সর্বনাশের গ্রাসে | ভয়ের দেশ | শঙ্খসাথি| Bengali Horror Story
0 (0)

Getting your Trinity Audio player ready...

তাঁবুর সামনের লাগোয়া উঠোনে চেয়ার পেতে দিয়েছিল বুধন। ওখানে বসেই সাতদিনের পুরনো খবরের কাগজ পড়ছিলাম এক্কেবারে টাটকা মেজাজে। আসলে চমকগড়ে এসে ইস্তক এভাবেই অভ্যস্ত করে ফেলতে হয়েছে নিজেকে। অদ্ভুত জায়গা এই চমকগড়। কাটোয়া স্টেশনে নেমে যেতে হয় দুইপাতি। দুইপাতি একটা ছোট্ট গ্রাম — বাসে যেতে হয়, কিন্তু আগে থেকে বাস কন্ডাক্টরকে বলে না রাখলে বাস দাঁড়ায় না নিয়ম করে। এবার দুইপাতিতে নামার পর চমকগড় পৌঁছতে আরও চার কিলোমিটার মত। আর এই চার কিলোমিটার এক্কেবারে ফাঁকা। চমকগড় জায়গাটা যেন আমাদের পৃথিবীর অংশই নয়, গ্রহান্তরের কল্পলোক। আমাদের গাড়ি করে পৌঁছে দিতে এসেছিল। সপ্তাহে একদিন গাড়ি আসে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে।

এই চমকগড় আগে বর্ধিষ্ণু জনপদ ছিল বলেই জানা গেছে জিওলজিক্যাল সার্ভের রিপোর্টে। কিন্তু এখন এখানে ভগ্নপ্রায় রাজপ্রাসাদ ছাড়া আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় কোনও লোকালয় নেই। স্থানীয় মানুষরা চমকগড়ের নাম অবধি নেয় না, কিছু বলতে গেলেও ভয়ে পাংশু হয়ে ওঠে তাদের মুখচোখ — দু’হাত দিয়ে কান চাপা দিয়ে, জিভ কাটে, বিপত্তারণ মন্ত্র বলে জোরে জোরে সুর করে। এর পেছনে একটা কোনও কুসংস্কার, কোনও প্রচলিত মিথ্যা কাহিনী আছে নিশ্চয়ই — তবে সে কথা অনেক চেষ্টা করেও আমি উদ্ধার করতে পারিনি কারোর থেকে। আমাদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের সম্পর্ক মোটেও ভালো বলা যায় না। ওরা সহজভাবে আমাদের গ্রহণ করতে পারেনি। আমরা ওদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করলেও ওরা যেন নিজেদের চারিদিকে এক গণ্ডি কেটে রেখেছে, আর সেই গণ্ডিতে আমাদের কঠোরভাবে প্রবেশ নিষেধ। এদিকে আমরাই বা কী করতে পারি! সরকারি প্রোজেক্ট, আর আমরা সরকারের চাকর। সুতরাং আমাদের পছন্দ অপছন্দ মেনে কাজ করার উপায় নেই। সরকারেরও যে কখন কী ভূত মাথায় চাপে! কী করে যে এই চমকগড়ের খোঁজ পেল, আর কেনই বা এখানে রাজপ্রাসাদকে হেরিটেজ করে ট্যুরিস্ট স্পট করার ইচ্ছা জাগল — ভগবান জানে! কে আসবে এখানে? কী আছে দেখার মত! ঐ তো কিছুটা দূরে ভৈরবী মায়ের ভাঙাচোরা মন্দির, রাজপ্রাসাদের ডানপাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা শীর্ণকায়া পিপাসা নদী, আর পেছনের দিকে বিস্তীর্ণ জঙ্গল। অবশ্য মানুষের শখ বড় বিচিত্র। ঝাঁ-চকচকে শহরের মানুষগুলো বিলাসবহুল আরামের জীবনে থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে ওঠে, আর তখন এইসব গোলমেলে জায়গায় আসে চেনা পরিধির বাইরেটা কেমন হয় তা একটু হালকা করে ছুঁয়ে দেখতে। আর এখানকার মানুষগুলো, যারা শহরের সমস্তরকম সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা আফসোস করে ওদের মত একটা জীবন না পাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি মাঝখান থেকে এই প্রোজেক্টটাতে বিশ্রীভাবে ফেঁসে গিয়েছি।

