অপেক্ষায় মোড়ানো ভালোবাসা| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | সুলতান মোহাম্মদ শাহরিয়ার নিলয়| Bengali Stories for Matured
0 (0)

ছাদে কবুতরগুলো দেখছিলাম। কয়েকটা বেশ রোগা পটকা হয়ে আছে। সামনে ইন্টার ফাইনাল। নিজের পড়া নিয়ে আছি ভেজালে, এর মাঝে  কবুতর গুলোকে একেবারেই সময় দিতে পারছি না । আজ মার্চের ০১ তারিখ হাতে সময় আছে মাত্র ১ মাস। হঠাত” নিচে ট্রাকের হর্নের শব্দ । তাকিয়ে দেখি নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। ৪ তলার ডান দিকের ফ্ল্যাটটা মাস দুয়েক ধরে খালি পড়ে আছে। নতুন পরিবার এসেছে যখন ভালোই হলো । বাবার টাকা কিছুটা বাড়ল। ৫ তলা বাড়ি, ১০টা ফ্ল্যাট । ১ টাতে আমরা থাকি , বাকি ৯টা তে থাকে ৯ পরিবার। সবগুলো কবুতর ছেড়ে আমি বাসায় চলে এলাম। আমরা থাকি ৩ তলায়, আর নতুন যারা আসল তারা থাকবে ঠিক আমাদের মাথার উপর। সারাদিন ফার্নিচার নাড়া চাড়ার শব্দে মাথা ধরে আসছিল। বিকেলে হাঁটার জন্যে বের হয়ে দেখি বেশ কিছু মালপত্র এখনো বাইরে পড়ে আছে। ভাবলাম এতো জিনিস পত্রতো আমাদেরও নেই ,ভাড়া বাসায় এতো জিনিস রাখার দরকারই বা কি । যাক আমি চলে গেলাম আমার মতো, বাসায় ফিরলাম সন্ধ্যার পর। মা তো বেশ গরম, সামনে পরীক্ষা, এখন সারাদিন থাকা উচিত পড়ার টেবিলে আর সময় হলে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে মোনাজাতে কান্না করে ভালো রেজাল্ট চাওয়া । এরপর টানা ২০ মিনিট চলল কিভাবে মা এবং খালারা পরীক্ষার আগে নামাজে বসে কান্না করত, কিভাবে ভাই-বোনেরা মিলে কম্পিটিশন করে পড়ত। কথা হলো, আমি কোনো মতে ৬০+ নাম্বার পেলে বাঁচি, কিন্তু মা চায় লেটার, মানে ৯০+। এটা কী সম্ভব! তবুও মা-র মুখে কথাগুলো শুনে পড়তে বসি ঠিকি,কিন্তু শয়তান তো আমায় ছাড়ে না । চা নিয়ে সোফায় আরাম করে বসলাম মাত্র , এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল । মা রান্না ঘর থকে বলল দরজা খুলতে , দরজা খুলতেই দেখি বোরকা পড়া এক মেয়ে দাঁড়িয়ে, জিজ্ঞেস করলাম কি চাই,

•  বাড়িওয়ালা আংকেল আছে?

আমি কি উত্তর দিবো বুঝতে পারলাম না, কারণ এতো মিষ্টি স্বর এর আগে খুব কমই শুনেছি আমি। মেয়েটার শুধু চোখই খোলা ছিলো, সেই চোখ দেখে আমি ধাঁদায় পড়ে গেলাম, কি আশ্চর্য সুন্দর চোখ দুটো । সৃষ্টির সবচেয়ে কালো চোখ হয়তো এই মেয়েরই । সে আমাকে আবার ডাক দিলো,

•  শুনছেন, আজিজ আংকেল কি বাসায় আছেন?

•  না, বাবা তো বাসায় নেই, কোনো কাজে এসেছেন?

•  জি, আমরা আজই উঠলাম, এই মাসের ভাড়াটা বাবা পাঠিয়েছে, আপনি আংকেল আসলে দিয়ে দিবেন । আসসালামু আলাইকুম।

বলে আমার দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিলো , তখন দেখলাম মুজো পড়া হাতে। খাম নিতেই হেঁটে চলে গেলো , আর আমি দেখেই থাকলাম । রান্নাঘরে গিয়ে মাকে খাম দিয়ে বললাম

•  মা , এই নাও নতুন ফ্ল্যাট এর ভাড়া। এরা তো বোধ হয় হুজুর।

•  হ্যাঁ, কোন এক মসজিদের খতিব সাহেব। ভালো মানুষ , তোর বাবার এতো পছন্দ হলো যে কোনো এডভান্সই নেয়নি। বলল মাওলানা সাহেব বাড়িতে থাকলেই বাড়িতে রহমত থাকবে । ভাড়াও ২ হাজার কম ।

•  হুজুর সলিড মনে হয় ?

•  কি ফাজিলের মতো কথাবার্তা, তুই এই মুহূর্তে যা আমার সামনে থেকে।

কি আর বলব , নতুন মাওলানার জন্য আজ আমি ত্যাজ্য! আমি পড়তে বসলাম । রাত ৮ টার দিকে ভাইয়া আসল। খাটের উপর ব্যাগ রেখেই শুয়ে পড়ল । আমি এক গ্লাস পানি এনে বললাম,

•  ভাইয়া, নতুন ভাড়াটিয়া এসে উঠলো আজকে । কি বলো , ডাকবো মাকে?

•  দৌড়দে ব্যাটা । বলতে হয় নাকি আবার?

আমি মাকে প্রায় জোর করে টেনে নিয়ে আসলাম,ভাইয়া বলল,

•  মা নতুন লোক আসল , তুমি ব্যাপার টা আমাকে জানালে না কেনো?

•  তোকে জানানোর কি আছে? তুই কে?

•  আমি কে? আমি কে? তোমার শশুর জনাব আহমেদ বুলবুল সাহেবের সবচেয়ে যোগ্য উত্তরসূরি আহমেদ ইমতিয়াজ । যাক পরিচয় পর্ব পরে হোক , মূল কথায় আসা যাক । আমাকে এই ভাড়াটিয়ার এডভান্স+ প্রথম মাসের মুল টাকার ১০% দিয়ে দিতে হবে । অন্যথায় তাহারা বাড়ি বসবাসের উপযোগী করিতে পারিবেনা ।

ভাইয়ার কথা শুনে মা সবসময় হাঁসে , কখন রাগ হয় না , কারণ ভাইয়া প্রফেসর । মাত্র ২৬ বছর বয়সে ভার্সিটির প্রফেসর হয়ে ভাইয়া সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে । এজন্য সবাই তাকে মাথার উপরে রাখে । আর সে আমাকে মাথার উপরে রাখে । যাক মা শেষমেশ রাজি হলো । এই টাকার পুরোটাই যে আসবে আমার পকেটে তা কেউ জানেনা । ভাইয়া নিজের বেতনের টাকা খরচ করতে পারেনা , সাথে শখ করে পাখি পুষে যে বাচ্চা পায় , সেগুলো থেকেও বড় অংকের টাকা আসে । যাক , মাঝখানে আমার লাভ।

রাতে ঘুমোতে যাবার আগে মেয়েটার কথা আবার মনে আসে , কি অদ্ভুত মেয়েটা! কি সুন্দর! তার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম । পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ছাদে গিয়ে কবুতর ছাড়ব ,ছাদে উঠেই দেখি মাঝ বরাবর দড়ি বেঁধে কাপড় শুকাতে দিয়েছে । নিশ্চয়ই হুজুরের কাজ , কারণ পুরাতন সবাই জানে ছাদে উঠা নিষেধ , কাপড় দেয়া তো বহুত দূরের কথা। চুপচাপ  কবুতর গুলো ছেড়ে বাসায় চলে আসলাম। যা করার এবার ওরাই করবে । রুমে এসে জৈবযৌগ পড়ছিলাম কিছুক্ষণ পর মা এসে বলল,

•  ছাদে কবুতর খোলা রেখে আসলি কেন?

