Getting your Trinity Audio player ready...
|
আজ থেকে কয়েক বছর আগের ঘটনা, ঘটনাটি একদম সত্য, আমার নিজের অভিজ্ঞতা। আমি তখন যৌবনে পা দিয়েছি, কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। গণিত বিষয় নিয়ে বিএসসি পড়ছি, পড়াশুনায় মোটামুটি ভালই ছিলাম। কলেজে অনেক বন্ধু বান্ধবী মিলে দিনগুলো বেশ মজা করে কাটত। বাড়িতে বাবা, মা আর আমার থেকে দুবছরের ছোট এক ভাই রয়েছে। ঠাকুমা ছিল, কয়েক মাস আগেই মারা গেছে, দাদুকে চোখে দেখিনি। দুই ভাই খেলা, পড়াশুনা এবং ঘুমানো সবকিছু একসঙ্গে করতাম। ছোটবেলা থেকে প্রচণ্ড ভূতের গল্প পড়তে ভালবাসতাম। রাত দিন পাড়ার লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে এসে পড়তাম। সত্যি কথা বলতে ভুতকে আমি প্রচণ্ড ভয়ও পেতাম। ভূতের ভয়ে কোনদিন একা ঘুমতাম না। এখন অবশ্য এই ভয় নেই, বর্তমানে এক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। ফাইনাল ইয়ারের শেষ পরীক্ষার জন্য বাড়ি থেকে পঞ্চাশ কিমি দূরে অন্য একটি কলেজে আমার সিট পড়েছিল। যে কলেজটিতে সিট পড়েছিল তার পাশেই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বাড়ি থেকে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব নয় বলে, বাবা পরীক্ষার কয়েকদিন আগেই আমাকে সঙ্গে নিয়ে কলেজের কাছাকাছি একটি মেস বাড়ি দেখতে এলো। প্রচুর মেস বাড়ি ছিল কলেজের আশেপাশে, কিন্তু বাবা একটি নিরিবিলি মেস খুঁজছিল, যাতে ভাল করে পড়াশুনা করে পরীক্ষা দিতে পারি। শেষে এক মেস পেলাম, মেসে সেই কলেজেরই পাঁচ জন ছাত্র থাকে, খাওয়া দাওয়া সবকিছু মেসের মধ্যেই। এক মাসি এসে দুবেলা রান্না করে দিয়ে যায়। বাড়িটি নীল রঙ করা দুতালা, বাড়ির পেছনে বিভিন্ন গাছের জঙ্গল। নীচে তিনটি রুম এবং সামনে বারান্দা, বারান্দার পশ্চিম দিকে উপরে উঠার জন্য একটি সিঁড়ি রয়েছে। উপরেরও তিনটি রুম, সিঁড়ির পাসের রুমটি বন্ধ মাঝের রুমটিতে মালিক আর তার এগারো বছর বয়সের এক ছেলে বুবাই থাকে। ঠিক তার পাশেই পূর্ব দিকের রুমটি আমাকে থাকার জন্য দেখানো হল। রুমটি ভাল সঙ্গে একটি বাথরুম রয়েছে, পূর্ব দিকের জানালা দিয়ে দূরের সবুজ প্রান্তর দেখা যাচ্ছে, তার পাশেই একটি বড় পুকুর, পুকুরে মাছ খেলা করছে, দুটো হাঁস ও চড়ে বেড়াচ্ছে আপন মনে। বাগানের গাছপালা গুলো রোদে ঝলমল করছে। রুমটি দেখে আমার পছন্দ হয়ে গেল, নিরিবিলিতে একা পড়া যাবে। সব দেখে এসে বাড়িতে মাকে বললাম, মা বলল- ঠিক আছে ভালো পরিবেশ। পরীক্ষার আগের দিন রবিবার সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে দুটো ব্যাগ ভর্তি করে বাবার সঙ্গে সেই বাড়িতে এসে উপস্থিত হলাম। বাড়ির মালিকের সঙ্গে এই দুদিনে একবারও দেখা হল না, বুবাই নীচে বসে পড়ছে, উপরে উঠতে কখন দেখিনি। মেসের এক ছাত্র দিপকদা আমার রুমে এসে সবকিছু দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল। দিপকদার গত বছর কলেজের পড়া শেষ হয়ে গেছে, এখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কাছেই তাই এখানেই থাকে। সবাই দিপকদাকে ভালোবাসে, পড়াশুনা এবং চাকরির জন্য নানা রকম উপদেশ পায় দিপকদার কাছ থেকে। রুমে আমি আর বাবা দুজনে মিলে ভালো করে গোছগাছ করে সাজালাম। বিছানা পেতে, জামা প্যান্ট