অশনি| প্রেমে পড়া বারণ |খোরশেদ হাসান আবির| Bengali Love Story
0 (0)

হাতঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে সময়টা দেখল রবিন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। আজকে রিপোর্টটা অনেক ভাল হয়েছে। ঢাকা থেকে যে প্রোজেক্ট এর উদ্দেশ্যে দিনাজপুর আসা তা সফল হয়েছে  বলা যায়। টেপরেকর্ডারটা ব্যাগে রেখে রয়াল রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এর পাশের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল রবিন। দেশ টিভি ‘র একজন নামকরা রিপোর্টার সে। ৩ বছর ধরে তার চাকরির খাতিরেই ঘুরেছে অনেক নতুন নতুন জায়গা। কিন্তু দিনাজপুরে এই তার প্রথম আসা নয়। তার আব্বার বদলির কারনেই ঠাকুরগাঁ থেকে দিনাজপুরে এসেছিল। একবছর থেকেই ঢাকা শিফট হতে হয় তাদের। প্রায় ১০ বছর পর এখানে আসা। রাস্তার চারপাশে তাকায় রবিন। কত কি পরিবর্তন হয়েছে! এসব ভাবতে ভাবতে লিলির মোড় এর কাছে চলে এসেছে। রাস্তার ডানে একটা সাদা দোতালা বাড়ির দিকে চোখ পড়ল তার। দোতালা বাড়িটায় কোনও বাতি জ্বলছে না। ল্যাম্পপোস্টের বাতিতে বাড়িটার নাম চোখে পড়ল। বাড়ির সানসেটের সামনে কালো রঙ দিয়ে লিখা ‘স্বপ্ননীড়’। বাড়িটা সে চিনে। বাড়িটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সে। কই থেকে যেন এক বেহালার সুর শুনতে পেল সে। যেন কেউ খুব আদরের সাথে মৃদুভাবে বাজাচ্ছে। এই সুর তার চেনা। তার হাত কাঁপছে। এ কিকরে সম্ভব! নিজেকে বারবার প্রশ্ন করলেও কোনও উত্তর পায় না সে। সুরটা যেন আশেপাশের সবকিছুকে ধির করে দিয়েছে। রবিনের বুকের বা পাশটা দুকদুক করতে লাগল। ১০ বছর আগে এখানকার ঘটনা বেহালার সেই পরিচিত সুরের সাথে তাল মিলিয়ে কোনও চলচ্চিত্রের মতো চোখের সামনে ভাসতে লাগল। নিজের চোখকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না রবিন। কাঁদছে সে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল একটি নাম। “অশনি”

২০১০। খাতার নিচে সাল এর একপাশে তারিখটা দিয়ে নিল রবিন। ঠাকুরগাঁ থেকে আসার ৩ দিন হয়ে গেছে। আব্বুর কথায় আজ থেকে কলেজ শুরু করতে হবে। কোনমতে খেয়ে নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওঁ দিল। বাসা তাদের ঘাসিপারাতে। রিকশায় কলেজ যেতে ৭-৮ মিনিটের মতো লাগল। সেকশন সি রুম নাম্বার ২০৩। ক্লাস তখনও শুরু হয়নি। খারাপ বিষয়টা হল যে এতগুলো ছেলেমেয়েদের মধ্যে কাউকে চেনে না সে। যেখানে সবাই সবার সাথে কথা বলছে আর সেখানে সে ঘাপটি মেরে পিছনের বেঞ্চে বসে আছে। হঠাৎ পাশের বেঞ্চ থেকে একটা কলম উড়ে নাকে লাগল রবিনের। কলমটা হাতে নিয়ে পাশের বেঞ্চে তাকাল। কয়েকটা মেয়ে হাসাহাসি করছে আর একটা মেয়ে দু’কানে হাত দিয়ে তার উদ্দেশ্যে সরি বলার এর ভঙ্গি করছে। মেয়েটার চোখগুলো টানাটানা আর মণিগুলো মনে হল সাধারণ মানুষের চেয়ে তুলনামুলক বেশি কালো। তার দুঠোঁটের কোনায় একটা হাসির ভাব লেগে রয়েছে। রবিন হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না কি করা উচিৎ। সে কি কিছু বলবে নাকি কিছুই না বলেই কলমটা তাদের দিকে এগিয়ে দেবে। একটু পরই তারই এক বান্ধবী রবিনের হাত থেকে কলমটা নিল। রবিন ভাবতে লাগল যে এভাবে তাকিয়ে থাকার কি কোনও মানে হয় না। নিজের প্রতি এক বাজে অনুভুতি জন্মাল। কলেজ শেষে দেখা হল আরিফের সাথে। আব্বুরই কলিগের ছেলে, গতকাল পরিচয় হয়েছিল। “এ” সেকশনে সে। যাক কাউকে তো পরিচিত পাওয়া গেল। আরিফ ছেলেটা খুব মিশুক স্বভাবের আর খুব হাসিখুশি। বলল, “কলেজের মোড়েই খুব ভালো চা আর সিঙ্গারা পাওয়া যায়, চলবে নাকি?”

