কিছুদিন হল রাতে ভালো ঘুম হচ্ছে না অন্দ্রীলের। প্রায় সারারাত জেগে থাকতে হয়। শেষ রাতের দিকে একটা ঝিমুনির মত আসে, তখন ঘুমাতে যায়। সকালে ঘুম ভাঙে দেরি করে। আজকেও ঘুম ভাঙলো দশটার কিছু পরে। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখে টেবিলে চা ঢাকা দেওয়া। চায়ের দোকানের পিচ্চিটা রেখে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। অন্দ্রীল ঘুমের মধ্যেও শুধু ওর পায়ের আওয়াজটা শুনেছিল। পরিচিত মানুষকে চেনার জন্য ওটুকুই ওর কাছে যথেষ্ট।
চা টা এক চুমুকে শেষ করে ফোনটা হাতে নিতেই চমকে উঠল অন্দ্রীল। সাতটা মিসড্ কল! ফয়সাল অনেকক্ষণ আগে থেকে কল দিচ্ছে, প্রথম কলটা প্রায় দেড় ঘন্টা আগে। তারপর থেকে একটু পরপরই ফোন দিচ্ছে। কালকে রাতে ফোনে একটা ব্লগ পড়ছিল অন্দ্রীল, তারপর ঘুমানোর আগে ফোনটা সাইলেন্ট মোডে রেখে ঘুমিয়েছিল। একটু শান্তিতে ঘুমানো দরকার ছিল। তাই ফয়সালের কলের একটাও যে সে শুনতে পাবে না, এটাই স্বাভাবিক।
তড়িঘড়ি করে ফয়সালকে ফোন দিল। ছেলেটা বোধহয় ফোনটা হাতে নিয়েই অপেক্ষা করছিল। একবার রিং হওয়ার পরেই ধরে ফেলল।
“স্যার, আপনি কোথায়?”
“আর বোলো না, ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেছে। ফোনটা সাইলেন্ট ছিল, শুনতে পাইনি।”
“ওহ্। স্যার, আপনি যত দ্রুত পারেন রেডি হয়ে উত্তরায় চলে আসুন। গাড়ি অনেকক্ষণ আগে থেকে আপনার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছে।”
“কী হয়েছে ফয়সাল?”
“খুন!”
ডিবি স্পেশাল ইউনিটের সিনিয়র অফিসার অন্দ্রীল রায় যতক্ষণে স্পটে পৌঁছলেন ততক্ষণে লাশের চারদিকে একটা জটলা বেঁধে গেছে। লাশটা পড়ে আছে একটা বড় অ্যাপার্টমেন্টের সামনে একটা খোলা জায়গায়। পুলিশের লোকজন হলুদ ফিতে দিয়ে ক্রাইম সিন ঘিরে রেখেছে, ফিতের বাইরে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মিডিয়া বোধহয় এখনও খবর পায়নি। আশপাশে “লাইভ টেলিকাস্ট”এর কোনও ক্যামেরা দেখা যাচ্ছে না। ওরা আসতে শুরু করলে এই ভিড় জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকবে।
অন্দ্রীল ভিড় ঠেলে লাশের কাছে এগিয়ে গেল। মৃত লোকটার দিকে তাকালে যে জিনিসটা সবার আগে চোখে পড়ে সেটা হল তার মুখমণ্ডল। একদম থেঁতলে গেছে। লোকটার চেহারা দেখে শনাক্ত করার মতো অবস্হা নেই। কান দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে, সেটা গড়িয়ে রাস্তার পিচের সাথে মিশেছে। মাথার পেছন দিকে আঘাত করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এছাড়া আর কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। অন্দ্রীলের মনে হল এই ভিক্টিমের পরিচয় বের করতেই অনেকটা সময় চলে যাবে। চেহারা দেখে শনাক্ত করা কষ্ট, শনাক্ত করার জন্য বেশ জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আর তার চেয়ে বড় কথা বেওয়ারিশ লাশের তদন্তে ডিপার্টমেন্টও খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। কিন্তু সে এটা কিছুতেই মানতে পারে না। ভিক্টিমের পরিচয় না জানা গেলে কি সেই অপরাধীর অপরাধ তুচ্ছ হয়ে যায়! এভাবে চলতে থাকলে তো যে কেউ মার্ডার করে ভিক্টিমের মুখটা শুধু থেঁতলে দেবে। ব্যাস, আর কোনও বিচার নেই!
ফয়সাল ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের অফিসারদের সাথে কথা বলছিল। অন্দ্রীলকে দেখে এগিয়ে এল। অন্দ্রীল লাশের দিক থেকে চোখ না তুলেই বলল, “লাশ কি বেওয়ারিশ?”
“না”
“বলো কি! এই লাশ শনাক্ত হয়ে গেছে! তাও আবার এই সময়ের মধ্যে!”
“জ্বি স্যার, বিশ্বাস করাটা কষ্ট কিন্তু এটা সত্যি। ভিক্টিমের বাড়ির লোক ওঁকে শনাক্ত করছেন।”
অন্দ্রীল মনযোগ দিয়ে ফয়সালের কথা শোনে আর ওর ফোন বের করে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে লাশের কয়েকটা ছবি তুলে নেয়৷ দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় সে জানে এগুলো পরে কতটা কাজে আসে। এই ভিড়, চেঁচামেচির মাঝখানে মাথা ঠিকভাবে কাজ করে না। একবার দেখায় সবকিছু চোখেও পড়ে না। পরে যখন শান্তভাবে দেখা যাবে তখন কত সূক্ষ্ম জিনিসও চোখে পড়ে যাবে। ‘সূক্ষ্ম অথচ দেখা যাবে’ সেই সূত্র ধরে খুনিকে খুঁজে বের করা যাবে।
ফয়সাল ডিটেইলস বলতে থাকে, “ভিক্টিমের নাম রাহাত। বিখ্যাত ব্যবসায়ী নাদিম কায়সারের শ্যালক। এই অ্যপার্টমেন্টটা নাদিম কায়সারেরই। তবে আরও অনেকে থাকে এখানে।
লাশটা প্রথমে দেখতে পায় অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান। উপুড় হয়ে অ্যাপার্টমেন্টের সামনের এই খোলা জায়গাটায় পড়ে ছিল। তারপর সে চেঁচামেচি করে সব লোকজনকে জড়ো করে।”
“শনাক্ত হল কীভাবে, সেটা বলো আগে।”“
“বিল্ডিংয়ের সব লোকজন যখন জড়ো হয়, তখন তাদের মধ্যে একজন একটা চিঠি দেখতে পায়।” বলে পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে অন্দ্রীলের দিকে এগিয়ে দেয় ফয়সাল। অন্দ্রীল তার মোবাইল ফোনটা পকেটে পুরে হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নেয়।
একটা দু’লাইনের খুবই সংক্ষিপ্ত চিঠি। একটা কাগজের ঠিক উপরের দিকে লেখা
“কৃতকর্মের ফল ভোগ করতেই হবে। দুনিয়ার বাইরে যা হবে তা আমি দেখতে পাব না, তাই দুনিয়াতেই শাস্তির ব্যবস্হা করলাম।
বিদায়
পুনশ্চ:
প্রিয়
নাদিম কায়সার,
তোমার শ্যালকের দাফন করো।”
চিঠিটার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো অন্দ্রীল। একেকটা অক্ষর যেন ওর মুখস্থ হওয়া চাই। তারপর চিঠিটা ফয়সালকে ফিরিয়ে দিয়ে আনমনে বলে চলল, “চিঠির প্রেরক কোনও পুরুষ। লেখার জন্য খুব বেশি সময় পায়নি। হয়তো কথাগুলো আগে থেকেই মনে মনে সাজিয়ে নিয়েছিল, তাই কথাগুলো গোছানো। কিন্তু লিখেছে খুব দ্রুত। একটা অস্হিরতা কাজ করছিল লেখার সময়। তবে চিঠি প্রেরকের বুদ্ধি বেশ ভালো।”
ফয়সাল এসবের সাথে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে। সে যারপরনাই চেষ্টা করে তার বিস্ময় প্রকাশ না করতে। কিন্তু অন্দ্রীল যখন শার্লক হোমসের মত কোন জিনিস এক নজর দেখেই এই এক গাদা তথ্য দিয়ে দেয়, তখন বিস্মিত না হয়েও উপায় থাকে না। এই যেমন এখন। একটা চিঠি দেখে এতো কিছু বলে দিল! পুরুষের হাত তুলনামূলক শক্ত হয়, সেটা না হয় লেখা দেখে বোঝা গেল যে শক্ত কোনও হাতের লেখা। কিন্তু তার মানসিক অবস্হা বোঝার উপায় কি? হাতের লেখা দেখেই কীভাবে বলে দিল যে চিঠির লেখক অস্হির ছিল! বা তার বুদ্ধির পরিচয়ই বা পেল কোথা থেকে!
