মহাস্থানগড়ের ভয়ংকর | ভয়ের দেশ |সায়ন দাশ| Bengali Horror Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

সূচনা

সন-১০৪৩ খ্রীষ্টাব্দ,

সে দৌড়াচ্ছে! পাহাড়ের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। বারবার পড়ছে সে মুখ থুবড়ে, গাছের কাঁটায় সারা শরীর রক্তাক্ত, তাও সে থামছে না! তার পরনের কুর্তা, ধুতি ছিন্নবিচ্ছিন্ন। পেছন থেকে ক্রমাগত চার পায়ের ভারী পায়ের আওয়াজ আসছে! নাহ্ তাকে পালাতেই হবে! পালাতে হবে অনেক দূর এই অদ্ভুত ভয়ানক জানোয়ারটার থেকে! নাহলে আর আশা নেই।

পারল না সে, গাছের শিকড়ে পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। পড়েই পাহাড়ি ঢাল দিয়ে গড়াতে গড়াতে গেল অনেকদূর। থামল যখন তার শরীরে আর শক্তি অবশিষ্ট নেই! চোখ-নাক-মুখ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। কোনোরকমে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল একটু দূরে পড়ে আছে তার তলোয়ার। ওটা আনার জন্য অনেক কষ্টে শক্তি সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়াতেই জোরে ধুপ্ করে একটা আওয়াজ আর সে আবার পড়ল মাটিতে।

মাটিতে পড়ার আগেই সে ওটাকে দেখতে পেয়েছিল, তাই শরীরের ব্যথা ভুলে গিয়ে আতংকে চিৎকার করে উঠলো। জন্তুটার অবশ্য তেমন হেলদোল হলোনা, লম্বা লম্বা নখযুক্ত লোমশ পা নিয়ে এগিয়ে গেল সে শিকারের দিকে।

চতুর্দিক কাঁপিয়ে একটা হুংকার শোনা গেল-

“আ-উ-উ-উ-উ-উ”

পর্ব-১

সন-২১৪৩ খ্রীষ্টাব্দ,

সে দৌড়াচ্ছে, অনায়াসে পেরিয়ে যাচ্ছে উঁচু অট্টালিকাগুলির ছাদ, পিঠে ব্যাগ, তাতে আছে কয়েকশো কোটি টাকার হীরে। সে অবশ্য একা নয়, তার পিছনে তাড়া করে আসছে ছয় জন গার্ড, হাতে উদ্যত রে গান! বারবার তা থেকে বিধ্বংসী রশ্মি ছুটে আসছিলো মেয়েটার শরীর লক্ষ্য করে তবে সে অপূর্ব দক্ষতায় আর চোখে লাগানো আই.নেক্সট গ্লাসের সাহায্যে তা কাটিয়ে পালাচ্ছিল। এমন সময় সে লাফিয়ে নামল এক নোংরা গলিতে। নোংরা জলকাদা পেরিয়ে তারা ঢুকে পড়লো এক বিখ্যাত মার্কেটে। পেরিয়ে গেল ঝকঝকে গেটের একপাশে প্রায় মুছে যাওয়া সাইনবোর্ডে লেখা “গড়িয়াহাট মার্কেট”! ক্যাল সিটি ওয়ান শহরটা আধুনিক হলেও কিছু কিছু জায়গা এখনও পুরোনো রয়ে গেছে, যেমন এই জি-৯৯ মার্কেট! তবে বিখ্যাত হবার কারণে রোজ কোটি কোটি টাকার জিনিস কেনাবেচা হয়।

“বাঃ দারুণ তো, প্যাক করে আমার ওয়াইফকে সেন্ড করে দাও ইলিশটা! আমার ই-বাস আসার সময় হয়ে এ এ এ এ..এ কে ধাক্কা মারলিরে? ধর ধর পকেটমার!”

বড় সাইজের ইলিশটা ধাক্কায় উঠে গেছে শূন্যে। শূন্যে থাকা অবস্থাতেই সেটির গায়ে এসে পড়ল লাল রশ্মি, মুহূর্তে মাছটা অদৃশ্য হয়ে গেল, তার পরিবর্তে কিছু কালো ছাই ভাসতে ভাসতে পড়লো মাটিতে।

ক্রেতা আর বিক্রেতার চিৎকারে কর্ণপাত না করে মেয়েটা আর তার পেছনে লোকগুলো ছুটে বেরিয়ে গেল, উঠে আসলো সব ঝকঝকে রাস্তায়। রাস্তা পুরো ফাঁকা, কোনো গাড়ি নেই! সব আছে মাটি থেকে চল্লিশ ফুট ওপরে! নিঃশব্দে যাতায়াত করছে ই-বাস, ই-ট্যাক্সি, ই-বাইক। তবে ফাঁকা রাস্তায় চলা বিপজ্জনক, অনবরত অদৃশ্য বিদ্যুতের প্রবাহ বয়ে চলেছে সেখানে, যা সাহায্য করছে ওপরের গাড়িগুলির চলাফোরায়।

রোডের ঠিক পাশেই একটা সরু রাস্তা আছে, হেঁটে যাওয়া বা বাইসাইকেল চালানোর জন্য। সেই রাস্তা দিয়েই দৌড়াতে দৌড়াতে একটা শর্টেস্ট রুট পোর্টাল বা টেলিফোন বুথের আড়ালে লুকিয়ে হেলান দিয়ে বসলো, মূলত এই বুথগুলো ব্যবহার হয় এমার্জেন্সি হিসেবে, টাকার বিনিময়ে এক পোর্টালের মাধ্যমে কেউ একশ কিলোমিটারের মধ্যে যেকোনো জায়গায় নিমেষে চলে যেতে পারবে। এসবের কারণে বায়ুদূষণ অনেকটা কমে গেছে, মেয়েটা বসে কয়েকবার অনেকটা অক্সিজেন নিল প্রাণ ভরে। এমন সময় গায়ের ওপর এসে পড়ল একটা বড় প্যাকেট! এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেল না সে। খুলে দেখল ভেতরে মিলিটারি ভার্সনের ন্যানোটেক গন্টলেট, বেল্ট আর কলার, সাথে একটা চিপ! চিপটা ওর আই.নেক্সট গ্লাসের ফাঁকা স্লটে ঢোকাতেই চোখের সামনে ফুটে উঠলো একটা ঠিকানা আর একটা নোট, তাতে লেখা-

“হ্যালো ফক্স, প্রচুর টাকা আয় করতে চাও? চলে এসো আধঘন্টার মধ্যে”

চিন্তায় পড়ে গেল সে, এ কে? কি চায়? তার নাম অবশ্য ফক্স নয়, ওটা তার কোডনেম, তার নাম ইলা ঘোষ। প্রফেশনালি সে একজন চোর, ক্যাল সিটির জাস্টিস ডিপার্টমেন্টে তার নাম মাঝেমধ্যেই উঠে আসে ওয়ান্টেড লিস্টে। দোনামোনা করলেও টাকার কথা ভেবে দেরী করলোনা, পেছনের গার্ডগুলো যখন তখন চলে আসতে পারে। চটজলদি গন্টলেটদুটো পরে নিলো দুই হাতে, সাথে বেল্ট আর কলারও। পরপর গন্টলেট আর বেল্টের বাটন প্রেস করতেই কালো রংয়ের এক স্যুট জড়িয়ে ধরল ওর শরীর। পিঠে উদয় হলো এক জেট ইঞ্জিন। আর কোনো ভয় নেই! নিশ্চিন্তে ব্যাগটা কোমরে জড়িয়ে আড়াল ছেড়ে বেরোলো সে। লোকগুলো একটু দূরে দাঁড়িয়ে খুঁজছিল ওকে। ইলাকে দেখেই সবাই একসাথে বন্দুক তাক করে বাটন প্রেস করলো। সাথে সাথে পরপর রশ্মিগুলি ইলার স্যুটে ধাক্কা খেয়ে এদিক সেদিক ছিটকে গেল। লোকগুলির চোখমুখের অবস্থা ছিলো দেখার মতো। মুচকি হেসে ইলা হাত দিলো গলায় আটকানো কলারে। নিমেষে গোটা মাথা ঢেকে গেল এক কালো হেলমেটে।

“সরি বয়েজ”

বলার সাথে সাথেই ‘শোঁ’ শব্দ আর ইলা প্রায় পঞ্চাশ-ষাট ফুট ওপরে উঠে উড়ে চললো গন্তব্যের দিকে।

বেশ গতিতে হাওয়া কেটে এগোচ্ছিল সে, এরম সুযোগ রোজ রোজ আসেনা। ভালোই উপভোগ করছিলো সে, তবে সমস্যা হলো গন্তব্যের ঠিক আগেই সামনে বড়ো বড়ো গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি এসে পড়ায়। সে অতটা পারদর্শি নয়, ঝামেলাটা বাধল ঠিক নামার আগেই। সামনে একটা টাওয়ারের গায়ে ধাক্কা লাগল তার শরীরের। তবে স্যুটের জন্য ব্যথা লাগলোনা তেমন! নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লাট্টুর মতো ঘুরপাক খেতে খেতে যেখানে নামার কথা সেই বাড়িটার জানলার কাঁচ ভেঙে সোজা ভেতরে ঢুকে গেল ইলা।

চারিদিকে ছড়ানো ভাঙা কাঁচের মধ্যে শুয়ে হেলমেট ডিসাবল করে আশপাশটা দেখছিল সে। একটা ল্যাবরেটরির মধ্যে এসে পড়েছে সে। চারিদিকে বড়ো বড়ো টেবিল, বড়ো বড়ো যন্ত্রপাতি! কারোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না কেন ভাবতে ভাবতেই একটা টুক-টুক আওয়াজ পেয়ে দেখে ছোটো পুতুলের মতো জনাদশেক রোবট ওর চারপাশে এসে হাজির হয়েছে, সবার হাতে ছোটো ছোটো ট্রে আর ঝাড়ু। পরিষ্কার করা শুরু করে দিয়েছে কাঁচের টুকরোগুলো, এরমধ্যে একজন ওর গায়ের ওপর উঠে কাঁচ সরাতে লাগল। শুয়েই দুই আঙুল দিয়ে সেটাকে আদর করতে যেতেই-

“খবরদার! ওরা কারেন্ট মারে আমি ছাড়া অন্য কেউ ধরলে!”

তাকিয়ে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে সবুজ শার্ট আর কালো প্যান্ট পরিহিত এক মধ্যবয়স্ক লোক, চোখে চশমা। বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডক্টর বিরাজ সাধুখাঁ! মুখে হাসি এনে বললেন তিনি,

“দ্যাট ওয়াজ কোয়াইট অ্যান এন্ট্রান্স ইউ হ্যাভ মেড হিয়ার! লাইক ইট! চলে এসো ভেতরে, ওইগুলো ওখানেই রেখে দাও”

“ওকে, থ্যাংক ইউ!” বলে ইলা উঠে দাঁড়ালো, জ্যাকেট, প্যান্ট একবার ঝেড়ে চললো ডাইনিং রুমের দিকে। জেটপ্যাকের অংশগুলো এক এক করে পড়ল মেঝেতে।

বেশ সাজানো গোছানো ডাইনিং রুম। ইলা সোজা ঢুকে একটা আর্মচেয়ারে আরাম করে বসল।

“কি কাজ বলে ফেলুন ঝটপট”

“আলাপ পরিচয় হবেনা?” ইলার হাতে এক গ্লাস ব্র্যান্ডি ধরিয়ে বললেন বৈজ্ঞানিক।

চুমুক দিল ইলা। বেশ উৎকৃষ্ট মানের। একবারে পুরো গ্লাসটা শেষ করে বললো, “আপনি জানেন আমি কে, আমিও জানি আপনি কে! কিউভিড-এ প্রতিটা ভিডিও প্লে করলেই শুরুতে আপনার ভাটের বকবকানির অ্যাড দেয়। চোরগুলো প্রিমিয়াম ভার্সনকেও ছাড় দেয়না আজকাল। এনিওয়ে বলুন কি কাজ?”

গোঁফের ফাঁক দিয়ে হালকা হাসি দেখা গেল বিরাজ সাধুখাঁর মুখে। “বেশ কদিন ধরে মিড সিটিতে একটা ভাইরাস হানা দিয়েছে নিশ্চয়ই খেয়াল করেছো?”

“হুম্ প্লায়ো-৫৭! অ্যানিমিয়া বলে সবাই! আমার প্রচুর টাকার প্রজেক্ট হাতছাড়া হয়ে গেছে”

“উঁহু! দেখতে অ্যানিমিয়ার মতো হলেও তার হাবভাব অনেক আলাদা তাই সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে আর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে আগুনের মতো”

ইলা শুনতে লাগল। আর এক গ্লাস পেলে বেশ হতো।

“সেই প্লায়ো ভাইরাসেরই ভ্যাকসিন তৈরীর চেষ্টায় আছি আমি। তার জন্য যে জিনিসটা অপরিহার্য সেটা এই দুনিয়ায় মেলেনা, সেটা আনার জন্যই তোমায় ডাকা। আনতে পারলে পুরস্কার দুই লাখ কোটি টাকা”

টাকার অংকটা শুনে নড়েচড়ে বসলো ইলা। সাধারণত সে কাজপ্রতি আয় করে দশ থেকে পনেরো কোটি মতো। তাও মাস চলেনা ঠিকঠাক করে।

“বলুন কি জিনিস? আর ওই দুনিয়া টুনিয়া কি বলছেন ভালো করে বলুন”

“জিনিসটা হচ্ছে ফুল, নাম নীলকমল! প্রতি পূর্ণিমায় ফোটে। তোমাকে সেটাই নিয়ে আসতে হবে তিনটে, মিনিমাম”

“ব্যাস্? গার্ড কজন?”

“মাত্র একজন”

“রাজি, বলুন কবে যেতে হবে? কোথায়? আর ওই দুনিয়া না কি বলছিলেন?”

