মর্ম| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | জ্যোতিষ্ক ব্যানার্জ্জী| Bengali Detective Story
0 (0)

বাঙালি বাড়িতে সঞ্চয়িতার অবস্থান আটপৌরে ব্যাপার। বর্তমানে চটজলদি মুখরোচক হিসাবে সঞ্চয়িতার পাশাপাশি ব্যোমকেশ, শার্লক কিংবা নিদেনপক্ষে ফেলুমিত্তিরের উঁকি দেখা দেয়। বয়স দোষে আর পাঁচটা তিন চারের ছেলেদের মতই গোয়েন্দাগিরির ব্রহ্মদৈত্য মাথাচারা দিয়ে ওঠে। একবার তো চোরের জিনিস ভেবে আমাদের পাড়ার হারু মিস্ত্রির জিনিস বেচে দিয়েছিলাম, সে এক হাস্যকর ব্যাপার। কদ্দিন পর সেই মিস্ত্রি যদিও সুইসাইড করে নেয়। প্রস্তাবনায় বেশি সময় নষ্ট করলে ইতি হবার আগেই ধৈর্য্যই ইতিহাস হয়ে যাবে। আমার লেখার অভ্যাস কোনো কালেই  নেই তাই কিভাবে শুরু করতে হয় জানি না। ওই ছুটকো ছাটকা খবরের কাগজের রবিবাসরীয় আর গোয়েন্দা গল্প-উপন্যাস থেকে যতটা জানা সম্ভব ততটাই জ্ঞান। আসলে ডিঙ্কির নাছোড়বান্দা মনোভাবের কারণে লিখতে বসেছি। আচ্ছা আমি নিজের পরিচয় থেকেই আমার বক্তব্যে আসি, আমি বাবিন। অফিসের খাতার একটি বড় নাম যদিও আছে তবে তা এখানে নিস্প্রয়োজন। আমি জীবনে কোনোদিনই ভাবিনি দশটা পাঁচটার অফিস ফেরৎ হয়ে, সময় বের করে লেখার মত কোনো দুঃসাহসিক অভিযানে নামতে হবে। প্রথমেই জানিয়ে রাখি এটার দু’টো অংশ আছে প্রথমটা আমার আর দ্বিতীয়টা ডিঙ্কির, সবটা ক্রমশ প্রকাশ্য।

প্রথমার্ধ

যেটার জন্য আমার লিখতে বসা সেই কারণটার, দুপুরের গনগনে আঁচের মধ্যে আপনাদের নিয়ে আসা দরকার। আমি বেসরকারি স্কুলের ভূগোলের টিচার। ষ্টুডেন্ট হিসাবে নেহাৎ মন্দ নই, আসলে আপনারা তো জানেন আজকাল সরকারি স্কুলের চাকরির কী অবস্থা, ধূ-ধূ মরুভুমি। আর যারা চাকরী পান তারা এতটাই বুদ্ধিমান যে রিক্রুমেন্ট লেটার আসার আগেই তারা জেনে যান তারা চাকরি পেয়েছেন। বেশি সম-আলোচনায় না এসে কেন লেখার প্রয়োজনীয়তা সেই ঝাপসা দিকটা স্পষ্ট করা দরকার। একে কী বলব আমি নিজেই জানি না।

আমি তখন জাষ্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছি দুচোখ ভরা অনিশ্চয়তার দুঃস্বপ্ন। বাড়িতে প্রতিদিনের শব্দবান নিক্ষেপ, হজম করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সকালে বেরোই, কিছু ট্যুইশন করি, তারপর আড্ডা দিয়ে রাত দশটা সাড়ে দশটায় বাড়ি ফেরা। মাঝে অবশ্য একবার ভাত খেতে যেটুকু সময়ের অপচয় হয়। বাবা রাধানাথ দাস স্কুলের হেডটিচার, ফিজিক্সে গোল্ড মেডেলিষ্ট, প্রাপ্তন রিসার্চ স্কলার ছিলেন। বছর চারেক আগে রিটায়ার করেছেন। ফলত একথা স্পষ্ট অনুমেয় যে, আমার প্রতি বাবার দৃষ্টিভঙ্গি কী রূপ। আমাদের অবস্থা খারাপ নয়। পেনশনের যেটুক টাকা আসে তা নেহাৎই কম নয়। যদিও আজকাল যা সংসার খরচ, তাই খুব যে রয়ে বসে চলে তা নয়, তবে চলে যায়। বাবা রিটায়ারমেন্টের পর বাড়িটাকে নিজের স্কুল বানিয়ে ফেলেছে – সারাদিন আমার বেকারত্বের জ্বালায় করাঘাত করে যাচ্ছে। এহেন গৃহ থেকে বনবাস নেওয়া অনেক ভালো। আচ্ছা আপনারাই বলুন চাকরীর নিয়োগপত্র না পেলে কোথা থেকে করব। শুধু চাকরি নয় সরকারী চাকরী, যা না পেলে জন্মই বৃথা। কোনও মতে এক বন্ধুর সহায়তায় কোনোক্রমে একটা বেসরকারী স্কুলে টিচার হিসাবে যোগদান করি। বেশ কদিন বেশ ভালোই কাটছিল, কথায় আছে অভাগার বেশি সুখ সহ্য হয় না। হঠাৎ বাবা একদিন স্কুল থেকে ফেরার পর আমায় ডাকলেন আর বললেন, “বাবিন তোমার মা আর আমার উভয়ের ইচ্ছা তোমার বিয়ে দেবার। এ বিষয়ে তোমার কী মন্তব্য?” আমি ঠাউর করতে পারলাম না এই রকম গরম আবহাওয়াতে কী করা উচিত। এক কথায় নিজের চালিকা যন্ত্র ক্ষণিকে বিকল হয়ে গেল। এই প্রশ্নের উত্তর, এককথায় প্রকাশ, নাকি একটু গুছিয়ে বলা উচিত কিছু বুঝে না উঠতে পেরে বললাম, “যেটা ভালো বুঝবে।”।

