“কেসটা কী মনে হচ্ছে আপনার, মিঃ স্যানাল?”
বছর পঁয়ত্রিশের প্রাইভেট ডিটেকটিভ নীতিশ স্যানাল আরও একবার ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে নেয় বছর আটচল্লিশের বিশিষ্ট সেনগুপ্ত গ্রুপ-এ্যান্ড-কোম্পানিস এর কর্ণধারিণী মিসেস নন্দিনী সেনগুপ্তর মৃতদেহটা। শরীরে তেমন কোনও আঘাত নেই। শুধু মাথায় ভারী কোনও বস্তু দিয়ে বারবার আঘাত করা হয়েছে আর তার ফলেই মৃত্যু। গত দুদিন ধরে তিনি মিসিং ছিলেন। আজ তাঁর মৃতদেহ পাওয়া গেছে শহর থেকে দূরে একটা ফাঁকা জমিতে।
হাঁটু গেড়ে বসে লাশটাকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে চশমাটা খানিকটা নাকের উপরে তুলে উঠে দাঁড়ায় নীতিশ। তারপর ইনস্পেক্টর দেবস্মিতাকে উত্তর দেয়,
“সবার প্রথমে ওঁর বাড়ির সকলের সঙ্গে কথা বলা দরকার। তাঁদের কারোর প্রতি কোনও সন্দেহ আছে কিনা সেটা জানা দরকার।”
“হ্যাঁ অবশ্যই। ইতিমধ্যেই তাঁদের খবর দেওয়া হয়েছে। তাঁরা থানায় আসছেনও।”
ঠোঁটের কোণায় একটা হাসি খেলিয়ে নীতিশ বলে,
“আমি একবার নিজে যেতে চাই ওঁদের বাড়ি।”
তারপর ক্রাইমজোন থেকে নিজের গাড়িটা ঘুরিয়ে পৌঁছে যায় নিজের দোতলা, সামনে বাগান করা, ছিমছাম বাড়িটার সামনে। ঘরে গিয়ে ব্যালকনিতে নিজের রোটেটিং চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরায় নীতিশ। হাতে ধরা মিসেস নন্দিনী সেনগুপ্তর পরিবারের ডিটেইলস এর ফাইলটা। সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে নীতিশ দেখতে থাকে সেটা।
ভদ্রমহিলার স্বামী মিঃ শ্রীজিত সেনগুপ্ত বছর সাতেক আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তারপর থেকে পুরো কোম্পানি আর সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি। ভদ্রমহিলা স্মার্ট, সুশিক্ষিতা, সুন্দরী এবং অত্যন্ত ধনী। এমন একজনের শত্রু থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। পরিবারের সদস্য বলতে তাঁর উনিশ বছর বয়সী কন্যা রেশমি আর দেওর অর্জুন সেনগুপ্ত এবং তাঁর স্ত্রী অপরূপা সেনগুপ্ত। দম্পতি নিঃসন্তান।
ফাইলটা হাত থেকে রেখে আরও একটা সিগারেট ধরায় নীতিশ, তারপর মনে মনে বলে, “কালই যেতে হবে ওঁদের বাড়ি।”
সেইমত পরদিন সকাল হতেই সেনগুপ্ত ভিলার উদ্দেশ্যে নিজের গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। মজবুত লোহার গেটের কাছে এসে সিকিউরিটিকে নিজের কার্ড দেখিয়ে পরিচয় দেবার পর সে গিয়ে ভিতর থেকে অনুমতি এনে দিতেই গেট পেরিয়ে এগিয়ে চলে নীতিশ। দুধারে ফোয়ারা আর বাগান পেরিয়ে মাঝখানের পাথর বিছানো পথ দিয়ে এগিয়ে চলে সে। সাদা রঙের বিশাল অট্টালিকাটার দরজার কাছে গিয়ে বেল বাজায় সে। একজন বছর তিরিশের যুবক এসে দরজা খোলে আর তারপর বলে,
“আসুন ভিতরে এসে বসুন। আপনি কার সঙ্গে দেখা করতে চান?”
“মিঃ অর্জুন সেনগুপ্তর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তাঁকে ডেকে দিন।”
“হ্যাঁ আসুন আসুন। দাদাবাবু ঘরেই আছেন। আমি ডেকে দিচ্ছি এক্ষুণি।”
ভিতরে ঢুকে অভিজাত ড্রয়িংরুমের বিশাল সোফাটায় বসে নীতিশ। চারিদিকে ভাল করে দেখতে থাকে। অ্যান্টিক জিনিস দিয়ে সাজানো চারিদিক। বেশ শৌখিন পরিবার বোঝাই যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ড্রয়িংরুমে চলে আসেন অর্জুন সেনগুপ্ত এবং সঙ্গে তাঁর স্ত্রী অপরূপা সেনগুপ্ত। দুজনের মুখেই নেমেছে দুঃখের ছায়া। সোফায় এসে বসে প্রথম কথা অর্জুনবাবুই শুরু করেন,
“আপনার নাম অনেক শুনেছি। আপনি তো একজন স্বনামধন্য গোয়েন্দা। আশা করি আমার বৌদির খুনিদেরও তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করবেন আপনি।”
নীতিশ সামান্য একটু সামনের দিকে ঝুঁকে আর চশমাটা খানিকটা উপরে তুলে জিজ্ঞেস করে,
“এই পুরো ব্যবসার দায়িত্ব আপনার বৌদি একাই সামলাতেন তো?”
“হ্যাঁ, দাদার মৃত্যুর পর পুরো মালিকানা বৌদিরই ছিল। তিনি সবটা সামলে নিয়েছিলেন একা হাতে। সাক্ষাৎ মা দূর্গা ছিলেন আমার বৌদি। এমনটা যে হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি।”
বলতে বলতে চোখের জল মোছেন অর্জুনবাবু।
নীতিশ খানিকটা সময় নিয়ে ফের প্রশ্ন করে,
“তাহলে আপনার ভূমিকা এই কোম্পানিতে কিরকম ছিল?”
“আমি ম্যানেজার এই কোম্পানির। সবকিছু দেখাশোনা করতাম কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার বৌদিরই ছিল।”
নীতিশ এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলে,
“তাহলে এবার থেকে তো সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আপনারই। আফটার অল এখন তো সমস্ত মালিকানা আপনারই।”
এবার যেন খানিকটা হকচকিয়ে যান অর্জুনবাবু। তারপর একটু সময় নিয়ে আমতা আমতা করে বলেন,
“হ্যাঁ, নইলে আর কেউ তো নেই তেমন সবটা সামলানোর মত। দাদা বৌদির একমাত্র মেয়ে মিলি তো সবেমাত্র কলেজ পড়ুয়া।”
নীতিশ একটু ভ্রু কুঁচকে বলে,
“মিলির সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। ডেকে দিন।”
এবার প্রথম মুখ খোলেন মিসেস সেনগুপ্ত অর্থাৎ অপরূপা দেবী। তিনি বলেন,
“সে কি ডাকলে আর আসবে? মেয়েটা যেন কেমন হয়ে গেছে। কত ভাল আঁকার হাত ছিল। ফাইন আর্টস নিয়ে পড়ছিল। আমরা সবাই ওকে সাপোর্ট করতাম। কিন্তু মাস তিন চারেক হল ওর যেন কী হয়েছে।”
“তার মানে? কী সমস্যা তার?”