“আজ পূর্ণিমা। আজই গিয়ে নিয়ে আসো। তোমায় যেতে হবে পুন্ড্ররাজ্যের রাজধানী মহাস্থানগড়ে” বলে মুচকি হাসলেন বৈজ্ঞানিক।

“কি গড়? এসব আবার কোথায়?” বেশ অবাক হলো ইলা।

আবার হাসলেন বৈজ্ঞানিক। “বলবো সব ডিটেলসে। এখন তোমার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে এসো, জামাকাপড় আনবে একস্ট্রা, চিন্তা নেই, জেটপ্যাকটা নিয়ে যাও। বিকেল হতেই চলে আসবে। এবার সদর দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করো”

* * *

বিকেলে আসলো ইলা। ব্যাগে বিশেষ কিছু আনেনি সে, দুটো টপ, একটা অতিরিক্ত জিন্স আর ওর পছন্দের কোল্ট ডেল্টা এলিট টেন এমএম পিস্তল। এরকম বন্দুক বেশি পাওয়া যায়না ব্ল্যাক মার্কেট ছাড়া। পিস্তলটা অবশ্য ইলার ঠাকুরদা ব্যবহার করতেন পুলিশজীবনে, ইলা তার ওপরেই খানিক কারিকুরি করেছে। বাকি যন্ত্রপাতি ওর বুটের তলায় প্রকোষ্ঠে লুকানো।

একটা বড় লেজার রাইফেল ইলার হাতে দিলেন বিরাজ সাধুখাঁ। “রাখো, কাজে লাগতে পারে”

রাইফেলটা একটা চেয়ারে রেখে ইলা দুহাত বুকে জড়ো করে বললো, “ডিটেলস বলুন, কুইক”

মুচকি হেসে বললেন বৈজ্ঞানিক, “ভড়কে যাবে না শুনে, তোমায় যেতে হবে অতীতে”

“টাইম ট্রাভেল?” দুবছর আগে টাইম ট্রাভেল সম্ভবপর হয়েছে তবে তা একদমই পাতে দেবার মতো না, মাত্র দশ মিনিটের জন্য চব্বিশ ঘন্টা আগে যাওয়া যাবে, কাঁচের ভেতর থেকে দেখতে হবে সব। বেশিরভাগ সময় দৃশ্যগুলো ঝাপসা হয়, ভীষণ খরচসাপেক্ষ।

“হুম্ ১০৪৩ খ্রীষ্টাব্দে”

“হোয়াট? আপনি পাগল না পেট খারাপ?”

“কোনোটাই না” হো হো করে হেসে উঠলেন বৈজ্ঞানিক, “এটা আমার লেটেস্ট ইনোভেশন, শুধুমাত্র গভর্নমেন্ট ইউসের জন্য বানানো, চলে আসো, এই বাথটবে শোও, মুখ সহ পুরো শরীর ডুবিয়ে রাখবে কয়েক সেকেন্ড তারপর আপনাআপনিই কাজ হবে। দশ মিনিটে পৌঁছে যাবে, সব বন্দোবস্ত করা আছে, ওখানে যেখান দিয়ে উঠবে সেখান দিয়েই এখানে পৌঁছাবে। চিন্তা করো না, সেফ এটা”

ইলা কিছু বললো না, দুই ঠোঁট টিপে ভাবছিলো একটা বেশ অ্যাডভেঞ্চার হবে। তাছাড়া উনি বিশ্ববিখ্যাত, একজন সাধারণ চোরকে মারতে হলে এত কষ্ট করবেন না। অতএব বিশ্বাস করাই যায়।

“ওকে! পাহারার ব্যাপারে বলুন ডিটেলসে” ব্যাগটা পিঠে পড়ে নিল ইলা।

গলাখাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন বৈজ্ঞানিক, “সব বলছি, রাজ্যের নাম পুন্ড্ররাজ্য। পুন্ড্র কথাটি এসেছে পান্ডু রোগ থেকে, যার অর্থ অ্যানিমিয়া। সেই রাজ্যের বর্তমান রাজার নাম পরশুরাম। ঝামেলায় জড়িয়ে না পড়লে ওনার সাথে তোমার কোনো কাজ নেই। গ্রামের নাম ফুলিগ্রাম, রাজধানীর গা ঘেঁষে। সেই গ্রামেরই নীলচন্দা পাহাড়ের চূড়ায় প্রতি পূর্ণিমায় ফোটে নীলকমল, আর কোথাও দেখা পাওয়া যায়না তার। সেই ফুল ছুঁয়ে যায় ঝর্নার জল, যা পান করে সুস্থ হয়ে ওঠে পান্ডুরোগীরা, তারা বলে দেবতার আশীর্বাদী ফুল। প্রচুর ফুল ফোটে সেখানে”

“পাহারার ব্যাপারটা বলুন” প্রাচীন যুগে যেতে হবে ভেবেই ইলার সারা শরীরের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছিল।

আবার হাসলেন বৈজ্ঞানিক, এবারের হাসিটা কেমন যেন-

“ইয়ে মানে, একজনই আছে পাহারায়, মাত্র একজন, সে ইয়ে..আই মিন্……”

দুড়ুম্!

হঠাৎই ওদের পেছনের দরজাটা প্রবল বিষ্ফোরণে উড়ে গেল। ঘরে ঢুকে পড়ল সকালের ওই লোকগুলো, হাতে রে গান।

“কুইক, আর সময় নেই, অল দ্য বেস্ট! যেখানে উঠবে ওখানে ওটাই পোর্টাল, ওর থেকে মোটামুটি দুই কিলোমিটারের মধ্যেই পাহাড়টা ঘন জঙ্গলের ভেতর! একটাই পাহাড় ওই চত্বরে। কাজ হয়ে গেলে সেইখানে যাবে, অটোমেটিক চলে আসবে এখানে। নাউ গো!” একনিশ্বাসে কথাগুলো বলেই ইলাকে দিলেন এক ধাক্কা! ইলাও টাল সামলাতে না পেরে চিৎ হয়ে পড়ল বাথটবে। পড়েই বুঝতে পারল একটা এনার্জি তাকে ভেসে উঠতে দিচ্ছেনা। সেও চুপ করে দম বন্ধ করে থাকল। ধীরে ধীরে জলের ওপরের স্তর ঝাপসা হতে শুরু করলো, তারপর সম্পূর্ণ অন্ধকার, তারপরেই প্রচন্ড জোরে এক টান পেছনের দিকে!

পর্ব-২

কতক্ষণ জলের তলায় ছিল ইলা জানেনা! জ্ঞান ফিরে চোখ খুলতেই দেখল জমাট অন্ধকার, চোখেমুখে জলজ গাছপালার অংশ ঠেকছে, কনুইএর ওপর দিয়ে একটা বড় মাছ চলে গেল যেন! ভয় পেয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে সাঁতার কেটে উঠতে লাগল ওপরের দিকে। একসময় মাথা তুললো জলের ওপর! শেষদিকে দম ফুরিয়ে আসছিল ওর। উঠেই বারকয়েক বড় হাঁ করে শ্বাস নিল কিছুক্ষণ, তারপর জল হাতেই মুখটা মুছে তাকালো আশেপাশে।

এ কোথায় হাজির হয়েছে সে? সে এখন আছে মাঝপুকুরে, একটু দূরেই শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল, তার পেছনেই উঁচু এক পাহাড়। আকাশে উজ্জ্বল গোলাকার চাঁদ, চাঁদ দেখেই তার মনে পড়ল সবকিছু। আজ পূর্ণিমা, আজ ফুল পেয়ে গেলে আজই ফেরা যাবে, তারপর অ্যাকাউন্টে ঢুকে যাবে টাকা! টাকার কথা মনে আসতেই মনটা খুশিতে ভরে গেল ওর। সাঁতরে উঠে আসলো পাড়ে, বহুদিন পর এভাবে নিজের শক্তি ব্যবহার করে সাঁতরালো সে। জ্যাকেট আর প্যান্টে লাগানো বোতাম টিপে ড্রায়ার চালু করলো, মনে করে চার্জ দিয়ে এনেছিল তাই বাচোঁয়া নয়তো শীতে কাঁপতে হতো এখন। ব্যাগ টা কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো পাহাড় লক্ষ্য করে। একটু পর এসে পৌঁছালো নীলচন্দা পাহাড়ের তলায়। সামনের ঘন জঙ্গল পেরোতে হবে। নিচু হয়ে অভ্যাসবশত বুটের আগায় লাগানো ‘রানার’ বাটন প্রেস করলো। কিছু হলো না। কি হলো ব্যাপারটা? এরম তো হবার কথা নয়! বারকয়েক টেপার পরে খেয়াল হলো, এই আদিযুগে ইন্টারনেটের কোনো অস্তিত্ব নেই! ওয়াইফাই ডেটা ছাড়া ছুটবে না বুট। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইলা ব্যাগটা ধরে পা রাখল জঙ্গলের ভেতর।

একজন চোরের জন্য একটা অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস হলো পা, সেটা ইলার আছে বেশ ভালো অবস্থাতেই! অ্যাথলেটিক শরীরের অধিকারিনি ইলার তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না ওপরে উঠতে। হাতঘড়িও কাজ করছিলো না। চাঁদের আলোয় চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। চারদিকটা অদ্ভুত রকমের নিস্তব্ধ, শুধু ঝিঁঝি ডেকে যাচ্ছে একটানা তার সাথে নাকে আসছিলো বিভিন্ন ফুলের সুবাস, ইলার অ্যাপার্টমেন্টের কৃত্রিম ফুল নয়, সত্যিকারের ফুল! ঝিঁঝি পোকার ডাক অনেকবছর পর শুনল সে। ইলার মাথায় অবশ্য ঘুরছিলো পাহারাদারের কথা, কি যেন একটা বলতে গেল ডক্টর! গুন্ডাগুলো আসার আর সময় পেলোনা। যাই হোক, বাঘ-ভল্লুক-অ্যানাকোন্ডা যাই থাকুক, লেসার গান তো আছে ওর কাছে। এক ফায়ারেই ছাই!

নিশ্চিন্ত মনে শিষ দিতে দিতে প্রায় চূড়ার কাছে উঠে এলো বিনা বাধাতেই, কোনো জীবজন্তুর সামনে মোলাকাত হয়নি অবশ্য এখনও। এখান থেকে বেশ অনেকটা দেখা যাচ্ছে। দূরে এক বিশাল প্রাসাদ মতো, রাজপ্রাসাদ! তার সামনে পাহারারত সৈন্যদেরও দেখতে পেল, তাদের হাতে তীরধনুক, তরোয়াল তার নজর এড়ালো না। “উফ্”বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইলা, সত্যিই সে অতীতে এখন! গা টা শিরশির করে উঠলো আবার। রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছ এক নদী।

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সে আরেকটু, জলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, অর্থাৎ ঝর্ণা কাছেই, ওখানেই থাকবে নীলকমল! পেয়েও গেল সে খানিক খুঁজে। পাহাড়ের একেবারে মাথা থেকে নেমে আসছে জলের ধারা! সেদিকে খানিক এগোতেই.. ও-ওইতো! ইলার কাঙ্ক্ষিত ফুল, নীলকমল! ফুটে আছে একগুচ্ছ নীল রংয়ের ফুল! অসাধারণ সেই দৃশ্য! চাঁদের আলোয় যেন পাপড়িগুলো থেকে রং ঠিকরে বেরোচ্ছে, তার সাথে মাতাল করে দেওয়া অদ্ভুত এক সুবাস! মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ সেই দৃশ্য দেখল সে। সম্বিৎ ফিরতেই সতর্ক হয়ে চারিদিকে তাকালো সে, পাহারাদারের তো থাকার কথা! ব্যাগের চেন খুলে একটা প্যাকেট বের করে পকেটে ঢোকালো, এর মধ্যে কোনো জিনিস বছর দুয়েক তাজা থাকবে। এরপর আবার ব্যাগের মধ্যে হাত ঢোকালো সে, কিন্তু একি? লেজার রাইফেল কই? বিরাজ সাধুখাঁ তো তার হাতে দিয়েছিল, গেল কই? আতিপাতি করে খুঁজল সে, কোথাও নেই! হতাশায় মাথার চুল টেনে ধরে মাটিতে বসে পড়ল সে। এবার কি হবে? আদিমকালের বিশাল বিশাল বাঘ-ভাল্লুক যদি থাকে? ওর সাধারণ দশ মিলিমিটারের বুলেট কি কিছু করতে পারবে? কিছুক্ষণ বসে থাকার পর উঠে দাঁড়ালো সে, বসে থেকে লাভ নেই! ওর পা আছে, কিছু হলে দৌড়ে পালাবে! সে চোর, চুপিচুপি ফুল নিয়ে নিতে পারলে কিছু ব্যবহার করতে হবেনা। ব্যাগ থেকে তার পিস্তলটা বের করে একটা ম্যাগাজিন ভরল, আরেকটা রাখল তার পকেটে। ককিং করে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বন্দুক তাক করে এগোতে থাকল ধীরে ধীরে। কিছু যেন আছে এই চত্বরে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে। এই নিস্তব্ধতায়, ঝিঁঝি পোকার ডাকে ভয়টা আরো জাঁকিয়ে বসছে! হঠাৎ তার পেছনে ‘হুশ্’ ককে এক আওয়াজ হলো! কেউ ভারী শরীর নিয়ে দৌড়ে চলে গেল, সেই হাওয়াটাও ওর গায়ে লেগেছে। চমকে পেছনে ফিরে পিস্তল তাক করলো ইলা। কেউ নেই, শুধু ওর দুইপাশের ঝোপগুলো নড়াচড়া করছে বাতাস জোরে না বওয়া সত্ত্বেও। হঠাৎই পায়ে কিসের সাথে যেন ঠোক্কর লাগল, নীচে তাকিয়েই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেল ওর!

