Getting your Trinity Audio player ready...
|
রাতের গভীর অন্ধকারে তান্ত্রিক দেখল সদ্য নিভে যাওয়া অগ্নিকুণ্ড নির্গত ধোঁয়ার অন্দরে পিশাচ এসে হাজির হয়েছে। সে আদেশের সুরে বলল, “আজও তোকে একই কাজ করতে হবে, যা গিয়ে শেষ করে দে রাজার দ্বিতীয় সন্তানকে।” কথা শেষ হতেই সেই ভয়ালদর্শন পিশাচ অদৃশ্য হল। মনে মনে নিষ্ঠুর হাসি হাসল তান্ত্রিক। তাকে অপমান করার প্রতিশোধ এবার সে নেবে, পুরো রাজবংশকে নিঃশেষ করবে সে।
এদিকে প্রথম সন্তান হারিয়ে বিমর্ষ রাজা ডেকে পাঠালেন কুলপুরোহিত প্রদ্যুৎমোহনকে। তিনি শুধু পূজারী নন, একজন সন্ন্যাসী। তিনি সব দেখে শুনে অশুভ কিছুর আন্দাজ করলেন। রাজার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সন্তানের হাতে একটা কবজ বেঁধে দিয়ে বললেন, সেগুলো যেন কোন অবস্থায় খোলা না হয়। তারপর সমগ্র রাজমহল মন্ত্রবন্ধনে আবদ্ধ করলেন। তারপর রাজার কথায় কিছু একটা সন্দেহ করে দু’জন রক্ষীকে সঙ্গে নিয়ে রাতের অন্ধকারে এগিয়ে চললেন শ্মশানের দিকে।
শশ্মানে পৌঁছে তান্ত্রিককে দেখে তাঁর সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হল। রক্ষীদু’জনকে ইশারা করতেই তারা সেই তান্ত্রিককে বন্দী করে নিয়ে গেল। পুরোহিত প্রদ্যুৎমোহন সেখানেই উপবেশন করে নিজক্রিয়া শুরু করলেন। এদিকে পিশাচ হাওয়ায় ভেসে চলে এল রাজপ্রাসাদের সম্মুখে। কিন্তু ভিতরে ঢুকতে যেতেই বাঁধা পেল। সে মহলের চারপাশে ঘুরল কিছুক্ষণ, বারংবার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই অভীষ্টে পৌঁছাতে পারল না। যতই সে ব্যর্থ হল, ততই তার রাগ বৃদ্ধি পেল। শেষে অসফল হয়ে ফিরে চলল শ্মশানের দিকে। তান্ত্রিকের শিরচ্ছেদ করে শরীরের রক্ত শুষে নিতে না পারলে তার রোষের আগুন নিভবে না। ঝড়ের বেগে শ্মশান চত্বরে এসে সে থমকে দাঁড়ালো। কোথায় তান্ত্রিক! এ যে অন্য এক সাধু। তাঁর শরীর থেকে তেজরশ্মি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। রক্তাভ দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করছে। সাধুর পাশে রাখা ওটা কি! বিপদ টের পেল পিশাচ। কিন্তু আর কিছু করার নেই। কেউ যেন তাকে অদৃশ্য শিকলে বেঁধে তার সমস্ত শক্তি নিংড়ে নিচ্ছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে এল তার সামনে। এক অজানা আঁধারে সে বন্দী হয়ে গেল চিরতরে।
(২)
শশোধরবাবু লিস্ট মিলিয়ে দেখলেন সাপ্লায়ার ছেলেটা সবকিছুই নিয়ে এসেছে। তার মনটা খুশিতে ভরে উঠল। প্রত্যেকটা জিনিস যতটা পুরোনো, ততটাই সুন্দর তাদের নক্সা ও কারুকার্য। বাজারে ভালো দাম পাওয়া যাবে। অনেকদিনের পুরোনো তার অ্যান্টিকের দোকান। বেশিরভাগ কাস্টমার তার চেনাজানা। মাঝেমধ্যেই তারা এসে নতুন জিনিসের খোঁজ করে যায়। তিনি চাহিদামত অনেকগুলো জিনিস বেছে নিলেন। অ্যাডভান্স করাই ছিল, হিসাব করে বাকি টাকার চেকও লিখে দিলেন। ছেলেটা বলল, “দাদা, ঐ যে মূর্তিটার কথা বলেছিলাম, একবার দেখবেন নাকি, বেশি দাম নয় কিন্তু জিনিসটার।” শশোধরবাবু এত ভালো ভালো জিনিস দেখে মূর্তিটার কথা ভুলেই গেছিলেন। তিনি সেটা দেখতে চাইলেন। ছেলেটা একটা ব্যাগ থেকে মূর্তিটা বার করে তার হাতে দিল।
