অর্ধাঙ্গ| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | আবু মুহম্মদ রাকিবুল হাসান সিয়াম| Bengali Story for Matured
0 (0)

তখন আমি সবেমাত্র উড়তে শিখেছি। খোলা প্রান্তরে ঘুড়ির মতো ছুটোছুটিতে যেত সময়গুলি। তবে সে ঘুড়ির লাটাই ছিলো আম্মার কাছে। শরৎের আকাশে যে-ই ডানা মেলে উড়বো, ঠিক তখনই সুতো ধরে টান দিতেন আম্মাজান। অগত্যা আমাকে বর্ষার কালোমেঘের মতো আধাঁর মুখে ফিরতে হতো ঘরে। মা বারবার বোঝাতেন, “দেখ তুলি,

তোকে যে বারবার বলি,

 বয়সটা খারাপ মা, বেড়াস না আর অলিগলি।”

কিন্তু আমার বয়সটা তখন চপল পায়ে নেচে যাওয়া পাহাড়ি জলধারার মতো। কান আছে, কিন্তু শোনার সময় নেই;অস্তিত্ব আছে, কিন্তু অস্তিত্বহীন আত্মার মতো বাড়িতে আমার অবস্থান;  শনশন শব্দে  বিনা মন্দনে ছুটে চলাই তখন ব্যস্ততা। আমি হাসতাম, শীতের শীতল হাওয়া হু-হু করে আমার ওষ্ঠাধরে  চুমু দিয়ে যেতো। আমার ঠোঁট যেত ফেটে। আম্মা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে কি যেন বলতেন, আমি এককানে শুনে অপর কানকে বলতাম যেন বের করে দেয়। ভুলে যাওয়াতে আনন্দ আছে, শান্তি আছে। মামা ছিলেন তুখোড় মেধাবী। আইএ পরীক্ষায় বসার অভিজ্ঞতা চার বার। এ গর্বে ওনার চোখ ছলছল করতো। মেট্রিক পাশ করা ছেলেমেয়েদের প্রায়শই অভয় বাণী দিতেন,”আমার আইএ পরীক্ষার অভিজ্ঞতা চার-চার বার। আমি বলছি ভয়ের কিছুই নেই। শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করো।”

বলে রাখি, আমি পড়তাম লালকুঠির গার্লস হাই স্কুলে। আমার সবচেয়ে বেশি ভাব ছিল খালার সাথে। রুনা খালা। আমাদের সারাদিনের জমানো কথার বাক্সটা খুলে বসতাম রাতের বেলায়। মজার গল্প হলে বিছানায় গড়াগড়ি খেতাম দুজনে।  দুঃখের গল্প হলে লুটিয়ে পড়তাম রুনা খালার কোলে। আর কোনো দোষত্রুটি পেলে ও কর্কশ ভাষায় বলতো, কথা তো শোনোনা। এ-ই শেষ, রুনা খালা আর কক্ষনো কথা বলবেনা তোমার সাথে।” বলা বাহুল্য,  আমরা ছিলাম একে অন্যের পরিপূরক। ফলে ঐ “শেষ” আর আসতোনা।

  বেশ ক’দিন ধরেই লক্ষ করছিলাম আমাদের বাসায় তিন-চার জনের নিয়মিত আগমন। প্রথমে ভাবলাম বাবার কাছে কোনো কাজের জন্যই তাদের আসা-যাওয়া। তারপরে একদিন ঐ ক*জনকে  নানাভাই এর কামরাতেও দেখতে পাই। এরা কারা! মনে প্রশ্ন জাগে। আবার নিভে যায়।

স্কুলের দৌড় প্রতিযোগিতা, খেলাধুলায় ছিল পাকা অবস্থান। এ-ই আমার একমাত্র গর্বের জায়গা। তবে সবচেয়ে গর্বের স্মৃতি হলো সপ্তম শ্রেণিতে। সেবার  খেলাধুলায় ম্যাডেল নেয়ার সময় বঙ্গবন্ধুকে সালাম করার সুযোগ পেয়েছিলাম। উনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। ওটা মনে করলেই আমার লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়! আনমনে হেসে উঠি! মা খেলাধুলায় বাঁধা দিলেও সেদিনের পর থেকে কিছুটা নমনীয় হয়েছিলেন। হবেন নাই বা কেনো! ওনার মেয়ের উপর যে একটা বাংলাদেশ এসে হাত বুলিয়ে গিয়েছে!

