হাতের ইশারায় ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বাঁ দিক চেপে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল আরশি। টাকা মিটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে শহীদ নগরের মোড় থেকে বাঁ দিকের গলিটায় পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে। কানে তখনও ‘হেডফোন’। ‘মোজার্ট’ শুনছে, মাঝে-সাঝে দু-এক কলি পাতলা এক জোড়া ঠোঁট ছুঁয়ে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। বছর পঁয়ত্রিশেও ছিপছপে চেহারা, উচ্চতা মেরেকেটে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি, তবে শরীর মেদহীন। দেখেই বোঝা যায় নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস। চোখে চপলতা, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। চারদিক একবার মেপে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে হোটেলের রিসেপশনে এসে থামল আরশি। ঘর পরিষ্কার করতে চাবিটা সকালেই জমা দিয়ে গিয়েছিল। হোটেলের নাম ‘ব্লুমুন’, পাঁচতারা না হলেও, চলনসই । বছর তিনেক আগে একবার বাবা মা কে নিয়ে ভুবনেশ্বর এসেছিল আরশি। উঠেছিল এই হোটেলেই। এবারের আসাটা অবশ্য একেবারেই কর্মসূত্রে। উৎকল ইউনিভার্সিটিতে সেমিনারে যোগ দিতে ডাক পড়েছিল আরশির। চেনা হোটেল, বড় রাস্তা থেকে মিনিট দুয়েকের পথ, এয়ারপোর্ট থেকেও দূরত্ব মাইল পাঁচেকের বেশি না। রেস্তরাঁ, ‘সুইমিং পুল’…সব নিয়ে ব্যবস্থা ভালোই। উপরি পাওনা, হোটেলের ম্যানেজার ভদ্রলোক বাঙালি। নাম আবির মুখার্জি। তার সাথে সেবারই পরিচয় হয়েছিল আরশিদের। তিনি যে আরশি মজুমদারের শখের গোয়েন্দাগিরিরও খবর রাখেন সে কথা জেনে আরশির আত্মবিশ্বাস আরও খানিকটা বেড়েছিল বইকি।
ঘরে এসে হাত-মুখ ধুয়ে, সেমিনারের কাগজপত্র নিয়ে সবে বিছানায় গা এলিয়ে বসেছে আরশি, ওমনি দরজায় টোকা। সারাদিনের পর ক্লান্ত শরীর বিছানা ছাড়তে নারাজ। তবে আরও বার দুই আওয়াজ হতে বিরক্তি কাটিয়ে উঠতেই হল। ঘড়িতে সন্ধে আটটা বেজে পঞ্চাশ। রাতের মধ্যেই ‘সেমিনারের’ একটা ‘রিপোর্ট’ তৈরি করে ফেলা দরকার। বেয়ারাকে দরজার বাইরে একটা ‘ডু নট ডিস্টার্ব’-র বোর্ড ঝুলিয়ে দিতে বলবে কি না ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলেছে আরশি। কিন্তু অপেক্ষারত মানুষটির বরাবর চেনা হাসির বদলে মুখ জুড়ে ঘনিয়ে আসা চিন্তার কালো মেঘ দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছে আরশি। কাজের কথা ভুলে দরজার এক পাশে সরে মানুষটিকে ভেতরে আসার পথ করে দিয়েছে। আবির মুখার্জি অবশ্য বাইরে থেকেই করজোড়ে অসময়ে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইলেন। তারপর তাঁর আসার কারণটা খুলে বললেন।
“মিস মজুমদার, একশো-সাতের ভদ্রলোক, মিস্টার অজয় সিঙ্ঘানিয়া, মারা গেছেন। মৃত্যু অস্বাভাবিক কি না তা অবশ্য জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছে ভদ্রলোক নাকি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। আপনি যদি একবার…” ভদ্রলোকের স্বরে পরিষ্কার আতঙ্ক।
অবাক হয়েছে আরশিও, জানতে চাইল, “পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে…?”
“জানানো হয়েছে । তবে জানেনই তো, আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে কতখানি ভরসা করি। তাছাড়া, হোটেলের একটা মান-সম্মানেরও ব্যাপার আছে। পুলিশ আসার আগেই যদি আপনি নিজে একবার সবটা দেখে নিতেন…”
আরশি ঘাড় নেড়ে আপত্তি জানায়, “তা কী করে হয়, মিস্টার মুখার্জি? পুলিশ যখন আসবেই…”
আরশিকে শেষ করতে না দিয়েই আবিরবাবু বললেন, “আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি, মিস মজুমদার। সেক্ষেত্রে ধরে নিন, এই হোটেলের পক্ষ থেকে আমিই আপনাকে সরকারি ভাবে এই তদন্তের কাজে নিয়োগ করছি। তবে তো আর কোন অসুবিধা নেই। আসুন একবার…।”
আরশি আরও একবার ঘরের চতুর্দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। ধবধবে সাদা বিছানার চাদর ঈষৎ কুঞ্চিত, শায়িত বছর চল্লিশের অজয় সিঙ্ঘানিয়ার নিষ্প্রাণ দেহ। চোখ ফ্যানের ব্লেডে, ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক। শরীরের কোথাও আঘাতের কোন চিহ্নমাত্র নেই। বিছানার সামনে ঘরের মাঝ বরাবর ‘ট্রাইপডে’ আটকানো ‘ভিডিও-ক্যামেরা’। হাতে ‘গ্লাভস’ পরে সন্তর্পণে ‘ক্যামেরা’বন্দী শেষ ‘ভিডিও’টা বার কয়েক চালিয়ে দেখেছে আরশি। অজয় সিঙ্ঘানিয়া নিজের মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী করে গেছেন ‘ভিডিও’তে। ঘরের বাইরে এসে আবিরবাবুকে কাছে ডেকে আরশি বলল, “শরীরে আঘাত যখন নেই, সেক্ষেত্রে আত্মহননের জন্য বিষক্রিয়াকেই বেছে নিয়েছেন, সে কথা দস্তুর। বাকিটা পোস্টমরটেমের রিপোর্ট এলে তবেই জানা যাবে। তবে তার আগে একবার সকলের সাথে কথা বলা দরকার। এই হোটেলে এখন ‘বোর্ডার’ ক’জন, মিস্টার মুখার্জি?”
