বিড়াল তপস্বী| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | নুজহাত ইসলাম নৌশিন| Bengali Detective Story
0 (0)

আবার চুরি হল, আজকেও! ধ্যাত্তেরি এই মেসটাই এবার ছেড়ে দিতে হবে। গজগজ করে শারিন আপু বলতে লাগল আর ইচ্ছে করে চেয়ারটা একটু জোরে টেনেই, টেবিলে ধুপধাপ শব্দ করে বই ফেলতে লাগল। পাশের রুমের বাসিন্দাদের শুনানো, “দ্যাখ এসব ঘটনায় আমারও মেজাজ খারাপ, ইচ্ছে করে এখানে থাকছি নাকি! আশেপাশে যতসব চোর-চোট্টা।”

ভালো রকম মুসিবতই হল। সুন্দর সকালের শুরুতে এসব হালকা চুরি-টুরি নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে না। তাও ভাবতে হচ্ছে, এসব নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। নয়তো আবার ভেবে বসে থাকবে আমি বুঝি এসবে যুক্ত আছি।

“জ্বি, আপু – আমিও ভাবছি কারা যে এসব করে।”

“কারা আর করবে! ওই ছোটলোকগুলাইতো – কে যে কোথা থেকে আসছে সব জানা আছে।”

এইরে – কথা দেখি কই থেকে কই চলে যাচ্ছে। নির্দোষ একটা প্রশ্নের যে বোমার মতো উত্তর হতে পারে কে জানত! আমি চুপ মেরে গেলাম। বাইরের আকাশটা কেমন পানি মেশানো দুধের মতো জোলো রঙ ধরে আছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। অবশ্য আমি চাইছি এখনই বৃষ্টি নামুক – কারণ পাশের রুম থেকে অলরেডি শারিন আপুর কথার কাউন্টার দেওয়া শুরু হয়ে গেছে।

“ভাবে কী নিজেকে! ময়মনসিংহের মানুষ টোটাল চুর।”

কাউন্টার দেওয়া আপু কখনই চোর উচ্চারণ করতে পারে না। আরো অনেক উচ্চারণে তার ভুল হয়। এসব শুনতে হল না কারণ টিনের চাল ভেঙে ঝম ঝম…

“মরবে, মরবে। দেখিস ডায়রিয়া, কলেরা হয়ে মরবে।”

পিছন থেকে মাবিয়ার রুমমেট ডলি একটু উস্কে দিল, “না মরে যাবে কই, চোর ছ্যাঁচড় সব। আমরা যে মেসে ভালো ভালো খাই, তা কারো সহ্য হয় না। বুঝিস না লালচ লাগে। আরে সরাসরি বললেই হয়, চুরি কেন করতে হয় রে বাপ।”

এই ঝগড়াগুলো শুনলে মাথা গুলিয়ে যায়। কে যে কখন কার পক্ষে বলছে, না কখন বিপক্ষে বলছে মনোযোগ দিয়ে না শুনলে বুঝা অনেক জটিল।

মাবিয়া বলতে বলতে কাহিল হওয়ায় পুরোপুরি ঝগড়ার দায়িত্ব ডলি নিজের উপর নিয়ে নিল।

“হুউউ… মুরগির কেজি এখন দুইশ টাকা। কত শখ করে ডিপে ম্যারিনেট করে রেখেছি চিলি চিকেন বানাবো বলে। এখন দেখি আমার মাংস গায়েব। ছোটলোকগুলা, ইতর- জানি তো কে বা কারা আমাদের শত্রু। কেবল দেখে যাচ্ছি কত বাড় বাড়তে পারে। যেদিন হাতে নাতে ধরব না –” বাক্যটা শেষ না করে এমন মুখ ভঙ্গি করল, পুরাই হরেন্ডাস।

আমি তখন বাথরুম থেকে বের হয়ে বেসিনে মুখ ধুচ্ছিলাম, আমার দিকে তাকি ডলি এমন লুক দিল – মনে হচ্ছে পেটের ভিতর গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। কী রে বাবা, শেষমেশ কি ডায়রিয়া হল নাকি! দ্বিতীয়বার ওদের চোখের সামনে বাথরুমে যাওয়ার মানে হয় না। সেধে সেধে কেন অস্ত্র তুলে দিব!

