অভিমন্যু ছিটকে বেরিয়ে আসে। নিজের হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে। খুব চেষ্টা করে মনঃসংযোগ করার জন্য। কিন্তু ব্যর্থ হয়। গত সপ্তাহেও তো ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে পেত। গত রবিবারও ও জঙ্গলে প্রবেশ করে নেশা করার মতো এক পোকার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। কি সুন্দর লাগতো! গত পরশু সকালবেলায় উঠে হরেকরকম পাখির কলতানে আনন্দিত হয়েছিল। আজ আর এসব শুনতে পাচ্ছে না। কোথাও সে কোনদিন পড়েছিল/জেনেছিল যে, যখন মন ভাল থাকে তখন এইসব আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় কিন্তু মন খারাপ হলে বা মন ভালো না থাকলে এসব আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় না। তবে কি সে ভালো নেই? নিজের মনেই বিড়বিড় করল। বারবার একটি ঘটনা ভাসছে যা, মনকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।
-গতকাল গভীর রাতে ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎ এক বিদঘুটে শব্দে কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে বেরিয়ে দেখল পাড়ার সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করা ছেলেটা এক ছুটে দৌড়ে হাওয়ার মত মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। সামনে এগিয়ে দেখল একটি চিঠি পড়ে রয়েছে। তাতে লেখা-
“কতদিন আর অভিনয় করব? বিদায় পৃথিবী।”
আজ সকালে তাদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারল সে নাকি গতকাল দুপুরে বেরিয়েছিল আর ফেরেনি।
(২)
প্রতি রবিবার এর মত আজও সে বেরিয়েছিল। আজ তার সাথী দুষ্মন্ত। দুষ্মন্ত তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল যেহেতু করোনা পরিস্থিতি চলছে এবং এটি ছোঁয়াচে রোগ তাই গাড়ি নিয়ে না, সাইকেলে বেরোই। তারপর দুজনে দু’টি সাইকেলে পাড়ি দিয়েছিল জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। এই সময়টাকে এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সময় বলে মনে করে অভিমন্যু। কারণ যা তার ভালো লাগে, যা তাকে খুব টানে, সেদিকেই সে যাত্রা করে। এজন্য সে তার সহযোগীকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়। কারণ অনেকের ইচ্ছে বাস্তবতা পায়না শুধুমাত্র এরকম একজন সহযোগী না পাওয়ার জন্য।
কিন্তু আজ সে জঙ্গলের সেই মায়াবী পরিবেশ উপভোগ করতে পারছে না; জঙ্গলের বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ আজ সে শুনতে পাচ্ছে না। তার মনে পুনরায় জাগরিত হয় সেই পুরনো সন্দেহ তাহলে কি সে ভালো নেই? সন্দেহ দূরীকরণের উদ্দেশ্যে এসে দুষ্মন্তদাকে এক নিঃশ্বাসে জিজ্ঞেস করে
অভিমন্যু – “দুষ্মন্তদা তুমি কি পোকার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ? জঙ্গলের মায়াবী পরিবেশ উপভোগ করছ? এমন কিছু দেখছ তা তোমাকে অনাবিল আনন্দ দিচ্ছে?”
