার গো, কেসটা তুমিই নিলে?”
“না না, নেবার কী আছে, এসে গেল। পাড়ার এমন বিশিষ্ট সমাজসেবী খুন হয়েছেন, কে দায়িত্ব নেবে তার অপেক্ষা করিনি।” বলল প্রিয়তোষদা।
“তু্ই কি আসবি?”
না বলার সাহস হয়নি। প্রিয়তোষদা যে আমার ইনস্পিরেশন। এই ভেবেই আমি তৎক্ষণাৎ কোনও কথা না বাড়িয়ে প্রিয়তোষদার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম।
বৃষ্টি একটু কমেছে। হয়ত অনাদিবাবুর খুনের জন্য আকাশ বাতাস তার সর্ব শক্তি দিয়ে নিজের রাগ অভিমান ক্রোধ প্রকাশ করছিল এতক্ষণ। যাই হোক খুন হওয়ার চারপাশটা অর্থাৎ লাশের চারপাশটা ভালো করে দেখলাম। সেরকম কিছু অন্ধকারে পেলাম না। পাশের নোয়াপাড়া থানার দাসবাবু এসে পাড়ার বাড়ি বাড়ি জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন। দু’জন কনস্টেবল হাজির। কেউ না লাশ সরায় এই ভেবে তারা পাহারায় ব্যস্ত। সারারাত আমাদের নিস্তব্ধ পাড়া আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বকুল নাকি কাউকে পালাতে দেখেছিল। দারোগা দাসবাবু সেটা নিয়ে চিন্তিত। এদিকে আমরা ভাবছি কে ও কেন অনাদিবাবুকে খুন করল। রহস্য ক্রমশ জটিল হতে থাকল। কালো অন্ধকারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করা যে কত কঠিন সেটা আজ উপলব্ধি করছি।
রাতে ঘুম হল না।
রবিবার।
রাতের বিভীষিকাময় বাস্তবতা সকালের স্নিগ্ধ আলোয় ধুয়ে মুছে দিয়েছে ঠিকই, তবুও কোন এক অজানা আতঙ্ক গ্রামকে ঘিরে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে।
প্ৰিয়তোষ দার সাথে আমিও চললাম অনাদিবাবুর বাড়ি।
ঘড়িতে তখন পৌনে ৮টা।
মিঃ দাস আগেই দু’বার টহল দিয়ে মিসেস সমাদ্দারকে ফোনে যোগাযোগ করে কথা বলেছেন। আমরা যেতেই একটু মনঃক্ষুন্ন হলেন। প্ৰিয়তোষদাকে দেখে দারোগা বাবুর প্রশ্ন, “কি মশাই এখানেও কি আপনি দপ্তর খুলবেন?”
“আরে মশাই এসব নিয়ে আপনাকে আর গোয়েন্দাগিরি করতে হবে না, এ আমি একাই সমাধান করে নেব। যান মশাই অন্য কোথায় যান।”
সকালবেলা মুখ খারাপ করতে চাইল না প্রিয়তোষদা। নিজের আত্মবিশ্বাসের বলে বলিয়ান, তাই দারোগার কথায় শুধু একটি বাক্য বলল “দপ্তর, ওটা আপনি খুলুন, মক্কেল যদি চায় তাহলে কিছু দেয়, তাতেই চলে যায়। আচ্ছা মিঃ দাস আমি একটু”…”
এই বলে প্রিয়তোষদা সামলে নিয়ে সোজা গিয়ে সমাদ্দারদের বাড়ির চাকরটিকে ধরল।
“কি নাম?”
প্রশ্ন শুনে একটু থতমত খেয়ে গেল চাকরটি।
“আজ্ঞে বাবু – “ভূপতি।”
“তা ভূপতি তুমি কি কাল রাত্রে এই ঘরেই ছিলে?”
প্রিয়তোষদার প্রশ্নটা ওর কাছে শক লাগার মত হল। হঠাৎ কেঁদে না বলবার ভান করল। অনেক চেপে ধরতে ভূপতি জানাল – “বাবু কাল রাত্রে ফিরে আসেন, আমায় বলেন আজ কিছু খাবেন না। উনি ঘরে ঢুকে গেলেন। আমি আর বাবুর সাথে কথা বলিনি। একটু পরে ছোটদাদাবাবু ও দিদিমনিকে বের হতে দেখি। আমি দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে বারান্দায় গিয়ে তা দেখেছি।”
এই বলে একটু থামল ভূপতি।
প্রিয়তোষদা কিছু বলার আগেই আবার শুরু করল।
“দিদিমনি ও ছোটদাদাবাবু ফিরে আসেন, আমি ঠায় দাঁড়িয়ে তা দেখেছি। তার পর আবার দরজা খোলার শব্দ শুনি, ভেবেছিলাম বাবু হয়ত বের হলেন। একটু শরীর ভালো লাগছে তাই যেখানে প্রতি শনিবার যান হয়তো সেখানে গেলেন। আমি আর উঠে দেখিনি। আমায় বলতেন, ‘দরজা খুলে দিবি’। রাত বারটা নাগাদ প্রতিদিন বাবু এলে ভূপতি বলে ডাকে আর আমি সদর দরজা খুলে দিই। কালও আমি সেরকমই ভেবেছিলাম, তাই অত কিছু ভাবিনি। অনেক পরে বাবুর না ফেরায় ভয় পেয়ে যাই আর তারপর … ”
“আচ্ছা বলোতো ভূপতি, প্রতি শনিবার রাতে উনি কোথায় যেতেন?” বলল প্রিয়তোষদা।
ভূপতি বলতে গিয়ে থামল। আসলে এতক্ষণ যা কথা সবই হচ্ছিল অনাদিবাবুর ঘরের পাশে বারান্দায়। কথা বলতে বলতে প্রিয়তোষদা টেবিলে রাখা জলের গ্লাসের দিকে তাকাল। খুব মন দিয়ে কিছু দেখছিল। আমি বললাম, “কি দেখছ?” প্রিয়তোষদা বলল “দেখ ধ্রুব, গ্লাসের জল পুরো আছে, এমন কি জলটা একটু অন্যরকম ঘোলাটে,পাশে ঘুমের ঔষধ একটা খোলা। দেখ, কোথাও ঔষধ পাবি।” আমি ঘরে খুঁজে দেখলাম, বিছানার পাশ থেকে একটা ঔষধ পাওয়া গেল।
“আর বিছানা দেখ অগোছালো। এর মানে অনাদিবাবু বিছানায় ছিলেন, ঘুমের ঔষধ নিয়েও খেতে পারেননি। যদি খেতেন তাহলে জল এক গ্লাস ভর্তি থাকত না। উনি ঔষধ খাননি, কি ঠিক তো?” বলল প্রিয়তোষদা। আবার বলে চলল, “তারপর ওঁর লাশ বাইরে পাওয়া গেল। কেমন অদ্ভুত মনে হচ্ছে না।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, উনি ঘরে এসেছিলেন, আর ভূপতির কথা মত আবার রাতে বেরিয়ে যান। তাই ঘুমের ঔষধ বা জল খাননি।”
“সে তো ঠিক, কিন্তু ঔষধের প্যাকেট খোলা, অথচ জলের গ্লাস ভর্তি? অদ্ভুত লাগছে রে। এর মানে উনি এখানেই ছিলেন, শরীর খারাপ লাগে তখন ঔষধ খেতে যান, তার আগেই ওঁর মৃত্যু হয়। এখানে উনি মারা যান। বিছানা কেউ ঘেঁটেছে। লাশ সরিয়ে নিয়ে বাইরে ফেলে এসেছে।”
“আর গ্লাসের জলটা একটু পরীক্ষা করতে হবে, কারও হাতের ছাপ মিলতে পারে।” বলল প্রিয়তোষদা।
একটু থেমে ডাকল ভূপতিকে। জিজ্ঞাসা করল, “অনাদিবাবুকে জল আর ঘুমের ঔষধ কে দিত, তুমি?”
“ভূপতি সম্মতি সূচক ঘাড় নেড়ে জবাব দিল হ্যাঁ।”
“শোনো ভূপতি তোমাকে এখন আর লাগবে না, তুমি আসতে পার। আর হ্যাঁ আমায় যা বললে তা হয়ত দারোগা বাবুকেও বলতে হতে পারে। ভয় পেও না তুমি কিছু না করলে কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। তবে হ্যাঁ, এলাকা ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করবে না” এই বলে প্রিয়তোষদা থামল।
একটা সিগারেট ধরাতে যাবে এমন সময় হঠাৎ ঘরে একজন মাঝবয়সী লোক গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বললেন, “দেখুন আপনি বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। নিজের এক্তিয়ারে থাকুন।” প্রিয়তোষদা চোখের ইশারায় আমায় বুঝিয়ে দিল যে, ভূপতি যা বলছে তা সত্যি। না হলে ভদ্রলোক এত রেগে যেতেন না।
ভদ্রলোকের কথা এই মুহূর্তে না গায়ে মেখে ভূপতির থেকে যা জানলাম তা জেনেই নিচের অন্য একটি ঘরে যাবার সময় এক সুন্দরী যুবতীকে দেখলাম, বলে দেওয়া ভালো ইনি ভূপতির কথা অনুযায়ী সেই দিদিমনি অর্থাৎ মিঃ সমাদ্দারের মেয়ে। প্রিয়তোষদা চেনে। আর আগের হুমকি দাতা আর কেউ নন – উনি ছিলেন ছোটদাদাবাবু, এটা বুঝতে আমার অসুবিধা হল না।
এর মধ্যে মিঃ দাস হঠাৎ ফিরে এসে বলল, “কি হে, কিছু পেলেন?”
