Getting your Trinity Audio player ready...
|
আজ আমি যা বলব তাকে বোধহয় গল্প বলা যায় না। গল্প আর সত্যের মাঝে যদি কিছু থাকে তাহলে সেটাই বলব।
সেবারে আমি আর অভ্র মন্দারমণি বেড়াতে যাই। আমার মন যথেষ্ট উৎফুল্ল হলেও অভ্র যেন শুরু থেকেই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে রয়েছে।
আমি ওকে জিজ্ঞাসা করি, “কিরে তোকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। কী ব্যাপার?”
অভ্র প্রতিবারই আমার কথা এড়িয়ে যেত। আমি ভাবতাম হয়তো ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো বিষয় তাই বেশি মাথা ঘামাইনি। কিন্তু ব্যাপারটা যে এতটা ভয়ঙ্কর হবে তা আমি অনুমান করিনি।
একদিন রাতে হঠাৎ, “ক্রিং ক্রিং!!!”
ফোনটা বাজতেই ধরমর করে উঠে বসলাম বিছানায়। তাকিয়ে দেখি একটা অচেনা নম্বর। একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ২টো। তবু কি মনে হওয়ায় ফোনটা ধরি।
ধরেই কানে আসে, “সমি বাঁচা, এরা আমায় ছাড়বে না।”
আরে এতো অভ্রর গলা! পাশে তাকিয়ে দেখি অভ্র নেই। এত রাতে কোথায় গেল ও? আমি জিজ্ঞাসা করি, “তুই কোথায় আছিস এত রাতে? আর কেউই বা তোকে ছাড়বে না?”
ওপাশ থেকে উত্তর আসে, “তোকে সব বলবো তুই আগে এখানে আয়।”
আবার আমি জিজ্ঞেস করি, “কিন্তু তুই কোথায়?”
কয়েক মুহূর্ত আবার সব চুপচাপ। এবার উল্টোদিক থেকে উত্তর আসে, “হোটেল ব্লু প্রাইড” বলেই ফোনটা কেটে দেয় অভ্র।
অভ্রর ফোনটা আমায় ভাবিয়ে তোলে। একবার ভাবি যে হয়তো কোনো প্র্যাঙ্ক কল তারপরই আবার মনে হয় যে গলাটা তো অভ্রর-ই আর ও যদি সত্যিই বিপদে থাকে তাহলে?
তাই আর কোনো কথা না ভেবে ফোনে ম্যাপ খুলে “হোটেল ব্লু প্রাইড” সার্চ করি। দেখি হোটেলটা আমাদের হোটেল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। আর যময় নষ্ট না করে আমি বেড়িয়ে পরি। যেতে যেতে খালি মনে হয় যে কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়েছে আর একটা কেমন অস্বস্তি করে কিন্তু কিসের অস্বস্তি তা আমি ঠাওর করতে পারি না।
এইসব ভাবতে ভাবতেই ম্যাপে দেওয়া লোকেশনে পৌঁছে যাই।
যাঃ বাবাঃ এ কোথায় এলাম। চারিদিকে বড় বড় পোড়ো বাড়ি আর তারি এক কোনায় একটা ঘরে আলো জ্বলছে। আমি এগিয়ে গেলাম আলোটা লক্ষ করে। সামনে গিয়ে দেখি সেটা একটা রেস্তোরাঁ আর নামটা “হোটেল ব্লু প্রাইড।” অন্য সময় হলে আমি হয়তো ঢোকার কথা ভাবতাম ও না কিন্তু তখনকার পরিস্থিতি আলাদা। একটু ইতস্তত করে সে ভিতরে ঢুকলাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। অভ্রর নাম ধরে সে বেশ কয়েক বার ডাকলাম, “অভ্র!!! অভ্র!!!”
কিন্তু কোনো ফল হলো না। এরপর আমি ফোনটা বার করলাম অভ্রকে কল করার জন্য কিন্তু হায় কপাল, ফোনেতো নেটওয়ার্কই নেই।
হঠাৎ পুরো অন্ধকার হয়ে গেল! কী হলো ব্যাপারটা, বুঝতে পারি না আমি। ফ্ল্যাশলাইটটা অন্ করলাম। কিন্তু আশ্চর্য মোবাইল চলছে না। সুইচড অফ হয়ে গেল নাকি?
কিন্তু তা কিকরে হয়? আমি তো ভালো করে লক্ষ করেছিলাম যে বেশ চার্জ ছিল। একবার আমার মনে হলো আমি কী স্বপ্ন দেখছি নাকি? নাঃ স্বপ্ন তো নয়। সব কিছুই যেন কেমন গোলমেলে ঠেকছে সেই ফোনটা আসা থেকে।
উফঃ আর মাথা কাজ করছে না। হঠাৎ আমার মনে হয় আরে অভ্র ফোনটা করল কী করে? এখানে তো নেটওয়ার্কই নেই। তাহলে? গা টা ছমছম করে ওঠে আমার। কেউকি তাকে ফাঁসাচ্ছে?