•  না খুলে কি আটকে রাখবো নাকি?

•  মাওলানা সাহেবের বৌ এসে বলল উনাদের সব ধোয়া কাপড় নাকি নষ্ট করে ফেলেছে। যা আটকে আয় ওইগুলো।

•  আটকে আসব মানে? উনাদের কে বলো ব্যাল কনিতে কাপড় শুকাতে দিতে । এতো বড় ব্যাল্কনি তাহলে আর কোন কাজে?

আমি আমার মতো পড়তে থাকলাম । বিকালে ছাদে গিয়ে দেখি ওই মেয়েটা ইয়া লম্বা বোরকা পড়ে ছাদে হাঁটাহাঁটি করছে। ছাদের এককোণে ভাইয়া কিছু গোলাপের চারা লাগিয়েছে, তার একমাত্র শখ গোলাপ, ৫-৬ রঙের ফুল গাছে ফুটে আছে। দেখলাম মেয়েটা প্রচুর আগ্রহে তাকিয়ে আছে, আমিও তাকিয়ে আছি তার দিকে। তখন কে যেন সিঁড়ি থেকে ডাক দিলো,” হুর, বাবা ডাকছে তোকে। তাড়াতাড়ি আয়।“ ডাক দেয়ার সাথে সাথে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো আমাকে, লজ্জা পেল, তারপর দৌড়ে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। এই ঘটনায় কোনো আকস্মিকতা নেই, তবুও আমায় কেমন নাড়া দিয়ে গেল। আমি বাসায় চলে আসলাম। পড়ায় মন বসতে চায় না, বার বার চোখ দুটো ভেসে আসে সামনে। আমি অস্থির হয়ে পড়লাম ওর সাথে একটাবার কথা বলার জন্য। হুর! আসলেই হুর! মনে হয় যেন আল্লাহ বেহেস্ত থেকে নিজ হাতে বানিয়ে তাকে পাঠিয়েছে। পড়া আর তেমন হলো না। রাতে ঘুমের মাঝেও তাকে দেখলাম, দেখলাম “ আমি ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে, হুর আমার হাত ধরা, আমরা দুজনেই পশ্চিমের সূর্যাস্ত দেখছি।“ ঘুম ভাংলো মা-র ডাকে।

•  কি হয়েছে মা?

•  মাওলানা সাহেব এসেছেন, সামনে তোর পরীক্ষা , দোয়া করে দিবে । তোর বাবাও আছে , তাড়াতাড়ি আয়।

•  আচ্ছা তুমি যাও, আমি আসছি।

মুখ ধুয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি মাওলানা সাহেব বসা। বাবার সাথে শরিয়ত নিয়ে আলোচনা করছে। আমাকে দেখেই বলল,

•  আস্তাগফিরুল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ! বাবা কি করছ তুমি? হাঁটুর উপরে কেন কাপড়? এতো কবিরা গুনাহ । এই মুহূর্তে পায়জামা পড়ে আসো, তওবা করতে হবে আল্লাহর কাছে।

হুজুরের সাথে এবার যোগ হলো বাবা । শুরু করল সে ছোট বেলার ইতিহাস , কবে কবে তর্ক করেছি, কবে কবে গান শুনেছি সব কিছু । আমি এর ফাঁকে গিয়ে একটা ফুলপ্যান্ট পরে আসলাম। তারপর আমাকে ডেকে তাঁর পাশে বসাল । বিড়বিড় করে দোয়া পড়তে লাগল, তারপর জোরে জোরে ফুঁ দিলো তিনবার। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,

•  ভাইজান, আপনার ছেলে মানে আমার ছেলে । খাশ দিলে দোয়া করেছি , ইনশাল্লাহ পরিশ্রম করলে আল্লাহ সহায় হবেই।

আনন্দে বাবার চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগল। মনে হলো হুজুর আমার এ+ এর গ্যারান্টি নিজ হাতে নিয়ে নিয়েছে। আমি সালাম দিয়ে উঠে চলে আসলাম। ভেতরের রুমে গিয়ে দেখি মা ঘোমটা দিয়ে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে গ্লাসের পানি খাচ্ছে ।

•  কি হয়েছে মা?

•  আরে বলিস না, বেশকিছু দিন ধরে মনে হয় ঘরে আমরা ছাড়াও কিছু আছে । তাই একটু পানি পড়া নিয়ে নিলাম ।

•  আমরা ছাড়াও তো ভাইয়ার পাখিগুলো আছে । আরকি থাকবে ।

•  ধুর গাধা! আমি বলছি জীনের কথা । কে জানে হয়তো থাকতেও পারে । এই জন্যে প্রতিটা বাড়িতে একজন বড় হুজুর থাকা দরকার।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি মায়ের দিকে । কি বলে এইসব ! বাড়ির পরিবেশ তো বদলে যাচ্ছে । যেমন মা আযানের সাথে সাথে নামাজে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে । বাবা মাঝরাত পর্যন্ত কোরআন শরীফ পড়ছে , প্রভাব পড়ছে না শুধু আমার আর ভাইয়ার উপর । ভাইয়ার কথা হলো মানুষ জাতী ভুল করবেই , আর আল্লাহ মহান আমাদের ক্ষমা করবেই । মাঝখানে হুজুরের কাছ হেঁকে দোয়া নেয়ার দরকার কি ।

আমি আর কি বলব । আমার মাথায় তো শুধু ঘুরছে হুর !

পরীক্ষার মাত্র ৩দিন বাকি। গতকাল কলেজের বিদায় অনুষ্ঠান ছিলো । আহা! মেয়েরা একজন আরেকজনকে ধরে কি যে কান্না । কারণ কয়েকজন জানে তাদের ভালো হবে না । আর তারপর বিয়ে ।এইজন্য এতো মরা কান্না । আমার জন্য সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো আগামীকাল ভাইয়া ৩ মাসের জন্য ট্রেনিং- এ যাচ্ছে । মানে পরীক্ষার সময় জুড়ে আমার কাছে থাকবে না । আমি তো একাকীত্বতে মরবো । যাই হোক কোনো না কোনো উপায় বের হবেই। মা ডাকছে,

•  কি হলো মম ?

•  ফাইজলামী করবি না । ধর বাটিটা হুজুরের বাসায় দিয়ে আয় । বলবি তোর বাবা পাঠিয়েছে ।

•  কি আছে এখানে?

•  মেজবানের মাংস । যা তাড়াতাড়ি যা ।

আমার এখানে অবাক হওয়া ছাড়া করার কিছু নেই । হুজুরের যথেষ্ট সামর্থ্য আছে , তবুও বাবা ভালো কিছু রান্না হলেই বাসায় পাঠিয়ে দেয় উনার জন্য । দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপ দিলাম । আন্টি দরজা খুলল । উনারা আসার পর আমি এই প্রথম এলাম । আন্টি হেঁসে ভেতরে আসতে বলল , বেশ জোরই করলো বলা চলে , তাই বসলাম । ঘর বেশ পরিপাটি , সুন্দর করে সাজানো ।

•  কেমন আছো বাবা?