প্রথম দিকে অফিসে যখন প্রোজেক্টটার কথা শুনেছিলাম হালকাপাতলা করে, তখন দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে আমাকে এখানে পাঠানো হবে — যদিও অফিসিয়ালি কাজের দায়িত্বটি আমারই। আসলে মিছরি থাকতে এসব ফিল্ড ওয়ার্কের কাজ আমি নিজেও খুশি হয়েই করতাম, কিন্তু মিছরির চলে যাওয়ার পর মোমোর সব দায়িত্ব তো এখন আমার — অফিসের বস সেটা জানেন এবং ফেভারও করেন, একথা অস্বীকার করলে চলবে না। কিন্তু এবার বস নিজেও অসহায়, কেউই এত দূরে এই রকম একটা জায়গাতে কেউই আমার ভাগের কাজ করতে রাজি হননি। অগত্যা চাকরি বাঁচাতে আমাকেই আসতে হল। একান্ত নিরুপায় হয়ে সাতবছরের সদ্য মা-হারা সন্তানকেও ভগবানের নাম স্মরণ করে নিয়ে এলাম সঙ্গে করে। মোমো বড্ড দুষ্টু, আমিই মাঝে মাঝে অধৈর্য হয়ে যাই ওকে সামলাতে — সেই ছেলেকে কার দায়িত্বে একমাস রেখে আসব! রাজিই বা হবে কে দায়িত্ব নিতে।

মিছরির মৃত্যুর পর মোমো যেন আরও বেশি জেদি, অবাধ্য হয়ে উঠছিল দিন দিন — হয়ত মায়ের মৃত্যুশোকে, কিংবা সঠিক যত্নের অভাবেই। আমারই অক্ষমতা হয়ত। কিন্তু এখানে এসে ও অনেকখানি সামলেছে। ঐ বাড়ির আনাচে কানাচে মিছরির স্মৃতিচিহ্ন, আমারই দম বন্ধ লাগে — একটা বাচ্চা তো তার মায়ের অভাব আরও বেশি করে অনুভব করবে — সেটাই স্বাভাবিকও। তাই এই জায়গা বদলটা কিছুটা শাপে বরও হয়েছে আমার জন্য। এমনিও এখন পুজোর ছুটি চলছে মোমোদের স্কুলে, স্কুল কামাইও হবে না বিশেষ। শুধু একটাই সমস্যা, কোনো স্থানীয় মহিলাকে ওর দেখাশোনা কাজে রাখব ভেবেছিলাম, কিন্তু সে তো আর পাওয়া গেল না। বুধনই আগলে রেখেছে বলতে গেলে।

“বাবাআআআআ”

আচমকা মোমোর ডাকে চমকে উঠি। খবরের কাগজ সরিয়ে রেখে এদিক-ওদিক তাকাই। ততক্ষণে জঙ্গলের দিক থেকে বেরিয়ে এসেছে মোমো। ভয়ে আঁতকে উঠি। ঐ জঙ্গলে কী করতে গিয়েছিল আমার ছেলেটা! যদিও হিংস্র জন্তু নেই নিশ্চয়ই, নাহলে গত সাতদিনে বুঝতে পারতাম। কিন্তু তবুও… একা একা কেন যাবে জঙ্গলে! যদি পথ হারিয়ে ফেলত! ভীষণ রাগ হল মোমোর ওপর, সেই সঙ্গে বুধনের ওপরও।

ততক্ষণে মোমো আমার সামনে, ওর সঙ্গে আরেকজন ওরই বয়সী ছেলে। কে ও!

“বাবা, দেখো আমার বন্ধু রত্নদেব।” মোমো বলে।

নিজের রাগকে সংযত করি। মুখে আলগা হাসি এনে বলি, “তুমি কোথায় থাকো রত্নদেব?”

ছেলেটি হাত তুলে রাজপ্রাসাদের দিকে দেখায়। অবাক হই। আবার পরমুহুর্তেই বাচ্চাছেলের খেয়াল ভেবে উড়িয়ে দিই।

“কার সঙ্গে থাকো তুমি?”

“একা।”

এবার সত্যি চমকেছি আমি। ছেলেটা কী পাগল নাকি রসিকতা করছে আমার সঙ্গে! ভালো করে তাকিয়ে দেখি, বয়সে প্রায় মোমোর মতোই হবে। নিষ্পাপ সরল একটা মুখ। কিন্তু এসব কী বলছে! এইটুকু বাচ্চা একা থাকে? তাও আবার রাজপ্রাসাদে? কী করে সম্ভব! সাতদিনে প্রাসাদের কত অংশ ভাঙা হল, নতুন করে কাজ হচ্ছে — সেই বাড়িতে কেউ থাকলে কি চোখে পড়ত না কারোর? নিশ্চয়ই কিছু একটা ভুল হচ্ছে।

এবার একটু কড়া গলায় ধমকে উঠি — “মিথ্যা কথা বলা হচ্ছে আমায়? ডেঁপো ছেলে।”

আমার কথায় যেন চমকে উঠল ছেলেটি মুহূর্তের জন্য। একবার ওর বড় বড় চোখ মেলে পূর্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। জলে ভরে গেছে চোখ, যেন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। পর মুহূর্তেই আমাকে অবাক করে মোমোর হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে রাজপ্রাসাদের তোরণ দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

আমিও ছুটেছি ওর পেছন পেছন। কিন্তু যেন চোখের সামনে থেকেই পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

প্রথমে অবাক হলেও পরে জেদ চেপে গেল। সবাইকে নিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম রাজপ্রাসাদের সমস্ত জায়গা — কোথাও তার দেখা পেলাম না।

এমন কী করে হতে পারে! কে এই রত্নদেব?

