মানিব্যাগ| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | কল্পেশ মান্না| Bengali Detective Story
0 (0)

গলি বেয়ে ছুটে চলেছিল একজন। গায়ে চামড়ার বাদামি জ্যাকেট কলকাতার শীত আটকাবার জন্য যথেষ্ঠ। কিন্তু মুখের অভিব্যক্তি দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় যে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘর্মবিন্দুগুলি ফুটে ওঠার কারণ তাপ নয়, বরং আতঙ্ক। দৌড়তে গিয়ে হয়তো খেয়াল করেনি সে, কিন্তু পকেটের একটা জিনিস কখন ফাঁক গলে নর্দমার পাশে গিয়ে পড়েছে তা নজর করল না সে।

ভৌ-ও-ও-উ, শেষপ্রহরে রাজপথে মনুষ্যের দৌরাত্ম্যে মনে হয় অভ্যস্ত নয় সারমেয়কুল। দৌড়তে দৌড়তে পাড়ার মোড়ে মিলিয়ে গেল জ্যাকেটধারী ছায়ামূর্তি। নেমে এল নারকীয় স্তব্ধতা পৃথিবীর বুকে।

কিরিং কিরিং!

– “হ্যালো, শ্যামপুকুরপুর থানা। কী ব্যাপার?”

– “হ্যালো স্যার, একটা খুন হয়ে গেছে স্যার, তাড়াতাড়ি আসুন।”

– “সকাল সকাল ফোন করে ইয়ার্কি করবেন না তো। কাজকর্ম নেই নাকি?” বিরক্ত গলায় উত্তর কনস্টেবলের।

– “না স্যার, মা কালীর দিব্যি, এই তো। চোখের সামনে পড়ে আছে লাশ।”

– “হুম, আচ্ছা। ঠিকানাটা দিন আপনি।”

দু’মিনিটের মধ্যেই হুটার বাজিয়ে ছুটে চলল পুলিশ ভ্যান।

– “কখন হল খুনটা?” নীল রঙের মোটা ফাইলটা ঠক্ করে টেবিলের উপর ফেলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন গোয়েন্দাপ্রধান।

– “ভোর চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে।” ধীরগলায় উত্তর ইন্সপেক্টর মেঘনাদ দাশগুপ্তের।

– “ডিটেকশন তো ভোর সাড়ে ছ’টা নাগাদ হয় বললে?”

– “হ্যাঁ, স্যার।”

– “কে প্রথম ডিটেক্ট করল?”

– “খবরের কাগজের লোক। কাগজ বরাবর দরজার পাশে টাঙানো বাক্সেতেই রাখে। আজ দরজাটা খোলা দেখে সন্দেহ হয় ওর। খুলতেই দেখে বডি পরে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করে থানায়।”

– “কোনও ক্লু পেলে কি স্পট থেকে?”

– “জুতোর ছাপ ছাড়া আর কিছু না।”

– “হাতের?”

– “না স্যার।”

– “হুম।” অ্যালিবাই নেওয়া হয়েছে?”

– “হ্যাঁ, স্যার। বাড়ির চাকর, কাজের লোক, পাশের ফ্ল্যাটের দু’জনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কোনও লিড নেই।”

– “হুম।” চেয়ারে ভর দিয়ে গা’টা এলিয়ে দিলেন গোয়েন্দাপ্রধান। বা হাতটা ভুঁড়ির উপর রেখে যেন নিজের মনেই বললেন, ‘রাতদুপুরে কলকাতার বুকে নৃশংস খুন, মিডিয়া তো একদম লাফিয়ে পড়বে এবার, জ্বালা!’

কিছুক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে চেয়ারে দোল খেয়ে মেঘনাদের দিকে চেয়ে বললেন, “শোনো হাই প্রোফাইল মার্ডার। ওঁর কাজের জায়গায় যাও, খোঁজ চালাও, কথা বলে দেখ যদি কোনও লিড পাও। এক হপ্তা টাইম দিলাম, তার মধ্যে যদি কোনও লিড না পাও কেসটা তাহলে পটবর্ধন হ্যান্ডেল করবে। রাজবিহারীবাবু সাধারণ লোক ছিলেন না। শত্রুর তো কমতি নেই ওঁর।”

কিছু না বলে শুধু মাথাটা একবার উপরনিচ করল মেঘনাদ।

– “হুম। এবার যাও। কাজে লেগে পড়ো।”

– “ইয়েস স্যার।”  বলে সেলাম ঠুকে অফিস থেকে বেরিয়ে আসার সময় সে লক্ষ্য করল দেয়ালঘড়ির কাঁটাগুলো বারোটার ঘরে এক হয়ে গেছে।

– “কে করতে পারে বলতো কেসটা? ” চায়ের কাপটা হাতে তুলে প্রশ্ন শিশিরবাবুর।

রোজ সন্ধেতেই একটা ছোটখাটো আড্ডা বসে উত্তর কলকাতার এই পুরানো বাড়িতে। মালিক নটরাজ পালের স্ত্রী গত হয়েছেন আজ প্রায় এক দশক হল। ছেলে জার্মানির ডুসেলডোর্ফের এক ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে কর্মরত। মেম বিয়ে করে সেখানেই পেতে বসেছে সংসার। দেশে ফেরে কদাচিৎ, বাড়ি আর বাপ কোনওটার উপরেই বিশেষ আগ্রহ নেই তার।

– “ওকালতি জীবনে তো অনেককেই শত্রু করেছে রাজবিহারী, তাদেরই কেউ হয়তো।”  গরম চায়ে সুরুত করে এক চুমুক দিয়ে উত্তর নটরাজ পালের।

– “হুম, সম্প্রতি ও অনেক দেনা করে ফেলেছিল সে খবর রাখিস?” ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন শিশির ব্যানার্জির।

– “বটে? হাইকোর্টের নামকরা উকিল, বিয়েথা করেনি। ওর হঠাৎ টাকার দরকার পড়ল কিসের?”  মাঝে রাখা মুড়ির ডিসটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে প্রশ্ন জগদীশবাবুর।

– “তুমি কতখানি জানতে তা জানি না ভায়া, তবে রেসের মাঠে যাওয়ার অভ্যাস তো ওর চিরকালের। আর এ নেশা একবার ধরলে ছাড়া মুশকিল। শান্তগলায় উত্তর দিয়ে মুড়ির কটা দানা মুখে চালান করে দিলেন শিশির সেন।

– “কিন্তু, কিন্তু আগে তো কখনও এরকমটা হয়নি?”

– “ভাগ্যের খেলায় কেউ হারে, কেউ জেতে। ইদানিং সময়টা খারাপ যাচ্ছিল ওর। হাতে কেস না থাকায় রোজগারপাতিও হচ্ছিল না সেরকমভাবে। তাই কিছু ধার নেয় আরকি। হাতে টাকা এলেই মিটিয়ে দেবে ভেবেছিল।”

তাস পেটাতে পেটাতে মুখ কোঁচকানো দেখেই মনে হল জগদীশবাবু এই যুক্তিতে মোটেই সন্তুষ্ট নন।

– “সুখদেব, আর দু’টো কাঁচা লঙ্কা দিয়ে যা তো বাপ। ঘরের ভিতরের দিকের দরজার দিকে তাকিয়ে হাঁক মারলেন নটরাজ ভট্টাচার্য।”

– “তোর সুখদেবের শরীর কেমন আছে এখন? পেটের গোলমালে ভুগছে বললি যে সেদিন।”

– “এখন অনেকটা ভালো। পাড়ার দীনবন্ধু ডাক্তারের ওষুধপাতি আজকাল ভালোই কাজ দিচ্ছে।”

– “ছোটোবেলা থেকেই এখানে মানুষ তো, চাকর হলেও নটরাজের মায়া পড়ে গেছে ওর ওপর।” সহানুভূতির স্বরে প্রত্যুত্তর শিশির ঘোষের।

মাথাটা একটু নামিয়ে যেন তাতে সায়ই দিলেন বাড়ির কর্তা।

– “সাবধানে বাড়ি যাস।” অতিথিদের সদর দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে যেন এক বিষাদ সাবধানবাণীই দিলেন কর্তা। দিনকাল ভাল নয় একদম।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুরনো ছাতাটা বগলে বাগিয়ে শিশিরবাবু জগদীশের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “চল।”

