শেষ নাকি শুরু? | ভয়ের দেশ | দেবলিনা ব্যানার্জী| Bengali Horror Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

“এই যা!!! নেট-প্যাক টা শেষ হয়ে গেলো! দেখ তো কাছের কোনো ওয়াই-ফাই তে কানেক্ট করা যাচ্ছে কিনা!” বলেই শাওন তার ফোনের ওয়াই-ফাই টা অন করে।

শাওন, দেবপ্রিয়া, অনন্যা প্রত্যেকেই ক্লাস টুয়েল্ভ। শৌর্য্যা, শাওনের বোন, ক্লাস টেন, সদলবলে বেরিয়েছে অরফ্যানেজ-এর বাচ্চাদের জন্যে গিফ্টস কিনতে। কাল চিল্ডরেন্স ডে। সাথে আবার কালীপুজো। তাই কিছু বাজিও কেনা হবে। আজ আবার ভূত চতুর্দশী। ওরা সবাই আবার ঠিক করেছে যে বাঙালিমতে ভূত চতুর্দশী পালন করবে।

না না, আপনারা যা ভাবছেন, তা নয়। ওই চৌদ্দ শাক, চৌদ্দ মোমবাতি জ্বালিয়ে নয়। খ্রিস্টান দের হ্যালোউইন এর মতো মুখোশ পরে উদযাপন করা তাদের এমনটাই ইচ্ছা। মুখোশ গুলো হবে বাঙালি ভূতের মতো। যেমন, স্কন্দকাটা, পেত্নী, ব্রেহ্মদত্তী, শাঁকচুন্নি। এখন ওরা সবাই মিলে লেক মল- এর এক ক্যাফেটেরিয়া তে বসে কফি খাচ্ছে আর আগামীকালের জন্য কিছু প্ল্যান করছে।

শৌর্য্যা বলল, “দিভাই, লেক মলের ওয়াই-ফাই টা দেখ না, কানেক্ট হয় কিনা!!” সঙ্গে-সঙ্গে শাওনের মোবাইলের স্ক্রিনে ফুটে ওঠে ওয়াই-ফাই-এর কিছু অ্যাভেইলেবল নেটওয়ার্কস। পরপর অনেকগুলো নাম-ই ভেসে ওঠে ওই স্ক্রিনে। LAKEMALLOFFICIAL, INDRANIL, POONAM’SMOBILE, ইত্যাদি। একটা অদ্ভুত নামে শাওনের চোখটা আটকে যায় এবং সেই নামটার দিকে সে অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়েই থাকে, এবং মনে-মনে কিছু একটা ভাবে। EVERYTHINGISCONNECTED. –“এরকম ওয়াই-ফাই-এর নাম!” হাসতে-হাসতে সবাইকে বলে, “মনে হয়, খুব ডার্ক সিরিজের ফ্যান। সেখান থেকেই ইন্সপায়ার্ড।” অনন্যা খুব উৎসাহের সাথে বলে ওঠে, “আমিও তো তাহলে আমার ওয়াই-ফাই এর আইডি টা JONASANDMARTHA রাখতেই পারি বা, আবোলতাবোল২০০০? এটা তো বেস্ট আমার পক্ষে, কি বলিস?”

খুব একটা বিশেষ ভীড় ছিলনা ক্যাফে তে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল যে এরকম একটা ওয়াই-ফাই এর নাম রাখলো কে? কারণ ওই তিন-চার জন ছাড়া আরো ছিল মোট সাত-আট জন এবং সেখানে যে দুটো ফ্যামিলি, তা বোঝা যাচ্ছে। একদিকে মা-বাবার দু-এক বছরের বাচ্চাকে নিয়ে এক কোনায় দাড়িয়ে এবং আরেকটা পরিবারের দুই প্রাপ্তবয়সি মহিলা, ও দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক ভদ্রলোক। এদের মধ্যে যে কেউ এই ধরণের নাম রাখবে, তার সম্ভাবনা খুবই কম। তা যাই হোক, পাশ থেকে দেবপ্রিয়া বলে ওঠে, “হতে পারে কাউন্টারে যেই মেয়েটি রয়েছে, এটা সম্ভবত ওর। এসব ভেবে কী লাভ আছে, ছাড় না!!”

সমস্ত গল্প-গুজব শেষের পথে। এখন সকলের বাড়ি ফেরার পালা। শৌর্য্যা আর শাওন ঠিক করে যে অত জিনিসপত্র নিয়ে ক্যাব ধরে বাড়ি ফিরবে। রাত তো আর কম হলোনা! ওদিকে বাইরে আবার হাল্কা হিম ও পড়ছে। ক্যাবে ওঠার পর, সে যখন আবারো সেই ক্যাবের ওয়াই-ফাই টা সেট করতে যায়, বেশ কিছুটা দূর গাড়িটি চলে যাওয়ার পরও দেখে আবার সেই এক-ই নাম! EVERYTHINGISCONNECTED. “এই দেখ বোন, এখানেও সেই নামটা।” শাওন বলল। শৌর্য্যা ভারী অবাক দৃষ্টিতে শাওনের মুখের দিকে বেশ একটা ভয়াবহ কিছু অনুভব করতে-করতে বলল, “আচ্ছা দিভাই, গাড়িটা তো অনেকটা দূর চলে এলো, তাও কেন এরকম হচ্ছে? লোকটা কি এখানেই কোথাও আছে নাকি?”