দুষ্মন্ত – “কেন হঠাৎ এরকম প্রশ্ন করছ? আমি তো আলাদা বিশেষ কিছু বুঝতে বা শুনতে পারছিনা। আওয়াজও শুনতে পাচ্ছি না। বরাবর এখানে এলে যে রকম লাগে সেরকমই লাগছে।”
অভিমন্যু – “ও আচ্ছা। দেখি কাউকে পেলে জানতে চেয়ে প্রশ্ন করতে হবে।”
(৩)
ধনঞ্জয় এক দৌড়ে কতটা এসেছে নিজেও বুঝতে পারল না। এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে সে কিভাবে এত জোরে দৌড় শুরু পারল! নিজেই অবাক হয়ে গেল। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে সে থেমে গেল এবং চারপাশটা লক্ষ করে বোঝার চেষ্টা করল কোথায় এসেছে? এবার বুঝতে পারল জঙ্গলের পাশে যে বড় রাস্তা রয়েছে সেই রাস্তা ধরেই সে ক্রমশ জঙ্গলের দিকে প্রবেশ করেছে।
তারপর কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য দুঃখ পেল। ভাবলো অভিমন্যু স্যার কি সব বুঝে গিয়েছে? একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে বুঝে যাবারই কথা কারণ সেখানে হয়তো দড়িটা এখনো পরে আছে। সে গাছের ডালটিকে অভিশাপ দিতে লাগলো। সে ভেবেছিল আজ একটা সুরাহা হবে, সহজ পথ, কোনো দুশ্চিন্তা নেই। সব সমস্যার সহজ সমাধান। সেখানে কিভাবে ডালটা ভেঙ্গে গেল! এবং একটা বিদঘুটে আওয়াজ সৃষ্টি করল। পাড়ার কুকুরগুলোকে বলিহারি! একটু আওয়াজ হলেই অনবরত ঘেউ ঘেউ করতে থাকে।
এক টুকরো স্মৃতি ধনঞ্জয় এর মনের কোনে উঁকি দিল। মনে পড়ে গেল দশম শ্রেণির এক ক্লাসের কথা যেদিন অভিমন্যু স্যার এসে প্রথমে ঘোষণা করলেন-
“আজ ধনঞ্জয়ের ফাঁসি।”
এ কথা শোনার পর সমস্ত ক্লাস জুড়ে হাসির হিল্লোল হয়ে গিয়েছিল কিন্তু ধনঞ্জয় ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন স্যারের দিকে। স্যার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি রেখে ধনঞ্জয় কে বলেছিল –
“রাগ করো না। এই বিদ্যালয়ে তোমার মত মেধাবী ছাত্র খুব কমই রয়েছে। দেখো, একদিন তুমি খুব বড় মানুষ হবে এবং বিদ্যালয়ের নাম উজ্জ্বল করবে। সেদিন এই ফাঁসির কথা ওদের হাসিতে মিলিয়ে যাবে।”
সেসব দিনের কথা মনে পড়লেই ধনঞ্জয়ের মন ভালো হয়ে যায়। সেসময় শুধু একটা গান গাইতে ইচ্ছে করে-
“আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম!”
হঠাৎ তার মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়, যেন সুন্দর মুখশ্রীতে মেঘলা আকাশ নেমে এসেছে। অভিমন্যু স্যার কি তাকে দেখেছে? চিনে ফেলেছে?
(৪)
অভিমন্যু প্রায় ঘন্টা খানেক চেষ্টা করল তাঁর প্রিয় শব্দগুলো শোনার। তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। অন্যদিকে দুষ্মন্তদা ক্যামেরা রেডি করে শিকারীদের মতো আচরণ শুরু করেছে। হঠাৎ তারা দেখল সামনে থেকে সাইকেল চালিয়ে একজন আসছে। কাছাকাছি আসতেই-
অভিমন্যু- “ও দাদা, একটু দাঁড়ান। আমার একটা প্রশ্ন আছে।”
সাইকেল আরোহী সাইকেলে বসেই এক পা প্যাডেলে আরেক পা মাটিতে রেখে ব্যালেন্স করে বললেন- “বলেন।”
অভিমন্যু – “এই যে আপনি বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন কোন প্রকার প্রাকৃতিক শব্দ বা পাখির কলতান শুনতে পাচ্ছেন?”
সাইকেল আরোহী- “আপনার কী মাথাটাথা খারাপ নাকি? দেখছেন একটা বিশেষ কাজে যাচ্ছি। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নেই নাকি আপনার?”