রাজবিহারীবাবুর বন্ধুদের জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস অন্তত জানা গেল। নটরাজবাবুর চাকরটার সঙ্গে যদিও কথা হল না, বাজারে গিয়েছিল। মেঘনাদের তাড়া ছিল বলে বেরিয়ে এল, ওকে থানায় এসে দেখা করে যেতে বলা হয়েছে। টাকার জন্য খুন করা হতে পারে আবার কোন পুরনো ক্রিমিনালের কাজও হতে পারে। শ্যামবাজারের জগদীশবাবুর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরোতে বেরোতে ভাবছিল মেঘনাদ।

– ‘নাহ্; একবার বসে মাথা ঠান্ডা করে না ভাবলে হবে না। কেসটা অতটাও সোজা নয় তার উপর আবার এক হপ্তার ডেডলাইন। কোনও মানে হয়, তার উপর আবার পটবর্ধন’ – এমনিতেই লোকটাকে দেখতে পারে না সে। ‘বিহার থেকে এসে এখানে হম্বিতম্বি। যত্তসব’।

গাড়িতে বসেই ড্রাইভারকে বলল, “হাইকোর্ট চলো।”

হাইকোর্টের কাজ মিটিয়ে যখন লালবাজারে ফিরল ঘড়ির কাঁটা তখন চারটে ছুঁইছুঁই। ৩৬ বছর ওখানে ছিলেন রাজবিহারীবাবু। নামকরা ল-ইয়ার। বহু খুন, রাহাজানি, ডাকাতির মামলার লিস্ট দেখে মনে হল সম্ভাব্য শত্রুর সংখ্যাটা কম নয়।

আজকের রাতটা বোধহয় সেই সব গুণীজনদের ব্যাপারে রিসার্চ করতেই চলে যাবে।

কলকাতার যানজট পেরিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ যখন স্ট্র্যান্ড রোডে নিজের বাড়িতে গিয়ে ঢুকলো তখন সত্যি বলতে শরীরে আর কিছু নেই। চাকরের উদ্দেশ্যে একবার “চা” বলে চেঁচিয়ে সোফায় গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল মেঘনাদ।

– “এত তাড়াতাড়ি চলে এলে আজ?” বেডরুম থেকে বেরোতে বেরোতে প্রশ্ন স্ত্রী সুদমার।

– “একটা নতুন কেস হাতে পড়েছে। তাই অফিসে অত সময় লাগল না”।

– “কী কেস? মার্ডার নাকি?”

– “হুম, বলে ক্লান্তিতে মাথাটা সোফায় এলিয়ে দিল সে।”

– “চা খাবে তো?” রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন সুদমার।

– “বলেছি নকুলকে।” হাতের ঘড়িটা টি-টেবিলে রাখতে রাখতে বলল মেঘনাদ।

সেদিন ডিনার করতে বসে সুদমার মাসির বাড়ি যাওয়ার কথাটা উঠতেই মেঘনাদের একটা কথা মনে এল।

আশ্চর্য! রাজবিহারীবাবুর কি কোনও কুলেই কোনও আত্মীয় নেই? নাকি তারা সংবাদটা পায়নি এখনও? না, তা তো হওয়ার কথা নয়। খুনের খবরটা শহরের সবক’টা কাগজেই বড়ো বড়ো করে বেরিয়েছে। নামজাদা উকিল ছিলেন, তার ওপর আবার খাস কলকাতায় মার্ডার। নাহ্, খবর নিতে হচ্ছে তো একবার।

সুদমার ভাইয়ের নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আগামী মাসে নিমন্ত্রণ, সপরিবারে আগমন অত্যন্ত কাম্য। মেঘনাদের এইসব অনুষ্ঠানে যেতে ভালো লাগে না, আর অফিসের কাজের জন্য বেশিরভাগ সময় যাওয়াও হয়ে ওঠে না। মুখরক্ষার কাজটা তাই সুদমাই করে বেশিরভাগ সময়, কিন্তু এবারের একথাটা আলাদা। সপরিবারে যাওয়ার বিশেষ অনুরোধ রয়েছে নিমন্ত্রণপত্রে।

খেয়ে উঠে বেডরুমে ঢুকে একবার ক্যালেন্ডারে চোখটা বোলাতেই বুঝতে পারল শ্যালকের বিবাহদিবস আসতে মোটে আর দু’দিন বাকি।

তদন্তের কাজে কোন গতি নেই, তার ওপর আবার এসে জুটল নিমন্ত্রণ রক্ষার ঝামেলা। বিরক্ত লাগছিল মেঘনাদের। রাত প্রায় বারোটা বাজতে চলল। কাল অনেক কাজ তাই এক গ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়ল।

ঘুম মোটেই ভালো হল না। সকাল সকাল উঠে ব্রেকফাস্ট না করেই বেরিয়ে পড়বে পরদিন। কাল নটরাজ ভট্টাচার্যের চাকরের থানায় আসার কথা। পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটাও আসার কথা আজ, পেলে খুনের সময় আর মৃত্যুর কারণটাও আরোও ভালো করে বোঝা যাবে। আরও দু-একটা কাজ আছে। তাড়াতাড়ি গেলে ফিরতেও পারবে তাড়াতাড়ি, এছাড়াও নিমন্ত্রণের জন্য গোছগাছ করা বাকি আছে এখনও। ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে এল মেঘনাদের।

সুখদেবের সঙ্গে কথা বলে দু’টি জিনিস জানা গেল। এক, খুনের দিন রাত সাড়ে চারটে পাঁচটা নাগাদ পাড়ায় রাস্তার কুকুরগুলো নাকি বেদম চিৎকার করছিল। কুকুরের স্বভাব অনুযায়ী সেটা অস্বাভাবিক নয়, চিৎকার তো তারা সবসময়ই করে। কিন্তু মেঘনাদকে ভাবাচ্ছে টাইমিংটা – পোস্টমর্টেমে বলা খুনের সম্ভাব্য সময়ের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যাচ্ছে। সাড়ে চারটে থেকে পাঁচটা। মৃত্যুর কারণ, বুকে ও গলায় একাধিক গভীর ক্ষত। উৎস: ধারালো কিছু ছুরিই সম্ভবত।

আরেকটা খবর পাওয়া গেল সুখদেবের কাছ থেকে যে ইদানিং এক কোট-প্যান্টপরা ভদ্রলোক নাকি মাঝেই মাঝেই আসতেন রাজবিহারীবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। খবরটা তাকে দিয়েছে পাড়ার পিন্টু পানওয়ালা। রাজবিহারীবাবুর বাড়ীর ঠিক পাশেই তার দোকান।

কে হতে পারে? কোনও ক্লায়েন্ট? সম্ভবত তাই।

তবে একবার সেই পানওয়ালার সঙ্গেও কথা বলতে হচ্ছে তাহলে, মেঘনাদের কেন জানি না মনে হচ্ছে তার কাছ থেকে নিশ্চয়ই কোন নতুন তথ্য পাওয়া যাবে।

কোট-প্যান্টপরা ভদ্রলোকের ব্যাপারেও খোঁজ খবর নিতে হচ্ছে একটু।

ঘটনার পর দু’দিন কেটে গেছে। অন্তত দু’ডজন প্রাক্তন অপরাধীকে জেরা করা হয়ে গেছে মেঘনাদের। কিন্তু সবই বৃথা। কোন তথ্যই পাওয়া গেল না কারোরই কাছ থেকে। বিরক্ত লাগছিল তার।

ইতিমধ্যে রিপন স্ট্রিটের শেঠ ঝুনঝুনওয়ালার সঙ্গে দেখা করে এসেছে সে। কোন ফল নেই। রাজবিহারীবাবু নাকি আগেও দু’চারবার তাঁর কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন। সময়মত ফেরতও দিয়েছেন প্রত্যেকবারই। এবারও তার ব্যতিক্রম আশা করেননি।