শাওন ওর বোনকে এই নিয়ে আর কিছু বলেনি। চুপচাপ ফোন থেকে ওয়াই-ফাই টা অফ করে বাকি পথটুকু বেশ চিন্তায় গাড়িতে যাচ্ছে। বুকের ভেতরটা বেশ ধর-ফর করেই চলেছে। ঠিক বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই দ্বোরগোড়ার সামনে যে তার কী মনে হলো, সে আবার ফোনটা খোলে, এবং অদ্ভুতভাবে সে দেখে, যে তার ওয়াই-ফাই অফ থাকার সত্বেও ওই নাম বার-বার ফোনে ভেসে আসছে! সে ভাবলো, তার ফোনটা খারাপ হয়ে গেছে হয়তো, তাই এই ভেবে সে একবার অফ করে আবার অন করে, কিন্তু কিছুই বদলালো না। আবারো সেই নাম ভেসে উঠেছে।

ভূত চতুর্দশীর রাত। রাত পোহালেই কালীপুজো। বাইরে কয়েকটা বাজির আওয়াজ আর ঘরের ভিতরে নিশ্চুপ শাওন বসে, একই জিনিস দেখে যাচ্ছে। কিন্তু এবার পাশে আরেকটা ওয়াই-ফাই ও পেয়েছে। RAHUL30. “এটা নিশ্চয়ই রাহুল দার হবে।” ঠিকই। ছাদ থেকে বাজি ফাটিয়ে নেমে এল রাহুল দা। ওর মুখ দেখে শাওনের সেই গা শিরশিরানির ঠাণ্ডা ভাবটা কেটে গেল কিছুটা। মুখের ওপর দিয়ে একটা শীতল হাওয়া বয়ে গেল। রাহুল দা কে দেখার পর, শাওনের মনে একটু শান্তি আসে এবং সে ঘরে চলে যায়। একটু ভয়ের সাথে সে ভাবতে থাকে, “না! আর ফোন টা আমি খুলবই না। এবার একটু এইসব থেকে দূরে থাকবো।” এটা ভাবতে না ভাবতেই তার ওই অন্ধকার ঘরের বাইরে কেমন যেন একটা বীভৎস ঝোড়ো হাওয়া বয়ে গেলো, আর কয়েকটা কুকুরের ডাক যেটা শোনা যাচ্ছিলো। এদিকে রাত ও বাড়ছে। তার বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছে বলে খেতে-শুতেও দেরি। ঘুম-ই আসতে চাইছে না শাওনের। গত বছর থেকে সে ওই ঘরটায় একা শোয়। তাই সে ভাবলো একটু অন্য কিছু করার কথা। তার খাটের পাশের টেবিল অ্যালার্ম ক্লকটায় বাজে তখন রাত আড়াইটে। শাওন আনমনেই ফোনটা হাতে তুলে নিলো এবং খুব তীব্রতার সাথে মেসেজ আসার নীল আলোটা ওরকম ঘুটঘুটে অন্ধকারে দবদব করে জ্বলে উঠলো। শাওন ভাবলো, “এত রাতে কে আবার টেক্সট করলো? এফবি তে কি কেউ কিছু পোস্ট করলো? অবশ্য সবাই তো এখন গলায় FAIRYLIGHTS জড়িয়ে ছবি দেবে হ্যাপি দিওয়ালি উপলক্ষে। সে আর নতুন কি!”

শাওন ফোন ধরে রয়েছে কিন্তু করছে কিছুই না কারণ কোথাও কিন্তু তার মনের কোনায় ভয় রয়েই গেছিলো। ফোনে হাত দেওয়া মাত্রই সেই নাম ভেসে উঠছে EVERYTHINGISCONNECTED. এমনকি ওয়ালপেপারের টনি স্টার্ক-এর ছবিটা যে ছিল, সেটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। কি করবে শাওন?কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। ক্রমশ: ভয় তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বাইরে গিয়ে কি কাউকে কিছু বলবে? কিছুক্ষণ পর তার ফোনে মেসেজ আসার মত কিছু টুং-টাং শব্দ হতে থাকে। পরপর কয়েকবার হয়েই যায়। সে না দেখার হাজার চেষ্টা করেও পারলো না নিজেকে মোবাইল স্ক্রিন টা দেখা থেকে আটকে রাখতে। মোবাইল স্ক্রিনে কয়েকটা শব্দ ফুটে উঠলো। “শুনতে পাচ্ছো?হ্যালো, আর ইউ লিসনিং?” শাওন অনেক চাইলো চিৎকার করে উঠতে কিন্তু তাকে যেনো সেটুকু মুহূর্ত কেউ কন্ট্রোল করে রেখেছিল। হাতের নার্ভ গুলো যেনো শিরশিরিয়ে উঠছে এবং তাকে টেলিপ্যাথি-র মতো ভিতর থেকে বলা হচ্ছে, “পাচ্ছি শুনতে পাচ্ছি, ইয়েস, আই অ্যাম লিসেনিং।”

“পেয়েছো আমায় খুঁজে তুমি, পেয়েছো!”

