সকাল থেকেই ঘরের মধ্যে পায়চারি করে চলেছে অভীক। মাঝে-মধ্যে হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, আবার হাঁটতে শুরু করছে। অভীকের এই কাণ্ডকারখানা দেখে অবশেষে বিরক্ত হয়ে পড়ল মধুমিতা।
“কী ব্যাপার অভীক! সকাল থেকে এভাবে পায়চারি করে যাচ্ছ কেন?”
মধুমিতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল অভীক, “একটা ইন্টারেস্টিং কেস আসছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে,” আবার হাতঘড়ির দিকে তাকাল।
ছোটবেলা থেকেই অভীকের গোয়েন্দা হওয়ার শখ। যে সে গোয়েন্দা নয়, বিখ্যাত এক গোয়েন্দা যার নাম ছড়িয়ে থাকবে সারা পৃথিবী জুড়ে। আজ অবধি সে অনেকগুলো কেসেরই সমাধান করেছে। ছোটবেলায় ক্লাসের পেন চোর ধরা থেকে এখন পাড়ার ছিঁচকে চোর ধরা, রোজ সকালে অন্যের বাড়ির বেল বাজিয়ে পালানো ব্যক্তিটিকে ধরা ইত্যাদি ইত্যাদি। গোয়েন্দা হিসেবে পাড়ায় বেশ নামডাকও হয়েছে তার। তবে তার চিরকালের স্বপ্ন কোনও এক খুনের মামলার তদন্ত করার। আজ হয়তো সেই সুযোগটা আসতে চলেছে।
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ কানে আসতে তাড়াতাড়ি দরজা খুলল অভীক। সামনে দাঁড়িয়ে এক লম্বা-চওড়া পুলিশ অফিসার।
“আয় আয় ভেতরে আয়,” এক গাল হাসির সঙ্গে বলল অভীক।
ঘরে ঢুকে সামনের সোফায় গিয়ে বসল ইন্সপেক্টর মিহির দাস। ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল, “হুম, দেখে মনে হচ্ছে সত্যিই কোনও গোয়েন্দার বাড়িতেই এসেছি।”
একটা মুচকি হাসি হাসল অভীক। চোখের ইশারায় মধুমিতাকে তিন কাপ চা বানাতে অনুরোধ করল।
“আর বল তোর খবর কী? এতদিন তো তোর কোনও পাত্তাই ছিল না। তোর নাম্বারে কত ফোন করা হত কিন্তু বাবুকে কখনও ফোনে পাওয়াই যেত না। আর হঠাৎ গত পরশু আমাকে ফোন করে বলছিস, কেসটা কি! মানে দরকার ছাড়া ফোন করবি না বল?”
“আসলে আমার পুরনো নাম্বারটা বন্ধ করে দিয়েছি আর এই নতুন নাম্বারটা নিয়েছি। গত পরশু যখন জানতে পারলাম যে নির্মল হত্যাকাণ্ডের কেসটা তুই পেয়েছিস তখন ভাবলাম এই সুযোগটা কাজে লাগানো যাক,” মুখের হাসিটা একটু প্রসারিত হয়ে গেল অভীকের।
“তাই তো ভাবি, কোনও কাজ ছাড়া তো ফোন করবি না তুই। তার আগে বল মেয়েটা কে?” চাপা গলায় বলল ইন্সপেক্টর।
“গার্লফ্রেন্ড। সবে সবে সেট হয়েছে।”
“কী বলছিস রে! কবে! কীভাবে?” লাফিয়ে উঠল মিহির।
“সে সব অন্য একদিন শোনাব। প্লিজ তুই আগে কেসটার ব্যাপারে একটু বল,” বেশ গম্ভীর হয়ে গেল অভীক। ইতিমধ্যে মধুমিতাও চা নিয়ে হাজির। ট্রে-টা সামনের টেবিলে রেখে অভীকের পাশে বসল।
“অভীক তোর গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ করাবি না।”
“হ্যাঁ নিশ্চয়। মধুমিতা, এ মিহির, আমার স্কুলের বন্ধু আর মিহির এ মধুমিতা, আমার গার্লফ্রেন্ড। এবার কেসটা বল,” একটু রাগতভাবে বলল অভীক।
“ওকে ওকে। রেগে যাচ্ছিস কেন? আচ্ছা বলছি,” বলতে শুরু করল ইন্সপেক্টর, “তিন দিন আগে দেশপ্রিয় পার্কের কাছের একটা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে থানায় ফোন আসে। আমরা সেখানে পৌঁছে দেখি অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বছর বারোর একটা ছেলের মৃতদেহ পড়ে আছে। ছেলেটার নাম নির্মল মল্লিক। সেই অ্যাপার্টমেন্টেরই বাসিন্দা রাজদীপ মল্লিকের ছেলে। এই পয়লা বৈশাখের দিন থেকে নাকি নির্মল আর তার দিদি সোহিনীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ছেলেটার মা থানায় এসে একটা মিসিং ডায়েরি করিয়েছিল। পুলিশ তাদের খোঁজার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল কিন্তু…” একটু থামল ইন্সপেক্টর।
“মেয়েটার কোনও খোঁজ পাওয়া যায় নি?”
“এখনও পর্যন্ত না। তবে চেষ্টা চলছে।”
“ছেলেটার মৃত্যু কীভাবে হল?”
“কয়েকদিন ধরে ওকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। বডিতে বেশ কিছু ক্ষতের চিহ্ন পাওয়া গেছে মানে টর্চার করা হয়েছিল। তবে মৃত্যু হয়েছিল গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে রাখার ফলে।”
“অ্যাপার্টমেন্টের সামনে সিসিটিভি বা কোনও সিকিউরিটি গার্ড?”
“না।”
“বাড়ির লোক এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা হয়েছে?”
“এখনও পর্যন্ত শুধু রাজদীপ মল্লিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। এই ঘটনার পর ওঁর স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। আর প্রতিবেশীদের সঙ্গেও কথা হয়েছে তবে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। আজকে ছেলেটার কাকা এসেছেন। ওঁর সঙ্গেই কথা বলব বলে যাচ্ছিলাম।”
কথাটা শুনে তৎক্ষণাৎ নিজের চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে দিল অভীক, “চল চল। এই অপেক্ষাতেই তো ছিলাম।”
“তুই কোথায় যাবি?”
