সারারাত জেগে ভোরের দিকে একটু ঘুমের ঘোর এসেছিল৷ সারারাতের গরম বাতাস কেটে শেষ রাতে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া পড়েছিল, তাই একটু চোখ নিভিয়েছিলাম৷ ঘুম জড়ানো চোখে সটান বিছানায় বসে পরলাম, সমস্ত শরীর জুড়ে ঘুম কাতুরে অবশ ভাবটা এখনও বিদ্যমান আছে৷ বাইরে আলো ফুটছে। জানলার শিক গলে সেই আলো মেঝেতে আছড়ে পড়ছে৷ এই যাহ্ সেরেছে। রান্নার সময় যে হয়ে এল। তাড়াতাড়ি উঠে কেরোসিন স্টোভে ভাত চড়িয়ে বিছানার পাশে বসে পড়লাম। কদিন হল দক্ষিণ দেওয়ালের ঘুলঘুলিতে চড়ুই পাখির কটা ছানা ফুটেছে৷ মা পাখি আর বাচ্চার কিচিরমিচির ডাক শুনতে পেলাম৷
এলাকায় নতুন এসেছি পথঘাট তেমন একটা চিনি না৷ শিক্ষকতা পেশার সুবাদে এখানে আসা৷ কিছুদিন হল এখানে একটা স্কুলে জয়েন করেছি। একদম গ্রামের মধ্যে স্কুলটা। ভাওয়াল অঞ্চল হওয়ায় চারিধারে বন জঙ্গলে ভরা। প্রথমত ভৌগলিক অবস্হান আর দুরত্বের কথা চিন্তা করে এখানে আসতে চাইছিলাম না। আমি ছোট থেকেই মফস্বলে বড় হয়েছি, তাই গ্রামের প্রতি ভালবাসা থাকলেও গ্রামে বসবাস করার মতো মানুষিকতা ছিল না। তাই এখানে আসার আগে নানান চিন্তাভাবনা মাথায় এসে ঘুরপাক খাচ্ছিল। শেষমেষ এসব চিন্তাকে উপেক্ষা করেই একদিন ভালো সময় দেখে ট্রেনে চড়ে বসলাম। এখানে এসে দেখি ব্যাপারটা একদম উল্টো। গ্রামটা একদম জেলা শহরের উপকণ্ঠে। চারদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। স্কুলের খানিক পাশেই রেল স্টেশন। চারদিকে মোটামুটি পাকা রাস্তা। কয়েক পা এগোলেই একটা ছোট নদী। নদীর পাড় ঘেঁষেই গ্রাম্য বাজার।
আমার আসার খবরে স্কুলের হেড মাষ্টার আর গ্রামের মেম্বার আমার থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। স্কুলের পাশেই একটা ঘরে আমার থাকবার জায়গাটা। রান্নাকরা, কাপড় ধোয়া, বাজার করা বিস্তর কাজ আমাকেই করতে হয়। রান্না তেমন পারি না। সেজন্য পোড়া,
আধসেদ্ধ খাবারেই পেট ভর্তি করতে হয়। তবুও ভালোই লাগে। নিজের মাঝে কেমন একটা সংসারী আমেজ টের পাই।
সকাল দশটায় বেড়িয়ে ক্লাস শেষে ফিরতে ফিরতে বিকেল পাঁচটা। শেষ বিকেলটুকু কাটানোর জন্য মাঝে মাঝে রেললাইনে গিয়ে হাঁটি নয়তো গ্রামের বাজারটাতে গিয়ে চায়ের বাটিতে চুমুক দিই। কাঁচা বাজারটাও এখান থেকেই করি। এখানে বেশ টাটকা সবজি পাওয়া যায়।