•  জি আন্টি ভালো । আপনারা?

•  আছি আলহামদুলিল্লাহ । তোমার আম্মু কেমন আছে? ভাবী তো আসে না ।

•  ইদানীং একটু ব্যস্ত । ভাইয়া ট্রেনিং এর জন্য কানাডা যাচ্ছে । তাই কিছু কাজে মা ভাইয়ার সাথে যাচ্ছে ।

•  কানাডা যাচ্ছে ? বাহ ভালোই তো।

•  ভাইয়া তো বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রফেসর । ওই খান থেকেই ট্রেনিং এর জন্যে পাঠাচ্ছে ।

•  মাশাল্লাহ। তোমার প্রস্তুতি কেমন?

•  আছে কোনো রকম । আল্লাহ ভাগ্যে যা রাখে আরকি ।

•  আমাদের হুর র রেজাল্ট তো আগামী মাসে ।

•  হুর ?

•  আমার বড় মেয়ে । ও তো এবছর এসএসসি দিলো ।

•  ও আচ্ছা আন্টি ।

•  ভর্তির ব্যাপারে সাহায্য করবে আরকি একটু ।

•  আচ্ছা আন্টি । আমি আজ উঠি ।

•  নাও বাবা । ভাবীকে দিও ।

আমি বের হবো ঠিক তখনি দেখি আড়াল থেকে বের হয়ে আসল হুর  মানে হুর । যতোটা সুন্দর ভেবেছিলাম তারচেয়েও বেশি সুন্দর । কি সুন্দর হাঁসি ! আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে চলে আসলাম । মেয়েটা  হঠাত আমার সামনে চলে আসল কেন?

১০ বছর পর আবার পা রাখলাম শহরের মাটিতে । কতকিছুই না বদলেছে । এইযে স্টেশনের আশেপাশের দোকান গুলো , শহরের মানুষ গুলো , শহরের বাতাস সব সবি বদলে গেছে । স্টেশন থেকে বের হতেই দেখি ভাইয়া গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে। গতও ১০ বছরে কারো সাথেই আমি কোনো যোগাযোগ রাখিনি । হাজারো ফোন , মেইল , চিঠি এসেছে আমার কাছে , আমি কখনো খুলেও দেখিনি । ভাইয়া একটু মোটা হয়েছে , আগে চশমা ছিলোনা , এখন চশমা পড়ছে । গাড়িটাও বেশ দামি । আমাকে দেখতে পায়নি এখনো । পেছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম । চমকে উঠে তাকালো আমার দিকে,

•  কিরে চ্যাম্প! দারুণ বডি বানালি দেখি । ডায়টিং চলছে নাকি? দেখি তোকে ধরতে পারি কিনা। ওঠ গাড়িতে ওঠ ।

•  ভাইয়া ভালো কোনো হোটেলে উঠি চলো । আমি ঢাকা যাবার আগে হোটেলে থাকবো ।

•  হোটেলে থাকবি মানে ? আমাদের বাড়ি আছে , আমি আলাদা একটা বাড়ি বানালাম শহরের বাইরে , আর তুই থাকবি হোটেলে ? বাড়াবাড়ি অনেক হয়েছে ,এবার তো চল বাড়ী । কতদিন দেখে না বাবা-মা তোকে!

•  ৩ হাজার ৪ শ ৩৮দিন ভাইয়া । তুমি আগে গাড়িটা কোনো পার্কের পাশে থামাও । কিছু কথা বলব।

•  সামনে বীচের পাশে দাঁড়াই?

•  দাঁড়াও । এখানেই দাঁড়াও ।

পতেঙ্গা সী-বিচ তো আগের চেয়ে বেশ সুন্দর হয়েছে । আগের ছড়ানো-ছিটানো দোকানগুলো এখন আর নেই । ভাইয়া কিছু মার্বেল সাইজের পেঁয়াজু নিয়ে আসলো ।

•  নে খা । সব বদলালেও এই পেঁয়াজুর সাইজ পালটায় নি ।

•  ভাইয়া শোনো তুমি জোর করে লাভ নেই । আমি বাসায় উঠছিনা । ভালো কোনো হোটেলে উঠে সপ্তাহ দশদিন থেকে ঢাকা চলে যাবো । এর মাঝে বাসায় গিয়ে বাবু আর মা বাবার সাথে দেখা করে আসব ।

•  দেখ তোর ইন্টার পরীক্ষার আগে যখন আমি বাসা থেকে যাই , এরপর সেই ছমাসে এমন  কি হলো যে একেবারে পড়ালেখার জন্য বাইরে চলে গেলি । বাইরে যাওয়া স্বাভাবিক , কিন্তু একেবারেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ার মানে কি? আমি তো ভেবে রেখেছি বাসায় গিয়ে কথাগুলো তুলব,তুই যেহেতু যাবি না এখানেই বল ।

•  ভাইয়া বলার মতো কিছুই নেই  । কেনো বাবা তোমাকে কিছুই বলেনি ।

•  না তো । বাবা তো শুধু এতোটুকুই বলল তোর দেশে পড়ার ইচ্ছা নেই,  বাইরে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বি ।

•  মা?

•  মা তো এই ব্যাপারে কিছুই কখনোই কিছু বলেনি । আমি জানতাম তোর ব্যাপারে মা কিছু লুকাচ্ছে , কিন্তু আমি তোর মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছি । এর মাঝে আমার বিয়ে হলো , শাখাওয়াত কে দিয়ে তোর কাছে খবর পাঠালাম  আমি নিজে পর্যন্ত গেলাম কিন্তু উই হাওয়া । তোর প্রফেসর বলল তুই সিক লিভে ১৫ দিনের ছুটিতে । কিসের সমস্যা এতো বল দেখি ।

•  শোনার মতো, বলার মতো কিছুই নেই বিধায় মা তোমাকে কিছুই বলতে পারেনি । আচ্ছা চলো উঠি , আমি ঘুমাবো , পুরো পথে ঘুমোতে পারিনি ।