“কেন তোর সঙ্গে। সেই সকাল থেকে রেডি হয়ে আছি।”
“ভাই আমি জানি যে তুই গোয়েন্দা হতে চাস কিন্তু এভাবে আমি তোকে নিয়ে যেতে পারব না। এটা একটা সিরিয়াস ম্যাটার।”
“তুই মনে হয় ভুলে যাচ্ছিস যে আজ পর্যন্ত আমি একটাও কেস হারিনি,” একটু অহংকারের সুরে বলল অভীক।
“সে যাই হোক কিন্তু আমি তোকে নিয়ে যেতে পারব না,” বলে উঠে দাঁড়াল ইন্সপেক্টর।
“এই প্লিজ প্লিজ। আর আমি থাকলে যে তোর সুবিধা হবে সেটা তুইও জানিস।”
কথাটা শুনে একটু ভাবতে লাগল মিহির। অভীক যে কেমন গোয়েন্দা সেটা মিহির স্কুলের দিন থেকেই জানে এবং এটাও জানে যে অভীক এই কেসে থাকলে তার সুবিধায় হবে। তাই অতিকষ্টে শেষমেশ রাজী হয়ে যায় মিহির।
ঘর থেকে বেরোনোর সময় অভীকের উদ্দেশ্যে মধুমিতা একটু মজার সুরে বলল, “জানি তোমার দ্বারা কেস সল্ভ হবে না তবুও অল দ্য বেস্ট।”
মধুমিতার দিকে খানিকক্ষণ কড়া চোখে তাকিয়ে থেকে শেষে মিহিরের সঙ্গে বেরিয়ে গেল অভীক।
২
মিনিট তিরিশের মধ্যে মিহিরের সঙ্গে নিজের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল অভীক। বাইক থেকে নেমে বিল্ডিং-টাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিল।
“কোন ফ্লোরে?” বিল্ডিং-এর গায়ে খোদাই করা ‘SHANTI’ নামটার দিকে তাকিয়ে বলল অভীক।
“ফোর্থ, চল।”
লিফট থেকে নেমে ফোর্থ ফ্লোরের দ্বিতীয় দরজার সামনে এসে দাঁড়াল দুজনে। বেল বাজাতে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক দরজা খুললেন।
“ও ইন্সপেক্টর দাস। আসুন।”
“ধন্যবাদ দেবব্রতবাবু। রণদীপবাবু এসেছেন তো?”
“হ্যাঁ, উনি ভেতরে আছেন,” অভীকের দিকে একবার তাকালেন দেবব্রত।
ওঁর কিছু বলার আগেই অভীক বলে উঠল, “নমস্কার দেবব্রতবাবু। আমি ডিটেকটিভ সেন, দাসবাবুর সহকর্মী।”
“নমস্কার সেনবাবু। আমি রাজদীপদার প্রতিবেশী। এঁদের সুখদুঃখের সঙ্গী। যখনই কোনও দরকার হয়…”
“চলুন আগে একবার রণদীপবাবুর সঙ্গে কথা বলা যাক,” দেবব্রতকে বাধা দিয়ে ভেতরের ঘরে গেল ইন্সপেক্টর।
“আপনার সঙ্গে একটু পরে কথা বলছি দেবব্রতবাবু,” বলে মিহিরকে অনুসরণ করল অভীক।
ঘরে ঢুকে অভীক দেখল ঘরের একপাশে একটা খাটের ওপর বসে আছেন রাজদীপ মল্লিক। পাশে ওঁর ভাই এবং খাটের পাশে একটা সোফায় বসে আছেন ওঁর স্ত্রী চারুলতা মল্লিক। খাটের ওপরের দেওয়ালে টাঙ্গানো ছেলের ছবির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
মিহির এবং অভীককে দেখে কান্নাজড়িত গলায় রাজদীপ বললেন, “আসুন দাসবাবু আসুন।”
মিহির কিছু বলার আগে অভীক বলে উঠল, “নমস্কার, আমি ডিটেকটিভ সেন। দাসবাবুর সহকর্মী। আপনাকে কিছু প্রশ্ন করার আছে,” রাজদীপ মল্লিককে একবার আপাদমস্তক দেখে নিল। পরনে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, গোঁফদাড়িতেও পাক ধরেছে। চোখে পুরু কাচের চশমা। চোখেমুখে ছেলে হারানোর ব্যথা স্পষ্ট।
“বলুন।”
“পয়লা বৈশাখ থেকে আপনার ছেলে আর মেয়ে নিরুদ্দেশ। সেইদিন ওরা কোথায় গিয়েছিল?”
“আমি সেইদিন বাড়িতে ছিলাম না। একটা জরুরি কাজে আমাকে বেরোতে হয়েছিল। বাড়িতে শুধু চারুলতা সোহিনী আর নির্মল ছিল।”
“আপনি কখন জানতে পারলেন?”
“সেইদিন সন্ধেবেলা দেবব্রত আমাকে ফোন করে জানায় যে সোহিনী আর নির্মলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
“চারুলতা দেবী জানতেন না?”
“না উনি জানতেন না। সেই জন্য তো সেদিন আটটা নাগাদ আমি আর বউদি থানায় গিয়ে মিসিং ডায়েরি করেছিলাম,” বললেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দেবব্রত।
কী একটা ভাবতে লাগল অভীক। তারপর রাজদীপ মল্লিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি পেশায় কী করেন রাজদীপবাবু?”
“শিয়ালদা এলাকায় আমার গয়নার দোকান আছে।”
“আর আপনিও কি একই পেশার সঙ্গে জড়িত রণদীপবাবু?”
“আজ্ঞে না। আমি এক বেসরকারি অফিসের কর্মচারী।”
“ও,” উঠে দাঁড়াল অভীক। ঘরটাকে ভালো করে দেখতে লাগল, “আপনার স্ত্রী এলেন না?”
“আমি বিয়ে করিনি। দাদাই আমার সব।”
রণদীপের দিকে তার দাদার আড় চোখে তাকানোটা নজর এড়াল না অভীকের।
“রাজদীপবাবু আপনার কারোর সঙ্গে কোনও শত্রুতা ছিল কি?”
“না।”
“রণদীপবাবু পয়লা বৈশাখের দিন আপনি কোথায় ছিলেন?” প্রশ্ন করল ইন্সপেক্টর।
“সেদিন আমার অফিসের এক সহকর্মীর বাড়িতে অনুষ্ঠান ছিল। আমি সেখানে গিয়েছিলাম।”
“গত পরশু আপনার ভাইপোর বডি পাওয়া যায় আর আপনি আজকে এলেন। কালকে এলেন না কেন?”
“আমি এই ঘটনার ব্যাপারে কিছু জানতাম না। কালকে রাতে আমাকে দেবব্রত ফোন করে জানায়।”
“ও…দয়া করে আপনি আপনার অফিসের ঠিকানাটা মিহিরবাবুকে দিয়ে দেবেন। আপনার দোকানের ঠিকানাটাও লাগবে রাজদীপবাবু,” একবার চারুলতা মল্লিকের দিকে তাকাল অভীক, “একবার নির্মল আর সোহিনীর ঘরটা দেখতে চাই।”
“আসুন।”
ঘরে ঢুকে চোখ বোলাতে লাগল অভীক। ঘরের একপাশে একটা বড় খাট পাতা আছে। তার ঠিক ওপরে দেওয়ালে একটা ছবি টাঙ্গানো। খাটের ঠিক পাশেই একটা পড়ার টেবিল, সঙ্গে দুটো চেয়ার। টেবিলের ওপর কিছু বই-খাতা রাখা আছে। অভীক একটা খাতা নিয়ে তাতে চোখ বোলাতে লাগল।
“কার লেখা?”
“সোহিনীর।”
“সোহিনীর গল্প লেখার শখ আছে?”