আজ কদিন রফিক ডাক্তারের সাথে ভাব হয়েছে। তিনি ভারি সজ্জন ব্যক্তি। বাজারের একদম দক্ষিণ পাশে একটা ছোট ঘরে রফিক সাহেব তার চিকিৎসা কাজ চালান। এই অচেনা দেশে একজন অন্তত কথা বলবার লোক পেয়ে বেশ ভালোই লাগে। নানা প্রসঙ্গে বেশ আড্ডা জমে তাঁর সাথে। বলা বাহুল্য আমার আবার পত্রিকা পড়ার বেশ ঝোঁক। বিশেষ করে সাহিত্য পাতাটা পড়া চাই-ই-চাই। এই বাজারে একমাত্র রফিক ডাক্তারই পত্রিকা নেন। তাই পত্রিকা পড়ার লোভেই হোক কিংবা তার সাথে গল্প করবার লোভেই হোক তাঁর দোকানে আমার নিত্য যাতায়াত। তবে পত্রিকা পড়ার লোভের কথাটা যদি বলে থাকি তবে সেটা বাসি পত্রিকা। কারণ বিকেল পাঁচটার আগে এদিক পানে আসা হয়না। আর যখন আসি গরম খবর ততক্ষণে ঠাণ্ডা হয়ে বাসি হয়ে যায়।
আজ কদিন প্রচণ্ড রকমের গরম পড়ছে। বাইরে বেরোলে মনে হয় আকাশ থেকে অগ্নিবর্ষণ শুরু হয়েছে। গরমের দাপটে সকাল থেকে বিকেলের আগে পর্যন্ত সমস্ত প্রাণীকুল হাঁসফাঁস করে। এই গরমে ক্লাস শেষ করে বাসায় যখন ফিরি ক্লান্তিতে শরীরটা তখন একদম নেতিয়ে পড়ে। অলসতা জুড়ে যায় সারা শরীরে। তাই আজ কদিন রফিক ডাক্তারের দোকানে বসা হয়না। টুকিটাকি কাজ সেরে বিছানায় উপরে শরীরটা এলিয়ে দিই। আমার রুমের পেছন বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেত। খোলা জানালায় তার অপরুপ শোভায় আমার দু নয়নের খিদে মিটিয়ে চলে।
আজ কদিন একটা নতুন উপদ্রব হয়েছে।
মাঝে মাঝেই দেখি ক্লাস টেনের একটা বালিকা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি তাকালেই মেয়েটি চোখ নামিয়ে নেয়। বিষয়টা আমার জন্যে লজ্জা এবং বিরক্তিকর। ক্লাস শেষে প্রায় দিনই মেয়েটিকে দেখি আমার বাসার পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।
আমি তাকালেই মুচকি হাসে। আর সেই হাসির কোনও রহস্য খুঁজে পাই না।
আমি লক্ষ করলাম ব্যাপারটা প্রতি দিনই ঘটছে। যেটা আমার জন্যে অস্বস্তিকর। আমার সন্দেহ হল। এভাবে চলতে থাকলে শেষমেষ সম্মান নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারব তো?
আজকেও স্কুল শেষে রাস্তায় বেরিয়েছি বাসায় যাবার জন্য। কিছুদুর যেতেই দেখি সেই মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যথারীতি আগের মতোই তাকিয়ে আছে।
ভাবলাম মেয়েটা আমাকে কিছু বলতে চায়। হয়তো লজ্জা পাচ্ছে বলে বলতে পারে না। ভাবলাম আমিই না হয় গিয়ে জিজ্ঞেস করি। এই ভেবে মেয়েটার কাছে গেলাম। আমি লক্ষ্য করলাম আমার হাঁটা দেখে মেয়েটা মৃদু কাঁপছে।
এগিয়ে গিয়ে বললাম, “ কি ব্যাপার তোমার? এমন তাকিয়ে থাকো কেন?”
মেয়েটা সচকিত হয়ে বলল, “কই না তো স্যার।”
“না তো মানে কি! বেশকিছু দিন ধরেই দেখছি তাকিয়ে থাকো। আমাকে কিছু বলবে নাকি?”
“ আপনিও তো তাকান আমার দিকে।”
কি মেয়েরে বাবা। এই বয়সেই এত পাকামি শিখে গেছে। আমি কি বলব ভেবে পেলাম না। এক গাল হেসে বললাম, “ হা হা হা, বেশ কথা জানো দেখছি।
তা বলি তাকানোর কারণটা কি শুনি? কোনও সমস্যা থাকলে ক্লাসেই তো বলতে পারো “
মেয়েটা মুখে এবার অভিমানী সুর “তাকালেও কি দোষ?”
