Getting your Trinity Audio player ready...
|
ঘড়ির কাঁটা রাত ন’টা ছুঁইছুঁই। আকাশে কালো মেঘ করে আছে সকাল থেকেই। দুপুরে এক পশলা ঝড় বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যেকোনো সময় আবার বৃষ্টি আসবে।
অনিকেত আমার বর। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। বিকেল বিকেল অফিস থেকে ফিরে যায় বাড়ি। আজ মনে হয় আটকে গেছে অফিসের চাপে। আমি মিলি, মিলি মুখার্জি। হাউজ ওয়াইফ, নিজের বাড়ির কাজ নিজেই করতে ভালোবাসি। তাছাড়া তেমন বিশ্বস্ত কাউকে পাইনি এখনো। আসলে অনির অফিস থেকে হঠাৎ করেই ট্রান্সফার হয়ে গেলো দার্জিলিঙে। এই সবে ছ’মাস হলো এসেছি কলকাতা থেকে এখানে।
হিমেল হওয়া গায়ে মেখে সবুজে ঘেরা পাহাড়, গাছ গাছালি, পাখিদের কিচির মিচির দেখেই সময় কেটে যায় বেশ। এখন যে বাড়িটায় থাকি, শুনেছি এককালে কোনো এক সাহেবের বাংলো ছিলো। বাড়িতে ঢোকার সময় গেটে সেই সাহেবের নেমপ্লেটটা এখনো রয়েছে। তবে তার নাম ধাম সবই অস্পষ্ট।
একসময় নাকি বাংলোটা পরিত্যক্ত অবস্থাতেই ছিলো। পরে মেরামত করা হলেও একটু নিরিবিলি জায়গায় বলেই হয়তো কেউ থাকেনি। অনির অফিস থেকে আমাদের জন্য অন্য কোয়ার্টার ঠিক করে রেখেছিলো। কিন্তু যেদিন আমরা এলাম শোনা গেলো ওই কোয়ার্টারে গত রাতে কোনো কারণে জলের পাইপ ফেটে গেছে। পাইপ সারাতে বেশ কদিন সময় লাগবে। তারপর অনির এক বন্ধু মারফত কদিনের জন্য জন্য এই বাংলোটায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। প্রথম প্রথম গা ছমছম করতো, তারপর থেকে আমারও বাড়িটার ওপর অদ্ভুত মায়া পড়ে গেলো। আমি আর যেতে চাইলাম না কোয়ার্টার। আমার জেদে বাধ্য হয়েই অনি একপ্রকার এখানে থেকে যেতে রাজি হলো।
বাংলোটা খুব বড়ো নয়। ঢোকার জন্য চওড়া গেট, যদিও তাতে মরচে ধরেছে। গেট খুলতেই ইট বাঁধানো পথ, দশ বারো পা এগোলেই কাঠের সিঁড়ি দিয়ে চারটে ধাপ উঠে গেলেই ছোট্ট বারান্দা। ভেতরে বড়ো বড়ো চারটে ঘর, ওপেন কিচেন। বেডরুম লাগোয়া পূর্বদিকে আরও একটা বারান্দা আছে। বাড়ির সামনের জায়গাটায় আগাছায় ভরে ছিলো। লোক দিয়ে সব পরিষ্কার করিয়েছি। নিজের হাতে বাগান বানিয়েছি। ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে এখন বাগানটা। সারাদিন এসব করতে করতেই সময় কেটে যায়। আর আছে টমটম। যেদিন প্রথম এসেছিলাম এখানে, সেদিন রাতে খুটখাট শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলে দেখি, জানালাটা হাট করে খোলা। অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম একটা বেড়াল ঢুকে আসছে ভেতরে। অবাক হলাম, জানালা বন্ধ করেই শুয়েছি, খুলে গেলো কিছু করে? অনি তখন গভীর ঘুমে। ডাকলাম,
— “অনি আই অনি ওঠো”
ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো ও,
— “অ্যা কি হয়েছে?”
— “জানালাটা আটকাও নি?”