•  ভাইয়া কিছু না বলেই উঠে গেলো । আমাকে একটা হোটেলের দিয়ে চলে গেল । আমি বুঝতে পারছি ভাইয়া কষ্ট পাচ্ছে , শুধু আজ না ,কয়েকবছর ধরেই কষ্টে আছে। কিন্তু আমারো হাত বাধা । রুমে এসে গোসল করে বন্ধু মাহমুদকে ৫ টায় আসতে বললাম । রিসিপশনে বলে দিলাম কেউ আসলে পাঠিয়ে দিতে । হালকা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম । ঘুম ভাংলো ফোনের শব্দে , মাহমুদ এসেছে । আমি নিচে নামলাম ।মাহমুদ দেখি ওরশের পাতিলের মতো বিশাল ভুঁড়ি । আমাকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো , কিন্তু আমি বেচারাকে ঠিকমতো ধরতে পারলাম না । বেটার তুলনায় আমি মাছি । ওকে কথার বলার সু্যোগ না দিয়ে ওর বাইকে করে গেলাম বাইকের শো-রুমে ।  একটা বাইক কিনে বের হলাম । ঠিক করলাম যতক্ষন না তেল শেষ হবে ঘুরবো । আমরা ঘুরতে থাকলাম । বলা হয়নি , মাহমুদ র‍্যাব এ আছে , বড় অফিসার । কিন্তু বেজায় মোটা । আমার থেকে চিকন ছিলো, ১০ বছরে কি চেঞ্জ! আগ্রাবাদ মোড়ে পুলিশ চেক পোষ্টে আটকালো বকশিশের জন্য , নতুন বাইক কিনার কারণে তাদের চা নাস্তার খরচ দিতে হবে । মাহমুদ একপাশে নিয়ে পরিচয় দিতেই সব সোজা, বেচারা সামান্য কনস্টেবল কি ঝাড়ি না খেলো, তারপর দয়া হলো দেখে । কিছু টাকা দিয়ে আমরা চলে আসলাম ।  পাহাড়তলি ঢ্যাবার পাড়ে আমরা আগে আড্ডা দিতাম । আজ আবার আসলাম, মাহমুদ জিজ্ঞেস করল,

•  বাসায় যাবি না?

•  নাহ । কিভাবে যাবো বল ? সব জেনেও তুই এই প্রশ্ন করলি কেনো?

•  দেখ আন্টি আমার হাত ধরে কতদিন যে কান্না করেছে তুই কল্পনাও করতে পারবি না ।

•  আর আমি? আমার দোষ কি ছিলো? আমি ৩ টা মাস পাগলের মতো এখান থেকে ওখানে দৌড়ে , হোটেলে কাজ করে আমার সখের কবুতর গুলো বিক্রি করে কতো কষ্টে ছিলাম সেটা তুই নিজে চোখে দেখেও এই কথা বললি?

•  তোর ভাই? তার দোষ কি? তাকে কষ্টদিয়ে লাভ কি?

•  এই অবস্থায় সবকিছু আগের মতো করা সম্ভব না, আমি থাকতে পারবো না । কালকে একবার পারলে আসিস । কিছু কেনাকাটা করব ।

•  কালকে ঢাকা থেকে কিছু লোক আসবে মন্ত্রণালয়ের। কালকে পারবো না ।

•  আচ্ছা আমি বলব তোকে ।

মাহমুদ কে রেখে আমি চলে আসলাম । হোটেলে এসে দেখি আমার রুমে ভাইয়া আর বাবা বসে আছে । এমন কিছু হবে আমি ভাবতেও পারিনি। রুমে ডুকে সোজা বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয় নিলাম। বের হয়ে ইন্টারকমে কিছু নাস্তা পাঠাতে বলে একটা চেয়ার নিয়ে তাদের সামনে বসলাম। বাবা তখন থেকেই আমার দিকে তাকিয়া আছে , খাটের দিকে তাকিয়ে বলল,

•  এখনো হাফ প্যান্ট পড়ে থাকিস, ভার্সিটির ক্লাসও কি এভাবে নিস নাকি?

•  না বাবা । অনেক গুলো স্যুট আছে , ম্যাচিং টাই আছে , তবে ঘুমানোর জন্য তো হাফ প্যান্ট লাগেই। আমি তো আর লুঙ্গি বাঁধতে পারি না।

•  দেখ বাবা, আমি জানিনা কি আছে তোর মনে, কি কারণেই বা আমাদের উপর এতো মনে কষ্ট তাও আমি জানিনা । তবে আমি চাই না আমার একটা ছেলে তার জীবনে শত কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকুক । তুই এখন আর ছোট না, তোকে আমি পারলে মেরে বাসায় নিয়ে যেতাম, কিন্তু আমি চাই তুই আমাকে বল সব।

•  বলার মতো কিছুই নেই আমার কাছে, আমি আসব বাসায়, আমি কথা দিলাম আসব, তোমাদের সাথে খাব, ভাইয়া তুমি আমার জন্য ভালো করে সব কিছু কিনে রাখো, আমি যেকোনো সময় চলে আসব, কিন্তু এখন না । তুমি শত বলেও লাভ হবে না । তোমরা এসেছে খুশি হয়েছি , কফিটা খাও।

আমরা ৩জন একসাথে কফি খেলাম, তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বাবা-ভাইয়া চলে গেলো । রাতে আর কিছুই খেলাম না, শুয় শুয়ে চিন্তা করতে থাকলাম জীবনটা কি আমার এভাবেই চলবে ভাগ্যে লেখা ছিল।

ইন্টার পরীক্ষার আগের দিন রাত, আমি সারাদিন বাংলা পড়ে পড়ে ক্লান্ত , তাই ছাদে উঠে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম, রাত তখন প্রায় সাড়ে ৯ টা । মাওলানা সাহেবের পাঞ্জাবী আর পায়জামা এখনো ছাদের দড়িতে ঝুলছে । কবুতরগুলো আমাকে দেখে ডাকা শুরু করল । কি অদ্ভুত ভাবে ডাকে , যতক্ষন ডাকে ততোক্ষণই শুধু ঘুরতে থাকে । আমি হেঁটে নেমে যাবো,তখনি হুর  সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠতে গিয়ে ওর মাথার সাথে বাড়ি লেগে আমার ঠোঁট কেটে যায়। আমরা দুজনই পড়ে যাই ফ্লোরে । বেচারী কি করবে বুঝতে পারছে না, উঠে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে । আমি উঠে ঠোঁটে হাত দিয়ে দেখি রক্ত পড়ছে , আমি হুর র দিকে তাকালাম,

•  তোমার নাম যেন কি?

•  জি, হুর  !

•  দেখ ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এখানে তোমার কোনো দোষও নেই । এতো তাড়া হুড়ো করে ওঠার কি দরকার ছিলো?

•  বাবার পাঞ্জাবী নিতে এসেছি ।

•  এতো রাতে আসার কি দরকার ছিলো।। সকালে আসলেও হতো।

•  বাবা জানাজা পড়াতে যাবে । তাই আসলাম । আপনার কি ব্যথা হচ্ছে?

•  আরে না না , তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না, যাও তাড়াতাড়ি বাসায় যাও।

হুরের সামনে তো বল দিলাম ব্যথা নেই, কিন্তু পরে বুঝলাম প্রচণ্ড ব্যথা করছে ।

পরীক্ষা বেশ ভালোই দিলাম । বাসায় এসে পরের পরীক্ষার জন্য পড়ছি মা-বাবা কেউই বাসায় নেই । তখন কলিং বেল বাজল। আমি উঠে দরজা খুলে দেখি আন্টি আর হুর  দাঁড়ানো । আজ বোরকা পড়েনি, সাধারণ হিজাব পড়ে এসেছে , আর হলুদ জামা । আমি আন্টিকে বসয়তে বললাম । আন্টিকে খুবই লজ্জিত লাগছিলো।

•  দেখো বাবা, ও অন্ধকারে দেখতে না পেরে ধাক্কা দিয়েছে তোমাকে । তুমিও তো ভালোই ব্যথা পেয়েছ । ভাবী আবার কি মনে করছে কি জানে। তাই ভাবলাম কথা বলে আসি ।

•  না না আন্টি , আমি মাকে বলিনি এই ব্যাপারে কিছু । ছোটখাটো ব্যাপার , আপনি লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই ।

•  ভাবী বাসায় নেই?

