আজ শহরের চেম্বার থেকে বেরোতে অনেকটা দেরী হয়ে গেল। অনেক রোগী আজ চেম্বারে এসেছিল। যদিও অয়ন জেনারেল ফিজিসিয়ান, ভালো ডাক্তার হিসাবে এখন একটু নামডাক হয়েছে। তাই রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অয়নের অপারেশনের হাতটা বেশ ভালো। বাড়ির চেম্বারে কিছু কিছু অপারেশনের কাজও সেরে নেয়। যদিও এটা অফিসিয়াল নয়। মফস্বল শহরে কেউ এ ব্যাপারে কিছু বলে না। এমনিতে এই ছোট শহরে কয়েকজন মাত্র ডাক্তার বসে, তাই কোনটা অফিসিয়াল আর কোনটা আনঅফিসিয়াল সে ব্যাপারে কারো মাথাব্যথা নেই। প্রতি সপ্তাহে সোম থেকে শুক্রবার অয়ন শহরের বাড়িতে থাকে। সকালের দিকে অপারেশনের কাজগুলো সেরে নেয়। তারপর খাওয়াদাওয়ার পর চেম্বারে ঘণ্টা তিনেক রোগী দেখা। বিকেলের দিকে বিশ্রাম, আবার সন্ধ্যে থেকে রাত্রি ন’টা পর্যন্ত রোগী দেখা। এটাই রোজকারের রুটিন।
শহরের চেম্বারের পাশাপাশি গ্রামের ভেতরে একটা চেম্বার আছে। ওখানে গোপনে কিছু অস্ত্রোপচারের কাজ করা হয়। ওখান থেকে অয়নের আয় বেশ ভালোই হয়। প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার শহরের চেম্বার সেরে রাত্রে গ্রামের চেম্বারে চলে যায় অয়ন। বছর চারেক আগে চারদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা চার কাঠা জমি কিনে দোতলা একটা বাড়ি করেছে গ্রামে। উপরতলাতে একটি ঘরে, অয়ন যখন এখানে আসে তখন থাকে। একটি ঘরে বিশু ও সবিতা থাকে। বাকী ঘরগুলি খালি রাখা আছে অতিথিদের জন্য। নীচতলায় একটি ঘরে চেম্বার, দুটি ঘর নিয়ে একটা মিনি নার্সিংহোম। আর একটি ঘর অপারেশন থিয়েটার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আজকাল শহরে যুবক-যুবতী দের মধ্যে অবাধ মেলামেশার সুযোগে বিয়ের আগে যুবতীদের গর্ভবতী হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। অপারেশনের হাত যেহেতু ভালো তাই অয়নের কাছে গর্ভপাতের প্রচুর কেস আসে। লোকচক্ষুর আড়ালে গ্রামের এই চেম্বারে অয়ন এই কেসগুলি ডিল করে। গ্রামেরই ছেলে বিশু এই চেম্বারে অয়নের সহকারী হিসাবে কাজ করে, বিশুর স্ত্রী সবিতা নার্সের দায়িত্বটা সামলে নেয়। ওরা দুজনেই অয়নের খুব বিশ্বাসভাজন। গর্ভপাতের কেসগুলি অয়ন গ্রামের চেম্বারে পাঠিয়ে দেয়। শুক্রবার রাতে বিশু ও তার স্ত্রী সবিতা অয়নের পাঠানো যুবতীদের ভর্তি করে নেয়। প্রাথমিক কাজগুলো ওরাই সেরে রাখে। অয়ন শুক্রবার রাতে ওখানে পৌছায়, ভোরবেলা একটু অন্ধকার থাকতে থাকতে অপারেশনের কাজ শুরু হয়ে যায়। দিনের আলো ভালোভাবে ফোটার আগে সব কাজ সেরে নেওয়া হয়। অপারেশনের পরে অবাঞ্ছিত ভ্রূণগুলোকে মাটি খুঁড়ে পুঁতে দেওয়ার কাজটি বিশু ও সবিতা খুব সাবধানে করে থাকে। এই ক’বছরে কত ভ্রূণ যে এই বাড়ীর চারপাশে মাটির নীচে পোঁতা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মাঝে মাঝে ভ্রূণগুলো এতটাই বড় থাকে যে সেগুলো নষ্ট করতে অয়নের হাত কাঁপে। অয়ন জানে সে পাপ কাজ করছে। কিন্তু এই কাজের বিনিময়ে সে যে অর্থ দাবী করে তা খুবই লোভনীয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ধনীর ছেলেমেয়েরাই এই ভুল করে থাকে। সমাজে লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে তারা যে কোন পরিমাণ অর্থ দিতে রাজী হয়ে যায়। অয়ন এ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে গ্রামে নিভৃতে এই চেম্বারটি খুলেছে। আজ অয়নের যে এত প্রভাব প্রতিপত্তি, বাড়ী গাড়ী তার বেশীর ভাগটাই এই আয় থেকে হয়েছে।