অন্দ্রীল সম্ভবত ফয়সালের মনের কথা পড়ে ফেলেছিল। একটা স্বভাবসিদ্ধ মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “আরে! এই সামান্য জিনিসটা বুঝলে না! ভালো করে লক্ষ্য করো, চিঠির অক্ষরগুলো সম্পূর্ণ নয়। মানে একটু লাগা লাগা, চাপাচাপি করে কাগজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যেন। এটা তখনই হবে যখন তুমি খুবই তাড়াহুড়োর মধ্যে থাকবে।আর যতটা তাড়াহুড়োতে সে লিখেছে, সেই টুকু সময়ে এতটা সুন্দর করে গুছিয়ে কথাগুলো লেখা রবীন্দ্রনাথেরও অসাধ্য। তাতেই বোঝা যায় কথাগুলো আগে থেকে ভেবে রাখা।”
ফয়সাল আরও একবার মুগ্ধ হয় প্রতিবারের মতই। প্রায় চার বছর ধরে অন্দ্রীলের সাথে আছে ফয়সাল। একসাথে প্রায় সাত আটটা কেস সলভ করেছে তারা। এই সময়ের মধ্যেই যেন অন্দ্রীলে বুঁদ হয়ে গেছে ফয়সাল। সে জানে যে কেস অন্দ্রীলের হাতে পড়ে, তা সলভ হবেই।
“শনাক্তটা তাহলে শেষমেশ কে করল? নাদিম কায়সার নিজেই?” অন্দ্রীল অন্যমনস্কভাবে বলল।
“না, ওঁর স্ত্রী। রাহাত দুইদিন হল নিখোঁজ ছিল। কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছল না। দুইদিন আগে যখন সে বাড়ি থেকে বের হয় তখন তার পরনে যে শার্ট প্যান্ট ছিল সেটা আর লাশের পড়নে যে শার্ট প্যান্ট আছে সেটা একই। লাশের পকেটে যে মানিব্যাগ পাওয়া গেছে সেটাও রাহাতেরই, মানিব্যাগে রাহাতের বোন মানে মিসেস কায়সারের একটা ছবি পাওয়া গেছে।”
“হুম, দারোয়ান কই গেল? ওকে ডেকে আনো, আগে ওর সাথে কথা বলা দরকার।”
ফয়সাল দারোয়ানকে ডেকে আনতে চলে গেল। অন্দ্রীল এগিয়ে গিয়ে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের কাজ দেখতে লাগল। ফরেনসিক টিমে মিস্টার হায়দারকে দেখে ও একটু স্বস্তি পেল, লোকটি খুব কাজের মানুষ। অন্দ্রীলের সিনিয়র, বয়সেও অনেকটা বড়। পাঁচ -ছয় বছরের মধ্যেই রিটায়ার্ড করবেন হয়তো।
“তেমন কিছু পেলেন?”
অন্দ্রীলের প্রশ্নটা শুনে বিরক্ত চোখে তাকালেন মিস্টার হায়দার। কাজের সময় উনি কারোর সঙ্গে কথা বলা পছন্দ করেন না। কিন্তু প্রশ্নকর্তাকে দেখে ওঁর সব বিরক্তি উবে গেল। অন্দ্রীলকে সে বেশ পছন্দ করে। ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে ব্রাইট আর ইন্টেলেকচুয়াল অফিসার।
“আপনি ইনভেস্টিগেশন করছেন?”
বয়সের বিশাল ফারাক থাক সত্ত্বেও মিস্টার হায়দার অন্দ্রীলকে আপনি বলেই সম্বোধন করেন। ওঁর হিসেবে এখন তিনি ডিবির একজন সিনিয়র অফিসারের সাথে কথা বলছেন। সে যতই বয়সে ছোট হোক, সে তার পদমর্যাদার জন্য সম্মান ডিজার্ভ করে। তুমি করে বললে সে জায়গাটায় কেমন যেন একটু ফাঁক থেকে যায়। হায়দারের এই মতবাদ অন্দ্রীলও জানে, তাই প্রথম প্রথম সে প্রতিবাদ করলেও এখন আর করে না। প্রতিবাদ শুনে নিজের সিদ্ধান্ত বদল করার মানুষ মিস্টার হায়দার নন।
“হ্যাঁ, আমার ঘাড়েই তো পড়ল। হা হা হা।”
“তাইলে তো কেস সলভড্ই ধরা যায়।”
অন্দ্রীল মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “কেবল এলাম। দেখা যাক কতদূর কী করতে পারি। আপনি কি তেমন কোনও ক্লু পেলেন? “
“না, তেমন কিছু পাইনি। এই ফিঙ্গার প্রিন্ট-মিন্ট এইসব সিম্পল জিনিস। মার্ডারের ওয়েপন হিসেবে কিছু পেয়েছেন?”
“না, তেমন কিছু পাইনি। কী ধরণের ওয়েপন হতে পারে?”
“খুব ভারী ভোঁতা ধরনের কিছু দিয়ে আঘাত করলে এরকম হতে পারে। কিন্তু আঘাতটা অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়ানো। এরকম কোনও জিনিসের কথা তো মনে করতে পারছি না। আপনার একটু লোক লাগিয়ে আশেপাশে ভালো করে খোঁজেন তো ওয়েপনটা পাওয়া যায় কিনা।”
“হুম, আমি লোক পাঠিয়েছি। ওটা আমার কাছেও ইমপরটেন্ট মনে হচ্ছে। দেখা যাক পায় কিনা। আপনি একটু কষ্ট করে সবার ফিঙ্গার প্রিন্টগুলো নিয়ে নিবেন।”
“অবশ্যই।”
হায়দার সাহেব কাজে মনোযোগ দিলেন। অন্দ্রীল আবার অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে ফিরে এল। ফয়সাল দারোয়ানকে সাথে নিয়ে দাঁড়িয়ে অন্দ্রীলের জন্যই অপেক্ষা করছে।
পাশেই একটা চেয়ার রাখা ছিল। অন্দ্রীল সেখানে বসে দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল।
“আপনার নাম যেন কি?”
“জ্বে, আমার নাম কুদরত আলী।”
“কুদরত, তুমি যা দেখেছ, তা খুলে বলো। কোনও কিছু বাদ রাখবে না। ছোটোখাটো কোনও বিষয়ও বাদ রাখবে না। অনেক সময় সাধারণ চোখে যা ছোট্ট একটা বিষয় বলে মনে হয়, পরে সেটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।”
কুদরত কেমন যেন একটু ভয়ের মত পাচ্ছে। এই শ্রেণির মানুষেরা পুলিশ দেখলে ঘাবড়ে যায়। পুলিশকে ভয় পায়। তাদের ধারণা পুলিশের সামনে পড়লেই তাদের কোনও না কোনও ক্ষতি হবেই। এজন্য তারা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে চায় পুলিশ আর পুলিশি ঝামেলা থেকে। এই যে এখন কুদরতকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময়ই সে ভয়ে একদম চুপসে যাচ্ছে। সে হয়তো ভাবছে পুলিশ তাকে ধরে হাজতে পুরবে।
অন্দ্রীল কুদরতের বিষয়টা বুঝতে পেরে ওকে আশ্বস্ত করল, “তোমার কোনও ভয় নেই। তুমি যা যা দেখেছ সেটা স্পষ্টভাবে আমাদের কাছে বলো, তাহলেই তুমি মুক্ত। তুমি তো আর খুন করনি, তাই না? নাকি করেছ?”
“না না সাব, কী কন আপনে! আমি খুন করুম ক্যান ওঁরে!”
