আমি বুঝতে পারছি, আমরা সম্পূর্ন ভাবে কাজ করছি। এই খুনের রহস্য খুব শীঘ্রই উদঘাটিত হবে। পুলিশ সম্পূর্ন ভাবে কাজ করছে। উত্তেজিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।”
কল’টা রেখে লালবাজার কমিশনার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। জীবনে এত চাপ কখনো অনুভব করেন নি। কিছু একটা ভেবেই আবার টেলিফোনটা তুললেন। ডায়েল করলেন পার্ক স্ট্রিট থানায়।
– “হ্যালো, পার্ক স্ট্রিট থানা! আমি কমিশনার অরূপ দেব রায়। ইন্সপেক্টর অনীশ সেন?”
2.
– “বলুন স্যার, কেন হঠাৎ ডাকলেন।” লালবাজার কমিশনারের রুমে এখন 3 জন। কমিশনার, ইন্সপেক্টর অনীশ সেন এবং তারাতলা থানার ইন্সপেক্টর রাহুল মজুমদার।
– “ইয়ে, রাহুল। তুমিই বল না হয়।”
কমিশনার অরূপ রায় ইশারায় বললেন পুরোটা অনীশ কে বুঝিয়ে দিতে। তার পর বললেন – “তার আগে বলি, অনীশ তুমি নিশ্চয়ই রামলাল ভোজীয়া এর মৃত্যু’র খবরটা জানো?”
অনীশ সম্মতি সম্পন্ন আর বুদ্ধিদীপ্ত একটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
– “হ্যাঁ, স্যার। কাগজে দেখেছি। কেসটা তারাতলা পুলিশ স্টেশনের আন্ডারে যে পড়ে তা জানি।”
– “হু, তা এবার শোনো।”
এবার ইন্সপেক্টর রাহুল কথা বললেন, “তাহলে নিশ্চই জানেন যে মৃত্যুটা মোটেই স্বাভাবিক বলে পুলিশ মনে করছে না।”
কথার মাঝেই অনীশ বলে উঠল, “প্লিজ আমাকে তুমি বলো। আমাদের বয়স প্রায় একই। তাই আমিও তোমাকে তুমিই বলছি।”
ইন্সপেক্টর রাহুল এর মুখে একটা হাসি খেলে গেলো। তিনি এবার বলতে শুরু করলেন – “মৃত দেহ পাওয়া গিয়েছিল খাটের উপর। ঘাড়টা একপাশে কাত করা। বাম কান ও মাথা থেকে অঝোরে রক্ত। প্রথমে ভেবেছিলাম যে কোনো আঘাতে মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট তা বলছে না। এ এক আশ্চর্যকর ভাবে ঘটা মৃত্যু। মৃত্যু এর কারণ রিপোর্ট বলছে মাথায় অর্থাৎ internal brain এ bleeding ও মাথার শিরার অস্বাভাবিক চাপ। রক্তের কারণ অবশ্য একই, তার সঙ্গে আর একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার। কোনো ভাবে কানের পর্দা ফেটে গিয়েছে। খাটের উপর ওঁর দেহের বাম পাশে একটা খোলা খাতা আর একটা মোবাইল পাওয়া গেছে, কিছু একটা সম্ভবত লিখছিলেন, লিখতে লিখতেই মৃত্যু ঘটেছে”।
– “আচ্ছা, উনি বেঁয়ো মানে left handy ছিলেন?”
বেশ হকচকিয়ে উঠে ইন্সপেক্টর রাহুল বললেন, “আজ্ঞে হ্যাঁ, ওঁর মেয়ে অর্থাৎ বিখ্যাত গায়িকা স্মিতা ভোজীয়া কথাটা আমাদের বলেন জেরাতে, তবে তুমি …?”
– “খুবই সহজ, তুমিই বলছ যে ওনার বাঁ দিকে খাতা পাওয়া গেছে, অর্থাৎ বাঁ হাতি এবং ওই ফোন। দেখবেন সাধারণত বিশেষ প্রয়োজন না থাকলে আমরা আমাদের ফোন বাঁ দিকে রাখি না। কিন্তু যখনই কোনো প্রয়োজন বা গুরত্বপূর্ণ কাজ থাকে, যেমন কোনো গুরত্বপূর্ণ খাতা, তখন হাতের কাছে তাড়াতাড়ি পাওয়ার জন্য আমরা সেটা ডান দিকেই রাখি। উনি যেহেতু ছিলেন ইনসিউরেন্সের দালাল তাই সব সময়ই খাতা কাছে থাকা দরকার। তাই বুঝতে অসুবিধা হলো না।”
কমিশনার সাহেব এতক্ষণে কথা বললেন, “বুঝলে রাহুল, এইজন্যই অনীশ কে আমি recommend করছি। ও এর আগেও অনেক কেস সলভ করেছে। এমন এমন কেস যা প্রায় অসাধ্য সাধন করা মত।”
– “হু, তারপর বলুন। আর কি কি পেলেন?” নিজের প্রশংসা’র উপরেই কথাটা বলল অনীশ।
– “হ্যাঁ, আমরা আর বিশেষ কিছু ঘরে পাইনি। ঘরে AC চলছিল। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী রাতেই মৃত্যু হয়েছে। এখন আমাদের কাছে দু’টো ব্যাপারে ধোঁয়াশা, প্রথমত মৃত্যু হলো কিভাবে? দ্বিতীয়ত, কোনো কারণ পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ এই খুনটা খুব সাবধানে করা হয়েছে তা আর বলতে হয় না আশা করি। খুনি কোনো প্রমাণ ছেড়ে যায়নি। এটুকু আন্দাজ করা যাচ্ছে। আর সবই অন্ধকার।”
অনীশ কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, “একটা জিনিস আন্দাজ করছি। তবে সেটা একটু ভাবতে হবে। আর কিছু বলার আছে কি রাহুল?”
– “না! এই আমার রিপোর্ট। এখন তুমি যদি সাহায্য করো তো খুব ভালো হয়।”
– “হুঁ অবশ্যই। আমি চেষ্টা করছি। আচ্ছা সকালে প্রথম মৃত্যুর খবর কে পায়?”
– “আমাদের প্রথম স্মিতা ম্যাডামই ফোন করেন। কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন। বেশ ভয় পেয়েছিলেন। যতটা যা জানি, চাকরই হয়ত প্রথম খবরটা পায়। ও হ্যাঁ, চাকরের কথায় মনে পড়ল, সেদিন অর্থাৎ যেদিন ওঁনার মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় সেদিন সকালে কয়েকজন এসেছিলেন ওঁর বাড়িতে। বোধ হয় client। তাদেরকেও জেরা করেছি।”
– “কতজন এসেছিলেন?”