রবিন হাসিমুখেই জবাব দিল, চলবে না, দৌড়বে। কিন্তু আগে একটু লাইব্রেরি রুমে যেতে হবে। এই সদস্য ফর্মটা জমা দিবো।

“আচ্ছা, তাহলে একসাথে যাওয়া যাক।”

লাইব্রেরিয়ান এর ডেস্কের কাছে যেতেই চোখ পড়ল সেই মেয়েটির দিকে। হাতে একটা বই, হয়ত নিচ্ছে নাহলে জমা দিচ্ছে। তখন তার চুলে লাইবেরির বারান্দা দিয়ে আসা আলো। চুলকে সোনালি করে দিচ্ছে। রবিনকে দেখে সে এক মুচকি হাসি দিল। রবিন একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা বই হাতে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “তুমি কলেজে নতুন?”

রবিনের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোলো না। খালি হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ালো। রবিনের কেনজানি সবকিছু হালকা লাগছে। মেয়েটার চোখগুলোর কালো মণিতে থেকে থেকে নীল হলুদ আভা দেখতে পাচ্ছে সে। মনে হচ্ছে গাঢ় মেঘের মধ্যে বজ্রপাত হচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে আছে রবিন যেন এক শিশু আকাশপানে চেয়ে বজ্রপাত দেখছে। মেয়েটার ঠোঁট নড়ছে। তার কোনও কথা কানে আসছে না রবিনের। পেছন থেকে আরিফ কাধ ধরে ঝাঁকি দিতেই সেই রাজ্য থেকে ফিরে এল রবিন। এবার মেয়েটির কথা শুনতে পেল সে,

“আমার এক ফ্রেন্ডকে কলমটা মারতে গিয়ে তোমাকে লেগেছে, সরি।” কিচ্ছুক্ষণ থেমে সে বলল, “তোমার নাম”?

রবিন তবুও চুপ করে থাকল। তার কথা যেন গলা থেকে বের হচ্ছিল না। শেষপর্যন্ত আরিফই পাশ থেকে বলল, “ওর নাম রবিন।”

মেয়েটা আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু বারান্দা থেকে তার বান্ধবীরা ডাকল ও সে ছুটে গেল বাহিরে।

আরিফ হাসতে হাসতে বলল, “অমন থ মেরে গিয়েছিলি কেন? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অসাড় হয়ে গিয়েছিল।”

“কই না তো।”

“সেজন্য কাধে ঝাঁকি দিয়ে হুঁশ ফেরাতে হল।”

ফর্ম জমা দিতে দিতে আরিফের দিকে তাকিয়ে বলল,”মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করা হল না রে।”

“সেকি, সে তো বলল, তুই কি কিছুই শুনিসনি? মাথাটা আসলে গেছে তোর।”

রবিন বুঝতে পারল মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আশেপাশে কি হচ্ছে কোনও কিছুর হুঁশ ছিল না তার। রবিন বলল, “বুঝতে পারিনি কী বলল।”

রবিন আর একদফা হেসে নিয়ে বলল, “ওর নাম অশনি।”

“রশ্নি?”

