Getting your Trinity Audio player ready...
|
গ্রামের মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশিস কুমার চক্রবর্তীর বাড়িতে তাঁর দূর সম্পর্কের এক মামা থাকতেন। মামারবাড়ি ছিলো প্রথমে বাংলাদেশে, পরে নাগাল্যাণ্ডে। জঙ্গি ভয়ে নাগাল্যাণ্ড থেকে হঠাৎ চলে আসেন ভাগ্নের বাড়িতে কৃষ্ণপুরে। সেই থেকেই তিনি এখানে থাকতেন। এখানে আসার কিছুদিন পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আশিস বাবু প্রথমে তাকে নিয়ে যান কৃষ্ণ পুর প্রাথমিক চিকিৎসালয়ে। প্রাথমিক চিকিৎসালয়ের ডাক্তার অভিক চৌধুরির খুব নামডাক। তিঁনি খুব ভালো ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি। আশিস বাবুর সাথেও একটা ভালো ভাব রয়েছে তারঁ। ডাক্তার অভিক চৌধুরি প্রাথমিক পথ্য দিয়ে আরোও উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দেন। সেইসূত্রে আশিস বাবু মামাকে নিয়ে প্রথমে জেলা চিকিৎসালয় ও পর্যায়ক্রমে বহির্রাজ্যের আধুনিক উন্নত ম্যাডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যান। তিনি আপন মামার চিকিৎসা ক্ষেত্রে কোনোও খামতি রাখেননি। ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষায় ধরা পড়ে তাঁর ক্যান্সার হয়েছে। তারপর থেকে ডাক্তারি পরামর্শমতেই চিকিৎসা চলছিল ও ভাগ্নের বাড়ি কৃষ্ণপুরেই তাঁর বৃদ্ধ কাল কাটতে লাগল। তবে তার কষ্টের পরিসীমা এখানেই শেষ নয়, তিনি ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর থেকে প্রতিদিন রাতে কী একটা অভিনব আওয়াজ শুনতে পান। কে যেন শিঁস দেয়। তিনি শিহরিত হয়ে উঠেন। কখনো বা ঘুম থেকে চিৎকার দিয়ে উঠেন। কখনো কখনো এ অদৃশ্য সত্বার ভয়ে চোখে ঘুম আসে না। কখনো বা তিনি বেহুঁশ হয়ে যান। এ নিয়ে তিনি ভাগ্নে আশিস কুমারকে বলেছেন। ভাগ্নেও মামার এ সমস্যা নিরসনে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। এমনকি মামার বাসগৃহ পরিবর্তনও করা হলো, কিন্তু সমস্যা সে তিমিরেই থেকে গেল। এভাবেই ভয় ও শংকার মধ্য দিয়ে আশিস বাবুর মামার দিন যাপন হচ্ছিল। এদিকে মারণব্যাধি ক্যান্সারও তার গতিতে চলতে লাগলো। হঠাৎ একদিন আষাঢ় মাসের শেষের দিকে এক শনিবার রাত দশটা নাগাদ মামা মারা গেলেন। এর আগের দিন থেকে মুষলধারে অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে। মারা যাবার দিন তো বজ্র-বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত হচ্ছে সারা দিন ধরে। সন্ধ্যা নামতেই পুরো গ্রাম অন্ধকার। মামা মারা যাবার পর আশিস কুমারের বার বার মনে পড়ছিলো মামার শেষ ইচ্ছার কথা, “তিনি যেন বাসি মড়া না হন।” আর তিনিও কথা দিয়েছিলেন মামাকে। কিন্তু কে জানে কার মৃত্যু কখন হবে, যা হবার তা তো হয়ে গেছে। এদিকে বৃষ্টি যেন কমার নামই নিচ্ছে না। ভেবে উপায়ন্তর না পেয়ে ছেলে সৌমেনকে দিয়ে গ্রামবাসীদের ডেকে পাঠালেন, কিন্তু প্রায় সবাই অসুবিধা দেখায়। শুধুমাত্র তার ছাত্র মানব ও রতন খবর পেয়ে উপস্থিত হয়। কিন্তু এরপর যখন ভোলা এসে উপস্থিত হয়, তখন চিন্তা কমবে কি আরো বেড়ে গেল। ভোলাকে সাত গ্রামের লোকেরা এক ডাকে চেনে। আশিস কুমার রতনের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বড়ো বিপদে পড়েছি, আমাকে উদ্ধার কর।”