– “বোধ হয় দু’ই জন। আমরা যাওয়ার পর দু’ই জনকেই দেখেছিলাম।”
– “আচ্ছা।”
– “ওকে, তাহলে স্যার আমি এখন উঠি?” চেয়ার টা ঠেলে রাহুল্ উঠে দাঁড়ালেন।
– “যাও। অনীশ তোমাকে হেল্প করবে সম্পূর্ন ভাবে।” বললেন কমিশনার অরূপ।
ইন্সপেক্টর রাহুল মজুমদার বেরিয়ে গেলেন। অনীশ ও উঠতে যাচ্ছিল কমিশনার আটকে দিলেন, “ দাঁড়াও অনীশ। আচ্ছা তুমি যে আন্দাজটা করেছ সেটা একটু বলেই যাও।”
অনীশ কি একটা ভেবে বলল, “স্যার আমি এখনও সিওর না ব্যাপারটায়, সিওর হতে গেলে আমাকে একটু সাইবার ক্রাইম ব্রাঞ্চে যেতে হবে।”
– “সাইবার ক্রাইম ব্রাঞ্চ? সেখানে কি হবে?” বেশ হকচকিয়ে প্রশ্নটা করেন কমিশনার।
– “আছে, আছে স্যার। আমি উঠি এখন। কাল আবার আসব।” বলে অনীশ উঠে যায়।
– “কে জানে কি করছে ছেলেটা।” নিজের মনেই বলেন কমিশনার সাহেব।
3.
– “দেখো অনীশ, তুমি যেটা ভাবছ সেটা হতে পারে। কানের পর্দা এই ভাবে ফেটে যাওয়া কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার না। তবে এই রকম ইফেক্ট তৈরী করতে গেলে একটা প্রফেসনাল অথবা ইঞ্জিনিয়ারকে লাগে। কারণ এটা করা মোটেই সহজ নয়।”
– “হ্যাঁ, স্যার। আমি দেখছি পুরোটা। আমি শুধু জানতে এসেছিলাম যে আমি ঠিক পথে এগোচ্ছি কিনা। এখন মনে হচ্ছে …. থাক সে কথা। আসি এখন স্যার।”
সাইবার ক্রাইমের ব্রাঞ্চ থেকে বেরিয়ে নিজের জিপে উঠল অনীশ। ওঁর কপালে একটা ভ্রূকুটি লেগে থাকল। হঠাৎ একটা দারুণ কথা মাথায় আসায় নিজের ফোনটা বার করে খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কে জানে কেন? তার পর প্রায় মিনিট তিনেক পর ইন্সপেক্টর রাহুল মজুমদার এর নম্বরে ফোন করে।
– “হ্যালো, রাহুল বলছ? আমি অনীশ।”
– “হ্যাঁ, অনীশ বলো।”
– “বলছি তুমি কি পুলিশ স্টেশনে?”
– “না, আমি মিস্টার ভোজীয়ার বাড়িতে। কেন?”
– “আচ্ছা তুমি একটা ফোনের কথা বলছিলে না? ওটা স্মার্টফোন তো?”
– “হ্যাঁ, তবে একটু পুরনো আমলের। কেন? ওটা ওই বিছানাতেই এখনও আছে। ডেড বডি বাদে কিছু সরানো হয়নি ঘর থেকে।”
– “যাক। আচ্ছা তুমি ওই ফোনটার পার্টস পত্র ঠিক আছে কিনা চেক করতে দাও। তারপর অবশ্যই ফরেনসিকে পাঠাবে।”
বেশ ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন রাহুল। এর সঙ্গে ফোনের কি সম্পর্ক থাকতে পারে তা না বুঝে আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে, মানে, কেন … ?”
– “সব-ই জানাবো। আমি সন্ধায় যাব ওখানে। তারপর না হয় কথা হবে।”
বলে ফোনটা রেখে দিল ও। কিভাবে খুন হয়েছে তা বোধ হয় অনীশ খুব সহজেই বুঝে গেছে। আসলে এখনকার খুনি, চোর এতই মডার্ন হয়ে গেছে যে সব কিছুই আধুনিক। শুধু পুলিশরাই হতে পারল না। কিন্তু অনীশ এখন ওসব ভাবছে না, ভাবছে, খুনের মোটিভ কি? কেন খুন করা হলো?
4.
সন্ধে প্রায় ছয়টা। পুলিশের জিপ একটা তিন তলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। ইন্সপেক্টর অনীশ সেন নামলেন জিপ থেকে, একাই। বিশাল এক গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। বাইরে আরেকটা জিপ দাঁড়িয়ে ছিল। বুঝলেন, ইন্সপেক্টর রাহুল আগেই এসেছেন। গেট দিয়ে ঢুকতেই দু’জন কনস্টেবল তাকে ভিতরে নিয়ে গেল। একটা সোফার উপর বসেছিলেন ইন্সপেক্টর রাহুল। অনীশ ঢুকতেই উঠে দাড়িয়ে আহ্বান জানালেন, “এসো অনীশ। মিস স্মিতা এখুনি এসে পড়বেন। এত বড় বাড়িতে উনি আর ওনার বাবা থাকতেন। মা মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। আর মাঝে মধ্যে মিস স্মিতার …”
বলতে না বলতেই দরজার সামনে একজন সুন্দর সুশ্রী বছর একুশের মহিলা এসে দাঁড়ালেন। সামনা-সামনি কোনোদিন না দেখলেও বাইরের পোস্টারে মাঝে মধ্যে দেখা এই মুখ চিনতে কোনো অসুবিধা হলো না অনীশের। বিখ্যাত গায়িকা মিস স্মিতা ভোজীয়া।
অনীশ নমস্কার করলেও প্রত্যুত্তরে নমস্কারটা পেল না। কিছু মনে করল না ও, সরাসরি মূল কথায় চলে গেলো।
– “আচ্ছা ম্যাডাম, আপনার বাবা রাত ক’টা অবধি জেগে থাকতেন?”
– “রাত কটা অবধি জাগতেন তা জানি না। তবে দেরিতে ঘুমাতেন। অনেক রাতেও ফোন আসত। খাতা পত্র নিয়ে কাজ করতেন।”
– “আচ্ছা, আপনার বাবার কি ওই পুরনো একটাই ফোন?”
– “না, আমি আর একটা ফোন কিনে দিয়েছিলাম। আর যেটা উনি ব্যবহার করতেন সেটা মোটেই পুরনো নয়। মডেলটা একটু পুরনো। ও হ্যাঁ, ভালো কথা, আচ্ছা রাহুল বাবু … ?”
