মৃত্যুর গন্ধ | ভয়ের দেশ | সুকান্ত ঘোষ| Bengali Horror Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

মৃত্যুভয়ে আঁতকে, চিৎকার করে উঠে বসলো বিপ্র। রাতের ক’টা হবে জানা নেই। মোবাইলের স্ক্রিন অন করে দেখলো রাত আড়াইটা বাজতে চলেছে। কি বীভৎস ছিল স্বপ্নটা। একটা মেয়ে প্রতিদিন এসে ফুল দিয়ে যায় বিপ্রকে। কি যে বন্য ফুল বিপ্র নাম জানে না তার। সূর্যমুখী ফুলের মতো দেখতে তবে রংটা বেগুনী আর আকারে ওই গাঁদা ফুলের মতো। মেয়েটি যে কে, তাকেও চেনে না বিপ্র। কিন্তু ফুলের গন্ধটা মাতাল করে দেয় বিপ্রকে। আহা জেনো শত শত বনমল্লিকা ঘিরে আছে ওকে। বা মনে হয় জেনো ও ঢুকে পড়েছে কোনো ল্যাবে যেখানে সুগন্ধি ম্যানুফ্যাকচারিং হচ্ছে। আর সেই গন্ধসাগরে ডুব দিয়ে বারে বার হারিয়ে যায় বিপ্র। হারিয়ে যায় কোনো রূপকথার জগতে। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। এই পর্যন্ত ও মাঝে মাঝেই দেখতো। না এটাকে কোনও সমস্যাই বলে মনে করতো না বিপ্র। কেনোই বা করবে? যে যে দিন এই স্বপ্ন আসতো সেদিন সেদিন ঘুমটাও হতো খুব গাঢ়। তাই একরকম উপভোগই করতো বিপ্র এই ব্যাপারটা। কিন্তু আজ যা দেখলো সেটা দ্বিতীয় বার ভাবলেও আর্তনাদ করে উঠছে ওর অবচেতন মনের প্রতিটি স্তর। আর যাই হোক মৃত্যুভয়কে কজনই আর জয় করতে পারে। আজকেও স্বপ্নে প্রতিবারের সেই অচেনা অদেখা মেয়েটি এক মায়াবী হাসি হাসতে হাসতে বিপ্রকে এক গোছা ফুল দিয়ে গেলো। কিন্তু আজ হঠাৎ বিপ্রর দু’হাতের মুঠোর মধ্যে থেকে ফুলগুলো আকারে বড়ো হতে হতে বিপ্রর মাথা ছাড়িয়ে চলে গেলো আর তারপরই ফুলের গর্ভাশয়ের জায়গা থেকে একটি বিরাট হা এর সৃষ্টি হয়ে অতর্কিতে গিলে নিলো বিপ্রর মাথা। ব্যস এর সাথে সাথেই স্বপ্নভঙ্গ। ভাগ্যিস স্বপ্নটা ভেঙেছিল। এরপরে কে জানে আর কি ভয়ংকর দৃশ্য অপেক্ষা করছিল ওর জন্য। কোনোরকমে সেই রাতটা পার করলো বিপ্র।