(২)

বিকালবেলা কাজ থেকে ফিরে আরেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হল। দুপুর থেকে নাকি মোমোর জ্বর। কি যে হচ্ছে আজ সারাদিন! এই তো দিব্যি সুস্থ ছিল সকালে। হাত-পা ধুয়ে বিছানায় এসে দেখি মরার মত বেঘোরে পড়ে আছে মোমো। সারা শরীর যেন আগুন হয়ে আছে। বুধনকে মোটামুটি ওষুধপত্র বোঝানোই থাকে। ও বলল ওষুধ খাইয়েছে। কিন্তু জ্বর কমেনি। কী করব এখন আমি? কী যে অসহায় আর অস্থির লাগছে। কোথায় এখন ডাক্তার পাব!

জলপটি! হ্যাঁ, মিছরি তো তাই করত। মোমোর এরকম জ্বর হলে মিছরি মাথায় জলপট্টি দিত। তাড়াতাড়ি করে একটা বাটিতে জল নিয়ে এসে তাতে রুমাল ভিজিয়ে জলপট্টি দিতে শুরু করলাম। আর প্রাণপণে ঠাকুর স্মরণ করছি। । হে ভগবান, তুমি রক্ষা করো।

রাতে আমার গলা দিয়ে খাবার তো দূরের কথা, জল অবধি নামছিল না। সন্ধে থেকে জলপট্টি দিচ্ছি, আরও একটা ওষুধ পড়েছে — তবু জ্বর নামেনি একটুও।

এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্কের অবস্থাও তথৈবচ। কোনোক্রমে দীর্ঘ সময় চেষ্টার পর অফিসে যোগাযোগ করতে পেরেছি। ওরা সকালে গাড়ি পাঠাবে বলেছে। কাটোয়াতে নিয়ে যেতে পারলেও কিছুটা স্বস্তি। কাটোয়াতে বেশ কিছু নামকরা ডাক্তার বসেন, আছে মহকুমা হাসপাতালও। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাটা অন্তত শুরু করা যাবে।

মোমোর মাথার কাছে বসে থাকতে থাকতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি। হঠাৎ কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হওয়ায় ধড়মড়িয়ে উঠলাম। তাঁবুর বাইরে চারদিক কেমন কুয়াশাচ্ছন্ন লাগছে, অথচ দমবন্ধ গুমোট আবহাওয়া সমস্ত ঘরে। পাশে বিছানার দিকে তাকাতেই বুকটা ধক করে উঠল। মোমো নেই!কোথাও নেই আশেপাশে।

বুধন মাটিতে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। ওকে তুললাম ধাক্কা দিয়ে। দু’জনে মিলে আলো নিয়ে বাইরেটা খুঁজে দেখলাম।

কোথাও নেই মোমো। আমার হাত-পা সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মাথা কাজ করছে না, সবকিছু শূন্য মনে হচ্ছে।

বুধন ততক্ষণে লেবারদের ঘুম থেকে তুলেছে ডেকে। টর্চ, হ্যারিকেন, লাঠিসোটা নিয়ে চারপাশে আবার খুঁজতে গেল ওরা। একটা দল জঙ্গলের ভেতররেও গেল। শুধু আমিই স্হানুবৎ বসে আছি একলা।

কতক্ষণ সময় কেটে গেছে জানি না। হঠাৎ বুধনের গলার স্বর শুনতে পেলাম —

“বাবুউউউউউ, ছোটাবাবু ইকানেএএএএএ…”

কোনদিক থেকে ডাকল? মনে হল যেন রাজপ্রাসাদের মধ্যে থেকেই এল ডাকটা। ইতস্তত করে খানিকটা এগিয়েছি, দেখি বুধন মোমোকে কোলে নিয়ে আসছে। পেছন পেছন আরও কয়েকজন।

ছুটে গিয়ে কোলে নিয়েছি মোমোকে।

আশ্চর্য! একফোঁটা জ্বর নেই তো! কী করে সম্ভব!

বুধনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, মোমোকে রাজপ্রাসাদের ভেতরে যেখানে সুইমিং পুলের কাজ শুরু হয়েছে সেখান থেকেই উদ্ধার করেছে ওরা। ।

মোমো একা একা অত রাতে ওখানে কী করছিল!

মোমোকে যতবার জিজ্ঞেস করছি, ততবারই এক উত্তর পাচ্ছি ওর থেকে। ও নাকি ওখানে একা যায়নি। ওর নতুন বন্ধু রত্নদেব এসে ওকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল।

আবার সেই রত্নদেব!

কে ও? এত রাতে মোমোর কাছে এল কী করে? আর এ এসেছিল যদি গেল কোথায়? বুধনরা কেউ ওকে দেখতে পেল না কেন?