গ্রামের চেম্বারটা শহর থেকে প্রায় এক ঘণ্টার পথ। গ্রামে বসতির সংখ্যা খুবই কম। একটা বাড়ি থেকে আরেকটা বাড়ির দূরত্ব বেশ ভালোই। যেদিকে চোখ যায় শুধু চাষের জমি। জমির বুক চিরে মাটির রাস্তা গ্রামে ঢুকেছে। খুবই নির্জন রাস্তা। রাস্তায় এখনো পীচ পড়েনি। লাল মোরাম ফেলা রাস্তা। আকাশটাও আজ পরিষ্কার নয়। ঈশান কোণে কালো মেঘ জমে আছে। যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি দিচ্ছে। অয়ন নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছে। অন্য কোথাও গাড়ি নিয়ে গেলে ড্রাইভার সাথে থাকে। শুক্রবারে গ্রামের চেম্বারে আসার সময় অয়ন নিজেই ড্রাইভ করে। গ্রামের এই চেম্বারটা একটু গোপনে রাখতে চায়। তাই এখানে ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে আসে না। শনিবার গ্রামের বাড়িতে কাটায়। রোগীদের দেখভাল করে। চেম্বারে গ্রামের কিছু রোগী আসে, ওদের চেক আপ করে। রবিবার বিকেলে আবার শহরের বাড়িতে ফিরে আসে। গ্রামের রোগীরা খুব গরিব, তাই ওদের কাছ থেকে অয়ন খুব কম ফিস নেয়।
কিছুটা পথ যাওয়ার পরে অঝোরে বৃষ্টি শুরু হল, সাথে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের তীব্র ঝলকানি। গ্রামের রাস্তাতে এমনিতেই কোন আলো নেই, তারপর আবার বৃষ্টি। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাড়ির হেড লাইটে যতটুকু দেখা যায় তার বাইরে সামনে পেছনে কিছু দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানিতে সামনে কিছুটা দূর পর্যন্ত ক্ষণিকের জন্য দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির সামনের কাঁচে বৃষ্টির জল পড়ে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। উইনশীল্ড ওয়াইপারটা চালিয়ে দিল অয়ন। কাদাতে গাড়ির চাকা আটকে যেতে পারে, তাই আস্তে আস্তে সাবধানে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে যেতে থাকল।
হঠাৎ তীব্র গতিতে আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের একটা ঝিলিক খেলে গেল। সেই আলোতে দূরে এক মহিলাকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল অয়ন। এই বৃষ্টির রাতে মহিলা একা এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে কেন? কিছু বোঝার আগে একটু দূরে বাজ পড়ার তীব্র আওয়াজ। মেয়েটি ভয় পেয়ে কি যেন বলতে বলতে একেবারে গাড়ীর কাছে চলে এল। চিৎকার করে কিছু একটা বলতে চাইছে। জানালার কাঁচ সব বন্ধ, মেয়েটির কথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ইশারায় তাকে গাড়ির জানালার সামনে আসতে বলল অয়ন। জানালার কাঁচটি একটু নামিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল,
– এত রাতে একা এই রাস্তায় কেন?
– আমার সন্তানকে বাঁচান ডাক্তারবাবু, ওকে মারবেন না।
– তোমার সন্তান কোথায়?