 আশ্চর্য! আমি আম্মাকে বেশ কঠোর মানুষ হিসেবে পরিচিত করালাম কেন! উহু, আম্মা আমায় ঘুরে-ঘুরে বেড়ানোয় বাঁধা দিলেও তিনি ছিলেন আমার চোখে দুনিয়ার সবচেয়ে নরম মনের মানুষ। বকাঝকা করার পর মুখখানা পাশ ফিরিয়ে অন্যদিকে নেয়ার আগেই ওনার রাগ বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যেতো। কিংবা দ্রবীভূত হয়ে গলে যেতো। আম্মার একটা বিষয় আমায় খুব সাহস জোগাতো। এখনো জোগায়। ,”তিনি একজন নারী” এটা ছিল মায়ের সবচেয়ে বড় গৌরব। আমাকে বলতেন, ” জানিস মা তুলি, আমার সবচেয়ে বড় শক্তি কী?”

 আমার কাছে জবাব দেয়ার মতো অনেক উত্তর থাকলেও আমি না জানার ভান করে বলতাম, “কী?”

উনি বলতেন, “আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার নারীত্ব। আমি স্রষ্টার সৃষ্টিকূলের মাঝে সবচেয়ে মায়াবী।”

কিছুদিন পরে আমার চোখে স্পষ্ট হলো, আমাদের বাড়িতে খুব শীঘ্রই বিয়ের মৌসুম আসতে চলেছে। ঐ তিন-চার জন বোধহয় ছেলে পক্ষেরই লোক।

আমাদের যৌথ পরিবারে তখন বিয়ের উপযুক্ত একমাত্র রুনা খালা। মনে মনে আফসোসের দমকা হাওয়া বইতে লাগলো। রুনা খালাকে খুব শীঘ্রই হারাতে যাচ্ছি – এই শঙ্কায় গোমরামুখে কাটলো কিছুদিন। রুনা খালা একদম স্বাভাবিক৷ যেন কিছুই হয়নি। আমি জানতাম বিয়ের আগে-আগে মেয়েরা একটু অস্বাভাবিক হয়ে যায়, বাড়ি ছাড়ার শোকে কাতর হয়ে যায়। রুনা খালাকেই ব্যতিক্রম মনে হলো। এই মেয়েটাকে লাজলজ্জাহীন বলতে ইচ্ছে করলেও বলতে পারছিলাম না। তারপর বেশ কিছুদিন ওর সাথে খিলখিলিয়ে হেসে  আগের মতো গড়াগড়ি খাওয়া হতোনা। মেয়েদের জীবনটা কেমন যেন! বাবা-মা এতো আদর যত্ন করে বড় করেন আরেকটা বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য। বাবা ডিসি অফিসে চাকুরি করতেন। ওনাকে খুব ভয় পেতাম।  শুধু প্রার্থনা করতাম যেন শুক্রবার না আসে৷ কারণ, শুক্রবার সারাদিন বাবার বিশ্রাম দিবস। বৃহস্পতিবারের সূর্যাস্ত থেকে শনিবারের সূর্যদয়ের আগ পর্যন্ত বাবা এই বিশ্রাম দিবস শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতেন। এইসময়টায় বাড়ির বাইরে যাওয়াটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। চৌকাঠ পেরুতে গেলেই যেন আলোর বেগে বাবার কানে সিগনাল পৌছুত। অবশ্য এতে আফসোস ছিলোনা, বরং আনন্দই পেতাম। পরাধীনতা না থাকলে স্বাধীনতার স্বাদ মিষ্টি লাগেনা।

সেদিন রাতে ঘুমুতে যাবো, এমন সময় মা ডেকে নিয়ে গেলেন বাবার ঘরে। বাবার ঘরে মামা, নানাভাই, বাবা, নানি বসা। আমাকে বলা হলো বাড়িতে বর‍যাত্রী আসবে আগামীকাল। আমার মন ভারী হলো। রানু খালা তাহলে শীঘ্রই বাড়ি ছাড়ছে।

নানাভাই বললেন, ” তো, তোমাকে তো সাজতে হবে তাহলে।”

হাসলাম, “হুম সাজবো তো বটেই। রানুখালার বিয়ে বলে কথা।

বাবা বললেন, ” রানুর বিয়ে না।”

অবাক হলাম। বিয়ের উপযুক্ত তো আর কেও নেই এ বাড়িতে!