“আরেহ না, আমি কি সেটা বলেছি!!”
বললাম, “কিছুদিন ধরে দেখছি তুমি
হয়তো কিছু বলতে চাও। তা বলো কি বলবে? “
মেয়েটা কিছু না বলেই একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে ওখান থেকে ছুটে পালাল।
উফ! মেয়েটা মাথা খাচ্ছে। এই বয়সেই ফাজিলের আস্ত এক ধাড়ি হয়ে গেছে।
ইদানিং কাজের চাপটা বেড়ে যাওয়ার কারণে বেশ কিছুদিন রফিক সাহেবের সাথে দেখা হয় না। আজকে ভাবলাম একটু বেড়িয়ে আসি।
আমাকে দেখে রফিক সাহেব বেশ খুশি হলেন। আমাকে সম্বোধন করে বলল, “কি মশাই রাস্তা ভুলে এদিকে নাকি?”
“না ভাই, ইদানিং কাজের চাপে কোনও ফুরসৎ নাই, তাই ইচ্ছা থাকলেও সময় হয়না।” এক গাল হেসে উত্তর করলাম।
হঠাৎ আমার হাতে দিকে নজর পড়তেই আতকে উঠলেন রফিক। “ইশ্ এমন করে হাতটা পোড়ালেন কীভাবে?”
আমি ইতস্ততবোধ নিয়ে বললাম, “সকালে ভাতের মাড়…”
কথা শেষ করতে না দিয়ে কি যেন একটা ক্রিম লাগাতে লাগাতে বললেন, “ কতবার করে বলি এবার একটা বিয়ে করেন। কিন্তু মশাই আমার কথা তো আপনি কানে তোলেন না। বউ থাকলে এভাবে হাত পোড়াতে হত? “
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “বাদ দিন তো ভাই এসব, বিয়ে সংসার হচ্ছে একটা বালাই। এসব বালাই থেকে যতদূর থাকা যায় ততোই ভালো। “ আমার কথা শুনে রফিক সাহেব হেসে ফেললেন। তবে তাঁর হাসিতে যে সন্দেহ ঝুলে আছে সেটা তাঁর মুখের আদলই বলে দিচ্ছে।
রফিক ডাক্তার কিছু খাওয়ার বড়ি আর একটা মলম লাগিয়ে দিলেন, সেগুলো নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলাম। বিকেলটা এখন গোধূলি লগ্নে এসে পৌঁছেছে। সূর্যের রক্তিম আভায় পৃথিবীটাকে রঙিন দেখাচ্ছে। বাড়ির সামনে এসে একটু অবাক হলাম। মেয়েটার সাথে তো এখন দেখা হবার কথা নয়। মেয়েটা একদম আমার বাড়িতেই চলে এসেছে। লক্ষ্য করলাম হাতে একটা খাবারের কেতলি।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটি বলল, “ সেই কখন থেকেই দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু আপনার তো কোনও দেখাই নেই।”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “প্রতিদিন তো রাস্তায় দেখা হয়, আজকে একদম বাড়িতেই চলে এসেছ। আর তোমার হাতে ওটা কি?”