অভিমন্যু – “সে আপনি যান কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান।”
সাইকেল আরোহী – “ডাকছে হয়তো। আমি শুনতে পাচ্ছি না। আমার মাথায় একটাই চিন্তা কখন কর্মস্থলে পৌঁছে কাজটি সম্পন্ন করব।”
অভিমন্যু- “কী বলছেন এসব! এখন যদি বনের মধ্যে রাস্তার ধারে এক হাতি দেখেন?”
সাইকেল আরোহী- “তবুও দেখতে পাব না। কারণ আমি এখন খুব ব্যস্ত। আমার ওসব দেখার সময় নেই। অনুগ্রহ করে আমায় নিস্তার দিন। যত্তসব!”
(৫)
রেঞ্জার মহাশয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গভীর রাত প্রায় ২:৩০ মিনিট। বিছানার পাশে রাখা মোবাইলটি ঘন ঘন ভাইব্রেট হওয়াতে ঘুম ভেঙে যায় রেঞ্জারর মহাশয়ের।
ফোন হাতে তুলে দেখে ভাতু ফোন করেছে। ৩০ টা মিস কল হয়ে আছে! দেখতে দেখতেই আবার ফোন এসে গিয়েছে ভাতু কলিং। এবার ফোনটা রিসিভ করেন তিনি।
– হ্যালো, ভাতু বল্। এত রাতে বারবার ফোন করছিস্ কেন?
– স্যার আমি ভাতু নই। আমি ধনঞ্জয় সরকার। আমাকে চিনবেন না। আমি হাতিয়াডাংগাতে থাকি।
– ভাতুর ফোন থেকে কল করেছ! এত রাতে। ব্যাপার কি?
– স্যার, অনেক বড়ো ঘটনা ফোনে বলা শক্ত।
– মূল ঘটনা সংক্ষেপে বলো।
– ঠিক আছে স্যার। আজ রাতে কোনও কারণে এই বনের বড়ো রাস্তায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। রাস্তার ধার থেকে হঠাৎ বনের ভেতর মৃদু আলো দেখতে পাই। সে আলো অনুসরণ করে মূল রাস্তা ছেড়ে বনের ভেতরে প্রবেশ করে লক্ষ করি কাঠ চোরেরা গাছ কাটছে। বুদ্ধি করে বনের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে তারস্বরে চোর চোর চোর বলে চিৎকার করি। তারপর নাটকীয় ভাবে তোরা কে কে এখানে আছিস্ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ কর্ বলতে বলতে ঘটনাস্থলে এগিয়ে যাই। পৌঁছে দেখি আশেপাশে কেউ নেই। সকলেই পালিয়েছে। সেখানে রুটি ও মাংস পাই এবং প্রচন্ড খিদে পেয়েছিল বলে সেগুলো খাই। তারপর…
– …এত ডিটেলসে বলতে হবে না। ভাতুর নং থেকে আমায় ফোন করলে কিভাবে? আশেপাশে কী ভাতু আছে?
– স্যার আশেপাশে কেউ নেই। আর ভাতু কে?
– তুমি যে নং থেকে ফোন করেছ সেটা তো ভাতুর নং।
– ও। আর একটুখানি ঘটনা শোনেন। সব জেনে যাবেন।
– ঠিক আছে বল।
– খাওয়ার আগেই দেখেছিলাম একটি বড়ো ও বেশ মোটা শাল গাছ কেটেছে এবং বৃহৎ তিনটি লগ্ বের করেছে। আরও একটি বড় গাছ কাটছিল কিন্তু পারেনি, তার আগেই সব সামান রেখে চম্পট দিয়েছেন।
– বুঝেছি। ভাতুর নং থেকে কিভাবে ফোন করলে?
– ওই অন্যান্য জিনিসের মতো তাড়াহুড়ো করে মোবাইল ফেলে পালিয়েছে। আমি স্পট থেকে মোবাইল ফোন পেয়েছি। এখন আমার কী করনীয় ভাবছি আর ফোন ঘাটতে ঘাটতে নজরে পড়ল…
– …কী নজরে পড়ল?