গোটা কলকাতা শহর জুড়ে তোলপাড়, আতঙ্ক। পুলিশ প্রশাসন নাওয়া খাওয়া ছেড়ে রাতদিন জুড়ে রয়েছে একটাই কাজে। উপরমহল থেকে বিরামহীন খবরদারি। অথচ জবাবদিহির কোনো জায়গা নেই। কি করেই বা জবাব দেওয়া যায়, সাধারণ মানুষের মতো তদন্তকারী অফিসারও এক বিরাট ধোঁয়াশায় জড়ভরত অবস্থা। পাঁচ দিনের মধ্যে পৃথক দু’টি ঘটনায় প্রায় শ’খানেক লোকের প্রাণ চলে গেছে এবং সেটাও এক রহস্যজনক ভাবে। আগে শহরের এক নামী ব্যাংকে তারপর সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরতি লোক ভর্তি বাসে। আর দু’টো ঘটনায় এখনও পর্যন্ত যতদূর বোঝা গেছে কোনো এক অদৃশ্য শক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়ে ওই সমস্ত মানুষগুলো আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। আর সেখানেই রহস্য। একসাথে এতগুলো মানুষ কিভাবে স্বেচ্ছায় আত্মহননের পথ বেছে নিল। প্রথম ঘটনায় তিনতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় অবস্থিত ব্যাংকের তেরো জন কর্মী আর ওই মুহূর্তে ব্যাংকে উপস্থিত পঁয়ত্রিশ জন গ্রাহক প্রত্যেকেই তিনতলার উপরের খোলা ছাদে উঠে সেখান থেকে নিচে লাফ মারে। ওই ঘটনায় প্রায় প্রত্যেকে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। চার জন আই সি ইউ তে লড়াই চালালেও তিনদিন পর তাদেরও একই পরিণতি হয়। এই ঘটনার দু’দিন পার করতে না করতেই আবারও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এইবারে দেখা যায় ব্যস্ততম হুগলী ব্রিজে একটি বাস হঠাৎ তার সামনের একটা গাড়িতে ধাক্কা মেরে থেমে যায় আর তারপর এক এক করে বাসের সমস্ত যাত্রীরা সেই ব্রিজের নিচ থেকে বয়ে যাওয়া নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই দু’টি ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই গোটা শহর এক প্রকার স্তব্ধ হয়ে যায়। মানুষ এতটাই ভীত হয়ে পড়ে যে অনেকে বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দেয়। এই অজ্ঞাত অনাসক্ত শত্রু কখন কোথায় আক্রমণ করবে কেই বা বলতে পারে! এমতাবস্থায় তদন্তকারী অফিসার দেবেন্দ্র ধর হসপিটালে এসেছেন। ঠিক দু’দিন আগে জলে ঝাঁপ দেওয়ার ওই ঘটনাতে কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তাদের এখন জ্ঞান ফেরায় হসপিটাল থেকেই ফোন করা হয়েছিল অফিসার ধরকে। কিন্তু হসপিটালে এসে পৌঁছনোর পর ডাক্তারের কাছে জানতে পারলো তারা আবারও মূর্ছা গেছে। কিন্তু যেসময় টুকু জ্ঞান এসেছিল তখনও তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। ঘোলা চোখে দু’হাত বাড়িয়ে ছুটে যেতে চাইছিল অদৃশ্য কোনো কিছুর উদ্দেশ্যে। এদিকে দুদিন পেরিয়ে গেলেও আগেরটার মতো এবারেও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসতে দেরি হচ্ছে। ফলে ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে অফিসার ধর ফিরে এলেন থানায়। থানায় এসে দেখলেন কিছু প্রত্যক্ষদর্শী যারা ওভারব্রিজে ওই ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল তাদের আনা হয়েছে। ওদের জিজ্ঞাসাবাদে যা জানা গেলো তা হলো এই বাসের প্রত্যেক যাত্রী এমন ভাবে সামনের দিকে ছুটছিল যেনো কাউকে তাড়া করছে আর সেটাতে কোনো ক্লান্তি নেই, দুশ্চিন্তা নেই সবাই বেশ প্রসন্ন মুখে হাসতে হাসতেই এটা করছিল। একজন মোবাইলে এই ঘটনা রেকর্ড করেছিল, সেখানে যা দেখা যাচ্ছে তা প্রত্যেকের বর্ণনার সাথে মিলে গেলো। তবে এর মধ্যে একজন নতুন তথ্য দিয়ে বললো “স্যার আমি ছিলাম ট্যাক্সিতে। আমি আর আমার অফিস কলিগ একসঙ্গে বাড়ি ফিরছিলাম। এমন সময় হঠাৎ জ্যাম হয়ে যায় আর তার সাথেই বাইরে থেকে অনেক চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমরা টাক্সি থেকে নেমে এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে তো অবাক। আমার সঙ্গীটি তখন ওই সাংঘাতিক ব্যাপার দেখে বাস থেকে নেমে জলে ঝাঁপ দিতে যাওয়া একজনকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে।” অফিসার ধর বেশ আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করলো “তারপর?” তখন লোকটি বললো “তারপর তো স্যার দেখলাম আমার সঙ্গীটি দৌড়ে গিয়ে আটকাতে চেষ্টা করলো বটে কিন্তু সে একার শক্তিতে ওই লোকের সাথে পেরে উঠছিল না। সেই না দেখে আমিও শেষে গেলাম। কিন্তু স্যার, অবাক কাণ্ড! ওই লোকটার গায়ে তখন এত জোর কোথা থেকে এল কে জানে! সে আমাদের দু’জনকেই ছিটকে ফেলে দিল। আমি তো ব্রিজের উপরেই পড়লাম কিন্ত ওই লোকটা আমার বন্ধুকে নিয়ে একসাথে জলে গিয়ে