আজকের দিনটা একটু অন্যরকম। অনেকদিন পর এত সুন্দর একটা সকাল। এক্কেবারে একটা ঝলমলে সকাল। স্কুলে যাওয়া কিংবা ছাত্র পড়ানো কিছুই নেই। অনেকদিন সোশ্যাল মিডিয়া দিয়ে ঘুরে আসা হয়নি। অন করতেই অবাধ বিচরণ না করার ছাপ এক্কেবারে স্পষ্ট। অনেক রিকুয়েষ্ট পেন্ডিং পরে রয়েছে, দেখি চেনা কেউ আছে নাকি। এই তো আমার ইস্কুলের বাংলার চিটার প্রলয় বাবু, না আপনারা ঠিকই পড়ছেন। আসলে ধার থেকে শুরু করে টাকা ফেরৎ না করা কিংবা ‘এই একটু পর দিয়ে যাচ্ছি’ বলে মাল হজম করে দেওয়া ইত্যাদি নিত্য দিনের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে এনার। এই তো কদিন আগে আমার কাছ থেকে হাজার চারেক টাকা নিয়ে “এই দিয়ে যাচ্ছি” বলে প্রতিদিনই আমাকে দিয়েই যাচ্ছেন। মোটের উপর পুরো দস্তুর চামার। ভাবছি অ্যাকসেপ্ট করব কিনা, না করেই দিই। আরও অনেকে পাঠিয়েছে, এই তো মেজো মামার মেয়ে কত বড় হয়ে গিয়েছে। দেখতে দেখতে হঠাৎ পলক জুড়ে একটা ছবি, মনকে প্রশান্তি দিল। অনেকে পাঠিয়েছে কিন্তু মায়া আছে এই মুখটার মধ্যে। সুন্দর মুখ, গায়ের রং ফরসা, খুব যে মোটা তা নয়। সব সময় ছবিতে যে মানুষটাকে দেখছি সেই মানুষটাই যে সামনে একই লাগবে এমনটা নাও হতে পারে, আজকাল তো কত সব নতুন অ্যাপ বেরিয়েছে, শুধু মুখের পরিবর্তন নয় ছেলে থেকে মেয়ে তৈরী হয়ে যাচ্ছে ক্ষণিকের মধ্যেই। তাই এইসব বিষয়গুলো আমল না দেওয়াই উচিত। তাছাড়া আমি এত ভাবছি কেন? আমি বেশ কিছুক্ষণ আমার পুরনো নতুন উভয় বন্ধুদের সাথে কথা বলে ক্লান্ত হয়ে ফোনটি পাশে রাখলাম। কিন্তু আমার মাথায় শুধু একটা মুখই ভেসে আসছে, কেন? অ্যাক্সেপ্ট করব কি না ভাবছি? একবার মনে হচ্ছে করব? নাকি করব না। অ্যাক্সেপ্ট করেই নিলাম মায়ের নাম করে। কত বন্ধুই আছে, সবাই কি চেনা? নাকি সবার সাথে কথা হয়? আর যদি কথা বলতেই আসে তাহলে দেখা যাবে। নাঃ, বেলা দু’টো হয়ে গেল, এবার স্নান খাওয়া না করলে হিটলার আবার চিৎকার করবে। আজ ভাবছি পুরানো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যাব। এতদিন পকেট পুরো ফুটো থাকার সুবাদে যাই ইনকাম করতাম তাই বেড়িয়ে কোথায় যে যেত খুঁজে পেতাম না। এখন আগের মত অতটা বেহাল অবস্থা নেই, তাছাড়া আমি সেই মানুষদের মত নই যারা বাবার টাকায় ফুটানি মারে।

ঘুমটা ভাঙল কোলাহলে, বাবাকে বারণ করেছিলাম এই ভরা বাজারের মধ্য বাড়িটা করোনা, এবার ঠেলা বোঝো, একটা কথা যদি শোনে।এই ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাদেবী কখন যে চোখের উপর এসেছে বঝতে পারিনি। তখনি বোঝা গেল যখন শোরগোল ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে গবেষণা করতে লাগলাম, বাজারের দামাদামি নিয়ে কিছু হয়েছে? না সেটা নয়, তাহলে কি অ্যাক্সিডেন্ট? মনে পড়ল কদ্দিন আগেই একটা কুকুর চাপা পড়েছিল। যদিও মারা যায়নি তবে চালকের মারা যাবার উপক্রম হয়ে গিয়েছিল। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। সামনের বাড়ির রিমি তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেল না তো? বেশ কিছু দিন আগে একটা শোরগোল শোনা গিয়েছিল, যাই দেখি। উঠে গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার মাথা সত্যিই কাজ করা বন্ধ করে দিল। যা দেখি তাতে আমি বাকরুদ্ধ। রিমি শুয়ে আছে তার মা অঝোরে কাঁদছে। অনেকক্ষণ তার লাশের দিকে তাকিয়েছিলাম। কতক্ষণ জানি না।

রিমি আর নেই। তদন্ত চলছে, কী হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

আজ প্রায় এক সপ্তাহ হল জোর পুর্বক কাজে মন দেওয়ার রিসার্চ চলছে। অনেক খানি সফল, আজ পরীক্ষার খাতাগুলো শেষ করে ফেলতে হবে। রাতের খাবার খেয়ে কি মনে হতে একটু ফেসবুকটা খুললাম, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ম্যাসেঞ্জারে এস.এম.এস। একপ্রকার গা এলিয়ে ছাড়তে যাচ্ছিলাম হঠাৎ কী মনে হতে দেখতেই চোখে পড়ল ডিঙ্কি রায়, আরে এ তো সেই যাকে দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে গ্রহণ করলাম। মেসেজের বিবরণ নিচে দিয়ে দিলাম। এবার মনে হচ্ছে পাঠকদের আমার নামটা বলার সময় এসেছে। আমার নাম জ্যোতিন্ময় দাস। যাই হোক লেখার খুব সংক্ষেপে বর্ণনা করছি

ডিঙ্কি- হাই

আমি- বলুন

এরপর বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা, হঠাৎ কিছুক্ষণ পরে বাইরে গোলযোগ শোনা গেল। বারান্দা দিয়ে উঁকি মারতেই দেখি একদল সার্জেন্ট রিমির কাকাকে কিছু একটা বোঝাচ্ছে, আমার বেশ ভয় হতে লাগল – কেন ভয় লাগল! অনেকক্ষণ বারান্দা দিয়ে কথোপকথন শুনে, জানালা বন্ধ করে দিয়ে আবার বিছানায় ফিরে দেখলাম ততক্ষণে বেশ কিছু এস এম এস এসেছে।

ডিঙ্কি, “আপনার বাড়ি রিমিদের পাড়ায় না?”