– এই ফোন থেকে রাত ৯:৩০ নাগাদ শেষ ফোন করেছিল যাকে তার নাম রেঞ্জার সাহেব। কথা বলেছিলেন প্রায় ৩০ মিনিট।
– সব বুঝেছি। তুমি আর কাউকে জানিয়েছ?
– না।
– তুমি ওখানে অপেক্ষা কর। আমি ৪০/৪৫ মিনিটের মধ্যে আসছি। আর কাউকে জানাতে হবে না। আমি আসছি।
(৬)
অভিমন্যু- দুষ্মন্ত দা তোমার ছবি তোলা হলো? অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল। এমনিতেই আজ সকাল থেকে আমি কোন আমেজ পাচ্ছি না। বুঝতে পারছি আমি ভালো নেই।
দুষ্মন্ত- এটা তোমার মনের ভুল। তুমি ভালো আছো বললে ভুল বলা হবে, খুব বেশি ভালো আছো। তাই ওরকম কথা বারবার বলছো।
অভিমন্যু- না, না সত্যি বলছি। কাল রাতে তো জানো না কি ঘটনা ঘটেছে। সেটা শুনলে তুমিও বুঝতে পারবে।
দুষ্মন্ত- কেন? কাল রাতে কি হয়েছে?
রাতের ঘটনা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবিস্তারে অভিমন্যু তার দুষ্মন্তদাকে বলে শোনালো। সব শুনে দুষ্মন্ত দা বেশ গম্ভীর হয়ে বলল
– শোনো ওই একই কথা বারবার চিন্তা কর না। যা হবার তা তো হয়েছে বা যা হবার তা হবে। তুমি কি চিন্তা করে তার কোনো পরিবর্তন করতে পারবে? বরং এখন তুমি কি কি ছবি তুলেছি সেগুলো দেখো।
নিজের হাতের ক্যামেরা অভিমন্যু র দিকে বাড়িয়ে দেয়। অভিমন্যু ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো এক এক করে দেখতে থাকে।
অভিমন্যু – এই যে তুমি বিভিন্ন রঙ্গের বিভিন্ন পাখির ছবি তোলো কিন্তু কাকের ছবি, বকের ছবি তোলো না কেন?
দুষ্মন্ত – অভিমন্যু, তুমি দারুণ প্রশ্ন করেছো। আমি অনেকদিন ভেবেছি কে আমাকে দারুণ এই প্রশ্নটাই করবে? এই প্রশ্নটার জন্য আমাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হলো। দারুণ দারুণ। পরের প্রশ্ন করো।
অভিমন্যু – হাসলে হবে না দুষ্মন্তদা। উত্তর দাও। আমি সিরিয়াসলি প্রশ্নটি করেছি এবং উত্তর জানতে চাই।
দুষ্মন্ত – তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ নেই। তবে এ কথা বলতে পারি আমরা সহজলভ্য কোন জিনিসকে তেমন পাত্তা দেইনা। যে জিনিস যত সহজে পেয়ে যাই সেই জিনিসকে তত কম গুরুত্ব দিয়ে থাকি। যেমন কাক, বক।
অভিমন্যু – বুঝেছি, বুঝেছি। এখন তোমার দর্শন ছাড়তে হবে না। বেলা তো অনেক হল। চলো এখন ফিরতে হবে। না হলে অনেক রাত হয়ে যাবে। তুমি কি ভুলে গিয়েছো আজ আমরা সাইকেলে বেরিয়েছি? এখান থেকে বাড়িতে পৌছাতে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা লাগবে।
দুষ্মন্ত – হ্যাঁ ঠিকই বলেছো। রাস্তায় আবার কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কফি আর বিস্কুট খেতে হবে। কফি কিন্তু আমি বাড়ি ফেরৎ নিয়ে যাবনা।
(৭)
অনেকক্ষণ যাবৎ ধনঞ্জয় চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত। রেঞ্জার সাহেব বলেছেন ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের মধ্যে চলে আসবো কিন্তু এক ঘণ্টা হতে চলল এখনো এল না। হঠাৎ তার হাতের ফোনটায় আলো জ্বলে উঠল এবং ভাইব্রেট করতে থাকলো। স্ক্রিনে নাম জ্বলজ্বল করছে রেঞ্জার সাহেব। ফোনটা রিসিভ করে ধনঞ্জয় বলল -হ্যালো।
রেঞ্জার – হ্যাঁ, আমি প্রায় পৌঁছে গেছি তোমার এক্সাক্ট লোকেশনটা বলতো।
ধনঞ্জয় – শাহু নদীর ব্রিজ পার করে কিছুদূর আসতে হবে স্যার। তারপর ডান দিকে জঙ্গলে।
রেঞ্জার – তোমার কাছে যা গাড়ি আছে, তা নিয়ে ব্রিজের দিকে আসতে পার।
ধনঞ্জয়- স্যার আমার কাছে কোনো গাড়ি নেই।
রেঞ্জার – গাড়ি নেই! তবে ওখানে পৌঁছলে কিভাবে?