পড়লো। অফিসার ধর উত্তেজিত ভাবে এবার জিজ্ঞেস করলো “আপনার বন্ধুর কি খবর? এখন কোথায় আছে?” সে এখন হসপিটালে আছে এই কথা শুনে অফিসার ধর আবারও এই লোককে নিয়ে ছুটলো হসপিটাল। অফিসারের মনে তখন কিছু হদিস পাওয়ার আশা। যদি আর কিছু নতুন তথ্য পাওয়া যায়। হসপিটালে গিয়ে খোঁজ করতেই পাওয়া গেলো সেই লোকটিকে। ডাক্তার জানালো অন্যান্য রুগীদের মতো এর কোনো অস্বাভাবিক অনুসর্গ নেই। তবে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে যে কারণে খানিকটা ট্রমার মধ্যে ছিল তবে সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে। ফলে ডাক্তারের কাছ থেকে জেরা করার অনুমতি পাওয়া গেলো। অফিসার ধর ধীরে ধীরে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। কথা বলে যা বুঝলেন এনার কথায় আর প্রতক্ষ্যদর্শীদের কথাতে কোনো পার্থক্য নেই কেবলমাত্র একটা জিনিস বাদে। আর সেটা হলো গন্ধ। ওনার কথামতো ইনি যখন প্রথম দৌড়ে গিয়ে নিচে ঝাঁপ দেওয়া থেকে আটকাতে একজনকে চেপে ধরেছেন তখন সামান্য একটা মিষ্টি গন্ধ তার নাকে এসেছিল। ব্যাস, এই টুকু। এবার অফিসার ধর আবার ছুটলেন থানায়। তবে যাওয়ার আগে ডাক্তারের কাছে পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট চলে এসেছে জানতে পেরে, রিপোর্টার এক কপি সঙ্গে নিয়ে গেলেন। যে বাসে এই ঘটনাটা ঘটেছিল সেটা থানাতেই রাখা ছিল তদন্তের জন্য। যদিও বাসটি পরীক্ষা করে তেমন কিছুই উদ্ধার হয়নি। তবু অফিসার ধর এবার নিজে গেলো। কারণ প্রথমবার সে নিজে উপস্থিত ছিলেন না, কাজটি তার এক সহকারী অফিসার করেছিল। কিন্তু এবারেও ফল তাই হলো। বাসের ভেতর সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেলো না। এবার তিনি তার সহকারী অফিসার রাউতকে ডেকে পাঠালেন যিনি এই বাসটি পরীক্ষা করেছিল তার আগে। রাউত আসলে পরে সিনিয়র অফিসার ধর জানতে চাইলেন ঠিক কি কি জিনিস পাওয়া গেছে ওই বাসের ভেতর থেকে সেগুলো আনবার হুকুম দিলেন। দু’টো অফিস ব্যাগ, একটা লেডিস ব্যাগ, একটা বাসের টায়ার যা কিনা ছিল ড্রাইভারের সিটের পিছনের ফাঁকা জায়গায়। আর দু’টো জলের বোতল, একটা খালি চিপসের প্যাকেট আর একটা নতুন কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল আর কিছু ছেঁড়া টিকিট। না গন্ধ সৃষ্টি করতে পারে এমন কিছুই তো এগুলোর মধ্যে নেই। এবার জানা গেলো ওই ব্যাগগুলো অনুসন্ধান করে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। কিছু টাকা-পয়সা ছিলো আর যা কাগজপত্র যা কিছু উদ্ধার হয়েছিল সেগুলোর ভিত্তিতে তদন্ত করে কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে ব্যাগের মালিক বা এখন তাদের অবর্তমানে তাদের ঠিকানায় গিয়েও অনেক খোঁজ নেওয়া হয়েছে কিন্তু ফলাফল জিরো। অফিসার ধর এবার ওই উদ্ধার হওয়া জলের দু’টো বোতল, একটা চিপসের প্যাকেট আর একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল ওগুলোকে ফরেনসিক টেস্টের জন্য পাঠিয়ে দিয়ে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলেন। এরপর চোখে মুখে একটু জল দিয়ে এলেন। বুঝতে পারছেন না এই জট খুলবেন কি করে। প্রথমে ব্যাংকের ঘটনাতেও কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অপরাধীর হদিস মেলেনি। কেবল ব্যাংকের সি সি টিভি ফুটেজে দেখা গেছিলো লোকগুলো পাগলের মতোন কেবল ছাদে ওঠার সিঁড়ি দিকে ছুটছে। মুখ মোছবার জন্য রুমাল বের করতে পকেটে হাত দিয়েই মনে পরে গেলো হসপিটাল থেকে আনা পোস্টমর্টেমের রিপোর্টের কথা। রিপোর্ট বের করে দেখলেন ঠিকই কিন্তু নিরাশ হতে হলো। আগের বার ব্যাংকে যে মানুষগুলো মারা গেছিলো তাদের বেলাতেও এই রেজাল্ট এসেছিল। পাকস্থলীতে কিছুই পাওয়া যায়নি অথচ রক্তে এক “unidentified element” যার অস্তিত্ব এখনো বিজ্ঞান খুঁজে পায়নি। আদা দেওয়া লিকার চা চলে এলে পরে অফিসার ধর বসলেন বাসের রুটের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে। বাসটি অর্ধেক পথও পেরোয়নি আর তার মধ্যেই এই দুর্ঘটনা। যে রাস্তাটুকু বাসটি এগিয়েছিল তার সব ফুটেজ হাতে না পাওয়ায় ফুটেজগুলো পরীক্ষা করা হয়নি। আজ অফিসার রাউতকে নিয়ে অফিসার ধর সেই কাজেই লেগে পড়লেন। বাস ডিপোতে থেকে বাসটি মোটামুটি ভর্তি হয়েই বেরিয়েছিল। এরপর দেখা গেলো দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত বাসে কেউ ওঠানামা করেনি। দেড় কিলোমিটার পরের এক স্টপেজে একজন মহিলা একটা বাচ্চাকে নিয়ে উঠলেন এবং বাচ্চাটার হাতে একটা চিপসের প্যাকেট। কিন্তু ১৫ মিনিট ট্রাভেল