– কেন! আপনার বাড়িতে! ওকে বাঁচতে দিন, ওকে মারবেন না।
– আমার বাড়িতে, অয়ন কিছুই বুঝতে পারছে না। কাকে মারতে বারণ করছে, কেনই বা বলছে, কিছুই পরিষ্কার নয়। অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটির মুখ ভালো করে দেখাও যাচ্ছে না। অয়ন গাড়ির ভেতরের লাইট টা জ্বালতেই মেয়েটি হাত দিয়ে মুখ ঢাকা দিল।
– হাতটা সরাও, ধমকে বলল অয়ন।
হাতটা সরাতেই মেয়েটির মুখ দেখে চমকে উঠল অয়ন। গত সপ্তাহে এই মেয়েটি ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে গ্রামের চেম্বারে এসেছিল। মেয়েটি প্রেগন্যান্ট ছিল। ওর বয়ফ্রেন্ড মেয়েটির গর্ভপাতের জন্য অয়নের চেম্বারে এসেছিল। মেয়েটি কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না। শেষে ছেলেটি প্রায় একপ্রকার জোর করেই রাজী করায়। নাহলে মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবার হুমকি দেয়। বাধ্য হয়ে মেয়েটি রাজী হয়। মেয়েটি যখন চেম্বারে আসে তখন অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। ভ্রূণটা তখন অনেক ম্যাচিওরড হয়ে গেছে। তাই অয়ন প্রথমে গর্ভপাত করাতে রাজি হয়নি। পরে অনেক চাপাচাপিতে ভালো অর্থের বিনিময়ে রাজি হয়।
মেয়েটি খুব কাঁদছিল, বারবার ছেলেটিকে অনুরোধ করছিল,
-আমাদের প্রথম সন্তান। এভাবে তাকে মেরে ফেলো না। আমরা দুজনে দূরে কোথাও গিয়ে থাকব। ওকে বাঁচতে দাও।
ছেলেটি ওর কথায় কর্ণপাত করেনি। উল্টে মেয়েটিকে শাসাতে থাকে।
-এত তাড়াতাড়ি আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমি এখনো নিজে সেটেলড্ হতে পারিনি। দূরে কোথাও গিয়ে আমি সংসার চালাব কি করে? বিয়ের কথা এখন বাড়ীতেও বলতে পারব না। আজকের দিনে অ্যাবোরশন্ এমন কি ব্যাপার! আমাদের সন্তান যে আর হবে না তা তো নয়। আর কিছুদিন অপেক্ষা করলে ভালোয় ভালোয় সব মিটে যাবে। কেন শুধু শুধু তর্ক করছ বুঝতে পারছি না। তুমি যদি এরকম জেদ ধর তাহলে আমাকে পাশে পাবে না। চিরদিনের মত আমাকে হারাবে।
অয়নের হাত ধরে মেয়েটি অনুরোধ করেছিল, “আমার সন্তানকে বাঁচান ডাক্তারবাবু।”
অয়ন কোন গুরুত্ব দেয়নি। এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। এগুলো অয়নের গা সওয়া হয়ে গিয়েছে।
কেসটা খুব ক্রিটিক্যাল ছিল। মেয়েটির সেন্স আসতে বেশ দেরী হয়েছিল। কিন্তু আজ এত রাতে একা এই রাস্তায় কি করছে! ওর তো অ্যাবোরশন্ হয়ে গেছে। এখন আবার এসব কি বলছে!