আম্মা বললেন, “রানুর বিয়ে না, তোমার বিয়ে।”

 শোনার পর চোখগুলো বড়বড় করে একবার সবার দিকে তাকালাম। নিজেনিজে খানিকক্ষণ প্রলাপ বকলাম। আমার জন্য বরযাত্রী আসবে কাল। অথচ আমি জানিইনা আমার বিয়ে!

কান্না জুড়ে দিলাম। মা, রানু খালা, নানি – সবাই মিলে বোঝাতে লাগলেন। আমি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়া বালিকা। এতো জোড়ে কান্না কখনো করেছি বলে মনে পড়েনা আমার। শেষরাতে এসে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যাই। ঘুমিয়ে যাবার আগে কী কী বলেছি আমার কিছুই মনে নেই। বোধহয় রাজি হয়েছিলাম। ১৯৭৪ সনে আমাদের বিয়ে হলো।

ঐদিন আমাকে নিতে বরযাত্রী এলো।  বরকে দেখলাম।

দেখার পর আরো অবাক হলাম। বর আর কেও না বরং রাশেদ নামের ঐ মুক্তিযোদ্ধা।  যখন বরপক্ষ আসা-যাওয়া করছিলো আমাদের বাসায়, তখন বেশ কথা হতো ওনার সাথে। ভাবিনি ইনার সাথেই আমাকে বেঁধে দেয়া হবে এ জনমে। বলে রাখি, এই মানুষটার ব্যবহার অমায়িক। ওনার হাসি চাঁদের চেয়েও সুন্দর।

 বিয়ের পরের সাত দিন পর্যন্ত শশুড়বাড়িতে যেতে চাইনি। অষ্টম দিনে গেলাম। চব্বিশঘণ্টা অব্দি ওনার সাথে থাকা হয়েছিল, কিন্তু একটা কথাও বলিনি ওনার সাথে। পরের দিন যখন আমাদের বাড়িতে ফিরলাম, নানি জিজ্ঞেস করলেন কথা হয়েছে কিনা।

বললাম, “না”

নানি ঠাস করে মেরে বসলেন।

“তুই মানুষ নাকি অন্যকিছু! বিয়ের প্রথম রাতও কাটিয়ে ফেললি তবু একটা কথাও বলিস নি!”

আমি লজ্জায় টুকটুকে জবার মতো লাল হয়ে গিয়েছি তখন। জবুথবু হয়ে বসলাম। একটু নালিশের স্বরে বললাম, “ধুর আমার কি লজ্জা করেনা? ও তো নিজেই কথা বলেনি আমার সাথে।”

নানি বোধহয় অনেক কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু কিছুই বলতে পারলেন না। পাশ থেকে আম্মা দোয়া করে দিলেন,”দেখিস, তোদের কথা কখনো ফুরোবেনা। অনেক ভালো থাকবি।”

আমার স্বামী আজ উপস্থিত নেই। ১২ই এপ্রিল  শব-ই-বরাতের দিনে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। সেদিন দুপুর বেলা একসাথে শুয়ে গল্প করছিলাম। হঠাৎ করে উনি লম্বা একটা শ্বাস নিলেন আর আমার হাতটা জোরে চেপে ধরলেন। সেই চুয়াল্লিশ বছর আগে অষ্টম শ্রেণির একটা বালিকা একটা অচেনা মানুষের হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করেছিল সারাজীবন পার করে দেয়ার। ১২ই এপ্রিল সেই মানুষটা আমার হাতটা শক্ত করে ধরে দুনিয়া ছাড়লেন। তখন হয়তো এই বালিকা জানতোনা ঐ হাতের উপর বিশ্বাস করে হাজার জনমও কাটিয়ে দেয়া যায়। রানু খালার অভাবটা টের পেতে দেননি কখনো। এ চুয়াল্লিশ বছরে এই মানুষটার সাথে যতো কথা বলেছি, তা দিয়ে গল্পের তাজমহল বানানো সম্ভব। যেখানে আজীবন শুয়ে থাকবে আমার প্রিয় গল্পের বাক্সটা।  এতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ আমি কখনো দেখিনি। ওনাকে যখন শেষ বিদায় দিলাম, লাশের পাশে কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম, ” ভালো থেকো অর্ধাঙ্গ।জান্নাতের সিঁড়িতে আমাদের আবার দেখা হবে, ইন শা আল্লাহ।”

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post আলো থেকে আলিয়া| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | অনীশ ব্যানার্জ্জী | Bengali Stories for Matured
Next post মুক্তির স্বাদ| কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য | -| Bengali Stories for Matured