করেই তারা নেমে পড়লেন। তখন কিন্তু আর বাচ্চাটির হাতে সেই চিপসের প্যাকেটটা ছিল না। অফিসার ধরের তখন বুঝতে অসুবিধা হলো না যে দুর্ঘটনার পর বাস থেকে উদ্ধার হওয়া সেই চিপসের প্যাকেটের উৎস হলো এটিই। এদিকে ওই মহিলা নেমে যেতেই সেই স্টপেজে এতো বেশি সংখ্যক যাত্রী উঠলো যে সবাইকে চিহ্নিত করা সম্ভব হলো না। এরপর বাসটি থামলো একেবারে সেই ব্রীজের ওঠবার মুখে, সেখানে একটা লোক নেমে গেলো আর তারপর বাসটি ব্রীজের মাজা বরাবর আসতেই এই অসম্ভব ঘটনা। এই বার লেগে পড়তে হবে সেই দু’জন মানুষের খোঁজে যারা পারে এই রহস্যের কিছুটা হলেও পথ দেখাতে। এক হলো সেই বাচ্চাসহ মহিলাটি আর একজন সেই ব্যক্তি যে ব্রীজের আগেই নেমে পড়েছিলেন। ওদের দু’জনের খোঁজ শুরু হয়ে গেলো সেদিন রাত থেকেই। পরের দিন বিকেলে ফরেনসিক বিভাগ থেকে এক চমকপ্রদ খবর এলো এই যে ক’টি জিনিস ল্যাবে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল — চিপসের প্যাকেট, জলের বোতল; তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি কেবল কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলের মধ্যেও আশ্চর্যজনক ভাবে সেই একই পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে যেটা মৃত মানুষগুলোর রক্তে পূর্বেই পাওয়া গেছিলো। অর্থাৎ এই মুহূর্তে সবার আগে খুঁজে বার করতে হবে যে ওই কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলের মালিক কে। যদি কোনোভাবে সেটা বের করা যায় তাহলেই এই জীবন মরণ খেলায় বাজিমাত করা সম্ভব হবে। এদিকে দুদিনের মধ্যে ওই মহিলার খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়েছে। অফিসার ধর তাই সেখানেই আগে গেলেন। তার নাম দীপ্তি ব্যানার্জী। মেয়েকে নিয়ে সেদিন নাচের ক্লাস গিয়েছিলেন। বাড়িতে পুলিশ দেখে স্বাভাবিক ভাবেই প্রথমে একটু চমকে গিয়েছিলেন। তবে অফিসারের মুখে সমস্ত কিছু শুনে নিজেই পরে আগ্রহ নিয়ে সমস্ত কিছু জানালেন। অফিসার ধর জিজ্ঞেস করলো “আচ্ছা ভালো করে মনে করুন বাসে কারো কাছে কি কোল্ড ড্রিঙ্কসের কোনো বোতল দেখেছেন?” ভদ্রমহিলা কিছুক্ষন ভাবলো কিন্তু উত্তরে জানালো যে তেমন কারো কাছেই তিনি তেমন বোতল দেখেননি। বরং বাসের কন্ডাক্টরকে দেখেছেন বোতলে জল খেতে আর সেটা বাসের মধ্যেই রাখা ছিল। “আচ্ছা কোনরকম কিছু অস্বাভাবিক কিছু?”- অফিসারের এই প্রশ্নের জবাবও কিছু আশাপ্রদ হলো না। তিনি বললেন “আসলে আমি বাসে উঠলে এক ভদ্রলোক লেডিস সিটে বসে ছিলেন, সে উঠে আমায় জায়গা দিলে পরে আমি আমার মেয়ের সাথে খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। যে কারণে তেমন ভালো করে খেয়াল করতে পারিনি। আর তাছাড়া কেই বা বিপদের আঁচ করতে পারে আগে থেকে বলুন।” না এনার কাছে আর কিছুই জানার নেই দেখে শুরু হলো দ্বিতীয় জনের খোঁজ। খুব ভালো করে ভিডিও ফুটেজটি আবারও খুঁটিয়ে দেখে আবিষ্কার করা গেলো লোকটি একটি পিংক কালারের টি-শার্ট পরে ছিল, চোখে চশমা। সঙ্গে ব্যাগ জাতীয় কিছুই ছিল না। এবারে অনুসন্ধান শুরু হলো লোকটি যেখানে নেমেছে ঠিক সেখান থেকে। অনেক খোঁজ করে শেষে এক অটোওয়ালার কাছে জানা গেলো যে হ্যাঁ সে চোখে চশমা গোলাপী রঙের জামা পড়া একটি লোককে একটি বিশেষ জায়গায় ছেড়ে দিয়ে আসে। অটোওয়ালা-এও বললো “লোকটা পাগল, স্যার মাথায় ছিট আছে। নাহলে অকারণে শুধু শুধু হাসে কেউ। তার উপর ৫০ টাকার ভাড়া ২০০ টাকার একটা নোট দিয়ে চলে গেলো।” এতক্ষনে হয়তো ঠিক জায়গায় তির বিঁধেছে। উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে অফিসার ধর। একটুও দেরি না করে ওই অটোওয়ালার দেখানো পথে নিয়ে গিয়ে দেখলো একটি অভিজাত আবাসনের সামনে এসে হাজির হয়েছে ওরা। এরকম একটা জায়গায় যেখানে সমাজের নামী দামী লোকেদের বাস সেখানেই এমন এক দুষ্কৃতীর থাকে। এই ভেবে অবাক হলেন অফিসার ধর। এরপর সেই আবাসনের রিসেপশনে রেজিষ্টার ঘেঁটে অটোওয়ালার বর্ণনা অনুযায়ী একজনকে খুঁজে পাওয়া গেলো আর ছবি দেখে অটোওয়ালা সেই একই ব্যক্তি বলে সনাক্ত করলেন। নাম: বিপ্র চৌধুরী। একজন কর্পোরেট ল-ইয়ার। এখানে একাই থাকে। টাওয়ার ফাইভের নঃ থার্টিন ফ্ল্যাট। সদলে পৌঁছে গেলো অফিসার ধর। একটু দেরি করেই দরজা খুললো সেই বিপ্র চৌধুরী। বয়স বেশি নয়, ৩০ এর মধ্যেই। তবে মনে হলো ড্রিংক করে আছে। যারা এসেছে তারা যে পুলিশ সেটা বুঝতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেলো। তবে তারপর অফিসার ধরের পর পর করে যাওয়া সমস্ত প্রশ্নেরই জবাব দিলো। প্রশ্নোত্তর পর্ব এরকম ছিল –