“আরে রশ্নি না, অশনি। অ-শ-নি।”

“বুঝতে পেরেছি।”

কলেজে রোডের একটা দোকানে কড়া লিকারের চা আর গরম গরম সিঙ্গারা বেশ জমলো। শীতের সময় এর থেকে ভাল নাস্তা আর কি আছে? আজ অবশ্য তেমন শীত নেই। খাওয়া শেষে বাসার দিকে রওঁ হল রবিন। আরিফের বাসা বড়মাঠের দিকে, তার বাসার ঠিক উল্টো পথে তাই একসাথে যাওয়া হল না। রিকশা না নিয়ে রবিন হাঁটা শুরু করল। লিলির মোড় এর কাছের রাস্তায় আসতেই তার চোখ পড়ল পাশের গলির এক সাদা দোতালা বাসার দিকে। সানসেটে বাসার নাম লেখা “স্বপ্ননীড়”। সামনে কিছু টবে অনেকগুলো ডালিয়া ফুলের গাছ লাগানো। সঙ্গে বেশ কিছু কচমচ ও গাঁদা ফুলের গাছও আছে। দোতালার একটা জানালায় একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। অশনি বলে মনে হচ্ছে না? হ্যাঁ অশনিই। অশনিরও চোখ পড়ল তার দিকে। সটান করে জানলা থেকে সরে গেল ও কিচ্ছুক্ষণ পর নিচের গেট খুলে বেরিয়ে এল।

“আরে রবিন! আমার বাসা চিনলে কীভাবে?’

রবিন এক আজব পরিস্থিতিতে পড়ল। কি উত্তর দিবে তা বুঝতে পারছে না সে। অশনির চোখ তাকে আবার সম্মোহিত করছে। রবিনের মস্তিস্ক তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধ করে যাচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে রবিন বলল,

“আমি এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম… জানলায় তোমাকে দেখলাম…”

অশনি হেসে উঠল। তার চোখের মতো হাসিতেও একটা ব্যাপার আছে। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা হাসলে মনে হয় তাদের চেহারা গোলাপের মতন ফুটে উঠেছে। এসব মানুষ কাঁদলেও মায়াবী ভাব চলে আসে। অশনিও হয়তো তাদের মধ্যে পড়ে। হাসিমুখেই অশনি একটু অবাক হবার অভিনয় করে বলল,

“তুমি কথাও বল! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বোবা।”

“রবিন তোতলাতে লাগল, না মানে… ইয়ে…”

“আচ্ছা যাই হোক, আমার বাসা পর্যন্ত যখন এসেছ তখন বাহিরে না দাঁড়িয়ে ভিতরে এসো।”

রবিন যতই না করুক না কেন শেষ পর্যন্ত অশনির কথাই রাখতে হল। বাসায় ঢুকে সোফায় বসতে বসতে রবিন জিজ্ঞাসা করল, “তোমরা কি এখানকার স্থানীয়?”

“না, আমরা জয়পুরহাট ছিলাম। আব্বা মারা যাবার মা ছোটবোন আর আমাকে নিয়ে এখানে আসেন। প্রায় ৪ বছর হল এখানে আছি।’

কথাটা বলেই অশনি পাশের ঘরে চলে গেল। রবিন বুজতে পারছে না বিষয়টা টেনে আনা ভুল হল নাকি। কিচ্ছুক্ষণ পর অশনি চা নিয়ে আসলো। চা এর কাপ দিতে দিতে বলল,

“তোমরা আগে কই ছিলে?”

“ঠাকুরগাঁ, কিন্তু হুট করে আব্বুর বদলি হওয়াতে এখানে। আচ্ছা, তোমার মা কি করেন?”

প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে অশনি একটা উলটা প্রশ্ন করে বসল।

“আজকের যে ২য় পিরিয়ডের বাংলা ক্লাস হল। কেমন লেগেছে ম্যাডামের ক্লাসটা?”