গুলো গুছিয়ে রাখলাম। তারপর বাবা বলল – আমি এখন আসি, পড়াশুনা মন দিয়ে করিস, ভালো করে পরীক্ষা দিস। বাবা চলে যায়, তখন সকাল নয়টা, মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। আমি সোমবারের প্রথম পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। বই গুলো উল্টেপাল্টে দেখছি, আর খাতায় কিছু অঙ্ক প্র্যাকটিস করছি। সেই সময় মনটা একদম ভালো লাগছে না, এই প্রথম বাড়ির কাছের মানুষদের ছেড়ে বাইরে আছি। এর আগে কোন দিন কোথায় একা থাকিনি। অনেক আজেবাজে চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। পড়ায় একদম মন বসছে না, ঘরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, উপরে আমিই একমাত্র মানুষ আর কেউ নেই। রুমের ভিতর আপনমনে চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি আর বাড়ির জন্য ভাবছি। বাইরে পাখির আওয়াজ হচ্ছে, সামনে রাস্তায় কতরকমের গাড়ি ছুটে চলছে, হর্নের বিকট আওয়াজ হচ্ছে অনবরত। ভাবতে ভাবতে ছাদের দিকে চোখটা চলে গেল, তাকিয়ে দেখি দরজার উপর কিছুটা অংশ কালো পোড়া দাগ গোল জায়গা জুড়ে আমার দিকে যেন তাকিয়ে আছে। আমাকে গিলতে চাইছে, বাথরুমে ঢোকার দরজায় একটা অনেক দিনের পুরনো পর্দা ঝুলছে, পর্দার নিচের দিকটা কিছুটা অংশ পোড়া। ঘরের কোনে কোনে মাকড়শা ফাঁদ পেতে বসে আছে শিকার ধরার জন্য, সেগুলি ধোঁয়া লেগে কালো হয়ে গেছে। একটি টিকটিকি লেজ খসিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে আমাকে দেখে। বাতাসে আঁশটে আঁশটে গন্ধ পাচ্ছি, গন্ধটা যেন কিছুতেই আমার কাছ থেকে যাচ্ছে না, আমি যেন গন্ধের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। মনটা কেমন ভয় ভয় করতে লাগল অথচ বাড়ির চারপাশ রৌদ্রে ঝলমল করছে, জানালা দিয়ে কিছুটা রোদ বিছানার উপর পড়েছে। সেই রৌদ্রের ছটায় ধুলো গুলো এদিকওদিক ছোটাছুটি করছে। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে বেলা বেড়ে গেল আমি নীচে গিয়ে স্নান করে খেয়ে নিয়ে রুমে এসে পড়তে বসলাম। পড়তে পড়তে ভাত ঘুম আসায় বিছানেতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কিছু সময় পর ঠিক ঘুম ধরবে, হঠাৎ মাথার বালিশটা সরে গেল উপরের দিকে। যেন বালিশটা কেউ টেনে নিচ্ছে মাথা থেকে। আমি বালিশটাকে টেনে মাথার নীচে নিয়ে আবার ঘুমাতে লাগলাম। কিছু সময় পর আবার একইরকম ভাবে বালিশটা মাথা থেকে সরে গেল। ধড়পড় করে উঠে বসলাম, তাকিয়ে দেখলাম, কাউকে দেখতে পেলাম না। এক গ্লাস জল গড়িয়ে খেলাম, মনে মনে ভাবলাম নিচের ছেলেরা হয়তো মজা করছে আমার সঙ্গে। বারান্দায় গিয়ে দেখি কেউ কোথাও নেই। বারান্দা থেকে এসে বিছানাতে বসলাম, সেই সময় একটা দমকা ঠাণ্ডা বাতাস আমার শরীরের উপর দিয়ে বয়ে গেল। বাতাস বয়ে যাওয়ার সময় আবার সেই আঁশটে গন্ধ পেলাম, বাথরুমের দিকে যেন লাল কিছু একটা সরে গেল এবং গন্ধটাও আর নেই। শরীরটা কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে এল, গা ছম ছম করতে লাগল, দেহের লোম গুলো খাড়া হয়ে উঠল, একটা অজানা ভয় চেপে ধরল আমার মনে। মনে হল এই পৃথিবীতে আমি একা চারপাশে আর কেউ নেই। এই সব ভয়ঙ্কর কথা ভাবতে ভাবতে বিছান ছেড়ে এক দৌড়ে নীচে এসে দেখি সবাই নিজের নিজের বিছানাতে