অবাক হলো অনিও। খানিক ভেবে বললো,
— “বোধহয় ছিটকিনিতে সমস্যা আছে। দাঁড়াও আবার আটকে দিই।”
আমি বললাম,
— “একটা বেড়াল এসে ঢুকেছে ঘরে, কোথায় লুকোলো দেখোতো!”
ঘুমচোখে অনির আর বেড়াল খোঁজার ইচ্ছে নেই, বললো,
— “বাদ দাও, বেড়াল কি আর করবে, সকালে দেখো।”
রাতে আর সমস্যা হয়নি। তবে সকালে উঠে আর বেড়ালটাকে খুঁজে পাইনি।
পরদিন সন্ধ্যের দিকে কফি নিয়ে বসেছিলাম বারান্দায়। দেখি ল্যাজ তুলে বেশ নাদুস নুদুস লোমওয়ালা একটা কালো বেড়াল কোত্থেকে এসে হাজির পায়ের কাছে। সেদিন আদর করে খেতে দিলাম। তারপর থেকে আমার কাছেই থাকে। ওরই নাম দিয়েছি টমটম। এমনিতে খুব শান্ত, তবে ওর চোখের দিকে তাকালে গা শিউরে উঠবে। প্রথম প্রথম আমিও ভয় পেতাম, এখন অবশ্য ভালো লাগে।
বাড়িটা মোটের ওপর বেশ ভালো। অনির অফিস থেকে একজন কেয়ার টেকারের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। বাহাদুর, স্থানীয় নেপালি ছেলে। ভীষণ সহজ সরল। বাজার ঘাট করে দেয়, মাঝে মাঝে এসে খোঁজ খবর নিয়ে যায়। রোজ সন্ধ্যে হলে আসে, আমি চা জলখাবার খাবার দিই। আশেপাশের খবর নিই, ওর নিজের গল্প বলে আধো আধো বাংলায়, আবার আমিও কলকাতার গল্প বলি ওকে। বাহাদুর হাঁ করে শোনে। কখনো হেসে গড়িয়ে পড়ে। ওর মুখের সামনের দিকে একটা দাঁত নেই। ওর ফোকলা হাসি দেখে আমিও হেসে উঠি। একবার নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছিলো ওর, পাহাড়ি রাস্তায় সাইকেলের চাকা স্লিপ করে খাদের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছিলো। কপাল জোরে বেঁচে গেছে সে যাত্রায়। অবশ্য পা ভেঙেছিল, মুখে চোট পাওয়ায় দাঁত ভেঙে যায়। সেই থেকে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে বাহাদুর।
এখন রাত সাড়ে ন’টা। এককাপ কফি খেয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। এখানে সামান্য বৃষ্টি এলেই লোডশেডিং হয়ে যায়। ইনভার্টারটাও কাজ করছে না কেন জানিনা। মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে আছি। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাহাদুরও কি জানি আজ সন্ধ্যেতে কেন এলোনা। টমটমেরও পাত্তা নেই। এমনিতেই পাহাড়াঞ্চল তার ওপর বৃষ্টি। অনিকে যে কল করবো উপায় নেই, নেটওয়ার্ক কাজ করছে না। কেমন গা ছমছমে পরিবেশ। আগে আমি ভীষণ ভীতু ছিলাম। এখন আস্তে আস্তে ভয়ডর কাটিয়ে উঠেছি। বরং আমার তুলনায় অনিই ভীতু। রাতে বাইরে কোথাও খুট খাট আওয়াজ পেলে আমাকেই লাইট নিয়ে উঠে দেখতে হয়। অনির সাহস নেই। এই নিয়ে ওকে মাঝে মাঝেই রাগাই। এই বাংলো বাড়িতে এতদিন কেন এতদিন কেউ থাকেনি সেটা নিয়ে ওর নাকি সন্দেহ হয়। আমি হাসি ওর কথা শুনে। প্রথম দিকে বাহাদুর বলেছিলো,
