Getting your Trinity Audio player ready...
|
লেবুতলা থানায় শনিবার সন্ধ্যায় এস পি রোহিত সেন আর ইন্সপেক্টর ভরত খাঁড়া একটা কেসের ব্যাপারে বিশেষ আলোচনায় ব্যস্ত। রোহিত সেনের বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। আর ভরত খাঁড়া, বছর আঠাশের যুবক। হঠাৎ সেই সময় একজন মাঝবয়সী, ছিমছাম গোছের ভদ্রলোক দরজার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
– “স্যার আসব?”
রোহিত- “হ্যাঁ আসুন।”
ঘরে ঢুকে লোকটি হিপ পকেট থেকে একটা ছোটো ফিচার ফোন বার করে টেবিলে রাখলেন। তারপর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললেন,
– “নমস্কার স্যার। আমি সনাতন পাত্র। আমার বাড়ি শংকরহাটি গ্রামে। একটু দরকারে আমাদের পাশের গ্রাম মহেন্দ্রনগরে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফেরার পথে আজ দুপুরে রাস্তায় এই ফোনটা কুড়িয়ে পাই। তাই এটা থানায় জমা দিতে এলাম।”
রোহিত – “খুব ভালো। আজকাল তো এরকম দেখাই যায় না। এরকম ফোনটোন কুড়িয়ে পেলেই লোকে পকেটস্থ করে। ধন্যবাদ, আমরা এটা যার ফোন তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।”
ভরত – “তা ভাই আপনি ফোনটা কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করেননি তো?”
সনাতন – “না স্যার যেমন কুড়িয়ে পেয়েছিলাম সেই অবস্থাতেই এখানে এনেছি।”
রোহিত – “আপনি ঠিক কোন পার্টিকুলার জায়গায় ফোনটা পেয়েছেন একটু বলতে পারবেন?”
সনাতন – “স্যার মহেন্দ্রনগর থেকে শংকরহাটি যাওয়ার রাস্তায় একটা মোড় পড়ে। সেখান থেকে একটা রাস্তা কুলোকাসের দিকে চলে গেছে। ওই কুলোকাসের দিকের রাস্তাতেই ফোনটা পড়েছিল। আমি সাইকেলে যাওয়ার সময় ওটা দেখতে পাই।”
রোহিত – “আরে কুলোকাসের পরের গ্রাম দিলেকাসে তো আমার গ্রামের বাড়ি। তাহলে ওদিককারই কারোর ফোন হবে। কোনও ভাবে রাস্তায় পড়ে গেছে।”
ভরত – “ঠিক আছে সনাতনবাবু আপনি ফোনটা রেখে যান। আর আপনার নাম, ঠিকানা আর বাকি ডিটেইলস একটু লিখিয়ে যান।”
সনাতনবাবু যেতেই রোহিত, ভরতকে বললেন,
– “ভরত, এটা তো ফিচার ফোন। কোনও ট্র্যাকার বা জি.পি.এস, কিছু তো কাজ করবে না। তুমি একটু এটা ঘেঁটে দেখো কারও ফোন নাম্বার বা কিছু ডিটেইলস পাওয়া যায় কিনা। যাতে এটা ফেরত দেওয়া যায়।”
ভরত – “হ্যাঁ স্যার আমি দেখছি।”
এই বলে ভরত ফোনটা ক্লিক করতেই দেখা গেল ফোনে একটা অডিও রেকর্ডিং ফাইল খোলা আছে। সেই ফাইলটা চালু করতেই তাতে কোনও এক মহিলার প্রচন্ড ভয় মিশ্রিত গলার একটি অডিও শোনা গেল –
“আমি পায়েল রায়। আমার বাড়ি কুলোকাসের রায় ভিলা। ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চায়। এই ফোনটা যার হাতে পড়বে দয়া করে আমাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করবেন। আর নাহলে পুলিশের কাছে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি খুব বিপদের মধ্যে আছি। দয়া করে আমাকে বাচান। ওই যে ওরা আসছে, ওরা আসছে আমাকে মেরে ফেলবে।”
ব্যাস অডিওটা এখানেই শেষ।
ভরত – “স্যার এটা তো শুনে মনে হচ্ছে কাউকে খুন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
রোহিত – “হ্যাঁ ভরত। এটা আজ দুপুরে সনাতনবাবু পেয়েছেন। আমার তো আজ এমনি একবার গ্রামে যাওয়ার কথা, আমি রাস্তায় এই ফোনটা কার বা এই রেকর্ডিংটা কার সেই সব খোঁজ নিয়ে নেব।
আর বেশী দেরী করা ঠিক হবে না বুঝলে, যে মহিলা এই রেকর্ডিংটা করেছেন উনি নিশ্চই খুব বিপদে আছেন। গলার আওয়াজ শুনে বোঝা যাচ্ছে এটা কোনও ফেক অডিও নয়। আমি এখনই বেরিয়ে যাই।”
ভরত – “ঠিক আছে স্যার।”
এরপরেই এস পি রোহিত সেন বেরিয়ে গেলেন লেবুতলা থানা থেকে।
(২)
রাত দশটায় কুলোকাসের রাস্তায় চাপ চাপ অন্ধকার। এদিকে কোনও কারণে স্ট্রিটলাইটগুলো অকেজো। আর গ্রামের মানুষ তাড়াতাড়ি তাদের কাজ মিটিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তাই রাস্তার মধ্যে কোনও জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। ঠিক যেন একটা নিস্তব্ধ, অন্ধকার, মৃত্যুপুরী।
রোহিত সেন অন্ধকারের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে এগোচ্ছিলেন। তার গ্রামের রাস্তা এখান থেকে অন্য দিকে বেঁকেছে। রায় ভিলা সম্ভবত উল্টোদিকের রাস্তায়। সেটা আন্দাজ করে তিনি এগোতে থাকলেন। হঠাৎ তিনি রাস্তার ধার থেকে একটা গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখতে পেলেন।
রোহিত সেইদিকে এগোতে দেখতে পেলেন একটা নীল রঙের মারুতি বলেনো রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত গাড়িটা খারাপ হয়েছে। রোহিত ভাবলেন রায় ভিলা কোথায় পড়বে, সেটা একবার গাড়িতে যে বা যারা আছে তাদের জিজ্ঞেস করা যেতে পারে।
এই ভেবে গাড়ি থেকে নেমে রোহিত পাশের গাড়িটার জানলায় উঁকি দিলেন। গাড়ির ড্রাইভারের সিট ফাঁকা – তবে পিছনের সিটে একটি মেয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় আছে। মেয়েটির বয়স এই সাতাশ-আঠাশ বছর হবে। দেখতে, এক কথায় বলতে গেলে মনে হচ্ছে —কোনও ঘুমন্ত পরী, জিয়ন কাঠির ছোঁয়ার অপেক্ষায় ঘুমিয়ে আছে। রোহিত তখন গাড়ির সামনে এসে একটু গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বললো – “কেউ আছেন? একটু শুনবেন?”
তখনই গাড়ির নীচ থেকে একজন বছর ত্রিশের ভদ্রলোক শোয়া অবস্থায় উঁকি দিলেন।
উনি সম্ভবত ড্রাইভিং করছিলেন। গাড়িটা বিগড়ে যাওয়ায় গাড়ির নীচে ঢুকে ঠিক করার চেষ্টা করছেন। সেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন
– “হ্যাঁ বলুন।”
– “রায় ভিলা কোথায় পড়বে একটু বলতে পারবেন?”