আমি, “হ্যাঁ, কিন্তু আমায় চিনলেন কী করে? মানে আমি তো …..ঠিক …..”।

ডিঙ্কি, “আমি রিমির ভালো বন্ধু। অনেকবার বাড়িতেও গিয়েছি তখনই আপনাকে দেখেছিলাম, আসলে যেদিন মারা যায় সেই দিন সকালে কথা হয়েছিল …।”

আমার বুকের ভিতরে ঢেউগুলো যেন আছাড় খাচ্ছিল। রাতে ঘুম আসছে না, বালিশ নিয়ে এপাশ ওপাশ করছি, মাথার মধ্য প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। কখন যে ঘুম ভেঙেছিল বলতে পারব না, বেশ কিছুদিন ভয় মাখানো চিন্তা মাথায় ঘুরত। আর রাত হলেই রিমিকে আমি দেখতাম, একদিন স্বপ্ন দেখেছিলাম রিমি আমাকে কিছু বলতে চাইছে। আমার কাছে সাহায্য চাইছে। আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ ওর বয়ফ্রেন্ডের দিকে। হয়ত ওর সাথে ঝামেলা হয়েছে, রাগারাগিতে আত্মহত্যা করেছে। এই ঘটনায় বাবা সবচেয়ে বেশী দুঃখ পেয়েছে কারণ রিমি বাবার কাছে পড়তে আসত।

প্রায় দু’মাস পর্যন্ত রিমির স্মৃতি আমাকে পীড়ন দিয়েছে। এখন অবশ্য স্থিতিশীল। এই অবস্থা থেকে বের করতে ডিঙ্কি অনেকটা সাহায্য করেছে। মেয়েটা এত সুন্দর রবীসংগীত গায়। বেশ কিছু রবীন্দ্রসংগীত সংকলন কিনে নিয়েছি। আমার প্রতিদিনের কাজ মিটিয়ে, দিনের ঝক্কি মিটিয়ে গানালাপ হয়। গানালাপ বলাটা ঠিক হবে নাকি জানি না। কারণ ডিঙ্কি অধিকাংশ সময়ে গান গায়। আমায় একবার গাইতে বলেছিল, গেয়েছিলাম তারপর আমায় সাবাশি দিয়ে বলেছিল চেষ্টা করো ঠিক হবে। ডিঙ্কির সাহিত্যের পান্ডিত্য বা রবীন্দ্রসংগীতের সুরেলা কন্ঠ যারই প্রশংসা করা হবে তাই কম। আমাদের প্রায় অনেক সময় ধরে একে অপরের সাথে বাক্য বিনিময় হত। কখন যেন দিনের কাজের মাঝে রাতের অপেক্ষায় থাকতাম, স্কুলের কাজে মন একপ্রকার জোর করেই দিতাম।

ডিঙ্কির সাথে পরিচয়ের আজ প্রায় মাস ছয় হল, কথার মিষ্টতা কী স্মার্টনেস সব কিছু মিলিয়ে মনকে শান্তি দেয়। আমি অনেকবার ডিঙ্কিকে সামনা সামনি দেখতে চেয়েছি, যখনি বলেছি, “একদিন কোনো কফিশপ এ কি দেখা করা যেতে পারে না?” প্রতিবারেই নিময় মাফিক একটাই উত্তর, প্রথমে একটা ভুবন মোহিনী হাসি, তারপর ভয়েসে, “সময় হলে ঠিক দেখা করব।” কথায় আছে নারীদের চেনা বড় জটিল। আমি আপনাদের একটা কথা চুপি চুপি বলি আমি প্রতিদিন রাতে আমার পাশবালিশকে ডিঙ্কি ভেবে জড়িয়ে ধরে শুয়েছি। ওর সামনে তো এই কথাগুলো বলা যায় না তাই আপনাদের জানিয়ে রাখলাম।

আজকে বাবা আবার একবার হুকুম জারি করেছে, “যদি কোনো মেয়েকে ভালোটালো বাসো আমায় বলো”। না হলে এটাও বলেছে তাঁর পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে। বলতে তো চেয়েছি, “বাবা আমি ভালোবাসি, কিন্তু আমি জানি না সে আমায় ভালোবাসে কিনা!” আমি ভালোই বুঝতে পেরেছি ডিঙ্কির সাথে কথা বলার পর খারাপ মনও সতেজ হয়ে যায়। কতই ছোটো হবে বছর তিন চারেক? আজকে ভাবছি একবার বলে দেখব, বলব, “ডিঙ্কি জানো আজ বাবা জিজ্ঞেস করেছে আমার কোনো প্রেম আছে নাকি?” তখন দেখা যাবে তার উত্তর কী হবে। কিন্তু কী করে বোঝা যাবে আমার সম্পর্কে ওর ধারণা কী? হয়ত তেমন কিছু ভাবে না। তাছাড়া ওই রকম স্মার্ট মেয়ের পিছনে প্রচুর ছেলে, খামোখা আমার মত সাধারণ ছেলেকে পাত্তা দেবে কেন? একবার বলেই দেখি না, না মরে ভূত হয়ে তো লাভ নেই, কিন্তু কী বলব? এই সমস্ত ভাবতে ভাবতে নিদ্রাদেবী কখন যে আমায় আক্রমণ করেছে তা বুঝলাম সকাল ছটা দশে, ঘুম ভেঙে উঠে। এত সকালে আমার ঘুম কোনোকালেই ভাঙে না, বুঝতে বাকি রইল না এটা কাল রাতের নিদ্রাদেবীর হঠাৎ আক্রমণের ফলাফল।

ঘুম থেকে উঠে যে কথাটা আমার প্রথম মনে এল তা হল আজ যেমন করে হোক বলতেই হবে ওকে যে সে পছন্দ করে। কিন্তু বাড়ির মধ্য সকাল সকাল এত কলরব কেন? বাইরে বেরোতে যাব অমনি নিজের বস্ত্র আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কোনো রকমে জামা পরে ঘরের বাইরে বেরুতে যাব হঠাৎ চোখ আটকে গেল দেখি বাবা মা তার সাথে মৃন্ময়কাকু আর মিতা কাকি। বাবার ডাকে সমস্ত কৌতুহলের নিঃশেষ হল। “এদিকে এসো”। বাবার কথায় এগিয়ে এসে দেখলাম মৃন্ময়কাকুর মেয়ে অঙ্কিতা, আমার ছোটোবেলার খেলার বন্ধু এসেছে। মৃন্ময়কাকু বাবার কলিগ। কাকু সেই সূত্র ধরে আমাদের বাড়িতে প্রায় আসত। বাবার দাবা খেলার বন্ধু ছিল এই মৃন্ময়কাকু, কলেজ লাইফে দারুন ফুটবল প্লেয়ার ছিল, সে অন্য গল্প৷ মিতা কাকিমা – মানে মৃন্ময়কাকুর বউ – তার সাথে মায়ের সম্পর্ক ভীষন ভালো। আর ছোটো বেলায় এই অঙ্কিতা ছিল মহা পাজি। খেলায় হেরে গেলই খেলা ভেস্তে দিত, কাঁদত। একবার তো আমার সামনে প্যান্ট খুলে গিয়েছিল, সেই দেখে আমি খুব হেসেছিলাম বলে সজোরে বোতল ছুঁড়ে মেরেছিল। এখন কত বড় হয়ে গিয়েছে আর মনে হয় কাঁদে না। এই কথা সেই কথা ভাবছিলাম –  বাবা যে কতবার ডেকেছে বুঝিনি। হঠাৎ সম্বিত ফিরল মায়ের কথায়, “মিতা এখনি শুভদৃষ্টিটা সেরে ফেলছে ।” কী বলল আরেকবার জিজ্ঞেস করতে যেটা কল্পনা করতে পারিনি সেটাই শুনতে হল – বলল, “বাবা আর মৃন্ময়কাকু দু’জনের ইচ্ছা তোমার সাথে অঙ্কিতার বিয়ে হোক!” মায়ের এই অপ্রত্যাশিত শব্দবান আমায় ধরাশায়ী করে তুলেছিল। কয়েক মুহুর্ত আমার বাকযন্ত্র বিকল হয়ে গিয়েছিল, আমার মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু ডিঙ্কির ছবি। গল্প তখন তুঙ্গে, এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত তা স্থির করতে না পেরে আমি বললাম, “এই নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে মা, এখনও তো বিয়ে করার জন্য মনকে তৈরী করিনি”। মৃন্ময়কাকু হঠাৎ বলল, “অবশ্যই। আসলে কী বলতো, বিয়ে তো একটা সময়ে সব মানুষকে করতেই হয়। আর তাছাড়া তুমি আসার আগে আমি তোমার বাবার সাথে সেই বিষয় কথা বলছিলাম যে, দু’জনের মধ্য এত বন্ধুত্ব ছিল যে, একসাথে খাওয়া, ঘুমানো এমনকি আমাদের ছাড়াই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটাতে। সেই বন্ধুত্ব, জীবনের বন্ধুর পথ দু’জন চলার প্রথম বুদ্ধিটা আমার মাথায় আসে, আমি মনে মনে ভাবলাম, আর তোমার বাবা রাধাকে বললাম, রাধাও রাজি। তুমি হয়ত ঠিকই বলছো।”