এবার দারোগা বিপুল দাসের গলাটায় কেমন আন্তরিকতার স্বাদ পাচ্ছি, ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হলেও প্রিয়তোষদার কাছে সকালে শুনে ফেলেছি। নিশ্চয়ই দারোগাবাবুর কাছে অনাদি সমাদ্দার খুনের তদন্তের ভার প্রিয়তোষ দত্তর হাতে দেবার খবর উপরতলা থেকে এসে গেছে। তাই উনি এতটা নম্র ভাবে আমাদের সাথে কথা বললেন। আসলে প্রিয়তোষদার পরিচিতি আমাদের গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, ওঁর কলকাতার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট সহ লালবাজারের বড় বড় অফিসার এর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে। ২০০৭ সালের পিয়ালী হত্যা রহস্যের কিনারা করার থেকেই তামাম বাংলা তথা প্রতিবেশী রাজ্যের নামিদামি মানুষেরা প্রিয়তোষ দত্তকে সমীহ করে চলেন। সেটা ২০০৫ সাল হবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করছে প্রিয়তোষদা ও পিয়ালী রায়। দু’জনের ঘনিষ্টতা ক্রমশ গাঢ় হতে থাকে। ইউনিভার্সিটি শেষ করে ক্যাম্পাসিং এ চাকরি, ও তার পর বিয়ে এই ছিল তাঁদের স্বপ্ন। পিয়ালীর বাবা অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার কলকাতা।
প্রিয়তোষদাকে তাঁর খুবই পছন্দ ছিল। এমনই এক বর্ষার দিনে কলেজ স্ট্রিটের কাছে দু’জনের দেখা করার কথা। প্রিয়তোষদার আসতে দেরি হয়। যখন পৌঁছায় তখন পিয়ালী ওখানে ছিল না। সারারাত এক করেও তার টিকি খুঁজে পাওয়া যায়নি। পিয়ালীর বাবা অর্থাৎ ধনঞ্জয় রায় তাঁর সব ক্ষমতা দিয়েও মেয়ের কোনও খোঁজ পাননি। উন্মাদের মত হয়ে ওঠেন। মেয়ের অন্তর্ধান হয়ে যাওয়া কেমন রহস্য সৃষ্টি করে। প্রিয়তোষদা পরদিন পিয়ালীর অর্ধনগ্ন মৃতদেহ আবিষ্কার করে। শোনা যায় দুঃখে, শোকে সেদিন প্রিয়তোষদাকে ধরে রাখা যায়নি।
পুলিশ পিয়ালীর দেহ পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে যায়।
রিপোর্টে জানা যায় পাশবিক অত্যাচার করে পিয়ালীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।
ধনঞ্জয়বাবুকে সামলাতে বেগ পেতে হয়েছিল। একমাত্র মেয়ের মৃত্যু বড্ড আঘাত দিয়েছিল। সেদিন প্রিয়তোষদা পণ করেছিল অপরাধীকে না ধরে এই শহর ছেড়ে কোথায় যাবে না। বহু তদন্ত করে অপরাধী ধরেছিল, সেটা খুবই আশ্চর্যজনক।
আসলে পিয়ালীকে যে হত্যা করেছিল, সে প্রিয়তোষদাদেরই সহপাঠী অমর মজুমদার। দেখতে শুনতে ভালো, হ্যান্ডসাম, বড় বাড়ির ছেলে। অথচ কুসঙ্গে গিয়ে একদম বখে যায়। পিয়ালীর প্রতি লোভ ছিল, ছিল তাকে ভোগ করার বিকৃত মানসিকতা। পিয়ালী অনেক বার সাবধান করেছিল, কিন্তু অধঃপতনে চলে গিয়ে অমর আর ফিরতে পারেনি। প্রিয়তোষ ও পিয়ালীর ভালোবাসা সহ্য করতে না পেরে এমন একটা অধার্মিক কাজ করে বসল। ধনঞ্জয়বাবু সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছিল প্রিয়তোষদাকে। কলকাতা ছেড়ে উত্তরপ্রদেশ চলে যাওয়ার পথে অমরকে ধরা হয়েছিল। ক্লু পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। পিয়ালীর মৃতদেহের কাছ থেকে একটা ব্রেসলেট পাওয়া গিয়েছিল, সেটায় ‘অ’ লেখা ছিল। কিন্তু কলকাতা শহরে এরকম ‘অ’ লেখা ব্রেসলেট একাধিক থাকতে পারে। তাও ব্রেসলেট, চিঠি, মাদক সব কিছু ক্লু এক করে পিয়ালীর হত্যার সমাধান করে প্রিয়তোষদা। মাদকের আসক্তি, গ্যাং এর মাথাকে ধরা এসব নিয়ে কলকাতা পুলিশ পাগল হয়ে গিয়েছিল। শুধু প্রেমের স্বার্থে শখের গোয়েন্দাগিরি করে অমর সহ পুরো মাদক কারবারিদের পুলিশের হাতে তুলে দেবার অসীম সাহস ও প্রচেষ্টা প্রিয়তোষ দত্তর নামকে স্বর্ণাক্ষরে লিখে দিয়েছিল। পুরো ঘটনাটা আমাদের এলাকার দৈনিক খবর কাগজ ‘সংবাদ’ এ বিস্তারিত দিয়েছিল। কারণ প্রিয়তোষদা আমাদের পাড়ার ছেলে। ওঁর বাবা মাধব দত্ত ভূগোলের শিক্ষক ছিলেন। অনাদিবাবুর সাথে ওঁর দারুন আলাপ ছিল। যাই হোক ঘটনার ডিটেলস বলতে গেলে অনাদিবাবুর হত্যা রহস্যের কিনারা করতে পারা যাবে না। শুধু এটুকুই বলব, পিয়ালীর হত্যাকারীকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য ধনঞ্জয় বাবু প্রিয়তোষদাকে আজও স্নেহ করেন, ভরসা করেন। জামাই করতে পারেননি, তাও মেয়ের খুনিকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পেরে তিনি তৃপ্ত হন। এখনও ওঁর সাথে প্রিয়তোষদার যোগাযোগ আছে। প্রিয়তোষদা কলকাতার চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে মহুয়া বৌদিকে নিয়ে দিব্যি সংসার করছে। মাঝে মাঝে আমিও যাই বৌদির হাতের চা খেতে। এখন প্রিয়তোষদার পৈত্রিক সম্পত্তি সামলানো ও শখের গোয়েন্দাগিরি এটাই দিননামচা। পিয়ালীর স্মৃতি মুছে ফেলা যায়নি, তাও পিয়ালীর বান্ধবী, বলতে গেলে প্রিয়তোষদারও সহপাঠী, মহুয়া মুখার্জীকে অনেক দিন পর বিয়ে করে। এই বিয়ে করতে ধনঞ্জয় বাবুই একপ্রকার জোর করেছিলেন। মহুয়া মুখার্জী হলেন ধনঞ্জয় বাবুর সহকর্মী মিস্টার অজিত মুখার্জীর একমাত্র মেয়ে। অজিত বাবুও লালবাজারে উচ্চপদে আসীন।
অগত্যা প্রথম প্রেমের ভয়ানক পরিণতি হবার পর আর বিয়ে না করার পণ ভাঙতে হয়েছিল প্রিয়তোষদাকে। গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে।
গতকাল রাত্রে নোয়াপাড়া থানার কাছে লালবাজার থেকে ফোন আসে যে অনাদি সমাদ্দারের খুনের তদন্ত সমান্তরালভাবে পুলিশের সাথে প্রিয়তোষ দত্ত করে যাবে, এক্ষেত্রে কোনও বাধা যেন পুলিশের তরফ থেকে না আসে। অগত্যা দারোগা দাসবাবুর এই শুভ চেতনা।
যাই হোক এর মধ্যে মিঃ দাস বললেন, “ছেড়ে দিন মিঃ দত্ত, এটা খুন টুন নয়, ব্যক্তির হার্ট ফেল। আশেপাশে মার্ডার ওয়েপেন বলে কিছু পাইনি। দেহ পোস্টমর্টেমে গেছে কাল রাত্রে, আজ বৈকালে রিপোর্ট এসে যাবে। অনাদিবাবুর দেহে কোন ক্ষত নেই। সুতরাং এখানে সময় নষ্ট করে কোন লাভ নেই মিস্টার দত্ত, আপনি এর পর তদন্ত চালাতে পারেন আমাদের কোন অসুবিধা নেই।” এই বলে দারোগা বাবু চলে গেলেন।
বাইরে তখন মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে, ঠান্ডা ভাব আছে। যদিও গ্রামের নীরবতা বুঝিয়ে দিচ্ছে এখনও কারও ঘুম ভাঙেনি। গতকাল রাতে যত লোক ছিল, আজ তার সিকি ভাগও জনসমাগম নেই এই বাড়ির আশেপাশে। দু’একজন উঁকি মেরে গেলেও সেই ভাবে কারও দেখা নেই।
সিঁড়ির কাছে প্রিয়তোষদা দাঁড়িয়ে আছে। কিছু একটা মন দিয়ে দেখছে। আমি বললাম, “ওটা কী?”