“মাস তিন চারেক হল মেয়েটা কিসব ভুলভাল বকে। সারাক্ষণ নিজের আঁকার খাতায় একটাই গ্রামের ছবি আঁকে। বলে ওটাই নাকি ওর গ্রাম। ওর আসল বাড়ি নাকি পুরুলিয়া জেলার এক গ্রামে। আর ওর আসল নাম নাকি সুখিয়া। ওর নাকি দুই ছেলে, স্বামী এবং শ্বাশুড়ী সবই আছে। ও বলে ও নাকি মিলি না, ও নাকি জাতিস্মর। কত সাইক্রিয়াটিস্ট দেখিয়েও কিছু লাভ হচ্ছে না।”
বলেই আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকেন অপরূপা দেবী।
নীতিশের ভ্রু এবার আরও কুঁচকে যায়। কপালে ফুটে ওঠে চিন্তার ভাঁজ। অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,
“জাতিস্মর! পূর্ব জন্ম! ইন্টারেস্টিং!”
তারপর সে বলে,
“আমাকে মিলির সঙ্গে একবার দেখা করতেই হবে। আমাকে ওর ঘরটা দেখিয়ে দিন।”
দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথম ঘরটাই মিলির। ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেই নীতিশ দেখে খাটের উপরে বসে মিলি তার ড্রয়িং কপিতে কী একটা আঁকছে। নীতিশ কাছে গিয়ে দাঁড়াতে মিলি চোখ তুলে তাকায়। অদ্ভুত তার চোখের দৃষ্টি। যেন শূন্যে ভাসছে।
নীতিশ হালকা হেসে বলে,
“আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ নীতিশ স্যানাল। তোমার মায়ের কেসটা ইনভেস্টিগেট করছি। দেখি তো তুমি কী আঁকছো?”
বলেই মিলির খাতার দিকে তাকাতেই নীতিশ দেখে সেখানে ফুটে উঠেছে এক গ্রামের দৃশ্য। পেন্সিল স্কেচের উপরে জলরঙের ছোঁয়ায় অসাধারণ জীবন্ত লাগছে ছবিটা। সত্যি মেয়েটার আঁকার হাত দারুণ।
হঠাৎ মিলি বলে ওঠে,
“উনি আমার মা নন। এঁরা কেউ আমার আপন নন। আমার আসল বাড়ি এই আমচুড়িয়া গ্রামে। আমার নাম সুখিয়া। আমাকে আমার আসল বাড়িতে নিয়ে চলুন প্লিজ।”
বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠে মিলি।
মিলির এমন কথায় কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নীতিশ। সে বুঝতে পারে যে মিলি সত্যিই মানসিকভাবে অসুস্থ। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার মত অবস্থা নেই।
তাই মিলির মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে খানিকটা সান্ত্বনা দিয়ে নীতিশ বেরিয়ে আসে তার ঘর থেকে। কপালে চিন্তার ভাঁজগুলো আরও স্পষ্ট হয় তার। নিজের মনে চিন্তা করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে ড্রয়িংরুমে সোফায় গিয়ে বসে সে। এবার তার সামনের টেবিলে কফি আর কিছু স্ন্যাকস রাখে সেই দরজা খুলে দেওয়া যুবকটি। অর্জুনবাবু বলেন,
“এই হল নরেন, আমাদের বাড়িতে কাজ করে। ও আমাদের পরিবারের সদস্যর মত।”
নীতিশ একবার আড়চোখে দেখে নেয় তাকে। মাজা গায়ের রং আর বেশ পেটানো চেহারা নরেনের। তারপর অর্জুনবাবুকে বলে,
“মিলি তাহলে ঠিক তিন চার মাস আগে থেকে এমন আচরণ করছে? তার আগে সে স্বাভাবিক ছিল?”
“একদম স্বাভাবিক ছিল মিঃ স্যানাল। জানিনা ওর হঠাৎ কি হল!”
“আচ্ছা আপনাদের কি কারোর উপর সন্দেহ হয়?”
“হয় একজনের উপর।”
নীতিশ এবার একদম সোজা হয়ে বসে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কার উপর হয়?”
“মিঃ অভিরূপ হালদার বলে একজনের উপর। এই যে এত সাজানো অ্যান্টিক জিনিস দেখছেন, এগুলো সব আমার বৌদি নিজেই এনে সাজিয়েছেন। অ্যান্টিক জিনিস সংগ্রহ করা ছিল তাঁর হবি। মিঃ হালদার তাঁর ব্যবসা ঠিক না চলায় তাঁর পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া অ্যান্টিক গ্রামোফোনটা আমার বৌদির কাছে বেশ ভাল দামে বিক্রি করেন। কিন্তু কিছু মাস বাবদ তাঁর ব্যবসা আবার ভালভাবে চলতে শুরু করলে তিনি সেই গ্রামোফোনটা পুনরায় কিনতে চান। তখন আমার বৌদি কিছুতেই সেটি বিক্রি করতে চাননি, যার কারণে মিঃ হালদার ওঁকে অনেক হুমকি দিয়েছিলেন।”
নীতিশ হাতটা বুকের কাছে জড়ো করে সব শুনছিল। সে বলল,
“চলুন সেই গ্রামোফোনটা আমাকে দেখান একবার।”
উপরের এক কোণের ঘরে অসাধারণ কারুকাজ করা এক টেবিলের উপর সযত্নে রাখা বহু বছরের পুরাতন গ্রামোফোনটা। এত সুন্দর জিনিসটা যে দেখলে চোখ জুড়িয়ে আসে। অনেকক্ষণ সেটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অপরূপা দেবী আর অর্জুনবাবুকে নীতিশ বলে,
“তবে এবার চলি। প্রয়োজন হলে আবার বিরক্ত করতে পারি।”
বেরিয়ে যেতে যেতে আরও একবার নরেনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নেয় নীতিশ।
“তাহলে আপাতত সাসপেক্টের লিস্টে দুজন, একজন হল মিঃ অভিরূপ হালদার এবং অপরজন মিঃ অর্জুন সেনগুপ্ত।”
ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক মেরে কথাটা বলে ওঠে অগ্নি। অগ্নি অর্থাৎ অগ্নি চ্যাটার্জি। বছর চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশের এই হ্যান্ডসাম জেন্টলম্যান পেশায় হলেন কলেজের লেকচারার এবং শখে স্বনামধন্য প্রাইভেট ডিটেকটিভ নীতিশ স্যানালের অ্যাসিস্ট্যান্ট।
“তবে পরেরজনকেই আমার আরও বেশি সন্দেহ হচ্ছে। মিঃ সেনগুপ্তর কাছেই মোটিভ বেশি আছে এমনটা করার। মিসেস নন্দিনী সেনগুপ্ত না থাকলে কোম্পানির সমস্ত মালিকানা তিনিই পাবেন এবং হতে পারে সেই কারণেই তিনি হয়তো মিলিকেও কোনও রকম ড্রাগস দিয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ করে রেখেছেন যাতে ওঁর আর এই বিশাল সম্পত্তির মাঝে কোনওরকম বাধা না আসে।”
কাঁচের টেবিলের আরেক প্রান্তে বসে কথাটা বললেন ইনস্পেক্টর দেবস্মিতা। ইনস্পেক্টর দেবস্মিতা মুখার্জী প্রায় সব জটিল কেসেই শরণাপন্ন হন নীতিশ স্যানালের।
তাঁর কথা শুনে অগ্নি উৎফুল্ল হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
“আরে এটা তো একদম ঠিক। একদম পারফেক্ট কথা বললেন আপনি ম্যাডাম। নিশ্চিত এটাই হয়েছে।”
শুধু নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছে নীতিশ। ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিতে দিতে নিজের মনেই কিসের যেন জট খুলছে সে।
নন্দিনী সেনগুপ্ত হত্যারহস্য নিয়ে আজ তারা তিনজন একত্র হয়েছে নীতিশের বাড়ি।
অগ্নি হেসে নীতিশকে বলে,
“কী মশাই? আপনি কি এমন মুখে কুলুপ এঁটেই থাকবেন?”