(৩)

আশ্চর্যজনকভাবে সেই রাতের পর থেকে আর একবারের জন্যও জ্বর আসেনি মোমোর। যদিও পরের দিন কাটোয়াতে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। ডাক্তারও বলেছেন, কোনও শারীরিক সমস্যা নেই। মানসিক উত্তেজনা বা অত্যধিক মানসিক আঘাত থেকে ওরকম হঠাৎ করে জ্বর এসেছিল হয়ত। কিন্তু আমি এটাই বুঝতে পারছি না কী এমন হয়েছিল সেদিন মোমোর যে হঠাৎ ওভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার থেকেও বেশি রহস্যজনক সেই রাতে ওর রাজপ্রাসাদে যাওয়া এবং সুস্থ হয়ে ওঠা।

তবে আমার তো মনে হচ্ছে রত্নদেব ছেলেটাই আসলে রহস্যের আধার। অনেকভাবে খোঁজ করার চেষ্টা করেছিলাম ওর, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। অগত্যা কিছুটা হাল ছেড়ে দিয়েছি। যদিও এই ক’দিনে আর তার দেখা পাওয়া যায়নি। বুধনকে ভালো করে বলা আছে, ছেলেটি মোমোর কাছে এলে ওকে বসিয়ে আমায় খবর দিতে। কিন্তু সে আসেনি। মোমো অবশ্য কয়েকদিন জঙ্গলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বুধনের নজরে পড়ায় সেটা সম্ভব হয়নি।

এভাবেই দিন সাতেক কেটে গেছে। আমিও সেদিন রাতের ঘটনা কিছুটা হলেও ভুলতে শুরু করেছি। কাজের ব্যস্ততা চূড়ান্ত। আমি আর দিন দশেক পর ফিরে যাব। বাকি কাজ জুনিয়ররা সামলে নিতে পারবে।

সকালে স্নান করতে করতে ঠিক করলাম আজ মোমোকে নিয়ে ভৈরবী মায়ের মন্দিরে যাব পুজো দিতে। আমি নিজে কোনদিনই ঈশ্বর বিশ্বাসী নই, কিন্তু মিছরি প্রতি বছর আজকের দিনে মোমোকে নিয়ে মন্দিরে যত পুজো দিতে — জন্মদিনের দিনের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। এবার প্রথম মোমোর জন্মদিনে মিছরি নেই। কেন জানি না ও চলে যাওয়ার পর থেকে ওর পছন্দ অপছন্দগুলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে আমার কাছে। এমনই হয় বোধহয় — যতদিন নাগালের বাইরে না যায় ততদিন তার মূল্য বোঝে না কেউই, আমিও বুঝিনি।

মোমোকে নিয়ে পায়ে হেঁটেই চলেছি মন্দিরের উদ্দেশ্যে। হালকা হালকা শীত পড়তে শুরু করেছে। রোদ্দুরে হাঁটতে ভালোই লাগছে।

মন্দিরে পৌঁছতেই সন্ন্যাসীবাবার সঙ্গে দেখা হল। আগে একদিন পরিচয় হয়েছিল ঘটনাক্রমে। উনিও বোধহয় তাই দেখেই চিনতে পেরেছেন আমায়। পুজোয় শেষে মোমোর কপালে সিঁদুরের টিপ পরানোর সময়ই অঘটনটা ঘটল। গর্ভগৃহে প্রবেশদ্বারে যে পেতলের বড় ঘন্টাটা ছিল, সেটা হঠাৎই ছিঁড়ে পড়ল মোমোর ওপর।

ঘটনার আকস্মিকতার ঝোঁক কাটিয়ে মোমোকে তুলে দেখি কোনো আঘাত লাগেনি ওর শরীরে। সন্ন্যাসী তার ন্যুব্জ শরীরটাকে আরও ঝুঁকিয়ে মোমোর মুখের কাছে এনেই ছিটকে সরে গেলেন। ওঁর চোখমুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ।

“কে তোমরা? কী করে এই হার পেলে তুমি?” সন্ন্যাসী মোমোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

হার! কই, ওর গলায় কোনও হার তোমাকে নেই। আমি ভাবলাম।

কিন্তু আমায় অবাক করে মোমো বলে উঠল, “আমার বন্ধু রত্নদেব দিয়েছে আমায়, জন্মদিনের উপহার।”

— “জন্মদিন! রত্নদেব! ঠিক করে বল তো বাবা তোমরা কারা?” সন্ন্যাসী এবার আমাকে প্রশ্ন করলেন।

আমি সবকিছু খুলে বললাম, আমদের কথা, এখানে আসার কারণ, রত্নদেবের কথা। তবে আমি যে হারের ব্যাপারে কিছু জানি না, তাও বললাম।

সব শুনে সন্ন্যাসী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তোমরা যত তাড়াতাড়ি, সম্ভব হলে আজই এই চমকগড় থেকে ফিরে যাও — নইলে অনর্থ হয়ে যাবে।”