ও এখন যেখানে দাঁড়িয়ে তার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কঙ্কাল, হাড়গোড়ের সারি! কয়েকটা মৃতদেহও আছে পড়ে এদিক সেদিক। কঙ্কাল বা মৃতদেহ সবাই মুন্ডুহীন। ফুলের মিষ্টি সুবাসের সাথে নাকে ভেসে আসছে পচা গন্ধ। ইলা টের পেলো তার হাত পা কাঁপছে, জোর করে ঠোঁট চিপে বেরিয়ে আসা অস্ফুট আর্তনাদটাকে বের করতে দিল না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কেউ এলোনা। এসব তার যুগে হলে কোনো অসুবিধাই হতোনা, আই.নেক্সট নিখুঁতভাবে তার কানে বলে দিত তার পেছনে কোনো বিপদ আছে কিনা। কিন্তু এই এগারোশো বছর আগে প্রযুক্তি ছাড়া নিজেকে নগ্ন মনে হচ্ছে, কয়েকমুহূর্ত অসহায়তার নাগপাশ তাকে জড়িয়ে ধরল, পা আর এগোতে চাইল না। মাথা নীচু করে দুই হাঁটু ধরে কয়েকবার বড় বড় শ্বাস নিল সে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আবার এগোলো সে! বুটের তলায় হাড়গুলি মট্-মট্ করে আওয়াজ করতে থাকল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বেরোতে হবে, ভয়ংকর কিছু একটা ওঁত পেতে আছে! মাঝে মাঝেই পেছনে পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল সে। কেউ যেন তার ভারী পা টেপার আওয়াজ প্রাণপণে কম করতে চাইছে। ওইতো সামনে ফুলগুলো! ঝর্নার জল ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। একটু এগোতেই আবার তার ঘাড়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠল, পেছনে কেউ আছে! তাকিয়ে দেখল যথারীতি কেউ নেই, শুধু দূরের ঝোপগুলো দুলছে। ইলার খুব ইচ্ছে করছিলো এক দৌড়ে পুকুরে গিয়ে ঝাঁপ মারে, তবে এতকাছে এসে ফিরে যাবে মানতে পারল না। টের পেলো ঝিঁঝি পোকার ডাক থেমে গেছে, চারিদিকে এক অপার নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে, সমগ্র পরিবেশটা যেন এক আসন্ন বিপদের অপেক্ষায়। ইলার হৃদযন্ত্রের দামামা ক্রমাগত তার কানে বাজছে, টের পেলো ঘামের স্রোত তার পিঠ দিয়ে বইছে। সাহস সঞ্চয় করে হিমশীতল জলে পা রাখল সে, বেশ পিচ্ছিল, একটা পাথরে পা রেখে ফুলগুলোর সামনে দাঁড়ালো, তুলতে পারলেই কতগুলো টাকা! একবার আবার পেছনে তাকিয়ে নিচু হয়ে একটা ফুলের ডাঁটিতে হাত দিয়েছে, সেইসময় কানে এলো একটা বেশ চাপা গর্জন, কোনো কুকুরের আওয়াজ মনে হলো শুনে। কাঁপতে কাঁপতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুই হাতে পিস্তলটা ধরল শক্ত করে, পেছনে তাকাতে একদমই সাহসে কুলাচ্ছে না! মনেহচ্ছে হৃৎপিন্ডটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে। চাপা গর্জনটা আবার কানে এলো, এবার মনে হলো বেশ কাছে। পা দুটো কাঁপছে খুব, একটা হাতে গাছের ডাল শক্ত করে ধরে ঘাড়টা বেঁকালো সামান্য, দেখা না গেলেও আড়চোখে যতটুকু দেখা যায় তা দেখে বুঝতে পারলো কালো লম্বা একটা শরীর দাঁড়িয়ে তার পেছনে। ভয়ে প্রাণ বেরিয়ে যেতে চাইলেও ঠিক করলো পেছনে ঘুরবে, এভাবে ভীরুর মতো মরবেনা সে। দুবার জোরে শ্বাস নিয়ে জ্যাকেটের হাতা দিয়ে ঠোঁটের ওপর জমে থাকা ঘাম মুছে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে চকিতে পেছনে ফিরে ট্রিগার টিপল, আওয়াজে আশেপাশের গাছ থেকে পাখির দল উড়ে পালালো। তবে ইলার আর দ্বিতীয়বার ফায়ার করা হলোনা, মাটিতে পড়লো সেটা ঠক্ করে।

ওর সামনে দাঁড়ানো কালো কদাকার কুকুরমুখো জানোয়ারটা ধীরে ধীরে দুপায়ে দাঁড়াল! এবার ইলা পরিষ্কার দেখতে পেল ওটাকে।

প্রায় দশ ফুট উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছে ঘন কালো লোমশ এক জানোয়ার। ঘাড়ের কাছে লোমগুলো আরো ঘন হয়ে কেশরের মতো রূপ নিয়েছে। দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে, মুখ থেকে ক্রমাগত চাপা গর্জন হয়েই চলেছে। ইলা স্পষ্ট দেখল জন্তুটার কাঁধ থেকে বুলেটটা মাটিতে পড়ল। ইলার মনে হচ্ছিল আর দাঁড়াতে পারবেনা, পা দুটো মনে হচ্ছিল জেলীর। একটা গাছের গুঁড়িতে কোনোরকমে হেলান দিয়ে বসে পড়লো জলের ওপর। কাঁপা হাতে পকেট থেকে বের করলো একটা ছোটো ছুরি, চুরির সময় দড়ি, তার কাটতে কাজে লাগে, এখানে এই ভয়ানক জন্তুর সামনে কি কাজ করবে ও জানেনা। , সামনেই পিস্তলটা, কিন্তু ওঠানো যাবেনা, হাত বাড়ালেই ঝাঁপাবে। জন্তুটার ঘাড় সামান্য নিচু হয়েছে, মনেহয় ঝাঁপ দেবে! মৃত্যুভয়ে ইলা চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। গলা থেকে কোনো স্বর বেরোলো না। এর থেকে লেসার গানের সামনে দাঁড়ানো ভালো।

ঝাঁপ দিলোনা জন্তুটা। ধীরে ধীরে ইলার সামনে আসল। কদাকার মুখটা নামাল ওর সামনে। কাঁপতে থাকা ইলা সাহস করে তাকালো ওটার চোখের দিকে! টকটকে জবাফুলের চেয়েও লাল চোখদুটো। দুই ধারের বড়ো শ্বাদন্ত থেকে লালা ঝরে পড়ছে ইলার কোলের ওপর। চোখে চোখ রাখার সাথে সাথেই বিকট আওয়াজে হুংকার ছাড়ল জন্তুটা। ডাকতেই থাকল একনাগাড়ে। ইলার মনে হলো গরম হাওয়ার কোনো যন্ত্র কেউ চালিয়ে দিয়েছে ওর মুখের সামনে। প্রায় এক মিনিট পর থামল জন্তুটা। পুরো চোখ মুখ ছিটে আসা লালায় ভর্তি হয়ে গেছে ইলার। ভয়ে হাতও ওঠাতে পারল না সে। চাপা গর্জন করতে করতে আস্তে আস্তে জন্তুটা দুই থাবা রাখল ইলার কাঁধে। সূচালো নখগুলো ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো ওর কাঁধের মাংসে। তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলো ইলা। কাঁধের ভেতর যেন আগুন জ্বলে উঠলো। ছটফটিয়ে উঠলো সে। কয়েকবার বৃথা মরণথাবা থেকে বেরোনোর চেষ্টা করলো, একচুলও নড়তে পারলোনা। গরম রক্তের ধারা ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে ঝর্নার জলকে লালরংয়ে পরিণত করে ফেলল খুব তাড়াতাড়িই! এই তাহলে শেষ, টাকার লোভে আজ তাকে মরতে হচ্ছে, তাও তার নিজের জগতে না, এগারোশো বছর আগে কোনো এক অলৌকিক জন্তুর হাতে। নখগুলো আর বের করলো না জন্তুটা। ওই অবস্থাতেই বিরাট বড় হাঁ করলো জানোয়ারটা, লক্ষ ইলার মাথা! সূতীক্ষ্ণ দাঁতগুলো চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠলো। চারপাশটা কেমন অন্ধকার হয়ে আসল ইলার। আপনাআপনিই চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেল তার।

দূরে কোথাও কিছু একটা বেজে উঠলো! প্রচন্ড তীক্ষ্ম সেই আওয়াজ! আওয়াজে ইলার চোখও খুলে গেছিল। কিছু বোঝার আগেই ওর গাল আর ঘাড়ে এসে পড়ল থাবার বাড়ি। খানিকটা উড়ে গিয়ে পাহাড় দিয়ে গড়াতে গড়াতে একটা গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে থামল সে, আর উঠলো না সে। একটা বড় ডাল ওর কোমরের ঠিক ওপরেই ঢুকে আছে গভীরভাবে। জ্ঞান হারানোর পূর্বে ইলা শুনতে পেলো ভারী পায়ের আওয়াজটা ক্রমশই দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

পর্ব-৩

কক্কর..ক্রক..ক্রক..

চোখ খুলল ইলা, মোরগের ডাক সে চেনেনা, তাই আওয়াজে খানিকটা ভয় পেয়েই ধড়ফড় করে উঠতে গেল সে। আধশোয়া অবস্থাতেই দেখল চোখের সামনে কতকগুলো বাচ্চা মুখ! তখনই খেয়াল পড়ল সে বেঁচে আছে কিকরে? যতদূর মনে পড়ছে তার পেটে ডালটা ঢুকে ছিল, থাবার বাড়িতে ঘাড়ও বেঁকে গেছিল, হৃৎপিন্ডের গতি কমে যাওয়াও টের পেয়েছিল সে। তার তো বাঁচার কথা না! আবার শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করলো, আবার খুললো। হ্যাঁ অন্য কিছু না, সামনে সেই বাচ্চাদের মুখ। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল সে মুখগুলোর দিকে। এমন সময় এক কিশোরকন্ঠ শোনা গেল-

“আরে তোরা করছিস কি? সর..সর..দিদিটাকে বাতাস নিতে দে”

মুখগুলো সরে গেল, তার পরিবর্তে চোখের সামনে উদয় হলো এক কিশোরের মুখ।

“বিদেশী দিদি, তোমার ভালো লাগলে উঠে বসতে পারো”

ধীরে ধীরে উঠে বসলো ইলা। একটা দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে ছিল সে। মাথাটা সামান্য ধরে আছে কিন্তু এছাড়া সারা শরীরে আর কোনো যন্ত্রণা নেই। আশ্চর্য! উঠে বসেই দেখল পাশে রাখা ব্যাগ, পিস্তল, ছুরি! দেখামাত্র উঠে গিয়ে ব্যাগটা চেক করলো, সব ঠিক আছে। ছুরিটা পকেটে ঢুকিয়ে পিস্তলটা ওঠালো, চেনা গ্রীপটা হাত দিয়ে ধরতেই মনে একরকম শান্তি আসল ওর। ম্যাগাজিনটা একবার বের করে ঢোকালো, স্লাইডটা পেছনে সরিয়ে ইজেকশন পোর্টটা দেখল, রাউন্ড আছে চেম্বারে। সেফটি অন করে ট্রিগারে হালকা আঙুল ছোঁয়াতেই ‘কিরিক’ করে একটা আওয়াজ আর নলের ফুটোর নিচে ছোট্ট একটা সবুজ আলো জ্বলল একবার। যাক! সব ঠিক আছে। হাঁফ ছেড়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি এনে ইলা বললো, “থ্যাংক ইউ”

অবাক চোখে দাঁড়িয়ে ইলার কাজকর্ম দেখছিল ছেলেটা। ওর হাতে একটা বড় গ্লাস, আরেক হাতে একটা থালা। ইলা ওর দিকে তাকাতেই তড়িঘড়ি ওর সামনে রাখল, দেখা গেল গ্লাসভর্তি দুধ, থালায় সাজানো ফল।

“খেয়ে নাও দিদি। আমার লক্ষ্মীর দুধ, খুব মিস্টি! গায়ে বল পাবে”

চুমুক দিল ইলা। সত্যিই বেশ উৎকৃষ্ট! প্যাকেটের দুধে অভ্যস্ত ইলার কাছে এটা অমৃত বলে মনে হচ্ছিল।

এক চুমুকে শেষ করে গ্লাসটা পাশে রেখে সামনে তাকাতেই চারপাশ থেকে হাসির রোল উঠলো! ছেলেটাও যোগ দিল সেই হাসিতে। ইলা কিছু বুঝতে পারছিল না, বারবার নিজের পোশাকের দিকে দেখছিল, তাও ধরতে পারছিল না হাসির কারণ।

কিছুক্ষণ পর জোর করে হাসি থামিয়ে ছেলেটা বললো কোনোমতে, “দিদি তোমার সাদা গোঁফ হয়ে গেছে!” বলে আবার হাসতে লাগল সে।

লজ্জা পেয়ে জ্যাকেটের হাতা দিয়ে তড়িঘড়ি মুখ মুছল সে। হাসিগুলি ধীরে ধীরে কমে এলো।

“তুমি আমায় কিভাবে..মানে আমি তো..” ইলা পুরো কথাটা শেষ করতে পারল না, তার আগেই ছেলেটা প্রচন্ড খুশীতে হাততালি দিয়ে বললো, “তুমি আমাদের ভাষায় কথা বলছো! কি মজা!”

কিছু না বলে একটা আপেলের টুকরো মুখে দিল ইলা, প্রচন্ড মিষ্টি! থালায় সাজানো কিছু ফল চিনতে পারল না সে।

“কাল জোরে আওয়াজ পেয়েই ভয় পেয়ে যায় সবাই, তারপর শুনতে পায় দুপেয়ে নেকড়েটার ডাক! আমি চুপিচুপি গিয়ে দেখতে পাই তোমায়, হাতে ভাগ্যিস শাঁখ ছিল, ওই আওয়াজ শুনলেই পালায় সে। তুমি কি করতে গেছিলে ওখানে পবিত্র ফুলের কাছে? ওই নেকড়ে যুগ যুগ ধরে ওই ফুল পাহারা দিয়ে আসছে”

‘পবিত্র’ শুনেই ইলা কিছু বললোনা, ফল চেবাতে চেবাতেই বললো, “আমাকে বাঁচালে কিভাবে? আমি তো….”

“তুমিতো অজ্ঞান হয়ে শুয়েছিলে, অনেক কষ্ট হয়েছে তোমায় উপর থেকে এখানে নিয়ে আসতে” দাঁত বের করে বললো ছেলেটা।

“কি? শুধু অজ্ঞান? আর কিছু না?” ইলা অংক মেলাতে পারছিল না। কাল ও শুধু অজ্ঞান হয়ে ছিল না, ছেলেটা মজা করছে নাতো?