“মৃত এবং আপনাকে বাদ দিলে ছ’জন,” একটু ভেবে বললেন আবিরবাবু, “এঁরা একইসাথে গতকাল দুপুরে আসেন। সবাই সবাইকে আগে থেকেই চেনেন বলে মনে হয়। ‘গেট-টুগেদার’ করতেই হয় তো…। এক তলার সাতটা আলাদা আলাদা ঘরে উঠেছেন। তবে এসে থেকে বেশিরভাগ সময়টাই সবাই একসাথে। এই তো, আজ দুপুরে ‘লাঞ্চ’ করলেন সবাই একসাথে, তারপর অজয় সিঙ্ঘানিয়ার ঘরেই ভিড় করেছিলেন সবাই মিলে। রেস্তরাঁ থেকে ‘ওয়াইন’, ‘হুইস্কি’ আনালেন। বিকেল হতে অবশ্য সব যার যার নিজের ঘরে। ঘণ্টা খানেক আগে এক মক্কেল…নাম সৌরভ ভটচাজ, এঁর ঘরে এসে দেখেন, দরজা খোলা, মাটিতে মদের গ্লাস গড়াগড়ি, ভদ্রলোক তখনও বেঁচে, মরার আগে জল খেতে চেয়েছেন। কিন্তু সৌরভ নাকি দেওয়ার আগেই সব শেষ।”
“বুঝলাম,” ঘাড় নেড়ে বলে আরশি, “এই সৌরভবাবুকে দিয়েই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করতে চাই। বাকিদের তারপর।”
“বেশ তো, ‘কনফারেন্স রুমে’ ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সৌরভবাবুকে ডেকে পাঠাচ্ছি, আর বাকিদেরও তৈরি থাকতে বলি,” বললেন আবিরবাবু।
* * *
মধ্যবয়স্ক, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখে সোনালি চশমা, পরনে ঢিলেঢালা ‘টিশার্ট’ আর পাজামা। আচরণে প্রগল্ভতা নেই, শান্ত প্রকৃতির মানুষ বলেই মনে হয়। আরশি সামনে বসা ভদ্রলোককে আপাদমস্তক জরিপ করে নিয়ে জানতে চাইল, “আপনার নাম?”
“সৌরভ ভট্টাচার্য।”
“কোথায় বাড়ি? কাজ কী করেন?”
“বাড়ি মধ্যমগ্রাম, কলকাতার কাছেই। কাজ বলতে একটা আইটি কোম্পানি তে সেলস ডিপার্টমেন্টে আছি,” একটু ভেবে বললেন সৌরভবাবু, “তাও প্রায় বছর সাতেক তো হলই।”
“এখানে কী করতে?”
নিজের চেয়ারে নড়েচড়ে বসলেন সৌরভবাবু, “‘গেট-টুগেদার’ বলতে পারেন। আমরা মানে, আমরা এই সাত জন, একসাথে পড়াশুনা করেছি, দিল্লির ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে । কলেজ জীবন শেষ হয়েছে সে প্রায় বছর পনেরো তো হবেই। ফোনাফু নি চলত, শেষে এই মাস খানেক আগে ঠিক হল সবাই দেখা করব একসাথে। প্রথমে ঠিক হয়েছিল দিল্লিতেই দেখা হবে। তারপর মোহান্তির কথায়…আলোক মোহান্তি, ওর বাড়ি এই ভুবনেশ্বরেই, কাছেই। বাবা নেই, মা ‘ক্রিটিক্যালি ইল’, ছেড়ে যাওয়া সম্ভব হত না। তাই ওর কথা ভেবেই আমরা সবাই এখানে। গতকাল বেলাবেলি পৌঁছেছি। আগামিকাল একসাথে ঘোরাঘুরি করে পরশু দুপুরের গাড়িতে ফেরবার কথা ছিল। কিন্তু এখন যা হল…” গভীর চিন্তার ভাঁজ পড়ল সৌরভবাবুর কপালে।
আরশি এক পলক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বুঝে নিতে চাইল ভদ্রলোকের কথায় কোন অনুভুতির প্রাধান্য বেশি… বন্ধু হারানোর শোক, সময় মতো বাড়ি ফিরতে না পারার দুশ্চিন্তা, নাকি ভয়? তারপর জানতে চাইল, “উনি মারা গেলেন ঠিক কখন?”
“এই ধরুন…” থুতনিতে আঙুল বুলিয়ে বললেন সৌরভবাবু, “সাড়ে সাতটা নাগাদ। আড়াইটে নাগাদ নিচে রেস্তরাঁতে ‘লাঞ্চ’ করতে গেছিলাম একসাথে। ফিরে সবাই মিলে অজয়ের ঘরেই যাই। সবাই বলতে অবশ্য নিত্যা, নিত্যা মিত্র, আমাদের ‘ব্যাচমেট’, ও নিজের ঘরে গেল।”
“কেন? আপনারা সবাই একসাথে, আর উনি একা নিজের ঘরে চলে গেলেন?”
“বেশিক্ষণের জন্য না, বড়জোর মিনিট দশেক। সকাল থেকেই মাথা ধরেছিল বলছিল, খুব সম্ভবত ওষুধ খেতেই। অবশ্য এটা আমার ধারণা,” বললেন সৌরভবাবু।
“বুঝলাম,” ঘাড় নেড়ে বলল আরশি, “আর বাকিরা? সবাই একসাথে অজয়বাবুর ঘরে, তাই তো?”
“হ্যাঁ, তবে, মিনিট পাঁচেক পর অবশ্য অতীশ আর শ্লোক সিগারেট খেতে বাইরে গিয়ে ছিল। শ্লোক ফিরে এল দশ মিনিটের মধ্যেই, অতীশ একটু পরে। ততক্ষণে নিত্যাও চলে এসেছে।”
“কতক্ষণ ছিলেন সবাই একসাথে? কী করছিলেন?”
“করছিলাম বলতে… গল্প, কলেজের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ। ছিলাম ওই ঘণ্টা দুয়েকের কাছাকাছি। সোয়া চারটে নাগাদ আমি আমার ঘরে ফিরে আসি। বাকিরাও একে একে তখনই। আমি আবার সাড়ে সাতটা নাগাদ ওর ঘরে যাই। দরজা ভেজানো ছিল, কিন্তু ভেতর থেকে আটকান ছিল না। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো আরও কেউ রয়েছে। কিন্তু ওকে ওই অবস্থায় দেখে আমি তো অবাক।”
“ঠিক কী অবস্থায় দেখলেন ওঁকে?”
“বিছানায় আধশোয়া, নেতিয়ে পড়ে আছে যেন। আমাকে দেখে কিছু বলতে চেষ্টা করছিল। কতটা গোঙানির মতো, প্রথমটা কিছু বুঝিনি… পরে বুঝলাম বলছে জল দেওয়ার কথা। বিছানার পাশেই টেবিলে জলের গ্লাস আর বোতল ছিল। তবে ঢেলে দিতে দিতে সব শেষ।”
“ঠিক কিভাবে বুঝলেন যে উনি আপনাকে জল দেওয়ার কথা বলছেন? ইশারা করছিলেন? নাকি কথা বলতে পারছিলেন তখনও?”
“কথা… তবে খুব অপরিষ্কার, জড়ানো । বললাম না, প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না। কাছে এসে বুঝলাম, বলছে “পানি… পানি”।”
“উনি তো হিন্দিভাষী ছিলেন, আপনাদের মধ্যে কথাবার্তা কী হিন্দিতেই হত?” ফের জানতে চাইল আরশি।
“তা বলতে পারেন, হিন্দি, ইংরেজি মিশিয়ে।”
“আচ্ছা,” একটু ভেবে বলল আরশি, “এবার বলুন তো, ঠিক কী কারণে আপনার মনে হল, অজয়বাবু আত্মহত্যা করেছেন?”