লোকলজ্জার খাতিরে তদন্তের কাজ ফেলেও তাই বুধবার শালাবাবুর বিবাহ অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক উপস্থিত হতেই হল। বিয়েবাড়িতে আসার সময় দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে যখন বিরক্তিতে গজগজ করছিল তখন কি ভেবেছিল বিয়ে বাড়িতে গিয়েই হবে রহস্যের সমাধান।

আসল ব্যাপারটা হল মেঘনাদের শালাবাবুও নেহাৎ হেঁজিপেঁজি লোক নন। রাজ্য সরকারের অধীনস্থ উঁচু পদের আমলা সে। তার অনেক বন্ধু-বান্ধবও তাই যোগাযোগ সূত্রে মেঘনাদের চেনাজানা। এরই মধ্যে একজন হলেন নদীয়ার জেলাশাসক মিস্টার পঙ্কজ বক্সি। হাইকোর্টের নামজাদা উকিল হিসেবে রাজবিহারী সেনের নাম অনেকেরই পরিচিত; তাছাড়াও খুন হয়ে যাওয়ার পর কলকাতার সব বড়ো কাগজেই প্রথম পাতায় বড়ো বড়ো করে ছাপা হয়েছিল সেই খবরটা।

মেঘনাদের সঙ্গে দেখা হতেই তাই জিজ্ঞেস করলেন তিনি, “কেমন আছো হে অফিসার? রাজবিহারী সেনের কেসটার কিনারা হল?”

বিয়ে বাড়িতে এসেও সেই একই প্রসঙ্গ, বাধ্য হয়েই মাথাটা দু’দিকে নাড়ালো মেঘনাদ।

– “হয়ে যাবে, ওঁর ভাইয়ের থেকে কিছু জানতে পেরেছে অন্তত।”

– “ভাই?” তৎক্ষণাৎ যেন মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল মেঘনাদের।

– “কোন ভাইয়ের কথা বলছ পঙ্কজদা? প্রশ্নটা যেন মেঘনাদের মুখ থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে গেল।

–  “সেকি! কোন ভাই মানে? তার নিজের ভাই, রত্ননীল সেন; আবার কে। তদন্ত শুরু করোনি নাকি এখনও? যতদূর জানি তার ভার তো তোমার ওপরেই পড়েছে।”

মুহুর্তের মধ্যে মেঘনাদ যেন কেমন বোবা হয়ে গেল। বিয়ে বাড়িতে এসে একি বিড়ম্বনা। তিন দিন হয়ে গেল কেসটার পেছনে পাগলের মতন পড়ে আছে, অথচ ভিক্টিমের ভাইয়ের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করে উঠতে পারলো না সে? লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করল তার।

ঠিক সেই মুহূর্তেই সুদমা এসে ওকে পাত্রীপক্ষের লোকজনদের সঙ্গে আলাপ করার জন্য টেনে নিয়ে না গেলে কী হত কে জানে।

ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলো সেদিন। মেঘনাদ বুঝতেই পারছিল সেদিন তার আর ঘুম হবে না।

সুদমা ওকে ঘুমোবার জন্য ডাকতে এলে স্পষ্ট জানিয়ে দিল; “তুমি যাও, আজ শোবো না আমি।”

নিজের অর্ধাঙ্গকে ভালোভাবেই চেনে সুদমা। তাই আর কিছু না বলে শুতে চলে গেল। তদন্তের স্বার্থে মেঘনাদের রাত জাগা নতুন কিছু নয়।

তবে সেই রাতটা বেকার গেল না মোটেই। গভীর রাতেও জেগে থাকে শহরের অনেক প্রাণী। তাদেরই কিছুজনকে ফোন করে রত্ননীল সেনের ব্যাপারে জানা গেল অনেক কিছু।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন রত্ননীল, ১৯৮৮ সালের পাশ-আউট, ফিজিক্সের গোল্ড মেডেলিস্ট ছিলেন। কিন্তু এই দুর্দিনের বাজারে দুর্ভাগ্যবশত কোনও চাকরিবাকরি জোটাতে পারেননি। বউবাজারের মোড়ে একটা ছোট্ট কেমিক্যালের দোকান চালাতেন। অবস্থা ভাল ছিল না মোটেই; দরকার পড়লে তাই দাদার কাছেই হাত পাততে হত, সেই জন্যই সম্ভবত বিয়ে করেননি কখনও।

দাদার সঙ্গেও সম্পর্ক যে মধুর ছিল তা বলা চলে না। ছোট ভাই অকর্মণ্য আর কলেজ পাশের পর গোল্লায় গেছে, টাকার সদ্ব্যবহার সে করতে পারবে না; এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগেও নাকি দুই ভাইয়ের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়েছিল যথেষ্ঠ‌।

এইসব খবরের বেশিরভাগটাই পাওয়া গেল রাজবিহারীবাবুর প্রাক্তন সহকর্মী সুবল দত্তের কাছ থেকে। হাইকোর্টে বহুদিন একসঙ্গে কাজ করেছেন তাঁরা। খুব ভালো বন্ধু ছিলেন রাজবিহারীবাবুর, যদিও সম্পর্কটা বেশিরভাগ সময়ই ছিল পেশাদারীত্বের। নটরাজবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওর কাছ থেকে ঠিকানা আর ফোন নাম্বারটা জোগাড় করেছিল মেঘনাদ।

সৌভাগ্যবশত সুবলবাবুর কাছ থেকেই পাওয়া গেল রাজবিহারীবাবু ভাইয়ের ঠিকানা, কিন্তু ফোন নাম্বার নেই।

পরেরদিনই মেঘনাদ বেরিয়ে পড়ল রিপন স্ট্রিটের উদ্দেশ্যে। সকাল নটার সময় যখন পৌঁছল তখন রত্ননীলবাবুর বাড়ির সামনে বাজার বসে গমগম করছে। জিজ্ঞেস করতে করতে পৌঁছে গেল সে।

দরজায় টোকা মারতেই বেরিয়ে এল এক শীর্ণকায় মানুষ, চোখে চশমা, গায়ের ফতুয়াটা ঢলঢলে, মাথায় ছেয়ে আছে বিস্তীর্ণ টাক।

– “বলুন? মেঘনাদের দিকে তাকিয়ে মিহি গলায় প্রশ্ন তাঁর।”

নিজের পরিচয়টা এখনই দেবে না ঠিক করল মেঘনাদ।

– “রত্ননীল সেন?” শান্ত গলায় বলল সে।

ভদ্রলোক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই বলল, “একবার ভেতরে আসতে পারি, আপনার দাদার ব্যাপারে কিছু কথাবার্তা বলার ছিল।”

হয়তো ইচ্ছা ছিল না কিন্তু মাথাটা আরেকবার হেলাতেই ভদ্রলোককে প্রায় একরকম পাশ কাটিয়েই ঘরে ঢুকে পড়ল মেঘনাদ।

রত্ননীলবাবু যে বিরক্ত তা বোঝা যাচ্ছিল স্পষ্টতই। দরজাটা বন্ধ করতে করতে তাই আর একবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার পরিচয়টা তো জানা হল না।

ইতিমধ্যে ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়েছে মেঘনাদ। সুবলবাবু ঠিকই বলেছিল, ভদ্রলোকের দৈন্যদশা ঘরের চারপাশ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়। ঘরে আড়াআড়ি টাঙানো একটা নারকেলের দড়িতে ঝুলছে খান দু’য়েক ফতুয়া আর একটা লুঙ্গি। তার নিচে তক্তপোশের উপর রাখা বালিশ-বিছানাগুলো দেখেই বোঝা যায় পরিষ্কার হয়নি মান্ধাতার আমল থেকে। দেওয়ালের পলেস্তারা অর্ধেক জায়গায় নেই, বাকি অর্ধেকও বিলুপ্তির পথে। ফ্যান মাথার ওপর একটা ঘুরছে বটে, তবে সেটাও মৃতপ্রায়। ঘরে আসবাবপত্র বলতে একটা টেবিল আর একটা ভাঙ্গা আলমারি।

প্রশ্নটা শুনে উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিলো মেঘনাদ, “আমি বীমা সংস্থা থেকে আসছি, আপনার দাদার ব্যাপারে কিছু কথা বলার ছিল।”