– “এই তো সোজা এগিয়ে যান। কিছুদূর গিয়ে দেখবেন একটা মোড় পড়ছে। ওই মোড়ের ডানদিকের রাস্তা ধরে সোজা কিছুদূর এগোলেই রায় ভিলা পড়বে।”
– “আচ্ছা থ্যাঙ্ক ইউ।”
এরপর রোহিত সেন গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
(৪)
রায় ভিলার সামনে এসে রোহিত সেন গাড়ি থামালেন। রায় ভিলা এক বিশাল কারুকার্যময় প্রাসাদোপম বাড়ি। এরকম একটা জায়গায় যে এরকম একটা বাড়ি থাকতে পারে তা ধারণার বাইরে। রোহিত সেন একটা ক্যাঁচ শব্দ করে বিশাল গেটটা একটু ফাঁক করলেন। তারপর বিশাল গেটের ভেতরে ঢুকলেন। চারদিক খুব ফাঁকা ফাঁকা আর অন্ধকার, এখানে কেউ থাকে বলে তো মনে হয় না।
মোরাম বিছানো পথ দিয়ে রোহিত সেন এগিয়ে চললেন, চারপাশে বিশাল বাগান থেকে ফুলের সুগন্ধ, আর চারপাশে নানা মূর্তি সাজানো সুন্দর ফোয়ারা থেকে তিরতিরে জলের শব্দ ভেসে আসছে, একদিকে ঘোড়াশাল, হাতিশাল, সেখানে যদিও আর হাতি ঘোড়া নেই। ফাঁকা হলেও মোটামুটি ওয়েল মেনটেনড। রোহিত সেন মনে মনে ভাবলেন —কেউ তো নিশ্চয়ই থাকে, না হলে এই সব কিছু এই অবস্থায় থাকত না। আর গেটটাও খোলা থাকত না।
রোহিত সেন একটা হাঁক দিলেন
– “কেউ আছেন এখানে, দয়া করে একবার বাইরে আসুন।”
বেশ কয়েকবার হাঁক দেওয়ার পর একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক কোথা থেকে যেন বেরিয়ে এলেন। লোকটার বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি হবে, পরনে সাদা ধুতি আর একটা কালো চাদর। সময়টা ফ্রেব্রুয়ারির শেষের দিক। ঠান্ডা খুব একটা নেই তাও লোকটার মাথায় একটা উলের টুপি। একটা হ্যারিকেন সে হাতে ধরেছিল, সেটার আলোটা একটু জোর করে দিয়ে রোহিত সেনের মুখের ওপর সেটা তুলে ধরে চোখগুলো কুঁচকে ছোটো করে ভালো করে দেখার এবং চেনার চেষ্টা করলেন। কিন্তু চিনতে না পেরে সাদা দাড়ি গোঁফের ভেতর থেকে বললেন
– “আপনি কে বাবু, আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।”
রোহিত সেন তার আই কার্ডটা বার করে দেখিয়ে বললেন
– “আমি এস পি রোহিত সেন। একটা বিশেষ দরকারে এখানে এসেছি।”
– “এস পি, মানে পুলিশ? কিন্তু এতদিন পরে কি ব্যাপার স্যার?”
– “বলছি। তার আগে আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?”
– “আমি দীননাথ স্যার, রায় বাড়ির পুরনো চাকর। এখন এই বাড়ির দেখাশোনার দায়িত্ব আমার ওপরেই।”
– “আচ্ছা তাহলে তো আপনি বলতে পারবেন। এখানে পায়েল রায় নামে কেউ কি থাকেন?”
– “পায়েল রায়, মানে ছোটো দিদিমণি? তিনি এখন তো আর এখানে থাকেন না। তার কি কিছু হয়েছে?”
– “সেটা জানার জন্যই আসলে আমি এখানে এসেছি। এটা একটু শুনে দেখুন তো।”
এই বলে রোহিত সেন সেই ফোনের অডিও রেকর্ডিংটা বৃদ্ধকে শোনালেন। রেকর্ডিং শুনে বৃদ্ধ হাহুতাশ করতে লাগলেন।
– “হায় হায় ভগবান! বড়বাবুকে মেরে এদের শান্তি হয়নি আবার ছোট দিদিমণিকেও মারতে চাইছে। ভগবান এদের কোনওদিনও ক্ষমা করবে না।”
– “শুনুন শুনুন, আপনি বলুন ঠিক কি হয়েছে? আপনি যা জানেন, সব আমাকে খুলে বলুন। আমি নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করব।”
– “হ্যাঁ স্যার আমি আর চুপ করে থাকবো না, আপনাকে সব বলছি।” এই বলে বৃদ্ধ তার কাহিনী শুরু করলেন —
এই রায়বাবুরা আসলে এদেশের মানুষ ছিলেন না। বহু প্রাচীন কালে ওঁদের পূর্ব পুরুষরা গ্রিস দেশ থেকে এই দেশে এসেছিলেন। তারপর এদেশে থেকে ওঁরা এখানকারই মানুষ হয়ে যান। নবাব বাদশাদের আমলে ওঁদের এক পূর্বপুরুষ রায় রায়ান উপাধি পান। তখন থেকেই এই রায় নামেই ওঁরা সব জায়গায় পরিচিত হন। পরের দিকে ওঁরা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। তাই ওঁরা জাতে ছিলেন খ্রিষ্টান। এই যে বাড়িটা দেখছেন এটা প্রায় দু’শো বছর আগে তৈরী হয়।
আমি, আমার বাপ দাদারা এই রায়বাবুদের বাড়িতে পুরুষানুক্রমে কাজ করছি। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল কিন্তু ঝামেলা বাধলো নিবারণ রায় মানে বড়বাবুর সময় থেকে। বড়বাবুর ‘ই মেয়ে— কোয়েল রায় আর পায়েল রায়। এই পায়েল রায় মানে ছোটো মেয়ের জন্মের সময় রাণীমা মারা যান। বড়বাবু তারপর আর বিয়ে করেননি। দুই মেয়েকে একাই মানুষ করতে থাকেন।
বড়বাবুদের অনেক রকমের পৈতৃক ব্যবসা ছিল। বড়বাবু সেসব আরও বাড়ানোর চেষ্টা করেন। সেই সঙ্গে নতুন হোটেল আর রিসর্ট খোলেন বিভিন্ন জায়গায়। আর সেটাই কাল হল বড়বাবুর জন্য। হোটেল রিসর্টের ব্যবসায় বড়বাবুর খুব লোকসান হতে থাকে। বড়বাবুর পার্টনার ছিলেন প্রশান্ত সেন। তার অনেক বড়ো বড়ো মানুষের সাথে ওঠা বসা। তিনি নানারকম বুদ্ধি বড়বাবুকে দিতে থাকেন ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য। কিন্তু কোনও লাভ হয় না। ধীরে ধীরে বড়বাবু ঋণের বোঝায় ডুবে যান।
এদিকে পায়েল দিদিমণি আর কোয়েল দিদিমণিও তখন বড়ো হয়ে উঠেছে। আর তার সাথেই বেড়েছে তাদের খরচা। পায়েল দিদিমণি অবশ্য খুব শান্তশিষ্ট। বাবার কাছে তার কিছুই চাওয়ার নেই, বাবা যা দেয় উনি তাতেই খুশী। কিন্তু কোয়েল দিদিমণির চাওয়ার যেন আর শেষ নেই। নানা রকম বাহানায় সে বড়বাবুর থেকে টাকা চায়। বড়বাবু এই সব ঋণ আর প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য সম্পত্তি বিক্রি করতে শুরু করলেন।
এই সময়েই এল পায়েল দিদিমণির আঠারো বছরের জন্মদিন। সেই উপলক্ষে বড়বাবু বেশ বড়ো করে পার্টির আয়োজন করেন, এই বাড়ির লনে। সেই পার্টিতে প্রশান্তবাবু তার অনেক বিদেশী বন্ধুদের নিয়ে এসেছিলেন।
এই বাড়িতে বড়বাবুদের পূর্বপুরুষের বহু অ্যান্টিক জিনিসপত্র ছিল যেগুলো গ্রীক শিল্পের নিদর্শন। টাকায় এই সব জিনিসের মূল্য দেওয়া যায় না। প্রশান্তবাবু বড়বাবুকে অনুরোধ করেন যে, তার বিদেশী বন্ধুদের অ্যান্টিক জিনিস কালেক্ট করার খুব শখ তাই বড়বাবু যেন তাদের একবার ওই অ্যান্টিক জিনিসগুলি দেখান। বড়বাবু তাই ওঁদের সেই জিনিসগুলো দেখালেন। সে সব জিনিস দেখে তো সেই বিদেশীদের চক্ষু চড়ক গাছ। এরকম জিনিস যে এত সুন্দর ভাবে সংরক্ষিত অবস্থায় কারোর কাছে থাকতে পারে তা তাদের কল্পনার বাইরে ছিল। সেই ভদ্রলোক বড়বাবুকে বলেন
– “আমি আপনাকে এগুলোর বদলে কুড়ি কোটি টাকা অফার করছি। দয়া করে জিনিসগুলি আমাকে দিয়ে দিন।”
বড়বাবু বললেন – “দেখুন মিস্টার রিচার্ড এসব জিনিস বিক্রি করবার জন্য নয়। এগুলি আমার পৈতৃক সম্পত্তি। আমি কোনওভাবেই এসব বেচবো না।”
রিচার্ড – “তবে ত্রিশ কোটি দেবো।”
– “না মিস্টার রিচার্ড আমি তো বললাম বেচব না।”
– “চল্লিশ কোটি!”