“একটু আধটু।”
“আচ্ছা সোহিনীর…”
অভীকের কথা শেষ হওয়ার আগে একটা চিৎকার শোনা গেল। পাশের ঘরে হঠাৎ চারুলতা দেবী ছেলে-মেয়ের শোকে কাঁদতে লাগলেন। দুই ভাই ওনাকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন। দেবব্রত ডাক্তারকে ফোন করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এই পরিস্থিতিতে আর জিজ্ঞাসাবাদ না করে অভীক মিহিরের সঙ্গে বেরিয়ে এল।
থানার সামনে এক চায়ের দোকানে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল মিহির, “এখনও বললি না?”
“হুম বলছি,” অন্যমনস্কভাবে বলল অভীক।
“তাহলে বল মধুমিতার সঙ্গে কোথায় দেখা হল তোর?” নড়েচড়ে বসল মিহির।
নামটা শুনে ঘোর কাটল অভীকের, “আমি ভাবছি অন্য কথা আর তুই…”
“বল আগে। বল বল,” অভীককে খোঁচা মারতে লাগল মিহির।
“আচ্ছা বলছি, কিন্তু বল হাসবি না,” বলে নিজেই মুচকি হাসল অভীক।
“একদম না।”
“দেড়-দু মাস আগে আমি একটা কেস পেয়েছিলাম। পাড়ার রতীনবাবুর স্ত্রীর গলার চেন চুরির কেস। অনেক তদন্ত করার পরে একজনকে আমার সন্দেহ হয়। কয়েকদিন ধরে আমি ওকে ওরই পাড়ায় ফলো করতে থাকি। একদিন রাতে লোকটাকে আমি ফলো করছিলাম, এমন সময় কয়েকজন এসে আমাকে ঘেরাও করে এবং মারতে থাকে। তখন একটা মেয়ে এসে আমাকে বাঁচায়। সেই মেয়েটাই মধুমিতা। তারপর থেকে ওর সঙ্গে আমার কথা শুরু হয় আর এখন তো…” ঠোঁটের কোণে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠল অভীকের।
সবটা শুনে ভুরু কুঁচকিয়ে বলল মিহির, “সবই বুঝলাম কিন্তু ওই লোকগুলো কারা আর তোকে মারছিল কেন?”
“ই-ইয়ে মানে আসলে কয়েকদিন ধরে ওই পাড়ায় ঘুরছিলাম বলে ওখানকার লোকেরা আমাকে চোর বলে সন্দেহ করে আর সেই জন্য…” মাথা চুলকে বলল অভীক।
হো হো করে হেসে উঠল মিহির। শেষে হাসি থামিয়ে বলল, “আচ্ছা চোর কি ওই লোকটাই ছিল?”
“হ্যাঁ,” বেশ গর্বের সঙ্গে জানাল অভীক।
“যাক তাহলে মার খেতে খেতে চোর ঠিকই ধরেছিলি,” আবার একটা অট্টহাসি দিল মিহির।
“বাজে কথা বাদ দে। তোর কাছে যত ইনফরমেশন আছে সব নিয়ে কালকে আমার বাড়িতে দেখা হচ্ছে। সব তথ্য দেখার পরই আমি কিছু বলতে পারব,” উঠে দাঁড়াল অভীক, “আরেকটা কথা, কালকের মধ্যে নির্মলের বন্ধু সুজয়ের ঠিকানা জোগাড় করে রাখিস। দরকার আছে।” বলে হনহনিয়ে চলে গেল।
পরদিন সকালে ইন্সপেক্টর মিহির দাস প্রয়োজনীয় সব তথ্য নিয়ে অভীকের বাড়িতে হাজির হল। অভীক খুব মনোযোগ দিয়ে সেই তথ্যগুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। মধুমিতার কথা জিজ্ঞেস করাতে অভীক মিহিরকে জানায় যে মধুমিতাকে কী একটা কাজের জন্য তার কলেজে যেতে হয়েছে। তাই সে আজ অনুপস্থিত।
“সুজয়ের ঠিকানা জোগাড় করা গেছে?” মিহিরের দিকে তাকাল অভীক।
“হ্যাঁ। কিন্তু বুঝতে পারছি না তুই কীভাবে জানলি যে, সুজয় নামে নির্মলের কোনও বন্ধু আছে?” অবাক হয়ে বলল মিহির।
“তুই জানিস নির্মলের ভুলে যাওয়ার প্রবণতা ছিল?”
“কই না তো।”
“এটা জানিস নির্মলের ঘরের দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবিতে নির্মলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি কে?”
“মহিলার ছবি?” ভুরু কুঁচকিয়ে বলল মিহির।
“আর এইভাবে তোরা ইনভেস্টিগেশন করছিলি?” ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসল অভীক, “নির্মলের পড়ার টেবিলে বইগুলোর পাশে কতকগুলো কাগজ পড়েছিল দেখেছিলি?”
“হ্যাঁ।”
“তার মধ্যে একটা কাগজে লেখা ছিল যে নির্মলকে মনে করে পনেরো তারিখে রবি স্যারের নোটস্-এর খাতাটা সুজয়কে ফেরত দিতে হবে। ভুলে যাওয়ার ভয়ে নির্মল সেটা লিখে রেখেছিল। হতে পারে সেদিন নির্মল সুজয়ের সঙ্গে দেখা করেছিল এবং হয়তো সুজয়কে জানিয়েছিল যে, সে কোথায় যাচ্ছে।”
“হুম হতে পারে। আর ওই মহিলাটি কে?”
“সেটা জানার জন্য এক্ষুনি আমাদের বেরোতে হবে। চল,” বলে অভীক মিহিরকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
৩
কলিং বেল বাজলে এসে দরজা খুললেন রণদীপ মল্লিক। ঘরে ঢুকে তারা দেখল সোফায় বসে চারুলতা মল্লিক ছেলের ছবিটা আঁকড়ে ধরে কেঁদে চলেছেন। ওঁর পাশে বসে রাজদীপ মল্লিক স্ত্রীকে খাবার খাওয়ানোর বৃথা চেষ্টা করছেন।
“আজকে কি চারুলতাদেবী আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন?” মৃদু গলায় বলল মিহির।
“দেখে কী মনে হচ্ছে আপনাদের? ওঁর কী অবস্থা দেখতে পাচ্ছেন না,” রাগতভাবে বলল বাড়ির মালিক।
দাদাকে সামলানোর জন্য এগিয়ে এলেন রণদীপ, “দাদা তুমি শান্ত হও। আমি কথা বলছি,” বলে মিহিরের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন, “আসলে বুঝতেই পারছেন বউদির এই অবস্থা। দাদার মাথাও কাজ করছে না। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।”
“ভালো, তাহলে আপনিই বলুন,” বলে ঘরের চারদিকে চোখ বোলাতে লাগল অভীক।
“বলুন কী জানতে চান?”
“বাড়িতে শুধু নির্মলের ছবি দেখতে পাচ্ছি। সোহিনীর একটাও ছবি নেই কেন?”
“সোহিনী একদম ছবি তুলতে চাইত না। সেই জন্য ওর একটাও ছবি নেই।”
“কিন্তু চারুলতাদেবী সেদিন মেয়ের একটা ছবি থানায় দিয়েছিলেন।”
“ও…এই ব্যাপারে আমার জানা ছিল না।”
“বটে। আচ্ছা আপনি তো বেসরকারি অফিসের এক কর্মচারী?”