প্রিয়তোষ তা বলল, “দেখ এটা।” কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। ক্যালেন্ডারে সব পূর্বপুরুষের নাম আর তার পাশে ছবি, এমনকি অনাদিবাবু ও তার পরবর্তী জেনারেশনের ছকে তিনটি ছবি। প্রিয়তোষদা মন দিয়ে দেখতে বলল। আমি দু’জনকে বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু তৃতীয় জন কে ঠিক বুঝতে পারলাম না।
পরে বুঝলাম ওটা ক্যালেন্ডার নয়, বংশলতিকা!
অনাদিবাবু তিন সন্তানের পিতা এটা তো জানা ছিল না। আর আমরা সমাদ্দারদের বাড়িতে সময় নষ্ট করিনি। কারণ অনাদিবাবুর স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের জিজ্ঞাসাবাদ পরে করা হবে এই ভেবেই আমরা বেরিয়ে এলাম।
প্রিয়তোষদা ও আমি পদুদার চপের দোকানে গেলাম। “কি রে খিদে পাচ্ছে না?”
“এমন করে কেউ বললে না বলতে পারি না আমি। আফটারঅল তুমি আমার দাদা হও।”
“চল খাওয়া যাক।” আমি বললাম, “বৌদি কিছু বলবে না?”
প্রিয়তোষদা বলল, “তোর বৌদি সব জানে। তাই বাইরে কোথাও খেয়ে মধ্যপ্রদেশকে ঠান্ডা করে তবেই কেসটার জট খুলতে পারব রে ধ্রুব।”
“সে না হয় হল,কিন্তু ….”
আমার কথা শেষ হল না, এরই মধ্যে প্রিয়তোষদা আমার হাত চেপে ধরেছে আর কিছু ইঙ্গিত করছে। আমি সে দিকে চেয়ে রইলাম। একটা সাদা অ্যাম্বাসেডর আমাদের কাছে এসে থামল। কার্তিক কাকার দোকানে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করে উল্টো দিকে ঘুরলেন। এক মাঝবয়সী লোক চোখে সানগ্লাস, পরনে নীল টাউজার্স, পায়ে কালো বুট, গলায় টাই ও হাতে সুটকেস। বিদেশি তেল, গায়ে পারফিউম ও মুখে চুরুট। ধোঁয়াটা ছেড়ে সানগ্লাস খুলে আমাদের দিকে এগিয়ে এল।
“নমস্কার, আপনি মিঃ দত্ত, মানে ডিটেকটিভ প্রিয়তোষ দত্ত।” প্রিয়তোষদা প্রতি নমস্কার জানাল।
উনি বলে চললেন, “আমি শতদল রায়। নিবাস কলকাতা। পারিবারিক ব্যবসা।” প্রিয়তোষদা কিছু বলার আগেই উনি বললেন, “মিঃ সমাদ্দারের সাথে একটু অন্য সম্পর্ক ছিল আমার। গতকাল সকালে মিঃ সমাদ্দারের ফোন পাই। উনি আজ আমায় দেখা করতে বলেন, অথচ বাসস্ট্যান্ডে এক ভদ্রলোক জানালেন ‘ওদিকে যাবেন না, হেব্বি ঝামেলা। বিশিষ্ট সমাজসেবী অনাদি সমাদ্দার খুন হয়েছেন।’ কাল উনি আপনার কথা বলেছিলেন যদিও সেটা কথায় কথায় এসে গিয়েছিল এমনকি আপনার ঠিকানাও দিয়েছিলেন যদি কোনও দিন কাজে লাগে। অথচ আজ একটি বিশেষ কারণে আমায় আসতে বলেন। ওঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে কলকাতা ফিরে না গিয়ে সোজা আমি আপনার কাছেই চলে এলাম। বৈষয়িক সম্পত্তি নিয়ে মিটিং ডেকেছিলেন উনি। উকিল ঠিক করেই ছিলেন। এখন উনি নেই তাই আমার ব্যাপারটা কী হবে তাই আপনার কাছে এলাম মিঃ দত্ত।” এই বলে উনি থামলেন।
প্রিয়তোষদা বলল, “জানি অনাদিবাবু আজ আমায় ওঁদের বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন, সম্ভবত উইল করার সময় সাক্ষী থাকার জন্য। কিন্তু আপনার কথা তো বলেননি?”
প্রিয়তোষদা সঙ্গে সঙ্গে বলল, “আপনাকে কোথায় দেখেছি?” একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে প্রিয়তোষদা চুপ হয়ে গেল।
আমি বলতে যাব, হাতটা টেনে নিয়ে প্রিয়তোষদা অন্য কথায় চলে গেল। “আচ্ছা মিস্টার রায় আপনার সাথে অনাদিবাবুর ঠিক কি সম্পর্ক ছিল?”
ব্যক্তিগত কেচ্ছা না ঘেঁটে যে তথ্যটা শতদল রায় দিলেন সেটা এইরকম …
“১৯৮৫ সালে আমার মা মিনতিদেবী বিবাহ সূত্রে আসেন হাওড়ায়। ওঁনার সাথে বিয়ে হয় আমার বাবা কামদারঞ্জন রায়ের। এক বছর পর জন্মগ্রহণ করলাম আমি। বছর দশেক পর ঝড়ের মত ফিরে এল আমার মায়ের পুরানো প্রেমিক বন্ধু অনাদি সমাদ্দার। বাবা এই নিয়ে খুবই অশান্তি করেছিলেন। এক বর্ষার রাত্রে বাবা খুন হলেন। অনেক তদন্ত করেও বাবার খুনি ধরা পড়ল না। এমতাবস্থায় মা আশ্রয় নিলেন অনাদিবাবুর প্রাসাদোপম এই এলাকার বাড়িতে। অনাদিবাবুর একাধিক জায়গায় বাড়ি কেনা আছে। অনাদিবাবুর স্ত্রী বিমলাদেবী আমাদের মেনে নেয়নি। অগত্যা হাওড়ার আমতাতে এক বাড়িতে ঠাঁই হল। শোনা যায় অনাদি সমাদ্দার তাঁর অন্য সম্পত্তির একটা অংশ মাকে লিখে দেবেন, আর এই বাড়িটা আমার জন্য লিখে দেবেন এমন স্থির করেন।খবরটা জানতে পেরে বাড়ির লোক তুলকালাম বাধিয়ে দেয়। স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা কেউই আমায় মেনে নেয়নি। এর পর আমতা ছেড়ে আমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে আসেন আমার মা। অনাদিবাবু নিজে বহুবার চেষ্টা করেও আমাদের খবর পাননি। পড়াশোনা শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াই। প্রতিহিংসা মা’র মনে যে এভাবে ছিল আমি তা জানতাম না। হঠাৎ আমার মা অনাদিবাবুর ঠিকানাতে হুমকি চিঠি দিতে থাকেন। এরকম ব্ল্যাকমেইল চলছিল। মোদ্দা কারণ ছিল আমার জন্য লেখা বাড়িটি ফিরিয়ে দিতে হবে, এবং আমাকে নিজের ছেলের মত সম্মান দিতে হবে। কারণ প্রেম করে আমার মাকে ছেড়ে চলে যান অনাদিবাবু এটা আমি মায়ের কাছে পরে জানতে পারি। পরে মা’র বিয়ে হয়ে যায় এবং বহুবছর অনাদিবাবুর সাথে কোনও যোগাযোগ ছিল না। নিজের ছেলে, মেয়ে এবং স্ত্রীর হাত থেকে বাড়িটি উদ্ধার করাই মায়ের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে যায়। আমি ডাক্তারি নিয়েই ছিলাম। কোনও অভাব ছিল না, অথচ মায়ের অনাদিবাবুর দেওয়া বাড়ির প্রতি এত কিসের লোভ আমি তা ভেবে পাই না। জানতে পেরে অনেকবার বারণ করেছিলাম, কিন্তু কে কার কথা শোনে। মা বলত, “ওঁর স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা কীভাবে তোকে দেওয়া সম্পত্তি আটকে রাখবে?”
মা মনে করত শুধু স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নন এসব অনাদিবাবুর নিজের মতিভ্রম। প্রেম করে ছেড়ে চলে যায় যে মানুষ, সে সম্পত্তি দেবে বলে আবার কেড়েও নিতে পারে। তাই অনাদি সমাদ্দারকে শান্তিতে থাকতে দেব না, এই ছিল আমার মায়ের এক ও একমাত্র লক্ষ্য।”
শতদল বলে চলল …
“দেখুন গতকাল থেকে মাকে খুঁজে পাচ্ছি না, আর আজ শুনলাম অনাদিবাবু খুন হয়েছেন। তাই আমার মনে হয় মিঃ দত্ত, আমার মা এই খুনটা করেনি তো?