“ও মামারা এত কাউ কাউ কিসের? কী এক জ্বালা শুরু হইল এই মেসে – কে যে কার খাওন চুরি করে কিছু বুঝি না। সবাই তো ভদ্দরলোকের পুলাপান। কই নিজেরা নিজেরা মিলমিশ করে থাকবেন – তা না সারাদিন চিল্লা চিল্লি। মাইয়া মাইনষের গলার আওয়াজ এত কেন বাড়ব?” কথা গুলো কেয়ারটেকার মঞ্জু মামা পানির ট্যাপ ঠিক করতে করতে সবাই শুনতে পায় এমন আওয়াজে গুজগুজ করে বলছিল।

যদিও সবাই শুনল, কিন্তু উত্তর দেবার দরকার মনে করল না। পানির জন্য ওয়েটিং লিস্টে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজনের চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে, মঞ্জু মামাই বোধ হয় এসব চুরির সাথে যুক্ত। রুমে গিয়ে তারা ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনায় বসবে।

আমি পানির দুইটা দুই লিটারের বোতল কোনরকমে কোলে তুলে নিজের ৫০৫ রুমের দিকে যাচ্ছিলাম তখন ডলি চোখ ইশারায় আমায় ডাকল।

আমারে কেন আবার! আমি খাই শাকসবজি, মাংসের সাথে আমার কোনো কারবার নাই। খামোখা ঝামেলায় আমায় কেন জড়ানো। কিন্তু গেলাম, না গেলে খারাপ দেখায়। কি না কি ভেবে বসে থাকবে।

“তোর কী মনে হয়!”

পানির বোতল দুইটা কোলে কোনরকমে সামলে বললাম, “কোন ব্যাপারে?”

“ওমা, তোর চোখের কি মাথা খেয়ে ফেললি! দেখছিস না যা হচ্ছে পনের ষোল দিন ধরে রেগুলার। আগে তো হুটহাট হত আর এখন যেন চুরির মচ্ছব লেগে গেছে।”

৫১১ রুমের দরজার সামনে দুই লিটারের দুই বোতল কোলে নিয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ভয়াবহ। ডলি ইচ্ছে করে আমায় ওদের দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে এসব প্রশ্ন করছে যাতে আরেকটা ঝগড়ার ইস্যু তৈরি হয়। এটা বুঝার জন্য প্যাসকেলের সূত্র আবিষ্কার করার ব্রেইন লাগে না।

বোতল সামলাতে সামলাতে বললাম, “ভাবতে হবে। হুট করে কাউকে কিছু বলা ঠিক হবে না।”

ডলি কালো মুখ আরো কালো করে বলল, “ওওহ।”

বোতল নিয়ে আসতে আসতে মনে হল ও বোধহয় আয়নায় নিজেকে দেখে না। দেখলে বুঝত ঝগড়ারত অবস্থায় কতটা কুৎসিত লাগে নিজেকে।

“আহহা – সবাই তো করছে, আমরা করলে সমস্যা কী!”

আমি রীতিমতো শিউরে উঠলাম। দিন দিন সামিনের কথার ধরন পাল্টে যাচ্ছে। কথায় যেন কিসের স্পষ্টাস্পষ্টি ইঙ্গিত। আমায় দ্রুতই ডিসিশন নিতে হবে।

“কি হল চুপ যে!”

