Getting your Trinity Audio player ready...
|
মনো যোগ সহকারে পেপার পড়ছিল অভিজিৎ। ঠিক সেই সময় তার স্মার্ট ফোনটা বেজে উঠল। পেপারটাকে টেবিলের উপর রেখে একটা বিরক্তি সূচক শব্দ করে ফোনটা ধরল অভিজিৎ। অভিজিৎ এর অনেকগুলো অভ্যেসের মধ্যে এই একটি অভ্যেস হল, পেপার বা কোন বই পরবার সময় তাকে একদম বিরক্ত করা চলবে না। ফোনটা ধরেই গুরুগম্ভীর হয়ে উঠল অভিজিৎ। ফোনে বিশেষ একটা কথা বলল না। শুধু হ্যাঁ, ঠিক আছে, অসুবিধা নেই, রাখি বলেই ফোনটা কেটে দিয়ে পেপারটায় আবার মনঃসংযোগ করল। আমি তাকে কার ফোন এসেছিল বা কী ব্যাপার কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। কারণ আমি জানি পেপারটা পড়া শেষ হলেই সে আমাকে সমস্ত ব্যাপারটা নিজেই বলবে।
কিছুক্ষণ পর পেপার পড়াটা শেষ করে অভিজিৎ বলে উঠল, ‘প্রকাশপুর যাবে নাকি?’ নামটা খুব চেনা চেনা ঠেকছে, কিন্তু কোথায় নামটা শুনেছি বা কেনই বা চেনা চেনা ঠেকছে বুঝতে পারলাম না। আমার এই রকম ভাবুক দৃষ্টি দেখেই অভিজিৎ বলল, ‘এই একটা দোষ তোমার, পেপারটাকে হাতে নাও, চোখ বোলাও কিন্তু মাথাতে নাও না। তাই এই নামটা তোমার কাছে খুব পরিচিত মনে হলেও ঠিক ধরতে পারছ না কোথায় পড়েছ বা কেন এত শোনা বা চেনা চেনা ঠেকছে। তাই তো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ তুমি ঠিক ধরেছ। এবার নামটা মনে পড়ল। সত্যিই তো কিছুক্ষন আগেই তো আজকের পেপারে নামটা পড়লাম। পুরুলিয়ার এই প্রত্যন্ত গ্ৰামটাকে এতদিন কেউ চিনত না, সেখানে হঠাৎ শোনা যাচ্ছে মাটি থেকে উদ্ধার হচ্ছে বিভিন্ন প্রাচীন যুগের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন জিনিসপত্র। এছাড়া পেপারে এইটাও পরছিলাম যে, সেখানে একজন বাড়ি বানানোর জন্য মাটি কাটছিল এবং সেই মাটি কাটতে গিয়ে উদ্ধার হয় বেশ কয়েকটি দামী অলঙ্কার। কিন্তু সে নয় হল, কিন্তু আমরা কেন যাব। নতুন কোন কেস নাকি?’
‘হ্যাঁ, ওই গ্ৰামেরই একজন বিত্তশালী ব্যক্তি ফোন করেছিল। নাম বললেন উমেশ্বর ব্যানার্জী। তিনি জানিয়েছে কালকেই তাদের গ্ৰাম প্রকাশপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে। তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম যাবে নাকি সেই গ্ৰামে?’
‘আরে অবশ্যই যাব। অভিজিৎ সেনের মত মস্ত গোয়েন্দার সঙ্গ কী এত সহজেই ত্যাগ করা যায়?। যাব যাব।’
‘থাক অনেক হয়েছে। বেশি বাড়িয়ে বলতে হবে না। সময় নষ্ট না করে বাড়ির লোককে জানিয়ে নিজের সমস্ত পোশাক গুছিয়ে নিয়ে আমার বাড়ি চলে আসো। বাড়িতে বলে এসো যে, রাতে তুমি এখানে খাওয়া দাওয়া করে নেবে এবং রাতে আমার বাড়িতেই থাকবে। কাল ভোর বেলায় আমরা রওনা দেব।’
আমার নাম রাহুল ভৌমিক। বর্তমানে বেশ কয়েকটি পত্রিকায় লেখালেখি করি। অভিজিৎ এর সাথে আলাপ কলেজ লাইফ থেকেই। দু’জনে একসাথে কলেজেই পড়েছি। বর্তমানে অভিজিৎ একজন প্রাইভেট ডিটেক্টিভ, তার একমাত্র সঙ্গী হিসেবে আমাকে সে তার বিভিন্ন অভিযানে বর্তমানে নিয়ে থাকে। ইতিমধ্যে দু চারটে ছোট, বড় তদন্ত কার্য সমাপ্ত করে অভিজিৎ গোয়েন্দা মহলেও পরিচিতি লাভ করেছে। তার কাছে এখন প্রায় অনেক কেস আসছে বিভিন্ন জায়গার থেকে। আগামীকাল রওনা দেব আমরা পুরুলিয়ার প্রকাশ পুর গ্ৰামে। খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে নিজেকে আজ। নিজের সমস্ত পোশাক গুছিয়ে নিয়ে রওনা দিলাম অভিজিৎ এর বাড়ির উদ্দেশ্যে।
‘রাহুল, কিছুক্ষণ আগে নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ অফিসার শ্যামল মন্ডল ফোন করেছিল। প্রকাশপুরের উমেশ্বর ব্যানার্জী তার দূর সম্পর্কের আত্মীয় হন বললেন। শ্যামলবাবুই উমেশ্বরবাবুকে আমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করে নিতে বলেছেন। শ্যামলবাবুকেই উমেশ্বর ব্যানার্জী প্রথম ফোন করে তাকেই প্রকাশ পুর আসতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি বর্তমানে একটা মার্ডার কেসে একটু ব্যস্ত হয়ে আছেন জানালেন।’
‘শ্যামলবাবু জানেন যে কি কারণে আমাদের প্রকাশপুর যেতে হবে?’
‘না, শ্যামলবাবু তা কিছুতেই বলতে পারলেন না। আমি তাকে কারণ জিজ্ঞেস করাতে সে বলেছে তাকেও ফোনে কিছু বললেন নি। শুধু বলেছে কেসটা খুব গোপন।’
অভিজিৎ এর কথাগুলো শোনার পর রহস্যের পারদ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে তা বুঝতে পারলাম। ষ্টেশনে যখন আমরা নামলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজে। অভিজিৎকে ট্রেন থেকে নামার আগে ফোন করে নিতে বলেছিলেন উমেশ্বরবাবু। কথা মত অভিজিৎ ফোন করে দিয়েছে। উমেশ্বরবাবু জানিয়েছেন, ষ্টেশন থেকে নেমেই একটা লাল রঙের ফোর হুইলার গাড়ির সামনে চলে যেতে। কথা মত আমরা ষ্টেশন থেকে নেমেই একটা লাল রঙের ফোর হুইলার গাড়ি দেখতে পেলাম। এগিয়ে যেতেই গাড়ির ভিতর বসে থাকা রোগা বেঁটে খাটো ড্রাইভারটা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন – ‘নমস্কার, কোলকাতা থেকে আসছেন?’ অভিজিৎ এবং আমি নমস্কার জানিয়ে ঘাড় কাত করে ‘হ্যাঁ ‘বলাতেই ড্রাইভার দরজা খুলে আমাদের ভিতরে বসতে বলে নিজে নিজের ড্রাইভারের আসনে বসে গাড়ি চালু করে দিলেন। ভিড় কাটিয়ে গাড়িটা ন্যাশনাল হাইওয়েতে উঠল। অভিজিৎ প্রথম মুখ খুলল, ‘আজ্ঞে উমেশ্বরবাবুর বাড়ি এখান থেকে কত দূর?’ ড্রাইভার লোকটি বললেন, ‘ সামান্য দূরে।’ এবার প্রশ্ন করলাম আমি।
‘আপনি কি উমেশ্বরবাবুর সহকারী?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি ওঁর সহকারী আমার নাম বিশ্বনাথ পাল।’
অভিজিৎ ট্রেনে বসে আমাকে জানিয়েছিল যে,উমেশ্বরবাবু হলেন ডাক্তার। তার সহকারী অর্থাৎ কম্পাউন্ডার গাড়ি নিয়ে আসবেন।
‘আপনি উমেশ্বরবাবুর সাথে কাজ করছেন কতদিন?’ বলল অভিজিৎ। লোকটি মৃদু হেসে বলল, ‘তা বেশ কয়েক বছর হল।’
ইতিমধ্যে গাড়িটা কাঁকর যুক্ত মাটির পথে পাড়ি দিয়েছে। দুপারে ধান খেত। তাতে ফলে আছে সোনালী ফসল। বেশ কয়েকজন চাষী মাঠে চাষের বিভিন্ন কাজে যুক্ত। সবুজ গাছপালা বিদায় জানিয়ে ঝড়ের গতিতে চলেছে আমাদের গাড়িটা। রাস্তায় বিশেষ লোকজন নেই। বেশ কিছুক্ষণ আমরা এমনি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। রাস্তায় দুচারটে গরুর গাড়িও দেখলাম। মনে হল শরীরটাও যেন চাঙ্গা হয়ে উঠল বেশ।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর গাড়িটা এসে থামল এক প্রকান্ড বাড়ির সামনে। সম্ভবত গাড়ির ব্রেক কষার আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এসেছেন বাড়ির অনেকেই। প্রকান্ড গেট। গেটের ডানদিকে পাথরে খোদাই করে লেখা ব্যানার্জী ভিলা। এবার দেখলাম বছর পঞ্চাশের একজন চশমা পড়া লম্বা স্বাস্থ্যবান লোক আমাদের দিকে হাসিমুখে এগিয়ে আসছে।
‘নমস্কার নমস্কার। আমিই উমেশ্বর ব্যানার্জী।’
অভিজিৎ ও আমি তাঁকেও নমস্কার জানালাম। উমেশ্বর ব্যানার্জী এবার আমাদেরকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। এত বড় বাড়ি আমি প্রথম দেখলাম। জমিদার বাড়ি। বেশ কিছু জায়গায় সংস্কার করা হলেও বাড়িটা বেশ খাসা। উমেশ্বরবাবু আমাদের দুজনকে তিন তলার একটি ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মনে হল এইটা কেবলমাত্র অতিথিদেরকে জন্য খোলা হয়। যখন কোন অতিথি আসেন তখন এই ঘর খোলা হয় আবার অতিথিরা চলে গেলেই এই বন্ধ করে দেওয়া হয়।
উমেশ্বরবাবু বললেন, ‘এই ঘরে আপনারা থাকবেন। কোন অসুবিধা হলেই আমাকে জানাবেন।’
অভিজিৎ বলল –
‘সে না হয় হল। কিন্তু এবার আমাদের বলুন কী ব্যাপারে আমাদের এখানে ডাকলেন?’