•  না। বাবার সাথে বাইরে গেছে।

•  তুমি পড়ছিলে মনে হয় । আচ্ছা আমি পরে এসে ভাবীর সাথে দেখা করে যাবো ।

আন্টি চলে গেলো । হুর  পুরো সময় খুবই লজ্জিত লাগছিলো । মহিলা মাদ্রাসার মেয়ে কখন কোনো ছেলের সাথে কথা বলেনি এটাই স্বাভাবিক । দেখি কি করা যায় পরীক্ষার পর । ওরা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে নাহ।

পরীক্ষা চলছে , আর দিন যাচ্ছে । মা কেন জানি হুর কে খুবই পছন্দ করছে । অপছন্দ করার মতো কোনো ব্যাপার নেই ,তারপরও বুঝতে পারলাম না । মাঝে মাঝে বাসায় এসে মার সাথে গল্প করে , তখনো হিজাব পরে থাকে। আমার তো একসময় মনে হলো মেয়েটার হয়তো মাথায় চুল নেই । মার সাথে কথা বলতে আসায় আমার সাথেও মাঝে মাঝে কথা হতে লাগলো । আমার পরীক্ষা শেষ ,আর ওর রেজাল্টের দিন কাছে আসতে লাগল । রেজাল্টের সপ্তাহ খানেক আগে একদিন ছাদে ও হাঁটছিল , আমি ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরে ফেলি । ও চমকে আমার দিক তাকায় , আমি আরেক হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে কোনো আওয়াজ করতে মানা করি । তারপর ওকে একটা টুলের পর বসিয়ে বলি , “আমি যদি তোমায় ভালোবাসতে চাই , তুমি কি রাজি হবে?” ও চুপচাপ বসে থাকে , কোনো কথা বলে না । পরে আমি বলি , কাল এই নতুন কালো গোলাপ গাছের প্রথম ফুল ফুটবে । যদি তুমি ফুলটা ফোঁটার পর নিয়ে নাও ,আমি বুঝে নিবো তুমি রাজি, আর যদি না নাও তবে বুঝব তুমি রাজি নও । যাও এখন বসায় যাও ।

সেদিন রাতে আমার আর ঘুম হয়নি । সকালে ফজরের নামাজের আযানের সাথেই উঠে পড়ি । অনেকদিন পরে নামাজ পড়েই ছাদে চলে যাই , আর অপেক্ষা করতে থাকি । সারাদিন বাসা-ছাদ, ছাদ-বাসা করতে থাকি । ফুলটা ফোটে ১২টার পর । আর আমি অপেক্ষা করতে থাকি । সকাল গড়িয়ে দুপুর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়, তবুও হুর  আসেনি । আমি মাগরিবের আজান শুনে বাসায় চলে আসি। তারপর এক বন্ধু আসায় তাকে নিয়ে বের হয়ে পড়ি । বাসায় আসি রাত ১০ টায় । আমার মন অনেক খারাপ  বাবা বাসায় নেই , মা মনে রুমে বসে বই পড়ছে , আমি মার কাছে বসার জন্য মার রুমের দিকে গেলাম । দরজা খুলেই দেখি, হুর  মার সাথে বসে কথা বলছে, কি একটা নিয়ে দুজনেই হাসছে । আমি দরজা আগিয়ে চলে আসব ঠিক তখন মা ডাক দিলো । অনিচ্ছার সত্ত্বেও ভেতরে গেলাম । গিয়ে দেখি আমাদের দুইভাইর ছোটবেলার ছবি দেখে হাসছে । হুর  আমার দিকে তাকাচ্ছে না । শুধু হাসছে । হঠাত খেয়াল করলাম হিসাবের ডান পাশে কালো গোলাপ টা আঁটকে রেখেছে । আমার খুশি দেখে কে । আমার ইচ্ছা করছিলো চিৎকার করে সবাইকে জানাতে ,কিন্তু সেই সুযোগ তো আর ছিলো না । আমি ওর সামনে বসলাম । মার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাঁসি দিয়ে মা-কে সালাম দিয়ে চলে গেলো । আমি ওর পেছন পেছন দরজা লাগানোর ভান করে চলে আসলাম। ড্রয়িং রুমে কেউ নেই , আমি ওর হাত ধরে ফেলি পেছন থেকে । ও আমার দিকে তাকায় না, নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে শুধু । আমি ওর কানে কানে বলি, “ ভালোবাসি তোমায়।“ লজ্জা পেয়ে দৌড়ে চলে যায় । আমি ভাবতে থাকি, এই মেয়ে এতো দৌড়ায় কেনো?

আমাদের ভালোবাসার গল্প শুরু হয়ে ধীরে ধীরে চলতে থাকে । ওর রেজাল্ট হয়, কলেজে ভর্তি হয় এসব কিছু আমি নিজেই করে দিই । মাওলানা সাহেব আমাকে ডেকে বারবার ধন্যবাদ জানায়, কারণ আমি না থাকলে নাকি উনি এসব করতে পারতেন না । ও আমার সাথে বের হয় , কোনো কাজ থাকলে হুজুর নিজেই আমাকে ডেকে কাজ করে দেয়ার জন্যে বলে । এই কাজে আবার বাবা-মা দুজনেই খুশি । কারণ হুর  আমাকে অল্প কয়েকদিনেই নামাজি বানিয়া ফেলে । সবসময় বুঝাতো আমাকে , তাই বাবা-মা ভাবতো হুজুরের কথা শোনায় আমার উন্নতি হচ্ছে । সবার মৌনসম্মতিতেই আমাদের ভালোবাসা চলতে থাকে । প্রায় ৩ মাস হলো আমাদের সম্পর্কের । একদিন আমি ওকে বলি কলেজ ছুটির পর অপেক্ষা করতে । ভাইয়ার অবর্তমানে তার বাকি সব কিছুর মতো মাইক টাও আমার দখলে চলে আসে । আমি বাইক নিয়ে বের হই বাসা থেকে । ওকে কলেজের সামনে থেক তুলে নিয়ে যাই পাহাড়তলি ঢ্যাবার পাড়ে । ওর হাতে আমার টিউশনের টাকায় কেনা একটা আংটি পড়িয়ে দিই । আনন্দে ওর চোখ ঝলমল করে ওঠে । তারপর আমি বলি যে আমার রেজাল্ট এসেছে , এ+ পেয়েছি । এরপর আমরা আর কিছুক্ষণ বসে বাসার দিকে চলে আসি । বিকেলে আন্টি আমাকে ডেকে নিয়ে যায় বাসায় । আমি বুঝতে পারিনি কেন উনি আমায় ডেকেছেন । প্রায় আধা ঘণ্টা আমাকে বসে থাকতে হয় ড্রয়িং রমে । আমি বুঝতে পারলাম উনারা জেনে গেছেন । এরও বেশকিছুক্ষন পর আন্টি আসলেন । তারপর হুর  আসল । আন্টি হুর  কে বলল আমার পাশে বসতে।

•  দেখ তোমাদের তো এখনো বিয়ের বয়স হয়নি।আর ইসলামে বিয়ের আগে এসব সম্পর্ক জায়েজ নেই । আমি বলব না তুমি ছেলে হিসেবে খারাপ, কিন্তু বাবা তোমার মা বাবা জানতে পারলে অনেক রাগ করবেন । তাই আমি ভাবলাম আগে তোমার সাথে কথা বলে নি। বল তোমার যদি কিছু বলার থাকে।