মেঘনাদ দেখল চশমার আড়ালে ভদ্রলোকের চোখ দু’টো একবার চিকচিক করে উঠেই মুখাবয়বটা আবার ম্লান হয়ে গেল।

– “ও, দাদা। তা বলুন কী বলার আছে।” হতাশা ভরা গলায় বললেন রত্ননীলবাবু।

– “আপনিই ওঁর ভাই তো?” ইতিমধ্যে মাঝের ফাঁকা দরজাটা দিয়ে রান্নাঘরেও এক ঝলক চোখ বুলিয়ে ফেলেছে মেঘনাদ। কয়েকটা মাত্র বাসন আর একটা ভাঙা স্টোভ। বৈভবের ছাপ নয় মোটেই। ঘরের একদিকে রাখা সম্ভবত ভাঙা কুঁজোটা থেকে জল গড়িয়ে মেঝের কিছুটা ভিজে আছে।

– “হ্যাঁ, তবে ওই নামেই, আজ যোগাযোগ নেই প্রায় কুড়ি বছর হল। দাদারও আমার মতন একারই সংসার, সম্ভাব ছিল না কেন কে জানে।” নিজের মনেই যেন কথাগুলো বলে গেলেন ভদ্রলোক।

-“রাজবিহারী সেনের যে জীবনবীমা করা আছে তা জানেন আপনি?” প্রশ্ন মেঘনাদের।

– “কী করে আর আমি জানব? যোগাযোগই ছিল না দাদার সঙ্গে।” হতাশ গলায় উত্তর রত্ননীল সেনের। “দাদা এত বড় মানুষ আর আমি তো জীবনে কিছুই করতে পারলাম না।” নিজের মনেই যেন কথাগুলো বলছিলেন তিনি।

– “তবে বীমার নমিনি কে আছে জানতে পারি?” কিছুক্ষণ থেমে মেঘনাদের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।

উত্তরটা এখনই দিয়ে দিলে আর প্রশ্ন করা যাবে না বুঝতে পেরে মেঘনাদ বলল, “বীমার তো কোন নমিনী ছিল না তবে তাঁর নিকটস্থ আত্মীয় হিসাবে তা আপনারই পাওয়ার কথা।”

– “ও।”

– “আপনার সঙ্গে কি ওঁর একদমই যোগাযোগ ছিল না?”

– “নাহ্। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি।”

“আপনি তো দাদার মারা যাওয়ার পরেও পুলিশ কিংবা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।”

“কী করে করি বলুন তো? খবরের কাগজে দেখেছিলাম খবরটা। কিন্তু, দাদা এত বড় গণ্যমান্য মানুষ, আর আমাকে তো কেউ চেনেও না। তাই ভাবলাম আর যোগাযোগ করব না, এতদিন অজানা অখ্যাত থেকেছি আজও তাই থাকতে চাই।”

– “পুলিশ জানে আপনার কথা? খুনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কিছু নাকি?”

– “এখন অবধি না। জানি না জানে কিনা। হয়তো জানে, কিন্তু প্রয়োজন মনে করেনি কিছু খোঁজখবর নেওয়ার।”

আর এখানে থাকা মানে শুধু সময় নষ্ট। তাই আবার আসবে বলে ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল মেঘনাদ।

অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে তার। প্রথমত, ভদ্রলোকের চেহারা। ওই শরীরে পিঁপড়ের বেশি কিছু মারা শক্ত তা সে বুঝতে পারছিল। কিন্তু ভদ্রলোকের ডাহা মিথ্যা কথা বলার অভ্যাসই সব হিসাব ওলট-পালট করে দিচ্ছে। দাদার সঙ্গে সম্পর্ক নেই বলে কী হাসিল করতে চাইছেন তিনি। ঘরের দুর্দশা দেখে মনে হল দাদার সম্পত্তির কিছুটা পেলেও বর্তে যান তিনি। পুরোটা হলে তো কথাই নেই। এদিকে সব আইনই তাঁর লক্ষ্মীপ্রাপ্তির দিকে ইঙ্গিত করছে। রাজবিহারী সেনকে মারার একটা বড়ো মোটিভ তাঁর আছে সে নিয়ে সন্দেহ নেই। অনেক কিছু জানা গেল এখানে এসে। ফেরার পথে মনে মনে তাই সুবলবাবুকে ধন্যবাদ দিচ্ছিল মেঘনাদ।

আজ আর অফিসে যাবে না ঠিক করল মেঘনাদ, অনেক কিছু ভাবার আছে আর সেটা ঘরে বসেই সম্ভব। ঘরের জন্য কিছু টুকিটাকি জিনিসপত্র আনার ছিল, বাড়িতে ফেরার পথেই সেগুলো কিনে নিয়েছিল মেঘনাদ।

ঘরে ঢুকে জিনিসপত্রগুলো রেখে নকুলকে এক কাপ চা করার হুকুম দিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল মেঘনাদ।

সুদমা ইতিমধ্যে স্কুলের জন্য বেরিয়ে গেছে বাড়িতে আপাতত সে তাই একা। চায়ের কাপে এক চুমুক দিতেই হঠাৎ তার মনে এল রত্ননীলবাবুর সেই দৃষ্টিটা। বীমার কথাটা শোনামাত্র এক মুহূর্তের জন্য হলেও বজ্রপাতের মত ঝলসে উঠেছিল তাঁর চোখগুলো। ও দৃষ্টি যে লোভের তা নিয়ে মেঘনাদের কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন, উনি কী জানতেন রাজবিহারীবাবুর নামে মোটা অঙ্কের বীমা করা আছে?

যদি টাকার জন্যেও খুন হন রাজবিহারীবাবু, তাহলেও খুনটা করল কে? রত্ননীলবাবু নিজেই নাকি কোন ভাড়াটে গুন্ডা?

নটরাজবাবুর চাকর সুখদেবের কথাটা মনে পড়ল তার। আততায়ীর সম্ভাব্য পোশাক ছিল কোট-প্যান্ট। রত্ননীলবাবুর সেরকম কোনও বেশ আছে বলে তো মনে হল না।

নিজের সঙ্গে দাদার সম্পর্ক নিয়েও কেন এতগুলো মিথ্যা কথা বললেন তিনি? নিজের এই দৈন্যদশার জন্য তিনি কী অনুতপ্ত, দাদার সঙ্গে টাকাপয়সা নেওয়ার সম্পর্কটাকে প্রকাশ করতে চাইছেন না? নাকি তার থেকেও বেশি কিছু লুকোতে চাইছেন রত্ননীল সেন।

চার্জশিটের ডেডলাইন আর দু’দিন বাকি। রত্ননীলবাবুই যে খুনটা করেছেন সেই ব্যাপারে মেঘনাদের ধারণা ক্রমশ বদ্ধমূল হচ্ছিল। কিন্তু প্রমাণ কই, প্রমাণ ছাড়া তো চার্জশিট দেওয়াই যাবে না। থানায় ডেকে এনে একবার জেরা করা যেতে পারে কিন্তু তাতেও যে লাভ হবে তার কোনও গ্যারান্টি নেই।

একবার লোকাল থানায় ঘুরে এলে মন্দ হয় না হঠাৎ মনে হল মেঘনাদের, ওরা কী খোঁজখবর করল সেটাও জানা যাবে। বলা যায় না, এইসব ক্ষেত্রে অনেক সময়ই লোকাল থানাই রহস্যের সমাধান করে ফেলে।

তাই আর দ্বিধা না করে ইউনিফর্মটা গায়ে চাপিয়েই বেরিয়ে পরলো সে। লোকাল থানায় যখন এসে পৌঁছলো ঘড়িতে তখন প্রায় তিনটে। কনস্টেবলের স্যালুট পেরিয়ে ওসির কাছে যেতেই তাঁর মুখে ফুটে উঠল একগাল হাসি।

– “কী মেঘনাদ, কতদূর এগোল? সমাধান করে ফেলেছ নাকি অলরেডি?”

বুদ্ধিমান তদন্তকারী হিসাবে মেঘনাদের সুনাম যথেষ্ট সুদূরপ্রসারী। তাই একগাল হেসে সেও বলল, “আরে না না আপনাদের কতদূর?”