পাল্টা প্রশ্ন করাতে রবিন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসল। নিজেকে একভাবে সামলে নিয়ে বলল,

“ভালই লেগেছে।”

“উনিই আমার মা। এখন অবশ্য তিনি বাসায় নেই, বোনকে নিয়ে একটু বাজারে গেছেন। থাকলে তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতাম।”

রবিন চমকে উঠল। অশনি হাসতে লাগে। কিছুক্ষণ কথা এভাবে কথা বলার পর রবিন যাবার জন্য উঠে।

“আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে, বাসায় যেতে হবে।”

“আচ্ছা, তোমাকে আর আটাকে রাখব না। কাল তো শুক্রবার, কাল বিকালে পার্কে আসতে পারবে? এই সাড়ে চারটের দিকে। একটু ঘোরাঘুরিও হবে।”

“আচ্ছা, পার্কটা কোথায়?”

“বললে চিনবে কিনা সন্দেহ। তার চেয়ে ভাল রিক্সায় উঠে বলবে পার্কে যান।”

“আচ্ছা।”

“তাহলে কাল বিকাল সাড়ে চারটে। ডোন্ট বি লেট।”

 রাত মনে হয় কাটতেই চায় না। রবিনের বারবার অশনির কথাই মনে হতে লাগল। অশনি, নামটাও তার মতো সুন্দর। অশনি নামের মানে কি। বিছানা থেকে উঠে রবিন গেল তার আব্বুর বুকশেলফ ঘাটতে। অনেক খুঁজে নামের অর্থের একটা বই পেল। “অ” দিয়ে মেয়েদের নামের সারিতে খুঁজতে থাকল। খুব বেশি খুঁজতে হল না। লিখা রয়েছে, “অশনি – বজ্র/ বজ্রপাত (lightning)”। বিছানায় শুতে শুতে রবীন্দ্রনাথের কবিতার দুটো লাইন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস-

তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ”

এখানে চৈত্রের জায়গায় পৌষ মাস হলে বিষয়টা জমত। তার মাথায় এসব ঘুরপাক খাচ্ছে কেন? সে কি অশনির প্রেমে পড়েছে?

অশনির সাথে দেখা করার জন্য তর সইছিলনা না রবিনের। ৪.১৫এর দিকে রওঁ দিল সে পার্কের দিকে। পৌঁছল সাড়ে চারটের একটু আগে। পার্কটা সুন্দর। পার্কে ঢুকে এদিক সেদিক খুঁজতে লাগল অশনিকে। অশনির মোবাইল নম্বরটা নিতে হত। ফোন দিয়ে জানা যেত কোথায় আছে সে। একটু ঘোরাঘুরি করতেই আরিফের আওয়াজ শুনতে পেল। একটা বড় গোল বেঞ্চে আরিফ আর তার কিছু বন্ধুবান্ধব আড্ডা দিচ্ছে। রবিন সেদিকএ এগিয়ে গেল। আরিফ সবার সাথে এক এক করে রবিনকে পরিচয় করিয়ে দিল। সাজ্জাদ, মারুফ আর মারজানা। কোনও উপায় না পেয়ে তাদের সাথেই গল্পে লেগে বসল সে। কথাবলার ফাঁকে ফাঁকে এদিক সেদিক দেখতে লাগল কোথাও অশনিকে দেখা যায় কিনা। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বাসার দিকে রওঁ দিল রবিন আর নিজেকে এই বলে সান্তনা দিতে লাগল যে কাল কলেজে তো অশনির সাথে দেখা হবে।

পরদিন কলেজে হুট করে অশনি এসে চমকে দিল রবিনকে। একটু মশকরা করে বলল,

“কি মিঃ রবিনহুড, গতকাল পার্কে আপনার সঙ্গদল নিয়ে কোন রাজার ধন চুরির প্ল্যানিং করছিলেন?”