“হুঁ! তোমার সারা গা শুধু রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, ওটা ওই নেকড়েটার হবে”

বিশ্বাস না হলেও করতে বাধ্য হলো ইলা, জ্বলন্ত উদাহরণ তো সে নিজেই। কাঁধ টিপে টিপে দেখল ব্যথা আছে কিনা, নেই, শুধু জ্যাকেটের ফুটোগুলো কাল রাতের সাক্ষ্য বহন করছে। গাছের কথা মনে আসতেই উঠে দাঁড়িয়ে চেন টেনে জ্যাকেটটা খুলতেই চারপাশে সম্মিলিত এক আওয়াজ উঠলো, সামনে বসা ছেলেটা দুহাত চোখে দিল।

সাথে সাথেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারল ইলা। এটা অন্য জগৎ! পেছন ঘুরে দাড়িয়ে চেন আটকানোর পূর্বে দেখল পেটের কাছে সাদা টপটা ছেঁড়া, শুকনো রক্তে মাখামাখি, অথচ কোনো ক্ষতস্থান বা ব্যথা নেই।

“তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ?”

পেছনে ফিরে দেখল সবকটা চোখ এখনও ওর দিকে স্থির হয়ে আছে। প্রশ্নটা করেছে লাল শাড়ি পরিহিতা এক মহিলা। ইলা কি বলবে মাথায় এলোনা, ভবিষ্যত বললে পাগল ভেবে মারধোর দেওয়াও বিচিত্র নয়! এমনিতে ওর লাল কালো পিক্সি কাট হেয়ারস্টাইলে সবাই বিদেশি ভাবছে ওকে। কিছু একটা বলতে হবে তাড়াতাড়ি।

“ফিউচার দেশ” কিছু না পেয়ে বলে ফেলল সে।

“কোন দেশ? সেটা কোথায়?”

“ফি-উ-চা-র দেশ” ভেঙ্গে বললো ইলা। “সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে আমার দেশ” পিস্তলটা কোমরে গুঁজে খাটিয়ায় বসে বলল ইলা।

“তোমার নাম কি?”

“ইলা, তোমার?”

“সুবর্ণ, ও আমার বোন সুবর্ণা” পাশে দাঁড়ানো একটা ছয়-সাত বছরের বাচ্চা মেয়েকে দেখিয়ে বললো সে।

“সু-হোয়াট?”

“সোহাত না গো দিদি, সুবর্ণ” হেসে বললো সুবর্ণ।

“তোমার বাবা-মা?”

“কেউ নেইগো দিদি, বাবা মা দুজনেই দুবছর আগে নেকড়েটার আক্রমণে মারা যায়। বাড়িতে আমি একাই বোনকে নিয়ে থাকি”

এমন সময় হইহই একটা আওয়াজ, সাথে সাথে ওদের চারপাশটা খালি হয়ে গেল! বাচ্চাদের নিয়ে মহিলারা লুকোলো ঘরের ভেতর, পুরুষেরা লুকোলো ক্ষেতের ফসলের আড়ালে। একা খাটিয়ায় বসে থাকল ইলা আর মাটিতে সুবর্ণ। ওর বোনটাও পালিয়ে গেছে।

দূরে একটা ধূলোর ঝড় দেখা গেল, ধীরে ধীরে এলো সেটা কাছে। দুজনের সামনে এসে থামল পাঁচজন ঘোড়সওয়াড়, একটা বড় ঘোড়ায় টানা গাড়ি, গাড়ির ওপর একটা সম্পূর্ণ লোহার বাক্স!

সামনের ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামল একজন সৈন্য। মাথায় পাগড়ি মতো, বুকে সোনালী বর্ম, সোনালী ধুতি। কোমরে ঝুলছে এক বিশাল তরোয়াল। নেমে এগিয়ে আসল ওদের দিকে, বাকিরা ঘোড়াতেই থাকল। ইলা ওদিকে না দেখে ব্যাগ থেকে একটা ছোটো ইয়ারপিস বের করে কানে লাগালো, কাজ না করার সম্ভাবনাই বেশি তাও চেষ্টা করা যাক।

“আমাদের কাছে খবর আছে কাল রাতে এক বিদেশিনী আক্রমণ করেছে আমাদের রাজ্য। মহারাজের আদেশে আমরা তাকে খুঁজছি”

জবাবে সুবর্ণ কি বললো শোনা হলোনা ইলার, কারণ ঠিক তখনই ওর ইয়ারপিসে বেজে উঠেছে বৈজ্ঞানিকের কন্ঠস্বর, “হ্যালো মাই সুইট থিফ! ভেবেছিলাম হারিয়েই ফেলেছো এটা, তারপর বলো কেমন আছো?”

“শাট্ ইয়োর মাউথ! আমাকে এসব ভয়ানক জানোয়ারের ব্যাপারে বলোনি কেন? আর লেসার গান কোথায়?”

“ও কি বলছে? কার সাথে কথা বলছে? ডাইনি নাতো?” ইলার চিৎকারে ভড়কে গিয়ে বললো সৈন্যটা।

“আস্তে আস্তে ডার্লিং! সবই বলতাম, তোমার লোকেরা যদি বাজে সময়ে চলে আসে কি করব বলো রাইফেলটাও ফেলে গেছ…কত টাকা খরচ হয়েছে জানো সব সারাতে?” বৈজ্ঞানিক নিস্পৃহ গলায় বললেন।

“ওরা আমার লোক না”

“সেতো আমার জানার কথা নয় বলো। তবে কাল আরো একটা কথা বলা হয়নি, কাল যে তুমি সফল হওনি বোঝাই যাচ্ছে! তো তোমার হাতে সময় নেক্সট পূর্নিমা পর্যন্ত, তার পরেরদিন সন্ধ্যের মধ্যে না ফিরলে পোর্টাল বন্ধ হয়ে যাবে চিরকালের মতো, নতুন পোর্টাল একই জায়গায় বানানো সম্ভব কিনা বলা যাচ্ছে না! টাইমের মধ্যে ফুল নিয়ে ফিরলে অটোমেটিক টাকা ট্রান্সফার হয়ে যাবে আমার ঘরের মেঝেতে পা রাখলেই। আর..তার আগে যদি ফেরো ফুল ছাড়া, আই অ্যাম সরি টু সে, তোমার লোকেরাই দাঁড়িয়ে থাকবে বাথটব ঘিরে” এটুকু বলে চুপ করলেন বৈজ্ঞানিক।

“ইউ সন অফ আ…আহ্ কি হচ্ছে?” বলতে বলতেই দেখল একজন সৈন্য তার হাতদুটো জড়ো করে শেকলের বেড়ি বেঁধে দিল, অপরজন বেঁধে দিল পায়ে!

“মহারাজের আদেশে তোমায় বন্দি করা হলো বিদেশিনী”

“আহ্ বুঝতে পারছি তুমি ব্যস্ত, ওকে হ্যাভ ফান, চিন্তা করোনা হেল্প করবো” আর কিছু শুনতে পেলো না ইলা।

ধাক্কা মারতে মারতে তাকে লোহার বাক্সটায় ঢোকানো হলো।

সাথে সাথেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। ভেতরটা অত্যন্ত নোংরা, শুধু মেঝের ওপর কিছু বিচালি রাখা এক কোণে বসে সুবর্ণ। মিটিমিটি হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে।

“তোমার আবার কি হলো?”

“তোমাকে আশ্রয় দেবার শাস্তি” নোংরা ফতুয়াটা খুলে কোমরে বাঁধল সে।

মাথা নেড়ে হাত-পায়ের শিকলগুলো দেখল ইলা। হাত ও পা থেকে মোট চারটে শিকল এসে জড়ো হয়েছে ওর কোমরে জড়ানো আরেকটা শিকলের সাথে, বড় একটা তালা মারা। এই তালা খোলা ওর কাছে কোনো ব্যাপার না, লকপিক যন্ত্র ওর সাথেই আছে!তাও দেখা যাক কি হয় ভেবে কিছু করলোনা। বাক্সটার মধ্যে একদিকে পাশাপাশি দুটো ছোটো জানলার মতো খোপ, তা থেকে সূর্যের আলো এসে পড়ছে ভেতরে। কাঁচা রাস্তার ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা, গত একমাসের খাবার বেরিয়ে আসবে এমন মনে হচ্ছিল তার। উঠে হাঁটু গেড়ে বসে খোপের ভেতর মুখ রাখল, বাইরে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, অদ্ভুত পোষাকে নারী-পুরুষেরা ব্যস্ত কৃষিকাজে, পশুপালনে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা খেলাধুলায় মগ্ন। পাশ দিয়ে মাঝেমাঝেই ছুটে যাচ্ছিল ঘোড়া, তাতে চেপে হয় সৈন্য নয়তো জমকালো পোশাকে কেউ! দেখল অজানা কিছু পশু, পাখি, গাছ! বিহ্বল হয়ে দেখছিল ইলা! চোখের সামনে যেন মেডিইভাল সিনেমা চলছে। শুধু ভাবছিলো সে কত সহজ সরল এদের জীবন, কত সুখী মনে হচ্ছে এদের দেখে।

“কি দেখছ দিদি?” সুবর্ণ পাশের খোপে মুখ রেখে বললো।

“তোমরা কত ভালো আছো এই জগতে” না তাকিয়ে বললো ইলা।

“আমরা? নাগো! রাজার সৈন্যরা সব কেড়ে নেয়, আগুন লাগিয়ে দেয় ফসলে। কিছুদিন আগে ভয়ানক যুদ্ধ হলো, আবার হবে নাকি শুনেছি। ওই দেখো সৈন্যের দল!”

ওদের গাড়ির পাশেই সারি সারি সৈন্য টহল দিচ্ছে, গাড়ি এগোতে লাগল আস্তে আস্তে সৈন্যদের মাঝখান দিয়ে।

“ওগুলো কি?” দূরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ইলা।

শব্দ করে হেসে উঠলো সুবর্ণ। “ওগুলো কুঁড়েঘর গো! ওপরে খড়ের চাল, আমরাও থাকি”

সুবর্ণের দিকে তাকিয়ে হাসল ইলাও।

“আচ্ছা তোমার যে দেশ, সেই দেশে সবার চুলই কি তোমার মত এরম লাল-কালো?” হাওয়ায় উড়তে থাকা ইলার চুলের দিকে তাকিয়ে বললো সুবর্ণ, “আমাদের এখানে যত বিদেশি আসে সবার চুল হয় কালো নয় সাদা, বড় বড় পাগড়ি, ইয়া বড় দাঁড়ি”

“নাহ্ আমার চুল কালোই, এটা হাইলাইট করা” হেসে বললো ইলা।

না বুঝেই মাথা নাড়ালো সুবর্ণ। কিছুক্ষণ পর আবার ইলা একটা বড় স্থাপত্যের দিকে দেখিয়ে বললো, “ওটা কি গো?”

বড় ইঁটের তৈরী স্থাপত্য, প্রায় অর্ধচন্দ্রাকার, জায়গায় জায়গায় বড় বড় প্রকোষ্ঠ, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।

“ওটা? ওই যে ওপরে, ওটা বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর, নীচে বড় শিবমন্দির, আগে বৌদ্ধরা থাকত নাকি! শিবরাত্রির দিন এসো কখনো, খুউব বড়ো মেলা হয়, নাগরদোলা, পাঁপড়ভাজা, খুব মজা হয়”

ইলা ছোটোবেলায় শুনেছে বেহুলা-লখিন্দরের গল্প অডিওবুকে। তবে এভাবে চোখের সামনে দেখবে ভাবেনি। যতক্ষণ না স্থাপত্যটা চোখের আড়াল হলো, দেখে গেল সে মুগ্ধদৃষ্টিতে।

একটু পর গাড়ির গতি কমতে শুরু করলো! তাকিয়ে দেখল গাড়িটা একটা পাথরের সরু রাস্তার ওপর দিয়ে যাচ্ছে, তার নিচে নদী। “করতোয়া নদী” বললো সুবর্ণ।

“ওটা কি? মাছ?” দূরে নদীর দিকে দেখিয়ে বললো ইলা।

“না গো, ওটা মাছ না, একটা নৌকা! ওতে করেই শাহ সুলতান নামে একজন এসেছেন তোমার মত বিদেশ থেকে, ওর সাথেই তো যুদ্ধ হলো কদিন আগে। আবার হবে নাকি শুনছি”

এমন সময় পেছনের দরজাটা খুলে গেল। দরজার সামনে উদ্যত বর্শা হাতে দুজন।

“চুপচাপ চলো, মহারাজ তোমাদের অপেক্ষায় আছেন”

নামার পর একটা মৃদু ধাক্কা খেয়ে এগোতে লাগল দুজন, ঝনঝন করে আওয়াজ হচ্ছে সামান্য হাত পা নাড়াতেই। সামনে দুজন, পেছনে তিনজন সৈন্য। “এরা কি করবে আমাদের নিয়ে?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো ইলা।

“জানিনা, হয় ফাঁসি নয়তো চিরকাল হাজতবাস, দোষ কম হলে একশ বার বেত্রাঘাত”

ঢোক গিলল ইলা।

ঘড়ঘড় আওয়াজ করে সামনের বড় দরজাটা খুলে গেল। সিংহদরজা পেরিয়ে ওরা ঢুকল প্রাসাদচত্বরে।

মুগ্ধদৃষ্টিতে চারিদিকে দেখছিল ইলা। এখনও মনে হচ্ছে স্বপ্নের ঘোরে আছে সে। হঠাৎ সুবর্ণর ঠেলায় চটকা ভাঙল। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো, “ওই যে অমর কূপ, এর জল খেলে মরা মানুষ বেঁচে ওঠে!”