রাহুল এতক্ষন নীরব ছিলেন। আচমকা অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন।”
– “বাবার ফোনটা কি করেছেন?”
– “ওটা ফরেনসিকে পাঠানো হয়েছে কিছু তথ্য সংগ্রহের জন্যে।”
– “ফোন নিয়ে কি পরীক্ষা হবে আবার। যত্ত সব। যাই হোক, আপনি কি বাবার BLUETOOTH ডিভাইস টা দেখেছেন?”
– “মানে?”
– “ওটা পাচ্ছি না তো। বাবাকে একটা BLUETOOTH EARPIECE কিনে দিয়েছিলাম, ড্রাইভিং করতে করতে যাতে ফোন কল না ধরে। তারপর থেকে অভ্যেস হয়ে যায় বাবার। বাড়িতেও পরে থাকতেন। ওটা তো পাচ্ছি না। আসলে বাবা মানুষটাই ছিলেন ওরকম।’’
কথা বলতে বলতে মিস স্মিতা এর চোখের কোনে জলের ঝিলিক দেখা গেল।
– “আপনি কি পুলিশের অনুমতি না নিয়ে ও ঘরে ঢুকেছিলেন?” প্রশ্নটা অনীশ করল।
– “না, আমি শুধু ইন্সপেক্টর রাহুল কে বলেছিলাম বাবার সব জিনিস পত্র ঠিক থাক আছে কিনা তার একটা লিস্ট আমাকে দিতে। ওদের লিস্ট এ তো এটা পাচ্ছি না।”
– “আচ্ছা আপনার হঠাৎ লিস্ট করার কি দরকার হলো? আপনার কি সন্দেহ হয় যে কিছু গন্ডগোল আছে?”
ভদ্রমহিলা কিছু বললেন না প্রথমে। তারপর বললেন, “বাইরের লোকের আনাগোনা আছে কিনা। বাবার ওই ঘরেই সবাই আসে। চা খায়, গল্প গুজব করে, এমনকি … এমনকি ঝগড়াও। আজ সকালেও তো মিস্টার সুখিয়াল ও মিস্টার চৌবে এসেছিলেন।”
– “দাঁড়ান দাঁড়ান। আপনি বলছেন ওঁনার ঘর ওঁনার অফিস। তার মানে ওই দুই ভদ্রলোক মিস্টার ভোজীয়ার মৃত্যুর আগে ওঁনার ঘরে ঢুকে ছিলেন, তাই তো।”
– “না, ঘরের বাইরে কয়েকটা সোফা আছে। বাবার অনুমতির পর তারা ঢুকত। তবে, বাবার ঘর দোতলায়। আমার তিন তলায়। তাই সে ব্যাপারে বিশেষ খবর জানি না। তবে চেঁচামেচি শুনে নীচে যখন আসি তখন মিস্টার সুখীয়াল এর সাদা ফ্যাকাশে মুখ দেখেছিলাম, উনি বাবার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চাকর ততক্ষণ বোধ হয় ভিতরে যায় ও তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে যে বাবা …” কথা বলতে বলতে নিজেই আবেগ ঘন হয়ে পড়েন মিস স্মিতা। চোখের কোণের জল মুছে বললেন – “আমার বাবার হত্যাকারী কে immidiate আমার চাই। তাকে ফাঁসি কাঠে না ঝোলানো পর্যন্ত আমার শান্তি হচ্ছে না।”
সব কথা শুনে অনীশ এবার এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। হঠাৎই জুতো রাখবার ওয়ারড্রব এর দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা এই বাড়িতে কে কে থাকেন?”
কথাটা শুনে ইন্সপেক্টর রাহুল এর চোখ গোলগোল হয়ে গেল। তাও চুপচাপ থাকলেন। মিস স্মিতা বেশ বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “ এক প্রশ্ন চোদ্দ বার করছেন আপনারা। আমি থাকি, বাবা থাকত, আর মাঝে মাঝে গেস্টরা আসে।”
– “ক্ষমা করবেন, না মানে আপনার বাবাই একমাত্র পুরুষ যিনি এ বাড়িতে থাকতেন। নিশ্চয়ই উনি এবয়সে হাল ফ্যাশানের ছেঁড়া ছেঁড়া ডিজাইনের শু কিনতেন না। তাও আবার তিনটে।”
অনীশ মিস স্মিতার দিকে তাকালেন। ওঁর মুখ লাল। বেশ লজ্জিত হয়ে বললেন, “আমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে নাক না গলালেই নয় কি। সকালে একবার জেরা হয়েছে। আবার এসব …” বলতে বলতে চলে গেলেন।
রাহুল বলল, “মিস স্মিতার বয়ফ্রেন্ড, রক্তিম। খুব ভালো ছেলে তা মনে হয় না। অভদ্র।”
– “হুঁ, কিন্তু হিসেব যে একটু গড়বড় করছে রাহুল। আচ্ছা, মিস্টার ভোজীয়ার ঘর একটু দেখা যায়?”
– “অবশ্যই, চলো।”
5.
একটা ছোট্ট কিন্তু দারুণ বিলাসবহুল ঘর। বালিশে এখনও রক্ত লেগে আছে। চারপাশ একটা বিশ্রী নীরবতা। অনীশ চারিদিকে ভালো করে তাকালো। একটা শোকেস আছে ঘরে। বিভিন্ন শো-পিস আছে তাতে। মোমের পুতুল, মাটির কাপ, একতারা, মাটির ফুল, ফল ইত্যাদি। অনীশ সোজা চলে গেল খাটের দিকে। খাটের উপর একটা ছেঁড়া ডাইরি এর মতন কি একটা দেখল। রাহুল বলল, “ এটাই সেই খাতা। কিছু একটা লিখছিলেন, তারপর ..। আঘাত কিভাবে আসতে পারে যদি না কেউ সজোরে আঘাত না করে। এখন …”
– “স্টার?”
– “অ্যাঁ?”
ইন্সপেক্টর রাহুল দেখল অনীশ ওই খাতাটা হাতে গ্লাভস পরে দেখতে শুরু করেছে। একটা নির্দিষ্ট পাতায় আঙুল দিয়ে কি একটা দেখাচ্ছে। রাহুল এগিয়ে গিয়ে দেখেন সেখানে একটা স্টার আকৃতি আঁকা হয়েছে।
– “এটা গতকাল রাতে আঁকা হয়েছে, আমি সিওর। কালি যদিও শুকনো তবু বেশ বোঝা যাচ্ছে। ফাউন্টেন পেন দিয়ে লেখা। এটা ঠিক খাতার শেষে। ফাউন্টেন পেনটা কোথায় গেলো?” বেশ উদ্বিগ্ন দেখাল অনীশ কে।
– “ওটা ছিল। সকালে ফিঙ্গারপ্রিন্ট চেক এর জন্যে পাঠান হয়েছিল অন্যান্য জিনিসের সাথে। রিপোর্ট এসেছে। একজনেরই ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া গেছে। কিন্তু এটা নিয়ে আমরা কি করব?”