ঘুমাচ্ছে। দিপকদা কে ডেকে বললাম তোমরা কেউ উপরে গিয়েছিলে। দিপকদা সকলকে জিজ্ঞাসা করে না বলল, সেখানেই বসে মেসের বাকিদের সঙ্গে গল্পগুজব করে কাটিয়ে দিলাম বিকেলটা। কলেজের শিক্ষক শিক্ষিকারা কেমন গার্ড দেয়, কেমন প্রশ্ন পড়তে পারে এই সব আলোচনা করতে করতে বেলা শেষ হয়ে এল, কিন্তু আমার মন একটুর জন্যও উপরে যেতে চাইল না। পাশে একটি মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলছে, খেলা দেখতে গেলাম। কিছু সময় পর সন্ধ্যে নেমে আসার সংকেত পেলাম সূর্য অস্তমিত, শেষ লাল আভা টুকু ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশে, তারপর এদিকওদিক ঘুরতে ঘুরতে উপরে উঠে এলাম বইগুলো নিতে। মনের মধ্যে সাহস নিয়ে বইগুলো নিয়ে তাড়াতাড়ি নীচে নামতে লাগলাম, একবারও আর পেছন ফিরে তাকালাম না। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মনে হল, পেছনে পেছনে একটি নূপুরের ঝমঝম আওয়াজ আমার সাথে সাথে নেমে আসছে। নীচে বইটই হাতে নিয়ে দিপকদার কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম- আমি আর উপরে যাবনা এখানেই পড়ব, এখানেই ঘুমবো। দিপকদা বলল – কেন ভয় করছে? আমি পূর্বের ঘটনা সবকিছু চেপে গিয়ে বললাম ভয় করছে না, একা একা ভালো লাগছে না। তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে গল্প করতে করতে ঠিক পড়া হয়ে যাবে। দিপকদা মুচকি হেসে বলল আচ্ছা ঠিক আছে এখানেই থাক তাহলে, উপরে যেতে হবে না। রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম দিপকদার পাশে। দিপকদার সঙ্গে গল্প করতে করতে রাত হয়ে গেল। আস্তে আস্তে রাত তার নিজের চেহারায় ফিরে এল চারিদিক নিস্তব্ধ, ঝি ঝি ডাকছে, হুপ হুপ করে একটা হুতুম প্যাঁচা হেঁটে বেড়াচ্ছে শিকারের খোঁজে। দূরে শেয়ালের হুকা হুয়া ডাক শুনে কুকুর গুলো ঘেউ ঘেউ করে ছুটে গেল সেই দিকে। ঘুম আসছে না কিছুতেই, নতুন জায়গা হয়তো তাই, দিপকদা কিছু সময় হল ঘুমিয়েছে। কিছুসময় পর আমিও পাতলা ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম, ঘুমিয়ে আছি – আবার যেন আমার মাথার বালিশ সরে যাচ্ছে, মাথা যেন বিছানার মধ্যে এক গভীর কালো গর্তে ডুবে যাচ্ছে, আশেপাশের কাঁথা কম্বল সব সরে এসে আমার মুখের মধ্যে চেপে দম বন্ধ করে দিচ্ছে। কণ্ঠ শুকিয়ে যাচ্ছে, হাত পা নাড়াতে পারছিনা। আমার মুখ থেকে গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে বাঁচাও বাঁচাও বলে। তখন একটি লাল শাড়ী পড়া মেয়ে হাত বাড়িয়ে আমায় তোলার চেষ্টা করছে, হাতটি কিন্তু আগুনের মত গরম আর কেমন পোড়া পোড়া গন্ধ। দিপকদা আমাকে ঠেলে জাগিয়ে বলল স্বপ্ন দেখছিস। আমি তখন ঘেমে একাকার হয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বললাম – হ্যাঁ এক ভয়ানক স্বপ্ন দেখছিলাম। একটু উঠে দিপকদার সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলাম। দিপকদা আমাকে ভয়কাতুরে বলে উপহাস করতে লাগল। এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি পর দিপকদা বলল চল এবার ঘুমাই। দিপকদা ঘুমিয়ে পড়ল আমার আর ঘুম আসছে না, এমনিতে নতুন জায়গা তার উপর এইরকম স্বপ্ন। জেগে আছি আর সেই স্বপ্নের কথা মনে হচ্ছে বার বার। কালকের পরীক্ষা নিয়ে ভাবছি এমন সময় হঠাৎ ছাদের উপরে