-তুমি কি যা তা বলছ, তোমার তো অ্যাবোরশন্ মানে গর্ভপাত হয়ে গেছে। আবার সন্তান বাঁচানোর কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলছ, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
-আমার সন্তান আপনার বাড়িতে আছে। ও এখনো বেঁচে আছে। ওরা মেরে ফেলতে চাইছে। আপনি বাঁচান ডাক্তারবাবু।
মেয়েটির অস্বাভাবিকতা দেখে অয়নের কেমন যেন সন্দেহ হল। মেয়েটির কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! ওর সন্তান অয়নের বাড়িতে আছে, কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলছে। রাস্তার মাঝে এই বৃষ্টিতে আর কথা না বাড়িয়ে অয়ন মেয়েটিকে গাড়িতে উঠতে বলল। অয়ন জানে চেম্বারে বিশু, সবিতা থাকবে। ওরা মেয়েটিকে নিশ্চয় চিনবে। ওদের সাথে আলোচনা করে একটা কিছু করা যাবে। এত রাতে মেয়েটিকে এভাবে রাস্তায় একা ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আপাতত সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলল,
– ঠিক আছে, তুমি স্থির হয়ে গাড়ীতে বস। আমি চেম্বারে যাচ্ছি। ওখানে গিয়ে তোমার সব কথা শুনব।
চেম্বারের সামনে এসে অয়ন দেখল, চারদিক অন্ধকার, কোন আলো জ্বলছে না। এত তাড়াতাড়ি সব লাইট নিভিয়ে বিশুরা কি ঘুমিয়ে পড়েছে! ওরা তো জানে অয়ন আজ রাতে আসবে। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে চেম্বারের কাছে ওইটুকু আসতেই ভিজে গেল অয়ন। কলিং বেলটা বাজাতেই উপরের ঘরের লাইটটা জ্বলে উঠল। বিশু তাড়াতাড়ি করে নেমে এসে দরজা খুলে দিল।
– কি ব্যাপার! তোরা কি সব ঘুমিয়ে পড়েছিস?
– আমরা ভেবেছি এই বৃষ্টির রাতে আপনি আর আসবেন না। কাল ভোরে আসবেন। তাই সব লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিলাম। এই বৃষ্টিতে এই রাস্তা দিয়ে কি করে এলেন ডাক্তারবাবু?
– সে কথা পরে হবে। আগের সপ্তাহে যাদের অপারেশন হয়েছিল তাদের মধ্যে একটি মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমি গাড়িতে তুলে নিয়েছিলাম। একটু নামিয়ে নিয়ে এস। ও কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলছিল, আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। ওসব পরে দেখা যাবে। একটা ছাতা নিয়ে যাও।
অয়ন ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। বিশু ছাতা নিয়ে গাড়ির কাছে গেল। পেছনের দরজা খুলে দেখে ভেতরে কেউ নেই।
– গাড়িতে তো কেউ নেই ডাক্তারবাবু, বিশু চেঁচিয়ে উঠল।
– কেউ নেই মানে! আমি নিজে গাড়িতে তুলেছি। ভালো করে দেখ, নেমে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে কি না!
বিশু টর্চ জ্বেলে বাড়ির চারদিক দেখে নিল। কোথাও কেউ নেই।
– না, ডাক্তারবাবু কেউ নেই।
– সে কি রে! এত রাতে কোথায় চলে গেল? আমি বললাম, চেম্বারে চল, তোমার সব কথা শুনব। ও উঠে গাড়িতে বসল। আমার সাথে এতটা রাস্তা এল, আর তুই বলছিস গাড়িতে কেউ নেই! বাড়ির আশেপাশেও কেউ নেই! মেয়েটি কি উধাও হয়ে গেল! আমি তো তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
অয়ন ছুটে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল। নিজে গাড়ির ভেতরটা ভালো করে দেখল। কিছুতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। পেছনের এই সীটেই তো মেয়েটা বসেছিল। মনটা কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। বিশুকে সাথে নিয়ে আর একবার বাড়ির চারপাশটা দেখে নিল। না, কোথাও তো নেই। বাড়িতে ফিরে এল। মাথার মধ্যে কত কি ঘুরপাক খেতে থাকল।