কিন্তু আর কিছু ভাবার আগেই আমি অনুভব করলাম যে আমি শূন্যে উঠে যাচ্ছি! এক জায়গায় এসে আমি থেমে গেলাম। আমার তখন এমনই অবস্থা যে আমি সমস্ত ভাবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। এবার আমি দেখলাম যে নিচে ঘরে অভ্র ঢুকল। তার সঙ্গে আরও চারজন। এরপর নিচে শুরু হয় এক অবিশ্বাস্য নাটকের পালা। দেখলাম কিছু একটা নিয়ে বচসা শুরু হয় অভ্র আর ওই চারজনের মধ্যে। অভ্রর নাম ধরে ডাকলাম কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুল না।
এরপর এক ভয়াবহ কাণ্ড ঘটল। চারজনেই হঠাৎ হাতে ছোঁড়া বার করল আর অতর্কিতে অভ্রকে আক্রমণ করল। তারা ক্রমাগত অভ্রর সারা গায়ে আঘাত করতে থাকল আর ওকে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিল। কিছুক্ষণ অভ্রর শরীরটা ছটফট করেই নিথর হয়ে গেল।
আমার চোখে জল এসে গেল। এ আমি কি দেখছি? মানুষ কতটা অমানবিক হলে বা কতটা কারুর উপর আক্রোশ থাকলে কাউকে এমন করে হত্যা করতে পারে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ইতিমধ্যে ওই চারজন জয়ের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিল কিন্তু এবার হঠাৎ অভ্র মানে অভ্রর দেহ উঠে দাঁড়ায়!
সবাই হতবাক। একজন মুহূর্তে ব্যাপারটা আন্দাজ করে সজোরে ছুঁড়ি চালায় অভ্রর উপর কিন্তু অভ্রর দেহে যেন আসুরিক শক্তি এসে গেছে, সে অনায়াসে লোকটার হাতটা ধরে আর নৃশংস ভাবে লোকটার বুক চিরে তাকে হত্যা করে! বাকি তিনজনের সঙ্গেও ভিন্ন কিছু হয় না, অভ্র ওদেরকেও একই ভাবে শেষ করে। এই মুহূর্তে সমি চোখ বন্ধ করে নিই আর চোখ খুলেই দেখি সব অন্ধকার। আমার তখন প্রায় উন্মাদের মতো অবস্থা। কী করব বুঝতে পারছি না এমন সময় একটা দমকা হাওয়া আমায় প্রায় ছুঁড়ে বাড়িটার বাইকে ফেলে দিল। এরপর কিভাবে যে আমি ওখান থেকে বাড়িতে পৌঁছাইলাম তা একমাত্র মা গঙ্গাই জানেন। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।
আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখি হোটেলের বিছানায় শুয়ে আছি। ধড়মড় করে উঠে দেখি অভ্র নেই। ওই অবস্থায় আর বসে থাকা যায় না। দৌড়ে গেলাম রিসেপশনে। রিসেপশনের ছেলেটা আমায় দেখেই উঠে দাঁড়ালো, বলল, “কী হয়েছে স্যার?”
আমি বললাম, “আমার সঙ্গে এক্ষুণি এসো।” বলেই ওকে প্রায় টেনে নিয়ে আমি ছুটতে শুরু করলাম। সে বেচারা এতই হতভম্ব হয়ে গেল যে কোন কথাই বলতে পারল না। আমরা পনেরো মিনিটে সেই ভগ্নাংশ “ব্লু প্রাইড” হোটেলে পৌঁছে গেলাম। আমার সঙ্গে ছেলেটা কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ওকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে প্রায় হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকলাম। একটা বিশ্রী পচা গন্ধ নাকে এল আর সামনে দেখি পাঁচটি রক্তাক্ত মৃতদেহ পরে আছে। আমি আবার জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান যখন হল তখন দেখি আমি হোটেলে শুয়ে আছি। আমাকে ঘিরে রয়েছে বেশ কয়েকজন তাদের মধ্যে একজন পুলিশের অফিসার ও একজন হোটেলের ম্যানেজার। ম্যানেজার বাবু বললেন, “মশাই বিশ্রী ব্যাপার, অভ্রবাবুকে কারা নৃশংস ভাবে ছুঁড়ি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।”
অফিসার বললেন, “হ্যাঁ আমাদের অনুমান বাকি চারজন যাদের লাশ পাওয়া যায় তারাই খুন করে অভ্রবাবুকে। কিন্তু তাদের কে মারল তা বোঝা যাচ্ছে না। ক্ষত দেখে মনে হচ্ছে কোন হিংস্র জানোয়ারের কাণ্ড। আমাদের আরও অনুমান কোনোও ব্যবসা সংক্রান্ত কারনেই খুন হন অভ্রবাবু। কিন্তু একটা কথা বলুন তো আপনি এক্স মার্ক্স দ্যা স্পটটা জানলেন কী করে?”
আমি বললাম, “কিছু না। আমি গত রাতেই স্বপ্ন দেখেছিলাম যে অভ্র ওখানে গেছিল।” আমি আর আমার আগের রাতের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করলাম না। ব্যাপারটা আমার মনের অন্তরালেই রয়ে গেল।
আজ এত বছর পরেও কিন্তু জানা যায় নি সেই চারজনকে অমন করে হত্যা করল। হয়তো কেউ কোনোদিন জানবেও না। কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর রাতের নাটকের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এখনও আমার সমস্ত শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়। কিন্তু মনে একটা প্রশ্ন আজও রয়ে গেছে যে সত্যিই কী এমন কিছু আছে যা সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না!