— “ম্যাডামজী, এই বাংলোতে যাদা দিন না থাকবেন। লোগ বোলতা হ্যায় রাত মে ইস বাংলো মে আত্মা কা সায়া দিখাই দেতা হ্যায়।”
আমি একটু ভয় পেলেও মুখে হাসি রেখেই বলেছিলাম,
— “বেশ তো আমিও দেখবো তাহলে।”
আমার কথা শুনে বাহাদুরও হেসেছিলো সেদিন।
একদিন ধুলো ঝাড়তে গিয়ে পুরোনো একটা আলমারির কোণ থেকে পাই একটা ডাইরি। ডাইরির প্রথম পাতায় নাম লেখা গিরীন্দ্রশেখর মুখার্জি। সম্ভবত তারই লেখা। সেখান থেকেই জানতে পারি, কোনো এক হ্যানরি সাহেবের বাংলো ছিলো এটা। চা বাগানের ম্যানেজার হিসেবে এসে এই বাড়িটি বানান। সঙ্গে ছিলেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী মারিয়ান, আর বেড়াল লুসি। লুসিকে ভীষণ ভালোবাসতেন হ্যানরি সাহেব। কিন্তু মারিয়ানের ভীষণ অপছন্দ ছিলো বেড়াল। শান্ত শিষ্ট লুসিও হ্যানরির কাছ ছাড়া হতোনা। একদিন সুযোগ বুঝে লুসির খাবারে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। ঘন্টাখানেকের মধ্যে এলিয়ে পড়ে লুসি। হ্যানরি সাহেব ভেবেছিলেন এ বুঝি স্বাভাবিক মৃত্যুই। প্রিয় লুসিকে সমাধিস্থ করেন বাড়ির পেছনের খোলা মাঠটায়। সমাধিস্থলকে সাদা মার্বেল পাথরে মুড়ে দেন।
তারপর সব স্বাভাবিকই চলছিলো। একদিন বিশেষ কাজে শহরে যান হ্যানরি সাহেব। রাতে বাড়ি ফিরে দেখেন ঘরে রান্নাঘরে স্ত্রীর অচৈতন্য দেহ। সাড়া শরীরে জন্তুর তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়। লালচে ভয়ার্ত চোখদুটো যেন বেরিয়ে আসছে। মিনিটখানেক গোঙানোর পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মারিয়ানা। লুসির কবরের পাশেই সমাধিস্থ হন তিনি। প্রিয়তমা স্ত্রীর সমাধি বড়ো সুন্দর করে বাঁধিয়েছিলেন হ্যানরি সাহেব। ওপরে একটা সুন্দর শ্বেতপাথরের পরীর মূর্তি বসিয়েছিলেন। তার নিচে লেখা ছিলো একটি কবিতা,
“Come and hold me out;
Darling I’m still waiting for you,
Come back wherever you are, oh beloved.”
তারপর কোথায় যেন চলে গেছিলেন তিনি। কোথায় গেছেন কেউ খোঁজ পায়নি তার।
ইতিমধ্যে কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর। বাগানের নতুন ম্যানেজার এনেছিলেন জেমস অ্যান্ডারসন। তাকে থাকার জন্য দেওয়া হয় এই বাংলো বাড়িটা। তিনিও পরিবার নিয়ে থাকতে এসেছিলেন। প্রায়ই রাতে কানে ভেসে আসতো একটা গান। গানের উৎস না পেয়ে বিশেষ পাত্তা দেন নি। এছাড়া আর কোনো সমস্যা তো ছিলোনা। তবে তার একমাত্র ছেলে দিনদিন কেমন শান্ত হয়ে যেতে থাকে। একদিন হঠাৎ ওর শুরু হয় ভীষণ জ্বর আর ভেদবমি। সেসময়টায় কালাজ্বরের প্রাদুর্ভাব ছিলো ভীষণ। চিকিৎসক প্রথমে ভেবেছিলেন জ্বরের কারণেই বমি। তবে ঘণ্টাখানেক পরই শরীর নীল হয়ে ওঠে ওর। মারাও যায়। জানা যায় বিষক্রিয়া হয়েছিলো শরীরে। সকলে অনেক ভেবেও বিষের উৎসস্থল পায়নি। প্রিয় পুত্রকে সমাধিস্থ করতে গেছিলেন পেছনের সেই সমাধিক্ষেত্রেই। কিন্তু সকলে আশ্চর্য হলেন। কেননা মারিয়ানের সমাধির ঠিক পাশেই আর শায়িত একটি সমাধি। কার সমাধি কেউই বলতে পারলো না।
