Getting your Trinity Audio player ready...
|
হোম সিকনেস কোনো রোগ কিনা জানিনা, কিন্তু রোগ না বলাটাও ভুল হবে। এই রোগের আজ অবধি কোনো ওষুধ বের হয়নি। এই রোগ হয় যখন কোনো মানুষ এক জায়গায় অনেক বছর কাটানোর পর সে অন্য আরেক জায়গায় গিয়ে বসবাস করে এবং ভেবে নেয় যে আর কোনোদিন সে সেই পুরনো জায়গায় ফিরতে পারবে না, তখন এই রোগ আক্রমণ করে।
আমি অঞ্জন আর আমার ভাই অংশু, আমরা বাবা মায়ের দুই সন্তান। আমরা দুজনে ভাই দাদা কম, বন্ধু বেশি। আমার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের ঘাটালে, কিন্তু আমি কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকি। আমার ভাই এখন পড়াশোনা করছে, পরীক্ষা দিতে যাবে উড়িষ্যাতে, তাই আমি আজ কলকাতা থেকে নিজের বাড়ি ঘাটালে ফিরছি। বাসে করে বাড়ি ফেরার সময় দেশের কথা ভাবছিলাম। সব ছোটবেলার কথা মনে পড়তে লাগল। ছোটবেলায় আমি এক জ্যাঠামশাই এর কাছে টিউশন পড়তাম, গত পাঁচবছর হল জ্যাঠামশাই তার ছেলের সাথে উড়িষ্যায় চলে গেছে। উড়িষ্যা যাওয়ার কারণ — জ্যাঠামশাই এর প্রথম সন্তান হবার পরই জেঠিমা নদীতে স্নান করতে গিয়ে মারা যায়। আজও জানা যায়নি জেঠিমা মারা যাবার কারণ টা কি। জেঠিমা মারা যাবার পর জ্যাঠামশাই আর বিয়ে করেনি, খুব কষ্ট করে সন্তানকে মানুষ করেছে। কিন্তু জ্যাঠামশাই এর ছেলে কর্মসূত্রে উড়িষ্যায় থাকে, তাই স্ত্রী ও বাবাকে নিয়ে উড়িষ্যায় চলে গেছে। কিন্তু জ্যাঠামশাই এর যাবার সময় সেই যে কান্না, সেই কান্না এখনো মনে পড়ে। কারণ জ্যাঠামশাই এখানেই সারা জীবন কাটিয়েছে কিন্তু শেষ জীবন তাকে উড়িষ্যায় কাটাতে হবে তাই সে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। তার যাবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু তাকে এখানে কে দেখবে তাই তাকে চলে যেতে হল। এইসব ভাবতে ভাবতেই আমার বাস ঘাটালে এসে উপস্থিত হল এবং আমি বাড়ি পৌঁছে গেলাম।
ভাই – কিরে দাদা খুব মোটা হয়ে গেছিস।
মা – চুপ কর তুই। নিজে একা রান্না করে না খেয়ে দাদা রোগা হয়ে গেছে, আর তুই বলছিস মোটা হয়ে গেছে!
আমি – (মা-বাবা সবাইকে প্রণাম করলাম) ভালো আছো তোমরা সবাই?
বাবা – হ্যাঁ আমরা সবাই ভালো আছি। তুই আগে ফ্রেশ হয়ে নে তারপর আমরা সবাই একসাথে খেতে বসব।
তারপর সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করে দুইভাই মিলে মজা করে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দুই ভাই মিলে একটু ঘুরতে বের হলাম।
আমি – কিরে ভাই তাহলে তোর পরীক্ষা কবে?
ভাই – কাল রওনা দেবো, রাত্রে পৌঁছে যাব। তার একদিন পরে পরীক্ষা।
(বাড়িতে এসে প্যাকিং শুরু করলাম)
বাবা – অঞ্জন, উড়িষ্যায় যাচ্ছিস, তোর জ্যাঠামশাই আর দাদা তো ওখানেই আছে কিন্তু তাদের ঠিকানা জানিনা। প্রায় দু-বছর হল ওদের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই, আর ওদের ফোন নাম্বারটাও সুইচ অফ বলছে। এক কাজ কর তুই, তোর জ্যাঠামশাই আর দাদার এই ছবিটা আছে, তোর সাথে রাখ। একটু খোঁজ নিয়ে দেখবি যদি কোনো খবর পাস।
তার পরদিন নিজেদের গাড়ি নিয়ে দুই ভাই রওনা দিলাম উড়িষ্যার পথে। দুপুরে একটা হোটেলে নেমে খাওয়া-দাওয়া করলাম এবং কিছু খাবার সাথে নিলাম। রাত নটায় উড়িষ্যার বর্ডারে হাজির হলাম আর তখনই শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি। 30 মিনিট যাবার পর হঠাৎ আমাদের গাড়িটা বন্ধ হয়ে গেল এবং গাড়ির ভেতর থেকে দেখলাম আমরা একটি বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছি, চারিদিকের দোকানপাট সব বন্ধ।
ভাই – দাদা এতক্ষণ গাড়ির ভেতর থাকা যাবে না, চল বাংলোর সামনে গিয়ে দেখি আজকের রাতটা ওখানে থাকা যায় কিনা।
তখনও প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি চলছে, দুই ভাই মিলে বাংলোর সামনে গেলাম এবং অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করার পরও কোনো সাড়া পেলাম না। তারপর ভাই দরজায় একটা ধাক্কা দিল আর দরজাটা খুলে গেল। দরজা খোলার সাথে সাথেই কিছু বাদুড় মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল এবং দেখে মনে হল বাড়িটা অনেকদিন থেকে বন্ধ।
ভাই – দাদা ভেতরে একটা কেমন গন্ধ গন্ধ লাগছে না!