আরে কবে কী হয়েছে তার জন্য আজ কেন সাফারার হব, উফ্‌!

মৃন্ময়কাকুকে কিছু একটা বলতে যাব হঠাৎ অঙ্কিতা এবার মুখ খুলল। বলল, “বাবিনদা আমার অসুবিধা নেই, তুমি ভেবে চিন্তে বলো।” বাবা হঠাৎ করে বলে উঠল, “বাবিন আমার কথার অবাধ্য হয় না, তাছাড়া ওর জীবনে যে অন্য কেউ নেই তা আমি ভালোই জানি। থাকলে বলে দিত।” ওদের আলোচনা কতক্ষণ চলবে কে জানে? জয় মা বলে স্কুলে বেরিয়ে পরতে পারলে বাচা যায়। বাড়ি ফিরে বাবার কড়া সিদ্ধান্তের মুখে পড়তে হল, স্পষ্ট জানিয়েছে, “ওই মেয়ে কে বিয়ে করতে হবে।”

আজ রাতে ডিঙ্কিকে বলে দেব তাকে ছাড়া প্রতি মুহুর্ত পীড়াদায়ক। তাকে এটাও বলে দেব তার যদি কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে বিয়ে করতে আমরা রাজি। কিন্তু এখনো অনলাইন হয়নি কেন? এই রাত যেন কাটতেই চাইছে না।

অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটল। অন হতেই আমিই নিজে থেকে এই রূপ বার্তা পাঠালাম, “আমি জানি না কথাটা বলা ঠিক হবে নাকি। আমি এও জানি আজকের পর থেকে হয়ত তুমি আমার সাথে কথা বলবে না, আবার ব্লকটাও করে দিতে পারো। তবে কথাটা না বললে অসম্পূর্ন থেকে যাবে। যদিও কথাটা সামনাসামনি বলার প্রয়োজন ছিল কিন্তু শত রিকুয়েষ্ট করার পরেও দেখা যখন করলে না তখন বলতে বাধ্য হচ্ছি তুমি আমার সাথে কম কথা বলো। কারণ বাবা বাড়ি থেকে মেয়ে পছন্দ করে দিয়েছে, তবে আমরা খুব ভালো বন্ধু হিসাবে থাকতে পারি।”

আপনারা বলুন আমি যে মেয়েকে কোনোদিন দেখিনি, না জানি তার স্বভাব, কেমন করে তার সাথে সংসার করব? আজ দুপুর বেলা আমি ভেবে এটাই স্থির করলাম, সব সময় বড় বিষয়কে বিচার করতে হয় বুদ্ধি দিয়ে। আবেগে মানুষ বোকা হয়, যেমন রিমির অবস্থা হয়েছে। এই সব কথা ভাবতে ভাবতে “কনগ্রাচুলেন্স” লিখে পাঠাল মনে হয় না আর কোনো এস এম এস পাঠাবে। কাল সকালে বাবাকে জানিয়ে দেব এই বিয়েতে রাজী।

সামনের মার্চ মাসে আমাদের বিয়ে। প্রত্যেকের জীবনের প্রথম পর্যায়ে একটা ভালোবাসা থাকে কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্রমশ ম্লান হয়ে যায়। আমি সেই বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি। শুধু একদিন বলেছিল, “ও আমার পাষ্ট।”ব্যাস এইটুকুই। আমাদের প্রেম জমে উঠল। না ও কিন্তু গান জানে না, সাহিত্যে-টাহিত্যে ডিঙ্কির মত অত জ্ঞান নেই। কখন যে ডিঙ্কির বিষয়টা মাথা থেকে বের করে দিয়েছি তা মনটাই জানে, বড় চঞ্চল। আমি যদিও ডিঙ্কির সমস্ত কথা বলি। শুনে সে হেসে বলেছিল, “সুইট হার্ট সোশ্যাল মিডিয়াতে কী করে প্রেম হয় বুঝি না।” আমাদের ভালোবাসা পরিবার কর্তৃক ক্রমে পরিচালিত হতে থাকল।

বিয়ের পর প্রথম একবছর মধুচন্দ্রিমার মত কেটেছিল, সমস্যা শুরু হল একবছর পর থেকে। আজ কাল অঙ্কিতাকে কেমন যেন অচেনা লাগছে। অঙ্কিতার ব্যবহারে খুব পরিবর্তন ঘটেছে। গোটা দিন ফোনে ব্যস্ত, বাড়িতে অর্ধেক সময়ে থাকে না। আমি স্কুল থেকে যখনই আসি তখনই অঙ্কিতা হয় ফোন নিয়ে ব্যস্ত, না হলে বাইরে। অসহ্য জীবন যন্ত্রণা ক্রমে অসহ্যনীয় হয়ে উঠেছে, ছেদ পড়েছে দাম্পত্য জীবনেও। কলহ, অর্ন্তদ্বন্দ ওসব আজ কাল আর হয় না। কাছাকাছি দুজন থাকলে একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরী হয়। এককথায় সংসার দু’জনের কাছে চার দেওয়ালের জেলখানায় পরিণত হয়েছে। অঙ্কিতার কি হয় জানি না তবে, আমি যখন বাড়ির বাইরে থাকি তখন সবচেয়ে ভালো থাকি, আশা করি অঙ্কিতার ক্ষেত্রে একই অবস্থা।