“আপনার জন্যে সামান্য কিছু খাবার এনেছি।”
“তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আমার জন্যে খাবার আনতে তোমাকে কে বলেছে?” আমি অনেকটা রেগে গিয়ে বললাম। লক্ষ্য করলাম মেয়েটা সামান্য বিচলিত হল না। বরঞ্চ লজ্জা-হীনভাবে বলল, “আপনি হাত পুড়িয়ে ফেলেছেন বলে মাকে বলে আপনার জন্যে রান্না করিয়ে আনলাম। “
মেয়েটার কথায় আমার অবাক হওযার মাত্রাটা আরও বেড়ে গেল। মেয়েটা নিশ্চয়ই আমাকে ফলো করে নতুবা আমার হাত পুড়েছে একথা রফিক ডাক্তার ছাড়া কেউ জানে না। কোনও সাত – পাঁচ না ভেবেই বলে ফেললাম। “ যা শুরু করেছ তা কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমার জন্যে তোমাকে কোনও আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, সুতরাং বেশি কথা না বাড়িয়ে এগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। আর কখনও যেন এখানে তোমাকে না দেখি। “ কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে একটা দম ফেললাম। আমার কথার আঘাতে এক মুহূর্তেই মেয়েটার গৌর মুখটা পাণ্ডুর হয়ে গেল। ক্ষণিকেই সে মুখ রাগ আর অভিমানে ভরে গেল। কিছু না বলে কেতলিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে স্থান ত্যাগ করার মুহূর্তে খেয়াল করলাম অভিমানের কান্না মেয়েটির দু চোখ ভাসিয়ে দিয়েছে।
এই বলে মেয়েটা চলে গেলে আমার খুব খারাপ লাগতে লাগল। নাহ্ মেয়েটাকে এভাবে কড়া কথা শুনিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি মেয়েটি আমার প্রেমে পড়েছে। তবে এটাকে প্রেম বা ভালোবাসা কিছুই বলা যায় না। এটাকে ভালো লাগা বলে। ভুলটা বোধহয় আমারই। আমিই বোধহয় একটু বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছি। কালকে দেখা হলে মেয়েটাকে খুব ভালো করে বোঝাতে হবে।
রাতে আর রান্না করিনি। মেয়েটির আনা কেতলি খুলে দেখলাম মেয়েটির মা বেশ উপাদেয় খাদ্য পাঠিয়েছে। ছোট মাছের চচ্চড়ি, মুরগীর মাংস আর ডালের বড়া। বেশ তৃপ্তি করেই খেলাম। যদিও প্রতি লোকমা তোলার সময় মনের মধ্যে অপরাধ বোধটা খোঁচা দিচ্ছিল। খাওয়া শেষে মেয়েটাকে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ দিলাম।
পরপর তিনদিন মেয়েটা স্কুলে আসে না। মনে মনে খোঁজ করেও পেলাম না। হঠাৎ কোনও অসুখ করল নাকি মেয়েটার? নাকি আমার উপরে অভিমান করে আসে না। ভারী সমস্যায় পড়া গেল। অতটুক মেয়ের কিই বা বুদ্ধি হয়েছে। তাই বলে এভাবে আচরণ করা মোটেও ঠিক হয়নি আমার। মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করলাম।
আজকে হঠাৎই মনটা খারাপ, তাছাড়া অনেকদিন নদীর পাড়ে হাঁটা হয় না। তাই আজকে একটু নদীর পাড়ে হাঁটতে বের হলাম। সারা বিকেল নদীর পাড়ে হেঁটে গোধূলিকে বিদায় জানিয়ে সন্ধ্যার আগে বাড়ির পথ ধরলাম। ঝাঁকেঝাঁকে পাখিরা সব নীড়ে ফিরতে শুরু করেছে। একমনে রাস্তায় হাঁটছি। হঠাৎ করে মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে গেল। আমাকে দেখে মেয়েটা বেশ বিস্মিত হয়ে বলল, “স্যার! আপনি এদিকে? ‘‘
মেয়েটাকে দেখে আমিও বেশ খুশি হলাম।
“হ্যাঁ, তোমাকে দেখতে চলে এলাম,” হেসে বললাম।
মেয়েটা ঠোঁট দুটো বাঁকা করে বলল, “জ্বি না স্যার, আপনি মিথ্যে বলছেন। “
আমি আর বেশি কথা না বাড়িয়ে বললাম, “ তোমার বাড়ি বোধহয় এখানেই?”
মেয়েটা আঙুল তুলে একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, “ ওই যে বাড়িটা দেখছেন না? ওটা আমাদের বাড়ি। “
একবার সূক্ষ্ম নজরে দেখে নিলাম বাড়িটা। তারপর আবদারের সুরে মেয়েটা বলল, “চলুন না স্যার আমাদের বাড়িতে?”