তখন প্রশান্তবাবুর চোখ চকচক করে ওঠে। উনি বললেন
– “একবার ভেবে দেখো নিবারণ এই টাকাটা পেলে তোমার সব ঋণ শোধ হয়ে যাবে। আর তার পরেও আমরা বাকি টাকা দিয়ে নতুন করে ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারব।”
বড়বাবু – “না প্রশান্ত আমি মরে গেলেও এগুলো বিক্রি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
রিচার্ড – “লাস্ট অফার বাবু ৬০কোটি।”
সেই সময় সেখানে কোয়েল দিদিমণিও ছিলেন। উনি বললেন
– “বাবা, এইসব পুরনো ভাঙাচোরা জিনিসপত্র জমা করে রেখে কী হবে? এই ভদ্রলোক এতগুলো টাকা দেবেন বলছেন। তাছাড়া আমার বিভিন্ন কোর্সের জন্য কত টাকা দরকার হয়।”
বড়বাবু – “কোয়েল তুমি এখন ঘরে যাও। এসব তুমি বোঝো না, তোমার এসবের মধ্যে থাকার দরকার নেই।”
– “আমি এখন সব কিছু বোঝার মতো যথেষ্ঠ বড়ো হয়েছি বাবা। একুশ বছর বয়েস হল আমার। এই সময় যদি সব না বুঝি তো কবে বুঝবো?”
বড়বাবু – “আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাই না। আমি বেচবো না বলেছি সেটাই শেষ কথা। মিঃ রিচার্ড, প্রশান্ত অনেক রাত হল এবার তোমরা আসতে পারো।”
রিচার্ড – “আপনার সাথে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগল বাবু। আমার অফারটা একবার ভেবে দেখবেন।”
প্রশান্ত – “হ্যাঁ নিবারণ ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করো। আসছি।”
সেদিন তো প্রশান্তবাবু আর রিচার্ড চলে গেলেন। কিন্তু এরপর তারা নানাভাবে জিনিসগুলি বিক্রি করার জন্য বড়বাবুর ওপর চাপ দিতে থাকেন। এরমধ্যে ব্যবসায় বড়বাবু, প্রশান্তবাবুর অনেক কারচুপি ধরে ফেলেন। তাই তার সঙ্গেও তার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়।
একদিন প্রশান্তবাবু বড়বাবুকে এসে বললেন
– “নিবারণ আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। তুমি যেভাবে হোক ব্যবসায় আমার যে টাকাগুলো পাওনা সেগুলো সব দিয়ে দাও।”
– “কিন্তু সে তো অনেক টাকা। এত টাকা এই মুহূর্তে আমি কোথায় পাব?”
– “টাকা জোগাড় করার উপায় তো তোমার হাতেই আছে নিবারণ। রিচার্ড তোমার এই জিনিসগুলির জন্য আশি কোটি টাকা দিতে রাজি আছেন।”
– “দেখো প্রশান্ত আমি যে ভাবে হোক তোমার টাকা দিয়ে দেবো। কিন্তু আমি আগেই বলেছি ওই জিনিসগুলো আমি বেচব না।”
এই সময়েই কোয়েল দিদিমণি ঘরে এলেন। উনি বললেন
– “বাবা একটা কোর্সে ভর্তির জন্য আমার পাঁচ লাখ টাকা চাই।”
বড়বাবু – “তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এত টাকা আমি কোথায় পাবো? আর এর আগেও তুই নানা অজুহাতে আমার থেকে টাকা নিয়েছিস। আমি আর কোনও টাকা তোকে দিতে পারব না।”
– “তাহলে তুমি প্রশান্ত আঙ্কেলের অফারটা নিচ্ছ না কেন বাবা? এই সব পুরনো জিনিস বাড়িতে জমিয়ে রেখে কি লাভ?”
– “তোকে আগেও বলেছি তুই এসব বুঝবি না। তুই ঘরে যা।”
– “আমার পাঁচ লাখ টাকা চাইই চাই। যদি দরকার হয় আমার ভাগের যা সম্পত্তি আছে তুমি আমাকে দিয়ে দাও। আমি সেখান থেকেই টাকা জোগাড় করে নেবো।”
– “তোর নামে কিছুই নেই। যতো বড় মুখ নয় তত বড় কথা। আমি কিছুই দেবো না তোকে। তুই যা ইচ্ছা তাই করতে পারিস।”
সেই সময় পায়েল দিদিমণিও সেখানে ছিলেন উনি কোয়েল দিদিমণিকে আটকাতে চাইলেন
– “দিদি তুই এসব কী বলছিস। তুই ভেতরে চল।”
কিন্তু এতে কোয়েল দিদিমণি আরও ক্ষেপে গেলেন আর বলতে লাগলেন
– “আচ্ছা, বুঝেছি। তুই সব সম্পত্তি বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের নামে করে নিয়েছিস তো? এমন মুখ করে থাকে যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে পারে না। আর আসল কাজটির বেলায় ঠিক করে নেওয়া হয়েছে।”
এসব শুনে বড়বাবু আর মাথার ঠিক রাখতে পারলেন না। কোয়েল দিদিমণির গালে এক থাপ্পড় মারলেন।
কোয়েল – “বাবা তুমি আমার গায়ে হাত তুললে?”
বড়বাবু – “হ্যাঁ এটা আমার অনেক আগেই করা উচিত ছিল। খুব বাড় বেড়েছ তুমি। নিজের বোনকে এভাবে বলতে একবারও বাঁধল না। এই শিক্ষা দিয়েছি তোমায়?”
কোয়েল – “বেশ তোমার কাছে যখন আমার কোনও দামই নেই আমার আর পৃথিবীতে থেকে কী হবে? শেষ করে দেবো আমি নিজেকে।”
এই বলে কোয়েল দিদিমণি বড়বাবুর ঘর থেকে রিভলভার নিয়ে এসে নিজের মাথায় ধরলেন। পায়েল দিদিমণি বললেন
– “দিদি এরকম করিস না, আমার যা আছে সব তো তোর। বাবা আমাকে যা দেবে, সব আমি তোকে দিয়ে দেবো।”
কোয়েল – “তোর ওই ভিক্ষার দান আমার চাই না। আমি মরেই যাব।”
বড়বাবু কোয়েল দিদিমণির হাত থেকে রিভলভারটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন।
– “ছাড় এটা, লোডেড আছে। ছেড়ে দে।”
কিন্তু কোয়েল দিদিমণি নাছোড়বান্দা। ধস্তাধস্তি চলল বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু হঠাৎ দুম করে একটা শব্দ হল। বড়বাবুর সাদা পাঞ্জাবির বুকের কাছটা রক্তে ভিজে গেল। ওখানে যারা ছিল কিছুক্ষণের জন্য সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। বড়বাবু বুকের কাছটা আঁকড়ে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। পায়েল দিদিমণি চিৎকার করে উঠলেন —”বাবা!”