আমি একপ্রকার নিশ্চিত অঙ্কিতা বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্কে জড়িত হয়েছে। বাড়ি থেকে বেরোয় তখন লিপষ্টিক, কাজল পরে বেরোয়। কালো রঙটা অঙ্কিতার বরাবরই প্রিয় তাই প্রিয়তমর সাথে দেখা করার সময় কালো শাড়ি পরে যায়। বেশ কিছুদিন আগে স্কুলের পঞ্চানন স্যার অঙ্কিতার সাথে জনৈক ব্যক্তির ঘোরার মত বড় খবর মুখরোচক করে পেশ করেছে। অপমানিত করার সুযোগ কী কেউ ছাড়ে। বিশ্বাস করুন, আমি জানি আজ কাল একটি ছেলের সাথে প্রায় ঘুরতে দেখা যায়। কিন্তু কোনোদিন বলতে পারিনি, হয়তো আমি আজও অঙ্কিতার প্রতি দুর্বল, যখনই কাছে যেতে চেয়েছি তখনই নানা রকম গালাগাল করে বের করে দিয়েছে।

কতবার জিজ্ঞেস করেছি, “আচ্ছা অঙ্কিতা আমার সমস্যাটা কী একটু বলবে?”

সর্বক্ষেত্রে একটাই কথা আমি একজন খারাপ মানুষ। জানি না কী খারাপ করলাম। প্রয়োজনের অধিক ভালোবাসাটা খারাপ মানুষের লক্ষণ নাকি? তবে যদি সেটা হয় তবে হ্যাঁ, আমি খারাপ।

বহুদিন চেষ্টা করেছি অঙ্কিতার মতিগতি ফেরাতে, কিন্তু না কোনো লাভ হল না। একটা মানুষের এতটা পরিবর্তন, জানি না এর শেষ কোথায়। পাড়া প্রতিবেশীর কাছে মুখ দেখানো দায় হয়েছে। আমি যেখানে থাকি জায়গাটা মফঃস্বল, তাই এই ঘটনা পাঁচ কান হতে বেশি দেরি হয় না।

আজ ১৫ই আগষ্ট। আজ সকাল থেকে অঙ্কিতাকে সম্পূর্ন অন্যরকম লাগল যেন পুরনো সূর্য নতুন ভাবে উঠেছে। এই তো আমার সেই একবছর আগের মানুষটি। হঠাৎ আমায় বলল, “আমি একটা মস্ত ভুল করেছি সেটা আমায় শুধরে নিতে হবে।” খুব মায়া হল, সত্যিই তো ভুল মানুষ করে। ক্ষমা পরম ধর্ম। আমাদের প্ল্যান হল আজ একবার বের হব, আমার সাথে বেশ কিছু কথা আছে। তারপর ডিনার করতে যাব। বলেছে বিরিয়ানি খাবে। না আজ হয়তো সমস্ত ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে। এই সব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি।

ঘুম ভাঙল একটা ফোন কলে। “হ্যালো” বলতেই ওপার থেকে একজন বললেন, “আপনি অঙ্কিতাদির হ্যাজব্যান্ড বলছেন? আমি থানা থেকে বড়বাবু প্রতাপ বলছি। আপনার ওয়াইফ খুন হয়েছেন আপনি আসুন।”

বিশ্বাস করুন আমি প্রথম দফায় কী হচ্ছে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছিলাম। তারপর কী করছি, কেন করছি কিছুই সম্বিত ছিল না। রোবটের মত কেমন যেন নিজের অজান্তে কাজ করছি।

সম্বিত ফিরল, দেখলাম মৃ্ন্ময় কাকু আর তার স্ত্রী কাঁদছে, পাশে বাবা মা সান্ত্বনা দিচ্ছে। তাদেরও অবস্থা শোচনীয়। আবছাভাবে শোনা গেল কাকিমা নাকি দু’বার অজ্ঞান হয়েছে। কাকু কাকিমা বলেছে, আমি নাকি দায়ী। তাদের বয়ান অনুযায়ী, আমার উপর জেরার পর জেরা শুরু হল। আপনারা তো জানেন তাদের জেরা কেমন, ঠিক একটা সময় পর আপনিই ভাবতে শুরু করবেন আপনিই নিজেই খুনি।

সমস্ত ঘটনা জানাল একজন কনস্টেবল। সে যে কথা বলল, তার অর্থ এই যে অঙ্কিতা রাস্তায় যেতে যেতে হঠাৎ করে পড়ে যায়, লোকাল কিছু মানুষ হাসপাতালে নিয়ে আসে, সেখানে ডাক্তার জানায় সে মারা গিয়েছে এবং নিজেই পুলিশকে ইনফর্ম করে প্রাথমিক ভাবে মৃত্যুর কারণ বিষ খাওয়া। এতদিন শুধু বিভিন্ন সিনেমায় দেখে এসেছি কবে বিয়ে খাওয়া হয়েছে, কতদিন চেনা পরিচিত, সম্পর্ক কেমন, কোন বিবাহ বর্হিভুত সম্পর্ক ছিল কী না ইত্যাদি। আমি যথারীতি যথা সম্ভব সমস্ত উত্তর দিয়ে চুপ করে আছি আর ভাবছি ঈশ্বর কেন এই শাস্তি দিল। বিশ্বাস করবেন না আপনারা আমার সেই সময় ইচ্ছা করছিল সব ছেড়ে ছুড়ে পালাই। হঠাৎ বড়বাবু তার বাজখাঁই গলায় বললেন, “যতদিন না কেস উঠছে ততদিন শহর ছেড়ে কোথাও না যাওয়া হয়। আর এই কেসটা হ্যান্ডেল করবে তিলোত্তমা রায়। আমি একমনে আমার অঙ্কিতার সাথে কাটানো সময়গুলো নিয়ে ভাবছি হঠাৎ তিলোত্তমা রায় আমার সামনে এসে হাজির হল, বুঝতে অসুবিধা হল না, এই সেই মুখ যাকে আগে থেকেই চিনতাম ডিঙ্কি বলে। কথা বলব, কিন্তু কী বলব বুঝলাম না। ডিঙ্কি তিলোত্তমা রায় হবার সাথে সাথে স্বভাবের পরিবর্তন ঘটেছে। সেই জানাল অঙ্কিতার দেহ এখন ছাড়বে না, পোষ্টমর্টেম হবে।