কফির কাপটা টেবিলে রেখে ঠোঁটের কোণে একটা রহস্যময় হাসি খেলিয়ে নীতিশ বলে ওঠে,
“ব্যাপারটা হয়তো অতটাও সহজ না। অভিরূপ হালদারের সঙ্গেও কথা বলাটা দরকার, তবে অর্জুন সেনগুপ্তকে একবার জিজ্ঞাসাবাদ করাই যায়। আপনি বরং ওঁকে একবার থানায় আসতে বলুন দেবস্মিতা ম্যাডাম।”
“হ্যাঁ এটাই আমিও ভাবছিলাম। কালকেই ওঁকে ডাকছি।”
পরদিন দুপুরের দিকে হন্তদন্ত হয়ে বিধ্বস্ত চেহারায় থানায় ঢোকেন অর্জুন সেনগুপ্ত। সেখানে ইনস্পেক্টর দেবস্মিতা সহ আগে থেকেই নীতিশ আর অগ্নিও ছিল। তিনি ঢুকতেই তাঁকে চেয়ারে বসতে বলা হল আর তারপরেই ইনস্পেক্টর দেবস্মিতা বললেন,
“তা বলুনতো, সবকিছু কি আপনি একাই করলেন নাকি আপনার স্ত্রী ও ছিলেন সঙ্গে?”
অর্জুনবাবু খুব ঘাবড়ে যান এই কথা শুনে। আমতা আমতা করে বলে ওঠেন,
“মা-মানে কী ব-বলছেন আপনি?”
“এটাই বলছি যে বিশিষ্ট সেনগুপ্ত গ্রুপ-এ্যান্ড-কোম্পানিস এর মালিকানার লোভে আপনিই আপনার বৌদিকে খুন করিয়েছেন। আর পুরো সম্পত্তি যাতে একা আত্মসাৎ করতে পারেন তার কারণে মিলিকেও কোনও প্রকারের ড্রাগস দিয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ করে রেখেছেন।”
সমস্ত কথা শুনে দরদর করে ঘামতে থাকেন অর্জুনবাবু। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন,
“জাস্ট শাটআপ। আপনি কোনও প্রমাণ ছাড়া আমার সম্বন্ধে এমন অ্যলিগেশন আনতে পারেন না। আর আপনি একজন বিশিষ্ট বিজনেসম্যানের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছেন কোন সাহসে?”
এবার নীতিশ মুখ খোলে,
“প্রমাণটা নেই বলে আপনাকে লকাপের বাইরে বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে নয় তো লকআপের ভিতরেই থাকতেন। আর আপনি যত বড় বিজনেসম্যান বা যাই হন না কেন আইনের চোখে অপরাধী শুধু একজন অপরাধীই হয় সেটা নিশ্চয়ই জানেন।”
রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে আবারও চেয়ারে বসে পড়েন অর্জুনবাবু। তারপর শান্ত স্বরে বলেন,
“বিশ্বাস করুন আমি এসব কিছুই করিনি। আমার বৌদি তো আমার কাছে ঈশ্বরের রূপ ছিলেন আর মিলি তো আমার নিজের মেয়ের মতই। ওর সঙ্গে আমি কী করে এমন করবো! মিলির চিকিৎসাও চলছে, ও একদিন ঠিক সুস্থ হবে। আর তাছাড়া বৌদি যেদিন নিখোঁজ হন তার তিনদিন আগে থেকেই আমি দিল্লি ছিলাম বিজনেস এর কাজে। বৌদির নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে আমি ফ্লাইট বুক করে তাড়াতাড়ি চলে আসি। আমি বলছি এই কাজ ওই অভিরূপ হালদারের। ও অনেকবার আমার বৌদিকে হুমকি দিয়েছিল।”
তার প্রতিটা কথা প্রবল মনোযোগ সহকারে শুনছিল নীতিশ, অগ্নি আর দেবস্মিতা। তারপর দেবস্মিতা ম্যাডাম বলে্ন,
“ঠিক আছে এবার আপনি আসতে পারেন। তবে ইনভেস্টিগেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই শহর ছেড়ে কোথায় যাওয়া চলবে না আপনার।”
অর্জুনবাবু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে চলে যান। তারপর অগ্নি বলে,
“তাহলে এটা এখন সবার আগে জানা দরকার যে উনি সত্যি দিল্লি গিয়েছিলেন কিনা।”
দেবস্মিতা ম্যাডাম বলেন,
“হ্যাঁ, সেটা তো আমি খোঁজ নিচ্ছি। তবে বাইরে থেকেও সুপারি কিলার দিয়ে এই কাজটা করানো অসম্ভব নয়।”
“হুমম। সেই পসিবিলিটিও আছে।”
সামনে রাখা গ্লাসটা থেকে এক ঢোক জল খেয়ে হাতের ঘড়িটা ঠিক করতে করতে নীতিশ এবার বলে ওঠে,
“একবার অভিরূপ হালদারের ব্যাপারটাও দেখতে হবে। ওঁর ডিটেইলস সব আমার চাই আর মিসেস সেনগুপ্তর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসা পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হবে।”
ইনস্পেক্টর দেবস্মিতা বলেন,
“হুমম। আপনাকে আমি অভিরূপ হালদারের সমস্ত ডিটেইলস জোগাড় করে পাঠিয়ে দেবো। আর পোস্টমর্টেম রিপোর্টও তাড়াতাড়ি এসে যাবে।”
“আচ্ছা তাহলে এবার আমরা উঠি।”
বলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে নীতিশ আর অগ্নি।
অগ্নি কৌতূহলী হয়ে মুখে হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আরে কিছু অন্য হিন্ট পাচ্ছেন বুঝি গোয়েন্দা মশাই?”
নীতিশ একটা সিগারেট ধরিয়ে তাতে দীর্ঘ একটা টান দিয়ে বলে,
“আপাতত শুধু এইটুকুই যে ব্যপারটা যেমন মনে হচ্ছে আদতে আরও অনেক জটিল, অনেক গভীরে এর শিকড়।”
বলে নিজের গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় নীতিশ।
পরদিন সন্ধ্যাবেলা ব্যালকনির রোটেটিং চেয়ারটায় হাতে অভিরূপ হালদারের ফাইলটা নিয়ে বসেছে নীতিশ। ফাইলে চোখ রাখতে রাখতে আরেক হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপটায় চুমুক মারছে পরম তৃপ্তিতে। বাইরে হালকা হালকা বৃষ্টি পড়ছে।
অভিরূপ হালদারদের পূর্বপুরুষ বেশ প্রতিপত্তিসম্পন্ন ছিলেন। একসময় তিনি ভাল ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন। বর্তমানে ভদ্রলোক একটি জলের ফ্যাক্টরির মালিক। আর অর্জুনবাবুর কাছ থেকে জানা গেছে যে মাঝখানে কিছু অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে বহু বছর ধরে যত্নে রাখা তাঁর পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া স্মৃতি গ্রামোফোনটি বিক্রি করেন। তারপর এখন আবার ব্যবসা ভাল চলায় সেটি তিনি কিনতে চান কিন্তু মিসেস সেনগুপ্ত তাতে রাজি না হতেই যত সমস্যা। বর্তমানে ভদ্রলোক থাকেন কলকাতার বৌবাজার এলাকায়। এক সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে তাঁর সংসার।
কফির কাপটায় আর একটা চুমুক মেরে হাত থেকে ফাইলটা নামিয়ে রাখে নীতিশ। তারপর চশমাটা হাত দিয়ে খানিকটা উপরে তুলে বিড়বিড় করে বলে,
“এঁকে একবার দেখতেই হচ্ছে।”
বউবাজারে একটা রেস্তোরাঁর পাশ দিয়ে গাড়িটা ঢুকিয়ে মিঃ অভিরূপ হালদারের চারতলা বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ায় নীতিশ।
বেল বাজাতে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা এসে দরজা খোলেন। তারপর মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
“কাকে চাই? আপনি কে?”