একটা সাধারণ কুয়ো! এর জল খেলেই মরা মানুষ জেগে ওঠে? অবিশ্বাসভরা দৃষ্টি নিয়ে দেখতে দেখতে খেয়াল করলো আশেপাশের সৈন্য, বাগানের মালী, দাসীবাঁদিরা সবাই অবাক চোখে দেখছে ওকে, এক অদ্ভুত পোষাকের নারীকে।

বড় বড় চোখ দিয়ে বিশাল রাজপ্রাসাদটা গিলতে গিলতে একসময় চওড়া সাদা পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠলো তারা। লম্বা করিডর দিয়ে হাঁটতে লাগল তারা! পাশে পরপর দাঁড়ানো সৈন্য। শেষে আর একটা ধাক্কা দিয়ে দুজনকে সভার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। শিকলের আওয়াজ করতে করতে দুজনে দাঁড়ালো সভার মাঝে। দুদিকে দাঁড়ানো জনাদশেক ভারী বর্ম পরা কজন সৈন্য। সামনে সিংহাসনে বসে এক পেশিবহুল ব্যক্তি, মাথায় মুকুট, দাঁড়িগোফ সম্বলিত জ্বলন্ত চোখ। সাজপোশাক দেখে ইলার ওর স্কুলের থিয়েটার দলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল! সোনালী ধুতি, সোনালী খাটো কুর্তামতোন, সোনালী কোমরবন্ধনী, পায়ে নাগড়াই জুতো। দুপাশে দুই দাসী বড় পাখা দিয়ে হাওয়া করছিল। রাজার আশেপাশেও কয়েকজন প্রায় ওইরকম পোশাকে তাকে জরিপ করছিল। একপাশে ঝলমলে শাড়ি পরিহিতা এক মহিলা, বিষন্ন দৃষ্টি।

চোখের ওপর পড়া চুলগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেখছিল ইলা দেখছিল সবাইকে। রাজার চোখ দেখে মনে হচ্ছে এখুনি ধ্বংস করে দেবেন। কি করবে এরা ওকে নিয়ে? ফাঁসি দেবে নাকি গলা কাটবে ভাবতে ভাবতেই দেখল জ্যাকেটে টান পড়েছে, তাকিয়ে দেখে সুবর্ণ এক হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নিচু করে আছে, ইলার জ্যাকেট টেনে ওকেও তাই করতে ইশারা করছে।

চোখ ওল্টালো ইলা। “ওহ্ গড্” বলে সুবর্ণকে দেখে এক হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করলো।

“মহারাজকে অভিবাদন না জানিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো বেয়াদব নারী? সভ্যতা ভদ্রতা কিছু নেই তোমার দেশে?” চিৎকার করে বললো একজন।

চুপ করে থাকল দুজনেই।

“উঠে দাঁড়াও” গম্ভীর গলায় বললেন মহারাজ পরশুরাম।

উঠে দাঁড়িয়ে আবার চোখের ওপর পড়া চুলগুলো ফুঁ দিয়ে সরালো।

“কোন দেশ থেকে এসেছ তুমি?”

“ফিউচার দেশ” ইলা বলার জন্য মুখ খুললেও উত্তর দিল সুবর্ণ।

“পুন্ড্ররাজ্যে অনধিকার প্রবেশ করেছ তুমি বিদেশিনী। কারণ দর্শাও”

“ওই নেকড়েমানব কে মারতে” আবার বললো সুবর্ণ! ইলার ভয় হলো এই না ওর গলা কাটে।

“কি?” কয়েকজনের চাপা হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল।

“ইয়েস..মানে হ্যাঁ” এবার বললো ইলা।

“কেন? ও তো আমাদের কোনো ক্ষতি করেনা” মহারাজের গলা।

“আজ্ঞে না মহারাজ, প্রতি পূর্ণিমার শেষ প্রহরে ও নেমে আসে সমতলভূমিতে, চোখের সামনে কাউকে দেখলেই তুলে নিয়ে যায়, সকালে উঠে তার রক্তমাখা কাপড় ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না” মাথা নিচু করে বললো সুবর্ণ।

“এই খবর এই বিদেশিনী কিভাবে পেল? তুমি সুলতানের চর!” আরেকজন বললো।

আবার চোখ ওল্টালো ইলা।

 “আগে বলো তো মেয়ে তোমার দেহে এসব কি?” মহারাজ হঠাৎ বলে উঠলেন, অনেকক্ষণ ধরেই তিনি ইলার জ্যাকেটের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা পিস্তলের দিকে তাকিয়েছিলেন।

“ও এগুলো! দিস ইজ..মানে এটার নাম ট্যাকটিক্যাল প্যান্ট, এটা হুডেড জ্যাকেট, এটাকে বলে বুট, এটা আপনারা জানেন, আর এটা? কোল্ট ডেল্টা এলিট টেন এম….ছাড়ুন.. পাতি কথায় অস্ত্র!”

“অস্ত্র?” মুখে হাত দিয়ে হাসতে শুরু করলেন দোর্দন্ডপ্রতাপ মহারাজা পরশুরাম! সাথে যোগ দিল তার সভাসদ, মন্ত্রী-অমাত্যগণ! সেই হাসি ক্রমে অট্টহাসিতে পরিণত হলো।

হাসল ইলাও! শুধু পিস্তল সহ দুই হাত পিছনে নিয়ে স্লাইডটা টানল একবার!

কোনোরকমে হাসি চেপে বললেন মহারাজ, “ওইটুকু জিনিস অস্ত্র? তলোয়ার, তীরের থেকেও বিপজ্জনক?”

“ইয়েস…মানে হ্যাঁ”

“প্রমাণ দিতে পারবে?”

“অবশ্যই”

 “পেছনে তাকাও, কোণের মাটির ফুলদানিটার উপরাংশ ছেদ করে দেখাও যেমন তরোয়ালে করা হয়”

“পুরো ফুলদানিটাই যদি মাটিতে মিশিয়ে দি?” গর্বভরে বললো ইলা ফুলদানির দিকে তাকিয়ে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ, ফিসফিস আওয়াজ, তারপর মহারাজ বলে উঠলেন, “তবে তাই হোক, দেখাও তোমার অস্ত্রের ক্ষমতা”

বেশি কিছু করতে হলো না ইলাকে, এসব তার কাছে জলভাত! সোজা হয়ে কোমরসহ ডান পাটা এগিয়ে দুহাতে পিস্তলের গ্রীপ ভালোভাবে ধরে ফ্রন্ট সাইটে চোখ রেখে ওয়েভার স্টান্সে দাঁড়ালো সে। জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে ট্রিগার টিপল একবার! প্রচন্ড জোর আওয়াজ আর সুন্দর ফুলদানিটা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো মাটিতে।

ঠং করে নিশ্চুপ সভায় শুধু কার্তুজের খোল পড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল!

পুরো এক মিনিট ধরে গোটা সভা চুপ! চোখ বড় বড় করে সবাই দেখছে পিস্তলটাকে। একজন নিচু হয়ে খোলটা তুলতে গিয়ে ছ্যাঁকা খেয়ে আঙুল ঘষতে লাগল ধুতিতে।

খানিক পর রাজা গলাখাঁকারি দিলেন,

“ওই অস্ত্র আমার চাই”

“এটা আপনি ব্যবহার করতে পারবেন না” জোর করে ঠোঁটের কোণায় হাসি এনে বললো ইলা! টের পেলো একটা ভয় দলা পাকিয়ে উঠছে তার দেহের ভেতর। পাকামি করে পিস্তলটা না বের করলেই হতো।

“মহারাজের কথার বিরুদ্ধে কথা বলছ? এত বড় সাহস? বেহায়া নারী! মহারাজ, আপনি আদেশ দিন ওকে বেঁধে জ্যান্ত পোড়ানোর। ও আসলে ডাইনি! রাজ্যের ক্ষতি করতে এসেছে, বামহাতে অস্ত্র ধরে, ওইরকম জাদুঅস্ত্র, উদ্ভট পোশাক, সাক্ষাত্ শয়তান, এ ডাইনি না হয়ে পারেনা, আপনি আদেশ দিন মহারাজ” মাথা ঝুঁকিয়ে ইলার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললো একজন।

সুবর্ণ মাথা নিচু করে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে ইলা পিস্তলটা আরো শক্ত করে ধরল। ধরতে আসলেই কয়েকটাকে শুইয়ে পালাতে হবে। জনপ্রতি কতগুলো বুলেট লাগবে হিসাব কষছিল এমন সময় একজনের আওয়াজ শোনা গেল,

“মহারাজ, আমার কিছু বলার আছে”

“বলুন”

ইলা তাকিয়ে দেখল রাজার থেকেও পেশিবহুল অত্যন্ত লম্বা একজন এগিয়ে আসল ওর দিকে, মোটা গোঁফ, ঘন দাঁড়ি, মাথায় মুকুট, হিংস্র চোখদুটোর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না। লোকটা ইলার একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালো। ওর সামনে ইলাকে ছোট বাচ্চামেয়ে মনে হচ্ছিল।

“আমার নাম বারীন্দ্রকুমার! পুন্ড্ররাজ্যের নবনিযুক্ত সেনাপতি” ইলার দিকে তাকিয়ে বললো সে! লোকটার চোখদুটো কেমন অস্বাভাবিক রকমের লাল!

“আমার প্রস্তাব এই যে, বিদেশিনী যেহেতু নেকড়েমানবটাকে মারতে এসেছে, ওকে সুযোগ দেওয়া হোক। এই কটা দিন বালকের বাড়িতেই কাটাবে, রাজ্যের সীমানার বাইরে যেতে পারবেনা। নেকড়েমানবটাকে মারতে পারলে পুরস্কার দেওয়া হবে আর না পারলে..” ইলার দিকে চেয়ে রহস্যজনক হাসি হাসল বারীন্দ্রকুমার।

“অতি উত্তম। জন্তুটাকে মারতে পারলে দুটি স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার। সভা আজকের মতো শেষ! বাঁধন খুলে দেওয়া হোক” বলে রাজা উঠে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে গেলেন, তার পেছন পেছন বাকিরাও। বারীন্দ্রকুমার ইলার দিকে আরেকবার হেসে চলে গেল আড়ালে, পেছন পেছন সৈন্যরা।

ফাঁকা কক্ষে দাঁড়িয়ে রইলো ইলা আর সুবর্ণ।

তৃতীয় অংশ-

পর্ব-৪

দেখতে দেখতে পূর্ণিমা চলে আসল কাছে। ইলার খুব একটা খারাপ কাটলোনা এতদিন। খাঁটি খাবার, খাঁটি দুধ-ঘি-মাখন, ফলমূল খেয়ে, টুকটাক কাজকর্ম করে বেশ আরামেই ছিল সে। প্রস্তুতি সে তেমন কিছুই নেয়নি, ওই বিরাট জানোয়ারের সাথে শক্তিতে পেরে উঠবে না। একমাত্র শুধু রোজ কাকভোরে উঠে কয়েক মাইল দৌড়াত, আশেপাশের লোকজন যথারীতি অবাক হয়ে চেয়ে থাকত ওর দিকে। একটাই অসুবিধা হতো ওর-স্নানের সময়!চিরকাল চার দেওয়ালের মাঝে স্নান করা ইলা চোখ তুলে তাকাতে পারতনা যখন পুকুরে নামত, যদিও সেটা শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য, তবুও। কাল পূর্ণিমা, কালই যা করার করতে হবে। বৈজ্ঞানিক মাঝে মাঝে কথা বলেন ওর সাথে, বলেছেন এই রাজ্যের ইতিহাস অর্থাৎ পরশু কি হতে চলেছে এখানে, আর একটা কাজের কথা বলেছেন, সেটা অবশ্য ইলাও জানত, কিভাবে নেকড়েমানবটাকে মারা যাবে। সেইমতো রাতের খাওয়াদাওয়ার পর কুঁড়েঘরের সামনে খাটিয়ায় বসে কাজ করছিলো ইলা, যদিও সে নিশ্চিত না কাজ হবে কিনা। ওর সামনে এক বড়ো পাত্রে রাখা সাতাশটা রূপোর বুলেট, বুলেটগুলিকে এক এক করে তিনটে খালি ম্যাগাজিনে ভরছিলো সে। গ্রামের এক স্বর্ণকারের সাহায্যে এটা সম্ভব হয়েছে। গোটা গ্রাম ইলার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওকে সাহায্য করেছে। যেকোনো মূল্যে জানোয়ারটাকে মারতে হবেই। নেকড়েমানব বা ওয়্যারউলফদের একমাত্র দুর্বলতা হলো রূপো। একটা বিষয়ে ওরা নিশ্চিত জানোয়ারটা সাধারণ ওয়্যারউলফ্, লাইক্যানথ্রোপ না! লাইক্যানথ্রোপ হলে পূর্নিমা ছাড়াও অন্যদিন দাপিয়ে বেড়াত! লাইক্যানদের মারা খুব কষ্টকর! ইলার পাশে বসে কাজ দেখছিল সুবর্ণা। ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হাসলো ইলা। এখানে আসার পর থেকে তাকে কোনো কথা বলতে শোনেনি সে, এমনকি দিনের বেলা সুবর্ণ মাটি কাটার কাজে গেলেও। শুধু তাকিয়ে থাকে। গাল টিপে আদর করলেও কিছু না বলে হাসে নয়তো লজ্জা পেয়ে পালায়। সুবর্ণার নাকটা ধরে আদর করে দেবে ভেবে ওকে ডাকতে যেতেই হঠাৎ ঝুপ করে ইলার পাশে কয়েকটা রূপোর তীর রাখল সুবর্ণ।

“এসব আবার কি?”

“কাল আমিও যুদ্ধে যাবো” উজ্জ্বল মুখে বললো সুবর্ণ।

“সেকি? না না ভাই তা হয়না, এ বড় ভয়ংকর যুদ্ধ” জোরে মাথা নাড়িয়ে বললো ইলা।

“তুমি আছোতো, আমি শুধু আড়ালে থাকব, তোমাকে প্রয়োজনে সাহায্য করতে পারব” ইলার পাশে বসে বললো সে।

ইলা ভাবল বেশ কিছুক্ষণ। বাচ্চা ছেলেটাকে বিপদের মুখে ঠেলে ফেলা যায় না কিন্তু সুবর্ণ আড়াল থেকে যদি কভার করে কাজ হতে পারে, রাস্তাঘাট চিনবে ভালো, পালাতে সুবিধা হবে কোনো গড়বড় হলে।

সুবর্ণর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল সে, “কথা দাও আড়াল ছেড়ে বেরোবে না?”

“হুঁ এই দেখো তোমায় ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম” ইলার বাম কাঁধ ধরে বলল সে।

ইলা হেসে দিল ওর কান্ড দেখে।

“আচ্ছা, দিদি এটা কি?” ওর ডান হাতে কবজির ঠিক ওপরে নীল প্রজাপতির উল্কি দেখিয়ে বলল সুবর্ণ।

“ট্যাটু… মানে উল্কি”

“আমায় বানিয়ে দেবে? দুটো টিয়াপাখি, আমি আর বোন”

“তোমরা দুটো পাখি?” হেসে দিল ইলা। “আচ্ছা, কাল দেবো বানিয়ে”

“দিদি, তুমি কালই চলে যাবে তাইনা?”