মাথা চুলকে ভদ্রলোক বললেন, “অজয়ের শরীর স্বাস্থ্য বরাবর ভালই ছিল। কোনদিন কোন রোগ-বালাইয়ের কথা শুনিনি ওর মুখে। যতক্ষণ একসাথে ছিলাম, ভালই ছিল। তারপর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে এমন কী হতে পারে, আমার তো মাথায় আসছে না। তাছাড়া ওই ‘ভিডিও ক্লিপ’। ঘর থেকে বেরনোর আগে খেয়াল করি ‘ট্রাইপডে’ আটকান অজয়ের ‘ক্যামেরা’টা। সত্যি বলতে কৌতূহলবশতই শেষ ‘ভিডিও ক্লিপ’টা চালিয়ে দেখি।”
“দেখুন সৌরভবাবু,” আরশি টেবিলের ওপর দুই হাতের কনুইয়ে চাপ দিয়ে সামনে ঝুঁকে বলে, “আপনিই ওঁকে শেষ জীবিত অবস্থায় দেখেছেন। গ্লাসে এবং ‘ক্যামেরা’য় আপনার আঙুলের ছাপ পুলিশ নিঃসন্দেহে খুঁজে পাবে। এতে আপনার ওপরই সন্দেহ বাড়বে।”
“কিন্তু কেন? আপনি ‘ভিডিও’টা দেখেছেন?” সৌরভ সোজা হয়ে বসেছেন, চোখে-মুখে সামান্য অনাকাঙ্ক্ষিত বিরক্তি, “‘ভিডিও’তে অজয় নিজেই জানিয়েছে এ মৃত্যুর জন্য সে নিজেই দায়ী।”
“বেশ আপনার কথাই মেনে নিলাম,” আরশি বলল, “কিন্তু আপনার কী ব্যাপারটা সত্যি এতটাই সহজ লাগছে, সৌরভবাবু? যে মানুষটা দু ঘণ্টা আগে অব্দি সকলের সাথে আনন্দ করলেন, তিনি হঠাৎ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত কেন নেবেন বলুন তো?”
“তার আমি কী জানি? আপনি তো গোয়েন্দা, আপনিই খুঁজে বের করুন,” গলায় বেশ ঝাঁজ নিয়েই কথাটা বলে ফেললেন সৌরভ ভট্টাচার্য, “তবে একটা কথা, আত্মহত্যা নয় এ কথা বলে যদি এটা খুন এটাই বলতে চান, তবে বলে রাখি, আমরা এই ছ’জনই অজয়ের পূর্ব পরিচিত, এবং শুভাকাঙ্খী। খুনি আমাদের মধ্যে কেউ হতেই পারে না।”
“বেশ তো,” আলতো হাসল আরশি, “তবে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আমাকে দেওয়া হয়েছে। তাই সবার সাথে কথা না বলে শুধুমাত্র ধারণার বশে আমি কাউকে দোষী সাব্যস্ত যেমন করব না, তেমনি এখনই সবাইকে নির্দোষ বলার সময়ও আসেনি সৌরভবাবু। আপনার সময়ের জন্য ধন্যবাদ। এবার আপনি আসতে পারেন,” তারপর সৌরভ ভট্টাচার্যকে চেয়ার ঠেলে উঠতে দেখে বলল আরশি, “আর ‘কাইন্ডলি’ আলোকবাবুকে এই ঘরে ডেকে দেবেন।”
* * *
কফির কাপে চুমুক দিয়ে রেস্তরাঁর নরম গদি আঁটা সোফায় হেলান দিয়ে বসেছে আরশি। ঘড়িতে সবে বিকেল সাড়ে চার, এখনও রেস্তরাঁ ফাঁকা। সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি আরশি। গত সন্ধের হোটেলের দোতলার ‘সিসি টিভি ফুটেজ’ দেখার পর থেকে মাথার মধ্যে অনেকগুলো সম্ভবনা উঁকি দিচ্ছে। পাজামার পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে টেবিলের ওপর মেলে ধরল আরশি। হোটেলের ‘বোর্ডার’দের নামের একটা তালিকা। যাদের সাথে কাল রাতেই কথা বলা হয়ে গেছে তাদের নামের পাশে পেন্সিলে দেওয়া টিক। সৌরভ ভট্টাচার্য, আলোক মোহান্তি, নবীন নেগি এবং শ্লোক ত্রিবেদী। বাকি এখনও দু জন…নিত্যা মিত্র আর অতীশ বাসু। এদের জিজ্ঞাসাবাদ না করা অব্দি চিন্তার জট যে ছাড়বে না, সে কথা ভালই জানে আরশি। তবু এখনও অব্দি জানতে পারা তথ্য এবং প্রশ্নগুলো মনে মনে সাজিয়ে নিল আরশি। সাত বন্ধু, গেট টুগেদার করতে ভুবনেশ্বর। হোটেল ‘ব্লুমুনে’ এসে পৌঁছল বাইশে মার্চ বেলা এগারোটা নাগাদ। পরেরদিন দুপুরে লাঞ্চের পর সবাই একসাথে অজয়বাবুর ঘরে। সবাই বলতে নিত্যা মিত্র নন, তিনি গেলেন নিজের ঘরে। মাথা ব্যথা। ওষুধ খেতেই গেলেন কি? যাইহোক, মিনিট দশেক পরে আর সবার সাথে তিনিও হাজির অজয়বাবুর ঘরে। ইতিমধ্যে বাইরে গেছিলেন শ্লোক এবং অতীশ। সিগারেট খেতে। নিত্যা ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যে তারাও ফিরলেন। অজয়বাবু সুস্থ, হাসি খুশি। সবাই মিলে গল্প হল, মদ্যপান হল। তারপর যে যার ঘরে ফিরে গেলেন। ঘরে ফেরার মিনিট পনেরো পরেই ‘সিসি ক্যামেরা’য় দেখা গেল নিত্যা মিত্রকে। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে অজয়ের ঘরে গেলেন। ঠিক কুড়ি মিনিট আঠেরো সেকেন্ডের মাথায় বেরিয়ে এলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে হাসলেন, তারপর হাত নাড়লেন। চলে আসার আগে টেনে বন্ধ করে দিলেন দরজা। গিয়েছিলেন খালি হাতে, ফিরলেন হাতে মোবাইল নিয়ে। হয়তো অজয়বাবুর ঘরে ভুলবশত মোবাইল ফেলে এসেছিলেন বলেই ফিরে যেতে হল। নিত্যা মিত্র ফিরে যাওয়ার আরও মিনিট পঁচিশ পরে নবীন নেগি এবং অতীশ বাসু একসাথে ঢুকলেন অজয়ের ঘরে। নবীন নেগি বেরিয়ে আসলেন মিনিট খানেকের মধ্যেই, মুখে হাসি। তার আরও মিনিট পাঁচেক পরে বেরলেন অতীশবাবু। দরজা আগের মতই টেনে বন্ধ করে চলে গেলেন নিজের ঘরে। কিন্তু কেন? কি উদ্দেশ্যে গেছিলেন এঁরা? নেহাত কথা বলতেই কি? যদি তাই ধরে নেওয়া হয়, এর আরও ঘণ্টা দেড়েক পর গেলেন সৌরভবাবু, ততক্ষণে অজয়বাবু প্রায় অচৈতন্য। বললেন, “পানি”, কিন্তু জল দেওয়ার আগেই তার মৃত্যু। রেখে গেলেন নিজের ‘ক্যামেরা’ বন্দী ‘ভিডিও ক্লিপ’…আত্মহননের প্রমাণ। কিন্তু এখানেই খটকা, যিনি মনে মনে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছেন, তাঁর পক্ষে কি ঘণ্টা তিনেক আগে সবান্ধব মদ্যপান এবং আনন্দ করা সম্ভব? নাকি স্মৃতিচারণ ছাড়াও আরও এমন কিছু হল বন্ধ ঘরে যার জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিতে হল তাঁকে?