মূর্তিটা হাতে নিতেই বুকটা অজানা ভয়ে শিরশির করে উঠল শশোধরবাবুর। এরকম অদ্ভুত দর্শন মূর্তি তিনি আগে দেখেননি। বিভিন্ন প্রাচীন মন্দিরে যেরকম রাক্ষসের মূর্তি দেখা যায় খানিকটা সেইরকম। দেহটা সিংহসদৃশ, একটা মুদ্রার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। মুখটা রাক্ষসের মতোই হাঁ করে আছে। কালচে লাল রঙের পাথরে খোদাই করে মূর্তিটা বানানো। গায়ের অলঙ্কার এবং পোশাকের কারুকার্য সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি মূর্তিটাও রেখে দিলেন। অনেক কাস্টমার এরকম ভয়ানক জিনিসই খুঁজতে আসে। মানুষের অ্যান্টিক সংগ্রহের শখ যে কত বিচিত্র রকম, তা তিনি এত বছরে ভালোই জেনেছেন। ছেলেটা টাকার অঙ্ক বুঝে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, দরজার মুখে দাঁড়িয়ে বলল, “ও হ্যা, এই মূর্তির মাথাটা যেন কেউ না খোলে।” কথাটা বলেই বাইরে বেরিয়ে গেল সে।
শশোধরবাবুর কৌতূহল বেড়ে গেল। তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন মূর্তিটাকে। সত্যিই মাথার নিচে গলার কাছে একটা অস্পষ্ট দাগ দেখা যাচ্ছে। তিনি মাথাটা ধরে একটু জোরে মোচড় দিলেন। সেটা প্যাঁচ খেয়ে ঘুরে গেল। তারপর কয়েকপাক ঘোরাতেই খুলে গেল মূর্তির নিরেট মাথাটা। শশোধরবাবু দেখলেন দেহের অংশের ভিতরটা ফাঁপা। কিন্তু কিছুই তো বুঝতে পারছেন না কেন মাথাটা খোলা বারণ, হয়তো বারবার খুললে মূর্তিটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই ভেবে মাথাটা আবার যথাস্থানে আটকে দিলেন। তিনি মূর্তিটা একটা তাকে তুলে রাখতে যাবেন এমন সময় একটা মাঝবয়সী ছেলে দোকানে প্রবেশ করল। শশোধরবাবুর হাতে মূর্তিটা দেখেই তার চোখ চকচক করে উঠল। সে জানালো ঐ মূর্তিই সে কিনতে চায়। শশোধরবাবু অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী, তার উপর ছেলেটাও প্রথমবার এসেছে তার দোকানে। সুযোগ বুঝে একটু চড়িয়ে দাম হাঁকালেন। কিন্তু তাকে অবাক করে সেই দামেই মূর্তিটা কিনে নিল ছেলেটা।
(৩)
আজ অফিস থেকে বেরাতে একটু দেরি হয়ে গেছে প্রণববাবুর। রাস্তাটাও বেশ অন্ধকার। স্ট্রীটলাইটগুলো খারাপ অনেকদিন ধরেই। মাস-খানেক পর দুর্গাপূজা, তবু সারানোর নাম নেই। বাস থেকে নেমে রোজ এই পথেই হেঁটে বাড়ি ফেরেন তিনি। আজ কেন জানেন না একটু ভয় ভয় করছে তার। মাইনের টাকাটাও পকেটে আছে। যদি কোন ছিনতাইবাজ…. সামনে চোখ পড়তেই ভাবনায় ছেদ পড়ল। আবছা অন্ধকারে অদূরেই কে একজন দাঁড়িয়ে আছে। বুকটা ধড়াস করে উঠল প্রণববাবুর। এই নির্জন রাস্তায় পথ আগলে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে ও কে! কি করবেন বুঝতে পারলেন না তিনি। কালো ছায়াশরীরটা এক পা দু পা করে এগিয়ে আসছে তার দিকে। তিনি ভালো করে লক্ষ্য করে আগন্তুকের হাতে কোন ছুড়ি বা অস্ত্র দেখতে পেলেন না।