‘আগে আপনারা টিফিন করুন। দুপুরের খাওয়া দাওয়া করুন, বিশ্রাম নিন তারপর সন্ধ্যাবেলায় সব কথা হবে।’
ইতিমধ্যে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল উমেশ্বরবাবুর কম্পাউন্ডার বিশ্বনাথ পাল।
‘স্যার, দীপঙ্কর বাবু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আবার। তাকে দেখতে যেতে হবে।’
‘তাহলে তো আমাকে যেতে হবে। অভিজিৎবাবু আপনারা বিশ্রাম নিন আমরা রোগীকে দেখে এক্ষুনি আসছি।’ বলে উমেশ্বরবাবু চলে গেলেন।
অভিজিৎ বিছানায় শুয়ে পড়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম –
‘কিছু বুঝতে পারছ কেসটা কি?’
– ‘না এখনও কেসটা কি সেটা বুঝে উঠতে পারছি না। তবে খুব তাড়াতাড়ি বুঝে যাব আশা করছি।’
– ‘তোমার কি মনে হয় যে, আমরা একটা কঠিন রহস্যের সম্মুখীন হতে চলেছি?।’
– অবশ্যই। তবে রহস্যটা কঠিন না সহজ সেটা উমেশ্বরবাবুর মুখ থেকে শোনার পর স্পষ্ট হয়ে যাবে।’
দুপুরের অসাধারণ খাবারগুলো এখনও মুখে লেগে আছে। ডাল, ভাজা, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, দই কাতলা, কচি পাঠার মাংস, চাটনি, পাঁপড়, রসগোল্লা পেটের ভিতর থেকে মাঝে মাঝেই জানান দিচ্ছে তাদের উপস্থিতি। পেট ভরে খাওয়া দাওয়ার পর ঘুম ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল। আমি আর অভিজিৎ ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো শঙ্খের আওয়াজে। সন্ধ্যা হয়েছে তখন।
‘কি মশাই ঘুম ভাঙ্গলো?’ আওয়াজটা কানে যেতেই পিছনে ফিরে দেখলাম উমেশ্বরবাবু দাঁড়িয়ে আছেন।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ আসলে খাওয়া দাওয়ার পর আমার আর রাহুলের ঘুমানো একটা অভ্যাস বলতে পারেন,’ বলল অভিজিৎ।
উমেশ্বরবাবু এবার ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে চারদিকটা একটু দেখে এলেন। কেউ আসপাশে আছে কিনা। তারপর দরজা খুব সন্তর্পনে বন্ধ করে বললেন, ‘দেখে নিলাম আশে পাশে কেউ আড়ি পাতছে কিনা।’
উমেশ্বরবাবুর এই কথাটার মধ্যে দিয়ে এক ব্যাপক রহস্যের গন্ধ পেলাম। বুঝতে পারলাম এখন সে এমন কিছু বলতে চলেছেন যা অত্যন্ত গোপন।
‘উমেশ্বরবাবু বলুন আপনার সমস্যার কথা। আমরা আপনার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব। তবে কোন কিছু গোপন করবেন না। সমস্ত কিছু খুলে বলবেন। এতে আমাদের রহস্য সমাধানে সহজ হবে।’
‘তাহলে আমি প্রথম থেকেই ব্যাপারটা বলি। আমি কোলকাতায় থেকে ডাক্তারি পড়েছি। ডাক্তারি পড়বার পর কোলকাতাতেই একটা নতুন বাড়ি বানিয়ে সেখানেই ছিলাম। বাবা অনেকবার আমাকে কোলকাতায় থাকাকালীন ডাকতেন এই প্রকাশপুরে। আমি আসতে চাইতাম না। কারণ এখানে আসা মানেই আমি মনে করতাম স্বাধীনতা হরণ হওয়া আমার। বাবার রক্তে জমিদারের আগুন জ্বলজ্বল করছে তখন। রাগী মানুষ। ভাবতাম তার থেকে যত দূরে থাকতে পারব তত ভালো। কোলকাতায় বেশ ভালোই ছিলাম।
সেদিন রাতে হঠাৎ ফোন এল আমার কাছে। ফোনটা করেছিল গ্ৰামের ডাক্তার। ডাক্তারবাবু জানালেন বাবার মাথার পিছনে কে একটা শক্ত কিছু দিয়ে ব্যাপক আঘাত করেছে। তাতেই রক্তাক্ত কান্ড ঘটেছে। এই কথাটা শোনার পর ফিরে আসি কোলকাতা থেকে গ্ৰামে। পরেরদিন ফিরে যেতে চাইলে মা আর ফিরে যেতে দেয়নি কোলকাতাতে। পূর্ব পুরুষদের যা সম্পত্তি আছে তাতে দিব্যি চলে যাবে তা সকলে বুঝিয়ে বললেন। আমার স্ত্রী তাই বললেন। তাই সকলের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই রয়ে গেলাম গ্ৰামে। জানেন বাবার সাথে এই রকম একটা বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটে যাবার পর থেকেই বাড়িতে আশ্চর্য বেশ কিছু ঘটনা ঘটে চলেছে। যেমন ধরুন, রাতের বেলায় দারোয়ান কাউকে না কাউকে আমাদের এই বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে দেখছে। রাতে বাবার ঘরে কেউ যেন কিছু একটা খুঁজছে। এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে সব তবে সেই চোর কিন্তু বাড়ির দামী জিনিসপত্র এর দিকে কোন বিশেষ নজর দিচ্ছে না। আমি ডাক্তার হবার কারণে এবং মা ও বাকিদের সেবার কারণে বাবা খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করলাম। বাচনিক ক্ষমতা অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে। কথাগুলো পরিষ্কার করে বলতে পারে না। তার উপর ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হবার কারণে তিনি অনেক কথাই মনে রাখতে পারেন না।
তবে বাবা সামান্য সুস্থ হয়ে যাবার পর আমাকে ও আমার ছোট ভাই রামেশ্বরকে একদিন বিকেল বেলায় ডেকে পাঠালেন। আমি ও ভাই যাবার পর বাবা আমাকে বেশ কিছু কথা বললেন অস্পষ্ট ভাবে। বাবা বললেন, “তোমাদের আমি প্রথমে ভেবেছিলাম এই কথাটা বলব না। তবে আমার শারীরিক অবনতি আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করছি। আজ আছি কাল নেই। তাই এই পরিস্থিতিতে তোমাদের এই কথাটা বলে যাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বাড়ির উত্তর পশ্চিম দিকে একটি বিষ্ণু মন্দির আছে সে তো তোমরা দু’জনেই জান। সেখানে আমাদের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে কেউ একজন বিপুল সম্পত্তি লুকিয়ে রেখেছেন। সেই বিপুল ধন- সম্পত্তির পাওয়ার নকশাও আমার কাছে আছে। কারণ নকশা ছাড়া কখনোই এই জিনিস পাওয়া সম্ভব নয়।” আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “বাবা মশাই কোথায় আছে সেই নকশা ?” প্রশ্নটা শুনে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে সে বলল, “সেটা আমার একদম মনে পড়ছে না। তবে আমি এইটা অনুমান করতে পারি সেটা আমার ঘরের কোথাও আছে।” আমি অবশ্য বাড়ির সমস্ত জায়গা খুঁজে ফেলেছি। কোথাও নেই সেই নকশা। আমার সন্দেহ হচ্ছে রাতে কোন চোর ঢুকে এইটাকে হাতিয়েছে। আপনার কাজ হল আমাদের বাড়ির নিরাপত্তা কে বা কারা হরণ করছে তার সন্ধান করা। আর তার পাশাপাশি নকশাটাকে খুঁজে বের করে বিপুল সম্পত্তি আমাদের হাতে তুলে দেওয়া। আপনি আপনার পারিশ্রমিক পাওয়া নিয়ে একদমই চিন্তা করবেন না। সেই ভার আমার। আমি আপনাকে সেই ব্যাপারে খুশি করে দেব। আপনি যতদিন পারেন এখানে থাকতে পারেন আমার অতিথি হয়ে। আশা করি আপনার কোন আপত্তি থাকবে না।’