অবশেষে তারা চারজন মিলে শবদেহ নিয়ে শ্মশানের দিকে যাত্রা করল। কিন্তু তখন যে রাত বারোটা। এতো রাতে আঁধারঘেরা পথে শ্মশানে যাওয়া চারটিখানি কথা নয়। তাদের গা ছমছম করতে লাগলো। মনে নানা ভয় বাসা বাঁধতে লাগল। বৃষ্টিরাতের হিমেল হাওয়াও আপন গতিতে চলতছে। নিশাচর জীবরাও অভ্যাসগতভাবে ডাকছে। গাছ নড়ছে, পাতা পড়ছে। এরকম একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। স্বাভাবিক স্থানে যাত্রাও ভীতির সঞ্চার করবে। উপরন্তু শ্মশানে যাওয়া, এ তো যমদূতের সাথে সাক্ষাত। তবুও যেতে হবে। উপায় নেই। সবাই বুকে সাহস সঞ্চয় করে চলতে লাগলো। অবশ্য তখন বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয়েছে। শ্মশানে গিয়ে মরদেহ মাচায় রেখে ডোমকে ডাকাডাকি শুরু করলেন, কিন্তু ডোম কোনো সাড়া দিল না। খড়ি মযুত আছে, কিন্তু বাঁশ নেই। তাছাড়া সব ভেজা। কেরোসিন লাগবে। সৌমেন বললো, “মানব আমার বাড়িতে সব আছে, চল গিয়ে নিয়ে আসি। ভোলা, তুই মৃতদেহ পাহারা দে, আমরা যাব আর আসব।” তারা রওনা দিল, মানব বলল, “পেট্রোম্যাক্স তো একটা লাগবে। তাছাড়া জিনিষগুলো তো ঠেলা ঠেলে আনতে হবে, পথে কত সাপ টাপের ভয়।” সৌমেন বলল, “ভোলা তুই ভয় করিস না, মনের দুর্বলতা থেকে ভয় আসে” সেগুলো নিয়ে ফেরার সময় প্রদীপ বলল, “স্যার আপনারা দু’জন পেট্রোম্যাক্স নিয়ে চলে যান।” তাই পথে তারা দু’জন কথা বলতে বলতে যাচ্ছেন, “বুঝলে আশিস, শেষ বার গিয়েছিলাম ফুলমতিকে ঐ যে পাগলের বউ তাকে দাহ করতে। সে তো বৈশাখ মাসের ১৮ তারিখ। এভাবে ফুলমতির গল্প করতে করতে হাজির হলেন শ্মশানে। শ্মশানে পৌঁছতেই যেন শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য মঞ্চস্থ হতে লাগল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালো, একটা দমকা হাওয়া জোরে বয়ে গেল। আকাশেও মেঘের গর্জন শোনা গেল। পুকুরের ব্যঙগুলি জোরে ডাকতে আরম্ভ করল। একই সাথে বাবলা গাছের উপরে শিশুর কান্না শোনা গেল, আর ঠিক ঐ মূহুর্তে মরদেহ উঠে বসল। এ যেন কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটার মতো। এই দৃশ্য দেখে তারা পেট্রোম্যাক্স ফেলে রাম রাম বলে দৌড়াতে লাগল। এই দৌড়ে অলিম্পিকের কোনো খেলোয়াড় তাদের বয়সে দৌড় দিতে পারবেন কি না সন্দেহ। এদিকে প্রদীপরাও আসছে, পথিমধ্যে প্রদীপদের সাথে দেখা হল তাদের। তাদেরকে সব বৃত্তান্ত বললেন। সব শুনে সবার হুঁশ উড়ে যাওয়ার জোগাড়। কিন্তু প্রদীপ সবাইকে অভয় দিল। সবাই শ্মশান অভিমুখে যাত্রা করলেন। শ্মশানে পৌঁছে রতন দেখল, মরদেহ জায়গায় নেই। খালি মাচা পড়ে আছে। ভোলাও নেই। ভোলা, ভোলা বলে সবাই ডাকাডাকি করলো কিন্তু কোনো সাড়া পেল না। মাস্টারমশাই তো কাঁদতে শুরু