নীতিশ নিজের কার্ডটা দেখিয়ে বলে,
“মিঃ অভিরূপ হালদারের সঙ্গে দেখা করতে চাই। ওঁকে ডেকে দেবেন প্লিজ।”
“হ্যাঁ আমি ডাকছি। আমি ওঁর ওয়াইফ। আপনি বসুন।”
ভিতরে ঢুকে ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে নীতিশ। বিলাসবহুল ড্রয়িংরুমের সারা দেওয়ার জুড়ে শুধু অভিরূপবাবুর ফুটবলের জার্সি পরা আর কাপ জেতার মুহূর্তের ছবি। ঘরের এক পাশের একটা শোকেসে সাজানো অনেক রকম কাপ। দেওয়ালে ঝোলানো অসংখ্য মেডেল। আরও একটা শোকেসে সাজিয়ে রাখা বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের নানান বই।
নীতিশ মনে মনে ভাবে, “মানুষটা বেশ কালচারাল।”
এমন সময় ঘরে ঢুকে মিঃ হালদার বলেন,
“আমি আপনাকে কিভাবে হেল্প করতে পারি?”
নীতিশ গম্ভীর হয়ে বলে,
“সেনগুপ্ত গ্রুপ-এ্যান্ড-কোম্পানিস এর মালকিন মিসেস নন্দিনী সেনগুপ্তর মার্ডার হবার খবর তো আপনি শুনেছেন নিশ্চয়ই?”
অভিরূপবাবু একটা ঢোঁক গিলে বলেন,
“হ্যাঁ। নিউজে দেখছিলাম। কেন বলুন?”
নীতিশ এবার হালকা হেসে বলে,
“কেন সেটা তো আপনিই ভাল জানেন।”
“ম-মানে কী বলছেন আপনি? আমি কী করে জানব?”
“কারণ হল আপনার পূর্বপুরুষদের সেই গ্রামোফোন। যেটা আপনি ওঁর কাছে বিক্রি করেছিলেন কিন্তু পরে তা আবার কিনতে চাইলে উনি রাজি না হওয়ায় ওঁকে নানান হুমকি দিয়েছিলেন। তাই বলাই যেতে পারে এই কাজটা রাগের বশে আপনিই করেছেন।”
“কী যা তা বলছেন আপনি! আমি এসবের কিছুই জানি না।”
“আপনি গলা নামিয়ে কথা বলুন মিঃ হালদার। মনে রাখবেন এই কেসে কিন্তু আপনি সাসপেক্ট।”
এবার অনেকটা নরম হয়ে যান অভিরূপবাবু। গলা নামিয়ে শান্ত স্বরে বলেন,
“দেখুন আমি এসব কিছুই করিনি। মিসেস সেনগুপ্তকে আমি কয়েকবার হুমকি দিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু সেটা রাগের মাথায়। আসলে আমার কাছে আমার সম্মান খুব দামী। আমি একজন ন্যাশনাল ফুটবল প্লেয়ার ছিলাম একসময়। এছাড়াও বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকাতেও আমার লেখা বেরোয় নিয়মিত। ব্যবসায় আমার মন তেমন ছিল না, তাইতো মাঝে ব্যবসাটা বাঁচানোর জন্যই গ্রামাফোনটা বিক্রি করেছিলাম। কিন্তু এখন সব ঠিক হতে আমি সেটা পুনরায় কিনে নিতে চাই কারণ সেটা আমাদের বংশের গর্ব আর আমাদের পূর্বপুরুষদের একমাত্র স্মৃতি এবং সম্পদ। এমনিতেই আমাদের আগের জেনারেশনের যেরকম প্রতিপত্তি ছিল আমি সেসব সম্পূর্ণ ধরে রাখতে পারিনি। তার উপর যদি গ্রামাফোনটাও না ফিরিয়ে আনতে পারি তাহলে যে আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে আমি অপরাধী হয়ে থেকে যাব। আমার কোনও সম্মান থাকবে না। সেই কারণেই আমি সেটা বারবার করে ফেরত চাই। বিশ্বাস করুন আমি ওঁর কোনও ক্ষতি করিনি।”
সবকথা মন দিয়ে শুনে নীতিশ বলে,
“আচ্ছা আপাততঃ মানলাম আপনার কথা। কিন্তু একবার যদি কোনও ক্লু আপনার সম্বন্ধে পেয়েছি তবে যে সম্মানের জন্য কাউকে হুমকি দিতে আপনি পিছুপা হন না সেই সম্মানের বা আপনার ফুটবলার এবং সাহিত্যিক ইমেজের কি হবে বুঝতেই পারছেন আশা করি।”
বলে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অভিরূপবাবুর দিকে তাকিয়ে এক রহস্যময় হাসি হাসে নীতিশ। আতঙ্কে অভিরূপবাবু ঠকঠক করে কাঁপতে থাকেন। তিনি চোখ নামিয়ে নেন মাটিতে।
নীতিশ আবারও বলে,
“চলি তাহলে আজ, তবে প্রয়োজন পড়লে খুব তাড়াতাড়ি আবার দেখা হবে।”
বলে নীতিশ চলে আসে সেখান থেকে আর অভিরূপবাবু কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
ঘরে পৌঁছে আবার ব্যালকনিতে নিজের রোটেটিং চেয়ারটায় বসে নীতিশ। চোখ বুজে কিসের যেন জট খুলতে থাকে সে। ঠিক তখনই তীব্র শব্দ করে তার ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে ইনস্পেক্টর দেবস্মিতার নাম ভেসে উঠেছে। নীতিশ ফোন রিসিভ করে বলে,
“হ্যালো ম্যাডাম, বলুন।”
“মিসেস নন্দিনী সেনগুপ্তর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চলে এসেছে মিঃ স্যানাল। তাঁকে যেদিন থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছে সেদিন থেকেই ড্রাগস দেওয়া হয়েছে, তাঁর শরীরে ড্রাগস পাওয়া গেছে। দুদিন ধরে তাঁকে ড্রাগস দিয়ে অসাড় করে রেখে তারপর প্রথমে শ্বাসরোধ করে তাঁর খুন করা হয় এবং তারপর মাথায় ব্লান্ট কোনও অবজেক্ট দিয়ে বারবার আঘাত করা হয়।”
“ওহ্ আই সি। আর কোনও কিছু কি পাওয়া গেল?”