আমি – অনেকদিন ঘরটা বন্ধ আছে, মনে হচ্ছে কেউ থাকেনা। এইজন্য পাখি ঢুকে নোংরা করে দিয়েছে, তাই একটু গন্ধ গন্ধ লাগছে, দেখলি না কিছু বাদুড় উড়ে গেল। দাঁড়া একটা আলোর ব্যবস্থা করি, বোধহয় ঘরে কোনো সুইচ আছে বলে মনে হয়।
একটা সুইচ পেলাম এবং সুইচ দেবার পর সাথে সাথে ঘরটা আলোকিত হয়ে গেল। মিথ্যা বলব না ভয়টা আমারও লেগেছিল একটু, কিন্তু ভাইকে বুঝতে দেয়নি। দেখলাম একটা খাট নোংরা অবস্থায় পড়ে আছে, দুই ভাই মিলে পরিষ্কার করে একটা বেডশীট বিছিয়ে কিছু খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। তখন রাত প্রায় এগারোটা।
কিছুক্ষণ পর…..
কিছু একটা আমাদের গায়ের উপর এসে পড়ল, খুব তাড়াতাড়ি আলো জ্বেলে দেখলাম একটা কালো বেড়াল। দুজনেই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
ভাই – দাদা একটু আজব লাগছে, আলোটা জ্বেলে রাখ।
(তারপর আলো জ্বেলে রেখে দুজনেই আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। তখন ঠিক রাত বারোটা, আবার দুজনেরই ঘুম ভেঙে গেল এক আজব শব্দে। )
ভাই – দাদা, মনে হয় ওপর থেকে কেউ নিচে নামছে।
আমি – হ্যাঁ আমারও তাই মনে হচ্ছে। মনে হয় বাড়ির মালিক ওপরে থাকে কিন্তু নিচের দরজা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল।
ভাই – চল দাদা, ওপরে গিয়ে ওনাকে বলে আসি, না হলে সকালে আমাদেরকে দেখে হয়তো চোর ভেবে পুলিশ ডাকবে।
(সিঁড়ি দিয়ে দুই ভাই ওপরে উঠলাম, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার ওপরে গিয়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না। তারপর একটা বড়ো প্যাঁচা আমাদের দিকে তাড়া করল। আমরা দুজনেই ভয়ে দৌড়ে নীচে চলে এলাম। দুজনেই খুব ভয় পেয়ে গেলাম, তারপর একটি থালা-বাসন পড়ার আওয়াজ পেলাম। পিছন ফিরে দেখলাম একটি অন্য ঘরে আলো জ্বলছে, দেখে মনে হল ওটা রান্নাঘর। দুই ভাই মিলে ভয়ে ভয়ে ওই ঘরটার দিকে গেলাম, গিয়ে দেখলাম একটি লোক কিছু রান্না করছে।)
আমি – শুনছেন, আপনাদের বাড়িতে আমরা না বলে ঢুকে গেছি, কারণ বাইরে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। আর আপনার বাড়ির দরজাটাও ভেতর থেকে বন্ধ ছিল না।
(লোকটি আমাদের দিকে ঘুরে তাকালো। আর আমরা তো অবাক হয়ে গেলাম, কারণ দেখলাম উনিই আমাদের সেই জ্যাঠামশাই, তাই খুব আশ্চর্য হলাম।)
ভাই – জ্যাঠামশাই তুমি! দাদা বৌদি কোথায়?
জ্যাঠামশাই – আরে দাঁড়া দাঁড়া সব বলছি। তোদেরকে আমি দেখলাম তোরা ঘুমাচ্ছিস তাই তোদের জন্য একটু চা বানাচ্ছিলাম। তোরা রাত্রিতে কিছু খেয়েছিস!
আমি – হ্যাঁ খেয়েছি। তোমাকে এভাবে দেখতে পাবো ভাবিনি খুব অবাক হলাম। দাদা বৌদি কোথায়?