“কিছু না।”

“জোহা শোনো, মজার কথা মনে হয়েছে।”

আমি কুঁচকানো ভ্রূ কোনরকমে সোজা করে একটু নড়েচড়ে বসলাম।

“ওই যে মহসির কথা বলতাম না – ওর বুকের সাইজ দেখেছ ইদানীং কেমন ঝুলে গেছে, কিছুদিন আগে ওর প্রেমিক –”

“থাম, আর কিছু শোনার ইচ্ছে করছে না।”

“বাব্বা – তোমার সাথে দেখছি কোনো কথাই বলা যায় না।”

“তুমি যা বলছ এগুলো বলার মতো কিছু না। খুবই নোংরা রুচিবোধের।”

“ফাইন, ফাইন – তাহলে আউজুবিল্লাহ বলে সূরা ফাতিহার তরজমা করি। কেমন?”

“স্টুপিড।”

সবুজ ঘাস মাড়িয়ে আমি চলে আসলাম। ঘৃণায় গা রি রি করছে। অদ্ভুত হলেও সত্যি আশেপাশের সবাই সামিনকে অতিরিক্তরকম ভালো বলে জানে। আমি যদি কাউকে বলি, নিজের পাতানো বোন সম্পর্কেও ভয়ানক নোংরা কথা বলে অবলীলায়। কেউ বিশ্বাস করবে? মনে হয় না।

রাস্তায় চলন্ত অবস্থায় আমি সচারাচর ফোন বের করি না। ক্যাম্পাস রোড যদিও সিকিওর তারপরও। কিছু দিন হল কেনা হয়েছে নতুন ফোনটা। রিস্ক নেয়ার মানে হয় না।

আজ বের করতেই হল। ক্রমাগত ফোনটা বেজেই যাচ্ছে, নিশ্চিত বাসা থেকে। নয়তো টানা ফোন দেওয়ার মতো মানুষ আমার কমই আছে নরমাল সময়ে।

“হ্যাঁ, খালাম্মা বলেন।”

“আরে শোন, কী সর্বনাশটা যে হইছে – ”

ওঁর কথার ধরনই এমন। সবকিছুই তার কাছে সর্বনাশ।

রাস্তা পার হতে গিয়েও থেমে গেলাম। এখনই আমার সর্বনাশ হত। একটা মালবাহী ট্রাকের নিচে পিষে যাওয়ার সম্ভাবনা সত্তর পারসেন্ট ছিল, ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেলাম।

“কি সর্বনাশ হয়েছে? এখনই বলতে হবে! আমি তো এখন রাস্তায়।”

“হায় হায়, তুই দুপুর রোদে রাস্তায় কি করিস? এখনি বাসায় যা।”

ভেতরে ভেতরে মেজাজ চরম খারাপ হয়ে গেল। মানুষের মাথায় ঘিলু এত কম কেন থাকবে। কিছু দিন আগেও ফোনে কথা হল, খালাম্মাকে পই পই করে বলেছিলাম আমার সেমিস্টার পরীক্ষা চলে আমি ক্যাম্পাসে।

“খালাম্মা এখন তো বাসায় যাওয়া যাবে না। আমি ক্যাম্পাসে যে।”

“আরে এসব এখন বাদ দে। সোজা ঢাকার একটা বাসে উঠে পড়। তোর বাপ যে আকামটা করছে। ছি ছি …”

এবার সত্যি মেজাজ খারাপ হল। একটা সোজা কথা এত ত্যানার মতো পেঁচিয়ে একশা করে ফেলছে।

“কি হয়েছে বলো তো?।”

এবার কান্না কান্না গলায় বলতে শোনা গেল, “ওই সাদা ধুমসি মাগীরে তোর বাপ বিয়ে করছে।”

কোন সাদা, কে ধুমসি কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কলটা কেটে দিলাম।

আমার বাবার চরিত্র খারাপ। খুবই খারাপ। আমার মনে হচ্ছিল এরকম কোনো একদিন ঘটতে পারে, কিন্তু সাদা ধুমসিটা কে তাই মাথায় ঢুকছে না। এবং বাসায় আমার গিয়েও কোনো লাভ নেই। এমন না যে আমি গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। বরং আমার মা নিজেই ছোট হবে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে।

ধপ করে বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে শারিন আপুর ভাঙা ভাঙা গলা শুনলাম। নিশ্চিত ঝগড়া করে গলার এই অবস্থা করেছে।

“এই শোনো, জোহা, ঘুমিয়ে গেলে নাকি?”