“আজ্ঞে।”
“হুম যদিও এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। আমি আপনার দাদার সঙ্গে গয়নার কারবার করতে পারতেন তো। ওতে তো বেশি লাভ।”
এক রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল রণদীপের মুখে, “আজ্ঞে অফিসে কাজ করা আমার চিরকালের ইচ্ছা ছিল।”
“বুঝলাম। শেষ প্রশ্ন, নির্মলের ঘরে টাঙ্গানো ছবিতে মহিলাটি কে?”
মুহূর্তের মধ্যে রণদীপের মুখের হাসিটা উধাও হয়ে গেল। ওঁর মুখে নেমে এল এক শোকের ছায়া। কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু বলতে পারলেন না। ইতিমধ্যে রাজদীপ মল্লিক উঠে দাঁড়ালেন।
“উনি আমার প্রথম পক্ষের স্ত্রী ছিলেন। দু বছর হল মারা গেছেন,” কাছে এসে কান্নাজড়িত গলায় বললেন বাড়ির মালিক।
“ও…সরি,” হাতঘড়িটা একবার দেখে নিল অভীক, “ঠিক আছে, দরকার হলে আবার আসব,” বলে মিহিরের সঙ্গে বেরিয়ে গেল।
দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক যে খুব একটা ভালো নয় সেটা বেশ আন্দাজ করতে পেরেছে অভীক। লিফট থেকে নেমে বাইকে ওঠার সময় তাদের দেখা হয় প্রতিবেশী দেবব্রতর সঙ্গে। দু হাতে ব্যাগ ভর্তি বাজার করে নধর চেহারাখানা নিয়ে হাজির হলেন বাইকের সামনে।
“ভালো হল দেবব্রতবাবু আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল,” এক গাল হেসে বলল অভীক। মিহিরও ম্লান একখানা হাসি হাসল যা থেকে দেবব্রত বুঝতে পারলেন যে তিনি মিহিরের পছন্দের পাত্র নন।
“হ্যাঁ বলুন স্যার। আমি কোন কাজে আসতে পারি?”
“আপনি মল্লিক পরিবারকে কতদিন ধরে চেনেন?”
“আমি এখানে ফ্ল্যাট নিয়েছি বছরখানেক আগে। তখন থেকেই চিনি।”
“কী জানেন এদের ব্যাপারে?”
“ওই যে চারুলতা বউদি রাজদীপদার দ্বিতীয় পক্ষ। রাজদীপদার ওই একটাই ছেলে ছিল নির্মল…”
“তার মানে সোহিনী রাজদীপবাবুর মেয়ে নয়,” বাধা দিয়ে বলল মিহির।
“না স্যার। চারুলতা বউদি দাদার বাড়িতে কাজ করত। মাঝে মাঝে মেয়েকেও নিয়ে আসত। একা মানুষ ছিল রাজদীপদা। পরে এদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয় আর তার জেরেই এরা বিয়ে করে। বউদি আর নির্মলের মধ্যে মা-ছেলের সম্পর্ক তৈরি হলেও সোহিনী রাজদীপদাকে দেখতে পারত না। সেই কারণে হয়তো রাজদীপদাও সোহিনীকে পছন্দ করত না।”
“ও…আর প্রথম পক্ষের ব্যাপারে কিছু জানেন?”
“আজ্ঞে না স্যার।”
খানিকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবল অভীক। শেষে দেবব্রতকে ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা দিল সুজয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
৪
পরের দিন সকাল থেকেই বেশ মাথা ধরেছে অভীকের। গতকাল সুজয়ের সঙ্গে কথা বলে কোনও তথ্য সে জোগাড় করতে পারেনি। সারা রাত ধরে তথ্যপ্রমাণ ঘাঁটাঘাঁটি করেও নির্মল এবং সোহিনীর ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানতে পারেনি। এমন সময় মধুমিতা চা নিয়ে এল এবং তদন্তের ব্যাপারে জানতে চাইল। কিন্তু অভীক তার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে চায়ের কাপটা তুলে নিল এবং অন্যমনস্কভাবে চায়ে চুমুক দিল। হঠাৎ অভীকের ফোন বেজে উঠল এবং তাতে মিহিরের নাম ভেসে উঠল। মিহিরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অভীক বেরিয়ে গেল। বাড়ির সামনে মিহির বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছে।
“কিছু জানা গেল,” অভীক কাছে আসতে জিজ্ঞেস করল মিহির।
“না রে,” এক বিষাদময় সুরে বলল অভীক, “আর তুই?”
নেতিবাচক ইঙ্গিত দিল মিহির। খানিকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে আপনমনে ভাবতে লাগল অভীক। শেষে বাইকে উঠে স্টার্ট দিতে বলল মিহিরকে।
“কোথায়?”
“চল না বলছি।”
মিনিট চল্লিশ পরে তারা একটা অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের বাইক থেকে হাত সাতেক দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন রণদীপ মল্লিক। তাদের দেখে এগিয়ে এলেন তিনি।
“ফোন করে নীচে ডাকাতে বিরক্ত হননি তো রণদীপবাবু?” বাইক থেকে নেমে বলল অভীক।
“অফিসে একটা জরুরি কাজ করছিলাম বটে, তবে আমার ভাইপোর খুনিকে ধরাটা বেশি জরুরি,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “বলুন কী সাহায্য করতে পারি?”
“রাজদীপবাবুর প্রথম স্ত্রীর ব্যাপারে একটু জানতে চাই।”
হঠাৎ রণদীপের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মৃদু গলায় বললেন, “কী জানতে চান?”
“সবটা।”
বলতে শুরু করলেন রণদীপ, “দাদার সঙ্গে প্রথম বউদির বিয়ে হয় তেরো বছর আগে। ভালো মানুষ ছিলেন বউদি। সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, মিশুকে। উনি কারোর সঙ্গে কখনও খারাপ আচরণ করেন নি। বিয়ের এক বছর পর নির্মলের জন্ম হয়। বেশ হেসেখেলে চলছিল আমাদের পরিবার। কিন্তু হঠাৎ একদিন দাদার কাজ চলে যায়…”
“কেন?” বাধা দিয়ে প্রশ্ন করল মিহির।
“দাদার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আসে। দাদা নাকি অফিস থেকে কয়েক হাজার টাকা চুরি করেছিল,” একটু থামল রণদীপ।
“সত্যিই কি চুরি করেছিলেন?”
“হ্যাঁ। আমরা পরে জানতে পারি যে দাদার জুয়ার নেশা ছিল। অনেকের থেকে টাকা ধার করেছিল কিন্তু তারপর ফেরত দিতে পারত না। তাই কেউ আর দাদাকে ধার দিত না। আমার থেকেও মাঝে-মধ্যে টাকা নিত। কিন্তু আমি কোনোদিনই সেই টাকা ফেরত চাই নি। শেষে দাদা অফিস থেকে টাকা চুরি করে। এই ঘটনার পর থেকে রোজ বউদির সঙ্গে দাদার ঝগড়া হত। নির্মলের তখন ছয় বছর বয়স। হঠাৎ একদিন দাদা তার কোন বন্ধুর থেকে এক গুচ্ছ টাকা নিয়ে আসে আর গয়নার দোকান খোলে। প্রথম বছরটা মন্দা গেলেও তারপর থেকে আমাদের ব্যবসার উন্নতি হয়। আমরা দুই ভাই মিলে ব্যবসাটা ভালোই করছিলাম কিন্তু একদিন…”
“এক মিনিট রণদীপবাবু,” বাধা দিয়ে বলল অভীক, “আপনারা দুই ভাই মিলে মানে আপনি আপনার দাদার সঙ্গে এই ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন?”