আপনি জানেন দু’দিন আগে যে সন্ধ্যেবেলায় যে বাসে চেপে ফিরছিলেন সেটায় এক ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটে গেছে?

হ্যাঁ আমি শুনেছি অত্যন্ত মর্মান্তিক মৃত্যু।

তা আপনি আপনার গন্তব্যে না নেবে আগে নেমে পড়লেন যে?

হ্যাঁ আমার একটা বিশেষ দরকার ছিল। সেটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত। দয়া করে চাপ দেবেন না। বলতে পারবো না।

আপনি তো ল-ইয়ার। গাড়ি না নিয়ে বাসে যাতায়াত করেন?

হ্যাঁ এতদিন কাজ করে এই সবেমাত্র ফ্ল্যাটটি নিয়েছি তাই আর কি…

আচ্ছা আর কেউ নেই আপনার পরিবারে? কাউকে দেখছি না।

না আমার বাড়ি পুরুলিয়া। সেখানেই সবাই আছে।

পুরুলিয়া কোথায়?

বাঘমুণ্ডি, বলরামপুর।

তারপর অফিসার ধর অ্যাকসিডেন্ট সম্মন্ধীয় সেই প্রথম মহিলার মতো একই কিছু প্রশ্ন করলো কিন্তু কার্যকরী কোনো তথ্যই পাওয়া গেলো না। সেও দেখেনি তেমন কাউকে যার কাছে কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল আছে। শেষে ওখানে থেকে ফিরে আসতেই হলো। তবে ফিরে আসার আগে ওনার থেকে ওনার মোবাইল নঃ টা নিয়ে ওনাকে বলা হলো যেনো উনি বিনা নোটিসে শহর না ছাড়ে।

পুলিশ চলে গেলে অট্টহাসিতে ফেটে পরলো বিপ্র। কেঁপে উঠলো ঘরের চার দেওয়াল। চিৎকার করে বলে উঠলো বিপ্র “পৃথিবীর কোনো শক্তি পারবে না, আমার কিছু করতে পারবে না। কি ঠিক বলিনি? এই বলে ও পকেট থেকে একটা ছোট কাঁচের শিশি বের করে তার দিকে তাকিয়ে আবারও ভয়ানক হাসি হাসতে লাগলো। পরক্ষণেই হাসি থামিয়ে উৎকণ্ঠায় বলে উঠলো, কিন্তু আমি তো আমি তো এতো গুলো মানুষকে মারতে চাইনি। ফুলম যে বললো শুধু যে আমার ক্ষতি করবে তাকে শুধু শাস্তি দেবে। আর তাছাড়া শাস্তি যে মৃত্যু তাও এতো গুলো প্রাণ। না না আজকেই আমি যাবো ফুলোমের কাছে আজকেই এক্ষুনি।

অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে এক ছোট্ট গ্রাম। দুসপ্তাহ আগে সে দেশের বাড়িতে গিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল সেখানে। আর সেখানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ও থমকে যায়। থমকে যায় জঙ্গলে ঘেরা একটা জায়গায়। অন্ধকার, বনটা সত্যিই একটু ঘন। স্থানীয় লোকেরা বললো এটি নিষিদ্ধ একটা গোরস্থান। এখানে প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু কেন নিষিদ্ধ তা বলতে পারলো না। পারলো না যখন সেই দায়িত্ব বিপ্র নিয়ে নিল নিজের মাথায়। আর নিতেই হতো। কারণ ও যে সেই স্বপ্নের গন্ধটা এখানে পেয়েছে। যে গন্ধ মাতোয়ারা করে তোলে ওকে। কিন্তু সেটা যে বাস্তবে থাকতে পারে তা কল্পনা করেনি বিপ্র কখনো। আর একবার যখন দেখা পেয়েছে তার উৎস না দেখে সেটা প্রত্যক্ষ না করে কি আর থাকা যায়। তাই এক রাতে লুকিয়ে পৌঁছে যায় সেই জঙ্গলে ঘেরা গোরস্থানে।