‘না, আমার তো আপত্তি থাকার কোন প্রশ্নই থাকে না। অবশ্যই আমি এই ব্যাপারে বিশেষ তদন্ত করব। আশা করি সময় লাগলেও আমার তদন্ত ব্যার্থ হবে না। তবে এইটাও ঠিক মাঝে মাঝেই আপনাকে আমার কাজে সাহায্য করতে হতে পারে। চলুন এবার বাড়ির সকলের সাথে আলাপ করা যাক। এতে হয়তো আমার তদন্ত কার্যক্রমে বিশেষ সুবিধা হতে পারে।’ কথাগুলো বলে অভিজিৎ তার মোটা কাচের চশমা রুমাল দিয়ে মুছতে থাকল।
উমেশ্বরবাবু উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘অবশ্যই, অবশ্যই!, চলুন আপনারা আমার সঙ্গে। আমাদের পরিবারের সকলের সাথে আলাপ করিয়ে দিই। তার পাশাপাশি পুরো বাড়িটাও একবার ঘুরে দেখে আসবেন চলুন।’
প্রথমে উমেশ্বরবাবু তার পর অভিজিৎ এবং সবার শেষে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের একটা ঘরে ঢুকলাম। সেইটায় বই-পত্রে পরিপূর্ণ। অভিজিৎ তাক থেকে একটা মোটা বই বার করে উমেশ্বরবাবুকে বললেন, ‘এই বইটা কে পড়ে?’ উমেশ্বরবাবু বললেন, ‘এই বইগুলো আমার ছোট ভাই পড়ে। খুব কল্পনা প্রবণ এখনও সেই ছোটটিই রয়ে গেছে। বাবা ছোটবেলা থেকেই ওকে বিভিন্ন রূপকথার গল্পের বই কিনে দিত। সেখান থেকেই ওর এই রূপকথার গল্পের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ। এইটা আমাদের লাইব্রেরী, যদিও আমাদের বাড়ির কেউই খুব একটা বিশেষ বিশেষ বইপত্র পরে না।’ অভিজিৎ একগাল হেসে বললেন, ‘বাহ্ দেখেও খুব ভালো লাগলো যে আজকাল কেউ রূপকথার গল্পের ভক্ত। এখন তো গল্পের বই পড়বার চলটাই উঠে গেছে সকলের মধ্যে থেকে।’
এবার আমরা লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে এলাম। উমেশ্বরবাবু আমাদের বেশ কয়েকটা ঘরের পর আরেকটি ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে বছর পঁচিশের একজন ছেলে হাতে বই নিয়ে পিছন ফিরে পড়ছেন মনসংযোগের সাথে। উমেশ্বরবাবু ডাক দিলেন – ‘ভুবন আরে ওই ভুবন!’ উমেশ্বরবাবুর ডাক শুনে পিছন ফিরে তাকালেন যুকটি। উমেশ্বরবাবু আমাদেরকে বললেন, ‘এই যে এইটা আমার ছোট ভাই ভুবনেশ্বর। খুব ভালো ছেলে। ভুবনেশ্বর কোলকাতার কলেজে পড়াশোনা করে বর্তমানে এখন গ্ৰামে বাবার বিভিন্ন ব্যবসার কার্যকর্ম সামলায়।’
আমরা নমস্কার জানালাম। ঠিক সেই সময় নারীকন্ঠের একটা বিকট চিৎকার ভেসে এল নীচ থেকে। চিৎকারের শব্দ লক্ষ্য করে আমরা তিনজনে তখন তিনতলা থেকে নীচের বাগানের দিকে ছুটে গেলাম। বাগানের সামনে গিয়েই আমাদের চক্ষু চরক গাছ। রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে রয়েছে উমেশ্বরবাবুর বৃদ্ধ বাবা রাজেশ্বর ব্যানার্জী। চিৎকারটা করছিলেন উমেশ্বরবাবুর মা।
পুলিশ অফিসার সৌমেন মহাপাত্র অভিজিৎ এর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনার কি মনে হচ্ছে, রাজেশ্বরবাবুকে ধাক্কা মেরে নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছে নাকি, তিনি কোন কারণে নীচে এসেছিলেন সেই সুযোগে খুনী মেরেছেন। তাকে যেমন প্রথমবারের মত ঘরে ভিতর শক্ত কিছু দিয়ে পিছনে মারা হয়েছিল ঠিক তেমনি হয়েছে?’ প্রশ্নটা করে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকল। অভিজিৎ মুখে কিছু না বলে হাতের ভঙ্গিতে উপরে উঠত বলল। আমরা অভিজিৎ এর পিছন পিছনে প্রবেশ করলাম রাজেশ্বরবাবুর ঘরে। পুলিশ অফিসার এবং অভিজিৎ খুনী কোন প্রমাণ রেখে গেছে কিনা তার কিনারা করতে থাকলেন। এরপর অভিজিৎ প্রথম মুখ খুলল।
‘সৌমেনবাবু এবার আপনার প্রশ্নের উত্তরের একটা অপ্রমাণিত জবাব দিতে পারব বলে মনে হচ্ছে। এই দেখুন এই চেয়ারটিতে তিনি বসতেন। এই চেয়ার থেকে তিনি কোন কারণে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। মনে হচ্ছে খুনীর সাথে বৃদ্ধ রাজেশ্বরের কোন ধস্তাধস্তি হয় নি। কারণ যদি ধস্তাধস্তি হত তাহলে ঘরের বাকি জিনিসপত্র এইদিক ওইদিক হয়ে যেত। এখানে কিন্তু তা হয় নি। তবে হ্যাঁ এইটা ঠিক তিনি উত্তেজিত হয়ে গায়ের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে কারোর দিকে এগিয়ে গেছিলেন। তারপর খুনী এক ধারে সরে যায়। তারপর এক বিশাল ধাক্কা দেয় খুনী রাজেশ্বরবাবুকে। জানালা বড় হবার কারণে বেগ সামলাতে না পেরে নীচে পড়ে যান। এই দেখুন এখানে পাঞ্জাবির একটা টুকরো জানলার ফাঁকে আটকে গেছে। যখন তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন তখন পাঞ্জাবির একটা অংশ এখানে আটকে যায়। জানালায় গ্ৰিল থাকলে হয়তো এই বিপত্তি ঘটত না। এই বাড়ির জানলাগুলো নতুন করে করা হয়েছে। কাঁচের লাগান হয়েছে। তবে এতক্ষণ যা বললাম, তা সম্পূর্ণ আমার অনুমান। এবার আপনাদের কাছে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এলে সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
সৌমেনবাবু অভিজিৎ এর কথাগুলো শোনার পর যেন বেশ খানিকক্ষন চমকিত ও অবাক হয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আরে মশাই আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দেখে তো আমি মশাই আপনার ভক্ত হয়ে উঠলাম। আমার তো মনে হয় না রিপোর্টে এর কোন পরিবর্তন হবে।’
ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন উমেশ্বরবাবু। সত্যি সে একদম ভেঙ্গে পড়েছে। তার সতেজ হাঁসি খুশি মুখমন্ডল বিষাদের ঘন মেঘে আচ্ছাদিত হয়েছে। চোখ মুখ লাল। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল এলোমেলো। অভিজিৎ বলল –’আমি জানি এই পরিস্থিতিতে আপনাকে প্রশ্ন করা উচিত নয়। তবুও আমাকে বেশ কিছু প্রশ্ন করতে হবে। আশা করি আপনি আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো দেবেন। এতে আপনার বাবার খুনীকে আমরা খুব শীঘ্রই ধরতে পারব।’
উমেশ্বরবাবু হতাশ মুখে বললেন, ‘আমি আমার বাবার খুনীর শাস্তি চাই। তার জন্য আপনার যে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি রাজি।’
অভিজিৎ আমাকে হাতের নির্দেশে ডাইরিতে তার প্রশ্ন ও উমেশ্বরবাবুর জবাবগুলো লিখে নিতে বললেন।
– ‘আপনাদের বাড়ির জানলায় কি আগে গ্ৰিল লাগানো ছিল?
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘তাহলে কে সেটাকে ভেঙে এত বড় করে জানলা বানিয়েছে? আর যদিও বা জানলা বড় হয় তাতে গ্ৰিল না লাগিয়ে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত রেখে একটা কাঁচের জানালা লাগিয়েছেন কেন?’