কোনও কথা বললেন না রণদীপ। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
“সত্যিটা বলুন রণদীপবাবু। নাহলে কিন্তু আপনারই বিপদ,” ধমকের সুরে বলল মিহির।
“হ্যাঁ আমি যুক্ত ছিলাম।”
“ছাড়লেন কেন?”
“দাদা আমাকে বাড়ি আর ব্যবসা থেকে বের করে দেয়।”
“কেন?”
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন রণদীপ। শেষে অত্যন্ত মৃদু গলায় বললেন, “আমার আর বউদির মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দাদা পরে সেটা জানতে পারে এবং আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। পরে একদিন জানতে পারি বউদির ক্যান্সার ধরা পড়েছে আর এই দু বছর আগে বউদি মারা গেলেন,” ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
“নতুন বউদির ব্যাপারে কিছু জানেন?” প্রশ্ন করল মিহির।
“দাদার বাড়িতে কাজ করতে আসত। বিধবা মহিলা, একটাই মেয়ে সোহিনী। গত বছরে দাদা একে বিয়ে করে। এর থেকে বেশি আর আমি কিছু জানি না।”
“হুম…ধন্যবাদ রণদীপবাবু। দরকার হলে আবার বিরক্ত করব,” বলে মিহিরকে নিয়ে বেরিয়ে গেল অভীক।
পরের গন্তব্যস্থলে গিয়ে সেই একই অতীত রাজদীপ মল্লিকের মুখে শোনার কথা শুনে বেশ চটে গেল মিহির। গুম হয়ে বাইক চালাতে লাগল। তার মনে হতে লাগল অভীককে এই তদন্তে নেওয়াটাই তার সব থেকে বড় ভুল। সাইড মিররে একবার অভীকের মুখটা দেখে নিল। সে তখন মধুমিতার সঙ্গে ফোনে ব্যস্ত। আর থাকতে পারল না মিহির।
“এটা কী হচ্ছে অভীক?”
“ফোনে কথা বলছি।”
“এটা না। আমরা সোহিনী আর নির্মলের খুনিকে না খুঁজে তাদের বাবা-কাকাদের অতীত শুনে যাচ্ছি।”
মুচকি হাসল অভীক, “তোর পুলিশ ডিপার্টমেন্ট তো সোহিনীকে খুঁজছেই। আমরা ততক্ষণ একটু ফ্যামিলি ষ্টোরিই শুনি না,” বলে আবার ফোনে কথা বলতে লাগল।
অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বাইক এসে দাঁড়াতেই অভীক দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল লিফটের দিকে। বাইক বন্ধ করে মিহিরও তাকে সঙ্গ দিল। বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে রাজদীপ তাদের স্বাগত জানালেন। আজ ওনাকে অন্যদিনের তুলনায় বেশি চিন্তিত দেখাল।
“রাজদীপবাবু আজ আপনাকে বেশি চিন্তিত লাগছে।”
“এখনও সোহিনীর কোনও খোঁজ নেই। চারুও ঠিক করে কিছু খাচ্ছে না। মাঝে মাঝে ছেলে-মেয়ের জন্য চিৎকার করে উঠছে,” চোখের জল মুছলেন রাজদীপ।
আশেপাশে চারুলতা মল্লিককে দেখতে পেল না অভীক, “আপনার স্ত্রীকে দেখতে পাচ্ছি না?”
“ভেতরের ঘরে আছে। এই সবে ঘুম ধরেছে।”
“ও…আচ্ছা আপনি চারুলতাদেবীর ব্যাপারে কিছু জানেন? মানে আপনার সঙ্গে বিয়ের হওয়ার আগের কোনও ঘটনা। আপনি যতটুকু জানেন সেটা যদি জানান…”
“আমি ওর ব্যাপারে প্রায় সবটাই জানি। ও আমার থেকে কিছু লুকোয়নি,” বলতে শুরু করলেন রাজদীপ, “ওর বিয়ে হয়েছিল ওরই গ্রামের একজনের সঙ্গে। সে ছিল চারুর বাবার বন্ধুর ছেলে। তারই মেয়ে এই সোহিনী। কিন্তু একদিন তার স্বামী কালাজ্বরে মারা যায়। সোহিনী তখন কলেজে পড়ে। কোনও কাজকর্ম না থাকায় সোহিনীকে নিয়ে চারু কলকাতায় চলে আসে আর এখানে লোকের বাড়িতে কাজ করতে থাকে। শেষে আমার বাড়িতে কাজে আসে। আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয় এবং শেষে আমরা বিয়ে করি।”
“বুঝলাম, ওঁর বাড়ি কোথায়?”
“দাঁতন, মেদিনীপুর।”
কিছুক্ষণ এক মনে কী একটা ভাবল অভীক। তারপর বলল, “রাজদীপবাবু এবার আপনার ব্যাপারে একটু জানতে চাই।”
“বলুন।”
“আপনার জুয়ার নেশা ছিল, আর তার জেরেই আপনি সর্বস্ব হারিয়েছিলেন। এটা কি সত্যি?”
হঠাৎ রাজদীপের মুখের নম্রভাবটা উধাও হয়ে গেল। প্রচণ্ড রাগী গলায় বললেন, “কে বলেছে আপনাদের এই সব, ওই রণদীপ তো। আমি জানি তো, আমার এত বড় ক্ষতি করেও ওর শান্তি হয়নি। এখনও আমার বদনাম করে যাচ্ছে,” রাগে গজগজ করতে লাগলেন।
“রাজদীপবাবু শান্ত হন। আমি শুধু একটাই কথা জিজ্ঞেস করব। এই দোকানটার জন্য আপনি আপনার এক বন্ধুর থেকে টাকা নিয়েছিলেন। পরে টাকা ফেরত দিয়েছিলেন?”
অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন রাজদীপ। শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “না।”
“রাজদীপবাবু পুরো ঘটনাটা খুলে বলুন। আমাদের ধারণা এই ঘটনার সঙ্গে আপনার ছেলের খুনের কোনও এক সম্পর্ক আছে।”
সোফায় বসে পড়লেন রাজদীপ। মৃদু গলায় বলতে শুরু করলেন, “আমি টাকা নিয়েছিলাম আমার কলেজের এক বন্ধুর কাছ থেকে। বন্ধু বললে ভুল হবে। বিনয় ছিল আমার ভাইয়ের মতো। কলেজে সবরকম বিপদে আমার পাশে থাকত সে। তার আসল বাড়ি মালদায়। হাইয়ার স্টাডির জন্য কলকাতায় এসেছিল। কলেজ শেষ হতে সে নিজের বাড়ি ফিরে যায়। তারপর থেকে ওর সঙ্গে আমার আর কোনও যোগাযোগ হয়নি। কলেজ শেষের প্রায় এক বছর পর আমি একটা অফিসে চাকরি পায়। আমি ইচ্ছে করেই বেশি বয়সে বিয়ে করি। আমি আরও টাকা ইনকাম করতে চেয়েছিলাম এবং হয়তো তখন থেকেই আমার জুয়ার নেশাটা শুরু হয়। দিন প্রতিদিন আমার সেই নেশা বাড়তে থাকে এবং আমি সবার থেকে টাকা ধার করতে শুরু করি। সেই নেশার জেরে আস্তে আস্তে আমি সব হারাতে থাকি। আমাকে সবাই টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিল। বাধ্য হয়ে আমি অফিস থেকে টাকা চুরি করলাম কিন্তু ধরা পড়ে গেলাম। এত অপমানিত আমি কখনও হইনি…” ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
“তারপর কী হল?”
“তারপর ঠিক করলাম যে এই নেশা থেকে বেরিয়ে একটা নতুন জীবন শুরু করব। একটা ব্যবসা করার পরিকল্পনা করলাম। কিন্তু কেউ সাহায্য করল না। শেষে অনেক কষ্টে বিনয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। সে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল এবং আমাকে মালদায় যেতে বলল। আমিও তাকে এক বছরের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেই টাকা নিয়ে কলকাতায় গয়নার দোকান খুললাম। এর ছয় মাস পরে হঠাৎ একদিন বিনয় আমাকে ফোন করে টাকা ফেরত দিতে বলল। তার মেয়ে একটা পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়। তার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। কিন্তু তখন ব্যবসায় মন্দা চলায় আমার কাছেও টাকা ছিল না। তাই আমি সাহায্য করতে পারিনি। পরে জানতে পারলাম তার মেয়ে মারা গেছে। আমি তাকে ফোনও করি কিন্তু সে আর আমার সঙ্গে কথা বলেনি। আমিও আর তার সঙ্গে দেখা করার বা কথা বলার সাহস পাইনি,” চোখের জল মুছলেন রাজদীপ।
“এই কথাগুলো আপনার আগে বলা উচিত ছিল রাজদীপবাবু। আপনার বন্ধুর ঠিকানাটা জানালে ভালো হয়।”
“হ্যাঁ দিচ্ছি।”
ঠিকানাটা নিয়ে মিহির এবং অভীক বেরিয়ে গেল। দরজার বাইরে বেরোতেই দেখা হল দেবব্রতর সঙ্গে।
“আপনারা কখন এলেন?” গাল ভর্তি হাসি হেসে বলল দেবব্রত।
“আপনি জানেন না আমরা কখন এসেছি! একটা উপদেশ দেব দেবব্রতবাবু?”
“আজ্ঞে।”
“আড়ি পেতে লোকের কথা শোনার অভ্যাসটা ছাড়ুন।” বলে চলে গেল অভীক।
৫
দুপুরের মধ্যে মিহিরকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বাড়িতে এল অভীক। মিহিরের যে ট্রিট-টা পাওনা ছিল সেটা সেদিন দিয়ে দিতে চায় অভীক। মধুমিতাও ইতিমধ্যে খাবার-দাবার টেবিলে এনে রাখল। বেশ তৃপ্তি সহকারে খেতে লাগল মিহির।
“আচ্ছা একটা কথা বলব, কিছু মনে করবি না তো?” একটু দ্বিধাবোধ করল মিহির।
“না না বল না।”
“তোরা কি লিভ-ইনে আছিস?”
“আরে না না। মধুমিতার যখন কোনও কাজ থাকে না তখন এখানে চলে আসে। রাতে আমি ওকে ওর বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসি। ও থাকলে আমার বাড়িটাও একটু পরিষ্কার থাকে আর ও আমাকে কেস সল্ভ করতেও বেশ সাহায্য করে…”
“এই কেসটা কতদূর এগোল! আর কিছু জানা গেল?” অভীককে বাধা দিয়ে বলল মধুমিতা।
“একটা সূত্র পাওয়া গেছে। আমার মতে এই পুরো ঘটনার সূত্রপাত সেখানেই, মালদার কালিয়াচক।”
“মালদা?” ভুরু কুঁচকিয়ে জিজ্ঞেস করল মধুমিতা।
“হ্যাঁ, মিহির আমি ভাবছি মালদায় গিয়ে একবার ব্যাপারটার খোঁজ নিই। তুই এদিকটা কয়েকদিন সামলে নিস। আর ওই দেবব্রতর ওপর একটু নজর রাখিস তো। আমার মনে হয় লোকটা কিছু জানে। চেপে ধরলে মুখ খুলবেই।”
মালদার কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল মধুমিতার। সে চিন্তিত হয়ে বলল, “মালদায় তুমি একা যাবে নাকি? কত বিপদ হতে পারে বলো তো! আমিও যাব তোমার সঙ্গে।”
“বাজে কথা বোলো না! আমি তোমাকে কিছুতেই বিপদে ফেলতে পারিনা। আর আমি একজন গোয়েন্দা। কিছু কিছু কাজ আমাকে একাই করতে হবে।”
অভীকের অনেক বোঝানোর পর অবশেষে রাজী হল মধুমিতা। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “তাহলে আজ একটা ইভিনিং শো দেখতে যাব আর আমি কোনও বাহানা শুনতে চাইনা না।”
রাত সাড়ে নটা নাগাদ শো দেখে মধুমিতার বাড়ির সামনের রাস্তার কাছে পৌঁছল তারা। অভীক অনবরত মধুমিতাকে প্রশ্ন করে চলেছে। কবে মধুমিতা তার বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করাবে, কবে সে এই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে অভীকের বাড়িতে এসে উঠবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
হঠাৎ অভীকের মনে হল কেউ যেন তাদের পিছু নিয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুখ ঢাকা এক লম্বা ব্যক্তি একটা চুরি দিয়ে অভীককে মারার চেষ্টা করল। অভীক কোনোরকমে সরে গেলেও সেই ছুরির আঘাতে আহত হয় মধুমিতা। ছুরিটা তার ডানহাতে আঘাত করায় হাত থেকে রক্ত বেরোতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে সেই ব্যক্তি অভীকের মুখে একটা ঘুষি মারে এবং রাতের অন্ধকারে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়।
“আমি জানি…আমি জানি এটা কার কাজ,” রাগে গজগজ করতে থাকে অভীক। মধুমিতাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তার হাতে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। গজগজ করতে করতে পকেট থেকে ফোন বের করল।
“হ্যালো মিহির। দেবব্রত আমাকে মারার জন্য লোক পাঠিয়েছিল। তুই এক্ষুনি ওর বাড়িতে যা, আমিও আসছি। আর আমি তোকে মধুমিতার বাড়ির ঠিকানা পাঠাচ্ছি। এখানে এক্ষুনি একটা পুলিশ পাঠা। আমি মধুমিতাকে কিছুতেই একা ছাড়তে পারব না।” ফোন কেটে দিল।
মিহিরের পাঠানো পুলিশের জিম্মায় মধুমিতাকে রেখে দেবব্রতর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল অভীক। দেবব্রতর ফ্ল্যাটের সামনে ভিড় দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল সে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে তার চোখে পড়ল খাটের ওপর পড়ে থাকা দেবব্রতর মৃতদেহের ওপর।
“বিষ দিয়েছে। আশেপাশের সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু কেউ কিছু জানে না” অভীকের পাশে এসে বলল মিহির।
ঘরের চারদিকে ঘুরে দেখতে লাগল অভীক। কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়ল না। মৃতদেহের সামনে গিয়ে অভীক খুব খুঁটিয়ে দেখতে লাগল, “তখন মল্লিক পরিবার কোথায় ছিল?”