“আর একটা ব্যাপার। মিসেস সেনগুপ্তর বাড়ির লোকের মতে তিনি যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন তখন তাঁর হাতে সোনার বালা এবং গলায় হার ছিল। কিন্তু যখন ওঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় তখন তাঁর গায়ে সেসব কিছুই ছিল না। আর তাছাড়া ওঁর পার্সটাও ছিল না।”
এবার খানিকটা নড়েচড়ে বসে নীতিশ। একটু সময় নিয়ে বলে,
“তাহলে তো এই কেসটা নিখোঁজ থেকে খুন আর খুন থেকে এখন চুরি পর্যন্তও চলে এল।”
“হ্যাঁ সেটাই, কেস ক্রমশ জটিল হচ্ছে।”
ইন্সপেক্টর দেবস্মিতার ফোনকল শেষ হয়ে যাওয়ার পর নীতিশ আবার চোখ বুজে ভাবতে লাগলো সবকিছু। আবারও কিছুর জট খুলতে লাগলো মনে মনে। নিজের মনেই বলল,
“আর একবার সেনগুপ্ত ভিলাতে যাওয়াটা দরকার।”
পরদিন সেনগুপ্ত ভিলাতে বেল বাজাতে আবারও দরজা খোলে নরেন।
ভিতরে এসে বসতে অর্জুনবাবু বলেন,
“কী ব্যাপার? কোনও খবর পেলেন?”
“খবর পাব তাড়াতাড়ি এমন আশাতেই তো এখানে আসা।”
বলে সামান্য হাসে নীতিশ। তারপর বলে,
“পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী নন্দিনী দেবীকে ড্রাগস দেওয়া হয়েছে এবং পরে শ্বাসরোধ করে ব্লান্ট কোনও অবজেক্ট দিয়ে বারবার আঘাত করা হয়েছে মাথায়। আর তাঁর শরীরে সোনাদানা বা তাঁর পার্স কিছুই পাওয়া যায়নি।”
অর্জুনবাবু কৌতূহলী হয়ে বলেন,
“তবে কি ব্যাপারটা শুধু চুরি ডাকাতির? মানে কেউ কি শুধু সেই জিনিসগুলো হাতাতেই এমন করেছে?”
“হতেও পারে। আচ্ছা আপনাদের কি কারোর উপর সন্দেহ হয়? আই মিন আপনাদের কোনও কর্মচারী বা কারোর প্রতি? মানে ঘর থেকে কি কখনও আগে কিছু চুরি হয়েছে?”
“সন্দেহ তো কারোর উপর হয়নি, কিন্তু মাঝেমাঝেই আমাদের কিছু টাকা পয়সা বেখেয়ালে কোথাও রাখলে পরে দেখি সেটা নেই। কিন্তু কে যে এটা করে এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।
নীতিশ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“আচ্ছা, নরেন আপনাদের বাড়িতে কতদিন রয়েছে?”
“তা প্রায় তিন বছর, কিন্তু আপনি কি নরেনকে সন্দেহ করছেন নাকি? সে এমনটা করবে বলে মনে হয় না। সে তো আমাদের সবাইকে এই ক’বছরের মধ্যে আপন করে নিয়েছে। সে আমাদের ঘরের লোকের মত।”
নীতিশ চশমাটা উপরে তুলে সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে হেসে বলে,
“যারা সবচেয়ে ক্ষতিকর তারাই ভাল মানুষের মুখোশটা বেশি পরে। যাইহোক অপরাধ যেই করে থাকুক সামনে আসবেই। আচ্ছা, মিলি কেমন আছে এখন?”
“তেমন কিছু উন্নতি হয়নি, তবে আগের থেকে একটু ভাল হয়তো। আজ কলেজ গেছে ও। একটু পর হয়তো আসবে। কদিন ধরে তো বৌদির মৃত্যু আর ওর নিজের অসুস্থতায় পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হল।”
নীতিশ এবার সোজা হয়ে তাকিয়ে বলে,
“আমি একবার মিলির ঘরটা দেখতে চাই।”
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই।”
সিঁড়ি দিয়ে উঠে মিলির ঘরে প্রবেশ করে নীতিশ। আজ ভাল করে ঘরের চারিদিকে চোখ বোলায় সে। ঘরের দেওয়াল জুড়ে নন্দিনী দেবী আর মিলির ছবি ফ্রেম করে লাগানো। দেখেই বোঝা যায় যে, মাকে খুব ভালবাসে মেয়েটা। ঘরের একপাশে রাখা একটা ক্যানভাসে সেই গ্রামের চিত্রটাই আঁকা। ছবিটা যেন পুরোই জীবন্ত। কি অসাধারণ প্রতিভাবান মেয়েটা। এরপর সে এগিয়ে যায় মিলির টেবিলের দিকে। সেখানে সামনেই রাখা তার আঁকার একটা খাতা। নীতিশ সেটা নিয়ে পাতা উল্টিয়ে দেখতে থাকে।
কোনওটা স্কেচ তো কোনওটায় লেগেছে ওয়াটার কালারের ছোঁয়া তো কোনওটায় আবার অয়েল কালারের ছোঁয়া। প্রত্যেকটা ছবি দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। একদম শেষ পাতা উল্টাতে গিয়ে কী যেন একটা সেই খাতার ভিতর থেকে থপ করে শব্দ করে নীচে পড়ে। নীতিশ চোখ সরিয়ে দেখে যে সেটা একটা কার্ড। নীচু হয়ে সেটা হাতে তুলে নেয় সে। কার্ডটা খুলে ভিতরে দেখে সেখানে লেখা”হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে ফ্রম রোহন।”
কপালে চিন্তার রেখাগুলো আবারও স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার। অস্ফুটে বলে ওঠে,
“রোহন!”
এরপরে ঘরেই একটা চেয়ারে বসে পড়ে নীতিশ। হাত দুটো সামনের দিকে করে কি যেন ভাবতে থাকে। ঠিক তখনই সিঁড়ি দিয়ে কারোর উঠে আসার শব্দ হয়। নীতিশ চোখ তুলে দেখে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মিলি। চোখ দুটোর সেই শূন্যতাটা এখনো রয়েছে। মিলির হাতের পাতার উপরে ট্যাটু করানো ‘His Queen’ লেখাটা নীতিশের আজ আর চোখ এড়ায় না।
মিলি এসে বলে,
“কী ব্যাপার? আপনার আমার সঙ্গে কী দরকার?”
নীতিশ হেসে বলে,
“তোমার মায়ের কেসটা নিয়ে একটা দরকারে এসেছিলাম। তাই ভাবলাম তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।”
মিলি অস্থির হয়ে বলল,
“উনি আমার মা নন। আমি মিলি নই। আমি সুখিয়া নস্কর।”
“সে তো তুমি তোমার আগের জন্মে ছিলে। এখন তো তুমি মিলি।”
“না, আমি মানি না আমার এই জন্ম। আমার গ্রামের নাম আমচুড়িয়া। সেখানে আমার স্বামী সন্তান আর শ্বাশুড়ী মা সকলে আছেন। আমার স্বামীর নাম বিমল নস্কর। আমি ওদের কাছে যেতে চাই।”
বলে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে মিলি।
“আচ্ছা আমি তোমাকে নিয়ে যাব তোমার গ্রামে।”
এবার মিলির মুখে আনন্দের ঝিলিক খেলে যায়। সে বলে,
“সত্যি আপনি আমায় নিয়ে যাবেন আমার গ্রামে?”
“হুমম নিয়ে যাবই তো।”
মিলির ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে দরজার এক কোণে রাখা গলফের সেটটা চোখে পড়ে নীতিশের। এক ঝলকেই দেখে নেয় যে সেখানে ড্রাইভার, পুটার, হাইব্রিড, স্যান্ড ওয়েজ সব ক্লাবই রয়েছে, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে শুধু পিচিং ওয়েজটা নেই।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচে এসে অর্জুনবাবুকে জিজ্ঞেস করে নীতিশ,
“শুনুন, আপনি কি রোহনের ব্যাপারে কিছু জানেন?”
অর্জুনবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,
“রোহনের ব্যাপারে?”