সত্যি বলতে কি কাল রাত থেকে মাকে পাওয়া যায়নি। পুলিশে কমপ্লেন করেছি, আর আজ অনাদিবাবুর খুনের পর আমার মনে হয়েছে আপনি আমায় আমার মা কে খুঁজে দিতে পারেন। মা ভুল করলে তাকে যদি বাচানো যায় তাই আপনার কাছে এলাম।
সত্যি বলতে কী লোভ আমার নেই। পারিবারিক ছোট ব্যবসা আছে আর ডাক্তারি এই নিয়ে দিব্যি কেটে যাচ্ছে। আমার লোভ না থাকলেও মা’র কেন এত লোভ, এর উত্তর জানতে চাই।”
প্রিয়তোষদা মিস্টার শতদল রায়কে আপাতত বাড়ি চলে যেতে বলল, আর তার ঠিকানা ও ফোন নম্বর নোট করে নিল। শতদল রায় তার অ্যাম্বাসেডর করে চলে গেলেন। শতদলের কথাগুলো প্রিয়তোষদার মনে বারবার আঘাত হানতে লাগল।
প্রিয়তোষদা এসব শুনে বেশ চিন্তিত হয়ে গেল, এবং আমাকে বলল, “যে দেখ একটা বিষয় মেলান যাচ্ছে না শতদল যদি তার মা’র প্রেমিকের কথা জানত তাহলে কি সে একবারও প্রতিহিংসা বা লোভের বসে খুন করত না? নাকি শতদল মিথ্যে কথা বলছে।”
প্রিয়তোষদা আমাকে বাড়ি চলে যেতে বলে নিজেও বাড়ি চলে গেল। বৈকালে প্রিয়তোষদার বাড়িতে যখন গেলাম তখন তদন্তকারী অফিসার দারোগা মিঃ দাস এসে হাজির। দারোগা জানালেন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট খুব তাড়াতাড়ি হাতে এসেছে। খুনটা কোনও বিষের প্রভাবে হয়নি, সম্ভবত অতিরিক্ত মদ্যপান ও অ্যালকোহলের ফলে হার্ট ফেল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা প্রিয়তোষদা দেখেই বুঝে গেল। দারোগা বাবুকে নমস্কার করে দরজা অবধি এগিয়ে দিল আর ফিরে এসে বলল, “ওই বাড়িতে আর একবার যেতে হবে রে ধ্রুব, ডাল মে কুছ কালা হ্যায় …”
প্রিয়তোষদা ড্রয়িং রুমে বসে এক মনে কিছু ভাবছে। আমায় চিন্তিত দেখে বলল, “খুনের ব্যাপার বাবুর মনে জমাট অন্ধকার তাই তো, সমাধান না হলে শান্তি নেই …”
আমাকে খুব ভালো বোঝে প্রিয়তোষদা। জানি অনাদিবাবুর প্রতি তাঁর একটা দুর্বলতা আছে। কেদারনাথ লাইব্রেরির জন্য প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা ডোনেশন দেওয়া ও এলাকার দুঃস্থ মানুষদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করার মত এমন মানুষের এই পরিণাম ঠিক মেনে নিতে পারছে না প্রিয়তোষদা।
লাইব্রেরিতে একবার ঘুরে এসেছে। কী একটা বই আজ খুঁজে পেয়েছে, সেখানে অনাদি সমাদ্দারের কথাও আছে। এলাকার বিশিষ্ট মানুষদের ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারি নিয়ে ঐ বইতে বহু চর্চা হয়েছিল। এলাকার একটি সংবাদ পত্রেও কিছুটা বেরিয়ে ছিল। তবে কালের নিয়মে সব অন্ধকারের বদ্ধ কুঠুরিতে চাপা পড়ে যায়। “পুরানো খবর কাগজ ও বইটা এই লাইব্রেরিতে পাব সেটা ভাবতে পারিনি।” বলল প্রিয়তোষদা।
যাইহোক অনেক তথ্য পেলেও এখনও বিমলাদেবী, দিদিমনি অর্থাৎ সরমা ও ছোটদাদাবাবু অর্থাৎ হরিবংশকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। মিস্টার দাস যতটুকু পেরেছিলেন করেছেন, কিন্তু প্রিয়তোষদা এখনও কিছু জেরা করেনি।
সারাদিনের ক্লান্তির পর প্রিয়তোষদার বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ একটা ফিসফিস শব্দে ঘুম ভাঙলো। প্রিয়তোষদা বলছে, “একবার ঘুরে আসি চল”। আমি ঘুম চোখে বললাম, “এখন?”
প্রিয়তোষদা বলল, “অনেক কিছু ঘটবে শিগগিরই চল।”
আমি বেরিয়ে পড়লাম। এখন রাত ১১.৩০টা। আমরা দাঁড়ালাম ঘোলপাড়ার কাছে একটা পোড়ো মন্দিরের সামনে। দুজন নারী-পুরুষকে কথা বলতে দেখলাম, তবে স্পষ্ট কিছু বুঝতে পারলাম না। প্রিয়তোষদাও খুব একটা বুঝতে পারেনি। অন্ধকারে কারা এসেছিল ঠিক না বুঝে আমাদের মনে আরও সন্দেহ বাড়িয়ে দিল। পাশেই অনাদি সমাদ্দারের বাড়ি সেখান থেকে ১২টার ঘন্টা স্পষ্ট শোনা গেল। কাল ওই বাড়ির কর্তা মারা গেছেন, আজ বাড়িটা খুব নিঝুম লাগছে। কেউ নিশ্চয়ই প্রিয়তোষদাকে খবর দিয়েছিল, পোড়ো মন্দিরের কাছে কারও আসার কথা। শুধু এইটুকু তথ্যের ওপর ভরসা করে প্রিয়তোষদা আর আমি চলে গেলাম। সারারাত আর সেই ভাবে ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে যায়।
সোমবার।
সকালে ঘুম ভাঙলো প্রিয়তোষদার ফোনের রিংটোন শুনে।
মান্না দের গাওয়া গানের রিংটোনে -”জাগো, নতুন প্রভাত জাগো সময় হলো …”
প্রিয়তোষদা কারও সাথে খুব ধীরে সুস্থে কথা বলছিল, এবং এটাও বোঝা গেল যে এক্ষুনি কোথাও যাবার কথা হচ্ছে। ফোনটা ছেড়ে আমাকে তৈরি হয়ে যেতে বলল।
সকাল ৭টা।
আমি ও প্রিয়তোষদা পৌঁছালাম অনাদি সমাদ্দারের বাড়ি। বাড়ির পাশে দু’টো কনস্টেবল পাহারা দিচ্ছে। ঘরে ঢুকে বুঝলাম বিমলাদেবী রাগে ফুঁসছেন। আমরা গেলাম বিমলাদেবীর কাছে। উনি প্রশ্নের আগেই উত্তেজিত হয়ে বললেন, “ঐ কুলাঙ্গার শতদল কেন এসেছে, কেন ওকে আপনারা আমাদের বাড়ির পাশে আসতে দিচ্ছেন? শতদলের মা আমার স্বামীকে মেরেছে। আমি ওদের ছাড়ব না।”
প্রিয়তোষদা বলল “আপনার জন্য আমার সমবেদনা রইল। কিন্তু কিছু প্রশ্ন করতে চাই। আপনার এই খুন নিয়ে কাউকে সন্দেহ হয় কি? যদি বিস্তারিত বলেন।”
“শুধু একটা কথা জানতে চাইব কাল আপনি ১১টা নাগাদ কোথায় ছিলেন?”
বিমলাদেবী বললেন, “প্রতিদিন আমি ১০.২০ র মধ্যে নিজের ঘরে চলে যাই, কালও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আর উনি রাতে আড্ডা দিয়ে ১২টার কাছাকাছি চলে আসতেন। ভূপতি ওঁর দেখাশোনা করত।”
“আচ্ছা কিছু সন্দেহ হলে বলবেন।” আপাতত আমরা উঠে গেলাম সরমার কাছে। খুব শান্ত গলায় সে প্রিয়তোষদার কথার উত্তর দিতে থাকল।
বিশেষ কিছু জানতে চাইল না প্রিয়তোষদা। শুধু বলল, “শনিবার রাত্রে তুমি কোথায় ছিলে?”
সরমা থতমত খেয়ে বলল, “আমি এক বান্ধবীর থেকে নোট নিতে বের হই, তবে একটু পরেই চলে আসি। বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।” অথচ ঘরে একটা আইডেন্টিটি কার্ড দেখে সন্দেহ হল, পরে বুঝলাম ওটা নার্সিংয়ের।
“আচ্ছা ঠিক আছে।” এই বলে এবার আমরা গেলাম হরিবংশের কাছে। সেও একই ভাবে কাল রাতে একবার বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল একথা জানাল। প্রিয়তোষদা বুঝল সবাই কিছু একটা ব্যাপার লুকোচ্ছে। যাই হোক আমরা উঠে পড়লাম। আজকের মুচমুচে খবর যেটা প্রিয়তোষদা আমায় জানাল সেটা হল সরমা ও ডঃ শতদল এর মেলামেশা। যাকে মা অপছন্দ করে, এলাকায় দেখলে সহ্য করতে পারে না, তাঁর মেয়ে সেই শত্রুর সাথে মিশছে, এটা কেমন অদ্ভুত লাগল। যে শতদল বহুদিন এখানে থাকে না, সে সরমার সাথে সম্পর্ক রাখবে কি করে …
এমন প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। প্রিয়তোষদা আজ আমায় দুপুরে বলল, “শোন, তু্ই শতদলের উপর নজর রাখিস।”
প্রিয়তোষদার কথায় আমি পুরোদমে শতদলের পিছু নিলাম। কলকাতা থেকে কখন আসছে সেটা নজর রাখতে শুরু করে দিলাম। বেলাতে শতদলবাবুকে একবার ডেকে পাঠিয়ে প্রিয়তোষদা জানতে চাইল, “আপনি সরমাকে ঠিক কত দিন ধরে চেনেন?