“না আপু,বলেন।”

“এর একটা হেস্ত নেস্ত করা দরকার। যে যাকে ইচ্ছে চুরির অপবাদ দিচ্ছে মেসে।”

রোদে হেঁটে মাথার শিরা দপ্‌দপ্‌ করছে। এসব চুরি রহস্য উদঘাটন করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আগে মেসে মাসে কয়েকবার বারান্দার মেইন লাইট কে বা কারা নষ্ট করেছিল তার মূল হোতাকে খুঁজে বের করেছিলাম বলে, এখন যে কোনও ধরনের চুরি তদন্তে মেসে আমার ডাক পড়ে।

সেবারে মূল হোতা ছিল এক কুটিল সিনিয়র আপু। কে আন্দাজ করতে পারে তার প্রেমিক লুকিয়ে বিশেষ বিশেষ দিনে মেসে আসত বলে সে এই লাইট নষ্ট করার কাজ করত। যেদিন হাতে নাতে ধরা পড়ল তাকে এলোমেলো অবস্থায় তার প্রেমিকের সাথে বারান্দার কোণে দেখা গিয়েছে। আর তারপর – তাকে এই মেসে কখনো দেখা যায়নি। সেদিন রাতেই সে চলে গেছে।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা সেই সিনিয়র আপুর ভক্ত ছিল তারা রাতারাতি পাল্টি মারল। তৎক্ষণাৎ বোল চেঞ্জ করে ফেলল, “ছি ছি, মানুষের কিভাবে ভেতরে এক আর বাইরে আরেক হয়।” যেন পৃথিবীতে প্রথম পা দেওয়া বাসিন্দা তারা।

অনেক দিন আমাদের মেসে রগরগে উত্তেজনার কিছু ঘটে না। ইদানীং ঘটছে। তাই আমরা সবাই উত্তেজিত এবং পরোক্ষভাবে আবার আমার ঘাড়ে দায়িত্বটা পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে এখন আমার নিজের ঘাড়ই নড়বড়ে, যে কোনও সময় কাটা কলা গাছের মতো ধপ করে পড়ে যেতে পারি।

টেবিলে বসে হিসাব করতে লাগলাম। উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে এগারটা রুম। বাসিন্দা বাইশ, তাদের মধ্যে অনিয়মিতের সংখ্যাই বেশি, যারা মেসে মিল খায় না। মেসের কোনো কিছুতে তারা থাকে না। কালেভদ্রে রান্না ঘরে আসে প্রেমিক কিংবা সিনিয়র ভাইয়ের জন্য নুডলস রান্না করতে। মেসে তাদের অবদান এই নুডলসেই সীমাবদ্ধ। এদের সন্দেহ তালিকায় রাখার তেমন প্রয়োজন নেই। এদের সংখ্যা এগারো জন।

রেগুলার মহাযজ্ঞের রান্নার আয়োজন করে মোটামুটি ছয় সাত জন। তাদের জীবনের উদ্দেশ্যই খাওয়া। মাংসে সস মিশালে বেশি টেস্ট না পুদিনা পাতা ব্লেন্ড করে দিলে টেস্ট খুলে তাদের চেয়ে ভালো আর কেউ মনে হয় না বলতে পারবে।

এরা সব একজোট। তাদের রান্না, খাওয়া, ঘোরাঘুরি সব একসাথে। সংখ্যা সাত।

আর বাকি থাকছে ৪ জন। তাদের মধ্যে আমিও পড়ি। এরা হচ্ছে ভেজিটেবল সদস্য। শাকসবজি, ডাল ভেজিটেবলদের রেগুলার রুটিন।

“পেলে কিছু?”