-মেয়েটা কেমন দেখতে ছিল ডাক্তারবাবু? হঠাৎ বিশুর প্রশ্নে সম্বিত ফিরে এল।
অয়ন আজ মেয়েটাকে যেরকম দেখেছে তার একটা রূপরেখা বিশুকে দেওয়ার চেষ্টা করল। মেয়েটির সাথে ওর বয়ফ্রেন্ডের কথা কাটাকাটির কথা বলতেই বিশু বলল, “বুঝতে পেরেছি ডাক্তারবাবু, আপনি কোন মেয়েটির কথা বলছেন, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ুন। আপনার আজ অনেক পরিশ্রম হয়েছে। অত চিন্তা করবেন না। আমি কাল খোঁজ নিয়ে আপনাকে সব জানাবো।”
অয়নের মনের ভেতরটা খচখচ করতে থাকল। নিজে যে মেয়েটাকে গাড়িতে তুলল, এই বৃষ্টির রাতে সে কোথায় উধাও হয়ে গেল। যদিও ভূত প্রেতে অয়নের বিশ্বাস নেই। তবু মনে কেমন যেন একটা ভয় চেপে ধরল। বিশুকে ডেকে বলল,
-বিশু, তুই আজ আমার ঘরে মেঝেতে শুয়ে পড়। আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে।
অয়নের কথা শুনে বিশু হেসে ফেলল।
-আপনার কিসের ভয় ডাক্তারবাবু, আমি তো পাশের ঘরেই আছি। প্রয়োজন হলে ডেকে নেবেন। আপনাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। আপনি শুয়ে পড়ুন। ওত চিন্তা করবেন না।
এখানে সবিতা সব রান্নাবান্না করে। বিশু বাজার করে এনে দেয়। গড়ে তিন চারজনের অপারেশন থাকে, তাদের দু একজন আত্মীয় থাকে, সবে মিলে প্রতি সপ্তাহে এই দুদিনে প্রতি বেলায় প্রায় দশজনের জন্য রান্না করতে হয়। সবিতা হাসিমুখে এই কাজগুলো করে থাকে। রাতে অয়ন ভাত খায় না, কয়েকজন রোগীও ভাত খেতে চায় না তাই আলাদা করে রুটির ব্যবস্থা করতে হয়। অয়ন রুটি তরকারী খেয়ে শুতে চলে গেল। দরজার ছিটকিনিটা চেপে বন্ধ করে দিল, জানালাগুলো সব বন্ধ করে দিল। বাইরে তখনোও বৃষ্টি পড়ছে। নাইট ল্যাম্পটা জ্বেলে একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুমটা সবে ধরেছে, হঠাৎ বাইরে থেকে একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে এল। প্রথম অয়ন ভাবল, কিছু ভুল শুনছে। তাই ভালো করে কান পেতে আবার শোনার চেষ্টা করল। এবারে স্পষ্ট কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল। অয়ন আলতো করে জানালা খুলে বাইরে তাকাতে দেখল, সেই মেয়েটি, কোলে একটা ছোট মত কিছু ধরে আছে। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে সেই একই কথা বলছে, “আমার সন্তানকে বাঁচান ডাক্তারবাবু, ওকে মারবেন না।” অয়ন ভয় পেয়ে গেল, ছুটে গিয়ে দরজা খুলে বিশুকে ডাকতে লাগল। বিশু হন্তদন্ত হয়ে বাইরে আসতেই অয়ন তাকে জড়িয়ে ধরল।
-বিশু, সেই মেয়েটা, বাড়ির নীচে বাগানে বসে কাঁদছে। তুই তাড়াতাড়ি আমার সাথে আয়।
বিশু ঘরের ভেতর থেকে টর্চটা হাতে নিয়ে অয়নের ঘরে জানালার কাছে ছুটে গেল। টর্চ জ্বেলে উপর থেকে ভালো করে দেখল। কোথাও কেউ নেই। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
-বাইরে কেউ নেই ডাক্তারবাবু। আপনি ঘুমের মধ্যে ভুল কিছু শুনেছেন।
-না না আমি স্পষ্ট কান্নার আওয়াজ পেয়েছি। তুই ভালো করে নীচে গিয়ে দেখে আয়।
অগত্যা বিশু ছাতা মাথায় দিয়ে টর্চ নিয়ে বাইরে বেরোল। বাড়ীর চারদিক ঘুরে দেখে ফিরে এল। কেউ কোথাও নেই।