“আপনি তো ডাক্তারি পড়তে কলকাতায় ছিলেন, এখনও থাকেন কলকাতায়।একবার বালক বয়সে অনাদিবাবুর বাড়িতে আসেন, কিন্তু তখন সম্ভবত সরমার জন্ম হয়নি তাই তো…? সেই হিসাবে আপনার চেনার কথা নয়, কি তাই তো?”
প্রশ্ন শুনে শতদল একটু ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বলল, “না ..ইয়ে মানে …” – কথাটা এড়িয়ে গেল। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হল না যে এরা আগে থেকেই পরস্পর পরস্পরকে চেনে। কথাটা হচ্ছিল অনাদিবাবুর বাড়িতে। ডঃ শতদল একপ্রকার পালিয়ে গেল। অনাদিবাবুর চাকর ভূপতি কিছু একটা বলতে যেতেই, বিমলাদেবী তা আটকে দিল। ঘরের নিস্তব্ধতা আরও বেড়ে গেল। এরই মধ্যে আড়ালে এসে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক আমাদের কিছু জানাল। মোটামুটি জেরা শেষ করে প্রিয়তোষদা দারোগা বাবুকে বলল, “সকলের হাতের ছাপ তুলে নিন।” দারোগা দাসবাবু চলে গেলে আমায় এক জায়গায় নিয়ে গেল প্রিয়তোষদা। আসলে ওর কথা মত পার্বতী হোটেলে ফাঁদ পাতা হয়েছিল। দু’জন অল্পবয়সী যুবক ও যুবতী হোটেলের চাবি নিয়ে রুমে চলে গেল। গাড়িটা দেখে যুবককে চিনতে অসুবিধা হল না। সঙ্গে মেয়েটিকেও..
আমি বলতে যাচ্ছি অমনি প্রিয়তোষদা মুখে হাত দিয়ে বলল, “চোরি চোরি চুপকে চুপকে …”
ওদের সম্পর্কটা এত দূর এগিয়েছে যে, ওরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। গতকাল রাত্রে যাদের কথা শুনেছিলাম পোড়ো মন্দিরের পাশে সেটা এদের দু’জনের। একদিন আগে অনাদিবাবু মারা গেছে, অথচ এদের কিছু আসে যায় না। ছিঃ..
এই বলে আমি প্রিয়তোষদার সাথে এগিয়ে চললাম।
প্রিয়তোষদা অনাদিবাবুর জলের গ্লাসটা নিয়ে কলকাতার ল্যাবে পাঠাতে বেরিয়ে পড়ল। ওর কেমিস্ট বন্ধু নীলকে টেস্ট করতে দিতে গেল। আরও কয়েকটা কাজ সেরে একটু বাদে ফিরল। আজ যাবার সময় নিজেই গাড়ি চালিয়ে গিয়েছিল।
বিকাল ৪টে।
আমি কেসটার ব্যাপারে জানতে প্রিয়তোষদার বাড়ি গেলাম। আমি সোফায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। “এবার প্যাঁচ একটু একটু খুলতে শুরু করেছে রে ধ্রুব।” এই বলে উৎসাহে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল প্রিয়তোষদা। বলল, “তাহলে সন্দেহের তালিকায় সবাই আছে তাই তো, বিমলাদেবী, ভূপতি, হরিবংশ, সরমা, শতদল আর শতদলের মা মিনতিদেবী। দেখ মোটিভ সবার আছে। কিন্তু কে খুন করল অনাদিবাবুকে, এই প্রশ্নই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।”
হঠাৎ কলিং বেল। বৌদি ভিতরঘরে ছিল , তাই দরজা খুললাম আমি। এক মহিলা ঘরে এলেন। আমায় বললেন যে তাঁর ডিটেকটিভ প্রিয়তোষ দত্তর সাথে কথা আছে। আমি মাঝবয়সী ভদ্র মহিলাকে চেয়ারে বসালাম। প্রিয়তোষদা বাথরুম থেকে আসার পরেই তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হলো। ভদ্রমহিলা তাঁর নাম বললেন সুলতা।
প্রিয়তোষদা তার সাথে কী দরকার সেটা জানতে চাইল। আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তা নোট করতে থাকলাম। সুলতা দেবী বলে চললেন, তাঁর বাড়ি দক্ষিণ কলকাতায়। তাঁর স্বামীর নাম শতদল। মানে ডঃ শতদল রায়। এই শুনে প্রিয়তোষদা ও আমি চমকে উঠলাম। আমার মনে উঁকি দিল তাহলে সরমার সাথে প্রেম …
এসব কী হচ্ছে, জট যে আরও পাকিয়ে যাচ্ছে। সুলতা বলেই চলল…
তাঁর স্বামীর বদমেজাজ। সরমা বলে মেয়েটিকে নিয়ে তাঁদের দাম্পত্য কলহ নিত্য দিনের সঙ্গী। সুলতা দেবীর থেকে শতদলের চরিত্রের যতটুকু আঁচ পেলাম তাতে নারীসঙ্গ ও বহুগামীতার একটা আভাস মিলেছে। ভদ্রমহিলার থেকে পাওয়া তথ্য থেকে অনাদি সমাদ্দারের খুনের জট খুলতে সাহায্য করবে।
এরই মধ্যে প্রিয়তোষদা অনাদিবাবুর উকিলের সাথে একবার দেখা করে এল। আমি তখন বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম। এই দু’দিন সেই ভাবে বাড়ি যাওয়া হয়নি।
মঙ্গলবার।
সকালে হালকা বৃষ্টি হলেও সারাদিন রৌদ্র ও মেঘের খেলা বেশ ভালই লাগছে। বৈকালে আমার অনাদি সমাদ্দারের বাড়ি যাবার কথা। আমি সমাদ্দারদের বাড়ি না গিয়ে প্রিয়তোষদার বাড়ি গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। বৌদি বলল, “ও তো এখনও আসেনি।”
আমি বসে আছি, এমন সময় প্রিয়তোষদা এল। বলল, “তু্ই এখানে কেন? তোকে তো…”
আর কথা শেষ না করেই মিঃ দাসকে ফোন লাগাল।
কথাটা ঠিক এরকম হল ..
“হ্যালো, মিঃ দাস …
এক্ষুনি আপনি ফোর্স নিয়ে সমাদ্দারদের বাড়ি চলে আসতে পারবেন?”
মনে হল ও প্রান্তে হ্যাঁ সূচক কিছু শুনে
এ প্রান্তে প্রিয়তোষদা বলল, “তাহলে ঐ কথাই রইল, ৩০ মিনিটের মধ্যে ওখানে দেখা হচ্ছে রাখলাম।”
“ধ্রুব তু্ই চলে আয়, এক্ষুনি অনাদি সমাদ্দারের বাড়িতে খুন ও প্রতিহিংসার যবনিকা পতন ঘটবে।”
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, “সবাই কে কি ডেকেছ?”
প্রিয়তোষদা বলল, “হ্যাঁ, মিঃ দাস সন্দেহভাজন সকলকেই ও বাড়িতে আনবেন, কেউ পালাতে পারবে না।”
“আচ্ছা এতক্ষণ তুমি কোথায় ছিলে?”