“মিস মজুমদার, আপনি এখানে?”
ভাবনায় ছেদ পড়েছে আরশির। পেছন ঘুরে দেখে কাঁচুমাচু মুখে এগিয়ে আসছেন ম্যানেজারবাবু। আবির মুখার্জি কাছে এসে বললেন, “পুলিশ এসেছে আবার। জিজ্ঞাসাবাদ করছে। পোস্টমর্টেমে বিষক্রিয়ার কথাই বলতে শুনলাম। আপনি একবার ইন্সপেক্টর সাহেবের সাথে কথা বলে নেবেন না কি?”
“চলুন,” চিরকুট পটেকে ভাঁজ করে রেখে সোফা ছেড়ে উঠে পড়েছে আরশি। যেতে যেতে আবিরবাবু বললেন, “আমি অবশ্য ইনস্পেক্টরকে আপনার পরিচয় দিয়েছি। আর এও বলেছি হোটেলের তরফ থেকে আমরা আপনাকে সরকারি ভাবেই এই তদন্তে নিয়োগ করেছি। ‘প্রাইভেট ইনভেশটিগেটর’দের নিয়ে ইনস্পেক্টর বেহেরার তেমন কোন ‘জেলাসি’ কিংবা সমস্যা আছে বলে তো দেখে-শুনে মনে হল না। তবে কী বলুন তো মিস মজুমদার, ভদ্রলোক রাশভারী, আর ঠোঁটকাটাও। কখন কাকে কি বলেন ঠিক নেই। তাই বলছিলাম আর কি, ভদ্রলোক যদি দু একটা আলপটকা কথা বলে দেন মুখের ওপর, ‘কাইন্ডলি’ কিছু মনে করবেন না।”
আরশি সহাস্যে আবিরবাবুকে নিশ্চিন্ত করে বলে যে আজ অব্দি কোন তদন্তেই পুলিশের সাথে তাকে ঝামেলায় পড়তে হয়নি।
হোটেলের লাউঞ্জে একটা চেয়ার টেনে ইন্সপেক্টর বেহেরার মুখোমুখি বসল আরশি। ইনস্পেক্টরের বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ, অপেক্ষাকৃত ঘন ভুরু, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, মাথার সামনের দিকে চুল পাতলা হলেও পাক ধরেনি এখনও। সুঠাম শরীর, তবে রাশভারী যে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। আরশির সৌজন্যসূচক হাসির উত্তরে গাম্ভীর্য বজায় রেখেই সরাসরি কাজের কথায় এসেছেন, “আপনার নাম?”
“আরশি মজুমদার।”
“শুনলাম আপনি নাকি শখের গোয়েন্দা?”
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় আরশি, “আপনি ঠিকই শুনেছেন। তবে গোয়েন্দাগিরি আমার পেশা নয়, নেশা। পেশায় আমি শিক্ষকতা করি।”
“তাই ভাবি,” এই প্রথম ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি দেখা গেল ইনস্পেক্টরের, “আসলে মহিলা গোয়েন্দা…শোনা যায় না বড় একটা। আর তাছাড়া আপনাকে দেখেও কিন্তু মনে হয় না। কী ধরণের কাজ করেন সাধারণত? সবই বিবাহ সম্পর্কিত, নাকি খুন-খারাবিও কিছু আছে?”
ইনস্পেক্টরের কথায় আত্মসম্মানে কোথাও যেন ঘা লেগেছে, তাও মুখের হাসি বজায় রেখেই বলল আরশি, “এই ‘জেন্ডার বায়াস’ একটা সামাজিক ব্যাধি। আপনার মত মানুষের থেকে প্রত্যাশিত নয়। নিজের কাজের বিষয়ে বড়াই করা আমার স্বভাব বহির্ভূত। মাফ করবেন। তবে আজকের তথ্য প্রযুক্তির যুগে কারোর বিষয়ে জানতে চাইলে সহজেই জানা যায়। আপনি নিজেই জানার চেষ্টা করে দেখবেন না হয়। আর তাছাড়া আপনি মনে হয় গোয়েন্দা গল্পের চরিত্রদের সাথে বাস্তবের গোয়েন্দাদের মিশিয়ে ফেলছেন ইন্সপেক্টর। বাস্তবের গোয়েন্দারা সবাই ছ’ফুট হন না, না তো তারা সবাই আগ্নেয়াস্ত্র হাতে কিংবা ক্যারাটের প্যাঁচ কষে দোষীদের ঘায়েল করেন। এ কথা তো মানবেন, প্রতিটা ‘ক্রাইমের’ পেছনে একটা ‘মোটিভ’ থাকে। ‘ক্রাইমের’ পেছনের এই ‘সাইকোলজি’টাই আমাকে টানে।”
উত্তর শুনে ইনস্পেক্টর যে আপ্লুত হননি, সেটা বলাই বাহুল্য। কাজের কথায় ফিরে এসে বললেন, “এই ঘটনায় আপনার ‘সাইকোলজিকাল’ বিশ্লেষণ কী বলছে, মিস মজুমদার?”
“এটাই যে ‘ভিকটিম’ মারা গেছেন বিষক্রিয়ায়, এবং সাধারণ চোখে এই মৃত্যুকে যতটাই আত্মহত্যা বলে মনে হোক, আসলে এটা খুন। ঠাণ্ডা মাথায়, সুপরিকল্পিত খুন।”
“আপনার তাই মনে হয়?” ইনস্পেক্টর বেহেরা যেন সত্যিই অবাক হয়েছেন, “বিষক্রিয়ার ব্যাপারে আপনি নির্ভুল। ‘পোস্টমরটেমে’ ভিকটিমের শরীরে ‘আরসেনিক অক্সাইড’ পাওয়া গেছে। ‘লেথাল ডোজ’। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই স্নায়বিক বিকলতা এবং তারপর মৃত্যু। তবে আপনি আশা করি ‘ভিডিও ক্লিপ’টার কথা জানেন। আর এও হয়তো জানেন, মৃত্যুর আগে মৃতের দেওয়া বয়ানকে আইনের চোখে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়!”