ধনঞ্জয় – হেঁটে।
রেঞ্জার – হেঁটে হেঁটে ওখানে পৌঁছে গেলে! স্ট্রেঞ্জ!!
তুমি জঙ্গল ছেড়ে মুল রাস্তায় উঠে ব্রিজের দিকে এগোতে থাকো, আমি আসছি।
মূল রাস্তায় উঠতেই কোথা থেকে হুড়মুড় করে তিনজন লোক ধনঞ্জয়-এর উপর ঝাঁপিয়ে পরল। কিছুক্ষণ ধস্তা-ধস্তি চলার পর তিনজনে মিলে ধনঞ্জয় কে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল।
একজন বললো – চল এটাকে মেরে ফেলি।
অপরজন বলল – আগে জঙ্গলের ভেতর নিয়ে চল্। এখানে কিছু করা যাবে না। জঙ্গলের ভিতরে নিয়ে দড়ি দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে গাছে ঝুলিয়ে মেরে ফেলবো যাতে কেউ সন্দেহ না করে।
ধনঞ্জয় বলল – তোমরা কে? আমি তোমাদের কি ক্ষতি করেছি যে আমাকে মেরে ফেলবে!
উত্তরে একজন বলল- চাঁদু, এই পৃথিবীতে কারো ক্ষতি না করে শুধু দেশের অপকার করতে চাইলেও এভাবে মরতে হতে পারে।
ঠিক তখনই অন্ধকার কাটিয়ে দ্রুত গতিতে রাস্তার পাশে তীব্র আলো নিয়ে একটি গাড়ি এসে থামল। গাড়ির আলো এসে পড়ল তাদের চার জনের ওপর। গাড়ি থেকে নেমে এলেন রেঞ্জার সাহেব এবং নির্দেশ দিলেন ওকে ছেড়ে দাও।
একজন বলে উঠলেন – স্যার আপনি এখন এখানে? আমরাই তো কেসটা সামলে দিতাম।
রেঞ্জার সাহেব বললেন – ভাতু, তোমরা এখন নিজের নিজের বাড়ি যাও। বিশ্রাম নাও। অনেক পরিশ্রম হয়েছে। আর ওকে আমার কাছে ছেড়ে দাও। আমি দেখছি ব্যাপারটা। ভাতু তোমার ফোনটা ওর কাছে রয়েছে নিয়ে নাও। নিজের ফোন সামলাতে পারবে না বড়ো বড়ো কথা!
ধনঞ্জয় কিছুই বুঝল না। অবাক হয়ে শুধু বলল- দিয়ে দেব ফোনটা!