রাতে আসবে বলে বিপ্র সঙ্গে একটা হাই ভোল্টেজ এল. ই.ডি টর্চ এনেছিল। যদিও দু’দিন আগেই পূর্ণিমা ছিলো তবুও অন্ধকার অতটাও জোরালো নয়। তবু টর্চের আলো ফেলে বিপ্র দেখছে সত্যি সত্যি এক একটা গাছের গোড়ায় ক্ষয়ে যাওয়া এক একটা ইটের সমাধি গুলো, এমন সময় হঠাৎ এক নারী কণ্ঠের চিৎকারে চমকে ওঠে বিপ্র। পিছন ঘুরে দেখবার আগেই এক মেয়ে ছুটে এসে ধাক্কা মেরে নিজেও ছিটকে পরে যায় সঙ্গে সঙ্গে বিপ্রকেও ফেলে দেয় মাটিতে। বিপ্র মাটি থেকে উঠে কিছু বলার আগেই বলে ওঠে মেয়েটি “কিছু মনে করো নি গো। আহা লাগেনি তো। আসলে এক শিয়াল তাড়া করেছিল তো। তাই ভয়ে দৌড়ে ছিলাম।” বিপ্র দেখলো মেয়েটির পরনে ব্লাউজ, ঘাগড়া আর মুখ ঢেকে রেখেছে একটা ওড়না দিয়ে। ওড়না ধরা হাত দু’টো দেখে বিপ্রোর বেশ চেনা চেনা লাগলো। কিন্তু মুখে বললো “আচ্ছা সে তো বুঝলাম কিন্তু এতো রাতে এই জঙ্গলে কি করছো? কে তুমি? আর তাছাড়া এই জঙ্গলটা শুনেছি পরিত্যক্ত।” মেয়েটা যা উত্তর দিলো তাতে বিপ্র অবাক না হয়ে পারলো না। মেয়েটার নাম ফুলোম। মেয়েটাকে নাকি গ্রামের মধ্যে বিনা দোষে একঘরে করে রাখা হয়েছিল, শেষে রাগে দুঃখে অভিমানে থাকতে না পেরে এই জঙ্গলের জীবন বেছে নিয়েছে। এবার মেয়েটি উল্টে জিজ্ঞেস করলো যে সে কেন এই বনে এসেছে জেনে শুনে। বিপ্র তখন ওর স্বপ্নের কথাটা মেয়েটাকে বলতেই মেয়েটা প্রবল হেসে উঠলো। বললো সে আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি এসো। এবারে বিপ্র সেই মেয়েটিকে অনুসরণ করে এগোতে লাগলো। একটা বিশেষ জায়গায় এসে দমিয়ে পড়লো মেয়েটা। সামনে একটা সমাধি। কিন্তু এটা অন্যগুলোর থেকে অনেকটা সুস্থ স্বাভাবিক। আর এই সমাধিকে ঘিরে বেশ কিছু জায়গা নিস্তব্ধ, নিষ্প্রাণ। ঝি ঝি পোকার ডাক নেই। নেই জোনাকির ঝিকিমিকি। নিজের নিশ্বাসের শব্দ পেলো বিপ্র। এই প্রথম মনটা একটু খচ খচ করে উঠলো ওর। আর তারপরের ঘটনাগুলো যেন জলের নিম্নধারার মতো নিজে নিজেই ঘটে গেলো। যে সমাধির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সেটার উপরের ঢালাই স্লাব হালকা ঠেলতে সহজেই সেটা সরে গিয়ে নিচে সিঁড়ি দেখা গেলো। আর তার সাথে সেই গন্ধটা। কিন্তু বিপ্র লক্ষ করলো সেই তীব্র গন্ধে ক্রমশঃ সে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। আর ওই মেয়েটার পেছন পেছন ওই কবরের ভেতর প্রবেশ করছে। নিচে নেমে যাচ্ছে সিঁড়ি ধরে। ভাবতে পারছে না এর পর সেই কবরের ভেতর কি হতে চলেছে! ভাবতে পারলো না বিপ্র। যত ভেতরে প্রবেশ করছে গন্ধটা ওর স্নায়ু আরো দখল করতে লাগলো। ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পেল ভেতরে নীল আলো কোথা থেকে আসছে বুঝতে পরলো না বিপ্র। বোঝার অবস্থাতে যদিও নেই ও। এবার দেখলো একটা উঁচু ঢিবি মতো অংশ সেখানেই সেই চোখ ধাঁধানো সুন্দর আর চিত্তগ্রাসী গন্ধ যুক্ত বেগুনি ফুল গুলো ফুটে আছে। এবার সেই মেয়েটি সেই ফুলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখের ওরনাটা সরিয়ে দিলো আর সেই মুখ দেখে বিপ্র বিশ্বাস করতে পারলো না নিজের চোখকে এ যে সেই স্বপ্ন সুন্দরী। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলোনা বিপ্র। কি অপরূপ শোভা যেনো স্বর্গের অপ্সরা নেমে এসেছে। নিজেকে সঁপে দিল বিপ্র সেই মেয়েটির কাছে। সব কিছু করতে রাজি সে তাকে লাভের জন্য। মেয়েটি তখন বললো আমাদের এক হতে গেলে তোমাকে যে মরতে হবে। বিপ্র কিন্তু তাতেই রাজি হয়ে গেল। একবারও জানতে চাইলো না কেন মরতে হবে! এদিকে কিন্তু সেই ফুলোরার মনে যে বিষের সাগর। সে বললো না তোমাকে মরতে হবে না। তবে এখনও সময় আসেনি, সময় হলেই আমাদের মিলন হবে তখন কিন্তু পিছিয়ে যেও না; যা বলবো করতে হবে। এরপর একটা তরল দিল সে বিপ্রকে আর জানালো দু’সপ্তাহ পর অমাবস্যায় তুমি আমার কাছে আসবে। আর তার মাঝে কোনো বিপদ তোমাকে স্পর্শ করলে এই গন্ধ একটু ছড়িয়ে দেবে আমি রক্ষা করবো। এরপর বিপ্র ফিরে আসে কলকাতা নিজের কাজের জায়গায়।