– ‘এইটা কেউ বানায়নি। বাবার নির্দেশে হয়েছে। আপনাকে আমি বলছিলাম না যে বাড়িতে কাদের যেন আনাগোনা হচ্ছে তাদের উপর নজর রাখার জন্য তিনি এমন জানালার ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন।’
– ‘তাহলে কি আপনার বাবা অনিদ্রায় ভুগতেন?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘আপনাদের বাড়িতে কে কে আছে? কারণ সবার সাথে তো এখনও পর্যন্ত আলাপ হয়নি।’
– ‘আমার বাড়িতে আছেন আমার বৃদ্ধা মা, ছোট ভাই ভুবনেশ্বর, বোন উমারাণী, আমার স্ত্রী, ছোট ছেলে, সহকারী বিশ্বনাথ পাল, দারোয়ান বিপিন যাদব, আর দুচারজন চাকর।’
– ‘আপনার মা কি তাকে উপর থেকে পড়তে দেখেছে? তিনি কি জানালেন?’
– ‘মা কাঁদতে কাঁদতে যেটুকু জানান তিনি ও আমার ছোট বোন ঘরেই ছিলেন। হঠাৎ একটা আওয়াজ বা আর্তনাদ পেয়ে তারা বাগানে গিয়ে এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখেন।’
– ‘আপনার বাবার কি কোন শত্রু আছে বলে আপনার মনে হয়?’
– ‘হ্যাঁ বাবার শত্রু থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ বাবা খুব রাগী মানুষ ছিলেন। এক কালে বহু মানুষের উপর অত্যাচারও করেছেন শুনেছি।’
– ‘কি ক্ষতি বলতে পারবেন?’
– ‘না।’
– ‘অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আপনাকে। আপনি এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমাদের এতটা সহযোগিতা করবেন ভাবতেই পারিনি। বাড়ির বাকিদের সাথে আমি পড়ে সময় করে কথা বলে নেব।’
– ‘আমি আপনাদের যে কোন সাহায্য করতে রাজি। আপনি আমার বাবার খুনীকে শুধু ধরুন।’
উমেশ্বরবাবু চলে গেছেন। সৌমেনবাবু থানায় চলে গেছেন। আর আমরা এখন আমাদের ঘরে। অভিজিৎ চিন্তিত মুখে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বলল –
‘তোমার কি মনে হয় কে খুন করতে পারে?, আর কাকেই বা সন্দেহ করা যেতে পারে?’
‘আমার তো বাড়ির কাউকেই সন্দেহ হচ্ছে না।’
‘কেন?’
‘কারণ বাড়ির সদস্যদের মধ্যে যাদের সন্দেহ করা যেতে পারে তারা আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। উমেশ্বরবাবু এবং তার ভাই ছাড়া উমেশ্বরবাবুর বোন ও মা একসাথে ছিলেন।’
‘কিন্তু রাহুল তুমি তো বাকিদের বাদ দিয়ে চলে গেলে। ডাক্তার উমেশ্বরবাবুর কম্পাউন্ডার, দারোয়ান বিপিন যাদব, চাকর। এদের কে ধরবে সন্দেহের তালিকায়?’
‘না, ওনাকে মেরে ওদের বিশেষ লাভ হবে বলে আমার তো কিছুতেই মনে হয় না।’
‘তুমি তাহলে আমাদের কাজটার কথা ভুলে যাচ্ছ। সেই বিপুল সম্পত্তির সন্ধানে বচসা?’
এই কথাটা শোনার পর ভাবতে থাকলাম। অভিজিৎ কিন্তু সঠিক পয়েন্ট তুলে ধরেছে। কম্পাউন্ডার বিশ্বনাথ নিশ্চিত জানতেন ওই বিষ্ণু মন্দিরে বিপুল সম্পত্তি আছে। এইটাও হতে পারে তিনি সম্পত্তি চাইতে গিয়েছিলেন। না দেওয়ায় ফলে … আর ভাবতে পারলাম না। অভিজিৎ বলল, ‘চল, উমেশ্বরবাবু আলাদাভাবে কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে।’ উমেশ্বরবাবুর ঘরের দিকে আমরা যাচ্ছি ঠিক এমন সময় উমেশ্বরবাবুও আমাদের মুখোমুখি হলেন। একটু লজ্জার সহিত আমতা আমতা করে বললেন –
‘আজ্ঞে আমি খুব লজ্জিত, আপনাদের রাতের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আর দেখুন আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।’
– ‘আপনার রাতের খাওয়া দাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমরা বাইরে খেয়ে নেব।’
– ‘না তা তো হয় না। আপনারা আমাদের অতিথি। আপনারা বাইরে খাবেন তা হয় না।’
– ‘আপনার সাথে আমার আরও একটা কথা আছে। যা আমি পুলিশ অফিসারের সামনে বলিনি। সেটা হল আপনার বাড়ির এমন একটা অবস্থা সেই পরিস্থিতে দাঁড়িয়ে আমি কি দুটি কেস কি হাতে নেব? মানে সম্পত্তির খোঁজ বা নকশার খোঁজ তার সাথে আপনার বাবার খুনটা।’
– ‘হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই আপনি দুটো কেস হাতে নিন। পারিশ্রমিক নিয়ে আপনি ভাববেন না।’
– ‘হুম আমারও মনে হচ্ছে। যে কেস দু’টো একটা সুতোতেই বাঁধা’।
অবশেষে নাছোড়বান্দা উমেশ্বরবাবুকে অনেক কষ্টে রাজি করানো হল তদন্তের কাজে আমাদের বাইরে যেতেই হবে এই বলে। বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করে আমরা বাইরে বেরোলাম। তখন রাত সাড়ে নটা বাজে। শুনশান রাস্তা। জনমানবের চিহ্নটুকু নেই। হঠাৎ পথে পুলিশের একটা জিপ আমাদের পিছনে এসে দাঁড়াল। আমরা পিছন ঘুরে দেখলাম জিপ থেকে নামলেন সৌমেন মহাপাত্র।,
– ‘কোথায় যাচ্ছেন অভিজিৎবাবু?’
– ‘এই একটু হোটেলের খোঁজ করছি।’
– ‘এই রাতে আমাদের এই গ্ৰামে হোটেল। হাসালেন মশাই। চলুন আমার সঙ্গে আমি আপনাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
সৌমেনবাবুর কথা মত তার জিপে উঠে আমরা থামলাম তার থানার সামনে। থানার ভিতরে আমরা প্রবেশ করলাম। সৌমেনবাবু তদন্তের কাজেই কোথাও একটা গেছিলেন জানালেন। আমাদের বসতে বলে কাউকে যেন ডাকতে গেলন। সৌমেনবাবু অত্যন্ত আলাপী, সৎ ভালো মানুষ বলেই মনে হয়। কত দ্রুত আমাদের আপন করে নিয়েছে। সৌমেনবাবু ফিরে এলেন বেশ কিছুক্ষণ পরে তার হাতে থালায় গরম গরম লুচি আর ডিম কষা। অভিজিৎ প্রশ্ন করল, ‘এত রাতে আপনি পেলেন কোথা থেকে এত খাবার?’ সৌমেনবাবু হো হো করে হেসে বললেন, ‘পুলিশ পারে না এমন কোন কাজ নেই মশাই। ওই থানার পিছনে একটা ছোট হোটেল আছে বিশুর। বিশুকে ঘুম থেকে তুলে করালাম।’
অভিজিৎ লুচি চিবাতে চিবাতে বলল, ‘আপনি তদন্ত কত দূর এগোলেন?’
– ‘আর তদন্ত। আমার মাথায় তো কিছুই আসছে না। একটু পর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চলে আসবে তখন যদি কিছুটা অনুমান করা যায়। তাছাড়া খুব একটা বেশি দিন হয়নি আমি এই থানার বড়বাবু হয়ে এসেছি। তাই এই কেসটার তদন্ত করতে বেগ পেতে হবে বলে মনে হচ্ছে।’
– ‘এই পরিবার সম্পর্কে বাকি পুলিশ মানে যারা এখানে পুরনো তাদের কাছ থেকে কিছু জানতে পারলেন?’
– ‘হ্যাঁ মশাই জানতে পেরেছি। রাজেশ্বর একদম বদের ঢিপি ছিল। একটা জমির জন্য তার পাশের এক ইতিহাস অধ্যাপককে দিব্যি পুড়িয়ে দিল। অর্থের লোভ দেখিয়ে সব কিছুও ধামা চাপা দিয়ে দিয়েছিল। এইতো আজকেই আমি কতকগুলো ফাইল ঘাটলাম, কোথাও কোন ফাইলে এই ব্যাপারে কোন তথ্য নেই।’
– ‘পাশের জমি বলতে কোন জমিটা?’
– ‘ দাঁড়ান মশাই যে বলেছে ঘটনাটা তার কাছ থেকে শুনে নিন।’
সৌমেনবাবু হাঁক দিলেন ‘জগদ্দল বাবু!’ আওয়াজ শুনে একজন বছর চল্লিশের লোক আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হলেন।
– ‘কি স্যার?’