আজ এক সপ্তাহ হল অঙ্কিতা মার্ডার কেসের কোনো সুরাহা হয়নি। পোষ্টমর্টেমের রিপোর্ট এসেছে। মৃন্ময়কাকু আমার নামে বধূ হত্যার কেস দিয়েছে। আমি এখন বেলে ছাড়া পেয়েছি। অঙ্কিতার মামা একজন নেতা প্রভাব খাটিয়ে তার খুনিকে ধরার জন্য প্রশাসনের উপর চাপ দিচ্ছে। চাপ বাড়তে বাড়তে ডিঙ্কির ঘাড়ে এসে পড়েছে। মনে হচ্ছিল মার্ডারের মত পাপের বোঝা ঘাড়ে নেওয়ার থেকে মরে যাওয়া ভালো ছিল। এই সব ছাইপাঁশ ভাবছিলাম হঠাৎ একটা কল এল। কন্ঠস্বর জানান দিল এটা ডিঙ্কি – সরি পুলিশ বিভাগের বড় অফিসার তিলোত্তমা। আমি কথা বলে যা বুঝলাম, ও চাইছে যাতে আমি ইনভেষ্টিগেশনে এ হেল্প করি তাতে নাকি ওর চাকরি থাকবে। আর আমি যদি খুন না করে থাকি তাহলে মিথ্যা মামলা থেকে বাচতে পারি। অবশেষে তার প্রস্তাবে রাজী হলাম। ঠিক হল কাল সকালে আমার বাড়ি এসে সার্চ করবে। তারপর আমি ডিঙ্কির সাথে অঙ্কিতার বাড়ি যাব। আর বেশি কথা না বলে শুধু একটাই কথা বলল এটা যেন পাঁচকান না হয়।

সকালে ঘুমের মধ্যই কল এল বুঝতে অসুবিধা হল না এটা কার কল। আমাকে রেডি হতে বলল। যথারীতি আমার ঘর আরও কিছু আসবাবপত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা চলল। অবশেষে অঙ্কিতার বাড়ি যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। বাড়ির সামনে আমায় দাঁড় করিয়ে তিলোত্তমা ম্যাম বাড়ি সার্চ করতে চলে গেলেন। আমায় বাড়ি নামানোর পথে রিমিদের বাড়িতে একবার ঢুকল। বাড়ি ঢুকে দেখি পঞ্চাননবাবু বেশ আনন্দের সাথে শোক জ্ঞাপন করতে এসেছেন। কিছু পেলেই কাল সকালে স্কুলের খাস খবর হয়ে যাবে। অনেকক্ষণ ইতস্তত করার পর বললেন, “হেডস্যার কদ্দিন ছুটি দিয়েছে, কেস মিটলে আবার জয়েন করবে।” বুঝতে বাকি রইল না কেন আমার প্রতি এত দয়া।

যারা এতক্ষন আমার ঘটনাটা পড়লেন তাদের জানাই আমাকে সময় কাটানোর জন্য ডিঙ্কি এই জীবনস্মৃতি গড়ার উপদেশটা দিয়েছিল। আসলে স্কুল বন্ধ ট্যুইশনগুলোও আর নেই একরকম উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম। ডিঙ্কিই বলল লিখলে নাকি সময় কাটবে তাই একপ্রকার এই অনধিকার চর্চা বেশ কদিন করলাম। কাল থেকে আমি স্কুল জয়েন করছি। আমি এতদূর লিখলাম এবার কী করে এই কেস মীমাংসা হল সেই ঘটনা ডিঙ্কি সরি তিলোত্তমা জানাবে। আর পাঠকদের আরেকবার মনে করিয়ে দি আমার নাম জ্যোতিন্ময় দাস।

সমাপ্তি

আমার প্রথম দিন থেকেই মনে হয়েছে এই কেসটা কোনো সাধারণ কেস নয়, খুব গভীর ষড়যন্ত্র আছে। উপর মহল থেকে চাপ, বাধ্য করে ব্রেন খাটাতে। প্রথমে মনে হয় অঙ্কিতার এক্সের সম্পর্কে খোঁজনি। জানতে পারি পাঁচ বছর ধরে আমেরিকায়। তার কোনো পাত্তা নেই। যেদিন খুন হয় সেই দিন কোনোভাবেই আমেরিকার বাইরে যায়নি। তাহলে বোঝা গেল ডিরেক্ট কোনও সম্পর্ক নেই, লোক দিয়ে মারলে অন্য ব্যাপার। কিন্তু মোটিভ কি? বদলা নাকি বিবাহ বহির্ভূত নতুন কোনো সম্পর্ক। সব নিয়ে স্থির করলাম কাল আর একবার মৃত্যুর স্পটটা দেখতে হবে। মনে হচ্ছে আমি তলানিতে যেতে পারিনি। কোনও ক্লু পাবার অপেক্ষায় অঙ্কিতার ফোন এই নিয়ে দশ বার চেক করলাম, কিছুই পাওয়া গেলো না। শুধু তার হাজব্যান্ডের ফোন ছাড়া। আমার মন বলছে জ্যোতিন্ময়ই খুনী। এই-সেই ভাবতে ভাবতে কখন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছি কে জানে।

সকালের এলার্মে আমার ঘুম ভাঙল, উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে চটপট বেরিয়ে পড়লাম যেখানে অ্যাক্সিডেট হয়েছে। সেখানে লোকাল দোকানদাররা যা বলল, সব জানা, নতুন কিছু নয়। তারপর হাসপাতালে যে ডাক্তার পোস্টমর্টেম করেছিলেন তিনি যা বললেন তাতে রহস্য আরও দানা বেঁধে গেল। ডাঃ রুদ্র বললেন, বডির পেটে খাবারের সাথে বিষ পাওয়া যায়নি, তারপর যে কথাটি শোনালেন আরও অবাক হলাম। অঙ্কিতাকে মারার জন্য পটাসিয়াম সাইনাইট্রডের ব্যবহার করা হয়েছে। একমাত্র সেই মারণ বিষ ল্যাবে মেলে।”

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “রিপোর্টে সেই বিষয়ে কেন কিছু উল্লেখ নেই।”

রুদ্র বললেন, “আমাদের কিছু প্রোটোকল মানতে হয়।”

যাবার আগে ডঃ রুদ্র বললেন, “সরকারি নির্দেশ ছাড়া কিন্তু এটা একপ্রকার অসম্ভব।” আমি জ্যোতিন্ময়ের কাছে হেল্প নিয়েছি এটা উপর মহল পর্যন্ত খবর চলে গেছে তারা ওয়ার্ন করেছে।

হঠাৎ মাথায় এল অঙ্কিতার পুরানো বন্ধুদের সাথে একবার কথা বলা প্রয়োজন – যদি তারা কিছু বলতে পারে। মৃন্ময় বাবু একটু কথা বলার মত অবস্থায় আছে। কিছু বন্ধুর অ্যাড্রেস নিয়ে, বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলাম। সেখান থেকে বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না।