“আমি…. ত…ত..তোমাকে…খ..খ…খুঁজে পেয়েছি মানে? তুমি ক.. ক…..কে??” শাওন তীব্র নিঃশ্বাসে এই কথা গুলো বলতে লাগলো।

“EVERYTHINGISCONNECTED. হ্যাঁ, আমিই সে।”

সব কথা গুলোর আওয়াজ যেনো ক্রমশঃ জোরে থেকে আস্তে হয়ে যাচ্ছে আর শাওন এর সারা শরীর আলাস্কার বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

“এক বছর ধরে আমি ঘুরছি ওখানে। ওহ! তুমি জানো না সে কী যন্ত্রণা। কেউ দেখছে না আমায়, কেউ ডাকছে ও না।”

“কেনো? কেউ ডাকছে না কেনো।” শাওন কথাগুলো বলছে ঠিকই কিন্তু বলছে না। তার কথাগুলো যেনো একটা তরঙ্গের মধ্যে দিয়ে চলে যাচ্ছে সমানে। সে টের পাচ্ছে যে সারা টা ঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাথার নীচে বালিশ আর পায়ের পাতায় ফ্যান এর হাওয়া। তার চোখের সামনে শুধু একটা টেবিল আর তার পিছনে এক জ্বলজ্বলে আলোকময় পর্দা, যেখানে রয়েছে সেই EVERYTHINGISCONNECTED.

“কারণ আমি নেই, থেকেও নেই। এক বছর আগে ওই বন্ধুদের সঙ্গে ওই ক্যাফে থেকে বেরোনোর সময় ফোনে মগ্ন ছিলাম। সন্ধ্যে ৬টা ৪৫মিনিটে আমার একটা লাস্ট মেসেজ আসে আর সেটা দেখতে দেখতেই রাস্তা পেরোনোর সময় আমার সামনে এক বিশাল বড় বাস চলে আসে এবং…সব শেষ…হয়ে যায়!

তারপর থেকে আমি ওখানেই ঘুরছি। দেখতে পেলাম প্রাণহীন শরীর টা ওরা সরিয়ে নিয়ে গেলো বাড়ির লোকজন ও কম কাঁদেনি। কিন্তু তারপর? তারপর আমি একাই ঘুরেছি। এমন কাউকে খুঁজেছি যে আমায় বাড়ি নিয়ে যাবে, তারপর তোমাকে পেলাম।”

“কিন্তু মোবাইলে কেন?”

“কারণ রাস্তায় চ্যাট করতে-করতে খেয়াল করিনি কখন আচমকা বাস টা এলো। তুমি এরকম কখনো করোনা তাই আটকে গেছি মোবাইল এর ফাঁদে। আমাকে কানেক্ট করবে তো?”

“কা…ক…কানেক্ট?” প্রচণ্ড কর্কশ হয়ে ওঠে শব্দহীন কন্ঠস্বর। চেঁচিয়ে উঠে বলে, “অনেকদিন এভাবে থেকেছি একটা চ্যাটরুমের মধ্যে। এবার আমি বেরোবই!! কাম অন, কানেক্ট মি!!” শাওন নি:শব্দে তারস্বরে বলে ওঠে, ‘না!!!!!’

প্রাণপণে রীতিমতো দড়ি ছেঁড়ার মত জোর দিয়ে নিজের দুই হাত আলাদা করার চেষ্টা করলো, আর ভীষণ শক্তি দিয়ে জিভ নাড়িয়ে বললো, ‘না!!!!!!!!’

এই আর্তনাদ শুনে পাশের ঘর থেকে শাওন এর মা বাবা ছুটে এসে দেখে মেয়ে মাটিতে, বিস্ফাড়িত নেত্রে পড়ে আছে এবং একটু দূরেই হাত থেকে ছিটকে পড়ে রয়েছে মোবাইল, যেটার স্ক্রিনে সেই নীল আলোটা তখন ও পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি!

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post ফেসবুক লাইভ | ভয়ের দেশ | অঙ্কিত ভট্টাচার্য| Bengali Horror Story
Next post শেষ পরিণতি | ভয়ের দেশ | তানভীর স্বাধীন| Bengali Horror Story