বললাম, “আজ সন্ধ্যা হয়ে এল। অন্য একদিন যাব।”
কিন্তু মেয়েটা নাছোড়বান্দার মতো বলল, “ না, আজকেই যেতে হবে। আমি মা কে অনেক বড় মুখ নিয়ে আপনার কথা বলেছি।”
“কি বলেছ তোমার মাকে?”, বললাম আমি।
মেয়েটা বোধহয় একটু লজ্জা পেল। আঁচলের এক কোণা মুখে নিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, “ এই আপনি এত কষ্ট করে হাত পুড়িয়ে রেঁধে খান। আর…”
মেয়েটা কথা সম্পূর্ণ না করে থেমে গেল। আমি আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করলাম, “ আর কি? “
মেয়েটা তার উত্তর না দিয়ে হাত ধরে টানতে টানতে বলল, “ আপনার অত জেনে কাজ নেই, চলুন তো আমার সাথে।”
আমার শত আপত্তি আর অনিচ্ছা শর্তেও নাছোড়বান্দা এই মেয়েটার কাছে আমাকে আত্মসমর্পণ করতে হল। মেয়েটাকে নিরস্ত্র করা গেল না দেখে বললাম, “আচ্ছা চলো।”
মেয়েটার পিছু হাঁটতে লাগলাম। মেয়েটার বাড়িতে যখন পৌচ্ছালাম, ততক্ষণে কালি সন্ধ্যা নেমেছে। গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে সাঁঝের প্রদীপ জ্বলে উঠেছে। মেয়েটা একটা ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর মাকে ডেকে বলল, “দেখো মা কাকে নিয়ে এসেছি।”
মহিলাটা হেঁসেল ঘরে রান্না নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, ওখান থেকেই উঁকে দিয়ে বলল, “কি রে কবিতা, কে ইনি?” অন্ধকারে মহিলার চেহারাটা বোঝা গেল না শুধু কণ্ঠটা শুনলাম।
“তোমাকে আমি পরাগ স্যারের কথা বলেছিলাম না? উনি সেই মানুষ।”
“ওহ আচ্ছা, যা যা স্যারকে ঘরে নিয়ে বসতে দে।”
কবিতা আমাকে বসতে দিয়ে কোথায় যেন ছুটে পালাল। ঘরের এক কোণে টেবিলের উপরে টিমটিমে জ্বলন্ত হারিকেনের লালচে আলোয় ঘরটা আলোকিত করেছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরটাকে একবার দেখে নিলাম। কিছুক্ষণ পরে গামছা আর বদনা হাতে একটা মহিলা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। প্রথমবার বোধহয় ঠাহর করতে পারেনি। দ্বিতীয়বার আমায় দেখেই চমকে উঠে বললেন,” পরাগ, তুই এখানে?”
আমিও এবার মহিলাকে চিনতে পারলাম। আমার কপালে বিস্ময়ের বলিরেখা জেগে উঠল। সচকিত হয়ে বললাম, “রেণু তুই এখানে কি করে?”
রেণু বড় একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “এটাই আমার বাড়ি। আর কবিতা আমার মেয়ে।”
ঘোরে আমার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে উঠল। এক মুহূর্তের জন্যে যেন আমি জ্ঞান হারালাম। কি বলব বুঝে ওঠার আগেই রেণু আমাকে বলল, “পরাগ, তুই প্লিজ চলে যা। আর কোনদিন এখানে আসিস না।”
লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাওয়া অবস্থা। কিছু না বলেই বেরিয়ে রাস্তায় এলাম।
যে রেণু কিনা আমার প্রথম প্রেম ছিল। যার সাথে কতগুলো বছর একই ক্লাসে পড়েছি। আর আজ কিনা তার মেয়ে কবিতার…
কিছুই ভাবতে পারছি না যন্ত্রণায় কপালটা টনটন করে উঠছে।
তাড়াতাড়ি পা বাড়ালাম। রান্নার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। বাসায় ফিরে আবার রান্না করতে হবে।