রেঞ্জার সাহেব বললেন – হ্যাঁ, দিয়ে দাও। চলো আমার সঙ্গে। তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
(৮)
গহীন অরণ্যের ভিতরে এমনিতেই দিনের বেলায় ঘন অন্ধকার বিরাজ করে ফেলে। অভিমন্যু ঘড়িতে চোখ রেখে দেখল তিনটে বেজে ত্রিশ। এত তাড়াতাড়ি চারিদিকে দেখা গেলেও গা ছমছমে মৃদু অন্ধকার নেমে আসছে। হঠাৎ জঙ্গলের মেটে রাস্তা থেকে ডানদিকে কিছু সারিবদ্ধ গাছের পাশে পেছনের একটি শাল গাছ দেখে অভিমন্যুর চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। এ কি দেখছে সে! শাল গাছের নীচের শাখায় কিছু একটা ঝুলে আছে না? আবার চোখ কচলিয়ে অভিমন্যু দেখে মানুষ মনে হচ্ছে! এবার সাহস করে ধীরে ধীরে সেদিকে অগ্রসর হন। একদম সামনে গিয়ে অভিমন্যু দেখল একটি মানুষ যেন শূন্যে ঝুলে রয়েছে। এ নিশ্চয়ই আমার ছাত্র ধনঞ্জয়। কাল আমার বাড়ির কাছে কাজ করতে না পেরে জঙ্গলে প্রবেশ করে এ কাজ করেছে। হায়! হায়! হায়! এ আমি কী দেখলাম। এত মেধাবী একজন ছাত্র এভাবে নিজেকে শেষ করে দিল। অস্ফুট শব্দে অভিমন্যু পিছনে ফিরে দুষ্মন্ত দাদাকে ডাকতে গিয়ে দেখেন তিনি আশেপাশে নেই। অভিমন্যু তখন পাগলের মতো তাঁকে খুঁজতে থাকে। রাস্তা ধরে কিছু দূর অতিদ্রুত এসে দুষ্মন্ত দাদাকে দেখতে পেলেন সাইকেল নিয়ে ধীরে ধীরে হেটে অগ্রসর হচ্ছেন। তাড়াতাড়ি এসে অভিমন্যু বলল “দাদা দ্রুত উলটো দিকে চ’ল। মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে চল দেখবে। আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না।”
– রিল্যাক্স, রিল্যাক্স, কী দেখেছ? এত উত্তেজিত কেন? বনে এসে এত চাপ নিলে চলে?
– আ আ আ আমাদের ধনঞ্জয়…এখানে এসে শেষে মারা গিয়েছিল।
– কি বলছ! কোথায়? কোথায়? দ্রুত চলো।
– উল্টো দিকে। ছেড়ে এসেছ।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে দুজনেই দেখল কোথায় কী? কিছু নেই। দুষ্মন্ত বললেন -” কি দেখতে কী দেখেছ কে জানে? তোমার মাথাটা বোধহয় কাজ করছে না। ধুর ধুর চল অনেক হয়েছে বাড়ি ফেরা যাক।
(৯)
গাড়িতে করে রেঞ্জার সাহেব ধনঞ্জয়কে নিয়ে অফিসে পৌঁছালেন তখন ঘড়িতে ভোর সাড়ে চারটা বাজে। চোখ কচলে হায় তুলতে তুলতে অফিসে ঢুকে তিনি একটি চেয়ারে বসে ধনঞ্জয়কে সামনের চেয়ারে বসতে বললেন।
রেঞ্জার – যা প্রশ্ন করব ঠিক ঠিক জবাব দেবে, তা নাহলে তোমার বিপদ হবে। আমার ঘুম পূরন হয়নি। তাই বেশী সময় দিতে পারব না। বুঝলে! তুমি স্পটে পৌঁছালে কিভাবে?