– “বেশিদূর না তোমার অপেক্ষাতেই বসে আছি।”

ওসি চন্দ্রিল ভট্টাচার্য্যের হলদে ছোপ ধরা দাঁতের হাসিটা দেখতে আর মোটেই ভাল লাগছিল না মেঘনাদের।

কাজের কোনও কিছু জানতে না পেরে বিরক্ত হয়ে উঠছিল সে, তখন কী আর জানত রহস্য সমাধান থেকে আর এক পা পেছনে দাঁড়িয়ে সে।

– “যাইহোক, চা বলি?” আবার সেই দেঁতো হাসি হেসে প্রশ্ন ওসির।

– “হ্যাঁ।” ওসি সামনের চেয়ারটায় বসতে বসতে উত্তর দিল মেঘনাদ।

– “আর আপনাকে একটা জিনিস বোধহয় দেখানোর ছিল।”

– “কি?” উল্টোদিকের চায়ের দোকানের ছেলেটার দিয়ে যাওয়া কাপটার দিকে হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল মেঘনাদ।

– “রাজবিহারীবাবুর বাড়ির কিছুটা দূরেই খুনের পর দিন একটা মানিব্যাগ পাওয়া গেছে।”

– “কি বলছেন কি?” চোখ প্রায় কপালে উঠে গেছে মেঘনাদের।

– “ঠিকই বলছি স্যার।” উত্তর দিয়ে এক কনস্টেবলকে মনে হয় সেটা আনার ইঙ্গিত করলেন ওসি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওসি সেটাকে হস্তগত করে এগিয়ে দিল মেঘনাদের দিকে। “দেখো তো একবার।”

– “মানিব্যাগ? কই দেখি। চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বা হাত বাড়িয়ে দিল সে।”

সেটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে ঘেঁটে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কোন আইডেন্টিফিকেশন মার্ক নেই দেখছি।”

– “নাহ্। শুধু চারটে দশ টাকা আর দু’টো একশো টাকার নোট আছে ভিতরে।”

– “আর একটা জিনিস আছে সেটা বোধহয় লক্ষ্য করেননি।”

– “কী?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওসি তাকালেন মেঘনাদের দিকে।

– “এটা।” মানিব্যাগের ভেতর থেকে একটা পুরনো ভেজা ফটো বার করে ওসিকে দেখাল সে।

– “ফটো? যার মানিব্যাগ তারই মনে হয়। কিন্তু এতো ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে পুরো।” ফটোটা হাতে নিয়ে হতাশ গলায় বললেন ওসি।

– “পুরোটা নয়। ভালো করে দেখলেই দেখতে পাবেন মাথার দিকের অংশটা ভেজেনি। ভদ্রলোকের মাথায় যে কালো চুল ছিল সেটা স্পষ্ট।”

– “হুম, তা থেকে কী প্রমাণিত হল?”

– “কিছুই না। তবে আমার সন্দেহ সেদিন রাতে রাজবিহারীবাবুর আততায়ীর পকেট থেকে এটি পড়ে যায়।”

– “বলছো কি মেঘনাদ! এই পার্স তবে সেই খুনীরই?”

– “হতে পারে। তবে তার কোনও তথ্য-প্রমাণ আমার কাছে এই মুহূর্তে নেই।”

– “এটা তুমি রাখো তাহলে। তদন্তে কাজে লাগতে পারে।”

– “ধন্যবাদ।” বলে মানিব্যাগটা পকেটে পুরে ফেলল মেঘনাদ।

– “আজ আসি তাহলে।” চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়ল সে।

– “হ্যাঁ। নতুন কিছু খোঁজ পেলে জানিও।”

– “অবশ্যই।” থানা দরজা দিয়ে বেরোতে বেরোতে বলল মেঘনাদ।”

ঘরে ফিরে মানিব্যাগটা নিয়ে বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল সে। বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে ফটোটা ভালো করে দেখছিল সে। মাথার চুল বাদে বাকি সব কিছুই অস্পষ্ট, জলে ভিজে ছিঁড়ে গেছে। সম্ভবত খুনের রাতের বৃষ্টির ফল।

হতাশ লাগছিল মেঘনাদের। রত্ননীলবাবুর বাড়ি গিয়ে যেটুকু আশার আলো দেখেছিল সেটাও যেন মিলিয়ে গেল। এ মাথা তাঁর হতেই পারে না। কে তবে? তার তদন্ত ঠিক দিকেই এগোচ্ছে তো? এটা কি সত্যি রাজবিহারীবাবুর হত্যাকারীর মানিব্যাগ? নাকি পথচলতি কোনও মানুষের বাজে জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে সে? একগাদা প্রশ্ন এসে মাথায় ভীড় করছিল তার।

ঠিক তখনই সদর দরজার কলিং বেলটা বেজে উঠল।

মেঘনাদ গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পেল সুদমাকে। ছটা বেজে গেল ইতিমধ্যেই?

– “তুমি অফিস যাওনি আজ?” মেঘনাদকে দেখে অবাক গলায় বলে উঠলো সুদমা।

– “না। ছুটি নিলাম আজ।” দরজা বন্ধ করতে করতে জবাব মেঘনাদের।

– “ও আচ্ছা।” ভেনিটি ব্যাগটা টেবিলে রেখে বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেল সুদমা।

তার পিছু পিছু মেঘনাদ ঘরে ঢুকতেই এগিয়ে এল সেই মোক্ষম প্রশ্ন।

– “তোমার সেই খুনের তদন্ত কত দূর এগোল গো?” কানের দুল খোলবার জন্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সুদমা।

– “কিছুই না। আটকে গিয়েছি পুরো।” হতাশ গলায় উত্তর মেঘনাদের।

– “কেন? কোনও ক্লু পাচ্ছো না বুঝি?” বাঁ কানের দুল খুলতে খুলতে প্রশ্ন গোয়েন্দা গিন্নির।

– “হুম।” বলে বিছানায় গিয়ে বসে বলল মেঘনাদ।

সুদমা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে কী ভেবে যেন একটা কথা বলে বসল মেঘনাদ, “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন ছাত্রকে নিয়ে খুব সমস্যায় আছি।”

– “কে ছাত্র? কী করে এখন? কবে পাস-আউট?” ঘর থেকে আর বেরোনো হল না সুদমার।

– “রত্ননীল সেন। কেমিক্যালের দোকান আছে বৌবাজারে।”

– “রত্ননীল সেন? নাহ্, মনে হয় না আমাদের ব্যাচে ওই নামে কেউ ছিল বলে। কবে পাস-আউট?”

– “১৯৮৮।”

– “অ্যাঁ? সে তো অনেক পুরনো। কি করবে তার খোঁজ নিয়ে?”

– “জানি না। আজ সকালে গিয়েছিলাম তার বাড়ি। দেখে মনে হল না খুনটা সে করতে পারে বলে। তবে বলা যায় না, আজকালকার বাজার।” জানলা দিয়ে দূরে নির্মীয়মান বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল মেঘনাদ।

– “হুম, এক কাজ করতে পারো তো তুমি। আশুতোষদার সঙ্গে একবার কথা বলে দেখতে পারো।”

– “আশুতোষদা? কে তিনি?” জিজ্ঞাসু গলায় প্রশ্ন মেঘনাদের।

– “আমাদের সিনিয়র ছিলেন। চারবছর আগের। ১৯৯৪ এর পাস-আউট।”

– “ও আচ্ছা। ওঁকে খোঁজ করলে পাওয়া যাবে রত্ননীলবাবুর খোঁজ?”

– “পেতে পারো। জুনিয়ার সিনিয়ার অনেকেরই খোঁজ রাখতেন উনি।”

– “হুম। নাম্বারটা দিতে পারবে ওঁর?”