এরপর জেমস অ্যান্ডারসন এ বাড়ি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেইমতো বন্দোবস্তও করেছিলেন। তবে যাবার দিন সকালে গাড়ির ড্রাইভার ওদের খুঁজে না পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখে স্বামী- স্ত্রীর রক্তাক্ত দেহ।
এরপর ভুতের বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায় এই বাংলোটা। আর কেউ পা মাড়ায় নি। লোক মুখে ছড়ালো, একটা রাতও এবাড়িতে কেউ কাটালে সে নাকি মারা যায়।
বহুদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার পর দার্জিলিং-এ বেড়াতে আসেন যুবক ফেড্রিক চার্লস জনসন। তার কৌতুহল জাগে বাড়ীটার ওপর। এই বিষয়ে খোঁজখবর শুরু করতে গিয়ে বন্ধুত্ব হয় একজন বাঙালির সাথে, তার নাম গিরীন্দ্রশেখর মুখার্জি। তারা সিদ্ধান্ত নেন এখানে এসে কাটাবেন কিছুদিন। অনেকে বারণ করেছিলো, কিন্তু শোনেননি তারা।
এই গিরীন্দ্রবাবুর অলৌকিকতা সম্পর্কে কৌতূহল ছিলো বেশ। ভূত প্রেত আত্মার সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। বেশ কিছু তন্ত্রমন্ত্রের সাধনাও জানা ছিলো তার। আত্মাকে বশীভূত করার চেষ্টায় রত ছিলেন। রক্ষা কবচ হিসেবে ঝোলায় রাখতেন কিছু জড়িবুটি, মাদুলি। তাই হ্যানরি সাহেবের বাংলোর ব্যাপারটা জানতেন, তবে একজন সঙ্গী না পেয়ে আসার সাহস পাননি। এইবার চার্লসকে সঙ্গী পেয়ে নির্দিষ্ট দিনে দুই বন্ধু রওনা দিলেন গন্তব্যে। বাকি কথা ডাইরির পাতা থেকেই তুলে ধরছি।
১২/০৪/১৯২৭
“এখন অপরাহ্ন, চারটে বেজে পাঁচ। খানিকপরেই অন্ধকার নেমে আসবে। মধ্যাহ্নকালেই পৌঁছে গেছি বাংলোটায়। সঙ্গে তেমন কিছু নিইনি। টর্চ, তাস, মোমবাতি, মাদুর, সিগারেট, আর আমার কিছু জড়িবুটি, হ্যাঁ একটা বিশেষ বই ও আছে, জলের বোতল, দেশলাই। আর কিছু শুকনো খাবার।
বহুদিন যাবৎ কেউ প্রবেশ করেনি বলেই জঙ্গলে ভরে ছিলো বাংলোটা। ভেতরে ঢুকতেই বেশ বেগ পেতে হলো। এখানে স্থানীয় একটি ছেলের সাহায্যে জঙ্গল সাফ করে ঢুকতে পেরেছি। ভেতরের অবস্থা আরও শোচনীয়। মানুষের থাকার অযোগ্য বললেই চলে। আমরা মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে থাকার বন্দোবস্ত করেছি। এখানে ভূতের থেকে সাপখোপের ভয় বেশী। বন্ধু চার্লস কি একটা ইংরেজি বই পড়ছে। এখন দেখা যাক।”
১৩/০৪/১৯২৭