রবিন ভাবতে লাগল অশনি কি তাকে দেখেছে? সে তো ভাবেছিল অশনি পার্কে আসেইনি। কীভাবে দেখল সে? সে অশনিকে দেখতে পেল না কেন? কেনজানি রবিনহুড ডাকটা শুনে ভারি ভাল লাগল রবিনের। সে যদি রবিনহুড হয়ই তাহলে অশনি কি মারিয়ান? সাধারণ ভঙ্গিতে রবিন বলল,

“কই ছিলে তুমি? কত খুঁজলাম তোমায়।”

অশনি একটু লাজুক ভঙ্গিতে বলল, “আসলে আমি যেতে লেট করেছিলাম। ভেবেছিলাম তোমাকে গেটের সামনে পাব তোমায়। ভেতরে গিয়ে দেখি তুমি তোমার ফ্রেন্ডের সাথে। তোমাকে ডাকতাম কিন্তু সেসময় আম্মুর ফোন আসে। একটা কাজ ছিল তাই চলে যাই।”

“ও আচ্ছা”

“আজকে বিকালে আমার বাসায় আসতে পারবে?”

“আচ্ছা যাব।”

এভাবে বেশ কদিন চলতে থাকে। অশনির মা ও তার বোন অহনার সাথে পরিচয় হয়। অশনির মাও রবিনকে পছন্দ করে। একদিন কলেজ শেষে রবিন গেট দিয়ে বের হচ্ছিলো সেইসময় একজন তার দিকে হাত দেখিয়ে ইশারায় ডাকল। মুখভর্তি চাপদাড়ি আর চোখে কালো চশমা। দেখে কলেজের সিনিওর গোছের কেউ মনে হয়। আশেপাশে আরও ৫-৬ জন চা এর দোকানে বসে চা খাচ্ছে। খুব সম্ভবত ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত আছে। রবিন এগিয়ে গেল। সে ভদ্র ভাষায় বলল,

“নাম কী তোমার?”

“রবিন”

“কোন সেকশন?”

“সি”

“আচ্ছা যাও।”

রবিন এসবের কিছুই বুঝল না। চলে যাচ্ছিল। আরিফের ডাকে থামতে হল। আরিফ এসে তার হাত ধরে নিয়ে গেল দুরের এক চা এর দোকানে। এখানে আরিফকে আগে কখনও আসতে দেখেনি সে। ভেতরে বসে দুটো চা এর অর্ডার দিয়ে আরিফ একটা সিগারেট ধরালো। দুটো টান দিয়ে রবিনের দিকে এগিয়ে দিল। রবিন বলল,

“নাহ, আমি খাই না”

“ওহ, আরও একটা টান দিয়ে আরিফ বলল, জাবেদ ভাইয়ের সাথে কি করছিলি?”

“ওঁওঁর নাম জাবেদ? আমাকে তো নাম আর কোন সেকশন জিজ্ঞাসা করল।”

“আসলে এখানের সিনিয়র। মন্ত্রী আলাউদ্দিন কে চিনিস? তুই চিনবিই বা কীভাবে। ওঁওঁর ডানহাত হল এই জাবেদ ভাই। তুই তো এসেছিস মাত্র ৩-৪ সপ্তাহ হল, জানিস না কিছুই। তোর ঐ ফ্রেন্ড অশনিকে ভালবাসে এই জাবেদ ভাই। অশনির সাথে কোনও ছেলের মেলামেশা সহ্য করতে পারে না। গতমাসে কলেজের প্রতি ক্লাসে বলে গেছে ওর দিকে বাজে চোখে যেন কেউ না তাকায়। অশনির সাথে তো তুই ইদানীং খুব ঘোরাঘুরি করছিস তাই আজকে তোর নাম আর সেকশন শুনে রাখল।”

রবিন খালি শুনতে থাকল। তার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোলো না। একটু ভেবে বলল,

“অশনি কি এই জাবেদ ভাই এর বিষয় জানে?”