“ভাবছি আপু। সবাই ভালো আবার সবাই খারাপ।”

“উফফ, ধাঁধা লাগে তোমার কথায়। খোলামেলা বলো তো।”

“সময় হোক। টেবিলে কলম ঠুকে চোখ বন্ধ করলাম।”গুনগুন করে মাথায় গানটা বাজছে, “তারে ধরি ধরি মনে করি ধরতে গেলে আর পেলাম না।”

ধরা না দিয়ে যাবে কোথায়!

রাত আটটা। ফ্রিজ রুমে বসে চোখের উপর শিটটা ধরে রাখলাম। ফ্রিজ রুমে ভাঙা চেয়ারে বসে দোল খাওয়া রিস্ক। যেকোন সময় ধপাস, গোয়ান্দাগিরির তেরটা বাজবে।

“কি রে! তোর উপর আবার ডিউটি পড়ল নাকি?”

“উমম।”

এলিজা দাঁত কেলিয়ে ফ্রিজের কাছে গেল। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলল, “ডলিটা বড্ড বাড় বেড়েছে। ওর বাড় আমি বের করছি।”

এলিজা একটা লাল বক্স বের করে ফ্রিজের রুম পার হয়ে মূল গেটে চলে গেল। তার মানে এই বক্সটা রাব্বিকে দিয়ে দিবে, কিন্তু বক্সটা তো সুপ্তার।

এলিজা সন্দেহ তালিকা থেকে বাদ। কিছুদিন আগে সুপ্তার সাথে চুল চেরা ঝগড়ার প্রতিশোধ হিসেবে ছোট্ট একটা রিভেঞ্জ নিল। চুরি কেউ কাউকে দেখিয়ে, শুনিয়ে শুনিয়ে করে না। আমাকে শুনানোর মানে হচ্ছে, “বলে দিস সুপ্তাকে আমি গুনি না।”

তার মানে, তার মানে… উঁহুহু…

আপাতত কিছুদিন চুরির ঘটনা বন্ধ আছে। ফ্রিজের সামনে পাহারায় বসার কুফল। সবাই সর্তক হয়ে গেছে। আমি অবশ্য তাই চেয়েছিলাম, রাত আটটার মধ্যে সবাই মোটামুটি রান্না সেরে নেয়, তাই ওই টাইমে ফ্রিজের রুমে ভাঙা চেয়ারে বসে থাকা।

সবার এক কথা, তোমায় দেখিয়ে দেখিয়ে চোর বুঝি চুরি করবে!

কিন্তু যে না দেখিয়ে করবে সেই তো – থাক, আমার এত তাড়া নেই। ধীরে পৌঁছাতে সমস্যা নেই আমার।

তারে ধরি ধরি মনে করি ধরতে গেলে আর পেলাম না… দেখেছি

আমার যা দেখার আমি দেখে নিয়েছি। সময়ের অপেক্ষা কেবল।

“কিরে কয়দিন তো খুব পাহারায় বসতি! পেলি না বুঝি?” মালা তেলতেলে হাসি দিল কথাটা বলেই। গায়ে খুব মাংস লেগেছে মালার। ইদানীং খুব ফুর্তিতে থাকে। নতুন নতুন প্রেমে পড়লে এমন হয়, সবকিছুতে নাক গলাতে মন চায়।

“না আর বসব না, আমার নিজের কিছু কাজ পড়ে গেছে। কয়েকদিনের জন্য বাসায় যাচ্ছি।”

মালা আবার তেলতেলে হাসি দিল। হাসির মানেটা পরিষ্কার, “তোমার গোয়েন্দাগিরির মুরোদ বুঝা হয়ে গেছে।”

মালা এখন এই খবর রংচঙে করে পরিবেশন করবে আর এই সুযোগের অপেক্ষায় আমি ছিলাম।

মোস্ট সিনিয়র আপুর রুমে বাইশজনকে ডাকা হয়েছে। মানে শত্রু মিত্র সব আজ মুখোমুখি।

কারো কিছু বলার আছে? না আমি কথা শুরু করব?