– “লাগবে লাগবে। হঠাৎ একটা স্টার তিনি আঁকতে যাবেন কেন? তাও শেষে?”
বলতে বলতে সারা ঘর একবার ঘুরতে লাগল। তারপর হঠাৎ বললেন, “ওই ফোনটা খুব প্রয়োজনীয়, একদম হাতছাড়া করবেন না। আমার মনে হয় না ফরেনসিক রিপোর্টে আমি যেটা চাইছিলাম সেটা আসবে। কারণ … ”। তারপর নিজের মনেই কিসব বলতে লাগে ও।
আস্তে আস্তে ওরা নীচে নেমে আসে। মাথায় দুশ্চিন্তা। নেমে আসার সময় খাতাটা নিয়ে আসে। ওঁর মাথার ভ্রূকুটিটা যাচ্ছে না একদম। নীচে জিপে ওঠার আগে হঠাৎ অনীশ বললেন, “আচ্ছা ওই দুই ভদ্রলোককে জেরা করেছিলে?”
– “অবশ্যই। তেমন কিছু পাইনি। একটু ভয়ও দেখিয়েছিলাম, ওই থার্ড ডিগ্রির। তাও কিছু হয়নি, উল্টো আবার খেঁকিয়ে এসে আমার উপর মানহানির মামলা দায়ের করবেন বলেছেন”।
– “আচ্ছা এখন ওদের বাড়ি গেলে হয় না?”
– “এই রাতে যাবে?”
– “রাত কোথায়? সবে সাড়ে ছয়টা। চলো। ঠিকানাটা আছে তো?”
– “তা আছে। চলো তাহলে। পাবে বলে মনে হয় না।”
6.
মধ্য কলকাতার এক ছিমছাম অঞ্চলে একটা একতলা বাড়িতে থাকেন মিস্টার সুরেশ মোহন সুখিয়াল। বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তে এক বেশ জোয়ান ভদ্রলোক দরজা খুললেন। মাথার কয়েকটা চুল পেকেছে। পুলিশ দেখে একটু ঘাবড়ে গেলেন বোধহয়। যেমনটা হয় আর কি। একটু গলা খাঁকরানি দিয়ে বললেন, “আপনারা … , আমি তো সকালেই সব বলে দিয়েছিলাম। আবার কেন?”
অনীশ বেশ ভেবেচিন্তে বললেন, “দ্বিতীয় বার যদি সব প্রথম থেকে জিজ্ঞেস করি তাহলে আশা করি আপনার কোনো অসুবিধা হবে না। আর হলেও কিছু করার নেই ”
বিরক্ত মুখে ভিতরে আহ্বান করলেন তিনি। অনীশ এর দৃষ্টি সারা ঘর ময় চলতে লাগল। ঘরটা একটু অন্ধকার।
অনীশ সরাসরি প্রশ্নে চলে গেলেন, “আজ সকালে আপনি মিস্টার ভোজীয়ার সঙ্গে কেন দেখা করতে গেছিলেন?”
– “ও ছিল বিমার এজেন্ট। এখন বুঝে নিন কি কেন যেতে পারি। নিশ্চয়ই বিমার প্রসঙ্গেই গেছিলাম।”
– “হুঁ, আচ্ছা মৃতদেহ প্রথম কে আবিষ্কার করে?”
– “চাকর। তারপর আমি ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দেখি রক্তারক্তি। আর ভেতরে যাইনি।”
– “হুঁ, আচ্ছা আপনার সঙ্গে যে ভদ্রলোক ছিলেন তিনি কি করছিলেন?”
– “উনি তো বাথরুমের দিকে গেছিলেন। উনি বাথরুম থেকে ফিরে আমার পাশে পা দোলাতে দোলাতে গুন গুন করে গান করছিলেন। তারপর মৃত্যুর খবর জানলেন। বিশেষ আবেগ প্রবণ মনে হলো না।”
– “আচ্ছা মিস্টার ভোজীয়ার একটা ডিভাইস হারিয়ে গেছে। জানেন কি?”
– “কি সে? আমি ওসব ব্যবহার করি না।”
– “আপনার কথায় কোথাও হিন্দি টান দেখলাম না। আপনার নামটা তো হিন্দিভাষীদের মতো।
– “পনেরো বছর কলকাতায় থাকলে বাংলাটা ভালো জানা কি কোনো খারাপ কথা?”
– “আচ্ছা, আমরা এখন উঠি। পরে আবার আসতে হতে পারে।”
ওরা চলে যাচ্ছিল হঠাৎ উনি পিছন থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কি মিস্টার … কি যেন নাম ..!”
– “না , আমরা এখন কোথাও যাব না। খুব টায়ার্ড।”
7.
– “চল মিস্টার চৌবের বাড়ি যাওয়া যাক।” ইন্সপেক্টর রাহুল কোনো কথা বললেন না। বুঝতে পারছেন, অনীশ বেশ ভালো ভাবে কেসটা হ্যান্ডেল করছেন। উনি ঠিক পথেই এগোচ্ছেন।
এবার ওঁরা যেখানে পৌঁছলেন সেটা যে কলকাতার প্রায় বাইরে তা বললে খারাপ হয় না। একটা দোতলা বাড়িতে কড়া নাড়লেন। দরজা খুলল একজন চাকর। বলল, “বাবু ঘরে আছেন, ভিতরে বসতে বলেছেন।” ভিতরে বসলেন দু’জন। কিছুক্ষণ পর একটা গাট্টা গোট্টা লোক মুখে পান নিয়ে ওদের সামনে এসে বসল।
– “নমস্তে, পুলিশ বাবু, আমি রাম গোপাল চৌবে। সকালে তো আপনাদের সবই বলেছিলাম। আবার হামাকে কেন। তার উপর ওই ইন্সপেক্টর সাহাব আমাকে থার্ড ডিগ্রির ভয় ভী দেখালেন।”
– “মাফ করবেন চৌবে বাবু, আমরা কয়েকটা জিনিস জানতে এসেছি। আচ্ছা আপনি মিস্টার ভোজীয়াকে কতদিন চেনেন?”
– “তিন বছর। তিন বছর ওঁর কাছে টাকা রাখছি আমি।”
– “টাকা রাখছি মানে? কেন বিমার লেনদেন চেক এ করেন না?”