বড়বাবুর মাথাটা পায়েল দিদিমণি কোলে তুলে নেন। বড়বাবু একবার তার মাথায় হাত দিয়ে চোখ বুঝলেন। প্রশান্তবাবু পরীক্ষা করে জানালেন বড়বাবু মারা গেছেন।
এদিকে কোয়েল দিদিমণির মাথায় তখন অন্য চিন্তা, তিনি তখন খুনের দায়ে ধরা পড়বেন। তাই বাচার জন্য উনি প্রশান্তবাবুর পায়ে ধরলেন। প্রশান্তবাবুর অনেক জানাচেনা। তাই তিনি একজন ডাক্তারকে ধরে এনে ‘হার্ট ফেল করে মৃত্যু’ বলে বড়বাবুর নকল ডেথ সার্টিফিকেট বার করলেন।
যেহেতু রায় পরিবার খ্রিস্টান, তাই তাদের কবর দেওয়া হয়। কিন্তু এই গ্রামে সেরকম কোনও কবরখানা না থাকায় এই পরিবারের লোকেদের জন্য বাড়ির পেছনে নিজেদের একটা কবরস্থান আছে। বড়বাবুকেও চুপিসারে সেখানেই কবর দেওয়া হয়।
বড়বাবু মারা যাওয়ার পর পায়েল দিদিমণি যেন কেমন হয়ে যান। ঠিক করে খেতেন না, ঘুমাতেন না, কথাও বলতেন না। কোয়েল দিদিমণি এক ডাক্তার নিয়ে আসেন তার জন্য। সেই ডাক্তার পায়েল দিদিমণিকে কি সব ইনজেকশান, ওষুধ দেন – তাতে ওঁর শরীর আরও খারাপ হয়ে যায়। কোয়েল দিদিমণি এরপর জোর করে পায়েল দিদিমণিকে পাগলাগারদে ভর্তি করে দেন। পায়েল দিদিমণি কিন্তু পাগল ছিলেন না।”
রোহিত – “সে কি! তার মানে পায়েল রায় এখন পাগলা গারদে আছে?”
– “হ্যাঁ স্যার।”
– “আর আপনি বলছেন এই বাড়িতে একটা খুন হয়েছে, কিন্তু তার কোনও তদন্ত হয়নি, তাই তো?”
– “হ্যাঁ একদম তাই স্যার।”
– “আচ্ছা এই ঘটনা কত বছর আগে হয়?”
– “তা ধরুন প্রায় দশ বছর হয়ে গেল।”
– “আচ্ছা আমি কী একবার এই বাড়ির ভেতরটা দেখতে পারি।”
– “হ্যাঁ তা পারেন। চাবি আছে আমার কাছে। কিন্তু এখানে তো ইলেকট্রিসিটি নেই তাই খুব অন্ধকার। কিছু কী ভালো করে দেখতে পাবেন?”
– “তাও আমি দেখতে চাই। আপনি চাবি খুলুন।”
এই কথা শুনে দীননাথ চাবি আনতে গেল তার ঘর থেকে। অন্ধকারে এতক্ষণ রোহিত সেন খেয়াল করেননি তার সামনেই বড়ো বাড়ির পাশে টালি ছাওয়া কয়েকটা ছোটো ঘর আছে। চাবি নিয়ে এসে দীননাথ রায় বাড়ির দরজা খুললেন।
রোহিত সেনের সঙ্গে একটা টর্চ ছিল। সেই টর্চ জ্বেলে রোহিত সেন, রায় বাড়িতে প্রবেশ করলেন। বিশাল বিশাল সব পুরনো আমলের ঘর। ঢুকতেই একটা বসার ঘর। সেখানে সব আসবাবপত্রের ওপর কাপড় দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা আছে। দীননাথ বোধহয় কমই ঢোকে বাড়ির ভেতর। তাই এই বাড়ির জানলা সব বন্ধ। আর বাড়ির ভেতর কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গন্ধ। রোহিত সেন টর্চের আলোয় খেয়াল করলেন বসার ঘরের একটা জানলা খোলা আছে।
– “আচ্ছা দীননাথ বাবু সব জানলা বন্ধ আর ওই জানলাটা খোলা কেন?”
– “আসলে ওই জানলার ছিটকিনিটা খারাপ তাই ওটা বন্ধ করা যায় না। “
– “এই জানলার ছিটকিনিটা কি সেই ঘটনার দিনও খারাপ ছিল?”
– “হ্যাঁ স্যার। এটা বহুদিন থেকেই সারানো হয়ে ওঠেনি। আর এখন তো—”
এই বলে বৃদ্ধ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন।
– “আচ্ছা সেদিন সেই ঘটনাটা কি এই ঘরেই ঘটেছিল?”
– “হ্যাঁ স্যার। আপনি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন একদম সেই জায়গায়।”
– “মানে এই জানলার সোজাসুজি তাই তো? আচ্ছা আপনার বড়বাবুর সেই রিভলভারটা কি এখনও এই বাড়িতেই আছে?”
– “হ্যাঁ স্যার, বড়বাবু মারা যাওয়ার পর কোয়েল দিদিমণি সেটা বড়বাবুর ড্রয়ারেই রেখে দেয়। আর তারপর বড়বাবুর ঘর বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই ঘরে আর কেউ ঢোকেনি।”
– “আচ্ছা সেই রিভলভারটা কি আমি দেখতে পারি?”
– “হ্যাঁ স্যার আসুন।”
এই বলে দীননাথ রোহিত সেনকে নিবারণ রায়ের ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে ড্রয়ার থেকে রোহিত রিভলভারটা পেলেন। তারপর সেটা খুলে দেখলেন। নিজের মনেই বললেন
– “উম, ছ’টা গুলিই আছে।”
তারপর দীননাথকে বললেন
– “আচ্ছা এটা আমি নিয়ে যাচ্ছি। আর আমার কিছু দেখার নেই। চলুন বাইরে যাই।”
এই বলে তারা সেই বাড়ি থেকে বাইরে বেরোলেন। তারপর দীননাথ বললেন
– “স্যার একটু দেখবেন পায়েল দিদিমণির যেন কিছু না হয়। নিষ্পাপ মেয়েটা খুব ভালো স্যার।”
– “হ্যাঁ আমি দেখব। আর আপনি যে খুনের কথা বললেন আমি দেখব তারও যদি কিনারা করতে পারি। আর একটা কথা এই পায়েল রায় কোন আ্যসাইলামে আছে আপনি জানেন?”
– “না স্যার.
সেটা তো কোয়েল দিদিমণি বলতে পারবেন।”
– “কোয়েল রায় এখানে তো নিশ্চয়ই থাকেন না। উনি কোথায় থাকেন?”
– “আজ্ঞে স্যার, আমি ঠিক তো জানি না। তবে প্রতি মাসে আমার মাইনে আর বাড়ির অন্যান্য খরচের জন্য উনি টাকা পাঠান। সেই টাকা পাঠানোর খামে ওঁর ঠিকানা থাকে। উনি কলকাতার লেক টাউনে একটা ফ্ল্যাটে থাকেন। দাঁড়ান আমি একটা খাম আপনাকে দিচ্ছি।”
রোহিত সেন দীননাথের কাছে থেকে সেই খামটি নিয়ে দীননাথকে একটা নমস্কার জানিয়ে গাড়ি নিয়ে রায় ভিলা থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
(৫)
সোমবার সকালে রোহিত সেন লেকটাউনের অর্পিতা অ্যাপার্টমেন্টে এসে উপস্থিত হলেন। এখানেই এই ফ্ল্যাটের চার তলায় কোয়েল রায় থাকেন। ফ্ল্যাটটা বেশ পুরনো আমলের। নিচের ফ্লোরে একটা রেস্টুরেন্ট, কোনও দারোয়ানের বালাই নেই। রোহিত সেন লিফটে ফ্ল্যাটের চারতলায় এসে উপস্থিত হলেন।
সেখানে দু’দিকে দু’টি ফ্ল্যাটের দরজা। একটি দরজার সামনের নেমপ্লেটে লেখা আছে — মিঃ সুশান্ত সেন। আর একটি দরজায় নেমপ্লেটে লেখা মিঃ রাজা তালুকদার ও মিসেস রত্না তালুকদার।
রোহিত সেন কি যেন ভেবে সুশান্ত সেনের দরজার বেলটা বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন মধ্যবয়স্ক পরিচারিকা গোছের ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন। তারপর প্রশ্ন করলেন
– “কে আপনি? বলুন কি দরকার?”