“হ্যাঁ, তাহলে তোমার কোনও ভয় নেই। যা দেখেছ সেটা বলো।”
কুদরত ভয় দূরে ঠেলে আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করে। অন্দ্রীল মনযোগ দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে৷ মানুষ সত্যি বলছে না মিথ্যা সেটা অনেকটা তার মুখ দেখে বোঝা যায়, অন্দ্রীল সেটাই খেয়াল করার চেষ্টা করছে। ফয়সাল টেপ রেকর্ডার চালু করে জবানবন্দি রেকর্ড করছে। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পরে অনেকসময় অনেকের জবানবন্দি বা অ্যালিবাই শোনার প্রয়োজন পড়ে। তখন আবার জিজ্ঞাসাবাদ না করে টেপ রেকর্ডারটা চালিয়ে দিলেই হয়।
মিনিট দশেক পরে কুদরতের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়। ওর কাছে তেমন নতুন কিছু জানা গেল না। এর আগে ফয়সাল আসার পরে ওকে যা বলেছে সেটাই আরেকবার বলল।
প্রতিদিন ভোরে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যায় কুদরত। তখনই অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খোলা হয়। এর আগে কেউ বাইরে যায় না। অ্যাপার্টমেন্টের সবাই মোটামুটি অবস্হা সম্পন্ন। সবাই প্রায় দেরি করেই ঘুম থেকে উঠে। আজকেও প্রতিদিনের মতই ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে নামাজ পড়তে যাওয়ার জন্য গেট খুলে বের হতে গিয়েই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে কুদরত। একটা রক্তাক্ত, বীভৎস লাশ পড়ে ছিল অ্যাপর্টমেন্টের সামনে। রক্তও ছিটিয়ে আছে একটু চারিদিকে। এসব দেখেই কুদরত বিকট এক চিৎকার দেয়। তার চিৎকার শুনে পাশের অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান হাফিজ ছুটে আসে। তারপর সেই অ্যাপার্টমেন্টের বাকিদের জড়ো করে। চিঠিটাও প্রথমে দেখতে পায় হাফিজ। নাদিম কায়সার নিচে নামেন একটু পরে, মিসেস কায়সার ততক্ষণে লাশটা শনাক্ত করে ফেলেন।
কুদরত যখন লাশটা দেখতে পায় তখন আশেপাশে আর কাউকে দেখেনি। শুধু নাসের সাহেবকে দেখেছিল, উনি প্রতিদিনই নামাজ পড়ার জন্য বের হোন। লাশটা দেখে ওঁরও আজ আর নামাজে যাওয়া হয়নি।
দারোয়ানের সাথে কথা বলে উঠে দাঁড়ায় অন্দ্রীল৷ ফয়সাল টেপ রেকর্ডার বন্ধ করে অন্দ্রীলের পাশে এসে দাঁড়ায়।
“ফয়সাল, নাদিম কায়সারের ফ্ল্যাটটা কোন ফ্লোরে? ওঁদের সাথে এখনই কথা বলা দরকার।”
“সিক্সথ ফ্লোর স্যার।”
অন্দ্রীল দ্রুততার সাথে লিফটের দিকে পা বাড়ায়। তার পিছু নেয় ফয়সাল।
নাদিম কায়সারের বাসার লোকজনের সাথে অবশ্য তখন কথা বলা আর হয় না। মিসেস কায়সার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাসার কাজের লোক দু’দিন হল ছুটিতে। দেখাশোনা করার মত আর কেউ বাসায় নেই। বাধ্য হয়ে নাদিম কায়সারকেই তার স্ত্রীর দেখভাল করতে হচ্ছে। উনি অসুস্থ স্ত্রীকে ফেলে আপাতত জবানবন্দি দিতে পারবেন না। উনি পরের দিন সকালে আসতে অনুরোধ করলেন। অন্দ্রীল কিছুটা নারাজ হলেও বিষয়টা মেনে নিতে হল তাকে। মানুষ যখন অসুস্হতার কথা বলে তার অপারগতা প্রকাশ করে তখন আসলে আর বলার কিছু থাকে না। শত আপত্তি সত্ত্বেও মেনে নিতে হয়। অন্দ্রীলও তাই করল। তারপর কিছুটা হতাশা নিয়ে আবার ফিরে এল নিচ তলায়।
লাশ এখনও নিয়ে যাওয়া হয়নি। ফরেনসিক টিম এখনও কী যেন সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছে। লাশটা সাদার রঙের কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। কিছু মাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে আশপাশে। কেউ সেদিকে পাত্তা দিচ্ছে না। এখন মানুষ জীবিত মানুষকেই পাত্তা দেয় না, আর এ তো মৃত লাশ!
অন্দ্রীল কুদরতকে সাথে নিয়ে পাশের অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান হাফিজের সাথে দেখা করতে গেল। সেও কুদরতের মত একই সুরে গান গাইল। কুদরত যা দেখছে সেও তাই দেখেছে। আলাদা করে ওর জবানবন্দি নিয়ে কোনও লাভই হল না। হতাশ হয়ে আবার স্পটে ফিরে এল অন্দ্রীল। ফিরে এসে দেখে নিচতলার লিফটের কাছে কিসের যেন একটা শোরগোল হচ্ছে। একজন লোক বেশ উদ্ধত স্বরে কী যেন সব বলছেন। ফয়সাল ওঁকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু ওঁর আচরণ আরও উদ্ধত হয়ে উঠছে। অন্দ্রীল দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেল।
“আপনার কী শুরু করেছেন বলুন তো! কে না কে মরেছে তার জন্য আমরা সারাদিন বসে থাকব? আমাদের কি কোনও কাজকর্ম নেই?”
ফয়সাল কী যেন বলতে যাচ্ছিল, অন্দ্রীল ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজে বলল, “আপনি পালাতে চাইছেন কেন?”
“পালাতে চাইছি মানে! আমি কী চোর না ডাকাত যে পালাতে যাব! আজব!”
“চোর ডাকাত হলে তেমন একটা সমস্যা নেই৷ কিন্তু খুনি হলে যে সমস্যা!”
“তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আমি খুনি! আপনার এত বড় সাহস আপনি আমাকে খুনি বলেন!”
“আমি কাউকেই কিছু বলছি না। কিন্তু এখনও তো কেউ সন্দেহের বাইরে না। তাই আপাতত কাউকেই বাইরে যেতে দিতে পারছি না।”
“দেখুন, ওসব জোচ্চর, খুনিকে খুন করার আমার কোনও ইচ্ছে নেই। আমাকে যেতে দিন, আমার অফিসে অনেক কাজ আছে।”
“খুনি মানে! কে খুনি? কার কথা বলছেন?”“
“সে কী! ভিক্টিম সম্পর্কে কিছু না জেনেই তদন্ত করছেন নাকি!”“কথাটা বলেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন ভদ্রলোক। হাসির মধ্যে উপহাসের ছাপ স্পষ্ট।
“আমরা তো মাত্র দু’ঘন্টা হল এ বাড়িতে এসেছি। উনি মার্ডার ভিক্টিম হওয়ার পরে। আর আপনি তো এ বাড়িতে আছেন তার আগে থেকেই, ওঁকে চেনেনও আগে থেকে। এটুকু সময়ে ওঁর সম্পর্কে আপনার মত জানা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব?”
ফয়সাল একটু তফাতে দাঁড়িয়ে তখন দর্শকের ভূমিকা নিয়েছে। অন্দ্রীল তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। এই ভদ্রলোক মনে হচ্ছে ভিক্টিম সম্পর্কে কিছু জানেন। এঁকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বাগে আনার চেষ্টা করছে, তারপর আস্তে আস্তে সব কথা বের করবে। অন্দ্রীলের এসব কাজ দেখতে খুব ভালো লাগে ফয়সালের। কী দক্ষতার সাথে মুহূর্তে মানুষের পেট থেকে কথা বের করে ফেলে! ফয়সাল নিজেও দুই একবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ঠিক অন্দ্রীলের মত পারেনি৷ সে এই কাজে একদম মাস্টার লেভেলের প্লেয়ার।
“আরে যে খুন হয়েছে সে নিজেও তো ছিল মহা জোচ্চর। আগে থাকত গ্রামে। সেখানে কী যেন এক ঝামেলা করে পালিয়ে এখানে এসে এখানে দুলাভাইয়ের কাছে উঠেছিল। দুলাভাইয়েরও ক্ষমতা আছে, টাকা আছে। সেসব দিয়ে শালাকে বাচিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এসব দিয়ে আর কতদিন বাচানো যায় বলেন! দেখুন উপরওয়ালা ঠিকই বিচার করে দিয়েছেন।”
“গ্রামে যে সে ঝামেলা পাকিয়ে এসেছে তা বুঝলেন কী করে? নাদিম সাহেব বলেছিলেন?”