ভদ্রলোক একগাল হেসে বললেন, “আপনি জানেন না বুঝি। ও নামেই ছিল বিমার এজেন্ট। তার পিছনে ও সুদের কারবার করত। ওঁর মেন আয় তো ওই সুদের কারবার।”
রাহুল আর অনীশ নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করল। তারপর অনীশ বলল, “আচ্ছা আপনি এই মিস্টার সুখিয়ালকে কতদিন চেনেন?”
– “মাত্র দুই মাস। উনি কোথা থেকে কেন আসলেন তাও জানি না।”
– “হুঁ, আচ্ছা আপনার বাড়ি গান বাজনার রেওয়াজ আছে?”
– “আজ্ঞে? আছে, আমার বেটি সূর্মলা গান করে বৈকি! কেন বলুন তো?”
– “না কিছুই না।”
– “ওকে, আপনি মিস্টার সুখিয়ালকে কাল কেমন দেখেন?”
– “বেশ উত্তেজিত, আর একটু রেগে ছিলেন বোধ হয়। ভালো কথা। সকালে একটা কথা বলা হয়নি আপনাদের জেরায়। উনি একটু বাথরুমে গেছিলেন। তারপর চাকর কে বলেন উনি এখনো আসছেন না কেন দেখতে। তারপর … ওর গতিবিধি ঠিক ভালো লাগেনি আমার।”
8.
ওরা বেরিয়ে আসে।
– “কি বুঝলে?” প্রশ্ন টা করলেন রাহুল।
– “বুঝলাম অনেক কিছু।”
– “আমি একটা ধারণা কিন্তু করেছি।”
– “কি করলে?”
– “এই চৌবে মোটেও সুবিধের লোক না। ওঁর shirt এ সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো দেখলাম। বুঝতে অসুবিধা হলো না কি সেটা।”
– “হুঁ, আমিও দেখেছি।”
– “আচ্ছা চাকর কি একই কথা বলেছে?”
– “হ্যাঁ, কিন্তু বাথরুম যাওয়ার কথাটা বলেনি। আর ইনিও বলেননি।”
9.
– “গুড মর্নিং স্যার।”
সকাল সাড়ে নয়টায় লালবাজারে এসে পৌঁছায়। সকালের দ্বিতীয়বার চা খেল অনীশ।
– “স্যার, অনেকটা এগিয়েছি বলে আমি বিশ্বাস করি। তবে ভিকটিম কে তা বুঝিনি।”
– “যা এগিয়েছে তা বলো।”
এবার ওর আগা গোড়া যা যা মনে হয়েছে আর প্রমাণ সহ সন্দেহ হয়েছে পুরোটাই যুক্তি দিয়ে কমিশনার অরূপ কে বলল। শুনতে শুনতে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন উনি। সব শুনে উনি উঠে দাড়িয়ে ওঁর পিঠ চাপড়িয়ে বলল, “বাহ। দারুণ দারুণ। এগিয়ে যাও।”
ওখান থেকে বেরিয়ে আসল ও। কাল সারা রাত ভেবেছে ওই একটা স্টার নিয়ে। কিছুই বুঝতে পারছেন ও। জিপে উঠল। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করল। পাশে একটা চায়ের দোকানের রেডিও তে একটা গান বাজছে।
‘ একতারা বাজাইও না, দোতারা বাজাইও না,
একতারা বাজাইলে মনে পইড়া যায়, একদিন
বাঙালি ছিলাম রে ‘
মনে মনে গানটা গাইছিল ও, গুনগুন করে। হঠাৎ কি মনে হতে সজোরে ড্রাইভারের কাঁধ চেপে বলল, “তাড়াতাড়ি চলো মিস্টার ভোজীয়ার বাড়ি।”
কি যেন একটা বুঝতে পেরেছে ও। উত্তেজনায় ছটফট করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর জিপ মিস্টার ভোজীয়ার বাড়ির সামনে থামল।
10.
প্রায় ছুটতে ছুটতে সিঁড়ি দিয়ে উঠল। ইন্সপেক্টর রাহুল সবে এসেছিলেন। অনীশ এর কাণ্ড দেখে চমকে গেলেন। তিনিও পিছু পিছু দৌড়ালেন। অনীশ সোজা মিস্টার ভোজীয়া এর ঘরে গিয়ে শোকেসে রাখা জিনিস গুলি এক একটা করে বের করতে লাগল। মিস ভোজীয়া বোধ হয় বাড়ি ছিলেন না, থাকলেও বুঝতে পারেননি। শেষে যেটা বার করল। সেটা হলো একটা মাটির আর কাঠের তৈরি ‘একতারা’। অনীশ তাড়াতাড়ি রাহুল কে ডাকলেন। রাহুলও তাড়াতাড়ি আসলেন। এসে যেটা দেখলেন সেটা দেখে ওর মাথা প্রায় ঘুরে গেল।
– “একটা স্টার। ওয়ান স্টার। একটা তারা। একতারা।”
একতারাটা সাধারণ একতারার মতই, শুধু যে স্ট্রিংটার সঙ্গে ওটা বাঁধা থাকে সেখানে একটা চিরকুট বাঁধা।
চিরকুটটা টেনে বার করল অনীশ। আস্তে আস্তে খুলল। ওরা দু’জন সহ এক কনস্টেবল সেই চিরকুটটা এর উপর ঝুঁকে পরে দেখল তাতে লেখা আছে, “আমার জীবন যেভাবে হঠাৎ করে কেড়ে নিয়েছিলে, তেমন ভাবেই তোমার জীবন শেষ করতে আসছি — এম এস”
ইন্সপেক্টর রাহুলের মুখ ঠেলে বেরিয়ে পড়ল, “হুমকি চিঠি।”
– “এম এস?” রাহুল বাবু অত্যন্ত অধৈর্য হয়ে বললেন।
অনীশ এর কপালে আবার ভ্রূকুটি। “মিস ভোজীয়ার সঙ্গে দেখা করতে হবে।” বলে ওদের কে ইশারায় ডেকে নীচের দিকে এগিয়ে গেল।
– “বাবার খাতাপত্র সব ওই বড় আলমারিতে থাকত। আর আপনি যেটা চাইছেন সেটা আমি জানি না পাবেন কি না কারণ আমি ওবিষয়ে খবর রাখতাম না।”
বলে মিস ভোজীয়া একটা চাবির গোছা অনীশকে দিল। অনীশ সেটা নিয়ে উপরে যাচ্ছিল হঠাৎ একটা একুশ কি বাইশ বছরের ছোকরা মিস স্মিতার ঘর থেকেই বেরোলো। চুলে highlight করা। একেবারে অভদ্র পোশাক। কোথায় একটা বেরিয়ে চলে গেল।
অনীশ আলমারি থেকে অনেক খাতা পত্র পেল। আর মিস্টার ভোজীয়া যে সুদের করবার করতেন তা তার প্রায় লুকিয়ে রাখার মতন জায়গা থেকে তুলে আনা ফাইল থেকে একেবারে স্পষ্ট। বেশ কিছু ফাইল ফর্ম পেল। কয়েকটা হাতে করে নিজের জিপে রাখল। তারপর বেরিয়ে আসার সময় রাহুল কে বলল, “ আজ আপনাকে বেশ দৌড়াদৌড়ি করতে হতে পারে।”
11.