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় আরশি। ইনস্পেক্টর বেহেরা কয়েক সেকেন্ড তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরশি কে মেপে নিয়ে উঠে পড়েন, “আজকের মতো তবে এটুকুই থাক। হোটেলের পক্ষ থেকে আপনাকে যখন নিয়োগ করেছে, আপনি আপনার মতো করে তদন্ত করতে পারেন, মিস মজুমদার। আর বিশ্বাস করুন, রহস্য সমাধানের ব্যাপারে আমি সত্যিই পক্ষপাতহীন। ‘ইগো’র লড়াইতেও যাই না। আপনি যদি আমাকে প্রমাণ সহ ‘কনভিন্স’ করতে পারেন, মিস মজুমদার, তাতে আমার কোন সমস্যা নেই। রহস্য সমাধানের কৃতিত্বটাও আপনারই থাকবে। আজ তবে আসি।”
* * *
সামনের চেয়ারে বসে অতীশ বাসুকে দু-হাত কচলাতে দেখে আরশি বলল, “গৌরচন্দ্রিকা না করে সোজাসুজি প্রশ্নে আসি, অতীশবাবু। সেদিন মধ্যাহ্ন ভোজের পর আপনারা সবাই অজয়বাবুর ঘরে যান। মিনিট খানেক পরেই আপনি এবং শ্লোক ত্রিবেদী সিগারেট খেতে বাইরে যান। শ্লোক ফিরে আসেন মিনিট দশেক পরে। কিন্তু আপনি ফিরলেন আরও মিনিট পাঁচেক পর। এই সময়টায় আপনি কথায় ছিলেন জানতে পারি?”
“কেন বলুন তো? আমি নিজের ঘরে যাই। একটা ফোন করতে।”
“আপনি আর শ্লোকবাবু একই সঙ্গে দোতলায় উঠে আসেন। তারপর শ্লোকবাবু অজয়বাবুর ঘরে ঢুকে যান এবং আপনি আসেন নিজের ঘরে তাই তো?”
অতীশ ত্রিবেদীর চোখ আরশির ডান হাতে ধরা পেনে। সামান্য আরষ্ঠ হয়ে গেলেন কি? নাকি আরশির চোখের ভুল? মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন অতীশ।
“কাকে ফোন করছিলেন, জানতে পারি?” আরশি জানতে চাইল। অতীশবাবু এই সামান্য প্রশ্নে যে এভাবে মেজাজ হারাবেন আরশি অনুমান করতে পারেনি। দাঁতে দাঁত চেপে অতীশ জানালেন তিনি কাকে ফোন করছিলেন এ তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং অজয়ের মৃত্যুর সাথে এর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন না।
“বেশ…” আরশি হেসে বলল, “যে সময়টা আপনারা একসাথে ছিলেন সেসময় কী ধরণের কথাবার্তা হচ্ছিল আপনাদের মধ্যে? এই উত্তরটা নিশ্চয়ই আপনার একান্ত ব্যক্তিগত না?”
“দীর্ঘদিন পর বন্ধুদের দেখা হলে যেমন কথা হয়…” রাগত স্বরেই উত্তর দিলেন অতীশ বাসু, “পুরনো দিনের কথা, এখন কে কী করছি, সাংসারিক জীবন, কর্মজীবন…এইসব।”
“আপনারা কি সকলেই বিবাহিত?”
“না, আমি অবিবাহিত। অজয়ও। বাকিরা অবশ্য সকলেই বিবাহিত।”
“আপনি বিবাহ করেননি কেন?”
অতীশবাবু কটমট করে তাকালেন, “আমার ইচ্ছে। আমার হবু স্ত্রীয়ের আমাদের বিয়ের আগেই মৃত্যু হয়। আপনি অকারণে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবেন না, ‘প্লিজ’ মিস মজুমদার।”
“কারণে না অকারণে, সেটা আপনি আপাতত আমার ওপরই ছেড়ে দিন অতীশবাবু,” ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে গলায় স্কুলের বড়দি সুলভ ভারিক্কি নিয়েই কথাটা বলল আরশি, “আচ্ছা, সেদিন সবাই নিজের নিজের ঘরে ফিরে আসার বেশ কিছুক্ষণ পর আপনি আর মিস্টার নেগি আরও একবার অজয়বাবুর ঘরে যান। কোন প্রয়োজনে কি?”
“হ্যাঁ, প্রয়োজনে,” বলেন অতীশবাবু, “পরেরদিন কোথায় কোথায় ঘুরতে যাওয়া হবে, তারই পরিকল্পনা করতে। তারপর আমি হোটেলের ‘রিসেপশনে’ যাই পরেরদিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করতে। চাইলে আপনি পরখ করে নিতে পারেন।”
“বুঝলাম,” আরশি তেরছা চোখে ঘাড় নাড়ে, তারপর বলে, “আচ্ছা, আপনারা তো সেদিন বিকেলে রেস্তরাঁ থেকে ‘ড্রিঙ্কস’ আনিয়েছিলেন। কে বানাল ‘ড্রিঙ্কস’গুলো?”
“মনে নেই,” সংক্ষেপে বললেন অতীশবাবু, “তখন তো জানতাম না আপনার জেরার উত্তর দিতে হবে, আমি ছিলাম, শ্লোক, আলোক, নিত্যা। আপনার আর কিছু জানার আছে, মিস মজুমদার?”
আরশি ঘাড় নাড়ল, “না, আপনি এখন আসতে পারেন মিস্টার বাসু। মিসেস মিত্র যদি বাইরে থাকেন, ওঁকে ভেতরে আসতে বলে দেবেন ‘প্লিজ’।”
“বেশ,” দরজার দিকে পা বাড়িয়েছেন অতীশ বাসু, হঠাৎ কী ভেবে পেছন ফিরে তাকালেন। বললেন, “মিস মজুমদার, অজয় আমাদের পুরনো বন্ধু। আমাদের জেরায় জেরবার করে আপনার কোন লাভ হবে না, কথাটা বলে রাখলাম। আসি।”
অতীশ বাবু র চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এক ঝলক হাসি আরশির ঠোঁটে এসেও মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। দরজা খুলে ঢুকছেন নিত্যা মিত্র। ছিপছিপে চেহারা, ঘাড় অব্দি ছোট করে কাটা চুল, পরনে ঢিলেঢালা কাফতান। ঠোঁটে সৌজন্যসূচক হাসি। আরশির উল্টো দিকের চেয়ারে গুছিয়ে বসে বললেন, “গতকাল যা হয়ে গেল, তার শোক কাটিয়ে ওঠা যে কী ভয়ানক কঠিন সে কথা বোধহয় ভাষায় প্রকাশ করা শক্ত। অজয় সারাদিন আমাদের সকলের সাথেই ছিল। এক মুহূর্তের জন্য বুঝতে দেয়নি ওর মনের মধ্যে কী চলছে,” গলায় বন্ধু হারানোর দুঃখ নিয়েই কথাগুলো বললেন নিত্যা মিত্র।
“আপনাদের মনের অবস্থা অনুমেয়, মিসেস মিত্র। আমি আপনার বিশেষ সময় নেব না। শুধু কয়েকটা প্রশ্ন…”
“বলুন না, কি জানতে চান,” আলতো হেসে বললেন নিত্যা।
“প্রথমত, দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই যখন অজয়বাবুর ঘরে গেলেন, আপনি গেলেন না। নিজের ঘরে ফিরে এলেন। কোন বিশেষ কারণে কি?”