– ‘ওই ওঁরা উমেশ্বরবাবুর বাবার ব্যাপারে কিছু তথ্য জানতে চান। তুমি আমাকে যেইগুলো বলছিলে কালকে। সেইগুলো বলো।’
অভিজিৎ বলল, ‘আপনি সত্যিই জানেন যে জমিদার রাজেশ্বর ব্যানার্জী জমির লোভে খুন করেছিলেন?’
‘হ্যাঁ স্যার। আমি ওই বুড়ো রামু দাসের কাছে শুনেছি।’
‘রামু দাসটা আবার কে?’
‘যেই ইতিহাস অধ্যাপককে মেরে ফেলা হয়েছিল তার প্রত্যক্ষদর্শী বলতে পারেন। তবে তাকে এখন পাগল বলা হয়। তার কথায় কতটা যুক্তি আছে আর কতটা বিশ্বাসযোগ্যতা বলতে পারব না।’
‘আপনি আমাকে এই রামু দাসের বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন কাল সকালে?’
‘বড় বাবু আদেশ করলেই নিয়ে যাব।’
অভিজিৎ সৌমেন মহাপাত্রের কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকবার পর বললেন, ‘তা বড় বাবু আপনি কি আদেশ দেবেন?’
সৌমেনবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই। আপনি সম্পূর্ণ সহযোগিতা আশা করতে পারেন আমার কাছ থেকে।’
‘তাহলে আজকে চলি সৌমেনবাবু।’
থানা থেকে ফিরছি তখন রাত এগারোটা বাজে। উমেশ্বরবাবুর বাড়িতে ঢুকতে যাব ঠিক সেই সময় পাঁচিল টপকে কে যেন পালাল। আমরা কিছুক্ষন ছুটলাম তার পিছনে কিন্তু ধরতে পারলাম না। বাড়িটা তখন রাজেশ্বরবাবুর মৃত্যু শোকে শোকাহত। তাই ব্যাপারটা নিয়ে হৈচৈ না করে ঘরের ভিতর বসে দরজা বন্ধ করে সমস্ত ঘটনা সাজানোর চেষ্টা করতে থাকলাম। আমার হাতে সেই প্রশ্নের খাতাটা। অভিজিৎ কেমন যেন একটা ভাবপ্রবণ হয়ে বলল –
‘রাহুল তুমি কাল থেকে আলাদা পথে গোয়েন্দাগিরি করবে। আর আমি আলাদা পথে। দু’জনেই একই জায়গায় একই পথে ঘোরাঘুরি করলে কিছু হবে না।’
আমি তো এই কথাটা শোনার পর অবাকের সাথে বিস্ময় মেশানো কন্ঠে বললাম –
‘তুমি আমার সাথে রসিকতা করছ?’
‘না গো! তা করতে পারলে তো ভালোই হত। শোন তোমাকে আমি যেটা বলছি সেটা মন দিয়ে শোন। তাহলেই ব্যাপারটা তুমি বুঝতে পারবে আমি কি বলতে চাইছি তোমাকে।
কাল আমি যখন রামু দাসের বাড়ি যাব, তখন তোমাকে উওর পশ্চিমের বিষ্ণু মন্দিরটাকে একবার ঘুরে আসতে হবে। নজর রাখতে হবে বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের উপর। তোমার সন্দেহজনক কিছু মনে হলেই তা নোট করে নেবে। বিশেষ অসুবিধা হলে আমাকে ফোন করবে। কারণ বাড়ির প্রত্যেকটা লোকের ব্যাপারে আমাকে গ্ৰামের আশেপাশের লোকজনদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আশা করি তুমি এইটুকু কাজ পারবে।’
অগত্যা কাল থেকে আমাকেই গোয়েন্দাগিরি করতে হবে তা বুঝতে পারলাম। তবে অভিজিৎকে জিজ্ঞেস করলাম-
‘কে পাঁচিল টপকে পালালো কিছু বুঝতে পারলে?’
‘না। তবে কালকের মধ্যে সব বুঝতে পারব আশা করছি। তবে দারোয়ান বিপিন যাদব কোথায় গেল সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। সে আদৌ বাড়িটা পাহারা দেয় না। সেই সুযোগে কেউ আসে বাড়ির ভিতরে। তাহলে সে কি করে সেই সময়টা? হাজারো প্রশ্ন এখন আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে বুঝলে।’
তখন সকাল হয়েছে। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম বিছানায় অভিজিৎ নেই। সে তার কাজে বেরিয়ে গেছে। এবার আমি হাত মুখ ধুয়ে বাগানের উত্তর পশ্চিম দিকে বিষ্ণু মন্দির পরিদর্শনে গেলাম। তার আগে যেখানে রাজেশ্বরবাবুর মৃত দেহটা পড়েছিল সেই দিকটা প্রদক্ষিণ করলাম। না কোন তথ্য প্রমাণ নেই। বিষ্ণু মন্দিরটা বেশ পুরোনো। পুরো বাড়িটা বেশ কিছু জায়গায় সংস্কার করা হলেও মন্দিরটা কেন সংস্কার করা হয়নি তা বুঝতে পারলাম না। যদিও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা আছে। ঠিক সেই সময় দেখলাম মন্দিরের মধ্যে একজন লোক প্রবেশ করল। মন্দিরের পুরোহিত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার আরতি দেখলাম। পূজো শেষ করে যখন সে বেরিয়ে এল তাকে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। সব কটাই সাধারণ প্রশ্ন কোথায় থাকেন? কবে থেকে কাজ করছেন? রোজ কি এই সময়ে পূজো করতে আসেন? এইসব। বাড়ির লোকজন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বিশেষ কিছু বললেন না। তবে তার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝলাম তিনি কিছু লুকিয়ে যাচ্ছেন ও আমার সাথে কথা বলতে বিরক্তি বোধ করছেন। তাই আর কথা বাড়ালাম না। বিষ্ণু মন্দিরটা বেশ অপূর্ব। গড়ুর দেবের পিঠে স্মিত হাস্যময় বিষ্ণুদেব। হাতে শঙ্খ, পদ্ম, গদা। এই অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছি ঠিক এমন মাথার ধারে একটা বিশাল যন্ত্রনা অনুভব করলাম। ভারী কিছু দিয়ে পিছনে কে একটা মারল। চোখে অন্ধকার দেখছি। মাটিতে পড়ে গেলাম।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি বিছানায় শুয়ে আছি। আমার পাশে উদ্বিগ্ন মুখ নিয়ে বসে অভিজিৎ। ডানদিকে একজন বছর পঁচিশের শাড়ি পরিহিত সুন্দরী মহিলা ওষুধের একটা শিশি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম ওইটা উমেশ্বরবাবুর বোন। আমি বিছানায় উঠে বসলাম। এবার চোখ পড়ল উমেশ্বরবাবুর দিকে। তিনি আমাকে বিছানা থেকে উঠে বসে দেখে অস্থির হয়ে বললেন, ‘আরে মশাই শুয়ে পড়ুন। বিশ্রাম নিন উঠেছেন কেন?’ আমার কী হয়েছিল জানতে চাইলাম। উমেশ্বরবাবু বললেন, ‘আপনার বিশেষ কিছু হয়নি। আপনি বিষ্ণু মন্দিরের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন।’
আমি বললাম, ‘আমার মাথার পিছনে কেউ একটা আঘাত করেছিল। তাতেই আমি..’
এবার অভিজিৎকে উত্তেজিত দেখাল।
– ‘কি বলছ রাহুল তুমি?’
– ‘হ্যাঁ, আমি যখন পুরোহিত মশাইয়ের সাথে কথা বলে বিষ্ণু মন্দিরের প্রতিমার সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম ঠিক তখনি কেউ যেন পিছনে কিছু একটা শক্ত জিনিস দিয়ে মারল। তাতেই আজ্ঞান হয়ে গেলাম।’
– ‘বুঝলাম। তারপর উমেশ্বরবাবুর বোন উমারাণী বিষ্ণু মন্দিরে পূজো দিতে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি তোমাকে এই ভয়ঙ্কর অবস্থায় দেখে সবাইকে ডাকেন।’
আমি একটু সুস্থ হয়েছি দেখে সকলে ঘরে ফিরে গেছেন। অভিজিৎ উত্তেজিত ভাবে বলল, ‘রাহুল গোলমালে কেসটা প্রায় গুটিয়ে এনেছি।’
আমি প্রশ্ন করলাম ‘ব্যাপারটা কি?’। অভিজিৎ বলতে শুরু করল তার আজকের কার্যক্রম।
– ‘যা দেখছি, যা শুনছি, আর যাদের সাথে রয়েছি তারা প্রত্যেকেই বিপদজ্জনক।’
‘ঠিক বুঝলাম না।’
– ‘তাহলে শোন। প্রথমে বলি আমাদের এখানে যে ডেকেছে তার কথা। উমেশ্বরবাবু। ডাক্তার হিসেবে ভালো হলেও সম্পত্তির উপর বিশেষ লোভ আছে। গরীবদের রোগীদের কাছ থেকে জোর পূর্বক টাকা আদায় করেন। যদি উনি এতোটাই বড়লোক হয় তাহলে এত জোর কেন? অর্থাৎ তিনি লোভী। এবার আসি তার বোনের কথায়। আমরা আসার তিনদিন আগে ব্যাপক ঝামেলা হয়েছে আর তার ফলেই বিশেষ অসুস্থ হয়েছে রাজেশ্বরবাবু। কিন্তু উমেশ্বরবাবু জানালেন তাকে কেউ মাথার পিছনে আঘাত করবার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে প্রায় কথা বলার শক্তি হারিয়ে ছিলেন। বাড়ির লোক ডাক্তার। তাই পুলিশ ডেকে গল্প ফাঁদলেন তাকে কেউ আক্রমণ করেছিল। এবার আসি উমেশ্বরবাবুর কম্পাউন্ডার কথায়। রাজেশ্বরবাবুকে আরো অসুস্থ করার জন্য তাকেই দায়ী করা যেতে পারে।’
– ‘রাজেশ্বরবাবুকে অসুস্থ করে দেওয়া মানে?’