“গতরাতে কম ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেনি। কাল ডাইরি লেখা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। ইচ্ছে হলো সমস্ত ঘরগুলো ঘুরে দেখি। ভুতুড়ে বাড়ি বলে আসবাবগুলো সবই প্রায় রয়েছে। চোর পর্যন্ত আসার সাহস পায়নি। আমরা যে ঘরটায় ছিলাম সেটা বোধহয় ড্রইং রুম ছিলো। অন্য ঘরগুলোর সব দরজা বন্ধ। এগিয়ে গিয়ে আলতো ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো। একরাশ ধুলো উড়ে এলো গায়ে। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে পিছিয়ে এলাম খানিক। চার্লসকে ইশারায় ডাকলাম। উঠে এলো সে ও। ঘরটায় বড়ো খাট। বিছানায় তোশক বালিশ সবই আছে। তবে পোকায় কাটা, ধুলোমাখা। এককোণে একটা পেল্লাই সাইজ আলমারি। পাশে গোল টেবিল সাথে দুটো চেয়ার পাতা। টেবিলের ওপর একটা ফুলদানি রাখা। কোনো এককালে রোজ টাটকা ফুল থাকতো তাতে। আর কোণে একটা পিয়ানো। আগেই জেনেছিলাম মারিয়ান ভালো গাইতেন। হয়তো এটা তারই।
ধুলো ঝেড়ে পিয়ানোর রীডে হাত দিতেই সজোরে বেজে উঠলো পিয়ানো। সেই শব্দে ঘরটাও কেঁপে উঠলো। একটা বড়ো বাদুড় কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেলো। হঠাৎ অনুভব করলাম বাতাস কেমন ভারি হয়ে আসছে। সম্ভবত বন্ধ ঘর বলেই। চার্লসের গলায় কিছু একটা ঝাপটা দিতেই চিৎকার করে ঝটকা মারলো তৎক্ষণাৎ। আমরা ঝটপট বেরিয়ে এলাম ঘরটা থেকে।
পাহাড়ি এলাকা তাই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো। মোমবাতি জ্বালালাম। ভাবছি সিগারেটটা ধরাবো ওমনি পাশের একটা ঘর থেকে ঝনঝন শব্দ ভেসে এলো। ঠিক যেন বাসন গড়িয়ে মেঝেতে পড়ছে। হাতে টর্চটা নিয়ে দৌড়ে গেলাম। পেছন পেছন এলো চার্লস। ঘড়িতে তখন আটটা।
এই ঘরটায় এখনো ঢুকিনি। পূর্ব অভিজ্ঞতা স্মরণ করে নাকে রুমাল চাপা দিলাম। দু তিনবার ধাক্কা দিতেও দরজা খুললো না। ভেতরে তখনও বাসন পড়ার শব্দ। চার্লস এবার সজোরে লাথি দিতেই কড়মড় করে সশব্দে দরজা খুলে গেলো। কিন্তু আশ্চর্য, এখানে একদম ধুলো নেই। ঘরটা একদম পরিষ্কার। যেন সদ্য কেউ ধুয়ে মুছে দিয়ে গেছে। খাটে নরম সাদা বিছানা পাতা। একপাশে একটা ইজি চেয়ার। সামনে একটা টেবিলে ঝুড়িতে রাখা ফল। পাশে একটা শোকেসে সাজানো দামী দামী চিনে মাটির শো পিস। আমি জানি এ সময় ভয় পেলে একদম চলবে না। বাম হাতে একটা দুর্মূল্য শেকড় ধরেই রেখেছিলাম। এতে কোনো প্রেতাত্মা ছুঁতে পারেনা। চার্লসের হাতেও দেওয়া আছে। বলে দিয়েছি কোনো অবস্থাতেই যেন হাতছাড়া না করে ওটা।
যাই হোক, সে ঘরে ভয়ঙ্কর কিছু চোখে পড়লো না। এই ঘর লাগোয়া একটা বারান্দা আছে। আমরা সেটায় গিয়ে দাঁড়াতেই গা হিম হয়ে গেলো। এখান থেকে স্পষ্ট চোখে পড়ে সমাধিক্ষেত্রটা। দিনের আলোয় দেখেছিলাম জঙ্গলে ভরে আছে কিন্তু এখন একদম পরিষ্কার। দূর থেকে দেখা গেলো অস্পষ্ট তিন জন মানুষ দাঁড়িয়ে ওখানে। দু’জন মহিলার অবয়ব। আর দুটো কবর খোঁড়া হচ্ছে সেখানে, একটা লাশ কাঁধে করে নিয়ে এলো দু’জন। কিছু বোঝার আগেই হাঁক দিলাম,