“আরে না, সে কি তার পরিবারের মানুষের দোষের কথা নিজে মুখে বলবে নাকি! একবার গ্রামের কিছু ছেলেপেলে এসে রাহাতের খোঁজ করছিল। নাদিম সাহেব বলেছিলেন সে এখানে নেই। তারপর সেই ছেলেপেলেরা হৈ চৈ চেঁচামেচি শুরু করে। নাদিম সাহেবকেও নাকি মারতে গিয়েছিল ওরা। এই ঘটনার পরই লোকের মুখে শুনলাম রাহাত নাকি গ্রামে কাকে যেন মার্ডার করেছে। এখন তাদের লোকই ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আজকে হয়তো সুযোগ পেয়েছিল, মেরে ফেলে দিয়ে গেছে।”“
“এই ঘটনা কতদিন আগের?”
“এই তো প্রায় ধরেন মাস দু’য়েক হবে।”
“ছেলেপেলে যারা এসেছিল তাদের কাউকে আপনি দেখেছেন?”
“না, আমি তখন অফিসের একটা কাজে চট্রগ্রামে গিয়েছিলাম। বাসায় এসে ঘটনা শুনলাম। আর তাছাড়া যারা এখানে ছিল তারাও ওসব ছেলেপেলেদের চেহারা দেখেনি।”
“মানে? চেহারা দেখেনি কেন?”
“ওরা সবাই কালো মুখোশ পরে এসেছিল।”“
ভদ্রলোকের সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলল অন্দ্রীল। লোকটি এর চেয়ে বেশি আর কিছু জানে না। অন্দ্রীল এরপর বুঝিয়ে সুঝিয়ে লোকটিকে ঠান্ডা করল। এখন একজনকে বাইরে যেতে দেওয়া মানে সবাই যেতে চাইবে। সেটা অনেক বেশি রিস্কি হয়ে যাবে। ভদ্রলোকও পরে আর তেমন চেঁচামেচি করলেন না। অন্দ্রীলের সাথে হ্যাণ্ডশেক করে উপরে উঠে গেলেন।
অন্দ্রীল স্পটে আর বেশিক্ষণ থাকল না। ফয়সালকে কিছু ছোটোখাটো কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেল একটু পরেই। ফয়সাল নাসের সাহেবকে খুঁজতে গেল জবানবন্দির জন্য। অন্দ্রীল কাজটা করতে বলে গেছে। ফয়সাল গিয়ে দেখে নিচে যে এতোক্ষণ কথা বলল সেই নাসের সাহেব। ফয়সালকে দেখে এবার আর রাগারাগি করলেন না। বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতে ভেতরে ডেকে বসালেন। উনি কাউকে দেখেছেন কিনা জানতে চাইলে বললেন দারোয়ান কুদরত আর পাশের অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান হাফিজ ছাড়া আর কাউকে উনি দেখেননি। ফয়সাল বিদায় জানিয়ে নিচে নেমে এল। ফোন করে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের জন্য তাড়া দিল। থানায় ফোন করে রাহাতের ক্রিমিনাল রিপোর্ট বের করতে বলল। তারপর আরও দু’ই একটা রুটিন ওয়ার্ক করে সেও বাড়িতে ফিরে গেল।
পরদিন সকালে ফয়সাল নাদিম কায়সারের অ্যাপার্টমেন্টে পৌছে দেখল অন্দ্রীল আগেই সেখানে পৌঁছে গেছে, নিচতলায় দাঁড়িয়ে তার জন্যই অপেক্ষা করছে। ওর টেপ রেকর্ডারটা না হলে জবানবন্দি নেওয়া শুরু করতে পারছে না। ফয়সাল আগের দিনের সব কাজের আপডেট জানিয়ে দিল। ক্রাইম রিপোর্ট বের করে রাখা হয়েছে, থানায় গেলেই পাওয়া যাবে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টও একদিনের মধ্যেই পাওয়ার কথা। মনে করে নাসের সাহেবের বিষয়টাও জানিয়ে দিল অন্দ্রীলকে।
সবটা শুনে অন্দ্রীল অন্যমনস্কভাবে বলল, “গুড। চলো নাদিম সাহেবের ফ্ল্যাটে যাই।”
“চলুন।”
নাদিম কায়সারের বাসার দরজায় টোকা দিতেই একটা ছেলে এসে দরজা খুলে দিয়ে বসতে বলল। গতকাল এই ছেলেকে দেখেনি। আর দশটা সাধারণ যুবকের মত সাধারণ, বৈশিষ্ট্যহীন চেহারা।
অন্দ্রীলদের বসতে দেওয়া হয়েছে যে ড্রইংরুমে সেটা মোটামুটি বড়। দেয়ালে বেশ কয়েকটা পেইন্টিং, দেখেই বোঝা যায় বেশ দামি। একপাশে একটা বড় বইয়ের আলমারি। আলমারি ভর্তি বই। এটা এখনকার বড়লোকদের একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। বই পড়ুক আর না পড়ুক। দামি দামি বই কিনে একটা আলমারি ভর্তি করে রেখে দেয় ড্রইংরুমে।
ঢোকার সময় যে ছেলেটা দরজা খুলে দিয়েছিল সেই ছেলেটাই একটু পরে দু’কাপ চা, বিস্কুট নিয়ে এল। নাস্তাটা টেবিলে রেখে বলল, “স্যার, আসছেন। ওঁর একটা জরুরি ফোন এসেছে সেটা শেষ করেই উনি চলে আসবেন।”
“তোমার কি শুধু হাতেই ট্যাটু না বডিতেও আছে? “অন্দ্রীলের আচমকা করা প্রশ্নটা শুনে একটু চমকে গেল ছেলেটা। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে জামার আস্তিন টেনে ট্যাটুটা ঢাকতে ঢাকতে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, ঐ একটাই। খুব শখ করে করিয়েছিলাম।”
কথাগুলো বলেই সাথে সাথে ছেলেটা চলে যায়। অন্দ্রীল ঠোঁটও সাথে সাথে চোখা হয়ে যায়। ও কোনও এক ভাবনায় ডুব দিয়েছে। ও যখন কোনও কিছু নিয়ে গভীর চিন্তা করে তখন ওর ঠোঁট দু’টো কেমন যেন পাকিয়ে গোল বা চোখা মত করে ফেলে।
নাদিম কায়সার রুমে এলেন ছেলেটা চলে যাওয়ার ঠিক মিনিট দশেক পরে। বেশ লম্বা চওড়া গড়নের মানুষ, মোটা একটা গোঁফ আছে। চোখ দু’টো সাধারণ, নাকটা একটু থ্যাবড়ানো। মুখে একটা পাইপ। গায়ে এখনও স্লিপিং গাউন। চোখে মুখে চিন্তা এবং ক্ষোভের একটা মিলিত রুপ দেখা যাচ্ছে। রুমে ঢুকেই বললেন, “আই অ্যাম রিয়েলি সরি ফর বিয়িং লেট। অ্যাকচুয়েলি আমার একটা ইমর্পটেন্ট কল এসেছিল। হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড।”
অন্দ্রীল কথা বলল, “ইটস ওকে। আপনার কি স্লিপিং পিল খাওয়ার অভ্যাস আছে না শুধু গতকালই খেয়েছিলেন?”
নাদিম কায়সার অবাক চোখে অন্দ্রীলের দিকে তাকাল। তার চোখে মুখে বিস্ময়। অন্দ্রীলও সেটা বুঝতে পেরে বলল, “আপনি হাঁটার সময় কেমন যেন একটু দুলে দুলে হাঁটছেন। ঠিক ব্যালেন্স পাচ্ছেন না। ড্রিংক যে করেননি তা বোঝা যাচ্ছে কারণ ড্রিংক করলে আপনার গা থেকে একটা গন্ধ বের হত। সেটা এখন বের হচ্ছে না। তাই ধরে নেওয়া যায় আপনি ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন। আর নিয়মিত স্লিপিং পিল খেলে তাদের এমন দুলুনির ভাবটা আসে না। হঠাৎ একদিন নিলে সমস্যা হয়। আপনার বোধহয় সেটাই হচ্ছে।”
নাদিম কায়সারের চোখে যে বিস্ময়ের ভাবটা ছিল সেটা আরও অনেকগুণ বেড়ে গেল। কিছুক্ষণ ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন,
“ইমপ্রেসিভ। আপনি তো দেখছি সেই উপন্যাসের ডিটেকটিভদের মত। দেখেই অনেক কিছু বলে দিতে পারেন। আমিও উপন্যাসে পড়েছি কিন্তু বাস্তবে এমন বিচক্ষণ মানুষ এই প্রথম দেখলাম।”
অন্দ্রীল মুচকি হেসে বিনয়ে মাথা খানিকটা নোয়াল। ফয়সাল একটু তফাতে বসে মুচকি মুচকি হাসছে। ও জানে অন্দ্রীল ইচ্ছে করে কাজটা করেছে যাতে তার সামনে যে বসে আছে সে যেন তাকে এলেবেলে কেউ ভেবে না বসে।
“রাহাত আপনার বাড়িতে থাকে কতদিন হল?”