একুশ জনের মধ্যে অনিয়মিত বাহিনী নির্জীব। তারা বিরক্ত হয়েছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মেসের নিয়মরক্ষা করার জন্য হাজিরা দেওয়া মাত্র। মেসে আগুন লাগলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের অখণ্ড মনযোগ হাতের ফোনটার দিকে, কখন সময় শেষ হবে।

বাকি এগারো জনের সাতজন বেশ সিরিয়াস। ভ্রূ কুঁচকে সত্যিকার একটা গাম্ভীর্য চেহারায় এনে ফেলেছে। তারা একসাথে বলল, “আপু, আপনি সবার বড়, আপনিই কথা শুরু করেন।”

ভেজিটেবল সদস্য চার জন আসলেই ভেজিটেবল। তাদের মুখ প্রতিক্রিয়াহীন।

মোস্ট সিনিয়র আপু যখন কথা শুরু করল তার দেড় মিনিটের মাথায় অনিয়মিতদের একজন বলে উঠল, “কিউজমি আপু, আমার হাসবেন্ড কল দিয়েছে। একটু যেতে হবে।”

একজন ফিক করে হেসে বলল, “স্বামী বিদেশ।”

“কত বড় বেয়াদব, আজকের মিটিংয়েও তার কল কাটা যায় না। “ডলি গজগজ করে বলল।

“আহ, বাদ দে তো।”

অনিয়মিত সদস্যদের ডাকার কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু মেসের নিয়ম রক্ষার জন্য ফর্মালিটি।

তাহলে শুরু করা যাক।

সবাই বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে সায় দিল।

“এক্সকিউজমি আপু, আমার দুধ বসানো চুলায়।”

চাপা হাসির হিড়িক পড়ে গেল।

আপু এবার যথেষ্ট বিরক্ত হল। আশ্চর্য, তোমাদের এত ব্যস্ততা! কারো দশ মিনিট সময় দেওয়ার মতোও সময় নেই!

থমথমে একটা পরিবেশে।

“এসব মিটিং-ফিটিং করে কখনও কোনো ফায়দা হয় না তা জানো?”

আমি চেয়ারে বসে মাথা নাড়ালাম। মিটিং এ ক্যাও ম্যাও হয় – থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।

“কী হবে বলো তো?”

চুপ করে রইলাম। এই মুহূর্তে কিছুই বলতে চাচ্ছি না। মোটা খাতায় আবার একটা খসড়া টানলাম।

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েকজনের খাবারই এক মাস ধরে চুরি হচ্ছে। সেই বিশেষ সেভেন সিস্টার্স! যারা আমিষভোজী। এই পর্যন্ত একমাসে নিরামিষ কোনো খাবার, সবজিতে কেউ হাত দেয়নি। দুই মাস আগে সবজি, নিরামিষ, লেবু পর্যন্ত ফ্রিজ থেকে গায়েব হয়ে গেছে।

এবার শুধু মাংস চুরি হচ্ছে। কাজের গণ্ডি কমে এসেছে কিন্তু চিন্তা বেড়ে গেল।

“সুপ্তা তোর কাছে মার্কার হবে?”

ঘুম ঘুম গলায় বলল, “না রে, হবে না।”

দিনের সাড়ে দশটা – এখন অবধি ঘুম। বাহবা, ভালো তেল হয়েছে গায়ে। আধ চাপা দরজা থেকে যখন ফিরে আসছিলাম তখন চোখ গেল ঘরের কোণে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে চলে এলাম। বড্ড চেনা চেনা লাগছে জিনিসটা।

হুট করে মাথায় এল, এমনও তো হতে পারে ডলি, মাবিয়া একটা নাটক করতে চাইছে, নিজেদের ফোকাস করার জন্য। কিন্তু, তারপরও একটা বড়সড় কিন্তু থেকে যায়।

“নাহ, এখানে দেখছি আর থাকা যাবে না। এত হইচই অসহ্য লাগছে” দাঁতে দাঁত চেপে শারিন আপু বলল। বেচারি মোটাসোটা হাসিখুশি মানুষ, যখন রাগ করে সত্যি সত্যিই করে। কাল থেকে ফাইনাল এক্সাম আর আজ আবার কোন কাহিনী হল কে জানে!