ধনঞ্জয় – বিশ্বাস করুন স্যার দৌড়ে দৌড়ে।
রেঞ্জার – তা অত রাতে দৌড়ে দৌড়ে পৌঁছে গেলে। একথা কেউ বিশ্বাস করবে? সত্যি কথা বল্।
ধনঞ্জয় – আপনি যদি আমাকে প্রতিশ্রুতি দেন একথা আর কাউকে বলবেন না তবে বলতে পারি।
রেঞ্জার – ব্যাটা তোর সাহস তো কম নয়। আমার কাছে প্রতিশ্রুতি চাইছিস্। হ্যাঁ ঠিক আছে প্রতিশ্রুতি দিলাম।
ধনঞ্জয় রাতের সমস্ত ঘটনা কোনো রকম না লুকিয়ে বিস্তৃত ভাবে বললেন।
সব শুনে রেঞ্জার সাহেব বললেন – “হ্যাঁ সব বুঝলাম। তুমি হয়তো জেনে অবাক হবে ভাতু স্পেশাল টাস্ক ফোর্স এর একজন স্থায়ী কর্মী। ওঁরা বিশেষ কাজে ওখানে রাতে পোস্টেড ছিল। প্রথম বারের মতো অল্পের জন্য অপরাধীদের ধরা গেল্ না। তবে তোমার শারীরিক ফিটনেস ও সাহসী ভূমিকা দেখে ও জেনে আমি ইম্প্রেসড।
ঠিক আছে তুমি যেতে পারো। একটু অপেক্ষা কর।”
(১০)
দুষ্মন্ত- অভিমন্যু ওদিকে তুমি চায়ের দোকানে কেন যাচ্ছ? আমি তো বাড়ি থেকে কফি এনেছি।
অভিমন্যু – চায়ের দোকানে তাকিয়ে লোকগুলো দেখো তাহলে বুঝতে পারবে আমি কেন চায়ের দোকানে যাচ্ছি?
দুষ্মন্ত চায়ের দোকানের লোকগুলো ঝলক দেখে নিল কিন্তু কিছু ঠাওর করতে পারলনা। দোকানে পৌঁছে চক্ষুচড়কগাছ! ধনঞ্জয় সরকার বসে চা ও সিঙ্গারা খাচ্ছে। ওর সামনের বেঞ্চে বসে চা ও সিঙ্গারা খাচ্ছে সকালে দেখা সেই সাইকেল চালানো লোকটি! যে অভিমন্যুকে পাগল বলেছিল।
অভিমন্যু সামনে গিয়ে জানতে চাইল-”কিরে ধনঞ্জয়, তুই এখানে?”
ধনঞ্জয় উঠে দাড়িয়ে স্যারকে প্রণাম করে বলল- “স্যার ঈশ্বরের কৃপায় গতকাল বন দপ্তরে একটা চুক্তি ভিত্তিতে চাকরি পেয়েছি। রাতে ডিউটি আছে।”
অভিমন্যু – “বা! চমৎকার! শুনে যে কী আনন্দ পেলাম তুই অনুভব করতে পারবি না। আরও বড়ো খুশির খবরের অপেক্ষায় রইলাম।”
ফেরার পথে অভিমন্যু দুষ্মন্ত দাদাকে বলল আজ সূর্য ডোবার প্রাক মুহূর্তে ওই পাখির কলতান শোনা যায়। অপূর্ব! দুষ্মন্ত ভাবছে এই রে ক্ষ্যাপা আবার ক্ষেপেছে! সকালেই ঠিক ছিল। এখন কত কী অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখাবে। এদিকে ও আর ভালো নেই। বাড়িতে ফিরে মিসেসের প্যানপ্যানানি কথা ভেবে মন বিষিয়ে দিচ্ছে। কখন যে এত লেট হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। বুঝছে অভিমন্যু ফুরফুরে হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ দুষ্মন্তের মাথার দুষ্টু বুদ্ধি অভিমন্যুকে প্রশ্ন করল -” ধনঞ্জয় ফাঁসি দিতে চেয়েছিল কেন?”
অভিমন্যু জবাব দিল – “তুমি আমার সাথে মস্করা করছ। তবে এটা সত্যি চিন্তার বিষয়।”