– ‘সেটা আপাতত প্রমাণ সাপেক্ষ নয়। তাই তোমাকে বলছি না।’
– ‘দেখ যেদিন রাজেশ্বরবাবুর মৃত্যু হল সেদিন উমেশ্বরবাবু ও তার ভাই আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তাহলে আমরা কি তাদের সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারি?’
– ‘সেটাও বলা মুশকিল রাহুল। তার ছোট ভাইয়ের ব্যাপারেও সন্ধান চালাতে হবে।’
– ‘ আজ তাহলে আমার মাথায় কে মারল অনুমান করতে পার?’
– ‘না। তবে তার বেশ স্বার্থ আছে মন্দিরের আশেপাশে কোন জিনিসের উপর এইটা বলতে পারি। আপাতত আজকের কাজ এখানেই শেষ বলতে পারো।’
– ‘বৃদ্ধ রামু দাস কি বলল?’
– ‘সেটাও আমি তোমাকে পরে বলব। এখন তুমি যদি নিজেকে সুস্থ মনে করে থাকো আমার সাথে মন্দিরের দিকে আরো একবার চল।’
অভিজিৎ ও আমি মন্দিরের সামনে গেলাম। অভিজিৎ কিছু একটা খুঁজছিল মন্দিরের আশেপাশে। তারপর একটা প্রশ্ন করল আমাকে।
– ‘তোমার কি মনে হয় আদৌও কোন নকশা বা মন্দিরের ভিতর কোন সম্পত্তি আছে?’
– ‘অবশ্যই আছে।’
– ‘আমি বলছি নেই। নকশা বলে কিছু নেই। তবে বিপুল সম্পত্তি আছে কিনা তাও জানি না।’
– ‘সে কি!’
– ‘তাহলে ছোট করে বলি শোন। তুমি তো জানো আমি রামু দাসের বাড়ি গেছিলাম। তিনি জানিয়েছেন জমিদার রাজেশ্বর ব্যানার্জীর বিশাল জমিদারি বাড়ির পাশে ছিল একজন গ্ৰামের দরিদ্র ইতিহাস অধ্যাপকের। নাম বলতে পারলেন না বৃদ্ধ। তবে জানালেন, তিনি তখন সম্প্রতি পাল যুগের কিছু মুদ্রার সন্ধান করছিলেন। বৃষ্টি পড়বার কারণে নরম মাটি থেকে বেরিয়ে এসেছিল পাল যুগের মুদ্রা। তিনি নিজেই তখন মাটি খুঁড়ে একটা পুঁটলি পান। তাতে ভরা ছিল পাল যুগের অসংখ্য স্বর্ণ মুদ্রা। রাজেশ্বরবাবুর কানে এই কথাটা পৌঁছায়। বিপদের আঁচ করেই সেই অধ্যাপক কোথাও লুকিয়ে ফেলে সেই পুঁটলি। কোথায় লুকায় কেউ জানে না। রাজেশ্বরবাবু তাকে ভয় দেখান সেই পুঁটলি ফেরত দেওয়ার জন্য কিন্তু সেই অধ্যাপক তা সরকারি সংগ্ৰহশালাকে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি বোঝাতে চান এতে আমাদের দেশের গৌরব ও গ্ৰামের সম্মান বাড়বে। এইসব কথাবার্তা শুনে অবশেষে রেগে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন তার ঘর- বাড়ি। বাড়ির সবাই কোনভাবে পালিয়ে গেছিল নাকি পুড়ে মারা গেছিল গ্ৰামের কেউ জানে না। বাকিটা আর জানা নেই সেই বৃদ্ধেরও। এবার তুমি বলো, যে সম্পত্তি রাজেশ্বরবাবুর নয় তার নকশা কি করে হতে পারে?’
– ‘বাহ্, তুমি একদিনে বাইরে বেরিয়েই তো কেসটার অনেকদূর গুটিয়ে নিয়েছ। তোমার বুদ্ধিকে সেলাম।’
– ‘শোন, এবার তোমাকে বাড়ির বেশ কিছু জিনিস পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বাইরের বাকি বেশ কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেই খুঁজে নিচ্ছি। তুমি শুধু এই মন্দিরের কোথাও পুঁটলি আছে কিনা দেখো । আর আমি হত্যা রহস্যটা সমাধান করে আনি। আশা করি আমরা দুই গোয়েন্দাই ব্যর্থ হব না। চলি এখন। থানা থেকে বেশ কিছু জানার আছে।’
আমি আর বিশেষ কিছু জানতে চাইলাম না। শুধু স্থির করলাম আমাকে পুঁটলিটা খুঁজে বের করতে হবে। জুতো খুলে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। ভক্তির সাথে প্রণাম জানালাম। মন্দিরটা বেশ বড়। চারদিকটা একবার প্রদক্ষিণ করলাম। বিস্ময় করার মত কিছু নেই। মূর্তিটার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম। মূর্তিটি মাটির তৈরী। প্রতি বছর নতুন ঠাকুর আনা হয়। ধুমধামের সাথে পূজো হয়। চারটি হাতে ধরে থাকা প্রতিটি দ্রব্যই তার শক্তির পরিচায়ক। বিষ্ণুর অসীম জ্ঞানের প্রতিনিধি হল পদ্ম, সুদর্শন চক্র হল ধর্মের প্রতীক, গদা হল অশুভ শক্তিকে নাশের প্রতীক। অশুভ শক্তিনাশের প্রতীক হল গদা। এইসব ভাবছি ঠিক এমন সময় ফোন বেজে উঠল। অভিজিৎ ফোন করেছে।
– ‘হ্যালো অভিজিৎ বলো।’
– ‘হুম, রাহুল বিশাল খবর আছে। রাতে পুলিশ সৌমেন ও শ্যামলবাবুকে নিয়ে ফিরছি। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই আমি কোথায় গেছি বা কি বৃত্তান্ত। আমি ফিরে এসে বলছি।’
আর কোন কথা না বলেই ফোনটা কেটে দিল অভিজিৎ। আমিও কিছুটা উত্তেজনা প্রশমন করে ঘরে গিয়ে বসলাম। রাত হয়েছে তখন হঠাৎ বেশ কয়েকটা গাড়ির আওয়াজ পেলাম। বুঝতে পারলাম বড় খবর নিয়ে অভিজিৎ চলে এসেছে। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম পুলিশ সহ অভিজিৎ বাড়ির ভিতরে ঢুকছে। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম। ইতিমধ্যে বাড়ির সকলে আমার মত গাড়ির আওয়াজ পেয়ে নীচে নেমে এসেছে। সকলের মুখেই একটা বিস্ময়। পুলিশ সৌমেন মহাপাত্র যেমন এসেছে, ঠিক তেমনি এসেছে শ্যামলবাবু। বাড়িটা চারদিক থেকে পুলিশে ঘিরে ফেলেছে। বুঝতে পারলাম এখানে রহস্য সমাধানের বোমা ফাটবে। অভিজিৎ সবার প্রথম মুখ খুলল, ‘আশা করি বাড়িতে সকলেই আছেন। তাই সকলকে বলব দয়া করে যদি আপনারা নীচে নেমে আসেন খুব ভালো হয়। আর উমেশ্বরবাবু আপনি সকলের বসবার ব্যবস্থা করুন।’
উমেশ্বরবাবু চাকরদের নির্দেশ দিলেন সকলের জন্য চেয়ার এনে দিতে। চেয়ারে সবাই বসে পড়ল। বুঝতে পারলাম কারোর বুকে ভয় আবার কারোর বুকে ব্যাপক উত্তেজনা অনুভূত হচ্ছে। এবার অভিজিৎ বলতে শুরু করল।