পরের দিন সকালে এদিকে অফিসার ধরের প্রথম থেকেই বেশ সন্দেহ হয় বিপ্রকে তাই সে বিপ্রর এক কপি ফটো নিয়ে তদন্তে নেমে পড়ে যেখান থেকে বিপ্র বাসে উঠেছিল। আর একটু খোঁজ করতেই জানতে পেরে যায় যে হ্যাঁ এই বিপ্র চৌধুরী এক মিষ্টির দোকান থেকে কোল্ড ড্রিংক কিনেছিল এবং সেই দিনের সেই দোকানের সি সি টিভি ফুটেজ তার প্রমাণ। এরপর দেরি না করে সেদিন দুপুরেই গ্রেপ্তার করতে পৌঁছে যায় অফিসার ধর তার আবাসনে। কিন্তু ততক্ষণে পাখি উড়ে গেছে। অফিসার ধর ওকে না পেয়ে ওর ঘরটা ভালো ভাবে সার্চ করতে লাগল। আর সার্চ করতে করতে সেদিনের সেই টি শার্টটি সহজেই পেয়ে গেলো। কিন্তু এক বীভৎস ঘটনা ঘটে গেলো। এক কনস্টেবল ফ্রিজে পরীক্ষা করার জন্য দরজা খুলতেই কেমন একটা গন্ধে মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেলো। সবাই মিলে না আটকালে সেই পাঁচতলার ওপর থেকেই ঝাঁপ মারতে উদ্যত হয়েছিল সেই কনস্টেবল। এত দানবীয় শক্তি দেখে সকলেই হতভম্ব। সঙ্গে সঙ্গে সেই ফ্রিজটি নিজেদের অধীনে নিয়ে গেলো পরীক্ষার জন্য। এদিকে এই ঘটনা পেরোতে না পেরোতেই থানায় ফোন আসলো পুরুলিয়া ঢোকবার মুখে চলন্ত পুরুলিয়াগামী এক ট্রেন থেকে কিছু লোক ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করে। তবে কামরার ভেতর থেকে কেউ চেন তাঁর ফলে ট্রেনটি থেমে যায় নাহলে আরো প্রাণহানি ঘটতো। এই খবর পেয়ে আর বুঝতে অসুবিধে হলো না যে এ সেই বিপ্র চৌধুরীর কাজ। ফোন নঃ নেওয়াই ছিল সঙ্গে সঙ্গে ফোনটি ট্রেস করে দেখা গেলো যে হ্যাঁ সেটির লোকেশন ওখানেই দেখাচ্ছে। অফিসার ধর এক মুহূর্ত দেরি না করে বেরিয়ে পড়লো পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে।

সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে গেলো পৌঁছাতে কিন্তু সকলে গিয়ে যেখানে পৌঁছলো এ হলো সেই ঘনো বন অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে। বনের মধ্যে তল্লাশি চালাতে চালাতে একসময় খুঁজে পাওয়া গেলো বিপ্রর ফোনটা। একটা খোলা শার্ট-প্যান্ট পরে আছে এক ঝোপের ভেতর আর তার ভেতরে ফোনটা। ফোনটা যখন পাওয়া গেছে তখন সেই অপরাধীকে পাওয়া যাবে। এই ভেবে আরো জোর তল্লাশি চালাল অফিসার ধর আর তার দল। কিন্তু কিছু যখন পাওয়া যাচ্ছে না হঠাৎ একটা সমাধির ভেতর ক্ষীণ শব্দ শুনতে পাওয়া গেলো। আর দেরি না করে তার ভেতরে সবাই প্রবেশ করলো। আর ভেতরে যেতেই এক বীভৎস দৃশ্য। এক গোলাকার বৃত্ত। আর তার ভেতরে একা রয়েছে তারার মতো চিহ্ন। তার পাঁচটা তীরের ফলার মতো চিহ্ন। আর সেখানে রয়েছে পাঁচটা সদ্য কাটা নরমুণ্ড। আর এসি বৃত্তের মাঝে শুধুমাত্র কৌপিন পরে বসে আছে বিপ্র চৌধুরী। আর তার বুকে কাটা দাগ যেনো কোনো বিড়াল আঁচড় কেটেছে সেখান থেকে ঝরে পড়ছে রক্ত। আর জ্ঞানশূন্য হয়ে কি যেনো সব মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছে বিপ্র। অফিসার ধর অনেক সাবধান বাণী শোনালেও কিছু কানে গেলো না বিপ্রর। এদিকে আরো একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটতে লাগলো। বিপ্রর সামনে একটা ঢিবিতে একটা কঙ্কাল আর ঢিবির নিচেই রয়েছে একটা মহিলার স্কন্ধকাটা লাশ। সবার চোখের সামনে সেই মৃতদেহের রক্ত-মাংস সমস্ত ছিঁড়ে বেরিয়ে সেই কঙ্কালের গায়ে গিয়ে বসতে লাগলো। এসব দেখতে দেখতে সকলে যখন ভয়ে আড়ষ্ঠ তখন সবাই দেখলো আর একজন লোক মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে বাইরে থেকে সেই সমাধির নেমে আসছে। নিচে নামতেই দেখা গেলো যে এ একজন তান্ত্রিক বা কাপালিক জাতীয় কেউ। হতে ত্রিশূল। লাল বস্ত্র কপালে লাল সিঁদুরের ফোঁটা। এদিকে উনি মন্ত্র পড়ে ভেতরে প্রবেশের সাথে সাথে বিপ্রর মন্ত্র উচ্চারণ ক্রমশ কমতে লাগলো। হঠাৎ বিপ্রর দেহ থেকে এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলা বেরিয়ে আসলো আর বিপরীত দেহ এলিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এইবার সেই নারী মূর্তির অবয়ব ক্ষণে ক্ষণে ভয়ংকরী রূপ নিয়ে সেই তান্ত্রিকের সাথে খণ্ডযুদ্ধ শুরু করে দিলো। কিন্তু কিছুতেই তান্ত্রিক সেই নারীমূর্তি সাথে পেরে উঠছিল না। এমন সময় তান্ত্রিক নিজের বুকের ত্রিশূলটি বিধিয়ে সেই রক্ত মাখা ত্রিশূল সেই ঢিবির উপরে রাখা কঙ্কালের উপর বিধিয়ে দিতেই সেই কঙ্কালটি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। আর এক তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠে সেই নারীমূর্তিটি অদৃশ্য হয়ে গেলো।