প্রণববাবু অচেনা মানুষটার অভিসন্ধি বোঝার চেষ্টা করলেন। ছায়াশরীরটাও আরও কিছুটা এগিয়ে এল তার দিকে। জমাট অন্ধকার ভেদ করে প্রণববাবুর দৃষ্টি এক ভয়ানক নিষ্ঠুর চেহারা প্রত্যক্ষ করল যেন। তিনি পিছন ফিরে ছুটতে শুরু করলেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে কেউ তাকে পিছন থেকে জাপটে ধরল। তিনি অনুভব করলেন সেটা কোন মানবশরীর নয়। একরাশ কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস যেন তাকে জড়িয়ে ধরেছে, কিন্তু অসম্ভব শক্তিশালী তার বাঁধন। শত চেষ্টা করেও তিনি নিজেকে ছাড়াতে পারলেন না।
দেখতে দেখতে সেই আলিঙ্গন আরও দৃঢ় হল। সারা শরীর জুড়ে ব্যথা করছে। তিনি চিৎকার করতে যাবেন ঠিক সেই মুহূর্তে দুটো হাত তার গলা টিপে ধরল। ভয়ে ও বিপদের আশঙ্কায় তার বুকের মধ্যে কেউ যেন হাতুড়ির ঘা দিতে শুরু করল। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বিস্ফারিত চোখদুটো গলার চাপ সহ্য করতে না পেরে কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ধীরে ধীরে তার চেতনা লোপ পেতে শুরু করল। অন্ধকার রাতের সেই নির্জন রাস্তায় প্রণববাবুর মাথাটা কেউ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল একসময়। দেহটা রাস্তার উপরেই লুটিয়ে পড়ে বেশ কিছুক্ষণ কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে গেল।
বায়বীয় ছায়াটা আবার জমাট বাঁধতে শুরু করল। অচিরেই সেটা একটা মানব শরীরের অবয়ব ধারণ করল। তার মুখে খেলে গেল এক পৈশাচিক হাসি। পড়ে থাকা দেহটার পাশে উবু হয়ে বসে নিজের মাথাটা নামিয়ে আনল রক্তাক্ত গলার কাছে। তারপর মুখ বাড়িয়ে সেখান থেকে টেনে চুষে খেতে লাগল শরীরের সমস্ত রক্ত। পাশে পড়ে থাকা প্রাণহীন মাথাটা খোলা চোখে দেখতে লাগল এই নারকীয় দৃশ্য।
(৪)
সকালবেলা অফিস যাওয়ার আগে টিভি চালিয়ে খবরটা শুনল অনিন্দ্য। আজ আবার একই ঘটনা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল ওর, সেই সঙ্গে দুশ্চিন্তাও বাড়ল। একমাসের মধ্যে তিনটে মৃত্যু, তাও একইভাবে। অন্ধকার রাস্তায় আততায়ী মানুষের ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে দিচ্ছে। আরও আশ্চর্যের বিষয় মৃতদেহের শরীর রক্তশূন্য। কেউ যেন সব রক্ত শুষে নিয়েছে শরীর থেকে। নাহ্, আজ অফিসে গিয়ে ওর মনের সন্দেহটা প্রতিমকে জানাতেই হবে। সেরকম হলে সন্ধ্যের দিকে রাজীবকে একবার ফোন করে আলোচনা করবে ব্যাপারটা নিয়ে। ইন্সপেক্টর রাজীব ঘোষ তার ছোটবেলার বন্ধু।
অফিসে কাজের ফাঁকে প্রতিমকে বলেই ফেলল কথাটা। প্রতিম মাস-খানেক হল ওড়িশা থেকে কোলকাতা শহরে এসেছে। প্রথম দিনই অ্যান্টিক শপ থেকে বেরিয়ে সে একটা ঠিকানা জিজ্ঞাসা করেছিল পথে দেখা হওয়া অনিন্দ্যর কাছে। পরদিন অফিসে দুজনে দু’জনকে দেখে অবাক হয়েছিল। সমবয়সী অনিন্দ্যর সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে সেইদিন থেকেই। অনিন্দ্য বলল, “ভাই একটা কথা বলছি, কিছু মনে করিস না, তুই আমাকে বলেছিলি শহরে এসে প্রথম দিনেই তুই কিউরিও শপ থেকে একটা অ্যান্টিক রাক্ষসের মূর্তি কিনেছিলি।”
~ “হ্যা, কিনেছিলাম তো, ভয়ানক সেই মূর্তি। আমি ওটাকে ভীষণ ভয় পাই। তবু ওটার কারুকার্য এত সুন্দর যে….”