“আচ্ছা, আপনি রুমে থাকুন। আমি দেখে আসি।”

ডলি, মাবিয়ার রুমের সামনে মরা সাপ। দেখার মতো নাচন কুঁদন হচ্ছে। একটা মেসে বাইশ জন মানুষ থাকতে এই দুজনের পিছনে ক্যান লাগল! গোঁজামিল দিয়েও মিলানো যাচ্ছে না কিছু।

এইতো তিন, চারদিন আগের রাতে রত্নার একপাটি জুতা আছে আরেকটা গায়েব। ঠিক গায়েবও না, আরেক পাটি জুতাকে টিনের চালের উপর পাওয়া গেছে কবুতর ধরতে গিয়ে।

যত আক্রোশ এই সেভেন সিস্টার্স এর উপর। কিন্তু এতকিছুর পর ডলির মুখের বিষ কমে না, “হিংসা, হিংসা! এই মেসের সবার হিংসা হয়। আমরা কয়েকজন মিলেমিশে চলি, একসাথে থাকি – এসব ছোটলোকগুলোর সহ্য হয় না।”

এলিজা বিড়বিড় করে বলে, “কি এমন খাস! গু খেতে পারিস না। টাটকা গু খা।”

এলিজার কথাবার্তা শুনলে যে কেউ চট করে মনে করবে আসলে ও বুঝি মূল হোতা। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। যে অপরাধ করে সে সাবলীল, সহজ আচরণ করতে পারে না। এলিজার মধ্যে কোনো রাখঢাক নেই। সন্দেহ তালিকা থেকে একটা নাম পুরোপুরি কাটা দিয়ে দিলাম।

বাকি রইল তিন … কিন্তু ধরা যাচ্ছে না ঘুঘুটাকে হাতে নাতে। প্রমাণের অভাবে বার বার হাত ফসকে যাচ্ছে।

ব্যাপারটা এইবার বেশি বাড়াবাড়িই হয়ে যাচ্ছে। মাবিয়ার রান্না করা চিলি চিকেন, ফ্রায়েড রাইস ডিপ থেকে পুরোপুরি গায়েব। আগে চোর দয়া করে অন্তত বক্সটা রেখে দিত, এইবার সেই দয়াটুকুও দেখাল না।

শারিন আপু ডলির নামই দিয়েছিল ‘চিলি চিকেন’। বেচারির সাধের চিলি চিকেন যতবার রাখা হয়েছে ততবারই গায়েব হয়েছে, কিন্তু বক্সটা তো থাকত। এবার যে বক্সও নেই।

দুই দিন ধরে মেসের আবহাওয়া, জলবায়ু দু’টোই খারাপ। সবাই সবাইকে সন্দেহ করছে।

কিন্তু আমার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। কিসের এত আক্রোশ যে এই কাজটা করছে তার! মাংস, চিলি চিকেন খুব পছন্দের শিকার। কাঁচা মাংসে তার আগ্রহ কম – একদম রান্না করা ইন্সট্যান্ট মাংসের প্রতি তার খুব টান।

বাইরে থেকে এনে একবক্স চিলি চিকেন, নান, কালিয়া ডিপ ফ্রিজে রেখে দিলাম।

আজ পাশা খেলবো রে শ্যাম…

শ্যামের বাইরের কেনা খাবারের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখলাম না। স্বচ্ছ সাদা বক্সে লোভনীয় আমিষ রাখার পর ও হাত দিয়ে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখল না। এমনকি বক্সের জায়গা পর্যন্ত বদলায়নি। বাহ, বাহবা। কাজটা জলবৎ তরলং করে দিল একেবারে।