আরিফের সিগারেট প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সে বলতে লাগল,

“বলতে পারছি না। ওর গুটিকয়েক বান্ধবী ছাড়া কেউ তো ওর সাথে তেমন কথা বলতে সাহস পায় না। ওর বান্ধবিদের কাছ থেকে জেনে থাকলে তো জানলোই। আচ্ছা যাই হোক, আমি চাই না তুই কোনও বড় সমস্যায় জড়িয়ে পড়িস।”

সাথে সাথে ওদিক থেকে আরিফের ডাক পড়ল। চা এসে গেছে। চা এর বিল দিয়ে আরিফ চলে গেল। চা খেতে খেতে রবিন ভাবল। অশনিকে ভালবাসে সে। অশনি কি তাকে বন্ধু  হিসেবেই দেখে। সে কি নিজের মনের কথা অশনিকে জানাবে সে। দেখবে কি অশনির মনে তার জন্য জায়গা আছে কিনা। না, ভয় হয়। অশনি যেন পরে তাকে অন্য চোখে না দেখে। অশনিকে কাছে পেতে গিয়ে যেন সে দূরে ঠেলে না দেয়।

বেশ কয়েকদিন হয় গেছে। কলেজ বন্ধ। দেশের অবস্থা অনেক খারাপ। যখন তখন হরতাল হচ্ছে। মানুষ তেমন ঘর থেকে বের হচ্ছে না। সেদিন শোনা যায় কোথায় যেন বোমাবাজি হয়েছে, দুজন পুলিশ সহ একজন আন্দোলনকারী মারা যায়। পুলিশ সবসময় আরমর পরে শটগান হাতে রাস্তা পাহারা দিচ্ছে। তবুও এত কিছুর মাঝে রবিন অশনির সাথে দেখা করতে যায়। যত দিন যাচ্ছে মনে হচ্ছে অশনিও তাকে ভালবাসে। কথায় কথায় তাদের মধ্যে অনেক মিল বেরিয়ে পড়ে। এই যেমন দুজনের ডালিয়া ফুল খুব পছন্দ। বিশেষ করে লাল ডালিয়া জাতে একটু সাদা আভা থাকে। একদিন রবিন অশনির সাথে বসে গল্প করছে। রবিনের চোখ যায় রুমে তার টেবিলের এক কোনে পড়ে থাকা একটা বেহালার বাক্স। অনেকবার তো সে অশনির বাসায় এসেছে, এটার দিকে কোনওদিন চোখ পড়েনি তো! অশনি নিজের সম্পর্কে কত কিছুই না বলেছে, কই তার এই বেহালাটার বিষয় কিছু বলেনি তো!

“তুমি বেহালা বাজাও?”

তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তারপর নিজেকে একপ্রকার সামলে নিয়ে বলল,

“না, বাজাতে পারি কিন্তু বাজাই না। আমার বাবা দিয়েছিল ওটা আমার ১০ বছরের জন্মদিন উপলক্ষে। আগে খুব বাজাতাম। বাবা মারা যাবার পর ওটা আর কেমন জানি বাজাতে পারি না। বাজাতে পারি না বলা ভুল হবে, আসলে যে সুর তুলতে চাচ্ছি সেটা উঠে না। আর এমনিতে আগে যখন বাজাতাম কারো সামনে বাজতে পারতাম না। একা বাজাতাম।”

রবিন তাকে অনেক অনুনয় বিনয় করল ওটা বাজানোর জন্য কিন্তু তাতে কোনও কাজ হল না। যতবারই ঐ প্রসঙ্গ উঠছিল অশনি ভিন্ন প্রসঙ্গ চালু করছিল। আজ অশনির কাছে বিদায় নিয়ে পাশের গলি দিয়ে রওঁ হল রবিন। দুপা হাঁটতেই দেখে জাবেদ ভাই বেশ কয়কজনের সাথে ল্যাম্পপোস্টর নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে তাই ল্যাম্পপোস্টর আলো পড়েছে তাদের মুখে। রবিনকে ইশারা করে ডাকতেই তার দিকে এগায়ে গেল সে। কোনও কথা ছাড়াই রবিনকে একটা চড় লাগিয়ে বসল জাবেদ। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলতে লাগল, “আর যেন তোকে এই পাড়ায় না দেখি।”