“হুম্” আর কি বলবে বুঝল না সে, এই কদিনে সুবর্ণকে নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবেসে ফেলেছে সে।

“আর আসবেনা? শিবরাত্রিতে তোমায় মেলা ঘোরাব বলেছিলাম, আসবে তখন? তুমি দেখো বোনের বিয়ে দিয়ে আমিও যাবো তোমার দেশে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে” স্বপ্নালু চোখে বললো সুবর্ণ।

ইলা শুধু হাসল, কিছু বললো না, ব্যাপারটা সত্যি হলে কি ভালোই না হতো! ইলার নিজের বলতে শুধু এক দাদা, বাবা-মা মৃত। তবে দাদার সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। ওর দাদা ক্যাল সিটির জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের খুব উঁচু পোস্টে আছে, কোন পোস্ট জানেনা ইলা। তিনবছর আগে প্রিসন সাইটে ইলাকে দেখেছিল একটা কাঁচের বাক্সের মধ্যে বসে থাকতে, প্রথম কাজ ছিল ইলার সেটা, সেটাই শেষ দেখা দুজনের! তারপর থেকে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি বোনের সাথে। ইলা চেষ্টা করলেও কোনো ফল পায়নি, সেই থেকে ইলা একাই থাকে ওর অ্যাপার্টমেন্টে। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছে সে।

আনমনে এসবই ভাবছিলো সে। হঠাৎই চটকা ভাঙল সুবর্ণের কথায়।

“তুমি খুব ভালো জানো দিদি” ইলার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো সুবর্ণ।

“তাই?” হেসে সুবর্ণর কাঁধে হাত দিয়ে কাছে টেনে ওর মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে বললো, “চলো ঘুমানো যাক ভাই, অনেক রাত হয়েছে, সুবর্ণা আসো”

জিনিসপত্র গুছিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল তিনজনে। এখন শুধু অপেক্ষা কালকের।

* * *

পরেরদিন বিকেল, সূর্য সবেমাত্র অস্ত গেছে, অন্ধকার হতে বেশি দেরী নেই, পাখিরা বাসায় ফিরছে দলে দলে, রাখালবালকেরা ঘরে ফিরছে পশু নিয়ে অপরদিকে জঙ্গলের মধ্যে গাছের ডাল ধরে ধরে পাহাড়ে উঠছে ইলা, কাঁধে ব্যাগ, পেছনে তীরধনুক হাতে সুবর্ণ, মাঝেমাঝেই হাত উল্টে ওর কাঁধের নিচে আঁকা উল্কিটাকে দেখছিল গর্বভরে।

“দিদি, একটু আস্তে!” গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো সুবর্ণ।

“তাড়াতাড়ি, ফুলটা ফুটে গেলেই তুলতে হবে! জানোয়ারটার আসার আগেই” হেসে বললো ইলা।

যখন ওরা পৌঁছালো, তখন অন্ধকার নেমে এসেছে, সাবধানে পা দিয়ে উঠে এলো দুজনে। ফুলগুলো ফুটে আছে যথারীতি, ঝর্ণার জল ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে, আজও মিষ্টি সুবাসে পরিবেশটা ভরে আছে। চারিদিকে যথারীতি কঙ্কাল-হাড়গোড় ছড়ানো। পচা গন্ধটা আজ একটু কম।

দূরে একটা গুহা মতো, জন্তুটা নাকি ওখানেই থাকে। ভাবতে ভাবতে এগোনো শুরু করলো ইলা, পেছনে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সুবর্ণ। আকাশে দেখা দিল গোলাকার চাঁদ। জঙ্গলের ওপর ছড়িয়ে পড়ল চাঁদের আলো।

কিন্তু একি! হঠাৎ কাঁধে কিসের যন্ত্রণা? ইলা অস্ফুটে আর্তনাদ করে উঠলো, পেটেও কেমন একটা ব্যথা মোচর দিয়ে উঠলো! ধীরে ধীরে বাড়ছে যেন।

“দিদি কি হয়েছে? কষ্ট হচ্ছে? এরম করছো কেন?” সুবর্ণ আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল।

“কিছু না, কিছু না! তুমি ওখানেই থাকো। আমি ঠিক আছি” কোনোরকমে বলে কাঁধ চেপে ধরে ফুলগুলোর দিকে এগোলো ইলা। ব্যথাটা সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ছে। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না বেশিক্ষণ। দাঁতে দাঁত চিপে কোনোরকমে জলের ওপর পাথরে পা রেখে হাত বাড়াতেই কানে এলো আগেরদিনের সেই চাপা গর্জন, তার সাথেই আরো দুটো শব্দ কানে এলো তার। শেষটা কেমন আর্তনাদের মতো শোনাল তার কানে। চকিতে হাতের প্যাকেট ফেলে পিস্তল বের করে ঘুরল সে, তাকিয়ে যা দৃশ্য দেখল তাতে আবার পিস্তল হাত থেকে পড়ে যাবার মতো অবস্থা হলো! তবে এবার আর ফেললো না সে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে সুযোগ খুঁজতে থাকল ট্রিগার টেপার।

জন্তুটার পিঠে গাঁথা একটা তীর! সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে একহাতে তুলে ধরেছে সুবর্ণর ঘাড়সহ গোটা শরীরটা। সুবর্ণ মনেহয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, নড়াচড়া করছেনা। ইলার চোখের পলক পড়ার আগেই সুবর্ণর মাথা ঢুকে গেল জন্তুটার মুখে! বেশ কয়েক সেকেন্ড কচরমচর শব্দ করে চেবানোর পর মাথাহীন সুবর্ণের দেহটাকে ছুঁড়ে ফেলল! পাহাড়ের ঢাল দিয়ে গড়াতে গড়াতে দেহটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

জন্তুটা এবার মুখ ফেরাল ইলার দিকে।

ঘটনার বিভৎসতায় হতবাক হয়ে গেছিল ইলা। কিছু করার শক্তি ওর শরীর থেকে বিদায় নিয়েছিল। জন্তুটার ভারী পায়ের সংস্পর্শে মাটির কাঁপুনিতে সম্বিৎ ফিরল ওর। “না এটা হতে পারেনা, না…নাআআ…ইউ বাস্টার্…” চিৎকার করে নিজের সমস্ত ব্যথা বেদনা ভুলে ফায়ার করতে থাকল ইলা। নবার ট্রিগার টিপে ফাঁকা ম্যাগাজিন ফেলে নিমেষেই জন্তুটার চোখের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে নতুন ম্যাগাজিন বের করে ভরে আবার ফায়ার করা শুরু করলো সে পিছোতে পিছোতে। চোখ জলে ভরে ঝাপসা হয়ে আসছিল! যাকে নিজের ভাই মনে করল এতদিন চোখের সামনে তার এমন পরিণতি! ফুলের কথা আর মনে ছিল না তার। গুলি খেয়ে বারবার জন্তুটা থমকে থমকে গেলেও সামনে এগিয়ে আসছিল।

বুলেট যে শেষ হয়ে গেছে তা ইলার খেয়াল ছিল না, তিনবার ফাঁকা পিস্তল ফায়ার করে যখন বুঝতে পারল তখন বেশ দেরী হয়ে গেছে। স্লাইড লক হয়ে যাওয়া পিস্তলটার দিকে একবার তাকিয়ে নতুন ম্যাগাজিন ভরলো ত্বরিতে, কিন্তু ট্রিগার টেপার সুযোগ হলোনা ইলার! বুড়ো আঙুল দিয়ে স্লাইড লক লিভার টেনে স্লাইড পূর্বের জায়গায় নিয়ে আসতেই লোমশ হাতটা ইলার গলা ধরে তুলে ফেলল মাটি থেকে, কোনোরকম আওয়াজ বের হওয়ার পূর্বেই নখগুলো বসে যেতে থাকল ওর গলার নরম মাংসে! সেই মুহুর্তে ইলা আবার টের পেলো ওর কাঁধের অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে।

অতিচাপে ইলার গলার অবস্থা খুবই শোচনীয়, শ্বাস ক্রমশ আসা বন্ধ করে দিচ্ছিল। হাওয়ায় দুই পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে হাত দিয়ে বৃথাই লোমশ হাতটাকে থামানোর চেষ্টা করছিলো সে। জন্তুটা মনেহয় ইলাকে নিয়ে খেলতে চাইছিল। ইলার বিস্ফারিত চোখের সামনে সে নিয়ে আসল অপর হাতটা, চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠলো নখগুলো। আস্তে আস্তে কোমরের অনেক গভীর পর্যন্ত নখগুলো ডুবিয়ে শ্বাদন্তদুটো দিয়ে ইলার গালে ঘষে ঘষে রক্তাক্ত করে দিল, তারপর ধীরে ধীরে যেন উপভোগ করছে এমনভাবে জন্তুটা নখগুলো প্রথমে ডুবিয়ে দিল ইলার কপালে, তারপর ওই অবস্থাতেই নখগুলো টেনে আনল ইলার চিবুক অবধি! আর্তনাদ করার অবস্থায় ছিলনা ইলা, নিমেষে ওর পুরো মুখ ভরে গেল গরম রক্তের ধারায়। সারা শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে বেয়ে পড়তে লাগল বুট দিয়ে টপটপ করে। অবশেষে জন্তুটা গায়ের জোরে ইলাকে ছুঁড়ে দিল একটা মোটা গাছের কান্ডের দিকে। কান্ডটা ভেঙে ইলা ঢুকে গেল গাছের ভেতর।

গাছের গুঁড়ির ভেতরটা বেশ ফাঁপা! ওর ভেতরেই পড়েছিল ইলা। ওর আর ওঠার শক্তি ছিলোনা, গলা দিয়েও আওয়াজও বের করতে পারছিলোনা, মুখ ভেসে যাচ্ছিল রক্তে!চাঁদের দিকে আধখোলা চোখে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বরণ করে নিচ্ছিল মৃত্যুকে। চোখটা পুরোপুরি বন্ধ করার আগেই সারা শরীরে কেমন একটা অনুভূতি হলো! চোখ খুলল, তেমন অসুবিধা হলোনা, খেয়াল করলো মুখের ব্যথা গায়েব, ভেঙে যাওয়া হাতটা তুলে দেখল অবাক জিনিস, হাত ঠিক হয়ে গেছে! মুখে হাত দিয়ে দেখল কোনো ক্ষত নেই, কোমরেও তাই। গাছের ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে সোজা চাঁদের আলো এসে পড়ছে ওর দেহে। অলৌকিক ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতেই সারা শরীর জুড়ে শুরু হলো প্রচন্ড যন্ত্রণা, এবার অত্যন্ত বেশী।

আর্তনাদ করে উঠলো ইলা। এই ব্যথা অসহ্য! কিছু একটা হচ্ছে ওর শরীরের ভেতর, বারবার জ্ঞান হারিয়ে যেতে চাইছে কিন্তু মারণযন্ত্রণা তা হতে দিচ্ছেনা। কাতরাতে কাতরাতেই আতংকের চোখে দেখল ইলা ওর শরীরে অদ্ভুত এক পরিবর্তন হচ্ছে, ধীরে ধীরে এক অসহ্য টানে পাল্টে যাচ্ছে তার শরীর! রোগা দেহটায় একসাথে ঘটছে অনেক পরিবর্তন!বুঝতে পারল চওড়া হয়ে যাচ্ছে তার কাঁধ, মুখটা এগিয়ে আসছে সামনে, কপাল যাচ্ছে পিছিয়ে, সারা শরীরে জন্ম নিচ্ছে ঘন লোম! একসময় চড়চড় করে ফেটে ছিঁড়ে গেল তার অন্তর্বাস, তারপর শার্টটা!

জন্তুটা অন্যদিকে তাকিয়ে ব্যস্ত ছিল রূপোর বুলেটগুলি বের করতে, ক্ষতস্থান তাড়াতাড়ি পূর্ণ হচ্ছে না, এ নিয়ে চিন্তায় ছিল সে, তাই মেয়েটার আর্তনাদ অতটা কানে নেয়নি। হঠাৎ অন্য একটা আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো সে। তাকিয়ে দেখল মেয়েটা যে গাছের ভেতর ঢুকেছিল সেই গাছের ভাঙ্গা জায়গার ঠিক ওপর দিয়ে চিড় ধরেছে, আস্তে আস্তে চিড়টা উঠতে লাগল ওপরের দিকে। কি হচ্ছে না বুঝে তাকিয়ে থাকল গাছটার দিকে। চিড়টা উঠতে উঠতে একসময় বিকট আওয়াজ করে গাছটা দুভাগ হয়ে গেল আর তার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল এক নেকড়েমানবী। হিংস্র কদাকার তার মুখাবয়ব! তার মুখের দুই কোণে চকচক করছে শ্বাদন্ত! চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠছে আঙুলের নখগুলো। টকটকে লাল চোখ দিয়ে সামনের জন্তুটাকে একবার মেপে নিয়ে চাঁদের দিকে চেয়ে হুংকার ছাড়ল সে চারিদিক কাঁপিয়ে..

আ-উ-উ-উ-উ-উ-উ!

অপর জন্তুটা বুঝে গেছিল কি হতে চলেছে, এর আগে ওর শিকারকে সম্পূর্ণ নিকেশ করেছে, আহত করেনি, তাই নতুন ব্যাপারটায় ধাতস্থ হতে সময় লাগল ওর। এই সুযোগটাই নিল নেকড়েমানবী, তীব্র প্রতিহিংসায় চার পায়ে মাটি কাঁপিয়ে দৌড়ে এলো ওটার সামনে, এসেই প্রচন্ড গতিতে থাবা মারল জন্তুটার মুখে, তারপর আরেকটা, আরেকটা! তারপরেই ওটার দুই কাঁধ ধরে তীরের বেগে পেছনে নিয়ে গিয়ে একটা বড় পাথরের গায়ে ধাক্কা দিয়ে বসালো, সঙ্গে সঙ্গেই জন্তুটার রক্তাক্ত মুখের সামনে মুখ এনে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ছাড়ল হুংকার, ছাড়তেই থাকল!ঠিক প্রথমদিনের মতো, তবে এবার শিকারী পরিণত হয়ে গেছে শিকারে।

ইলার হুংকারের তেজ এতটাই ছিল যে জন্তুটার গলা দিয়ে কুঁইকুঁই আওয়াজ বেরোলো।

এবার শেষ করার পালা!