– “হ্যাঁ। এই নাও।”

তদন্তে ভালোই কাজে এল সহধর্মীনী। সুদমা যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত তা মেঘনাদ আগে থেকেই জানত কিন্তু তদন্তের কোনও ব্যাপার তাকে জানায়নি কারণ রত্ননীলবাবুর বহু পরে সেখানে পড়াশোনা করেছে সে, আশুতোষ মাঝিকে ফোন করার পর ভাবছিল মেঘনাদ। ভদ্রলোক আমেরিকায় থাকেন এখন। কোন এক সফটওয়্যার কোম্পানির কর্মচারী। কিন্তু মাতৃভূমি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর টানটা রয়েই গেছে।

রত্ননীলবাবুর খোঁজ উনিও দিতে পারলেন না ঠিকই। কিন্তু কলকাতার এক নামকরা ব্যবসায়ীর খোঁজ দিলেন তিনি। ১৯৮৮ সালের পাশ-আউট তিনি।

পরেরদিন সকাল দশটায় ট্যাক্সি থেকে যখন ভবানীপুরে তার প্রাসাদসম বাড়ির সামনে এসে নামল তখন বৈভব আর ঐশ্বর্য দেখে মেঘনাদের চোয়ালটা যেন আপনিই নিচে নেমে গেল।

গাড়ি থেকে নেমে বিশাল বড়ো সিংহ দরজার সামনে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল এক দারোয়ানকে। তার দিকে এগিয়ে যেতেই গম্ভীর গলায় প্রশ্ন এল, ইন্সপেক্টর মেঘনাদ দাশগুপ্তা?”

– “ইয়েস।” পুলিশি ভঙ্গীতে উত্তর দিল মেঘনাদে।

– “আসুন সাহেব।” বলে অন্দরমহলে যাওয়ার আহবান এল।

দারোয়ানের পিছু পিছু বাড়িতে ঢুকতেই মেঘনাথ বুঝতে পারল কোনও এক কালে পুরনো রাজপ্রাসাদ ছিল এই বাড়ি। বৈঠকখানা দেওয়ালে বিশাল বড়ো বড়ো পূর্বপুরুষের পেইন্টিং যে এ আমলের নয় তা বলে দিতে চিত্রবিশেষজ্ঞ হতে হয় না।

– “বসুন।” শ্বেতশুভ্র সোফাগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ঘোষণা দারোয়ানের।

এগিয়ে গিয়ে একটা বড়ো সোফা দেখে তাতে বসে পড়ল মেঘনাদ।

– “বাবু এসে পড়বে এক্ষুনিই।” দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে গেল দারোয়ান।

দু’মিনিট পরে পাশের ঘরের দরজা দিয়ে যে ঢুকলেন তাকে দেবপুরুষ বললেও মনে হয় কম বলা হবে।

সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা হাতের দশ আঙুলে বোধহয় বারোটা আংটি আছে সব মিলিয়ে।

ভদ্রলোক ধীরপায়ে এসে মেঘনাদের সামনের চেয়ারটায় বসে পড়লেন।

– “বলুন ইন্সপেক্টর। কী ব্যাপারে আসতে হল?” সৌম্য গলায় প্রশ্ন ভদ্রলোকের।

– “রাজবিহারী সেনের খুনের তদন্তের ব্যাপারে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করবার ছিল।”

-রাজবিহারী সেন? কলকাতা হাইকোর্টের উকিল ছিলেন যিনি? কিছুদিন আগেই খুন হয়েছেন যিনি?”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল মেঘনাদ।

– “আসলে তার ভাই রত্ননীল সেনের ব্যাপারেই আপনার কাছে খোঁজখবর করতে আসা।”

– “রত্ননীল সেন? চেনা চেনা লাগছে নামটা। দাঁড়ান, তার আগে কি খাবেন বলুন? চা বলি?”

আবার মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল মেঘনাদ।

– “রমেন, দু’টো চা।” ভিতরের দিকে তাকিয়ে হাঁক মারলেন ভদ্রলোক। হ্যাঁ এবার বলুন কী বলছিলেন। রত্ননীল নামটা শোনা শোনা কিন্তু কোথায় শুনেছি মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে।”

– “আপনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন তো?”

– “হ্যাঁ। কেন বলুন তো?”

– “রত্ননীলবাবুও ওখানের ছাত্র ছিলেন। ১৯৮৮ সালে পাস-আউট।”

– “ওহ্; ইয়েস ইয়েস। সাচ লং টাইম এগো। কিন্তু আপনি এসব জানলেন কোত্থেকে?” মুচকি হেসে প্রশ্ন ভদ্রলোকের।

– “কিছু মনে করবেন না কিন্তু ওখানকার আশুতোষ পালের সঙ্গে কাল রাতে কথা হয়েছে আমার। তিনিই আসলে আপনার ঠিকানাটা আমাকে দেন।”

– “আশুতোষ পাল? হ্যাঁ মনে পড়েছে। সে তো জুনিয়ার ছিল আমাদের থেকে অনেক। তবে ছেলেটাকে চিনি আমি। এখন আমেরিকায় থাকে সম্ভবত।”

– “হ্যাঁ।”

– “আপনি যে রত্ননীল সেনের কথা বলছেন এ সেই রত্ননীল সেন কিনা জানি না। তবে আমাদের ব্যাচে একজন ওই নামে ছিল বটে। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। ফিজিক্সে গোল্ড মেডেল পেয়েছিল সেবার সে।”

– “হ্যাঁ, ইনি তিনিই।”

– “ওহ্। রাজবিহারী সেন কি তারই দাদা ছিল?”

– “হ্যাঁ।”

– “আই সি।”

– “রত্ননীল সেনের স্বভাব আচরণ কেমন ছিল সে ব্যাপারে একটু আলোকপাত করতে পারেন?”

– “স্বভাব আচরণ বলতে অস্বাভাবিক কিছু নয়, মেধাবী ছাত্র তাই পড়াশোনা নিয়েই থাকত বেশিরভাগ সময়।”

– “তাঁকে দেখতে কেমন ছিল মনে আছে?”

– “তেমন কোন বিশেষত্ব ছিল না। রোগা-পাতলা চেহারা, তবে হ্যাঁ ঠোঁটের বা কোনে কালো তিল ছিল একখানা।”

কথাটা শুনে চমকে উঠলো মেঘনাদ। তিল? বর্তমানের রত্ননীল সেনের ঠোঁটের কোনে তো সে রকম কিছু নেই।”

– “মাথার চুল কি পাতলা ছিল? পরবর্তীকালে টাক পড়ার সম্ভাবনা ছিল কি?”

– “টাক? না, ওর পরিবারের কারোরই টাক ছিল না। তবে টাক তো শুধু মাথার চুল পাতলা হলে পরে না এখন তো অনেক কারণেই অনেকেরই মাথার চুল পড়ে যায়।”

– “তাও ঠিক।”

– “আপনার ব্যাচের পাস-আউটের ফটোটা কি একবার দেখা যায় সেখানে তো রত্ননীলবাবু আছেন মনে হয়?” দার্জিলিং টিয়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করল মেঘনাদ।

– “নিশ্চয়ই। দাঁড়ান এক মিনিট। অ্যালবামটা নিয়ে আসছি আমি।” বলে উঠে গেলেন ভদ্রলোক।

তিনি চলে যেতে ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে দেখল মেঘনাদ। একদিকে দেওয়ালের ধারে শোকেসের ওপর রাখা আছে কতগুলো মার্বেলের মূর্তি। দেখে পুরোনোই মনে হল।

ইতিমধ্যেই ফিরে এলেন ভদ্রলোক। হাতে একখানা মোটা বাধানো জাবদা খাতা।

– “এই যে।” বলে মেঘনাদের সামনের টেবিলে খাতাটা খুলে বসে পড়লেন তিনি।

একটা নির্দিষ্ট পাতায় এসে একটা ছবিতে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন তিনি। মেঘনাদ ঝুঁকে পড়ে দেখলো একটা আবছা ফটো। কিন্তু বোঝা যায় ভালো করেই।

– “এই যে রত্ননীল, আর আমি।” ফটোতে দু’টি নির্দিষ্ট জনকে দেখিয়ে বললেন তিনি।

বেশ সুপুরুষ ছিলেন এককালে রত্ননীল সেন। মাথায় ঘন কোঁচকানো চুল, ঠোঁটের কোণে পাতলা হাসি।