‘চার্লস, জলদি বেরিয়ে চলো এখান থেকে’
পেছন ফিরে দেখি চার্লস নেই। জোরে চিৎকার করলাম
‘চার্লস…চার্লস… চার্লস…’
আকাশ বাতাস ভেদ করে সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো আমার কাছে।
মেঝের দিকে চোখ গেলো, দেখি সেই শেকড়টা মাটিতে পড়ে। বুঝলাম ভয় পেয়ে হাত থেকে পড়ে গেছিলো। কিন্তু গলায় তো মাদুলি দিয়েছিলাম। সেটা থাকলে তো ওর ক্ষতি হবার কথা নয়। দৌড়ে গেলাম সেই পিয়ানোর ঘরে। টর্চের আলো ফেলে দেখলাম যা ভেবেছি তাই। চার্লসের মাদুলিটাও পড়ে আছে নিচে। তার মানে গলায় ঝাপটা মেরেই অশরীরী মাদুলিটা খুলে নিয়েছে। চার্লসের জন্য খুব মন খারাপ হলো।
তখন রাত দশটা প্রায়। চারদিকে জংলী পোকার একটানা আওয়াজে আমার তখন মাথা যন্ত্রণা আরম্ভ করে দিয়েছে। বিকেলে তাস খেলেছিলাম চার্লসের সাথে। একটু চালাকি করে ওকে হারিয়ে দিয়েছিলাম বলে ক্ষেপে উঠেছিলো। বলেছিলো, পরের বার ও জিতে দেখিয়ে দেবে। ওর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো বারবার। তাসগুলো মাদুরের ওপর এখনো ছিটিয়ে রাখাই আছে। আসার আগে চার্লস কিছু কেক কিনেছিলো। ওর পড়ে থাকা ব্যাগটা থেকে বের করে গিললাম ক টুকরো। তারপর ঢকঢক করে জল খেয়ে একটু স্থির হয়ে বসলাম। এখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে আমাকে এগোতে হবে। আমার বন্ধুকে কেড়ে নিয়েছে ওরা। জেদ চাপলো, ওদের জব্দ না করে আমি এখান থেকে নড়বো না।
আমার সেই বিশেষ বইটা খুলে বসলাম। এখানে যে প্রেতাত্মা আছেই সেটা নিশ্চিত, সুতরাং আমার করণীয় কিকি সেগুলো আরও একবার ঝালিয়ে নিতে হবে বইটা পড়ে। বইটা আমার গুরুর দেওয়া। উনি ছিলেন বিখ্যাত তান্ত্রিক। ভূত প্রেত ছিলো ওনার কুক্ষিগত। ওঁনার কাছেই এসব বিদ্যে আমার শেখা। আমি যতটুকু শিখেছি, তাতে আমার কোনো ক্ষতি ওরা করতে পারবে না।
চার্লসকে নিয়ে যাওয়ার পর আর কোনো শব্দ পাইনি। আমি সারারাত ঠায় বসেছিলাম যদিও। শেষে ভোরের দিকে চোখ লেগে যায়। ঘন্টাখানেক ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ চোখে জলের ঝাপটায় ঘুম ভেঙে যায়। উঠে ভয়ানক চমকে গেলাম। এ কি দেখছি! জলজ্যান্ত চার্লস বসে আমার সামনে! আমাকে ডাকছে। চার্লসকে ফিরে পেলাম বটে। তবে খটকাটা মনে রয়েই গেলো।
চার্লস যদি বেঁচেই থাকে তাহলে কাল রাতে কোথায় গেছিলো? কবরে যে লাশটা পোঁতা হচ্ছিলো ওটা তাহলে কার? আমি খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি ওকে। তবে কোনো চিহ্নই পাচ্ছিনা। অবশ্য আমার কাছে পরীক্ষা করার উপায় আছে। তবে রাত না হলে ওসব কাজ করেনা।