— “দেখ তুই ওটা কেনার পর থেকেই কিন্তু শহরে একের পর এক মৃত্যু নেমে আসছে। আমার মনে হয় এসবের জন্য ঐ অপয়া মূর্তিটাই দায়ী।”
~ “কি বলছিস এসব তুই? এরপর তো বলবি আমি শহরে নতুন এসেছি, ওদের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী।”
অনিন্দ্য দেখল, প্রতিম উত্তেজিত হয়ে গেছে। তাই আর কথা বাড়ালো না। শুধু বলল, “দেখ, শহরে এরকম ঘটনা তো আগে ঘটেনি। তাই আমি ভাবলাম, তুই ঐ মূর্তিটার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখেছিস কিনা তাই জানতে চাইলাম। আচ্ছা, তোর যদি কোন আপত্তি না থাকে, আমাকে একবার দেখাবি মূর্তিটা?” এতক্ষণে প্রতিম শান্ত হয়েছে। একগাল হেসে সম্মতি দিল।
সন্ধ্যার দিকে অফিস থেকে বেরিয়ে প্রতিমের বাড়িতে গেল অনিন্দ্য। শহরের একধারে একটু নিরিবিলি জায়গায় বাড়িটা। ঘরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসল অনিন্দ্য। প্রতিম নিজেই এসে মূর্তিটা তার হাতে দিল। তারপর চা বানাতে ভিতরে চলে গেল। অনিন্দ্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল মূর্তিটা। ফাঁকা ঘরে মূর্তির দিকে তাকিয়ে তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। এমন ভয়ংকর জিনিস কেউ ঘরে রাখে! প্রতিম আসার আগে সে চটপট মোবাইলে ওটার কয়েকটা ছবি তুলে নিল।
অনিন্দ্য চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে মূর্তিটা নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দিল। তখনই প্রতিম ঘরে ঢুকল চা নিয়ে। চা খেতে খেতে অনিন্দ্য জিজ্ঞাসা করল, “শুধু মূর্তি ছাড়া আর কোন অ্যান্টিক নেই তোর ঘরে?” প্রতিম বলল, “ওড়িশার বাড়ি থেকে সবকিছু আনা হয়নি। আর প্রথম মাসের মাইনে পেলে আরও কিছু কিনব।” এরপর কিছু কথাবার্তা বলে উঠে পড়ল অনিন্দ্য।
প্রতিমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে দীর্ঘ একটা অন্ধকার রাস্তা, সেই রাস্তায় ছায়ার মতো একটা লোককে দেখে সে চমকে উঠল। আজ শনিবার, আগের ঘটনাগুলোও শনিবারই ঘটেছে। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল সে। কাছে গিয়ে দেখল, একজন গোবেচারা ভদ্রলোক। তিনিও বোধহয় ওকে দেখে ভয় পেয়েছিলেন। ভদ্রলোক একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, “আজকাল কি যে হয়েছে, স্ট্রীটলাইট ঠিকঠাক জ্বলে না, আর যত অপকর্ম ঘটছে অন্ধকারেই।” অনিন্দ্য ওনার কথায় সায় দিয়ে বলল, “ঠিকই বলেছেন, সাবধানে যাবেন।” কথাটা বলে আর দাঁড়াল না সে। সামনের মোড় থেকে বাড়ি ফেরার বাস ধরল। বাড়ি গিয়ে মূর্তির ছবিগুলো রাজীব আর প্রফেসর চৌধুরীকে পাঠাতে হবে। প্রয়োজন হলে দুজনের সাথে ফোনে কথাও বলে নেবে। কাল একবার কিউরিও শপটায় যাওয়া দরকার।
(৫)
অনিন্দ্য চলে যেতেই মূর্তির কাছে এসে দাঁড়ালো প্রতিম। মূর্তিটাও তার দিকে একটা কঠোর দৃষ্টি ফেলে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। একলা এই ঘরে, নিভু আলোয় একটা শিরশিরে ভয় ঘিরে ধরতে শুরু করল তাকে। কোন এক মায়াজালে সে যেন আটকা পড়েছে, কিছুতেই দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না ঐ মূর্তি থেকে। তার সারা শরীর ঘেমে যাচ্ছে, কেমন অবসন্ন লাগছে শরীরটা। চোখ বুজে মেঝেতে শুয়ে পড়ল প্রতিম।
মেঝেতে শুয়ে থাকাকালীন অনেকগুলো চিন্তা তার মাথায় এল। কি করবে সে মূর্তিটা নিয়ে। অনিন্দ্য কি সন্দেহ করছে কে জানে? শহরের আশ্চর্য মৃত্যুর পিছনে মূর্তিটা দায়ী হতে পারে না। কিন্তু একটা বিশেষ কারণে মূর্তিটাকে সে নষ্ট করতে বা ফেলে দিতে পারবে না। আবার প্রতিনিয়ত এই ভয়ংকর মূর্তি দর্শন করাও তার পক্ষে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। তার চেয়ে ভালো আলমারিতে তুলে রাখবে সে মূর্তিটাকে। কথাটা ভেবে খানিকটা নিশ্চিন্ত হল প্রতিম।