-বাইরে কেউ নেই ডাক্তারবাবু। জানালা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ুন।
-তুই এই ঘরে আজ থাক বিশু। আমার বেশ ভয় করছে।
-ঠিক আছে, আপনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ুন। আমি ভোরে আপনাকে ডেকে দেব। কাল তিনটে অপারেশন আছে। আমি এক্ষুণি আসছি।
বিশু পাশের ঘর থেকে বালিশ আর একটা পাতলা চাদর নিয়ে এল। মেঝেতে চাদর পেতে অয়নের ঘরে শুয়ে পড়ল। ভোরে উঠে দেখল অয়ন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। অপারেশন আছে, তাই বাধ্য হয়ে বিশু অয়নের ঘুম ভাঙাল।
তিনটে অপারেশন করতে একটু দেরী হয়ে হল। আজ অয়ন অপারেশনের কাজে সেভাবে মনোযোগ দিতে পারেনি। অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে বিশুকে বলল, “তুই একবার বেরিয়ে ওই মেয়েটির ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি, কাল থেকে আমি খুব চিন্তায় আছি।”
বিশু সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে একটি ছেলেকে সাথে করে ফিরে এল। ছেলেটি ছুটে এসে অয়নের পা দুটি ধরে কাঁদতে শুরু করল।
অয়ন ছেলেটিকে দেখেই চিনতে পারল, জিগ্যেস করল, “তোমাদের কি ব্যাপার বল তো? আমি কাল রাতে মেয়েটিকে একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, আমার গাড়ীতে তুললাম, এখানে এসে দেখি উধাও। তারপর রাতে বাড়ির নীচে ওকে বসে কাঁদতে দেখলাম। অথচ বিশু বলছে, ওখানেও কেউ ছিল না। আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। তুমি কি কিছু জান?
ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, “সে কথা জানাতেই আমি ছুটে এসেছি ডাক্তারবাবু। অপারেশনের পর ওর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। তার উপর সব সময় কাঁদছিল। একটাই কথা, আমার সন্তানকে তোমরা মেরে ফেলেছ। কোন কথাই শুনছিল না। দুদিন মুখে কিছু তুলেনি। গতকাল রাতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। থানা থেকে বডি পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়েছে। আমি খুব ভুল করেছি ডাক্তারবাবু। আমার সব শেষ হয়ে গেল।”
অয়ন যেন আকাশ থেকে পড়ল। ও তাহলে গতকাল রাতে কি দেখল! বেশী কথা বাড়ালো না। পুলিশী কেসে জড়ালে খুব অসুবিধায় পড়তে হবে। তাই তাড়াতাড়ি ছেলেটিকে বিদায় করতে হবে। ওর মাথায় হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
-দেখ, এতো তোমাদের সিদ্ধান্ত, আমার কিছু করার নেই। সমাজে লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে তোমরা আমার কাছে এসেছিলে। আমি আমার পক্ষে যতটা সম্ভব তোমাদের সাহায্য করেছি। এখন এ ব্যাপারটা চেপে যাও। নাহলে পুলিশী কেসে কোথায় ফেঁসে যাবে তার ঠিক নেই। তুমি ওদিকটা সামলানোর চেষ্টা কর। তাতে পুলিশ কে কিছু ঘুষ দিতে হলে দিও। গর্ভপাতের ব্যাপারটা সামনে এলে তোমার ক্ষতি হয়ে যাবে। তুমি গ্রেপ্তার হতে পারো। তাই ব্যাপারটি মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কর।
অয়নের কথা শুনে ছেলেটি খুব ভয় পেয়ে গেল। হাত জোড় করে অয়নকে বলল, “যদি এখানে পুলিশ আসে আপনি কিছু বলবেন না ডাক্তারবাবু। আমি ওদিকটা সামলানোর চেষ্টা করছি।” এই বলে ছেলেটি দ্রুত বেরিয়ে গেল।