“কিন্তু কেন? কী হবে? আমাদের কাজ শেষ হয়নি এখনও — দিন দশেকের আগে তো কোনোভাবেই যাওয়া সম্ভব নয়।” আমি বলি।

“তোমার ছেলের প্রাণের দাম বেশি, নাকি কাজের? তুমিই ঠিক করো।”

এর উত্তরে কী বলব কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকলাম। একটু পরে আস্তে আস্তে উঠে এলাম। তাঁবুর উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই পেছন থেকে সন্ন্যাসীর ডাক শুনতে পেলাম।

—“ছেলেমানুষী করো না, ফিরে যাও। এখানে থাকলে তিনদিনের মধ্যে তুমি তোমার সন্তানকে হারাবে — এই আমি বলে দিলাম।

রূপবতী জেগে উঠেছে। সে আবার জেগে উঠেছে।”

কিছু না বলে সামনের দিকে পা চালালাম। একটু পরেই আচমকা সমস্ত আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। একটু আগেই যেরকম সুন্দর আবহাওয়া ছিল, তাতে এরকম কিছু হতে পারে বলে মনেই হয়নি। এমনিও এই সময় ঝড়বৃষ্টি হয় না সাধারণত। আজ যে কী হল!

এখনও তাঁবু অবধি পৌঁছাতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। তাড়াতাড়ি পা চালালাম, ঝড়বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই পৌঁছতে হবে আমাদের। এই সময় বৃষ্টিতে ভিজলেই আবার জ্বরে পড়বে নির্ঘাত।

ঠিক এমন সময় বিদ্যুতের ঝলকানিতে চোখ ঝলসে গেল, দূরে কোথাও বুঝি বা বাজ পড়ল। কিন্তু আমি যেন স্পষ্ট শুনলাম সেই আওয়াজের সাথে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সন্ন্যাসীর কথা — “রূপবতী জেগে উঠেছে”

(৪)

ভয়ে মোমোকে কোলে তুলে দৌড়তে শুরু করি। । একটা ভয়ংকর ঝড় যেন পিছু পিছু ধাওয়া করে আসছে আমায়। তাঁবুর একদম কাছে পৌঁছে গেছি এমন সময় কিসে যেন পা জড়িয়ে ছিটকে পড়লাম। মোমোও ছিটকে গেল আমার কোল থেকে।

বুধনরা ভাগ্যিস দেখতে পেয়েছিল। ওরাই দৌড়ে এসে তোলে আমাদের। আমার হাত পা কেটে ছড়ে গেলেও মোমোর শরীরে কোনো আঘাত লাগেনি।

এদিকে ততক্ষণে বীভৎস ঝড় উঠেছে। সবাই আতঙ্কগ্রস্ত, ভীত। যে যার আরাধ্য ইষ্টকে স্মরণ করছে। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই আমাদের তাঁবুগুলোকে খড়কুটোর মত উড়িয়ে নিয়ে গেল ঝড়ের তীব্র বাতাস। আমরা কোনোরকমে দৌড়ে গিয়ে রাজপ্রাসাদে আশ্রয় নিলাম।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে কিন্তু ঝড়ের দাপট কমছে না। পৃথিবীর বুকে যেন ধ্বংসপ্রলয় নেমেছে আজ।

মোমোকে পাশে নিয়ে বসে আছি চুপচাপ। পর পর ঘটনাগুলো ভাবার চেষ্টা করছিলাম। মোমোর মধ্যে এক অদ্ভুত অস্থিরতা লক্ষ্য করছি। খালি বলছে, “মায়ের কাছে যাব।” বারবার ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু আগে তো কখনও এমন করেনি। হঠাৎ কী হল আজ ওর!

আচমকাই চোখ গেল ওর গলার হারটার দিকে। সোনার চেন, সাথে একটা নীলা বসানো লকেট। যথেষ্ট দামি এই জিনিস। কোথায় পেল ছেলেটা, আর মোমোকেই দিতে বা এল কেন। শুনেছি নীলা নাকি সবার সহ্য হয় না। মুহূর্তের মধ্যে সব রাগ গিয়ে পড়ল ঐ রত্নদেব আর ওর দেওয়া উপহারের ওপর। মোমোর গলা থেকে হারটা খুলে ফেলে দিতে উদ্যত হতেই সন্ন্যাসীর গলার আওয়াজ এল কানে।

— “খবরদার! ভুলেও ওই ভুল কোরো না। তোমার ছেলের গলায় রত্নদেবের শেষচিহ্ন আছে বলেই রূপবতীর গ্রাস থেকে এখনও পর্যন্ত বেঁচে আছে।”

— “কী বলছেন সন্ন্যাসীবাবা! কে এই রূপবতী? কেন আমার ছেলেকে মারতে চায়?”