– “আমি এস পি রোহিত সেন।”
এই বলে নিজের আই কার্ডটা দেখালেন। তারপর বললেন
– “আচ্ছা কোয়েল রায় নামের কেউ কি এখানে থাকেন?”
– “হ্যাঁ কোয়েল ম্যাডাম এখানেই থাকেন। তার সাথে কি আপনার কোনও দরকার আছে?”
– “হ্যাঁ দরকার আছে। উনি বাড়িতে আছেন তো?”
– “হ্যাঁ আছেন। আপনি ভেতরে আসুন। আমি ওঁকে ডেকে দিচ্ছি।”
রোহিত সেন সেই ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে এসে, একটা সোফায় বসলেন। ড্রয়িংরুমটা বেশ সাজানো গোছানো। আভিজাত্যের ছাপ আছে সব জিনিসগুলোর মধ্যেই। রোহিত সেনের চোখ পড়ল সামনের দেওয়ালে টানানো কয়েকটা ছবির উপর। বেশ কিছু মানুষের ছবি। তারমধ্যে একজন পুরুষ ও একজন মহিলাকে রোহিতের চেনা চেনা ঠেকল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের মধ্যে একজন ভদ্রমহিলা প্রবেশ করলেন। মহিলা ডাকসাইটে সুন্দরী। নীল গাউনে ওঁকে অনেকটা পশ্চিমী রূপকথায় বর্ণিত সুন্দরী ডাইনীর মত লাগছে। ঘরে ঢুকেই নমস্কার, প্রতি নমস্কারের পর উনি বললেন
– “আমি কোয়েল রায় বলুন কি দরকার?”
– “বেশী কিছু না। জাস্ট একটা এনকোয়ারি আছে। আপনি পায়েল রায় নামের কাউকে চেনেন?”
কোয়েল রায় যেন একটু থতমত খেলেন।
– “পায়েল রায়, মানে পায়েল তো আমার বোন ছিল।”
– “ছিল? তিনি এখন কোথায় আছেন?”
– “পায়েল তো দশ বছর আগে মারা গেছে। “
রোহিত সেন একটু চমকে বললেন
– “মারা গেছে! কিভাবে মারা গেলেন?”
– “আসলে দশ বছর আগে আমার বাবা মারা যান। পায়েল বাবাকে খুব ভালোবাসত। বাবার মৃত্যুর শকটা পায়েল নিতে পারেনি। ওর হার্টও খুব উইক ছিল। তাই বেচারী হার্ট ফেল করে মারা যায়।”
– “তাই নাকি? আচ্ছা আপনার বাবা কীভাবে মারা যান?”
– “সেরিব্রাল স্ট্রোক।”
– “ওকে। আচ্ছা মিস কোয়েল ফ্ল্যাটের বাইরে দেখলাম সুশান্ত সেন লেখা। এই ফ্ল্যাটটা কি ওঁর? আর আপনার সাথেই বা ওঁর কী সম্পর্ক?”
– “হ্যাঁ এটা সুশান্তর ফ্ল্যাট। আমরা লিভ ইনে থাকি।”
– “আচ্ছা, সুশান্ত বাবুকে আপনি কতদিন চেনেন?”
– “সুশান্ত আমার বাবার বন্ধু আর বিজনেস পার্টনার প্রশান্ত সেনের ছেলে। ওর সাথে আমার পরিচয় কলেজ টাইম থেকে।”
– “প্রশান্ত সেন এখন কোথায়?”
– “উনি দু’বছর হল মারা গেছেন।”
– “আচ্ছা আপনার দেওয়ালে ওই যে ছবিটা, আপনার সাথে যে ভদ্রলোক আছেন ওটাই কি সুশান্ত বাবু?”
– “হ্যাঁ। কিন্তু আপনি এত প্রশ্ন কেন করছেন জানতে পারি কি?”
– “আসলে গত পরশু আমাদের থানায় একটা পুরনো ফোন জমা পড়ে। তাতে আমরা একটা রেকর্ডিং পাই। একটু শুনে দেখুন তো এটা।”
এই বলে রোহিত সেই ফোনের রেকর্ডিংটা শোনালেন। তারপর সেটা শেষ হতে বললেন
– “এটা কি পায়েল রায়েরই গলা?”
– “হ্যাঁ এটা পায়েলের গলা। আসলে ওর অ্যাক্টিংয়ের খুব সখ ছিল। নানা রকম হাসি, কান্না ও প্রাকটিস করতো। আর সেগুলোর অডিও, ভিডিও রেকর্ড করে রাখতো। এটাও হয়ত সেরকমই একটা অডিও রেকর্ডিং। আর এই ফোনটা দশ বছর আগে চুরি হয়ে গেছিল। কে যে নিয়েছিল—আপনারা এতদিনে তাহলে ফোনটা পেয়েছেন।”
– “বাঃ আপনার বোন তো বেশ ট্যালেন্টেড ছিল। একদম ন্যাচারাল অ্যাক্টিং। আচ্ছা আপনার দেওয়ালে ওই আরেকটি ছবিতে যে বৃদ্ধ ভদ্রলোক আর একজন অল্প বয়সী মেয়ে আছে ওঁরাই আপনার বাবা আর বোন তো?”
– “হ্যাঁ ওটা আমার বাবা আর ওটা আমার বোন।”
– “বেশ মিস কোয়েল,, আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। আপনার এতটা সময় আমাকে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।”
এই বলে নমস্কার করে রোহিত সেন সেখান থেকে বিদায় নিলেন।
রোহিত সেন বেরিয়ে যেতেই কোয়েল কাকে যেন ফোন করল।
– “হ্যালো সুশান্ত, কিভাবে যেন পুলিশ অনেক কিছু জানতে পেরে গেছে। আমাদের ফ্ল্যাটে এসেছিল জিজ্ঞাসাবাদ করতে।”
ওদিকের ব্যক্তি কী যেন বললেন। তার উত্তরে কোয়েল বলল
– “আমি কী করে জানব, কী করে জানল। আমাকে পায়েলের একটা অডিও রেকর্ডিং শোনাল। আমার মনে হয় দীনু কাকাই কিছু জানিয়েছে।”
আবার কিছু শুনে বললো
– “দেখো তুমি মাথা গরম করে কিছু করে ফেলো না। প্রশান্ত আঙ্কেলও আর বেঁচে নেই, যে সব কিছু সামলে নেবে। শোনো—”
কিন্তু আর কিছু বলার আগেই ওপাশের ব্যক্তি ফোন কেটে দিলেন। এরপর আর কোয়েল সেনের ফোন রিসিভ করলেন না।
(৬)
লেবুতলা থানায় ফিরে রোহিত সেন ইন্সপেক্টর ভরতকে ডেকে পাঠালেন। ভরত আসলে তাকে বললেন
– “ভরত সব কিছুর পেছনে আমি একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি। এই ফোনের অডিও, তার রেকর্ডিং টাইম দেখাচ্ছে চারদিন আগে সকালবেলা। অথচ কোয়েল রায় বলছে ওর বোন দশ বছর আগে মারা গেছে। আবার বাড়ির কেয়ারটেকার বলছে পায়েল রায় পাগলাগারদে আছে। আর নিবারণ রায় খুন হয়েছে তার মেয়ের হাতে। তুমি এই কোয়েল রায়ের ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর করো।”
– “হ্যাঁ স্যার, আপনি বলার আগেই আমি এই কোয়েল রায়ের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। মহিলা খুব একটা সুবিধার নয় স্যার। উনি এই রাজ্যের অনেক জায়গার অনেকগুলো হোটেল আর রিসর্টের মালিক। দু’বছর আগে পুরুলিয়ায় ওঁর একটা রিসর্ট থেকে অনেক ড্রাগস, জাল নোট আর সোনার বার উদ্ধার হয়। মাঝে মাঝে ওঁর অনেকগুলো হোটেল থেকে মধুচক্রেরও খবর পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা ধরতে পারার আগেই কোনও না কোনও উপায়ে ঠিক মহিলা বেরিয়ে যান।”
– “তাই নাকি! আচ্ছা আমি রায় ভিলাতে যে নজর রাখার জন্য লোক পাঠাতে বলেছিলাম, পাঠানো হয়েছে?”