ভালো করে ছবিটা দেখলো মেঘনাদ। এখনকার রত্ননীলবাবুর কোন মিলই নেই।

আরও কিছুক্ষণ থেকে কিছু প্রশ্ন করে বেরিয়ে এল মেঘনাদ।

প্রশ্নের তালিকা আরো বড়ো হচ্ছে মেঘনাদের মনে। এত ভালো ছাত্র হয়েও কেন কোনও ভালো চাকরি বাকরি জোটাতে পারলেন না রত্ননীলবাবু। আরেকটা কথা, তাঁর ঠোঁটের কোণের তিলটা গেল কোথায়। একটু আগে ফটোতেও দেখে এল সেটার অস্তিত্ব মনগড়া নয়। রহস্যের কালো অন্ধকার ঘিরে রয়েছে মেঘনাদকে, কোনও আশার আলো নেই।

হঠাৎ কী মনে করে পকেটে রাখা মানিব্যাগ থেকে ফটোটা একবার বের করে দেখলো সে। অস্পষ্ট মাথার চুলটাই বোঝা যায় শুধু। ফটোটা আবার মানিব্যাগে রাখতে গিয়ে একটা জিনিস চোখে পড়ল তার। ফটোটা উল্টো পিঠে নীল পেন দিয়ে কি যেন লেখা। ভালো করে নজর করতেই বুঝতে পারল সেটা সম্ভবত ফটো আর মানিব্যাগের মালিকের নাম, “আর. _ সেন”।

মাঝের অক্ষরটা পড়া যায় না কিন্তু যেটুকু আছে সেটাই যথেষ্ট।

– “ট্যাক্সি – ” বলে সে দৌড়ে গেল মেনরোডের দিকে।

রিপন স্ট্রিটের গলি দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলেছিল মেঘনাদ। এখনও খুব বেশি দেরি হয়নি আশাকরি। পিছনে পুলিশ লেগেছে যখন তখন পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি। এমনিতেই তো আসবাবপত্র চালচুলো বিশেষ নেই, খুব বেশি সময় নেওয়ার কথা নয়।

রত্ননীলবাবুর বাড়ির কলিংবেল দু’বার বাজাতেই দরজা খুললেন রত্ননীল সেন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে সজোরে ধাক্কা মেরে ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ দিল মেঘনাদ।

– “এ – একি? কে আপনি? ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকে পড়লেন কোন সাহসে?” চিৎকার করে উঠলেন বাড়ির মালিক।

তক্তপোশের উপর একটা সুটকেস দেখেই সবকিছু আরও স্পষ্ট হয়ে গেল মেঘনাদের কাছে।

– “থানা থেকে আসছি। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।” বজ্রনির্ঘোষ কন্ঠে ঘোষনা মেঘনাদের।

– “মানেটা কি? একি মগের মুলুক নাকি?” সকালের দুঃখ দুঃখ ভাবটা আর নেই রত্ননীল সেনের মুখে, বরং তার বদলে স্পষ্ট হয়ে উঠছে রাগ আর হিংস্রতার ছাপ। লক্ষ করল মেঘনাদ।

– “মানে পরে বুঝবেন, আগে বলুন এটা কি?” মানিব্যাগটা পকেট থেকে বের করে রত্ননীলের সামনে ধরার আগেই হঠাৎ একটা প্রচন্ড ঘুষি আছড়ে পড়ল মেঘনাদের মুখে।

এক মুহূর্তের জন্য যেন পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেল মেঘনাদের কাছে। মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরমুহূর্তেই চোখ খুলে দেখতে পেল বিছানা থেকে স্যুটকেসটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে দৌড়তে যাচ্ছে রত্ননীল সেন। সময় নেই, তাই মাটিতে শুয়েই যুযুৎসুর ভঙ্গিতে বা পাটা সেদিকে বাড়িয়ে দিল মেঘনাদ।

দড়াম! তাড়াহুড়োতে সেদিকে নজর না করে মেঘনাদের লেঙ্গি খেয়ে প্রায় ডিগবাজি দিয়ে প্রচন্ড আছাড় খেলেন রাজবিহারী সেনের ভাই। স্যুটকেসটা ছিটকে চলে গেল পুরো দরজার বাইরে। চশমাও ছিটকে চলে গেল ঘরের কোণে।

ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে দু’জনেই। রোগাপাতলা হলেও দুর্বল নয় রত্ননীল সেন সেটা বুঝতে পারছিল মেঘনাদ। আরেকবার ঘুষি মারার জন্য দৌড়ে আসতেই নিচু হয়ে এক মোক্ষম পাল্টা ঘুষি বসিয়ে দিল আততায়ীর পেটে।

– “আঁক বলে পেট চেপে দু’পা পিছিয়ে যেতেই আরেকটা ঘুষি আছড়ে পড়ল প্রাক্তন আইনজীবীর ভাইয়ের মুখে।

ব্যাস; গোঁওও শব্দ করে মাথাটা পিছনের দিকে এলিয়ে মেঝেতে চিৎপাত হয়ে গেল কেমিক্যাল ব্যবসায়ী।

– “খেলা শেষ, রত্ননীলবাবু।” মাটি থেকে উঠে কাঁধ থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে উঠল মেঘনাদ।

হামাগুড়ি দিয়ে তিনি উঠতে যাচ্ছেন দেখে ঘাড়ের কলার ধরে রত্ননীল সেনকে টেনে তুলল সে।

মেঘনাদের পিছু ধাওয়া করে ইতিমধ্যেই রিপন স্ট্রিটে রত্ননীলবাবুর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে পুলিশ ভ্যান।

দু’জন কনস্টেবল সেখান থেকে নেমে দরজা দিয়ে ঢুকতেই বিখ্যাত আইনজীবীর ভাইকে তাদের দিকে ফেলে দিল মেঘনাদ।

– “কাজটা ভালো করলেন না কিন্তু।” দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে বলে উঠলো হত্যাকারী।

শুনতে পেয়ে মুচকি হেসে তার মানিব্যাগটা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে পকেটে পুরে ফেলল মেঘনাদ।

এই ঘরটা এখনও সার্চ করা বাকি ছিল মেঘনাদের, তাই এই বেলাই সেই কাজটা করে ফেলতে চাইছিল। রত্ননীলবাবুকে নিয়ে পুলিশ ভ্যান বেরিয়ে যেতেই দ্রুতপায়ে ভাঙা আলমারিটার দিকে এগিয়ে গেল মেঘনাদ। ভাঙা কপাট খুলতেই বেরিয়ে এল কালো রঙের কোট প্যান্ট।

এক্সপেক্টেড, মনে মনে ভাবছিল সে। তখনই নজর চলে গেল ঘরের কোণে টুলের উপর রাখা জলের কুঁজোটার দিকে। কী যেন ভেবে সেদিকে এগিয়ে গেল মেঘনাদ। কুঁজোর ঢাকনাটা খুলতেই একটা উৎকট গন্ধ এসে নাকের ঠেকলো তার। এটা কি আদৌ জল? মেঝের চারপাশটায় চোখ বোলাতেই একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করল সে। কুঁজো থেকে জলটা মেঝের যেসব অংশে পড়েছে সে জায়গাগুলোর রং চটে গেছে।

এসব ছেড়ে একটু ঝুঁকে কুঁজোর ভেতরটা দেখতেই মেঘনাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল সব। এই জিনিসটাকেই কি এতক্ষণ ধরে খুঁজছিল সে। একটা কিচেন নাইফ, খুনের অস্ত্র স্বভাবতই। কিন্তু আদালতে এ কোনও কাজে লাগবে বলে মনে হয় না। রাসায়নিকে ডুবিয়ে রাখার ফলে রক্তের দাগ তো কোন ছার, হাতের ছাপও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

আরেকটা জিনিস চোখে পরলো মেঘনাদের, এটা অবশ্য অপ্রত্যাশিত। কাপড়ের ছাঁট, সাদা কাপড়ের। শার্টের অংশ সম্ভবত, খুনের দিন এই পোশাক পড়েই মনে হয় দাদার বাড়িতে গিয়েছিলেন ভাই।