“আসলে আমার ‘মাইগ্রেনের’ সমস্যা,” বললেন নিত্যা, “সকাল থেকেই মাথাটা ধরে ছিল। দুপুরে খাওয়ার পর ভাবলাম একটা ‘প্যারাসিটামল’ খাওয়া দরকার। ‘রুমে’ গেছিলাম ওষুধ খেতে। হয়ে যেতেই আবার অজয়ের ঘরে সবার সাথে যোগ দি।”
“বেশ। আপনি পরে আরেকবার ওঁর ঘরে যান। বিকেলে, সবাই যে যার ঘরে ফিরে যাওয়ার পর, কি তাই তো? সেবার কী কারণে গেলেন?”
“ওহ…” হাসলেন মিসেস মিত্র, “আমার এমন ভুলো মন। ফোনটা ফেলে চলে এসেছিলাম অজয়ের ঘরেই। ঘরে ফিরে এসেও মনে পড়েনি। মিনিট খানেক পর বাড়িতে একটা ফোন করব বলে খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ল। তাই ফোনটা আনতে গিয়েছিলাম।”
“বেশ। তবে, আপনি তো বেশ খানিকক্ষণ অজয়বাবুর সাথেই ছিলেন। প্রায় মিনিট কুড়ি। ফোন খুঁজে পেতে কি এতটা সময় লেগে গেল?”
“আরে না, না,” হেসে বললেন নিত্যা, “ফোন তো ‘টিভি ক্যাবিনেটের’ ওপরই রাখা ছিল। অজয়কে বললাম মেয়েকে ‘ভিডিও কল’ করব। সেই শুনে অজয় ও ধরে বসল, আমার মেয়েকে দেখবে। আসলে কী বলুন তো মিস মজুমদার, আমাদের এই ক’জন বন্ধুর মধ্যে আমারই সবার আগে বিয়ে হয়ে যায়, এক বছরের মাথায় সন্তান। বাকি যারা বিবাহিত, তাদের কারোর ছেলে-মেয়ে হয়নি এখনও। তাই এত আগ্রহ। মেয়েকে ফোন করলাম তাই অজয়ের ঘর থেকেই…”
“আচ্ছা, সেই সময়টায় অজয়বাবুকে কেমন দেখেছিলেন? অসুস্থতার কোন লক্ষণ কি ছিল?”
“একেবারেই না,” বললেন মিসেস মিত্র, “একেবারে সুস্থ। তবে আমাকে বলল দরজাটা টেনে দিয়ে যেতে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, তখনও বুঝিনি ওর মাথায় এসব চলছে।”
“বেশ, মিসেস মিত্র। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। এখনকার মতো আসতে পারেন আপনি,” কথাটা বলে নিজেও উঠে দাঁড়িয়েছে আরশি। মিসেস মিত্রকে ‘কনফারেন্স রুমের’ দরজা অব্দি ছেড়ে দিয়ে হাত-ঘড়িতে সময় দেখল আরশি। সাতটা বেজে দশ। এবার একান্তে কিছুটা সময় কাটানো দরকার। চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নেওয়া দরকার। কিন্তু তারও আগে দরকার আরেক কাপ কফি। রাতে জাগতে হতে পারে।
* * *
পরেরদিন দুপুরের পর থেকে আরশির মেজাজ ফুরফুরে। চিন্তিত কপালের মাঝবরাবর ভিড় করা রেখাগুলো উধাও, মুখ থেকে গত দু দিনে হারিয়ে যাওয়া হাসিটা আবার ফিরে এসেছে। পরেরদিন দুপুরে কলকাতা ফেরার বন্দোবস্তও সারা। দুপুরেই ম্যানেজার আবির মুখার্জির সাথে কথা হয়ে গেছে।
“আজ সন্ধেবেলা আরেকটিবার ‘কনফারেন্স রুম’টা চাই। হোটেলের ছ’জন ‘বোর্ডারেরই’ উপস্থিত থাকা চাই। আপনিও থাকবেন, আর যদি পারেন, ইনস্পেক্টর বেহেরাকেও আমন্ত্রণ জানাবেন,” বলে রেখেছে আরশি।
এখন ঘড়ি ধরে সন্ধে ছ’টা আঠাশ, সবাই ‘কনফারেন্স রুমে’ এসে পড়েছেন ইতিমধ্যেই। লম্বা আয়তাকার টেবিলের একদিকে সৌরভ ভট্টাচার্য, আলোক মোহান্তি, অতীশ বাসু। উল্টোদিকে নবীন নেগি, নিত্যা মিত্র, শ্লোক ত্রিবেদী। তার পাশে হোটেলের ম্যানেজার আবির মুখার্জি, এবং তারও পরে ইনস্পেক্টর বেহেরা। দরজার কাছে দু জন কনস্টেবল। আরশি দাঁড়িয়ে টেবিলের একদিকে। সবার চোখ আরশির দিকে, আরশির চোখ ঘড়িতে। কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ছ’টায় একবার সবার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে আরশি বলল, “আপনারা সকলে আজ এখানে উপস্থিত হয়েছেন যে কারণে, আপনাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু মিস্টার অজয় সিঙ্ঘানিয়ার মৃত্যু ঘিরে যে রহস্য ঘনীভূত হয়েছে, সে ব্যাপারে আমি শীঘ্রই আলোকপাত করব। তবে তার আগে আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ। আপনাদের সহযোগিতা, মিস্টার মুখার্জির সাহায্য ব্যতিরেকে এই রহস্যের সমাধান আমার একার পক্ষে করা কঠিন হত। এবার আসি ঘটনাপ্রবাহে। গত পরশু, অর্থাৎ তেইশে মার্চ সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ মিস্টার ভট্টাচার্য অজয়বাবুর ঘরে যান এবং তাকে প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখেন। অবশ্য তখনও তার শরীরে প্রাণ আছে। দরজা ছিল ভেজান, ভেতর থেকে আটকান ছিল না। মেঝেতে মদের বোতল, গ্লাস পড়ে। শরীরে বাহ্যিক আঘাতের কোন চিহ্ন নেই। সৌরভবাবুকে ঘরে ঢুকতে দেখে অজয়বাবু অনেক কষ্টে দুবার ‘পানি’ দেওয়ার কথা বলেন, অর্থাৎ জল চান। সৌরভবাবু বিছানা লাগোয়া টেবিল থেকে বোতল নিয়ে জল দিতে দিতে অবশ্য প্রাণ হারান অজয় সিঙ্ঘানিয়া। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগে সৌরভবাবু লক্ষ্য করেন অজয় সিঙ্ঘানিয়ার ‘ক্যামেরা’। ‘ট্রাইপডে মাউনটেড’। ওঁর বয়ান অনুযায়ী, ঔৎসুক্যের বশেই ‘ক্যামেরা’য় মৃত অজয়বাবুর জবানবন্দীর ‘ভিডিও’টি দেখে ফেলেন তিনি। তারপর সবাইকে এসে জানান, অজয়বাবু আত্মহনন করেছেন এবং একটি ‘ভিডিও’তে সে কথা স্বীকার করে নিজের মৃত্যুর দায় নিজেই নিয়ে গেছেন। এই অব্দি ঘটনার বিবরণ শুনে আমারও মনে হয়েছে, এ অত্যন্ত সোজা-সাপটা ব্যাপার, যাকে বলে ‘ওপেন অ্যান্ড শাট কেস’। বিষক্রিয়ায় আত্মহননের চেষ্টা এবং মৃত্যু। কিন্তু আমার প্রথমবার খটকা লাগে আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার পর,” আরশি টেবিলের ওপর রাখা ‘মিনা রেল ওয়াটারের’ বোতল থেকে এক চুমুক জল গলায় চালান করে বলল, “আপনাদের সাথে কথা বলে জানতে পারি, সেদিন বিকেল অব্দি উনি আপনাদের সাথে গল্প করেছেন এবং তাঁর আচরণে আপনারা একজনও অনুমান করতে পারেননি, আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই এই জীবনের মায়া ত্যাগ করবেন অজয়বাবু। সন্দেহের কারণ এই না অনুমান করতে পারাটাই। আপনাদের জানিয়ে রাখি, পুলিশ সূত্রে ‘পোস্ট- মর্টেমের’ যে ‘রিপোর্ট’ আমি পেয়েছি, তাতে অন্তত মৃত্যুর চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা আগে বিষটি তার শরীরে ঢোকে। কিন্তু সেই হিসেবে অন্তত দুপুর তিনটে নাগাদ অজয়বাবুর আত্মহত্যা করে থাকার কথা। কিন্তু তা কী করে হয়? তখন তো আপনারা সকলে একসাথে তাঁর ঘরেই রয়েছেন। তাই না?”
অতীশ বাসুকে নিজের আসনে উশখুশ করতে দেখে আলতো হেসে আরশি বলল, “তবে আপনার কথা দিয়েই শুরু করা যাক, মিস্টার অতীশ ? আপনার ব্যবহারে আমার প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল আপনি কিছু গোপন করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ঠিক কী, সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আপনি বিকেলে মিস্টার নেগির সাথে আরেকবার অজয়বাবুর ঘরে যান। মিস্টার নেগি বেরিয়ে আসার পরেও আপনি আরও মিনিট দশেক ভেতরেই ছিলেন। কী করতে গিয়েছিলেন, এ প্রশ্ন আমি এর আগেও আপনাকে করেছি। আপনি বলেছেন, পরের দিন কোথায় কোথায় ঘুরতে যাওয়া হবে সেই প্রসঙ্গে কথা বলতেই অজয়বাবুর ঘরে আরও মিনিট দশেক রয়ে গিয়েছিলেন আপনি। কি তাই তো?”
অতীশবাবুর চিবুক বুক ছুঁয়েছে, গম্ভীর স্বরে বললেন, “আগে যখন বলেছি তখন আবার জানতে চাইছেন কেন? বারবার জানতে চাইলে কি সত্যিটা বদলে যাবে?”
“যাবে না?” অতীশবাবুর উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে আরশি, “আমি যদি বলি, আপনি সত্যি কথা বলছেন না? যদি বলি আপনি তখন আলমারি থেকে ‘ট্রাইপডে মাউনটেড ক্যামেরা’টা পুনরায় বের করে বিছানার সামনে রেখে সজত্নে আপনার আঙুলের ছাপ মুছে বেরিয়ে আসছেন?”
অতীশবাবুর মুহূর্তে বদলে যাওয়া চেহারা আরশির চোখ এড়ায়নি। ততক্ষণে টেবিল চাপড়ে জানতে চাইছেন অতীশ বাসু, “প্রমাণ আছে কোন? প্রমাণ ছাড়া কাল্পনিক গল্প শুনতে আমরা কেউ আসিনি এখানে।”
“শান্ত হন, অতীশবাবু। আমি তো বলিনি অজয়বাবুর খুন আপনিই করেছেন। ‘মোটিভ’টা কি? এই কথাটা কাল সারা রাত ধরে ভেবেছি। তারপর ম্যানেজারবাবুর শরণার্থী হয়েছি। আজ ভোরবেলা আপনি যখন ‘লাউঞ্জে’ গেলেন খবরের কাগজ পড়তে, তখন ওঁর সাথে আপনার ঘরে গিয়ে একবার আপনার ব্যাগপত্র খুঁজে দেখতেই হল।”
যারপরনাই অবাক হয়েছেন অতীশবাবু। তবে আরশি থামেনি, বলে চলেছে, “খুঁজছিলাম বিষ, পেয়ে গেলাম অন্য কিছু। আপনার ওয়ালেটে সযত্নে রাখা একটি বছর বাইশের মেয়ের ছবি। মনে পড়ে গেল, আপনি বলেছিলেন আপনি অবিবাহিত, কারণ আপনার হবু স্ত্রী বিয়ের আগেই মারা যান। হয়তো তারপর আপনার আর বিবাহের প্রবৃত্তি হয়নি। রিক্তা পানিগ্রাহিকে আপনি বড় ভালবাসতেন, তাই না?”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন অতীশবাবু, মুখ চোখে লাল আভা। মুহূর্তে দরজা থেকে ছুটে এসেছে কনস্টেবল দু জন। শান্ত করে বসিয়েছে অতীশ বাবু কে। তবে এবার শুধু তিনিই অবাক হননি, হয়েছেন আরও এক জন। তাঁর দিকে আলতো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে আরশি বলল, “খবর নিয়ে জানতে পারি, মেয়েটির নাম রিক্তা, তেইশ বছর বয়সেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। রিক্তা ভালবাসতেন অজয়বাবুকে। কিন্তু অজয়বাবু কি ভালবাসতেন? মেয়েটির মায়ের সাথে আজ সকালেই কথা হয় আমার, আর তার পরেই যেটা খুঁজছিলাম, সেটা পেয়ে যাই…’মোটিভ’। প্রতিহিংসা। একরকম প্রায় ধরেই নিয়েছিলাম অতীশবাবুই…কিন্তু এবার যে একটা অন্য খটকা।”
সবার উদগ্রীব চোখে চোখ বুলিয়ে আরশি বলল, “সৌরভবাবু, আপনি যখন সেদিন অজয়বাবুকে প্রায় মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলেন, উনি আপনাকে ঠিক কি বলেছিলেন, মনে করে আমাদের সবাইকে বলতে পারেন একটিবার?”