করলেন। প্রদীপ দৌড়ে গিয়ে দেখলো মৃতদেহটাকে গাছের নীচে দাঁড় করানো অবস্থায়। তা দেখে সে বোবা হয়ে গেল। ভয়ে কিছুই বলতে পারল না। বাকীরা সবাই ভীত, সন্ত্রস্ত। প্রদীপ আবার কিছুক্ষণ পরে দৌড়ে গিয়ে মরদেহটাকে একা কাঁধে নিয়ে আবার মাচায় শুইয়ে দিল। হঠাৎ বাবলা গাছের উপর থেকে একটি মরা ডাল ভেঙে পড়ল। গাছের উপর থেকে নারী কন্ঠের আওয়াজ এলো, “হিঁ হিঁ হিঁ…..।” “এই অদ্ভূত আওয়াজ শুনে প্রদীপ ছাড়া বাকী সবাই কাঁপতে লাগলো। “আমাকে চিনিস না, আমি ফুলমতি, মরে গিয়ে ভুতুনি হয়েছি, হিঁ হিঁ হিঁ। অনেক জ্বালিয়েছিস আমাকে। আমার স্বামী পাগল বলে আমাকে কত অপমান করেছিস তোরা। এতদিনে পেয়ে সব কটির ঘাড় মটকে খাবো হিঁ-হিঁ-হিঁ।”
সৌমেন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল বাবা ভুতুনী, পাগলের বউ ফুলমতি। তখনি দেখা গেলো, গাছে কী একটা নাচছে। অস্পষ্ট বিদ্যুতের আলোতে দেখা যাচ্ছিল না। পাশে্র বন থেকে শেয়ালের দল ডাকছে। বাঁদুড় ও পেঁচা উড়োউড়ি শুরু করলো।
প্রদীপ তবুও ভয় পেল না, শুধু পরখ করতে লাগলো। বাকী সবাই দে ছুট। আর কোনো দিকে না তাকিয়ে একেবারে গ্রামের শেষ সীমানায় পাঠশালার বারান্দায় হরিহর পণ্ডিত হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, এটা মা বিদ্যাদেবীর মন্দির। এখানে ভূত -প্রেত আসবে না। আমি সে সময় মন্ত্র পড়েছিলাম, না হলে সবাইকে ফুলমতি খেয়ে নিত।
সৌমেন বলল, প্রদীপ দা কোথায়! মনে হয় রয়ে গেছে। বেশি সাহস ভালো নয়, মরবে, মরবে। আশিসকুমার কেঁদে কেঁদে বললেন, মামা গো, জীবিত কালে জ্বালালে, এবার মরার পরেও। আশ্রয় দিয়ে কি পাপ করলাম। হরিহর পণ্ডিতের মনে পড়ল তার স্ত্রীর কথা, দুর্যোগপূর্ণ এই দিনে যেয়ো না গো, কোনো বাহানা খাড়া করে কেটে পড়। মানব মনে মনে বলল, শালা, অঙ্ক টা পারি না, ভাবলাম বিপদের সময় স্যারের পাশে দাঁড়াই, স্যার খুশি হবেন।
এদিকে প্রদীপ গাছের উপরের দিকে টর্চ মারতেই ভুতুনি নাকি সুরে বলল, “হিঁ -হিঁ -হিঁ, বড্ড সাহস তোর, আমাকে ভয় করিস না, তোকে খাবো, হিঁ-হিঁ-হিঁ।” এরই মধ্যে হঠাৎ ডাল নড়তে লাগল। কলসের ভাঙা টুকরো উপর থেকে পড়তে থাকল। “কী, আমাকে মারবি, দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা। “এই বলে প্রদীপ বাবলা গাছে বেয়ে খানিকটা উঠে গেলো। উপরে উঠতেই ছোট ছোট ডাল প্রদীপের উপর এসে পরতে থাকল। এবার জোরে চিৎকার করে প্রদীপ বললে, আমার কাছে পিস্তল আছে। এক, দুই, তিন এর উচ্চারণ শেষ হতে না হতেই ফুলমতি ভুতুনি উত্তর দিল পুরুষ কণ্ঠে, “গুলি করো না প্রদীপদা, আমি ভোলা।” প্রদীপ লাফ দিয়ে নেমে গেল, ও ভোলা ভূতুনি, হারামজাদা, তাড়াতাড়ি নেমে আয়। ভোলা সাদা কাপড়টি নিয়ে নেমে এল।
প্রদীপ বড় বড় চোখ করে বলল, ভয় দেখালি কেন?সাথে সাথে ভোলা বললে, তুমি কোথা থেকে এলে, তোমার তো আসার কথা নয়।
“ওহ আমি এসে তোর ঢপ যাত্রাতে জল ঢেলে দিলাম!কী হয়েছে বল, না হলে একটা কষিয়ে চড় মারব। আর্মির হাত…” প্রদীপ ভারি গলায় বললে।