সাদা কাপড়, তাই রক্ত লেগে থাকার সম্ভবনাটাও অনেক বেশি। হয়তো লেগেছিল। তাই সেটা অ্যাসিডে পুড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন রত্ননীলবাবু। কোট আর প্যান্টে সম্ভবত রক্ত লাগেনি অথবা লাগলেও গাঢ় রঙের জন্য বোঝা যাবে না ভেবেছিলেন তিনি। এমনিতেও এই ধরনের পোশাক তাঁর যে খুব বেশি ছিল তা নয়।

জিনিসগুলোকে পকেটে রাখা প্লাস্টিক র‍্যাপারে পুরে ফেলল মেঘনাদ। সেটা পকেটে ঢুকিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে।

থানায় চার্জশিট জমা করে যখন সেদিন রাতে বাড়ী ফিরল সে, তখন খুশি খুশিই লাগছিল মেঘনাদকে। কিন্তু রহস্যের শেষ সেখানেই হল না।

একদিন মামারবাড়ির আদর পেয়েই জানা গেল গতকাল বিকেলে যার সঙ্গে এত মল্লযুদ্ধ হল মেঘনাদের, সে আসলে রত্ননীল সেনই নয়। রহস্য ক্রমশ গাঢ় হচ্ছিল মেঘনাদের মনে।

রত্ননীল সেন যে মারা গেছেন প্রায় এক বছর হল এটা জানা গেল নিমতলা শ্মশানের রেজিস্টার বুক থেকে। মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক।

অনেক জেরা করে জানা গেল নকল রত্ননীল সেনের আসল পরিচয় রমেশ রায়। রত্ননীল সেনের দোকানে এককালে কাজ করত সে। দোকান বহুদিন বন্ধ সেই কারণে কেউ জানত না আসল রত্ননীল সেনের মৃত্যুর খবর।

কীভাবে মারা গেলেন তিনি সেটা লালবাজারের ইন্টারোগেশন রুমে বসে পরেরদিন জানতে পারল মেঘনাদ।

রত্ননীল সেন মেধাবী ছাত্র হলেও বাবা মাকে হারিয়ে ছিলেন কম বয়সেই। দাদা রাজবিহারী সেনই ছিল তার একমাত্র নিকট আত্মীয়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ হওয়ার পর পরবর্তী পড়াশোনার জন্য দাদার কাছে তাই অর্থ সাহায্য চাইতে গিয়েছিল তিনি। যে কোনও কারণেই হোক না কেন ভাইয়ের উপর ততদিনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন ওকালত ব্যবসায়ী রাজবিহারী সেন। ভাইয়ের পেছনে গাদা গাদা টাকা খরচা করেও কোন রিটার্ন পাওয়া যাচ্ছে না সেই ধারণা বদ্ধমূল ছিল তাঁর। বরং এই টাকা রেসের মাঠে কাজে লাগালে ভালো ফল পাবেন বলে ভেবেছিলেন।

মেধাবী ছাত্র হয়েও শেষ পর্যন্ত তাই বউবাজারের মোড়ে ছোট্ট কেমিক্যালের দোকান খুলে বসতে হয়েছিল তাকে। নিজে কোটি কোটি টাকা রোজগার করেও ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাতে চাননি রাজবিহারী সেন। তবে দাদার এই ভুল সিদ্ধান্ত কোনদিন ক্ষমা করতে পারেননি রত্ননীল সেন। দাদার কাছে এরপরেও যেতেন টাকা পয়সার দরকার পড়লে।

আজ থেকে প্রায় এক বছর আগে রাজবিহারীবাবুর বাড়িতে তিনি টাকা চাইতে গেলে এই বিষয় নিয়ে প্রচন্ড তর্কাতর্কি হয় দু’জনের মধ্যে। রমেশও সেইবার রত্ননীলবাবুর সাথে গিয়েছিল রাজবিহারীবাবুর বাড়িতে। অভদ্র ভাষা ব্যবহার করায় রেগে গিয়ে ভাইয়ের গলা টিপে ধরেন রাজবিহারী সেন। চোখের সামনে মালিককে শ্বাসরোধ হয়ে মারা যেতে দেখে রমেশ। হাইকোর্টের একজন এত বড় উকিলের গায়ে হাত তোলার সাহস তখন ছিল না তার।

ভাই মারা যাওয়ার পর রাজবিহারীবাবু নিজের ভুল বুঝতে পেরে মারাত্মক আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। শ্বাসরোধ করে খুন এর সাজা যে মৃত্যু, সেটা তিনি ভালো করেই জানতেন। নিজের অপরাধ ঢাকা আর সম্মান রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েন তিনি। মৃত্যুর কারণ আর হত্যাকারীকে লুকোতে রমেশকে তৎক্ষণাৎ এক লাখ টাকা অফার করেন তিনি বদলে রমেশকে কিছুদিন রত্ননীল সেন সেজে তার বাড়িতে থাকতে হবে।

পাড়ার চেনা এক ডাক্তার, ডঃ দীনবন্ধু মিত্রকেও মোটা টাকার জালে ফাঁসিয়ে ভুয়ো ডেড সার্টিফিকেট জোগাড় করে তিনি।

হ্যাঁ। নিমতলা শ্মশানেই দাহ হয় তার। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। রত্ননীল সেনের পাড়ার কেউই খবরটা জানত না। হাতে পেয়ে দোকানটাও বন্ধ করে দেয় রমেশ। রত্ননীল সেনের চেনাশোনা লোক এমনিতেই খুব কম ছিল। যা ছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগও বিশেষ ছিল না। তাই রত্ননীল সেন যে বেঁচে আছেন সেটা বাইরের দুনিয়াকে জানানোর কাজটা ভালোই চলছিল।

কিন্তু সমস্যা ছিল একটাই নানান রকমের নেশা করত রমেশ। আর এই ঘটনার পর থেকেই এইসব জিনিসের টাকা জোগাবার জন্য সে পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পরে রাজবিহারী সেনের উপর। হুমকি দেয় টাকা না পেলে সে সব ফাঁস করে দেবে।

সম্ভবত সেইজন্যই টাকা ধার নিতে হচ্ছিল রাজবিহারীবাবুকে। সেদিন রাতে রমেশ টাকা চাইতেই গিয়েছিল তাঁর বাড়ি। রমেশের ক্রমাগত দাবিতে তিতিবিরক্ত হয়ে তার সঙ্গে প্রচন্ড ঝগড়া শুরু করেন রাজবিহারী সেন। রাগের মাথায় রমেশের ওপর শারীরিক আক্রমণ করতে গেলেই পকেটের রাখা ছুরিটা তাঁর উপর চালিয়ে দেয় রমেশ।

ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় রাজবিহারীবাবুর। নকল রত্ননীল সেনের ভেক ধরার জন্য তার মানিব্যাগই ব্যবহার করত রমেশ। খুনের রাতে রাজবিহারী সেনের বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার সময় সেটা তার পকেট থেকে রাস্তায় পড়ে যায়। জেরায় স্বীকার করে নিয়েছিল রমেশ।

ধাঁধার পর ধাঁধা। কেঁচো খুঁড়তে কেউটে। কে জানতো হাইকোর্টের এত বড়ো নামকরা এক উকিল তার ভাইকে খুন করে বসে আছেন আজ প্রায় এক বছর হল। রেসের নেশা, পয়সার নেশা, ড্রাগসের নেশা যেন ডুবিয়ে দিল গোটা মানবজাতিকেই।

ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল মেঘনাদ। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে রমেশের দিকে তাকিয়ে একটাই কথা বলল শুধু।

– “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।।”

শুনে বাকা হাসি হাসল সে।

পরপর দু’দিন কলকাতার কাগজে ছাপা হয়েছিল এই জোড়া খুনের হত্যারহস্য। একটা কলকাতার বিখ্যাত উকিলের খুনের সমাধান নিয়ে; আরেকটা, যেখানে হত্যাকারী সেই উকিল নিজেই।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post কালচক্র| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | রাজশ্রী দত্ত| Bengali Detective Story
Next post রায় ভিলায় রক্তপাত| বাংলা গোয়েন্দা প্রিমিয়ার লীগ | মৌলী কুন্ডু| Bengali Detective Story