প্রিয়তোষদা বলল, “আরও একটা খুনের হদিস করে ও তার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে এলাম।” “বলেই হাসতে থাকল …
আমি কিছু বুঝলাম না।
প্রিয়তোষদা সঙ্গে নিল তার পিস্তলটা।
প্রিয়তোষদা ও আমি চললাম অনাদি সমাদ্দারের প্রাসাদোপম বাড়িতে। গেটের সামনে সাদা গাড়ি দেখে বুঝতে অসুবিধা হল না যে ওটা শতদলের। রবিবার অর্থাৎ গতকাল থেকে শতদল কলকাতা নয় এই এলাকার কাছাকাছি ছিলেন, তাই আধঘন্টার মধ্যে দারোগা বাবু তাকে সমাদ্দারদের বাড়িতে হাজির করতে পেরেছেন। যাই হোক কথা অনুযায়ী বাড়ির সব সদস্য ও বাইরের কয়েকজন সন্দেহভাজনকে সমাদ্দারদের বাড়িতে হাজির করান হয়েছে।
ঘরের মাঝ বরাবর বিমলাদেবী, হরিবংশ। আমাদের ডানদিকে এক কোণে শতদল, তার বামদিকে সরমা বসে আছে। আমাদের বামদিকে এক ধারে মেঝেতে বসে চাকর ভূপতি। সুলতা বসে ঠিক হরিবংশের পাশে। এছাড়াও দারোগা বাবু, কনস্টেবল কয়েকজন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। বকুলকে সঙ্গে করে আনা হয়েছে, সে কিছু দেখেছিল। বকুল প্রিয়তোষদার বাড়ি মাঝে মাঝে আসে। আমার সাথে দারুন ভাব। বকুল এখন কম্পিটিটিভ এক্সাম এর জন্য কিছুটা সাহায্য নিতে প্রিয়তোষদা ও বৌদির কাছে আসে। মনে মনে আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু বকুল কে এখানে আনা কি ঠিক হল আমি ভাবতে লাগলাম। ঘরে একটা পাখা ঘুরছে, তার শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে এখন। আজকের সন্ধ্যায় যে কী ঘটতে চলেছে তা ভেবে আমি উত্তেজিত। প্রিয়তোষদা কিছু বলার আগে গোটা ঘর জুড়ে এক নিস্তব্ধতা গ্রাস করল। নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পেলাম। চাপা টেনশনে শুধু চুপ করে রইলাম। ঘড়িতে তখন ৫টার ঘন্টা পড়ল। প্রিয়তোষদা এবার মৌনব্রত ভাঙল। বলল, “এবার আমি আপনাদের সকলকে একটা গল্প বলব, আপনারা সবাই খুব মন দিয়ে শুনবেন।”
এই বলে প্রিয়তোষদা শুরু করল…
“অনাদিবাবু ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তবে আমি স্টাডি করে যতটুকু জেনেছি ওঁর অতীত মোটেও ভাল ছিল না। আশির দশকের মাঝামাঝি তিনি তাঁর যৌবনকে অন্য ভাবে উপভোগ করতে থাকলেন। বহু নারীসঙ্গ তাকে উদ্দাম ও পাগল করে তুলল। ভালো মন্দের ফারাক বুঝতেন না। এমনই এক ভুলের ফসল শতদল।”
কথাটা শেষ করতেই ডঃ শতদল চেঁচিয়ে উঠে বলে, “আপনি মিথ্যা কথা বলছেন, আপনি আমার মা, বাবাকে অপমান করছেন।”
মিঃ দাস তাকে সামলাতে ব্যস্ত হলেন। প্রিয়তোষদা বলে চলল…
“কামদারঞ্জন বাবুর সাথে মিনতিদেবীর বিবাহ হবার আগেই জন্ম নেন মিনতিদেবী ও অনাদিবাবুর অবৈধ সন্তান শতদল। এদিকে অনাদিবাবুর বাবা ছেলের কুকীর্তির জন্য মেয়ে দেখে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। অগত্যা অনাদিবাবুকে কলকাতা ছেড়ে গ্রামে চলে আসতে হয়। অনাদি সমাদ্দারের বাবা রাশভারী লোক ছিলেন, তাই সম্পত্তির ভাগ বেহাত হবার ভয়ে অনাদিবাবু তাঁর বাবার কথায় বিবাহ করে গ্রামেই ব্যবসা সামলাতে লাগলেন। প্রায় পাঁচ বছর পর ওঁর পুত্রসন্তান হল। এই কয়েক বছরের মধ্যে অবৈধ সন্তানের কথা একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলেন। মিনতিদেবী তাঁকে তা ভুলতে দিলেন না। দাবি ছিল শতদলকে স্বীকৃতি দিতে হবে, সঙ্গে তার অগাধ সম্পত্তির কিছু অংশ। অনাদিবাবু শুরুতেই বীজ উপড়ে ফেলতে চাইলেও তা হয়ে ওঠেনি। এর মধ্যে মিনতিদেবীর প্রস্তাব একপ্রকার অস্বীকার করেই তাঁকে বাইজি বলে দূরে ঠেলে দেন। মিনতিদেবীর সাথে এক ভাল লোকের আলাপ হয়, যিনি বিবাহ করেন ও সন্তান স্নেহে মানুষ করেন শতদলকে। এই ভাবে বেশ চলছিল। শতদল তাঁর বাবার চেষ্টায় দুর্দান্ত রেজাল্ট করে। বড় হয়ে ডাক্তারিতে সে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে। সরমার সাথে আলাপ ডাক্তারি করতে গিয়ে। সরমা মেডিকেল কলেজের নার্সিং ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে। ডাক্তার ও নার্সের প্রেম সেখান থেকেই। ডঃ ও নার্সের ডিউটির সময় অভিসারে যাওয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেনে নেননি। দু’জনকেই বরখাস্ত করেন। অথচ শতদল জানত না যে প্রেমিকা আসলে তার বাবারই মেয়ে অর্থাৎ সম্পর্কে তারা ভাই-বোন। প্রেম ও ভালোবাসা এসব জানার তাগিদ দেয়নি। একাধিক বার নিশিযাপন এসব চলতেই থাকল। এমনকি এখানে এসে গতকালও পার্বতী হোটেলে দু’জনকে দেখা গিয়েছে। একদিন ঐ পার্বতী হোটেলে এমনই এক রাত্রে শতদল ও সরমাকে ঘনিষ্ট অবস্থায় আবিষ্কার করেন অনাদিবাবু। সেদিনই তিনি স্থির করেন সব সম্পত্তি তিনি বৈধ সন্তান হরিবংশকে দেবেন। উল্লেখ্য প্রতি শনিবার পার্বতী হোটেলে অনাদিবাবু মনিকা নামে এক রহস্যময়ীর সাথে দেখা করতে যেতেন। মনিকা দেবীর থেকে জেনেছি ওঁর সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল অনাদিবাবুর। খারাপ কিছু নয়।এই নিয়ে বিমলাদেবীর সাথে তাঁর অশান্তি হত। যাই হোক এর পর উইল বানাতে উকিল বাবুকে ডেকে পাঠান। আমাকেও ডেকেছিলেন,” বলল প্রিয়তোষদা।
“কারণ উনি মনে করতেন যে তাঁর মেয়ে সরমা বিগড়ে গেছে তাঁর স্ত্রী বিমলাদেবীর প্রশ্রয়ে। তাই সম্পত্তির পুরোটা পাবে তাঁর ছোটছেলে হরিবংশ। কিন্তু এটা জানতে পেরে বিমলাদেবী, সরমা ও ডঃ শতদল তিনজনই খুশি হয়নি। অন্যদিকে মিনতিদেবী সামাজিক স্বীকৃতি না পেয়ে প্রতারিত হয়ে অনাদিবাবুকে প্রাণে মেরে দেবার প্ল্যান বানান। পরে অনাদিবাবুর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হতে উনি আর কিছু ভাবেননি।”
এবার দেখলাম বিমলাদেবী, সরমা, হরিবংশ সবাই একে অপরজনের দিকে তাকিয়ে আছে। আবার বলে চলল প্রিয়তোষদা। “এই অবধি শুনলে বুঝবেন যে, অনাদিবাবুকে মারার জন্য সকলের মোটিভ অল্প হলেও আছে। হরিবংশ সম্পত্তির পুরো ভাগ পেলেও বাবার অবৈধ সন্তানের কথা সে আগেই জানত, কারণ শতদলের বাবা কামদারঞ্জন বাবু মারা যাবার পর এই বাড়িতে বালক শতদলকে নিয়ে মিনতিদেবী একবার এসেছিলেন, এমনকি কয়েকদিন ছিলেনও। সালটা ১৯৯৬এর আশেপাশে। তখন বিমলাদেবী অন্তঃসত্ত্বা। বিমলাদেবীর প্রবল আপত্তিতে তাঁদের এখান থেকে চলে যেতে হয়। উল্লেখ্য কামদারঞ্জন বাবুর মৃত্যুর সাথে শোনা যায় অনাদিবাবুর হাত ছিল। তবে সেটা মিনতিদেবী জানলেও আর কেউ জানত না। সে তদন্ত ওখানেই শেষ হয়ে যায়।