— “ঠিকই বলছি। প্রতিশোধের নেশা বাবা। সবই প্রতিশোধের নেশা। সব বলব। কিন্তু এখানে নয়। আমি ভৈরবী মায়ের কাছে যজ্ঞের আয়োজন করে এসেছি। তোমাদেরকে যেতে হবে আমার সঙ্গে। আজ তোমার ছেলের হাতে যদি রূপবতী মুক্তি পায় তবে তোমারাও বেঁচে যাবে। নাহলে সবাই শেষ হয়ে যাবে।”

এরপর আর কিছু বলার মত সাহস আমার অবশিষ্ট ছিল না। মোমোকে নিয়ে সন্ন্যাসীকে অনুসরণ করতে থাকলাম।

সন্ন্যাসী হাতের কমণ্ডলু থেকে কী যেন হাতে ঢালছে আর চারিদিকে ছেটাচ্ছেন, সঙ্গে সমানে মন্ত্রপাঠ করে চলেছে। ঝড়ের দাপট সামান্য কমেছে। মোমোও যে একটু শান্ত আগের থেকে।

ভৈরবী মায়ের মন্দিরে পৌঁছে সন্ন্যাসী আমাদের বসতে বলে যজ্ঞের বাকি আয়োজন করতে লাগলেন। কিছু জিজ্ঞেস করতেও ভয় লাগছে, আবার মনের মধ্যে অজস্র প্রশ্ন পাক খেয়ে চলেছে।

কিছুক্ষণ পরে সন্ন্যাসী নিজের থেকেই বলতে শুরু করলেন।

“এই যজ্ঞ কোনও সাধারণ যজ্ঞ নয়। এই যজ্ঞ সফলভাবে সমাপন না করতে পারলে তোমার সন্তানকে বাঁচানো সম্ভব হবে না আর। যদি কয়েকদিন আগেও তোমরা আমার কাছে আসতে তাহলে এই অনর্থ হওয়ার আগেই আমি সামলাতে পারতাম। কিন্তু এখন আর কোনও উপায় নেই। তোমার সন্তান সাত পেরিয়ে আটে পা রেখেছে, আর তার ফলেই রূপবতী জেগে উঠেছে। এতবছরের অতৃপ্ত আত্মাকে ঠেকানো কোনও সহজ কাজ তো নয় বাবা। সামান্য একটু ভুলেও সর্বনাশ হতে পারে। তোমার ছেলে বড্ড ছোটো, ও হয়ত বুঝবে না কিছুই। কিন্তু তোমাকে বুঝতে হবে। সব কাজ সুষ্ঠুভাবে করাতে হবে ওকে দিয়ে।”

একটু থামলেন, চারিদিকে দেখে নিলেন ভালো করে, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন।

“তার আগে তোমাদের জানতে হবে কে এই রূপবতী! রত্নদেবই বা কে! কী তাদের কাহিনী। আর তোমরাই বা কেমন করে তার সঙ্গে এক সূত্রে বাঁধা পড়ে গিয়েছ নিজেদের অজান্তেই।”

(৫)

—“তখনও আমাদের দেশে ইংরেজ শাসন কায়েম রয়েছে। কিন্তু চমকগড়ের মত কিছু জায়গা কোম্পানিকে শুল্ক দিয়ে নিজেদের মত করে থাকত। চমকগড় খুবই ছোট্ট একটা জায়গা। নামে রাজা হলেও আসলে ছিল জমিদারীই। রাজা ভূপতিদেবের মৃত্যুর পরে রাজা হল তাঁর ছেলে ইন্দ্রদেব। বাপের মতোই সেও ছিল প্রজাদরদী শাসক। সুতরাং চমকগড়ের মানুষজন ভালোই ছিল বলা যায়।

কিন্তু এই কাহিনী রূপবতীর কাহিনী। এই রূপবতী ছিল এক তন্ত্রসাধকের মেয়ে। তন্ত্রসাধক প্রথম জীবনে সংসারী মানুষ ছিলেন, তারই চিহ্ন মেয়ে রূপবতী। রূপবতী জন্মের পরই মাতৃহারা হয়েছিল। তারপর থেকে বাপের কাছেই মানুষ। বাপ তন্ত্রসাধনা শুরু করলেও মেয়েকে ত্যাগ করেনি। বাপের সঙ্গে সঙ্গে রূপবতীও নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াত। এমনভাবেই একদিন বাপের সঙ্গে রূপবতী এই চমকগড়ের এই ভৈরবী মায়ের মন্দিরে এসেছিল। রাজা ইন্দ্রদেব এসব তন্ত্রসাধনা মোটেও পছন্দ করতেন না। তাই খবর পেয়েই দেখা করতে এলেন। এসেছিলেন তো ওদের এই মন্দির থেকে উচ্ছেদ করতে। কিন্তু নিয়তির লিখন কিছু আলাদাই ছিল। রাজা ইন্দ্রদেব রূপবতীর রূপে মজলেন। দ্বিতীয়বার পাণিগ্রহণ করলেন প্রথমা স্ত্রী বর্তমান থাকতেও, বিয়ে করলেন রাজা ইন্দ্রদেব রূপবতীকে। আর তার বদলে তাঁর বাপকে এই মন্দিরে তন্ত্রসাধনার অনুমতি দিলেন।