“হ্যাঁ, রোহনের ব্যাপারে। মানে রোহনের সঙ্গে মিলির যে সম্পর্ক ছিল বা আছে সেটার ব্যাপারে।”
অর্জুনবাবু একটু ইতস্তত করে তারপর বলেন,
“আসলে ওরা দুজন একসঙ্গে কলেজে পড়ত। সেই থেকে সম্পর্কে জড়ায়। কিন্তু ছেলেটা একেবারে ভাল ছিল না। ড্রাগ অ্যাডিক্টেড ছিল তারপর আরও অনেক খারাপ গুণ ছিল। সেসব বৌদি জানতে পেরে মিলিকে বারণ করেন ওর সঙ্গে মিশতে। কিন্তু মিলি মানতে নারাজ। এই নিয়ে মা মেয়ের মধ্যে অনেক ঝগড়া অশান্তি হয়। কিন্তু শেষমেশ মিলি বুঝতে পারে নিজের ভুল আর মাস চারেক মত আগে রোহনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে। এখন আর ওদের মধ্যে কিছু নেই।”
সব কথা শুনে নীতিশ গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“আই সি।”
নীতিশ আবার জিজ্ঞেস করে,
“আচ্ছা মিলি কি গল্ফ খেলে?”
“হ্যাঁ, খুব ভাল প্লেয়ার কিন্তু এখন আর সেইভাবে প্র্যাকটিস করে না।”
“হুমম।”
কি এক গভীর চিন্তায় যেন ডুবে যায় নীতিশ।
সেনগুপ্ত ভিলা থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ি আসার পথে নীতিশের মাথায় শুধু এইসব চিন্তাই ঘুরছিল। রহস্য ক্রমাগত জটিল হয়ে উঠছে। সন্ধ্যাবেলায় অগ্নি আর ইন্সপেক্টর দেবস্মিতা দুজনেই জড়ো হয় নীতিশের বাড়ি।
সর্বপ্রথম ইন্সপেক্টর দেবস্মিতা বলে ওঠেন,
“মিঃ অর্জুন সেনগুপ্ত সেইসময় দিল্লিতেই ছিলেন, খোঁজ নিয়ে তাই জানা গেছে। কিন্তু ওই যে আগেই বলেছি, সুপারি কিলার দিয়ে কাজটা করানোও অসম্ভব নয়।”
অগ্নি বলে উঠলো,
“রাইট। ইভেন এটা করানোরই বেশি চান্স। তাহলেই উনি এই অজুহাত দিতে পারবেন যে অপরাধের সময় তিনি এখানে ছিলেন না এবং এতে ওঁর কোনও হাত নেই। স্বাভাবিকভাবে এতে ওঁর প্রতি সন্দেহ কমবে।”
ইন্সপেক্টর দেবস্মিতা উত্তরে বলেন,
“আমারও তাই মনে হয়। আর যদি মিঃ অভিরূপ হালদারের কথা ধরা যায় তাহলে যা শুনেছি মিঃ স্যানালের কাছে তাতে এটাই মনে হয় যে, ওঁর কাছে নিজের সম্মান খুব দামী। আর উনি এমন কিছুই করবেন না যাতে নিজের সম্মানহানি হয়।”
এতক্ষণ ধরে সবার কথা চুপচাপ শুনলেও এবার মুখ খোলে নীতিশ,
“ইম্পরট্যান্ট পয়েন্ট। কিন্তু সম্মানের জন্যই করবেন করলে।”
ইন্সপেক্টর দেবস্মিতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন,
“মানে?”
“মানেটা হল এই যে এই মানুষটার কাছে নিজের সম্মান খুব দামি। ইতিমধ্যেই তিনি তাঁর আগের প্রজন্মের মত ব্যবসায় বিশাল পটু হতে পারেননি আর তার উপর পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া বহু পুরাতন সম্বলটি বিক্রি করে দিয়েছেন। এর ফলে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এবং পুরো সমাজের কাছে তাঁর কতটা সম্মানহানি হবে ভাবতে পারছেন? তাই সেই হারানো সম্মান ফেরত পেতে তিনি এমনটা করতেই পারেন। কারণ তাঁর কাছে নিজের সম্মানটাই সব। আর অপরাধী যখন অপরাধ করে তখন সেটা জানাজানি বা শাস্তির কথা সে ভাবে না আর সেই কারণেই এত অপরাধ ঘটে।”
এবার অগ্নি আর ইন্সপেক্টর দেবস্মিতা দুজনের কপালেই চিন্তার রেখা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
“ব্যাপারটা পসিবল হলেও হতে পারে।”
অগ্নি বলে ওঠে।
নীতিশ আবারও বলে,
“আর নরেনকেও আমার মোটেই সুবিধার লাগে না। হতেও পারে গয়নাগাটি চুরির জন্য সে এমনটা করেছে। নরেনের সমস্ত ডিটেইলস আমার লাগবে। সে সেনগুপ্ত ভিলাতে কাজ নেওয়ার আগে কোথায় কাজ করত, কোথায় তার বাড়ি সমস্ত কিছু। অগ্নি, তুমি নরেনের দিকটা দেখো। সে আগে যেখানে কাজ করত সেখানে গিয়ে কথা বলে দেখো যে ওর কোনও চুরির বদনাম আছে কিনা।”
“ওকে বস।”
এবার আস্তে আস্তে নীতিশ বলে ওঠে,
“আর ততক্ষণে মিলির জাতিস্মর রহস্যটা সমাধান করতে আমাকে পুরুলিয়া যেতে হবে।”
এবার ইন্সপেক্টর দেবস্মিতা আর অগ্নি দুজনেই হেসে ওঠে।
অগ্নি বলে,
“হোয়াট রাবিশ। জাতিস্মর বলে আবার কিছু হয় নাকি! এসব তো ওর মানসিক অসুস্থতার জন্য।”
ইন্সপেক্টর দেবস্মিতাও বলে ওঠেন,
“আপনি এখন এসব তুচ্ছ কারণে অতদূর যাবেন মিঃ স্যানাল?”