যাইহোক ডঃ শতদল ও সরমার ব্যাপারটা তিনি না মানলেও একপ্রকার বাধ্য হয়েই ওনাকে উইলে এদের নাম ঢোকাতে হয়। মিনতিদেবীর হুমকি চিঠির থেকে উনি জানতে পারেন শতদল তারই সন্তান। এর পর অনাদিবাবু উইলে হরিবংশ, সরমা, বিমলাদেবী ও ডঃ শতদলের নাম যুক্ত করেন। এটা কোনও ভাবে জেনে ফেলেন বিমলাদেবী। ঘটনাগুলো খুব তাড়াতাড়ি ঘটে, বলতে গেলে দু’একদিনের মধ্যে। পরদিনই শতদল কে আসতে বলেন এই বাড়িতে অনাদি সমাদ্দার। অর্থাৎ রবিবার।
কিন্তু শতদল শনিবারে অনাদিবাবুর ফোন পেয়ে ঠিক করেন আজই যাবেন বীরপুরে। বিকালের মধ্যেই ডঃ বাবু এই এলাকায় চলে আসেন। সে দিন অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি হলেও অনাদিবাবু মদ্যপানের আসরে যেতে কখনও ভুল করেননি। খুনি অর্থাৎ ডঃ শতদল মদ্যপানের আসরে আগে থেকেই হাজির ছিল। ডঃ শতদল সুযোগ বুঝে তার কাছে থাকা ‘সেরিন’ নামক বিষ অনাদিবাবুর গ্লাসে মিশিয়ে দেন। ছদ্মবেশ ও টুপির আড়ালে শতদলকে অনাদিবাবু চিনতে পারেননি। যদিও মদের আসরে এমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন, তাঁর চেনার মত অবস্থা ছিল না। শতদল জানত ‘সেরিন’ একবার শরীরে গেলে তার প্রভাব আস্তে আস্তে হবে, এবং ১ঘন্টার মধ্যে নিশ্চিত মৃত্যু। এই ‘সেরিন’ শরীরে গেলে প্রথমে স্নায়ুর উপর প্রভাব ফেলবে, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাবে, ব্যক্তি কোমায় চলে যাবে আর তার পর হার্টফেল। নির্ঘাত মৃত্যু। আমি জার্নাল পড়ে জেনেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘সেরিন’ বিষ এর প্রয়োগ হয়েছিল। শত্রুকে আলোচনার টেবিলে ডেকে এমন ভাবে মেরে ফেলা যায় তা বোধহয় ডঃ শতদল জানত।
১৯৯০ সালে জাপানে ‘সেরিন’ কে ব্যবহার করা হয়। মৃত্যুর এমন অস্ত্র ডঃ শতদল বিদেশ থেকে আনিয়ে ছিল। আমি ডঃ বাবুর কিছু ই-মেইল ও ক্যাশমেমো থেকে ‘সেরিন’ এর কথা জানতে পারি। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে হার্টফেলের কথা বলা ছিল, এবং আরও বলা ছিল অতিরিক্ত মদ্যপান এর ফলে বিষক্রিয়া। সেই ভাবে বিষ বা কোন ধরণের বিষের প্রভাবে মৃত্যু তা উল্লেখ নেই। যাইহোক খুনি তার অস্ত্র প্রয়োগ করে কাছাকাছি অপেক্ষা করছিল, ভেবেছিল বাড়ি অবধি উনি আসতে পারবেন না, তাতে লাশ সরানোর প্রয়োজন হবে না। কিন্তু বাদ সাধে অনাদিবাবুর মন। তিনি সেদিন একটু আগে ফিরে আসেন ঐ ৯.৩০ নাগাদ। বকুল আমার বাড়ি থেকে বের হয় প্রায় ১০.৩০মিনিট হবে। সেই সময় বৃষ্টি একটু কমেছিল।
বাড়ি ফিরে ‘শরীরটা ভালো লাগছে না’ বলে অনাদিবাবু না খেয়ে নিজের ঘরে চলে যান। সন্ধ্যাবেলা শতদল ও মিনতিদেবীকে নিয়ে অশান্তির জন্য বিমলাদেবী আর ওনার কাছে যাননি, যদিও বিমলাদেবী আলাদা শুতেন। অনাদিবাবুর ঘরের বারান্দায় থাকত ভূপতি।
কাল উইল বানানো হবে তাই আজ তার বাবা চিন্তিত থাকবেন, আর ঘুমানোর জন্য ঘুমের ঔষধ নেবেন এটা জানত সরমা। তাই সরমা দ্বিতীয় তথা শেষ চেষ্টা করার জন্য তৈরী ছিল, যদি তার প্রেমিক ডঃ শতদল কাজটা না করতে পারে, তবে সে ঐ অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করবেই। আজকে প্রবল ঝড়বৃষ্টি, আজই এই চ্যাপ্টার শেষ করতে হবে এই ভাবনা কাজ করছিল সরমার মধ্যে। শতদলের থেকে নেওয়া সেরিন এর একটু পাউডার অনাদিবাবুর জলের গ্লাসের মিশিয়ে দেয় সরমা, যেই না ঘুমের ঔষধ খেতে যাওয়া সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। কিন্তু জল আর খেতে হয়নি অনাদিবাবুকে। তার আগেই উনি মারা যান। ডঃ শতদল অনাদিবাবুর বাড়ির কাছাকাছি ছিলেন সরমার সবুজ সংকেতের অপেক্ষায়। কিন্তু অনাদিবাবু বাড়ি চলে যাওয়ায় প্ল্যান আনসাকসেসফুল হয়ে যাবে এই আশঙ্কা তৈরী হয়। খুনিরা চেয়েছিল অনাদিবাবুর এই বৃষ্টির রাতে রাস্তায় মৃত্যু হলে, কেউ সন্দেহ করবে না। কিন্তু তেমন হয়নি। তাই বাইরে দাঁড়িয়ে ডাক্তারবাবু সরমার আসার অপেক্ষা করতে থাকল। ঠিক ১০.৩০নাগাদ সরমা বেরিয়ে ডাঃ শতদল এর সাথে দেখা করে তৎক্ষণাৎ ফিরে আসে। সরমাকে বের হতে দেখে হরিবংশ তার পিছু নেয়, কিন্তু কিছু বুঝতে পারেনি। ১৫ মিনিট পর ডাঃ শতদল অনাদিবাবুর বাড়িতে লুকিয়ে ঢোকে। সরমার সাহায্যে অনাদিবাবুর লাশ গাড়িতে করে ঘোলপাড়ার মাঠের ধারে ফেলে আসে। সরমা ফিরে আসে, আর ডাঃ শতদল প্রমাণ লোপাট করে অর্থাৎ তার জ্যাকেট, টুপি নকল দাড়ি সব ফেলে আসে জয়পুরের খালে। যে জয়পুর খালে সে তার মা মিনতিদেবীকে ফেলে আসে। আগে খুন হন মিনতিদেবী, তার কয়েক ঘন্টা পর খুন হন অনাদি সমাদ্দার। আসলে সরমার সাথে তাঁর ছেলের প্রেম উনি একদমই মেনে নেননি, এই নিয়ে শনিবার সকালে তুমুল তর্ক হয় মা ছেলের। কি ঠিক তো ডঃ বাবু?” বলে থামল প্রিয়তোষদা। তারপর আবারও বলে চলল।
“আসলে সুলতা দেবী শনিবারের তুমুল বাকবিতন্ডার কথাটা আমায় জানান।
সরমার সাথে প্রেম মানতে না পারার জন্য মিনতিদেবীকে গলা টিপে খুন করে ডঃ শতদল। উল্লেখ্য সরমার জন্ম ১৯৯৭। অর্থাৎ শতদল ও মিনতিদেবী যেদিন অনাদিবাবুর বাড়ি আসেন তখন সরমার জন্মই হয়নি। সেটা সরমার আইডেন্টিটি কার্ড ও মেডিকেল কলেজের নথি থেকে পেয়েছি।
আসলে আগামী কাল উকিল বাবুর সাহায্যে হরিবংশ, সরমা, বিমলাদেবী, শতদল ও মিনতিদেবী সকলকে অনাদিবাবু উইল করে তাঁর অগাধ সম্পত্তির ভাগাভাগি করে দিতেন, এই কথাটা মিনতিদেবী ও ভূপতি জানত। খুনিরা জানত না। যাইহোক খুনের পর কাজ মিটে গেলে গাড়ি নিয়ে শতদল কলকাতা পালায় আর মিথ্যা মায়ের অন্তর্ধানের নাটক সাজায়। সবাই মনে করে অনাদিবাবুকে খুন করে মিনতিদেবী গা ঢাকা দিয়েছে। ভূপতি ঠিক বুঝতে পারেনি যে, কে কতবার বাইরে বেরিয়ে ছিল। আফিম এর ঘোরে সে ঠিক ঠাওর করতে পারেনি। যাই হোক আমরা যেখানে ছিলাম। অবৈধ প্রেম ও লোভ মানুষকে কত নিচে নামায় সেটা এই কেসটা দেখলেই বোঝা যায়।”
এতক্ষণ মন দিয়ে সব শুনছিল ডাঃ শতদল। এবার সে প্রচন্ড রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে কিছু একটা খেতে যাচ্ছিল, আমি এক পায়ের শটেই মাটিতে ফেলে দিই। ওটা বিষ ছিল। ওটা সেরিন। দারোগা তৎক্ষণাৎ বিষের নমুনা প্রমাণ হিসাবে সাবধানে তুলে নিলেন।
মিঃ দাস এবার মুখ খুললেন। “আচ্ছা মিঃ দত্ত ডাঃ শতদল যে খুনি সেটা কি করে বুঝলেন?”