কিন্তু সমস্যা শুরু হল তারপর। রূপবতীকে কেউই মন থেকে মানতে পারেনি, না রাজার প্রথমা স্ত্রী, না চমকগড়ের প্রজারা। এক সামান্য মেয়েকে কে কবে সহজে আসন ছেড়ে দিয়েছে এ দুনিয়ায়! তবে রাজা ইন্দ্রদেব প্রকৃতপক্ষেই ভালোবাসত রূপবতীকে। রূপবতীও স্বামী সোহাগে বাকি সব অবহেলা, অসম্মান, অপ্রাপ্তি ভুলে থাকত। বছর ঘুরতে না ঘুরতে রূপবতীর কোল আলো করে এল রত্নদেব।”

চুপ করে মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলাম সন্ন্যাসীর কথা। রত্নদেবের কথায় নড়েচড়ে বসলাম।

সন্ন্যাসী আবার বলতে শুরু করেছেন।

— “রত্নদেবের জন্মের পর পরই রাজা ইন্দ্রদেবের প্রথমা স্ত্রীও পুত্রসন্তান প্রসব করেন। কিন্তু হিসেব মতো রত্নদেবই রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র ও সিংহাসনের ভাবী উত্তরাধিকারী।

সেদিন রত্নদেবের জন্মদিন ছিল। রূপবতী প্রতি বছর ঐ একটা দিন ছেলেকে নিয়ে বাপের সঙ্গে দেখা করতে আসত, ভৈরবী মায়ের কাছে পুজোও দিত। সেবার রত্নদেবের শরীর ভালো না থাকায় তাকে প্রাসাদে দাসীদের কাছে রেখে এসেছিল।

কিন্তু ফিরে গিয়ে সে আর তাঁর সন্তানকে খুঁজে পায়নি। খাসদাসী আর রত্নদেব যেন ভেল্কিবাজিতে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। তিনদিন পর রাজার লোক দাসীর হদিশ পায়, আর তার থেকেই জানা যায় আসল ঘটনা।

রাজার প্রথমা স্ত্রীর কথায় দাসী রত্নদেবকে তুলে দিয়েছিল বড়রানির লোকের হাতে। বদলে দাসী অনেক সোনা পেয়েছিল বড় রানির থেকে।

তখনও বোঝা যায়নি কী সর্বনাশ ঘটে গেছে। ভেবেছিল, হয়ত আটক করে রেখেছিল রত্নদেবকে। কিন্তু না, পিপাসা নদীতে রত্নদেবের লাশ পাওয়া যায় তার পরের দিন।

রূপবতী পাষাণের মত স্থিরমূর্তি হয়ে গিয়েছিল সন্তানের শোকে।

রাজা কিন্তু বড়রানিকে কোনও শাস্তি দেননি। বরং ঘরের কেচ্ছা যাতে বাইরে প্রকাশ না পায় সেই চেষ্টায় রত হয়েছিলেন। হয়ত ভেবেছিলেন এভাবেই সবকিছু সামলে যাবে।

কিন্তু রাজা জানত না, রূপবতীও তার বাপের মতোই তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধা ছিল। সন্তানহারা মায়ের বুকে কতখানি প্রতিশোধ স্পৃহা থাকতে পারে, তা বোঝা গেল কয়েকদিনের মধ্যেই।

বড় রানির ছেলের জন্মদিনের দিন মারা গেল সেই ছেলে। বড়রানিও তার কয়েকদিন পরই অপঘাতে মারা গেলেন। রাজমাতা মারা গেলেন আচমকাই তার কয়েকদিন পরে। রাজা এবার দুই সন্তানকে হারিয়ে, তার ওপর একের পর এক মৃত্যু শোকে উন্মাদের মত আচরণ করতে লাগলেন। রূপবতীকে আটক করার চেষ্টা করতেই সে রাজপ্রাসাদের ছাদ থেকে পিপাসা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করল। কিন্তু রাজপরিবারে মৃত্যু মিছিল থামল না। তখন রাজা বন্দি করল রূপবতীর বাপকে। কিন্তু রূপবতীর অতৃপ্ত আত্মা একে একে সবাইকে গ্রাস করল। রাজা ইন্দ্রদেব আত্মহত্যা করেন এক পক্ষকালের মধ্যে। ক্রমশ রাজপরিবারও শেষ হল, উজাড় হয়ে গেল চমকগড়ের সাধারণ মানুষের ঘরও। যে কয়েকজন বেঁচে ছিল তখনও, তারা ভয়ে পালাল। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকল চমকগড়। লোকমুখে রূপবতীর গল্প চলতে থাকল শতাব্দীর পর শতাব্দী।”

— “কিন্তু বাবা, আমরা কী অপরাধ করলাম?,” আমি জানতে চাই।

— “তোমার ছেলে আজ আটে পা দিল। রত্নদেবের আট বছরের জন্মদিনেই তাকে হারিয়েছিল রূপবতী। সেই শোক আজও ওর অতৃপ্ত আত্মাকে মুক্তি দেয়নি। ও তোমার ছেলেকে হত্যা করতে চায় প্রতিশোধ স্পৃহায়।”

— “এখন উপায়?”