এতক্ষন ধরে চলতে থাকা অতিলৌকিক ব্যাপার কিছুই বুঝতে পরলো না কেউ। অফিসার ধর এগিয়ে এসে সেই তান্ত্রিককে জিজ্ঞেস করলো সমস্ত ঘটনার ব্যাপারে। তান্ত্রিকটি তখন বললো “দাড়ান আগে ওই ছেলেটিকে ফিরিয়ে আনি। এই বলে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকা বিপ্রর কপালে নিজের বুক থেকে রক্তের ফোঁটা দিতেই বিপ্রর শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠলো কয়েকবার। আর তারপর আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরে পেয়ে চোখ খুলে উঠে বসল মাটিতেই। এরপর তান্ত্রিকটি বলতে শুরু করলো “আমি তান্ত্রিক হরহরি। আমার বাবাও ছিলেন মহা কালি সাধক সিদ্ধি পুরুষ তান্ত্রিক। তার কাছ থেকে আমার শিক্ষা। আমাদের গ্রামের এক মেয়ে ছিল ফুলোম বলে, সেও বাবার কাছে তন্ত্র মন্ত্র আর অন্যদিকে কালা জাদুতেও শিক্ষা নিচ্ছিল অন্য এক কাপালিকের কাছ থেকে। একদিন সেই ফুলোরা বাবাকে এই স্থানে ডেকে এনে একাই তন্ত্র জগতের অধিশ্বরী হওয়ার লোভে ছলনায় বাবাকে হত্যা করে। কিন্তু গুরু হত্যার পাপ দেবতাদেরও অলঙ্ঘনীয়। ফলে বাবার মৃত্যুকালীন অভিশাপে সেই ফুলোম প্রেতযোনি প্রাপ্তি হয়। তাই মুক্তি লাভ করতে প্রতি বছর এই অমাবস্যা তিথিতে নিজ শরীর লাভের চেষ্টা করে। কিন্তু যতদিন আমি আছি ততদিন সেটা সম্ভব না। জানিনা আমার অবর্তমানে কি হবে। এইবারে ও অনেক রক্ত পান করেছে। প্রবল শক্তি সঞ্চয় করেছিল। এই বার প্রবল সম্ভাবনা ছিল ওর ফিরে আসার। ওর সাথে পেরে উঠতাম না যদি না আমার নিজের রক্তপাত করতাম।”এবার বিপ্র বলে উঠলো আমাকে ও বলেছিল যে ওই গন্ধটা ছড়ালে আমাকে বিপদ থেকে বাঁচাবে। কিন্তু যখনই আমি ওই গন্ধটা খুলেছি আমার মধ্যে যেনো এক শয়তান জেগে উঠতো। আর দেখতাম ওই গন্ধ ছড়ানোর সাথে সাথে ফুলোম এসে হাজির হতো। আর অন্য সবাই ওকে দেখে মোহের ঘোরে ওর পিছনে পিছনে ছুটে যেত। আর এই ভাবেই এতগুলো লোক এই পর্যন্ত বলে কেঁদে দিল বিপ্র।

অফিসার ধর অসহায়। সে সব ঘটনার সাক্ষী হলেও নিজে আইনের দাস। সে জানে বিপ্র চৌধুরীকে তাকে গ্রেপ্তার করতেই হবে। ওদিকে যে গন্ধের নির্যাস ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল, সেই ল্যাবে এখন তৈরি হচ্ছে মৃত্যুর নতুন কাহিনী।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post মৃত্যু আয়না | ভয়ের দেশ | সাদাফ মান্নান| Bengali Horror Story
Next post রহস্যটা রয়েই গেল | ভয়ের দেশ | অর্ণব রায়| Bengali Horror Story