তারে ধরতে পারলে মনবেড়ি দিতাম পাখির পায়…

দুপুর এগারোটা। সুবর্ণ না একদম হীরক সুযোগ।

বাইশ জনের মাত্র একজনের এই টাইমে অফ পিরিয়ড থাকে। তার ক্লাস সকাল আটটা থেকে দশটার মাঝে শেষ।

আজ আর ক্লাস করলাম না সবগুলো। এমন কোনও পিএইচডি একদিনে অর্জন হবে না।

দ্রুত আসার কারণে হাঁপিয়ে গেলাম। মেন গেটের কাছাকাছি এসে দম নিলাম। স্বাভাবিক থাকতে হবে এখন এই মুহূর্তে।

কেয়ারটেকার মামা দরজা খুলে বিরস মুখে আবার টিভি দেখা শুরু করল। এই ঝিরঝিরে টিভিতে দেখার কী আছে কে জানে!

রান্না ঘর থেকে সুপরিচিত মাংসের চেনা ঘ্রাণ। গরম করা হচ্ছে। চান্দু তোমার শরীরে ঘুম আর তেলের এই রহস্য।

“বাহ! তোকে বুঝি দায়িত্ব দিয়ে গেছে চিলি চিকেন গরম করে খাওয়ার জন্য!”

এত আকস্মিক আক্রমণের জন্য সুপ্তা প্রস্তুত ছিল না একেবারেই। হাত থেকে গরম খুন্তি কড়াইয়ে বাড়ি খেয়ে টং করে পায়ে পড়ল।

“আহহ – ”

একেবারে পড়ার সাথে সাথে ফোস্কা পড়ে গেছে।

ভারতীয় সিরিয়াল হলে দুপুর রোদে বজ্রপাত হত। তেমন কিছুই হল না। সুপ্তা কয়েক মুহূর্ত অপ্রস্তুত থেকে ঝাঁঝিয়ে উঠল, “বেশ করেছি। হাজার বার করব। কেউ খাবে, আর কেউ খাবে না তা কেন হবে।”

এ দেখি ধরা পড়ে পুরোপুরি কমিউনিস্ট হয়ে গেছে। আমার একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল – ছয় সাত মাস আগে একবার ফিস্ট হয়েছিল। সেদিন সুপ্তা ডলিকে অনেক বলেছিল, “ওই তোর রানের পিসটা আমায় দিয়ে দে না, তোর তো অনেক জমে গেছে। দে না।”

কেমন হ্যাংলার মতো লাগছিল ওকে। অথচ কি শান্ত নিরীহ চেহারা।

“হাজার বার খাবো। বেশ করেছি, ওরা না আমার বন্ধু! কখনো দেখেছিস কাজ না করিয়ে কিছু খেতে দিয়েছে, সব উপরে উপরে। ইচ্ছে মতো খাটিয়ে তারপর পাতিলের তলায় পড়ে থাকা তেল, ঝোল, হাড়ের টুকরা।”

সুপ্তার গলা খালি মেসে কেবল ভয়ানক কানে বাজছে। রান্নাঘরের আগুনের আঁচে শ্যামলা মুখ লালচে হয়ে উঠছে – পায়ের ফোস্কার দিকেও নজর নেই।

মনজু মামা ঝিরঝিরে টিভি ছেড়ে ঘটনা স্থলে হাজির। বোঝার চেষ্টা করছে কী হচ্ছে।

সুপ্তা কেবল ক্রমে ক্রমে কমিউনিস্ট হয়ে উঠছে। আমি বুঝতে পারলাম দুপুর রোদে ওর মাথায় কমিউনিজমের ভূত ভর করেছে। আর কিছু না।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post কালো চোখের রহস্যে| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | সন্দীপ মন্ডল| Bengali Detective Story
Next post বিপ্রদীপের বিপদ| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | সায়ন দাস| Bengali Detective Story