“পানি… পানি, দুবার, ব্যাস ওইটুকুই,” বললেন সৌরভবাবু।
“পানি… পানি বলতে জল, আবার পানি হতে পারে পানিগ্রাহি। রিক্তা পানিগ্রাহি। তাহলে কি অজয়বাবু মরে যাওয়ার আগে চেয়েছিলেন অন্তত একজন সত্যিটা জানুক? অতীশবাবুর প্রতিহিংসার কথাই কি তিনি বলে যেতে চেয়েছিলেন? কিন্তু তার নিজের ‘ক্যামেরা’বন্দী ‘ভিডিও’ যে অন্য কথা বলে। ‘ভিডিও’টা মনের মধ্যে বারবার ভাবতে ভাবতে কি হল বলুন তো? ‘ইউরেকা’! ‘ভিডিও’তে কথা বলার সময় অজয়বাবুর চোখেমুখে কেমন যেন ভয়ের ভাব। দুবার দরজার দিকে তাকালেন। ততক্ষণে আমি যেন পুরো ‘ভিডিও’টাই আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আত্মহত্যার আগে যে মানুষ ভয় পেতে পারে না এমন তো নয়। আবার এও হতে পারে, যে কেউ তাকে ভয় দেখিয়ে জোর করে এই জবানবন্দী দিতে রাজি করিয়েছে। অতীশবাবুই কি? সেই জন্যই কি চোখে মুখে ভয় নিয়ে দরজার দিকে দু বার তাকালেন অজয়বাবু? কিন্তু অতীশবাবু তো প্রায় ছ’ফিটের কাছাকাছি। ‘ভিডিও’ থেকে এটুকু স্পষ্ট যার দিকে অজয়বাবু তাকালেন তার উচ্চতা মেরেকেটে পাঁচ এক কি দুই। এর পরেই বাকি সবটা আমার কাছে কেমন পরিষ্কার হয়ে গেল। অজয়বাবুর ‘পানি’, ভয়ার্ত দৃষ্টি…সবটা। বাকিটা কি আপনি আমাদের গুছিয়ে বলবেন, মিসেস নিত্যা মিত্র পানিগ্রাহি?”
মিসেস মিত্র মুখ ঢেকেছিলেন দু হাতে। হাত সরিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, “আমি যা করেছি বেশ করেছি। অজয়ের মতো একটা লম্পট দুশ্চরিত্রের বেঁচে থাকার কোন অধিকারই নেই। রিক্তা ওকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসত। হোস্টেলে আমার সাথে থাকতে এসেই ওদের সাথে পরিচয় হয়। কিন্তু ভালবাসার বদলে কি পেয়েছে ও? প্রতারণা। বোনটা আমার মেনে নিতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেল। সেদিনই আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, অজয়কে আমি ছাড়ব না-”
নিত্যার মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে আরশি ফের বলল, “আর তাই আপনি ‘মাইগ্রেনের’ অজুহাতে ঘর থেকে বিষ আনলেন লুকিয়ে, মদের গ্লাসে মেশালেন সেই বিষ। বিকেলে সবাই চলে যাওয়ার পর ফোন খোঁজার অজুহাতে অজয়বাবুর ঘরে এসে ওঁকে দিয়ে জোর করে ‘ভিডিও’ বানিয়ে ‘ক্যামেরা’ আলমারিতে লুকিয়ে রাখলেন। পরে অতীশবাবু গিয়ে আবার সেই ‘ক্যামেরা’ যথাস্থানে বিছানার সামনে রেখে দিলেন। আপনি তো পুরোটাই জানতেন অতীশবাবু। সেদিন দুপুরে ঘর থেকে বেরিয়ে আপনি আর মিস্টার ত্রিবেদী গেলেন ধূমপান করতে। মিস্টার ত্রিবেদী ফিরে এলেন, আপনি এলেন না। সেদিন আপনি মিসেস মিত্রকেই ফোন করছিলেন, তাই তো?”
উপায়ন্তর না দেখে ঘাড় নাড়লেন অতীশ বাসু, তারপর মাথা তুলে বললেন, “কিন্তু এটা ওর প্রাপ্য ছিল। ওর জন্যই আমরা রিক্তাকে হারিয়েছিলাম।”
“কিন্তু প্রতিহিংসা কি কখনও সমাধান হতে পারে, মিস্টার বাসু?”
দরজা খুলে মহিলা কনস্টেবলদের ঢুকে আসতে দেখে সবার থেকে বিদায় চেয়ে বেরিয়ে এল আরশি, তার কাজ এই অবধিইই। সাথে এলেন ইনস্পেক্টর বেহেরা। আরশিকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, “আপনার বুদ্ধির তারিফ করতেই হল। আমি হলে তো সুইসাইড বলেই ভেবে নিতাম।”
গম্ভীর একরোখা বেহেরার খ্যাঁকখ্যাঁকে হাসি শুনে আরশিও হেসে ফেলেছে, “তবে সেটাই ভেবে নিন না।”
“মানে?”
“মানে,” ইনস্পেক্টরের চোখে চোখ রেখে বলল আরশি, “হতেও তো পারে অজয়বাবু সুইসাইডই করেছেন। অজয়বাবু তো ফিরে আসবেন না। কিন্তু বাকি দুজন…যারা জীবিত, আপনি চাইলে তারা আরও একটা সুযোগ পেতে পারে। নিজেদের শুধরে নিতে পারে…”
“কিন্তু…”
“ভেবে দেখুন। আমি আজ আসি, ইনস্পেক্টর বেহেরা।”
* * *
ভুবনেশ্বর থেকে কলকাতাগামী ফ্লাইটের অপেক্ষায় ‘এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে’ আরশি। এক হাতে কফির কাপ, অন্য হাতে খবরের কাগজ। সামনে ‘ক্লোজড সার্কিট স্ক্রিনে’ ফ্লাইটের তালিকায় ঝটিতি চোখ বুলিয়েই ফিরে এসেছে খবরের কাগজে। তিনের পাতায় নীচের দিকে আয়তাকার খোপে আটকে গেছে দৃষ্টি। লেক গার্ডেনসে প্রয়াত ষাটোর্ধ দম্পতি। ইনস্পেক্টর নিবারুন দাসগুপ্তের মতে…”
পুরোটা পড়া হল না, পকেটে ফোন বাজছে। ফোনের ফুটে ওঠা নাম দেখে ঠোঁটে হাসি ছুঁয়ে গেল আরশির। ফোন ধরে বলল, “আপনি অনেক দিন বাঁচবেন, বুঝলেন নিবারুন দা? এইমাত্র আপনার নাম দেখলাম খবরের কাগজে।”
“যাক, খবরটা ইতিমধ্যেই চোখে পড়েছে তাহলে। তুমি আছ কোথায়?” উল্টোদিক দিক থেকে ভেসে এল।
“‘এয়ারপোর্টে’… ফিরছি কলকাতায়।”
“বেশ, বাড়ি ফেরার পথে একবার ঢুঁ মেরে যেও। কাজ আছে তোমার জন্য।”
হেসে উঠল আরশি, “যথা আজ্ঞা…”
সমাপ্ত