প্রিয়তোষদা বলল, “আমি শতদলের অতীত ঘেঁটে দেখেছি যে সে কাউকে কোনও দিন মানেনি। পড়াশোনায় ভালো ছিল। কিন্তু বেপাড়াতে যাতায়াত, নারীসঙ্গ সব ছিল তার। লোভ তার অসীম। সম্প্রতি ডাক্তারিতে তার পসার তেমন জমেনি। টাকার দরকারে সে অনাদিবাবুর কাছে আসে। নিজের মেয়ের সাথে তার প্রেম অনাদিবাবুকে খুব খেপিয়ে তোলে। সম্পত্তি থেকে মেয়েকে যখন বাদ দেবেন মনস্থির করেন, তখনই সরমা ও শতদল এই খুনের ছক কষে ফেলে। ওদের শরীরেও তাঁর বদরক্ত বইছে। তাই শত রাগারাগির পরে নিজের সম্পত্তি ছেলে, মেয়ে সকলকে সমান ভাগেই ভাগ করে দিতেন অনাদিবাবু। অথচ এই ব্যাপারটা ওরা ধরতে পারেনি। অনাদিবাবু নিজের কুকর্মের জন্য অনুতপ্ত ছিলেন। যুবক বয়সের ভুল আজ সম্পত্তি ভাগাভাগি ও স্বীকৃতির দ্বারা তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অদৃষ্টে তার মরণ লেখা ছিল। শতদল ও সরমা এসব কিছুই জানত না। নিজেদের প্রেমের বাধা ও সম্পত্তির ভাগ না পাওয়ার আশঙ্কায় আর অপেক্ষা করেনি। অনাদিবাবুকে পৃথিবী থেকে সরানোর সব প্ল্যান তৈরী করে ফেলে সেই দিনেই।”
সরমা এবার ভেঙে পড়ল।
আমি বললাম, “তুমি কি করে জানলে যে মৃত্যু ‘সেরিন’ নামক বিষের প্রভাবে হয়েছে? আর ল্যাব টেস্টে কি পেলে?”
প্রিয়তোষদা বলল, “আমি গ্লাসের জল দেখে সন্দেহ করি। অন্যদিকে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে অতিরিক্ত মদ্যপান ও তার বিষক্রিয়া। আমি অনাদিবাবুর ঘরে ভালো করে দেখেছি। গ্লাসে ভূপতির হাতের ছাপ পেয়েছি। আর ল্যাব টেস্টের পর গ্লাসের ভিতরে যে রাসায়নিক পাওয়া যায় তা অত্যন্ত বিষাক্ত বিষ ‘সেরিন’।
জানিস কি কাল বৈকালে বকুল আমায় নিয়ে যায় জয়পুর খালে। সেখানে মিনতিদেবীর মৃতদেহের পাশ থেকে টুপি, গ্লাভস, কোর্ট ও কিছু কাগজ মিলেছে। সেগুলো সবই ডঃ শতদলের। ইনভয়েসগুলো ভালো করে ফরেনসিক টেস্ট করে জেনেছি ওগুলো বিদেশি গোপন জিনিস আনার, আবছা হলেও কোড দেখে বোঝা যায় বেআইনি ভাবে নাইজেরিয়া থেকে ‘সেরিন’ আনিয়েছিল। উল্লেখ্য আমি সুলতা দেবীর থেকে ডাঃ শতদলের ই-মেইল ও তার পাসওয়ার্ড হ্যাক করে নানা অনৈতিক ড্রাগ ভারতে আনার তথ্য পেয়েছি, সবই কলকাতা পুলিশকে তুলে দিয়েছি।”
আমি বললাম, “তাই তুমি কাল দুপুরে ও আজ সারাদিন বীরপুরে ছিলে না, তাই তো…”
প্রিয়তোষদা হাসল। “সে তো বটেই, এর মধ্যে কলকাতা যাওয়া, ল্যাব টেস্ট করান, এসব করতে সময় লাগে রে ধ্রুব।” বলল প্রিয়তোষদা।
মিঃ দাস শতদল ও সরমাকে জিপে তুলল। এই অবধি বলে প্রিয়তোষদা একটু থামল। মিঃ দাস বললেন, “তাহলে চললাম।”
উনি জিপ নিয়ে চলে যেতে কান্নায় ভেঙে পড়ল সুলতা দেবী। মিসেস সমাদ্দারকে নমস্কার জানিয়ে আমি ও প্রিয়তোষদা উঠে পড়লাম। হেঁটে বাড়ির পথে রওনা দিলাম। আমি এবার বললাম, “এই কেসটা তুমি সমাধান করেই দিলে, কিন্তু বললে না তো বকুলকে কেন ডেকেছিলে?”
প্রিয়তোষদা বলল “তোর বকুল আমায় একটা জিনিস দেখাবে বলে ডেকেছিল। জয়পুরে ওদের কলেজের পাশে কোনও মহিলার মৃতদেহ দেখেছিল আজ। আমায় বলল আর আমি দারোগা বাবুকে নিয়ে তা শনাক্ত করি। তু্ই ভাবছিস যে মিনতিদেবীকে আমি চিনলাম কি করে?
সেদিন ভূপতি কিছু বলতে গিয়েছিল, সেটা মিনতিদেবীর প্রসঙ্গ। বিমলাদেবী তাকে আটকে দেন। পরে ভূপতির থেকে ছবি সহ কিছু তথ্য পাই। যাই হোক যেটা বলছিলাম।” আবার বলতে থাকল প্রিয়তোষদা, হাঁটতে হাঁটতে তা মন দিয়ে শুনতে লাগলাম।
“এ এক জটিল মনস্তত্ত্ব। প্রেম, ঘৃণা, প্রতিহিংসা ও লোভ সব গুলো এই কেসটাতে আছে। কাল বকুল আমার বাড়ি থেকে আসতে গিয়ে একটা গাড়ির আওয়াজ পায়, অন্ধকার রাস্তায় কেউ এমন বৃষ্টির রাতে গাড়ি নিয়ে কি করছে এটা ওর মনে হয়। বৃষ্টির দাপট বাড়লে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে। আসলে বেশি কিছু বুঝতে পারেনি। তবে কেসটাতে বকুল আমায় ভালই সহযোগিতা করেছে।”
আমায় রাগানোর জন্য বলল “তোর থেকে বকুলের অবদান এই কেসে অনেক বেশি, ভাবছি তোকে অ্যাসিস্ট্যান্ট না করে ওকেই রাখব। তোর বৌদিরও বকুলকে ভীষণ পছন্দ, কি বলিস?”
আমি অপ্রস্তুত হয়ে ঠিক কি বলব বুঝতে পারলাম না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিতে যাব এমন সময় পিছন থেকে ডাক, “প্রিয়তোষদা …”।
এক নারী কণ্ঠ ভেসে এল। “তুমি আমায় নেবে তো?”
আমি দেখি বকুল। প্রিয়তোষদা কিছু বলতে যাবে এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল। ধনঞ্জয় বাবুর ফোন। উনি কংগ্রাচুলেট করতে প্রিয়তোষদাকে ফোন করেছেন। ওদের কথা চলতে লাগল, আর আমিও বকুলের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মোড়ের রাস্তায় আলোটা ভীষণ জোর। কপালের কাছ থেকে চুলের একটা অংশ নেমে এসে মুখটা আরও লাবণ্যময় হয়ে উঠেছে। চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। হঠাৎ প্রিয়তোষদার ডাকে সম্বিত ফিরল। দু’জনেই কেমন লজ্জা পেয়ে গেলাম। বকুলের বাড়ি এসে গেছে। আমি ও প্রিয়তোষদা আবার এগোতে লাগলাম।
প্রিয়তোষদা বাড়ি চলে গেল। এত মহান মানুষ প্রিয়তোষদা অথচ থাকে কত সাধারণ ভাবে। খুনের কিনারা করেও নির্বিকার। সরকার এই কেসের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে, কিন্তু তার এসব নিয়ে কোনও মাথাব্যাথা নেই। মানুষটা শুধু চায় কাজ আর একটু সম্মান। বিস্তীর্ণ অঞ্চল আজ থেকে অন্ধকারের পাঁচিল ভেঙে আলোর সরণি বেয়ে গতিময় জীবনের পথে ধাবিত হবে। আমরা সবাই সেই প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেব। আমাদের বিকৃত মানসিকতা, লোভ, প্রতিহিংসা এগুলো কখনও অন্ধকারের কূপে চাপা পড়ে থাকবে না। মানব জীবনের অনন্ত কালের এটাই মায়া, রিপুর কাছে আমরা সবাই হেরে যাই। প্রেম, যৌনতা, লোভ, লালসা সবই থাকবে, শুধু আমরা তার হাতের পুতুল হয়ে এই পৃথিবীর সাজান বাগানে নিজেদের কৃতকর্মের ডালি নিয়ে বসে থাকব। অনাদিবাবুদের মত মানুষরা না থাকলে প্রিয়তোষদা দের মত মানুষদের চিনতে পারা যায় না। শেষে বলতেই হয় অনাদিবাবু এলাকার শিক্ষার জন্য, দুঃস্থ মানুষদের জন্য যা করেছেন তা আমরা চিরকাল মনে রাখব।
আমি দরজার সামনে দাঁড়ালাম। মা আমার আসার শব্দে দরজা খুলে দিল।
ঘরে ঢুকলাম, আর জামা ছাড়তে গিয়ে দেখতে পেলাম একটা চিঠি..
খুলে দেখলাম তাতে লেখা,
“তোমাকে আজ ভীষণ ভাবে নিজের করে পেতে চাই
অন্তরের সবটুকু নির্যাস তোমায় দিয়ে
আপন করে নিজের করে
শুধু চাই তোমায়।”
বকুলের এই চিঠি পড়তে পড়তে আমার মনে রোমান্টিক গান বেজে উঠল
“তোমার সুরে সুর বেঁধেছি…”।
~সমাপ্ত~