প্রেম নাকি মানুষের সাহস দশগুণ বাড়িয়ে দেয় তার হাতেনাতে প্রমান পেল রবিন। নিজের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে জাবেদ ভাই এর মুখ নিশানা করে লাগিয়ে দিল এক ঘুষি। হুমড়ি খেয়ে পড়ল জাবেদ। পরক্ষনেই সে বুঝতে পারল তার হাত দুই দিক দিয়ে দুজন ধরে রেখেছে। জাবেদ কোনরকমে উঠে এসে রবিনের মুখে ক্রমাগত ঘুষি চালাতে লাগল। রবিনের নাক মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। হাত দুটো ছেড়ে দিতেই সে মাটিতে পড়ে গেল। “দ্বিতীয়বার এই জায়গায় না দেখি” এইকথা বলে তার সঙ্গীসমেত চলে গেল জাবেদ ভাই। অন্ধকার হয়ে আসছে। চারিদিকে হালকা কুয়াশা পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। পাশাপাশি ভেসে আসছে শীতের মিহি বাতাস। রবিন উঠে দাঁড়াল। কুয়াশার বুক চিরে কিছু দূর থেকে যেন বেহালা এর একটা সুর যেন ভেসে আসছে। সে যেন এক অপরূপ সুর। পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলছে। গাছের পাতা যেন সেই সুরেকেই  অনুকরন করে দুলছে। কুয়াশার আস্তরন যেন পাতলা হয়ে আসছে। রবিন শরীরের সব ব্যাথা ভুলে গেল। অশনিদের জানালার কাছে এসে দাঁড়াতেই সুরটা আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কতক্ষণ যে অশনি বাজিয়েছিল এ সুর কতক্ষন যে রবিন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তা মনে নেই।