এক মহিলার আর্তনাদ শুনতে পেলাম, বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করেছে, আর ছোটাছুটির আওয়াজ হচ্ছে। কি ভয়াবহয় আর্তনাদ করছে মেয়েটি, হৃদয়ভেদী গগনভেদি সেই আর্তনাদ আমি আর শুনতে পারছিনা, কান দুটো চেপে ধরলাম। চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল কিছু সময় পর চারিদিক নিস্তব্ধ, কান পেতে আছি, ছাদে নূপুরের ঝুম ঝুম আওয়াজ করে কে যান হেঁটে বেড়াচ্ছে, আস্তে আস্তে সেই আওয়াজও বন্ধ হয়ে গেল। ভয়ে আমার হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, চোখ খুলে আর তাকাতে পারছি না। রাতে আর আমার একটুও ঘুম ধরল না, কানের মধ্যে সেই শব্দটা বেজে যাচ্ছে আর লাল শাড়ী পড়া মেয়েটির চোখ বার বার উঁকি দিচ্ছে, ভোরের দিকে একটু ঘুমলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করতে করতে দিপকদা কে বললাম – বাড়ির মালিককে দেখছি না কেন? বুবাই তোমাদের কাছে ঘুমাচ্ছে, পড়ছে কি ব্যাপার বলতো? রাতের সেই আওয়াজের কথাও বললাম। দিপকাদা শুনে হাসতে লাগল। মেসের কিছু ছেলেরা আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে, দিপকদা বলল ও কিছু না তোর মনের ভুল, তুই প্রচুর ভয় করিস মনে হচ্ছে। দিপকদা বলল – রাতে মালিক বাড়িতে আসে না, এক কারখানায় গার্ডের ডিউটি করে, সকালে আসে খেয়ে দেয়ে ঘুমায় আবার বিকেলে বেরিয়ে যায়। আমি আর কিছু বললাম না। কয়েকদিন পরীক্ষা নিয়ে কেটে গেল, পরীক্ষা গুলো ভালই দিয়েছি, ভয় টয় কিছু আর করছে না, সেই সব গন্ধ আর শব্দ আর শুনতে পাচ্ছিনা। সব কথা প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। তার কয়েকদিন পর একরাতে ঘুম ভেঙে গেল। হাত ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখি রাত দেড়টা। সেই রাত ছিল অমাবস্যার রাত চারিদিক নিঝুম অন্ধকার। গ্লাসে জল খেয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে টয়লেটে গেলাম, সবাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে, নিচের টয়লেটটি বারান্দায় সিঁড়ির নীচে। আমারও মন থেকে ভয় চলে গেছে, তাই লাইট জ্বেলে একাই টয়লেটে গেলাম। টয়লেটে বসে আছি চারিদিক নিস্তব্ধ, কোন দিকে কোন শব্দ নেই শুধু আমার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এমন সময় শুনতে পেলাম উপরের বারান্দায় ঝনাৎ করে কি একটা পড়ে যাওয়ার আওয়াজ। সেই শব্দ সব নির্জনতাকে খান খান করে দিল, কিছু সময় কার যেন চলাফেরার আওয়াজ পেলাম। উপর থেকে কে যেন নূপুরের ঝম ঝম আওয়াজ করতে করতে নেমে আসছে। কান পেতে শুনলাম শব্দটি ঠিক কিনা, না একদম স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি মনের ভুল নয়। ঝম ঝম করে আওয়াজটি ঠিক যেন আমার কাছে এগিয়ে আসছে। আমি ভয়ে টয়লেট থেকে বের হয়ে বারান্দা দিয়ে রুমের দিকে দৌড়াতে যাব ঠিক সেই সময় সামনে মেয়েটিকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম, বেশ মিষ্টি চেহারা, কপালে লাল সিঁদুর মাথায় ঘোমটা হাত গুলো কেমন সরু সরু, সেই হাতে শাখা সোনার চুড়ি গুলো বেশ ঝলমল করছে, চোখে কাজল, গাল গুলো ফর্সা রঙের উপর লালচে আভা, পরনে সুন্দর একটি লাল বেনারসি শাড়ী। তখন আমার পা একটুও আর তুলতে পাড়লাম না মেঝে থেকে, পা যেন কেউ ধরে রেখেছে যতই তোলার চেষ্টা করছি আরও যেন জোরে চেপে ধরছে পা দুটো কে। একটুও নড়তে চড়তে পারছিনা, যেন জগতের সমস্ত দুর্বলতা আমায় চেপে ধরেছে। মুখ থেকে আওয়াজ বেরিয়ে এলো – কে আপনি? মেয়েটি খিল খিল হেসে চলছে, হাসি যেন থামছেই না। আমি আবার বললাম – কে আপনি? কিছু সময় পর হাসি থামিয়ে বলল – আমার বাড়িতে আছো আমাকে চেনোনা, তুমি তো নতুন এসেছো তাই আমাকে চেনো না। আমিতো এই উপরের রুমে থাকি, এই বাড়ির মালকিন। এই কথা গুলো বলতে বলতে দেখলাম হঠাৎ মেয়েটির সারা শরীরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে শুরু করল। আগুনের লাল শিখায় গোটা বারান্দা আলোকিত হয়ে গেল, দেখলাম মেয়েটির চামড়া আস্তে আস্তে গলে পড়ে যাচ্ছে ঠিক মোমের মত, ভেতর থেকে সাদা হাড় গুলো দেখা যাচ্ছে। যেন একটি কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে মনে মনে ভগবানকে ডাকতে লাগলাম, জয় সীতা রাম, জয় সীতা রাম আওড়াতে লাগলাম। সেই অবস্থায় মেয়েটি আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল – ‘একটু জল দাও ভাই, আমার কণ্ঠ জ্বলে যাচ্ছে, জল দাও তাড়াতাড়ি, আমাকে বাঁচাও ভাই।’ সেই দৃশ্য দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম। যখন জ্ঞান ফিরল চেয়ে দেখি মেসের ছেলেরা আমাকে ঘিরে বসে আছে। আমার জ্ঞান ফিরে এসেছে দেখে একজন বলল – কী হয়েছিল তোর? আমি বলতে যাব, সেই সময় দিপকদা বলল আজ থাক কাল সকালে শুনব, সবাই যে যার রুমে গিয়ে শুয়ে পর। সকালে ঘুম থেকে উঠে মাথার কাছে একটু ব্যথা অনুভব করলাম, সবাই এসে আবার ঘিরে ধরল কাল কি হয়েছিল বল আমাদের। তাদের কে দেখে মনে হল যেন ওই ঘটনা না শুনা পর্যন্ত তাদের নিস্তার নেই। আমি তাদের কে সব কিছু বললাম – মেয়েটির কথা, নূপুরের কথা, জল চাওয়ার কথা। প্রথম দিনের দুপুরের কথা গুলোও বললাম। তারা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। আমি দিপকদা কে বললাম – তোমরা আমার কাছ থেকে কিছু একটা লুকচ্ছ, এইসব ঘটনা তোমরা নিশ্চয়ই জানো। আমার জেদ চেপে গেল, আমি বললাম তোমাদের বলতেই হবে এই ঘটনাগুলির কারণ কী। দিপকাদা তখন বলল তুই ভয় পাবি বলে আমরা কিছু বলিনি এতদিন। তারপর দিপকদা যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলল তা শুনে চোখের পাতা না নামিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে গেল। দিপকদা বলল – আমরা শুনেছি পাঁচবছর আগে মালিকের বউ একদিন মালিকের সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া করে। মালিক রাতে ডিউটি চলে গেলে, বউটি সারা শরীরে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে নেয়। সারা বারান্দায় বাঁচাও বাঁচাও বলে দৌড়তে থাকে। দৌড়তে দৌড়তে শেষে যে রুমটায় তুই প্রথম ছিলি সেখানে গিয়ে পড়ে থাকে, বাঁচানোর মতো কারোর সুযোগ হয়নি বউদিকে। সবাই যখন গিয়ে দেখে শরীরের সবকিছু পুড়ে গেছে চামড়া গুলো ঝুলে ঝুলে পড়ছে, হাড়গুলো বেরিয়ে পড়েছে যেন এক কঙ্কাল পড়ে রয়েছে, চারিদিকে ধোঁয়ায় ভর্তি, চামড়া পুড়ে গন্ধে ঘর গমগম করছে। তারপর থেকে এই মেসের সবাই এই রকম আওয়াজ শুনতে পায়, উপরে আর কেউ থাকার নাম ধরেনি। একবার পলাশ নামে এক সাহসী ছাত্র জেদ করে ওই রুমে কয়েকদিন ঘুমিয়ে ছিল, প্রথম