“এই তো মাস দু’য়েক। গ্রামেই থাকত কিন্তু ওখানে… “
“একটা খুন করেছিল তাই তো?”
“না না খুনটা ও করেনি। ওকে ফাঁসানো হয়েছিল।”
“এত মানুষ থাকতে বেছে বেছে ওকেই কেন ফাঁসানো হল?”
“আসলে ও একটু পলিটিক্সে ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছিল। রাহাত পলিটিক্স হয়তো ভালোই বুঝত। বড় বড় নেতাদের বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছিল। অল্প দিনেই সবার চোখে পড়ে যায়। দলের বাকিরা সেটা ভালোভাবে নেয়নি। এজন্যই প্ল্যান করে ওকে ফাঁসিয়েছে, নিজেদের রাস্তা ক্লিয়ার করার জন্য।”
“হুম, ওরা এখানে এসেছিল কবে?”
“আপনি কী করে… মানে এটা আপনাকে কে বলল?”
অন্দ্রীল তার বিখ্যাত মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “পুলিশকে অনেক কিছুই জানতে হয়। সেসব সোর্স কি আপনাকে বলা যাবে! আপনাকে যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দিন।”
“রাহাত এখানে আসার সপ্তাহখানেক বাদে এখানে একদল ছেলে এসে খুব হৈ চৈ শুরু করে। ওরা ওকে খুঁজতে এসেছিল। আমি বলেছিলাম ও বাসায় নেই।”
“আপনি মিথ্যা বলেছিলেন?”
“হ্যাঁ, মিথ্যা না বলে উপায় ছিল না। ওদের হাতে অস্ত্র ছিল, রাহাতকে পেলে ওরা কুচকুচি করে ফেলত। ওদের চোখ দেখে এমনই মনে হচ্ছিল।”
“আচ্ছা, আপনার কথা মত ওরা রাহাতকে ফাঁসাতে চাইছিল। ফাঁসানোর জন্য ওর বিরুদ্ধে একটা মার্ডার কেস করা হয়েছে। ফাঁসানোর জন্য একটুকুই তো যথেষ্ট হওয়ার কথা। এরপর তাহলে আবার বাড়ি বয়ে তাকে খুঁজতে আসবে কেন?”
“আসলে ওরা চাইছিল রাহাতকে লকাপে রাখতে। কিন্তু আমি ভালো উকিল টুকিল ধরে..”
“মানে টাকা খাইয়ে বের করে আনেন, তাই তো?”
নাদিম কায়সার মুখটা নিচু করে লজ্জিত ভাবে উত্তর দিলেন, “বলতে গেলে ব্যাপারটা তেমনই। আর এই কাজের ফলে ওরা আরও খেপে যায়৷ রাহাতকে মারার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে।”
“হুম, আপনার কি মনে হয় ওরাই রাহাতকে খুন করেছে?”
“দেখুন মিঃ. রয়, এখানে মনে হওয়ার কিচ্ছু নেই। এটা তো দিনের আলোর মত পরিষ্কার। ওরাই ওকে মারার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছিল, সুযোগ পেয়েছে, মেরে ফেলে দিয়ে গেছে। আমি বারবার মানা করতাম রাজনীতিতে ঢুকতে। কে শোনে কার কথা!”
“কিন্তু আমাদের হাতে যেহেতু প্রমাণ নেই সেহেতু সিওর হয়ে বলা যাচ্ছে না যে ওরাই মার্ডারটা করেছে। তাই আমাদের সব দিকেই ভাবতে হচ্ছে।”
“আপনারা দয়া করে আর কোনও দিকে ভাববেন না, বরং ওদের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ জোগাড় করতে পারেন কিনা দেখুন। আর সবচেয়ে সহজ বুদ্ধি সবকটাকে ধরে এনে পুলিশের থার্ড ডিগ্রি দেন, দেখবেন একদম বমির মত হড়বড় করে সবটা স্বীকার করে নিয়েছে৷ আমাকে এক্ষুনি অফিসে যেতে হবে। আপনাদের আর সময় দিতে পারছি না। কিছু মনে করবেন না৷”
“আপনার স্ত্রী এখন কেমন আছেন? ওঁর সাথে একটু কথা বলা দরকার।”
“কথা বলার মত অবস্থায় সে নেই। ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে গেছে, এখন সে ঘুমাচ্ছে। ও একটু সুস্থ হলে আমি আপনাদের জানাবো।”
“চা দিয়ে গেল ওইটা কি আপনাদের কাজের লোক?”
“হ্যাঁ, কেন?”
“বেতন কি খুব বেশি দেন?”
“একথা কেন বলছেন?”
“হাতে যে ট্যাটুটা দেখলাম সেটা করাতে বেশ অনেক টাকা লাগার কথা। বেতন খুব বেশি না হলে এসব করার চিন্তা মাথায় আসে না।”
“আসলে ও খুব শৌখিন। এতিম ছেলে৷ পরিবারের কেউ নেই। খাওয়া পড়ার চিন্তাও করতে হচ্ছে না। যা বেতন দেই তার প্রায় পুরোটাই ও ওসব করে খরচ করে ফেলে।”
নাদিম সাহেব ওঠে দাঁড়ালেন। সাথে সাথে অন্দ্রীল আর ফয়সাল৷ নাদিম সাহেব খুব দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন। আর ডিবির অফিসার দু’জন বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। বাড়ির বাইরে এসে অন্দ্রীল বলল, “রাহাতের গ্রামের বাড়ি কোথায়?
ফয়সাল সকালে একবার থানায় গিয়েছিল ক্রাইম রিপোর্টটা দেখার জন্য। তাই রাহাতের গ্রামের বাড়ির কথা ও জানত। বলল, “এই তো স্যার খুব বেশি দূরে না, গাজীপুরের মধ্যে, একটু ভেতরের দিকে।”
“ঠিক আছে। তুমি ড্রাইভারকে ঠিকানাটা বুঝিয়ে দিও। আমি একটু ওখান থেকে দেখে আসি বিষয়টা কী?”
“আপনি একাই যাবেন?”
“হ্যাঁ, তোমাকে আরেকটা কাজে যেতে হবে। আইজি স্যার তোমাকে একটু ডেকেছেন। কি যেন জরুরি একটা কেসের জন্য। তুমি একটু ঐ কেসটা দেখো। আর এখানেও তোমার আপাতত কোনও কাজ নেই। আমি ওদিকটা একটু দেখে আসি।”
“ঠিক আছে স্যার।”
“আর ক্রাইম রিপোর্টটার একটা কপি একটু ড্রাইভারের হাতে পাঠিয়ে দিও। ওটাও একটু দেখতে হবে।”
বিকেলবেলায় অন্দ্রীল গাড়ি নিয়ে রাহাতদের গ্রামের বাড়িতে গেল। ওদিককার ইনফরমেশনটা খুব বেশি দরকারী। এদিকে ফয়সালকে একটা সরকারের গোপন নথি চুরির কেস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হল। কাজটার জন্য এত বেশি চাপ ছিল যে এই কেসটার কথা সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। এভাবে দু’দিন চলে গেল নিস্তরঙ্গভাবে। অন্দ্রীল ফিরল দু’দিন পরে। কাকতালীয়ভাবে ফয়সালেরও কাজটা শেষ হল ঐ দিনই। অবশ্য দুজনের যোগাযোগ হল না। অন্দ্রীল সেদিন আর অফিসে গেল না। একবার নাদিম কায়সারের বাড়ি থেকে ঘুরে এল শুধু। তারপর ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের হায়দার সাহেবের সাথে দেখা করে একটা ফিঙ্গার প্রিন্ট ম্যাচ করাতে বলল। বাড়ি ফিরে বাকিটা দিন দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে রইল। মস্তিষ্কের দরজা খোলার জন্য হয়তো ঘরের দরজা আটকাতে হয়।
বিকেলে ফয়সালের কাছে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এল। ফয়সাল একটু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে ফোনটা ধরল।
“হ্যালো, কে বলছেন?”