দুদিন অশনির সাথে দেখা করল না রবিন। তার চোখে মুখে কালো দাগগুলো হালকা সেরে গেলেই আবার যাবে সে এবং এবার সে অশনিকে নিজের ভালবাসার কথা বলবে। আজ একটা লালসাদা ডালিয়া ফুল জোগাড় করে গেল অশনির বাসায়। কলিংবেল দিল, বুক দুকদুক করছে। দরজা খুলে অশনির বোন অহনা। তাকে অশনির রুমে বসতে বলল। অশনি নাকি ওর এক বান্ধবির বাসায় গিয়েছে, কখন ফিরবে বলে যায়নি। রবিন কিচ্ছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখল যখন অশনি ফিরছে না তখন পাশের টেবিল থেকে একটা কাগজ কলম নিয়ে লিখল,” অশনি, আমি তোমাকে ভালবাসি… “এরপর নীচে নিজের নাম লিখে কাগজটা রেখে দিল আর ডালিয়া ফুলটা তার একপাশে রেখে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তা দিয়ে একটা মিছিল যাচ্ছে। রবিন মিছিলের মধ্যেই ঢুকে পড়ল। লিলির মোড় এক দিকে যাচ্ছে মিছিল। কিচ্ছুক্ষণ পর মিছিল আর এগোল না। পুলিশ আর সামনে যেতে দিবে না। কই থেকে গুলির শব্দ শোনা গেল। পুলিশ গুলি করেছে? না, আন্দোলনকারীদের কেউ ওকজন গুলি ছুড়েছে। দূরে দেখা যাচ্ছে একজন পুলিশ এর দেহ  রাস্তায় পড়ে আছে। পুলিশরা একের পর এক রাবার বুলেট ছুঁড়তে থাকলে মানুষজন এলোপাথারি ছুটে থাকে। রবিন ভিড়ে ধাক্কা খেতে খেতে এগিয়ে যায় উল্টো দিকে। কেন জানি মনে হল সে অশনিকে দেখতে পেল। হ্যাঁ, অশনি এদিক অদিক খুঁজছে রবিনকে। পরীর মতো একটা সাদা জামা পড়া। হাতে তার সেই ডালিয়া ফুলটি আর রবিনের লিখা চিরকুটটি। চিৎকার করে রবিনকে খুঁজছে সে শত মানুষের ভিড়ে। রবিন অশনি বলে ডাক দিতেই দেখতে পেল তাকে। দুজনের চোখে চোখ পড়ল। ওদিকে গুলির শব্দ জোরালো হচ্ছে। রবিন মানুষের ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে তার দিকে। অশনি তার ডানহাত বাড়িয়ে আছে তার দিকে। চারিদিকে মানুষ তাদের হিংসা ও রাগে লেগে যাওয়া এক যুদ্ধ আর তার মধ্যে রবিন অশনি ও তাদের ভালবাসা। রবিন আর অশনির মধ্যে ১০-১২ হাতের তফাত তখন রবিন দেখল অশনির সাদা জামা লালা রঙ ধারন করছে ধীরে ধীরে। বুক দিয়ে বেরিয়ে আছে লাল রক্ত। অশনি তার দিকেই হাত বাড়িয়ে রেখেছে। রবিন “অশনি… অশনি…” বলে চিৎকার করতে করতে ভিড় ঠেলে এগোচ্ছে। অশনির দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার মুখ আর হাত রবিনের দিকে। রবিন নিজের মাথার পেছনে এক ব্যথা অনুভব করল। কোনও ইট জাতীয় কিছু মাথায় এসে লেগেছে। তার চোখ  ঝাপসা হয়ে আসছে। সে মাটিতে পড়ে গেল। হামাগুড়ি দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছে সে অশনির দিকে। প্রথম দিন অশনির কালো চোখে সে যে নীল হলুদ দীপ্তি দেখেছিল সেটা আর নেই। তার বদলে চোখের এক কোনে পানি। যেন বজ্রপাত শেষে বৃষ্টির ফোঁটা। চারিদিকে গোলাগুলির শব্দ। সবকিছুর মাঝে তারা দুজন পড়ে রয়েছে রাস্তায় রয়েছে। রবিন নিজের সব শক্তি হামাগুড়ি দিয়েই অশনির হাতটি ধরতে এগোচ্ছে কিন্তু তার মস্তিস্ক তা করতে দিল না। রবিন জ্ঞান হারায়।

জ্ঞান ফিরতে রবিন নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করল। রবিনের মা বাবা, আরিফ, মারজানা সহ আরও অনেকে তাকে দেখতে এসেছে। কিন্তু সে সবাইকে চিনতে পারছে না। সেদিন শুধু মা বাবাকেই চিনতে পেরেছিলো। আরিফ অনেক ঘটনা বলে কিন্তু রবিন কিছু মনে করতে পারছি্ল না। ডাক্তার বলেছিল মাথার পেছনে চোট পাওয়ায় পোস্ট ট্রম্যাটিক আম্নেসিয়া হয়েছে। বেশ কিছু মেমোরি মুছে গেছে। সেগুল রিকভার হবে তবে ঠিক কবে হবে বলা যাচ্ছে না। দশদিনও লাগতে পারে আবার দশ বছরও। রবিন হালকা সেরে উঠতেই তার বাবা বদলি নিয়ে ঢাকা চলে আসে। রবিন তার জীবন থেকে অশনি নামের অধ্যায়টা আর মনে করতে পারেনি।

আজ এতবছর পর তার সব কথা মনে পড়েছে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে। সব কষ্টগুলো তাকে একবারে আঘাত করছে। সে তার চোখের পানি আটকাতে পারছে না। তার কানে আসছে সেই মায়াবী বেহালার সুর। আর তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে একটি নাম, “অশনি”।

About Post Author

9F10 AB

Click to rate this post!
[Total: 0 Average: 0]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous post স্বপ্নের জলছবি| প্রেমে পড়া বারণ | শ্রী স্নেহাশিস সামন্ত| Bengali Love Story
Next post নতুন ভোর | প্রেমে পড়া বারণ | শঙ্খসাথি| Bengali Love Story