আন্টি ও হয়ত আপনাকে সব বলেই দিয়েছে আগে,তবুও আপনি যখন শুনতে চাচ্ছেন তবে বলি, আমি ওকে যথেষ্ট পছন্দ করি । আমি সবে ইন্টার পাশ করলাম , কোথাও ভর্তি হয়ে নি । আর ওরতো পড়ালেখা শেষ করতে আরো সময় লাগবে । ততদিনে আমি ভালো কিছু হতে পারব ইনশাল্লাহ । এখন সব আপনার উপর । আপনি চাইলেই আমাদের সম্পর্কটা আগাবে , না হয় দুজনই কষ্ট পাবো ।

•  ঠিক আছে বাবা । আমি তোমার কথা মেনে নিচ্ছি । কিন্তু মাঝে তোমার এবং ওর কারো পড়াশোনাই যাতে নষ্ট না হয় , আর আমি যেভাবে সব মেনে নিচ্ছি বাকিরা কিন্তু মানবে না । আর জানাজানি হলে কিন্তু ওর বাবার উপর আমি আর কিছুই বলতে পারব না।

আমি আন্টি কে সালাম করে বের হয়ে আসলাম । দরজায় দাঁড়িয়ে শুনলাম হুর  কাঁদছে । মানুষের জীবনের কিছু কিছু সময় তারা অতি আনন্দে কাঁদে । তখন তারা চায় তাদের প্রিয় মানুষরা তাদের হাত ধরে পাশে বসে থাকুক । আজ হয়ত ও একা , কিন্তু আর বেশি দিন তো নয় ।এর পর কিছুদিন পর পর আমি ওর সাথে কথা বলতাম, তাও ছাদে । সেই সময়টাতে আন্টি বাসায় এসে মা-র সাথে গল্প করত । আন্টি কেন আমাদের এতো ছাড় দিলেন তা আমি জানতাম না , কখনো প্রশ্নও করিনি, কারণ আমার দিন তো ভালোই কাটছিলো । একদিন মা আমাদের ছাদে দেখে ফেলে , আমি তখন গোলাপ গাছগুলোর পাশে ওর হাত ধরে কথা বলছিলাম । আরকি মা আন্টিকে ডেকে পাঠায়, আমার কোনো কথা না শুনে আন্টিকে অনেক অপমান করে, হুর কেও মা অনেক চড় থাপ্পড় দেয় । আন্টি সেদিন কোনো কথা বলে নি , শুধু আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। কথাটা আমাদের কারোরই বাবার কান পর্যন্ত গড়ায়নি । মাসের শেষদিকে মাওলানা সাহেব এসে বলেন উনি বাসা ছেড়ে দিবেন , ঢাকার একবড় মাদ্রাসায় উনি প্রিন্সিপাল হিসেবে চাকরী পেয়েছেন । আমি কিছুই বলতে পারিনি , ওরা যেদিন চলে যাবে ,আমি একফাঁকে ওদের বাসায় যাই, আন্টি আমার হাত ধরে অনেক কান্না করে, উনি বললেন,

•  বাবা, আমার কোনো ছেলে নেই, একটা মাত্র মেয়ে , তোমাদের সম্পদের লোভে আমি আমার মেয়েকে অন্তত তোমার পেছনে লাগিয়ে দেই নি।

ওই মুহূর্তে আমার বলার মতো কিছুই ছিলো না । আমি তখন হুর র রুমে যাই , গিয়ে দেখি জানালার দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে , সেদিন প্রথম বারের মতো ওকে হিজাব ছাড়া দেখি , ওর মাথায় যে এতো চুল আমি কখনো ভাবতেও পারিনি । জানালার আলোয় মনে হচ্ছিলো যেন বেহেস্তের হুর আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়ে দিয়েছে । হাত টা ধরতেই আমাকে জড়িয়ে ধরল, বলল, “ আমাকে নিয়ে কোথাও চল যাও।চলো আমরা আমার মামার বাড়িতে চলে যাই, মা বলে দিলেই হবে । “ সেদিন তার কথার পর “ঠিক আছে চলো” বলার মতো সাহস আমার ছিলো না । আমি ওকে শক্ত করে ধরে বললাম,” আমি আসব , তুমি অপেক্ষা করো।“ তারপর আর দেখা হয়নি ওর সাথে । আমি বাসা থেকে বের হয়ে যাই , বেশ কিছুদিন এখানে সেখানে ঘুর ঘুর করে , চা দোকানে কাজ করে কোনো মতে চলতে থাকি । একদিন আমাদের দোকানের এক ছেলে আমাকে দেখে বাবাকে খবর দিলে বাবা এসে আমাকে নিয়ে যায়, মা এতো কিছুর পরও মুখ খুলে বলেনি কেনো আমার এই অবস্থা হলো । মা বাবার সাথে কথা বলে সিধান্ত নেয় আমাকে কানাডা পাঠিয়ে দিবে । দেশে রাখবে না । আমিও কোনো কথা বললাম না, কারণ বাসা তখন আমার জন্য জাহান্নাম হয়ে গিয়েছিলো। ভাইয়া আসার আগেই আমি কানাডা চলে আসলাম । বাবার এক বন্ধু আমাকে ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেয় । উনি আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছিলো । আমার জীবন চলতে লাগলো আপন গতিতে । ওর সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি , কারণ কোনো নাম্বার ,কোনো ঠিকানাই ছিলোনা । দিন যেতে থাকে , সময় গড়াতে থাকে , বাসা থেকে ফোন, চিঠি আসতে থাকে , আমি কোনো উত্তর দিই নি । ভাইয়া বছর ২ পরে আসে তার বিয়ের জন্য আমাকে নিয়ে যেতে , আমি তার সাথে দেখাও করিনি , চলে যাই কানাডার একবন্ধুর গ্রামে । ১০ দিনের মতো অপেক্ষা করে ভাইয়া চলে যায় । মাহমুদের সাথে মাঝে মাঝে কথা হতো। পরে ওর কাছে শুনলাম সবচাইতে কষ্টের ব্যাপার । ভাইয়ার বিবাহিত স্ত্রী আর কেউ না ,আমার হুর  । তারপর থেকে দিন গুলো আমার কিভাবে কাটতো তা আমিই জানতাম , একদিন বিকেলে হাঁটতে বের হয়ে চিন্তা করলাম সবাই যখন সুখে আছে তখন আমি কষ্টে থেকে লাভ কি? পাল্টাতে থাকলাম নিজেকে ধীরে ধীরে । অনার্স,মাস্টার্স শেষে পিএইচডি করে ফিরলাম দেশে । আমি সরাসরি ঢাকায় চলে যেতাম, কিন্তু আমার কিছু প্রশ্ন আছে ,আমার মা-র কাছে, হুর র মা-র কাছে । উনারা এখন চট্টগ্রামেই থাকে । আমি আমার প্রশ্নের জবাব নিয়েই চলে যাবো। সারারাত ঘুম হলো না । সকালে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে বের হয়ে পড়লাম ।

দরজার টোকা দিচ্ছি বেশ কিছুক্ষণ ধরে । এই বাসায় মনে হয় কলিং বেল নেই।  ১৪-১৫ বছর বয়সী এক মেয়ে দরজা খুলল , দেখতে অনেকটা হুরের মতো ।

•  জি বলুন কাকে চাচ্ছেন?