আরো বারকয়েক থাবার মোক্ষম বাড়ি মেরে মুখটাকে রক্তাক্ত করে অনায়াসে জানোয়ারটার গলায় হাত দিয়ে তুলে নিল মাটি থেকে। কুঁইকুঁই আওয়াজ করতে করতে আকুপাকু করতে লাগল জন্তুটা। ইলা কিছু না করে গলাটা শক্ত করে ধরে হাতের চাপ বাড়াতে লাগল, জন্তুটার জীবন যখন প্রায় শেষের পথে এমনসময়-

চাঁদ ঢাকা পড়ে গেল ঘন মেঘে!

দেহের মধ্যে হাড়গুলির মটমট আওয়াজের সাথে মুহূর্তের মধ্যে দুজনে ফিরে এলো পূর্বের আকারে। গহীন অরণ্যের মাঝে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকল দুইটি সম্পূর্ণ নগ্ন নর-নারী! নিজের আকারে ফিরতে ফিরতে ফিরতে ইলা দেখল ওর বাঁ হাতটা ছোটো হতে হতে সামনের ব্যক্তির গলার শুধুমাত্র নলিটা ধরে আছে!ধাতস্থ হয়ে চেয়ে দেখল ওর সামনে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড পেশিবহুল লম্বা একজন! তার চোখের দিকে তাকিয়েই চিনতে পারল তাকে-

বারীন্দ্রকুমার!

শয়তানের হাসি হেসে বারীন্দ্রকুমার হতভম্ব ইলার হাতটা শক্ত করে ধরে জোরে মুচরে দিল, ইলাকে মুখ খোলার সুযোগ না দিয়ে ডান হাত দিয়ে মুখে মারল এক থাপ্পড়, পরপর তিনটে মার খাবার পরেই ইলা মুখ থুবড়ে পড়লো মাটিতে, মুখ থেকে বেরিয়ে এল রক্তের ধারা। সেই অবস্থায় সে ইলার চুল ধরে দুবার জোরে ঠুকে দিল একটা পাথরে, সাথে সাথেই পেটে কষালো সজোরে দুটো লাথি! তারপরেই একটা চিৎকার করে অবলীলায় ইলাকে মাথার ওপর তুলে ধরে ছুঁড়ে মারল গুহার অন্ধকারে, যাতে চাঁদের আলো একদম না পায়।

পড়েই ইলা হাত দিল মাথায়, টপটপ করে রক্ত পড়ছে। হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো বারীন্দ্রকুমার। মাটি থেকে তুলে নিল পিস্তলটা।

“এক চিনদেশীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর অভিশাপের ফলে এই নেকড়েমানব ব্যাপারটা আমাদের বংশগত ব্যাপার হয়ে গেছে। যুগযুগ ধরে নীলকমল আমরা পাহারা দিয়ে এসেছি। আজ তুই এসে অনেক হিসেব বদলে দিলি! সকালে ভেবেছিলাম তোকে এইরূপে বানিয়ে দুজনে একসাথে রাজ করবো পুন্ড্ররাজ্য। কিন্তু তুই তা হতে দিবিনা বোঝা যাচ্ছে! মরতে হবে তোকে”

প্রশংসার দৃষ্টিতে পিস্তলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল সে। ওর চওড়া হাতে পিস্তলটা খেলনা বন্দুক মনে হচ্ছিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো সে,

“বেহায়া নারী! বজ্জাত বিদেশী! এটাই তোর গর্বের বিষয় তাইনা? আমি দেখেছি কিভাবে চালাস তুই এটা! আজ তোর অস্ত্রেই মর তুই” হিংস্রভাবে হেসে পিস্তল তাক করলো বারীন্দ্রকুমার ইলার মুখ বরাবর।

পিস্তলে ম্যাগাজিন ভরা! ইলা চুপ থাকল, সারাদেহ ব্যথায় ভর্তি! চাঁদ এখনও মেঘে ঢাকা। ট্রিগার টিপছে না দেখে তাকিয়ে দেখল বারীন্দ্রকুমারের চোখ অন্যদিকে। সে তাকিয়ে আছে ইলার নগ্ন দেহের দিকে।

“তোকে ভোগ করার খুব ইচ্ছে ছিল জানিস! কিন্তু উপায় নেই, কাল যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে, তোকে শেষ করে প্রাসাদে যেতে হবে। তাছাড়া তোর দেহ এমন কিছু আকর্ষণীয় নয়! সরু কোমর, ছোটো….ছোঃ তুই মর”

ট্রিগার টিপল বারীন্দ্রকুমার।

গুলি বেরোলো না, তার বদলে পিস্তলের সেফটি লিভারের ঠিক ওপরে একটা খুব ছোটো স্ক্রিনে লেখা ফুটে উঠলো, “আই.ডি ফেল”

আবার টিপল সে, দুবার! সাথে সাথেই নলের নিচে সবুজ আলোর জায়গায় লাল আলো জ্বলা-নেভা শুরু করলো আর সেই আলোর ছন্দে আস্তে কিন্তু বেশ তীক্ষ্ম আওয়াজ শুরু হলো-

টিঁপ…টিঁপ…টিঁপ…টিঁপ…টিঁপটিঁপটিঁপটিঁপ..টিঁইইইইইইইপ…

লাল আলোটা স্থির হয়ে গেল! বারীন্দ্রকুমার অবাক চোখে তাকাল পিস্তলটার দিকে।

পর্দায় লাল হরফে ফুটে উঠল, “সেল্ফ ডেস্ট্রাক্ট”

“দুম্” শব্দে বিস্ফোরণের সাথে সাথে ইলার চোখেমুখে ছিটকে এসে লাগল কয়েকদলা মাংস আর রক্ত! তাকিয়ে দেখল বারীন্দ্রকুমারের হাতের কনুই পর্যন্ত অংশ উড়ে গেছে বিস্ফোরণে। অবিশ্বাসে ভরা চোখ আর কাঁধ থেকে ঝুলতে থাকা হাতের অংশ নিয়ে মাটিতে বসে পড়ল সে, চিৎকার করতেও ভুলে গেছে সে।

ইলা টলতে টলতে এসে দাড়ালো ওর সামনে, এমন সময় ওদের ওপর এসে পড়ল চাঁদের আলো। আবার ব্যথা শুরু হলো ইলার কাঁধে।

রূপোর বিষক্রিয়ায় বারীন্দ্রকুমারের পরিবর্তন একটু দেরীতেই হচ্ছিল, ফলে অর্ধেক রূপান্তরিত অবস্থাতেই নেকড়েরূপী ইলা গায়ের জোরে বারীন্দ্রকুমারের বুকে মারল এক ধাক্কা। খানিকটা উড়ে গিয়ে মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ল সে।

বারীন্দ্রকুমার এখন পুরোপুরি পরিণত! তবে তাতে ইলার কোনো অসুবিধা হলোনা, যা করার এখনই করতে হবে, চাঁদ আবার ঢাকা পড়তে পারে। লাফিয়ে বারীন্দ্রকুমারের বুকের ওপর বসে ওর দুই চোয়াল ধরে টানতে থাকল সাথে মারণ হুংকার। বারীন্দ্রকুমার একহাতে সাধারণ আঁচরানো ছাড়া কিছুই করতে পারল না। ওর মধ্যে সেরকম শক্তিও বিশেষ ছিলোনা! ইলার হুংকারে মাঝেমাঝেই গলা দিয়ে কুঁইকুঁই আওয়াজ বেরোচ্ছিল ওর অজান্তেই। কোনোদিকে নজর ছিলোনা ইলার। লাল চোখের মণি জুড়ে খেলা করছিল প্রতিশোধের আগুন! একটা সময় প্রবল টানে বারীন্দ্রকুমারের চোয়ালের নিচের অংশ উঠে এল ইলার হাতে। মাথা হেলে গেল জন্তুটার। লড়াই শেষ বারীন্দ্রকুমারের, আর উঠলো না সে। এক হাতে রক্ত ঝরতে থাকা চোয়ালের অংশটা ধরে চাঁদের দিকে চেয়ে হুংকার ছাড়ল ইলা-

“আ-উ-উ-উ-উ..”

আবার মেঘের সারি এগিয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি যা করার করতে হবে, চারিদিক আবার নিস্তব্ধ হয়ে যাবার কারণে নিচ থেকে মানুষের গলা শুনতে পেল সে। সৈন্যরা আসছে। দূরে পড়ে থাকা ব্যাগটা এক আঙুলে তুলে গুহার ভেতরে ঢুকলো সে। মনুষ্যরূপ ফিরে আসল সঙ্গে সঙ্গেই। ওর সারা দেহ রক্ত-মাংসে ভরা। পুরোপুরি মানুষ হবার সাথে সাথেই মাটিতে পড়ে গেল ইলা। দেহে আর শক্তি নেই ওর, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে কোনোরকমে জিন্স আর বুট পড়ল, শক্তি একদম নিঃশ্বেষ তার! তবুও মনের জোরে টপ গলানোর সাথে সাথেই আবার মুখ থুবড়ে পড়ল ইলা, আর উঠতে পারল না, কানে এলো অনেকগুলি পায়ের আওয়াজ।

পর্ব-৫

ক্রমাগত ঠকর-ঠকর আওয়াজে একসময় জ্ঞান ফিরল ইলার। বেশ শীত করছে! এতক্ষণ গুটিশুটি হয়ে শুয়ে ছিল সে ভেজা বিচালির ওপর। মাথায় বেশ ব্যথা, ঠাহর করতে পারল না সে কোথায়! হাত পা নাড়াতে গিয়ে দেখে শিকল বাঁধা! টের পেলো সে আছে সেই লোহার বাক্সতে! ব্যাপার কি? আবার টাইম ট্রাভেল হলো নাকি? তড়িঘড়ি মাথা উঁচু করে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজল সুবর্ণকে! নাহ্ বাক্সটায় সে একাই, জানলার খোপ থেকে সূর্যের আলোও আসছেনা। সুবর্ণ আর বেঁচে নেই! চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল তার। এতটুকু বাচ্চা ছেলে, শুধু তার দোষেই মরে গেল ভাই। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছিলো ইলার। এমন সময় কানে এলো ঢোলের আওয়াজ, তার সাথে জোরে গলায় বলা কিছু কথা-

“শুনুন, শুনুন, শুনুন! একটি বিশেষ ঘোষণা! গতকাল আমাদের সবার প্রিয় প্রানাধিক পুন্ড্ররাজ্যের সেনাপতি কুমার বারীন্দ্রকুমারকে হত্যা এবং পরম পূজনীয় মহারাজা শ্রীপরশুরামের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে বন্দি এক ডাইনীকে আনন্দগড়ের মাঠে রাত্রির প্রথম প্রহরে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করার আদেশ দিয়েছেন স্বয়ং মহারাজ। শুনুন..শুনুন..”

আগুনে পোড়াবে ওকে! খোপ দিয়ে দেখল, সূর্য ডুবতে বসেছে অর্থাৎ অন্ধকার হতে বেশি দেরী নেই। মনে পড়ল বৈজ্ঞানিকের কথা!

“অন্ধকার হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই পোর্টাল বন্ধ হয়ে যাবে!”

না, ইলার পুড়ে মরার বা অতীতে আটকে থাকার কোনো ইচ্ছা নেই। তাকে বেরোতে হবে। চটপট মাটিতে বসে পড়ে ডান পায়ের জুতোর নিচে চাপ দিতেই একটা প্রকোষ্ঠ বেরিয়ে এল, সেখান থেকে লকপিক যন্ত্র বের করে হাত পায়ের বাঁধন খুলতে লাগল দুই মিনিট মতো। এবার দরজা। বাইরে থেকে তালা দেওয়া। বাঁ পায়ের বুটের তলায় চাপ দিয়ে লুকোনো প্রকোষ্ঠ থেকে বের করলো অবিকল অ্যাডেসিভ ব্যান্ডেজের মতো দেখতে দুটো জিনিস, তবে একটু মোটা-’সেমটেক্স!’ কভার সরিয়ে লাগিয়ে দিল দরজার হাতল যেখানে তার ওপরে আর নিচে। তারপর চলে গেল বাক্সের এক কোণে, মুখ দেওয়ালের দিকে করে মাথা নিচু করে গুনতে শুরু করলো দশ থেকে এক পর্যন্ত…

“প্রায় অনেকদিন পর ডাইনী ধরা হলো বলো? আমার স্ত্রী-পুত্র তো ডাইনী পোড়ানো দেখবে বলে সকাল থেকে বলে আসছে”

“হ্যাঁ, শুনেছি ওকে নাকি সুলতান পাঠিয়েছে! কাল সৌরেন্দ্র দেখেছে ডাইনীটা চোখ দিয়ে আগুন বের করতে করতে সেনাপতির মাংস কচমচ করে খাচ্ছিল”

“সুলতান! আজ রাতে দেখিয়ে দেব সব!দুবার মেরেছে আমায়, যতবার মারবি ততবার বেঁচে উঠবো আ…”

“দুম্”

ঢোলের ছন্দময় আওয়াজ, সুন্দর বিকেলে পাখিদের ঘরে ফেরার ডাক নিমেষের মধ্যে পরিবর্তিত হলো এক কানফাটানো বিস্ফোরণে! সাদা ধোঁয়া তার সাথে লোহার দরজাটা উড়ে এসে সোজা লাগল ঘোড়সওয়াড় সৈন্যের মুখে। তারপর কি হলো তা দেখার জন্য অপেক্ষা করলোনা ইলা! সোজা উঠে পড়ল গাড়ির ছাদে। সূর্য অস্ত গেছে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। এদিক ওদিক দেখে ছাদ থেকে লাফ মারল পাশের জঙ্গলে। ফুলিগ্রামেই আছে তারা। ভাগ্য ভালো কদিন আগে এসব জায়গা ঘুরে দেখিয়েছে সুবর্ণ, তাই রাস্তা চিনতে ভুল হলোনা। লাফ দিয়ে জল-কাদামাটিতে পড়ে গড়াতে গড়াতেই দেখল ওর ঠিক পাশের গাছের গুঁড়িতে এসে বিঁধল একটা বর্শা। কোনোরকমে উঠেই মাথা নিচু করে দৌড়াতে লাগল সে, লক্ষ্য পুকুর!