আমি জানি কিছু প্রেতাত্মারা কার্যসিদ্ধির জন্য মনুষ্য রূপ ধারণ করে থাকে। এরা জীবিত সঙ্গীকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে চায়। সে কারণে পূর্বের মনুষ্য রূপ ধরে ফিরে আসে সঙ্গীর কাছে। যে কোনো উপায়ে তাকে নিয়ে তার যেতেই হবে। আর যদি ব্যর্থ হয়, কোনো না কোনো উপায়ে টেনে আনে তার বংশের কাউকে। সেই ব্যাক্তি বা তার বংশের কারো রক্ত না পেলে কোনোভাবেই এই অতৃপ্ত আত্মারা শান্ত হয়না।
আপাতত লেখা বন্ধ করছি। আজ রাতে কি ঘটে এখন সেটাই দেখার।”
ডাইরির লেখা এখানেই শেষ। পরের পাতাগুলো সাদা। গিরীন্দ্র বাবুর পরিণতি কি হলো সে বিষয়ে জানা হলো না। তবে বাহাদুরের মুখে শুনেছি শেষবার যে দু’জন এসেছিলো তাদের মধ্যে বিদেশি লোকটার লাশ পড়েছিলো কবরের কাছে। তবে গিরীন্দ্রবাবুর হদিশ মেলেনি। তবে খুব সম্ভবত তিনি পালিয়ে বেঁচেছিলেন। বোধকরি ডাইরিটা নিয়ে যাওয়ার আর সুযোগ পান নি।
এদিকে বৃষ্টির বেগ বেড়েই চলেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। কখন রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে খেয়াল করিনি। টমটম কোথায় বেপাত্তা কে জানে। ও থাকলেও সঙ্গ মেলে। কিন্তু আর তো বসে থাকা যায়না! ঝড় জলের রাত, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলো না তো! কেন যে এখানে থেকে গেছিলাম এখন পস্তাচ্ছি। কোয়ার্টারে গেলে অন্তত বাড়ির কাছেই অফিস হতো। কাছাকাছি কিছু মানুষকেও পেতাম। এখন কোথায় যাবো ভেবে পাচ্ছিনা। কোথায় গিয়েই বা খোঁজ করবো ছেলেটার। দুশ্চিন্তায় চোখে জল আসছে।
অনির জন্য চিকেন পকোড়া বানিয়েছিলাম। খেতে খুব পছন্দ করে ও। বলেছিলো বাড়ি এসে কফি দিয়ে খাবে। কোথায় এখন অনি?
ঘরময় পায়চারি করতে করতে মনে আসছিলো পুরোনো দিনের কথাগুলো। সেই আমাদের কলেজের দিন। অনি ছিলো সিনিয়র। আমাদের ফ্রেশার্স এর দিনই আমাকে গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করেছিলো ও। মনে আছে মায়ের একটা আকাশী রঙের শাড়ি পরে গেছিলাম সেদিন। অবশ্য প্রথমেই অনিকে ‘হ্যাঁ’ বলিনি। আসলে প্রেম করতে ভয় পেতাম খুব। আমার বাবা যা রাগী। মেয়ে প্রেম করছে জানলে খুনই করে ফেলবে। তারপর আস্তে আস্তে দিন গেলো কলেজে লুকিয়ে ওকে দেখতাম। খুব হেল্পফুল ছেলে ও, কতো গরীবদের বই কিনে দিতো। আমাকে কোনোদিন জোর করেনি ভালোবাসার জন্য। আমরা বন্ধু হয়েই ছিলাম, ঘুরতাম, পার্কে যেতাম। আস্তে আস্তে কবে যে আমি ওর প্রেমিকা হয়ে উঠলাম টেরই পাইনি।
এরপর বি টেক করে ও এম. টেক করতে বাইরে চলে গেলো। আমিও বি. টেক কমপ্লিট করে একটা ছোটোখাটো চাকরিতে ঢুকলাম। তারপর আস্তে আস্তে বাড়িতে জানানো হলো আমাদের সম্পর্কের কথা। বাবাও অনিকে ভালো পাত্র দেখে রাজি হয়ে গেলো। ব্যস এই তিন বছরের আমাদের সংসার। কিন্তু অনির কি হলো?