একটু পরে প্রচণ্ড ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা অনুভব করল সে। অনিন্দ্যর সাথে গল্প করতে করতে সে ভুলেই গেছে, আজ তো ঘরেও কোন খাবার নেই। এখন রান্না করা অসম্ভব, যা জোর খিদে পেয়েছে। আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। পেটের কোনায় একটা ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। কালবিলম্ব না করে গায়ে জামা গলিয়ে, দরজায় তালা ঝুলিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল। আজ বাইরের কোন হোটেলেই খেতে হবে। একটু জল খেয়ে বেরোলে ভালো হত, তৃষ্ণায় গলাটা একেবারে শুকিয়ে আসছে।
(৬)
রবিবার একটু বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠে অনিন্দ্য। আজ ঘুম ভাঙতেই একটা সন্দেহের বশে টিভির সুইচ অন করে দিল। আর খবরটা চোখে পড়তে সে প্রায় আঁতকে উঠল। আবার খুন হয়েছে শহরের অন্ধকার গলিপথে। রাস্তার উপর দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে আছে দেহটা। বিচ্ছিন্ন মাথাটা পাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে। শরীর রক্তশূন্য। ইনসেটে মৃত লোকটার ছবি দেখতেই তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ইনি যে কালকের অন্ধকার রাস্তায় দেখা হওয়া সেই মানুষটা, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আর স্থির থাকতে পারল না অনিন্দ্য। উত্তেজনায় তার সারা শরীর কাঁপছে। যে রাস্তায়, যে সময়ে সে কাল রাতে হেঁটেছে, সেখানেই তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটেছে ঘটনাটা। এমনকি লোকটার সাথে সে কথাও বলেছে। কোনোভাবে পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে না তো! গতকাল মূর্তির ছবিগুলো সে প্রফেসর চৌধুরী এবং ইন্সপেক্টর রাজীবকে পাঠিয়েছিল। প্রফেসরকে সে তার সন্দেহের কথাও জানিয়েছে। রাজীব গতকাল ব্যস্ত থাকায় তার সাথে কথা হয়নি। আজ আবার সে ফোন করল রাজীবকে।
দু-তিনবার রিং হতেই ফোনটা রিসিভ করল রাজীব। অনিন্দ্য তাকে সবকিছু খুলে বলল। নিজের সন্দেহ থেকে শুরু করে গতকালের ঘটনা অবধি সবকিছু। শুনে কিছুটা অবাক হল রাজীব। অনিন্দ্য বলল, যে কিউরিও শপ থেকে প্রতিম মূর্তিটা কিনেছে সেখানে সে একবার যেতে চায়, তার থেকে জানতে চায় মূর্তিটার সম্পর্কে। রাজীব তার সঙ্গে গেলে ভালো হয়। এই ব্যাপারে তারও যদি কিছু জানার থাকে জেনে নিতে পারবে। এই কেসটা নিয়ে বিগত একমাস ধরে রাজীব নাজেহাল। কোনভাবে কোন কিনারা করতে পারছে না। এই সূত্র ধরে যদি কোন লিড পাওয়া যায়, ভেবে সে রাজি হয়ে গেল। দোকানের সামনে কখন দাঁড়াবে, জানিয়ে ফোন কেটে দিল।
অনিন্দ্য চটপট তৈরি হয়ে নিল। প্রাতরাশ সেরে সে রওনা দিল কিউরিও শপের উদ্দেশ্যে। দোকানের সামনে এসে দেখল রাজীব তার আগেই সেখানে উপস্থিত হয়েছে। দু’জন মিলে দোকানে প্রবেশ করল। এদিক ওদিক কিছুক্ষণ ঘুরে, এটা ওটা জিনিস হাতড়ে দোকানী লোকটার কাছে এসে আসল কথাটা বলল রাজীব।
দোকানে পুলিশ ঢুকতে দেখে এমনিতেই একটু হকচকিয়ে গেছিলেন শশোধরবাবু। কিন্তু মূর্তির ব্যাপারে জানতে চাইছে দেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন। এইসব দোকানে কিছু বেয়াইনি জিনিসও থাকে। তাই পুলিশ দেখলে ভয় পাওয়ারই কথা। শশোধরবাবু সবকিছুই বললেন। মূর্তিটা কবে, কিভাবে পেয়েছেন, কত দামে কিনেছেন, কত দামে বিক্রি করেছেন, কাস্টমার যে তার দোকানে নতুন, এমনকি মূর্তির মাথা খোলার ব্যাপারে সাপ্লায়ার ছেলেটার কি সতর্কতা ছিল এবং তিনি তা লঙ্ঘন করেছেন সবকিছু জানালেন তিনি। শেষে সাপ্লায়ার এবং কাস্টমারের কন্টাক্ট ডিটেইলসও দিলেন পুলিশকে। তারপর আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন স্যার কিছু সমস্যা হয়েছে?”