•  এটা মাওলানা ওয়াহিদুর রহমান সাহেবের বাসা না?

•  জি । বাবা তো বাসায় নেই ।

•  তোমার মা আছে ?

•  জি । ডাকব?

•  হ্যাঁ ।

•  আচ্ছা আপনি বসুন ।

আমি সোফায় বসলাম । বাসা পাল্টেছে ঠিকই , কিন্তু সাজসজ্জা পাল্টায়নি । সেই আগের মতোই কার্পেট , আয়াতুল কুরসী লিখা সোনালী ফ্রেম , ঘোড়ার মতো পেন্ডুলামের দেয়াল ঘড়ি , সবই আছে । আন্টি আসলেন । প্রথমে চিন্তা পারলেননা ।

•  জি বলুন ।

•  আসসালামু আলাইকুম আন্টি।চিনতে পেরেছেন?

•  না তো বাবা । তোমাকে তো ঠিক চিন্তে পারলাম না ।

•  চিনবেন কিভাবে আন্টি , ১০ বছর আগে এই অন্তুর তো দাড়ি গোফ কিছুই ছিলো না ।

আন্টি অনেকটা ধাঁদায় পরে গেলেন । একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে । তারপর হঠাত করে বললেন ,

•  কেনো এসেছ এখন? কোথায় ছিলে সেদিন ,যেদিন আমার মেয়েটা সারাটা সময় কাঁদছিলো ।যখন তোমার প্রয়োজন সব চাইতে। কোথায় ছিলে সেদিন?

•  আমি কিছুই জানতাম না আন্টি । কিন্তু আপনি কেনো রাজি হলেন?

•  কি  করার ছিলো আমার ? উনার উপর কথা বলার সাহস আমার কখনোই ছিলো না ।

•  তাই বলে আমার পরিবারে ? কেনো আপনি মানা করে দেননি আমার বাবা-মা কে । আমার ভাইয়াকে তো অন্তত আপনি বলতে পারতেন?

•  না , আমি হয়ত অনেক কিছুই পারতাম , কিন্তু আমি করিনি । এখন এসব বলে কোনো লাভ নেই।

•  জি আন্টি ঠিকই বলেছেন । আচ্ছা আমি উঠি ।

আমি বের হয়ে আসলাম। হুর র মতো আজও সেই মেয়েটি দরজার আড়াল থেকে সবই শুনছিল । মা কেনো সব জেনেও এমন করল তা আমাকে জানতেই হবে । তাই বের হয়েই চলে গেলাম আমাদের বাসায় । এইদিকের রাস্তা ঘাট ও অনেকটা বদলে গেছে । আশেপাশের খালি মাঠগুলোর সবই এখন বাড়ি, বহুতল বাড়ী ।

আমাদের বাড়িটা এখনো আগের মতোই আছে , দেয়ালে সাদা রং , বাড়ির দেয়ালে হালকা আকাশী রং , আর প্রতিটা ব্যালকনী সাদা । ভাইয়ার কথায় এই রং করানো হয় । আজও আছে দেখছি । বাইক টা বাসার নিচে রেখে গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখি এক বুড়ো দারোয়ান বসে আছে । আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো ,

•  কার কাছে আসছেন?

•  আজিজ সাহেবের বাসায় ।

•  কে লাগে আপনার?

•  কেউ না। দেখা করতে আসলাম ।

•  নেন  এই খাতায় ফোন নাম্বার দিয়া নাম লেখা দেন ।

বাড়ির নিরাপত্তার খাতিরে সব নিয়ম মেনে নিজের বাড়িতে আসলাম । বাসার সামনের দরজাটা পাল্টেছে । কলিং বেল না বাজিয়ে আস্তে টোকা দিলাম । পর পর ৩ বার । রোগা ধরনের এক মহিলা দরজা খুলে কর্কশ ভাষায় জিজ্ঞেস করল,”কাকে চান?” আমি বললাম , “ আজিজ সাহেব কে বলেন ঢাকা থেকে ফ্রিজের মিস্ত্রি আসছে।“ মহিলা মুখের উপরে দরজা লাগিয়ে ভেতরে চলে গেলো । তখনি দরজা খুলল বাবা , আমাকে দেখে যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না , তারপর জোরে জোরে মাকে ডাকতে লাগলেন । মা এসে নিজেই থ! আমি পা ধরে সালাম করতেই মা আমাকে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন । সব সামলাতে সামলাতে প্রায় ১০ মিনিট লেগে গেলো । মা তারপরও কাঁদছেন । মার পেছনে ভাইয়া দাঁড়ানো , আর ভাইয়ার পেছনে ফুটফুটে এক মেয়ে । আমাকে দেখে লজ্জায় সামনে আসছে না  । আমি মাকে নিয়ে আমার ঘরে চলে আসলাম । আশ্চর্যের বিষয় আমার ঘরটা আমি যেভাবে রেখে গিয়াছিলাম সে ভাবেই আছে । আমি মা-কে আমার পাশে বসালাম ।

•  মা তুমি কি এখন একটু স্বাভাবিক হয়েছ?আমি কিছু কথা বলব

•  হ্যাঁ । । তার আগে বল দাঁড়ি রেখেছিস কেন?

•  মা ,তুমি আমার মা হয়ে কিভাবে করতে পারলে এই কাজ।

•  কি করেছি? তোকে বিদেশ পাঠিয়ে , এতো শিক্ষিত বানানো কি আমার ভুল ছিলো?

•  না তোমার ভুল ছিলো না । কিন্তু যেই মহিলাকে তুমি এতো অপমান করলে , যে মহিলার মেয়েকে চরিত্রহীন বলেছিলে , সেই মেয়েকে কিভাবে তুমি আবার এই বাড়ির বৌ হিসেবে নিয়ে আসলে । যাকে আমি এতো ভালবাসতাম , তাকে তুমি………। এটা করে তুমি আমাকে কি বোঝাতে চেয়েছ ? এতো ঘৃণা আমার প্রতি তোমার ।

•  দেখ অন্তু ,তুই ব্যাপার টা বুঝছিস না ।

•  না মা আমি বুঝতে চাই না । আমি শুধু একটা কথা বলতে আজ এখানে এসেছি , তা হলো আমাকে  তুমি যে কষ্ট দিয়েছ তা হয়ত আজ পর্যন্ত কোনো মা-ই তার ছেলেকে দেয় নি । এর চেয়ে ভালো হতো আমাকে যদি……..

আমি বের হয়ে ছাদে চলে আসলাম । আমার মনে হচ্ছে যদি না আসতাম দেশে তবেই আমার জন্য ভালো হতো। এখানে এসে পুরোনো সব কথাগুলো আবার মনে পড়ে যাচ্ছে ।এই ছাদেই আমার ভালোবাসার গল্প শুরু, এই ছাদেই সব, এই ছাদ আমার সব কিছুর সাক্ষী । আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে , কিন্তু পারছি না । হঠাত আমার কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেলাম । চোখমুছে পেছনে তাকাতে দেখি হুর  । আমি কি বলব বুঝতে পারছি না, কারণ ও এখন আমার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। আমি চুপ করে আছি , হুর  বলল ,” কেমন আছো?” আমি উত্তর দেয়ার মতো কোণো শব্দ খুঁজে পেলাম না । হুর  আমার হাত ধরলো, আমি ওর দিকে তাকালাম , কি সুন্দর লাগছে ওকে , এখনো কাঁদছে , ওকে এখন ঠিক সেদিনের মতো লাগছে যেদিন ওর সাথে আমার শেষ দেখা হয় । আমি হাতটা সরিয়ে নিলাম , হুর  বলল,

•  কি হলো জবাব দাও? কেমন আছ? কোথায় ছিলে এতদিন ?