এখন রাত একটা বেজে দশ। নাহ অনি ফেরেনি। বৃষ্টির বেগ একটু কমেছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। জল খেতে রান্না ঘরে গিয়ে খোলা জানালার দিকে চোখ যেতেই চিৎকার করে উঠলাম। বাইরে দেখি হ্যাট কোট পরে দাঁড়িয়ে একজন বিদেশি। আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসছে। ভয়ে দৌড়োতে দিকবিদিক শূন্য হয়ে দৌড়োতে লাগলাম আমি। “অনি… অনি… অনি…”
ছুটতে ছুটতে এসে দাঁড়ালাম কবরস্থানে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম হ্যাট কোট পরা সেই লোকটি ভেজা মাটি খুঁড়ছে। টমটম দাঁড়িয়ে ওর পাশে। আমাকে দেখতে পেয়েই দৌড়ে উঠে গেলো লোকটার কাঁধে। আমি চিৎকার করলাম,
“কোথায় আমার অনি?”
মুহূর্তে দেখতে পেলাম দু’জন বীভৎস রক্তাক্ত চেহারার, চোখগুলো যেন তাদের খুবলে খাওয়া। তাদের কাঁধে চেপে আসছে একটা মৃতদেহ। আমার পায়ের কাছে নামিয়ে দেওয়া হলো বডিটা। রক্তমাখা মুখটা দেখে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম,
“অনি…………..”
আশেপাশের সবগুলো সমাধি থেকে উঠে এলো ভয়ঙ্কর চেহারার প্রেতাত্মারা একে একে। মারিয়ান, অ্যান্ডারসন তার ছেলে, স্ত্রী, চার্লস, বাহাদুর সকলে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হিহি হিহি করে হেসে উঠলো, আমার কাঁধের ওপর লাফ দিয়ে দাঁড়ালো টমটম ওরফে লুসি।
বাংলোতে যেদিন প্রথম এলাম, সেদিন রাতেই যথেষ্ট অবাক হয়েছিলাম বন্ধ জানালা হঠাৎ খুলে গেছে দেখে। তার পরদিন রাতে এক মেয়েলি কণ্ঠস্বর কানে আসতেই শব্দের পিছু পিছু অনুসরণ করতে করতে হোঁচট খেয়ে পড়েছিলাম এই কবরের ওপর। দেখলাম কি অমানুষিক দৃশ্য, মনে হলো যেন নিমেষে শরীরের রক্ত সমস্ত শুষে নিচ্ছে কেউ। সঙ্গে সঙ্গে আমি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরতেই দেখি নতুন জগতে হাজির আমি। সবকিছুই সবকিছুই যেন অপরিচিত। একে একে পরিচিত হই মৃতদের সাথে। চলাফেরা, ওঠাবসা, বন্ধুত্ব এখন আমার এদের সাথেই। শুধুমাত্র অনিকে আনতে পারছিলাম না। অনির ক্ষতি করা সহজ ছিলোনা। ও যে গিরীন্দ্রশেখর মুখার্জির বংশধর। কোনো এক দৈবিক শক্তি ছিলো ওর ওপর। তবে আজ আমরা সফল।
রাতে ডিনার টেবিলে বসেছি। অনি আজ আমাদের নতুন সদস্য। সকলের সাথে অনিও খুলবে খাচ্ছে ওরই রক্তাক্ত মৃতদেহটা। দেখে আমি সজোরে হেসে উঠলাম। হেসে উঠলো সব অশরীরীরা। শুধু লুসি আমার কানের কাছে এসে বললো, “মিউ।” * * *