– “হ্যালো, রাহুল বাবু। আমি যে চারটে নাম পাঠিয়েছিলাম তাদের ডিটেলস নিয়েছেন? কী? তাদের মধ্যে দু’জন মারা গেছেন। আচ্ছা। আর মোহন সরকার এর আদি বাড়ি বিহার। কিন্তু তার বর্তমান ঠিকানা পাওয়া যায় নি। আর মৃণাল সুরাট বলে কেউ দক্ষিণ কলকাতা অথবা বেহালা অঞ্চলে থাকে না। অর্থাৎ পুরো পুরি failed। আচ্ছা, আজ রাত বারটায় পুলিশ স্টেশনে থাকবেন? হ্যাঁ আমি যাব, কাজ আছে। আচ্ছা রাখছি।”
ফোনটা রেখে একটা দুশ্চিন্তা ভরা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। যা সিদ্ধান্ত আজই নিতে হবে। নয় এস্পার নয় ওস্পার। এই চারটে নাম ও পায় মিস্টার ভোজীয়া এর বিভিন্ন ডায়েরি থেকে। এম এস এই আদ্যক্ষরের নাম সে খোঁজে কিন্তু এই চারটে ছাড়া পায় না। এই চার্টের মধ্যে তিনটেই সে পেয়েছে ওঁর সুদ আদান প্রদান এর খাতা থেকে। স্মিতা এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড। ভদ্রলোকের সুদ দিয়ে টাকা দেওয়ার ব্যাবসা এর প্রতিষ্ঠানের নাম। অনেক কিছু ঘুরছে ওঁর মাথায়। বোধ হয় রহস্যের দোরে এসে গেছে ও।
12.
রাত সাড়ে বারোটায় লালবাজার এর সামনে এসে দাঁড়ায় দু’টো জিপ। মানে লালবাজারে যাওয়ার জন্যে না। একটা মিট-আপ এর জায়গা দরকার ছিল, তাই এখানেই করল। এরপর রাহুল অনীশের জিপ এ উঠে পড়ল। আজ ওরা একদম নরমাল ড্রেস এ।
– “রাহুল, মিস স্মিতার বয় ফ্রেন্ডকে ট্রাক?”
“ অবশ্যই। আমার রিপোর্ট অনুযায়ী ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় আর একটা বাড়িতে। আর বের হয় একটা মোটা ব্যাগ হাতে। তারপর সেটা দেয় আর একটা বাড়িতে। তারপর সেই বাড়ি থেকে প্রায় দু’ঘণ্টা পর বেরোয়। তারপর ‘chill and rock’ বার এর সামনে এসে পাঁচ মিনিট দাঁড়ায়। তারপর ওর সঙ্গে পাঁচজন জয়েন করে। তারপর সবাই একসঙ্গে বারে ঢোকে। বারের ভিতরে মস্তি, নেশার ঝোঁকে অনেক বাজে কথা, মেয়েদের নোংরা কথা বলে, টিটকিরি মারে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর নেশায় টলতে টলতে রাত দশটার সময় বাড়ি যায়। প্রতিটা বাড়ির ঠিকানা আমার কাছে আছে।”
– “অর্থাৎ সারাদিন বাড়ির বাইরেই কাটায়, বাড়ি বলতে ওই মিস স্মিতার বাড়ি তো?”
– “হ্যাঁ।”
– “আচ্ছা, মিস স্মিতা, মিস্টার চৌবে ও সুখিয়াল এর বাড়ির প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে কি জানা গেছে?”
– “মিস স্মিতার বাড়ি সম্বন্ধে কোনো খারাপ রিপোর্ট নেই, সবাই প্রায় ভালো ও ভদ্র ফ্যামিলি বলেছে। শুধু কয়েকজন নাকি অনেক রাতে চেঁচামেচি করতে শুনেছে। আর মিস্টার চৌবে এর বাড়ি সম্বন্ধে যা জেনেছি তা খারাপ না তবে আমাদের সন্দেহই ঠিক। লোকটার চোরা চালানের কারবার আছে। কিন্তু এখনও ধরা পড়েনি। দেখতে হচ্ছে।”
– “আর মিস্টার সুখিয়াল?”
-“মিস্টার সুখিয়াল এর বাড়ি সম্বন্ধে কোনো কথাই ওঠে নি। সকলেই বলেছেন অত্যন্ত অমাইক, অবিবাহিত, ভদ্রলোক। গান বাজনার শখ আছে বোধ হয়, অনেক রাতে বিভিন্ন বাজনার আওয়াজ শোনা যায়। ভদ্রলোক বেহালা বাজানো শেখান। কয়েকজন বলেছে উনি নাকি এক সময় সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।”
অনীশ এর চোখ চিক চিক করে উঠল। ওঁর মুখে হাসি ফুটল। একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, “আচ্ছা, চলো এবার দুজনের বাড়ি যাওয়া যাক।”
– “মানে? এই রাত দুপুরে?”
– “আরে বাড়ির ভিতরে যাব না। বাড়ির বাইরে থাকব।”
প্রথমে ওরা পৌঁছল মিস্টার চৌবের বাড়ির সামনে। দূরে একটা ঝোপের আড়ালে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে চুপচাপ একটা যায়গায় ঘাপটি মেরে থাকল ওরা। প্রায় আধা ঘণ্টা পর একটা মিনি ট্রাক এসে দাঁড়ালো মিস্টার চৌবের বাড়ির সামনে। আস্তে আস্তে বাড়ির একটা garage এর মতন দেখতে দরজা খুলে গেল। গাড়িটা আস্তে আস্তে ঢুকল।
অনীশ এর কানে ফিস ফিস করে রাহুল বললেন, “চোরাই মাল, আমরা কি এখুনি গিয়ে ধরব?”