প্রথম তার কিছু হয়নি। শেষে এক রাতে তাকে এমন ভয় দেখিয়ে ছিল সেও যা নেমেছে আর উপরে ওঠার নাম ধরেনি, পরে এই মেস ছেড়ে পালিয়ে যায়। আমি তখন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম, রেগে গিয়ে বললাম তোমাদের আমাকে আগেই বলা উচিত ছিল এই ঘটনা গুলো, আমার যদি কিছু হয়ে যেত। দিপকদা বলল – মালিক আমাদের বলে রেখেছিল এই ঘটনা কাউকে যেন না বলি, কারণ তাহলে এই মেসে আর কেউ আসবে না। সবাই যে যার রুমে চলে গেল, আজ আমার শেষ পরীক্ষা, পরীক্ষা দেওয়ার আগে ধুপ জ্বেলে ঠাকুরকে ডেকে পরীক্ষা দিতে গেলাম। পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসে দেখি বাবা এসেছে আমাকে নিতে। বাবা গতরাতের সবকিছু ঘটনা দিপকদার কাছে শুনেছে, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা মুষড়ে গেল। পরীক্ষা কেমন হয়েছে জিজ্ঞাসা করল, আমি বললাম ভালো, কিন্তু আমার শেষের পরীক্ষা একদম ভাল হয়নি। পরীক্ষার সময় খাতার মধ্যে সেই মুখ ভেসে উঠছে বারে বারে, কানের কাছে বাঁচাও বাঁচাও বলে শব্দ শুনতে পারছি। শেষ পরীক্ষা পাস করতে পারবনা বলে মনে হচ্ছে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বাবার সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছি সেইসময় অতি পরিচিত ঠাণ্ডা দমকা বাতাস আমার শরীরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেল, সঙ্গে সেই আঁশটে গন্ধ। এই গন্ধ কি আমার পিছু ছাড়বেন কিছুতেই? রাস্তায় গিয়ে পেছন ফিরে উপরের বারান্দায় দিকে তাকালাম। দেখলাম সেই মুখ লাল শাড়ী পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার রোগা হাতদুটো আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে যেন বিদায় জানাচ্ছে, শাঁখা গুলো যেন হাত থেকে খুলে আসছে। আমি বাবাকে বললাম ওই দেখ, বাবা বলল কই কিছু নেইতো। আমি বাসে গিয়ে উঠলাম জানালা ধারে সিটে বসে ঘুমিয়ে পড়লাম, কালরাতে ভাল করে ঘুম না হওয়ায় একটু পরেই ঘুমিয়ে গেলাম। তখন শুনলাম কানের কাছে কে যেন ক্ষীণ গলায় বলছে ‘একটু জল দাও ভাই’ বলে ডাকছে। আমি সহ্য করতে না পেরে দুহাত দিয়ে কান চাপা দিয়ে বললাম, যাও এখান থেকে আমার কাছে আর এসো না। তখনও যেন আমার কানের মধ্যে শুনতে পাচ্ছি ‘একটু জল…, একটু জল…। চেয়ে দেখি বাবা জল চাইছে। আমি আমার জলের বোতলটি বাড়িয়ে দিলাম, জল খেতে খেতে বাবা বলছে বাড়ি গিয়ে মন্দিরে পূজা দিতে হবে। পরের স্টপেজে বাস দাঁড়াল অনেক লোক নামল, আবার উঠল চেয়ে দেখি একটি লালা শাড়ী পড়া মেয়ে উঠেছে পায়ে নূপুর, ঠিক আমার সিটের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, কোলে একটি বাচ্চা, ছেলেটি কাঁদছে, মেয়েটি বলছে কাঁদিস না বুবাই আর একটু পরে আমারা মামার বাড়ি পৌঁছে যাব। আমি তখন সিট থেকে উঠে মেয়েটিকে বসতে দিলাম। তাকিয়ে থাকলাম মেয়েটির দিকে, সেই মেয়েটি আমার পিছু নিয়েছে। নিজেকে বললাম লাল শাড়ী কী আর কারোর থাকতে নেই, বুবাই নামতো আমাদের পাড়ায় দু তিন জনের রয়েছে। মেয়েটি ছেলেটিকে কোলে নিয়ে তিনটি স্টপেজ পর নেমে গেল। আমি আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে আমার সিটে গিয়ে বসলাম। এখনো রাতে মাথা থেকে বালিশ সরে গেলে সেই দিন গুলির কথা মনে হয়। সেই লাল শাড়ী।