জ্যোতিন্ময় বাবুর বাড়ি থেকে ফেরার সময় রিমির বাড়িতে একবার যেতে হবে। আসার সাথে সাথে কাকিমা মানে রিমির মা আমাকে রিমির ফোনটা দিল বলল, “দেখিস তো ডিঙ্কি, এখান থেকে ওই বয়ফ্রেন্ডকে ধরতে পারিস কিনা।”

জ্যোতিন্ময়ের খোঁজ খবর জানতে চাইলে আনমনা ভাবেই বলি, “অঙ্কিতা পটাসিয়াম সাইনাইটেডে মারা যায়।”

এ কথা বলার পরেই দেখি কাকিমার মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

আমি বললাম “কাকিমা ওটা একটা বিষ খুব খারাপ …”

কথা শেষ না হতেই রিমির মা একটু ভেবে বলে, “ওর বাবা এই বিষ খেয়েই তো মারা যায়। জানো, রিমির বাবা পেশায় রাজমিস্ত্রী ছিল। একবার ওঁর জিনিসপত্র চুরি হয়, তার কিছু কাল পরই দুঃখে মারা যায়। আমার পোড়া কপাল মেয়েটাও পালাল!” বলতে বলতে কেঁদে ফেলল।

আমি নিজেকে খুব সামলে বললাম, “কাকুর পুরানো কিছু জিনিস পত্র আছে?” পুরানো জিনিসপত্রের কিছু জিনিস ঘেঁটে দেখলাম, তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। সেই সময়ও আজকের মত এত পোষ্টমর্টেম ছিল কিন্তু সেটা অত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।

রিমির মা কী একটা বলল, আমি নিজের অজান্তে বলে উঠলাম, “যে দিন অঙ্কিতার বাবা মারা যায় তার আগের দিন কী হয়েছিল?”

রিমির মা বলল, “সেই সময় জ্যোতিন্ময়ের বাড়িটা দোতলা করছিল রিমির বাবা।” বলেই কেঁদে উঠল, “আমার কী কপাল মেয়েটাও অকালে চলে গেল।”

আমি শুধু পাখির চোখ করে ভাবছি জ্যোতিন্ময় বাবু কি বুদ্ধিটাই না খাটিয়েছে। এবার আমার মাথায় আসছে যেদিন সুইসাইড করে সেই দিন আমি দেখি রিমির হাতে একটা প্যাকেট ছিল। গায়ে কী লেখাছিল মনে করছি আর নিজের স্মৃতি শক্তিকে দোষারোপ করছি।

এবার আস্তে আস্তে জট খুলছে, কী সাংঘাতিক ব্যাপার রিমিদের বাড়ি থেকে বেরুবার সময় বাড়িটার দিকে একবার তাকালাম, ইচ্ছা করল জ্যোতিন্ময়কে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে জেলে পুরে দিই। কোনোমতে রাগ সম্বরণ করে থানার উদ্দেশে রওনা দিলাম। ফোনটা একবার দেখতে ইচ্ছা করল কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল না বাড়ি গিয়ে দেখব। হয়ত রিমির মা টাকার জন্য জ্যোতিন্ময় বাবুকে ফাঁসাতে চাইছেন। কোনো কিছুই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

রাতে বাড়ি গিয়ে ফোনটা চেক করতে করতে একটা বিষয় জানা গেল। একটা নম্বর থেকে প্রায় কল এসেছে। নাম্বারটা নোট করে কল সেন্টারে খবর দিলাম, ঘন্টা খানিক পর উত্তর এল, ‘এটা বাবিন বলে কোনো একজনের।’ বুঝতে অসুবিধা হল না অঙ্কিতার খুনি আর কেউ নয় জ্যোতিন্ময় রাস্কেল। নিজেকে ঘেন্না করতে শুরু করল। এই মানুষটার সরলতা দেখে একদিন ভালো লেগেছিল। কিন্তু এটা তো কোর্টে প্রমাণ করা চাপ, কিছু একটা অকাট্য প্রমাণ চাই।

আমার হাতের ফোনটা কখন পড়ে যায়।

‘একি এটা একটা চিপ না!’ কথায় আছে অপরাধী যতবড় হোক না কেন প্রমাণ ছেড়ে যায়। ভাবতে ভাবতে চিপটা ল্যাপটপে দিতেই ভেসে উঠল জ্যোতিন্ময়ের সাথে রিমির ছবি। বুঝতে অসুবিধা হল না মার্ডারের মোটিভ। জ্যোতিন্ময়ের আর রিমি এই ছবি দিয়ে কোনও কারণে ব্ল্যাক মেল করা হয়। রিমি লোকলজ্জায় সুইসাইড করে।

সেই ছবি অঙ্কিতার হাতে আসে। তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়। তারপর বিষ খাইয়ে খুন করে।

আর বাকি থাকল পটাসিয়াম সাইনাইটেড। ভুললে কী করে হবে জ্যোতিন্ময় ভুগোলের ষ্টুডেন্ট। প্র্যাক্টিকাল করার অজুহাতে ল্যাবে ঢুকে চুরি করাটা আশ্চর্যর। কিন্তু কোন পরীক্ষাগার থেকে পেল? এটা যে সে ব্যবহার করতে পারে না। কিন্তু কিছু জটিলতা আছে ওটা খুনি নিজেই বলবে। থানাতে ইনফর্ম করে দেওয়া আছে, কাল সকাল সকাল আসামীকে আনা হবে।

সকাল হতেই আমি বেশ কিছু কাজ সেরে আমার সমস্ত ফোর্স নিয়ে গেলাম আসামীকে গ্রেফতার করতে। জ্যোতিন্ময়বাবুকে ডেকে নিয়ে নিচে চলে এলাম।

এরপর জ্যোতিন্ময়ের বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনাকে তিনটি মার্ডার আর চুরির জন্য গ্রেফতার করা হল।”

আমি দেখলাম রাধানাথবাবু পাথরের মত দাঁড়িয়ে হকচকিয়ে বললেন, “আমি কি করলাম!”