– “না, এই কাজটা পরে কোনোদিন হবে। টার্গেটে রাখলাম। স্মাগলারদের ধরতে হবে। এখন আস্তে আস্তে বেরিয়ে যাই চলুন। যা দেখার দেখে নিয়েছি।”
রাত প্রায় একটা পনেরো। মিস্টার সুখিয়াল এর বাড়ির সামনে একটা ল্যাম্প পোস্ট বাদে সব অন্ধকার। একটা ছোট গুল্মের ঝোপের কাছে ওরা দাঁড়িয়ে আছে। অনীশ এর দৃষ্টি একটা ছোট্ট ঘরে। হঠাৎ ঘরটায় আলো জ্বলে উঠল। তারপর আবার বন্ধ হয়ে গেল। চারিদিক নিঝুম। হঠাৎ একটা মিষ্টি বেহালার স্বর শোনা গেল। প্রায় পনের মিনিট কাটল। তারপর তাও বন্ধ হয়ে গেল। তারপর সব চুপ।
অনীশ এবার আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “চল এবার, যে যার বাড়ি গিয়ে ঘুমানো যাক।”
13.
সকালে অনীশ এক কাপ চা খেয়ে একটা এক্সারসাইজ করে নিজের ইউনিফর্ম পরে তৈরি হলেন। একটা নাটক হবে আজ। নিজের পকেট থেকে ফোনটা বার করলেন, তারপর ডায়েল করল ইন্সপেক্টর রাহুল মজুমদার কে।
– “সব তৈরি? …ওকে।”
অনীশ এর আজ বেশ হালকা হালকা লাগছে। আজ বিকালে একটা লং ড্রাইভ এ যাবে ভাবছে। নাহ, পুলিশের জিপে না, নিজের একটা গাড়ি আছে, সেটাতে।
আজও মিটিং প্লেস লালবাজার। সেখানে কমিশনারের অনুমতি নিয়ে এগোনো হলো। কমিশনার এক গাল হেসে বললেন, “যাও যাও, আমিও চাপ মুক্ত হই।”
তখন কটা বাজে। সকাল সাড়ে দশটা। দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুললেন মিস্টার সুরেশ মোহন সুখিয়াল। এবার ওদের দেখে একটু বেশী আতঙ্কিত মনে হল ওনাকে।
– “আ, আসুন!”
– “হ্যাঁ, আসব তো বটেই, আসুন আপনি ও একটু বসুন তো।”
সবাই মিলে মিস্টার সুখিয়াল এর ড্রয়িং রুমে বসলেন।
অনীশ প্রথমে একটু আয়েশ করে নিলেন। চারিদিকে তাকিয়ে নিলেন। গতবার বেশি কিছু দেখতে পাননি। আজ অনেক কিছু দেখতে পেলেন। তারপর বললেন, “আচ্ছা আপনি কি কয়েকদিন আগে তাজমহলে গেছিলেন?”
এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে রাহুলও ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন।
মিস্টার সুখিয়াল বললেন, “আজ্ঞে না। কেন?”
– “না মানে আপনার বাড়ির কোনায় একটা shoe cover দেখলাম। এরম কভার ওখানে ব্যবহৃত হয় কিনা। ধর্মীয় স্থান বলে কথা। তা যাক, আপনি নাকি ভালো বেহালা বাজান! এছাড়া আপনি নাকি একজন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন? কটা গানে কাজ করেছেন?”
ভদ্রলোক এবার দর দর করে ঘামছেন, কেন তা বলা মুশকিল। বললেন, “এক সময় করেছি। কিন্তু এসব প্রশ্ন কেন? আমার কিন্তু বেশি সময় নেই। যা বলার বলুন।”
– “আপনার হাতের লেখা বড্ড সুন্দর। ওই যে ডাইরিটাতে আপনার লেখা তো?”
ভদ্রলোক কিছু বললেন না। এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি চা করতে যাচ্ছি, এসে কথা বলছি।”
উনি চলে যাওয়ার পর অনীশ বেশ রসিকতার সাথে বলল, “ বাব্বাহ্, ভদ্রলোক একটু ঘাবড়ে গেছেন, তবে অতিথি সেবায় ত্রুটি রাখছেন না।”
কিছুক্ষণ পর চা নিয়ে আসলেন উনি। চা টা দিয়ে বললেন, “নিন।” তখনও যে ওঁর হাত কাঁপছে সেটা অনীশ ভালই লক্ষ্য করেছে।
– “হ্যাঁ, অবশ্যই নেব। তবে আমার এখনও দু’টো প্রশ্ন বাকি আছে। তারপর আমরা নেব, তার আগে না। আচ্ছা এবার বলুন। রাহুল এখন নিও না চা, আগে কথা গুলো শুনে নাও। হ্যাঁ যা বলছিলাম, আপনি তো সাউন্ড বিষয়ে অনেক কিছু জানেন, আচ্ছা পঁচাত্তর ডেসিবেল আমাদের কানের জন্যে ভালো, তাই না?”
ভদ্রলোক কাঁপছেন। কিছু বললেন না।
– “আচ্ছা এবার আমার শেষ প্রশ্ন। মোহন সরকার কে?”
এইবার একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল যার জন্যে ইন্সপেক্টর রাহুল বোধ হয় মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। মিস্টার সুখিয়াল এবার তীব্র রাগে গর্জে উঠে বললেন, “আমি, হ্যাঁ আমি মোহন সরকার। বিহারে আমার আদি বাড়ি ছিল, আমার টাকা লুটে আমাকে সর্বস্বান্ত করেছিল ওই শালা ভোজীয়া। বন্ধুর নামে কলঙ্ক ও। খুব কষ্ট করে বাবা মা বড় করেছে। নিজের ইচ্ছেতে এই পথে এসেছিলাম। তারপর আমার জীবনে আসল ওই পিশাচ। লোভ দেখাল। আমিও লোভে নাচলাম। একদিন টাকা চাইতে গেলাম। বলল কাল দেবে। আর তারপর দিন ব্যাটা হাওয়া। অনেক খুঁজে খোঁজ পেলাম। অপেক্ষা করলাম পনেরো বছর। ভাব জমালাম। আমায় চিনল না ও। তারপর একদিন সুযোগ পেলাম। আমি জানতাম ওর ব্যাবসায়িক সমস্ত কিছু। আমায় সব বলত। এতটাই বিশ্বাস করেছিল আমায়। আমায় কেউ চিনত না। আমি লুকিয়ে আসতাম। অনেক চোরাকারবার ওর। পুলিশের ভয়ে আমায় লুকিয়ে আনত আর নিজে বের হতে দিত না। মাইনে দিত আমায়। এক এক টাকা গুনে নিয়েছি। তখন আমার একুশ বছর বয়েস। নিজের আর বাবার জমানো রো লাখ টাকা দিয়েছিলাম, সেই বারো লাখ টাকা গুনে গুনে মাইনে হিসেবে পুরণ করেছি আমি। আর পেতেছি ফাঁদ। আর তারপর একদিন হুমকি চিঠি দিলাম। হাতের লেখা বিকৃত করে, তাও দেখছি ধরে ফেলেছেন। আপনাদের সব বলে ফেললাম যে … হে হে হে হে কারণ এবার আপনারা মরবেন।”
একটা অট্টহাসির পর পকেট থেকে একটা পিস্তল এনে ওদের দিকে তাক করার আগেই অনীশ ওঁর সার্ভিস পিস্তলটা বার করে ফেলল।”
– “ও, পুলিশ আবার বন্দুক ধরেছে। ঠিক আছে, কিন্তু আমায় ধরতে পারবে না।” বলে চায়ের কাপগুলো থেকে একটা কাপ তুলে নিয়ে নিজের গলায় প্রায় ঢালতে যাচ্ছিল মিস্টার সুখিয়াল, ঠিক তক্ষুনি ইন্সপেক্টর রাহুলের রিভলবার গর্জে উঠল। মোক্ষম টিপ, ঠিক হাতের কব্জির উপরে। মিস্টার সুখিয়াল ওরফে মোহন সরকার মাটিতে লুটিয়ে গেলেন। অজ্ঞান হয়েছেন।
14.