“রাজদীপ সকালে তার দোকানে গিয়েছে। এখনও ফেরেনি। আর রণদীপ দাদার কথায় সন্ধেবেলা বউদিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল,” মৃতদেহ পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়ে মিহির চিন্তিতভাবে বলল, “কে করতে পারে বল তো?”
“কাউকে ছাড়া যাবে না। নির্মলের পরিবারের সবার ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা কর। কয়েকজনকে মেদিনীপুরে পাঠা। তুই এখানে সামলা আর আমাকে মালদায় পাঠানোর ব্যবস্থা কর,” রাগে ফুঁসতে লাগল অভীক।
৬
মিহিরের তত্ত্বাবধানে মধুমিতাকে রেখে মালদার জন্য রওনা দিল অভীক। সেখানে পৌঁছে বিনয়ের বাড়ি খুঁজতে খুব বেশি পরিশ্রম করতে হল না তাকে। সেখানকার লোকজনকে ঠিকানা বলতে তারাই বিনয়ের বাড়িটা দেখিয়ে দিল। তাদের থেকে বিনয়ের সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্যও জোগাড় করে নিল সে।
তাদের দেখানো পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে শেষে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল সে। পুরনো ভাঙ্গা একতলা বাড়ি। দেওয়ালের কিছু কিছু অংশে ফাটল ধরেছে এবং সেখানে জন্ম নিতে শুরু করেছে আগাছা। বাড়িটার আশেপাশে জনবসতি প্রায় নেই এবং সেই ফাঁকা অঞ্চল ক্রমাগত বিভিন্ন অজানা গাছপালায় ভরে উঠছে।
দরজায় কয়েকবার ধাক্কা দিতেই একটা দড়াম শব্দ করে দরজা খুলে গেল। বাড়ির ভেতরটা বাইরের তুলনায় বেশ ভালো অবস্থাতেই আছে। অভীকের মনে হল যেন কয়েকদিনের মধ্যে কেউ এই বাড়িতে এসেছিল। ঘরের বিভিন্ন জায়গা পরিষ্কার করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে। বাড়িটা ভালো করে দেখতে লাগল। প্রতিটা কোণায় তন্নতন্ন করে প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কোনও কিছুই খুঁজে পেল না। এমন সময় তার চোখ পড়ল ঘরের একটা টেবিলের ভাঙ্গা পায়ার দিকে। তার ঠিক পাশে পড়ে আছে একটা ছোট খাতা। খাতাটা বের করে দেখতে লাগল সে। মুহূর্তের মধ্যে তার চোখদুটো বড় হয়ে গেল। এমনটার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ সে তার মাথায় ভারী কোনও বস্তুর আঘাত অনুভব করল এবং মুহূর্তের মধ্যে তার চোখে নেমে এল এক ঘন অন্ধকার।
পরপর তিনদিন অভীকের কোনও খোঁজ মিলল না। মিহিরের চিন্তা বাড়তে লাগল। অনবরত অভীককে ফোন করেও তাকে ফোনে পাওয়া গেল না। কালিয়াচক থানায় যোগাযোগ করেও কোনও লাভ হয়নি। এদিকে মধুমিতা কান্নায় ভেঙে পড়েছে। তাকে সামলানো মিহিরের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠতে লাগল। এমন সময় একদিন সন্ধেবেলা মিহিরের ফোন বেজে উঠল। মিহির তখন বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ থেকে সূত্র খুঁজতে ব্যস্ত। মধুমিতা তার পাশে একটা চেয়ারে বসে অভীকের চিন্তায় মগ্ন। ফোনটা ধরল এবং কথা বলার সঙ্গে মিহিরের চিন্তা আরও বাড়তে লাগল। সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।
“মধুমিতা চলো। বেরোতে হবে।”
“অভীকের ব্যাপারে কিছু জানা গেছে?” মুখে হাসি ফুটে উঠল মধুমিতার।
“না। রণদীপকে একজন মারার চেষ্টা করেছে। পুলিশ রণদীপকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আমাদের রাজদীপকে জানাতে হবে। চলো,” বলে মধুমিতার সঙ্গে বেরিয়ে গেল মিহির।
গন্তব্যস্থলে পৌঁছে রণদীপের ব্যাপারে তার দাদাকে সবটা জানাল মিহির। এক গভীর চিন্তা নেমে এল রাজদীপের মুখে। স্ত্রীর দিকে একবার তাকালেন। মহিলা তখনও নিজের ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হল অভীক। তাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল মধুমিতা, সঙ্গে বেশ অবাকও।
অভীককে জড়িয়ে ধরে বলল, “কোথায় ছিলে তুমি! কী হয়েছিল তোমার! মাথায় ব্যান্ডেজ কেন?”
“সব বলব,” মুচকি হাসল অভীক, “তার আগে সবাইকে একজনের সঙ্গে দেখা করাতে চাই। ওকে নিয়ে এসো,” বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল।
দুজন মহিলা পুলিশ একটা মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। মেয়েটাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন রাজদীপ।
“সোহিনী! একে তুই কোথায় পেলি?” বিস্মিতভাবে বলল মিহির।
“মালদায়,” বলে অভীক এগিয়ে গেল সোফায় বসে থাকা মহিলার দিকে, “আর অভিনয় করতে হবে না চারুলতাদেবী। উঠে পড়ুন।”
“কী বলছেন সেনবাবু। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না,” অবাক হয়ে গেলেন রাজদীপ।
“আপনি আর আপনার ছেলে নির্মল বড় একটা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন যার জাল বোনা হয়েছিল আপনার বন্ধু বিনয়ের মৃত্যুর পর থেকে।”
“এসব কী বলছেন! বিনয় মারা গেছে?”
“হ্যাঁ, যেদিন বিনয়ের মেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় তার এক মাস পরেই বিনয় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। সম্ভবত নিজের মেয়ের চিকিৎসার জন্য টাকার জোগাড় করতে না পেরে।”
মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকলেন রাজদীপ। অভীক আবার বলতে শুরু করল, “আপনি যেদিন বিনয়ের বাড়ি গিয়েছিলেন সেদিন ওঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল?”