– “হ্যাঁ স্যার। আজ সকালেই আমি সাদা পোশাকের কয়েকজন কনস্টেবলকে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি।”
ঠিক সেই সময় ইন্সপেক্টর ভরতের ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনটা ধরে ভরত একটু কথা বলে। তারপর রোহিত সেনকে এসে বলে
– “স্যার যে কনস্টেবলদের রায় ভিলায় নজর রাখার জন্য পাঠিয়েছিলাম তাদের একজন এইমাত্র খবর দিল রায় ভিলার কেয়ারটেকার দীননাথ খুন হয়েছে।”
– “সেকি কিভাবে হল এসব?”
– “স্যার কেউ দীননাথকে গুলি করে খুন করেছে।”
– “ওহ নো! আমাদের এক্ষুনি সেখানে যেতে হবে।”
– “ঠিক আছে স্যার আমি ব্যবস্থা করছি।”
এই বলে ভরত চলে গেল সব ব্যবস্থা করতে।
(৭)
সোমবার দুপুরবেলা রায় ভিলায় থিক থিক করছে পুলিশ। আশপাশের কিছু কৌতূহলী মানুষও জমা হয়েছে গেটের বাইরে। নেহাতই এটা গণ্ডগ্রাম তাই সংবাদ, মিডিয়ার ভীড় নেই। এর মধ্যেই এস পি রোহিতের জিপ ঢুকল রায় ভিলায়। রায় ভিলায় পৌঁছে রোহিত সেন ক্রাইম স্পটে গেলেন সব দেখতে। বাড়ির পিছনের দিকে লনে দীননাথ এর লাশটা পড়ে আছে।
রোহিত সেন দেখলেন দীননাথ হাত পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়েছে। তাকে সামনে থেকে বুকে গুলি করা হয়েছে। দীননাথেয চোখগুলো বিস্ফারিত। বোধহয় সে খুনীকে চিনতো আর মরার আগে খুব ভয় পেয়েছিল। সব দেখে রোহিত সেখানকার ইন্সপেক্টরকে বললেন
– “লাশটা পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠান।”
সেখানকার ইন্সপেক্টর বললেন
– “স্যার আপনি এখানে? আর এরকম একজন বৃদ্ধ কেয়ারটেকারকে কেই বা খুন করল?”
– “আমার অন্য একটা কেসের সাথে এই কেসটা রিলেটেড। আপনাকে আমার কিছু কথা বলার আছে। এই বাড়িতে এটাই প্রথম খুন নয়। এখানে দশ বছর আগে আরেকটা খুন হয়েছিল।”
– “কি বলছেন স্যার, আমরা তো সেরকম কিছু জানি না।”
– “জানেন না কারণ তার কোনও তদন্ত হয়নি। যাই হোক আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।”
– “কি কাজ স্যার?”
– “বলছি। এই রায় পরিবার ছিল খ্রিস্টান। এই বাড়ির পেছন দিকে এই পরিবারে নিজস্ব কবরখানা আছে। সেখানে নিবারণ রায়ের কবর পাবেন। সেই কবর খুঁড়ে নিবারণ রায়ের লাশটা বার করতে হবে। আপনি এই কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন?”
– “হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার। আমাদের সঙ্গে তো অনেক লোক আছে। আর গ্রাম থেকে মাটি খোঁড়ার জিনিসপত্র আনার ব্যবস্থা করছি।”
এই বলে সেই ইন্সপেক্টর সব ব্যবস্থা করতে গেলেন।
বিকালের মধ্যেই সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। একবার অন্ধকার নামলে এখানে কাজ করা মুশকিল হবে তাই কবর খোঁড়ার জন্য সবাই তাড়াতাড়ি হাত চালাতে লাগল। এক ঘণ্টার মধ্যেই নিবারণ রায়ের কফিনটা বেরিয়ে এল। সেটা খুলতেই একটা পুরনো লাশ পচা ভ্যাপসা গন্ধ। লাশ বলতে এখন আর কিছু নেই। শুধু একটা কঙ্কাল। রোহিত সেন ভালো করে সেটা পরীক্ষা করে দেখলেন। সেই কঙ্কালের পাঁজরের মধ্যে একটা বুলেট পাওয়া গেল। রোহিত সেন ইন্সপেক্টরকে বললেন
– “এই লাশটাও পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করুন। আর এই বুলেটটাও পরীক্ষা করবেন, এই রিভলভারের বুলেট কিনা?”
এই বলে রোহিত সেন তার পকেট থেকে একটা রিভলভার বার করে দিলেন।
– “ঠিক আছে স্যার, আমি সব টেস্টের জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।”
এরপর রায় ভিলায় সমস্ত কাজ মিটিয়ে রোহিত সেন সেখান থেকে বিদায় নিলেন।
(৮)
লেবুতলা থানায় হাতে একটা সিগারেট নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে রোহিত সেন গালে হাত দিয়ে বসেছিলেন। সেই সময় ইন্সপেক্টর ভরত এসে উপস্থিত হল।
– “আরে ভরত বলো নতুন কোনও তথ্য পেলে?”
– “হ্যাঁ স্যার। নিবারণ রায়ের শরীরে যে বুলেট পাওয়া গেছে, সেটা আপনি যে রিভলভারটা দিয়েছিলেন সেটার নয়।”
– “আমি জানতাম এরকমই একটা কিছু হবে।”
– “আর স্যার ওই বুলেটটা আর দীননাথের শরীরে যে বুলেট পাওয়া গেছে সেটা একই রিভলভারের।”
– “আচ্ছা! কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি না বাইরে পুলিশ পাহারায় থাকা সত্বেও আততায়ী ভেতরে ঢুকে খুনটা করলো কি করে!”
– “আমিও সেটাই ভাবছিলাম। আর স্যার পায়েল রায়েরও তো এখনও কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না।”
– “আর দেখো আমি দীননাথের মুখে শুনেছিলাম ওই বাড়িতে অনেক প্রাচীন গ্রীক আমলের শিল্প সামগ্রী আছে। আমি যখন ওই বাড়িতে সার্চ করলাম সেসব তো কিছুই কিন্তু দেখতে পাইনি।”
– “স্যার সেটা তো হতেই পারে। কোয়েল রায় সেগুলো কোথাও বিক্রি করেছে বা সরিয়ে নিয়ে গেছে।”
– “না ভরত, এত কোটি টাকার জিনিস এভাবে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আর সেটা হলে দীননাথ তো বলতো। বিক্রি করলেও এত ভালো অবস্থায় থাকা, এত প্রাচীন জিনিস মার্কেটে এলে কোনও কিছু খবর তো নিশ্চয়ই বের হত। আমার মনে হয় ওই জিনিসগুলো ওই বাড়িতেই আছে। তবে সেগুলো এমন কোথাও রাখা হয়েছে যা সবার দৃষ্টির বাইরে।
ভরত, এই দু’টো খুন,পায়েল রায়ের খোঁজ এই সব কিছুর সূত্র আমার মনে হয় ওই বাড়ি থেকেই পাওয়া যাবে। তুমি রায় ভিলায় তল্লাশি চালানোর সার্চ ওয়ারেন্ট বার করো।”
– “ঠিক আছে স্যার সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
(৯)
বুধবার সকালে রায় ভিলায় উপস্থিত হল রোহিত সেন সমেত একটা বড়ো পুলিশ টিম। তারা গোটা রায় ভিলায় তন্নতন্ন করে সার্চ করতে শুরু করলেন। কিন্তু সেরকম কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। নীচের বসার ঘরে সার্চ করছিলেন ইন্সপেক্টর ভরত। রোহিত একটা জলের বোতল হাতে তার কাছে এসে বললেন
– “ভরত কিছু পেলে?”