— “উপায় ছিল না কিছুই। কিন্তু রত্নদেবের আত্মা সে উপায় করে দিয়েছে। রত্নদেব নিজের গলার হার তোমার ছেলেকে দিয়েছে। রত্নদেবের চিহ্ন আছে বলেই রূপবতী এখনও ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি এই যজ্ঞের আয়োজন করেছি, যাতে তোমর ছেলে রূপবতীর নামে আহুতি দেবে। যেহেতু মৃত্যু অপঘাতে এবং সে পুত্রের হাতের আগুন পায়নি, তাই তার মুক্তিও ঘটেনি। আজ তোমার ছেলের মধ্যে রত্নদেবের আত্মা বিরাজ করছে। এই আহুতি রূপবতীর আত্মাকে মুক্তি দেবে।

কিন্তু রূপবতী সহজে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে চাইবে না। আর তাই যজ্ঞে বাধা দিতে চাইবে। তুমি ছেলেকে কোলে নিয়ে বসবে হোমকুণ্ডের সামনে। যত যাই হয়ে যাক, ওকে উঠতে দেবে না। একবার আসন ত্যাগ করলে সব পণ্ডশ্রম হবে। তোমার ছেলেও বাঁচবে না।”

(৬)

যজ্ঞ শুরু হতেই চারিদিকে নতুন করে তাণ্ডব শুরু হল। প্রলয় হচ্ছে মনে হচ্ছে। গাছের ডাল ভেঙে পড়ছে চারিদিকে, মোমোর মধ্যে অদ্ভুত এক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। কোল থেকে উঠে ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাইছে। সর্বশক্তি দিয়ে ধরে আছি, তবু যেন আটকে রাখতে পারছি না। কোথা থেকে শরীরে এত শক্তি পেলো মোমো। তবে কি ওর মধ্যে রত্নদেব সামিল হয়েছে! তাই এতো আকুল হয়ে ছুটে যেতে চাইছে রূপবতীর ডাকে! আরও শক্ত করে চেপে ধরি, কিছুতেই ছাড়ব না। ওকে রূপবতীর কাছে যেতে দেওয়া মানেই মোমোকে হারানো। আমি কিছুতেই মোমোকে হারাতে পারব না। মোমো আমার একমাত্র অবলম্বন, মিছরির চিহ্ন।

এভাবে কতক্ষণ চলেছে আমি জানি না। আস্তে আস্তে সব শান্ত হল। হোমাগ্নি থেকে একটা আবছায়া অবয়ব যেন এগিয়ে এল মোমোর দিকে। ভয়ে কাঁটা হয়ে গেছি আমি। তবে কি রূপবতী জিতে গেল! কেড়ে নেবে এবার আমার থেকে মোমোকে?

কিন্তু না, তেমন কিছু হল না। একবার মোমোর কপালে স্নেহচুম্বন দিয়েই সেই অবয়ব অদৃশ্য হয়ে গেল। মোমোও শান্ত হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি আমার হাতে কয়েক ফোঁটা জল। এ কি রূপবতীর অশ্রু!

— “বিপদ কেটে গেছে। রূপবতী মুক্তি পেয়েছে, মুক্তি পেয়েছ তোমারও।”

সন্ন্যাসীর কথায় আশ্বস্ত হই।

— “আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব সন্ন্যাসী বাবা! আপনি না থাকলে তো আমি মোমোকে বাঁচাতে পারতাম না।”

— “আমার যে এবার গুরুদক্ষিণা লাগবে।” মৃদু হেসে বলেন উনি।

— “কী করতে পারি আমার জন্য আমি বলুন…”

— “এবার ঐ হোমে আমার নামে একইভাবে আহুতি দিতে হবে তোমার ছেলেকে!”

—“কী বলছেন কি আপনি! ঐ আহুতি তো আত্মাকে বন্ধন মুক্ত করার জন্য….”, কথা শেষ করতে পারি না উত্তেজনায়।

—“অবাক হচ্ছ! আমি রূপবতীর সেই হতভাগ্য বাপ, যে নিজের সন্তান আর নাতিকে বাঁচাতে তো পারিনি অপমৃত্যুর হাত থেকে। রাজা আমাকে বন্দি করেছিল যখন রাজপরিবারে একের পর এক অপমৃত্যু ঘটেছিল। পরে শিরচ্ছেদ করেন। মুক্তি তো আমিও পাইনি বাবা। এখন তোমার ছেলের হাতের আহুতি পেলে মুক্তি পাব।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post শেষ পরিণতি | ভয়ের দেশ | তানভীর স্বাধীন| Bengali Horror Story
Next post সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর | ভয়ের দেশ | কৌস্তভ রায়| Bengali Horror Story