‘আমি সৌমেনবাবু এবং শ্যামলবাবু তিনজন মিলে একটা জটিল কেসের সমাধান করে এনেছি। সৌমেনবাবু তো খুনীকে ধরে নিয়ে যাবেন তার আগে একটু সময় আপনাদের নষ্ট করব। সেটা গল্প বলে। তাহলে গল্পটা প্রথম থেকেই শুরু করি।
গল্পটার শুরু ধরুন আমার আর রাহুলের আগমন থেকে। উমেশ্বরবাবু আমাদের এখানে ডেকেছিলেন তার বাড়িতে উত্তর পশ্চিমের বাগানে বিষ্ণু মন্দিরে নাকি তাদের পূর্বপুরুষদের বিপুল সম্পত্তি আছে সেই সম্পত্তির কথা আর তার বাবা শারীরিক অবনতি নিয়েও তাদের বলছেন। উমেশ্বরবাবু আবার জানালেন, তার বাবাকে কেউ বা কারা যেন মাথার পিছনে শক্ত কিছু দিয়ে মারে এবং সেটাই তার শারীরিক অবনতির কারণ। কিন্তু আমি যদি বলি এই শারিরীক অবনতি কেউ না মারবার কারণে হয়েছে। আমি যদি বলি সেদিনের ঘটনাটা কী হয়েছিল। বলব উমেশ্বরবাবু?’ প্রশ্নটা করে অভিজিৎ উমেশ্বরবাবুর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। মুখ থেকে কোনও কথা বার হচ্ছে না তার। এইদিকে শান্ত শীতল কন্ঠে অভিজিৎ বলে চলেছে।
‘শারীরিক অবনতির কথাটা সত্যতা নিয়ে কোন প্রশ্ন হবে না তবে এই কান্ডটির পিছনে দায়ী উমেশ্বরবাবুর বোন উমারাণী দেবী। উমারাণী দেবী একজন দরিদ্র ছেলেকে ভালোবাসেন। কিন্তু সে ধনী পরিবারের মেয়ে তার পক্ষে একজন ওইরকম ছেলেকে ভালোবাসার কথা জানতে পেরে যান রাজেশ্বরবাবু। রাজেশ্বরবাবু সেদিন রাতে ডেকে পাঠান মেয়েকে। মেয়ের সাথে তার প্রায় হাতাহাতি হয়। রাজেশ্বরবাবু দাপুটে হলেও সেদিন মেয়ের সাথে লড়াইয়ে তিনি পারেন নি। মাটিতে পড়ে যান। এইটাই তার অসুস্থতার কারণ। কিন্তু জমিদার বাড়ির সম্মান বাঁচানোর খাতিরে উমেশ্বরবাবু এই ব্যাপারটাকে সাজিয়ে ফেলেন। উমেশ্বরবাবু এই হল তাহলে আপনার বাবার নিরাপত্তা হরণকারী। যার জন্য আমাকে আপনি ডেকেছেন।’ উমেশ্বরবাবু এবং তার সুন্দরী বোন উমারাণী দেবীর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। তারা বুঝতে পেরেছে অভিজিৎকে ডেকে তারা নিজেদের তীর নিজেদের দিকেই নিচ্ছে। অভিজিৎ বলে চলেছে।
‘বিশ্বনাথবাবু এবার আপনার কথায় আসি। মশাই আপনার বুদ্ধিকে আমার শত কোটি প্রণাম। গল্পটা জমিয়ে দিয়েছেন অন্যভাবে। গুপ্তধনের নকশা বলে কোন জিনিস তার কাছে আছে সেটা জানতে পেরে তিনি সন্ধান করতে থাকেন কোথায় আছে সেই নকশা। না, তিনি নকশা পেলেন না। নকশা বলে কিছু নেই তো মশাই। সেই কথায় পরে আসছি। তার আগে এই মানুষটার কথা একটু বলে নি। উমেশ্বরবাবুর বাবা যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন তখন তার চিকিৎসার দায়ভার নেয় এই দুইজন। একজন তার নিজের সন্তান অপর জন …..। না থাক এখন বলব না। এখন বলি তার পরের ঘটনা। উমেশ্বরবাবু যেই ঔষুধ গুলো লিখে দিতেন সেগুলো আনবার দায়িত্ব ছিল বিশ্বনাথবাবুর উপর। তিনি এই ওষুধের সঙ্গে মিশিয়ে দিতেন হাল্কা হাল্কা বিষ। এই হাল্কা বিষের প্রভাবে রাজেশ্বরবাবু সুস্থ হয়ে উঠবার বদলে দিনের পর দিন আরো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এই ব্যাপারটা ধরতে পারলেন না উমেশ্বরবাবু। রাজেশ্বরবাবু জীবনে কোনদিনও ঔষুধ খেত না। তাই তার শারীরিক ক্ষতি করা একরকম অসম্ভব ছিল বিশ্বনাথবাবুর। তাই বিশ্বনাথবাবু এই সুযোগটা হাত ছাড়া করলেন না। রক্তাক্ত করে মেরে ফেলবার ঝুঁকি আছে। তাই ঠান্ডা মাথায় একটু একটু করে মেরে ফেলার এই মোক্ষম পরিকল্পনা করেন। পুলিশ অফিসার সৌমেনবাবুর হাতে রাজেশ্বরবাবুর খাওয়া সেই ঔষুধের একটা শিশি তুলে দিয়ে তার রিপোর্ট জানতে চাইলাম। প্রমাণিত হল আমার ধারণা সত্য। পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও হাল্কা সেই বিষক্রিয়া আভাস পাওয়া গেছে। যাইহোক বিশ্বনাথবাবু এবার আপনি সবার সামনে বলুন আপনি এমন কাজ কেন করলেন? আশা করি আপনি বলবেন।’
বিশ্বনাথবাবু তখন ফুঁসছে রাগে। এবার বিশ্বনাথ উঠে গিয়ে অভিজিৎ এর কলার ধরে হাতাহাতি শুরু করে দিল। পকেট থেকে ঝকঝক করে উঠল ছুরিটা ভয়ে আমি কী করব কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঠিক সেই সময় পুলিশ অফিসার সৌমেন মহাপাত্রের এক ধাক্কায় মাটিতে ছিটকে পড়েন বিশ্বনাথ। ছুরিটা দূরে ছিটকে পড়ল। শ্যামলবাবুর দুজন পুলিশ তাকে কব্জা করে নিয়েছে। উমেশ্বর উত্তেজিত হয়ে এবার বিশ্বনাথের গালে দু চারটে চর কষিয়ে দিলেন। রাগত স্বরে বললেন – ‘হতচ্ছাড়া তুই আমার বাবাকে মেরেছিস। তোকে আমি ছাড়ব না!’ অভিজিৎ সেই রকম শান্ত এখনও। অভিজিৎ উমেশ্বরবাবুর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আরে মশাই বসুন বসুন উত্তেজিত হবেন না। এখনও আমার অনেককিছু বলবার আছে। এখনও রহস্য উন্মোচন হয়নি।’ সকলে আবার শান্ত। আবার অভিজিৎ বলতে শুরু করেছে।
‘প্রথমে যখন এই রিপোর্টটা আমাকে সৌমেনবাবু জানালেন ভেবেছিলাম খুনী বিশ্বনাথবাবু। কিন্তু না। সন্দেহজনক তো আপনারাও। উমারাণীও তোর বাবাকে মারতে পারেন। মারতে পারেন তো উমেশ্বরবাবুও। আরেকজনকে তখন আমি বাদ দিয়ে ফেলেছি সে হল দারোয়ান বিপিন যাদব। বিপিন যাদব আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব উত্তর দেবেন।’
বিপিন যাদব ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। যথেষ্ট সন্দেহ আছে তার মুখ থেকে ভয়ে কথা বের হবে কিনা। বিপিন শুধু মাথা দোলালো। অভিজিৎ তার প্রশ্নবাণ ছুঁড়তে শুরু করেছে তখন।
– ‘বিপিন বাবু আপনি রোজ রাতে পাহারা না দিয়ে কোথায় যান?’