•  জানিনা কোথায় ছিলাম ।জানিনা কেমন আছি ।

•  কেন, জান না কেন? তুমি না আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছিলে । আমাকে অপেক্ষা করতে বলে নিজেই ডুবদিয়ে বসেছিলে ।

•  এখন আর এসব বলে  লাভ নেই । আমার ভালো লাগছে না কিছুই ।

•  আর আমার? আমার তো ঈদ আজকে? কি মনে করো তুমি আমি খুব সুখে আছি ।

•  দেখো হুর  এখন এসব কথা বলার না । আমাদের ভাগ্যে এটাই ছিলো । যা হবার হয়েছে । যা আছে তা নিয়েই থাকতে হবে আমাদের ।

ঠিক তখনই ভাইয়ার পেছনে দাঁড়ানো মেয়েটা এসে হুর কে বলো বড় মা , দাদু তোমাকে আর উনাকে ডাকছে । আমি হুর কে বললাম ,” মেয়েটা তোমার মতো হয়নি। ভাইয়ার মতো হয়েছে।“ ও বলল,” ছাই হয়েছে। অহনা হয়েছে ওর মার মতো। আমার মতো হতে যাবে কেন?”

আমি এক মুহূর্তের জন্যে নড়ে উঠলাম । ওর মা-র মতো মানে কি? তখন দেখলাম সিঁড়ি দিয়ে মা,বাবা, ভাইয়া,মাহমুদ, আর একজন মহিলা উঠছে । বাবা বলল,” তোকে তো ওর কথা বলাই হয়নি , ও হলো তর ভাবী । এতদিন শুধু তোকে ছবিতে দেখেছে । আজ সামনাসামনি দেখে নিলো ।“ আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা । সব গুলিয়ে যাচ্ছে , তখন মাহমুদ আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,” হুর  গতও ১০ বছর তোর জন্য অপেক্ষা করছে । বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তোর সাথেই  কিন্তু তুই তো হয়ে গেলি হাওয়া । অপেক্ষা করতে থাকে তোর জন্য।“ আমার কাছে সব ধোঁয়াশার মতো লাগছে । কি হচ্ছে না হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না । মাহমুদ আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে হুর কে রেখে বাকিদের নিয়ে চলে গেলো । আমি চুপচাপ বসে থাকলাম হুর র দিকে তাকিয়ে, আর ও আমার হাত ধরে বসে রইল । কতক্ষণ সময় কাটল জানিনা , হুর  বলল,

•  কি মিস্টার , বলবে কিছু নাকি মুখ হা করেই বসে থাকবে ।

•  কি করে হলো এসব । একটু খুলে বলবে আমাকে ।

•  ভাইয়ার বিয়ের কথাবার্তা চলছিলো, তোমার বাবা একদিন কি কাজে ঢাকা এসে বাবার সাথে দেখা হয় , বাবা উনাকে বাসায় নিয়ে আসে । তখন উনারা ভাইয়ার জন্য আমার কথা বলে ,দুজনই রাজি হয়ে যায় । পরে একদিন তোমার বাবা-মা ,ভাইয়া আমাদের বাসায় আসে , আমাকে দেখে আংটি পরিয়ে দিবে বলে । তোমার মা তখনো জানত না আমার ব্যাপারে । আমাদের বাসায় এসেই উনি সবার সামনে আমাদের ব্যাপারে কথাগুলো তুলে , তখন ওইদিনের সব কথা উঠে আসে । একপর্যায়ে ভাইয়া দাঁড়িয়ে বলে যাকে আমার ভাই এতোটা ভালোবাসে তার সাথেই ওর বিয়ে হবে , আর বিয়ে একদিনেই হবে । অনেকে অনেক কথা বলে কিন্তু ভাইয়া অনড় থাকে তার কথায় । তোমাকে আনার জন্য কানাডায় পর্যন্ত যায়, কিন্তু তোমার কোনো খবর নেই । আমি অপেক্ষা করতে থাকি । লোকে কতো কথা বলে ,কতো কিছু শুনতে হয়েছে এই দিন গুলোতে । তবে আমার বিশ্বাস ছিলো , তুমি আসবে । প্রতিদিন নামাজে বসে আমি আল্লাহর কাছে বলতাম যেন তোমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেয়, আল্লাহ আমার কথা শুনেছেন ,  তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন আমার কাছে । আজ সকালে ভাইয়া নিয়ে আসে আমাকে ।

ঠিক এই মুহূর্তে আমার বলা কিছুই নেই । আমি দেশে ফিরেছি , আমার পুরো পরিবার আমার সাথে আছে , ১০ বছর আগে যেই মানুষটার জন্য আমি পাগল হয়ে সব ছেড়ে পালাতে চেয়েছি , আজ সব কিছুর সাথে আল্লাহ তাকেও আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে । আমি হুর র হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম ,” একবার বলতো ভালোবাসি ।“ হুর  কিছুই বলতে পারল না । কারণ কাঁদার সময় মানুষ কথা বলতে পারে না । একটা সময় ছিল যখন কাঁদার সময় ওর হাত ধরে বসার মতো কেউ ছিলো না, আজ আমি আছি , আমি থাকবো । আমরা অনেকক্ষণ ছাদে বসে ছিলাম । বাসায় এসে দেখি মাওলানা সাহেব আর আন্টি বসে আছেন সবার সাথে । আমাদের দেখেই বলল,” কোনো কথাবার্তা না বলে গোসল করে দুজনেই যা যা কাপড় রুমে আছে সব পড়ে নাও। কাজী সাহেব আসবেন সন্ধ্যায় ।“

ভাইয়া , মা-বাবা , হুরের মা-বাবা যদি না চাইতেন তবে কি এই মুহূর্ত কখনো আসতো আমার জীবনে??

রাত ১২ টা বাজে । আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে আরো ২ ঘণ্টা আগে । হুর কে আজ সেই আগের কলেজে পড়া মেয়েটির মতোই লাগছে । কি সুন্দর! মনে হচ্ছে জ্যোছনার সব আলো ওই ছড়াচ্ছে ।  আমরা এখন ছাদে বসে আছি । আকাশে চাঁদ আছে , আশ্চর্যের ব্যাপার কালো গোলাপ গাছের একটা কলি এখন ফুটছে । আমরা দেখতে পাচ্ছি, ধীরে ধীরে পাপড়ি গুলো আলাদা হচ্ছে , এই গাছটা ওই প্রথম গাছের কলম , বেঁচে থাকুক পৃথিবীর সকল গোলাপ , বেঁচে থাকুক তাদের ঘেরা ভালোবাসা ,বেঁচে থাকুক তারা ,যারা অমর হতে দেয় ভালোবাসাকে ।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post মুক্তির স্বাদ| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | -| Bengali Stories for Matured
Next post প্রেম প্রতিক্রিয়া| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | দীপঙ্কর পড়্যা| Bengali Stories for Matured