“আমি বলব নাকি আপনি বলবেন? অঙ্কিতা কিন্তু সব লিখে গেছে। রিসার্চ সেন্টার থেকে চুরি, রিমির বাবাকে টাকায় বিষ দেওয়া। আপনি বলবেন নাকি আমি কষ্ট করব।”

মুহুর্তে রাধানাথ বাবু হিংস্র হয়ে বলতে শুরু করলেন, “আমিই সব খুন করেছি, রির্সাচ করতে করতে আমি বুঝতে পারি আমার মাসের হাতখরচা থেকে শুরু করে অসুস্থ বাবার চিকিৎসা কিছুই হচ্ছে না।তাই আমি এই মহামুল্যবান বিষ চুরি করার সিদ্ধান্ত নিই। পরে আমি বিভিন্ন ওষুধ আর দূর্মূল্য বিষ চুরি করে চোরাই বাজারে বিক্রি শুরু করি। টাকা বুঝেছ, টাকা দরকার, আর প্রচুর টাকাও কামিয়েছি। এই ভাবে আমার কাজ বেশ ভালো চলছিল। একসময় আমার লোভ বেড়ে যায়। যখন আমার রিসার্চ শেষ হয় সেখান থেকে মারণাস্ত্র পটাসিয়াম সাইনাইটেড কিছু অংশ নিয়ে আসি, বাগানে নির্দিষ্ট স্থানে পুঁতে রাখি। ঠিক কিছু বছর পরের কথা, বাড়ি দোতলা তৈরীর সময় হারু ওটা পায়, ছোটোলোকরা এটা ভালোই জানে লুকানো জিনিস মুল্যবান হয়। সেই বোধ ওর ছিল, ওর কাছে লুকিয়ে রাখে। একটা ফাইল বাড়ি রেখে দিয়ে ব্ল্যাক মেল করার জন্য একটা শিশি নিয়ে আসে। আমি দেখি আর টাকায় রফা হয়। আমায় চাপে ফেলে টাকার অঙ্ক ক্রমশ বাড়তে থাকে। ছোটোলোকটার মুখ বন্ধ করার জন্য দিলাম টাকাতে বিষ মিশিয়ে। আমি জানতাম থুতু দিয়ে টাকা গোনার অভ্যাস ছিল। প্যাকেটে এমন করে দিলাম যাতে বাড়িতে গিয়ে গোনে।

জানতাম রিমি জ্যোতিন্ময়কে পছন্দ করে। আমি অপেক্ষা করে থাকি কখন মেয়ে বড় হবে। শাপে বর হল রিমি জ্যোতিন্ময়কে পছন্দ করত। ছেলের সাথে বিয়ে দেব বলতেই লজ্জায় লাল হয়ে যেত। বলি বিয়ের জন্য একটা বাক্স খুঁজে দিতে হবে। এও বলি, তোর বাবা হারুকে ওটা আমি রাখতে দিয়েছিলাম। মেঘ না চাইতেই জল, সব বলে দিল। এতই ভালো মেয়ে আমি প্যাকেটটা দেখব বলতেই বলল, “বেশ স্যার।” কিন্তু মেয়ে আর খুঁজে পায় না। অবশেষে কিছুতেই যখন কাজ হল না। তখন বাবিনের সাথে ওই ছবিগুলো ছেড়ে দেব বলি। তাকে বাবিনের সাথে আপত্তিকর ছবিগুলো দেখাই। আমিই তুলেছিলাম একসেট ওকে দিয়েছিলাম ব্ল্যাকমেলের জন্য। কিন্তু সুইসাইড করবে জানতাম না।

অঙ্কিতার সাথে আমার শারিরীক সম্পর্ক ছিল, আমার চাহিদা মেটানোর জন্যই বাবিনের সাথে বিয়ে দিই। তার জন্য টাকাও আমার কাছ থেকে নিত, আমার কালো কাজ কারবারের সব খবরই ওর কাছে ছিল। একদিন জানায়, এই সব কাজ আর করবে না, সে প্রেগনেন্ট। বেশি টাকা না দিলে বাবিনকে সত্যি বলে দেবে। আর পুলিশকে খবর জানিয়ে আমাকে জেলে পুরবে। ভয় হল অঙ্কিতার লিপষ্টিকের সাথে মিশিয়ে দিলাম বিষ, আমি জানতাম অঙ্কিতা খুব ঘন ঘন লিপষ্টিক মাখে। তবে নিশ্চয়ই কিছু মস্ত ভুল করেছিলাম না হলে ধরা পড়তাম না।”

অনেকক্ষণ থেমে বলল, “ডাইরি কোথা থেকে পেলেন?”

দেখলাম সবাই নিশ্চুপ। রাধাকান্তবাবুর বউ কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “ভাগ্যিস এত লেখা পড়া শিখিনি।”

এবার আমি রাধাকান্তবাবুর উদ্দেশ্যে বললাম, “আমার হাতে কোনও ডাইরি নেই। আমার বেশ কিছু জায়গা খটকা লাগে যেমন ধরুন আপনার রিসার্চের পেপার চুরি করে মেডেল লাভ, যে সেন্টারে রিসার্চ করতেন সেখানে ওষুধের গরমিল, সব ঘটনার পটাসিয়াম সাইনাইটের যোগ, আপনার ছেলের ফোন থেকে রিমিকে ডাকা, আর সব শেষ আমার উপস্থিত বুদ্ধি। এবার চলুন অনেক হয়েছে।”

রাধানাথবাবু চুপ। জ্যোতিন্ময়ের উদ্দেশ্যে বলে, “আমার মৃত্যুর পর, আশা করি টাকাগুলো ব্যবহার করবে।”

রাগে ঘেন্নায় জ্যোতিন্ময় শুধু একটা কথাই বলল, “থু!!”

জ্যোতিন্ময় সব শেষে বলে, “রাধানাথ দাস, আপনি যে জিনিস খুঁজছিলেন সেটা আমি ছোটোতেই ভাঙাচোরা বলে বিক্রি করে দিয়েছি।”

রাধানাথবাবু চুপ মেরে গেছে এতক্ষণে।

খবর পেয়ে মৃন্ময়বাবু সস্ত্রীক চলে এসেছে। প্রায় মারমুখী হবার উপক্রম। আমি এবং অন্যান্য পুলিশদের সহযোগিতায় কোনো মতে রক্ষা পেয়ে গেল।

রাধানাথবাবু যাবার আগে একবার বৌমার ছবির সাথে দেখা করতে চায়। আমি বললাম, “মাত্র দুই মিনিট সময়।”

“একদম ম্যাডাম!” বলে হাসতে হাসতে বৌমার ছবির কাছে গিয়ে লুটিয়ে পড়লেন। বুঝতে অসুবিধা হল না, যেখানে গিয়েছেন দু’মিনিটে উনি আর ফিরবেন না।

এই ঘটনার পর বাবিনের জীবন একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। আমরা দু’জনেই এই লেখাটা শেষ করলাম আর আপনাদের জানিয়ে দিলাম আমি সত্যিই ভালোবেসেছি, সত্যিই নিখাদ সোনা। সামনের জানুয়ারিতে আমরা আমাদের নতুন জীবন শুরু করছি। বাবিনের প্রথম অংশটা লিখে এক ঘুম দেওয়া হয়ে গিয়েছে। গুডনাইট।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post সংখ্যা রহস্য| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | অর্পন মাইতি| Bengali Detective Story
Next post সম্পর্কহীনা| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | রিতেশ দাস| Bengali Detective Story