– ‘কোথাও না বাবু। আমি তো রোজ পাহারায় থাকি।’
– ‘আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। অহেতুক সময় নষ্ট করাবেন না।’
– ‘না বাবু আমি সত্যিই বলছি।’
– ‘সৌমেনবাবু অ্যারেস্ট করুন এনাকে।’
– ‘অ্যারেস্ট করবেন না বাবু। আমি গরিব মানুষ বিবি, ল্যারকা কে নিয়ে না খেয়ে মরে যাব। আমি বলছি সব।’
– ‘বলুন সব। ভয় পাবেন না একদম।’
– ‘রোজ রাতে আমি ছোট বাবুর জন্য ড্রাগ এনে দি তারপর দুজনে মিলে জুয়ার আসরে যাই।’
এবার চিৎকার করে উঠলেন উমেশ্বরবাবুর সেই কল্পনা প্রবণ ছোট ভাই ভুবনেশ্বর।
– ‘মিথ্যা বলছে সব, ওর কথা একদম বিশ্বাস করবেন না।’
– ‘বিশ্বাস অবিশ্বাসের তো প্রশ্নই ওঠে না। সৌমেনবাবু আপনাদের পুলিশদের তোলা ছবিটা একবার বার করে দেখিয়ে দিন। তাহলেই তো কে মিথ্যা বলছে কে সত্য বলছে সব প্রমাণ হয়ে যায় কি বলেন?’ হাসতে হাসতে বলে অভিজিৎ। সৌমেনবাবু পকেট থেকে একটা ছবি সকলের সামনে তুলে ধরেছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে উমেশ্বরবাবুর ছোট ভাই ভুবনেশ্বর ও বিপিনকে ড্রাগের নেশা করতে। অভিজিৎ আবার বলতে শুরু করেছে।
‘কিন্তু সকলের মনে নিশ্চয়ই এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে যে, ভুবনেশ্বরের নেশার সঙ্গে রাজেশ্বরবাবুর খুনের কি সম্পর্ক? শুনুন উমেশ্বরবাবু তাহলে। বিশ্বনাথবাবুর দেওয়া বিষে আপনার বাবা পুরোপুরি অসাড় হয়ে যায়নি। আপনার বাবা সজ্ঞানে ছিলেন। আপনার বাবার মৃত্যুর দিন আপনাদের ব্যাবসার কাজে বহুদিনের কর্মচারী রমেশ চন্দ্র মজুমদার ব্যাবসার পয়সা নয় ছয়ের সমস্ত কথা রাজেশ্বরবাবুকে এসে বলেন। রাজেশ্বরবাবু কথাটা শোনার পর উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং রমেশ বাবু চলে যাবার পর তার ছোট ছেলে ভুবনেশ্বরকে ডেকে পাঠান। অনেক বকাঝকা করেন। রাজেশ্বরবাবুর কাছে আরো টাকা চান ভুবনেশ্বর। কারণ জুয়া খেলা ও ড্রাগের নেশায় সব সর্বনাশ হয়েছিল তার। টাকা দিতে অস্বীকার করায় মুখে মুখে তর্ক করতে থাকেন ভুবনেশ্বর। টাকার ক্ষিদে পেয়ে বসেছে তখন। রাজেশ্বরবাবুর শরীরে জেগে ওঠে জমিদারের গরম রক্ত। রাজেশ্বরবাবু ভুবনেশ্বরকে মারতে যান ঠিক সেই সময় রামেশ্বরের পাশে থাকা একটা চেয়ার তুলে পিছনে আঘাত করেন। জানলায় গ্ৰিল নেই। খোলা জানালায় কাঁচের চমৎকার ব্যবস্থা। কিন্তু সেই চমৎকার ব্যবস্থাই কাল হয়ে গেল। অর্থাৎ রাজেশ্বরবাবুর খুনী হলেন তারই ছোট ছেলে রামেশ্বর।’
সবাই উত্তেজনার সাথে হতবাক হয়ে অভিজিৎ এর কথা শুনছিলাম। কি অদ্ভুত নিরবতা। ভুবনেশ্বর ইতিমধ্যেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পালাতে যাচ্ছিলেন। অভিজিৎ গর্জে উঠল।
– ‘পালিয়ে লাভ নেই। বাইরেও পুলিশ রয়েছে। বরং আপনি কিছুক্ষণের জন্য চেয়ারেই বিশ্রাম নিয়ে নিন। কারণ আপনার পরবর্তী জীবন খুব কঠিন হতে চলেছে।’
পুলিশ ইতিমধ্যে অ্যারেস্ট করেছে ভুবনেশ্বরকে। আমি প্রশ্ন করলাম –
‘কিন্তু অভিজিৎ যেখন রাজেশ্বরবাবু মারা যায় তখন তো ভুবনেশ্বর আমাদের সাথেই ছিলেন।’
– ‘ছিলেন বটে তবে খুন করবার পর। বাবাকে ফেলে দেওয়ার পর দৌড়ে ঘরে ঢোকে। আমি তখন তাকে হাঁপাতে দেখেছি। ওইদিকে আওয়াজ শুনে আমরা ছুটে যাই। আওয়াজটা করেছিল উমেশ্বরবাবুর মা। ধাক্কা মেরে ফেলার পর ভুবনেশ্বরের কাছে ছিল ঘরে ঢোকবার সময়। অপরদিক উমেশ্বরবাবুর মা এবং বোনের বাগানের দূরত্ব ছিল ততটাই। আশা করি বোঝাতে পারলাম।’
– ‘হ্যাঁ, কিন্তু আরও একটা প্রশ্ন। আমার মাথায় সেদিন কে মেরেছিল? আর আমরা সেদিন রাতে কাকে পালাতে দেখেছিলাম?’
– ‘তোমাকে মেরেছিল বিপিন যাদব। তাকে শুধু বলা হয়েছিল তোমাকে আঘাত করাতে। তার ছোটবাবু চাইত না আমরা এখানে বেশি দিন থাকি। তাই আমাদের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ভয় দেখিয়েছিল। আর সেদিন আমরা যাকে পালাতে দেখেছিলাম সেটা উমেশ্বরবাবুর বোন উমারাণীর প্রেমিক। যিনি বিপিন আর ভুবনেশ্বর বাবুর নেশা করবার সময় রোজ রাতে আসেন। প্রবল নেশার চোটে অনেক সময় বুঝতে না পারলেও কোন একদিন নেশা না জমায় তিনি অনুভব করতেন বাইরের কেউ একজন এই বাড়িতে আসে। তারা ভেবেছিল সেই নকশা চোর।’
এবার প্রশ্ন করলেন সৌমেনবাবু, ‘অভিজিৎবাবু রাজেশ্বরবাবুকে বিশ্বনাথ কেন অল্প অল্প করে বিষ খাওয়াত?’
অভিজিৎ হাসতে বলল, ‘বিশ্বনাথবাবু যখন নিজের মুখেই কিছু বললেন না আমাকে কষ্ট করে বলতে হচ্ছে। রাজেশ্বরবাবু ব্যবসায়িক কারণে একজনকে হত্যা করেন। তার একটা ছোট ছেলে ছিল তিনিই হলেন ওই বিশ্বনাথবাবু। কি তাই তো বিশ্বনাথবাবু?’
বিশ্বনাথবাবু তখন চুপচাপ মাথা নিচু করে রয়েছে। অভিজিৎ এবার উমেশ্বরবাবুর দিকে ফিরে বলতে শুরু করল –
– ‘এবার আসি আপনার মিথ্যা বানানো গল্পতে। আপনি জানতেন যে, আপনাদের পূর্ব পুরুষদের সম্পত্তি নেই মন্দিরে। অতয়েব নকশাও নেই। তাও আপনি ভাবলেন বাকি জীবন শুয়ে কিভাবে কাটানো যায়। এছাড়াও কোলকাতায় আপনার বেশ দেনা আছে শুনলাম। সেটা বেশ নোংরা কারণ হওয়ায় আমি এখানে বলব না। আপনি ছোটবেলায় সেই অধ্যাপকের স্বর্ণমুদ্রার লুকানোর গল্পটা জানতেন। ভাবলেন যদি কেউ খুঁজে দিতে পারে তাহলে যে মীরাক্কেল ব্যাপার হয়ে যাবে। সেই কারণেই আমাদের আগমন ঘটালেন।’
অভিজিৎ এই উত্তেজিত গরম করা পরিবেশেও দিব্যি শান্তভাবে বলে চলেছে কথাগুলো। কমবেশি অপরাধী সকলের মাথা নিচু করা।
– ‘আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম এক ইতিসের অধ্যাপককে কিভাবে হেনস্তা করা হয়েছিল। রাজেশ্বরবাবুকে সেই পাল যুগের মুদ্রাগুলো না দেওয়ায় তার বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলা হয়। অধ্যাপক পুড়ে মরলেও বেঁচে যায় তার ছেলে এবং স্ত্রী। সৌমেনবাবু কি ঠিক বললাম তো?’
সবাই এবার চমকে তাকালাম সৌমেন মহাপাত্রের দিকে। বুঝতে পারলাম না অভিজিৎ কি বোঝাতে চাইছে। সৌমেনবাবুর ভ্রু যুগল কুঞ্চিত। সৌমেনবাবু বললেন –
‘ঠিক বুঝলাম না অভিজিৎবাবু!’
– ‘আপনি সব বুঝতে পারবেন। দাঁড়ান’
অভিজিৎ হাঁক দিল রামুবাবু আপনি এখানে আসুন। বাইরে থেকে একটা বৃদ্ধ এসে ভিতরে ঢুকল। তার হাতে একটা পুঁটলি। সেই পুঁটলিটা এবার অভিজিৎ সৌমেনবাবুর হাতে তুলে দিয়ে বললেন
– ‘এই নিন আপনার বাবার লড়াই করে বাঁচিয়ে রাখা সম্পদ। যা আপনার বাবার বিশ্বস্ত বন্ধু রামু দাসের কাছে ছিল। তার সুযোগ্য পুত্র হিসেবে আপনার হাতে তুলে দিলাম। আমাদের দেশের সংগ্ৰহশালায় স্থান পেল আপনার বাবার লড়াই।’
সৌমেন মহাপাত্রের চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে পুঁটলিটায়। ছলছল চোখে সৌমেনবাবু বললেন –
‘অভিজিৎবাবু আমি এখানে এসে ঘটনাটা প্রথম শুনি। বুঝতে পারি আমার বাবার হত্যাকারীর তদন্ত করছি। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার বাবার লড়াই আমার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।’
হঠাৎ অভিজিৎ এর ফোনটা বেজে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করলাম –
‘কার ফোন?’
– ‘নতুন একটা কেস। শীঘ্রই বাড়ি চল।’