রাজীব ব্যাপারটাকে হালকা করে দিয়ে বলল, “না না সেরকম কিছু নয়। জাস্ট একটা এনকোয়েরি, একটা ইনভেস্টিগেশনে কাজে লাগবে।” ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে এল অনিন্দ্য এবং রাজীব।
রাস্তায় বেরিয়ে রাজীব বলল, “দেখ অনিন্দ্য আমি এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করিনা যে একটা রাক্ষসের মূর্তি জীবন্ত হয়ে গিয়ে মানুষ মেরে রক্ত খাচ্ছে। আবার তোর সন্দেহ উড়িয়েও দিচ্ছিনা। অলৌকিক কিছু না হোক, খুনের সাথে এই মূর্তি বা মূর্তির মালিকের কোন সম্পর্ক থাকতেই পারে। কারণ মূর্তির সাথে সাথে ছেলেটাও শহরে নতুন এসেছে। আর তারপর থেকেই ঘটছে এইসব ঘটনা। সিরিয়াল কিলিং এর কেস বলে মনে হচ্ছে। প্রতি শনিবার ঠিক রাত নটা থেকে দশটার মধ্যে একইভাবে খুন। আমি কালই ঐ সাপ্লায়ার ছেলেটার সাথে যোগাযোগ করছি। সবকিছু খবর নিয়ে তোকে জানাব। সাবধানে থাকিস।” রাজীব নিজের গাড়িতে উঠে বসল। অনিন্দ্যও বাড়ির পথ ধরল। মূর্তির মাথা খোলার কথাটা শুনে তার মনটা খচখচ করছে। পকেট থেকে ফোন বার করল সে। প্রফেসরকেও সবকিছু জানানো দরকার।
(৭)
দেখতে দেখতে একটা সপ্তাহ কেটে গেছে। শরতের আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের আড়ালে রোদ ঝলমল করছে। আরেকটা শনিবার উপস্থিত হয়েছে। অনিন্দ্য আজ অফিসে যায়নি। কথামতো বিকেলের দিকে এসে হাজির হয়েছে প্রফেসর চৌধুরীর বাড়িতে। মূর্তিটার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে অনেককিছু জেনেছেন তিনি।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অনিন্দ্যকে বুঝিয়ে বললেন সব কথা, “এই মূর্তি কোন সাধারণ মূর্তি নয়। বিশেষ পাথর দিয়ে বিশেষ নক্সায় তৈরি করা হত এই মূর্তি। প্রাচীন ঋষিরা দুষ্টু আত্মাদের কয়েদ করে রাখার জন্য এইধরনের মূর্তি ব্যবহার করতেন। এসব এতদিন নিছক গল্প বলেই লোকে মনে করত। বাস্তবে যে মূর্তির অস্তিত্ব থাকতে পারে তা সকলের ভাবনার অতীত। ইচ্ছা করেই মূর্তির রূপ বীভৎস করা হত যাতে সাধারণ মানুষ এর থেকে দূরে থাকে। আত্মাকে পুনরায় বশ করার জন্য মন্ত্র লেখা হত মূর্তির গায়ে। তোমার পাঠানো মূর্তির গায়েও সেরকমই মন্ত্র লেখা আছে। আমার এক পুরাতাত্ত্বিক বন্ধুর কাছ থেকে জেনেছি এইসমস্ত কথা এবং এক ভাষাবিদ বন্ধুর থেকে ঐ ভাষা পাঠোদ্ধারও করেছি।”
কথাবার্তা বলতে বলতে দিনের আলো নিভে গিয়ে সন্ধ্যা নামল। অনিন্দ্য বলল, “তার মানে, ঐ মূর্তি থেকে কোন শয়তান আত্মা বেরিয়ে এইসব ঘটনা ঘটাচ্ছে! আচ্ছা প্রফেসর, আমরা তো মূর্তিটা নষ্ট করে দিতে পারি অথবা মন্ত্র পড়ে ঐ আত্মাকে আবার মূর্তির মধ্যে বন্দী করতে পারি।” প্রফেসর বললেন, “এটা অনেকটা বুমেরাং এর মত। সেই আত্মা যদি নিজে মূর্তিটা নষ্ট করে, তাহলে সে তার সমস্ত অলৌকিক শক্তি হারাবে। আবার আমরা যদি নষ্ট করি তাহলে তাকে আর কোনদিন বন্দী করা যাবে না। আর মন্ত্র পড়তে হবে সেই আত্মার সম্মুখেই।”