– “না স্যার সেরকম কিছু তো পাওয়া যাচ্ছে না।”
বোতল থেকে একটু জল খেয়ে, কথা বলতে বলতে রোহিত তার জলের বোতলটা টেবিলের ওপর রেখেছিলেন। হঠাৎ সেটার ওপর রোহিতের চোখ পড়ল।
– “ভরত দেখো, বোতলের জলটা খুব হাল্কাভাবে কাঁপছে না?”
– “হ্যাঁ তাই তো স্যার।”
– “আর খুব ক্ষীণ কন্টিনিউয়াস একটা মেশিন চলার মতো শব্দ হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছো কি?”
– “হ্যাঁ স্যার।”
– “ভরত, নীচের তলায় কোনও মেশিন বা জলের পাম্প জাতীয় কিছু চললে এরকম হয়। কিন্তু এ বাড়িতে সেরকম কিছু কে চালাবে? ভরত, তুমি বাড়ির ভেতরটা দেখো আমি বাইরেটা একবার দেখে আসছি।”
রোহিত সেন বাইরের লনে এসে উপস্থিত হলেন। এই দিকটা আগে ভালো করে দেখা হয়নি।
লনটা বিশাল বড়ো এরপর একটা বাগান আছে। লনের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ জলের পাইপের মতো কি যেন একটা রোহিত সেনের পায়ে ঠেকলো। রোহিত সেন সেটা ভালো করে দেখতে, দেখা গেল— হ্যাঁ একটা জলের পাইপ, সেটার ওপরে মাটি চাপা দেওয়া। এক জায়গায় একটু মাটি সরে গিয়ে ওপর দিকে বেরিয়ে এসেছে। রোহিত পাইপটা হাত দিয়ে তুলে সেটা ধরে এগোতে লাগলেন। লন পার হয়ে তিনি বাগানে চলে এলেন। বাগানে অনেক বড়ো বড়ো ফলের গাছ আর নীচের দিকে আগাছায় ভর্তি। একটা জায়গায় এসে রোহিত সেন লক্ষ্য করলেন জলের পাইপটা মাটির ভেতর ঢুকে গেছে আর সেই জায়গাটায় অনেক গাছের পাতা জড়ো করে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। রোহিত সেই পাতাগুলো সরিয়ে দেখলেন, একটা পাথরের স্ল্যাব দিয়ে কিছু ঢাকা দেওয়া আছে। স্ল্যাবটা বেশ ভারী।
রোহিত সেটা সরাতেই দেখা গেল একটা সিঁড়ি নীচের দিকে চলে গেছে। রোহিত তার পিস্তলটা বার করে হাতে নিলেন, তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলেন। একটু নামতেই দেখা গেল সেখানে একটা সুদৃশ্য সাজানো ড্রয়িংরুম গোছের ঘর। রোহিত সেন সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেই ঘরে এসে পৌঁছলেন। এখানে ইলেকট্রিসিটি আছে। অনেক লাইট জ্বলছে। আর চারিদিক খুব ঠাণ্ডা। রোহিত নিজের মনে বললেন
– “এ সি চলছে। খুব হাই পাওয়ারের এ সি। উপরে প্রাসাদ আর মাটির নীচেও এত সুদৃশ্য ঘর। নীচে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই। তাই এতো পাওয়ার ফুল এ সি লাগিয়েছে। আর এর জন্যই ওপরের ঘরে জল কাঁপছিল।
ওই পাইপটা – তার মানে এ সির জল বেরোনোর পাইপ।
রোহিত দেখলেন গোটা ঘরে প্রাচীন আমলের সব শিল্পসামগ্রী সাজানো। নানা রকম মূর্তি, আয়না, ড্রেসিং টেবিল। এগুলোই তাহলে সেই গ্রীক অ্যান্টিক জিনিসপত্র। ড্রয়িং রুমের পাশের দিকে আর একটা সিঁড়ি। আর সামনে একটা ঘরের দরজা। রোহিত সেনের চোখ পড়ল সেই ঘরে।
দরজাটা খোলা, আর তার ভেতর দেখা যাচ্ছে একটা খাট। তার ওপর কেউ শুয়ে আছে। আর খাটের পাশে চেয়ারে এক ভদ্রমহিলা বসে ঢুলছেন। রোহিত সেই ঘরে ঢুকতেই খাটে শোয়া মানুষটির দিকে চোখ পড়লো। একটি মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। আরে, এর ছবি তো সেদিন কোয়েল রায়ের ফ্ল্যাটের দেওয়ালে ছিল। যদিও ছবিতে মেয়েটির বয়স তখন কম ছিল। এটা আর কেউ নয়, পায়েল রায়। রোহিতের আর একটা ব্যাপার মনে পড়তেই উনি বেশ অবাক হলেন। সেই প্রথমদিন রায় ভিলায় আসার সময় গাড়িতেও এই মেয়েটাকেই তিনি দেখছিলেন। তাই কোয়েল রায়ের ফ্ল্যাটে ছবিটা দেখে পায়েল রায়ের মুখটা চেনাচেনা লাগছিল। এই সব রোহিত সেন ভাবছেন এমন সময় পাশের চেয়ারের ভদ্রমহিলা জেগে উঠলেন। আর রোহিত সেনকে দেখে চমকে উঠে বললেন
– “একি কে আপনি?”
রোহিত সেন তার পকেট থেকে আই কার্ডটা বার করে দেখিয়ে বললেন
– “আমি এস পি রোহিত সেন। “
– “পুলিশ, বিশ্বাস করুন আমি কিছু করিনি আমি কিছু জানি না স্যার। ওই সুশান্ত বাবু আমাকে প্রাণের ভয় আর টাকার লোভ দেখিয়ে এখানে এনেছেন। “
ভদ্রমহিলা খুব উত্তেজিত হয়ে এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন। তখন রোহিত সেন বললেন
– “ওয়েট ওয়েট,আমাকে গোড়া থেকে সব খুলে বলুন। কিছু লুকাবেন না। আমি কথা দিচ্ছি পুলিশ আপনাকে ধরবে না। ফুল প্রটেকশন দেবে।”
– “বলছি স্যার, বলছি।
আমি মালতি, আশার আলো মেন্টাল আ্যসাইলামের একজন নার্স। এই পায়েল ম্যাডামকে দশ বছর আগে ওই আ্যসাইলামে ভর্তি করা হয়। ওঁর কোনও রোগ ছিল না। কিন্তু ওঁর বাড়ির লোক আ্যসাইলামের অথরিটি আর ডাক্তারদের টাকা খাইয়ে জোর করে পায়েল ম্যাডামকে সেখানে ভর্তি করেন। পায়েল ম্যাডামের দেখাশোনার দায়িত্ব প্রথম থেকেই আমার ওপর ছিল। ওঁদের সম্পত্তির কী সব নিয়ম ছিল। তার জন্য প্রতি মাসে একবার করে পায়েল ম্যাডাম যে বেঁচে আছেন তা কোর্টে হাজির দিয়ে দেখাতে হত। তাই ওঁকে ওষুধ দিয়ে অসুস্থ সাজিয়ে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হত। এরকমই চলছিল কিন্তু একমাস আগে আ্যসাইলামে একজন নতুন ডাক্তার আসেন। তিনি খুব সৎ, কোনও অপরাধ বরদাস্ত করেন না। তাই পায়েল ম্যাডামের ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পেরেই পুলিশকে সব জানিয়ে দেবার হুমকি দেন। তখন সুশান্ত বাবু ঠিক করেন পায়েল ম্যাডামকে বাড়ি নিয়ে চলে আসবেন। আর বাড়িতেই আ্যসাইলামের মতো সব ব্যবস্থা করবেন। তাই সব ঠিকঠাক করতে পায়েল ম্যাডামকে আনার একদিন আগে আমাকে এখানে নিয়ে আসেন।
আমার এই বাড়িতে আসার খবর কোনওভাবে পায়েল ম্যাডাম জানতে পারেন। ওঁর কাছে বহু বছর ধরে একটা ফোন লুকানো ছিল। সেই ফোনে একটা অডিও রেকর্ড করে, আমি এখানে আসার আগে আমাকে দিয়ে বলেন
– “রায় ভিলায় পৌঁছে কেয়ারটেকার দীননাথকে পাবে, এই ফোনটা ওর হাতে দিও।”
কিন্তু আমি খুব ভয়ে ছিলাম। সুশান্তবাবু যদি একবার জানতে পারেন আমাকে প্রাণে
মেরে ফেলবেন। তাই আমি এখানে আসার সময় ফোনটা রাস্তায় ফেলে দিই।”
ঠিক সেই সময় শোনা গেল একজন মহিলা ও পুরুষ কথা বলতে বলতে এদিকে আসছে।
রোহিত সেন মালতিকে বললেন
– “তুমি স্বাভাবিক ভাবে এখানে বসে থাকো আমার এখানে থাকার কথা ওরা যেন বুঝতে না পারে।”
মালতি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেন। রোহিত পায়েলের খাটের নীচে ঢুকে গেলেন।
সেখানে যারা এসেছিল তাদের একজন কোয়েল রায় আর একজন সুশান্ত সেন।
কোয়েল, সুশান্তকে বোঝানোর চেষ্টা করছে
– “দেখো আমি কি করব ওই রোহিত সেন এমন হঠাৎ এসে গেল। তাই আমি বলে ফেলেছিলাম পায়েল মারা গেছে। আর আমি যদি বলতাম ও আ্যসাইলামে আছে তাহলে তো রোহিত সেন জানতে চাইতো কোন আ্যসাইলাম। সেখানে গিয়ে সব জানতে পারলে?”