“জাতিস্মর হওয়ার কিন্তু বহু ঘটনার উদাহরণ আছে, আর তাই আমি ব্যাপারটাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারি না। কি ঘটনা সেটা আমাকে একবার ওখানে গিয়ে দেখতেই হবে।”
প্রায় দু’সপ্তাহ পর পুরুলিয়ার ট্রেনের টিকিট পায় নীতিশ। এই মুহূর্তে কোনও টিকিট নেই তাই অগত্যা দু’সপ্তাহ অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। এর মধ্যে নরেনের খবরও সব জোগাড় করে আনে অগ্নি। অগ্নি জানায় যে নরেন আগে যেইখানে কাজ করত সেইখানেও একই ভাবে টাকা পয়সা উধাও হয়ে যেত আর সেই কারণেই তারা নরেনকে কাজ থেকে বার করে দেয়। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তারা নরেনের বিরুদ্ধে কোনও আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সব শুনে নীতিশের মুখ থেকে অস্ফুটে শুধু বেরিয়ে আসে,
“আই সি।”
সে যেন অন্য কোনও জট খুলছে মনে মনে।
ইন্সপেক্টর দেবস্মিতা বলেন,
“একবার নরেনের ঘরের তল্লাশি নেওয়া উচিত। সে যদি কাজটা করে থাকে তবে আশা করি মিসেস সেনগুপ্তর গয়নাগুলো তার ঘর থেকে পাওয়া যাবে, আর যদি সে সেগুলোকে বিক্রি করে থাকে তাহলেও সেটা শহরের সমস্ত সোনার দোকানে খোঁজ নিয়ে জানাই যাবে।”
নীতিশ বলে,
“হুমম, সেটা করতেই পারেন। নরেনের ঘরের তল্লাশি নিয়ে দেখতে পারেন।”
প্ল্যান অনুযায়ী নরেনের ঘরের তল্লাশি নেওয়া হয় এবং একটি পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে উদ্ধার হয় মিসেস নন্দিনী সেনগুপ্তর নিখোঁজ হওয়ার সময় থেকে সমস্ত হারানো গয়না। কিন্তু নরেন কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে যে সে এই কাজ করেনি, সে নির্দোষ। লকাপে ঢুকিয়ে শতবার জিজ্ঞেস করলেও সে বলতে থাকে যে সে নির্দোষ।
কিন্তু হাল ছাড়েন না ইন্সপেক্টর দেবস্মিতা। নীতিশ আর অগ্নিকে তিনি বলেন,
“চিন্তা করবেন না। অপরাধীরা সহজে স্বীকার করে না নিজের অপরাধ। তাকে স্বীকার কী করে করাতে হয় আমি ভাল করে জানি।”
অগ্নি হেসে বলে,
“আরে হ্যাঁ ম্যাডাম। আপনার উপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে।”
আর নীতিশ শুধু একটা হুমম ছাড়া কিছুই বলে না। সে যেন অন্য কোনও চিন্তায় ডুবে আছে।
দেখতে দেখতে নীতিশের পুরুলিয়া যাওয়ার দিন চলে আসে। সে একদম মাঝরাতের ট্রেন ধরে। পুরুলিয়া নামতে নামতে সকালের আলো ফুটে যায়। তারপর সেখান থেকে বাস ধরে আমচুড়িয়া গ্রামে পৌঁছায়।
সেখানে পৌঁছে সে ভাবে কাউকে জিজ্ঞেস করবে যে এখানে বিমল নস্কর বলে কেউ থাকে কিনা। কিন্তু তার আগেই সে দেখে যে একজন বৃদ্ধা অতি কষ্ট করে বাজারের ভারী ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেখে খুব মায়া হয় নীতিশের। সে কাছে এগিয়ে বলে,
“দিন মাসিমা ব্যাগটা। আমি আপনার বাড়ি অবধি পৌঁছে দিচ্ছি।”
বৃদ্ধা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলে,
“না না বাবা থাক। আমি চলে যেতে পারবো।”
কিন্তু নীতিশ শুনতে নারাজ। সে আরও জোর দিয়ে বলে ওঠে,
“না না দিন আমাকে ব্যাগটা। তারপর একসাথে যাওয়া যাবে।”
বৃদ্ধা আর আপত্তি করল না। সারা রাস্তা এটা সেটা গল্প করতে বৃদ্ধার বাড়িতে পৌঁছালো তারা। বৃদ্ধা নীতিশকে অনুরোধ করে ডেকে ঘরে বসালো। সে সেই বৃদ্ধাকে বিমল নস্কর আর সুখিয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই বৃদ্ধা শাড়িতে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
“জানো বাবা আমার এত দূর্দশা ছিল না। আমার বৌমা থাকতে আমি রানীর হালে থাকতাম। কোনও কাজ আমায় সে করতে দিত না। কিন্তু সে হঠাৎই সবাইকে ছেড়ে চলে গেল।”
বলে বৃদ্ধা দেওয়ালে এক মালা পরানো ছবির দিকে ইঙ্গিত করল। নীতিশ একবার দেখল সেদিকে।
বৃদ্ধা আবারও চোখে জল নিয়ে বলে উঠল,
“আজ থেকে আঠারো-উনিশ বছর আগে দুই ছেলেকে কত ছোট ফেলে রেখে অকালেই চলে গেল আমার সুখিয়া।”
এইবার নীতিশের চোখে বিস্ময় ফুটে ওঠে। সে জিজ্ঞেস করে,
“কী বললেন? আপনার পূত্রবধূর নাম কী? আর আপনার ছেলের নাম কী?”
“বৌমার নাম সুখিয়া আর ছেলের নাম বিমল, বিমল নস্কর। সে তো ভোর হতেই কাজে বেরিয়ে গেছে আর নাতি দুটো কলেজে। আর আমার বৌমা আঠারো-উনিশ বছর আগেই মারা গেছে।”
নীতিশের মুখ থেকে বিস্ময়ে আর কোনও কথা বেরোয় না। মনে পড়ে যায় যে মিলির বয়সও উনিশ। তবে কি মিলি যা কিছু বলছে সব সত্যি?
বৃদ্ধা আবার বলে ওঠে,
“তবে তোমাদের মত ভাল মানুষদের দয়া আছে বলে আমরা এখনও তাও ভাল আছি। সত্যি তোমাদের শহরের মানুষের মনে খুব দয়া। এই যে মাস চারেক আগে কলকাতার কলেজে পড়া ছেলেমেয়েগুলো এসেছিল এখানে ছবি আঁকতে, তারাও কত্ত ভাল ছিল!”
এবার নীতিশ চোখ বড়বড় করে তাকায় বৃদ্ধার দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করে,
“কলকাতার কলেজ থেকে ছেলেমেয়েরা এসেছিল ছবি আঁকতে এই গ্রামে মাস চারেক আগে?”
“হ্যাঁ। আমাদের গেরামের ছবি আঁকতে এসেছিল। শহরের দিকে থাকার জায়গা ওই কি হুটেল না কি বলে সেই ভাড়া করেছিল। কিন্তু সেদিন খুব বৃষ্টি হওয়ায় আর হুটেলে ফিরতে পারেনি তাই এই গেরামে আমাদের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিল একদিন। বড় মায়া তাদের মনে। আমার সুখিয়ার অকালে চলে যাওয়া আর আমার কষ্ট দেখে তাদেরও চোখে জল চলে এসেছিল।”
সবকিছু শুনে নীতিশ মনে মনে কি একটা ভাবতে থাকে। আবারও কিছু জট খুলতে থাকে। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে এসে গ্রামটা ভাল করে দেখে। মিলির ক্যানভাসের চিত্রটার সঙ্গে হুবহু মিল এই গ্রামের। সেই ঝিল, সেই কলা গাছের সারি। সব কিছু এক।