অনিন্দ্য আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় রাজীবের ফোন এল। সে ফোনটা রিসিভ করে স্পিকার অন করল। ওপাশ থেকে রাজীবের কথা ভেসে এল, “ভাই অনিন্দ্য, তোর মূর্তির ব্যাপারে অনেক তথ্য পেয়েছি। ওড়িশার এক প্রাচীন রাজবাড়ির সমস্ত পুরানো জিনিস নিলামের সময় ঐ মূর্তিটা অ্যান্টিক সাপ্লায়ার ছেলেটার হাতে আসে। আমি নিজে টীম নিয়ে সেখানে গেছিলাম। রাজবাড়িটা আজ ভগ্নপ্রায়। কেউ থাকেনা সেখানে। পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের ছেলমেয়েদের মূর্তিটা অপছন্দ ছিল, তাই তারা ওটা বিক্রি করে দেয়। তবে নিজেরা কুসংস্কারে বিশ্বাস না করলেও জানিয়ে দেয়, এই মূর্তির মাথার অংশটা খোলা বারণ, খুললে নেমে আসবে ঘোর অমঙ্গল।”
এতটা বলে সে একটু থামল। তারপর আবার বলল, “আরেকটা কথা শোন। খুনের স্পটগুলো যদিও খুব অন্ধকার ছিল। তবে তার আশেপাশে একটা ছেলেকে আবছা দেখা গেছে। তার চেহারার সাথে তোর ঐ অফিস কলিগের অনেকটা মিল। এখন সাতটা বাজে। আমি বাড়িতেই আছি। তুই ঘন্টাখানেকের মধ্যে চলে আয়, তারপর টীম নিয়ে একসাথে বেড়াবো। এইরে, আমার অ্যাপার্টমেন্টে আবার লোডশেডিং হয়ে গেল। ফোন রাখছি, তুই চলে আসিস। কে, কে ওখানে?” কথা শেষে রাজীবের উত্তেজিত গলায় এতটুকু শোনার পরেই ফোনটা কেটে গেল।
রীতিমত শিহরণ খেলে গেল অনিন্দ্যর শরীরে। প্রফেসর বললেন, “এখনই বেরোতে হবে, আর দেরী করা ঠিক হবে না।” প্রফেসর তৈরি হয়ে নিলেন। বেরোনোর সময় একটা কাগজ ভাজ করে পাঞ্জাবীর পকেটে ভরে নিলেন। রাজীবের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে আসতেই অনিন্দ্যর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। সামনে অনেক ভিড়। একজনের মুখ থেকে যা শুনল, সেই দৃশ্য দেখার সাহস তার আর হল না। রাজীবের পরিণতিও হয়েছে বাকি চারজনের মতোই। বন্ধুর মৃত্যুর শোকে কেঁদে ফেলল সে। প্রফেসর তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, নিজেকে সামলানোর জন্য। দু’জন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে তারা আবার রওনা হলেন প্রতিমের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
অন্ধকারে নিস্তব্ধ প্রেতপুরীর মত দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। আলো নেই, কোন সাড়াশব্দ নেই। অনিন্দ্য, প্রফেসর চৌধুরী এবং দু’জন কনস্টেবল দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঠেলা দিতে বোঝা গেল সেটা ভিতর থেকে বন্ধ। প্রফেসরের চোখের ইশারায় একজন কনস্টেবল একটু পিছিয়ে গিয়ে জোরে ধাক্কা দিল দরজায়। দরজাটা খুলে যেতেই চারজন ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল। কিন্তু সামনে ওটা কে?