গোটাদশেক কুঁড়েঘর আর টালির ঘরের ছাদ পেরিয়ে, একটা লম্বা পাঁচিল টপকে, গোটাকুড়ি গরু-ছাগল আর রাখালবালকদের ডজ করে, একটা গরুর গাড়ির ওপর দিয়ে লাফ মেরে এবং তার সাথে অবশ্যই সৈন্যদের চোখে ধুলো দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যখন পুকুরপাড়ের সামনে একটা টিলার ওপর পৌঁছাল তখন ইলার অবস্থা বেশ খারাপ! সারা মুখে, হাত কাঁটাগাছের সাথে সংঘর্ষের ফলে ক্ষতে ভরে গেছে, কপাল থেকে আবারও রক্ত ঝরা শুরু হয়েছে, ছেঁড়া টপ আর জিন্স জলকাদায় মাখামাখি। তার চুলের রং এখন লাল-কালোর বদলে ধারণ করেছে বাদামী রং! অনেক দূরে সৈন্যদের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, বেঁচে এতদূর এসেছে এই অনেক। শেষদিকে বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ছিলো কাদার ওপর। ডানপায়ের গোড়ালির ওপরে কেটে গেছে অনেকটা। খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঢাল বেয়ে নামতেই মনে পড়ল তার!

সে হেরে গেল! এত পরিশ্রমের ফল শূন্য। পাহাড়ে আর ওঠা সম্ভব নয়, অন্ধকার ছাড়াও অগনিত সৈন্য ওদিকে। এমন সময়ে আকাশে তাকিয়ে দেখল বেশ নিচু দিয়ে একটা চিল উড়ে গেল!

আজ রাতে অনেক কিছু ঘটবে! তবে তা চাক্ষুষ করার ইচ্ছা ইলার নেই। বাথটবের ওইপারে কজন রাইফেল হাতে ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে সেটা ভাবতে ভাবতে ঢালু বেয়ে পুকুরপাড়ে এসেই থমকে দাঁড়ালো সে। নাকে এলো হালকা পোড়া গন্ধ।

এতক্ষণ সে অন্য কথা ভাবতে এত ব্যস্ত ছিল যে পুকুরপাড়ে কি হচ্ছে খেয়াল করেনি। চোখমুখ থেকে ঘাম-কাদা মুছে দেখতে পেল, একটু দূরেই নিভুনিভু জ্বলছে এক চিতা। আশেপাশে কেউ নেই, শুধু সামনে চুপচাপ বসে আছে…সুবর্ণা!

পায়ের শব্দ পেয়ে সুবর্ণা ঘাড় ঘুরিয়ে ইলাকে দেখল।

ইলার পা দুটো আটকে গেল কাদায়। কি করবে বুঝে উঠতে পারল না, চোখ দুটো জ্বলতে শুরু করলো! একটা অসহায়তা আর অপরাধবোধ কুড়ে কুড়ে খেতে লাগল তাকে! সে সেই রাতে জোর করলে বাচ্চা মেয়েটা দ্বিতীয়বার অনাথ হতো না।

সুবর্ণা অবশ্য কিছু করলো না। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ইলার কাঁপা হাতের তালুতে গুঁজে দিল চারটে নীলকমল।

কেঁদে ফেলল ইলা! বসে পড়ে জড়িয়ে ধরল সুবর্ণাকে। সুবর্ণাও হাত রাখল ওর পিঠে, ইলা টের পেলো ওর কাঁধ ভিজে যাচ্ছে।

এমন সময় আবার হইহল্লা শোনা গেল পেছনে। আর সময় নেই, সুবর্ণার কপালে একটা চুমু খেয়ে গাল ধরে কান্নাভেজা গলায় বললো ইলা, “ভালো থেকো, কেমন?”

সুবর্ণা প্রত্যুত্তরে হাসল একটু।

এগিয়ে গিয়ে পুকুরের হিমশীতল জলে পা ডোবালো ইলা। সারাদিন বৃষ্টির ফলে টইটম্বুর হয়ে আছে পুকুরটা। শক্ত হাতে ফুলগুলো ধরে এগোতে থাকল জল ঠেলে। হঠাৎই প্রচন্ড একটা ক্লান্তি তাকে ঘিরে ধরল। সে ফিরছে, অবশেষে। তার ঘর ডাকছে ওকে। আশ্চর্যজনক ভাবে টাকার কথাটা আর মাথায় এলো না ওর!

বুকজলে দাঁড়িয়ে একবার পিছন ফিরে সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ইলা ডুব দিল কালো জলে।

উপসংহার

সন ২১৪৪,

সে দৌড়াচ্ছে, অনায়াসে পেরিয়ে যাচ্ছে উঁচু অট্টালিকার ছাদ! বুটের রানার আপগ্রেড করার ফলে পেছনে জেটপ্যাকে তাড়া করে আসা ড্রাগ কার্টেলের লোকেরা বেশ পেছনে পড়ে যাচ্ছে বারবার। এত দ্রুত আর ক্ষীপ্র সে যে পেছনের লোকজন ঠিক করে নিশানাই করতে পারছে না! আজ বিকেলে একটু বেশিক্ষণ ধরেই তুষারপাত হচ্ছে। আজ অবশ্য তার কাছে কোনো হীরে জহরত নেই, আছে তার পকেটে শুধুমাত্র একটা চিপ। চোখের আই.নেক্সট গ্লাসে হয়ে চলেছে ডাউনলোড।

ডাউনলোডিং লেখাটার পাশে সংখ্যাটা একশ দেখাতেই ইয়ারপিসে ভেসে আসলো বৈজ্ঞানিকের গলা, “ওয়েল ডান এজেন্ট! তবে আরএকটা ছোট্ট কাজ আছে তোমার”

“কি কাজ?” এক লাফে একটা গগনচুম্বী টাওয়ারের মাথা থেকে খানিক নিচে আরেক অট্টালিকার ছাদে লাফিয়ে খানিক গড়িয়ে সোজা হয়ে উঠে বললো মেয়েটি।

“এলিমিনেট দেম! দে হ্যাভ সিন টু মাচ”

“হোয়াট? আবার? আপনি সাইন্টিস্ট নাকি কোনো শ্যাডো অর্গানাইজেশনের নেতা?”

“হাঃ হাঃ অবশ্যই সাইন্টিস্ট বাকিটা তোমার এক্তিয়ারের বাইরে! যাও কাজ করো, ট্যাকোবেল বিল্ডিংএর ছাদে যাও, পূজোর ছুটির জন্য বিল্ডিং জনমানবশূন্য এখন! ওখানেই সেরে ফেলো, এক্সট্রা ইনকাম হবে তোমার! কোনো ওয়েপন এয়ারড্রপ করতে হবে?”

“নো থ্যাংকস, ভ্যাকসিনের কি হলো?” জ্যাকেট থেকে বরফ ঝাড়তে ঝাড়তে বলল সে।

“কাজ সেরে এসে জানতে পারবে! ওক্কে! চাঁদ উঠবে আর দশ মিনিটে। উৎসবের এক সপ্তাহ আগে আতংকের উৎসব চাক্ষুষ করুক সিনর্ কার্টেল! অল দ্য বেস্ট এজেন্ট বর্…এই তুমি তোমার নিউ কোডনেম পাল্টাও! এতো খটোমটো নাম, আগেরটাই বেটার ছিল! কি আছে ওই নামে?”

“সেটা আপনার এক্তিয়ারের বাইরে” বলে কল এন্ড করে বুটের রানার বাটন প্রেস করলো ইলা ওরফে এজেন্ট বর্ণা!

 ট্যাকোবেল অট্টালিকার ছাদ প্রকান্ড বড়ো। চিপের ট্র্যাকারটা অন করে দেওয়ায় তাড়া করা লোকগুলোকে ফাঁদে ফেলতে অসুবিধা হলোনা, ওরা আসতে এখনও মিনিট দুয়েক, অন্ধকার হয়ে এসেছে, আকাশে চাঁদও উঠবে উঠবে করছে। ছাদের কোণায় কোণায় লাগানো ক্যামেরাগুলোর মাথায় লাল আলো জ্বলে উঠলো, অর্থাৎ ডিসাবেল্! অন্ধকার দেখে আড়ালে গেল ইলা। প্রথমে খুলে ফেলল আইওয়্যার, বুট-মোজা, চেন টেনে খুলল জ্যাকেটটা, তারপর খুলে ফেলল লাল টপ! কোমর থেকে পেশিবহুল পিঠের ঠিক মাঝখানে শিঁড়দাড়া দিয়ে উঠেছে একটা শিকড়সহ মোটা গাছের গুঁড়ির উল্কি, যা ডালপালা সমেত ছড়িয়ে পড়েছে দুইদিকে কাঁধের হাড় অবধি, দুই কাঁধের হাড়ে গাছের ডালে বসে দুটো টিয়াপাখি! এই অন্ধকারেও নীলরঙা দুটি পাখি জ্বলজ্বল করে উঠলো। বেশ ঠান্ডা লাগছে তবে একটু পর আর লাগবে না! ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি উঠে এলো ইলার। চেনা ব্যথাটা কাঁধে আসছে চুপি চুপি।

* * *

উড়তে উড়তে ছয়জন ধীরে ধীরে নামল ছাদে। ছাদ ভেসে যাচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয়। বেশ ফাঁদে ফেলা গেছে ভেবে শিষ দিতে দিতে আঙুলের ইশারায় বাকিদের চারিদিকে খুঁজতে পাঠিয়ে যেই নিজে সেই রাইফেল তাক করে একটা বড় জলের ট্যাংকের পেছনে গেল অমনি পরপর টুপ্-টুপ্ করে আওয়াজ! তাকিয়ে দেখল ওর লেসার রাইফেলের গায়ের আলোগুলো নিভে গেছে। ওর সঙ্গী সাথীরাও আসল, ওদেরও এক অবস্থা! এভাবে সবার রাইফেল একসাথে লক হয়ে গেল? হঠাৎ দেখা গেল একজন আসেনি, গেল কই? রেডিও কাজ করছেনা! ফাঁদে পড়েছে বুঝে বাকিদের নতুন নির্দেশ দিয়ে সবাই একসাথে এগোলো! সবার হাতে রাইফেলের বদলে উঠে এসেছে লম্বা লম্বা ছুরি বা এ.এস.পি ব্যাটন। চারিদিক নিস্তব্ধ! কিছুটা যেতেই একজনের চোখে পড়ল, বাকিদেরও ডেকে দেখালো সেটা-

সাদা বরফের পাতলা চাদরের ওপর অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়ানো চাপ চাপ রক্ত। আশপাশ দেখেও দেহ পাওয়া গেল না! থেকে থেকেই কেমন একটা অদ্ভুত আওয়াজ আসছে কানে! সবাই প্রশিক্ষিত মার্সিনারি হলেও মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে ততক্ষণে, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার জানান দিচ্ছে ভয়াবহ কিছু একটা হতে চলেছে এখানে! এমন সময় সবার কানে এল চাপা গর্জন!

কুকুরের ডাক না? হ্যাঁ কুকুরই তো! সবার মুখে একটা স্বস্তির হাসি সবে ফুটে উঠতে যাবে তখনই….

গায়েব হওয়া সাথীর মুন্ডুহীন দেহটা পড়ল ধপ্ করে ওদের সামনে।

আস্তে আস্তে ওপরে তাকালো সবাই এক এক করে!

বিস্ময়ভরা পাঁচজোড়া চোখের মণিতে মুহুর্তের মধ্যে উদয় হল আতংক!

….!

সমাপ্ত

(নীলকমল, নেকড়েমানব, সুবর্ন/সুবর্ণা ছাড়া অতীতের সবকিছু বাংলাদেশের প্রচলিত লোককথার ওপর ভিত্তি করে লেখা। )

মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। প্রসিদ্ধ এই নগরী ইতিহাসে পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর নামেও পরিচিত ছিল। এক সময় মহাস্থানগড় বাংলার রাজধানী ছিল। একসময় সেই রাজ্যের রাজা ছিলেন পরশুরাম। ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে কিংবদন্তি অনুসারে বালখির শাহ সুলতান তার শিষ্যদের সঙ্গে একটি মাছের মতো আকৃতির নৌকায় ফকিরের পোশাক পরে মহাস্থানগড়ে এসেছিলেন। প্রথমদিকে পরশুরামের সেনাপ্রধান ও আরো কিছু লোক ইসলামের বাণী গ্রহণ করে মুসলমান হন। তবে রাজা পরশুরাম ও তার বোন শিলা দেবী তা গ্রহণ করেননি।

রাজা পরশুরাম শাহ সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা করেন। যুদ্ধের প্রথমেই শাহ সুলতান পরাজিত হয়। কারণ যুদ্ধ চলাকালীন শত্রুকে আক্রমণের সময় শাহ সুলতানের যোদ্ধাদের সংখ্যা কমলেও পরশুরামের যোদ্ধাদের সংখ্যা কমেনি। অপ্রাকৃতিক ও অলৌকিক কিছু শক্তির বলে এমনটি ঘটেছিল। যুদ্ধ চলাকালীন অনেক সময় পরশুরামের মৃত সৈন্যদের পুনরায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দেখা যেত। জানা যায়, অমর কূপ নামে একটি কূপ আছে যেটি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। এই কূপটি মৃতকে জীবিত করতে পারে। কূপটির অলৌকিক ক্ষমতা বিনাশের জন্য সুলতান একটি চিলের সাহায্যে কূপের মধ্যে একটি গরুর মাংস ফেলে দিলেন। তারপর থেকে কূপের জলের অলৌকিক শক্তি অদৃশ্য হয়ে যায়। এ কারণে পরশুরাম শাহ সুলতান বালখী মহিষাওয়ারের কাছে পরাজিত হন।

সূত্র- Wikipedia

**লেখক পরিচিতি- সায়ন দাশ, জন্ম- ২৫শে নভেম্বর, ১৯৯২, নিবাস- ব্যারাকপুর,

বিদ্যালয়- রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন এবং ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট হাই স্কুল

কলেজ- রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ সেন্টিনারি কলেজ, বিষয়- জুলজি অনার্স

টুকটাক গৃহশিক্ষকতা

ভালো লাগে- সিনেমা এবং গল্পের বই

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post অভিশপ্ত অভিমান….. | ভয়ের দেশ | অমিত কুমার সাহা| Bengali Horror Story
Next post আরেকটা গণকবর | ভয়ের দেশ | মোঃ আতিকুর রহমান| Bengali Horror Story