পরের দিনের ট্রেনেই নীতিশ কলকাতা ফিরে আসে। তারপর কি মনে হতে একবার মিলির ফেসবুক প্রোফাইলটা সার্চ করে। একটু খোঁজার পরেই রেশমি সেনগুপ্ত নামে মিলির অ্যাকাউন্টটা পেয়ে যায়। তার আপলোড করা সব ছবি গুলো দেখতে থাকে। হঠাৎ এক মাস আগে আপলোড করা একটা ছবিতে নীতিশের চোখ আটকে যায়। একটা রেস্টুরেন্টে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে একটা ছবি দিয়েছে মিলি, সঙ্গে একটা সুন্দর ক্যাপশনও আছে। তার পিছনে বড়ো আয়না লাগানো এবং সেই আয়নায় একটি ছেলের অবয়ব দেখা যাচ্ছে যে সেই ফটোটি তুলছে নিজের স্মার্টফোনে। ফোনটা মুখের সামনে ধরায় মুখটা বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু ডান হাত দিয়ে ফোনটা ধরায় সেই হাতের পাতার উপরটা ভালই বোঝা যাচ্ছে। তার মধ্যে ট্যাটু করিয়ে কিছু লেখা রয়েছে। ফটোটা জুম করে লেখাটা পড়ার চেষ্টা করল নীতিশ। অস্পষ্ট হলেও ‘Her King’ লেখাটা পড়তে সক্ষম হল সে। তারপর মনে পড়লো যে মিলির হাতেও ঠিক পাতার উপরেই ‘His Queen’ লেখা ছিল। ছেলেটা যে রোহন সেটা বুঝতে আর বাকি থাকল না।
কিন্তু অর্জুনবাবু তো বললেন চার মাসেই আগেই ওদের বিচ্ছেদ ঘটেছে। তবে একমাস আগে কী করে একসঙ্গে রেস্টুরেন্টে গেল আর রোহনের তোলা ছবিও আপলোড করল? হতে পারে ছবিটি আগের তোলা কিন্তু বিচ্ছেদের পরে প্রাক্তনের তোলা ছবি কি কেউ এত ভাল ক্যাপশন দিয়ে আপলোড দেয়? এতে তো শুধু মনের কষ্টই বাড়বে। নীতিশের কপালের চিন্তার রেখাগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। একটা সাদা কাগজ বের করে সেখানে লাল কালি দিয়ে অর্জুন সেনগুপ্ত,অভিরূপ হালদার,নরেন মিত্র এবং আরও দুটো নাম লেখে।
ঠিক তখনই ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। ইন্সপেক্টর দেবস্মিতার নাম ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ওঠে।
“হ্যালো, মিঃ স্যানাল।”
“হ্যালো ইন্সপেক্টর মুখার্জি, বলুন।”
“একটা গুড নিউজ রয়েছে। নরেন সবকিছু স্বীকার করেছে। এখন পুরো কেসটা জলের মত পরিস্কার। আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন থানায় চলে আসুন। আমি মিঃ চ্যাটার্জিকেও খবর দিয়েছি।”
লকাপের অন্ধকার রুমে বসে মিলি আর রোহান। মিলির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। সামনে দাঁড়িয়ে অগ্নি, দেবস্মিতা আর নীতিশ। সকলেই নীরব। শেষে নীরবতা ভেঙে নীতিশই প্রথম বলে ওঠে,
“নরেন সবকিছু স্বীকার করেছে যে তোমার ঘর পরিস্কার করতে গিয়েই সে নন্দিনী দেবীর গয়না গুলো পায় যেগুলো তিনি নিখোঁজ হওয়ার সময় পরেছিলেন। নন্দিনী সেনগুপ্তর মৃত্যুর পরেই সে এটা পায়। কিন্তু লোভী নরেন পুলিশকে সেই ঘটনার কথা না জানিয়ে সেগুলো চুরি করে। আর তাছাড়া তুমি রোহনকে কখনওই ছাড়োনি। সম্পর্ক না থাকলে নিশ্চয়ই প্রাক্তনের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে যেতে না বা বিচ্ছেদের পরে প্রাক্তনের তোলা ছবি নিয়ে আনন্দের ক্যাপশন দিয়ে সেটা আপলোড করতে না। আর তোমার এই জাতিস্মর হওয়ার ঘটনাটা পুরোটাই ড্রামা। এই সবকিছু তোমার চার মাস আগে থেকে শুরু হয় তার কারণ চার মাস আগে তুমি আমচুড়িয়া গ্রামে গেছিলে আর সেখানে গিয়ে তুমি জানতে পার যে সেখানে সুখিয়া নস্কর বলে একজন ছিল যে আঠারো-উনিশ বছর আগে মারা গেছে। তখনই তোমার মাথায় এই জাতিস্মর হওয়ার বুদ্ধি আসে। আর নন্দিনী দেবীর মাথায় কোনও ব্লান্ট অবজেক্ট দিয়ে বারবার আঘাত করা হয়েছে। ওইদিকে তোমার গল্ফ সেটে সবকটা ক্লাব থাকলেও পিচিং ওয়েজটা নেই কেন? আর এই সবকিছুতে তোমাকে সাহায্য করেছে রোহন। কারণ মিসেস সেনগুপ্তকে ড্রাগস দিয়ে আচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছিল। আর একজন ড্রাগ অ্যাডিক্টেড এর সাহায্য ছাড়া ড্রাগস এর সন্ধান তোমার পক্ষে পাওয়া সহজ নয়।”
মিলির দুচোখ বেয়ে এখনো জল পড়ছে। রোহন নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।
এবার ইন্সপেক্টর দেবস্মিতা বলেন,
“এবার তোমরা স্বীকার করবে যে কেন তোমরা এমন করেছ নাকি আমরা বাধ্য করব স্বীকার করাতে?”
মিলি চোখের জল মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আমি আর রোহন দুজন দুজনকে ভালবাসতাম, কিন্তু মা তাতে রাজি ছিল না কিছুতেই। তাই বাধ্য হয়ে আমরা এটা করি। অনেকদিন আগে থেকেই আমরা ভাবছিলাম কিভাবে এই কাজ করা যায়। চারমাস আগে যখন পুরুলিয়া যাই তখন ওখানে সুখিয়া নস্করের ঘটনা শুনেই আমি এটা করি যাতে সবাই ভাবে যে আমি মানসিকভাবে অসুস্থ এবং তার ফলে আমার দিকে কোনও সন্দেহ না আসে। আমাকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো হলেও সেই ঔষুধ আমি না খেয়ে লুকিয়ে ফেলে দিতাম।
আর ব্যাপারটা যাতে সাধারণ চুরি ডাকাতির ঘটনা মনে হয় সেইজন্যই মায়ের সব সোনাদানা খুলে নিই। আর ড্রাগস দিয়ে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলাম যাতে মা কোনও চিৎকার না করতে পারে। তারপর রোহন মায়ের গলা টেপার পর আমি কাজটা সম্পন্ন হয়েছে কিনা সেটা নিশ্চিত হতে আমার পিচিং ওয়েজটা দিয়ে মায়ের মাথায় …”
পুরো কথা শেষ করার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়ে মিলি। ইন্সপেক্টর দেবস্মিতা একরাশ ঘৃণা নিয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ছিঃ ছিঃ! কয়েকদিনের ভালবাসার জন্য নিজের জন্মদাত্রী মাকে খুন করতে হল। মা যে এতবছর ধরে ভালবেসে এত বড় করে তুলল তার কোনও দাম নেই তোমার কাছে!”
অগ্নিও বলে উঠলো,
“আর কী ড্রামা! অ্যাক্টিং এ গেলেই তো পারতে।”
মিলির চোখ দিয়ে এখনো জল পড়ে যাচ্ছে।
নীতিশ ঠোঁটের কোণে একটা যুদ্ধজয়ের হাসি হেসে বলল,
“বলেছিলাম না যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর, নিস্পাপ ভাল মানুষ হওয়ার মুখোশটাও বেশি তারাই পরে।”
দেবস্মিতা আর অগ্নি দুজনেই সম্মতি জানায় তার কথায়।
বাড়ি ফিরে ব্যালকনির রোটেটিং চেয়ারটায় বসে নীতিশ। বাইরে আজ অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সেই সাদা কাগজটা বের করে সেখানে অর্জুন সেনগুপ্ত, অভিরূপ হালদার, নরেন মিত্র এবং তারপরে মিলি আর রোহনের নামে একটা করে ডট দেয়। তারপর কাগজটা পাশে সরিয়ে রেখে গরম কফির আমেজ নিতে নিতে চোখ বন্ধ করে বাইরের এই বৃষ্টির অপূর্ব ঝমঝম শব্দ উপভোগ করতে থাকে। অপেক্ষা করতে থাকে আরও নতুন কোনও কেসের, কোনও অপরাধীকে আবারও যোগ্য শাস্তি দেওয়ার।
ডিটেকটিভ নীতিশ স্যানাল অপেক্ষা করতে থাকে আরও কোনও নতুন রহস্য সমাধানের।