– “সেসব কিছুই হত না তোমার বোকামির জন্যই দীননাথকে মারতে হল। আর এত ঝামেলা হচ্ছে। তোমাকে না এই ভাবে খোলা ছেড়ে রাখাই আমার ভুল হয়েছে। তোমার অবস্থাও ওই পায়েলের মতো করে রাখা উচিত ছিল। “
– “এসব কি বলছো সুশান্ত? তুমি না আমাকে ভালোবাসো?”
– “ভালোবাসা মাই ফুট। “
– “তোমার জন্য আমি কী না করেছি। নিজের বাবাকে মেরেছি, বোনকে সরিয়েছি, আমার নামে থাকা রিসর্টে দিনের পর দিন তোমার বেআইনি ব্যবসা চালাতে দিয়েছি। আর আজ তুমি এমন বলছ! এরকম করলে আমি পুলিশকে সব জানিয়ে দেবো।”
– “কী পুলিশকে জানাবি? সুশান্ত সেনকে হুমকি! দেখ আমি তোর কী করি।”
এই বলে হঠাৎ সুশান্ত একটা রিভলভার বার করে কোয়েলের পায়ে গুলি করল। কোয়েল পাটা ধরে মাটিতে বসে ছটফট করতে লাগল। সুশান্ত এই সুযোগে পকেট থেকে একটা ওষুধের অ্যাম্পুল আর সিরিঞ্জ বার করল। সিরিঞ্জে অ্যাম্পুল থেকে তরল ভরে নিয়ে সেটা কোয়েলের শরীরে পুষ করতে গেল। তখনই রোহিত সেন খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এসে সুশান্ত সেনের দিকে রিভলভার তাক করে বললেন
– “হ্যান্ডস আপ সুশান্ত বাবু। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।”
কোয়েল রায়কে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন
– “দেখলেন তো মিস কোয়েল ভুল মানুষকে বিশ্বাস করার ফল।”
– “হ্যাঁ মিঃ রোহিত। এর জন্যই আমার হাতে আমার বাবাও খুন হয়েছে। আজ বাবা বেঁচে থাকলে এসব কিছুই হত না। এই লোকটা বাবার খুনের কথা সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার নাম করে আমাকে কিছুটা ব্ল্যাকমেল করেই এসব করিয়েছে।”
– “না মিস কোয়েল আপনার বাবা আপনার হাতে খুন হননি। সেদিন আপনাদের ঝামেলার সুযোগ নিয়ে এই লোকটাই আপনাদের ঘরের খোলা জানলা দিয়ে গুলি চালায়। আপনার বাবার শরীরে যে বুলেটটা পাওয়া গেছে তা মিঃ সুশান্ত সেনের রিভলভারের বুলেট।”
– “কি বলছেন মিঃ রোহিত!”
ঠিক এই সময় সুশান্ত তার পেছনে থাকা একটা গ্রীক আমলের ছুরি তুলে নিয়ে রোহিত সেনকে আক্রমণ করতে আসে। রোহিত সেন সুশান্তকে লক্ষ্য করে গুলি চালান। গুলিটা সুশান্তর পেটে লাগে। সুশান্ত মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে।
রোহিত সেন তখন ইন্সপেক্টর ভরতকে ফোন করে সেখানে আসতে বলেন আর অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিতে বলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ ফোর্স নিয়ে ভরত সেখানে উপস্থিত হলেন। কিন্তু সুশান্ত আর কোয়েলকে ওই বাগানের রাস্তা দিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া মুশকিল। তখন রোহিত বললেন
– “ভরত, এখানে আসার জন্য বাইরে দিয়ে হয়তো আর একটা রাস্তা আছে। সেখান দিয়ে যাতায়াত করা সহজ হতে পারে।”
এই বলে তারা একটু খুঁজতেই উল্টো দিকে আরেকটা সিঁড়ি দেখতে পেলেন। সেই সিঁড়ি ধরে উঠতেই বেশ বড়ো একটা দরজা পড়লো। সেটা ওপর দিকে তুলে খোলা হল। বাইরে বেড়িয়ে দেখা গেল, তারা রায় পরিবারের কবরখানায় এসে পৌঁছেছেন। আর এই সুরঙ্গের দরজাটা ঠিক একটা বাধানো কবরের মতো দেখতে তাই বাইরে থেকে বোঝা যায় না। রোহিত সেন বললেন
– “ভরত আগেকার দিনের সব প্রাসাদেই শত্রুর হাত থেকে বাচার জন্য এরকম গুপ্ত কক্ষ আর বাড়ির বাইরে বেরোনোর সুড়ঙ্গ থাকত। আমি যেদিন প্রথম এ বাড়িতে আসি রাস্তায় এই সুশান্ত সেন, পায়েলকে নিয়ে আসছিল। তখন আমি বুঝতে পারিনি। সুশান্তরা এই বাড়িতে ঢোকার জন্য এই রাস্তাটা ব্যবহার করত তাই দীননাথও কিছু বুঝতে পারেনি। আর দীননাথকে খুন করার জন্য সুশান্ত ওই বাগানের রাস্তাটা দিয়ে বেরিয়েছিল। তাই আমাদের লোক কাউকে রায় ভিলায় ঢুকতে দেখেনি।”
– “বাপরে! ভাগ্যিস ওই বাগানের দিকের দরজাটা আপনার চোখে পড়েছিল। নাহলে তো এই কেসটা সলভই হতো না।”
– “হ্যাঁ ভরত।”
এরপর সব কাজ মিটিয়ে রোহিত রায় আর ইন্সপেক্টর ভরত খাঁড়া, রায় ভিলা থেকে বেরিয়ে গেলেন।
রায় ভিলার কেসটা কোর্টে প্রায় এক বছর ধরে চলে। এরপর সুশান্ত সেনের জেল হয়। কোয়েল রায় পায়েলকে নিয়ে রায় ভিলাতেই থাকতে শুরু করে। কোয়েল নতুন জীবন আর নতুন একটা ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা শুরু করেছে। আর গ্রীক আমলের প্রাচীন সব শিল্প সামগ্রী তারা ভারতীয় প্রত্নতত্ব বিভাগে দান করেছে। তাদের এই নতুন জীবন দেওয়ার জন্য কোয়েল রায় আর পায়েল রায় রোহিত সেনের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
—@—