ঘরে নিভু আলোয় ওরা দেখল সামনের মেঝের উপর দৈত্যাকার একটা মানবশরীর ছটফট করছে। আর বিড়বিড় করে বলছে, “রক্ত চাই, আরও রক্ত চাই।” ওটা মানুষ না, মানুষ হতে পারে না। প্রতিমের বেশে একটা পিশাচ। হঠাৎ সেই পিশাচটা হিংস্র দৃষ্টিতে তাকালো ওদের দিকে। একটা কনস্টেবল সেদিকে এগিয়ে যেতেই তাকে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে শেষ করে দিল। অনিন্দ্যর মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল শুধু একটা শব্দ, “প্রতিম!” কিন্তু ততক্ষণে একটা হাত ওর গলাটা চেপে ধরে শূন্যে তুলে নিল। অনিন্দ্যর পা দুটো অসহায়ভাবে ছটফট করতে লাগল।
দ্বিতীয় কনস্টেবল পরপর দুবার গুলি চালালো সেই ভয়ঙ্কর দর্শন মানবশরীরটা লক্ষ্য করে। কিন্তু গুলি তো তার গায়ে লাগলই না, আরেক হাত দিয়ে সেই দানব তাকে ছুড়ে ফেলে দিল দরজার বাইরে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তার আর উত্থানশক্তি রইল না। এদিকে প্রফেসর সারা বাড়ি ঘুরেও মূর্তিটাকে কোথাও খুঁজে পেলেন না। খুঁজতে খুঁজতে একটা আলমারির সামনে এসে দাঁড়ালেন। শুনতে পেলেন পাশের ঘরে সেই পিশাচের হুঙ্কার, “তোরা অনেককিছু জেনে গেছিস। তোদের বাঁচিয়ে রাখলে আমার বিপদ। পুলিশটাকে শেষ করেছি, এবার তোর পালা।”
অনিন্দ্যর পায়ের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে এসেছে। চেতনা লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে। ঠিক সেইসময় প্রফেসরের মন্ত্রোচ্চারণ শোনা গেল। তৎক্ষণাৎ গলার কাছে চাপ আলগা হয়ে গেল। অনিন্দ্য মেঝেতে পড়ে হাঁপাতে লাগল। প্রতিমের বিশাল অশরীরী অবয়বটা যেন কোন অদৃশ্য শিকলে বাঁধা পড়েছে ততক্ষণে। ভয়ঙ্কর চিৎকার করে উঠল সে, কিছুক্ষণ ছটফট করল অসহায়ভাবে। তারপর একটা জমাট বাঁধা ধোঁয়ার মত কুণ্ডলী পাকিয়ে প্রবেশ করল প্রফেসরের হাতে ধরা মূর্তির ভিতরে। কাজ শেষ হতেই মূর্তির মাথাটা চেপে আটকে প্যাঁচ ঘুরিয়ে দিলেন প্রফেসর।
(৮)
“তারপর সেই মূর্তি কালো কাপড়ে পেঁচিয়ে বাক্সে ভরে পাথরের সাথে বেঁধে গঙ্গার জলে বিসর্জন।” কথাটা বলে গল্প শেষ করে বড়ো বড়ো চোখ মেলে, মুখে সেই চেনা পরিচিত হাসি মেখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন প্রফেসর চৌধুরী। আমরা এতক্ষণ হাঁ করে তার গল্প শুনছিলাম। আমি বললাম, “শহরে বছর দুয়েক আগে এই রহস্যমৃত্যু এবং জনৈক পুলিশ ইন্সপেক্টরের একইভাবে হত্যার কথা শুনেছিলাম। কিন্তু তার নেপথ্যে যে এরকম ভয়ানক ঘটনা ছিল তা জানা ছিল না।”
সৌম্য জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কিভাবে বুঝলেন, প্রতিমই সেই ভয়ংকর পিশাচ!” প্রফেসর বললেন, “খানিকটা সন্দেহেই বলতে পার। একটা বিষয় প্রথম থেকেই আমার মাথায় এসেছিল। মূর্তি কেনার পর ওর মাথাটা খোলা হয়েছিল, নাকি মাথাটা খোলার পর দোকানে ওর আবির্ভাব ঘটেছিল। এই বিষয়টা জানতেই আমার কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে যায়।”
দীপ সব শুনেও এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন প্রফেসরের একটা কথাও ওর বিশ্বাস হয়নি। সেটা আন্দাজ করেই প্রফেসর উঠে গিয়ে কয়েকটা ছবি এবং একটা ভাজ করা কাগজ নিয়ে এলেন। সেগুলো আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আপাতত এগুলো দেখে রাখ। অনিন্দ্য এখন বিদেশে আছে, সে ফিরলে তোমাদের সাথে আলাপ করিয়ে দেব।” আমরা দেখলাম ছবিগুলো ঐ মূর্তির নিচের অংশের, যেখানে সত্যিই দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু লেখা। আর কাগজে বাংলা হরফে কয়েকটা মন্ত্র লেখা, হয়তো সেই দুর্বোধ্য ভাষারই উচ্চারণ।
বেলা বাড়তে আমরা উঠে পড়লাম। প্রফেসর জ্ঞানী মানুষ। তার কথা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবু যদি নিছক তার কল্পনাও হয়, আমাদের তা শুনতে মন্দ লাগেনা। রবিবার ছুটির দিনে সেই কারণেই আমরা চারবন্ধু মাঝে মধ্যে ছুটে আসি প্রফেসরের কাছে রোমাঞ্চকর গল্প শোনার নেশায়।