দেখ না প্রদীপদা চারজন মিলে এসেছি দাহ করতে। তারা এখানে আসার পর কানাকানি করে, তখনই বুঝে গেছি মতলব আছে। ভীতুর দল, আমাকে একা ফেলে কেরোসিন আনার ছলনায় বাড়ি ফিরে গেল। একবারও আমার কথাটা ভাবলো না! স্যারও কেমন মানুষ এত রাত্রিতে চারটে বাচ্ছা ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন শ্মশানে দাহ করতে। তবুও কিছু মনে করিনি। তারা আমাকে একাকি রেখে চলে যাবার পর ভয়কে জয় করে মড়ার পাশেই বসেছিলাম। হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা লাগল। তাই ভাবলাম অযথা ঠাণ্ডায় কষ্ট করে কী লাভ, যে মরে গেছে তার গায়ে চাদর যা, না থাকাও তা, বরং যে বেঁচে আছে তার বেশী দরকার। তাই আমি সাদা চাদরটা নিয়ে মাথা মুড়ি ঢেকে শুয়ে পড়লাম, ঘুমও লেগে গেল। হঠাৎ স্যারের কথা শুনে ঘুম ভাঙল। উঠে বসতেই দেখি পেট্রোম্যাক্স ফেলে রেখে ই তাঁরা দৌড় লাগালেন। আমি আর পেছন পেছন ডাকিনি। এবার সত্যি সত্যি আমার মাথায় দুষ্টুমি এল, আমি মড়াটাকে টেনে খড়ির উপর দাঁড় করালাম। আর সাদা চাদরটা ও ভাঙা কলসি নিয়ে বাবলা গাছে গিয়ে বসলাম। এরপর সুযোগ খুঁজলাম, জানতাম তাঁরা আবার আসবে। ভোলা প্রদীপ কে সব খুলে বলল।
প্রদীপ ভোলার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে তো আশ্চর্য। সে ভোলার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে জোরে একটা চড় কষালো। ভোলা হতবম্ভ হয়ে গেল। প্রদীপ বললো ভোলা তুই খুব সাহসী ছেলে, তাই তোকে প্রথমে আদর করলাম। আর ক্রোধ মেটাতে আবার তোর গালে চড় কষালাম। কারণ, ক্রোধ মেটাতে গিয়ে কাউকে ভয় দেখানো উচিত নয়, কেউ ভয় পেয়ে মরে যেতে পারে। সেজন্য তোর গালে চড় কষালাম। ভোলা অবনত মস্তকে সব শুনে একটু মুখ তুলে বলল তোমার পিস্তল কই দেখি।
পিস্তল সাথে নেই, দা আছে। মিথ্যে বলেছিলাম। তবে ফুলমতি ভূতুনির অভিনয় করলি কেমন করে? ভোলা মুচকি হেসে বললো, পুজোর সময় নাচ ঘরে যাত্রাপালা গাইগো। মাঝে মধ্যে ছোট অভিনয়ও করি, অভিনয়ে সেরার শিরোপাও আমার ঝুলিতে রয়েছে। আসলে তুমি তো এখন এখানে থাকো না, তাই জানো না। প্রদীপ সব শুনে রাগ সম্বরণ করল ও ভোলার ঘাড়ে হাত রেখে বললো, চল চিতা সাজাই।
এদিকে পাঁচজন পাঠশালার বারান্দাতে দাঁড়িয়ে ভোরের অপেক্ষা করছে। হরিহর পণ্ডিতের কথামতো ঠিকই বিদ্যালয়ে ভূত-প্রেত নেই, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল পাশের বাড়ির গাছপালা ও বাঁশ ঝাড়ে যেন ভূতের পৈত্রিক আস্তানা। পেঁচা ডা কছে, গাছে কড়-কড়, মড়-মড় শব্দ হচ্ছে, ব্যাঙ ডাকছে, গাছের ডালও ভেঙে পড়ছে, কথা বলা বলির অস্পষ্ট আওয়াজও কানে ভেসে আসছে। কখনো কখনো হাসি-কান্নাও শোনা যাচ্ছে। যেন শ্মশান থেকেও আরোও খারাপ অবস্থা। এ যেন ভূতের স্বর্গরাজ্য। এসব লোমহর্ষক ঘটনায় তাদের শরীর শিলা হওয়ার উপক্রম। সবাই সাহস সঞ্চয় করে একসাথে জড়ো হয়ে বন্ধন গড়ে ঠায় ভোরের অপেক্ষা করতে লাগলেন। তারা বেশী কথাও বলতে পাছিলেন না, ভূত টুত তাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে যায় কি না এ ভয়ে। তাদের কাছে একটি টর্চও নেই। এমন সময় মানব চুপিসারে বলতে লাগলো, “স্যার গত মাসদিন আগে সন্ধ্যারাতে বাজার থেকে বাড়ি ফেরার সময় রাস্থায় একটি সাপের উপর দিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে দেই। আসলে প্রথমে আমি টেরই পাই নি। সাপটিকে অতিক্রম করতেই তা অনুভব করি এবং গতি বাড়িয়ে চটজলদি বাড়ি ফিরি। ঘরেএসে আমি নেয়ে ঘেমে সারা, রাতে ভাতও খেতে পারি নি। সবার চেষ্টা ব্যর্থ করে না খেয়েই শুয়ে পড়ি। রাত প্রায় দুটো নাগাদ আমার দরজায় কে যেনো মেয়েলি সুরে ডাকছে, ও মানব, মানব…. দরজা খোল, পরক্ষণে শিশুর কান্নার আওয়াজও শুনতে পাই। এরপর একটু নিস্তব্ধ। আবার সেই একই আওয়াজ, মানব, মানব..দরজা খোল, আবারো সেই শিশুর কান্না, এভাবে একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। আমি দুর্বলতা ও ভয় হেতু কাউকে কিছু বলতেও পারছি না, এদিকে শুধু কাঁপছি ও ভীষন জ্বর উঠেছে। যত সময় গেলো জ্বরের মাত্রা আরোও বাড়লো, পরের দিন ডাক্তার দেখালাম, তাবিজ কবজও করা হলো, তারপর তিনদিন পর সুস্থ হয়েছি। এখন অবশ্য আমার শরীর বন্ধ আছে। ভূতের আছর পড়বে না।” … হঠাৎ আজানের সুর এলো। তাঁদের মনে একটু আশার উদয় হলো, বুকে একটু সাহস পেয়ে তারা ভাবল এবার শ্মশানের দিকে গিয়ে তাঁদের খোঁজ নিই।
শ্মশানে পৌছেই ভোলাকে দেখে তাদের দুশ্চিন্তা দূর হল। ভোলা শ্যাওড়া গাছের নীচে বসে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। “কোথায় ছিলি সারাটা রাত?” ভোলা কোনো কথা বললো না। কোনোক্রমে আঙুল তুলে পানাপুকুরটা দেখালো। তার সারাটা শরীর কাঁপছে। চোখ দুটি লাল, কথা বলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। সবাই ভোলাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। প্রদীপ দূরে দাঁড়িয়ে দক্ষ অভিনেতার অভিনয় দেখছিল। হঠাৎ বললো, আর সময় নষ্ট করবেন না, চিতাতে মুখাগ্নি করুন।
মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ভোর হয়েও অন্ধকার দূর হচ্ছিল না। চিতাতে আগুন জ্বলল। দেহটা কীভাবে ব্রহ্মার কাছে বিলীন হয়ে গেল। আশিস কুমার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কোথায় জন্ম, কোথায় মৃত্যু কেউ তা বলতে পারে না।
হরিহর পণ্ডিত এতক্ষণে বেশ জমিয়েছিলিন, কাল যে আমরা বেঁচে ফিরেছি, তা কীসের জন্য জানো, আমি সেই মূহুর্তে ভূত তাড়ানোর মন্ত্র জপ করেছিলাম। ফুলমতি ভূতুনিকে তো আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। ওর মুখের কথা শুনেছি। এই বিশাল বড় বড় চোখ, একেবারে শ্যাওড়া গাছটা নাড়িয়ে দিল। কথা বলতে বলতে সবাই বাড়ি পৌঁছে গেল। সোমবার ভোলা যখন স্কুলে গেলো স্যার ওকে সারাটা দিন কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। আশিস কুমার খানিকক্ষণ পর পর পায়চারি করছিলেন আর বড় বড় চোখে ভোলার দিকে তাকিয়েছিলেন। ভোলার কেন শাস্তি হল তা কেউ জানার সাহসও করলো না।