ছেলেটিকে তো ম্যানেজ করা গেল। পুলিশ এখানে এলে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা যাবে। কিন্তু কাল রাতে অয়ন তাহলে কি দেখল! মেয়েটি কাল রাতে সুইসাইড করেছে। তার মানে অয়ন মেয়েটির অশরীরী আত্মাকে দেখেছে। এসব আবার আছে নাকি! এবার অয়ন সত্যিই ভয় পেল।
বিশুকে ডেকে বলে দিল, “শরীরটা ভালো নেই। আজ কোন রোগী দেখতে পারব না। যারা অপেক্ষা করছে, ওদের চলে যেতে বল।”
আজ দুপুরের খাওয়ার পরে বিশু ও সবিতাকে নিজের ঘরে আসার কথা বলে চেয়ারে শরীরটাকে এলিয়ে দিল।
দুপুরে বিশু ও সবিতাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজার ছিটকিনি বন্ধ করে দিল অয়ন। গতকাল রাতের ঘটনা থেকে আজ সকালে ছেলেটির সাথে যা কথা হয়েছে, সব ওদের জানাল। ওদেরকে অনুরোধ করল, যাতে ওরা এ ব্যাপারে কারো কাছে কোন কথা না বলে। কাল অয়ন চলে গেলে ওরা চেম্বার ভালো করে বন্ধ করে যেন ওদের বাড়ি যায়। পরের সপ্তাহে চেম্বার বন্ধ থাকবে।
বিকেলের দিকে ছাদে পায়চারি করছিল অয়ন। মনটা ভালো নেই। মেয়েটির অসহায় মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। অনেকদিন পর এ বাড়ির ছাদে উঠল অয়ন। ছাদ থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। একবার ঝুঁকে বাগানের দিকে তাকাল। কাল মেয়েটাকে ওখানে বসে কাঁদতে দেখেছে অয়ন। হতে পারে কোন অশরীরী আত্মা। কিন্তু অয়ন কাল ঠিক ওখানেই মেয়েটিকে দেখেছে। কাছাকাছি কোন বাড়ি নেই। একটু দূরে কয়েকটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। চারদিকে সবুজ ধানের ক্ষেত। কেমন যেন একটা নির্জন পরিবেশ। অনেক ভেবে চিন্তেই অয়ন এ জায়গাটা বেছেছিল। এখানে অয়ন যে কাজটা করে সেটা মোটেও ভালো কাজ নয়। সেটা অয়ন ভালোই জানে। তবে এটাও ঠিক, অয়ন না করলে অন্য কেউ এ কাজটা করত। টাকাটা একটা ফ্যাক্টর। কিন্তু টাকাটাই কি জীবনের সব! এটা না থাকলে এতটা লাক্সারিয়াস লাইফ হয়ত হত না। তবে এখন শহরের চেম্বার থেকে, আর দু একটা অপারেশন থেকে যা ইনকাম হয় তাতে হেসেখেলে জীবন কেটে যায়। তাহলে কেন এই টাকার পেছনে মিথ্যে ছোটা! কেন এই পাপ কাজ করা!
এরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে খেয়াল নেই। অয়ন নীচে নেমে এল। সবিতা ততক্ষণে টিফিন রেডি করে ফেলেছে। অয়ন টিফিন খেয়ে খবরের কাগজটা নিয়ে বসল। কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ক্লান্তিতে চোখ বুজে এল। বিশুর ডাকে ঘুম ভাঙল।
-ডাক্তারবাবুর শরীরটা সত্যিই ভালো নেই মনে হচ্ছে। নাহলে আপনাকে কখনো এই সময়ে ঘুমোতে দেখিনি। উঠে পড়ুন, হাত মুখ ধুয়ে নিন। রাতের খাবার রেডি। খেয়েদেয়ে আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল থেকে যা ধকল আপনার শরীরের উপর দিয়ে যাচ্ছে।
আলমোড়া ভেঙে চেয়ার থেকে উঠল অয়ন। ঘুমটা হয়ে ভালোই হয়েছে। শরীরটা বেশ হাল্কা লাগছে। হাত মুখ ধুয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিল। যাক আজ একটু নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাবে।
আজ আকাশটা পরিষ্কার। কাল বৃষ্টি হওয়ার জন্য একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব আছে। আজ ঘুমটা বেশ ভালোই হবে। চাদরটাকে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ল। রাত বেশ গভীর তখন, হঠাৎ কান্নার শব্দ। ভালো করে শোনার চেষ্টা করল অয়ন। ঠিক শুনছে, কালকের মত কে একজন কাঁদছে। সাহস নিয়ে অয়ন জানালা খুলে নীচের দিকে তাকাল। সেই মেয়েটা, কোলে পোঁটলার মত ছোট একটা জিনিস ধরে আছে। আগের দিনের মত একই কথা বলছে, “আমার সন্তানকে বাঁচান ডাক্তারবাবু, ওকে মারবেন না।”