“আমি কুদরত কইতেছিলাম সাব। নাদিম সাবের বাড়ির দারোয়ান।”
“হ্যাঁ, কুদরত বলো।”
“সাব, হেইদিন একখান কথা আপনাগো কওয়া হয় নাই। আমি ডরের লাইগা সেদিন বেবাগ ভুইল্যা গেছিলাম। তাই মনের ভিতর থেইক্যা কথাডা চইলা গেছিল।”
“কি কথা? বলো।”
“আমি লাশটা যখন দ্যাখতে পাই তার কিছু সময় পড়ে ছাদে একটা শব্দ হুনতে পাই। ছাদে সেদিন কে জানি আছিল।”
“কে ছিল? তুমি মুখ দেখেছ?”
“না, সাব। মুখখান দ্যাখতে পারলাম কই! তার আগেই তো সে দৌড়ায়া পালাল।”
“আচ্ছা। ঠিক আছে। তুমি যে মনে করে এটা বলছো তার জন্য ধন্যবাদ।”
ফয়সাল তখনই অন্দ্রীলকে ফোন দিল বিষয়টা জানানোর জন্য। পর পর তিনবার কল হলেও ফোনটা রিসিভ করল না অন্দ্রীল। চতুর্থবারে কল হওয়ার একটু পরেই ফোনটা রিসিভ হল।
“স্যার ব্যস্ত ছিলেন?”
“না, বলো কী বলবে।”
ফয়সাল যা জেনেছে তার বিস্তারিত অন্দ্রীলকে বলল। সে চুপ করে মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনলো। তারপর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলল “আমি এখনি নাদিম কায়সারের বাড়িতে যাব একবার। ছাদটা একটু দেখা আবশ্যক। পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট কি তোমার কাছে?”
“না, ওটা তো আজকে দেওয়ার কথা ছিল। এখনও পাইনি।”
“ঠিক আছে। তুমি রিপোর্টটা নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ওখানে পৌঁছাবে। আর দুইটা কনস্টেবল এখনই ওখানে পাঠিয়ে দাও।”
“ঠিক আছে। আমি এক্ষুনি বের হচ্ছি আর কনস্টেবলও পাঠিয়ে দিচ্ছি। স্যার, কেস কি সলভ হয়ে গেছে?”
“মনে তো হচ্ছে সেরকমই। শুধু দুইটা একটা জায়গায় খটকা আছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা পেলে আরও ক্লিয়ার হতে পারব।”
আধা ঘন্টার মধ্যে নাদিম কায়সারের বিশাল অ্যাপার্টমেন্টের সামনে পৌছে গেল অন্দ্রীল। গেটের সামনে দু’জন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। ফয়সাল ছেলেটা খুব কাজের। এরই মধ্যে কনস্টেবল পাঠিয়েও দিয়েছে। অন্দ্রীল কুদরতকে সাথে নিয়ে পৌছে গেল ছাদে। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে। ছাদটাও অন্ধকার হতে শুরু করেছে। তেমন ভালোভাবে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কুদরত একটা টর্চ জ্বালিয়ে দিল। টর্চের আলোতে ছাদটা একটু স্পষ্ট হল। অন্দ্রীলও ফোনের ফ্ল্যাশটা জ্বালিয়ে নিল। তারপর দু’জন তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলো সারা ছাদ। যদি কিছু পাওয়া যায়।
কিছুক্ষণ পরে কুদরতের ডাক শুনে সেদিকে এগিয়ে গেল।
“সাব, এই বস্তাডা পাইছি।”
অন্দ্রীল হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বস্তাটা দেখল। বস্তায় রক্তের দাগ লেগে আছে। একটা কোনায় সামান্য ছেঁড়া। বস্তার ওপর কী যেন একটা নাম লেখা। সম্ভবত কোম্পানির নাম আর লোগো।
কুদরত টর্চ হাতে সামান্য সংকোচ নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কী যেন বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না। অন্দ্রীল বিষয়টা বুঝতে পারল। বলল, “কুদরত, তুমি যা দেখেছ তার পুরোটা এখনও আমাদের বলোনি। বাকি যেটুকু বলোনি সেটুকু নিঃসংকোচে বলে ফেলো। তোমার কোনও ভয় নেই। কেউ তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।”
কুদরত অনুচ্চ স্বরে বলল, “সাব, হেইদিন রাতের বেলায় আমি কি যেন একটা পড়ার শব্দ পাইছিলাম। মনে লয়, ছাদের থেইকানই কী যেন পড়ছিল।”
“তুমি তখন চেক করোনি যে কি পড়লো?”
কুদরত কিছুক্ষণ চুপচাপ মাথা নিচু করে তার জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল তারপর মিনমিনে গলায় বলল, “আমার ভূতের ডর লাগে সাব। এইজন্য রাত বিরাতে বাইর হই নাই।”
“এই সাহস নিয়ে তুমি দারোয়ানের চাকরি করো!”
“আমারে মাফ কইরা দেন সাব। কাউরে এই কথাডা কইয়েন না। আমার কামডা চইল্যা যাইবো।”
“আচ্ছা। আমি কাউকে বলব না। কিন্তু আমাকে কথা দিতে হবে যে আর এরকম বিনা কারণে তুমি ভয় পাবে না।”
“আমি এইখানে দাঁড়াইয়া আল্লাহর নামে কসম কইরা বলতাছি আর এমন হইবো না সাব।”
“হুম গুড। এখন তুমি যাও, আমার একটু কাজ আছে।”
অন্দ্রীল বস্তাটা হাতে নিয়ে নিচে কোথায় একটা চলে গেল। আর কুদরত চলে গেল নাদিম কায়সারের ফ্ল্যাটে। উপাখ্যানের যবনিকা পাতের সময় হয়ে এসেছে। যতটুকু দ্বিধা, সন্দেহ ছিল তার সবটা কেটে গেছে এখানে এসে। এখন কেসটার সলভ হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।
নাদিম কায়সারের ফ্ল্যাটে লোকসংখ্যা অন্যদিনের চেয়ে বেশি। নাদিম সাহেব, বাড়ির কাজের লোক, নাসের সাহেব, মিসেস কায়সার। আর ফয়সাল এসে বসেছে একটু আগে। কুদরত আর হাফিজ দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে। সেখান থেকে সবটা দেখা ও শোনা যায়। তাদের পাশে দু’জন জাঁদরেল পুলিশ কনস্টেবল। অন্দ্রীল এদের মধ্যে প্রবেশ করতেই সবার মধ্যে যে অস্থিরতা, আতঙ্ক আর উত্তেজনা ছিল তা যেন আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
নাদিম সাহেব বসে আছেন বিরক্ত ভঙ্গিতে। তার পাশে নাসের সাহেব। ওঁর বসার ভঙ্গি চুপচাপ, শান্ত। মিসেস কায়সার এখন একটু সুস্হ হয়েছেন। উনি বসেছেন আরেকটা সোফায়। বাড়ির কাজের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে একটু তফাতে। ফয়সাল মনোযোগ দিয়ে পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা পড়ছে। এর আগেও বেশ কয়েকবার পড়েছে। কিন্তু যা লেখা আছে এতে তা কিছুতেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।
অন্দ্রীল ঘরে ঢুকেই ফয়সালের হাত থেকে পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা নিল। কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে পড়লো সেটা। পড়ার মাঝে মাঝে ভ্রু দু’টো কুঁচকে গেল। তারপর সেটা আবার ফয়সালকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “হুম, আমিও এরকম কিছুই ভেবেছিলাম।”
তারপর ঘরের অন্যান্য মানুষদের দিকে ফিরে বলতে শুরু করলেন ,
“এই কেসটা বেশ জটিলই বলা যায়। জটিল বলছি এই কারণে যে, খুনি খুব বুদ্ধিমানের মত একটা কাজ করেছিল কিন্তু কিছু জায়গায় হিসাব নিকাশ তার ইচ্ছেমত হয়নি। একটা সময় এসে পাশার দানটা উল্টে গেছে। নইলে সে একদম নিখুঁত একটা মার্ডার করে ফেলতে পারত। আর তার পাপের শাস্তি ভোগ করত আরেকজন।”
নাসের সাহেব এতসব ভূমিকা পছন্দ করছেন না। উনি বলে উঠলেন,
“মিস্টার রয়, কাইন্ডলি আপনি মেইন টপিকে আসুন।”
“হুম আসছি। লম্বা গল্প, সবাই একটু মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। একটা খুন হওয়ার পরে প্রথমে আমাদের যে জিনিসটার খোঁজ করতে হয় সেটা হল খুনির মোটিভ। আমরা যখন সেই মোটিভ খুঁজে বেড়াচ্ছি, তখন আমাদের সামনে একটি মোটিভ এবং সাসপেক্ট তুলে ধরা হল। খুবই স্ট্রং মোটিভ এবং সাসপেক্টও যথেষ্ট সাসপিশাস। আমি যখন এগুলো শুনলাম তখন এক মুহুর্তে আমার বিশ্বাস করে নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত আমি তখনই ওগুলো বিশ্বাস করিনি। সত্যতা যাচাইয়ের জন্য হোক আর সাসপেক্টের বিষয়ে প্রুফ জোগাড়ের জন্যই হোক আমাকে একবার যেতে হয় রাহাতদের গ্রামের বাড়িতে।
সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম নাদিম সাহেব আমাদের কাছে যা বলেছেন সেটা অর্ধসত্য। উনি আমাদের বলেছিলেন রাহাতকে মার্ডার কেসে ফাঁসানো হচ্ছে। ও সম্পূর্ণ নির্দোষ। কিন্তু ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম রাহাতকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছিল এটা সত্যি। কিন্তু উনি যে সম্পূর্ণ নির্দোষ এটা মিথ্যা। আসলে মার্ডারটা কেউ একা করেনি। করেছিল কয়েকজন মিলে কিন্তু কেসের সময় কেসটা হয় শুধু রাহাতের নামে। বাকিরা সুযোগ বুঝে ওকে ফাঁসিয়ে দিয়ে কেটে পড়ে।
তখন নির্বাচনকালীন সরকার ক্ষমতায়। ভিক্টিম ছিল তৎকালীন সদ্য বিদায়ী সরকারী দলের। আর রাহাত আর তার সঙ্গীরা বিরোধী দলের। রাহাতের বাকি সঙ্গীরা তখন সুযোগ বুঝে নির্বাচনকালীন সরকারের লোকজনদের সাথে যোগ দেয়। নৈতিকতার কারণেই হোক আর সুযোগের অভাবেই হোক রাহাত তখন দল পাল্টাতে পারেনি। তাই যখন কেস হয় তখন রাহাতের সঙ্গীরা বেঁচে যায় এবং কেসের আসামী হয় একজন। তার সঙ্গীরা তাকে বাচানোর কোনও চেষ্টাই করেনি বরং দুই চার দিনে দলে জায়গা করে নেওয়া এই ছেলেটাকে দেখে তাদের যে ঈর্ষা হত তা মিটতে যাচ্ছে দেখে তারা যারপরনাই খুশি হয়। কিন্তু পাশার দান পাল্টাতে সময় লাগেনি।
নাদিম কায়সার সাহেবের টাকা পয়সার যে কমতি নেই তা মোটামুটি আমরা সবাই জানি। শ্যালককে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে চারিদিকে পয়সা ছিটানো শুরু করেন। আর তাতে কাজে দেয়। রাহাত জামিন নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। এর কিছুদিন পরেই নির্বাচন হয়। নির্বাচনে ভিক্টিমের দল অর্থাৎ রাহাতদের অপোজিশন জিতে যায়। তারা ক্ষমতায় আসার পরপরই নির্বাচনকালীন সরকারের সময়ে তাদের দলের লোকদের গুম, খুন এসবের কেসগুলো রি-ওপেন করার নির্দেশ দেয় এবং খুব স্ট্রিক্টলি বলা হয় যেন এইসব তদন্ত যেন কোনওভাবেই প্রভাবিত না হয়।
এর ফলে রাহাতের বাকি সঙ্গীরা খুব তাড়াতাড়ি জেলে প্রবেশ করে। কিন্তু রাহাত তখনো পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। আর পুলিশ তার পিছু পিছু ধাওয়া করে বেড়ায়। এই আত্মগোপনের সময়েও রাহাত তার বোন আর দুলাভাইয়ের সাথে যোগাযোগ ঠিকই রেখেছিল। এইসময় রাহাতের যে বাকি সঙ্গীরা ছিল তারাও জানতে পারে যে শুধু রাহাত বাদে বাকিরা সবাই জেলে। তারা ভাবে রাহাতের দুলাভাই আবারও টাকা খাইয়ে রাহাতকে বাচিয়ে দিচ্ছে আর এর প্রতিকার হিসেবে তারা রাহাতের শাস্তির দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেয় আর সে কারণেই তারা তাদের যেসব ক্যাডাররা জেলের বাইরে আছে তাদেরকে নিয়োগ করে রাহাতকে খুন করার জন্য। আর সেজন্যই তারা এ বাড়িতে এসে রাহাতের খোঁজ করে।
“আর তারপর সেদিন যখন সুযোগ পায় তখন রাহাতকে মেরে ফেলে। এ তো পানির মত সহজ বিষয়।” এতক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকার পরে হঠাৎ কথা বলে উঠলেন নাদিম সাহেব৷
“হ্যাঁ, এতদূর পর্যন্ত পানির মত সহজই ছিল। কিন্তু একটা সামান্য জিনিস আমার কাছে একটু খটকার মত সৃষ্টি করে। আপনার বাড়ির কাজের লোকের হাতের ঐ ট্যাটু। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি ও ট্যাটু করাতে প্রায় তিন হাজার টাকার মত খরচ হয়। যতই খরুচে আর ফূর্তিবাজ মানুষই হোক, যে একজনের বাড়িতে কাজ করে তার পক্ষে তিন হাজার টাকা খরচ করে গায়ে ট্যাটু করানোর বিষয়টা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়।
খটকা মেটানোর জন্য আমি মাঝে একদিন আপনাদের বাসায় আসি এবং কাজের ছেলেটার কাছে এক গ্লাস পানি খেতে চাই। ও পানি রেখে চলে গেলে কৌশলে আমি গ্লাসটা নিয়ে কেটে পড়ি। সেখানে ছেলেটার স্পষ্ট হাতের ছাপ আছে। এরপরে আমি ফরেনসিকের শরণাপন্ন হই। তারপর বাকি কাজটা ফরেনসিকের হায়দার ভাই করেছেন। ফিঙ্গার প্রিন্ট ক্রস চেক করে জানান ফিঙ্গার প্রিন্টটি আমাদের রেকর্ডের একজন ফেরারি আসামীর ফিঙ্গার প্রিন্টের সাথে মিলে যায়। আর সেটা হল আমাদের রাহাত অর্থাৎ ভিক্টিম। কিন্তু এখনকার চেহারার একটুও রাহাতের চেহারা সাথে মিলে না। এই অমিলের কারণ সহজ – প্লাস্টিক সার্জারি।”
প্লাস্টিক সার্জারি করে রাহাত তার চেহারা বদলে ফেলে যাতে পুলিশ বা তার শত্রুপক্ষ কেউ আর তাকে চিনতে না পারে।
ঘটনা এই পর্যন্ত গড়ালেই ভালো হত। এই কাজের পরে নিজের বোনের বাড়িতে কাজের লোক সেজে থাকলে কেউ সন্দেহ করবে এমনটা ঘটার খুব একটা সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু তাহলে এই খুনের নাটক করার প্রয়োজনটা কি ছিল?
প্রথম প্রয়োজনটা ছিল মামলার চার্জশিট থেকে রাহাতের নামটা বাদ দেওয়া। কিন্তু এটা করার জন্য হয়তো প্লাস্টিক সার্জারি যথেষ্ট ছিল। তাহলে নাটকটার পেছনে কি অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে? আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা যে লাশটা দেখেছি সেটা সত্যি একজনের লাশ। সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য তাকে রাহাত বলা হচ্ছে। কিন্তু তাহলে আসলে সে কে?
প্রথমে আসি নাটকটার পেছনের আরেকটা কারণ কী ছিল?