গাড়িতে করে যেতে যেতে ইন্সপেক্টর রাহুল ইন্সপেক্টর অনীশ এর কাছে জানতে চাইলেন, “আমাকে একটু খোলসা করে বলো তো সব।”
অনীশ হেসে বললেন, “তাহলে শুনুন, আপনার প্রথম দিনের কথাতেই বুঝি খুনি অত্যন্ত তুখোড় বুদ্ধিমান ও যিনি খুন হয়েছেন তার ঘনিষ্ট। নাহলে প্রত্যেকটা ক্ষুদ্র পয়েন্ট সে জানতো না। মিস্টার সুখিয়াল BLUETOOTH ইয়ারপিস পরতেন তাও বাঁ কানে। রাতে যে ফোনটা আসে সেটা হলো 100+ ডেসিবেল সম্পন্ন একটা সাউন্ড ওয়েভ। উনি সাউন্ড সম্বন্ধে ভাল বোঝেন। তাই কল connect করে মার্জ করে তিনি ওই তীব্র শব্দ প্রয়োগ করেন। ফোন এ করা সম্ভব না কারণ ফোন এর স্পিকারে কাজ অত হতো না। এটা একটা আচমকা শক এবং শট।
এরপর আর একটা জিনিস তিনি করেন। ঠিক তার পরদিন যান। আমার মতে উনি বাথরুম যাওয়ার ভান করে যান মিস্টার ভোজীয়ার ঘরে। তারপর শু-কভার পড়েন যাতে দাগ না পড়ে জুতোর। তারপর earpiece টা খুলে নেন। হাতে গ্লাভস পরেন। মিস্টার চৌবে তাকে খুব কমই দেখেছেন কারণ তিনি নিজেই আত্মপ্রকাশ করতেন না। তিনি থাকতেন একটা সিক্রেট প্লেসে কারণ মিস্টার ভোজীয়ার সমস্ত ব্যাবসার সেক্রটারি হিসেবেই তিনি তাকে রেখেছেন। নাড়ি নক্ষত্র সবই জানতেন। তাকে যাতে কেউ বাগে না পায় তাই এই ব্যাবস্থা। নিজের মেয়েও জানত না। কিন্তু খাতায় থাকা চিহ্নের সম্বন্ধে তিনি জানতেন না। বোধ হয় নিজের প্রাণ আশঙ্কা বুঝেই সংকেতটা রেখে দিয়েছিলেন মিস্টার ভোজীয়া। মোহন সরকার তারপর বেরিয়ে এসে চাকর কে বলেন যে ভিতরে গিয়ে দেখতে। এবার আমার সন্দেহ হয় আমাদের এই পরিচিত তিন জনের ওপরেই। মেয়ে সম্ভবত বাবা কে খুন করবে না। কিন্তু মেয়ের বয়ফ্রেন্ড পারে। মিস স্মিতার বাবা এই সম্পর্ক পছন্দ করতেন না বলেই মনে হয়। তবু মেয়ের জোর। কিন্তু শ্বশুর কে সরাতে পারলে অনেক টাকার মালিক হতে পারত জামাই।
এবার মিস্টার চৌবের কথা বলি, ওঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই আমার ওঁর উপর একটা সন্দেহ জাগে। ওঁর ধান্দা ছিল – কোকেন, আফিম অন্যান্য জিনিস সাপ্লাই করা হতো।
মিস্টার সুখিয়াল ওরফে বিহার অধিবাসী মোহন সরকার। লোকটা যে অনেক মিথ্যে বলছে তার প্রমাণ পর পর পাচ্ছিলাম। চিঠিতে লেখা ছিল এম এস। খুঁজে খুঁজে মোহন সরকার নামটা পাই। এখন প্রশ্ন ওটাই কেন দেখছিলাম। দেখছিলাম কারণ সেদিন একটা গিটারের তার উঁকি মারতে দেখেছিলাম। শব্দ যে কোনো কিছু দিয়ে বানান যায়, যদিও এ বিষয়ে বেশি জ্ঞান নেই। মিস্টার সুখিয়াল এর পুরো নামে ওই শব্দটা আছে। তারপর একটু অনুমান। আস্তে আস্তে সব সাজাই। তারপর অনেক প্রমাণ। তারপর জাল গোটাই। আর তারপর সবই জানো। চা তে যে কিছু থাকবে তা একটু আন্দাজ করেছিলাম। উনি আন্দাজ করেছিলেন যে অনেক কিছু জানাজানি হয়ে গেছে। হয়ত আজ রাতেই বেরিয়ে যেতেন। কাল যাননি কারণ আমরা গিয়েছিলাম। একটু ভয় ঢুকে গেছিল ওনার মধ্যে, ভেবেছিলেন পুলিশ যদি বাইরে পাহারা দেয়। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। কিন্তু কথাটা পুরোপুরি কার্যকরী হয় না যখন সেই লাভের ভাগীদার অন্য কেউ হয়। তাকেও মরতে হয়।”
– “হ্যাঁ, সব ই বুঝলাম। আমার কল্পনা শক্তির অনেক বাইরে দিয়ে গেছে কেস টা।”
– “হে হে” কিছুক্ষণ নিরবতা, তারপর ইন্সপেক্টর অনীশ সেন ইন্সপেক্টর রাহুল মজুমদার কে বললেন, “চলো, আজ বিকালে ভাবছি আমার গাড়ি করে লং ড্রাইভ এ যাব। একটু ছুটিও দরকার বই কি। যাবে নাকি?”
– “যেতেই পারি, তাহলে লালবাজার অফিসের সামনে দাঁড়াচ্ছ নাকি?”
The End