“না। তখন ওর স্ত্রী তিন মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়িতে গিয়েছিল।”
“সেই জন্যই আপনি চিনতে পারেন নি। চারুলতাদেবীই হলেন বিনয়ের স্ত্রী, আর সোহিনী তাদের মেয়ে।”
“কী বলছেন আপনি?” বিস্মিত চোখে অভীকের দিকে তাকিয়ে থাকলেন রাজদীপ।
“ঠিকই বলছি। বিনয়ের আত্মহত্যার পরে চারুলতাদেবী আপনাকে এবং আপনার ছেলেকে মারার পরিকল্পনা করেন এবং একই সঙ্গে আপনার সম্পত্তি হাতাতে চেয়েছিলেন। সেই কারণেই তিনি কলকাতায় এসে আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান। ওঁর মেদিনীপুরে কোনও বাড়িই নেই। আপনাকে একটা মনগড়া গল্প শুনিয়েছিলেন। আর এঁদের সাহায্য করেছিলেন দেবব্রতবাবু।”
“দেবব্রত?”
“হ্যাঁ, দেবব্রত আর কেউ নয়, চারুলতাদেবীর পুরনো প্রেমিক। আপনার ব্যাপারে সব তথ্য জোগাড় করে চারুলতাদেবীকে উনিই কলকাতায় নিয়ে আসেন। নিজেও পাশের ফ্ল্যাটটা কেনেন, আপনার এবং নির্মলের ওপর নজর রাখার জন্য।”
“কিন্তু দেবব্রতকে কে খুন করল?”
“আপনার স্ত্রী। আমরা যে দেবব্রতকে সন্দেহ করেছিলাম সেটা উনি জানতে পেরেছিলেন। যেদিন আপনি আপনার দোকানে গিয়েছিলেন সেদিন দুপুরে চারুলতাদেবী দেবব্রতবাবুর ফ্ল্যাটে যান এবং কথার ছলে ওঁর খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেন। আর এই কাজে সাহায্য করেন আপনার ভাই।”
“রণদীপ?” নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না রাজদীপ।
“শুধু তাই নয়। পয়লা বৈশাখে সোহিনীর সঙ্গে মিলে নির্মলকে একটা গোপন জায়গায় নিয়ে যান তিনি এবং তাকে বেঁধে রাখেন। কয়েকদিন পর একদিন মাঝরাতে নির্মলের বডি এখানে ফেলে যান দেবব্রতবাবুর সহায়তায়।”
সোফায় বসে পড়লেন রাজদীপ, “কিন্তু কেন সে নির্মলকে মারল?” কাঁদতে লাগলেন।
“সম্পত্তির লোভে। কোনোভাবে তিনি চারুলতাদেবীর পরিকল্পনার কথা জানতে পারেন এবং তখন থেকেই উনি এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হন,” একটু থামল অভীক।
“এখন কোথায় সে?” রাগে গর্জে উঠলেন রাজদীপ।
“পুলিশ হেফাজতে আছে।”
“আচ্ছা, বিনয়ের যদি তিনটে মেয়ের মধ্যে একজন মারা যায় আর একজন সোহিনী তাহলে আরেকটা মেয়ে কোথায় আছে?” প্রশ্ন করল মিহির।
মুচকি হাসল অভীক, “সেটা বলবে মধুমিতা…ওরফে রোহিণী,” মধুমিতার সামনে এসে দাঁড়াল।
“কী আজেবাজে বকছিস তুই?” অভীকের কথা বিশ্বাস হল না মিহিরের।
“তুমিই তোমার মাকে বলেছিলে যে আমরা দেবব্রতবাবুকে সন্দেহ করছি। তোমার মনে ভয় ছিল যে দেবব্রতবাবু সব সত্যি বলে দেবেন তাই তোমরা তাকে মেরে ফেললে। আমার মালদা যাওয়ার কথা শুনে তুমি তোমার বোনকে সেখান থেকে সরে যেতে বলো কিন্তু ও সেটা শুনল না। পরিবর্তে দুজনে আমাকে মারার চেষ্টা করলে। তুমি ভাবলে কীভাবে যে আমি বিনা প্রোটেকশনে সেখানে চলে যাব। এবার সত্যিটা বলো রোহিণী।”
রাগে কাঁপতে লাগল রোহিণী। রক্তবর্ণিত চোখে তাকাল অভীকের দিকে, “কী সত্যি শুনতে চাও তুমি। আমার বাবা এই লোকটাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করল আর শুধু এই লোকটার জন্য টাকার অভাবে আমার বোন মারা গেল। শুধু এই লোকটার জন্য আমার বাবা আত্মহত্যা করল। আমাদের সংসার তছনছ হয়ে গেল। তাই আমরা এটা করেছি। আমরা যদি দোষী হই তাহলে এই লোকটাও সমান দোষী।”
রোহিণীর দিকে তাকিয়ে একটা ম্লান হাসি হাসল অভীক। তার চোখটা ছলছল করে উঠল। মৃদু গলায় বলল, “আমার সঙ্গে দেখা হওয়াটাও সেই পরিকল্পনার মধ্যেই ছিল, তাই না?”
“হ্যাঁ। মা আর বোনের এখানে ব্যবস্থা করে আমি একটা ভাড়া বাড়িতে উঠি। সেখানে গিয়ে জানতে পারি তোমার কথা। আশেপাশে কিছু এলাকায় শুনলাম গোয়েন্দা হিসেবে তোমার বেশ নাম হয়েছে। তখন আমার মাথায় এই বুদ্ধিটা আসে। কোনোভাবে যদি গোয়েন্দার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা যায় তাতে আমাদেরই লাভ। গোয়েন্দার পরিচিতদেরকে কেউ সন্দেহ করবে না। তাই আমি তোমাকে ফলো করতে থাকি আর একদিন সুযোগ বুঝে তোমার সঙ্গে আলাপ করি।”
“মিহির এদেরকে নিয়ে যেতে বল।”
সোফার এককোণে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লেন রাজদীপ। অভীক তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। বাইরে বেরিয়ে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসল অভীক এবং মিহির।
“মধুমিতা…আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না। ওকে ধরার জন্যই তুই তখন আমাকে ফোন করে রণদীপের মিথ্যে খুনের চেষ্টার গল্পটা বলিস আর মধুমিতাকে এখানে আনতে বলিস, তাই না?”
ম্লান হেসে চায়ের কাপটা তুলে নিল অভীক।
“কীভাবে বুঝলি যে মধুমিতা এর সঙ্গে জড়িত?”
“বিনয়ের বাড়ি থেকে আমি একটা খাতা পেয়েছিলাম। সেই খাতায় যে হাতের লেখাটা ছিল তার সঙ্গে মধুমিতার হাতের লেখা হুবহু মিলে যায়। যেদিন ওর হাতে চোট লেগেছিল সেদিন ওর বাড়িতে আমি ওর কিছু লেখা দেখেছিলাম। সেটা থেকেই…” চায়ে চুমুক দিল অভীক।
অভীকের কাঁধে হাত রাখল মিহির, “তুই না থাকলে হয়তো কেসটা সল্ভ করতে পারতাম না। থ্যাঙ্ক ইউ।”
“আর কোনও কেস পেলে আমাকে জানাস কিন্তু।”
“অবশ্যই।”
“এখন উঠি বুঝলি। একটু একা থাকতে চাই। একটু মানসিক শান্তির দরকার। চল বাই,” বলে বড় রাস্তা পার হয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল অভীক।