আমাদের রুটিন ইনকোয়ারির একটা হল ভিক্টিমের যাবতীয় যে ফাইন্যান্সিয়াল ইস্যুগুলো আছে সেটা চেক করা। আমি গত পরশু সেই ইনকোয়ারি করতে গিয়ে একটা মজার তথ্য জানতে পারি।
আমাদের শ্যালকের শোকে আহত দুলাভাই শ্যালকের মৃত্যুর দু’দিনের মধ্যেই তার নামে যে পঞ্চাশ লাখ টাকার লাইফ ইন্সিওরেন্স ছিল সেই টাকাটা তোলার জন্য আবেদন করেছেন। এখান থেকে মৃত্যুর নাটকের প্রচ্ছন্ন এবং প্রধান কারণটা অনুমান করা যায়।
পরে আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ‘কায়সার অ্যাগ্রো লিমিটেড’ এখন লসে চলছে। বাজারে তাদের অনেক দেনা। তারপরে অবৈধভাবে শ্যালকের প্লাস্টিক সার্জারি করাতে গিয়ে আরও অনেকগুলো টাকা চলে যায়। এসব লস্ কাটিয়ে ওঠার জন্যই হয়তো মিস্টার নাদিম কায়সার রাহাতের মৃত্যুর নাটকটা সাজান। যাতে এক ঢিলে তিন চারটে পাখি মারতে পারেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাখি উড়ে যায় আর এখন ঢিলটাও এসে ওঁর নিজের মাথায়ই পড়ছে।
আর সেদিন আসলে যাকে মার্ডার করা হয় সে হচ্ছে নাদিম সাহেবের বাড়ির কাজের লোক। নাদিম সাহেব নিজের প্ল্যানকে সফল করার জন্য নির্দোষ ছেলেটাকে মার্ডার করে।
এতক্ষণ আবার চুপ করে ছিলেন নাদিম সাহেব। একথাটা শুনে যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। “রাবিশ! আমি মার্ডার কখনোই করিনি। আগে থেকেই ও মরে ছিল আমি শুধু ওর মুখটা থেঁতলে নিচে ফেলে দিয়েছি। আপনাকে বেশ বুদ্ধিমান বলে মনে হচ্ছিল এতক্ষণ। কিন্তু এখন তো দেখছি সেটা ভুল।”
“হা হা, মিস্টার নাদিম কায়সার, আপনি দয়া করে আমার ওপর আরেকটু সময় ভরসা রাখুন। খুনিটা কে সেটা নিয়ে আমি একটু দ্বিধা দ্বন্দ্বে ছিলাম। আপনার রিয়্যাকশন আমার ধারণাটা স্বচ্ছ করে দিল।”
এবার অন্দ্রীল ঘাড় ঘুরিয়ে নাসের সাহেবের দিকে ফিরে বললেন, “আপনি খুনটা কেন করলেন?”
কথাটা শুনে চমকে যেন নাসের সাহেবের মুখটা যেন লাল হয়ে উঠলো।
“কী সব যা তা বলছেন! আমি কেন শুধু শুধু ওকে খুন করতে যাব?”
“সত্যিই কি শুধু শুধু? কুদরত আমার সাথে ছাদে একটা কাজ করছিল। কাজটা শেষ হলে কুদরত এখানে চলে আসে। কিন্তু আমি এসেছি ও আসার একটু পরে। আমি ছাদ থেকে নিচে নেমে আপনাদের পাশের ফ্ল্যাটে যাই। সেখানে আপনাদের সম্পর্কে জানতে চাই। লাশে আপনার ফিঙ্গার প্রিন্ট কেন ছিল সেটা আমি তখনো জানতে পারিনি। আর ফয়সাল আমাকে জানিয়েছিল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে ভিক্টিমের শরীরে অ্যালকোহল আর বিষ পাওয়া গেছে। আমি ধারণা করেছিলাম আপনার কোনও গুপ্ত কথা আছে যা আমার অজানা। এটা শুধুই আমার ধারণা ছিল, কিন্তু আন্দাজে ঢিল ছুঁড়তে গিয়ে দেখি মৌচাক ভেঙে ফেলেছি।
আপনার পাশের ফ্ল্যাট থেকে আমি যা জানতে পারলাম তা আমার ধারণাকে ঠিক প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এই অ্যপার্টমেন্টে সবার সামনে ড্রিংক করেন একমাত্র আপনি, তাই অ্যালোকহল আর বিষের দায়টা প্রথমে আপনার উপর বর্তায়। আপনার মেয়ে অবিবাহিত এবং প্রেগন্যান্ট। আর এ নিয়ে প্রতিবেশিদের মধ্যে অনেক রকম গল্প চালু আছে। তার মধ্যে যেটা সবচেয়ে বেশি শোনা যায় সেটা হল নাদিম কায়সারের কাজের লোকের সাথে… “
নাসের সাহেবের মুখ ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠছিল, অন্দ্রীল কথা শেষ করার আগেই উনি যেন গর্জে উঠলেন “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঐ জোচ্চরের বাচ্চা আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছিল। কত বড় সাহস ওর, ও আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়ায়! তাই ওকে একটা চরম শিক্ষা দিলাম।”
“কাজটা করলেন কীভাবে?”
“ও সন্ধ্যার দিকে ছাদে যেতো শুকনো কাপড় তোলার জন্য। সেদিন সন্ধ্যায় যখন ও ছাদে গেল তার আগে থেকেই আমি ছাদে লুকিয়ে ছিলাম। যেই ও ছাদে এল তখনই ওকে জোর করে বিষ মেশানো মদ খাইয়ে দেই। ধস্তাধস্তি করতে করতে একসময় ছাদে পড়ে থাকা একটা রড দিয়ে আমি ওর মাথায় একটা বাড়ি দেই। তারপর ও ধীরে ধীরে যখন নিস্তেজ হয়ে যায় তখন এক গোপন জায়গায় লুকানোর আয়োজন করছিলাম, হঠাৎ পায়ের আওয়াজ শুনে আমি লুকিয়ে পড়ি। আর বাকি….. ”
“বাকিটা যার কীর্তি তার কাছ থেকেই শোনা যাক। নাদিম সাহেব বাকিটা বলেন।”
“আমার রুমে আমার ওয়াইফ স্মোকিং অ্যালাউ করেন না। শুধু রুমে না উনি স্মোকিংই অ্যালাউ করেন না। তাকে আমি লুকিয়ে ছাদে গিয়ে সিগারেট খাই। সেদিনও ঐ কারণেই ছাদে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি আমাদের বাসার কাজের লোক কামরুল ছাদের মাঝখানে গা এলিয়ে শুয়ে আছে। কানের পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এগিয়ে গিয়ে দেখি নিঃশ্বাস পড়ছে না, ও মরে গেছে। তখনই হুট করে মাথায় বুদ্ধিটা এল। আমি তাড়াতাড়ি করে নিচ থেকে একটা ইঁট নিয়ে গিয়ে ওর মুখটা থেঁতলে নিচে ফেলে দিলাম।”
“এ কি আপনি যে কুদরতের সাহায্যকে পুরোপুরি অস্বীকার করছেন! ও সাহায্য না করলে আপনি একা একা এত কাজ করতে পারতেন!”
এবার অন্দ্রীল কুদরতের দিকে ঘুরে বলল, “অভিনয়টা ভালো ছিল কিন্তু একটা সামান্য ভুল করে ফেললে।”
কুদরত কথা শুনেই দৌড়ে পালাতে গেল, পাশের দু’জন জাঁদরেল কনস্টেবলের কারণে বেশি দূর যেতে পারলো না।
অন্দ্রীল বলল, “ফয়সাল, কেস শেষ মেশ সলভ হল। তুমি অতিথিদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্হা করো।”
কনস্টেবল দু’জন ফয়সালের আদেশ পাওয়া মাত্র একে একে নাদিম কায়সার, রাহাত আর নাসের সাহেবকে বের করলেন। কুদরত আগেই ওদের কব্জায় ছিল।
মিসেস কায়সার এসব নাটকের কিছুই জানতেন না। এমনকি তার ভাই যে ছদ্মবেশে তার বাড়িতেই আছে, সেটাও না। অন্দ্রীলের মুখে সবটা শুনে উনি যেন কেমন স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। শুধু বেরিয়ে আসার আগে অন্দ্রীলকে ধন্যবাদ জানালেন।
কেস সলভের পরে মানসিক একটা শান্তির প্রয়োজন হয়। অন্দ্রীল সেই শান্তির খোঁজে যায় হাতির ঝিলে। আজকেও তাই এসেছে। পাশে ফয়সালও বসে আছে। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ থাকার পরে ফয়সালই নিরবতা ভাঙলো,
“স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“কুদরতকে কেন সন্দেহ করলাম সেটা জানতে চাও তো?”
ফয়সাল সামান্য লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, “জ্বি স্যার। ওটার কোনও কিনারা করতে পারছি না।”
“না করতে পারাই ভালো।”
ফয়সাল চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে বলল, “কেন স্যার?”
“আরে সবটা জেনে গেলে যদি তুমিও অন্দ্রীল রয় হয়ে যাও, তাই বলা যাবে না। হা হা হা।”
অন্দ্রীল তার বিখ্যাত মুচকি হাসির পরিবর্তে এখন শব্দ করে হাসছে। তার সাথে যোগ দিয়েছে ফয়সালও। তাদের এই হাসির আওয়াজ ছড়িয়ে চারদিকে, আশপাশের মানুষ অবাক হয়ে দেখছে এই অপার্থিব দৃশ্য।
সমাপ্ত।