অয়ন চেঁচিয়ে উঠল, “কে ওখানে?,” কোন কথা নেই, একই ভাবে কেঁদে চলেছে। বারবার দু তিনবার অয়ন চেঁচিয়ে বলল, কিন্তু কোন উত্তর পেল না। অয়ন এবার ভয় পেয়ে গেল, বিশুকে ডাকবে বলে যেই ঘুরেছে, কান্নার আওয়াজ তখন জোরে শোনা গেল। এবার যেন একজন নয়, অনেকে কাঁদছে বলে মনে হল। অয়ন জানালা দিয়ে নীচে তাকাতেই এক ভয়ানক দৃশ্য দেখতে পেল। মেয়েটি একা নয়, তার চারপাশে বেশ কয়েকটি শিশু একসাথে কাঁদছে। তাদের কান্নার বিচিত্র শব্দে অয়নের কান ঝালাপালা হয়ে গেল। অয়নের হাত পা কাঁপতে শুরু করল, মাথা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। চেঁচিয়ে বিশুকে ডাকতে চেষ্টা করল, গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোচ্ছে না। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। একটু জল খাবে অয়ন, কিন্তু বলতে পারছে না। গলা দু হাতে চেপে ধরল অয়ন। আস্তে আস্তে চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল।
যখন জ্ঞান ফিরল, তখন অয়ন শহরের এক নার্সিং হোমের বেডে শুয়ে আছে। অয়নের স্ত্রী মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পাশে বিশু ও সবিতা শুকনো মুখে বসে আছে। অয়ন চোখ খুলতেই বিশু চিৎকার করে উঠল, “ডাক্তারবাবুর জ্ঞান ফিরেছে, কাল কি হয়েছিল ডাক্তারবাবু? আপনি কাল রাতে অতজোরে চেঁচালেন কেন? কিছু কি দেখেছিলেন?।” একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগল বিশু। অয়ন ইশারায় তাকে থামতে বলে আস্তে করে উঠে বসল। একটু জল খেতে চাইল। খানিকক্ষণ চোখ বুজে বসে কালকের রাতের ঘটনা বলতে শুরু করল।
শেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্ত্রীর হাত ধরে বলল, “আমি ডাক্তার, ভুত প্রেতে বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু এই দুদিনে যা যা দেখলাম, তাতে আমার বিশ্বাস চলে গেছে। আমি অনেক পাপ করেছি, টাকার মোহে অনেক ভুল করেছি। আর নয়, আমি গ্রামের ওই বাড়িতে আর যাব না। এই পাপ কাজ আর করব না।”
অয়নের স্ত্রী সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “তুমি এত চিন্তা কোরো না, একটু সুস্থ হয়ে উঠ, তারপর ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবে। তোমার মন যা চায় তাই কোরো।”
অয়ন বিশুর দিকে তাকিয়ে বলল, “জানি, তোদের কাছেও আমি পাপী, তোদেরকে বাধ্য করেছি আমার পাপ কাজে সাহায্য করতে, আমাকে তোরা ক্ষমা করে দে।”
বিশু ডাক্তারবাবুর হাতটা ধরে কেঁদে ফেলল, “এভাবে বলবেন না ডাক্তারবাবু, আপনার জন্যই আমরা আজ বেঁচে আছি, আপনি আমাদের কাছে ভগবান।”
অয়ন বিশুর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “না রে বিশু, আমার মত পাপী কখনো ভগবান হতে পারে না। আজ আমি বুঝতে পারছি আমি কত শিশুকে অবলীলায় হত্যা করেছি। ওই মেয়েটি আমার চোখ খুলে দিয়েছে, তা সে অশরীরী আত্মাই হোক বা পেত্নী। আমি জানি না কিভাবে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব। যা হবার হয়ে গেছে, আর নয়। তোরা ওই বাড়িটা নিয়ে কি করবি দেখ। আমি তোদেরকে ওই বাড়িটা দিয়ে দিলাম। অয়নের দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।