জ্যাঠামশাই – দু’বছর আগে তোর দাদার চাকরি মুম্বাইতে ট্রান্সফার হয়েছে, তাই তোর দাদা বৌদি এখন মুম্বাইতেই থাকে। আমার সাথে ওরা আর কোন যোগাযোগ করেনি। আমাকে দেশে নিয়ে যাবি তোদের সাথে! আমার এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আমি – হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ভাইয়ের দুদিন পর পরীক্ষা, তারপর তিনজন মিলে বাড়ির দিকে রওনা দেব।
জ্যাঠামশাই – এই নে তোরা চা বিস্কুট টা ধর।
দুজনেই চা টা খেতে গিয়ে একটা বিশ্রী গন্ধ পেলাম এবং প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওটা আর চা বিস্কুট নেই। ওটা রক্ত আর দুটো হাড় হয়ে গেছে এবং দুজনের হাত থেকে চা টা পড়ে গেল। সামনে দেখলাম যার সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলাম সেটা জ্যাঠামশাই নয় কঙ্কালে পরিণত হয়ে গেছে। দুই ভাই মিলে দৌড়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলাম এবং গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লাম। গাড়ি চালু হয়ে গেল এবং গাড়ির ভেতর থেকে বাড়িটির দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, ছাদের ওপর জ্যাঠামশাই মায়াবী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ভোর পাঁচটা নাগাদ ভাইয়ের পরীক্ষার জায়গায় এসে পৌঁছালাম এবং ওখানে আমাদেরকে একটি রুম দেওয়া হল। দুজনেই ফ্রেশ হলাম, পরীক্ষা আগামীকাল ছিল, তাই ভাই কিছু খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি গাড়ি নিয়ে কাল রাতের বাংলোর দিকে রওনা দিলাম বাবার দেওয়া জ্যাঠামশাই আর দাদার ছবিটি সঙ্গে নিয়ে এবং গিয়ে দেখলাম বাড়ির দরজা বন্ধই আছে। বাড়িটির সামনে একটা চা দোকান ছিল। আমি সেই চা দোকানে গিয়ে হাজির হলাম এবং দাদা আর জ্যাঠামশাই এর ছবিটা দেখালাম চা দোকানদারকে।
দোকানদার – এনারা কে হয় আপনার?
আমি – আমার দাদা এবং জ্যাঠামশাই।
দোকানদার – ওই বাংলোটিতে আপনার দাদা বৌদি এবং জ্যাঠামশাই থাকতেন। কিন্তু আপনার দাদা বৌদি প্রায় দুই বছর হল এখান থেকে চলে গেছেন। আপনার জ্যাঠামশাই এখানেই থাকতেন কিন্তু অনেকদিন হল আপনার জ্যাঠামশাই কে আর দেখা যায়নি। আর বাংলোটা বন্ধ হয়েই আছে।
আমি – আপনারা কিছুজন যাবেন আমার সাথে! তাহলে বাংলোটা খুলে দেখতাম।
দোকানদার – এইভাবে যাওয়া তো ঠিক হবেনা। দাঁড়ান, পুলিশকে খবর দিই পুলিশ আসলে সবাই মিলে যাওয়া যাবে।
কিছুক্ষণ পর …….
একজন পুলিশ আর দু’জন হাবিলদার এসে হাজির হলেন। তারপর বাংলোর সামনে গেলাম, আমি তো অবাক — দেখলাম দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ (কাল রাতে আমি বাংলোর ভেতরে ঢুকেছি কাউকে কিছু জানালাম না)। তারপর বাংলোর দরজাটি ভাঙ্গা হল। ভেতর থেকে একটি বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছিল এবং রান্না ঘরের সামনে গিয়ে দেখা গেল একটি কঙ্কাল পড়ে আছে। পুলিশ কঙ্কালটি কে পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে গেলেন এবং আমি বাড়িতে ফোন করে সবকিছু জানালাম। তৎক্ষণাৎ বাড়ির কিছু লোকজন উড়িষ্যার দিকে রওনা দিল। পুলিশকে সবকিছু জানিয়ে আমি ভাই এর কাছে গেলাম। রাতটা ভাইয়ের সাথে সেই রুমেই কাটালাম। পরের দিন সকালে বাড়ির লোকজন এসে হাজির হল। তারপর দুপুরের দিকে পুলিশ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট সহ জ্যাঠামশাই এর কঙ্কালটি আমাদেরকে দিলেন এবং বাংলোটি সিল করে দিলেন। ভাইয়ের পরীক্ষা বিকেল চারটেই শেষ হল। তারপর সবাই মিলে জ্যাঠামশাই এর কঙ্কাল সাথে নিয়ে গাড়ি করে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। বাড়িতে এসে জ্যাঠামশাই এর কঙ্কালটি সৎকার করা হল। সৎকার করার পর বাতাস থেকে একটি আওয়াজ আমার কানের সামনে ভেসে আসল, কেউ যেন আমায় বলছে — “শান্তি পেলাম।”